পূর্ণেন্দু রায়
(১)
হ্যাঁ, এই শহরটা বদলে গেছে। অথবা বদলে যায়নি কিছুই—শুধু সময়ের ফ্রেম বদলেছে, চোখের লেন্স বদলে গেছে। কলকাতা বিমানবন্দরের গ্লাস দরজার ওপার থেকে যখন বাইরে পা রাখল অরিত্র, ঠিক তখনই গায়ে লেগে গেল এক অদ্ভুত গন্ধ—একটুও রুমালসুলভ নয়, বরং ধুলো, জল, গরমের পরশ আর ভিজে বাসনের মত পুরনো দিনের এক গন্ধ। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন পার হতে হতেই মুখভরা ক্লান্তি, কিন্তু বাইরের আলোয় এসে দাঁড়াতেই সে যেন হঠাৎ চুপ করে যায়। মনে পড়ে যায় শৈশবের শেষ পুজোটার কথা, যখন সে মায়ের গলা জড়িয়ে কাঁদছিল কানাডা যাওয়ার আগে। আজ এত বছর পর সেই মাটিতে আবার পা রেখেছে—যার গন্ধ সে ভুলে গিয়েছিল, আবার ভেতরে ভেতরে চিরকাল খুঁজে গিয়েছিল। গাড়িতে বসে শহরের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সে খেয়াল করে—যদিও রাস্তা নতুন পিচে ঢাকা, মোড়ে মোড়ে কফি শপ আর হাইরাইজ উঠেছে, তবু বাতাসের মধ্যে একটা টান রয়ে গেছে। মানিকতলার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরনো চায়ের দোকান, বউবাজারের বাঁক পেরিয়ে উঁকি মারা ট্রাম—সবই যেন তাকে ডাকছে। গাড়ি যখন শ্যামপুকুর স্ট্রিটের পুরনো চ্যাটার্জী বাড়ির গেটের সামনে এসে থামে, অরিত্রর গলা শুকিয়ে আসে। ছোটবেলায় যে লাল-হলুদ পিলারের মধ্যে দিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকত, যেখানে ঠাকুরদা বসে নামগান গাইতেন আর ঠাকুরমা খেজুর গুড়ের নাড়ু বানাতেন, সেই উঠোন আজও প্রায় একইরকম আছে। শুধু ঠাকুরদার চেয়ার খালি, এবং ঠাকুরমার মুখশ্রী এখন ছবিতে বাঁধানো। বাড়ির দরজা খুলে মায়ের চোখের জল, বাবার শান্ত হাত রাখার ভঙ্গিমা—সবকিছু যেন এতটাই চেনা, অথচ যেন অন্য এক স্বপ্নের ভেতরে থাকা কিছু।
পরদিন সকাল। কলকাতার শরৎকাল এমনই—ভোরবেলা আলো পড়ে জানলার ফাঁক দিয়ে, আর ঘুম ভাঙায় শালিক পাখির ডাক। অরিত্র উঠে ছাদে যায়। সাদা একটা গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে থাকে ছাদের কার্নিশে, হাতে চায়ের কাপ, আর মনে মনে ভাবে—কানাডায় এত বছর থেকেও কোনোদিন এমন সকাল তার হয়নি। হঠাৎ তার চোখ পড়ে পাশের বাড়ির ছাদে। লাল পাড়ের শাড়ি পরে এক মেয়ে ধীরে ধীরে শিউলি কুঁড়োচ্ছে। তার পাশে বসে আছে একটা কালো বেড়াল। অরিত্রর চোখ আটকে যায়। বাতাসে তখনও স্নিগ্ধ ঠান্ডা, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘ। ঠিক এমন মুহূর্তে পাশের ছাদ থেকে ভেসে আসে গান—“আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই…”। অরিত্রর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কণ্ঠস্বরটায় যেন কী এক ব্যথা আছে, আবার আশ্বাসও। গানটা শেষ হয়, মেয়েটি উঠে যায়, আর বেড়ালটি ধীরে ধীরে তার পিছু নেয়। অরিত্র শুধু তাকিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে তার মনে হয়—এই শহরটা তাকে একটা গল্প শোনাতে চায়, যার শুরু হয়েছে এই মেয়েটিকে দেখে। নিজের ঘরে ফিরে এসে সে পুরনো অ্যালবাম খুলে বসে—যেখানে আছে সেই পাড়ার পূজোর ছবি, তার ঠাকুরদার হাসিমুখ, ছোটবেলার বন্ধু সৌম্য আর পর্ণোর সঙ্গে তার ধুলো-মাখা দিনগুলোর টুকরো ছবি। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্তে সৌম্য—“ফিরলি অবশেষে! আজ সন্ধ্যায় পুজোর প্রস্তুতির মিটিং আছে, চলবি?” অরিত্র উত্তর দেয়, “যাব, আবার পাড়ায় হাঁটব, আবার ঢাকের সুর শুনব।”
সন্ধ্যায় পা রাখতেই পাড়ার মণ্ডপে, আবার ফিরে আসে সেই চেনা দৃশ্য। ঠাকুর তৈরি হচ্ছে, কাঠামোর গায়ে মাটির প্রলেপ পড়ছে। কাসার থালায় শঙ্খ রাখা, মালা গাঁথা হচ্ছে, প্যান্ডেল বাঁধা, আলো লাগানো—সবই যেন সিনেমার সেট মনে হয়, অথচ এই দৃশ্যেরই কোনওদিন অংশ ছিল সে। সৌম্যর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তার চোখ আবার খুঁজে বেড়ায় সেই মেয়েটিকে। হঠাৎ এক কোণায় দেখতে পায়—মাইক হাতে একটা মেয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্র পড়ছে। তাকালেই বোঝা যায়—ওই সেই ছাদের মেয়ে। কণ্ঠে একই স্নিগ্ধতা, মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস। তার নাম কৃপা। সৌম্য বলে, “ও আমাদের পাড়ার গর্ব—রবীন্দ্রসঙ্গীতের দারুণ শিল্পী, আর খুব ভালো নাচেও।” অরিত্র শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, এই শহরে সে ফিরে এসেছে পূজো দেখতে, কিন্তু পূজোর মধ্যেই কি ধরা দিচ্ছে কোনও পুরনো দিনের মতো ধীর প্রেম? অচেনা এক অনুভূতি বুকের ভেতরে পাক খাচ্ছে। ঢাকের সুর, আলো ঝলমলে প্যান্ডেল, আর সেই কণ্ঠস্বরের মতো—মুখোমুখি না হয়েও কেউ কারো মনের আয়নায় ছায়া ফেলে যাচ্ছে। শহর তখন ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে, আর অরিত্রর ভিতরে একটা নতুন গল্প শুরু হচ্ছে—যার নাম, ‘তুমি’।
(২)
ভোর চারটে। ঘড়িতে অ্যালার্ম না থাকলেও, অরিত্রর ঘুম ভাঙে এক আশ্চর্য শান্তির ভেতর দিয়ে। জানালার ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়া হালকা নীলচে আলো, রাস্তা ধোওয়া ঠান্ডা হাওয়া, আর দূরে কে যেন কাঁসরের ঘণ্টা বাজাচ্ছে—এইসব নিয়ে সকালটা যেন বেজে উঠেছে এক অব্যক্ত সুরে। গা ছমছমে ঠান্ডা জানালার কাঁচে হাত রাখতেই শরীর কেঁপে ওঠে। এত বছর পর এই শহরের শরতের হাওয়ায় সে বুঝে যায়—এখানে আলোও গন্ধ ধরে রাখে। চাদর গায়ে দিয়ে সে ছাদে উঠে যায়। ছাদের রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে নিচের গলির দিকে তাকায়—তেমনই কুয়াশা ঘেরা, কিছুক্ষণ বাদেই মাধুরীর মতো করে দোকানদাররা চা বানাবে, গ্যাসে হাঁড়ি চাপবে, আর টিনের চালে কাকের ডাক পড়বে। কিন্তু এখন, এখন চারপাশ জেগে ওঠার আগের মুহূর্ত—নীরব, ধুলোবিহীন, স্নিগ্ধ। হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ পড়ে তার—সেই মেয়েটি। আজও শাড়ি পরা, কিন্তু আজ সাদা পাড়ের মাটি রঙা শাড়ি, কাঁধে একটা নীল চাদর জড়ানো। তার চুল খোলা, হাতে একটা বালতির মতো কিছু, আর সে মাটিতে খুব ধীরে ধীরে শিউলি কুঁড়োচ্ছে। প্রতিটি ফুল তুলে যেন নরম করে স্পর্শ করছে, যেন সে ফুল নয়—কোনও স্মৃতি। পাশে বেড়ালটি আজও ঘুমিয়ে, তার লেজটাও গুটিয়ে রাখা। অরিত্রর গলা শুকিয়ে আসে। সে ক্যামেরা আনতে ছুটে যায়, কিন্তু আবার ছাদে ফিরে এসে দাঁড়াতেই দেখে—মেয়েটি থেমে গেছে। সে তাকিয়ে আছে অরিত্রর দিকেই। দু’জনের চোখ মিলে যায়। কোনও কথা নয়, কেবল চোখের ভিতর দিয়ে যেন বাতাস বইতে থাকে। সেই মুহূর্তে অরিত্র জানে—এই শরৎ শুধু মেঘের জন্য নয়, এই শরৎ কারো চোখেও ভাসে।
সন্ধ্যাবেলা। মণ্ডপে আজ চূড়ান্ত ব্যস্ততা। স্টেজ তৈরির কাজ শেষ, ঢাকিদের রিহার্সাল চলছে, আর চারপাশে মালা গাঁথা, চাঁদমালা বাঁধা, বিদ্যুৎ সংযোগ—সব কিছু যেন এক রঙিন ব্যস্ততা। অরিত্র হাতে ক্যামেরা নিয়ে প্যান্ডেলের চারপাশে ঘুরছে। সে শহরের ছবি নয়, মুহূর্তের ছবি তুলে—একটা মায়ের হাতে শিশু, এক যুবকের চোখে আলো, এক প্রবীণের মুখে ছায়া—এইসব ক্যাপচার করে সে। হঠাৎ মাইকের শব্দে ভেসে আসে এক ঘোষণার কণ্ঠ—“পরবর্তী সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির অনুশীলন শুরু হবে সন্ধ্যা ছ’টায়। কৃপা মৈত্র ও তার দল আগামীকাল সকাল ন’টার মধ্যেই মহড়া শুরু করবেন।” আবার সেই কণ্ঠ। অরিত্র জানে, আবারও সে দেখা পাবে। সেদিন রাতে বাড়ির উঠোনে বসে মা যখন রাঁধছেন, তখন সে জিজ্ঞেস করে, “পাশের বাড়ির মেয়ে, কৃপা—ও কি এখানে থাকে অনেকদিন?” মা বলে, “হ্যাঁ রে, খুব ভালো মেয়ে। গান শেখায়, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে নিজের সংসার সামলায়। একেবারে নিজের মতো মেয়ে। তোকে ভালো লাগছে?” অরিত্র একটু হেসে বলে, “ভালো লাগছে না মানে? ওই কণ্ঠটা তো একবার শুনলেই মনের মধ্যে গান হয়ে থাকে।” মা একটু অবাক হলেও কিছু বলে না। বুঝতে পারে—ছেলের চোখে আবার কোনো আলো পড়েছে।
পরদিন খুব সকালে অরিত্র বেরোয়। সঙ্গে ক্যামেরা আর একটা পুরনো নোটবুক। সে ঠিক করেছে আজ সে কৃপার কথা লিখবে। সে ওর নাম জানে, কিন্তু ওর চোখের ভাষা পড়তে চায়। পুজোর ক’টা দিনেই যদি একটা মনের শহর গড়ে ওঠে, সে শহরের পথঘাট বুঝতে হলে সে লিখবে। মণ্ডপের কোণায় দাঁড়িয়ে সে দেখে—কৃপা সাদা সালোয়ার পরে, চুল বেঁধে, হাতে হারমোনিয়াম নিয়ে অনুশীলনে বসেছে। ‘বরণৰ তোরে’ গাইছে। অরিত্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। সে অনুভব করে, শরৎকাল কেবল ঋতু নয়, শরৎকাল হৃদয়ের সুর হয়ে ওঠে যদি কৃপার মতো কেউ গায়। হঠাৎ কৃপার চোখ পড়ে তার দিকে। সে একটু থেমে যায়, হেসে বলে—“আপনি ক্যামেরা নিয়ে সকাল সকাল হাজির?” অরিত্র প্রথমবার সরাসরি উত্তর দেয়—“তোমার গলার সুর তো শুধু ক্যামেরা নয়, মনে চেপে বসে। লিখছি তোমাকে নিয়ে।” কৃপা চমকে যায়, কিন্তু তার মুখে হাসি। বলে, “তবে এবার গানের ফাঁকে বসে পড়ে দেখো, কীরকম লাগছে।” দুই অচেনা মানুষ যেন হঠাৎ করে একই বইয়ের পাতায় এসে পড়ে। কোনও ভূমিকা ছাড়া, কোনও শেষের চিন্তা ছাড়াই।
(৩)
সপ্তমীর সকাল। শ্যামপুকুর প্যান্ডেল তখন গন্ধে-মালায়-আলোয় এক মোহময় জাদু। ধুপকাঠির ধোঁয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে, বাতাসে গন্ধ—শিউলি, গাঁদা আর প্রণামের মিষ্টি ফুল। ঠাকুরের সামনে বসে কাঁসর, শঙ্খ আর ঢাকের তালে সকালটা যেন এক অলৌকিক অভিষেক হয়ে উঠেছে। অরিত্র ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছে আজ, মনে হচ্ছে নিজের মধ্যেই একটা ভিন্ন মানুষ সে হয়ে গেছে। পায়ের নিচে কাঁদামাটির আলপনা, সামনের চোখে পূজার বিশাল প্রতিমা, তার পাশে ছোট ছোট প্রদীপ। কিছুটা দূরে কৃপা বসে আছে, তার পরনে হালকা রঙের শাড়ি, চোখে বিনা প্রসাধনের এক অনন্য আলো। সে আজ তার দাদুর পাশে বসে, ঠাকুরকে প্রণাম করে, আর নিঃশব্দে কিছু বলে চলেছে, হয়তো কোনও মন্ত্র উচ্চারণ করছে, অথবা মনে মনে তার মৃত বাবার কথা ভাবছে। অরিত্র দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, দেখে যে ঠিক পূজোর এই মাঝখানেও, শঙ্খধ্বনির মধ্যে কৃপা যেন এক ভিন্ন জগতে চলে গেছে। একসময় তাদের চোখ মেলে, আর তখনকার সেই মুহূর্তটা ঠিক যেন সময়কে আটকে ফেলে—চোখে চোখ রাখা, কিছু না বলা, অথচ অনেক কিছু বলা। পুজো শেষে প্রসাদ নিতে গিয়ে দু’জন আবার মুখোমুখি হয়। একি কাকতালীয়? না কি কোনও অদৃশ্য ছায়া তাদের একই লাইনে এনে দাঁড় করিয়েছে?
“আপনিও অঞ্জলি দিলেন?” কৃপার প্রশ্ন, স্বভাবসুলভ সহজতার সাথে।
“হ্যাঁ, অনেক বছর পর এখানে অঞ্জলি দিলাম। বিদেশে এমন করে কখনো হয় না।”
“আপনি বাইরে থাকেন?”
“হ্যাঁ, কানাডায়। ছোটবেলায় এখানেই থাকতাম, তবে আজকাল… কাজের সূত্রে অনেক দূরে। কিন্তু শরৎ আসলেই মন ফিরে আসে এই পাড়াতেই।”
কৃপা হেসে বলে, “তাই তো ভাবছিলাম, মুখটা একেবারেই চেনা নয়। পাড়ার মানুষ না হলে কেউ এমন করে ঢাকের তালে তালে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।”
অরিত্র হাসে। বলে, “তুমি গান করো?”
“হ্যাঁ, রবীন্দ্রসঙ্গীত… আর কিছু লোকগান। ছোটবেলা থেকে এই পুজোর সাংস্কৃতিক অংশের দায়িত্বই আমার ওপর ছিল।”
সেদিন দুপুর অবধি তাদের কথা হয়—প্যান্ডেলের পাশের অস্থায়ী চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে। আশেপাশে ঢাক, হালকা বৃষ্টি, আর মাঝেমধ্যে হাওয়ায় উড়ে আসা শিউলির গন্ধ। দুই মানুষ যেন একে অপরের সাথে এমন ভাবে কথা বলে, যেন বহু বছর ধরে পরিচিত, অথচ দুজনের মনের ভিতরেই একটা ছোট কৌতূহল নড়েচড়ে বসে—এই সম্পর্কের নাম কী?
বিকেলের দিকে বৃষ্টি নামে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে প্যান্ডেলের নিচে সবাই গুটিয়ে বসে যায়। অরিত্র ও কৃপা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, দুজনেই চুপ। বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালে, ছাদ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ছোট ফোঁটার মতো। সেই সময়ে, অরিত্র হঠাৎ করে বলে ওঠে—“জানো, আমি এখানে এসেছি ছুটি কাটাতে, কিন্তু মন বলছে… অন্য কিছু খুঁজতে এসেছি।”
কৃপা চমকে তাকায়। “তোমার মন কী খুঁজছে?”
“তোমার গান, তোমার ছাদে বসে শিউলি কুঁড়োনো দৃশ্য… এবং সেই সকালগুলো, যেগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”
কৃপা একটু থেমে বলে, “তবে মনে রেখো, কলকাতার সকাল অনেক কিছু দেয়, কিন্তু সবসময় ধরে রাখতে দেয় না।”
এই কথার ভেতরেই একটা সাবধানতা, একটা অনুভব। সেই মুহূর্তেই হাওয়ার ধাক্কায় এক মুঠো শিউলি গাছ থেকে পড়ে যায় প্যান্ডেলের সামনের জমিতে। অরিত্র নিচু হয়ে একটা ফুল কুড়িয়ে কৃপার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“তবে এইটা রাখো… মনে পড়লে বোঝা যাবে, শরতের একটা ভোর আমার কাছে কেমন ছিল।”
কৃপা কিছু না বলে, হাতে ফুলটা নেয়। তারা আর কথা বলে না। দুজনেই বুঝে ফেলে, সম্পর্কের শুরু কখনও বড় ঘোষণা দিয়ে হয় না—এটা হয় এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো, অথবা একটি শিউলি ফুলের নীরব বিনিময়ে।
(৪)
শ্যামপুকুরের পুজো সন্ধ্যাগুলো যেন আলাদা কোনও জগতের অন্তর্গত—যেখানে সময় কেমন যেন থমকে যায়, গলি আর বাড়ির জানালাগুলো আলোয় জ্বলজ্বল করে, প্রতিটা মুখে হাসি, আর বাতাসে বাজে পুরোনো দিনের সেই চেনা সুর। পাড়ার রাস্তা ছোট ছোট রঙিন ফেস্টুনে ভরা, দোকানের সামনে কলার থোড় আর আলপনা আঁকা, আর ঠিক সন্ধে নামার আগে—সেই মন্দিরঘেরা গন্ধ। ঢাকিদের প্র্যাকটিস চলাকালীন, অরিত্র হাঁটছিল পাড়ার পুরনো গলি ধরে। এমনভাবে হাঁটছিল যেন প্রতিটা জানালা, প্রতিটা দরজা তাকে চিনে রেখেছে বহুদিন আগের থেকে। হঠাৎ একটা দোতলার বারান্দা থেকে কাশফুলের মতো সাদা কাগজ উড়ে এসে তার গায়ে লাগে। তুলে দেখে—একটা শিশু লিখেছে “শারদ শুভেচ্ছা।” অরিত্র হেসে ফেলে। রাস্তার একপাশে তখন প্যান্ডেলের আলোগুলো একে একে জ্বলে উঠছে। সেই আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায় না, বরং সে অনুভব করে এই শহরের সমস্ত আলো যেন একসঙ্গে ফিরে এসেছে তার স্মৃতির পাতায়। পেছনে হঠাৎ পায়ের শব্দ—সে ঘুরে দাঁড়াতেই কৃপা, আজ নতুন করে সাজানো রূপে, নীল পাড় সাদা শাড়িতে দাঁড়িয়ে। তার কপালে ছোট্ট লাল টিপ, আর হাতে একটা নোটবুক। বলল, “আমি একটু গানের লাইন লিখছিলাম… তখনই দেখলাম তুমি রাস্তায় হাঁটছো।” অরিত্র হেসে বলে, “আমি আসলে খুঁজছিলাম সেই গলিটা, যেখানে এক সময় কানের দুল হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর আমার বোন আমাকে খুব বকা দিয়েছিল।” কৃপা হাসে—“তুমি খুব গল্প বলো বুঝি?” অরিত্র বলে, “তুমি কিন্তু আমার গল্পের মধ্যেই ঢুকে পড়েছো।” কৃপা থেমে যায়, তার চোখে একটু ধাঁধা, আবার মৃদু প্রশ্রয়।
প্যান্ডেলের ভিতরে তখন কাসরের শব্দে সন্ধ্যার আরতির আয়োজন চলছে। আলোয় ঠাকুরের মুখ যেন আরও বেশি জ্যোতির্ময়, আর ধূপের ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ঘুরছে চারপাশে। কৃপা ও অরিত্র একসঙ্গে দাঁড়িয়ে, দু’জনেই চুপচাপ। তারা কোনও ভক্তি-ক্লান্তি না নিয়ে, ঠাকুরের চোখে চোখ রাখে। যেন চোখের ভিতর ঢুকে আছে এক নদী—যার জলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের স্রোত একসঙ্গে বয়ে যায়। আরতির শেষে সবাই প্রসাদ পেতে ভিড় করে, কিন্তু তারা দু’জন একটা নির্জন কোণে দাঁড়িয়ে থাকে, সামান্য দূরে। হঠাৎই মণ্ডপের ভিতরে আলোর সমস্যা হয়—হালকা ঝিকমিক, আর সেই মুহূর্তে কৃপার হাত অরিত্রর হাতের পাশে এসে পড়ে। একটা আলতো স্পর্শ, একটুও পরিকল্পিত নয়, তবু যেন কতকিছু বলে যায়। “আমার ভয় লাগে এই হঠাৎ অন্ধকারে,” কৃপা বলে নিচু গলায়। অরিত্র জবাব দেয় না, শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ফিরে আসে, শব্দ, গান, আর উচ্ছ্বাস ফিরে আসে, কিন্তু কৃপা ও অরিত্র তখনও কিছুটা থেমে থাকে সেই মুহূর্তে, যেখানে একটা সম্পর্কের ক্ষুদ্র চিহ্ন পড়ে গেছে—যেটা হয়তো তারা কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না, তবু ভিতরে ভিতরে তারা জানে—এই শহর শুধু পূজোর নয়, এটা চেনা হয়ে ওঠার শহর।
সন্ধ্যার শেষ ভাগে প্যান্ডেলের পাশে কফির দোকানে বসে দু’জনে কফির কাপ হাতে নেয়। “তুমি বিদেশে এত বছর থেকেও বাংলা এত ভালো বলো!” কৃপা বলে হেসে। অরিত্র বলে, “ভাষাটা রয়ে গিয়েছিল, শুধু উচ্চারণে একটু খোঁচা লেগেছে। কিন্তু কথা বলার ইচ্ছেটা গেছে না। আমি কানাডায় যতদিন থেকেছি, বাংলা গান, বাংলা কবিতা আর পুজোর স্মৃতি—এই তিনটিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।” কৃপা একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “তুমি ভাবছো, এই পুজো শেষ হলে আবার চলে যাবে, তাই তো?” অরিত্র মুখ তুলে তাকায়, একটু বিস্ময়ে। “হ্যাঁ… জানি আমাকে ফিরতেই হবে। কিন্তু… মনে হচ্ছে এই শহর যেন আমাকে ছেড়ে দিতে চাইছে না।” কৃপা ধীরে বলে, “তবে তুমি তো জানো, শরতের মেঘ স্থায়ী হয় না… সে আসে, আর সরে যায়… ঠিক যেমন পূজোর দিনগুলো।” অরিত্র মাথা নোয়ায়, বুঝতে পারে—এই সম্পর্কের ভিতরেও আছে সেই মেঘের মতোই হালকা, অথচ গভীরতা, যা বলে যায়: হয়তো তুমি আমার হাওয়ায় ভেসে এসেছো, কিন্তু চিরকাল এখানে থেকে যাবে না। তবুও সেই সন্ধ্যা, সেই আলো, সেই চোখে চোখ রাখা—সবকিছু গেঁথে যায় কফির কাপে, চুপ করে বসে থাকা দুই মানুষের মধ্যে। এবং তারা জানে, এই সংক্ষিপ্ততাতেই প্রেমের সত্যতা লুকিয়ে থাকে।
(৫)
সপ্তমীর রাত, আর প্যান্ডেলে তখন থিকথিক করছে ভিড়—রঙিন আলো, বাচ্চাদের উচ্ছ্বাস, আর মাঝেমধ্যে মাইকের আওয়াজে ভেসে আসছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঘোষণা। প্যান্ডেলের ঠিক পাশে, যেখানে ছোট্ট একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে, সেখানে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃপা। সাদা শাড়ির নিচে তার পায়ে আজ আলতা, লাল একেবারে ঘন করে পরা, যেন পদ্মপাতায় রক্ত ফোঁটা। তার চোখে আজ একটা আলাদা তীব্রতা—না সেটা জোরে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নয়, বরং যেন নিজের ভিতরের কোনও চাপা সুর ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা। অরিত্র তখন সামনে বসে, একেবারে দর্শকদের সারির মাঝামাঝি। তার চোখে ক্যামেরা নেই, আজ সে সবকিছু নিজের চোখ দিয়ে দেখতে চায়—একটি গান, একটুখানি সন্ধ্যা, আর সেই মেয়েটিকে যার কণ্ঠে সে নিজের মনের চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছে। ঠিক আটটা বেজে গেলে আলো একটু কমিয়ে মঞ্চে ফোকাস পড়ে, আর হালকা সুরে হারমোনিয়াম বাজতে থাকে। তারপর নীরবতা… আর সেই নীরবতাকে ছেঁড়ে কৃপা গাইতে শুরু করে—“আমার হিয়া জুরায়ে…”। অরিত্রর মনে হয়, সময় থেমে গেছে। তার মনে হয় এই মূহূর্তে চারপাশের সব শব্দ, আলো, মানুষের কোলাহল—সব নিঃশব্দ হয়ে কেবল মাত্র সেই গানের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। গান গাইতে গাইতে কৃপা একবার চোখ তুলে তাকায়—অরিত্রর চোখের দিকে। সেই মুহূর্তে যেন মঞ্চ থেকে আলো নামে সরাসরি ওদের মাঝখানে, এবং চোখের ভিতর দিয়ে তারা নিজেদের স্পর্শ করে।
গান শেষ হলে কৃপা কিছুক্ষণ মঞ্চেই বসে থাকে, যেন তার কণ্ঠস্বর এখনো ফিরে আসেনি মাটিতে। দর্শকসারিতে করতালির শব্দ, তবে অরিত্র চুপ। তার হাত যেন বেঁধে গেছে, সে শুধু তাকিয়ে থাকে। কৃপা যখন নেমে আসে মঞ্চ থেকে, তাকে ঘিরে ধরে অনেকে—বাহবা, ছবি তোলা, প্রশংসার ঢেউ। কিন্তু তার চোখ খুঁজে নেয় একটা চেনা মুখ। অবশেষে এক ফাঁকে তারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ায় প্যান্ডেলের এক কোণায়, আলো-ছায়ার মধ্যখানে। “গানটা শুনে…”—অরিত্র শুরু করতেই কৃপা বলে, “তোমার চোখের ভাষা আগেই বলেছে।” তারা দুজনেই হেসে ফেলে, সেই হেসে ফেলার ভিতরে একটা স্নিগ্ধতা থাকে—যা প্রথাগত পরিচয়ের বাইরে। সেই মুহূর্তে অরিত্র ধীরে বলে, “তুমি যখন গাইছিলে, আমার মনে হচ্ছিল তুমি আমার জীবনের এমন এক পৃষ্ঠা পড়ছো, যেটা আমি কারো সঙ্গে কখনো ভাগ করিনি।” কৃপা তখন চুপ। কিছুক্ষণ পর হালকা গলায় বলে, “আমার গানের মধ্যে তুমি থাকো?” অরিত্র বলে, “থাকি… খুব নীরবে।” সেই কথার ভিতরেই কৃপা একটু ঝুঁকে আলতো করে বলে, “তবে জানো, এই গানগুলো আমি কারো জন্যই গাই না। আজকে আমি গেয়েছি, কারণ তুমি সামনে বসেছিলে।” অরিত্র কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার উপরে তখন প্যান্ডেলের আলো, দূরে ঢাকের শেষ তাল, আর মাঝখানে শিউলি পাতার গন্ধ—তারা দু’জন যেন দাঁড়িয়ে থাকে সেইসব পুরনো প্রেমগাথার কোনও পঙক্তির পাশে।
রাতের শেষে, তারা হাঁটছিল পুজো মণ্ডপ থেকে বাড়ির দিকে—পাশাপাশি, অথচ একটু দূরে, যেন শব্দে ব্যাখ্যা না করে দুজনেই হাওয়ায় কথা বলছে। কৃপা বলল, “জানো, আমি অনেক বছর ধরেই এই পূজোয় গান গাই। সবাই বলে, সুন্দর লাগে। কিন্তু আজ রাতে প্রথম মনে হলো… আমি কাউকে উদ্দেশ্য করে গাইছি। নিজের মন খুলে দিচ্ছি।” অরিত্র হেঁটে যেতে যেতে বলে, “তবে সেই কেউ কি সেই কানাডা ফেরত অচেনা ছেলে?” কৃপা একটু থেমে বলে, “অচেনা নয়, বরং পুরনো—যাকে চেনা ছিল, শুধু সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল। তুমি বুঝতে পারছো না, কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বললে মনে হয় যেন একটা আটকে থাকা গল্প শেষ পর্যন্ত ভেসে উঠছে।” তখন বাতাসে ভাসে সেই পুরনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের টুকরো লাইন—“তোমায় গেঁথেছি, আমার বর্ণমালার অলিতে গাঁথা…”। পায়ের নিচে শিউলি পড়ে আছে, আর ওদের দুজনের পায়ের ছাপ পড়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে। সেই রাতে কৃপা ঘরে ফিরে গিয়ে যখন চুল খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, দেখে—তার চোখে এক ধরণের দীপ্তি, যা কোনও গান বা মঞ্চ এনে দেয় না, যা শুধু একজন মানুষের চুপচাপ তাকানোর ভেতর দিয়ে হৃদয় স্পর্শ করে। আর অরিত্র ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—আজকের গান কেবল কৃপার কণ্ঠে নয়, ওর মনের গোপন দরজাতেও বাজছে।
(৬)
অষ্টমীর সকাল আসে এক বিষণ্ণ রূপে। আকাশে সাদা মেঘের দল, কিন্তু যেন আগের দিনের মতো আনন্দী নয়—বরং সেই মেঘগুলো যেন নিজের গন্তব্য খুঁজে না পেয়ে দিকভ্রান্ত। অরিত্র উঠেই ছাদে চলে আসে, কৃপা কী করছে জানার একটা অদৃশ্য টান টের পায় বুকের গভীরে। পাশের ছাদ তখন খালি, কৃপা নেই, বেড়ালটাও ঘুমিয়ে নেই। অরিত্রর মনটা হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে—জানলাতেও কৃপার মুখ নেই, প্যান্ডেলেও খোঁজে, মঞ্চের ধারে, আলপনার পাশে, যেখানেই চোখ পড়ে—সেখানে কৃপার অনুপস্থিতিই স্পষ্ট। ঠিক তখন সৌম্য এসে বলে, “কৃপা আজ একটু দেরি করে আসবে, বাবার মৃত্যুবার্ষিকী… সকালবেলা বাড়িতে পুজো হয়।” অরিত্র কেমন যেন চুপসে যায়, যেন বুকের মধ্যে কিছু একটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠেছে। তার মনে পড়ে, আগের রাতে কৃপা বলেছিল—“আমি কাউকে উদ্দেশ্য করে গাইনি কখনও, কিন্তু আজ গেয়েছি…” এইসব স্মৃতি গুলিয়ে যায়, আর তার ভিতরে তৈরি হয় একটা অদ্ভুত শূন্যতা। সে ভাবে—এই শহরের ভেতরে সে হারিয়ে যেতে চাইছিল, এখন সেই হারিয়ে যাওয়া যেন কারো স্পর্শ ছাড়া অসম্পূর্ণ। দুপুরে অবশেষে কৃপা আসে, সাদা সালোয়ারে, চোখে ক্লান্তি। মণ্ডপের কোণে ওদের দেখা হয়। কৃপা বলে, “আজ একটু দেরি হলো, মনে রেখো না?” অরিত্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “মনে রেখেছি বলেই তো খুঁজে গেছি। জানো কৃপা, তোমার না থাকাটা আজ শহরটাকে অচেনা লাগাল।” কৃপা চুপ করে তাকিয়ে থাকে তার চোখে। বলে, “তুমি জানো না, কিন্তু আমি অনেকবার ভেবেছি—তোমাকে যতটা চিনি মনে হয়, বাস্তবে তো চিনি না। অথচ মনের ভিতর তুমি এমনভাবে বসে পড়েছো, যেন তোমার না থাকাটা এখন অসম্ভব।”
সেই দিন বিকেলে তারা গিয়েছিল নদীর ধারে—ঘাটে পায়ে হেঁটে হেঁটে। চারপাশে পুজোর উচ্ছ্বাস থাকলেও, গঙ্গার জল যেন দু’জনের ভেতরের কথাগুলো বেশি স্পষ্টভাবে শোনে। অরিত্র হঠাৎ বলে, “তুমি যদি বলো, আমি থেকে যেতে পারি।” কৃপা তার দিকে তাকায় না, শুধুই বলে, “তোমার থাকার সঙ্গে তোমার ইচ্ছেটা যদি সত্যি হয়, তবেই থাকো। আমি চাই না কোনও আবেগজর্জর সিদ্ধান্ত হোক, কারণ তুমি এই শহরে ভালোবাসা খুঁজতে এসে মায়ায় জড়িয়ে পড়েছো।” অরিত্র এক পা সামনে এগিয়ে বলে, “তুমি কি সেটা, যে আমার এই সফরের শেষগন্তব্য?” কৃপা থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখ ভিজে যায়, সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমি নিজেই জানি না আমি কার গল্পের নায়িকা। শুধু এটুকু জানি, এই কয়েকদিনে তুমিই সেই মানুষ, যার জন্য প্রতিটা গান মনে হচ্ছে নতুন করে গাইছি, প্রতিটা সকাল মনে হচ্ছে নতুন করে বাঁচছি।” সেই সময়, নদীর হাওয়া যেন ওদের কথাগুলো নিজের সুরে বেঁধে নেয়। পাশে পড়ে থাকা একটি শুকনো শালপাতা ধীরে জলে ভেসে যায়। কৃপা বলে, “তুমি ভাবছো সবকিছু খুব দ্রুত ঘটছে, কিন্তু প্রেম তো ক্যালেন্ডার দেখে আসে না। সে তো কেবল হৃদয়ের ছন্দে আসে।” অরিত্র কিছু বলে না। কৃপার চোখে তখন একটা ভয়—এই সম্পর্ক কি সত্যিই দাঁড়াবে, না পুজোর শেষে হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাবে?
রাত বাড়ে, পুজোর আনন্দ আকাশ ছুঁয়ে যায়। ঢাকিদের তাল, আলোর রোশনাই, চারপাশে হইহুল্লোড়—সবই চলছে, অথচ কৃপা আর অরিত্র ধীরে সরে আসে ভিড়ের বাইরে। মণ্ডপের পিছনে একটা নির্জন কোণে বসে থাকে দু’জনে। সেখানে হাওয়া বেশি, আলো কম। কৃপা বলে, “তুমি ভাবছো দূরত্ব আর সময় আমাদের ভাগ্য লিখে দেবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কখনো এমন অনুভব করিনি কারো জন্য। তবুও ভয় হয়—এই প্রেমটা কি সত্যিই পেরোবে দূরত্বের সীমানা?” অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি তোকে নিয়ে কোথাও যেতে চাই না, কৃপা। আমি তোকে তোর জায়গাতেই ভালোবাসতে শিখেছি—এই শিউলিপাতা উঠোনে, এই ছাদের ধারে, এই গানভরা চোখে। আমি তোকে এখানেই ভালোবাসি।” কৃপা তার চোখে চেয়ে থাকে, ধীরে হাতে হাত রাখে। সেই মুহূর্তে তারা বুঝে ফেলে—এই ভালোবাসা শুধু শরতের নয়, এই ভালোবাসা সেইসব দিনের, যেখানে মানুষ অচেনা অজুহাতে পরিচিত হয়ে যায়। তারা একসাথে বসে থাকে অনেকক্ষণ—কোনও কথা নয়, শুধু স্পর্শের ভেতরেই একটা অচেনা, অথচ অদ্ভুতভাবে চেনা টান বুনে যায়।
(৭)
নবমীর সকাল। ঢাকের তালে আবার জেগে উঠেছে পাড়াটা, কিন্তু আজকে কেমন যেন একটা ভার ছড়িয়ে আছে বাতাসে—ঠিক যেন উৎসবের ভেতরেও একটা অনুজ্জ্বলতা। প্যান্ডেলের চারপাশে শঙ্খধ্বনি, প্রভাতী আরতি, আর ফুলে ভরা থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা—সবকিছু স্বাভাবিক, কিন্তু অরিত্রর চোখ শুধু কৃপাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজ সেই অঞ্জলির সকাল, যে দিন সবাই নিজের মনের প্রার্থনা মুঠোবন্দি করে ঠাকুরের পায়ে রাখে। মঞ্চে আজও কৃপা নেই, ছাদেও দেখা যায়নি। প্যান্ডেলের এক পাশে দাঁড়িয়ে অরিত্র চুপ করে থাকে—হাতে অঞ্জলির ফুল, আর মনে কেবল একটাই নাম। ঠিক সেই মুহূর্তে ভিড় ফাঁক করে আসে কৃপা—আজ একেবারে অন্যরকম রূপে। তার পরনে সাদাচুড়ি আর লাল পাড় সাদা শাড়ি, চোখে শূন্যতা আর ঠোঁটে কোনো সাজ নয়—একটা চাপা ক্লান্তি। সে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ঠাকুরের কাছে, দু’হাত জোড় করে প্রণাম করে, আর তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে অঞ্জলি দেয়। অরিত্র তাকিয়ে থাকে—যেন এই মুহূর্তে কৃপা কোনও দেবী নয়, কোনও কাহিনির অংশ নয়—সে কেবল একজন মানুষ, যে তার সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত না বলা কথা এই ফুলের থালায় মিশিয়ে ঠাকুরের কাছে রেখে যাচ্ছে। তার চোখ দিয়ে ধীরে অশ্রু গড়ায়, কিন্তু সে মুছে না—কারণ হয়তো সে জানে, কিছু অশ্রু ঠিক ওইভাবে পড়তেই হয়।
অঞ্জলি শেষ হতেই প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে চলে যায় কৃপা। অরিত্র ওকে অনুসরণ করে, এবং এক নির্জন কোণে গিয়ে ধীরে তার পাশে দাঁড়ায়। তারা কিছুক্ষণ কিছু বলে না। কৃপার চোখে তখনও কিছু জল, অরিত্র জিজ্ঞেস করে না কিছু—শুধু বলে, “তোমার চোখে জল দেখে আজ মনে হলো, আমার চোখেও জ্বালা হচ্ছে।” কৃপা নিচু গলায় বলে, “আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী নয়… আজ তার শেষবারের মতো পুজোতে অংশ নেওয়ার দিন ছিল, যেদিন আমি গিয়েছিলাম স্কুলে, আর ফিরে এসে দেখি, সে নেই।” অরিত্র স্তব্ধ হয়ে যায়। কৃপা বলে চলে, “প্রতি নবমী আমার মনে করিয়ে দেয়, কারও অপ্রত্যাশিত বিদায় কেমন হয়। তুমি ফিরবে—তাও জানি। কিন্তু মন চাইছে না বিদায় নিতে।” অরিত্র চুপ করে শুনে, তারপর হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরে। বলে, “তুমি যদি বলো, আমি এখানে থেকেই যাই… তবে আমার বিদেশ ফেরা দরকার নেই। শুধু তুমি বলো, ‘থেকে যাও।’” কৃপা মাথা নাড়ে, “তুমি থাকবে না, আমি জানি। তুমি কবিতা, আর কবিতা থেকে কেউ সংসার চায় না।” সেই কথাটা শুনেই অরিত্রর চোখে জল আসে। কিন্তু সে কিছু বলে না, শুধু ওর হাতটা আর একটু শক্ত করে ধরে রাখে, যেন এই মুহূর্তে সে কৃপার কষ্টটাকে নিজের ভেতর ছেঁকে নিতে চায়। এবং সেই থমথমে সকালটা এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওদের দু’জনের মাঝখানে—অঞ্জলি আর অশ্রুর সীমানায়।
বিকেল গড়ালে শহর আবার আলোয় সেজে ওঠে। ঢাকের তালে তালে সন্ধ্যার প্রস্তুতি চলে, আর সবাই ব্যস্ত—কিন্তু কৃপা ও অরিত্র একটুও বদলায় না। তারা দু’জনেই জানে, পূজোর অন্তিম সময় এগিয়ে আসছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কোনও কিছু চিরতরে মুছে যাবে। সন্ধ্যায় মণ্ডপের পিছনে আবার দেখা হয় দু’জনের। কৃপা বলে, “আজ রাতে একটা গান গাইব—শেষবারের মতো।” অরিত্র বলে, “তুমি গান গাও, আর আমি তেমনি করে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি।” তারপর সন্ধ্যায় সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কৃপা গায়—“যদি তারে নাই চিনি গো… সে কী করে মোর হয়…”। আর অরিত্র দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক আগের মতো, কিন্তু এবার চোখে জল। গান শেষে কৃপা মঞ্চ থেকে নেমে ওর দিকে আসে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বলে, “ভালোবেসো, কিন্তু আটকে রেখো না।” অরিত্র বলে, “তোমায় আমি মুক্তই ভালোবাসি।” এবং সেই অন্ধকারে, এক ঝলক হাওয়ার সঙ্গে, ওদের চোখে দেখা যায় না বলা প্রেমের সবচেয়ে সত্য রূপ—নিঃশব্দে প্রবাহিত হওয়া, যেমন অঞ্জলি আর অশ্রু…।
(৮)
দশমীর সকাল। প্যান্ডেলে তখন ঢাকের শেষ তাল, বিজয়ার প্রস্তুতি, ঠাকুরের চরণে সিঁদুর-দানের রঙিন আবেগ। মেয়েরা লাল পাড় শাড়িতে, কপালে টিপ, হাতে শঙ্খের শব্দ আর চোখে জল—এক বিষাদের সৌন্দর্যে আবিষ্ট করে রেখেছে গোটা পাড়া। চারপাশের আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে একটা ক্লান্তি আছে, একটা ফুরিয়ে আসার গন্ধ আছে। শহর জানে আজ বিদায়ের দিন, কিন্তু এই বিদায় যেন কারও একার নয়—সবাই কিছু না কিছু ছেড়ে দিচ্ছে, ভেঙে পড়ছে ভিতরে ভিতরে। অরিত্র আজ ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে জিনস আর কুর্তায় এসেছে—তাকে দেখে বোঝা যায়, এবার সে সত্যিই প্রস্তুত, হয়তো বিদায়ের জন্য, হয়তো কোনও অজানা অস্থিরতার সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য। সে মণ্ডপের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখে, দেবীর মুখের দিকে কেউ কেউ জল ছিটিয়ে দিচ্ছে—ভাসান হবে আর কিছুক্ষণ পর। তার চোখ খোঁজে কৃপাকে, অথচ আজ কোথাও নেই সে। না ছাদে, না প্যান্ডেলে, না জানালায়। অরিত্রর মনটা ভারী হয়ে ওঠে। এমন কি আজও সে আসবে না? বিজয়ার দিন যে শুধুই দেবীকে বিদায় নয়, তা সে কৃপা জানে না?
ঠিক সেই সময় শঙ্খ বাজে, এবং কৃপা আসে ধীরে ধীরে, শাড়ির আঁচলে মাথা ঢেকে, চোখে কাজল গলিয়ে। তার হাতে এক থালা সিঁদুর, অন্য হাতে এক মুঠো শিউলি ফুল। সে সবার মাঝে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে, তারপর মূর্তির পায়ে ফুল রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে অনেকক্ষণ। অরিত্র একটু এগিয়ে যায়, কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দু’জনের চোখ মেলে, এক চুপ থাকা রয়ে যায় মাঝখানে। কৃপা হালকা গলায় বলে, “শেষটা অনেক বেশি কঠিন, জানো?” অরিত্র বলে, “শেষটা তখনই কঠিন, যখন তা শেষ নয়, বরং একটা শুরু।” কৃপা একটা শিউলি তুলে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “নাও, এইটা রেখে দিও… মনে করিয়ে দেবে এই পুজোর সবকিছু। আমি জানি তুমি ফিরে যাবে, তাও চাই, যেন মনে থাকে এই শহরের এক টুকরো সকাল।” অরিত্র হাতে নেয় সেই শিউলি—যা যেন একসঙ্গে গান, গল্প, ছুঁয়ে যাওয়া আর চোখের ভাষা। তাদের কথা কেউ শুনছে না, চারপাশে ঢাক, মাইকের আওয়াজ, নারীসঙ্গীতের আবৃত্তি—সবকিছু সুরে, কিন্তু এই নিরবতা যেন সবচেয়ে গাঢ়। অরিত্র বলে, “তুমি থেকো, কৃপা… এই শহরটা যদি কখনো আবার আমাকে ফিরিয়ে আনে, যেন জানি, তুমি এখানে আছো—ছাদে বসে শিউলি কুড়োচ্ছো, কিংবা গাইছো সন্ধ্যের গান।” কৃপা কিছু বলে না, শুধু মাথা নেড়ে, হালকা করে একটা হাসি দেয়—যেটা ঠিক চোখে জল লুকিয়ে রাখা হাসি নয়, বরং সেই ধরনের হাসি, যেটা কোনও শেষের মাঝেও আশা বুনে দেয়।
বিকেলে ভাসানের শোভাযাত্রা নামে রাস্তায়। ঠাকুর বরণ হয়ে গেছেন, মুখে সিঁদুরের ছোঁয়া, আর চোখে বিদায়ের বার্তা। কৃপা ও অরিত্র একসঙ্গে হাঁটে শোভাযাত্রার পেছনে—দুজনের মাঝে একটু দূরত্ব, কিন্তু মনে একটাই টান। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে প্রতিমা বিসর্জনের মুহূর্তে, ঢাকের গর্জনে, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে, তারা বুঝে যায়—এই মুহূর্তটা চিরস্থায়ী নয়, তবু চিরদিন রয়ে যাবে তাদের হৃদয়ের ফাঁকে। প্রতিমা যখন জলে ভাসে, অরিত্র কৃপার দিকে তাকায়। বলে, “তোমার সঙ্গে আমার দেখা যেন এই শহরের শরতের মতোই—অল্প, হালকা, অথচ মন কেমন করানো। তুমি যদি থাকো, আমি একদিন ফিরব।” কৃপা চোখে জল চেপে বলে, “আমি থাকব… ছাদের কোণায়, শিউলি গাছের নিচে, অথবা সন্ধ্যার গান গাইতে গাইতে তোমার নাম মনে করে।” তারপর তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে গঙ্গার জল, আলো, ফুল আর বিদায়ের শব্দ মিলেমিশে এক অপার শান্তি এনে দেয়। সেই সন্ধ্যায় অরিত্র ফিরে যায়—হয়তো তার জীবনে, কিন্তু কৃপার মনে থেকে যায় এক অপূর্ণতার মৃদু পঙক্তি হয়ে, শরতের সাদা মেঘে লেখা সেই প্রেম, যা সবার চোখে পড়ে না… কিন্তু একবার চোখে পড়লে আর ভোলা যায় না।
বছর কেটে গেছে। পুজো এসেছে আবার, কলকাতার আকাশে ভেসে উঠেছে সেই চেনা শরতের সাদা মেঘ, আর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে ঢাকের তীব্র, হৃদয় কাঁপানো সুর। শ্যামপুকুর পাড়ায় আজও আলো জ্বলেছে, আলপনায় সাজানো উঠোনে শিউলি ঝরে পড়ছে ঠিক আগের বছরের মতোই। ছাদে বসে কৃপা এবার একা নয়—তার পাশে একটা ছোট্ট টেপরেকর্ডার, যেটায় বাজছে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত: “যদি তারে নাই চিনি গো, সে কী করে মোর হয়…”। আর একটা সাদা খামে মোড়া চিঠি, যা এসেছে কানাডা থেকে—অরিত্রের হাতের লেখা, তার ভেতর গুঁজে দেওয়া একটি শুকনো শিউলি ফুল। চিঠিতে লেখা: “আমি ফিরছি, কৃপা। এই শহরের গান আর তোমার চোখ দুটোকে ছাড়া আর কিছুই আমি চিনে উঠতে পারি না। এবার ফিরছি থেকে যাওয়ার জন্য, যদি তুমি এখনো গাও… আমার জন্য।” কৃপা চোখ বন্ধ করে হাসে, তার চোখে জল এসে নামে ঠোঁট ছুঁয়ে গালে। সে উঠে দাঁড়ায়, পায়ে আলতা পরা, হাতে সাদা শাড়ির আঁচল, আর ঠাকুরের সামনে এসে চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি ঠিকই বলেছিলে—শরতের প্রেম চিরকাল থাকে না, কিন্তু একবার এলে, আর মন থেকে যায় না। এবার তবে নতুন গল্প শুরু হোক, শিউলির গন্ধে।” মণ্ডপের আকাশে তখন কাশফুল উড়ছে, আর তার ভেতর দিয়ে, যেন অদৃশ্য কোনো ট্রেনে ভেসে আসছে অরিত্র—হাতভরা ফিরে আসা নিয়ে, আর কৃপার সেই একটিমাত্র অপেক্ষার উত্তর হয়ে।
___




