Bangla - তন্ত্র

চণ্ডীমণ্ডপের ছায়া

Spread the love

অরূপ কুমার সেনগুপ্ত


এক

উৎসব মিত্র গাড়ি থেকে নামতেই তার চোখে পড়ল গ্রামের সেই ধূসর রঙা বিকেল, যেন ছায়ায় মোড়া এক মৃত সময়। গড়ভানিপুর — নামটা যতটা রূপকথার মত, বাস্তবটা যেন ঠিক ততটাই নিঃসাড়। কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে তিন ঘণ্টা বাস জার্নি আর এক ঘণ্টা ইজে রিকশার পর, অবশেষে তার গবেষণার গন্তব্যে সে পৌঁছল। একটি পুরনো, প্রায় ভেঙে পড়া পাকা ঘর তার থাকার জায়গা; গ্রামের পাশেই গাছপালার ছায়ায় ঢাকা এই রাজবাড়ির ভগ্নাংশ। ছাদে শালপাতার স্তর, দেওয়ালে ছোপ ছোপ শ্যাওলা, আর মাঝে মাঝে ঘুঘুর ডাক। উৎসব ইতিহাসের ছাত্র— তার থিসিস “উনবিংশ শতকের বাংলার সামন্তপ্রথা ও মন্দির সংস্কৃতি” নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স লাইব্রেরিতে চণ্ডীমণ্ডপ নামক এক রহস্যময় পূজাস্থানের উল্লেখ দেখে সে আঁচ করেছিল যে এখানে কিছু লুকনো ইতিহাস আছে, যা এতদিন কেউ খুঁটিয়ে দেখে নি। কিন্তু এখানে এসে তার কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও যেন ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিচ্ছে। গ্রামের মানুষজন প্রথমেই তাকে সাবধান করেছিল—চণ্ডীমণ্ডপ এখন ‘মরা’ জায়গা। কেউ যায় না, কেউ বলে না। শুধু কখোনো কখোনো রাতে হাওয়ার সঙ্গে এক ধরণের গন্ধ ভেসে আসে—জ্বলা ধূপ আর পোড়া মাংসের মত। কিন্তু উৎসব তো যুক্তিবাদী—সে এসব গুজব মানে না। গ্রামের বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে, একটা মাটির উনুনে দুপুরে চা বানিয়ে, সে রাজবাড়ির ছবি তুলতে গেল। ধ্বংসাবশেষের মাঝেই ছিল একটা ভাঙা, কিন্তু এখনও দণ্ডায়মান চারচালা চণ্ডীমণ্ডপ। তার গায়ে লতাগুল্ম, কিছু পুরোনো সিংহমুখি অলঙ্করণ, আর একটি কালো পাথরের সিঁড়ি—যেটা জঙ্গল আর আগাছার ভিতর দিয়ে চলে গেছে মন্দিরের মূল চত্বরে। উৎসব একটু থেমে দেখল—মন্দিরের দরজা বন্ধ, কিন্তু তার সামনে মাটি কালচে রঙের, যেন সাম্প্রতিককালের ছাই আর কিছু চটচটে দাগ পড়ে আছে। সূর্য তখন হেলে পড়ছে, এবং সে জানে, এই জায়গায় সন্ধ্যার আগে কাজ শেষ না করলে অসুবিধে হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাকের ডাক তার মনোসংযোগ ভেঙে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়—কেউ যেন তাকিয়ে আছে গাছের আড়াল থেকে।

রাতটা কেটেছিল অস্বস্তিতে। কাঠের দরজার ওপারে যেন হাঁটার আওয়াজ, জানালার কাঁচে যেন কেউ হালকা ঘষাঘষি করছে। কিন্তু একটাও ছায়া দেখতে না পেয়ে সে মনে মনে নিজের ক্লান্তিকে দায়ী করল। পরদিন সকালে সে দাদাঠাকুরকে খুঁজতে যায়—এক প্রবীণ মানুষ যিনি নাকি এখনও অনেক পুরোনো কথা মনে রাখতে পারেন। খুঁজে পাওয়া গেল এক ঝুপড়ি ঘরে, যেখানে ধূপকাঠি জ্বলছে, কাঠের পিঁড়িতে বসে বৃদ্ধ এক চেয়ে আছেন শূন্যে। উৎসব তার সঙ্গে কথা বলতেই, দাদাঠাকুর এক আশ্চর্য শান্ত গলায় বললেন—“তোকে ডেকেছে, না রে?” উৎসব একটু চমকে ওঠে, জিজ্ঞেস করে “কে?” বৃদ্ধ বলেন, “যার পূজা একশো বছর ধ’রে থেমে আছে… সেই দেবী… চণ্ডী। মণ্ডপে গেলে খালি চোখে কিছুই পাবি না। কিন্তু সে তো জানে, কে এসেছে, কার রক্তে তার ক্ষুধা মিটবে।” উৎসব এসব শুনে হাসে—লোককথা, গ্রামের ভূতের গল্প। কিন্তু বৃদ্ধ তখন একটা পুরোনো কাগজ এগিয়ে দেন—তাতে ছাপা পুস্তকের মত অক্ষরে লেখা: “অগ্নিদেব শাস্ত্রীর অধিষ্ঠানে শেষ পূজা অমাবস্যা তিথিতে সমাপ্ত, বলি সহকারে। যজ্ঞ সমাপ্তি ঘোষণা করিলেন রায়বাহাদুর নিজে।” উৎসব বুঝে যায়, এটা নিছক গল্প নয়—এই পূজা সত্যি ঘটেছে, এবং কেউ একসময় বলিও দিয়েছে। সে ঠিক করে, পরদিন সকালেই সে মণ্ডপের ভেতরে প্রবেশ করবে, সব তথ্য নথিভুক্ত করবে। কিন্তু সেই রাতে তার ঘরে হঠাৎ বাতাসের তোড়, পুরোনো জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকে যেন ধোঁয়ার মত কিছু—এক ধরণের মিষ্টি পচা ফুলের গন্ধ। চোখ বুজতেই সে স্বপ্ন দেখে—এক রক্তাক্ত চণ্ডীমণ্ডপ, বেদিতে শুয়ে এক শিশু, আর তার পাশে দাঁড়ানো এক কঙ্কালসার পুরোহিত, যার মুখে ছিল আগুনের আলোয় জ্বলতে থাকা চোখ।

পরদিন, উৎসব তার ক্যামেরা, খাতা-কলম, আর একটা লণ্ঠন নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে রওনা দেয়। পথে গ্রামের কেউ তাকে কিছু বলে না, শুধু দূর থেকে তাকায়। কেউ কেউ দরজা লাগিয়ে দেয়। আগাছা আর বনজ ঝোপ ঠেলে সে পৌঁছে যায় মন্দিরের চূড়ান্ত অংশে। পাথরের বেদি, কালো সিঁড়ি, আর একটা হিন্দি লিপির ফলক—যেখানে লেখা “জীবদানের মধ্যে দিয়েই শক্তির জাগরণ।” উৎসব তার ক্যামেরা চালু করে ছবি তোলে। মন্দিরের ভেতরে এখন আর কোনও মূর্তি নেই, শুধু একটা পাথরের ত্রিশূল আর শুকিয়ে যাওয়া মালার ছায়া। হঠাৎ, তার ক্যামেরার স্ক্রিনে সে দেখে, পিছনে যেন কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু ঘুরে তাকাতেই কেউ নেই। সে ভাবে কোনও কাক বা পাখি হবে। কিন্তু ঠিক তখন, তার গায়ে হঠাৎ একটা শীতল বাতাস লাগে, আর তার কানে আসে অস্পষ্ট এক কণ্ঠস্বর—যেটা যেন মন্দিরের বেদি থেকে উঠে আসে, ধীরে ধীরে, অস্পষ্ট ভাষায়—“আগামী অমাবস্যা… পূর্ণ হবে চক্র… রক্ত চাই… আগুন চাই।” উৎসব পিছিয়ে আসে ধীরে ধীরে, তার কাঁধ ভারী হয়ে আসে, বুকের ভেতরে ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। সে ভাবে ফিরে যাবে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ে বেদির গায়ে খোদাই করা একটি প্রতীক—যেটা সে ইতিমধ্যেই পেয়েছিল তার গবেষণার পাণ্ডুলিপিতে, কিন্তু বিশ্বাস করেছিল সেটি নিছক অলংকরণ। এখন তার মাথায় একটাই প্রশ্ন—এই চণ্ডীমণ্ডপ শুধু ইতিহাস নয়, এর সঙ্গে কিছু এমনও জড়িয়ে আছে, যা এখনও শেষ হয়নি। সে বুঝতে পারে, তার যাত্রা এখনই শুরু। অতীতের প্রেত ছায়া হয়তো তাকে ইতিমধ্যেই নিজের ভেতরে টেনে নিয়েছে।

দুই

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই উৎসব মিত্র বুঝে যায়, এই গ্রাম শুধু অতীতের অংশ নয়—এটা যেন এক জীবন্ত ক্যালেন্ডার, যেখানে সময় দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না, কেবল রাত্রির দিকে ধাবিত হচ্ছে। চণ্ডীমণ্ডপ থেকে ফিরে এসে তার মাথার ভেতর যেন হাজারো শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল—যজ্ঞ, বলি, অগ্নিদেব, রক্ত, আর সেই অস্পষ্ট গলার আওয়াজ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মাথার ভেতর একটা ধাঁধা বেজে চলেছে—পাণ্ডুলিপিতে যে প্রতীক সে দেখেছিল, তা মন্দিরের বেদিতে কি করে এল? প্রতীকটি ছিল এক জ্যামিতিক চক্রের মতো—বৃত্তের মাঝে ত্রিভুজ, তার কেন্দ্রে একটি ত্রিশূল আকৃতি। সাধারণ ব্রাহ্মণ্য চিহ্ন বলে ধরে নেওয়া গেলেও উৎসব জানে, এই চিহ্নের আশ্চর্য মিল রয়েছে একটি নির্দিষ্ট প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র কেতার সঙ্গে, যা রাজা অনন্ত নারায়ণ চৌধুরীর আমলেই নিষিদ্ধ হয়েছিল। সে এই কৌতূহল নিয়ে ফের যায় দাদাঠাকুর রামচন্দ্রর কাছে, যিনি দিনের বেশিরভাগ সময় একটি বটগাছের নিচে বসে ধূপ জ্বালিয়ে নির্লিপ্তভাবে থাকেন। বৃদ্ধ আজ চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন, আর উৎসবের পা পড়ে যেতেই যেন চমকে না গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললেন, “দেখলি তো, ভিতরটা কেমন ঠাণ্ডা?” উৎসব প্রথমে অবাক হয়, তারপর বলে—“আপনি কীভাবে জানলেন আমি গেছি?” দাদাঠাকুর চোখ মেলেন না, শুধু বলেন, “ওরা জানে, কে কোথায় যাচ্ছে। মণ্ডপ তো সজীব রে বাবু, শুধু মানুষ চিনতে শিখেছে রক্ত দিয়ে।” উৎসব তার খাতার মধ্যে থেকে প্রতীকের ছবিটা বের করে দেখায়, আর বলে—“এই চিহ্নটার মানে জানেন?” বৃদ্ধ ছবিটা দেখে একটুও অবাক না হয়ে বলেন—“ওটা চক্রনিক্ষেপ, একটা পুরনো বলিপদ্ধতির চিহ্ন। যেখানে মাঝখানে বলি দেওয়া হয়, চারদিকে জ্যোতিষ্চক্র তৈরি হয়। এই চিহ্নটি কেবলমাত্র তখনই আঁকা হত, যখন বলি সম্পূর্ণ হতে পারত না… মানে কিছু অসম্পূর্ণতা থাকত। এমন বলিপূজা থেমে গেলে আবার পুনরারম্ভ করতে হত একই দিনে, একই রক্তের বর্ণে, একই জ্যোতিষ লগ্নে।” উৎসব বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো বলেছিলেন, শেষ পূজা একশো বছর আগে হয়েছিল, তা হলে এখন আবার…” দাদাঠাকুর প্রথমবারের মত চোখ মেলে তার দিকে তাকালেন—দুটি চোখ যেন দুটো পোড়া পাতার মত ক্লান্ত, অথচ তীব্র। তিনি বললেন, “কারও না কারও জন্ম হয় ঠিক সেই লগ্নে, যাতে পূজার অসম্পূর্ণ চক্র আবার ঘুরে দাঁড়ায়। তুই সেটা জানিস না, কিন্তু ওরা জানে।” এই ‘ওরা’ কারা? উৎসব বুঝে ওঠে না, কিন্তু তার শরীরে কাঁটা দিয়ে যায়—কারা যেন তাদের দেখে, তাদের নিয়ে খেলে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।

দাদাঠাকুর আর কথা না বলে হাতে একটি পুরনো লাল রঙের কাগজে মোড়া ছোট কাঠের বাক্স এগিয়ে দেন। উৎসব ধীরে ধীরে বাক্সটি খোলে—ভেতরে একটি ছোট পিতলের ঘন্টি, আর একটি ভগ্ন রুদ্রাক্ষ মালা, যার গায়ে রক্তরঙা দাগ। দাদাঠাকুর বলেন, “এইটা ছিল অগ্নিদেব শাস্ত্রীর মালা। তোর কাজে লাগবে না, কিন্তু ওরা চিনবে তোকে… এটা নিয়ে রাখ।” উৎসবের হাতে মালাটা যেতেই তার তালু যেন ঠান্ডা বরফে ডুবে যায়, কিছু মুহূর্তের জন্য তার শ্বাস আটকে আসে, সে দেখতে পায় এক মৃতদেহ শুয়ে আছে, যজ্ঞের আগুন জ্বলছে, চারপাশে মুখ ঢাকা মানুষদের ছায়া, আর মাঝখানে দাঁড়ানো এক দীর্ঘকায় পুরুষ—চোখে আগুনের প্রতিচ্ছবি, হাতে রক্তমাখা কৃপাণ। মালা হাত থেকে ফেলে দিয়ে সে ধপ করে বসে পড়ে। দাদাঠাকুর বলেন, “ওটা শুধু বস্তু না, ওটা এক স্মৃতি। এই মণ্ডপের ইতিহাস শুধু বইতে নেই, রক্তে আছে, হাড়ে আছে। অমাবস্যার রাতে, একবার যদি চক্র সম্পূর্ণ হয়, তবে সেই বলির আওয়াজ তোকে ঘিরে ধরবে।” উৎসব চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়, আর বলার কিছু থাকে না। তার মনে হয়, সে আর সাধারণ গবেষক নেই—সে এখন এক কাহিনির অংশ, যেখানে অক্ষরগুলো কেবল পাণ্ডুলিপিতে নয়, মৃত্যুর গন্ধে লেখা। গ্রামটা যেন এক বড় নাটমঞ্চ, আর চণ্ডীমণ্ডপ তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে পরবর্তী দৃশ্যের জন্য। সেই রাতে, উৎসব মালাটা একবার আবার ছুঁয়ে দেখে—এবং এবার অনুভব করে, সেটির স্পর্শে শরীর কাঁপলেও মনের ভিতর এক অদ্ভুত দৃঢ়তা গড়ে উঠছে। যেন চক্র তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে, কিংবা সেও শিকার না হয়ে যজ্ঞের পুরোহিত হয়ে উঠছে।

রাত দশটার পর, গ্রামের বিদ্যুৎ চলে যায়, এবং কুয়াশা নেমে আসে গাঢ় হয়ে। উৎসব ঘরে বসে নোট লিখছিল—তার মনে হচ্ছিল, সময়ের ধাপে সে পিছিয়ে যাচ্ছে। দরজার ওপাশে কুকুরের ডাকার মত শব্দ, কিন্তু এই গ্রামে কোনও কুকুর নেই বলেই লোকজন বলেছিল। এক সময় সে খেয়াল করে, জানালার কাঁচে ঘাম জমে ওঠে, অথচ ঘরের ভিতরে হাওয়ার স্পর্শ নেই। হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে একটা ধাতব শব্দ হয়—যেন কেউ ধাতুর ওপর ধাতু ঠেকাল। উৎসব উঠে টর্চ জ্বালায়—কিছুই নেই। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখ পড়ে দরজার নিচ দিয়ে একটা কাগজ গড়িয়ে এসেছে। সে কাগজটা তুলে দেখে, সেখানে একটা অদ্ভুত লিখনশৈলীতে লেখা মাত্র তিনটি শব্দ—“রক্ত না দিলেই…” বাকিটা ছেঁড়া। উৎসবের হাত কেঁপে যায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে যায় দাদাঠাকুরের সেই ধাঁধার মত বলা কথা—“বলির রক্তের বর্ণ মিলে গেলে, পূজা আবার জেগে ওঠে।” তাহলে কি সে-ই সেই মিল? তাহলে কি তার জন্ম সেই লগ্নেই, যেদিন পূজা অসম্পূর্ণ ছিল? এতসব যুক্তিসম্মত কথা তার পক্ষে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তার শুধু মনে হয়, এই চক্রের কেন্দ্রস্থলে সে দাঁড়িয়ে, এবং যাই ঘটুক, তাকে এই পূজার পেছনের সত্য জানতে হবে—হোক সে প্রেতাত্মা, নরবলি, না হোক শয়তানি বিশ্বাস। বাইরের বাতাস থেমে গেছে, রাতটা যেন দমবন্ধ করা; কিন্তু উৎসব জানে, আগামীকাল সকালেই সে চণ্ডীমণ্ডপে প্রবেশ করবে আবার, এবার দাদাঠাকুরের দেওয়া মালা গলায় পরে। কারণ, সে বুঝে গেছে—এই ধাঁধার উত্তর কেবল ইতিহাসের খাতায় নেই, তার রক্তের মধ্যেই কোনও গোপন চাবিকাঠি লুকানো।

তিন

সকালে ঘুম ভাঙতেই উৎসব মিত্রর মনে হয় যেন সে অন্য কারও স্বপ্ন থেকে উঠে এসেছে—একটা কালচে আলো, অস্পষ্ট মুখ, মন্ত্রের আওয়াজ, আর তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কুয়াশার মতো কিছু ছায়া। নিজের শরীর স্পর্শ করেই সে বুঝতে পারে—এটা বাস্তব, সে গড়ভানিপুরেই আছে। সকাল আটটার দিকে সে তৈরি হয়, গলায় দাদাঠাকুরের দেওয়া রুদ্রাক্ষ মালা পরে, নোটবুক, ক্যামেরা, লণ্ঠন, আর একটা ছোট রেকর্ডার নিয়ে রওনা হয় সেই চণ্ডীমণ্ডপের দিকে, যেখানে তার গবেষণার কেন্দ্রীয় সত্য লুকিয়ে আছে। গ্রামবাসীরা আজ আরও বেশি চুপচাপ, কেউ কারও চোখে চোখ রাখে না, যেন তার উপস্থিতি সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলছে। কেবল একজন বয়স্ক মহিলা, যার চোখে ছিল অন্ধকারের ছায়া, ধীরে ধীরে বললেন—“যত গভীরে যাবে, তত কম আলো পাবে।” উৎসব আর উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায়। মন্দিরের চারপাশ আগের চাইতেও বেশি নিঃস্তব্ধ। একটা কাকও ডাকে না। আগাছা, শ্যাওলা, আর সাদা ধুলোতে ঢাকা পাথরের চূড়াগুলি যেন একাধিক শতাব্দীর স্মৃতি নিজের গায়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই সে দেখে, আগের দিনের তুলনায় আজ একধরনের অস্বাভাবিক ছায়া জমে আছে—সূর্যের আলো সেদিকে পৌঁছায় না। মন্দিরের ভিতরের মূল চত্বরটি বিশাল—প্রায় পঁচিশ ফুট ব্যাসার্ধ, গোলাকৃতি ঘর, মাঝখানে একটি বিশাল কালো বেদি। বেদির ঠিক ওপরে একটি ভাঙা ত্রিশূল দাঁড়িয়ে আছে, যার একপাশ রক্তচিহ্নে রঙিন—যদিও তা অনেক পুরনো, কিন্তু যেন আজকেও তা জীবন্ত। উৎসব ধীরে ধীরে ভেতরে হাঁটে, দেয়ালে প্রাচীন চিত্রলিপি, পাথরের খোদাই, আর কিছু অদ্ভুত প্রতীক দেখতে পায়—যার মধ্যে কিছু তার থিসিসে আগে দেখা ছিল, কিছু সে এই প্রথমবার দেখছে। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ জিনিস ছিল বেদির নিচে খোদাই করা সেই চক্রচিহ্ন, যেটা তার পাণ্ডুলিপিতে ছিল—তবে এখানে সেটি ছিল সম্পূর্ণ, রক্তরঙা রঙে আঁকা। সে বুঝতে পারে, আগের দিন যে প্রতীক সে দেখেছিল, সেটি ছিল আংশিক, আজ সম্পূর্ণতা পেল।

বেদির চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখে পড়ে একটি ক্ষুদ্র পাথরের বাক্স, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সেটিকে লুকিয়ে রেখেছিল। সে সেটি খুলে দেখে—ভেতরে আছে একটি কাঁসার পাত, যেটিতে শুকনো রক্তের দাগ, এবং একটি লেখা কাগজ—যেখানে পুরোনো সংস্কৃত ছায়া লিপিতে লেখা কয়েকটি শ্লোক। উৎসব সেই শ্লোকগুলি রেকর্ডারে পড়ে নেয়, পরে অনুবাদ করবে বলে ঠিক করে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে অদ্ভুত ঘটনা—হঠাৎ একটা শীতল বাতাস ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে, লণ্ঠনের আলো দপ করে নিভে যায়, আর এক ঝলক সাদা ধোঁয়া তার চারপাশ ঘিরে ফেলে। সে যতই চোখ সঁপে দেখতে চায়, বুঝতে পারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কেবল শব্দ—এক ঘন ও নিঃশ্বাসের মত শব্দ, যেন কেউ তার গলার খুব কাছে এসে ফিসফিস করছে—“আগুন… রক্ত… বলি… সময় এসেছে…” উৎসব এক মুহূর্তে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে তার রুদ্রাক্ষ মালাটা চেপে ধরে এবং মন্ত্রের মত বলে—“আমি ইতিহাস জানতে এসেছি, বলি দিতে নয়।” ঠিক তখনি ঘরের এক পাশে, দেওয়ালে সোনালি রঙের মত কিছু জ্বলজ্বল করে ওঠে—এক প্রাচীন শিলালিপি, যা সে আগে লক্ষ্য করেনি। এগিয়ে গিয়ে সে পড়ে—“অপূর্ণ যজ্ঞ, পুনরায় জাগে রক্তসন্ধ্যায়। পূর্ণ হোক, যেই জন্ম তার লগ্নে মিলুক।” উৎসব যেন মাটিতে গেঁথে যায়—তাহলে কি তার জন্মই এই যজ্ঞের অসম্পূর্ণতা পূরণের জন্য? তখনই মন্দিরের ছাদ থেকে একটি দড়ির মতো জিনিস ঝুলে পড়ে, আর সেই সঙ্গে সে দেখে এক মুহূর্তের জন্য, বেদির উপর এক পচাগলা মৃতদেহ শুয়ে আছে—চোখ খোলা, ঠোঁটে অর্ধেক মন্ত্র। পরক্ষণেই সেই দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উৎসব মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার মনে হয়, এই জায়গা তাকে কিছু বলতে চাইছে—না, শুধু বলা নয়, দেখাতে চাইছে এমন কিছু যা ইতিহাস নয়, বরং অভিশাপ। ফেরার সময় সে দেখে, গ্রামের বাইরে হরিপদ ঘোষ দাঁড়িয়ে আছে—যে আগে রাজবাড়ির কেয়ারটেকারের ছেলে ছিল। সে উৎসবকে দেখে হঠাৎ হেসে ওঠে—একটা বিকৃত, প্রায় অমানবিক হাসি, আর বলে—“দেখলেন তো বাবু? এখনও খেলা শুরুই হয়নি। আসল বলি তো বাকী আছে।” উৎসব আর কিছু না বলে সোজা ঘরে ফিরে আসে, দরজা বন্ধ করে দেয়। তার হাতে মালা, চোখে বেদির চিহ্ন, আর মনে এক অমোঘ ভয়। সে জানে, ইতিহাস এখানে শেষ নয়, বরং সেই ইতিহাস এখন তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে—তার চিন্তা, তার স্বপ্ন, এমনকি তার রক্তে। একটাই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে—সে কি কেবল গবেষক? না কি এই অভিশপ্ত চক্রের পরবর্তী কেন্দ্র? সে জানে, উত্তর একদিন আসবেই, হয়তো পরের অমাবস্যা রাতে, যখন চক্র সম্পূর্ণ হবে—বা তার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে এক অসমাপ্ত বলি।

চার

রাত গভীর হতেই উৎসবের ঘরে আবার সেই গা ছমছমে অস্বস্তি নেমে আসে—কিন্তু এবার সেটা নিছক ভয় নয়, বরং এক ধরণের অজানা টান, যেন তাকে কেউ তার নিজের ইতিহাসের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই সে উঠে পড়ে, কারণ মাথার ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই পাণ্ডুলিপির অংশ, যেখানে এক রহস্যময় পুরোহিত—অগ্নিদেব শাস্ত্রী—এর নাম উঠে এসেছিল। রাজবাড়ির শেষ আমলের এই পুরোহিত সম্পর্কে কোথাও স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই—না মৃত্যুর বিবরণ, না স্বাভাবিক গৃহত্যাগ, কেবলমাত্র কিছু অস্পষ্ট ইঙ্গিত: “যজ্ঞ অসমাপ্ত,” “পুরোহিত অন্তর্ধান,” ইত্যাদি। উৎসব ঠিক করে, আজ সে পৌঁছবে পাশের গ্রাম মেঘচাঁদপুর—যেখানে অগ্নিদেবের পূর্বপুরুষেরা থাকতেন, এবং হয়তো আজও কেউ আছেন যাঁরা তাঁর কথা বলতে পারেন। পায়ে হেঁটে, মাঠের আল পেরিয়ে, সে পৌঁছায় সেই গ্রামে—যেখানে চারপাশে ভাঙা কুঁড়েঘর, ধুলোমাটিতে ভরা পথ, আর মাঝেমধ্যে পচা গরলগন্ধে ভেসে আসছে বাতাস। উৎসবের প্রশ্নে প্রথমে কেউ কিছু বলতে চায় না, কিন্তু এক বৃদ্ধা, যার চোখ দুটো ছাইরঙা ও গলা রুক্ষ, কাঁপা গলায় বলে—“অগ্নিদেব? তাঁর নাম আবার কেউ নেয় আজকাল?” উৎসব জিজ্ঞেস করে, “আপনি তাঁকে দেখেছেন?” উত্তর আসে—“আমার ঠাকুরমা বলতেন, তিনি আগুনের সঙ্গে কথা বলতেন। একদিন সন্ধ্যেবেলা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। কেউ বলত, দেবী তাঁকে নিয়ে গেছেন, কেউ বলত—তাঁর নিজের রক্তে যজ্ঞ অসম্পূর্ণ ছিল, তাই তাঁর আত্মা এখন মণ্ডপেই ঘোরে।” উৎসব এক মুহূর্তে চুপ করে যায়—এই প্রথমবার কেউ বলল, অগ্নিদেবের আত্মা এখনও চণ্ডীমণ্ডপে ঘোরে। সে একটানা নোট নিচ্ছিল, কিন্তু তার কলম যেন থেমে যায় বৃদ্ধার পরবর্তী বাক্যে—“তিনি বলতেন, শেষ পূজা অসমাপ্ত ছিল, কারণ বলি যে দেয়ার কথা ছিল, সে পালিয়ে যায়।” উৎসবের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়—তাহলে কি সেই পুরনো বলির রাতেই পূজা ভঙ্গ হয়েছিল? সেই অসম্পূর্ণ যজ্ঞ কি এখনো প্রেতচক্রের মত বারবার ফিরে আসছে?

গ্রামে ফিরে এসে উৎসব নোট ঘাঁটতে ঘাঁটতে সন্ধ্যে পার করে। ঘরটা আজ অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা—মেঝেতে হাত রাখতেই শীতল ঘাম জমে ওঠে। সে মালাটা পরেই ছিল, কিন্তু তবু বুকের ভেতরে এক চাপা উদ্বেগ যেন ঠেকিয়ে রাখা নদীর মতো জমা হচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, মণ্ডপে রাত্রে না গিয়ে বরং রাজবাড়ির পুরোনো লাইব্রেরি ঘর খুঁজে দেখবে, যেখানে নাকি কিছু দলিল ছিল যেগুলো স্থানীয় জমিদার বাড়ির মানুষেরা কাগজে নথিভুক্ত করতেন। খুঁজতে খুঁজতে সে রাজবাড়ির পেছনের দিকে একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়—পৃথিবী যেন নিঃশব্দ হয়ে এসেছে। জীর্ণ কাঠের দরজা ঠেলে সে প্রবেশ করে একটি ভাঙ্গাচোরা ঘরে, যেখানে প্রাচীন কাগজ, ছেঁড়া বই, পোকায় কাটা দলিল—সব স্তূপ করে রাখা। ঘরে একটা ধাতব তক্তার মধ্যে সে খুঁজে পায় একটি মোটা খাতা, যার উপরে লেখা—“তান্ত্রিক আচারের বিস্তারিত বিবরণ—শ্রী অগ্নিদেব শাস্ত্রী”। উৎসব সেই খাতা খুলে দেখে, সেখানে নিজের হাতে লেখা অদ্ভুত সব নোট—”যজ্ঞে রক্ত না পড়লে, দেবীর আসন নড়ে যায়,” অথবা “বলির পূর্বে চক্র ভঙ্গ হলে, পুরোহিত নিজে বলি হয়,” ইত্যাদি। পৃষ্ঠাগুলির মাঝে একটা জায়গায় লেখা—“শেষ চক্রে, এক বালককে এনে বেদিতে শোয়ানো হয়েছিল। কিন্তু সে পালিয়ে যায়। আর আমি… আমি তখন দেবীর অভিশাপে…” বাকিটা কাটা। উৎসব তখন বুঝতে পারে, সেই বলি রাতেই যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল, এবং পুরোহিত অগ্নিদেব শাস্ত্রী নিজে সেই ব্যর্থতার দায়ে নিখোঁজ হন—অথবা আত্মবলিদান দিতে বাধ্য হন। কিন্তু এই সবের মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভয়ানক—it’s still ongoing. সেই চক্রের ঘূর্ণন থামেনি, বরং নতুন বলি খুঁজছে। উৎসবের হাত কাঁপতে থাকে। কে সেই পালিয়ে যাওয়া বালক? আর কে সেই ভবিষ্যৎ বলি?

হঠাৎ লাইব্রেরি ঘরের পেছনের জানালায় এক ঝলক হাওয়া আসে, সাথে আসে এক সুরেলা কিন্তু বিকৃত কণ্ঠ—“আমি এখনও পূর্ণতা পাইনি… সে ফিরে আসবে… তুই কি বলি দেবে?” উৎসব ঘুরে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই—তবু তার মাথায় ঘুরে সেই একই দৃশ্য, বেদি, রক্ত, ছায়ামূর্তি। সে খাতা বন্ধ করে ছুটে বেরিয়ে আসে রাজবাড়ি থেকে, কিন্তু তার মাথায় তখন ঘূর্ণায়মান একটাই নাম—অগ্নিদেব। সে যেন মরেনি, বরং সময়ের গভীর চক্রে কোথাও লুকিয়ে আছে। উৎসব বুঝতে পারে, মণ্ডপ তাকে ডাকছে—তাকে শুধু ইতিহাসের গবেষক হিসেবে নয়, যজ্ঞের অসমাপ্ত কাহিনির সাক্ষী এবং সম্ভবত অংশ হিসেবে। সেই রাতে ঘুমোতে গিয়ে উৎসব দেখতে পায়, সে নিজেই সেই বেদিতে শুয়ে আছে, চারপাশে আগুন জ্বলছে, আর সেই একই পুরোহিত তার গলায় মালা পরাচ্ছে। ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎই—মাথা ঘামে ভেজা, বুক ধড়ফড় করছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দেখে, মন্দিরের দিক থেকে আলো আসছে—একদম মাঝরাতে, চাঁদহীন অমাবস্যার অন্ধকারে, যখন আলো জ্বলে না। সে জানে, এই আলো স্বাভাবিক নয়। মন্দিরের চক্র আবার জেগেছে।

পাঁচ

পরদিন সকালে উৎসব মিত্র রাজবাড়ির সেই পুরনো লাইব্রেরিতে আরও কিছু সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আগের রাতের ঘটনার পর তার ভিতরটা এক অজানা শঙ্কায় কুঁকড়ে থাকলেও, কৌতূহলের কাছে ভয় আজ অসহায়। সে জানে, এই ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নেই, বরং মানুষের হাড়গোড়, প্রাচীন রক্ত এবং এক অভিশপ্ত পূজাচক্রের ভিতরে বাঁধা। লাইব্রেরির পোকায় কাটা স্তূপ থেকে ধুলো মুছে সে তুলে আনে একটি মোটা ধূসর খাতা, যার নাম — “রাজবাড়ির বলিপাঁজি ও যজ্ঞপত্র, ১৮৩৫–১৮৯২”। খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঘর যেন ভারি হয়ে ওঠে, বাতাস থেমে যায়। পাতার পর পাতা সে উল্টে দেখতে থাকে—প্রথম দিকে শুধু চণ্ডীপূজার সাধারণ রেওয়াজ, ভোগের বর্ণনা, তিথি ও পুজোর লগ্ন। কিন্তু ১৮৮১ সালের পর হঠাৎ করে কালি বদলে যায়, শব্দের ছাঁট কেমন যেন বদলে যায়—মাঝেমধ্যে ‘বলিপাত্র’, ‘রক্তজাগরণ’, ‘চক্রবন্ধ’, ইত্যাদি শব্দ জ্বলজ্বল করে ওঠে পাতার উপর। তার চোখ আটকে যায় ১৮৮৫ সালের এক পাতায়, যেখানে লেখা—”রক্তের পূজা সম্পূর্ণ হল না। রাজা নিজে উপস্থিত ছিলেন। বলির জন্য আনা হয়েছিল এক বালক, নাম অনামা। কিন্তু সে পালিয়ে যায় যজ্ঞচক্রের ভেতর থেকে। তখন পুরোহিত অগ্নিদেব শাস্ত্রী বলি সম্পূর্ণ করতে নিজের রক্ত উৎসর্গ করেন। কিন্তু চক্র বন্ধ হয়নি। চণ্ডীমণ্ডপের শক্তি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।” উৎসবের গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়—এই ঘটনা ঠিক সেই কাহিনির সঙ্গে মিলে যায়, যা সে শুনে এসেছে টুকরো টুকরো ভাবে। বলিপাঁজির শেষে একটি পাতা আছে, যার উপর শুধুমাত্র রক্তের দাগ এবং খসখসে অক্ষরে লেখা—“পরবর্তী বলি আসবে, যখন জন্মকাল ও চক্র এক হবে। পিতৃনামের ছায়া তার উপর থাকবে, এবং দেবী নিজেই ডেকে নেবেন।” উৎসব ভীষণভাবে অস্থির হয়ে পড়ে। সে নিজের জন্মনাম, জন্মতারিখ মনে করে—সেই তারিখ কি সেই চক্রের লগ্নর সঙ্গে মিলে যায়? তার বাবার নাম ছিল ঈশান মিত্র, যার অর্থ—দিকের প্রভু। হঠাৎ তার মনে পড়ে, আগের অধ্যায়ে দাদাঠাকুর তাকে বলেছিলেন—“তোর নামের অর্থ জানিস তুই?” সে বুঝতে পারে, এখানে কাকতাল নয়, বরং এক পূর্বনির্ধারিত মিলন ঘটেছে—তাকে টেনে আনা হয়েছে।

তবে উৎসব আরও একটা তথ্য জানার জন্য ব্যাকুল—রাজা অনন্ত নারায়ণ চৌধুরীর ভূমিকা কী ছিল এই বলিপূজায়? সে লাইব্রেরির অন্য কোণে খুঁজে পায় “রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ রাজপত্র, ব্যক্তিগত রেকর্ড” নামের একটি হাতেকাটা রেজিস্টার, যার বেশিরভাগ পাতাই নষ্ট বা ছেঁড়া। তবু একটি পাতায় স্পষ্ট লেখা—“চণ্ডীপূজায় চক্র সম্পূর্ণ করতে না পারলে রাজবংশে দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ও অকাল পুত্রহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। রাজার স্বপ্নে দেবী নির্দেশ দেন—রাজ্যের রক্ত চাই। সেই রক্ত যদি রাজপুত্রের না হয়, তবে প্রজার হৃদয় হোক।” এই বাক্যগুলি উৎসবের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়। রাজবাড়ির পুজো ছিল না কেবল ভক্তির জায়গা—তা ছিল এক রক্ত-তান্ত্রিক শক্তির খেলা। সে আরও পড়ে—“রাজা নিজেই একবার পূজার রাতে বেদির পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—‘যদি কেউ পালায়, তবে আমার রাজ্যই পূর্ণ বলি হবে।’” এই বাক্যটার পর থেকে পাতাগুলি নষ্ট, ছেঁড়া, কিন্তু একটিতে দাগানো একটি নোট—“শেষ পাণ্ডুলিপি পুরোহিতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।” উৎসব বুঝে যায়, অগ্নিদেব শাস্ত্রীর হস্তলিখিত সেই খাতাই সম্ভবত এই বর্ণনার চূড়ান্ত দলিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—রাজবংশ আজ কোথায়? যারা বলির আদেশ দিয়েছিল, তাদের উত্তরসূরি কি আজও আছে? নাকি তারাই নিজের রাজবাড়ির অভিশাপকে বুকে নিয়ে হারিয়ে গেছে সময়ের ধুলোর মধ্যে? উৎসবের মন বারবার ফিরছে সেই প্রাচীন ত্রিশূল, সেই রক্তচিহ্ন, সেই ছায়া আর ধোঁয়ার দিকে। তাকে যা পেয়েছে, তা শুধু ইতিহাস নয়—একটা আত্মার ঘূর্ণি, যা ধীরে ধীরে তাকে পাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বিকেলের দিকে, উৎসব মন্দির চত্বরের কাছে পৌঁছায় আবার। এবার সে নতুন চোখে দেখে সেই স্থির বেদি, সেই কাঁসার পাত্র, আর সেই প্রতীকগুলি—যা এতদিন নিছক অলঙ্করণ বলে মনে হয়েছিল, এখন যেন জীবন্ত কাহিনি। সে বেদির চারপাশ ঘুরে দেখতে পায় একটিমাত্র পাথরের ফলক, যেটা অনেক আগের থেকে চাপা ছিল ধুলোয়। মুছে দেখে সেখানে খোদাই করা—“পঞ্চবলির শেষ নাম লেখা নেই। তার হৃদয়ে লিখিত, তার রক্তেই পূর্ণতা।” উৎসব বুঝে যায়, পঞ্চম বলি এখনও হয়নি, আর সে–ই হতে পারে সেই শেষ নামহীন বলি। সে জানে না কাকে বিশ্বাস করবে, কার কথা শুনবে। শুধু এইটুকু বোঝে, এই পূজার, এই রাজবাড়ির, এই চক্রের সমস্ত ধারা এখন তার শরীরে এসে মিশেছে। সে চায় বেরিয়ে আসতে, কিন্তু বেরোনো মানেই অপূর্ণতা—আর অপূর্ণতা মানেই, যেমন পাঁজিতে লেখা আছে, “মৃত্যু পুনরাবৃত্ত হবে।” সেই রাতে ঘুমের মধ্যে উৎসব দেখে—সে দাঁড়িয়ে আছে বেদির উপরে, চারপাশে আগুন, মাথায় তামার মুকুট, আর সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ পুরোহিত—চোখের জায়গায় শূন্যতা, যার ঠোঁট থেকে উচ্চারিত হচ্ছে—“এই রাজ্য তোকে বলি স্বরূপ গ্রহণ করল, উৎসব মিত্র। জন্ম নয়, রক্তই নিয়তি।” ঘুম ভাঙতেই সে বুঝে যায়—পরবর্তী অমাবস্যা তার জন্য নয়, বরং এক প্রাচীন শক্তির জন্য অপেক্ষা করছে।

ছয়

গ্রামের মানুষজন ধীরে ধীরে উৎসব মিত্রের উপর ভয়ের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেছে। তার চোখে গাঢ় চক্রাকার কালি, মুখে শুকনো উদ্বেগ, আর কথার মাঝে মাঝে এমন কিছু নাম ও সময় উচ্চারিত হয়, যা সাধারণ কেউ জানে না। উৎসব বুঝতে পারছিল, চণ্ডীমণ্ডপ তার মানসিকতা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে—তবে তবুও তার ভিতরকার গবেষক এখনও বেঁচে ছিল, যে ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠা নিজে পড়ে দেখতে চায়। সেই কারণেই সে শহর থেকে ফোন করে ডেকে পাঠায় তার সহপাঠিনী ও ছেলেবেলার বন্ধু রিনি ধরকে—ফটোগ্রাফি ও নৃতত্ত্বে আগ্রহী, যুক্তিবাদী স্বভাবের, যার চোখ দিয়ে উৎসব চায় সত্যটাকে আরেকবার যাচাই করতে। রিনি পৌঁছায় দুইদিন পর—দুপুরের পর, রোদে জ্বলা মাঠ পেরিয়ে, ব্যাগভর্তি ক্যামেরা, লেন্স ও ফিল্ম রোল নিয়ে। প্রথম দিনেই উৎসব তাকে নিয়ে যায় মন্দির চত্বরে—চণ্ডীমণ্ডপের চারদিকে ছবি তোলে সে, কিন্তু বারবার ক্যামেরার লেন্সে অদ্ভুত কিছু ঝাপসা ধরা পড়ে। প্রথমে মনে হয় ধুলো বা রোদের রিফ্লেকশন, কিন্তু পরদিন সকালে দেখা যায়—সব ছবি একই রকমভাবে ঝাপসা, এবং প্রত্যেকটিতেই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এক অন্ধকার প্যাটার্ন, যা মন্দিরের প্রতীকচিহ্নের সঙ্গে মিলে যায়। রিনি অবাক হয়, কেবল প্রযুক্তির ব্যাখ্যায় মন ভরেনা। সন্ধ্যায়, সে বলে—“এই জায়গায় আলো কিছুতেই সোজাসুজি কাজ করছে না। একটা অবিচ্ছিন্ন বিরোধ তৈরি হচ্ছে, যেন কিছু শক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আলোর পথ আটকে দিচ্ছে।” উৎসব তখন তার পড়া ও জেনে ওঠা বলিপাঁজি, রাজবংশ ও অগ্নিদেব শাস্ত্রীর কাহিনি এক নিঃশ্বাসে রিনিকে বলে—তখনও সে ভাবছিল, অন্তত একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ তাকে ভুল ভাববে না। রিনি প্রথমে হাসে, তারপর চুপ করে শোনে—শোনার শেষে শুধু বলে—“আমরা যদি সত্যি এমন ইতিহাসের অংশ হই, তাহলে সেটা শুধুই খুঁজে দেখার জিনিস নয়, সেটা টের পাওয়া উচিত। চল, আজ রাতে চণ্ডীমণ্ডপে যাই। আমি ছবি তুলব, তুই কিছু রেকর্ড কর।”

রাত তখন অমাবস্যার এক রাত আগে। চাঁদহীন আকাশ, বাতাস থেমে থাকা, আর কুয়াশা যেন গাছের মাথা থেকে ঝুলে পড়ছে। উৎসব আর রিনি হাতে লণ্ঠন, ক্যামেরা ও রেকর্ডার নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে। মন্দিরের ভিতরটা আগের চেয়ে আরও বেশি শীতল—হাড়ের মতো ঠাণ্ডা, শ্বাস টানলে মনে হয় ভেতরে বরফ জমে যাবে। রিনি ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ থেমে যায়—তার ক্যামেরা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। বারবার চেষ্টা করেও খোলা যায় না। তখনই উৎসব দেখে, রিনির চোখ বড় হয়ে গেছে—সে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে মন্দিরের এক কোণে, যেখানে কোনো মূর্তি ছিল না, তবু ধোঁয়ার মতো কিছু একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন গা ছমছমে ধূসর এক ছায়া। সেই ছায়া ধীরে ধীরে মানুষের আকার নিচ্ছে, মাথায় মুকুটের মতো কী যেন, শরীরে জ্বলা গন্ধের গন্ধ, আর চোখের জায়গায় ফাঁকা কুঠুরি। রিনি ফিসফিস করে বলে—“ওটা তো… দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শরীর নেই।” উৎসব মালা চেপে ধরে—তার চোখেও সেই ছায়া পরিষ্কার, এবং হঠাৎ, ছায়াটি কথা বলে ওঠে—কিন্তু তার কণ্ঠস্বর একযোগে বহুজনের কণ্ঠস্বরের মতো, যেন রাজা, পুরোহিত, আর ভুক্তির আর্তনাদের এক সংগীত। “যজ্ঞ অসম্পূর্ণ… বলি অসম্পূর্ণ… আসন খালি… পূর্ণ করো…” ঠিক সেই মুহূর্তে বেদির উপর আগুন জ্বলে ওঠে—কোনও আলো না থাকা সত্ত্বেও। রিনি কাঁপতে থাকে, সে ক্যামেরা ফেলে দেয়, আর হঠাৎই মন্দিরের দেয়ালে এক লেখা উদ্ভাসিত হয়—”যে ছবির আলো নেবে, সেই অশরীরীকে ধারণ করবে।” রিনির শরীর জড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক শীতলতা—সে জ্ঞান হারায়, আর উৎসব তাকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।

ঘরে ফেরার পর রিনি ঘণ্টাখানেক জ্ঞানহীন থাকে—তার চোখ অর্ধেক খোলা, আর ঠোঁটে বারবার একই শব্দ—“পূর্ণতা… পূর্ণতা…” উৎসব বোঝে, রিনির উপর এখন কোনও আত্মা ভর করেছে, এবং সেটা সেই অশরীরী ছায়া—যা চক্র সম্পূর্ণ করতে চায়। সে দাদাঠাকুরের কাছে ছোটে—বৃদ্ধ তখন ছায়ার মধ্যে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছেন। সব কথা শুনে ঠাকুর বলেন—“সে ধারণ করেছে। এখন যে পূজিত হবে, তার শরীরেই চিহ্ন পড়ে থাকবে। কই, মালা এনেছিস?” উৎসব মালা এনে রিনির গলায় পরিয়ে দেয়—আর এক মুহূর্তের মধ্যে রিনির শরীর থেকে যেন ধোঁয়ার মতো কিছু বেরিয়ে আসে, কেঁপে উঠে ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়ায়, আর তারপর জানালার ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়। রিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পায়, কিন্তু তার চোখে এখন এক গভীর শূন্যতা—সে বলে—“আমি দেখেছি, উৎসব। ওর চোখে। তুমি ভাবছ তুমি গবেষক, কিন্তু তুমি তো সেই চক্রের জন্মসূত্রধর। ও বলেছে, তোমার রক্তেই চক্র বন্ধ হবে।” উৎসব স্থির হয়ে যায়। তাহলে সব কথা মিলিয়ে একটাই সত্য দাঁড়ায়—এই চক্র তাকে চায়, তার রক্ত চায়, তার অস্তিত্বই এই বলির অগ্রদূত। সে জানে, অমাবস্যা আর এক রাত পর, এবং সেই রাতেই হয় শেষ হবে সব, না হয় সে নিজেই শেষ হবে।

সাত

রিনির জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে উৎসব বুঝতে পারে, তারা আর কোনও সাধারণ অনুসন্ধানের পথে নেই—এটা এক চক্র, এক আধ্যাত্মিক শিকল, যা কেবল পুরনো যজ্ঞ বা অভিশপ্ত মন্দিরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ছড়িয়ে আছে তাদের রক্তে, শিকড়ে, জন্মসূত্রে। সকাল হতে না হতেই উৎসব ঠিক করে—এবার তাকে ফিরতে হবে তার নিজের অতীতে। সে বেরিয়ে পড়ে গড়ভানিপুরের প্রাচীন রেকর্ড রুমের দিকে, যেটা মূলত জমির দলিল ও জন্ম-মৃত্যুর পুরনো হিসাব রাখা হয় এমন একটা জরাজীর্ণ ঘর। বহু দরজার মধ্যে সবচেয়ে শেষেরটাতে ঠেলে সে ঢোকে—এক প্রৌঢ় কর্মচারী ঠোঁটে পান রেখে তাকায়, উৎসবের নাম শুনেই বলে, “মিত্র? হ্যাঁ… এই নাম এখানেও আছে, তবে একটু গোলমেলে।” কৌতূহলে উৎসব তার দিকে এগিয়ে যায়। কর্মচারী একটি পুরনো নথি বের করে আনে—সেখানে লেখা এক ছেলেশিশুর জন্মনিবন্ধন, যার নামের জায়গায় কেবল লেখা—“পঞ্চম”। পিতার নাম—ঈশান চৌধুরী। উৎসব থমকে যায়—তার বাবা ঈশান মিত্র, কিন্তু এই নথিতে লেখা চৌধুরী—রাজবাড়ির বংশপরিচয়! সে বুঝতে পারে, জন্মের পর তাকে পালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্য নামে, অন্য পরিবারে, এবং তার প্রকৃত পরিচয় চেপে গিয়েছিল কোনও এক গভীর ভয় বা দায় থেকে। সে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বলে—“এই ছেলেটা কে ছিল?” কর্মচারী বলে, “এই নামটা আসলে রাজবাড়ির বলিপাঁজির সঙ্গে জড়িত। শোনা যায়, ২৫ বছর আগে রাজবাড়ির আদি তান্ত্রিক বলিতে এক বালককে বলি দেওয়ার আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু সেই রাতে সে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। রাজপরিবারের এক গর্ভবতী দাসী, যার গর্ভে ছিল রাজবংশের অবৈধ উত্তরসূরি, নাকি সেই রাতেই পালিয়ে যায় এবং শিশুটিকে লুকিয়ে ফেলে…” উৎসবের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার জন্ম, তার নাম, তার জীবন—সব যেন সেই বলির রাতেই নির্ধারিত হয়েছিল। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে—“আমি সেই পঞ্চম বলি?”

এই কথার ভার সে সামলাতে পারে না। সে ছুটে বেরিয়ে যায়, গ্রামের একমাত্র মন্দিরের পেছনের মাঠে বসে পড়ে—আকাশ কালো হয়ে আসছে, বাতাস ভারি, যেন প্রকৃতিও প্রস্তুত হচ্ছে সেই অমাবস্যার জন্য। রিনি ধীরে ধীরে পাশে এসে বসে—তার মুখেও এখন আর যুক্তির ছাপ নেই, কেবল এক নিঃশব্দ উপলব্ধি। উৎসব ধীরে ধীরে তাকে সবটা খুলে বলে—তার জন্ম, তার পিতৃপরিচয়, তার সেই রাতের পূর্বসূত্র। রিনি বলে, “তুই যদি সেই উত্তরসূরি হিসেবেই বলির জন্য নির্বাচিত হোস, তবে তোকে যে বলি দেবে, সে কে?” প্রশ্নটা বিদ্ধ করে উৎসবকে—কারণ সেই পাঁজিতে লেখা ছিল, যদি রাজপরিবারের উত্তরসূরি ফেরে, তবে বলি দিতে হবে রাজপুত্রকেই, নয়ত চক্র চিরতরে ভাঙবে না। এর মানে দাঁড়ায়, উৎসব নিজেই চক্রের পূর্ণতার জন্য উৎসর্গ। কিন্তু কেউ না কেউ সেই যজ্ঞপূজা সম্পন্ন করবে। তখনই উৎসবের মনে পড়ে, দাদাঠাকুর বারবার বলতেন—“তুই একা নোস… তোকে কেউ ডেকেছে, তৈরি করেছে।” সে বুঝে যায়, কেউ না কেউ এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে থেকে সব পরিচালনা করছে। উৎসব রিনির হাত ধরে বলে, “আমার আর পেছনে ফেরা নেই, রিনি। আমি কাল সেই চণ্ডীমণ্ডপে যাব, কিন্তু বলি দিতে নয়—সত্য জানার জন্য, চক্র ভাঙার জন্য।”

সন্ধ্যার কিছু আগে উৎসব নিজের ঘরে ফিরে আসে, সেখানে একটি চিঠি অপেক্ষা করছিল—সাদা খামে, কোনও প্রেরক নেই। খোলার পর উৎসবের হাত কেঁপে ওঠে—চিঠিতে লেখা রয়েছে এক অপরিচিত হাতের লেখা—“তুই ফিরে এসেছিস। চক্র এখন সম্পূর্ণ হবে। রাজা আবার তার সিংহাসন চাইছে। পূজা শুরু হবে কাল রাত ঠিক দ্বাদশীর শেষে। সেই পর্যন্ত সময় আছে।” তার সঙ্গে রাখা ছিল এক পুরোনো পিতলের মুদ্রা—যা শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। উৎসব বুঝে যায়—সে একা নয়, কেউ একজন তার আগমনের খবর জানত, এবং অপেক্ষা করছিল এই মুহূর্তের জন্য। কিন্তু কে? অগ্নিদেব শাস্ত্রীর আত্মা? না কি সেই বংশধর যার অস্তিত্ব কেউ জানত না? সে জানে না—শুধু এটুকু বোঝে, কাল রাত সেই রাত, যখন সব নির্ধারিত হবে। যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না হয় ভাঙবে, বলি হবে না হয় অভিশাপ ছিন্ন হবে। সে রিনিকে বলে, “তুই আমার সঙ্গে আসিস না। যা হবার, সেটা শুধু আমার জন্য।” রিনি কিছু বলে না—শুধু কাঁপা গলায় বলে, “আমি তোকে রেখে যাব না, উৎসব। শেষটা একসঙ্গে দেখতে হবে।” অমাবস্যার রাতের আগে, এই মুহূর্তটা যেন সময়ের এক নিঃশেষ স্তব্ধতা—পেছনে শতাব্দীর ছায়া, সামনে অনিশ্চয়তার রক্তজাল।

আট

অমাবস্যার রাত নেমে আসে এক ভারী নীরবতা নিয়ে। গড়ভানিপুরের আকাশে আজ কোনও তারা নেই, বাতাস নেই, কেবল একটা অচেনা নিঃশ্বাসের শব্দ, যেন অরণ্যের ভেতরে একটা অলৌকিক কিছু জেগে উঠেছে। চণ্ডীমণ্ডপের চারপাশ ঘিরে এক ঘন ছায়া জমছে, যার ভিতর থেকে যেন কে যেন চুপচাপ তাকিয়ে আছে। উৎসব আর রিনি হাতে রুদ্রাক্ষ মালা, ক্যামেরা ও রেকর্ডার নিয়ে রাত দশটার পর পৌঁছে যায় সেই চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। আজ আর কুকুরও ডাকে না, ঝিঁঝিঁও নেই—শুধু অন্ধকারের স্তব্ধতা। কিন্তু উৎসব আজ ভয় পায় না—তার মনে শুধুই সেই উত্তর: সে কে? কেন সে জন্মেছিল? আর কেনই বা এই অভিশপ্ত স্থানের সঙ্গে তার রক্ত এত গভীরভাবে জড়িয়ে? মন্দিরের ভেতরে ঢোকার সময়েই তার চোখ পড়ে—বেদির চারপাশে এখন নতুনভাবে আঁকা হয়েছে চক্রচিহ্ন, যেন কেউ আজ সারাদিন ধরে রক্তে এঁকেছে। উৎসবের মাথা ঘুরে যায়—এই যে চিহ্ন, প্রতীক, যজ্ঞমণ্ডপের আয়োজন—সবকিছু আগে থেকে প্রস্তুত, যেন কেবল তার জন্য। তখনই শোনা যায় মন্ত্রোচ্চারণ—ধীরে ধীরে, গম্ভীর স্বরে, যেন শতবর্ষ পুরোনো কণ্ঠগুলো ধ্বনিত হচ্ছে কোনও এক অলৌকিক গহ্বর থেকে। রিনি উৎসবের হাত ধরে ফিসফিস করে বলে, “ওরা প্রস্তুত, উৎসব… তোকে বলি দিতে।” উৎসব সামনে এগিয়ে যায়—বেদির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে এক ছায়ামূর্তি, যার শরীর ধোঁয়ায় গঠিত, মাথায় মুকুট, আর চোখে গর্ত—সেই পুরনো রাজা। তার ঠোঁটে শুধু একটা বাক্য—“চক্র এবার পূর্ণ হবে।” তখনই উৎসব বুঝতে পারে, সে না এলে এই চক্র কখনো সম্পূর্ণ হতো না। অর্থাৎ, তার উপস্থিতি ছিল পূর্বনির্ধারিত। সে এখন বোঝে, তার আসা, তার জন্ম—সব ছিল এই বলি রীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ঠিক তখনই মন্দিরের মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসে আরও ছায়ামূর্তি—প্রাচীন পুরোহিত, সিংহাসনের পাশে বসা নারীরা, পুরোনো বলিপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দাস, আর সবচেয়ে সামনে অগ্নিদেব শাস্ত্রী—যার চোখে খালি চাউনি, ঠোঁটে অসমাপ্ত মন্ত্র। সে এগিয়ে আসে উৎসবের দিকে, কপালে অগ্নিস্পর্শ দিয়ে বলে, “তুই শেষ বলি। তুই পঞ্চম রক্ত। যজ্ঞ শেষ কর।” উৎসব মালা চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি বলি হতে আসিনি। আমি ইতিহাস জানতে এসেছি।” তখনই চারদিকের আলো নিভে যায়, আগুন জ্বলে ওঠে বেদির চারপাশে, আর ছায়ামূর্তিগুলি একত্র হয়ে বৃত্ত তৈরি করে। তাদের গলা থেকে উঠে আসে একযোগে উচ্চারিত মন্ত্র—যা উৎসবের শিরা-উপশিরা কাঁপিয়ে তোলে। রিনি কিছু একটা বলতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে—তার চোখে সেই আগুনের প্রতিফলন, আর উৎসবের গায়ে রক্তের দাগ ফুটে ওঠে যেন ভিতর থেকেই। ঠিক তখনই, উৎসবের মাথায় ঝড়ের মত স্পষ্ট হয় সেই বলিপাঁজির চূড়ান্ত বাক্য—”বলির রক্ত নয়, যজ্ঞে আত্মস্মরণই চক্র ভঙ্গ করে।” অর্থাৎ, বলি না হয়ে যদি কেউ চক্রের অন্তর্নিহিত সত্য চিনতে পারে—নিজের উৎসকে নিজের ইচ্ছায় গ্রহণ করতে পারে—তবে অভিশাপ ভাঙে। উৎসব দু’হাত বেদির উপরে রাখে, চোখ বন্ধ করে নিজের রক্তস্রোতকে অনুভব করে—এবং উচ্চারণ করে সেই অসমাপ্ত মন্ত্র, যার শেষ অংশ সে পাণ্ডুলিপিতে খুঁজে পেয়েছিল—“যজ্ঞং শুদ্ধি: আত্মবোধেন। রক্তং নয়, সত্যং সম্পূর্ণ করো।”

এক বিকট শব্দে সমস্ত ছায়া ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আগুন নিভে যায়, বাতাস গর্জে ওঠে, আর বেদির চারপাশে ধ্বসে পড়ে প্রতীকগুলো। এক মুহূর্তে ঝাপসা আলোতে উৎসব পড়ে যায় মাটিতে। জ্ঞান ফেরে ভোরে, যখন সে দেখে রিনি তার পাশেই বসে, চোখে জল। চারপাশে ছায়া নেই, আগুন নেই, কেবল নরম সকাল, পাখির ডাক। চণ্ডীমণ্ডপের চক্রচিহ্নগুলি আজ ফ্যাকাসে, ধোঁয়াহীন, এবং রক্তহীন। উৎসব বুঝে যায়—চক্র ভেঙেছে। বলিপাঁজি আজ পূর্ণ না হয়ে শূন্য হয়েছে। দাদাঠাকুর এসে মাথায় হাত রাখেন—“তুই পারলি, উৎসব। শতবর্ষের রক্তপথ শেষ করলি। তুই নিজের রক্ত দিসনি, নিজের চেতনা দিয়েছিস।” রিনি উৎসবের হাত ধরে বলে, “তুই বলি নয়—তুই হলি মুক্তি।” চণ্ডীমণ্ডপের ছায়া সেদিন প্রথমবার উজ্জ্বল আলোর নিচে পড়ে, আর উৎসব জানে—এই ইতিহাস, এই রহস্য সে আর কাউকে শুধু থিসিস হিসেবে দেবে না। এ তার জীবনের ভিতরকার জেগে ওঠা, তার জন্মের গভীরতম রহস্য উন্মোচনের ইতিহাস।

নয়

চণ্ডীমণ্ডপে সেই ভোরের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে উৎসব মিত্র ধীরে ধীরে চারপাশে তাকায়। এই জায়গা, যেখানে কিছুদিন আগেও অশরীরী ছায়া ঘুরে বেড়াত, এখন যেন শান্তির শ্বাস নিচ্ছে। পাথরের বেদি, রক্তের প্রতীক, পুরনো ত্রিশূল—সবকিছু আজ নিঃশব্দ। রিনি পাশে বসে আছে, দুজনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই মণ্ডপের দিকে, যেখান থেকে ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা ধরা দিয়েছিল—কখনও আতঙ্কে, কখনও আশ্চর্যে। চক্র ভেঙেছে, অভিশাপ শেষ হয়েছে, কিন্তু উৎসবের ভিতরে একটা প্রশ্ন এখনও জাগে—এই অভিশাপ কি সত্যিই চিরতরে শেষ? নাকি কেবল এক চক্র থেকে মুক্ত হয়ে সে আরেক চক্রে ঢুকে পড়েছে—যেখানে সে নিজেই ভবিষ্যতের ইতিহাস? সে জানে, আজ তাকে ফিরতে হবে—শহরে, গবেষণার জগতে, মানুষের ভিড়ে। কিন্তু তার চেতনার মধ্যে রয়ে যাবে সেই অমাবস্যার রাত, সেই ধোঁয়া-ঘেরা চক্র, সেই বেদির সামনে দাঁড়ানো পুরোহিত অগ্নিদেবের অভিশপ্ত চোখ। সে মন্দিরের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে মালাটা খুলে রেখে দেয় বেদির পায়ে—যা তার সমস্ত পথচলার সঙ্গী ছিল। সে বলে ওঠে—“তোমাদের বলি আমি হতে পারিনি। কিন্তু আমি তোমাদের কথা ভুলব না।” সেই কথাগুলো যেন বাতাসে মিশে যায়, এবং উৎসব প্রথমবার অনুভব করে—চণ্ডীমণ্ডপ আজ আর তাকে টানছে না, বরং বিদায় জানাচ্ছে।

দাদাঠাকুর সেই সকালে উৎসবকে ডাকেন—তার চোখে আজ শান্তি, যেন বহু বছরের বোঝা নামল। তিনি বলেন, “আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম, তোকে হারাব। কিন্তু তুই তো আমাদের সবার ঋণ শোধ করে দিলি। এই রাজবাড়ির, এই গ্রামের, এমনকি অগ্নিদেব শাস্ত্রীরও।” উৎসব কিছু বলে না—সে শুধু বলে, “তাঁরা কি আজ মুক্ত?” ঠাকুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “মুক্তি চাইলেই হয় না, আত্মা তখনই মুক্ত হয়, যখন তার গল্প বলা শেষ হয়। তুই সেই গল্প বলেছিস।” রিনি সেই সময়ে ক্যামেরার ভিতরের পুরোনো ছবি একে একে দেখছিল—সব ঝাপসা, অদ্ভুত আলোছায়া, কিন্তু একটি ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে—চণ্ডীমণ্ডপের বেদির সামনে উৎসব দাঁড়িয়ে, আর পেছনে আলোয় গঠিত এক মুখ—রাজা অনন্ত নারায়ণ চৌধুরীর, যার চোখে আজ আর অভিশাপ নেই—শুধু শান্তি। রিনি সেই ছবি তুলে রাখে, উৎসবকে বলে, “এইটাই তো শেষ বলি—স্মৃতির মধ্যে থাকা সত্য। যতদিন এই ছবি থাকবে, এই কাহিনি ভুলে যাওয়া যাবে না।” তারা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু যাবার আগে উৎসব একবার শেষবারের মত চণ্ডীমণ্ডপে ফিরে যায়—আজ আর সেখানে কোনও ছায়া নেই, শুধু ফিঁকে আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রাচীন ত্রিশূল, যা একদিন রক্ত চাইত, আজ কেবল নীরব সাক্ষী।

দুদিন পর উৎসব শহরে ফিরে আসে। তার গবেষণার থিসিস এখন “চণ্ডীমণ্ডপ ও উপমহাদেশের রক্ততান্ত্রিক বলি-সংস্কৃতি: একটি আত্মানুসন্ধানমূলক গবেষণা।” কিন্তু শুধু পাণ্ডুলিপি নয়—তার থিসিসে যুক্ত হয়েছে সেই চিত্র, সেই কাহিনি, সেই গভীর অভিজ্ঞতা যা কোনও বইতে লেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই বলে—“এমন থিসিস আগে কেউ লেখেনি।” কিন্তু উৎসব জানে, এটা গবেষণা নয়—এটা আত্মপরিচয়ের চাবিকাঠি। সে আজ বুঝতে পারে, তার জন্ম কোনও দুর্ঘটনা নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত ছিল, ঠিক যেমন মন্দিরে প্রতিটি প্রতীক পূর্বনির্ধারিত ভাবে আঁকা হয়। সে কখনো রিনিকে বলে, “তুই না থাকলে, আমি হয়ত কখনো ওই চক্র থেকে ফিরতে পারতাম না।” রিনি হাসে, বলে, “তুই ফিরেছিস ঠিকই, কিন্তু তুই আগের উৎসব নোস। তুই আজ শুধু একজন ইতিহাসবিদ নয়, তুই নিজেই এক ইতিহাস।” উৎসব জানে, সে চণ্ডীমণ্ডপে আর ফিরবে না—কিন্তু তার রক্তে, তার গল্পে, আর তার মনে সেই ছায়া চিরকাল রয়ে যাবে—নয় আতঙ্কের ছায়া, বরং এক প্রাচীন অভিজ্ঞান, যা তাকে সত্যের মুখোমুখি করেছিল।

সমাপ্ত

1000032550.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *