Bangla - প্রেমের গল্প

দেহের শেষ সত্য

Spread the love

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়


পর্ব ১

নন্দিনী জানালার কাঁচ ঘেঁষে বসে ছিল। নভেম্বরের হালকা রোদ গায়ে মেখে একটা পুরনো বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল সে, কিন্তু চোখ ছিল অনেক দূরে—ঠিক যেখানে আকাশ শহরটাকে ছুঁয়ে আছে, আর তারও পেছনে কোথাও যে প্রশ্নটা ওকে টানছে দিনের পর দিন—”এটাই কি আমার জীবন?”

বিয়ে হয়েছে দশ বছর। সঞ্জয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা স্থিত, নিরাপদ, কিন্তু অনুভবহীন। ঘরে সব আছে, হাসি নেই। বিছানায় স্পর্শ আছে, উত্তাপ নেই। নন্দিনী কখন যে নিজের শরীরকে ভুলে গিয়েছে, নিজেকে শুধু গৃহিণী, মা, আর এক নিঃশব্দ রুটিন ভেবে নিয়েছে, সে আর মনে পড়ে না।

অথচ আজ সকালেই তার মনে হয়েছে, তার শরীর এখনও চায়। তার চোখ এখনও খুঁজে ফেরে।

সে দিনটা ছিল একেবারেই সাধারণ। অফিস থেকে ফিরছিল সে, মেট্রো থেকে নেমে গলিপথ ধরে হাঁটছে। হঠাৎ কাঁধে এক টোকা। ঘুরে দেখল—অভিজিৎ। কলেজের সিনিয়র। একটা সময় প্রচুর কবিতা পড়ত ছেলেটা, চোখে ছিল দুঃখের ছায়া। বছর ছয়েক পরে দেখা।

“তুই তো একেবারেই পাল্টাসনি,” বলল অভিজিৎ, হালকা গলার স্বরে।

নন্দিনী হাসল, কিন্তু চোখে লেগে ছিল বিস্ময়। “তুই একেবারে পাল্টে গেছিস। সেই লম্বা চুল, চশমা, পাতলা গলা—সব চলে গেছে।”

অভিজিৎ একগাল হেসে বলল, “জীবন পাল্টায় নন্দিনী, শরীরও পাল্টায়। শুধু কিছু গন্ধ থেকে যায়। তোর শরীরের সেই অপরাহ্নের গন্ধটা আমি এখনো ভুলিনি।”

কথাটা যেন তার ত্বকে ছুরি চালাল। এতদিন পরে কেউ আবার তাকে তার শরীর দিয়ে চিনল, অনুভব করল, নাম ধরে ডাকল না, বরং গন্ধ দিয়ে চিনল—এমন ভাবে কেউ তাকে অনেকদিন ডাকেনি।

সেইদিন সন্ধেয় তারা একটা ক্যাফেতে বসেছিল। কিছু কথার, কিছু চায়ের ধোঁয়ার ফাঁকে পুরনো সম্পর্কগুলো আবার সরে সরে উঠছিল। অভিজিৎ এখন ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার, সারা দেশে ঘুরে বেড়ায়, সম্পর্ক মানে তার কাছে শুধুই অনুভবের মুহূর্ত।

“তোর চোখে এখনও সেই দুপুরের নরম আলোটা আছে,” বলেছিল সে।

“তুই এখনও মিথ্যে বলে যাস,” নন্দিনী হাসল, কিন্তু তার অন্তর্বাসে কোথাও যেন তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল।

“আমি মিথ্যে বলছি না,” অভিজিৎ গলার স্বর নামিয়ে বলল, “তুই নিজেই ভুলে গেছিস তোর শরীর কীরকম দেখতে ছিল। আমি দেখেছি। আজও দেখছি। আর বিশ্বাস কর, শরীরটা এখনও কথা বলে।”

সেই রাতে নন্দিনী অনেকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ত্বক, তার স্তন, তার কোমর—সব কিছুই যেন আজ নতুন করে চিনতে ইচ্ছে করছিল। অবচেতনেই সে নিজের ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দেখছিল, যেন কোথাও কেউ এখনও চুমু দিয়ে গেছে।

পরদিন থেকে তারা নিয়ম করে দেখা করতে লাগল। শহরের কোণে কোণে, ছাদে, গলিতে, অভিজিৎ তাকে ছবির মত ধরে রাখত। নন্দিনীর শরীরকে সে ছবির মতই বুঝত—আঁকত চোখে, মনে, আর মাঝে মাঝে আঙুলেও। সে বলত, “আমি তোকে কামনা করি, কিন্তু ভালবাসি না। তুই আমাকে ভালবাসিস, কিন্তু নিজের শরীরকে অবহেলা করিস। তুই জানিস না তোর শরীর কতটা জীবন্ত।”

এ কথাগুলো নন্দিনীর মনে অদ্ভুত আলোড়ন তুলত। সে বুঝতে পারত, সে এখনও চায়। তীব্রভাবে চায়।

একদিন অভিজিৎ তাকে নিয়ে গেছিল একটা গেস্টহাউসে—পুরনো দিনের মত, কিন্তু পুরনো অনুভব নয়। জানলার ধারে একখানি বিছানা, আর নীলচে আলোয় ঢাকা সেই ঘরে তারা একে অপরকে খুঁজে পেতে চেয়েছিল শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।

প্রথম স্পর্শে নন্দিনীর শরীর যেন কেঁপে উঠল। তার শরীর অভ্যস্ত ছিল সংযমে, সহনশীলতায়। কিন্তু এই স্পর্শ ছিল স্বীকৃতির, আকাঙ্ক্ষার, প্রেমের নয়—তবুও চরম সত্যের। অভিজিৎ তার স্তন ছুঁয়ে বলেছিল, “এখানে সময় জমে থাকে। আমার আঙুলে এখন তোর সময়টা বাজছে।”

তারা ঘন্টার পর ঘন্টা শরীরে কথা বলেছিল। নন্দিনী তখন আর মা নয়, স্ত্রী নয়, শুধু এক নারী—যার শরীরেও গল্প আছে, জিজ্ঞাসা আছে, উত্তর আছে। অভিজিৎ তাকে বিছানায় ফেলে বলেছিল, “এই শরীরটাই শেষ কথা, নন্দিনী। তুমি যতই ভাবো মনের সম্পর্ক, আদতে তুমি এই দেহেই জন্মাও, মরো, কামনা করো।”

সেই মুহূর্তে, সত্যিই, নন্দিনী বিশ্বাস করেছিল।

পর্ব ২

সেই রাতে গেস্টহাউসের সাদা বিছানার চাদরে যে দাগগুলো পড়েছিল, তা কেবল ঘামের বা শরীরের নয়। ওগুলো ছিল প্রতীক্ষার দাগ, বেঁচে থাকার দাগ, আত্মস্বীকৃতির দাগ। অভিজিৎ যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল—নির্ভার, শান্ত, নন্দিনী তখন জানালার ধারে চুপচাপ বসেছিল, শরীরে এক ধরনের ঝিমুনি, কিন্তু মনে এক গভীর আলোড়ন।

“এই আমিই?”—সে নিজেকেই প্রশ্ন করছিল। যে মেয়েটা এত বছর ধরে সংসার করেছে, স্বামী আর সন্তানের দায়িত্বে নিজের শরীরটাকেই বিসর্জন দিয়েছে, সে আজ একরাতে কীভাবে এতটা বাঁচতে শিখল?

সে জানত—এই সম্পর্কের নাম নেই। এখানে ভালোবাসা নেই, কেবল অনুভব আছে। তবু সেই অনুভবটাই এতদিন পরে তাকে নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছে।

পরদিন সকালবেলা যখন তারা বেরোচ্ছে, তখন অভিজিৎ তাকে বলেছিল, “নন্দিনী, তুই একা হাঁটিস। পেছন থেকে তোর পিঠ আর কোমরের রেখাগুলো আমার কাছে এখনো সিনেমার মত।”

নন্দিনী তখন হেসেছিল। কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল না কোনও লজ্জা বা ভয়। ছিল আত্মবিশ্বাস—যে সে এখনও একজন নারী, একজন কামনীয় নারী।

দিনগুলো এগোতে লাগল। তারা দেখা করত নিয়ম করে। একেকদিন একেক জায়গায়। কখনও অফিস ফাঁকি দিয়ে দুপুরে হোটেল রুমে, কখনও শহরের প্রান্তে কোন বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলে। অভিজিৎ ছবিও তুলত, কখনও নন্দিনীর চোখের, কখনও তার কাঁধের, কখনও তার নগ্ন পিঠের। প্রতিটা ছবিতে ছিল একরাশ গল্প।

“আমি এই ছবিগুলো কোথাও দেখাব না,” সে বলত। “কিন্তু তোকে দেখাব, যেন তুই বুঝিস তোর শরীর কতটা কবিতা হতে পারে।”

এভাবেই একদিন, অভিজিৎ ওর বুকের ওপর মাথা রেখে বলল, “জানিস, তোকে প্রথম যখন দেখি, তোর চোখে একটা ক্লান্তি ছিল। এখন তুই জ্বলছিস। তোকে কামনা করি, এটা আমি বারবার বলি, কিন্তু তুই নিজেই তোকে কামনা করছিস এখন। এই আত্মসন্তুষ্টি অনেক বড় জিনিস।”

সেই দিন রাতে, অভিজিৎ ওর সারা শরীরে অজস্র চুমু দিয়ে বলেছিল, “তোর দেহটা একটা খোলা চিঠির মত। আমি প্রতিদিন একেক পৃষ্ঠায় লিখছি আমার ইচ্ছের কবিতা।”

নন্দিনী সেই শব্দগুলো শরীরে ধারণ করেছিল, তীব্রভাবে। সে অভিজিতের শরীরের ভেতর দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজছিল—যেমন কেউ ঘন অন্ধকারে নিজের নাম খোঁজে।

তবে সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়।

সঞ্জয়, তার স্বামী, হয়তো কিছু টের পাচ্ছিল। সে হঠাৎ করেই বেশি কথা বলছে, বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। একদিন সন্ধেয়, সঞ্জয় ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “তুই তো আজকাল কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিস? কিছু বলবি আমাকে?”

নন্দিনী চমকে উঠেছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, “বয়স হচ্ছে, হয়তো একটু একা লাগছে।” কথাটা অর্ধসত্য। বয়স হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখন সে আগের চেয়েও বেশি বেঁচে আছে।

কিন্তু মিথ্যে চিরকাল চাপা থাকে না।

একদিন রাতে, সঞ্জয় নন্দিনীর ফোনটা হাতে পেয়েছিল। তখন ও ঘুমাচ্ছিল। একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে লেখা ছিল—“আগামীকাল সকালে তোকে ছুঁয়ে জাগাতে চাই। তোর বুকের বাঁদিকের তিলটার পাশে আমার কবিতাগুলো জমে আছে।”

সঞ্জয়ের চোখ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। কিছু বলেনি।

পরদিন সকালে সে শুধু বলেছিল, “আজ রাতে আমি ফিরতে দেরি করব।”

নন্দিনী বুঝেছিল, কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা পড়ে ফেলল। তারপর হঠাৎ গা শিউরে উঠল—কারণ এই খেলাটা আর গোপন থাকছে না।

সে দিন বিকেলে তারা দেখা করল এক পুরনো বাংলো বাড়িতে—যেখানে কেবল দেহের নয়, শরীরের স্মৃতি জমা থাকে ইটের মধ্যে। অভিজিৎ তাকে দরজা খুলেই বলল, “তুই কাঁপছিস কেন?”

নন্দিনী বলল, “সব টের পেয়ে গেছে।”

অভিজিৎ বলল না কিছু। সে শুধু সামনে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটে এক গভীর চুমু দিল। তারপর বলল, “তাহলে এবার আমাদের আরও জোরে বাঁচতে হবে। কারণ মৃত্যু সামনে এলেই শরীর তার আসল রঙ দেখায়।”

নন্দিনী জানত, ভয় এখন আর তার মধ্যে নেই। সে তার বিবাহিত জীবনে ছিল জীবন্ত এক ছায়া। এখন সে শরীর হয়ে উঠেছে—তীব্র, কাতর, আগুনে।

সেই রাতে তারা একে অপরকে ছিঁড়ে খেয়েছিল। ওদের মধ্যে আর কোনও প্রেম ছিল না, ছিল শরীরের গভীর উপাসনা। কাঁধ, ঘাড়, স্তন, নাভি—সব জায়গা দিয়ে যে ভাষা বেরোয়, তা শুধুই কামনার। অভিজিৎ ওকে বিছানায় পিছনে ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিল, “আজ তোকে দেবতা বানাব। শরীর দিয়ে আমি তোকে পুজো করব। কারণ তুইই আমার সত্য।”

সেই ঘামে ভেজা, নিশ্বাসে কাঁপা রাতে নন্দিনী বুঝেছিল—এই ভালোবাসা নয়, তবুও এর চাইতে সত্য কিছু নেই।

পর্ব ৩

নন্দিনী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই একই আয়না, যেটার সামনে দাঁড়িয়ে বছর দশেক ধরে সে কেবল সিঁথির সিঁদুর ঠিক করেছে, গলার হার মিলিয়েছে শাড়ির রঙের সঙ্গে, আর মাঝে মাঝে নিজের চোখের ক্লান্তি লুকাতে চেয়েছে। আজ, সেই আয়নায় নিজেকে দেখে ওর মনে হল, কেউ যেন বলছে, “তুই আর আগের মত নেই।”

সত্যিই তো, সে আর আগের নন্দিনী নেই। এখন তার শরীর গন্ধ ছড়ায় অন্যরকম। অভিজিতের আঙুল, ঠোঁট, দৃষ্টির গন্ধ লেগে থাকে ত্বকের ভাঁজে। শরীর এমন এক ভাষা শিখে ফেলেছে, যা লুকিয়ে রাখলেও ছড়ায়।

সঞ্জয় এখন ওর দিকে অনেকটা সময় নিয়ে তাকায়। কথা বলে পরখ করে। এমনকি রাতেও তার মধ্যে সেই পুরনো স্বামীসুলভ স্পর্শ ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু নন্দিনী জানে, তার শরীর সে আর খালি দেয়নি সঞ্জয়কে।

একদিন সকালে ওদের খালি ঘরে সঞ্জয় বলে উঠেছিল, “তুই কি এখন অন্য কারও কথা ভাবিস, যখন আমার পাশে শুয়ে থাকিস?”

নন্দিনী চমকে ওঠেনি। কিছুটা শান্ত গলায় বলেছিল, “তুই কি এখন অন্য কাউকে দেখে চিনতে পারিস, আমার শরীরের গন্ধে?”

দুজনের মাঝখানে একরাশ নীরবতা জমে গেল। কিছু শব্দ ছুঁয়ে গেল, কিছু কথা থেকে গেল বুকের ভেতর।

সেইদিন দুপুরে, নন্দিনী ছুটির অজুহাতে বেরিয়ে পড়েছিল। গন্তব্য, অভিজিতের সেই বাংলোঘর। সেখানে অভিজিৎ একখানা চাদর বিছিয়ে রেখেছিল, সাদা রঙের, নতুন কেনা। বলেছিল, “আজ তোর শরীরের গল্প নতুন পৃষ্ঠায় লিখব।”

সে জানত, এই চাদরটা রক্তমাখা হবে না, কিন্তু শরীরের ঘামে, ভালোবাসায়, কামনায় ভিজে থাকবে এমনভাবে যে কেউ ছুঁলেই বুঝে যাবে—এখানে কেউ কাউকে নিংড়ে দিয়েছে।

আলোর মতো করে শরীরগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল। কোনও কথা ছিল না, কেবল তীব্র নিঃশ্বাস। অভিজিত ওর বুকে মাথা রেখে বলেছিল, “তুই আমাকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে ফেলিস, জানিস? আমি শরীর চাইনি, আমি তোকে চাই। যেভাবে তুই নিজেকে আমার কাছে তুলে ধরিস, তাতে আমি পুরুষ হয়ে উঠি।”

নন্দিনী হেসেছিল, “আমি শুধু শরীর দিতে শিখেছি তো, মন তো অনেক আগেই মরে গেছে।”

“তোর শরীরটাই মন হয়ে গেছে,” অভিজিৎ বলেছিল। “এই তো, তোর নাভির পাশে একটা দাগ আছে। ওটা না থাকলে তুই নন্দিনী হতি না। এই শরীরেই তোর সমস্ত পরিচয় লুকিয়ে আছে।”

দুপুরের সেই প্রগলভ উত্তাপে নন্দিনী যেন একটু কাঁপছিল। কিন্তু সেই কাঁপন ভয় থেকে নয়, ছিল স্বীকারোক্তির আনন্দ।

ঘরে যখন তারা বসে চা খাচ্ছিল, তখন অভিজিৎ বলল, “তুই কি কখনও ভাবিস, যদি একদিন ধরা পড়ে যাস?”

নন্দিনী একটু থেমে বলল, “ধরা পড়ার ভয় তো কেবল তখনই থাকে, যখন সম্পর্কটা গোপন রাখতে চাই। আমি আর চাই না। এই শরীরটা তো দিনের পর দিন মরেছে। আজ যদি বেঁচে ওঠে, তাহলে তার শাস্তি হওয়া উচিত না।”

“তুই খুব সাহসী হয়ে যাচ্ছিস,” অভিজিৎ মুচকি হাসল। “আমি তো শুধু শরীরের গল্প লিখছিলাম, তুই তো সেটা জীবন বানিয়ে ফেলছিস।”

“কারণ শরীরই আমার জীবনের শেষ সত্য,” নন্দিনী বলল। “তুই হয়তো আমাকে ভালবাসিস না, কিন্তু আমি নিজের শরীরটাকে ভালবেসে ফেলেছি, কারণ তুই সেটা ফিরিয়ে দিয়েছিস আমাকে।”

আলতো করে অভিজিৎ ওর আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল, “আমি চাই, তুই একদিন এই প্রেমের জন্য মরে যেতে পারিস, না-হলে তা অপূর্ণ।”

সেই রাতেই নন্দিনী বাড়ি ফিরে দেখে, সঞ্জয় সোফায় বসে আছে, হাতে একটা কাগজ।

“তোর নামে একটা ছবি এসেছে মেইলে,” সঞ্জয় বলল।

নন্দিনী দাঁড়িয়ে গেল, বুকের ভেতরটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল।

সঞ্জয় বলল, “কাঁধে একটা চিহ্ন আছে, যেটা আমি চিনি। সেটা তোর। কিন্তু তুই হয়তো ভাবিস, আমি চিনি না।”

নন্দিনী শান্ত গলায় বলল, “চিনে থাকলে আর প্রশ্ন করতে হয় না।”

সঞ্জয় ওর চোখে চোখ রেখে বলল, “তুই জানিস, আমি তোকে কখনো বাধা দিতে চাইনি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, তুই শুধু একজন প্রণয়িনী নয়, তুই একটা জিজ্ঞাসা। আমি হয়তো তোকে ভালোবাসিনি, আমি শুধু তোকে ব্যবহার করেছি—তোর দায়িত্বের শরীরটাকে।”

নন্দিনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কোনও অশ্রু, কোনও অনুতাপ তার চোখে ছিল না।

সে বলল, “আমার জীবনে যেটুকু বেঁচে থাকা ছিল, সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি কারও শরীরের মধ্য দিয়ে। তুমি যদি সেটা অপরাধ ভাবো, আমি দোষী।”

সঞ্জয় কেবল বলল, “তুই এবার এখান থেকে যেতে পারিস।”

নন্দিনী সেদিন রাতে এক ব্যাগ কাপড় নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। শহরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সে একা নিজের শরীরের সঙ্গে গল্প করছিল।

তখন রাত একটা। অভিজিতের ফোনে একটা মেসেজ এল—

“আমি চলে এসেছি। আজ থেকে আমি শুধু শরীর নই, আমি স্বাধীনতা। আমি দেহের সেই নারী, যে নিজের স্পর্শকে আর লুকাবে না।”

পর্ব ৪

শহরের অদূরে এক ছ’তলার ছাদে অভিজিত দাঁড়িয়ে ছিল, হাতজোড়া পকেটে, গায়ে কেবল সাদা লিনেনের শার্ট, নিচে ডেনিম। তার চোখের দৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছিল আকাশের শেষ বিন্দু—যেখানে রাতের আলো গলে গিয়ে শরতের জ্যোৎস্না নামে। হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ। সে ঘুরে দাঁড়াতেই নন্দিনীকে দেখল—এক ব্যাগ হাতে, পরনে ধূসর রঙের কুর্তি, চুল খোলা, চোখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি আর ক্লান্তির মিশেল।

“আমি এসেছি,” সে শুধু বলল।

অভিজিত কিছু বলল না। কাছে এসে ব্যাগটা নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল। তারপর এক গ্লাস জলের মতো স্বচ্ছ চোখে তাকাল ওর দিকে।

“তুই কাঁদিসনি?”

“না,” নন্দিনী বলল, “কারণ আমার কান্নাগুলো আমি অনেক আগেই ফুরিয়ে ফেলেছি। আমি শুধু দেহটাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, মন তো অনেকদিন আগেই শুকিয়ে গিয়েছিল।”

তারা দুজন একসাথে ছাদের কোণায় গিয়ে বসেছিল। নীচে শহরের গুঞ্জন, মাথার ওপরে জ্যোৎস্না—আর মাঝখানে এক নিঃশব্দ কামনা, যা ক্রমশ হিম হয়ে জমে উঠছিল।

“তুই কোথায় থাকবি এবার?” অভিজিত জিজ্ঞেস করল।

“এই শহরের একটা ভাড়া বাড়িতে, বা তোদের এই ঘরে যদি জায়গা থাকে…”

“এই ঘর তোদের নয়,” সে বলল, “এই ঘর শরীরের। এখানে জায়গা দিতে হলে তুই তোর শরীর দিয়ে চাবি ঘোরাতে হবে।”

নন্দিনী হাসল, মৃদু অথচ আগুনমাখা হাসি।

“তাহলে এবার খুলে দাও দরজাটা,” সে বলল, “আমি আজ রাতে আমার শরীরকে তোমার কাছে বন্ধক রাখব।”

সেই রাত ছিল সম্পর্কের নতুন ব্যাখ্যার। তারা বিছানায় উঠেছিল না, বরং ছাদের ওপরই পুরনো কম্বল পেতে শুয়েছিল পাশাপাশি। আকাশের নিচে নগ্ন শরীর, হাওয়ায় ওড়ানো কামনা—এ যেন এক স্বাধীন প্রার্থনা।

অভিজিত তার পায়ের গোড়ালি থেকে শুরু করে উরুর ভাঁজ, নাভি, স্তন, গলার হাড়—প্রতিটি জায়গায় চুমু দিয়ে বলেছিল, “এই তোর শরীর। তুই চাইলে আমায় ফিরিয়ে দে। আমি তোকে কামনা করি না শুধু, আমি তোর দেহে বাঁচি।”

নন্দিনী ওর আঙুল চেপে ধরেছিল। বলেছিল, “তুই আমার শরীরকে যে ভাবে ছুঁস, আমি নিজেকে নতুন করে চিনে ফেলি। প্রতিটা আঙুলের ফাঁকে, ঠোঁটের কোণে, স্তনের নিচে যে নাম লেখা থাকে, সেটা তুই ছাড়া কেউ পড়তে পারেনি।”

তারা বিছানায় নয়, ছাদের পাথরে শুয়ে থেকেও একে অপরকে গলে ফেলেছিল। কোনও যৌনতা ছিল না যেখানে কেবল প্রবেশ আর উত্তরণ, বরং ছিল শরীরের গভীর এক আলাপন। নন্দিনী অভিজিতের বুকে মাথা রেখে বলেছিল, “আমার ভেতরে শুধু শরীর নয়, ভয়ও ছিল। তুমি তা মুছে দিয়েছো।”

সেই রাতে তারা ঘুমায়নি। তারা শরীরের গল্প লিখেছে, ত্বকের ওপর ভাষা এঁকেছে, আর মাঝে মাঝে থেমে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বলেছে, “এই আলোতেও তুই দেখিস, আমি কেমন?”

পরদিন সকালবেলায় তারা একসাথে কফি খাচ্ছিল। নন্দিনী জিজ্ঞেস করেছিল, “তোর কি কখনও মনে হয়, এটা ঠিক নয়? আমি আমার সংসার ভেঙে তোর কাছে এসেছি, তুই তো কিছুই ছাড়িসনি।”

অভিজিত থেমে বলেছিল, “কারণ তোর সবকিছু ছিল—সংসার, স্বামী, সন্তান। আমি তো কেবল দেহ দিয়ে বেঁচে আছি এতকাল। আমি ছাড়ার কিছুই পাইনি। আমি কেবল পেয়েছি, তোর শরীরের ভেতরে আশ্রয়।”

“তুই কি আমাকে ভালবাসিস?”

“ভালোবাসা বড় গন্ধহীন শব্দ। আমি তোর ঘামের গন্ধ চাই, তোর কামনার কাঁপুনি চাই। ভালোবাসা বলে কিছু নেই। আছে শুধু শরীর, যা একে অপরকে চিনে ফেলে।”

নন্দিনী সেই কথায় কষ্ট পায়নি। কারণ সে বুঝেছিল—এই সম্পর্ক কোনো আবরণ চায় না। তারা একে অপরকে ভালবাসে না, বরং তারা শরীরকে ভালবাসে—যেখানে সত্যি কিছুই লুকনো নেই।

বিকেলে তারা নতুন একটা ফ্ল্যাট খুঁজতে বেরোল। একটা একরুমের অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ হল। জানালার পাশে ছোট্ট ছাদ, একটা নরম আলোয় ঢাকা ঘর।

“এইখানেই আমরা থাকব?”

“এইখানেই আমরা লুকিয়ে থাকব,” অভিজিৎ বলল।

“আমাদের কী নাম হবে এখানে?”

“কোনো নাম থাকবে না,” সে বলল, “তুই যদি এখানে থাকিস, তাহলে তুই আমার শরীরের ঠিকানা। আর আমি তোর ছায়া। নাম দরকার নেই। গন্ধটাই যথেষ্ট।”

সেই রাতে তারা নতুন ফ্ল্যাটে প্রথম রাত কাটাল।

বিছানার চাদরে রক্ত পড়েনি, তবু একটা জন্ম হয়েছিল—দেহের, আবারও।

পর্ব ৫

নতুন ফ্ল্যাটে দিনগুলো অদ্ভুতভাবে শান্ত কেটে যাচ্ছিল। ঘরটা ছোট, কিন্তু জানালার বাইরে যে খোলা আকাশ, তার তুলনায় কত বড় আরাম পাওয়া যায়, তা আগে কখনো বোঝেনি নন্দিনী। এখানে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না, কেউ ছেঁদো খোঁজখবর নেয় না, দরজায় নক করে না সকালবেলা। এখানে শুধুই তারা দুজন—একটা শরীর আর তার প্রতিবিম্ব।

তবুও সমাজ তো কখনো ঘরবন্ধ থাকে না।

প্রথম আঘাত এসেছিল ফোনে। মা ফোন করেছিলেন। গলা জড়ানো, কান্নাভেজা—
“তুই কী করলি নন্দিনী? লোকে কি বলছে জানিস? তুই তোদের পাড়ায় ফিরতে পারবি না। তোর ছেলের স্কুলেও খোঁজ পড়েছে, শিক্ষকরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তুই কি শুধুই শরীর?”

নন্দিনী ফোন কানে রেখে চুপ করে ছিল। তারপর হালকা গলায় বলেছিল, “হ্যাঁ মা, আমি শরীর। এই শরীরটা যদি একদিন বাঁচতে না পারে, তাহলে আমি কিছুই নই। আমার শরীর মরছিল মা, আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। আমি বাঁচতে চেয়েছি, মা। হয়তো ভুলভাবে, কিন্তু ইচ্ছেটা সত্যি ছিল।”

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফোন কেটে দিলেন।

সেই রাতে অভিজিৎকে কিছু বলেনি সে। শুধু কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে বসেছিল। অভিজিৎ ওর চুলে আঙুল চালিয়ে বলেছিল, “এই চুলগুলো এখন আরও গাঢ় হয়ে গেছে, জানিস? আগের থেকে শক্তও দেখাচ্ছে।”

“শরীরের শক্তিই তো এখন আমার একমাত্র অস্ত্র,” নন্দিনী বলল।

“না,” অভিজিৎ মাথা নাড়ল, “তোর শরীর অস্ত্র নয়, তোর শরীর একটা মঞ্চ। এখানে তুই নাচিস, কাঁদিস, হাসিস, প্রেম করিস, আবার প্রতিবাদও করিস। তুই বুঝিস না, কত সাহস লাগে একজন নারীকে নিজের শরীর নিয়ে দাঁড়াতে?”

নন্দিনী গভীরভাবে অভিজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার ভেতরে কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরেই আবার এক নবজন্ম হয়েছে।

তারা এখন খুব বেশি বাইরে যায় না। নন্দিনী চাকরি ছাড়েনি, কিন্তু অফিসে যেতে যেতে অনুভব করত, সহকর্মীদের দৃষ্টি তার শরীরকে পোড়াচ্ছে। কেউ স্পষ্ট কিছু বলে না, কিন্তু কেউ আর কাঁধে হাত রাখে না, কেউ আর সহানুভূতিতে পাশে দাঁড়ায় না।

একদিন, এক পুরনো কলিগ বলল, “ভালোই করেছো। সংসার ভেঙে প্রেম—সাহস লাগে। কিন্তু শেষমেশ তোমার জায়গা কী? একটা শরীর?”

নন্দিনী হেসেছিল। সেই হাসিতে ছিল না কোনো আত্মরক্ষা, ছিল এক অবজ্ঞার আগুন। সে শুধু বলেছিল, “তুমি কি সংসারটা রেখেছো কেবল মনের জন্য? যদি হ্যাঁ, তাহলে প্রতি রাতে কাঁদো কেন? আমার শরীর অন্তত এখন আর কাঁদে না। আমার শরীর এখন চায়।”

ফিরে এসে সে অভিজিতকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, “আমি আর কোনো অজুহাত দেব না। আমি আমার শরীরকে কখনও মা হিসেবে দেখেছি, কখনও স্ত্রীর খাঁচায় বন্দি করেছি। এখন আমি চাই, আমি শুধু একজন নারী হই—যার ত্বকে জ্বলে, ঠোঁটে কামড়ে থাকে জীবন।”

সেই রাতে অভিজিৎ ওকে এক নতুন খেলা শেখাল।

একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, “আজ আমরা শরীর দিয়ে প্রতিবাদ করব। এই আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখ, ঠিক যেভাবে সমাজ তোকে দেখে। এখন নিজেকে ছুঁয়ে বল, ‘আমি লজ্জা নই, আমি সাহস।’”

নন্দিনী প্রথমে কেঁপে উঠেছিল। আয়নায় নিজেকে নগ্ন দেখে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু যখন অভিজিৎ ওর পিঠে আলতো চুমু দিয়ে বলল, “এই তোর পিঠের দাগটাও ইতিহাস,” তখন সে বুঝেছিল—শরীর একমাত্র স্মৃতির উৎস, আর স্মৃতি কখনও পাপ হয় না।

সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্তন ছুঁয়ে বলেছিল, “এইখানে আমার সন্তান দুধ খেয়েছে, এইখানেই কেউ এখন চুমু খায়। উভয়ই পবিত্র।”

তারপর ওর পেট, ওর নাভি, ওর জঙ্ঘা—একটার পর একটা ছুঁয়ে বলেছিল, “এই সব জায়গা দিয়ে আমি বেঁচে আছি, এইখানেই আমার নৈতিকতা, আমার কবিতা।”

সেই রাতে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তারা ঘাম, শরীর, আর প্রতিবাদের একটা উৎসব করেছিল। দুজনের চোখে চোখ, দেহে দেহ, আর জিহ্বায় জিহ্বা—সব কিছুই ছিল সমান সত্য।

পরদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে জানালার ধারে বসে ছিল নন্দিনী। পায়ের ওপর পা তুলে, গায়ে একটুকরো ছেঁড়া শাড়ি জড়ানো, চোখে ক্লান্তির সঙ্গে তৃপ্তি মিশে থাকা।

“আমরা কি একদিন থেমে যাব?” সে জিজ্ঞেস করেছিল।

“না,” অভিজিৎ বলেছিল, “আমরা থামব না। কারণ শরীর যতদিন জেগে থাকে, ততদিন জীবনের নাম হয় আকাঙ্ক্ষা।”

পর্ব ৬

ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তখন সন্ধ্যার আলো ঢুকছিল। হলুদ, নরম, ক্লান্ত আলো। বাইরে কোনো চিৎকার নেই, গাড়ির হর্ন নেই, কেবল রুটিন শহরের নিঃশব্দ কোলাহল। ঘরের ভিতর কফির গন্ধ ছড়িয়েছে। নন্দিনী বসে ছিল পড়ার টেবিলের সামনে, অথচ কোনও বই খুলে রাখেনি। তার চোখ জানালার বাইরে—যেখানে একদম কিছু নেই।

তবুও মন এমনভাবে শূন্যের দিকেই ফিরে ফিরে যায়, যেন সেখানে সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে।

পেছনে এসে অভিজিৎ হাত রাখল ওর কাঁধে। কাঁধটা একটু কেঁপে উঠল—আজকাল অনেকক্ষণ ছোঁয়াও কখনও কাঁপন তুলতে পারে।

“তুই ঠিক আছিস?”

“আমাকে তো ঠিক বললেই চলে। আমার ঠিক আর বেঠিকের পার্থক্যটাও এখন মুছে গেছে,” বলল নন্দিনী।

“আজ তোর গলা খুব স্তব্ধ,” অভিজিৎ বলল।

নন্দিনী আস্তে করে বলল, “তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?”

প্রশ্নটা শুনে অভিজিৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখের পলক পড়ল একবার। তারপর বলল, “তুই তো জানিস, আমি তোকে কামনা করি। তোর শরীর আমার কাছে পৃথিবীর শেষ কবিতা। ভালোবাসা তো একদম অপ্রয়োজনীয় শব্দ।”

নন্দিনী মুখ ফিরিয়ে বলল, “তবু মনে হচ্ছে, ভালোবাসাটা না হলে শরীরটা শুধু একটা কাঠামো হয়ে যায়। গত কিছুদিন তুই আমার শরীরের মধ্য দিয়ে আমাকে চিনেছিস, কিন্তু আজ আমি চাই তুই আমার ভিতরটা স্পর্শ কর।”

“ভিতর মানে?”

“মন নয়, অভিজিৎ। মন আমি কাউকে দিই না। কিন্তু শরীরের ভিতরেও যে একধরনের নিঃসঙ্গতা থাকে, তুই তাকে ছুঁসিস না কখনো। শুধু ত্বকের গল্প লিখে তো সব বলা যায় না।”

অভিজিৎ চুপ করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে ওর পাশে এসে বসে বলল, “তুই কি প্রেমে পড়ছিস?”

নন্দিনী দীর্ঘক্ষণ চুপ ছিল। তারপর বলল, “হয়তো। হয়তো প্রেম না, হয়তো অভ্যেস। হয়তো তোর গন্ধ এখন আমার রক্তে মিশে গেছে। তোকে না ছুঁলে আমার শরীরটা বেঁচে থাকে না। কিন্তু এটা কি কেবল অভ্যেস?”

“তুই ভয় পাচ্ছিস,” অভিজিৎ বলল।

“ভয় পাচ্ছি ঠিকই। শরীর দিয়েছিলাম জানি, কিন্তু এখন তোকে হারানোর কথা ভাবতেই একটা হাহাকার আসে। আর এই হাহাকার তো প্রেমের কাছেই থাকে, শরীরের না।”

অভিজিৎ উঠে দাঁড়াল। ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বলল, “আমি তোকে ভালবাসিনি, সত্যি। আমি তোকে চিনেছি, খুঁজে পেয়েছি, চেয়েছি। কিন্তু ভালবাসিনি। কারণ আমি জানতাম, ভালোবাসা মানে বাধ্যতা। আর আমি তো তোকে কখনো বেঁধে রাখতে চাইনি।”

“তবু তো তুই আমায় দেহে বেঁধেছিস,” বলল নন্দিনী, “আমার ত্বকে তোর নাম লেগে গেছে। আমি আর অন্য কেউ হতে পারব না। আমি চাই বা না চাই—তুই এখন আমার শরীরের গন্ধ। আমি আর আলাদা করতে পারি না।”

এক অদ্ভুত沉默 এসে ঘিরে ধরল তাদের। ঘরটা এতদিন শুধু কামনার ছিল, এখন সেই কামনায় কেঁপে উঠছে একটা অবাক মায়া।

নন্দিনী উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে ওর কুর্তির গলা খুলতে খুলতে বলল, “আজ আমাকে শুধু ছুয়ে যাবি না, আজ আমাকে অনুভব কর। আজ আমি শুধু শরীর না—আমি সেই নারী, যার শরীরে প্রেমের অপেক্ষা জমেছে।”

অভিজিৎ ওর কাছে এসে দাঁড়াল। প্রথমবার তার হাত কাপছিল। এমনভাবে কখনও সে নন্দিনীকে ছোঁয়নি—যেখানে কেবল কামনা নেই, আছে দায়, অনুভূতি, এমনকি ঘাম ঝরা ভয়।

তারা বিছানায় এল। কিন্তু সেই রাত, আগের রাতগুলোর মত ছিল না। কোনও হাহাকার, কোনও তীব্র গুঞ্জন ছিল না। ছিল ধীর, শান্ত, আদর। প্রতিটা চুমু ছিল চোখ বন্ধ করে দেওয়া গোপন কবিতা।

অভিজিৎ ওর কপালে হাত রেখে বলল, “আজ তোর শরীর একটা নদী। আমি এই নদীর ভিতরে ডুবে যেতে চাই, কোনও তীরে উঠতে চাই না।”

নন্দিনী ওর হাত ধরে বলল, “আমি জানি, আমি তোকে হারাব একদিন। এই সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু আজকের এই রাত, আমার শরীরে প্রেমের প্রথম গান হয়ে থাকবে। আমি শরীর দিয়েই তোকে ভালবাসতে শিখেছি।”

সেই রাতের পরে অভিজিৎ বদলে যেতে শুরু করল।

সে আগের মত নিখুঁতভাবে ছবি তুলত না। ওর শরীর নিয়ে কবিতা লিখত না। বরং হঠাৎ করে ডান হাতে ছুঁয়ে বলত, “তুই আজ মন খারাপ করেছিস?”

তারা সিনেমা দেখতে যেত, যেখানে একসাথে হাত ধরা থাকত, কেউ কারও বুকের ওপর হেলান দিত। সমাজের চোখে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠছিল—তারা যা হতে চায়নি।

একদিন অভিজিৎ বলল, “আমরা কি একটু স্বাভাবিক হচ্ছি?”

নন্দিনী বলেছিল, “না। আমাদের প্রেম কখনও স্বাভাবিক ছিল না। এটা তো শরীর দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন যদি মনে কিছু জমে, সেটা দোষ না।”

“কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি,” অভিজিৎ বলল, “এই প্রেমটা যদি একদিন একঘেয়ে হয়ে যায়? তখন কী করবি?”

“তুই কি তখন আবার শরীর খুঁজে নেবি?”

অভিজিৎ কিছু বলেনি।

তারা জানত, শরীর দিয়ে শুরু হওয়া গল্পে প্রেম ঢুকে পড়লে প্রশ্ন আসবেই। শরীর কখনও প্রতিশ্রুতি চায় না, কিন্তু প্রেম চায়। শরীর মুহূর্তে বাঁচে, প্রেম ভবিষ্যতের ছায়া নিয়ে হাঁটে।

আর সেই ছায়া এখন ওদের ঘরে ঢুকে পড়েছে।

পর্ব ৭

ফ্ল্যাটের ভেতরে এখন এক ধরনের অস্থিরতা জমে আছে। চোখে দেখা যায় না, ছুঁয়ে বোঝা যায় না—কিন্তু নিঃশ্বাসে, চলাফেরায়, কথার ছাঁদে সেটা থিকথিক করছে। অভিজিৎ যেমন হঠাৎ করেই মোবাইল স্ক্রল করে, তারপর চোখ লুকিয়ে ফেলে। নন্দিনী যেমন চুপচাপ থেকে গেছে—তার শরীর এখনও উষ্ণ, কিন্তু সেই উষ্ণতায় একটা প্রশ্ন জেগে থাকে, “এটা কি শেষ?”

তারা একসাথে থাকছে, শরীরের মাঝখানে ঘুমোচ্ছে, কিন্তু তাদের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি—যার নাম কেউ উচ্চারণ করেনি।

সন্ধেয় তারা ছাদে উঠেছিল। আগে যেখানে চুমু, হাসি আর স্পর্শ জমত, আজ সেখানে একরাশ নীরবতা। অভিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তোর ছেলেটা কেমন আছে?”

নন্দিনী একটু কেঁপে উঠল। অনেকদিন পর কেউ ছেলেকে নিয়ে কিছু বলল।

“ভালো নেই,” ও বলল, “সঞ্জয় ওকে আমার ছবি দেখায় না। আমাকে মুছে ফেলেছে একরকম।”

“তুই কী করবি?”

“আমি এখন নিজের জন্য বাঁচছি। একদিন হয়তো ও বুঝবে, আমি কেন পালিয়েছিলাম।”

অভিজিৎ বলল, “কখনও কখনও মনে হয়, তোকে এতটা জড়িয়ে ফেলেছি, যে আর সরে দাঁড়াতে পারি না। অথচ আমি কখনও চাইনি এই জায়গায় পৌঁছাতে।”

“আমি তো তোকে চেয়েছিলাম কেবল শরীরের জন্য,” নন্দিনী মৃদু গলায় বলল, “কিন্তু তুই আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছিস। এখন তুই ছাড়া আমি আমার ত্বককেও চিনতে পারি না।”

অভিজিৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। “তোর কী মনে হয়, আমরা এখন যা করছি সেটা ঠিক?”

“ঠিক-ভুল নিয়ে আমি ভাবি না। আমি শুধু ভাবি, আমি যাকে ছুঁই সে কি আমায় ফিরিয়ে দেয়? তুই কি আমায় ফিরিয়ে দিচ্ছিস?”

অভিজিৎ কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ঘরে ফিরে নন্দিনী একা বিছানায় শুয়ে ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা হাওয়ায় ওর চুল উড়ছিল। কোথায় যেন মনে হচ্ছিল, এই রাতটা আগের মতো নয়। অভিজিৎ দরজা বন্ধ করেনি। তবু সে নেই।

সেই রাতে তাদের মধ্যে কোনও স্পর্শ হয়নি।

পরদিন সকালে অভিজিৎ উঠে চলে গিয়েছিল, “একটা মিটিং আছে,” বলে।

দুপুরবেলা নন্দিনী ফোন হাতে পায়চারি করছিল। ভিতরে ভিতরে চেপে থাকা রাগ, সন্দেহ, আর হঠাৎ জেগে ওঠা একটা গোপন ভয়—সব একসাথে খেলা করছিল।

কোনও সন্দেহ নেই যে অভিজিৎ বদলাচ্ছে। শরীরের মধ্যে থেকেও সে যেন সরে যাচ্ছে।

সেই বিকেলে, হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। খুলে দেখল, রিনি দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিনীর ছোটবেলার বান্ধবী। অনেকদিন পর দেখা।

রিনি বলল, “আমার সবকিছু জানি। তুমি চাইলে বলো, না চাইলে চুপ থাকো। কিন্তু একটা কথা বলি, তুই কি জানিস তুই আসলে কী খুঁজছিস?”

নন্দিনী থমকে গেল। সে কিছু বলল না।

রিনি ভিতরে ঢুকে বলল, “শরীর দিয়ে শুরু করা সম্পর্ক শেষ হয় দেহ খালি হয়ে গেলে। কিন্তু যদি মাঝখানে প্রেম ঢুকে পড়ে, তখন সম্পর্কটা হাঁসফাঁস করে। তখন কেউই আর জানে না কে কাকে কেন ভালোবাসে। সেই জায়গায় তুই এখন।”

নন্দিনী ধীরে বলল, “আমি তো চেয়েছিলাম শুধু বাঁচতে। প্রেম আমার দরকার ছিল না। কিন্তু তুই জানিস, প্রতিদিন কেউ যখন তোর শরীরটা না বলে বুঝে নেয়, তখন ওর প্রতি একরকম দুর্বলতা জন্মায়। আমি জানি না সেটা প্রেম কিনা, কিন্তু সেটা ক্ষুধার মতো, আর অভিজিৎ এখন সেই ক্ষুধা মেটাতে চায় না।”

রিনি বলল, “তাহলে কী করবি?”

নন্দিনী বলল, “আমি ওকে ছাড়ব না। কারণ আমি জানি, ও এখনও আমায় চায়। হয়তো প্রেমে নয়, কিন্তু শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তৃপ্তির ভাষায়।”

সেই রাতে অভিজিৎ ফিরল অনেক পরে। মুখে ক্লান্তি, চোখে চিন্তা।

নন্দিনী অপেক্ষা করছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই কি আমায় ছাড়া কারও কথা ভাবছিস?”

অভিজিৎ তাকিয়ে বলল, “আমি তো কিছুই ভাবছি না। আমার মাথায় এখন শুধু অস্পষ্ট চিন্তা। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি বুঝতে পারছি না।”

নন্দিনী ওর হাত ধরে বলল, “তুই আমার শরীরের ভিতরেও তোর পথ খুঁজেছিস, তাই আমি তোর। আজ আমি চাই, তুই আমায় বল, এই সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়িয়ে?”

অভিজিৎ চুপ করে ছিল। তারপর আস্তে বলল, “আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি, তোর গায়ে যখন হাত রাখি, তখন আমার সমস্ত অনিশ্চয়তা গলে যায়। আমি এখনো তোর শরীর চিনি, কিন্তু তোর মন আমায় অজানা।”

নন্দিনী বলল, “তাহলে তুই কি আমাকে ভালোবাসিস না?”

“ভালবাসি। কিন্তু সেটা শরীরের পথ ধরে এসেছিল। এখন সেটা অন্য কিছু হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না, সেটা প্রেম নাকি অভ্যাস, নাকি অপরাধ। কিন্তু তুই আমার অভ্যন্তরের একমাত্র সত্য।”

সেই রাতে তারা আবার এক হল। কিন্তু সেই মিলন ছিল যুদ্ধের মতো—জিজ্ঞাসা আর নিশ্চিতির দড়ি টানাটানি। প্রতিটি স্পর্শে যেন প্রশ্ন ছিল—”তুই কি এখনও আমায় চাস?”

তবু তারা জড়াল, তবু তারা চুমু খেল, তবু তারা জেনেছিল—কোনো প্রেমই শরীর ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, আর কোনো শরীরই প্রেম ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী নয়।

পর্ব ৮

ঘরটা তখন নিঃশব্দ। টেবিলের কোণে রাখা মেঘরঙা কাপ থেকে ধোঁয়া আর উঠে না। জানালার পাশে বসে নন্দিনী তাকিয়ে আছে বাইরে—তেমন কিছু দেখার নেই, তবু তাকিয়ে থাকা যায়। তার গায়ের চাদরটা আজ নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত, ঠোঁট শুকনো, চোখ লাল। অভিজিৎ তিন দিন ধরে ঘরে নেই।

ফোন বন্ধ, মেসেজে ‘seen’ লেখা আসে না, কিছুই না।

এই তিনদিনে বিছানাটা কেবল একা ছিল না, ওর শরীরটাও ছিল একা। যে শরীর এতদিন কথা বলত, ঘামে কাঁপত, চুমুতে মিশে যেত—সেই শরীর এখন নিঃশব্দ, জড়।

তিন দিন আগের সেই রাতটা মনে পড়ে।

সেই রাতে মিলনের পরে, এক অদ্ভুত ঠান্ডা ঢুকে পড়েছিল ওদের মাঝে। অভিজিৎ শুয়ে থেকেও অনেকটা দূরে ছিল। নন্দিনী ওর পিঠে হাত রেখেছিল, কিন্তু অভিজিৎ কোনো সাড়া দেয়নি। শুধু বলেছিল, “আমি ক্লান্ত। একটু ঘুমোতে দে।”

নন্দিনী বুঝেছিল, এই ক্লান্তি শরীরের নয়, সম্পর্কের। হয়তো অভিজিৎ আর পারছে না—এতটা গভীরতায় ডুবে থাকতে।

সকালে উঠে অভিজিৎ বলেছিল, “আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কয়েকদিনের জন্য। সময় লাগবে। আমার মাথা কাজ করছে না।”

সেই থেকে নিখোঁজ।

প্রথম একদিন খুব কাঁদছিল নন্দিনী। এমন কান্না যে গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না, কেবল চোখ ভিজে থাকে। দ্বিতীয় দিনে কাঁদতে কাঁদতে আয়নায় নিজেকে দেখেছিল—চোখের নিচে কালি, ঠোঁট ফেটে গেছে, কিন্তু তবুও সেই চোখে একরাশ অভিমান। আর আজ, তৃতীয় দিন, সে আর কাঁদছে না।

আজ তার শরীর আবার নিজের শরীর হয়ে উঠেছে।

সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। জামা খুলে ফেলে। নিজেকে দেখে। বুক, পেট, উরু, নাভি—যেসব জায়গায় অভিজিৎ কবিতা লিখত, সেগুলো এখন ফাঁকা, অথচ জীবন্ত।

নিজেকে স্পর্শ করে। ধীরে, সম্মানে, নিজের মতো করে।

সে ভাবে—“তুই যদি না থাকিস, তবু আমি আছি। আমার শরীর আছে। এই শরীরটাই তো আমাকে স্মরণ করায় আমি এখনো বাঁচি।”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেই নিজের স্তনে হাত রাখে, নিজের পেটে চুমু খায়—মনের ভেতরে। আর বলে, “তুই আমার। কেউ আসুক বা যাক, তুই আমারই।”

হঠাৎ একটা মেসেজ আসে।
“আমি আসতে পারব না আর। খুব তীব্রভাবে তোকে চেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। ক্ষমা করে দিস। ভালো থাকিস।”
– অভিজিৎ

নন্দিনী ফোনটা নামিয়ে রাখে। চোখে জল নেই। ঠোঁটে একটা শান্ত হাসি।

সে শুধু বলে, “আমি তো তোকে দিয়েছিলাম শরীর। তুই তো আমায় নিতে পারিসনি।”

সেই রাতে সে একা বিছানায় শুয়ে, নিজেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়। নিজেকে ভালোবাসে, নিজেকে ছোঁয়, নিজেকে কামনা করে।

ভোরবেলা উঠে সে নিজেকে বলে, “আজ থেকে আমি আর কারও জন্য অপেক্ষা করব না। আমি এখন নিজের শরীরের প্রেমে পড়েছি। আমি একা, কিন্তু অসম্পূর্ণ নই।”

অফিসে যায়, মুখোমুখি দাঁড়ায় সহকর্মীদের। কেউ টিপ্পনি করে, কেউ চোখ ঘোরায়, কেউ হাসে।

কিন্তু সে সোজা হেঁটে চলে যায়, সোজা কথা বলে, সোজা চোখে তাকায়।

চাকরির ফাঁকে, সে এখন লিখতে শুরু করেছে। শরীর নিয়ে। একজন নারী হিসেবে শরীর কেমন করে গল্প বলে, কেমন করে বাঁচে, কেমন করে প্রতিবাদ করে।

সে নিজের ত্বকের প্রতিটা ভাঁজকে শব্দে তুলে ধরছে। তার লেখার শিরোনাম: “আমার শরীর, আমার ভাষা”।

প্রথম পর্বে সে লিখে—
“যে পুরুষ আমার শরীর চেয়েছিল, সে প্রেম পেলেই পালিয়ে যায়। কিন্তু আমি সেই শরীরকে রেখে দিয়েছি নিজের কাছে। কারণ এই শরীরই আমার শেষ ঠিকানা।”

নন্দিনীর লেখাগুলো এখন ছড়িয়ে পড়ছে। এক নতুন প্ল্যাটফর্মে মেয়েরা ওর লেখা পড়ে কাঁদছে, সাহস পাচ্ছে।

একদিন এক অচেনা মেয়ের মেল আসে—
“আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমি নিজের শরীরটাকে প্রথমবার ছুঁয়ে দেখেছি। আমি জানি না ভালোবাসা কী, কিন্তু আজ আমি নিজেকে বুকে নিয়ে ঘুমোতে পারি।”

নন্দিনী সেই মেল পড়ে হাসে। নিজেকে বলে, “তুই একজনের শরীরের খোলা খাতা ছিলি, আজ তুই নিজেই লেখক।”

শরীর আজ তার আর কাঁদে না। আজ সে কামনা করে না প্রেমকে, বরং ভালোবাসে নিজের ঘাম, নিজের শ্বাস, নিজের আদল।

একদিন হয়তো কেউ আবার আসবে। হয়তো কেউ ওকে আবার নগ্ন দেখবে। কিন্তু এবার, নন্দিনী জানে—
সে আর কাউকে নিজের শরীর দেবে না, সে দেবে আত্মার ত্বক।

পর্ব ৯

গ্রীষ্মের এক বিকেল, জানালার কাচ গলে ভেতরে নেমে আসছিল স্বচ্ছ রোদ। ঘরের মধ্যে সেই রোদ ছুঁয়ে ছিল নন্দিনীর খালি পায়ের পাতা, ভাঁজ করা বইয়ের পাতা, আর একটা অনাদরে ফেলে রাখা কফির কাপ। বাইরে হালকা বাতাস, কিন্তু ঘরের ভেতরে নিঃশব্দ। এত নিঃশব্দ, যেন সময়ও পা টিপে হাঁটে।

নন্দিনী তখন নতুন লেখা শুরু করেছে।
শিরোনাম: “নারীর শরীর মানেই অপরাধ?”

শরীরকে ঘিরে সমাজের অপমান, পুরুষের অধিকার, নারীর মৌনতা—সব মিলিয়ে এক গাঢ় আক্রোশে সে শব্দ গেঁথে চলেছে। কিন্তু তার আঙুল থেমে যায় একটা মেসেজের শব্দে।

স্ক্রিনে ভেসে ওঠে:
“আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। শেষবার দেখা করতে পারি?”
– অভিজিৎ

চার মাস। চার মাসে একটাও খোঁজ নেয়নি, একটাও মেসেজ পাঠায়নি। যে অভিজিৎ বলত, “তোর নাভির পাশে আমার কবিতা জমে,” সে কীভাবে এমন নিশ্চুপ থাকতে পারে?

নন্দিনী ফোনটা নামিয়ে রাখে। প্রথমে উত্তর দেয় না। কিন্তু মন তো কখনও পুরোপুরি মুক্ত হয় না। কৌতূহল, ক্ষোভ, পুরনো গন্ধ—সব মিলিয়ে মনের ভিতর একটা দরজা ঠেলতে থাকে।

তিন ঘণ্টা পরে, সে মেসেজ পাঠায়:
“কাল দুপুরে ক্যাফে বটানিকায় আসো। কিন্তু জানিয়ে রাখি, আমি আগের মতো নেই।”

পরদিন। দুপুর ২টা।
নন্দিনী সাদা কুর্তির ওপরে পরেছে হালকা নীল ওড়না, চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে কিছুমাত্র রঙ নেই। তবু চেহারার মধ্যে একরকম জ্যোতি। শরীর যেন নিজের ছন্দে ফিরে পেয়েছে আত্মমর্যাদা।

অভিজিৎ এসে দাঁড়ায়। চুল একটু ছোট, চোখে ক্লান্তি, তবু ঠোঁটে সেই পুরনো গন্ধমাখা হাসি।

“তুই অনেক বদলে গেছিস,” সে বলে।

“আমিও তোকে দেখে বুঝতে পারছি, তুইও বদলেছিস। এখন আমার গায়ে হাত রাখার মতো আকাঙ্ক্ষা তোর চোখে নেই,” নন্দিনী বলে।

অভিজিৎ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে, “আমি ভুল করেছি, সেটা মানি। কিন্তু তুই জানিস, আমি তোকে ভুলতে পারিনি। আমার স্পর্শের মধ্যে আজও তোর শরীর খেলে যায়।”

নন্দিনী হেসে বলে, “তুই কি আবার আমায় ছুঁতে চাস?”

“না, আমি তোকে ছুঁতে চাই না। আমি তোকে ফিরে পেতে চাই।”

“কোন তরে?”

অভিজিৎ থেমে যায়। তারপর ধীরে বলে, “তুই যা আমার মধ্যে ছুঁয়ে দিয়েছিস, আমি এখন সেইখানে শূন্যতা দেখি। আমি জানি, আমি তোকে ভালোবাসিনি ঠিকঠাক। আমি শুধু চেয়েছিলাম। কিন্তু চাওয়া তো শেষ হয়। আজ আমি তোর চোখে সেই আগুন দেখি, যেটা আমি জ্বালিয়ে এসেছিলাম। তুই এখন নিজেই আগুন।”

নন্দিনী একটু ঝুঁকে বলে, “তুই কি জানিস, তুই চলে যাওয়ার পরে আমি প্রতিদিন নিজেকে ছুঁয়েছি? আমি নিজেই আমার শরীরের প্রেমে পড়েছি। আমার ঘাম, আমার বুকের কাঁপন, আমার স্তনের নরমতা—সব আমি নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। তুই যা নিতে পারিসনি, আমি সেটা নিজেকে দিয়েছি।”

অভিজিৎ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে যেন কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।

“তুই যদি ভাবিস, আমি তোকে ফিরিয়ে নেব, তবে ভুল করছিস,” নন্দিনী বলে। “আমার শরীর এখন আর ভিখারি নয়, আমার শরীর এখন স্রষ্টা। আমি কাউকে আর দিই না, আমি নিজেকে সৃষ্টি করি প্রতিদিন।”

অভিজিৎ নিচু গলায় বলে, “তুই কি আমায় ঘৃণা করিস?”

“না,” বলে নন্দিনী, “আমি তোকে ঘৃণা করি না। আমি তোকে স্নেহ করি। কারণ তুই আমার শরীরকে জাগিয়ে দিয়েছিস। তুই আমায় আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু আমি তো এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছি, যেখানে তুই পৌঁছাতে পারিস না।”

সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। ক্যাফের আলো জ্বলে উঠছিল একে একে। সময়ও যেন একটু থেমে গিয়েছিল।

অভিজিৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, “তুই জানিস, তুই এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস। তোকে ছোঁয়া আমার সাধ্য নেই।”

নন্দিনী বলল, “আমি এখন এমন এক নারী, যে নিজের শরীরের গন্ধে নিজেকে চেনে। আর যেদিন শরীর নিজেকে চেনে, সেদিন প্রেমও মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।”

অভিজিৎ চলে গেল।

নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। তারপর উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রোদে মুখ রাখল।

সে নিজের গাল ছুঁয়ে বলল, “আজ আমি কারও স্পর্শ চাই না। আমি নিজেই নিজেকে স্পর্শ করব। আমি দেহের ভেতর একা থাকব, কিন্তু অপূর্ণ থাকব না।”

সে জানে, সে এখন একা—তবু শক্ত। কারণ শরীর এখন তার নিজের। আর নিজের শরীরকে যে নারী ভালোবাসে, তাকে কেউ পরিত্যাগ করতে পারে না।

পর্ব ১০

ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে নন্দিনী আজ সন্ধ্যার আলো গায়ে মেখে আছে। সামনে রাখা বইটায় একটা পাতাও ওলটায়নি, পাশে রাখা কফির কাপের ধোঁয়া ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবু সে চুপ করে বসে আছে—চোখে একটা অদ্ভুত আলোকছায়ার খেলা।

এখন আর কেউ এসে পিঠে হাত রাখে না। ফোনে টুং টাং শব্দ হয় না, সকাল বেলা কেউ জিজ্ঞেস করে না, “আজ কোথায় যাচ্ছ?”

তবু সে একলা নয়। এখন সে নিজের সঙ্গে থাকে। একা থাকাকে সে ভয় পায় না, বরং নিজের শরীর, নিজের গন্ধ, নিজের নিঃশ্বাস—সবকিছুকে সে এমনভাবে আপন করে নিয়েছে যে এখন আর অভাব বলে কিছু মনে হয় না।

কতটা বদলেছে জীবন!

একটা সময় ছিল, সে প্রতিটা দিন কারও স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করত। অভিজিৎ তখন ওর শরীরের ভেতর দিয়ে প্রেম খুঁজত। তারপর সেই প্রেম একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়াল। আর এখন—এখন সে জানে, নিজের শরীর যদি নিজে না বোঝে, তাহলে আর কেউ বোঝাতে পারে না।

আজ তার লেখা ছাপা হয়েছে এক নামী পত্রিকায়—
শিরোনাম: “একটি নারীর আত্মদেহসংবাদ”

তার লেখায় যে সাহস, যে খোলামেলা গন্ধ—তা মানুষকে চমকে দিয়েছে। কেউ প্রশংসা করেছে, কেউ সমালোচনা করেছে। কিন্তু কেউই চুপ করে থাকতে পারেনি।

তার লেখার একটা লাইন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—
“আমি শরীর দিয়েছি, লজ্জা নয়। আমি ত্বক উল্টে দেখেছি, সেখানে কোনো পাপ লেখা ছিল না।”

সেদিন এক অনলাইন লাইভে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কি এখনও প্রেমে আছেন?”

নন্দিনী একটু হেসে বলেছিল, “হ্যাঁ, আমি প্রেমে আছি। নিজের প্রেমে। আমি এখন এমন একজনকে ভালোবাসি, যার গায়ের গন্ধ আমি চিনি, যার ত্বকের ভাঁজে ঘাম জমে, যার চোখে ক্লান্তি থাকে—সেই মানুষটা আমি নিজে।”

এই উত্তর শুনে মুহূর্তে কমেন্ট বক্স ভরে গিয়েছিল। কেউ বলেছিল, “আপনার মতো সাহসী হতে চাই,” কেউ বলেছিল, “আপনি আদর্শ”—কিন্তু নন্দিনী জানে, এটা সাহস নয়, এটা প্রয়োজন। একসময় যাকে সে ভাবত প্রেম, তা ছিল কেবল শরীরের খিদে। আর এখন, সে বুঝে গেছে, নিজের শরীরকে জানাটাই সবচেয়ে গভীর প্রেম।

রাতে ঘুমোনোর আগে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের নগ্ন শরীর দেখে। আজ সে আর দাগ লুকায় না, শিরা-উপশিরায় প্যাচানো চিহ্নগুলোকে ভয় পায় না। সে নিজের স্তনের উপর আঙুল ছোঁয়ায়, নাভির গহ্বরে চুমু দেয় মন দিয়ে, উরুর ভাঁজে ভালোবাসা রাখে।

সে এখন আর কাউকে চায় না।

অভিজিৎ ছিল, এসেছে, গেছে। সঞ্জয় ছিল, একটা রুটিন ছিল, সামাজিক পরিচয় ছিল। কিন্তু সেই জায়গাগুলো কখনই তাকে প্রেম দেয়নি, দেয়নি মুক্তি।

আর আজ, নিজের শরীরের প্রতিটি কোষ যখন জেগে উঠেছে, তখন সে নিজেকেই প্রেমিক ভাবে।

সে ভাবে, “আমি কি কামনা করি না?”—
করে, খুবই করে। কিন্তু এখন সেই কামনা আসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। নিজেকে ছুঁয়ে সে যেমন চায়, তেমন করে কেউ তাকে কখনও চায়নি।

একবার এক পুরনো সহকর্মী ডেটিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল, “তুমি এত সাহসী, এত আকর্ষণীয়—চলো কোথাও যাই।”

নন্দিনী হেসেছিল। বলেছিল, “আমি এখন কোনও পুরুষের কামনার গল্প হতে চাই না। আমি এখন নিজের গল্পের একমাত্র পাঠক।”

একদিন সকালে সে নিজের জন্য একটা সিল্ক শাড়ি কিনল। গাঢ় লাল রঙের, পাতলা, হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় এমন। পরার পর আয়নায় দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বলল, “তুই কেমন লাগছিস?”

নিজেই জবাব দিল, “তুই অপূর্ব। তুই একা, কিন্তু অপরূপ।”

বিছানায় শুয়ে সে এখন আর অস্থির হয় না। যে বিছানা ছিল কামনার, ছিল সম্পর্কের, ছিল ভাঙনের—সেই বিছানাই এখন তার শান্তির। সে একা হাত রাখে নিজের বুকের ওপর, ধীরে চোখ বন্ধ করে ভাবে—আজকের মতো আমি নিজেকে পেলাম।

শরীর এখন তার আর কোনো অপরাধ নয়, কোনো গোপনীয়তা নয়। শরীর এখন তার অস্তিত্ব।

তার এক লেখায় সে লিখেছিল—
“আমি একদিন দেহ দিয়ে বাঁচতে শিখেছি, আর একদিন প্রেম দিয়ে মরতে চেয়েছি। আজ আমি জানি, আমি দেহ দিয়েই প্রেম করব, আর প্রেম দিয়েই নিজের দেহকে বাঁচাব।”

এখন তার প্রতিটি সকালে আয়নার সামনে নিজেকে স্পর্শ করে শুরু হয়। প্রতিটি রাতে নিজের ত্বক ছুঁয়ে ঘুম আসে। সে এখন নিজের শরীরে ঈশ্বর খুঁজে পায়।

একটা সময় সে চেয়েছিল, কেউ এসে তাকে ভালোবাসবে। এখন সে জানে, কেউ আসুক বা না আসুক—সে নিজেই নিজের প্রেমে ডুবে আছে।

আজকাল তার লেখায় নারীরা নিজেদের খুঁজে পায়। কেউ তাকে বলে, “তুমি আমাকে সাহস দিয়েছো,” কেউ বলে, “তুমি আমার মতো নারীকে বাঁচিয়ে তুলেছো।”

নন্দিনী জানে, এই পথ সহজ ছিল না। প্রেম দিয়ে শুরু, শরীর দিয়ে বাঁচা, ত্যাগ দিয়ে গড়া।

তবু এই পথেই সে পেয়েছে নিজের পরিচয়। আজ সে কারও মেয়ে নয়, কারও স্ত্রী নয়, কারও প্রেমিকা নয়—
সে এক নারী, যে নিজের শরীরের প্রেমে বেঁচে আছে।

আর এই প্রেম কেউ কেড়ে নিতে পারে না।

সমাপ্ত

 

1000024784.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *