অনিরুদ্ধ ঘোষ
পর্ব ১
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির জানালার পাশের ঘরটায় বসে আছে অরিত্র। চোখে তার একধরনের শূন্যতা, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে টেবিলের কোণে, আর গিটারের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে যেন কোনো স্মৃতি ছুঁতে চাইছে। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল মৃণাল, অরিত্রর ছোটবেলার বন্ধু, এখনকার থিয়েটার ডিরেক্টর।
“তুই এখনো ওই পুরনো গানের সুরটা নিয়ে পড়ে আছিস? কতবার বলেছি, নাটকটা নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে,” বলে মৃণাল চেয়ারে বসে পড়ল।
অরিত্র হালকা হেসে বলল, “এই সুরটা গেলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে রে। মা যখন ছোটো ছিলাম, এই গানের সুরেই ঘুম পাড়াতো। এখন এটা ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।”
মৃণাল একবার গভীরভাবে তাকাল অরিত্রর দিকে। অরিত্র একসময় কলেজে থিয়েটারের জনপ্রিয় মুখ ছিল। পরে এক দুর্ঘটনায় সব ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে আসে। মৃণাল চায় অরিত্র আবার ফিরে আসুক মঞ্চে।
“তুই জানিস, এবার নাট্যোৎসবে নতুন একটা নাটক করার সুযোগ পেয়েছি। ‘আলোর জানালা’। একজন পঙ্গু নাট্যশিল্পী আর তার কণ্ঠের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া শহরকে নিয়ে গল্প। আমি চাই তুই ওই চরিত্রটা করবি।”
অরিত্র হঠাৎ চুপ করে যায়। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। রোদ পড়ে এসেছে, জানালার কাচে খেলা করছে আলো।
“তুই জানিস, আমি অভিনয় করতে পারি না আর। গলা যেমন গেছে, মনও গেছে।”
মৃণাল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “আলো জানালা ভেঙে ঢোকে না, দরজাও ঠেলে আসে না। তাকিয়ে থাকতে জানতে হয়, বুঝলি?”
এই বলে মৃণাল বেরিয়ে যায়। অরিত্র চুপ করে বসে থাকে। একসময় জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে, আবার গিটারের তারে আলতো করে আঙুল চালায়। সেই পুরনো সুরটা ফিরে আসে ধীরে ধীরে।
এক তলার রান্নাঘর থেকে মা ডাক দেন, “অরিত্র, সন্ধ্যাবেলা হয়ে এল, কিছু খাসনি তো এখনো।”
অরিত্র কিছু বলে না। ঘরের মধ্যে আলো-আঁধারির খেলা। পুরনো দেওয়ালে ছবি, তার ওপরে ধুলো জমে আছে। এক কোণে শোভা পায় পুরনো এক খাঁচা—যেখানে এক সময় টিয়া পাখি থাকত, এখন খালি। ঠিক যেমন অরিত্রর জীবন।
রাত নামলে, সে নিজের পুরনো খাতা খুলে একটা সংলাপ লিখে ফেলে—“আলো কখনো আলো বলে আসে না। সে ছায়া টপকে জানালার কাচে মুখ রাখে।”
সেই প্রথম ২ বছর পর আবার কলম ছুঁলো অরিত্র। ঠিক তখনই ফোন বাজে।
স্ক্রীনে নাম—ঋদ্ধি।
যে নাম অরিত্র অনেকদিন ভুলে থাকার ভান করেছিল।
ফোনটা কিছুক্ষণ বাজে। অরিত্রর চোখে খেলে যায় পুরনো এক ছবি—মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে এক মেয়ের হাসিমুখ, চোখে আগুন, গলায় জেদ। ঋদ্ধি—একদা সহঅভিনেত্রী, প্রেয়সী, আর এখন শুধুই অতীত।
ফোনটা কেটে যায়। অরিত্র হঠাৎ করে উঠে পড়ে, গিটারটা রেখে দেয় কোণে, খাতাটা নিয়ে জানালার পাশে বসে যায়। একটা লাইন লিখে—”যে চলে যায়, সে কি সত্যি চলে যায়?”
অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, কিন্তু জানালার পাশে বসে থাকা অরিত্রের মুখে যেন আলো পড়ে থাকে।
পর্ব ২
ঘরের মধ্যে যেন শব্দ নেই কোনো। অরিত্রর লেখার খাতায় সেই একটা লাইন—”যে চলে যায়, সে কি সত্যি চলে যায়?”—ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে অনেক না বলা কথা, পুরনো দিনের ধুলোমাখা স্মৃতি আর কিছু বৃষ্টিস্নাত বিকেল, যেগুলোর গায়ে এখনও ঋদ্ধির কণ্ঠস্বর লেগে আছে।
রাত তখন অনেকটা গড়িয়ে গেছে। মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বারান্দার লোহার রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে আসা হাওয়ায় যেন শিস বাজছে। অরিত্র জানালার পাশে বসেই আছে, মুখে সিগারেট নেই, কিন্তু ভেতরের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে।
হঠাৎ আবার ফোন বাজে। স্ক্রীনে আবারও সেই নাম—ঋদ্ধি।
এইবার আর ফোনটা উপেক্ষা করতে পারে না। একবার নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা তুলে নেয়।
— “হ্যালো…”
— “অরিত্র… এতদিন পরেও তুই ঠিক সেই সুরেই হ্যালো বলিস রে…” অপর প্রান্তে ঋদ্ধির গলা, নরম, কাঁপা কাঁপা।
— “তুই ফোন করবি ভাবিনি আর কখনো,” গলা খসখসে হয়ে আসে অরিত্রর।
— “আমি ভাবিনি তুই ফোন ধরবি। কিন্তু ধরেছিস… তার মানে এখনো কিছুটা রয়ে গেছিস তুই।”
— “আমি তো কোথাও যাইনি, ঋদ্ধি। তোদের নাট্যদলটা ছেড়েছি, মঞ্চটা ছেড়েছি, তোকে নয়…”
একটা দীর্ঘ নীরবতা।
— “তুই জানিস, এবার জাতীয় নাট্যোৎসবে আমি প্রস্তাব পেয়েছি আমার লেখা নাটক ‘আলোর জানালা’ মঞ্চস্থ করার। আমি তোর নাম রেজিস্টার করে দিয়েছি মুখ্য চরিত্রে। তোর সম্মতি ছাড়াই। রাগ করিস না।”
অরিত্রর মুখে একরাশ বিস্ময়।
— “তুই… তুই আমার হয়ে কেন কথা বললি?”
— “কারণ মঞ্চে তোকে ছাড়া আমি এই নাটকটা ভাবতেই পারিনি। এই গল্পটা আসলে তোর, অরিত্র। পঙ্গু নাট্যশিল্পী, যে আলোয় মুখ ফেরাতে ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু একদিন আবার ফিরে চেয়েছিল জানালার দিকে… মনে পড়ে, আমরা একদিন এরকমই একটা গল্প লিখতে বসেছিলাম?”
অরিত্র চুপ করে থাকে। হ্যাঁ, মনে আছে। সেই রবিবার বিকেল। কলেজের ক্যান্টিনে বসে ওরা দু’জনে এক খাতা খুলেছিল, গল্প তৈরি করার নামে নিজেদের ভালবাসা লিখছিল।
— “তুই কি আসবি অডিশনে?” ঋদ্ধির গলায় এক চিলতে কাতরতা।
— “অডিশন? আমি? এখন?”
— “এই রবিবার। থিয়েটার ওয়ার্কশপে। শুধু একবার এসে দেখ। আমি তোকে প্রমিস করছি, যদি একটুও খারাপ লাগে, তুই ফিরে আসবি। কেউ জোর করবে না।”
— “তুই জানিস, আমার হাঁটুর ব্যথাটা এখনো আছে। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেও পা টনটন করে।”
— “এই নাটকে তোকে দৌড়তে হবে না, শুধু একটা চেয়ারে বসে বলতে হবে, সেই সংলাপগুলো যেগুলো তুই অনেক আগে লিখেছিলি… তোর নিজের কথা… তুই পারবি, আমি জানি।”
ফোনের ওপ্রান্তে শব্দহীনতা। তারপর একটা ক্লিক। ঋদ্ধি কেটে দিয়েছে।
অরিত্র জানালার গ্লাসে কপাল ঠেকায়। কী করবে? এতদিনের ভয়, অভিমান, লজ্জা, অপরাধবোধ সব মিলে একরকম জড়িয়ে রেখেছে তাকে। একদিকে মৃণাল, অন্যদিকে ঋদ্ধি—দুজনেই চায় অরিত্র ফিরে আসুক। কিন্তু সে কি নিজেকে সেই আলোর সামনে আবার দাঁড় করাতে পারবে?
সকালবেলা মা এসে দেখে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে জানালার পাশে, খাতাটা পাশে পড়ে আছে, মুখে একধরনের শান্তি। মা ধীরে ধীরে চা এনে পাশে রেখে বলেন, “ঋদ্ধি ফোন করেছিল?”
অরিত্র চমকে ওঠে, “তুমি জানলে কী করে?”
মা হেসে বলেন, “মা তো সব বোঝে। একদিন যেদিন ঋদ্ধি প্রথম এসেছিল আমাদের বাড়িতে, আমি বুঝে গিয়েছিলাম ওর চোখে তোকে নিয়ে কী আছে। এমন কেউ কেউ আসে জীবনে, যাদের ছেড়ে দিলে একটা আস্ত সময় থেমে যায়।”
অরিত্র সেদিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। চায়ে একটা চুমুক দেয়। তারপর নিচু গলায় বলে, “মা, যদি রবিবার ওদের ওয়ার্কশপে যাই, তুই আমার সাথে যাবি?”
মা এক মুহূর্ত থেমে বলে, “আমি শুধু গেট পর্যন্ত যাবো। তারপর তুই একাই ঢুকবি, যেমন তুই একাই মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছিলি প্রথমবার।”
রবিবার, অডিশনের দিন।
লক্ষ্মীনারায়ণ থিয়েটার হলের সামনে অরিত্র দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটুতে এখনো হালকা ব্যথা, কিন্তু চোখে একরকম প্রস্তুতি। ঋদ্ধি দূর থেকে দেখে, এক মুহূর্ত যেন চোখ ছলছল করে ওঠে তার।
“তুই এলি…” — সে ফিসফিস করে।
“তোকে দেয়া কথা তো কখনো ভাঙিনি,” — বলে অরিত্র।
সেই বিকেলের আলোয় আবার এক নতুন যাত্রা শুরু হল। অডিশন রুমে ঢুকতেই অরিত্র দেখে এক সারি নতুন মুখ—নতুন প্রজন্ম, নতুন কণ্ঠ, নতুন চোখ। তারা সবাই অপেক্ষা করছে। কেউ জানে না, সেই কোণায় দাঁড়ানো মানুষটা একসময় মঞ্চ কাঁপিয়েছিল।
কোনো ঘোষণা নেই, কোনো করতালি নেই। কিন্তু যখন অরিত্র প্রথম সংলাপটি বলে—“আমি আলো খুঁজি না আর, আমি কেবল জানালার পাশেই বসে থাকি…”—তখন গোটা ঘরটা থমকে যায়। ঘড়ির কাঁটা নড়ে না, বাতাস থেমে যায়।
আর মঞ্চে ফিরে আসে সেই অরিত্র, যে হারিয়ে যায়নি—কেবল একটু থেমেছিল।
পর্ব ৩
রিহার্সাল রুমে ঘন নীরবতা। অরিত্রর গলা থেকে বেরোনো সেই প্রথম সংলাপ যেন আছড়ে পড়েছিল প্রত্যেকের ভেতর। কারো চোখের পলক পড়েনি। কেউ কাশি দেয়নি। ঘরে শুধু শব্দ ছিল সেই কণ্ঠের, যার মধ্যে সময়ের ধুলো জমে আছে, ভালোবাসার চিহ্ন, একাকিত্বের বিষ, আর অব্যক্ত অভিমানের অভিসার।
ঋদ্ধি দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে। মুখে স্পষ্ট বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতার ছায়া। মৃণাল এগিয়ে আসে, চোখে তার চাপা উত্তেজনা। “এতদিন পরেও, তোর গলায় কেমন করে এতটা ভার থাকে রে? এতটা যন্ত্রণাও কীভাবে রয়ে যায় এত স্বরেও?”
অরিত্র হালকা হেসে বলে, “সব কিছু তো চলে যায় না। কিছু কিছু থেকে যায়, জমে থাকে, অপেক্ষা করে। কেউ যদি ডাকে, তখন বেরিয়ে পড়ে। ঠিক যেন আলোর জানালায় আলো ঢোকার মতো।”
মৃণাল বলে, “তাহলে শুরু করি। তোকে নিয়েই গোটা নাটকটা সাজাব। কাস্টিং, প্রপস, স্ক্রিপ্ট সব তোর মত অনুযায়ী গড়ে নেব। কিন্তু রিহার্সাল তবেই শুরু হবে, যদি তুই নিজে চাস।”
অরিত্র জানালার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। “আলো দেখতেই তো এসেছি। ফিরতে তো এসেছি নিজেকেই। একবার চেষ্টা করা যাক।”
পরদিন সকাল থেকে শুরু হয় রিহার্সাল। প্রথম দু’দিন শুধুই স্ক্রিপ্ট রিডিং। সবার মধ্যে একটা চাপা জড়তা, কারণ অরিত্র একটা নাম, একটা অতীত, একটা কিংবদন্তি—তারা ভয়ে অরিত্রর পাশে দাঁড়াতেও দ্বিধা করে। কিন্তু অরিত্র নিজে খুব শান্ত, সহানুভূতিশীল। নতুনদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে, মজাও করে। একদিন সে একজন নবীন অভিনেত্রী—মীরা—কে সংলাপ বলার পর থামিয়ে বলে, “তুই সংলাপ বলছিস, কিন্তু চরিত্রটা তো দেখছি না। ওর ভয় কোথায়? ওর লজ্জা কোথায়? থিয়েটার মানে তো শরীর দিয়ে কথা বলা। গলার ভেতরে শব্দ তো সবাই তৈরি করতে পারে। কিন্তু চোখ? চোখ দিয়ে সত্যিটা বল না, কেবল শব্দে সত্যি হয় না কিছু।”
মীরার চোখ ছলছল করে ওঠে, সে আবার সংলাপ বলে—এইবার নিঃসংশয়, এক অন্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
ঋদ্ধি একটা কোণে বসে নোট নিচ্ছিল। সে মাঝে মাঝে চেয়ে চেয়ে দেখে অরিত্রর অনর্গল শিক্ষা দেওয়ার ধরন, যত্ন, ভালবাসা। মনে পড়ে, কলেজের প্রথম বছর অডিশনের দিন অরিত্র কীভাবে ওর ভুল উচ্চারণ শুধরে দিয়েছিল। তারপর সেই সন্ধ্যাগুলি, যে সন্ধ্যায় ক্যান্টিন ফাঁকা হয়ে যেত, কিন্তু অরিত্র একটা পুরনো মঞ্চ নাটকের গল্প বলে যেত—দূর ইউরোপের থিয়েটার থেকে রবীন্দ্রনাথ, ঊর্মিলা থেকে মার্লন ব্র্যান্ডো।
ঋদ্ধি রিহার্সালের পর অরিত্রর পাশে এসে দাঁড়ায়। “তুই বদলাইনি, জানিস?”
অরিত্র একবার তাকিয়ে বলে, “বদলানো তোকে ভুলে গেলে হতো। আমি বদলাইনি। শুধু থেমে গেছিলাম।”
“আবার চলা শুরু করেছিস?” —ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করে।
“হয়তো। তুই তো দেখছিসই।”
ঋদ্ধি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তারপর বলে, “একটা কথা বলি? নাটকটার শেষ দৃশ্য আমি একটু বদলাতে চাই।”
অরিত্র চমকে তাকায়। “শেষ দৃশ্যটা? যেখানে চরিত্রটা জানালার দিকে মুখ করে বলে, ‘এবার আমি উঠবো’? সেটা বাদ দেবে?”
“না। আমি চাই, তার পরেও সে জানালার পাশে বসে থাকে। কারণ সব আলো জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে না। কিছু কিছু আলো মনে জন্মায়। বুঝলি?”
অরিত্র হাসে। “তুই এত ভাল লিখিস… কিন্তু মনে মনে সবসময় মনে করতিস, আমি তোকে ছেড়ে গেছিলাম। অথচ তোকে ছেড়ে যাওয়া মানেই তো নিজের লেখা ছেড়ে দেওয়া। তুই আর আমি মিলেই তো ‘আলোর জানালা’।”
ঋদ্ধি থমকে যায়। অরিত্রর মুখে এমন কিছু ছিল, যেটা অনেকদিন পর শুনল সে। কোনো সংলাপ নয়, বাস্তবের মমতা।
তিন সপ্তাহ কেটে যায়। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন এগিয়ে আসে। ফ্লায়ার ছাপা হয়, পোস্টার লাগানো হয় শহরের বিভিন্ন মোড়ে। “আলোর জানালা—নির্দেশনায় মৃণাল দত্ত, অভিনয়ে অরিত্র সেন ও ঋদ্ধি ঘোষ।”
নাটকের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে চাপও। একদিন রিহার্সালের শেষে অরিত্র হঠাৎ পা মচকায়। সবাই দৌড়ে আসে। ডাক্তার দেখিয়ে জানা যায়—পুরনো ইনজুরি আবার মাথাচাড়া দিয়েছে।
ঋদ্ধি বসে পড়ে তার পাশে। “এইবার তুই বলবি—‘আমি পারবো না’, তাই তো?”
অরিত্র চোখ বন্ধ করে বলে, “শরীর হার মানে না, মন হার মেনে নেয়। আমি ঠিক সময়মতো মঞ্চে উঠবো। পা থাকুক বা না থাকুক।”
মৃণাল বলে, “তুই যদি না পারিস, আমরা নাটক পিছিয়ে দেবো।”
অরিত্র ততক্ষণে চোখ খুলে চুপচাপ এক কোণে রাখা হুইলচেয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে।
“না। এই নাটক আমার জীবনের শেষ সুযোগ নয়, এটা আমার নতুন শুরু। আমি যদি এই চরিত্রটাকে সত্যি করে তুলতে পারি, তাহলে আর কিছু দরকার নেই। আর এই চরিত্রটা তো পঙ্গুই, তাই না? তাহলে আমার বাস্তবই আমার সেরা অভিনয় হবে।”
ঋদ্ধি চোখের জল মুছে বলে, “তুই হুইলচেয়ারে অভিনয় করবি?”
“হ্যাঁ। সত্যি দিয়ে মিথ্যে তৈরি করব। আর সেটা যদি থিয়েটার না হয়, তাহলে কিছুই নয়।”
চুপ করে যায় সবাই। বুঝে যায়—এই মানুষটা ফিরে এসেছে। নিজের আলো নিয়ে। নিজের জানালার পাশে।
পর্ব ৪
নাটকের দিন যত এগিয়ে আসে, ততই যেন শহরের বাতাসে একরকম শিহরণ জমে। পোষ্টারে যে মুখটা ছাপা হয়েছে—অরিত্র সেন, এক সময়ের তারকা, বহুদিন পর আবার ফিরে আসছে মঞ্চে। লোকমুখে গুঞ্জন—এই কি তবে প্রত্যাবর্তনের গল্প? কেউ বলছে, সে পারবে না; কেউ বলছে, এই নাটক বদলে দেবে অনেক কিছু।
অন্যদিকে থিয়েটার রিহার্সাল ঘর একেবারে অন্যরকম হয়ে উঠেছে। সব অভিনেতা-অভিনেত্রী যেন আরও যত্নে সংলাপ বলছে, শরীরের অঙ্গভঙ্গিতে টান টান মনোযোগ, যেন অরিত্রর উপস্থিতি নিজে একটা শিক্ষা। প্রতিদিনের রিহার্সাল শেষে কেউ তাড়াতাড়ি চলে না। সবাই থাকে, দেখে, শেখে, বুঝে।
ঋদ্ধি প্রতিদিন আগেই চলে আসে, মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে সমস্ত আলো পরীক্ষার সময় নিজের সংলাপ বারবার বলে যায়। অরিত্র এখন হুইলচেয়ারেই রিহার্সাল করে। শুরুতে অদ্ভুত লাগলেও, ধীরে ধীরে যেন সেই চেয়ারটাই তার চরিত্র হয়ে উঠেছে।
একদিন সন্ধ্যায় রিহার্সালের পর, থিয়েটারের ভেতর আলো নিভে আসতেই অরিত্র বলে, “ঋদ্ধি, একটু থাকবি?”
ঋদ্ধি থামে। বাকিরা বেরিয়ে যায়। মঞ্চে শুধু তারা দুজন।
অরিত্র ধীরে ধীরে বলে, “জানিস, অনেকদিন ধরেই একটা কথা বুকের মধ্যে আটকে ছিল। তোকে বলিনি, কারণ ভয় পেতাম।”
ঋদ্ধি একটু চমকে যায়, “কী কথা?”
“তোর যাওয়ার পর আমি সত্যি একা হয়ে গেছিলাম। কিন্তু যেদিন জানলাম তুই চলে যাচ্ছিস, সেদিন তোর মুখে কিছু না শুনে… আমি একরকম খুশি হয়ে পড়েছিলাম।”
“খুশি?” ঋদ্ধির কণ্ঠে বিস্ময়।
“হ্যাঁ। কারণ আমি নিজেই জানতাম না তোকে আমি কতটা ভালোবাসি, যতক্ষণ না জানলাম তুই চলে যাচ্ছিস। আমি ভয় পেয়েছিলাম। আর তখনই বুঝেছিলাম—ভালোবাসা মানে না পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে হারানোর ভয়।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে।
“আমি তোকে ছেড়ে যাইনি, অরিত্র। আমি নিজেকে বাঁচাতে পালিয়েছিলাম। তুই তখন এত ভেঙে পড়েছিলি, আমি নিজেই তোর কষ্টের ভার নিতে পারছিলাম না। আমি বিশ্বাস করতাম না যে তোকে ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আজ… তোকে দেখলে মনে হয়, মানুষ আবার নিজের ছায়াকে ছাপিয়ে যেতে পারে।”
অরিত্র হেসে বলে, “আর সেই গল্পটাই তো আমরা বলছি এই নাটকে। এক পঙ্গু মানুষ, যে ভাবত তার জীবনে আর আলো নেই, সে জানালার পাশে বসে বসেই নতুন সূর্য দেখে।”
ঋদ্ধি বলে, “তবে নাটকের শেষ দৃশ্যটা একটু বদলাও না? চরিত্রটা যেন একটা চিঠি পড়ে, একটা পুরনো চিঠি—যেটা সে কোনোদিন কাউকে পাঠাতে পারেনি।”
অরিত্র একবার ভাবনার গভীরে ডুবে যায়। “চিঠি… হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। কিন্তু কে লিখেছে সেই চিঠি?”
ঋদ্ধি বলে, “ধর, সেই চিঠিটা লিখেছে এক পুরনো প্রেম। কিন্তু পাঠানো হয়নি। সেই চিঠিতেই লেখা ছিল—‘তুই হয়তো জানালার পাশেই থাকবি, আমি হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসব না, কিন্তু জানালায় যদি আলো পড়ে, জানবি আমি আছি।’ ”
অরিত্র চোখ নামিয়ে ফেলে। মুখে একটা নরম হাসি।
“তুই কি এই চিঠিটার কথা বলছিস?” বলে নিজের ব্যাগ থেকে একটি হলুদ হয়ে যাওয়া খাম বের করে।
ঋদ্ধির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়।
“এটা তো… আমার হাতে লেখা!”
“হ্যাঁ। তুই নাট্যদল ছেড়ে যাওয়ার আগের দিন এটা তুই আমার ব্যাগে রেখেছিলি। আমি পড়েছিলাম। কিন্তু কোনোদিন বলিনি। কারণ বললে হয়তো তুই ফিরতে চাইতিস, আমি চাইনি তুই অপরাধবোধে ভুগিস। আমি জানালার পাশে বসেই অপেক্ষা করতাম। ঠিক যেমন নাটকের চরিত্রটা করে।”
ঋদ্ধির চোখে জল জমে। সে ধীরে এসে অরিত্রর পাশে বসে।
“আমরা কি এই নাটকের চরিত্র হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে?”
“না,” অরিত্র বলে, “আমরা বরং চরিত্রগুলোকে আমাদের মতো করে তুলছি। তাই তারা সত্যি হয়ে উঠছে। নাটক আর জীবনের মাঝখানে এক জানালা। সেই জানালা দিয়েই আলো আসে।”
দু’জনেই চুপ করে বসে থাকে। মঞ্চে আর কেউ নেই। আলো নিভে গেছে, শুধু স্টেজলাইটের এক কোণায় হালকা নীল আভা।
তৃতীয় দিন, ফাইনাল রিহার্সাল।
থিয়েটার পূর্ণ। প্রায় একশো দর্শক, শিল্পী, নাট্যকার ও সমালোচক উপস্থিত। কেউ জানে না এটাই মূল নাটকের ঠিক আগের রাতের প্রিভিউ। দর্শকের মধ্যে রয়েছে শহরের থিয়েটার মহলের নামীদামী মানুষজন।
মঞ্চে অরিত্রর প্রথম দৃশ্য। হুইলচেয়ারে বসে, আলোয় চেয়ারটা ঢেকে যাচ্ছে। সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর মুখ তোলে।
“আমি জানি, তোমরা সবাই তাকিয়ে আছো… আমার পা নয়, আমার চোখের দিকে। কেননা এই চোখেই আমি হারিয়েছি শহরের মুখ, প্রেমিকার মুখ, নিজের মুখ। জানালায় আমি আর তাকাই না, কারণ আমি জানি আলো আর ঢোকে না।”
দর্শকেরা নিঃশব্দ। এরপর সংলাপ এগোয়, নাটক ঘনীভূত হয়। নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারফর্ম্যান্স চোখে পড়ার মতো। কিন্তু অরিত্রর উপস্থিতি যেন সবকিছুর ওপর ছায়া ফেলে রাখে।
শেষ দৃশ্য। অরিত্রর চরিত্র জানালার দিকে চেয়ে বলে—
“আজ আমি একটি চিঠি পড়ে শোনাবো, যেটা লেখা হয়েছিল, কিন্তু পাঠানো হয়নি।”
সে চিঠিটা খুলে পড়ে। সেই চিঠি, যা ঋদ্ধি লিখেছিল। কণ্ঠে তার গভীরতা, স্পষ্টতা, এবং সেই অনুপম ব্যথা।
“… জানালায় যদি আলো পড়ে, জানবি আমি আছি।”
প্রেক্ষাগৃহ নিঃশব্দ। কিছুক্ষণ সেরকমই থাকে। তারপর হঠাৎ—একটি করতালি। তারপর আরও। তারপর গোটা ঘরটায় যেন বজ্রধ্বনির মতো করতালির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।
নাটক শেষ হয়। আলো নেমে আসে।
মঞ্চের পর্দার ওপারে বসে থাকা অরিত্র জানে—সে ফিরে এসেছে। ঠিক যেমন নাটকের চরিত্রটা ফিরে পেয়েছিল নিজেকে।
পর্ব ৫
নাটক শেষ হওয়ার পরেও থিয়েটার ঘরে করতালির প্রতিধ্বনি যেন কানে বাজতে থাকে। শহরের পুরনো থিয়েটারচর্চার ভেতরে এক নতুন আলো ছড়িয়ে পড়ে—একজন হারিয়ে যাওয়া শিল্পীর প্রত্যাবর্তন শুধু নয়, একজন মানুষের নিজের ছায়াকে ছাপিয়ে ওঠার গল্প।
পর্দা পড়ার পর, অভিনেতারা এসে দাঁড়ায় একসাথে। অরিত্রকে ধীরে ধীরে হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে আসেন মীরা। দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, “ভালোবাসা এমনই হয়… যন্ত্রণা থেকে জন্ম নিয়ে আলো হয়ে যায়!”
মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মৃণাল চোখে হাত রাখে। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কৃতজ্ঞতার অশ্রু। এই শহরে নাটক মানেই যেখানে রাজনীতি, শ্লোগান, ক্ষমতার লড়াই, সেখানে এই গল্পটি যেন নিঃশব্দে ভালোবাসাকে মঞ্চে ফিরিয়ে এনেছে।
অভিনেতাদের ভেতর একটি বয়স্ক মানুষ উঠে আসে মঞ্চে—গৌতমদা, যিনি এক সময় শহরের সবচেয়ে প্রশংসিত নাট্যকার ছিলেন। তিনি ধীরে এসে অরিত্রর কাঁধে হাত রাখেন।
“তুই প্রমাণ করলি, অভিনয় শুধু অভ্যাস নয়, তা আত্মার আর্তি। আমি বহু বছর পর আজ চোখে জল নিয়ে মঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছি,” — বলে তিনি হাত মুছে চলে যান। তার হাঁটার গতি ধীর, কিন্তু প্রত্যেক পদক্ষেপে একটা স্বীকৃতির অনুরণন বাজে।
ঋদ্ধি অরিত্রর পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলে না। শুধু হালকা করে হাত রাখে তার গায়ে। তারা দুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। যেন মঞ্চের সমস্ত শব্দ, আলো, দৃষ্টি ছাপিয়ে কেবল একটিই জিনিস তখন প্রাসঙ্গিক—দুজন মানুষের নীরব যোগাযোগ।
পরদিন সকালে শহরের প্রায় সমস্ত দৈনিক পত্রিকার সংস্কৃতির পাতায় ‘আলোর জানালা’-র প্রথম রিভিউ।
“এক নতুন সূর্যোদয়”—প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম।
“অরিত্র সেন—শরীর পঙ্গু হতে পারে, আত্মা নয়”—সমালোচক অমিতাভ বসু লিখেছেন।
“ঋদ্ধি ঘোষের সংলাপ যেন চিঠির ভাঁজ খুলে দেয়। সংলাপে নয়, চোখে চোখে অভিনয়।”
থিয়েটার দলের ঘরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। প্রতিটি মুখে প্রশংসা, ক্লান্তি আর গর্বের ছায়া। মীরা এসে অরিত্রর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি না থাকলে, আমি কোনোদিন বুঝতাম না—একটা সংলাপও কতটা জীবন্ত হতে পারে!”
অরিত্র মাথা ঠেকিয়ে বলে, “তুমি শিখেছ, আর আমি ফিরে পেয়েছি নিজেকে। এটাই তো থিয়েটার—প্রত্যেক চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়া আর নিজের কিছু ফেলে আসা।”
সেইদিন বিকেলে মৃণাল সবাইকে একবার করে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমাদের ‘আলোর জানালা’ এবার মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, এমনকি কোলকাতা থিয়েটার ফেস্টিভ্যালেও ডাক পেয়েছে। আগামী তিন মাস শুধু ভ্রমণ, মঞ্চ আর আলো!”
এক মুহূর্তের জন্য ঘরে নিঃশব্দ নেমে আসে। কেউ ভাবতেও পারেনি এমন কিছু ঘটবে। তারপর হইহই করে উঠল সবাই।
অরিত্র একটু চুপ করে থাকে। হুইলচেয়ার ঠেলে সে ধীরে ধীরে জানালার পাশে গিয়ে বসে। বাইরে হালকা বাতাসে পাতাগুলি দুলছে। ছায়া আর আলোয় তার মুখ খেলা করছে।
ঋদ্ধি পাশে এসে বলে, “তুই চুপ করে গেলি কেন?”
“ভাবছিলাম, আমি তো জানালার পাশে বসতেই অভ্যস্ত। এবার জানালার বাইরেও হাঁটতে হবে, যদিও পা নেই।”
ঋদ্ধি মুচকি হাসে। “তোর অভ্যস্ততাই তোর সাহস। তুই যা পারিস, আমাদের অনেকেই তা পারে না—নিজেকে মেনে নেওয়া। এটা অনেক বড় সাহস।”
“তুই থাকবি তো আমার পাশে?” — অরিত্র ধীরে বলে।
ঋদ্ধি একটু থেমে বলে, “আমি কখনো তোকে ছাড়িনি অরিত্র। শুধু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—তুই নিজের আলো খুঁজে পেলি কিনা দেখতে।”
সন্ধ্যাবেলা অরিত্র একা বসে খাতার পাতায় একটা নতুন সংলাপ লেখে।
“আলো ফিরে আসে না। আলো সবসময় থাকেই। শুধু জানালার পর্দা সরাতে হয়।”
রাত বাড়ে। সবাই চলে যায়। থিয়েটারের বাতি নিভে যায় একে একে। কিন্তু মঞ্চে তখনো আলো জ্বলে আছে, হুইলচেয়ারে বসে অরিত্র একা একা নিজের সংলাপ বলছে। যেন প্রতিটি শব্দে সে নিজেকে আরও একবার ফিরে পাচ্ছে।
হঠাৎ পেছন থেকে এক কিশোরী এসে দাঁড়ায়। বয়স বড়জোর চৌদ্দ কি পনেরো। মঞ্চের বাইরেই দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি সত্যি পঙ্গু?”
অরিত্র চমকে তাকায়। কিশোরীর মুখে বিস্ময় আর কৌতূহল।
সে হেসে বলে, “তুই সত্যি ভাবিস অভিনয় আর বাস্তব আলাদা?”
মেয়েটি মাথা নাড়ে। “আমি ভাবি, বাস্তবটাই সবচেয়ে বড় নাটক। আপনি সেটা বুঝিয়ে দিলেন।”
অরিত্র মৃদু হেসে বলে, “তাহলে তুই বুঝে গেছিস। নাটকটা শুধু মঞ্চের নয়, জীবনের। আলোও শুধুই জানালায় নয়, চোখে, মনে, শব্দে।”
মেয়েটি চলে যায়। অরিত্র আবার নিজের খাতার দিকে ফিরে যায়।
এই নাটক আর থেমে থাকবে না। নতুন শহর, নতুন দর্শক, নতুন আলো—সবকিছুর মাঝে ‘আলোর জানালা’ শুধু এক অভিনয় নয়, এক উপলব্ধির নাম হয়ে উঠবে।
এখন শুধু অপেক্ষা—পরবর্তী মঞ্চ, পরবর্তী দর্শন, পরবর্তী শব্দ।
পর্ব ৬
রেলস্টেশনের লাউডস্পিকারে ভেসে আসে ঘোষণা—“এই ট্রেন মুম্বই লোকাল গন্তব্যে পৌঁছতে চলেছে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে।” অরিত্রর চোখে রোদ পড়ে আছে, পেছনে থিয়েটার দলের ব্যাগ, প্রপস, মেকআপ ট্রাঙ্ক। সামনে বিশাল মুম্বই শহর, আর তার বুক চিরে তৈরি হতে চলা আরেকটা মঞ্চ।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধি তার ফোনে টিকিট চেক করছে। মৃণাল চা হাতে এসে দাঁড়ায় পাশে।
“কেমন লাগছে? পঁচিশ বছর পর এই শহরে আবার নাটক করতে আসলি।”
অরিত্র হালকা হেসে বলে, “মনে হচ্ছে যেন একটা পুরনো গল্প আবার শোনা শুরু করেছি। যেটা একদিন থেমে গিয়েছিল, আজ আবার বাজছে।”
ঋদ্ধি এসে বলে, “তোর জন্য মুম্বই ফেস্টিভ্যালে খুব জোরালো প্রতিক্রিয়া এসেছে। রুম ফিল্ড হয়েছে, সাংবাদিক ইন্টারভিউ, রেডিও—সব একসাথে। একবার ভাবছি, তুই যদি রাজি থাকিস, একটা ছোট ডকুমেন্টারি বানাই তোর নিয়ে।”
“আমার নিয়ে?”—অরিত্র একবার তাকায়।
“তুই জানিস না, তুই কতজনের সাহস হয়ে উঠেছিস এই নাটকের পর। অনেকে চিঠি লিখেছে থিয়েটার ঘরে, কেউ বলেছে অন্ধকারে ছিল, তোর সংলাপে তারা আলোর মুখ দেখেছে।”
মৃণাল বলে, “একজন মানুষ যদি আরেকজনের মনে আলো জ্বালাতে পারে, সেটাই থিয়েটার। তুই সেটাই করেছিস।”
মুম্বইয়ে প্রথম দিনের ফেস্টিভ্যাল হাউসে প্রবেশ করতেই, একঝাঁক মিডিয়া, ক্যামেরা, এবং সাংস্কৃতিক মুখ এসে ঘিরে ধরে।
“স্যার, আপনার ফিরে আসার গল্পটা কি আপনি নিজেই লিখেছিলেন?”
“এই চরিত্র কি আপনার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি?”
“ঋদ্ধি ম্যাডামের সঙ্গে আবার মঞ্চে ফেরা, সেই অনুভূতি কেমন ছিল?”
অরিত্র মাথা নিচু করে একটাই কথা বলে, “আমি তো হারিয়ে যাইনি, শুধু নিজেকে একটু চুপ করে খুঁজছিলাম। যারা ফিরে আসতে চায়, তারা একদিন ফিরবেই।”
সেই রাতে ফেস্টিভ্যাল অডিটোরিয়ামের মঞ্চে যখন “আলোর জানালা” শুরু হয়, তখন হল ভর্তি দর্শক নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। অন্য শহরের মানুষ হলেও, অরিত্রর কণ্ঠস্বর, তার চাহনি, তার নিঃশ্বাস যেন তাদের একেকটা কথা বলে।
শেষ দৃশ্য। চিঠি পড়া শেষ করে অরিত্র একটু থেমে যায়। জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“জানালার কাচে ভোরের আলো পড়ে। কেউ দেখে, কেউ না দেখেই চলে যায়। কিন্তু আমি জানি, সেই আলো আমাকে খুঁজেই এসেছে।”
পর্দা পড়ে। এই শহরেও করতালির ধ্বনি দীর্ঘ সময় ধরে বেজে চলে। থিয়েটারের ডিরেক্টর, সমালোচকরা মঞ্চের বাইরে এসে বলে,
“বহুদিন পর থিয়েটার সত্যিই থিয়েটার হয়ে উঠল।”
“অভিনয় নয়, আত্মপ্রকাশ। অরিত্র সেন যেন এক শিল্পের নাম।”
নাটক শেষে সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে। রাত তখন গভীর, হোটেলের করিডোরে নীরবতা। অরিত্র একা নিজের ঘরে জানালার পাশে বসে। মুম্বইয়ের ঝলমলে আলো নেমে এসেছে শহরের গায়ে, কিন্তু তার চোখে ভেসে আসে পুরনো সেই উত্তর কলকাতার জানালা, যেখানে সে প্রথম লিখেছিল—”আলো কখনো বলে আসে না, জানালার কাচে মুখ রাখে চুপচাপ।”
ফোন বাজে। ঋদ্ধি।
— “ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
— “না। তোকে ভাবছিলাম।”
— “তুই জানিস, আজ মঞ্চের পর আমি অনেক মানুষের চোখে জল দেখেছি। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে ছিল জানালার দৃশ্যে।”
— “কারণ তারা জানে, সেই জানালা শুধু আমার নয়। আমাদের প্রত্যেকের জানালার সামনে কিছু অন্ধকার জমে থাকে। কেবল কেউ কেউ সাহস করে কাচ মুছে তাকায়।”
— “তুই তো সেই মানুষটা, অরিত্র।”
একটু চুপ। তারপর অরিত্র বলে, “ঋদ্ধি, আমি যদি বলি, আমি আর ফিরে যেতে চাই না পুরনো জীবনে—চুপচাপ, একা, ভাঙা…?”
ঋদ্ধি ধীরে বলে, “তাহলে নতুন জীবন শুরু কর। যেটার শুরু এই জানালা থেকে, কিন্তু গন্তব্য কোথায় হবে, তা আমরা মিলেই লিখব।”
রাতের মাঝখানে সেই কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হয়ে গায়ে এসে পড়ে।
পরদিন সকালে, মুম্বইয়ের পত্রিকায় আবার খবর—
“একটি নাটক, একটি শহর, একটি জানালা—’আলোর জানালা’ মুম্বইয়ের দর্শকের চোখে জল এনেছে।”
একটি ছোটো শিশু এসে দাঁড়ায় মঞ্চের বাইরে। তার হাতে ‘আলোর জানালা’র ফ্লায়ার। সে অরিত্রকে দেখে বলে,
“আমি জানালার পাশে বসে আছি আজকাল। মা বলেছে, আলো আসবেই একদিন।”
অরিত্র হেসে বলে, “আর আমি বলি, আলো সবসময় আসে, যদি মনে একটা জানালা রাখিস।”
শহর বদলায়, নাটক এগোয়। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, ভুবনেশ্বর—প্রত্যেক শহরেই ‘আলোর জানালা’ হয়ে উঠছে মানুষের গল্প। একটা নাটক, একটা জানালা, আর একজন পঙ্গু মানুষের চোখ দিয়ে দেখা পৃথিবী—এই তিনে তৈরি এক মহাকাব্য, যেটা লিখছে শত শত দর্শক, শিল্পী আর অপেক্ষা করে থাকা কেউ একজন।
একদিন সন্ধ্যায়, থিয়েটার রিহার্সালের শেষে, অরিত্র ও ঋদ্ধি চুপ করে বসে থাকে মঞ্চের নিচে।
অরিত্র বলে, “তুই জানিস, আমি এখনো ভয় পাই? যদি আবার হারিয়ে যাই?”
ঋদ্ধি হাত ধরে বলে, “ভয় মানেই তো তুমি জীবিত। ভয় পেলে জানলা খুলে দিস, আমি পাশে থাকব। আমি এখন আর দূরে যাব না, অরিত্র।”
অন্ধকার থিয়েটারে, নিঃশব্দে, দুটি হাত জড়িয়ে থাকে। বাইরে রাতের শহরে হাজার হাজার জানালায় আলো জ্বলে, কারও মুখ দেখা যায়, কারও দেখা যায় না। কিন্তু কোথাও না কোথাও, আলো ঠিকই জানালায় মুখ রাখে।
পর্ব ৭
অন্ধকার মঞ্চে আলো জ্বলে উঠছে ধীরে ধীরে। অরিত্র হুইলচেয়ারে বসে। তার চোখ জানালার দিকে, কিন্তু চোখের দৃষ্টির থেকেও গভীর যেন তার ভেতরের চাহনি। ধীর, স্থির, আত্মস্থ।
“জানালাটা আর খুলি না আমি। শুধু চেয়ে থাকি। জানালার ওপাশে কেউ আছে কি না, তা জানার জন্য না—নিজের মনটা শুনতে চেষ্টা করি।” — সংলাপ বলে সে থেমে যায়।
এটা এখন প্রতিটি শহরের ‘আলোর জানালা’ নাটকের শেষ দৃশ্যের সংলাপ। এবং নাটকের সবচেয়ে প্রশংসিত মুহূর্ত।
এইবার তারা এসেছে ভুবনেশ্বর নাট্য উৎসবে। স্টেজে ওঠার আগে পেছনের ঘরে বসে ঋদ্ধি চুপচাপ মেকআপ তুলছে আয়নার সামনে। অরিত্র এসে পেছন থেকে বলে, “আজ তোর চোখে একটু অন্যরকম ঝিলিক দেখছি।”
ঋদ্ধি আয়নার দিকে তাকিয়েই বলে, “আজ মায়ের মৃত্যুদিন। এই নাটকটা মা কোনোদিন দেখতে পারেনি, কিন্তু উনি চেয়েছিলেন আমি যেন একদিন এমন কিছু করি যাতে মানুষ কাঁদে—আমার অভিনয়ে নয়, আমার কথায়।”
অরিত্র থেমে যায়। “তুই কখনো বলিসনি…”
“কারণ আমরা কেউ নিজেদের দুঃখ নিয়ে স্টেজে উঠি না, তাই না? কিন্তু জানিস, দুঃখই আমাদের শক্তি, ঠিক জানালার পাশের অন্ধকারের মতো—যেখানে আলো সবচেয়ে স্পষ্ট হয়।”
রিহার্সাল শেষ। তারা মঞ্চে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎই একজন থিয়েটার কর্মী এসে বলে, “আপনাদের নাটক দেখতে আজ এসেছেন স্বয়ং সত্যদীপ ঘোষ। ওনার মতো খ্যাতনামা পরিচালক এই উৎসবে সাধারণত আসেন না। ওনার সামনে পারফর্ম করতে পারা মানেই এক ধরনের স্বীকৃতি।”
সবাই এক মুহূর্ত থমকে যায়। এই নাম শুনেই কলকাতার শিল্প মহলে এখনো কাঁপুনি ওঠে—যার নাটক প্যারিস, বার্লিন, নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্থ হয়েছে, যিনি শিল্পকে ধর্মের মতো মানেন। অরিত্র চোখ বন্ধ করে বলে, “তাহলে আজ শুধু অভিনয় নয়, আত্মা দিয়ে বলতে হবে।”
শো শুরু হয়। একের পর এক দৃশ্য এগিয়ে চলে। দর্শক নিঃশব্দ। অরিত্রর কণ্ঠস্বর, ঋদ্ধির চোখ, মীরার চাহনি—সব মিলিয়ে নাটক যেন প্রাণ নিয়ে দাঁড়ায়।
শেষ দৃশ্য। অরিত্র জানালার দিকে চেয়ে বলে—
“আমি জানি না, তুমি ফিরে আসবে কি না। জানালার ওপাশে তুমি আছ কি না। কিন্তু জানালার কাচে আমার শ্বাস জমে রয়ে যায়, জানো? সেইটুকুই বাঁচিয়ে রাখে আমাকে।”
নাটক শেষ। আলো নিভে যায়। করতালির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে, তারপর অনেকক্ষণ চলতেই থাকে।
ব্যাকস্টেজে যখন সবাই এসে দাঁড়ায়, মৃণাল বলে, “আজকের অভিনয়, আমি বলব—এটাই সেরা পারফরম্যান্স। শুধু এই শো নয়, তোদের জীবনের সেরা।”
একটা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে আসে আলোর নিচে। সত্যদীপ ঘোষ। তার চোখে সানগ্লাস, কিন্তু মুখে একরকম গাম্ভীর্য আর প্রশ্রয়।
“তোমাদের নাটকটা আমি শেষ পর্যন্ত বসে দেখেছি। কারণ আমি উঠে যেতে পারিনি। অরিত্র সেন, তোমার অভিনয় নয়—তোমার ‘থেমে থাকা’ আমাকে ছুঁয়ে গেছে। থিয়েটারে সবাই বলে, চরিত্রে ডুবে যেতে হয়। তুমি চরিত্রের ভেতরে থেকেও একটা জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিলে। অসাধারণ।”
তারপর সে ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি সংলাপ লেখো না কেন?”
ঋদ্ধি চমকে যায়।
“তোমার সংলাপ গুলো যেন কবিতা, কিন্তু কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাট্যকাররা শব্দে ফাঁদ তৈরি করে, তুমি শব্দে মুক্তি দিতে জানো।”
ঋদ্ধি কিছু বলতে পারে না। মাথা নিচু করে ফেলে।
সত্যদীপ বলেন, “আমি চাই, তোমরা আমার নতুন প্রজেক্টে যুক্ত হও। আমি একটা আন্তর্জাতিক প্রযোজনায় কাজ করছি—‘The Other Window’। এটা একটি দ্বৈত নাটক—একটা ভারতীয়, একটা ইউরোপীয় চরিত্র নিয়ে। আমি চাই, অরিত্র তুমি ভারতীয় চরিত্র করো, আর ঋদ্ধি, তুমি সহ-লেখক হও স্ক্রিপ্টের।”
ঘরে নীরবতা। কেউ ভাবেনি, এমন প্রস্তাব আসতে পারে। মীরার মুখে বিস্ময়, মৃণাল চেয়ে আছে অভিভূতের মতো।
অরিত্র বলে, “আমি ভাবিনি এমন কিছু হবে। আমি তো নিজের ভাঙা জানালাটা জোড়ার চেষ্টা করছিলাম মাত্র।”
সত্যদীপ বলে, “আর আমি দেখছি, তুমি শুধু জানালা নয়, নিজের চারপাশের অন্ধকারও আলোকিত করে তুলছো।”
পরদিন সকালের ট্রেনে তারা ফিরছে কলকাতায়। কামরার জানালার পাশে বসে অরিত্র চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। ঝোপঝাড়, গাছ, ধানক্ষেত, দূরের শাল বন—সব যেন একেকটা দৃশ্যপট।
ঋদ্ধি এসে বসে পাশে। “তোকে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“আমি রাজি হয়েছি সত্যদীপের প্রজেক্টে কাজ করতে, কিন্তু একটা শর্তে।”
“কি শর্ত?”
“যতদিন তুই থাকবি, ততদিনই আমি লিখব। কারণ আমার সংলাপ শুধু তোর মুখ দিয়ে জীবন্ত হয়।”
অরিত্র তাকায়। মুখে একটানা শান্তি।
“আমি তো জানালার পাশে বসেই আছি। শুধু আলোর দিকে তাকাচ্ছি। তুই তোর শব্দ নিয়ে আসলে, জানালার ওপারেই তোকে দেখতে পাই।”
ট্রেনের জানালায় ভেসে আসে আলো। পাশে বসে থাকা দুজন মানুষ—একজন অভিনয়ে ফিরে আসা শিল্পী, আর একজন নিজের লেখা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা প্রেমিকা। আর এই দুজনের মাঝখানে পড়ে থাকে এক খোলা খাতা, যেখানে লেখা—
“জানালার ওপারে সে বসে থাকে, আমি তার আলোয় লিখে চলি।”
পর্ব ৮
কলকাতায় ফিরে আসার পর সবকিছু যেন একটু বদলে গিয়েছে। উত্তর কলকাতার সেই পুরনো বাড়ির জানালায় এখন আর ধুলোর আস্তরণ জমে না। মা প্রতিদিন জানালার কাচ মুছে রাখেন। অরিত্র সেই পুরনো জানালার পাশেই এখন বসে না; সে ঘরে কম আসলেও, সেই জানালা যেন এখন অন্য অনেকের চোখে ভেসে থাকে—পত্রিকার পাতায়, সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রলিং-এ, আর থিয়েটারের ব্যাকস্টেজে।
‘আলোর জানালা’ এখন শুধু একখানা নাটক নয়—এ এক আন্দোলন। এক বারে ফিরে আসা নয়, ফিরে আসার প্রেরণা।
সত্যদীপ ঘোষের প্রজেক্ট ‘The Other Window’-র প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একটি চিত্রনাট্য মিটিং হয়। স্থান—কলকাতার রবীন্দ্র সদনের পাশে এক পুরনো কাঠের মেঝের ঘর, যার দেওয়ালে ছবি ঝুলছে বিখ্যাত নাট্যকারদের, আর মেঝেতে ছড়ানো নানান রকম কাগজ, প্রপস, বই, নোট।
ঋদ্ধি এখন লিখছে নিয়মিত। তার ডায়েরির পাতা ভর্তি হচ্ছে দৃশ্যের নকশা, সংলাপের খসড়া আর তার নিজস্ব ভয় আর সাহসের টুকরো অনুভূতি দিয়ে। একদিন লিখে—
“আমার কণ্ঠে তোমার নীরবতা যদি বসে থাকে, তবে অভিনয় শুধু মঞ্চেই হবে না—তোমার চোখে, আমার কাঁধে, জানালার কাচে।”
অরিত্র তাকে দেখে মুচকি হাসে। তারপর বলে, “তুই কখনো জানতিস, তোর লেখায় এতখানি আলো লুকানো ছিল?”
“না,” —ঋদ্ধি চোখ সরিয়ে বলে, “আলো তো আমি খুঁজে পেয়েছি তোকে দেখে।”
প্রতিদিন রিহার্সাল শেষে দুজনে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে হাঁটতে বের হয়। একদিন তারা গেলো সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারিতে। হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে অরিত্র বলল, “তুই জানিস, থিয়েটারের চেয়েও বড় থিয়েটার কোথায় হয়?”
ঋদ্ধি তাকাল। অরিত্র আঙুল দিয়ে দেখাল—সামনের এক পুরনো কবরে লেখা আছে,
“He acted in silence, and the world watched unknowingly.”
ঋদ্ধি ধীরে বলল, “নীরবতা… তুই তো এখনো অনেক সময় চুপ করে থাকিস।”
“কারণ আমার ভেতরে শব্দ জমে যায়। আমি সব বলতে পারি না। কিছু কিছু আলো শব্দহীন হয়, বুঝলি?”
ঋদ্ধি কিছু বলল না। সে জানে—অরিত্র এখনো একরকম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে নিজের সঙ্গে। নাট্যসফলতা, সম্মান, প্রেম—সব পেয়েও সে কিছু একটার জন্য কাঁপে মাঝে মাঝে। একরকম অনিশ্চয়তা, যেন আলো এসে চোখে প্রশ্ন ফেলে।
একদিন সন্ধ্যায়, সত্যদীপ ঘোষ এসে জানালেন, “আমরা চাই, প্রজেক্টটা শুরু হোক লন্ডনে। সেখানে একটা স্ক্রিপ্ট রিডিং সেশন হবে। তারপর প্যারিসে রিহার্সাল, এবং বার্লিনে প্রিমিয়ার। এরকম সুযোগ খুব কম আসে। তোমাদের দুজনের উপরেই নির্ভর করবে সম্পূর্ণ প্রথম পর্বের মেজাজ।”
ঋদ্ধি বিস্ময়ে বলে, “লন্ডন? প্যারিস? আমি তো বিদেশ যাইনি কোনোদিন!”
অরিত্র বলে, “নাটকের গল্প তো আমরাই বলি, এবার সেই গল্পটা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে।”
কিন্তু সেই রাতেই কিছু একটা বদলে যায়।
অরিত্র বাড়ি ফিরে মায়ের মুখে শুনে, তাঁর রক্তচাপ খুব বেড়ে গেছে। রিপোর্টে ধরা পড়েছে হঠাৎ একটা হার্টের প্রবণতা। ডাক্তার বলেছেন, তিন মাস পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, আর একা থাকা একদম চলবে না।
মা অরিত্রকে দেখে হাসেন। “তুই ভাবিস না। আমি ঠিক আছি। তুই তোর নাটক নিয়ে যা।”
অরিত্র চুপ করে। জানে, তিনি শুধু ছেলের আনন্দ দেখতে চান। কিন্তু সত্যিকারের প্রশ্নটা এখন নিজের মনেই জেগে উঠেছে—সে কি যাবে? মাকে ফেলে রেখে প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন—সেই আলোছায়ার খেলা?
সেদিন রাতে সে ঋদ্ধিকে ফোন করে। কণ্ঠে ক্লান্তি।
— “আমার মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে আমায় থেকে যেতে হবে।”
ঋদ্ধি কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে। তারপর বলে, “আমিও ভাবছিলাম, একসাথে না থাকলে এই নাটকটা ঠিক প্রাণ পাবে না।”
— “তুই পারবি না এইসব কিছু একা?”
— “তুই জানিস, আমি তো আমার কলম তোকে দেখে চালাই। আমি তোর পাশে বসে একটা শব্দ লিখি না—তুই দূরে থাকলে সেটা সাদা হয়ে যায়।”
— “তাহলে আমরা একসাথে থেকে যাব।”
— “হ্যাঁ, একসাথে থেকেই আমরা নাটক তৈরি করব, যেটা জানালার ওপাশেও যাবে, কিন্তু জানালার কাচে আমাদের ছায়াও রয়ে যাবে।”
এইভাবে প্রজেক্টের প্যারিস রিহার্সাল পিছিয়ে যায়। সত্যদীপ ঘোষ বলেন, “তোমরা একসাথে না থাকলে প্রজেক্টটাই অসম্পূর্ণ হবে। আমরা অপেক্ষা করব।”
তাদের মধ্যে অপেক্ষার একটা সুর তৈরি হয়।
একদিন সকালে অরিত্র নিজের জানালার পাশে বসে খাতায় লেখে—
“আলো যখন প্রশ্ন করে, তখন অন্ধকারই উত্তর দেয়। কিন্তু যাদের জানালায় প্রশ্ন জমে থাকে, তারা আলোকে দোষ দেয় না, তারা অপেক্ষা করতে জানে।”
পর্ব ৯
শহরের গ্রীষ্মকালীন দুপুরের মধ্যে এক অদ্ভুত স্থবিরতা থাকে। কাচের জানালায় পড়া রোদের রেখা ধীরে ধীরে গলিয়ে দেয় সময়কে। অরিত্র বসে আছে তার ঘরের জানালার পাশে, গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের তীব্র আলোয়। হাতে খোলা খাতা, কিন্তু কলম থেমে আছে। মাথার মধ্যে সংলাপ ঘোরে, কিন্তু শব্দে রূপ পায় না।
ঋদ্ধি সেই সময় এসে ঢোকে ঘরে। সে আজকাল নিয়মিত আসে—কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়। একদিন চুপ করে খাবার নিয়ে আসে, আরেকদিন গান শোনায় ইউটিউবে পুরনো নাটকের আবৃত্তি।
“কি রে, আজ কিছুই লিখলি না?” — জিজ্ঞেস করে সে।
অরিত্র হালকা হেসে বলে, “শব্দগুলো যেন আমার থেকে দূরে সরে গেছে। সবকিছু এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে—মা অসুস্থ, আমরা থেমে গেছি, অথচ আমাদের নাটক দেশ পেরিয়ে যাচ্ছে। জানি না, এই থেমে যাওয়াটাও নাটকের অংশ কিনা।”
ঋদ্ধি ধীরে পাশে এসে বসে। জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় সে বসে বলে, “এই থেমে থাকাটাও তো এক রকম নাট্যদৃশ্য। সব নাটকে একটা ‘পজ’ থাকে, যেখানে শব্দ না বলে চরিত্র নিজেকে প্রকাশ করে।”
“পজ… থেমে যাওয়া… হ্যাঁ। কিন্তু কখন আবার শুরু হবে?”
“আলো তো আসে বলেই না। আলোকে পেতে সময় দিতে হয়। কাচে ধুলো থাকলে আলো তো স্পষ্ট হয় না,” — বলে ঋদ্ধি, আঙুল দিয়ে জানালার ধুলো মুছে দেয়।
মৃদু বাতাস ঢুকে পড়ে ঘরে। অরিত্র একটু সোজা হয়ে বসে।
“তুই তো জানিস, আমি কখনো চাইলেই লিখতে পারি না। আমার কলম তো মনে বসে থাকে। আমি লিখি যখন হৃদয় জেগে ওঠে। এখন তো মনে হচ্ছে, কিছুই অনুভব করতে পারছি না।”
ঋদ্ধি তাকায় গভীর দৃষ্টিতে। “তাহলে চল, বাইরে যাই। শব্দ যদি না আসে, তাহলে দৃশ্য দেখি। শহরের মুখ দেখি, মানুষের হাঁটাচলা দেখি। হয়তো কিছু একটা দেখেই শব্দ ফিরে আসবে।”
তারা দুজন বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য—কলকাতার কলেজ স্ট্রিট। বইয়ের গলি, দোকানের গন্ধ, ছাপাখানার মেশিনের আওয়াজ, ছড়ানো পাতা, পুরনো সংলাপের গন্ধ। অরিত্র হুইলচেয়ারে, পাশে ঋদ্ধি। দুজনেই নিঃশব্দে এগিয়ে চলে।
এক দোকানে ঢুকে অরিত্র দেখতে পায়, ছেঁড়া মলাটের একটা বই—“নাট্যস্মৃতি”—অচিন্ত্য চট্টোপাধ্যায়। বইয়ের পাতায় একটা চিঠি ঠেকে যায় তার চোখে। হাতে তুলে দেখে, সেটা এক নাট্যকারের নিজের হাতে লেখা সংলাপের খসড়া।
তাতে লেখা—
“আমি দাঁড়িয়ে থাকি, আর তাকিয়ে থাকি। আমি চাই না কেউ আমাকে দেখুক, আমি চাই কেউ আমাকে অনুভব করুক। কারণ আমি শুধু শরীর নই, আমি সেই চরিত্র, যে মঞ্চে উঠে এসে নিজেকে খুঁজে পায়। নাটক আসলে একা হওয়ার শিল্প।”
অরিত্র চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ঋদ্ধি বলে, “দেখলি, থেমে থাকলেও শব্দ ফিরে আসে। তারা শুধু অপেক্ষা করে, ঠিক যেমন জানালায় আলো অপেক্ষা করে কাচ পরিষ্কারের।”
ফেরার সময় তারা কলেজ স্ট্রিটের এক ছোট ক্যাফেতে বসে। ঋদ্ধি চা আনতে যায়। অরিত্র সেই ফাঁকে খাতাটা খুলে লেখে—
“এই নাটক শুধু মঞ্চের জন্য নয়, এই নাটক শুধু দর্শকের জন্য নয়—এই নাটক অপেক্ষার জন্য। সেই অপেক্ষা, যেখানে আলো প্রশ্ন করে, শব্দ উত্তর দেয়, আর আমরা শুধুই চুপ করে বসে থাকি।”
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অরিত্র মায়ের পাশে গিয়ে বসে। মা তখন ঘুমোচ্ছেন, মুখে শান্তির ছায়া। ঘরের জানালার গ্লাসে চাঁদের আলো পড়ছে, ধীরে ধীরে।
“তুমি জানো, মা? আমি আজ আবার লিখতে পেরেছি। আবার অনুভব করতে পেরেছি। হয়তো কিছুই পালটায়নি, কিন্তু আমি একটু একটু করে নিজের ভেতরে আলো জ্বালাতে পারছি।”
পরদিন সত্যদীপ ঘোষ ফোন করেন।
— “আমি জানি, তোমাদের যাত্রা আপাতত থেমে আছে। কিন্তু প্যারিসের থিয়েটার দল থেকে মেইল এসেছে—তারা নাটকটি নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করতে চায়। এবং তারা চায়, সংলাপের আদি অনুবাদ যেন লেখিকা নিজেই করেন।”
ঋদ্ধির মুখে বিস্ময়। “আমি? আমি তো কখনো ইংরেজিতে বা ফরাসিতে লেখার কথা ভাবিইনি!”
অরিত্র পাশে বসে বলে, “তুই শুধু ভাষা জানিস না, তুই আবেগ জানিস। শব্দ কেবল ভাষা নয়, অনুভব। সেটা তুই জানিস। তুই পারবি।”
ঋদ্ধি মৃদু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “তবে চল, আবার শুরু করি। আমাদের অপেক্ষার শব্দগুলোকে এবার বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাই।”
অরিত্র জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“জানালার পাশে বসে থাকলেও, সেই আলো আজ ছড়িয়ে পড়ছে দূর দূর দেশে। কারণ প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রেম, প্রতিটি ফিরে আসা—একেকটা জানালা, একেকটা নাটক।”
পর্ব ১০
প্যারিস শহর তখন সন্ধ্যার আলোয় গা ধুয়ে নিচ্ছে। সাঁইত্র নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে দূরের আইফেল টাওয়ারে চোখ পড়ে যায় আর এক ঝলক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে—কতটা পথ পেরিয়ে এসেছে তারা।
ঋদ্ধি ও অরিত্র এখন প্যারিসে, সত্যদীপ ঘোষের আন্তর্জাতিক প্রযোজনার অংশ হিসেবে। নাটকের নাম The Other Window, তবে যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন—এই নাটক আদতে এক গল্পেরই উত্তরাধিকার—আলোর জানালা।
রিহার্সাল চলছে পুরোদমে। ফরাসি সহ-অভিনেতারা মাঝে মাঝে উচ্চারণে হোঁচট খায়, কিন্তু অনুভবের জায়গায় তাদের ভুল হয় না। কারণ ভাষা বদলালেও, অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই আর আলোকে বেছে নেওয়ার গল্প তো সবার।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা সত্যদীপ তাঁদের সবাইকে একত্র করেন ছোট একটা অডিটোরিয়ামে। পরেরদিন The Other Window’র প্রথম ইউরোপ প্রিমিয়ার।
তিনি বলেন, “আমি অনেক নাটক করেছি, বহু দেশে কাজ করেছি, কিন্তু এই নাটকের মত এত গভীর কিছু তৈরি হয়নি আগে। কারণ এটা কেবল সংলাপ বা প্রপস নয়, এটা অপেক্ষার নাটক—যা আমরা সকলে জীবনে একবার না একবার অনুভব করি।”
তিনি অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি অভিনয় করছো না, তুমি অস্তিত্ব তুলে ধরছো মঞ্চে। আর ঋদ্ধি, তুমি নাট্যকার নও, তুমি কবি। এই নাটকে শব্দেরা থামতে জানে, আর থেমে গিয়েও কত কিছু বলে যায়।”
ঋদ্ধির গলায় কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সে শুধু বলে, “আমরা একটা জানালার পাশে বসে অপেক্ষা করছিলাম, আর সেই অপেক্ষার শব্দ দিয়েই গল্প গড়েছি।”
পরদিন প্যারিসের ঐতিহাসিক মঞ্চে নাটক শুরু হয়।
মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠে ধীরে ধীরে। হুইলচেয়ারে বসে থাকা সেই পুরনো পরিচিত অরিত্র। ফরাসি ভাষায় হলেও, তার চোখে, মুখে, গলার স্বরে এতখানি ব্যথা আর আশা জমে থাকে যে ভাষার বাধা অতিক্রম করে তা পৌঁছে যায় দর্শকদের হৃদয়ে।
ঋদ্ধি মঞ্চে নেই, কিন্তু সে জানে, প্রতিটি সংলাপে তার হাতের ছোঁয়া আছে।
শেষ দৃশ্য।
অরিত্রর চরিত্র জানালার পাশে বসে থাকে। এক ঝলক আলো জানালার কাচে এসে পড়ে।
সে বলে,
“Je ne cherche pas la lumière. Je m’assois à côté de la fenêtre. Et j’attends.”
(আমি আলো খুঁজি না। আমি জানালার পাশে বসে থাকি। আর আমি অপেক্ষা করি।)
পর্দা পড়ে।
প্রেক্ষাগৃহ নিস্তব্ধ।
তারপর হঠাৎ এক ঝলকে ওঠে করতালির ধ্বনি।
দর্শক দাঁড়িয়ে পড়ে। কেউ চোখ মুছে, কেউ পাশে দাঁড়ানো অপরিচিতের দিকে তাকিয়ে বলে—“This is not just theatre. This is us.”
এক ফরাসি মহিলা এসে অরিত্রর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “আপনার চরিত্র জানালার পাশে বসে ছিল। অথচ আমি যেন নিজেকে দেখেছি সেখানে। আমার জীবন, আমার ভয়, আমার অপেক্ষা।”
অরিত্র উত্তর দেয় না। সে শুধু হালকা মাথা নেড়ে জানালার দিকে চেয়ে থাকে।
সেদিন রাতে, ছোট একটি ককটেল পার্টি হয়। থিয়েটার দল, অতিথি, শিল্পী, সাংবাদিক—সবাই একসাথে। সত্যদীপ সেখানে ঘোষণা করেন, “আমরা The Other Window কে নিয়ে যাব বার্লিন, নিউ ইয়র্ক, এবং কলকাতায়—যেখানে এর জন্ম। আর এই নাটকের আন্তর্জাতিক সংস্করণের চূড়ান্ত কপিরাইটে লেখা থাকবে—‘Based on an original play by Riddhi Ghosh & Aritro Sen.’”
অরিত্র আর ঋদ্ধি মুখ চেয়ে হাসে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন বোঝে, এই হাসির নিচে কত অন্ধকারের গল্প লুকানো ছিল।
দু’দিন পর তাঁরা ফিরে আসে কলকাতায়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে শহরের বাতাস যেন অন্যরকম লাগে।
ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ঋদ্ধি বলে, “এই শহরটা জানে না, আমরা তারই এক জানালার গল্প নিয়ে ফিরছি।”
অরিত্র বলে, “এই শহরটাই তো আমাদের শিখিয়েছে, আলো কেমন করে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। হয়তো তাই ফিরে আসাটাও আনন্দের।”
বাড়ি ফিরে অরিত্র মায়ের ঘরে যায়। মা বিছানায় বসে ছিলেন, হাতে ছেঁড়া চিঠি গুছোচ্ছেন।
তিনি বলেন, “তুই এসেছিস বুঝি? টিভিতে তোকে দেখিয়েছিল। বলেছিল ‘ভালোবাসার অভিনেতা’, তুই জানিস?”
অরিত্র মায়ের পা ছুঁয়ে বলে, “ভালোবাসাটাই তো আসল চরিত্র, মা। আমি শুধু সেটার সুর করে দিয়েছি।”
মা বলেন, “তোর জানালাটা তো আজও একই আছে। কিন্তু তোকে দেখলে মনে হয়, আলো নিজেই বদলে গেছে।”
কয়েকদিন পর তাঁরা আবার যান সেই উত্তর কলকাতার পুরনো থিয়েটার ঘরে, যেখানে প্রথম ‘আলোর জানালা’র রিহার্সাল শুরু হয়েছিল।
দেখে, দেয়ালে বড় একটা ব্যানার—
“This is where light first touched the window.”
তলার দিকটায় ছোট করে লেখা—
“Riddhi & Aritro, ২০২৩”
অরিত্র পেছনে তাকিয়ে বলে, “তুই জানিস? একদিন এই থিয়েটারে কেউ এসে দাঁড়াবে আমাদের মতো। কেউ হয়তো জানালা নিয়ে আবার লিখবে।”
ঋদ্ধি বলে, “আর আমরা সেই জানালায় আলোর মতো রয়ে যাব। কখনো সরাসরি নয়, কিন্তু অনুভবে। জানালার গায়ে লেখা থাকবে আমাদের নাম—অদৃশ্য কালি দিয়ে।”
মৃদু বাতাসে জানালার পর্দা উড়ে ওঠে। আলো ঢুকে পড়ে এক কোণে।
একটি নাটকের যাত্রা শেষ হয় না—সে কেবল জানালার পাশ থেকে অন্য এক চোখে চলে যায়।
শেষ




