Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

ফেরা

Spread the love

অধ্যায় ১: ফিরে আসা

ট্রেনটা যখন শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকল, তখন ঘড়িতে সকাল আটটা কুড়ি। জানলার বাইরে শহরটা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে—ছোট ছোট চায়ের দোকান, ব্যস্ত হকার, হর্ন বাজানো ট্যাক্সির ভিড় আর মানুষের ছুটে চলা। অনুরাধা জানলার পাশে বসে ছিল নিঃশব্দে, কাঁধে একটি বাদামী চামড়ার ব্যাগ, চোখে পুরনো শহরটার টুকরো টুকরো ছবি। ট্রেনের গতি কমতে কমতে থেমে গেল, আর ঠিক তখনই যেন সময় থমকে দাঁড়াল তার কাছে। বিয়ের পঁচিশ বছর পর সে এই শহরে ফিরে এসেছে—যে শহর একদিন ছিল তার নিজের, আর এখন যেন একটু দূরের, অচেনা। মাথার মধ্যে কুয়াশার মতো ভেসে উঠছে সেই সব সকাল, যখন সে কলেজ শেষে মঞ্চে যেত রিহার্সাল করতে; সেই পুরনো রাস্তা, থিয়েটারের গন্ধ, কাঠের পাটাতনের শব্দ, আর মেকআপ রুমের আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি। তখন সে ছিল অনুরাধা সেন—একজন স্বপ্ন দেখা মেয়ে। আজ সে অনুরাধা চ্যাটার্জি—এক প্রাক্তন গৃহবধূ, যিনি নিউ জার্সির এক শহরতলিতে কাটিয়ে এসেছেন জীবনের বড় একটা অংশ। সে জানে না, শহর তাকে চিনবে কিনা, কিংবা সে চিনতে পারবে কিনা তার ফেলে আসা জীবনকে। কিন্তু আজ আর ফেরার পথ নেই।

স্টেশনের বাইরে বেরিয়েই প্রথম ধাক্কা খায় সে। ভিড়, শব্দ, নতুন করে গড়ে ওঠা ফ্লাইওভার, দোকানের নাম বদলে গেছে, রিকশার বদলে অ্যাপ ক্যাব, আর চারপাশের মুখগুলো যেন আর কোনো গল্প বলে না। সে যেন একটা নোস্টালজিয়ার আবরণে মোড়া, অথচ সেই নোস্টালজিয়ারও নতুন মুখ গজিয়েছে। অনুরাধা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পূর্বপাড়ার দিকে—যেখানে সে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। তিরিশ বছর আগে এই একই রাস্তায় সে আচার্য ইনস্টিটিউটে নাট্যচর্চা করত, আর আজ, ফিরে এসেছে এক নতুন ভূমিকা নিতে—এইবার সে দর্শক নয়, অভিনেত্রী হতে চায় নিজের জীবনের। বাড়িটা তিনতলার পুরনো ফ্ল্যাট, জানালা দিয়ে একটা পাম গাছের মাথা দেখা যায় আর দূরে ট্রামের ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। অনুরাধা চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলে, ধুলো জমা ঘর, খালি দেয়াল, অথচ তবুও তার মনে হয় এখানে সে একটু একটু করে নিজেকে আবার গড়ে নিতে পারবে। সে ব্যাগ নামিয়ে বিছানার কোণে বসে পড়ে—এক হাতে ছুঁয়ে দেখে নিজের মুখ, নিজের চুল, যেখানে আগের মতো আর নেই সেই আগুনে প্রাণ। তবু কোথাও ভেতরে একটা আলো জ্বলে ওঠে—এই ঘর, এই শহর, এই একাকীত্ব—সব যেন একসাথে মিলিয়ে একটা নতুন নাটকের সূচনা।

সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে যখন সে এক কাপ চা খায়, তখন আকাশে নরম হলুদ আলো। শহরের শব্দ তার চারপাশে ঢেউয়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর সে ভাবছে—এই শহর তাকে কি আবার মেনে নেবে? কিংবা সে কি পারবে নিজেকে ফিরে পেতে? পাশের ফ্ল্যাট থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসে—“যাবি যদি যাবি রে… চলে যা”—কী আশ্চর্যভাবে মিলে যায় এই গানের কথা তার মনে চলা অনুভবের সঙ্গে। অনুরাধা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে খুঁজে বের করবে সেই থিয়েটার গ্রুপটা, যে তাকে একসময় সাহস জুগিয়েছিল, আর খুঁজে পাবে সেই মানুষগুলো যারা তার ভেতরের শিল্পী সত্তাকে চিনেছিল। তার এই ফিরে আসা শুধু শহরে নয়, ফিরে আসা তার নিজের ভেতরের আলোয়। দীর্ঘ সংসারজীবনের পর, যখন সে একা হয়ে উঠেছে মা হিসেবেও, স্ত্রী হিসেবেও, তখন সে চাইছে একজন মানুষ হয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এই যাত্রার শুরু আজ, এই সন্ধ্যায়, এই চায়ের কাপে, এই পুরনো শহরের নতুন গন্ধে। অনুরাধা জানে না কী অপেক্ষা করছে সামনে, কিন্তু সে প্রস্তুত—এই প্রথম সত্যিকারের নিজেকে নিয়ে এক অভিনয়ে নামছে সে, যেখানে কেবল স্ক্রিপ্ট লেখে জীবন।

অধ্যায় ২: পুরনো বাড়ি, নতুন স্মৃতি

পূর্বপাড়ার এই ফ্ল্যাটটি যে কতকিছু জাগিয়ে তুলবে, সেটা অনুরাধা জানত না। পরদিন সকালে জানালার ধারে বসে রোদে শুকোতে থাকা ছাদগুলো, দূরের বাসন্তী রঙের বাড়িগুলো, আর গলির চা-ওয়ালার আওয়াজে সে যেন হঠাৎ আটকে পড়ে বহু বছর আগের এক সকালে। ঠিক এই সময়েই তো সে তখন বাইকাসের স্কুল ইউনিফর্ম খুলে ছুটে যেত থিয়েটার রিহার্সালে। অল্প পকেটমানি, আর অনেকখানি স্বপ্ন নিয়ে সে গিয়েছিল আচার্য ইনস্টিটিউটের প্রথম অডিশনে। তখন আর্চি দিদি তাকে দেখে বলেছিলেন, “তোর চোখে আগুন আছে অনু, তবে তা জ্বালিয়ে রাখতে শিখতে হবে।” সেই আগুন কি এখন নিভে গেছে? বারান্দার চেয়ারে বসে অনুরাধা সেই পুরনো মুহূর্তগুলোকে স্পর্শ করে, মনে পড়ে অঞ্জনদা, যে রিহার্সালের মাঝে গেয়ে উঠত “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”, আর পার্থ, যে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলত, “তুই পারবি রে।” কত সহজে সে সেই জীবন ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ভেবেছিল পরে সময় হবে—কিন্তু সময় তো আর অপেক্ষা করে না। আজ এত বছর পর, সেই ফেলে আসা জীবনকেই আবার ছুঁতে চাওয়ার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে তার মনে। কিন্তু সেই অপরাধবোধকে সরিয়ে রেখে সে উঠে দাঁড়ায়, আলমারির নিচ থেকে বের করে একটা পুরনো কার্ডবোর্ডের বাক্স—যেটা তার সঙ্গে এসেছে নিউ জার্সি থেকে, বছর বছর ধুলো খাওয়া, কিন্তু না ফেলা। বাক্স খুলতেই বেরিয়ে আসে পুরনো স্ক্রিপ্ট, কিছু ছবি, আর একটা চিঠি—হাতের লেখা একটু কাঁপা, কিন্তু স্পষ্ট—আর্চনা দত্ত।

চিঠিটার কাগজ এখন একটু মলিন, কিনারা হলুদ হয়ে গেছে, তবুও লেখার মধ্যে যে স্পষ্ট আবেগ, সেটা আজও তাজা। “অনু, তুই চলে গেলি বলে কিছু বলতে পারলাম না, কিন্তু থামিস না কখনো—তোর ভিতরে যা আছে, সেটা অন্যরকম। মঞ্চ একদিন তোকে খুঁজবে, আমি জানি।” এই চিঠিটা অনুরাধা অনেকবার পড়েছে জীবনে, বিশেষ করে যখন সবকিছু হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করত—তখন। কিন্তু তারপরও সে ফিরে আসতে পারেনি। সংসার, সন্তানের স্কুল, রজতের চাকরি বদল, নতুন শহর, আরেকটা দেশ—সব যেন তাকে তার সত্তা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়েছিল। এখন, সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে, সে ভাবে—তবে কি আবার দেখা হবে আর্চনা দিদির সঙ্গে? ইন্টারনেটে সার্চ করে সে পায়, “অরুণোদয় থিয়েটার ওয়ার্কশপ”—আর্চনা দত্ত, পরিচালক। ঠিকানা দেখে বোঝা যায় খুব বেশি দূরে নয়—হাতিবাগানের কাছাকাছি। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত ধুকপুকানি শুরু হয়, এতদিন পর মুখোমুখি হওয়ার ভয়, আবার প্রত্যাশাও। কী বলবে দিদিকে? কী করে ব্যাখ্যা দেবে এত বছরের অনুপস্থিতি? কিন্তু সে জানে, আর দেরি করলে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। সে ফোন তোলে, নম্বরটা ডায়াল করে, রিং হয়, তারপর একটা ভারী কিন্তু নরম গলা—“হ্যালো? অরুণোদয় থিয়েটার।” অনুরাধা কিছু বলতে পারছিল না, গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। তারপর একটানা বলে ওঠে, “দিদি… আমি অনুরাধা সেন… আপনি চেনেন আমাকে… অনেক বছর আগে…”—আর ওপাশে নিঃশব্দ কিছুক্ষণ, তারপর সেই গলা একটু কেঁপে ওঠে, “অনু? তুই? তোকে তো অনেকদিন ধরে খুঁজছি… কোথায় ছিলি এতদিন?”

সেই একটিমাত্র বাক্যে যেন অনুরাধা ফিরে পায় তার আত্মপরিচয়ের স্পর্শ। ‘তোকে খুঁজছি’—এই ছোট্ট শব্দগুচ্ছ এতদিন পরে এসেও যেন তার ভেতরের রুদ্ধ কান্নাটাকে মুক্ত করে দেয়। দুজনে কথা বলে আরও কিছুক্ষণ, আর ঠিক হয়, পরের দিন বিকেলে সে যাবে ওয়ার্কশপে। ফোন রেখে সে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়, রোদটা তখন একটু ঢলে পড়েছে, একটা ট্রামের ধাতব শব্দ কানে বাজে—ঠিক যেমন বাজত তার স্কুলফেরত বিকেলগুলোয়। শহরটা হয়তো বদলে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু ধ্বনি, কিছু আলো, কিছু গন্ধ—তাকে এখনো মনে করিয়ে দেয় যে সে এখানেই তৈরি হয়েছিল, গড়া হয়েছিল এক শিল্পী হওয়ার জন্য। এবং আজ এত বছর পর, সেই শিল্পীই আবার তার হাত ধরে হাঁটতে চাইছে নতুন পথে। অনুরাধা গভীর নিঃশ্বাস নেয়, মনে মনে বলে, “এবার আমি পালাব না।” সেই রাতে খেতে বসে একা একা যখন সে রুটি ভাজে, তখন মনে হয়, এই একাকীত্বটা আর একা নয়। এতে আশার আলো আছে, একটি শুরু আছে, একটা সম্ভাবনা আছে। তার ফেরা শুধু শহরে নয়, ফেরা নিজের শিকড়ে—সেই জায়গায়, যেখানে সে সত্যিই নিজেকে অনুভব করতে পারত।

অধ্যায় ৩: আর্চি দিদির চিঠি

পরদিন বিকেলবেলা অনুরাধা একখানা পাতলা সুতির শাড়ি পরে ওয়ার্কশপে পৌঁছয়। হাতে ছোট একটি খাতা, ভেতরে পুরনো কিছু কবিতা আর তার নিজের লেখা কিছু ডায়েরির অংশ—এগুলো সে কাউকে দেখায়নি এতদিন। অরুণোদয় থিয়েটারের ঘরটা পুরনো, ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তার মনে হয়, এই পথটাই যেন তার সময়ের উল্টো স্রোতে যাওয়ার রাস্তা। একদা যেখানে তরুণ শিল্পীরা জমা হতো নানা স্বপ্ন নিয়ে, সেখানে আজ বয়সের ভারে ধরা পড়া চেয়ার, অল্প আলোয় ঝুলে থাকা পোস্টার আর ধুলোয় ঢেকে থাকা প্রাচীন নাটকের স্মৃতি। আর্চনা দত্ত, যিনি ‘আর্চি দিদি’ নামে পরিচিত, এক কোণে বসে নতুন ছাত্রদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। মুখে সেই একই কড়া অথচ মায়াবী ভাব, চোখে ধুলো রঙা চশমা, আর গলার স্বর আজও একই রকম ছন্দময়। অনুরাধা দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, দেখছিল সেই দৃশ্য। হঠাৎ আর্চনা দিদির চোখে পড়ে সে—“অনু!” বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, “এই তো, আমি জানতাম তুই ফিরবি একদিন।” দুজনের চোখে জল, কিন্তু কেউই কাঁদল না—সময় অনেক কেড়ে নিয়েছে, আর এখন সময় নতুন কিছু নির্মাণের। তারা বসল, কুশল বিনিময়ের পর দিদি অনুরাধার হাতে দিলেন একটা খাম—একটা পুরনো চিঠি, যা তিনি বছর দশেক আগে লিখেছিলেন, কিন্তু পাঠাতে পারেননি। চিঠিটা খুলতেই অনুরাধার গলা শুকিয়ে আসে। তাতে লেখা ছিল: “যদি কখনো ফিরে আসিস, জানিস, মঞ্চটা তোকে আজও ডাকে। আমি আজও সেই আগুন খুঁজে বেড়াই চোখে, যেটা একদিন তোর মধ্যে দেখেছিলাম।”

চিঠির প্রতিটি লাইনে এক অদ্ভুত ব্যথা আর ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল। অনুরাধা যেন একেকটা শব্দ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলল নিজেরই অতীতের দিকে। “তোর চলে যাওয়াটা আমার কাছে হঠাৎ বিদ্যুৎপাতে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ছিল”—এই লাইনটা পড়ে সে স্থির থাকতে পারল না, মাথা নামিয়ে রাখল膝ের ওপর। এতদিন পর সেই স্বীকৃতি, সেই আদর, সেই অধিকারবোধ যেন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। আর্চি দিদি তার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, “তুই এখনও পারবি। শুধু সাহসটা জোগাড় করতে হবে।” তারপর অনুরাধাকে নিয়ে গেলেন রিহার্সালের মধ্যে। চারপাশে এখনকার তরুণ-তরুণী, কেউ কলেজ পড়ুয়া, কেউ সদ্য চাকরিজীবী—তারা কেউ জানে না অনুরাধার অতীত, তার সেই ক্ষণিকের জ্যোতির অভিজ্ঞতা। আর্চনা দিদি বললেন, “আজকে অনুরাধা একটা কবিতা পড়ে শোনাবে। মন দিয়ে শোনো, ওর অভিজ্ঞতা তোমাদের শিখতে সাহায্য করবে।” অনুরাধার মুখ লাল হয়ে গেল, হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে জানত, এবার পেছনে যাওয়ার পথ নেই। সে খাতা খুলল, আর পড়তে শুরু করল: “আমি একদিন নিজেকে হারিয়েছিলাম, এই শহরের এক কোণায়… আবার খুঁজে পেয়েছি সেই ছায়া, যাকে আমি বলি ‘আমি’…” পড়তে পড়তে সে যেন নিজেকেই ফিরে পায়, আবার শব্দের ভেতর দিয়ে সে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে।

রিহার্সালের পরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী এসে তার সঙ্গে কথা বলে। তারা বলে, “দিদি, আপনি এত গভীর করে পড়েন কীভাবে?” কেউ কেউ বলে, “আপনার চোখে একটা গল্প আছে।” এই প্রশংসাগুলো শুনে সে প্রথমে অবাক হয়, তারপর একটানা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে। পথের ধারে ফুলওয়ালার দোকানে ছোট্ট টগর ফুলের মালা কিনে নেয়, নিজের জানালার পাশে রাখবে বলে। মাথার ভিতর শুধু বাজতে থাকে চিঠির সেই লাইন—”মঞ্চ তোকে আজও ডাকে।” সেই ডাক, সেই কণ্ঠ আজ অনেক দিনের পরিচিত কিন্তু অনেকদিন পর ফিরে আসা। সেই রাতে অনুরাধা ঘুমাতে পারছিল না। সে জানালার পাশে বসে থাকে অনেকক্ষণ, পাখার আওয়াজ, দূরের কুকুরের ডাক, পাশের ফ্ল্যাটে টিভির মৃদু শব্দ—সব মিলিয়ে সে বুঝে যায়, এখন তার জীবনের নতুন একটি রিহার্সাল শুরু হয়েছে। আর এইবার, সে তার স্ক্রিপ্ট নিজেই লিখবে।

অধ্যায় ৪: প্রথম মঞ্চে ফেরার লড়াই

পরের কয়েকটা দিন যেন এক অদৃশ্য সময়ের স্রোতে ভেসে যায় অনুরাধার জীবনে। প্রতিদিন বিকেলে সে ওয়ার্কশপে যায়, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। প্রতিদিনের রিহার্সাল, গলার ব্যায়াম, স্ক্রিপ্ট পড়া—সব যেন নতুন আর পুরনোর এক মিশ্র অভিজ্ঞতা। অথচ শরীরটা আর আগের মতো সাড়া দেয় না। হাঁপ ধরে, গলা শুকিয়ে আসে, চোখে ঝাপসা পড়ে যায় মাঝে মাঝে। একদিন ডায়লগ বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় সে, ভুলে যায় লাইন, তারপর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। চারপাশে থাকা কিশোর কিশোরীরা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কেউ কিছু বলে না। আর্চনা দিদি এগিয়ে এসে শুধু বলেন, “তোকে আবার শুরু করতে হবে ভিতর থেকে, বাইরে থেকে নয়।” এই কথাটার মধ্যে একটা তীব্র সত্য ছিল। অনুরাধা বুঝে যায়, তাকে শুধু নাটক শেখার নয়, নিজের ভিতরের সেই ভয়, সংশয়, অপরাধবোধ—এসবকেও জয় করতে হবে। বাড়ি ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, নিজের চোখের দিকে তাকায়—সেখানে ক্লান্তি আছে, কিন্তু এক ধরণের স্থিরতা ও জন্ম নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

একদিন আর্চি দিদি ঘোষণা করেন, তারা একটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছেন—চরিত্রভিত্তিক নাটক, যেখানে প্রত্যেক অভিনেতার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্র গঠিত হবে। এইবার অনুরাধার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের দায়িত্ব পড়ে—এক মধ্যবয়সী নারী, যিনি নিজের জীবনের ভুল স্বীকার করে নতুন করে বাঁচতে শেখে। চরিত্রটি শুনেই অনুরাধার গায়ে কাঁটা দেয়—এ যেন নিজেরই প্রতিচ্ছবি। প্রথমদিকে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, ভাবে পারবে কি না। কিন্তু আর্চনা দিদির অনুপ্রেরণায়, আর সহঅভিনেতাদের ভালোবাসায় সে ধীরে ধীরে মঞ্চে নিজের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায়। প্রতিটি রিহার্সালে সে আরও গভীরে ডুবে যায় চরিত্রটিতে—নিজের জীবনের হারানো মুহূর্ত, অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, অব্যক্ত কষ্ট—সব যেন একসূত্রে গাঁথা হতে থাকে সংলাপের ভেতর। একদিন একটা দৃশ্যে সে নিজের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের মুহূর্ত অভিনয় করছিল, হঠাৎ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে—কেউ জানে না, ওই কান্না অভিনয় নয়, বাস্তবের পুরনো রক্তক্ষরণ। রিহার্সাল শেষে অনেকেই এগিয়ে আসে, বলে, “দিদি, আপনি তো যেন সত্যিই হচ্ছেন ওই চরিত্র।” এই কথাগুলো যেন নতুন রসদ যোগায় অনুরাধার ক্লান্ত মনে।

বাড়ি ফিরে সে তার ডায়েরিতে লিখতে শুরু করে প্রতিদিন—প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি ভয়, প্রতিটি ছোট জয়—সবই লিপিবদ্ধ করে। তার কাছে এই লেখাগুলো হয়ে ওঠে একরকম আত্মোপলব্ধির নথি। কখনো সে নিজেকে প্রশ্ন করে, “তুই এতদিন কোথায় ছিলি অনু?” কখনো জবাব আসে, “এই তো, তোর মধ্যেই ছিলাম, শুধু সাহস করিসনি চোখে চোখ রাখার।” শারীরিক ক্লান্তি সত্ত্বেও সে মনের ভিতরে একরকম অনির্বচনীয় শক্তি অনুভব করে—একটি আগুন, যা আবার জ্বলছে, এইবার নিভবে না সহজে। সে এখন আর মঞ্চে যেতে ভয় পায় না, বরং অপেক্ষা করে কখন আবার আলো জ্বলে উঠবে, আর সে দাঁড়াবে পাটাতনের ঠিক মাঝখানে, যেখানে কেউ তাকে দায়িত্বে বাঁধেনি, যেখানে সে কেবল নিজে। এই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে তার চারপাশের মানুষদের দৃষ্টিও। তরুণরা এখন তাকে দেখে অনুপ্রেরণা হিসেবে, আর্চি দিদি বলেন, “অনু, তুই আবার ফিরে এসেছিস নিজের জায়গায়।” আর এইবার, অনুরাধা জানে, সে পালাবে না। এই লড়াইটা সে জিতবেই—এইবার অভিনয়ের মঞ্চে নয়, জীবনের মঞ্চে।

অধ্যায় ৫: ছেলে-মেয়ের চোখে মা

নাটকের প্রস্তুতির মধ্যেই একদিন হঠাৎ অনুরাধার মেয়ে নীলা ফোন করে, আমেরিকা থেকে। ভিডিও কলে অনুরাধাকে দেখে চমকে ওঠে, “মা, তুমি কি শাড়ি পরে আছো? তুমি তো তোদের থিয়েটারে গিয়েছিলে না?” অনুরাধা একটু হেসে জানায়, “হ্যাঁ মা, শাড়ি পরলেই তো মানুষ পাল্টে যায় না। থিয়েটারে যাচ্ছি ঠিকই, আজ একটা সংলাপ ছিল, খুবই জোরালো দৃশ্য।” নীলা বিরক্ত হয়, “এই বয়সে আবার থিয়েটার? মা, তুমি ঠিক আছ তো? কার সঙ্গে চলাফেরা করছ?” অনুরাধা কথাটা গায়ে মাখে না, কিন্তু ফোনটা রেখে বুকের মধ্যে হালকা একটা খচখচানি অনুভব করে। এতগুলো বছর ধরে সে নিজের সব ইচ্ছাকে সরিয়ে রেখে কেবল মেয়ে আর স্বামীর পাশে থেকেছে, আর আজ যখন সে একটু নিজের মতো করে বাঁচতে চায়, তখন সেই মেয়েই প্রশ্ন তুলছে? নিজের লেখার খাতাটা খুলে সে লেখে, “মেয়ের চোখে আমি এখনও সেই মা, যে রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে ডুবে থাকে, অথচ সে জানে না আমি অনেক আগে থেকেই ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছিলাম। এখন আমি নিজেকে আবার জ্বালাতে চাই।” কিন্তু মন তার চুপ করে বসে না। বিকেলে মঞ্চে গিয়ে সংলাপ বলতে গিয়ে একবার গলা কেঁপে যায়। আর্চি দিদি সেটা বুঝতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিছু হয়েছে?” অনুরাধা বলে, “মেয়েটা বুঝতে চায় না দিদি, আমি আসলে কাকে খুঁজছি।” তখন দিদি বলেন, “বেশিরভাগ মানুষ কাছের মানুষের স্বপ্নকে বোঝে না, কারণ তারা ভাবেই না তুমি কিছু চাও। কিন্তু তুই তোর জায়গায় ঠিক আছিস। সময়ই সব ব্যাখ্যা দেবে।”

পরদিন সকালে নীলা আবার ফোন করে, গলাটা একটু নরম। “মা, আমি একটু রুঢ় ভাবে বলে ফেলেছিলাম, আমি মাফ চাই। আসলে তোমাকে এতদিন ধরে একভাবে দেখেছি যে এই নতুন মাকে মেনে নিতে একটু সময় লাগছে।” অনুরাধার মনটা একটু হালকা হয়, সে বলে, “আমি নতুন হচ্ছি না মা, আমি শুধু আমার পুরনো স্বপ্নটাকে ঝেড়ে মুছে তুলছি।” নীলা বলে, “তুমি ঠিক করেছ, আমি গর্বিত মা। ছোটবেলায় তো দেখতাম তুমি আয়নায় দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে, আমি বুঝতাম না, এখন বুঝছি তুমি শুধু আমার মা নও, একজন মানুষ, যাঁর নিজের গল্প আছে।” এই স্বীকারোক্তি অনুরাধার মনে এতদিনের জমে থাকা কুয়াশা সরিয়ে দেয়, সে হাসে, চোখে জল আসে—শুধু তৃপ্তির। এই এক মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে, নিজের স্বপ্নকে আবার খুঁজে পাওয়া মানেই হয়তো অন্যদের চোখেও নিজের নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা। তার ছেলেও কয়েকদিন পর মেসেজ করে, “মা, থিয়েটারের ছবি দিও তো! বন্ধুদের বললাম, আমার মা আবার অভিনয় শুরু করেছে।” এইসব ছোট ছোট গ্রহণযোগ্যতার ভিতর দিয়ে অনুরাধা বুঝে যায়, এই লড়াই শুধু নিজের না, আশেপাশের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে দেওয়ার এক অব্যক্ত আন্দোলন।

মাঝেমধ্যেই অনুরাধা খেয়াল করে, তার ভিতরে যেন নতুন এক ধরণের আলো তৈরি হয়েছে। সকালের আলোয় বারান্দায় বসে সে জানালার বাইরে তাকিয়ে অনুভব করে, কত বছর পর সে আবার তার ‘আমি’-কে ভালোবাসতে শিখছে। আগে যে একাকীত্ব তাকে গ্রাস করত, এখন সে একাকীত্বে স্বস্তি খুঁজে পায়, কারণ সে জানে, এই সময়টা তার নিজের। সে এখন আর কারো মা, কারো স্ত্রী বা কারো ছায়া নয়—সে নিজে একজন মানুষ, যার স্বপ্ন আছে, গল্প আছে, ব্যর্থতা আছে, এবং সেই ব্যর্থতা থেকেও নতুন করে জন্ম নেওয়ার শক্তি আছে। রিহার্সাল করতে করতে সে নিজের শরীরকে, নিজের গলার স্বরকে, নিজের মুখভঙ্গিকে আরেকবার নতুন করে আবিষ্কার করে। নাটকের চরিত্রের মতো, নিজের জীবনের চরিত্রও সে আবার নির্মাণ করছে—ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে। ছেলে-মেয়ের চোখে একসময় যে মা ছিল চিরস্থায়ী একটি ছায়াপথের মতো, আজ সেই মাই হয়ে উঠছে এক নক্ষত্র—আলাদা, দীপ্তিমান, স্বাধীন। এই পরিবর্তন অনুরাধার কাছে শুধু অভিনয়ের ফিরে আসা নয়, এটি এক রকম নবজন্ম—যেখানে ভালোবাসা ও স্বীকৃতি ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, ঠিক যেভাবে সূর্য উঠতে সময় নেয়, কিন্তু একবার আলো ছড়ালেই পৃথিবী পাল্টে যায়।

অধ্যায় ৬: বন্ধু ফিরে আসে

অনুরাধা যেদিন কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়েছিল নাটকের স্ক্রিপ্ট খুঁজতে, সেদিন সকালটা ছিল একটু ধোঁয়াটে। হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুয়াশার মতো জমে থাকা ধোঁয়া, চায়ের দোকান থেকে আসা এলাচের গন্ধ, আর বইয়ের পাতার পুরনো গন্ধে শহরটা যেন আরও কাব্যিক হয়ে উঠেছিল। দোকানটার নাম ‘অভিজ্ঞান’, ছোট, ছিমছাম আর অতীতের গন্ধে মোড়া। দোকানে ঢুকেই অনুরাধা থমকে যায়—কাউন্টারে বসে থাকা লোকটার মুখ খুব চেনা, যেন কলেজের দিনের কেউ, আর ঠিক তখনই সে চোখ তুলে তাকায়। দুজনের চোখ আটকে যায়। “অনু?”—ভেজা স্বরে বলল সেই মানুষটি। “সৌমেন?” অনুরাধার মুখে বিস্ময়ের ছায়া। কলেজে নাট্যচর্চার সময়কার সহপাঠী, যার সঙ্গে কতবার মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছে, কবিতা নিয়ে বিতর্ক করেছে, যার সঙ্গে শেষ কথোপকথন ছিল তিরিশ বছর আগে, হঠাৎ তার সামনে বসে আছে এক অন্যরকম সৌমেন—কেশপাতিত, চশমাধারী, কিন্তু চোখে সেই পুরনো আলো। সৌমেন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তুই? এতদিন পরে? আমি জানতাম তুই একদিন ফিরবি। কিন্তু এভাবে হঠাৎ?” অনুরাধা একটু হাসে, “হ্যাঁ, ফিরে এসেছি। থিয়েটারের জন্য। নিজের জন্য। তোকে দেখব ভাবিনি কিন্তু তুই এখনও বইয়ের দোকান চালাস?”

সৌমেন একটু হেসে মাথা নাড়ে, “চাকরি করতাম, পরে ছেড়ে দিলাম। এই দোকানটাই এখন সব। বইয়ের গন্ধ, মানুষের মুখ, আর মাঝে মাঝে রাতের SESSION —এই নিয়েই বেঁচে আছি।” ওদের কথা এগোয়, স্মৃতির গলিতে হাঁটতে হাঁটতে তারা সেই পুরনো নাটকের কথা তোলে, যে নাটকে অনুরাধা শেষবার অভিনয় করেছিল কলেজ ফেস্টে—‘চিঠি’র সেই মর্মস্পর্শী একক দৃশ্য। সৌমেন বলে, “তোর অভিনয়টা আমি আজও ভুলিনি অনু। তখনই বুঝেছিলাম, তুই একদিন বড় কিছু করবি।” অনুরাধার মুখটা নরম হয়ে আসে, সে বলে, “তারপর? সব তো হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। বিয়ে, বিদেশে পাড়ি, সংসার—সব মিলে নিজের স্বপ্নকে পিছনে ফেলে ফেলেছিলাম। এখন আবার টানটা অনুভব করছি, নিজের ‘আমি’-কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।” সৌমেন গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর বলল, “তুই ঠিক করেছিস। আমাদের প্রজন্মের খুব কম জন সাহস করে নিজেকে ফিরে পেতে। আমি দেখেছি, সবাই কেবল মানিয়ে নিতে চায়।” এই এক কথায় যেন অনুরাধা সাহস পায় আরও। ওরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে আসে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চা খায়, ভেজা বইয়ের বাক্সের পাশে দাঁড়িয়ে। সেই সন্ধ্যেটা যেন এক আশ্চর্য উষ্ণতায় ভরা, যেখানে হারিয়ে যাওয়া সময় আর বর্তমানের সাহস পাশাপাশি হাঁটে।

পরের কিছুদিনে সৌমেন আর অনুরাধা মাঝে মাঝে দেখা করে, কখনো বইয়ের দোকানে, কখনো লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে। তারা একে অপরের জীবনের হারানো অধ্যায়গুলো পড়ে ফেলে নতুন করে। অনুরাধা দেখে, সৌমেন একজন গভীর, নির্জন মানুষ হয়ে উঠেছে, যে বইয়ের পাতায় আর মানুষের চোখে নিজের জগত খোঁজে। আর সৌমেন দেখে, অনুরাধা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থির, পরিণত, অথচ এখনও চোখে স্বপ্নের রেখা। একদিন অনুরাধা বলে, “জানিস, যখন অভিনয় করি, তখন মনে হয় যেন আমি সত্যিই বেঁচে আছি।” সৌমেন শুধু বলে, “আমি তোদের শো দেখতে যাব।” এই নিঃশব্দ সমর্থন, এই চোখের গভীরতা—সব মিলিয়ে অনুরাধার ভেতরে এক অদ্ভুত আশ্রয় গড়ে তোলে। কোনও সম্পর্কে নাম নেই, দাবি নেই, শুধু বোঝাপড়ার এক আন্তরিক আলো। সৌমেনের উপস্থিতি যেন তাকে মনে করিয়ে দেয়, যে সময় একবার হাতছাড়া হলেও, জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসে সম্পর্কগুলো আরও প্রগাঢ় হয়। এই বন্ধুত্বটা অনুরাধার জীবনে একটা নতুন অধ্যায় তৈরি করে, যেখানে সে আর একা নয়, তার পাশে একজন আছে—যে বোঝে, দেখে, আর প্রশ্ন করে না। এইবার তার মঞ্চে ফেরার লড়াইয়ে কাঁধে হাত রাখে এক পুরনো বন্ধু, আর অনুরাধা বুঝে যায়—ফিরে আসাটা শুধু নিজের কাছে নয়, সেইসব মানুষের কাছেও যারা চিরকাল অপেক্ষায় ছিল।

অধ্যায় ৭: মঞ্চস্থ হওয়ার প্রস্তুতি

নাটকের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে—মাত্র একমাস বাকি। পুরো দল এখন রিহার্সালের চাপে একেবারে থমথমে, কিন্তু সেই চাপের মধ্যেও একটা উত্তেজনার তরঙ্গ বয়ে যায় যেন—মঞ্চে উঠবে সবাই, শহরের নানা কোণ থেকে মানুষ এসে দেখবে, আর অনুরাধার কাছে এ যেন নিজের জীবনের একটি প্রকাশের মুহূর্ত। প্রতিদিনের রিহার্সাল ঘাম ঝরিয়ে চলতে থাকে—ডায়লগের টান, শরীরের ভঙ্গি, চোখের ভাষা—সব কিছু নিয়ে আর্চি দিদির তীক্ষ্ণ চোখে প্রতিনিয়ত শোধরানোর প্রক্রিয়া। অনুরাধা বোঝে, যতই অভিজ্ঞ হোক বা পরিণত বয়সে ফিরে আসা হোক, থিয়েটারের সামনে সবাই সমান। একটা দৃশ্য ছিল যেখানে অনুরাধার চরিত্রটা একা বসে নিজের অতীতের ভুল স্বীকার করে, আর সামনে রাখা আয়নায় নিজের মুখ দেখে। এই দৃশ্যের rehearsals এ সে বারবার আটকে যায়, শব্দ গুলিয়ে যায়, চোখে জল আসে, আর তখনই আর্চনা দিদি বলে ওঠেন, “তোকে তোর সত্যিটা কবুল করতে হবে রে অনু। ওই দৃশ্যের মধ্যে তোর নিজের জীবন ঢুকিয়ে দে। সাহস কর।” অনুরাধা সেই রাতে বাড়ি ফিরে কিছু খায় না, জানালার পাশে বসে থাকে, শহরের শব্দে ভরে থাকা বাতাসে নিঃশব্দে একরাশ কান্না ছেড়ে দেয়, আর বুঝে যায়—এই অভিনয়টা অভিনয় নয়, এই চরিত্র তারই ছায়া।

এরপর থেকে সে ওই দৃশ্যটিতে আর চোকেনা, বরং গভীর চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের অতীতের সমস্ত পলায়ন, সমস্ত নীরবতা আর সমস্ত কষ্টকে গিলে ফেলে বলে ওঠে সংলাপ—“আমি পালিয়েছিলাম, কারণ আমার সাহস ছিল না, কিন্তু এখন দাঁড়িয়ে আছি নিজের চোখে চোখ রেখে, কারণ আমি আবার জন্ম নিয়েছি।” রিহার্সালের দিনগুলোতে অনুরাধার শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে, পায়ে ব্যথা হয়, গলা শুকিয়ে যায়, তবু সে থামে না। সৌমেন প্রায় রোজ আসে, চুপচাপ একপাশে বসে দেখে, মাঝে মাঝে জল আর মুখপুছা এগিয়ে দেয়, আর একদিন বলে, “তুই জানিস না অনু, তোর অভিনয় শুধু একটা নাটক নয়, এটা আমাদের মতো হাজার মানুষের জীবনের আয়না।” অনুরাধা তখন বুঝে যায়, এই মঞ্চ তার স্বপ্নের থেকেও বড় কিছু হয়ে উঠেছে—একজন নারীর সাহসের, হারানো সত্তার, আর বেঁচে থাকার অস্তিত্বের ঘোষণা। নাটকের পোস্টার হয়েছে শহরজুড়ে, নাম—“অবরুদ্ধ”—আর অনুরাধার নাম সেই প্রধান চরিত্রে। একদিন হঠাৎ রজত, তার প্রাক্তন স্বামী, মেসেজ পাঠায়—“শুনেছি মঞ্চে ফিরেছো, অভিনন্দন। আমাদের অনেক কথা হয়তো বলা হয়নি, কিন্তু আমি জানি তুমি এটা অনেক আগেই ডিজার্ভ করতে।”

এই বার্তা পড়ে অনুরাধা থমকে যায়, পুরনো অন্ধকার গলির মতো সেই সম্পর্কের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে, যেখানে বোঝাপড়া ছিল না, ছিল চুপ চাপ সহ্য করে যাওয়া। সে উত্তর দেয় না, শুধু নিজের মনকে বলে, “আমি তো নিজের কাছেই ফিরে এসেছি, আর কারো কাছে নয়।” নাটকের দিন যত এগোয়, তার আত্মবিশ্বাসও বাড়ে, কিন্তু একইসাথে বাড়ে এক অজানা আবেগ, মঞ্চে উঠেই যদি ভুল করে বসে? যদি গলা বন্ধ হয়ে যায়? আর্চি দিদি একদিন বলে, “ভয় হবে, হবেই। কিন্তু তুই যদি বিশ্বাস করিস তোকে শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে, তাহলেই পারবি।” এই কথা অনুরাধার মনে গেঁথে যায়। শো-এর আগের রাতে সে নিজের চুল আঁচড়ে নিয়ে ছোট্ট একজোড়া কানের দুল পরে, যা তার মা তাঁকে অনেক বছর আগে দিয়েছিল, আয়নায় তাকিয়ে বলে, “এই আমি, নতুন করে ফিরছি।” শহর তখন গভীর নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়, আর অনুরাধা জানে, এই রাত তার জীবনের শেষ রাত নয়—বরং নতুন জীবনের এক মহড়ার প্রাক্কাল। যেই curtain উঠবে পরদিন সন্ধ্যায়, তাতে শুধু নাটকের আলো থাকবে না, থাকবে তার জীবনের সংগ্রাম, ভালোবাসা, ত্যাগ আর সাহসের এক শুদ্ধ প্রদর্শন।

অধ্যায় ৮: আলো জ্বলে ওঠে

শো-এর দিন সন্ধ্যা নেমেছে একটু ধীর গতিতে, যেন সময় নিজেই থেমে থাকতে চাইছে অনুরাধার জন্য। থিয়েটারের বাইরের ভিড়টা যত বাড়ছিল, অনুরাধার হৃদস্পন্দনও তত বেড়ে যাচ্ছিল—যেন নিজের ভিতরে কোনও ঢেউ টলমল করছে, যা কেবল আলো জ্বলে উঠলেই ফেটে পড়বে। গেটের বাইরে বড় বড় পোস্টারে তার নাম, নিচে ছোট করে লেখা: “অভিনয়ে ফিরে আসা একজন নারীর আত্মস্মৃতির পরিসমাপ্তি”। সৌমেন এসে পৌঁছেছে আগেই, দর্শকদের সিটে চুপচাপ বসে, একরাশ গর্ব নিয়ে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকেই, যেখানে একটু পর অনুরাধা উঠবে একা, নিজের সমস্ত ভয় ও অতীত টেনে নিয়ে। মেকআপ রুমে এক কোণে বসে সে আয়নায় চোখ রাখে—সেখানে সে দেখতে পায় নিজের অতীত ও বর্তমানের ছায়াপাত, আর অনুভব করে, আজ তার অভিনয় নয়, তার বেঁচে থাকাই মঞ্চে উঠে যাচ্ছে। সহ-অভিনেত্রীরা এসে বলে, “দিদি, আপনি তো সত্যি অবাক করার মতো অভিনয় করছেন রিহার্সালে!” সে মুচকি হেসে বলে, “অভিনয় নয় মা, এই আমার আসল গল্প।” তখনই ডাকা হয় স্টেজে। প্রেক্ষাগৃহে আলো নেভে, পর্দার আড়ালে থমথমে নীরবতা, আর সে অনুভব করে বুকের ভিতরটা ধ্বনিময় হয়ে উঠছে নিজের অস্তিত্বে।

প্রথম সংলাপটা বলার আগে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করে। তারপর, যখন তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে—“আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম”—প্রেক্ষাগৃহ নিঃশব্দ হয়ে যায়। প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি হাঁটাচলায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে যেন জীবনের সত্যি কথা বলে। দর্শকরা তার মধ্যে দেখে এক মেয়ে, যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল, আবার হারিয়েছিল, আবার ফিরে পেয়েছে নিজেকে। নাটকের মাঝপথে সেই আয়নায় মুখ দেখার দৃশ্যে, অনুরাধা সংলাপ থামিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে, নিজের চোখে চোখ রাখে, আর তারপর খুব শান্ত স্বরে বলে, “আমি নিজেকে মাফ করে দিয়েছি”—এই লাইন বলার পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে পুরো হল, যেন প্রতিটি মানুষ তার সঙ্গে একযোগে মুক্তি পায়। সৌমেনের চোখে জল, আর্চি দিদি কাঁধে হাত রাখেন পাশে বসা শিক্ষার্থীর, বলেন, “এই হল শিল্প, যা মানুষকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।” নাটকের শেষে, যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরো দল কুর্নিশ করে, অনুরাধার চোখে তখন আর অশ্রু নেই—শুধু দীপ্তি, প্রশান্তি। হাজার হাততালির মধ্যে সে বুঝতে পারে, এটা তার অভিনয়ের জয় নয়, এটা তার জীবনের পুনর্জন্ম। এই মুহূর্তে তার একার চারপাশে যেন হাজারটি আলোকরেখা।

শো শেষ হলে, দর্শকেরা এগিয়ে আসে। কেউ হাত ধরে, কেউ চোখে চোখ রেখে বলে, “আপনার অভিনয় দেখে মনে হল নিজের কথা শুনলাম।” একজন বয়স্কা মহিলা বলে, “আপনার জন্যেই আবার বিশ্বাস পেলাম যে জীবন এখানেই থেমে যায় না।” সৌমেন ধীরে এসে বলে, “তোকে বলেছিলাম না? তুই শুধু অভিনয় করিসনি, তুই জীবনকে রাঙিয়ে দিলি।” অনুরাধা চুপচাপ হাসে, কোনও উত্তর দেয় না। আর্চি দিদি এসে বলে, “আজ আমি গর্বিত অনু, কারণ তুই কেবল মঞ্চে ফিরে আসিসনি, তুই আমাদের প্রত্যেককে ফিরিয়ে এনেছিস নিজস্ব স্বপ্নের কাছে।” সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময়, শহরের রাস্তাগুলোকে অন্যরকম মনে হয়—প্রত্যেকটা আলো যেন তার জন্যেই জ্বলে আছে, যেন ছায়ায় ছায়ায় তার নাম লেখা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়, বলে, “মা, আমি ফিরে এসেছি”—কারণ সে জানে, তার মা ছিলেন সেই প্রথম মানুষ, যিনি তাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন। এখন সে জানে, মঞ্চটা তাকে আবার টেনে নিয়েছে বাঁচার জন্য, আর এবার সে আর হারাবে না। এই ফিরে আসা ছিল একটি নারীর, যে একদিন থেমে গিয়েছিল, আবার সাহসে ভর করে, শিল্পে ভর করে, নিজের জীবনকে নতুন করে রচনা করেছে—আলোয়, শব্দে আর নিঃশ্বাসে।

অধ্যায় ৯: নিজস্বতার ছায়াপথ

নাটকের সেই এক সন্ধ্যা অনুরাধার জীবনে যেন অনেক দরজা খুলে দিয়েছিল—সেই দরজাগুলোর ভেতর দিয়ে আলো ঢুকছিল, আর তাতে ভেসে উঠছিল তার নিজের মুখ। শহরের নানা থিয়েটার গ্রুপ থেকে ফোন আসতে শুরু করে, কেউ চাইছে অভিনয়ের ওয়ার্কশপ নিতে, কেউ বলছে ছোট ছোট নাটকে অভিনয় করতে, কেউ আবার অনুরোধ করছে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে। এতগুলো বছর পর, এই পরিচয়টাকে এত খোলামেলা, সম্মানের সঙ্গে ফিরে পেয়ে অনুরাধা প্রথমে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে—যে নারীটি এতদিন কেবল এক পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে, সে এখন কীভাবে নিজের স্বপ্নকে এত নির্দ্বিধায় তুলে ধরবে? কিন্তু দিন পেরোতে পেরোতে সে বুঝতে শেখে, জীবনের এই পর্ব তার নিজস্বতার ছায়াপথ, যেটা সে নিজেই নির্মাণ করছে। একদিন আর্চি দিদি তাকে ডেকে বলে, “তুই এবার নতুন নাটকের নির্দেশনা দে। শুধু অভিনেত্রী হয়ে থাকিস না, স্রষ্টা হ।” অনুরাধা অবাক হয়, তারপর ধীরে বলে, “আমি পারব তো?” দিদি মৃদু হেসে বলে, “পারবি। কারণ তুই জানিস কোথায় মানুষ হারায়, আর কোথায় সে নিজেকে ফিরে পেতে পারে।” সেই রাতে সে নিজের পুরনো লেখা ডায়েরি খুলে বসে, আর খসড়া করতে থাকে এক নতুন নাটকের চিত্রনাট্য—নাম দেয়: “রৌদ্রের মুখোমুখি।”

এই নাটকের গল্পটা এক নারীর, যে ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখত, কলেজে পড়ে নাটক করত, কিন্তু বিয়ের পর সেইসব জিনিস একে একে হারিয়ে যায়। বছর কুড়ি পর, যখন সে হঠাৎ তার শূন্যতাকে উপলব্ধি করে, তখন সে আবার কলম তোলে। নাটকে কোনও অতিনাটকীয়তা নেই, নেই সাফল্যের গৌরব, আছে কেবল আত্মস্বীকারোক্তি, ব্যর্থতার মুঠো, আর জীবনের সহজ আলোর খোঁজ। অনুরাধা বুঝে যায়, এই গল্প তার নিজেরই একরকম প্রতিচ্ছবি—আর সেই জন্যই সে চায় এটা যেন সবার কাছে পৌঁছে যায়। সে নিজের ওয়ার্কশপে নানা বয়সের মেয়েদের নিয়ে শুরু করে রিহার্সাল—তরুণী, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধা—সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে, শেখে, হাসে, কাঁদে, গড়ে তোলে একটা শক্তপোক্ত মঞ্চ। একদিন এক প্রবীণ অভিনেত্রী, যিনি বহুদিন অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন, এসে বলে, “তুমি আবার আমার ভেতরের আগুন জ্বালিয়ে দিলে, অনুরাধা।” আর তখন সে বুঝতে পারে, এই মঞ্চটা আর শুধু তার নিজের নয়, এটা এক সামাজিক জায়গা—যেখানে নারীরা নিজেদের স্বর, ব্যথা, স্বপ্ন নিয়ে এসে দাঁড়াতে পারে। নাটক তৈরির সেই দিনগুলোতে, প্রতিটি চরিত্র যেন তার নিজের ভাঙাচোরা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে নতুন করে নির্মাণ করছে—কখনও শব্দে, কখনও নীরবতায়।

রিহার্সাল শেষে একদিন সৌমেন এসে চুপ করে বসে থাকে, তারপর বলে, “তুই জানিস না অনু, তুই একটা আন্দোলন শুরু করেছিস—নাটকের নামে, জীবনের নামে। যে চুপ করে থাকে, সেই তো সবচেয়ে জোরে কথা বলতে পারে।” অনুরাধা মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হেসে বলে, “আমি শুধু নিজেকে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। এখন দেখি, আরও অনেকেই এই আলোয় আসতে চাইছে।” সে জানে, এই পথ সহজ না—সমাজের চোখে এখনো মধ্যবয়সী নারী মানেই সীমাবদ্ধ জীবন, নির্লিপ্ত সংসার, নিঃস্বপ্ন ছায়া। কিন্তু সে বিশ্বাস করে, শিল্প একমাত্র পথ যা দিয়ে এই ছায়া ভেদ করে সত্যি নিজেকে দেখা যায়। তার নাটক এখন প্রযোজনার পথে, পোস্টার তৈরি হচ্ছে, সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার নিচ্ছে, ছেলেমেয়েরা গর্ব করে নিজেদের বন্ধুকে বলে, “আমার মা এখন নাটক করেন।” এই নতুন পর্বে সে একা নয়—তার পাশে আছে সেইসব মানুষ, যারা একসময় তাকে হারিয়ে ফেলেছিল, আবার ফিরে পেয়েছে। অনুরাধা বুঝে যায়, জীবন একটানা সাদা পাতায় লেখা গল্প নয়—এটা এমন এক কোলাজ, যেখানে ছিন্ন অংশগুলোকে জোড়া লাগাতে হয় সাহস, অনুভব আর নিজের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে। এই অধ্যায়ে এসে সে আর কোনও চিহ্ন খোঁজে না, সে শুধু ছাপ রেখে যায়, প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অভিনয়ে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

অধ্যায় ১০: শেষ দৃশ্যের আগে

নতুন নাটক ‘রৌদ্রের মুখোমুখি’র প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এক বড় মঞ্চে—যেখানে আগে অনুরাধা শুধু দর্শক হয়ে বসে থেকেছে জীবনের নানা সময়ে, আর আজ সেই মঞ্চে সে নিজের সৃষ্টি নিয়ে উঠবে। প্রেক্ষাগৃহের আলো-আবহের মধ্যে একরাশ নিরব উত্তেজনা জমে উঠছে; কিন্তু অনুরাধার মন এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরা। তার চারপাশে ব্যস্ততা, কুশল বিনিময়, টেনশনের ফিসফাস, ক্যামেরার ঝলকানি—তবুও সে ঠিক করে রাখে, আজ সে কোনও কিছু প্রমাণ করতে মঞ্চে উঠছে না। সে আজ কেবল নিজের পথ শেষ করে একটি আলো জ্বালাতে উঠছে। সে জানে, প্রথম শো-এর ভুল হতে পারে, সংলাপ মুখ ফসকে উল্টে যেতে পারে, কেউ কেউ হয়তো গল্পের গভীরতাকে ধরতে পারবে না—তবুও এটা তার শেষ নয়, বরং আরও অনেক শুরুর প্রথম সোপান। আর্চি দিদি এক কোণে দাঁড়িয়ে বলে, “আজ তোকে আমি কিছু বলব না, তুই নিজেই নিজেকে নিয়ে যা।” সৌমেন আসনে বসে আছে, হাত জড়িয়ে রেখেছে বুকের ওপর, চোখে সেই একই আস্থা যা একদিন সে কলেজের মঞ্চে অনুরাধার চোখে দেখেছিল।

পর্দা উঠে গেলে প্রথম দৃশ্যে অনুরাধা একক সংলাপে দর্শকদের সামনে আসে—চোখের ভাষা, শরীরের অভিব্যক্তি, সংলাপের উঠানামা—সব মিলিয়ে সে যেন এক গভীর কবিতা পাঠ করছে, যার প্রতিটি শব্দ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা। তার অভিনয়ে কেউ একটা মধ্যবয়সী নারীকে দেখে, যে নিজের হারানো ‘আমি’কে খুঁজছে; কেউ দেখে একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে, যে চারদেয়ালের বাইরে গিয়ে আলোর মুখে দাঁড়ানোর সাহস করে; আবার কেউ দেখে এক নিঃশব্দ বিপ্লব, যা সমাজের ক্লান্ত সংজ্ঞাগুলোকে পেছনে ফেলে দিতে চায়। নাটকের একটা দৃশ্যের সময়, অনুরাধার চরিত্র দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে, পিছনে রেকর্ডেড ভয়েসে শোনা যায়: “আমি আজও লিখি সেই চিঠিগুলো, যা কেউ পড়ে না। আমি বলি সেই শব্দগুলো, যা শোনা যায় না। তবু আমি থামি না।” এই শব্দগুলো বলার সময় অনুরাধার চোখে জল আসে না, কিন্তু তার ভিতরটা যেন জ্বলে ওঠে এক অদ্ভুত আলোর দাহে। দর্শক নিঃশব্দে বসে থাকে, যেন কেউ কারো নিঃশ্বাসও শুনতে পারছে না। তারপর, ধীরে ধীরে করতালির ধ্বনি শুরু হয়—প্রথমে কিছুকজন, তারপর গোটা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। দাঁড়িয়ে থাকা অনুরাধা বুঝে যায়, আজ সে শুধুমাত্র নাট্যকার বা অভিনেত্রী নয়—সে এক সত্তা, এক প্রতিবাদের মুখ, এক আশার দিশারি।

নাটকের পর মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুরাধা হাসে, কুর্নিশ করে, কিন্তু কিছু বলে না। সে শুধু চেয়ে থাকে দর্শকদের দিকে—যাদের চোখে জল, কৃতজ্ঞতা, বিস্ময় আর অনেক অপ্রকাশ্য ভালোবাসা। সেদিন রাতে যখন সে বাড়ি ফেরে, তখন শহরটাও অন্যরকম মনে হয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি সত্যিই ফিরতে পেরেছি”—এবার আর শুধুমাত্র শহরে নয়, মঞ্চে নয়, বরং নিজের হৃদয়ের কেন্দ্রে। তার চারপাশে কিছুই বদলায়নি হয়তো, কিন্তু সে নিজেই হয়ে উঠেছে পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু। সে জানে, সব লড়াই জেতার নয়, কিন্তু কিছু লড়াই শুধু করলেই মানুষ নিজেকে ফিরে পায়। সেই রাতটায় সে ডায়েরি খুলে লেখে, “আমি আজ নিজের গল্পের শেষে পৌঁছলাম, কিন্তু এর মানে এই নয় যে সব শেষ—বরং এখান থেকেই শুরু হবে নতুন সব গল্প, যেখানে আমি আর ছায়া হয়ে থাকব না, আমি থাকব রৌদ্রের মুখোমুখি।” অনুরাধা জানে, জীবন এখন আর থেমে নেই, জীবন এখন তার নিজের গলায় বলা এক একটানা সংলাপ—নিঃশব্দে, নির্ভীকভাবে, নিজস্ব আলোর দিকে এগিয়ে চলা।

__

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *