Bangla - রহস্য গল্প

চন্দননগরের ছায়া-খুন

Spread the love

মনোরঞ্জন পাল


চন্দননগরের সেই বিকেলটা ছিল একেবারে অন্য রকম। গরম আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ভরা বাতাবরণে অরিজিৎ সেনগুপ্তের শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল প্রাসাদের ভেতরের অজানা ইতিহাসে। ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় চড়ে আসা পথটুকুতে সে শহরের ফরাসি স্থাপত্যের ছাপ লক্ষ্য করছিল—ভাঙা কলাম, জং ধরা ল্যাম্পপোস্ট, আর গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অতিকায় প্রাসাদ, যা যেন কালের ভারে নুয়ে পড়েছে। বাড়িটার বিশাল লোহার ফটক খুলে যাওয়ার শব্দ শুনে তার হৃদয়ে কেমন যেন অজানা শিহরণ জাগল। সে ভাবল, এমন একটা জায়গা, যেখানে ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সেখানে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য, কোনো বেদনার কাহিনি। গেটের ভেতরে পা রাখতেই তার চোখে পড়ল পাথরের রাস্তা ধরে শেওলা পড়া ফোয়ারা, যার পানি অনেক বছর আগে শুকিয়ে গেছে। বাগান একসময় সুন্দর ছিল হয়তো, কিন্তু এখন তা জঙ্গল হয়ে উঠেছে। একপাশে লাল ইটের দেওয়ালে ছোট্ট দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ নরেন পাল। তার কাঁধে সাদা ধুতি জড়ানো, মুখে বলিরেখা, চোখে ঘোলা চশমা। সে কোনো কথা না বলে অরিজিৎকে হাত নেড়ে ভিতরে ডেকে নেয়। প্রাসাদের সদর দরজা, বিশাল কাঠের, তাতে খোদাই করা আছে অদ্ভুত সব নকশা—সিংহ, হাতি আর অজানা কিছু চিহ্ন, যা ফরাসি প্রভাবে তৈরি সেই সময়ের জমিদার বাড়ির অহঙ্কার ছিল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল অরিজিৎ-এর শরীরে। গম্ভীর অন্ধকার, দেওয়ালে ঝোলানো পুরনো তেলের চিত্র, আর মেঝেতে ফাটল ধরা মার্বেল পাথর—সব মিলিয়ে সময় যেন এখানে থেমে গেছে। ছাদ থেকে ঝুলছে ধুলো জমা এক বিশাল ঝাড়বাতি, যা হয়তো একসময় আলো ছড়াত, কিন্তু এখন মৃত।

অরিজিৎ এর চোখ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হলো অন্ধকারে। নরেন তাকে নিয়ে গেল বিশাল এক অন্দরমহলে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির শেষ বংশধর দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ রায়। বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি যেন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে বসে আছে, তার চুল রূপালী, গাল কুঁজো, আর চোখের তলায় কালি। সে অরিজিৎ-এর দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল, যেখানে ক্লান্তি আর আশার মিশ্রণ। শ্রেয়সী রায়, তার নাতনি, পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা সুতির শাড়ি পরে, চোখে চশমা, কপালে ছোট্ট টিপ। সে অরিজিৎকে বসতে বলল। ঘরের চারপাশে সাজানো ছিল দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র—একপাশে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি চেয়ার, অন্যপাশে মাটির পুতুল, যার গায়ে মাটি ধরা। দেওয়ালে ঝুলছিল সেই বিখ্যাত পেইন্টিং—এক নারী মুখোশ পরা, চোখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি, যার পেছনে লাল আর কালোর ছায়া। এই চিত্রকর্মের ইতিহাসই টেনেছিল অরিজিৎকে চন্দননগরে। দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ বলল, “এই বাড়ি আর এই ছবিটাই আমাদের শেষ অহঙ্কার। শুনেছি আপনি এর ইতিহাস জানতে চান। জানবেন, কিন্তু তার আগে আপনাকে থাকতে হবে এখানে কয়েকদিন। এই ছবি যে শুধু শিল্প নয়, সে আমাদের অতীতের অভিশাপও বটে।” অরিজিৎ চমকে গেল। অভিশাপ? ইতিহাসের ছাত্র হয়ে সে অভিশাপকে তেমন মানত না, কিন্তু বৃদ্ধের গলায় যে কম্পন ছিল, তাতে ভয় আর বেদনার ছাপ স্পষ্ট। বাইরে থেকে গঙ্গার হালকা বাতাস এসে পর্দা নাড়া দিল। সেই হাওয়ায় যেন ভেসে এলো চেনা-অচেনা শোকগাঁথা, ইতিহাসের চাপা কান্না।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদটা যেন আরও বেশি ভয়ানক হয়ে উঠল। পাখিদের ডাক থেমে গেল, রাতের নিশুতি নেমে এলো। শ্রেয়সী অরিজিৎকে তার থাকার ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরের ভেতর পুরনো কাঠের খাট, জানালায় লোহার গ্রিল, আর ছাদের কোণে জাল বোনা মাকড়সা। বাইরে রাতের অন্ধকারে গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ ভেসে আসছিল, আর দূরের মন্দির থেকে শোনা যাচ্ছিল ঘণ্টার মৃদু আওয়াজ। ঘুম আসছিল না অরিজিৎ-এর। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ল অদ্ভুত এক ছায়া, যা ভেসে বেড়াচ্ছিল করিডরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। অন্ধকারে সেই ছায়া মানুষের মতো, কিন্তু যেন মাটিতে পা ছুঁয়ে হাঁটছিল না। অরিজিৎ চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখতে চাইল, কিন্তু হঠাৎ সেই ছায়া মিলিয়ে গেল। রাতের বাতাস হু হু করে বইতে লাগল, আর অরিজিৎ-এর মনে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে ভর করল। সে বুঝল, এই প্রাসাদে যা ঘটতে চলেছে, তা নিছক ইতিহাসের কাহিনি নয়, তা এক ভয়ঙ্কর অজানা অধ্যায়ের শুরু।

পরদিন ভোরবেলা প্রাসাদে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। রাতের আঁধার সরে গিয়ে গঙ্গার ধারে নতুন দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসাদের পুরনো দেওয়ালগুলো যেন আরও জীর্ণ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। অরিজিৎ ঘুম থেকে উঠে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশের বাগান, ফোয়ারার মুখে শেওলা জমেছে আরও একটু বেশি, আর দূরের গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে এক খানা শুঁটকি নৌকা। কিন্তু এই প্রাকৃতিক দৃশ্যের শান্তির মাঝেই তার মনে চাপা অস্বস্তি কাজ করছিল—সেই রাতের ছায়ামূর্তি যে শুধু দৃষ্টি বিভ্রম নয়, তা যেন সে বুঝতে পারছিল অন্তর থেকে। হঠাৎই নরেন পালের ব্যস্ত পায়ের শব্দ শোনা গেল করিডর জুড়ে। অরিজিৎ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল নরেন প্রায় ছুটে যাচ্ছে অন্দরমহলের দিকে, তার মুখ বিবর্ণ, চোখে আতঙ্ক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নরেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো ফিসফিস আওয়াজ—“ছবিটা নেই বাবু… ছবিটা নেই!” প্রথমে অরিজিৎ বুঝে উঠতে পারল না কোন ছবি, কী নেই, তারপর মনের মধ্যে বিদ্যুতের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল সেই পেইন্টিং-এর কথা—মুখোশ পরা নারীর সেই শতবর্ষ পুরনো চিত্রকর্ম, যা নিয়ে সে এখানে এসেছিল ইতিহাসের গন্ধ শুঁকতে। ছুটে গিয়ে সে ঢুকে পড়ল সেই ঘরে যেখানে চিত্রকর্মটি ঝুলছিল। ঘরটা যেন আগের রাতের থেকেও অন্ধকার আর ভারী হয়ে উঠেছিল। দেওয়ালে ফাঁকা পেরেকগুলো নীরবে সাক্ষী দিচ্ছিল যে ছবিটা ছিল এখানে। সেই বিখ্যাত পেইন্টিং, যা প্রায় পৌনে দুই শতাব্দী ধরে এই প্রাসাদের গর্ব ছিল, সেই ছবি যেন হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেছে। ঘরের ভেতর নরেন দাঁড়িয়ে কাঁপছে, শ্রেয়সী মাটিতে বসে মাথায় হাত দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাঁকা দেওয়ালের দিকে, আর দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ শয্যায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসে অস্পষ্ট কষ্টের আওয়াজ।

ঘরজুড়ে থমথমে পরিবেশ। বাতাসও যেন থেমে গেছে, কেবল বাইরে শাখা-প্রশাখার কাঁপা শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরিজিৎ ঘরের চারপাশে নজর বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, কীভাবে সম্ভব এটা? ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ, কোথাও কোনো চোরের চিহ্ন নেই, মেঝেতে ধুলোর আস্তরণ অক্ষত, অথচ সেই ছবি নেই! ঘরটা যেন এক নিশ্বাসে শূন্য হয়ে গেছে। অরিজিৎ কানে ভেসে এলো নরেনের ফিসফিস আওয়াজ—“বাবু, রাতের আঁধারে কেউ এসেছে… আমি শুনেছি কারও পায়ের শব্দ… কিন্তু বাইরে গেলে কেউ ছিল না… কেবল ছায়া দেখেছি একবার…” অরিজিৎ অনুভব করল, এখানকার মানুষজন শুধু চিত্রকর্মের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নয়, আরও কিছু গভীর আতঙ্কের শিকার। সে জানালার গ্রিল পরীক্ষা করল, পেরেকের দাগ দেখল, এমনকি ঘরের মেঝেতে ছিটকে পড়া রঙের ছোট্ট টুকরোও সংগ্রহ করল, যাতে বোঝা যায় কোনভাবে ছবি নামানো হয়েছিল কিনা। হঠাৎ বাইরে থেকে শোনা গেল সাইকেলের ঘণ্টার শব্দ। স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর বিপ্লব দত্ত এসে পৌঁছেছে খবর পেয়ে। তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল। খাকি পোশাকে, গোঁফে তর্জনী চালিয়ে ঘরে ঢুকেই সে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ল। দেওয়ালের শূন্যতা দেখে তার ভুরু কুঁচকে গেল। সে ঘর পর্যবেক্ষণ করে বলল, “এটা ভেতরের কাজ ছাড়া সম্ভব নয়। বাইরে থেকে কেউ ঢুকলে আমরা চিহ্ন পেতাম। দরজা-জানালা, গ্রিল—সব ঠিক আছে। ভেতরের কেউ এ কাজ করেছে।” কথাগুলো শোনার পর ঘরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, কারণ এই বাড়িতে যে কয়েকজন মানুষ রয়েছে, সন্দেহের চোখ ঘুরে গেল সবার দিকে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, প্রাসাদে একের পর এক কক্ষ তল্লাশি করল পুলিশ। কনস্টেবলরা মেঝের ফাঁকফোকর, দেওয়ালের ফাঁপা অংশ, এমনকি বাগানও খুঁড়ে দেখল কোথাও পেইন্টিং লুকিয়ে রাখা হয়েছে কিনা। কিন্তু চিত্রকর্মের কোনো চিহ্ন মেলেনি। অরিজিৎ বুঝতে পারল, এই রহস্যের সমাধান নিছক চুরি নয়। এটি হয়তো সেই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত, যা সে জানার জন্য এতদূর এসেছে। সূর্য নেমে এলো পশ্চিম আকাশে, প্রাসাদের ছায়া দীর্ঘ হলো গঙ্গার বুকে। তখনই অরিজিৎ লক্ষ্য করল বাগানের এক কোণে কুয়োর মুখে কিছু অদ্ভুত দাগ—মাটি খোঁড়াখুঁড়ির দাগ, ভাঙা ঘাস, আর যেন কারও টানা পায়ের চিহ্ন। হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এলো কুয়োর ভেতর থেকে ভেজা মাটির গন্ধ। অরিজিৎ বুঝল, রাত গভীর হলেই তাকে আবার বেরোতে হবে, ছায়ার তাড়া করতে হবে অজানা সেই আঁধারে। এই প্রাসাদের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস, এক অভিশাপ, আর এক মৃত্যু-ছায়া, যা হয়তো শুরু হলো এই ছবি হারানোর রাত থেকেই।

রাত গভীর হতে থাকল, আর চন্দননগরের সেই পুরনো প্রাসাদ যেন তার প্রতিটি ইট আর খোলে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছিল এক অজানা ঘটনার। গঙ্গার তীরে দূরের কোনো মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছিল, আর প্রাসাদের বাগান যেন নিশুতি আঁধারে ডুবে অচেনা ফিসফিস আওয়াজে ভরে উঠছিল। অরিজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধতা উপভোগ করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মনের ভেতরে ক্রমশ বাড়তে থাকা অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা তাকে কাবু করে তুলছিল। চিত্রকর্মের অদৃশ্য হওয়া এখন আর নিছক চুরির ঘটনা বলে মনে হচ্ছিল না তার কাছে। যেন ইতিহাসের গর্ভ থেকে উঠে আসছে এক গভীর, অশরীরী হাত, যা আঁকড়ে ধরতে চাইছে প্রাসাদের প্রতিটি প্রাণ। বারান্দা থেকে সে স্পষ্ট দেখতে পেল বাগানের এক কোণায় পুরনো কুয়োর মুখ, যার চারপাশে ছায়া আরও ঘন হয়ে আছে। সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে হঠাৎ অনুভব করল, শূন্য বাতাসে কেমন অদ্ভুত ঠান্ডা স্রোত বইল। যেন রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো এক অজানা আতঙ্ক। পেছন থেকে আসা হালকা পায়ের শব্দে চমকে ফিরে তাকিয়ে অরিজিৎ বুঝল, নরেন হয়তো কিছু বলতে এসেছে, কিন্তু সে দেখল, করিডর একেবারে ফাঁকা। কেবল বাতাসে হাওয়া খাওয়া পর্দার নড়াচড়া, আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক।

রাত প্রায় শেষের দিকে, অন্ধকার ধীরে ধীরে পাতলা হতে শুরু করেছে পূর্ব আকাশে। তখনই হঠাৎ প্রাসাদজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এক আতঙ্কঘন আর্তচিৎকার। সেই চিৎকার কেটে গেল কানের পর্দা, অরিজিৎ ছুটে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। শ্রেয়সীও দৌড়ে এলো অন্য প্রান্ত থেকে, তার মুখ বিবর্ণ, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ভয়ে। নরেনের সেই করুণ আর্তনাদ ভেসে আসছে বাগানের দিক থেকে। সবাই একসঙ্গে ছুটে গিয়ে দেখল—প্রাসাদের পুরনো কুয়োর ধারে পড়ে আছে নরেনের নিথর দেহ। তার মুখের দিকে তাকাতেই স্পষ্ট হলো মৃত্যু কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত, নখগুলো মাটিতে আঁচড়ানো, যেন শেষ মুহূর্তে সে প্রাণপণে বাঁচতে চেয়েছিল। মুখে যেন থিতিয়ে আছে এক অজানা ছায়াকে শেষবার দেখার আতঙ্ক। বাগানের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, কুয়োর ভেতর থেকে ভেসে এলো ভেজা মাটির গন্ধ, আর কুয়োর দেয়ালে পড়ে থাকা নরেনের ছায়া যেন সেই মুহূর্তে আরও কালো, আরও দীর্ঘ হয়ে উঠল। দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদকে যখন খবর দেওয়া হলো, তখন সে শয্যায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে শুধুই ফিসফিস করে বলছিল—“ছায়া… ছায়া আবার ফিরে এসেছে…” প্রাসাদজুড়ে নেমে এলো শোক আর আতঙ্কের কালো ছায়া। শ্রেয়সী অরিজিৎ-এর দিকে তাকাল, তার চোখে জল আর আতঙ্কের ছাপ—সে বুঝতে পারছিল এই মৃত্যুর পেছনে শুধু লোভ বা হিংসা নয়, লুকিয়ে আছে ইতিহাসের সেই অমীমাংসিত অশুভ অধ্যায়।

পুলিশ খবর পেয়ে সকালবেলায় এসে পৌঁছাল। বিপ্লব দত্ত প্রাসাদজুড়ে তল্লাশি শুরু করল। কনস্টেবলরা কুয়োর চারপাশে পায়ের ছাপ খুঁজল, মাটি পরীক্ষা করল, কিন্তু স্পষ্ট কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। নরেনের মৃত্যু কীভাবে হলো, তা এক রহস্য হয়ে রইল। প্রাসাদের লোকেরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করল—রাতের আঁধারে তারা অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দেখেছে, কেউ দেখেছে কুয়োর পাশে, কেউ দেখেছে করিডরের কোণায়। কেউ বলল, সেই ছায়া যেন ভেসে বেড়ায়, মাটিতে পা পড়ে না, কেবল বাতাসে মিশে থাকে। অরিজিৎ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই প্রাসাদের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত ছায়ার জন্ম দিয়েছে? নাকি মানুষের লোভ আর হিংসাই জন্ম দিয়েছে এমন এক মৃত্যু-ছায়া? সূর্য ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছিল পূর্ব আকাশে, কিন্তু প্রাসাদের গায়ে লেগে থাকা ছায়া যেন আরও ঘন হয়ে উঠছিল। অরিজিৎ জানত, এই মৃত্যু ছিল কেবল শুরু; এই প্রাসাদ আরও মৃত্যুর সাক্ষী হবে, যদি না সে খুঁজে বের করতে পারে সেই ছায়ার আসল চেহারা।

নরেনের মৃত্যুর পর প্রাসাদ যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। শোকের ভারে নুয়ে পড়েছিল সবাই, আর চারপাশের বাতাসে ভাসছিল অজানা আতঙ্কের গন্ধ। গঙ্গার ওপার থেকে ভেসে আসা শঙ্খের মৃদু ধ্বনি পর্যন্ত যেন অসহায় মনে হচ্ছিল সেই নৈঃশব্দ্য ভাঙতে। সকালবেলার রোদও প্রাসাদের ছাদ ছুঁয়ে তেমন আলো ফেলতে পারছিল না, ছায়ার রাজত্ব যেন অটুট থাকছিল প্রতিটি কোণে। সেই নীরবতার মাঝেই হঠাৎ ভাঙল কনকলতা দেবীর জোরালো কণ্ঠস্বর। তিনি যেন অনেক দিন চেপে রাখা এক সত্যি বলে ফেলতে চাইলেন। প্রাসাদের মহিলা অন্দর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন মাঝের প্রাঙ্গণে, মাথায় সাদা ঘোমটা টানা, হাতে লাল সুতো বাঁধা, চোখে যেন আতঙ্ক আর অভিশাপের ছাপ। তিনি বললেন, এই প্রাসাদ আর সেই পেইন্টিং অভিশপ্ত। বহু বছর আগে, যখন এই চিত্রকর্ম প্রথম আনা হয় ফ্রান্স থেকে, তখনই নাকি পরিবারের ওপর নেমে আসে অশুভ ছায়া। সেই মুখোশ পরা নারীর ছবির সঙ্গে নাকি জড়িয়ে আছে এক নিহত ফরাসি মহিলার আত্মার আর্তি। তিনি যে প্রণয়ে বঞ্চিত হয়ে প্রাণ হারান, সেই অভিশাপ আজও থেকে গেছে এই প্রাসাদের প্রতিটি ইটে ইটে। প্রতিটি প্রজন্মে কেউ না কেউ নাকি মৃত্যুর শিকার হয়েছে যখনই ছবিটি নিয়ে বাড়িয়েছে গর্ব। কনকলতার গলায় কাঁপা শোনা যাচ্ছিল, আর উপস্থিত সবাই নিশব্দে শুনছিল সেই ইতিহাসের অজানা, অশুভ অধ্যায়ের কথা। প্রাসাদের বাতাস হঠাৎ আরও ভারী মনে হলো, আর অরিজিৎ বুঝল, কুসংস্কার আর ইতিহাসের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক জটিল ধাঁধা, যা না খুললে মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নেই।

অরিজিৎ স্থির করল, সে এই কাহিনির শেষ খুঁজবে। সে শ্রেয়সীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রাসাদের বাইরে, কালীঘাট অঞ্চলের এক বৃদ্ধ চিত্রশিল্পীর সন্ধানে, যার কথা শুনেছিল সে কলকাতায় গবেষণার সময়। লোকটি একসময় জমিদার পরিবারের জন্য চিত্রকর্মের সংরক্ষক হিসেবে কাজ করত এবং পেইন্টিংটির ইতিহাসের বহু অজানা দিক জানত। গঙ্গার পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে তারা যখন কালীঘাটের আঁকাবাঁকা গলিতে ঢুকল, তখন সূর্য আরও উঁচুতে উঠে তাপ ছড়াচ্ছিল, কিন্তু সেই গলির ছায়াঘেরা অন্ধকার যেন দিনের আলোকেও রুখে দিচ্ছিল। পুরনো কাঠের বাড়ি, ভাঙা জানালা, দেওয়ালে শেওলার দাগ—সব মিলে জায়গাটা যেন সময়ের ফাঁদে আটকে গেছে। সেই অন্ধকার ঘরে বসে থাকা বৃদ্ধ শিল্পী চুপচাপ শুনল অরিজিৎ-এর বর্ণনা। তার চোখ দুটি ঝাপসা, কিন্তু মনের চোখে যেন সব স্পষ্ট। সে জানাল, পেইন্টিংটি আসলে এক ফরাসি অভিজাত পরিবারের আদেশে তৈরি হয়েছিল, এক প্রণয়ে প্রতারিত মহিলার স্মৃতিতে। সেই মহিলার মৃত্যু হয়েছিল এক ভয়াবহ রাতে, গঙ্গার পাড়ে, প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায়। পরে সেই চিত্রকর্ম নিলামে উঠে আসে এই প্রাসাদের পূর্বপুরুষের হাতে। তখন থেকেই নাকি অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করে প্রাসাদে—আত্মহত্যা, মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ড। বৃদ্ধ বলল, “ছবিটা শুধু ছবি নয়, ওতে যে কান্না আঁকা আছে, তা আজও থামেনি।” অরিজিৎ অনুভব করল, কুসংস্কার বা সত্যি, এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা যাবে না।

প্রাসাদে ফিরে আসার সময় অরিজিৎ আর শ্রেয়সীর মন ভরে ছিল আরও প্রশ্নে। রাত নামতে না নামতেই চারদিকের বাতাসে যেন ছড়িয়ে পড়ল সেই কাহিনির ছায়া। গঙ্গার জল প্রতিফলিত করছিল চাঁদের আলো, কিন্তু সেই আলোর ছায়া পড়ছিল প্রাসাদের ভাঙা দেয়ালে এমনভাবে, যেন এক মুখোশ পরা নারীর অবয়ব ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর নীরবতা, বাইরে বাতাসে ফিসফিস শব্দ, আর নরেনের মৃত্যু যেন প্রতিটি ইটে ইটে আঁচড় কেটে রেখে গেছে। দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ বিছানায় শুয়ে থাকলেও মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ফিসফিস করে বলছিলেন সেই মুখোশের কথা, সেই ছায়ার কথা। শ্রেয়সী রাতের অন্ধকারে অরিজিৎ-এর পাশে দাঁড়িয়ে ঘরের জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, রহস্যের আসল জটিলতা এখন শুরু হয়েছে। সেই পেইন্টিংয়ের অন্তর্ধান আর নরেনের মৃত্যু যে কেবল শুরু, সেই রাতে তারা প্রথমবার অনুভব করল এই প্রাসাদে আরেকটি অদৃশ্য, অশুভ শক্তি জেগে উঠেছে, যা হয়তো আর থামবে না যতক্ষণ না তার রহস্য উন্মোচিত হয়।

দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের অন্দরের বাতাস আরও ভারী হতে লাগল। নরেনের মৃত্যুর পর থেকে চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন এক ভয়াবহ অশরীরীর উপস্থিতি টের দিচ্ছিল, যা প্রতিটি ইটে, প্রতিটি করিডরে অদৃশ্য ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, দূরে বিদ্যুতের ঝলকানি আর বজ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। গঙ্গার ওপার থেকে ভেসে আসা কাঁচা মাটির গন্ধে মিশে যাচ্ছিল বৃষ্টির আগমনী বার্তা। অরিজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হয়তো প্রাসাদকে শুদ্ধ করবে, সেই অশুভ শক্তিকে ধুয়ে মুছে দেবে। কিন্তু হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো এক চিৎকার, যা রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলল। সেই চিৎকার যেন হতাশা, আতঙ্ক আর মৃত্যুর পূর্বঘোষণা। অরিজিৎ ছুটে বেরোল, শ্রেয়সীও দৌড়ে এলো তার পিছু পিছু। বজ্রের আলোয় তারা দেখতে পেল প্রাসাদের ভেতরের বড় করিডরের শেষে মিহির বাবু, পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নিথর হয়ে পড়ে আছেন। তার দেহ কুৎসিতভাবে বিকৃত, এক হাতে আঁকড়ে রেখেছেন প্রাচীন দেওয়ালের এক খণ্ড ভাঙা পাথর, আর চোখ দুটি স্থির হয়ে গেছে শূন্যের দিকে। মুখের বাম পাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, শরীরের নীচে জমা হয়েছে এক পুকুর সমান রক্ত। তার চেহারায় মৃত্যু মুহূর্তের চরম আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

প্রাসাদের প্রতিটি মানুষ ছুটে এলো সেই করিডরে। কনকলতা দেবীর মুখ থেকে অস্ফুট বেরিয়ে এলো প্রাচীন মন্ত্র, দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ শয্যায় শুয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করলেন—“ছায়া… ছায়া আবার এল…” বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আর বিদ্যুতের চমকে করিডরের ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে, প্রতিটি কোণে, প্রতিটি দেওয়ালে অদৃশ্য শত্রুর উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে। অরিজিৎ ধীরে ধীরে মিহির বাবুর নিথর দেহের দিকে এগোল, আর দেখতে পেল দেওয়ালে আঙুলের আঁচড়ের চিহ্ন, যেন কেউ শেষ মুহূর্তে বাঁচার চেষ্টা করছিল। করিডরের মেঝেতে ভেজা পায়ের ছাপ মিলিয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টির জলে, যেন সেই অদৃশ্য ঘাতক তার চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে। বিপ্লব দত্তকে খবর দেওয়া হল, এবং সে এসে চারপাশ ঘিরে ফেলল, পুলিশ প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ পরীক্ষা শুরু করল। কিন্তু ঘাতকের কোনো চিহ্ন মিলল না, কেবল করিডরের অন্ধকারে যেন লুকিয়ে আছে সেই ছায়া, যা প্রতিটি মৃত্যুর সাক্ষী।

রাত আরও গভীর হল, প্রাসাদের বাতাস ভিজে উঠল বৃষ্টির জলে, আর অরিজিৎ নিজের ঘরে ফিরে এসে জানালার পাশে বসে থাকল নির্ঘুম। বাইরে বজ্রপাতের আলোয় প্রাসাদের গায়ে ছায়া পড়ছিল, আর সেই ছায়া কখনও নারী অবয়বের মতো, কখনও অশরীরীর মতো মনে হচ্ছিল। শ্রেয়সী চুপচাপ বসেছিল বিছানায়, চোখে শূন্য দৃষ্টি। দুজনে জানত, এই প্রাসাদ আর তার ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অভিশাপ বা লোভের কাহিনি হয়তো আরও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। কুয়োর ধারে জমে থাকা বৃষ্টির জল থেকে ভেসে আসছিল ভেজা মাটির গন্ধ, আর মনে হচ্ছিল সেই গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে অতীতের কোন কান্না, কোন অজানা আর্তনাদ। অরিজিৎ বুঝতে পারছিল, এই মৃত্যু ছিল নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং এক পরিপূর্ণ ষড়যন্ত্রের অংশ। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই ছায়ার মুখোশ খোলার সংকল্প আরও দৃঢ় হয়ে উঠল তার মনে।

মিহিরের মৃত্যুর পর প্রাসাদের চারপাশে যে শোক আর আতঙ্কের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছিল, তা যেন ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেওয়াল থেকে করিডরে, করিডর থেকে ঘরের কোণে কোণে। দিনের আলোও যেন সেই অদৃশ্য ছায়ার ভয়ে প্রাসাদের ইট পাথরকে উজ্জ্বল করতে পারছিল না। অরিজিৎ চুপচাপ বসে প্রাসাদের সেই পুরনো নকশা খুঁজছিল, যেটা তাকে দেওয়া হয়েছিল কলকাতায় গবেষণার সময়। সে বুঝতে পারছিল, এই মৃত্যুগুলি নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক সুপরিকল্পিত রহস্য, এক অশুভ হাতের ছোঁয়া। দুপুরের রোদে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে সে দাঁড়াল, দূর আকাশের মেঘের ফাঁক দিয়ে যে সূর্যের আলো পড়ছিল গঙ্গার জলে, তা কেমন যেন নিস্তেজ আর নির্জীব লাগছিল। বাতাসে ভাসছিল শুষ্ক পাতা আর ভাঙা মাটির গন্ধ। হঠাৎ তার মনে হল, প্রাসাদের করিডরের এক কোণ থেকে ভেসে এলো ঘুঙুরের মৃদু শব্দ। সে চমকে ফিরে তাকাল। কিন্তু চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই শব্দের প্রতিধ্বনি, যেন দেওয়াল গুলো গোপনে মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে উঠেছে সেই অদৃশ্য নাচের।

রাত নামতেই সেই ঘুঙুরের শব্দ যেন স্পষ্ট হতে লাগল। প্রাসাদের অন্দরে, করিডরের অন্ধকারে, সেই মৃদু ছন্দময় ঝঙ্কার যেন কারও অজানা পদক্ষেপের গোপন ছন্দ বয়ে আনছিল। দ্বিজেন্দ্রপ্রসাদ শয্যায় শুয়ে দূর থেকে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন—“ছায়া ফিরেছে… মুখোশ পরা নাচ আবার শুরু হলো…” শ্রেয়সী আর অরিজিৎ মিলে দেওয়ালের গায়ে কানের কাছে লাগিয়ে সেই শব্দ শোনার চেষ্টা করল, আর তখনই তারা অনুভব করল, অদৃশ্য এক পদক্ষেপ খুব কাছে এগিয়ে আসছে। মেঝেতে হালকা কম্পন, বাতাসে হঠাৎ ঠান্ডার স্রোত, আর জানালার পর্দা অকারণে দুলতে লাগল। সেই রাত যেন এক অব্যক্ত আতঙ্কের নাচে ডুবে গেল। বাইরে গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ পর্যন্ত থেমে গিয়েছিল। প্রাসাদের দেওয়ালে দেওয়ালে সেই ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, অরিজিৎ স্পষ্ট দেখতে পেল চাঁদের আলো পড়া মার্বেল মেঝেতে অদ্ভুত নকশার মতো ছায়ার রেখা আঁকা হচ্ছে, যেন এক প্রাচীন রক্তলেখা নিজের ইতিহাস বলতে চাইছে। সেই অন্ধকারে সে প্রতিজ্ঞা করল, এবার সে ঢুকে পড়বে সেই পুরনো কুঠুরিতে, যেখানে বলা হয় প্রাসাদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর কাহিনি লুকিয়ে আছে।

প্রাসাদের একদম পেছনের দিকে যে পরিত্যক্ত কুঠুরি, যেখানে বছরের পর বছর কেউ পা রাখেনি, সেই দিকে পা বাড়াল অরিজিৎ। করিডরের অন্ধকার ভেদ করে হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি দেওয়াল থেকে কারা যেন তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। কুঠুরির দরজা খোলা পেয়ে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘরের ভেতরে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, দেওয়ালে শেওলা, মেঝেতে ধুলো আর ইঁদুরের পায়ের ছাপ। হঠাৎ টর্চের আলোয় ফুটে উঠল দেওয়ালের গায়ে আঁকা প্রাচীন এক নাচের দৃশ্য—মুখোশ পরা নারী, হাত তোলা ভঙ্গিমা, পায়ের কাছে ঘুঙুরের নকশা। সেই ছবি যেন দেওয়ালের গায়ে নয়, অরিজিৎ-এর চোখের ভেতরে নাচতে শুরু করল। টর্চের আলো কেঁপে উঠল, বাতাসে হালকা চাপা কাঁদুনির গন্ধ, আর দূরে করিডরের অন্ধকারে সেই ঘুঙুরের শব্দ আবার শোনা গেল—এইবার আরও স্পষ্ট, আরও নিকটবর্তী। অরিজিৎ বুঝল, প্রাসাদের ছায়া যে নাচ শুরু করেছে, তা আর থামবে না যতক্ষণ না ইতিহাসের রক্তাক্ত মুখোশ খুলে ফেলা যায়।

রাতের আঁধার ভেদ করে প্রাসাদের বাতাসে সেই ঘুঙুরের শব্দ এখনও ভেসে আসছিল। অরিজিৎ মনের জোরে সেই শব্দের উৎস খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিল, আর অন্ধকার করিডর পেরিয়ে সেই পুরনো কুঠুরির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেল। তার হাতে টর্চের আলো কাঁপতে কাঁপতে ঘরের ভেতরের দেওয়ালে আঁকা সেই মুখোশ পরা নর্তকীর ছবি ফুটিয়ে তুলছিল আরও স্পষ্ট করে। সেই ছবি যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে শূন্য দৃষ্টি, পায়ের কাছে অদৃশ্য নৃত্যের ঘুঙুরের সুর। বাতাসে ভেসে এলো জীর্ণ কাঠের দরজার কর্কশ শব্দ, যেন অতীতের কষ্টের আর্তনাদ। অরিজিৎ ধীরে ধীরে ঘরে পা রাখল, আর মুহূর্তেই তার মনে হল, ঘরের বাতাসে কোনো অদৃশ্য চোখ তাকে দেখে চলেছে। দেওয়ালের শেওলা ঢাকা ফাঁকফোকর থেকে ভিজে মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে ছিল এক চাপা আতঙ্কের ঘ্রাণ। ঘরের মেঝেতে পায়ের ছাপের মতো কিছু চিহ্ন, যা বৃষ্টির জলে আধভেজা হয়ে গেছে, অরিজিৎ অনুভব করল যেন কিছুক্ষণ আগেই এখানে কেউ হেঁটে গেছে।

ঘরের এক কোণে টর্চের আলো ফেলতেই অরিজিৎ দেখতে পেল একটি কাঠের পুরনো সিন্দুক, যার গায়ে লোহা বসানো আর তালা জংধরা। সে যখন ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সিন্দুকের ঢাকনা তুলল, সেই মুহূর্তে জানালার কাঁচে বৃষ্টি ধেয়ে এলো ঝড়ের মতো, আর বিদ্যুতের ঝলকে ঘরের অন্ধকার আলোকিত হল এক মুহূর্তের জন্য। সেই আলোর ঝলকে সিন্দুকের ভেতর দেখা গেল এক মুখোশ, কালো আর লাল রঙের মিশেলে তৈরি, যার চোখের ছিদ্র যেন শূন্যের দিকে চেয়ে আছে। মুখোশের পাশে রাখা ছিল এক পুরনো পাণ্ডুলিপি, তাতে অদ্ভুত ফরাসি আর বাংলার মিশ্রণে লেখা কিছু বাক্য। অরিজিৎ পাণ্ডুলিপির ধুলো ঝেড়ে যখন পড়তে শুরু করল, তখন বুঝতে পারল সেই মুখোশ ছিল প্রাসাদের সেই চিত্রকর্মের মূল নকশা, আর পেইন্টিংয়ের মহিলার অভিশপ্ত কাহিনির সূত্র লুকিয়ে আছে এই মুখোশে। পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল কাহিনি—প্রেমঘাতিনী ফরাসি মহিলার, যাকে বঞ্চিত করে প্রাণ নিয়েছিল এক জমিদার বংশের পূর্বপুরুষ। সেই মহিলার আত্মা নাকি এই মুখোশের ছায়া হয়ে প্রতিশোধ নেয় যুগের পর যুগ।

ঝড়ের রাত গভীরতর হতে থাকল, আর অরিজিৎ অনুভব করল যে এই রহস্যের গিঁট আলগা হতে শুরু করেছে। বাইরে বৃষ্টির তোড়ে গঙ্গার জলধারা হুহু করে বয়ে চলেছে, আর প্রাসাদের অজানা কুঠুরিতে মুখোশের চোরা আলো যেন ছড়িয়ে পড়ছে দেওয়ালে দেওয়ালে। সেই মুখোশ হাতে নিয়ে সে বাইরে বেরোতে যাবার মুহূর্তেই করিডরের অন্ধকারে আবার ভেসে এলো সেই ঘুঙুরের মৃদু সুর। এইবার সে শব্দ যেন দূরে নয়, একেবারে কাছেই। ঘরের বাতাস হঠাৎ আরও ঠান্ডা হয়ে উঠল, জানালার কাঁচ নড়ে উঠল ঝড়ের তোড়ে। অরিজিৎ জানত, এই মুখোশের রহস্য ফাঁস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, কারণ এই অশরীরী ছায়া থামবে না যতক্ষণ না সেই অভিশপ্ত ইতিহাসের নাড়ি-নক্ষত্র উন্মোচিত হয়। সেই রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট অনুভব করল, প্রাসাদের প্রতিটি ইট, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি মৃত্যুর রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু এই মুখোশ।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, যেন পুরনো প্রাসাদের করিডরের অন্ধকার আর শীতলতা সমস্ত আশেপাশের প্রাণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এক অভিশপ্ত ছায়া। অরিজিৎ যখন মুখোশটি হাতে নিয়ে সিন্দুকের তলা থেকে বের করেছিল, তখন তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল—যেন সে কোনও অতীতের কালো অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করছে, যা অনিবার্যভাবে তাকে তার পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। মুখোশের আঁকা ডিজাইনগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল, তার চোখের ভেতর থেকে একটি গভীর অন্ধকার ঝিকমিক করছিল। মুখোশের প্রতিটি রেখায় মিশে ছিল এক প্রাচীন যন্ত্রণা, এক অশুভ শক্তি। টর্চের আলোতে সেই কালো আর লাল রঙের মিশ্রণ স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন কোনো দুঃখী, ক্ষুব্ধ আত্মা নাচছে, চিৎকার করছে, আর অরিজিৎকে তার ভেতরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

সিন্ধুকের তলা থেকে মুখোশ বের করার পর, অরিজিৎ বুঝতে পারল, এ শুধু একটি মুখোশ নয়, বরং এর মধ্যে একটি অতুলনীয় শক্তি লুকিয়ে আছে। মুখোশের নিচে থাকা পুরনো পাণ্ডুলিপি তার হাতে চলে এল, যেটি সে সাবধানে খুলে পড়তে শুরু করল। পাণ্ডুলিপির ভাষা ছিল বিচিত্র—একদিকে ফরাসি, অন্যদিকে বাংলা, এক ধরনের মিশ্রণ যা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। অরিজিৎ যতই পড়তে থাকল, ততই সে বুঝতে পারছিল যে এই মুখোশ, এই ছবি, এবং এই পাণ্ডুলিপি এক বৃহত্তর রহস্যের অংশ। চিত্রকর্মের মহিলার জীবন, তার বঞ্চনা, তার মৃত্যু, এবং সেই মৃত্যুর পরেও তার অভিশাপ বহমান ছিল এই জমিদার প্রাসাদে। পাণ্ডুলিপির এক জায়গায় লেখা ছিল—”প্রতিশোধের আগুন নিবে না যতক্ষণ না ছবির ক্যানভাসে শেষ রক্তের দাগ না ফেলে”। অর্থাৎ, প্রাসাদে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মৃত্যুই এক পরবর্তী স্তরের অভিশাপের গর্ভ থেকে জন্ম নিত।

হঠাৎ, প্রাসাদের বাইরে বিদ্যুৎ চমকাল, আর আকাশের গর্জন আরও তীব্র হয়ে উঠল। অরিজিৎ জানত, কিছু সময়ের মধ্যে, এই প্রাসাদে ঘটে যাওয়া সকল মৃত্যুর রহস্য প্রকাশ পাবে। সে মুখোশটি হাতে নিয়ে বাইরে বের হল, আর করিডর ধরে চলে যেতে লাগল। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ঘর, যেন তাকে এক অনিচ্ছাকৃত পথের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে অপেক্ষা করছিল এক পুরনো, কষ্টকর সত্য। বাইরে বৃষ্টি আরও ভারী হয়ে উঠল, আর প্রাসাদের ঘরের দরজা-জানালা দিয়ে টেনে আসছিল বাতাসের এক অদৃশ্য শক্তি। অরিজিৎ পুরো প্রাসাদ ঘুরে বেড়াল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে অতীতের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, সেই মুখোশের রহস্য কেবল এই প্রাসাদের ইতিহাসের মধ্যে নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত একটি গভীর মানবিক ট্র্যাজেডিও ছিল। তবে, সে জানত যে একমাত্র এই মুখোশের সাহায্যেই সে সত্যের মুখোমুখি হতে পারবে, এই অভিশপ্ত ইতিহাসকে খুঁজে বের করতে পারবে।

অরিজিৎ পুনরায় কুঠুরির দিকে ফিরে গেল, যেখানে মুখোশটি রাখা হয়েছিল। সে একদম নিরব, অদ্ভুত নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই মুখোশটি তার মুখে বসিয়ে দিল, যেন সমস্ত জগত থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে সে অনুভব করল, যেন তার চোখের সামনে একটি অন্ধকার অভিসম্পাতের পর্দা সরে যাচ্ছে। ঘরের দেওয়ালের ছায়া তার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল—ছায়ার মধ্যে জীবন্ত অবয়ব যেন নাচছে, একটি নারীর অশ্রুভরা চেহারা, যার চোখের কোণে দৃশ্যমান এক হতাশার কালো দাগ। সে এক স্নিগ্ধ, শান্ত নৃত্যে কাঁপছে, কিন্তু সেই নৃত্যের ভেতরে যেন কিছু নিঃশব্দ আর্তনাদ ছিল। অরিজিৎ বুঝতে পারল, এই পেইন্টিং, এই মুখোশ, এবং এই প্রাসাদের ভেতরে থাকা প্রতিটি প্রাচীন বস্তু এক অতীতের অভিশপ্ত গল্পের অংশ, যা সেই নারীকে বন্দি করে রেখেছে—তার প্রতি প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ প্রতিটি আত্মা তাকে থেকে চলে যেতে পারছে না। সেই ঘরে দাঁড়িয়ে অরিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে মুখোশটি খুলে ফেলে, আর আকাশের গর্জন আর বৃষ্টির শব্দ তাকে তার ঘুম ভেঙে নিয়ে গেল।

রাতের কালো অন্ধকার যেন ক্রমশ প্রাসাদটিকে গ্রাস করে নিচ্ছিল, আর সেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছিল এক অজানা প্রতিশোধের গন্ধ। অরিজিৎ মুখোশটি হাতে নিয়ে প্রাসাদের করিডর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি জানালা, এমনকি ভাঙা মার্বেল মেঝের প্রতিটি ফাটল থেকে অতীতের আর্তনাদ ভেসে আসছে। বাইরে গঙ্গার জল আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে, বৃষ্টির ধারায় সমস্ত পুকুর, খাল একাকার হয়ে গেছে। হাওয়ার তোড়ে জানালার কাঁচ কাঁপছে, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকে সমস্ত করিডর আলোকিত হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে মুখোশের লাল-কালো রঙ যেন রক্ত আর অশ্রুর মিশ্রণ হয়ে ফুটে উঠছে অরিজিৎ-এর হাতে। হঠাৎ, দেওয়ালের কোণ থেকে সে শুনতে পেল চাপা কান্নার শব্দ, যা অজানা এক নারীর আর্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত অট্টালিকায়। অরিজিৎ জানত, সে চরম মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অতীত আর বর্তমানের বিভাজনরেখা মিলিয়ে যাবে এক অনন্ত প্রতিশোধের অন্ধকারে।

মুখোশটি সে শেষবারের মতো নিজের মুখে পরল, আর মুহূর্তেই সে যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করল। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ফরাসি নারীর ছায়া—মুখোশ পরা, দীর্ঘ পোষাক পরিহিতা, চোখে শুধুই শূন্যতা আর বেদনা। করিডরের অন্ধকারে যেন সেই নৃত্য শুরু হলো, ঘুঙুরের ঝঙ্কার আর পায়ের ছন্দ মিলিয়ে তৈরি হলো এক ভয়ঙ্কর ছন্দময় ধ্বনি। ঘরের কোণ থেকে ছায়াগুলো বেরিয়ে এলো, নাচতে নাচতে তারা অরিজিৎ-এর চারপাশ ঘিরে ধরল, আর বাতাসে ভেসে এলো সেই পুরনো পাণ্ডুলিপির কথাগুলো—“অভিশাপ ঘুচবে রক্তে, প্রতিশোধ থামবে মৃত্যুর পরে।” সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল, যতক্ষণ না সে প্রাসাদের অভিশপ্ত কুঠুরির গোপন ফাঁকফোকর থেকে আসল ষড়যন্ত্রকারীকে বের করে আনতে পারছে, ততক্ষণ মৃত্যু থামবে না, ছায়ার নাচ থামবে না। মুখোশের ভেতর দিয়ে দেখা দৃশ্যগুলো তাকে বারবার ফিরে নিয়ে যাচ্ছিল সেই রাতে, যখন প্রথম মৃত্যু হয়েছিল, যখন প্রথম প্রতারণা হয়েছিল।

অরিজিৎ হঠাৎ করিডরের শেষপ্রান্তের সেই গোপন দরজার কাছে গিয়ে থামল, যেটি বছরের পর বছর বন্ধ ছিল। মুখোশের অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে পথ দেখাচ্ছিল, অন্ধকার ভেদ করে। দরজা ঠেলে সে যখন ঢুকল, তখন ঘরের ভেতর দেখা গেল সেই মানুষটিকে—প্রাসাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, যাকে সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তার মুখে বিকৃত হাসি, হাতে রক্তমাখা ছুরি, আর পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটি ছিন্নভিন্ন ছবি—প্রাচীন সেই চিত্রকর্মের ক্যানভাস। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, বাইরে বজ্রপাতের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল মাটিও। অরিজিৎ বুঝল, এই মানুষই সমস্ত মৃত্যুর মূল কলকাঠি নেড়েছে, অভিশাপের নাম নিয়ে হত্যা করে নিজের লোভ পূরণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুখোশের শক্তি, প্রাসাদের শতবর্ষ পুরনো ইতিহাস আর মৃতের আত্মার প্রতিশোধ মিলে আজ তাকে শেষ করে ছাড়বে। সেই রাত যেন এক অদ্ভুত নৃত্যনাট্যের অন্তিম দৃশ্যে পরিণত হলো, যেখানে ছায়া, মৃত্যু আর প্রতিশোধ একসঙ্গে মিশে গিয়ে প্রাসাদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় রচনা করল।

১০

রাতভর চলা সেই বিভীষিকার পরে ভোরের প্রথম আলো যখন চন্দননগরের সেই প্রাচীন জমিদার প্রাসাদের গায়ে এসে পড়ল, তখন পুরো প্রাসাদ যেন হঠাৎ জেগে উঠল দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পর। বৃষ্টিতে ধোয়া উঠোন, করিডরের ধুলো ধোয়া মেঝে, দেওয়ালের শেওলা আর জানালার কাঁচে লেগে থাকা জলের ফোঁটা—সব মিলিয়ে সেই প্রাসাদ যেন শতাব্দীর শাপমুক্তির নিদর্শন হয়ে উঠল। অরিজিৎ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল প্রাসাদের সামনের উঠোনে, তার চোখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ, হাতের তালুতে শক্ত করে ধরা সেই অভিশপ্ত মুখোশ। প্রায় এক রাতের লড়াই, আতঙ্ক আর সত্যের খোঁজ শেষে সে জানত যে এই মুখোশের সঙ্গেই শেষ হবে সেই অভিশপ্ত ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়। তার চারপাশে পাখিরা ডেকে উঠছিল, গঙ্গার স্রোতে আলো লেগে তৈরি হচ্ছিল রূপালী রেখা। আর সেই আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে অরিজিৎ যেন দেখতে পাচ্ছিল সেই ফরাসি নারীর মুখ—যার চোখে ছিল দুঃখ, যন্ত্রণার অন্ধকার, কিন্তু আজ সেই মুখে ফুটে উঠেছে এক অপার্থিব শান্তি। সে ধীরে ধীরে সেই মুখোশটি গঙ্গার জলে বিসর্জন দিল, আর মুহূর্তেই মনে হল, প্রাসাদের সমস্ত অভিশপ্ত অতীত যেন নদীর স্রোতে মিশে একান্ত চুপিসারে বিদায় নিল এই ভূমি থেকে।

প্রাসাদের ভেতর তখন নিস্তব্ধতা। করিডরের সেই ঘুঙুরের ধ্বনি আর শোনা যাচ্ছিল না, বাতাসে ভেসে থাকা কান্নার প্রতিধ্বনি মিলিয়ে গিয়েছিল ভোরের হিমেল হাওয়ায়। বাইরে কনকলতা দেবী শাড়ির আঁচল সামলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সেই অশ্রু বেদনার নয়, ছিল এক অজানা শান্তির। শ্রেয়সী এসে দাঁড়িয়েছিল অরিজিৎ-এর পাশে, তার চোখে ছিল কৃতজ্ঞতা আর গভীর বেদনার ছায়া, যা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিল না। বিপ্লব দত্ত প্রাসাদের উঠোনে পায়চারী করছিল, তার চেহারায়ও দেখা যাচ্ছিল এক ধরণের পরিতৃপ্তি—কারণ এতদিনের আতঙ্ক আর মৃত্যুর জাল ভেদ করে আজ তারা সত্যকে সামনে এনেছে। প্রাসাদের দেওয়ালে দেওয়ালে সেই শাপমুক্তির আলো লেগে ছিল, যেটি শতাব্দীর অভিশপ্ত গল্পের শেষ পাতা উল্টে দিয়ে নতুন ইতিহাস লিখছিল। গঙ্গার জলে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছিল মুখোশটি, আর নদীর স্রোত নিয়ে যাচ্ছিল সেই অজানা প্রতিশোধের যন্ত্রণা আর অভিশাপকে বহুদূরে।

প্রাসাদজুড়ে নতুন দিনের হাওয়া বইতে লাগল। দেওয়ালের শেওলা ধুয়ে যাচ্ছিল সূর্যের আলোয়, করিডরের অন্ধকার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছিল আলো, আর জানালার কাঁচে লেগে থাকা জলের ফোঁটা শুকিয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। অরিজিৎ একবার ফিরে তাকাল সেই ইতিহাস-ঢাকা অট্টালিকার দিকে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই প্রাসাদকে আবার সে গড়ে তুলবে, আর কোনো ছায়া, অভিশাপ বা লোভের নোংরা গল্প যেন এখানে মাথা না তোলে। সে অনুভব করল সেই প্রাসাদ আজ শুধুই একটি অট্টালিকা নয়, এটি এক সাক্ষী—যেখানে মৃত্যু, শাপ, প্রতিশোধ আর অবশেষে মুক্তির কাহিনি লেখা থাকবে চিরদিন। দূরে গঙ্গার ওপারে সূর্য উঠে পড়েছিল, আর তার আলোয় সেই প্রাসাদ যেন স্নান করল নবজীবনের আশায়। বাতাসে বৃষ্টির ভেজা মাটির গন্ধ মিশে গেল গঙ্গার জলরাশির শীতলতার সঙ্গে, আর মনে হল—প্রাসাদ, মানুষ আর নদী, তিনজনই যেন একসঙ্গে শান্তির শ্বাস নিচ্ছে বহুদিন পর।

___

1000032131.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *