Bangla - प्रेम कहानियाँ

ক্যালেন্ডারের বাইরের দিনগুলো

Spread the love

তিস্তা বন্দ্যোপাধ্যায়


পর্ব ১: প্রথম ইমেল

সকালটা শুরু হয়েছিল একেবারে নির্লিপ্তভাবে। স্নান, ব্রেকফাস্ট, মেট্রো, আর তারপর অফিস। কিন্তু সেই নির্লিপ্ততাকে ভেঙে দিল একটা ইমেল—অপরিচিত প্রেরকের, বিষয়বস্তু: “Couldn’t help noticing your post-it habit.”

অপরাধ যেন হাতে নাতে ধরা পড়েছে। অনন্যা বসু, এইচআর ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যাঁর ডেস্ক সবসময় একটা রঙিন ঝকঝকে পোস্ট-ইটের সাম্রাজ্য, প্রথমে একটু চমকে উঠলেন। তারপর হাসলেন। কে এই মানুষটা? অফিসের কেউই হবে। না হলে তো তাঁর ডেস্ক পর্যন্ত নজর পড়ে না।

ইমেলের শেষে সিগনেচার ছিল—“Regards, S. Dey, Product Strategy.”

অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করে লগ-ইন করলেন অনন্যা। “S. Dey”—মানে কি সেটা সুদীপ? না শুভম? স্ট্র্যাটেজিতে তো কয়েকজন নতুন এসেছে। আবার চোখ গেল সেই ইমেলের লাইনে—“Couldn’t help noticing your post-it habit. Yellow for meetings, pink for personal calls, green for reminders. Very efficient.”

উনি কবে এতটা খেয়াল করেছেন? আর… কে তিনি?

“তুমি চিনছো?” পাশে বসে থাকা তিথি বলল, অনন্যার চোখে ঝলকে ওঠা হাসির ছায়া দেখে।

“কাকে?”

“এই মেইলটা যাকে দেখে এত হাসছো,” তিথির মুখে সেই চেনা কৌতূহল।

অনন্যা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “নতুন কেউ। এসেছেন স্ট্র্যাটেজি টিমে। নামটা এস. ডে।”

তিথি একটু ভেবে বলল, “ওহ! সেই ছেলেটা না? ফ্লোরের ওপাশে বসে। ল্যাপটপে একগাদা স্টিকি নোট লাগানো, একেবারে OCD টাইপ?”

অনন্যা হেসে ফেলল। “ভালো দেখেছে তুমি!”

তিথির চোখে একঝলক কূটতা। “সতর্ক থেকো কিন্তু। অফিশিয়াল পোস্ট-ইট থেকে যদি আনঅফিশিয়াল চিঠি হয়ে যায়…”

“ধুস,” অনন্যা বলল, কিন্তু কানের লতিতে লালিমা খেলে গেল।

দিন তিনেক কেটে গেল। আর কোনো ইমেল এল না। অনন্যা মাঝে মাঝে স্ট্র্যাটেজি ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। তার চেয়ে বেশি তাকিয়ে দেখেছে নিজেরই মন—কেন সে এমন উৎসাহী হয়ে পড়েছে এক অজানা ইমেল নিয়ে?

চতুর্থ দিনে এল একটা নতুন মেইল—
Subject: Thought of the Day
Body: “A day without a green post-it is like a sky without clouds.” —S.Dey

এইবার অনন্যা হেসে ফেলল জোরে। কফি হাতে বেরিয়ে পড়ল সেই ফ্লোরের দিকে। হঠাৎ একটা ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। একজন ছেলেকে দেখতে পেল—চোখে চশমা, মাথার চুল একটু এলোমেলো, হাতে কফি কাপ। ডেস্কে একগাদা স্টিকি নোট—তিথি ঠিকই বলেছিল।

“তুমি S.Dey?” অনন্যা জিজ্ঞেস করল।

সে তাকাল, তারপর একটু হেসে বলল, “Caught me.”

“তোমার স্টিকি নোট তো দেখছি রংবাহার।”

“ইনস্পিরেশন পেয়েছি,” ছেলেটা বলল, আর চোখের কোণে একটা দুষ্টুমি।

“তুমি নাম বলো না?” অনন্যা বলল।

“শ্রেয়শ,” সে হাত বাড়াল। “শ্রেয়শ দে। আর তুমি?”

“অনন্যা,” সে হাত মেলাল, আর বুঝতে পারল এই প্রথম স্পর্শটা কতটা অচেনা আর একই সঙ্গে স্বাভাবিক।

এরপর যেন অফিসের রুটিন বদলে গেল। সকালের ইমেল, দুপুরের ক্যান্টিন কফি, বিকেলের এক আধটু মেসেজ। কেউ কাউকে ‘ডেট’ বলছে না, কিন্তু ক্যালেন্ডারের বাইরের কিছু দিনে একটা নিজস্ব ছায়া পড়তে শুরু করেছে।

শ্রেয়শ জানে অনন্যা রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসে। অনন্যা জেনে গেছে শ্রেয়শ প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগে পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে থাকে—সেটাই নাকি ওর প্রস্তুতি।

কেউ কেউ বলছে, ওরা কিছু ‘প্ল্যান’ করছে। কেউ কেউ বলছে, “ওই তো হবে অফিস কাপল। সব অফিসেই থাকে একটা।”

কিন্তু শ্রেয়শ আর অনন্যা জানে, এটা কিছু প্ল্যান নয়। এটা একটা অভ্যেস, একটা অলিখিত চুক্তি—যেখানে ভালোবাসার সংজ্ঞা লুকিয়ে থাকে এক একটা পোস্ট-ইটের নিচে।

পর্ব ২: ক্যান্টিনের কোণে

অফিসের ক্যান্টিনটা ঠিক জমজমাট নয়, আবার নিস্তব্ধও নয়। একটা মাঝামাঝি জায়গা—যেখানে কফির কাপের আওয়াজ আর চাপা ফিসফাস একটা অদৃশ্য পর্দার মতো। অনন্যা আজ একটু আগে চলে এসেছে, জানালার ধারে টেবিলটা দখল করে রেখেছে। শ্রেয়শ বলেছিল, “আজ দুপুরে ক্যান্টিনে দেখা হবে?” অনন্যা বলেছিল, “হবে, যদি কফির সঙ্গে কিছু গল্প মেলে।” এই হালকা বাক্যালাপই এখন দিনে একবার অন্তত দরকার হয়ে উঠেছে, যেন এই কিছুটা সময় তাদের আলাদা একটা বলয়ে নিয়ে যায়, যেটা অফিসের গ্রিডলাইন আর ক্লায়েন্ট কলের বাইরে। শ্রেয়শ এল মিনিট দশেক পরে, হাতে কফি আর ছোট একটা প্লেট—দুইটা স্যান্ডউইচ, আর একটায় আলু বেরেছে পাশ থেকে। “তোমার জন্য,” সে বলল, আলুর দিকে ইঙ্গিত করে। অনন্যা অবাক। “তুমি জানো আমি আলু বেরেস্তা ভালোবাসি?” “না, কিন্তু ওইদিন তুমি তিথিকে বলছিলে—‘এই স্যান্ডউইচে আলু না থাকলে জমে না।’ আমি পাশেই ছিলাম।” অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এবার সে বুঝতে পারছে, শ্রেয়শ শুধু দেখেই না, শুনেও খুব ভালো। “তুমি বেশ খেয়াল রাখো, না?” “তুমি রঙিন স্টিকি নোটে যা লেখো, আমি সেগুলো না পড়লেও তার ছায়া বুঝতে পারি,” শ্রেয়শ বলল। “তুমি কবি নাকি?” অনন্যার প্রশ্নে ও হেসে ফেলল। “নাহ, আমি স্রেফ পর্যবেক্ষক। আর তুমি লেখো কি?” “বিশ্বাস করো, আমি কখনো কিছু লেখার সাহস পাইনি। নিজের ভেতর যা জমে থাকে, সব স্টিকি নোটেই থেকে যায়।” “তবে একটা ব্লগ চালাও,” শ্রেয়শ হঠাৎ বলে উঠল। “স্টিকি থটস ডট কম!” অনন্যা হাসতে হাসতে কফি চুমুক দেয়। এমন সহজ, হালকা, অথচ ঘোরে ভরা মুহূর্ত সে অনেক দিন পায়নি। শ্রেয়শের চোখে কোনো তাড়া নেই, কোনো দাবিও নেই। এমনকি কোনো মোড়ও নেই—তবু যেন একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। অফিসের একেবারে বাইরে নয়, অথচ একেবারে ভেতরেও নয়—এই আধা-ছায়া জায়গাটা যেখানে সম্পর্ক জন্ম নেয়, অথচ কেউ নাম দিতে চায় না। শ্রেয়শ বলল, “জানো, আমি যখন প্রথম অফিসে ঢুকলাম, তখন খুব একা লাগত। নতুন শহর, নতুন চেহারা, নতুন নিয়ম… এইটুকু পরিচিত হাওয়া ছিল তোমার ডেস্ক। জানি, অদ্ভুত শোনায়।” “না, ঠিক অদ্ভুত না,” অনন্যা বলল। “আমিও বুঝি একা থাকাটা কেমন। আমি তো এই শহরেরই মেয়ে, তবু কিছু কিছু দিন মনে হয়, চারপাশে এত লোক, অথচ কাউকে ছোঁয়া যায় না।” “তবে কি আমরা দুজনেই একা ছিলাম?” শ্রেয়শ ধীরে বলল। অনন্যা চমকে উঠল। কখন যেন কথার ভেতর ঢুকে পড়েছে একটা আশ্রয় খোঁজার ইঙ্গিত। সে সোজা চোখে তাকায়, বলল, “কিন্তু অফিসে এমন কিছু… জটিল হয়ে যায় না?” “তুমি কি কথা বলছো অফিস পলিসির?” “না, গসিপের। অফিসে কেউ দেখলে—একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বারবার একসঙ্গে কফি খাচ্ছে—তাদের বন্ধুত্বেও অনেকে অর্থ খোঁজে।” শ্রেয়শ মাথা নাড়ে। “তা হলে কি বন্ধুত্ব গোপন রাখতে হবে?” “না, তেমন কিছু না… আমি শুধু…” “ভয় পাও,” শ্রেয়শ কথা কেটে বলে। “ভয় পাও আবার ভেঙে যাওয়ার, আবার হারিয়ে যাওয়ার, আবার নিজেকে বোঝাতে হবে, ‘এটা কিছুই না ছিল।’” অনন্যার গলার স্বর কঠিন হয়ে আসে। “তুমি অনেক কিছু বুঝে ফেলো।” “কারণ আমিও অনেক কিছু লুকোই।” শ্রেয়শ টেবিলের ওপাশ থেকে হালকা ভাবে বলে। কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর ক্যান্টিনের দরজায় বেল বাজে—একটা ছোট প্রেজেন্টেশন আছে সাড়ে তিনটায়। দুজনেই উঠে পড়ে। বাইরে যাবার আগে শ্রেয়শ থেমে বলে, “আজ সন্ধ্যায় একটা ছোট্ট জায়গায় যাব? রকবেল ক্যাফে, অফিস থেকে হাঁটাপথ।” “কেন?” অনন্যার ঠোঁটে হালকা হাসি। “কারণ ওইখানে চা দেয় কেটলিতে। আর তাতে স্টিকি ট্যাগ ঝোলে।” “ঠিক আছে,” সে বলল। তারপর দুজন দুদিকে হাঁটতে শুরু করে, অথচ পিছন ফিরে কেউই তাকায় না। কারণ তাদের ভেতর জানে—এই গল্পটা ক্যালেন্ডারে লেখা নেই, কিন্তু দিনে দিনে নিজের মতো করে জমে উঠছে।

পর্ব ৩: রকবেল ক্যাফেতে রঙিন সন্ধে

সন্ধ্যেটা যেন ঠিক ক্যালেন্ডারের মধ্যে পড়ে না, আবার অফিসেরও নয়। অফিস ছাড়ার পর অনন্যা বাসায় না ফিরে হাঁটতে শুরু করে। শ্রেয়শ আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, “আমি বেরিয়ে যাব সাড়ে ছটায়, ঠিক সময়ে পৌঁছোতে চেষ্টা করো।” অনন্যা পৌঁছাল ঠিক সময়ে—সাড়ে ছটা বাজতে না বাজতেই ‘রকবেল ক্যাফে’-র সেই কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল। ক্যাফেটা বেশ নিরিবিলি, একটু পুরনো ধাঁচের—জানালার পাশে রঙিন কাঁচ, কাঠের চেয়ারগুলো একটু কেঁপে ওঠে বসলে, দেওয়ালে কবিতা লেখা ছোট ছোট বোর্ড। ভেতরে ঢুকতেই ঘ্রাণটা বদলে গেল—চায়ের পাতা, সেঁকা পাউরুটি আর বইয়ের পুরনো গন্ধের মিশ্রণ যেন একসঙ্গে কানে-কানে বলছে, “তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো।” শ্রেয়শ একটা জানালার ধারে বসে ছিল, হাতে একটা বই, আর পাশে চায়ের কেটলিতে স্টিম উঠছে। অনন্যা বসতেই শ্রেয়শ বলল, “ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আসবে না।” “ভেবেছিলে?” “হ্যাঁ, কারণ তুমি একটু দোলাচলে ভোগো।” “তুমি তিনদিনের পরিচয়ে এত বিশ্লেষণ করে ফেললে?” “তিনদিন নয়, অনেকটা দেখার পর। তুমি যে টেবিলের কোনায় চুপ করে বসো, তুমি যে একই রকম ঘড়ি পরো প্রতিদিন, তুমি যে লোকের সঙ্গে হেসে কথা বললেও অন্তরে একটু দূরত্ব রাখো—এসব তো একদিনে বোঝা যায় না।” অনন্যা কিছু বলল না, শুধু চা থেকে একটা চুমুক নিল। কেটলির ঝুলে থাকা ট্যাগে লেখা ছিল—”Somewhere, something wonderful is waiting to be known.” সে পড়ে হেসে ফেলল। “তুমি কি সব কিছুতেই এরকম দার্শনিক?” শ্রেয়শ হেসে বলল, “তুমি কি সব কিছুতেই এরকম প্রতিক্রিয়াশীল?” কথোপকথনটা যেন দাবা খেলার মতো, প্রতিটি বাক্য চিন্তাভাবনা করে ফেলা—আর একেকটা চালের পেছনে একটা গোপন তাস। “তুমি এখানে চা খেতে আসো নাকি মানে খুঁজতে?” অনন্যা এবার জিজ্ঞেস করল। “দু’টোই। কিন্তু সত্যি বলতে, আজ একটু অন্য মানে ছিল। আমি একটা চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম—তোমার সঙ্গে সময় কাটানোর, অফিসের বাইরেটা বোঝার। কারণ আমার মনে হচ্ছে, তুমি তোমাকে সত্যিই খুলে দাও কেবল তখনই, যখন তুমি জানো সামনে বসে থাকা মানুষটা তোমার অনুপস্থিতিতেও তোমার কথা ভাববে।” অনন্যার গলা শুকিয়ে গেল একটু। এতটা সোজা কথা এত মোলায়েমভাবে কেউ বলে? এত সহজে? এত নিখুঁতভাবে? “তুমি কি… সিরিয়াস কিছু ভাবছো?” সে ধীরে বলল। শ্রেয়শ একটুও চমকায় না, উত্তর দেয়, “আমি জানি না। আমি শুধু জানি, এই প্রতিদিন দেখা হওয়া, একসঙ্গে মেসেজে কথা বলা, এই ভাবনাগুলো—এগুলো অস্বাভাবিক নয়। বরং এই স্বাভাবিকতাটাকেই আমি আরেকটু সময় দিতে চাই।” “আমরা কি এটা সামলাতে পারব?” অনন্যা জিজ্ঞেস করল, যেন নিজের মনেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল। “কারণ আমি জানি অফিসে সম্পর্ক মানে শুধু গল্প নয়, অনেক হিসেবও।” “আমি সংখ্যা ভালো বুঝি,” শ্রেয়শ বলল। “কিন্তু ভালোবাসা কি এক্সেল শিটে ফেলা যায়? অফিসের বাইরেও কি আমরা নিজেরা কিছু না হতে পারি?” “আরে! তোমরা এখানে?” পেছন থেকে এক চেনা গলা। তিথি আর তার সঙ্গী এসেছে ক্যাফেতে। মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেল। অনন্যা একটা সোজা ভঙ্গিমা নিল, হাসল, “হ্যাঁ রে, শ্রেয়শ বলল এখানে চা ভালো, তাই চলে এলাম।” তিথি এক ঝলক শ্রেয়শকে দেখে বলল, “ও তো কিছুই খাচ্ছে না দেখি, শুধু তোমার কথায় মনোযোগ।” সবাই হেসে ফেলল, পরিবেশ একটু হালকা হল। তিথির চোখে যে একটু কৌতূহল, সেটা অনন্যা বুঝল, কিন্তু কিছু বলল না। তিথি চলে যাওয়ার পর শ্রেয়শ বলল, “সবাই জানবে একদিন।” অনন্যা তাকাল। “তুমি চাইছো সবাই জানুক?” “আমি চাই না লুকিয়ে রাখি। কিন্তু তুমিই ঠিক করবে—কবে, কীভাবে, কতটুকু।” সেই মুহূর্তে চুপ করে গিয়ে চা খেতে খেতে অনন্যা জানালার বাইরে তাকাল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু রাস্তায় আলো জ্বলছে। আর ক্যাফের ভেতরে সেই আলো-ছায়ার খেলায় দুজন মানুষ বসে আছে, যাদের প্রেম এখনও নাম পায়নি, অথচ প্রতিটা কথায় একটা স্পর্শ ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই স্পর্শ হয়তো একদিন তাদের নাম দেবে, হয়তো দেবে না—তবু এই সন্ধে, এই কেটলি, এই ঝুলন্ত চা-ট্যাগে লেখা শব্দ, সবটাই থাকবে একটা অদৃশ্য স্মৃতির পাতায়। ঠিক পোস্ট-ইটের মতো—অল্প, রঙিন, ক্ষণিকের, অথচ ভোলার নয়।

পর্ব ৪: ক্লায়েন্ট মিটিং ও কানাঘুষো

পরদিন অফিসে ঢুকেই অনন্যা বুঝতে পারল বাতাসে কিছু একটা বদলে গেছে। রিসেপশন থেকে শুরু করে তার ডেস্ক পর্যন্ত হাঁটার সময় দু-একটা চোখ তার দিকে একটু বেশি সময় থমকে থাকল। কেউ মুখ ফিরিয়ে কথা থামিয়ে দিল, কেউ আবার হালকা হাসি দিল, যার মানে বোঝা গেল না—বন্ধুত্ব না বিদ্রুপ। সে ডেস্কে বসেই কম্পিউটার অন করল, চোখের কোণে দেখে নিল শ্রেয়শ নিজের ডেস্কে আছে কিনা—আছে, কিন্তু মাথা নিচু করে কী যেন টাইপ করছে। হঠাৎ তিথি এসে দাঁড়াল পাশে। “কাল বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলে দেখলাম,” কণ্ঠে স্নেহ আর কৌতূহলের মিশ্রণ। “হ্যাঁ, চা ভালো ছিল,” অনন্যা সংক্ষেপে বলল। “তোমার মুখে যে রঙ ছিল সেটা চায়ের থেকে বেশি চড়া মনে হচ্ছিল,” তিথি হেসে বলল। অনন্যা মুখ নামিয়ে ফাইল খুলে ফেলল। তিথি চলে গেলে সে গভীরভাবে শ্বাস নিল। ঠিক এইরকমটা সে চায়নি। সম্পর্ক গড়ে ওঠার মুহূর্তগুলোকে এত জলজ্যান্ত করে তুলতে চায়নি অফিসের কথার বুদবুদের ভেতর। তার প্রেম একান্ত তার—রংমাখা পোস্ট-ইটের মতো, নোটপ্যাডে রাখা টুকরো অনুভূতির মতো, যার ব্যাখ্যা কাউকে দিতে হয় না। দুপুরবেলায় ক্লায়েন্ট প্রেজেন্টেশন ছিল। শ্রেয়শ আর অনন্যাকে একসঙ্গে যেতে হল। প্রেজেন্টেশন রুমে ঢোকার আগে শ্রেয়শ তাকিয়ে বলল, “সব ঠিক তো?” অনন্যা হালকা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, কাজের দিক থেকে তো সবই ঠিক। ব্যক্তিগত কিছু নিয়ে চিন্তা করতে চাই না এখন।” “তবু যদি তুমি বলো, আমি…” “না, তুমি কিছু বলো না,” অনন্যা কেটে দিল। “এখন না।” প্রেজেন্টেশন ভালো হল। ক্লায়েন্ট প্রশংসা করল, ম্যানেজার হাততালি দিল। কিন্তু অনন্যার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকে গেল, যেন ঘাড়ের পেছনে কেউ একটানা তাকিয়ে আছে, আর একটু পরপর ফিসফিস করছে। বিকেল গড়াতে গড়াতে একটা ঘটনা হল। ক্যান্টিন থেকে ফিরছিল অনন্যা, হঠাৎ শুনতে পেল দুই জুনিয়র কর্মী নিজেদের মধ্যে বলছে, “এই যে আমাদের পোস্ট-ইট দিদি, নতুন রঙের প্রেম খুঁজে পেয়েছে মনে হয়।” “হুম, স্ট্র্যাটেজি টিমের ছেলেটা না? কেমন যেন চুপচাপ টাইপ, আর এখন একেবারে ঝলমলে হয়ে গেছে।” দুজনেই হেসে উঠল। অনন্যা থেমে গেল, কিছু বলল না, কিন্তু মনটা যেন গুঁড়ো হয়ে গেল ভেতরে। এইখানেই ভয় করেছিল সে—এই নির্জন ভালোবাসা যদি সবার চোখে এমন প্রকাশ পায়, তাহলে তার ব্যক্তিগত সীমারেখা মুছে যাবে, সম্পর্কটা হয়ে যাবে একটা গল্প, একটা চর্চার বস্তু। সে সোজা নিজের ডেস্কে ফিরে এল। মনে হচ্ছিল, যেন স্টিকি নোটগুলো হঠাৎই অর্থহীন হয়ে গেছে। তারা আর তার নিজস্ব নয়—সবাই যেন এখন সেই রঙের মানে খুঁজতে ব্যস্ত। সে জানে, শ্রেয়শ এসব শুনলেও কিছু বলবে না—সে এমন নয় যে লোকের কথায় ভয় পায়। কিন্তু অনন্যা? সে ভয় পায়। ভয় পায় কারণ সে অনেক কিছু হারিয়েছে আগেও—বিশ্বাস, বন্ধু, এমনকি একবার একটা সম্পর্কও, যা অফিসেই শুরু হয়েছিল এবং শেষও। সেই শেষের পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিল—কাজে ব্যক্তিগত জীবন ঢোকাবে না আর। কিন্তু প্রতিজ্ঞার থেকেও বড় হয়ে উঠেছিল শ্রেয়শের চোখে মুগ্ধতা, তার চুপ করে শুনে যাওয়া, তার ছোট ছোট বিষয় মনে রাখা। এমন কারও সামনে মন খুলে দেয়নি অনেকদিন। হঠাৎ এক মেইল এল—From: S.Dey, Subject: Coffee? অনন্যা পড়ে শুধু একটা লাইন দেখল—“I know you’re shrinking. Let me be the warm cup in your cold afternoon.” সে মাথা নিচু করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে পড়ল, শ্রেয়শের ডেস্কের দিকে হাঁটা দিল। কেউ কেউ তাকাচ্ছে, কেউ কেউ হাসছে—তবু সে হাঁটল, থামল না। “চলো,” সে এসে বলল। শ্রেয়শ অবাক, “কোথায়?” “বাইরে। একটু হাঁটতে। কফি তো পরে হবে।” শ্রেয়শ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। “সবাই দেখছে,” সে হেসে বলল। “হ্যাঁ, জানি,” অনন্যা শান্ত গলায় বলল। “তবু এবার আমি লুকোব না।” দুজনে বেরিয়ে গেল করিডোর পেরিয়ে লিফটের দিকে। আর পেছনে থেকে একজন ফিসফিস করে বলল, “ওদের কাহিনি জমে উঠছে রে!” কিন্তু অনন্যার কানে তখন বাজছিল কেবল নিজের মনের গলায় উচ্চারিত একটা সত্য—“হ্যাঁ, এটা কাহিনি, কিন্তু সেটা তোমাদের চায়ের কাপের গল্প নয়—আমার নিজের জীবনের গল্প।”

পর্ব ৫: ডিপার্টমেন্টাল ওয়ালে ফাটল

শ্রেয়শ আর অনন্যা হাঁটছিল অফিস বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে, নিচের ছোট্ট গার্ডেনটা ধরে। চারদিকে প্রায় ফাঁকা, বসন্তের হাওয়ায় বেলিফুলের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। অনন্যার মুখে একধরনের জেদ, কিন্তু চোখে ক্লান্তি। শ্রেয়শ শান্ত, তার মুখে অভিমান নেই, বরং বুঝতে পারার চেষ্টা আছে। হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, “আমার চা-প্রস্তাবে তুমি হাঁটার উত্তর দিলে। কেন?” অনন্যা একটু থেমে বলল, “কারণ কফিশপের চার দেওয়ালেও কান আছে। আর হাঁটতে হাঁটতে মানুষ একটু সহজ হয়ে যায়।” শ্রেয়শ মাথা নাড়ল। “আজ অফিসে কী হয়েছে?” “কি হবে,” অনন্যা হেসে বলল, “আমরা দুজন একসঙ্গে কফি খাচ্ছি, তার মানে নাকি নতুন প্রেম চলছে। পোস্ট-ইট দিদি আর কৌশলী কনসালটেন্ট—এটাই এখন গল্প।” শ্রেয়শ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আমি কি কিছু ভুল করেছি?” “না। তুমি শুধু ঠিক জায়গায়, ঠিক সময়ে এসেছো। সমস্যা হয়েছে আমি ভুলে গেছি এটা একটা অফিস। যেখানে ভালোবাসার আগে অনুমান আসে, সম্পর্কের আগে রিপোর্ট, আর বিশ্বাসের আগে গসিপ।” “তা হলে কি আমাদের—মানে, যেটা শুরু হয়েছে—তা বন্ধ হয়ে যাবে?” “আমি জানি না, শ্রেয়শ,” অনন্যা একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। “আমি শুধু জানি, আমি এইসব মুখ চাওয়া কথা, লোকের ফিসফাস, কিংবা প্রতিদিন র‍্যাপ আপ মিটিং-এর পরে পেছনে কারও হাসাহাসি আর নিতে পারছি না।” “তুমি ভেঙে পড়ো না,” শ্রেয়শ আস্তে বলল। “আমরা যদি নিজেরা পরিষ্কার থাকি, তাহলে বাইরের শব্দে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” অনন্যা তাকাল, তার চোখে কিছু একটা ফুটে উঠল—অভিমান, গর্ব আর হয়তো একটু ভালোবাসা। “কিন্তু জানো শ্রেয়শ, শুধু বাইরের মানুষ না, আমার নিজের ডিপার্টমেন্টেও ফাটল ধরেছে। আজ রিক্রুটমেন্ট টিমের মিটিং-এ বসে বুঝলাম—আমার রোল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ম্যানেজার বলল, ‘অনন্যা, ফোকাস হারাচ্ছো তুমি।’ আমি কি হারিয়েছি?” “না,” শ্রেয়শ বলল। “তুমি বরং মানুষ হতে শিখেছো।” “মানুষ হলে অফিসে অসুবিধে হয় বোধহয়,” অনন্যা বলল। “তুমি তো দেখো না, তোমার টিমের কেউ কিছু বলে না?” “আমার টিম একটু অন্যরকম। ওরা জানে আমি পেশাগত দিক থেকে কঠোর, তাই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু আমি চাই না তোমাকে আঘাত হোক, অনন্যা। তোমার জায়গাটার জন্য আমি দায়ী হতে চাই না।” অনন্যা উঠে দাঁড়াল। “তুমি দায়ী না, বরং তুমি আমায় একটা জানালার মতো হলে—যেটা খুললে কিছু আলো ঢোকে, কিছু হাওয়া আসে।” “তা হলে জানালাটা বন্ধ করে দেবে?” “না,” সে ধীরে বলল। “কিন্তু জানালার পর্দা হয়তো কিছুদিন টেনে রাখব।” শ্রেয়শ এবার সরাসরি তাকাল, “তুমি কি আমাকে একটু দূরে সরতে বলছো?” অনন্যা জবাব দিল না, শুধু বলল, “তুমি কি পাশে দাঁড়াতে পারবে, কিন্তু শোরগোলের বাইরে?” শ্রেয়শ একটুও না ভেবে বলল, “পারব। যদি জানি, তুমি ঠিক আছো।” অনন্যা এবার একটু হেসে বলল, “ঠিক থাকা জিনিস না। তবে চেষ্টায় থাকা যায়।” তারা আবার হাঁটতে শুরু করল, দুজনেই জানে, এখনকার নীরবতা অন্যরকম—এটা দূরত্ব নয়, বরং একধরনের বোঝাপড়া। অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে তারা এখন কেউ প্রেমিক বা প্রেমিকা নয়, তারা সহকর্মী, একে অন্যকে বুঝতে চাওয়া মানুষ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল অনন্যার। তিথি কল করছে। “তুই কোথায়? বোস ম্যাম তোকে খুঁজছে। আজকের ইনডাকশন প্ল্যান নিয়ে রিভিউ আছে।” “আমি আসছি,” অনন্যা বলল। ফোন কেটে সে বলল, “তুই যাচ্ছিস না?” “না,” শ্রেয়শ বলল, “আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব। একটু মাথা ব্যথা করছে।” “তাহলে আজ রাতের মেসেজটা আমিই আগে পাঠাব,” অনন্যা বলল। “এবার তুই অপেক্ষা কর।” “সবসময় অপেক্ষা করতে রাজি,” শ্রেয়শ বলল। তারা দুজন আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করল—একজন অফিসের ভিতর, একজন বাইরে। কিন্তু মনের ভিতরে তাদের ভালোবাসার পোস্ট-ইট আজও লেগে রইল—একটা হলুদ, একটা সবুজ, আর মাঝখানে হালকা গোলাপি একটা স্পর্শ।

পর্ব ৬: নিয়মের নোটিশ আর নিরব সম্মতি

পরদিন সকালেই অফিসে ঢুকে অনন্যা টের পায়, আজ বাতাস আরও ভারী। রিসেপশনের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় বোস ম্যামের কেবিনের দরজা খোলা, আর ভিতরে বসে থাকা চেহারাগুলো অচেনা নয়—এইচআর হেড, কমপ্লায়েন্স অফিসার আর একজিকিউটিভ ডিরেক্টর, যার সঙ্গে মাসে একবার কেবল মেইলে কথা হয়। তার মানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ডেস্কে গিয়ে বসলেও মনটা শান্ত হচ্ছে না। মেইল ওপেন করে দেখে, টপ ইনবক্সে একটা ইনটেনাল কমিউনিকেশন মেইল এসেছে—Subject: Reminder on Employee Conduct & Interpersonal Boundaries in Workplace। বডিতে লেখা, “It has been observed that certain interpersonal engagements are drawing attention in the workplace and potentially affecting professional decorum. Employees are advised to maintain discretion in all personal interactions. Any perceived breach of the Employee Code of Conduct may result in formal review.” অনন্যা মেইলটা পড়ে চুপ করে যায়। অফিসে শুধু গল্পই ছড়ায়নি, সেটা উঠে গেছে লেভেল টু-এর মিটিং টেবিলে। এটা যে তাদের সম্পর্ক নিয়েই বলা হয়েছে, সে বুঝতে কারোর দেরি হওয়ার কথা নয়। তার চোখ সেদিকে চলে যায়—শ্রেয়শের ডেস্কে। সে মাথা নিচু করে কাজ করছে, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু তবু যেন কাঁধের রেখায় টান আছে, একরকম অস্পষ্ট প্রস্তুতি, একটা মানসিক ব্যাকপ্যাক। ঠিক তখনই তিথি এসে দাঁড়ায়। তার মুখে আজ মজা নেই, বরং গম্ভীর। “তুই ঠিক আছিস?” “হ্যাঁ,” অনন্যা বলল। “না, আমি ঠিক করে বলতে পারিনি। মানে, সব ঠিক তো?” অনন্যা চোখ তুলে তাকায়। “আমি জানি না, তিথি। আমরা কেউই তো কিছু করিনি—না কোনো নিয়ম ভেঙেছি, না কারো কাজের ক্ষতি করেছি। তবু সবাই এমন দেখছে, যেন আমরা অফিসে বিপদ ডেকে এনেছি।” “ওরা সম্পর্কের চেয়ে গল্প বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে যদি সেটা অফিস ফ্লোরে তৈরি হয়,” তিথি বলল। “আমি জানি। কিন্তু গল্পের যে নায়ক-নায়িকা হয়ে যাব, ভাবিনি।” তিথি একটু থেমে বলল, “শ্রেয়শকে আজ মিটিংয়ে ডেকেছিল কমপ্লায়েন্স। ওর সাথেও কথা হয়েছে।” “কি বলেছে?” “ও কিছু বলেনি, শুধু বলল, ‘ওকে একটু শান্ত থাকতে দাও।’” অনন্যার বুকের মধ্যে একটা কষ্ট হল—শ্রেয়শ, যে চুপচাপ কিন্তু গভীর, যার মুখে শব্দ কম, কিন্তু অনুভব গভীর—সে নিশ্চয়ই ভেতরে কিছু বলছে নিজেকে। দুপুরে তারা মুখোমুখি হয় ক্যান্টিনে, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। কেউ কিছু ভাবে না, কারণ আজ আর কেউ হেসে উঠছে না—সবাই জানে, নিয়মের মেইল এসেছে। এবার আর মজা নয়। তারা কেবল চুপচাপ দুটো কফির কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে। শ্রেয়শ বলল, “আমাদের গল্প অফিসের হাতে চলে গেছে।” অনন্যা বলল, “আমাদের গল্প কি কেবল অফিসেই ছিল?” “না, ছিল না। কিন্তু শুরুটা তো এখানেই। আর এখানেই যদি এর শেষ লিখে ফেলে কেউ, তাহলে তো আমরা নীরব দর্শক ছাড়া কিছু না থাকি।” “তাহলে আমাদের কী করা উচিত?” অনন্যা জিজ্ঞেস করে। শ্রেয়শ একটু ভেবে বলে, “আমার মনে হয়, আমাদের কয়েকটা ব্যাপারে নির্দিষ্ট হতে হবে। অফিসের ভেতরে আমরা কেবল সহকর্মী, অফিসের বাইরে আমরা স্বাধীন। আমরা আমাদের সম্মান রাখতে চাই—আমার, তোমার এবং আমাদের এই সম্পর্কের। আমরা আর কিছুই লুকোব না, আবার কিছু জাহিরও করব না।” “তুমি কি সেটা পারবে?” “পারতে হবে, অনন্যা। কারণ এই সম্পর্ক যদি আদৌ সত্যি হয়, তাহলে এটা একটা সময় চায়, রঙিন পোস্ট-ইট না—বরং ধৈর্যের হাইলাইটার।” অনন্যা একটু হেসে ফেলল, “তুমি সব কথায় লেখার উপমা খুঁজে পাও কীভাবে?” “তুমি লেখার মতোই,” শ্রেয়শ বলল। “কখনো সরল বাক্য, কখনো বক্র প্রশ্ন।” সেই মুহূর্তটা শান্ত, অথচ স্থির। একটা যুদ্ধের মাঝে দাঁড়িয়েও যেন তারা নিজেদের মতো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফিরে আসার সময়, অনন্যা বলল, “আজকে একটু দেরি করে বের হব। একা থাকাটা দরকার।” শ্রেয়শ মাথা নাড়ে। “ঠিক আছে। আমি থাকব পাশে—কিন্তু ছায়ার মতো, শব্দহীন।” অনন্যা হাসে। “তুমি শব্দহীন নও, শ্রেয়শ। তুমি আমার প্রতিধ্বনি।”

পর্ব ৭: দূরত্বের ভিতরেও কাছাকাছি

রাত দশটা পঁচিশ। অফিস ফ্লোর প্রায় ফাঁকা। ডেস্কের সব কম্পিউটার নিভে গেছে, কেবল অনন্যারটায় এখনো মেইলের আলো জ্বলছে। সে একটানা বসে ছিল শেষ এক ঘণ্টা, মেইলের খামে একটা নতুন অ্যাসাইনমেন্ট এসেছে—হায়দরাবাদের নতুন ব্রাঞ্চের জন্য হেড কাউন্ট রিভিউ। কাজটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আজকের রাতে মনটা কাজে নেই। বাইরে মেট্রোর শেষ ট্রেন চলে গেছে, কাঁচের জানালায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হল, এতদিন পরে সত্যিই নিজেকে একা দেখছে। হঠাৎ তার ফোনটা ভাইব্রেট করল। স্ক্রিনে নাম জ্বলে উঠল—শ্রেয়শ। সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর কলটা রিসিভ করল না, কেটে দিল। মিনিটখানেক পরে ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এল—“জানালার পাশে বসে আছো, আমি জানি। কিন্তু আজও কি কাউকে নিজের ভিতরে বসতে দেবে না?” অনন্যা ফোন নামিয়ে রাখল। উত্তর দিল না। উত্তর না দেওয়াটাও তো একধরনের উত্তর। সে আবার মন দিল মেইলের কাজে। কিছু লিখল, কিছু ডিলিট করল। চোখের কোণে ক্লান্তি, কিন্তু মনের ভিতরে চলছিল একটা আরাম-না-দেওয়া যুদ্ধ। মানুষ যখন ভালোবাসে, তখন সে যত না চায় কাছে আসা, তার থেকেও বেশি চায় না হারানো। আর সেই ভয়ের ভিতরেই জন্ম নেয় এইরকম দূরত্ব। অনন্যা জানত, শ্রেয়শ ওর মতো করে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করাটা ওর স্বভাবের মতো। এমন কেউ যে চেঁচায় না, জোর করে না, কিন্তু স্থিরভাবে পাশে থাকে—ঠিক ছায়ার মতো, দিনের আলো না থাকলে যে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে উঠে দাঁড়াল, ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। করিডোর পেরিয়ে লিফটের দরজায় দাঁড়াল। ঠিক সেই সময়, নিচের লাউঞ্জে চোখ পড়ল—শ্রেয়শ বসে আছে একা, কানে হেডফোন, হাতে ফোন, আর সামনে খোলা একটা নোটবুক। সে মুহূর্তেই থমকে গেল। লিফটে না নেমে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল, ধীরে ধীরে। যেন প্রতিটি ধাপ পেরোনো একটা সাহসের পরীক্ষা। নিচে নেমে এসে শ্রেয়শের সামনে দাঁড়াতেই সে হেডফোন খুলে তাকাল। “তুমি কেন?” অনন্যা জিজ্ঞেস করল। “কারণ তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি কখন তোমার পাশে থাকা দরকার।” “কিন্তু আমি তো বলেছিলাম আমি একা থাকতে চাই।” “হ্যাঁ, আর আমি তোমার একা থাকাটা সম্মান করে—তবু পাশে থেকেছি, ঠিক জানালার বাইরের গাছের মতো, যার ছায়া পড়ে কিন্তু শব্দ হয় না।” অনন্যার চোখে জল জমে এল, সে মুখ ফিরিয়ে বলল, “তুমি কি কখনো রাগ করো না?” “রাগ করি,” শ্রেয়শ বলল। “কিন্তু রাগ তোমার উপর নয়, রাগ এই ব্যবস্থার উপর, এই চার দেয়ালের উপর, যা মানুষকে ভালোবাসাকে অপরাধ ভাবতে শেখায়।” “আমিও রাগ করি,” অনন্যা বলল। “নিজের উপর, যে বারবার এই সম্পর্কটাকে প্রশ্ন করি।” “তা হলে চল,” শ্রেয়শ আস্তে বলল। “চল একটা নির্জন ক্যাফেতে, যেখানে কেবল চা আর দুটো মন থাকবে। আজ শুধু কথা হবে, আর কিছু নয়।” “আজ দেরি হয়ে গেছে,” অনন্যা বলল। “আজ হোক শুধু হাঁটা।” “ঠিক আছে,” শ্রেয়শ ব্যাগ কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়াল। দুজন হাঁটতে লাগল, ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথ ধরে, রাতের বাতাসে কথা না বলেও যেন একটা চেনা ছোঁয়া ছিল। হঠাৎ শ্রেয়শ বলল, “জানো, আমি একটা জিনিস ভেবেছি।” “কি?” “যদি অফিস এই সম্পর্কের জন্য আমাকে সরিয়ে দেয়, আমি মেনে নেব। কিন্তু যদি তুমি নিজেই এই সম্পর্ক থেকে সরে যাও, সেটা আমি মেনে নিতে পারব না।” অনন্যা থেমে গেল। “মানে?” “মানে তুমি ঠিক করো, তুমি এই গল্পটা রাখতে চাও কিনা। যদি না চাও, আমি বুঝব—আর কোনো প্রশ্ন করব না। কিন্তু যদি চাও, তবে এই হাঁটাটা থামিও না। আমরা একসঙ্গে হাঁটতে পারি, নিরবে হলেও।” অনন্যা শ্রেয়শের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমি জানি না, এই গল্পটা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। আমি শুধু জানি, এটা আমার সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ভুল। আমি জানি, আমি যদি ভেঙে পড়ি, তুমি পাশে থাকবে। আর সেটা জানাটাই আমার কাছে যথেষ্ট।” তারা হাঁটতে থাকে আবার। শব্দ নেই, কেবল পায়ের আওয়াজ আর রাস্তার হালকা আলো। এই শহরে এমন রাত অনেক আসে, কিন্তু সব রাতেই এমন হাঁটা হয় না। এই হাঁটা—ভালোবাসার নামে নয়, কিন্তু ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে।

পর্ব ৮: সিদ্ধান্তের ছায়ায় আলো

সোমবার সকালটা শুরু হলো এক অদ্ভুত নিরবতায়। অফিসের করিডোরগুলোও যেন একটু বেশি নিঃশব্দ, কাগজের আওয়াজ পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায়। অনন্যা নিজের ডেস্কে বসে থাকলেও মনটা কাজ করছে না—বারবার মেইল বক্স চেক করছে, ক্লায়েন্ট আপডেট পড়ছে, কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একটা সিদ্ধান্ত মাথায় কিলবিল করছে, একরকম ধমক দিয়ে বলে চলেছে, “আর দেরি নয়।” শ্রেয়শ আজ একটু দেরিতে এসেছে, ডেস্কে বসেই চোখাচোখি হল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। সেই নীরব সম্মতিতে আজ তাদের প্রেমে কথা নেই, আছে কেবল উপস্থিতি। দুপুর নাগাদ বোস ম্যাম হঠাৎ ডাক পাঠালেন অনন্যাকে। কেবিনে ঢুকতেই অনন্যার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা ফাইলের উপর—তার নাম লেখা, পাশে লেখা ‘Transfer Proposal: Hyderabad Branch, HR-Lead Interim Assignment’। মুখ তুলেই বোস ম্যাম বললেন, “অনন্যা, তোমার কাজের প্রতি কমিটমেন্ট নিয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ম্যানেজমেন্ট মনে করছে, তোমার নেতৃত্বে হায়দরাবাদ ব্রাঞ্চে একটা শিফট হোক। এটা অস্থায়ী, তিন মাস। তুমি চাইলে এরপর ফিরে আসতে পারো।” অনন্যা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “কোন পরিস্থিতির কথা বলছেন?” “তুমি জানো,” ম্যাম গলা নরম করলেন। “আমরা কেউ তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করছি না। কিন্তু অফিসে এখন অনেক কথাবার্তা, এবং তোমার হেড হিসেবে আমার দায়িত্ব তোমাকে এই গসিপ থেকে দূরে রাখা। হায়দরাবাদ তোমার জন্য একটা নতুন শুরুও হতে পারে।” অনন্যা চুপ করে রইল। একদিকে তার আত্মসম্মান বলছে, এ যেন একরকম নির্বাসন, যেন সে অপরাধ করেছে। অন্যদিকে তার সচেতন মন বলছে, এটা একটা পালাবার সুযোগ—একটা ‘রিসেট’। কিন্তু সে কি পালাতে চায়? কি চায় আসলে? বেরিয়ে এসে অনন্যা সোজা শ্রেয়শের ডেস্কে গেল। “একটু হাঁটবে?” শ্রেয়শ সব ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। এবার তারা অফিসের টেরেসে উঠল—যেখানে কেউ সহজে আসে না। ছাদে নরম রোদ পড়েছে, নিচে শহরের ট্র্যাফিক, আর দূরে দেখা যাচ্ছে কিছু ভাঙা ছাদ আর ধোঁয়ার রেখা। “আমায় হায়দরাবাদ পাঠাতে চায় তিন মাসের জন্য,” অনন্যা বলল। শ্রেয়শ কিছু বলল না, তার মুখে আশ্চর্য এক ধীরতা। “তোমার কিছু বলার নেই?” “তোমার সিদ্ধান্ত জানলে বলব,” সে বলল। “তুমি চাইছো আমি যাই?” “আমি চাই তুমি নিজের মতো বাঁচো। শুধু আমাদের প্রেমটা টিকিয়ে রাখার জন্য যদি তুমি কিছু হারাও, সেটা আমি চাই না। তুমি সব হারিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।” “কিন্তু যদি আমি না যাই?” “তাহলে আমি লড়ব, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। লোকের চোখে চোখ রেখে বলব, আমাদের সম্পর্ক যদি পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, তাহলে ওদের সমস্যাটা ওদের।” অনন্যা চুপ করে গেল। ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে সে চোখ বন্ধ করল। এই ছাদ, এই রোদ, এই একটুকরো নির্জনতা—সব মিলিয়ে মনে হল যেন তার জীবনের একটা গেটওয়ে খুলে গেছে। আর এই গেটওয়ের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তার দুটো ভবিষ্যৎ—একটা নিরাপদ, নিয়মে মোড়া; আরেকটা সাহসী, কিন্তু অনিশ্চয়তায় ভরা। “আমি যাব,” সে ধীরে বলল। “তিন মাস। কিন্তু পালিয়ে নয়। আমি নিজেকে একটু সময় দিতে চাই। এই সম্পর্কের মূল্য বোঝার মতো নির্জনতা চাই আমার। আর যদি বুঝি, এই ভালোবাসাটা আমার মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছে, তাহলে আমি ফিরে আসব—কেবল তোমার জন্য না, নিজেদের জন্য।” শ্রেয়শ কাছে এসে একটুখানি মাথা নাড়ল। “তুমি যা চাও, আমি চাই তার থেকেও বেশি। শুধু একটাই অনুরোধ—দূরে থেকেও, কখনো হারিয়ে যেয়ো না।” “আমি কোথাও যাই না, শ্রেয়শ,” অনন্যা বলল। “আমি শুধু নিজেকে একটু খুঁজে নিতে চাই।” সন্ধ্যায় অনন্যা ল্যাপটপ খুলে মেইল টাইপ করল—Subject: Acceptance – Hyderabad Assignment। তারপর শেষ লাইনে লিখল, “Hope to return stronger. And more sure.” পাঠিয়ে দেওয়ার আগে থেমে রইল কিছুক্ষণ, তারপর এক ক্লিক। মেইলটা চলে গেল, ঠিক যেমন সে নিজে চলে যাবে কয়েকদিন পর। তবু এই ‘যাওয়া’-র ভেতরেও একরকম ‘থাকা’ লুকিয়ে থাকে, যদি ভালোবাসা সত্যিই যথেষ্ট হয়।

পর্ব ৯: হায়দরাবাদের জানালা

হায়দরাবাদে প্রথম সকালটা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অনন্যা দেখছিল বাইরের রাস্তা—চেনা নয়, কিন্তু অচেনাও নয়। এই শহরও একটা রুটিনে চলে, যেখানে সকালের ধূপ, বেল বাজা, দুধওয়ালার সাইকেল, অফিসগামী মানুষের ভিড়—সবকিছু একধরনের ছন্দ তৈরি করে। কিন্তু সেই ছন্দের ভিতর অনন্যা এখনো নিজের ছায়াটা খুঁজে পায় না। সে এসেছিল কিছুটা বিরতি খুঁজতে, কিছুটা নিজেকে বুঝতে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, নিজেকে একা দেখতে শেখাটা সবচেয়ে কঠিন। অফিসের নতুন ফ্লোরটা একেবারে কাচঘেরা, কর্পোরেট ধাতব রঙে মোড়া, আর এখানে কেউ কাউকে চেনে না—তা-ই সুবিধা। কেউ তাকে প্রশ্ন করছে না, কেমন আছো? বা, দিল্লি অফিসে আসলে কী হয়েছিল? কেউ তাকে চিনে না মানেই সে নিজের মতো করে থাকতে পারছে। তবু দুপুরে একঘেয়েমি কাটাতে সে একটা টেক্সট পাঠাল শ্রেয়শকে—“Lunch done. Today’s sky looks pale grey, but I don’t feel grey.” শ্রেয়শ উত্তর দিল কিছুক্ষণ পর—“Grey is a balanced colour. Not everything has to be bright to feel real.” অনন্যা একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। দূরত্বের ভিতরেও এমন কিছু যোগাযোগ থাকে যা সময় আর জায়গার উপর নির্ভর করে না। এটাই কি তাহলে প্রেমের পরিণত রূপ? যেখানে ‘আমি চাইছি’ বলে আঁকড়ে না ধরে বরং বলে, ‘তুমি চাইলে থাকো, না চাইলে আমিও সম্মান করি।’ প্রতিদিন সকাল আটটায় সে নিজের হোস্টেল থেকে অফিস যায়, নতুন টিমের সাথে মিটিং করে, ক্লায়েন্ট কল নেয়, আর সন্ধ্যায় একা ফিরে আসে। কিন্তু এই একাকীত্বে আর আগের মতো ভয় লাগে না। বরং মনে হয়—নিজের ভিতর নিজের সাথে থাকা একরকম সাহস। হায়দরাবাদের কফিশপে সে একদিন নিজে একা গিয়ে বসে, একটা বই নিয়ে—মুরাকামি’র ‘Sputnik Sweetheart’। চা’য়ের সঙ্গে বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে মনে পড়ে যায় শ্রেয়শ বলেছিল—“তুমি নিজেই এক-একটা অধ্যায়, পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হয়, টের পাওয়া যায় না।” হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে একটা ভার তৈরি হয়। এতদিন ধরে যা হয়েছে, সেটা কি ছিল কেবল কিছু হালকা মুহূর্তের অস্থায়ী সাজানো সাজানো গল্প? না কি এটা ছিল সত্যি এমন কিছু যা সময়কে অতিক্রম করতে পারে? দিন দশেক কেটে যায়। হঠাৎ একদিন সকালে শ্রেয়শ একটা গিফট পাঠায়—একটা ছোট প্যাকেট, যাতে তিনটা স্টিকি নোট, আর একটা হাতে লেখা চিঠি। প্রথম পোস্ট-ইট: “Yellow: You’re missed in meetings.”
দ্বিতীয়: “Green: Every reminder feels like it’s about you.”
তৃতীয়: “Pink: I’m still saving a seat beside me in the canteen.”
আর চিঠিতে লেখা—“Distance doesn’t dilute truth. When you’re ready, come back not just to office, but to us.” অনন্যা চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ, আর চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে। এমনকি এই দূরত্ব, এই নির্জনতাও বুঝিয়ে দেয়, ভালোবাসা চাইলেই মিলিয়ে যায় না। এটা এক ধরনের অদৃশ্য উপস্থিতি, ঠিক যেন জানালার ওপাশে থাকা সেই আলো যা ভিতরটা আলোকিত করে, কিন্তু ছুঁতে আসে না। হায়দরাবাদের শহর তাকে চেনায় তার নিজের ছায়া। এখানে সে ভালোবাসাকে নিয়ে পলায়ন করেনি, বরং মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সেই সন্ধ্যায় সে শ্রেয়শকে একটা ছোট মেসেজ পাঠায়—“The window’s still open. And I’ve learned to stand beside it.” উত্তর আসে মিনিট পাঁচেক পর—“When you come back, we’ll not just open the window—we’ll walk through the door, together.” অনন্যা জানে, ফিরে যাওয়ার দিনটা যতই দেরি হোক না কেন, এই কথা তার ভিতরে থেকে যাবে। ভালোবাসা হয়তো সব সমস্যার সমাধান নয়, কিন্তু সাহস—হ্যাঁ, সাহস সেটা হতে পারে।

পর্ব ১০: ফিরে আসা, নতুনভাবে

তিন মাস পরে, অনন্যা দিল্লি ফিরে আসে। খুব বড় কোনও ঘোষণা নয়, অফিসে মেইল যায় “Welcome back, Ms. Basu,” এবং সকলে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে নেয় তার ফিরে আসা। কিন্তু কিছু চোখ, কিছু কণ্ঠস্বর এখনও আগের মতোই ফিসফিস করে ওঠে—“ফিরে এল?” “ওই স্ট্র্যাটেজি ছেলের জন্যই না?” “ওরা এখনো আছে?” কিন্তু এবার অনন্যা আর কুঁকড়ে যায় না। এবার তার ভেতরে একধরনের স্থিরতা জন্ম নিয়েছে—যেটা শুধু দূরত্বে নয়, নিজেকে আলাদা করে বুঝে নেওয়ার মধ্যেও তৈরি হয়েছে। ফিরে আসার প্রথম দিনেই শ্রেয়শ তার ডেস্কে এসেছিল। খুব সাধারণ ভঙ্গিতে, যেন কেবল সহকর্মী, কিন্তু চোখে একটা স্পষ্ট উজ্জ্বলতা ছিল, যা বলে দেয় অপেক্ষার প্রতিটি দিন কতটা জমাট বেঁধেছিল তার ভিতরে। “কেমন লাগছে?” শ্রেয়শ জিজ্ঞেস করেছিল। “ঠিকই। দিল্লি এখনো কাঁচে মোড়া, কিন্তু আমি এখন জানি জানালার বাইরে কেমন হাওয়া।” “এবং ভিতরে?” “ভিতরের হাওয়াটা আর কাচে আটকে নেই। এবার আমি জানি, ভালোবাসা মানে শুধু একসঙ্গে থাকা নয়, সময় দিলে তাও নিজেকে গুছিয়ে ফেরে।” তারা প্রথম দিনেই একসঙ্গে কফি খেতে যায়নি। শুধু মিটিং শেষ হলে করিডোরের কোণায় একটু দাঁড়িয়ে গল্প করেছে, অফিস শেষে আলাদা আলাদা লিফটে গেছে। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে তারা বুঝেছে—এটা কোনও লুকিয়ে রাখা নয়, বরং একধরনের সম্মান, যা সম্পর্ককে আরও মজবুত করে। এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে বেরিয়ে অনন্যা হঠাৎ বলল, “আজ চল, সেই পুরনো রকবেল ক্যাফেতে।” শ্রেয়শ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ভেবেছিলাম, তুমি বলবে।” ক্যাফেটা আগের মতোই আছে। জানালার ধারে সেই কাঠের টেবিল, সেই কেটলিতে চা, আর সেই ঝুলন্ত চা-ট্যাগে লেখা কিছু কথাবার্তা। আজকের ট্যাগে লেখা ছিল—“Sometimes, you return not to the place, but to the person.” শ্রেয়শ সেটা পড়ে চুপ করে থাকল। অনন্যা বলল, “তুমি কি জানো, আমি কেন ফিরে এসেছি?” “কারণ তিন মাসে হায়দরাবাদ তোমার শহর হয়ে উঠতে পারেনি?” “না। বরং কারণ তুমি আমার শহর হয়েছিলে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে বুঝেছি, শহর কেবল রাস্তা বা বাড়ি নয়, মানুষও হয়। আর তুমি সেই মানুষের তালিকায় পড়ো।” শ্রেয়শ একটুও কথা বলল না। চায়ে চুমুক দিলো। তারপর আস্তে বলল, “আমাদের প্রেমটা ক্যালেন্ডারের বাইরের দিনগুলোতে জন্মেছিল, তাই হয়তো সে নিয়মে বাঁধা পড়েনি। কিন্তু আজ আমি চাই, আমরা নিয়ম বানাই, যা আমাদের মতো করে তৈরি—না অফিসের, না সমাজের, শুধু দুজন মানুষের জন্য।” “তুমি বলতে চাও…?” “হ্যাঁ,” শ্রেয়শ বলল, ব্যাগ থেকে একটা ছোট খাম বার করল। ভেতরে একটা নোট—হাতের লেখা। “Will you build your days with me—in and outside the calendar?” অনন্যা হাসে, চোখে জল চলে আসে। এইবার সে কাঁপা হাতে একটা স্টিকি নোট বার করে নিজের ব্যাগ থেকে, তাতে গোলাপি কালিতে লেখা—“Yes. With yellow mornings, green plans, and pink evenings.” তারা দুইজন জানে, এই ভালোবাসা হয়তো গল্পের মতো নিখুঁত নয়, কিন্তু এই ভালোবাসা তাদের দুজনের। অফিসের ভেতরে যা শুরু হয়েছিল, তা অফিসের বাইরেই পরিণতি পেয়েছে। ক্যালেন্ডারের বাইরের দিনগুলো তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। এখন প্রতিটা দিন তাদের নিজের তৈরি—একটা রঙিন, ছোট ছোট পোস্ট-ইট দিয়ে সাজানো ভবিষ্যৎ।

সমাপ্ত

1000024721.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *