ঋদ্ধিমা বসুরায়
দুধে চিনি একটু কম দিলে চা ঠিক যেন তার মনমতো হয়—তেতো নয়, আবার অতটাও মিষ্টি নয় যে জিভকে পীড়া দেয়। স্নিগ্ধা এত বছর ধরে নিজের চায়ের স্বাদ নিজের মতোই গড়ে তুলেছে, কিন্তু কেউ সেটা জানে না। রতন জানে না, মা জানেন না, এমনকি ছেলেও নয়। হয়তো এটাই তার আসল একাকীত্ব—নিজের মতো হতেই চা বানাতে হয়।
প্রতিদিন সকাল আটটায় ছেলের স্কুল, আর আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়েছিল। স্কুল গেটের সামনে একটা ভিড় জমেছে। একটা নতুন শিক্ষক যোগ দিয়েছেন, অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করানো হচ্ছে। স্নিগ্ধা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে তাকাল, তারপর চোখ আটকে গেল।
হালকা গায়ের রঙ, লম্বা গড়ন, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, আর ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি। সে ছেলে, কিন্তু তার ভেতর যেন কবিতা লুকিয়ে। হ্যাঁ, কবিতা—ঠিক যেমন কোনও মানুষকে দেখে মনে হয়, এ তো সাদামাটা শরীর নয়, শব্দের ভিতর হাঁটছে।
ছেলেটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলে কোন ক্লাসে?”
স্নিগ্ধা হালকা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “ফোরে।”
“ও আকাশের মা?”
একটা হালকা শিউরে ওঠা। কী করে জানে?
“হ্যাঁ।”
“ও খুব মিষ্টি। আর অদ্ভুত কল্পনা। আমি ওর খাতায় এক লাইন পেয়েছি—‘আমার মা গোপনে গল্প লেখেন, বাবাকে বলেন না।’ সত্যি?”
স্নিগ্ধা থতমত খেয়ে তাকাল। ঠোঁট শুকিয়ে এল।
“ও হয়তো কল্পনা করেছে।”
ছেলেটির নাম অভিষেক। সে হেসে বলল, “তবু তো কল্পনাও কোথাও থেকে জন্ম নেয়, তাই না?”
সেদিন বাড়ি ফিরে স্নিগ্ধা নিজের ডায়েরি খুলে বসেছিল। বহুদিন ধরেই লেখে না, কেবল জমিয়ে রাখে কথা—যেমন জমিয়ে রাখে নিজের শারীরিক অভাব, অনুভূতির ক্ষুধা, নিঃশব্দ সন্ধ্যাবেলা।
রতনের সঙ্গে বিয়েটা কোনো নাটক ছিল না, আবার প্রেমও নয়। ভালোবাসা একটা সময় ছিল হয়তো, কিন্তু এখন সে যেন নিছক গৃহস্থালীচুক্তির মতো। রাতে শরীর আসে, ছুঁয়ে যায়, কিছু চায়, আর নিঃশব্দে চলে যায়। তাতে কারো আর ব্যথা জাগে না—না স্নিগ্ধার, না রতনের।
কিন্তু অভিষেকের ওই একটা বাক্য যেন ভিতর থেকে কিছু খুলে দিয়েছিল। একটা প্রশ্ন রেখে গিয়েছিল—আমি সত্যিই কি আছি? না কি শুধুই এক গৃহিণী, এক মা, এক রান্নাঘরের আলো?
সেই রাতেই ফোনে একটা মেসেজ এল—অভিষেক, স্কুলের অভিভাবক গ্রুপ থেকে নম্বর নিয়েছে।
“আপনার গল্প পড়া যায়?”
স্নিগ্ধা উত্তর দিল—“সব লেখা গল্প হয় না।”
“তবু কেউ পড়লে, সেটা গল্প হয়ে ওঠে,” এলো রিপ্লাই।
একটা নিঃশব্দ হাসি এসে গড়ালো ওর ঠোঁটের কোণে।
দুপুরবেলা একদিন স্কুলের পেছনের ছোট্ট ক্যাফেতে দেখা। খুব সাধারণ, দুইজনের সামনেই এক কাপ করে চা।
“চিনিটা একটু কম,” বলেছিল স্নিগ্ধা।
অভিষেক তাকিয়ে বলল, “জানি। যেমন তোমার চাহিদা, একটুও বেশি নয়, কিন্তু গভীর। খুব গভীর।”
স্নিগ্ধা চুপ করেছিল। তার ঠোঁট যেন কিছু বলবে বলে থেমে ছিল। চায়ের কাপ তুলে ধরেছিল দুজনেই, মাঝখানে টেবিলের ওপাশ থেকে চোখে চোখ রেখে চুমুক। ওই চা, ওই চুমুক, ওই চোখের সংলাপ—সবই ছিল অনাবৃত কিন্তু উচ্চারণহীন।
সেই প্রথম ছোঁয়া। কিন্তু কেউ কাউকে ছোঁয়েনি।
সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। নিজেকে দেখেছিল, শরীরটাকে নয়, চোখের দিকে, চুলের রেখায়, ঠোঁটের কাঁপুনিতে। নিজেকে মনে হয়েছিল—একটা জীবন্ত, হাওয়ায় ভেসে থাকা গল্প, যার একটা পাঠক ঠিকই আছে। অভিষেক হয়তো তার পাঠক, যাকে সে এতদিন খুঁজে ফেরে।
রাতে রতনের পাশে ঘুমোনোর ভান করেছিল স্নিগ্ধা। রতনের গায়ে তার ঠান্ডা হাত, কিন্তু মনে ছিল আগুন। মনে হচ্ছিল, অভিষেক ওর পাশে শুয়ে আছে, বলছে—“তুমি কল্পনার থেকেও বেশি, কারণ তুমি নিজেই বাস্তবের সাহস।”
ঘুমোনোর আগে ফোন খুলে লিখেছিল সে—
“আমার নামটা আজও তোমার ফোনে নেই, ঠিক?”
রিপ্লাই এসেছিল মিনিট দশের মধ্যে—
“নেই, কিন্তু মাথার ভেতর আছে। আর আমি চিনি কম চা খাইনি কখনো, এখন বুঝছি কেন পছন্দ করো।”
স্নিগ্ধা প্রথমবার বুঝেছিল, এক কাপ চায়ের মতোই একটা মানুষও রুচির বিষয়। কেউ তেতো লাগে, কেউ বেশি মিষ্টি। কিন্তু কেউ কেউ ঠিক পরিমাপ। অভিষেক সেই পরিমাপের নাম।
রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে সে আরও একটা মেসেজ করেছিল—
“তুমি কি আমায় গল্প বলবে?”
অভিষেকের উত্তর ছিল—
“তুমি নিজেই গল্প, আমি শুধু পড়ে যাবো।”
স্নিগ্ধা সেই রাতের মধ্যেও কেঁদে ফেলেছিল, কিন্তু চোখের জলটা দাগ হয়ে ছিল গালের ভাঁজে। ভালোবাসা নয়, না, এ প্রেমও নয়। এটা সেই চুপচাপ শরীরের গল্প, যেটা হয়তো কাঁথার নিচে বলে ওঠে, মুখে নয়।
***
সেদিন দুপুরে জানালার ফাঁক দিয়ে রোদের টুকরো এসে পড়েছিল রান্নাঘরের সিঙ্কের ধারে। জলচাপার শব্দে সেই রোদ যেন কাঁপছিল। স্নিগ্ধা হাতে কাঁচা কলা কুচোচ্ছিল, কিন্তু মনটা বারবার ফিরে যাচ্ছিল সেই চোখ দুটোয়—যার ভেতর এক ধরনের তাপ, আর টান ছিল। অভিষেক যেন কেবল দেখেনি, ছুঁয়ে গেছে।
তাকে ভাবলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল শরীরের ভিতর কিছু আলগা হয়ে যাচ্ছে। যেন বহুদিন চেপে রাখা বেদনার নিচে সোঁদা ঘামের মতো কিছু গলে নামছে। এই প্রথম স্নিগ্ধা অনুভব করল, সে আর শুধু অনুভব করছে না, সে চাইছে। খোলা, উন্মুক্ত, বেপরোয়া হতে চাইছে। অভিষেক সেই চাওয়ার দরজা।
অভিষেক আর তার মধ্যে কোনও গোপন বার্তালাপ নেই—তারা এখন স্পষ্ট কথা বলে, কিন্তু আবরণে। প্রতিদিন দুটো-তিনটে ছোট মেসেজ, কখনও একটাও নয়। কিন্তু সেই নীরবতাও এমন এক ধরণের সাহস দেয়, যেন দমবন্ধ ঘরে কেউ জানালা খুলেছে।
এক বিকেল বেলায়, ছেলেকে স্কুল থেকে আনার সময় স্নিগ্ধা অভিষেককে গেটের বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। টিফিনবক্স হাতে, এক হাতে ফোন, অন্য হাতে একগাল রোদ। সে স্নিগ্ধাকে দেখেই ফোন রেখে এগিয়ে এল।
“চা খেতে ইচ্ছে করছে। হেঁটে যাব?”
স্নিগ্ধা কিছু না বলে মাথা নাড়ল।
দু’জনে রিকশায় উঠল না। হেঁটেই গেল স্কুলের পেছনের ছোট্ট ক্যাফেটায়। দুপুরের ক্লান্ত রোদ তখন কাঁধে এসে থেমেছে। অভিষেকের আঙুলে একটা সূক্ষ্ম কাঁচের আংটি। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল না, কেন পড়ে আছে।
চা এল। চিনিটা একটু কম। অভিষেক প্রথম চুমুক দিয়ে বলল, “এই চা-টা তোমার মতো। ধীর, ধীরে গাঢ়।”
স্নিগ্ধা চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। বাইরের আলোতে কাপের ধোঁয়ায় তার মুখ আবছা হয়ে যাচ্ছে।
“তুমি কেন চুপ করে থাকো?” অভিষেক জিজ্ঞেস করল।
“কারণ আমি যদি কথা বলি, তুমি হয়তো আমায় অন্য চোখে দেখবে।”
“আমি তো প্রথম দিন থেকেই অন্য চোখেই দেখছি।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল। অভিষেকের কথা শুনলে মনে হয় সে যেন বইয়ের ভিতর থেকে উঠে আসা কোনও চরিত্র, যে জেনে গেছে কোথায় স্পর্শ করলে শব্দে কম্পন ওঠে।
হঠাৎ অভিষেক তার ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, “তোমার হাতে লিখে দিই একটা শব্দ?”
স্নিগ্ধা কাঁপা গলায় বলল, “কি শব্দ?”
অভিষেক বলল, “যেটা তুমি কাউকে বলতে পারো না। এমনকি নিজের কাছেও না।”
স্নিগ্ধা ধীরে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল।
অভিষেক তার আঙুল দিয়ে স্নিগ্ধার তালুতে একটা আকার আঁকল—ধীরে, খুব ধীরে।
“এই শব্দটা রোদে লেখা। শুকিয়ে যাবে, যদি কেউ ছুঁয়ে না দেয়।”
স্নিগ্ধা আর কোনও কথা বলতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন পাঁজরের নিচে কেমন করে রোদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে হেঁটে আসার সময় অভিষেক শুধু বলল, “তোমার শরীরের গন্ধটা খুব পুরোনো কোনও গল্পের মতো। মনে হয় আগে কোথাও পড়েছি।”
স্নিগ্ধা বলল, “তুমি আমার শরীর চেনো?”
অভিষেক বলল, “না, কিন্তু আমি জানি—তোমার পিঠের বাঁদিকে একটা তিল আছে।”
স্নিগ্ধা থমকে দাঁড়াল। কীভাবে জানে ছেলেটা? ও তো কখনও দেখেনি, ছোঁয়েনি।
“তুমি স্বপ্নে এসেছিলে,” বলল অভিষেক।
“স্বপ্নে তিল দেখা যায়?”
“যদি সেই স্বপ্নটা অনেকদিনের ইচ্ছেতে গড়া হয়, তবে যায়।”
স্নিগ্ধার গলা শুকিয়ে গেল। নিজের শরীরটা তাকে এতদিন শুধুই এক কর্তব্যবোধ মনে হয়েছে, আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে—এই শরীরও একটা চিঠি। কেউ সেটা পড়তে চায়। শুধু চোখে নয়, স্পর্শে, নিশ্বাসে, স্মৃতিতে।
রাতে রতনের পাশে শুয়ে সে বুঝতে পারল—এই বিছানাটা এখন একটা খাঁচা। যেখানে পাখি আছে, কিন্তু গান নেই। রতন পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিঃশব্দ, নিঃস্পৃহ। অথচ স্নিগ্ধার শরীরের ভিতর কোথাও এখনো সেই আঙুলের আঁকা শব্দটা কাঁপছে।
সে ফোনটা হাতে নিল। অভিষেককে মেসেজ করল—
“তুমি যদি আমার তিলটা খুঁজে পাও, আমিও তোমার মনের গোপন ঘরটা খুলে দেব।”
অভিষেকের উত্তর এল—
“তুমি শুধু দরজাটা খুলে রাখো, আমি ভিতরে বাতাস নিয়ে ঢুকে পড়ব। আর তোমার তিলটাকে গল্প বানিয়ে লিখব, ঠিক তোমার পিঠে।”
স্নিগ্ধা জানত—এই লেখা নিষিদ্ধ, এই ভালোবাসা সমাজ মানবে না, এমনকি সে নিজেও হয়তো ক্ষমা করতে পারবে না নিজেকে। কিন্তু তবু সে জানে—এই টান, এই রোদ, এই আঙুলের স্মৃতি তাকে বাঁচিয়ে রাখছে। বহুদিন পর সে শুধু একজন মা বা স্ত্রী নয়, সে একজন নারী, যার শরীরে হাওয়া খেলে যায়, যাকে কেউ জিজ্ঞেস করে—“তুমি চা-টা কেমন খাও?”
সেই রাতে ঘুম হয়নি। শুধু মনে হচ্ছিল, অভিষেকের আঙুলে যে রোদ, সেটা যদি সারা গায়ে ছড়িয়ে যায়… তবে শরীরের প্রতিটি রেখা হয়তো শব্দ হয়ে উঠবে।
***
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো উচ্চারণ না হলেও শরীর মনে রাখে। যেমন কোনও দিনের আলো, যেটা চোখ নয়—গায়ে লেগেছিল। যেমন একটা গন্ধ, যেটা অভিজ্ঞান নয়—ভেতরের গোপন দরজায় টোকা মেরেছিল। অভিষেকের সঙ্গে দেখা হওয়া সেই বিকেলটা ঠিক তেমনই রয়ে গেছে স্নিগ্ধার শরীরে—একটা নিঃশব্দ হাহাকার হয়ে।
সেই দেখা হওয়ার পর দিনদুই কথা হয়নি। স্নিগ্ধা নিজেকে আটকে রেখেছিল। অভিষেকের মেসেজ না এলে তার মোবাইল খুলতেও ভয় লাগত। একরকম গোপন অপরাধবোধ, আবার অদ্ভুত আকর্ষণ। এই টানটা যেন শরীর নয়, নিঃশ্বাসে ঢুকে আছে। সে নিজেকে বোঝাতে চেয়েছিল—এটা কেবল কল্পনা, এটা ক্ষণিকের বৃষ্টি, কোনোদিন ঘর বানাতে চায় না।
কিন্তু যখন আকাশ টিফিন আনতে স্কুলে গেল, স্নিগ্ধা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল গেটের বাইরে। ছেলেদের ভিড় পেরিয়ে হঠাৎ সে দেখল অভিষেক স্কুলের বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই তাকানোটা চোখে নয়—নিখাদ চেনা এক স্পর্শ, যেন চোখের ফাঁকে শরীর গলে তার কাছে এসে পড়ল।
স্নিগ্ধা তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর সরে গেল। চলে যাওয়ার আগে পেছনে একবার তাকাল—অভিষেক দাঁড়িয়ে নেই আর। ও হেঁটে গেছে ভিতরে। কিন্তু তার পদচিহ্ন যেন রেখে গেছে বুকের গভীরে।
সেদিন রাতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সে কড়াইয়ে ডাল নাড়িয়ে দিতে দিতে হঠাৎ অনুভব করল, কেউ যেন তাকে পেছন থেকে দেখছে। সে জানে, কেউ নেই। তবু তার মনে হচ্ছিল—কেউ ওর পিঠের তিলটার দিকে তাকিয়ে আছে। সেইভাবে, যেভাবে কোনও শিল্পী ছবির অবয়ব আঁকে—ধীরে, মন দিয়ে, ভালোবেসে।
রাত আটটার দিকে একটা মেসেজ এল।
“তুমি আজ ফিরেও তাকিয়েছিলে, জানি।”
স্নিগ্ধার গলা শুকিয়ে গেল।
“তোমার চোখ তো আমার দিকেই ছিল।”
“তুমি কি চাও, আমি সবসময় তোমার দিকেই তাকিয়ে থাকি?”
“আমি চাই না। আমি শুধু সহ্য করতে পারি না, তুমি অন্যদিকে তাকাও।”
সেই কথাগুলো এত মধুর ছিল, আবার এত বিষাক্তও। এই অনুভব কি প্রেম? না, নিছক কামনা? সে জানত না। সে শুধু জানত, এমন কেউ তার জীবনে কখনও আসেনি—যে তার নিঃশ্বাসে চোখ রাখে।
সেদিন রাতে স্নিগ্ধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরটা দেখছিল। সে কবে নিজেকে এমন করে দেখেছিল, মনে পড়ে না। শরীরটা শুধু গৃহস্থালির বোঝা ছিল এতদিন। সন্তানের জন্ম, স্বামীর প্রয়োজন, সমাজের নিয়মে বাধা জীবন। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে—তার শরীর একটা নদী। যে নদীর স্রোত বহুদিন আটকে ছিল, কিন্তু অভিষেকের চোখে সে বাঁধ ভেঙে দিয়েছে।
তিন দিন পর অভিষেক ফোন করল। কোনও শব্দ ছিল না শুরুতে। শুধু নিঃশ্বাস। একটা দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাস।
স্নিগ্ধা নিজেই বলল, “কেন ফোন করলে?”
অভিষেক বলল, “তোমার গলার আওয়াজ আমার রাতে দরকার।”
স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
“এই দরকারটা কোথা থেকে এল?”
“সেইদিন, তোমার পিঠে যখন রোদ পড়ছিল, আমি দেখেছিলাম। তারপর থেকে আমি আর চোখ ফেরাতে পারিনি।”
এই স্বীকারোক্তি, এই জোর নেই এমন স্পর্শ—তাকে একধরনের অভ্যন্তরীণ ঝড় এনে দিল। সে আর নিজের মধ্যে থাকতে পারছিল না। ফোনের ওপ্রান্তে অভিষেক বলল,
“তুমি কি একদিন আসবে আমার ঘরে? কিছু না করলেও, তুমি যদি নিঃশ্বাস ফেলো পাশে বসে—আমি তাতেই বাঁচব।”
স্নিগ্ধা বলল না কিছুই। কেবল জানাল, তার চুল আজ খোলা।
সেই রাতে সে স্বামীর পাশে শুয়ে ছিল। রতন ঘুমিয়ে গেছে তাড়াতাড়ি, অফিসের ক্লান্তিতে। কিন্তু স্নিগ্ধার মনে হচ্ছিল, সে একটা ভিন্ন বিছানায় শুয়ে আছে। অভিষেকের গলা, তার নিঃশ্বাস, তার চোখের সেই চুম্বক টান—সব একসাথে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা পথে। সে বুঝতে পারছে না, সে প্রেমে পড়ছে, না প্রেমের নামে নিজের শরীরকে খুঁজে পাচ্ছে।
রাত একটা। একটা মেসেজ।
“তুমি কি এখন ঘুমিয়ে আছো?”
“না। ঘুমের ছদ্মবেশে লুকিয়ে বসে আছি।”
“তাহলে তুমি কি একবার আমাকে মনে করে নিঃশ্বাস ফেলবে?”
“তুমি যদি মন খারাপ করো, আমি নিঃশ্বাসে তোমার নাম জড়িয়ে রাখব।”
স্নিগ্ধা কাঁদছিল না, অথচ মনে হচ্ছিল তার চোখের কোণে জল ভেসে আছে। অভিষেক তাকে কাঁদায় না, সে শুধু তাকিয়ে থাকে, আর সে ভেঙে পড়ে। লুকিয়ে দেখা, লুকিয়ে শ্বাস নেওয়া—এটাই এখন তার সত্যি প্রেম।
সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। স্বপ্ন দেখল, অভিষেক তার পাশে বসে আছে, বলছে,
“তোমার শরীরের ভিতর গল্প আছে। আমি শুধু পাঠ করছি, ছিঁড়ে ফেলছি না।”
স্নিগ্ধা সেই স্বপ্ন থেকে উঠে ফোনটা দেখল। একটা নতুন মেসেজ—
“তোমার শরীরের গন্ধ কি জানো? বৃষ্টির আগের মাটির মতন। যেটা একবার নিলে, ফেলে রাখা যায় না।”
স্নিগ্ধা জানত, সে আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। সে ধীরে-ধীরে, প্রতিদিন একটু-একটু করে তার নিজস্ব সত্যির দিকে এগোচ্ছে। যেখানে প্রেম হয়ত নেই, কিন্তু নিজেকে ভালোবাসা আছে।
***
শরীরের ভিতরে মনের শব্দ থাকে—এ কথা কেউ কোনওদিন বলেনি স্নিগ্ধাকে। ছোটবেলায় জেনেছে, মন মানে আবেগ। শরীর মানে প্রয়োজন। মন বই পড়ে, গান শোনে, কবিতা লেখে। আর শরীর খায়, ঘুমায়, সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু অভিষেক আসার পর এই দুইয়ের ভেদরেখা এমনভাবে মিশে গেল যে সে বুঝতে পারল—এতদিন যা মন বলে জেনেছিল, তার অনেকটাই শরীর থেকে জন্ম নিয়েছে।
স্নিগ্ধা এখন অভিষেকের মেসেজ না পড়েও তার নিশ্বাস চিনতে পারে। একটা শব্দ, একটা দৃষ্টি, একটা নিঃশব্দ আহ্বান—সবকিছু তার শরীরের মধ্য দিয়ে সরে গিয়ে মনের খোলা জানালায় শব্দ ফেলে যায়।
সেদিন রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, স্নিগ্ধা রান্নাঘরের জানালার ধারে বসেছিল। হাতে মোবাইল। অন্ধকার ঘরে মোবাইলের আলোই একমাত্র স্পর্শ।
মেসেজে লেখা—
“তোমার গলায় একটা পিছুটান আছে, আমি শুনি। কোথা থেকে আসে?”
স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে লিখল—
“আমার ভয় হয়। আমি পাপ করছি কিনা ভাবি। আবার ভাবি, নিজেকে বাঁচানো কি পাপ?”
অভিষেক উত্তর দিল না সঙ্গে সঙ্গে। কয়েক মিনিট পর একটা অডিও মেসেজ। সে খুলে শোনে। অভিষেকের কণ্ঠ ধীরে ধীরে বলে—
“পাপ হয়, যখন তুমি নিজেকে মেরে ফেলো। পাপ হয়, যখন নিজের শরীরকে অস্বীকার করো, নিজের চাওয়াকে গিলে ফেলো। আমি তোমায় চাই না শুধু শরীরের জন্য। কিন্তু তোমার শরীর ছাড়া তোমাকে চাওয়াও অসম্পূর্ণ। ঠিক যেমন চোখ ছাড়া গল্প পড়া যায় না।”
স্নিগ্ধা মোবাইলটা বুকের কাছে চেপে ধরে বসে রইল। সে জানত, অভিষেক তাকে কোনও উপহার দেয়নি, কোনও ফুল পাঠায়নি, কিন্তু এই কথাগুলো সে বুকের ভিতর রেখে দিয়েছে। ওগুলোই এখন তার শাড়ির ভাঁজে, চুলের গন্ধে, চায়ের কাপের ধোঁয়ায় গেঁথে আছে।
স্নিগ্ধার মধ্যে একটা বড় রকমের পরিবর্তন আসছে। আগে যে শাড়িটা শুধুই পরার জন্য পরত, এখন সেটাতে অভিষেকের চোখ খোঁজে সে। আগে যে গলা কাটা ব্লাউজটা আয়নার সামনে লুকিয়ে রাখত, এখন সেটাই খুলে পরে। আগে নিজের শরীরের দিকে তাকালে আত্মগ্লানি হতো, এখন শরীরটা একটা রোদের মেঘ হয়ে উঠেছে—আলগা, উড়ন্ত, কামনাময়।
একদিন বিকেলে অভিষেক হঠাৎ মেসেজ করল—
“আজ একটা গল্প লিখেছি, তোমার শরীর নিয়ে।”
“তুমি আমার শরীর চেনো?”
“না। কিন্তু আমি প্রতিদিন তোমার শরীরের স্বপ্ন লিখি, যাতে মন হিংসে করে।”
স্নিগ্ধা চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল, শরীরটা ধীরে ধীরে উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটা গল্প তাকে স্পর্শ করছে যেটা লেখা হয়নি, কিন্তু তার গায়ে লেখা আছে।
সেই রাতেই তার স্বামী রতন বলল, “তুমি এখন অনেক বেশি চুপ করে গেছ। কিসের চিন্তা?”
স্নিগ্ধা কিছু বলল না। ভেতরে তীব্র এক দ্বন্দ্ব। সে এই সংসার ভাঙতে চায় না। সে জানে, অভিষেককে বিয়ে করবে না। কোনও ভবিষ্যৎ নেই এই সম্পর্কে। কিন্তু একটা গভীর ‘বর্তমান’ আছে—যেখানে সে বেঁচে আছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
স্নিগ্ধা রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার শরীর কেমন লাগে তোমার?”
রতন চমকে উঠল। এমন প্রশ্ন ওদের সম্পর্কে কখনো আসেনি।
“মানে?”
“মানে, আমার গায়ের গন্ধ, আমার চোখ, আমার বুক… এগুলো কিছু তোমায় টানে?”
রতন মাথা নাড়ল, “তুমি এসব হঠাৎ জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি তো জানো, আমি তোমায় ভালোবাসি। এসব আলাদা করে ভাবি না।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল। এই ‘আলাদা করে ভাবি না’–এই লাইনটাই তাকে বিছানায় রেখে এসেছে, কামনার বাইরে। অভিষেক প্রতিটি ভাগ আলাদা করে চেনে—গন্ধ, গলার আওয়াজ, নিঃশ্বাসের কাঁপুনি।
রাতে বিছানায় শুয়ে স্নিগ্ধা ফোনে টাইপ করল—
“তুমি যদি আমায় একটানা চুমু খাও, কোথা থেকে শুরু করবে?”
অভিষেক লিখল—
“তোমার কানের পেছনে, যেখানে মগজে শব্দ জন্মায়। তারপর তোমার গলার বাঁদিকে, যেখানে শ্বাস আটকে থাকে। তারপর তোমার পিঠের তিলটা।”
স্নিগ্ধা আর উত্তর দিতে পারল না। ওর শরীর তখন নিজের ভিতরেই কাঁপছিল। নিজের ঠোঁট নিজেই ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছিল সে—আছে তো, অনুভব তো বাঁচিয়ে রেখেছে?
পরদিন, অভিষেক হঠাৎ বলল—
“তুমি যদি একদিন তোমার শরীরটা আমায় পুরোপুরি দাও, আমি সেটা ছিঁড়ে ফেলব না। আমি তাকে গল্প করে তুলব, যাতে তোমার মন বেঁচে যায়।”
স্নিগ্ধা জানত, সে এই মুহূর্তে পড়ে যাচ্ছে এক অতল গভীরতায়। হয়তো ভাঙবে, হয়তো গিল্টি হবে, কিন্তু এই যে শরীরের ফাঁক গলে মনের শব্দ বেরিয়ে আসছে—এই তো বেঁচে থাকা।
***
সকালটা অদ্ভুতভাবে স্নিগ্ধ ছিল। জানালার কাঁচে জল জমে আছে, ছড়িয়ে পড়েছে কুয়াশার মতো। বৃষ্টি হয়নি, অথচ যেন চারপাশ ভিজে। স্নিগ্ধা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ ধরে রেখেছিল, কিন্তু ঠোঁটে তুলছিল না। এই কয়েক দিনে সে শিখে গেছে—এক কাপ চায়ের চেয়েও গভীর হতে পারে অপেক্ষা।
সেই অপেক্ষার মধ্যেই অভিষেকের মেসেজ এসে পৌঁছাল।
“ভেজা জানালার পাশে বসে আছো?”
সে কোনো রিপ্লাই দিল না। হয়তো অভিষেক জানে—স্নিগ্ধার ভিতরের পাতা এখন হাওয়ায় ভিজে আছে। কিছু শব্দ শুকায় না।
স্নিগ্ধা আজ আর স্কুলে যায়নি। আকাশ নিজে গিয়েছিল, তার বাবার সঙ্গে। স্নিগ্ধার শরীরে ক্লান্তি ছিল না, কিন্তু সে জানত—আজ তার দরকার ছিল একান্তে থাকার। এমন একটা দিন, যখন সে নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। নিজের শরীরের স্পর্শ খুঁজতে পারবে, কোনও চাওয়ার চোখের ভয়ে নয়, নিজেকে ছুঁয়ে দেখার সাহসে।
অভিষেক তাকে আগেই জানিয়েছিল—আজ সে শহরের একটা বইয়ের দোকানে থাকবে, এক সাহিত্য সভায়। সকাল থেকে বিকেল অবধি।
“তুমি কি একটু আসবে?”
স্নিগ্ধা শুধু লিখেছিল—
“ভেজা জানালার পাশে বসে কেউ যদি ডাক দেয়, আমি আসব।”
সে আসল। দুপুর একটার সময়, একটা হালকা ধূসর শাড়ি পরে, পিঠে চুল ছড়িয়ে, চোখে kajal ছাড়া। অভিষেকের দেখা সেই মেয়েটির চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন, অনেকটা নরম, আবার অদ্ভুত রকম দারুণ।
দোকানে গিয়েই অভিষেক স্নিগ্ধাকে দেখতে পেল। বইয়ের তাকের ধারে সে দাঁড়িয়ে। একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। অভিষেক ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু বলল না। শুধু তার হাতটা বইয়ের ওপরে রাখল। স্নিগ্ধা চমকে উঠল না। যেন জানত এই ছোঁয়া আসবে।
“এই প্রথম তুমি আমাকে দিনের আলোয় ছুঁলে,” স্নিগ্ধা ফিসফিস করে বলল।
“দিনের আলোয় চোরাও প্রেম লুকিয়ে থাকে না,” অভিষেক বলল, “সে জানালার পাশে বসে থাকে। যেমন তুমি।”
দুজনেই বই কেনার ভান করে কিছুক্ষণ কাটাল। দোকানের পেছনে একটা ছোট্ট রিডিং রুম ছিল—দু’জন চুপ করে সেখানে ঢুকে গেল। রুমটা ফাঁকা ছিল, কাঁচের জানালা ভেজা, আর টেবিলে একটাই চা রাখা। অভিষেক বলল, “বাকি কাপটা তোমার জন্য।”
স্নিগ্ধা বসে পড়ল। অভিষেক ওর মুখের দিকে তাকাল। সেই তাকানো, যা ভেতরটা খুলে দেয়।
“তুমি জানো,” অভিষেক বলল, “তোমার মুখে একটা দাগ আছে, যা কেউ দেখে না। শুধু বৃষ্টির দিনে দেখা যায়।”
স্নিগ্ধা হেসে বলল, “তুমি তো সব কিছু দেখি বলে দাবি করো।”
“তুমি তো নিজেকেও পুরো দেখো না। আমি কেবল আয়নার ধুলোটা মুছে দিই।”
একটা মুহূর্ত এল, যেখানে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। সেই মুহূর্তে অভিষেক ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার আঙুলগুলো ছুঁয়ে দিল। একটুও কাঁপল না স্নিগ্ধা, শুধু চোখ বন্ধ করল।
“তুমি চাইলে এখন চলে যেতে পারো,” অভিষেক বলল।
স্নিগ্ধা চোখ খুলল। বলল, “তুমি কি জানো, এই শহরে কত জানালার পাশে আমি বসে থেকেছি, আর কেউ এসে ছুঁয়ে দেয়নি?”
অভিষেক চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তুমি চাইলে আমি একটানা শুধু তোমার চুল আঁচড়াবো।”
স্নিগ্ধা বলল, “আমি চাই তুমি আমাকে পুরোপুরি ছুঁয়ে দেখো, যতটা দেখে একজন লেখক তার চরিত্রকে ভালোবাসে।”
সেই প্রথম স্পর্শ।
আস্তে আস্তে অভিষেক তার হাত নিয়ে ওর কপালে রাখল। চোখে, চিবুকে, গলায়। তারপর ধীরে পিঠের সেই তিলের কাছে। তার আঙুলে কোনও দাবি ছিল না, ছিল শ্রদ্ধা। স্নিগ্ধা বুঝতে পারল—এই ছোঁয়া শরীরকে টানে, কিন্তু মনকে লুকায় না।
বৃষ্টির জল জানালার কাচে পড়ে টুপটাপ শব্দ করছে। সেই শব্দ যেন ওদের নিঃশ্বাসের তালে মিলিয়ে যাচ্ছে। অভিষেক বলল, “তুমি কি জানো, এই মুহূর্তে আমি তোমার গন্ধ মনে রাখছি। আজ যদি সব কিছু শেষ হয়, আমি শুধু এই গন্ধটা নিয়ে বাঁচতে পারি।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তুমি জানো, আমি যতবার চুল খুলি, ভাবি তুমি পাশে বসে আছো। এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি নিজেই গল্প হয়ে গেছি।”
বাইরে হঠাৎ হালকা রোদের ছায়া পড়ল। জানালার কাচে সেই আলো ছড়িয়ে গেল, ভিজে ছিল যা, সেটাও জ্বলজ্বল করতে লাগল।
অভিষেক বলল, “চলো, বেরিয়ে পড়ি।”
স্নিগ্ধা ধীরে উঠে দাঁড়াল।
চা শেষ হয়নি, গল্পও নয়। কিন্তু তারা জানে—সব কিছু শেষ করতেই হবে না, কিছু গল্পের পরত আলগা রেখে দেওয়া জরুরি।
বেরিয়ে আসার সময় স্নিগ্ধা পেছন ফিরে তাকাল। সেই ভেজা জানালার ধারে চায়ের কাপটা এখনও বসে, যেন কেউ আবার ফিরে আসবে।
ফোনে অভিষেক লিখল—
“আজ তোমাকে নিয়ে বৃষ্টি লিখলাম। তুমি ভিজলে, আমি শুকিয়ে গেলাম।”
স্নিগ্ধা জানত, সে আর আগের মতো নেই। আজ সে নিজের গন্ধে ভিজে, নিজের শরীরটাকে নিজের মতো করে ভালোবাসে।
***
স্নিগ্ধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটে লিপস্টিক ছোঁয়াচ্ছিল, ধীরে, যত্ন করে। আগের মতো আর লুকিয়ে নয়, লজ্জায় নয়, শুধুই নিজের জন্য। প্রতিটি রঙ আজ তার কাছে একেকটা অনুভব। আজ সে নিজের ঠোঁট রাঙিয়ে বেরোবে—কোনও অনুষ্ঠানে নয়, কোনও বাজারে নয়—শুধু অভিষেকের সামনে দাঁড়ানোর জন্য।
তার মনে পড়ে যায়—সেই বিকেলটা। বইয়ের দোকানের পেছনের ঘরে অভিষেক তার আঙুল দিয়ে চুল সরিয়ে কপালে স্পর্শ করেছিল। ঠোঁট অবধি যায়নি সে দিন, যায়নি কারণ হয়তো তারা দু’জনেই জানত—চুমু একবার হয়ে গেলে, শরীর আর নিজের থাকবে না।
কিন্তু শরীর কি তখনও নিজের আছে?
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে স্নিগ্ধা স্বামীর সঙ্গে ডিনার টেবিলে বসেছিল। রতন বলেছিল, “তুমি আজ খুব সুন্দর লাগছো।”
স্নিগ্ধা একটা কৃত্রিম হাসি দিয়েছিল, মাথা নাড়িয়েছিল।
সে বুঝেছিল—রতনের চোখে তার রূপ আজ হঠাৎ করে ধরা দিলেও, অভিষেকের চোখে সে প্রতিদিন এক নতুন রঙে ধরা পড়ে।
রাত এগারোটায় ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠেছিল।
“তোমার ঠোঁটে আজ একটা গল্প জমেছে। পড়তে পারি?”
স্নিগ্ধা উত্তর দিয়েছিল—
“তুমি যদি শব্দ খোঁজো, আমি চুমুতে লিখে দেব।”
সেই রাতেই অভিষেক তাকে প্রথমবার ডাকল নিজের ফ্ল্যাটে। অজুহাত কিছুই ছিল না। কোনো অভিনয়, কোনো আলাদা নাম না। শুধু একটি ছোট্ট টেক্সট—
“আমি জানি, তুমি আসবে না। তবু দরজা খুলে রাখলাম। যদি শরীর ছুঁয়ে না পারো, অন্তত নিঃশ্বাস দিয়ে ফুঁ দিও—এই রাতটা বাঁচে।”
স্নিগ্ধা জানত, সে যাচ্ছে। জানত, সমাজের চোখে এই পদক্ষেপ একটা অপরাধ। জানত, কেউ জানলে তার পায়ের নিচের জমি কাঁপে যাবে। কিন্তু সে এটাও জানত—প্রেম যদি নিঃশ্বাসের মতো হয়, তাকে আটকে রাখা যায় না।
ফ্ল্যাটটা ছোট। জানালা খোলা, হালকা হাওয়া ঢুকছে। অভিষেক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু বলেনি। স্নিগ্ধা ঢুকেই ধীরে দরজাটা টেনে দিল। শব্দ হয়নি। কেবল নিঃশব্দে একটা ‘আমি এসেছি’ লেখা থাকল ঘরের বাতাসে।
অভিষেক তার দিকে এগিয়ে এল। স্নিগ্ধার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখ ছিল স্থির। অভিষেক তার কানের পাশে এসে বলল,
“আমি চাই না তুমি ভয় পাও। আমি শুধু চাই, তুমি চাও।”
স্নিগ্ধা বলল, “আমার ভিতরে এতদিন যা লুকিয়ে ছিল, সেটা আজ ঠোঁট দিয়ে বলে দিতে চাই।”
তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে গেল—ধীরে, যেন শব্দ ছুঁয়ে ফেলার ভয়। অভিষেক প্রথমে তার কপালে একটা চুমু খেল, তারপর নাকের পাশে, গালের কোণে, গলার ভাঁজে। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করল।
তাদের চুমুটা উচ্চারণ ছিল না, ছিল বোঝাপড়া। ছিল সেই সব দিনের প্রতিবাদ, যেদিন শরীর শুধু কর্তব্য পালন করেছে, চাওয়া নয়। ছিল সেই একাকীত্বের উত্তর, যেখানে রতনের পাশে থেকেও সে নিজেকে ফাঁকা মনে করত।
অভিষেকের ঠোঁট তার ঠোঁটে ছুঁয়ে গেল—কোনো জোর নেই, কোনো দাবি নেই। ছিল শুধু একটা অনুরোধ—“আমাকে বিশ্বাস করো। আমাকে তোমার মতো হতে দাও।”
স্নিগ্ধা জানে, সেই চুমুতে সে নিজেকে অস্বীকার করেনি, বরং ফিরিয়ে পেয়েছে। এ চুমু ছিল না কোনো নিষিদ্ধ কাজ, ছিল তার আত্মার সিগনেচার। এত বছর পর সে প্রথমবার বুঝতে পারল—শরীরও মনকে ভালোবাসতে পারে।
চুমুর পর তারা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। অভিষেক তার হাত ধরে বলেছিল,
“তুমি যদি এখন চলে যাও, আমি জানব, তুমি এসেছিলে। আমি বেঁচে যাব।”
স্নিগ্ধা বলেছিল,
“তুমি আমার ঠোঁট ছুঁয়েছো, তাতে আমার আত্মা জেগে উঠেছে। তুমি আমাকে শুয়ে পড়তে বলোনি, তুমি আমাকে বাঁচতে বলেছো।”
সেই রাতে তারা একসঙ্গে কিছুই করেনি, শুধু একে অপরকে চুমু খেয়েছে—বুকে, কপালে, কানের পাশে, আঙুলের ফাঁকে। শরীরের সব ফাঁক থেকে এক এক করে বেরিয়ে এসেছে বছরের পর বছর জমে থাকা চুপচাপ মনের শব্দ।
রাতে ঘরে ফিরে স্নিগ্ধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেখল। একটু লাল, একটু আলগা, একটু অন্যরকম। কিন্তু নিজের মনে হলো না, সে অপরাধ করেছে। মনে হলো, সে একটা গভীর সত্যির দিকে হেঁটেছে, যেখানে শরীর শুধু শরীর নয়—প্রেমের কবিতা।
ফোনটা বেজে উঠল।
“আমি তোমায় ছুঁয়েছি, কিন্তু দাগ রাখিনি। কারণ তুমি দাগ দিয়ে তৈরি নও, তুমি নিজের ইচ্ছের ফসল।”
স্নিগ্ধা লিখল—
“আমার চুমুতে দোষ ছিল না। দোষ ছিল না তোমার ঠোঁটেও। দোষ ছিল শুধুই সমাজের চোখে, যা চায় চেয়ে থাকি, কিন্তু না ছুঁই।”
সেই রাতের পর থেকে স্নিগ্ধা আর আগের মতো ছিল না। তার হাঁটার ভঙ্গি পাল্টে গিয়েছিল, তার চোখে ছায়া আর আলো একসাথে খেলত। এখন তার চুলে অভিষেকের আঙুল ঘুমিয়ে থাকত, তার ঠোঁটে থেকে যেত একটা অসমাপ্ত লাইন—যা লিখে শেষ করা যায় না, কেবল চুমু দিয়ে বোঝানো যায়।
***
সকালের আলোটা ছিল অন্যরকম। সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু জানালার কাচে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে যেন ধোঁয়ায় মেশা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা বসেছিল তার পড়ার ঘরে, টেবিলের উপর হাত রেখে চুপ করে। অভিষেকের ছোঁয়ার পর থেকে তার শরীরে আর কিছুই আগের মতো লাগছিল না। বিছানা শুধু শোওয়ার জায়গা নয়, এখন সেটা একটা অভিজ্ঞতা। এবং তার চেয়েও বেশি—সেটা একটা স্মৃতি।
কিন্তু আজকের সকালটা কেমন যেন বেসুরো। স্নিগ্ধা জানত না ঠিক কী হচ্ছে। তার ভিতরে যেন একটা নরম কিন্তু স্পষ্ট কান্না জমে আছে। কারণ, অভিষেক চিঠির মতো তাকে পড়েছে—নিঃশব্দ, ধৈর্য ধরে, কিন্তু চিঠি তো একদিন পড়ে রাখা হয়।
রাতে, বিছানায় যখন রতন পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছিল, তখন স্নিগ্ধার মনে হচ্ছিল—এই বিছানার গায়ে আর তার গন্ধ নেই। অথচ অভিষেকের সেই ছোট্ট সোফার গায়ে এখনও তার চুলের ছোঁয়া লেগে আছে। স্নিগ্ধা শুয়ে শুয়ে ভেবেছিল—বিছানার ভিতর যা ঘটে, সেটা হয়তো শরীরের কাজ। কিন্তু বিছানার বাইরে যা ঘটে—সেই চুমু, সেই চোখে চোখ রাখা, সেই নীরব হাসি—সেগুলোই আসলে প্রেম।
সেদিন সকালেই অভিষেক হঠাৎ মেসেজ করল না। কোনও শব্দ, কোনও ইমোজি, কিছুই না। স্নিগ্ধা মোবাইল খুলে কয়েকবার চেক করল। বারবার। তারপর জানালা খুলে দিল, ভাবল, বাতাস যদি মনের চাপ সরিয়ে দেয়। কিন্তু চাপটা কেবল বাড়ছিল।
সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ফোন করল। রিং গেল। অভিষেক ধরল না।
আবার করল। এবার ধরল।
“তুমি চুপ কেন?”—স্নিগ্ধা বলল, গলা ভারী ছিল।
অভিষেক বলল, “আমি ভয় পেয়েছি।”
“কিসের ভয়?”
“তোমায় হারিয়ে ফেলার। তোমাকে এতখানি ছুঁয়ে ফেলেছি, এখন যদি তুমি চলে যাও, আমি আর কোনওদিন কোনও মেয়ের ঠোঁটে বিশ্বাস করতে পারব না।”
স্নিগ্ধা চুপ করে ছিল। তারপর বলল, “আমি আসব। কিন্তু আজ আর কিছু নয়। আজ শুধু হাত ধরব। আজ শুধু জিজ্ঞেস করব—তুমি কি আমায় মানুষ হিসেবে দেখো, না শরীর হিসেবে?”
অভিষেক বলল, “তুমি আমার ভিতরের আয়না। যেখানে আমি নিজেকে স্পষ্ট দেখি। আমার দৃষ্টি শুধু তোমার গায়ের রেখায় থামে না, তোমার দম আটকানো নিঃশ্বাসে থামে।”
স্নিগ্ধা জানত, এই কথাগুলোই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু একবার, একটিবারও যদি অভিষেক শুধু শরীর চাইত—তবে হয়তো এই গল্প এত দূর আসত না।
সেদিন দুপুরে তারা পার্কে দেখা করল। একদম লোকচক্ষুর আড়ালে, একটা গাছের ছায়ায়। অভিষেক একটা ছোট্ট নোটবুক বের করল।
“তোমার শরীর নিয়ে কিছু লিখেছি।”
স্নিগ্ধা বলল, “এই নিয়ে তো অনেক কিছু লিখেছ।”
“না, আজ অন্যরকম।”
সে পড়ে শোনাল—
“তোমার পিঠে যেই তিলটা আছে, সেখানে আমি প্রতিদিন একটি শব্দ রেখে আসি—‘থাকো’।
তোমার পায়ের পাতায় আমি লিখি—‘চলো’।
তোমার কপালে ছুঁয়ে বলি—‘থেমো না’।
তোমার ঠোঁটে আমি কেবল নিঃশব্দে বলি—‘আমি চাই’।”
স্নিগ্ধা শুনে থেমে গেল। সে জানত, এই লেখা শুধু চিত্রনাট্য নয়, এই লেখা সে নিজে। সে এই লেখার পাতা। সেই সন্ধ্যায় সে অভিষেককে বলল,
“তুমি আমার ভিতর যা খোঁজো, সেটা যদি আর কেউ খোঁজে, আমি তার চোখ ফুঁড়ে দেব।”
অভিষেক হেসে বলল, “আমি তো চাই তুমি অন্য কারো চোখেই না তাকাও।”
“তুমি জানো, আমি এখন আর তাকাইও না। আমার চোখ শুধু শুনে, দেখে না।”
রাতে স্নিগ্ধা বিছানায় শুয়ে আবার সেই পুরোনো ভাবনায় ফিরে গেল। রতন ঘুমিয়ে ছিল পাশে, নাক ডেকে। ছেলের হাত ধরে পাশের ঘরে মা ঘুমোচ্ছিল। অথচ এই একটা মানুষ, এই এক শরীর, এই এক নিঃশ্বাস যেন দিনের শেষে শুধুই অন্য কারোর জন্য।
সেই রাতে স্নিগ্ধা ফোনে টাইপ করল—
“আমি তোমার বিছানায় থাকিনি, কিন্তু তোমার প্রতিটি স্পর্শে থাকি। আমার জন্য নতুন কোনও চাদর কিনো না। আমি যে চুপচাপ গায়ে লেগে থাকি, সেটা কোনো চাদরেই মুছে যাবে না।”
অভিষেক উত্তর দিল—
“তুমি আমার শরীরের বাইরের প্রেম। তুমি বিছানার আগে-পরে-ওপর-নীচের সমস্ত সময়। তুমি গল্প না, তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে মাথায় রাখা হাত।”
স্নিগ্ধা জানত, প্রেম শুধু চুমুতে শেষ হয় না। প্রেম হয়তো চুমু দিয়ে শুরু হলেও, শেষ হয় একটা ভেতরকার বিশ্বাসে—যেখানে একটা মানুষ, আরেকটা মানুষের নিঃশব্দ ভালোবাসায় শরীরের বাইরেও টিকে থাকে।
***
স্নিগ্ধার মাথায় আজকাল একটা জিনিস ঘুরপাক খায়—রাতের ঘুম। সে ঘুমোয়, ঠিকই। বিছানায় যায়, চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাস নেয়। রতন পাশে থাকে, কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে তার হাত স্নিগ্ধার পিঠ ছুঁয়ে যায়, কিন্তু সেই স্পর্শে কোনো ভাষা নেই। যেন আলোর সুইচ টিপে দেওয়া, একটিবার ছুঁয়ে দেখা, তারপর নিজের ঘরে ফেরত যাওয়া।
কিন্তু সেই শরীরের পাশে যে নামটা শুয়ে থাকে—তা রতন জানে না।
স্নিগ্ধার মনে হয়, প্রতিদিন রাতে তার পাশে কেউ একজন আসে—ধূসর চোখে, ধীরে নিঃশ্বাস নেয়, তার চুলের মধ্যে আঙুল চালায়। সেই মানুষটার নাম অভিষেক। এবং সেই নামটাই এখন তার শরীরের ভিতরে গেঁথে গেছে। বিছানায় যতবার সে চোখ বন্ধ করে, অভিষেক এসে দাঁড়ায় তার কপালে।
সেদিন সন্ধ্যায় অভিষেক লিখেছিল—
“তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন তোমার শরীরকে একটা নতুন নামে ডাকি?”
“নাম রাখো কেন?”
“কারণ প্রতিদিন তুমি নতুন লাগো। কখনও জলরঙা গল্প, কখনও আগুনের পালক। আমি যদি তোমাকে এক নামে বাঁধি, তোমার রূপ বদলে যাবে।”
স্নিগ্ধা জানে, এই লেখাগুলো প্রেম নয়। এগুলো প্রেমের আগের সময়। যেখানে শরীর একটা চিঠি, মন একটা খাম। এবং প্রেম ঠিক তখনই হয়, যখন কেউ ছিঁড়ে না ফেলে, ভাঁজ করে রেখে দেয়।
রাত দশটা নাগাদ রতন তার পাশে এসে বসেছিল। বলল, “আজ তোমার গায়ের গন্ধ কেমন অন্যরকম।”
স্নিগ্ধা চমকে গিয়েছিল। কাঁপেনি, কিন্তু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সে বলল, “ভালো লাগছে?”
রতন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, কিন্তু যেন অন্য কারো মতো লাগছে।”
স্নিগ্ধা হেসে বলল, “আমার তো গন্ধ বদলায়নি। বদলেছে হয়তো তোমার চোখ।”
সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধা বুঝে গিয়েছিল—রতনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা এখন আর প্রেম নয়, এটা অভ্যাস। এবং অভ্যাস ভাঙে না, শুধু অন্য কিছু এসে জায়গা নিয়ে নেয়।
সেই রাতে সে অভিষেককে লিখল—
“আজ আমি স্বামীর পাশে শুয়ে ছিলাম, কিন্তু নামটা তোমার ছিল। তুমি ছিলে আমার পায়ের তলায়, ঠোঁটের ফাঁকে, বুকের ভাঁজে।”
অভিষেক লিখল—
“আমি তোমার পাশে নেই, কিন্তু ভিতরে আছি। তুমি যদি চোখ বন্ধ করো, আমি নিঃশ্বাসে এসে দাঁড়াব।”
স্নিগ্ধার মনে হচ্ছিল—প্রেম হয়তো এখন আর ফুল দেওয়া বা কবিতা লেখা নয়। প্রেম এখন কারো কাছে নিজের নাম গোপন রাখা। যে নাম সমাজ জানে না, কিন্তু মন জানে। শরীর জানে।
পরদিন সকালে রতন বলল, “চলো কোথাও বেড়াতে যাই কয়েকদিন, কাশ্মীর বা দার্জিলিং।”
স্নিগ্ধা একবার থমকে গিয়েছিল। সে জানত, সেই বেড়ানোয় তার মন যাবে না, শুধু শরীর যাবে। এবং সেই শরীরটাও এখন অন্য কেউ পড়ে নিচ্ছে প্রতিদিন।
সে বলল, “তুমি একা যাও। আকাশের পরীক্ষা আসছে। আমি থাকব।”
রতন মাথা নেড়ে চলে গেল। তাতে কোনো অভিমান ছিল না, শুধু ক্লান্তি ছিল।
সেদিন দুপুরে স্নিগ্ধা অভিষেকের ফ্ল্যাটে গেল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে অভিষেক ওকে জড়িয়ে ধরল না, চুমু খেল না। শুধু বলল, “তুমি কেমন আছো?”
স্নিগ্ধা বলল, “আজ আমার ভিতরের নামটা অন্যরকম। তুমি কি তা শুনতে পারো?”
অভিষেক বলল, “আমি শুধু তোমার ভিতরের দরজায় কান পেতে থাকি। যেখানে তোমার স্বামীর পাশে তুমি শুয়ে থাকো, আর আমার নামটা তোমার বুকের নিচে চাপা পড়ে।”
সেদিন ওরা একে অপরকে কিছুই দেয়নি। শুধু বসে থেকেছিল। চুপ করে। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখেছিল। অভিষেক স্নিগ্ধার হাতের তালুতে একটা শব্দ লিখেছিল—“আমার।”
স্নিগ্ধা বলেছিল, “তুমি কি আমারও গোপন নাম?”
অভিষেক বলেছিল, “আমি সেই নাম, যেটা রাতে বিছানায় ফিসফিস করে বলো, আর সকালে ভুলে যাও না।”
সেই রাতে স্নিগ্ধা রতনের পাশে শুয়ে ছিল। জানালা খোলা ছিল। বাইরে বৃষ্টির গন্ধ, ভিতরে নিঃশব্দ শরীর। সে চোখ বন্ধ করল। ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল—“তুমি আজ আমার নামেই ঘুমাবে।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল।
সে জানত, স্বামীর পাশে যে শরীর শুয়ে থাকে, তার নাম স্নিগ্ধা। কিন্তু যেই নামটা আজকাল ওর ঠোঁটে এসে থামে—সেই নামটা কেউ জানে না।
সেই নাম এখন শুধু একজন জানে—যে বিছানার পাশে নয়, ভিতরে নেই, কিন্তু গায়ের গন্ধে মিশে থাকে।
***
চিঠির মতো করে লেখা ছিল কথাগুলো। কাগজে নয়, খামে নয়—তার শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে। কপালের পাশে লেখা ছিল “চাওয়া”, গলার বাঁকে লেখা ছিল “দোষ”, আর বুকের মাঝখানে—”আমিই তো লিখেছিলাম!”
স্নিগ্ধা মাঝে মাঝে নিজেকে চিঠি ভেবে দেখে। মনে হয়, কেউ তাকে ছিঁড়ে ফেলে পড়েছে, আবার কেউ ভাঁজ করে তুলে রেখেছে। কেউ চুমু খেয়েছে তার খামের ওপর, আবার কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে না খোলার আগেই।
এই যে শরীরের ভিতর পাপ জন্ম নেয়, সেই পাপ কার জন্য? সমাজের চোখে না কি নিজের দৃষ্টিতে? স্নিগ্ধা বুঝতে পারেনি। সে কেবল অনুভব করেছিল—প্রতিটি চুমু একটা শব্দ, আর প্রতিটি নিঃশ্বাস একটা চিঠি, যা সে নিজেকে লিখেছে, অভিষেকের নামে পাঠিয়েছে।
সেদিন সকালে সে হঠাৎ একটা পুরোনো স্যুটকেস খুলে দেখছিল, যেটা আলমারির নিচে বহুদিন ধরে ধুলো পড়ে ছিল। ভিতরে পাওয়া গেল একটা ছোট্ট ডায়েরি, কলেজ জীবনের। তাতে লেখা ছিল, “আমি এমন কাউকে চাই, যে শুধু আমার শরীর না, আমার চুপ থাকা কষ্টগুলোও ছুঁতে পারবে।”
সেই মুহূর্তে ওর মনে পড়ল—অভিষেককে চেনার অনেক আগে থেকেই সে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। অভিষেক শুধু এসে সেই শূন্য নামটা পূর্ণ করেছে।
দুপুরবেলা, অভিষেক একটা ছবি পাঠাল। একটা খোলা খাম, ভিতরে কিছু লেখা নেই। শুধু নিচে লেখা—“তোমার শরীরটাই আমার চিঠি। আর আমি প্রতিদিন তোমার ভাঁজে ভাঁজে কবিতা রাখি।”
স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছিল, বুকের নিচে কিছু কাঁপছে। সে উত্তর দিল—
“আমি পাপ করেছি হয়তো। কিন্তু সেই পাপ তুমি লিখে দিলে প্রেম হয়ে গেছে।”
অভিষেক জবাব দিল না। কেবল একটা ভয় জেগে উঠল স্নিগ্ধার ভিতরে—এই পাপ কি কোনোদিন প্রকাশ পাবে? কেউ কি কখনও এই চিঠিগুলো পড়ে ফেলবে, যেগুলো সে মনে মনে লিখেছে, ঠোঁটের নিচে রেখেছে?
সেই রাতে রতন হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কিছু লুকোচ্ছ?”
স্নিগ্ধা থমকে গেল। মাথা নাড়ল, “না তো।”
রতন বলল, “তোমার চোখে আজকাল অনেক কথা জমে থাকে। যেগুলো আমি পড়তে পারি না।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল। কেমন একটা বিষাক্ত হাসি। বলল,
“তুমি তো কোনওদিন পড়ার চেষ্টা করোনি।”
রতন চুপ করে গেল।
সেই রাতে স্নিগ্ধা চুপচাপ নিজের ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল। মনে হচ্ছিল, সেখানে এখনও অভিষেকের চুমু রয়ে গেছে। সে জানে, ওই চুমু শুধু শরীরের ছিল না, ছিল চিঠির মতো—যা কেউ খামে ভরে ভালোবেসে পাঠিয়েছিল।
রাতে অভিষেক লিখল—
“তুমি কি জানো, আমি তোমার শরীরকে একবার ছুঁয়ে তারপর দু’দিন কিছু লিখতে পারি না। যেন আমার শব্দ ফুরিয়ে যায়।”
স্নিগ্ধা লিখল—
“আমার শরীর যদি তোমার কবিতা হয়, তবে তুমি সেই কবি, যে পাপের মধ্যেও প্রেম খুঁজে নেয়।”
পরদিন সকালে সে এক খোলা খাম নিল। ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট রাখল—
“তুমি আমাকে যেভাবে ছুঁয়েছ, কেউ কোনোদিন ছোঁয়েনি। এই পাপ আমি নিজের হাতে লিখেছি।”
সেটা সে অভিষেককে পাঠায়নি। নিজের আলমারির ভিতরে রেখে দিল। যেন কোনোদিন কেউ খুঁজে পেলেও, বুঝতে পারে—এই পাপের চিঠি লেখা হয়েছিল চুপ করে, কিন্তু প্রেমে ডুবে।
***
স্নিগ্ধা আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে ঠিক যেন প্রথমবার। কপালের টিপটা আজ একটু বাঁদিকে সরে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো নয়, কিন্তু সাবধানে বাঁধাও না। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত স্থিরতা—যেটা কেউ বাইরে থেকে দেখলে বলবে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু ভেতরে জানে সে—এটা আসলে আত্মসমর্পণ।
ঘরটা নিঃশব্দ। রতন সকালে বেরিয়ে গেছে অফিসে। ছেলেটা স্কুলে। চারপাশ নিঃশব্দে ভরে আছে অভিষেকের ছোঁয়া না থাকা সত্ত্বেও উপস্থিতিতে।
ফোনে আজ মেসেজ নেই। অভিষেক আজ লেখেনি—কোনো নতুন শব্দ, কোনো চুমুর ব্যাকরণ, কোনো শরীরঘেঁষা কবিতা। কিন্তু তার অভাব স্নিগ্ধার গায়ে লেগে আছে—একটা গন্ধের মতো, যেটা ধোয়া গেলেও চলে না।
স্নিগ্ধা ধীরে আয়নার সামনে বসে পড়ল। তার মনে হলো, আয়নাটা আজ কথা বলছে।
“তুমি কি জানো, তুমি আর আগের সেই নারী নও? যাকে শুধুই দায়িত্ব, দাম্পত্য আর ত্যাগের গন্ধে চেনা যেত?”
সে চুপ।
“তুমি এখন সেই নারী, যে নিজের নাম জানে, নিজের গন্ধ চিনে, নিজের ঠোঁটে চুমুর মানে বোঝে।”
আয়না যেন ফিসফিস করে বলল, “তুমি তাকে ভালোবেসেছিলে?”
স্নিগ্ধা ধীরে মাথা নাড়ল।
“ভালোবাসিনি। আমি তাকে চেয়েছিলাম। গভীরভাবে। চাওয়া মানেই ভালোবাসা নয়। কিন্তু চাওয়া মানেই জীবিত থাকা।”
সেই মুহূর্তে ফোনে একটা নোটিফিকেশন এল। অভিষেকের মেসেজ।
“তুমি কি জানো, আয়নার সামনে দাঁড়ালে, আমি ভিতর থেকে ডাকি? আমি তোমার আয়নার প্রতিচ্ছবিতে বাস করি এখন।”
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল।
“তুমি কি চাও, আমি সব ভেঙে ফেলি? সংসার, সমাজ, এই নামের দেয়াল?”
“না। আমি চাই না তুমি ভাঙো। আমি চাই তুমি থেকো। ঠিক যেমন আছো। আমি জানি, তুমি আমার কাছে আসবে না। তবু আমি তোমার মধ্যে রয়ে যাব।”
স্নিগ্ধার গলা ভার হয়ে এল।
সে লিখল—
“তুমি জানো, আমি তোমার শরীরে শেষবার ঠোঁট রাখার পর থেকে, আর কাউকে চুমু খেতে পারিনি। কারণ, আমি জানি, তুমিই ছিলে আমার শেষ ছোঁয়া।”
অভিষেক জবাব দিল—
“আমি এখনো তোমার আয়নার ওপার থেকে ডাক দিই। কিন্তু আজ আর তুমি তাকাও না। কারণ তুমি জানো, আমার চুমুতে কোনো দোষ ছিল না। দোষ ছিল সেই সমাজে, যারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরই চিনতে শেখেনি।”
স্নিগ্ধা ফোনটা নামিয়ে রাখল। মাথা উঁচু করে আয়নার দিকে তাকাল।
নিজের চোখে আজ যেন একটা অন্যরকম ঝিলিক। প্রেম না, অপরাধ না—এই চোখে আছে অভিজ্ঞতা, গভীরতা, আর এমন এক মুক্তি, যা কেউ দেয়নি, শুধু এক অপরিচিত যুবক তার শরীরের ভিতর থেকে খুলে দিয়েছিল।
ঘরের কোণায় বাতাসে একটা চুমুর মতো কিছু উড়ে বেড়াচ্ছে। অদৃশ্য, কিন্তু জ্বলে ওঠে, প্রতিবার যখন সে আয়নায় নিজেকে দেখে।
স্নিগ্ধা জানে—এই গল্পটা সমাজের গল্প নয়। এই গল্পটা একজন নারীর গল্প, যে নিজের শরীরটাকে চিঠি বানিয়ে পাঠিয়েছিল তার প্রয়োজনের ঠিকানায়। সেও জানে, সেই চিঠির উত্তর আসবে না। কিন্তু সেই চিঠি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সেই আয়নার ওপার থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ ডাকবে—
“তুমি আছো তো?”
আর সে চুপ করে বলবে,
“হ্যাঁ, আমি আছি। তোমার শরীরে নয়, কিন্তু তোমার ভিতরকার স্তব্ধতা জুড়ে।”
সে জানে, ভালোবাসা চাইলেই পাওয়া যায় না। আবার হারালেও ফুরোয় না।
ভালোবাসা যেন আয়নার মতো—যে যত দেখবে, তত নিজের মধ্যেই হারিয়ে যাবে।
[সমাপ্ত]




