রূপক চক্রবর্তী
এক
শহরের ভেতরে থেকেও কিছু মানুষ থাকে সময়ের বাইরে। অম্বরীশ সেন ছিল তেমনই একজন। তার সহপাঠীরা যখন উচ্চতর গবেষণার জন্য বিদেশে পাড়ি দিচ্ছিল, বা চাকরির খোঁজে দৌড়াচ্ছিল কর্পোরেট কারিডোরে, তখন অম্বরীশ দিনের পর দিন পড়ে থাকত কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের “তরুণ ভারতী গ্রন্থাগার”-এর প্রাচীন, ধূলিধুসর কক্ষে। সে যেসব বই পড়ত, তা বহু আগেই মানুষের স্মৃতির বাইরের জিনিস। হাতে লেখা পুঁথি, ঘুনধরা পাতায় সাঁটানো লাল কালি, শিরোনামে এমনসব শব্দ যা উচ্চারণ করলেই শিরদাঁড়া দিয়ে কাঁপুনি নামে—“অগ্নিতত্ত্ব বেদ”, “মৃত্যুজয় তন্ত্র”, “ভূতকারিক রচনাবলী”। এমনই এক বর্ষার সন্ধ্যায়, কড়কড়ে বিদ্যুৎ-ছিন্ন আকাশের নিচে বসে সে খুঁজে পায় তার ঠাকুরদার রেখে যাওয়া এক পাণ্ডুলিপি—চামড়ার মলাটে বাঁধা, নামহীন, নির্জনতা-বিহ্বল এক বই। বইয়ের প্রথম পাতায় কেবল লেখা ছিল—“পঞ্চতত্ত্ব আমার রক্তে, তাই আমার মৃত্যু ছিল অসমাপ্ত।” অম্বরীশ জানত, তার ঠাকুরদা বিভূতিভূষণ সেন ছিলেন এক নিভৃত সাধক, যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে জনসম্মুখ থেকে হারিয়ে যান হঠাৎ, এবং পঁচিশ বছর পর তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় হিমালয়ের এক গুহায়। পরিবারের কেউ কখনও এ বিষয়ে কথা বলত না। কিন্তু আজ, সেই রহস্যময় পাণ্ডুলিপি তার সামনে খোলা, আর প্রতিটি পাতার লেখা যেন অম্বরীশের ভেতরের ঘুমন্ত কোনো বোধকে জাগিয়ে তুলছিল। বইয়ের মধ্যে আঁকা ছিল পাঁচটি চক্র—পৃথিবী, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ—যা ঘিরে ছিল পাঁচটি প্রতীক, এবং তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি চোখ, যা যেন তাকিয়ে ছিল অম্বরীশের আত্মার গভীরে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ অম্বরীশের জীবন এক অদ্ভুত নিয়মে বাঁধা পড়ে। সে খেতে ভুলে যায়, ঘুমাতে ভুলে যায়। পাণ্ডুলিপির প্রতিটি বাক্য যেন একেকটি ধাঁধা, আর প্রতিটি ধাঁধার মধ্যে ছিল এক দিশানির্দেশ। প্রথম নির্দেশ ছিল—“বেদিনাথ ঘাটে রক্তজবা ফুটলে, যে জল পিছু ডাকে, সে তোর প্রাচীন পথপ্রদর্শক।” সে পাড়ি জমায় বেনারস, গঙ্গার তীরে বসে থাকা প্রাচীন শহর যেখানে ধর্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে সময় স্থির হয়ে যায়। বেদিনাথ ঘাটে পৌঁছেই সে দেখতে পায় এক বৃদ্ধ ফকির, চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, সামনে রাখা একটি রক্তজবা, এবং তার পিছনে নদীর টান। ফকির হঠাৎ চোখ খুলে বলে ওঠেন, “তোকে অনেক আগেই ডাকা হয়েছিল, তুই দেরি করেছিস।” আতঙ্কিত অম্বরীশ ফকিরের দিকে এগিয়ে গেলে তিনি কেবল একটি বাক্য বলেন, “জল খুঁজিস না, আগে মাটি বুঝে আয়।” সেই রাতে, গঙ্গার ধারেই এক তক্তপোষে অম্বরীশের ঘুম আসে না। গঙ্গার শব্দের ভেতর, বাতাসে, আর শহরের ঘুমন্ত ছায়ায় সে যেন টের পায় একটি টান, একটি প্রাচীন আহ্বান, যা তার রক্তের মধ্যে ঘুরছে বহু যুগ ধরে। পরদিন সকালে তার সঙ্গে দেখা হয় তাপ্তি মিশ্রর, একজন প্রথিতযশা নৃতত্ত্ববিদ যিনি তন্ত্র ও লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করছেন। অম্বরীশের হাতে ধরা পাণ্ডুলিপি দেখে তাপ্তির চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়। তিনি বলেন, “এই রচনাটা আমি মাত্র দু’বার শুনেছি, একবার অন্ধ্রের এক জাদুঘরে, আরেকবার এক মৃত সাধুর মুখে। কিন্তু কেউ কোনোদিন এটাকে চোখে দেখেনি!” দুজনের আলোচনা গড়ায় গভীর রাতে। অম্বরীশ বুঝতে পারে, তার যাত্রা একা নয়—তাপ্তি তার পথের সহযাত্রী হতে চলেছেন, যদিও তিনি তন্ত্রে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে আকর্ষণ করে।
তৃতীয় সপ্তাহে, তাদের পথ চলে বেনারস থেকে বহুদূরে, বিহারের সীমান্তবর্তী গিরিখাদ অঞ্চলের দিকে, যেখানে একটি পুরাতন মঠের ধ্বংসাবশেষে লুকিয়ে আছে “ভূধারিণী”-র দ্বার। পথ দুর্গম, পাহাড়ি, এবং অন্ধকারে ঢাকা। চলতে চলতে তাপ্তি প্রশ্ন তোলে, “তুমি নিশ্চিত এই পথেই যাবে? এই যে পাঁচটি ত্যাগের কথা পাণ্ডুলিপিতে লেখা, তুমি কি জানো কাদের ত্যাগ দিতে হবে?” অম্বরীশ চুপ থাকে। তার মনে পড়ে ঠাকুরদার একটি নোট, যেখানে লেখা ছিল, “যত এগোবে, নিজেকেই ছাড়তে হবে পেছনে।” এই অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, তারা পৌঁছায় সেই গুহামুখে—চারপাশে ছড়িয়ে মাটি, শিকড়, জংলা গন্ধ। হঠাৎ ঝড় উঠে, আর মাটির গভীর থেকে এক কণ্ঠ ভেসে আসে—“তুই কে, যে নিজেকে ধরতে এসেছে?” তাপ্তি চমকে ওঠে, কিন্তু অম্বরীশ এগিয়ে যায়, যেন বহু জন্ম আগের কোনো কথা মনে পড়ে গেছে। গুহার ভিতর থেকে উঠে আসে এক শতবর্ষীয় বৃদ্ধা—তার গা ভর্তি শৈবালী, চোখ মাটির রঙের মতো ধূসর, আর ঠোঁটের কোণে এক কুৎসিত অথচ স্মিত হাসি। তিনি বলেন, “ভূমি তোকে ডাকছে, ছেলেটা। প্রথম ত্যাগ কর, তারপর ভিতরে আসিস।”
দুই
জঙ্গলের ঘন সবুজ আর শিকড়ে ছাওয়া গুহামুখ যেন পৃথিবীরই মুখ, যা চুপচাপ গিলে নেয় সব প্রশ্ন, সব শব্দ। অম্বরীশ গুহার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করল, তার পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠছে সামান্য, যেন এই ধরণী নিজেই জানে—তার একজন সাধক এসেছে। পাশে তাপ্তি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, তার চোখে মিশে আছে কৌতূহল ও ভয়। গুহার প্রবেশমুখে অদ্ভুত গন্ধ—ভেজা মাটির, নোনা শিকড়ের, আর যেন গন্ধের মধ্যেই কোনো চিরকালীন স্মৃতি। ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই অম্বরীশ অনুভব করে, বাইরের সময় এখানে ঢোকার অধিকার রাখে না। ভিতরের দেয়ালজুড়ে লতা, ছত্রাক, আর অলক্ষ্যে ঝুলে থাকা শেকড়ের সুর যেন এক তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে অবিরাম। ঠিক তখনই অন্ধকারের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে সেই বৃদ্ধা—ভূধারিণী। তাঁর শরীর কেবল মাটি ও শিকড়ে গঠিত নয়, তাঁর দেহ যেন মাটির স্তর—একটা সময়ে মানুষের মাংস ছিল, এখন তা ধীরে ধীরে ধরণীতে মিশে যাচ্ছে। তাঁর হাঁটার শব্দ মাটির গড়গড়ানি, তাঁর কণ্ঠে নেই কোনো উত্তেজনা, কেবল এক অবিচল গভীরতা। তিনি বলেন, “তুই তো জানিস না মাটি কাকে বলে। শুধু গড়ে তোলার ক্ষমতা থাকলেই মাটি জয় করা যায় না, তাকে ধারণ করতে হয়। তুই এখনো ধারণ করিস নিজের অহং, নিজের স্মৃতি, নিজের রক্তের সম্পর্ক। ত্যাগ কর।” অম্বরীশ বুঝতে পারে, এ ত্যাগ কেবল প্রতীকী নয়, বাস্তব। তাঁকে দিতে হবে এমন কিছু যা তাঁর অস্তিত্বের মূলে। ভূধারিণী তার সামনে রাখেন একটি পাত্র, ভরা কাদায়। তিনি বলেন, “এই কাদায় ফেল যা তোর হৃদয়ের কেন্দ্রে, যা তুই আঁকড়ে ধরেছিস।” অম্বরীশ নিজের ব্যাগ খুলে, নিঃশব্দে বের করে তার মৃত মায়ের শেষ চিহ্ন—একটি ছোট্ট মাটির গহনা, যা সে ছোটবেলা থেকে সঙ্গে রাখত। সে পাত্রে তা ফেলে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে গুহার মাটি যেন জেগে ওঠে—ছাদ থেকে পড়ে ছত্রাক, মেঝেতে কাঁপুনি, আর এক হালকা উষ্ণতা তার শরীর ছুঁয়ে যায়। ভূধারিণী তার কপালে এক বিন্দু কাদা ছুঁইয়ে বলেন, “তুই এখন মাটির সন্তান।”
তাপ্তি সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দেখে, এক যুবক যেন নিজের মায়ের স্মৃতি বিসর্জন দিয়ে নতুন জন্ম নিচ্ছে। অম্বরীশের চোখে জল, কিন্তু তার মুখে অভূতপূর্ব স্থিরতা। ভূধারিণী তাঁকে বলেন, “পৃথিবী শুধু শক্তি নয়, তা সহনশীলতা। যারা ধরে রাখতে জানে, তারাই ফুঁড়ে দিতে পারে কালের স্তর।” এরপর তিনি অম্বরীশকে নিয়ে যান গুহার এক গভীর চেম্বারে। সেখানে মাটির উপর আঁকা পাঁচটি চক্রের প্রথমটি—ভূমিচক্র—ঝলমল করছে অলৌকিক আলোয়। তার মাঝখানে স্থাপন করা একটি পাথরের শিলা, যেখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে ধোঁয়া। ভূধারিণী বলেন, “এখানে বসে ধ্যান কর। তুই যদি সত্যিই প্রথম ধাপ পার হস, তবে তোর শরীর অনুভব করবে পৃথিবীর রণক্ষেত্র—যেখানে জন্ম, মৃত্যু, সৃষ্টির মধ্যে সীমারেখা মুছে যায়।” অম্বরীশ বসে পড়ে, ধ্যানস্থ হয়। শুরুতে কিছুই অনুভব করে না, কিন্তু ধীরে ধীরে তার মেরুদণ্ডের নিচ থেকে এক চাপা গর্জন উঠতে থাকে, যেন সে নিজেই মাটির স্তর হয়ে উঠছে, তার হাড়, মাংস সব গলে গিয়ে এক প্রাচীন ভূতত্ত্বে পরিণত হচ্ছে। মাটির ভেতর থেকে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর—তার ঠাকুরদার, অজানা কৃষকের, ধ্বংসপ্রাপ্ত মঠবাসীর, এমনকি, গর্ভস্থ ভ্রূণের আর্তনাদ। এই ধ্যান তাকে মোহিত নয়, আতঙ্কিত করে। কারণ এই শক্তি সৃষ্টি করে, আবার ধ্বংস করতেও সক্ষম। তপ্তির উপস্থিতি তখন খুব দূর থেকে টের পায় সে, যেন আর তার সঙ্গে কোনো মানবিক সম্পর্ক নেই। ধ্যানের শেষে তার কপালে ফুটে ওঠে ভূমি-চিহ্ন—একটি ঘূর্ণায়মান বৃত্ত, যার চারপাশে মাটির ভাঙাচোরা রেখা।
ধ্যান শেষ হলে ভূধারিণী কেবল একবার বলেন, “এবার জল ধরতে যাবি, কিন্তু মনে রাখিস, মাটি তোর পায়ের নিচে নয়, এখন তোর শরীরের ভিতরে।” গুহা ছাড়ার সময়, পেছনে তাকালে অম্বরীশ দেখল গুহা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। গুহার প্রবেশপথ, মাটি, শেকড়, ভূধারিণী—সবকিছু যেন কখনো ছিল না। তাপ্তি নিঃশব্দে পাশে আসে, তার কাঁধে হাত রাখে, কিন্তু কিছু বলে না। কারণ তিনিও বুঝতে পেরেছেন—এই যাত্রা আর কেবল অধ্যয়নের নয়, এটি আত্মবিসর্জনের, আত্মোত্থানের। গোধূলি বেলায় তারা নেমে আসে গিরিখাদ থেকে, সামনে তাদের পরবর্তী গন্তব্য—উত্তর ভারতের এক পাথুরে নদীঘেরা এলাকা, যেখানে ‘জলেশ্বরী’ অপেক্ষা করছেন। পেছনে পড়ে থাকে এক মৃত মায়ের স্মৃতি, এক পুরাতন গহনা, আর একটি কাদা পাত্র—যার গভীরে মাটি গ্রহণ করেছে মানুষের আবেগ। অম্বরীশ অনুভব করে, সে আর আগের মানুষ নেই। ভূমি এখন তার শরীরের গভীরে, তার আত্মার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে।
তিন
উত্তরাখণ্ডের নিঃসঙ্গ এক উপত্যকা—যার নাম মানচিত্রে নেই, পথ নির্দেশনায় নেই, এমনকি স্থানীয়দের কথাতেও শুধুই ফিসফাস। নামহীন সেই উপত্যকায় ঢোকার আগে পাহাড়ি গ্রামের শেষ ধাপে একজন বৃদ্ধ বলেছিল, “ওপারে গেলে জল ফিরে আসে, কিন্তু তার রঙ আর স্বাদ পাল্টে যায়।” তাপ্তি প্রথমে সন্দেহে ভুরু কুঁচকে বলেছিল, “জল তো নির্দোষ!” কিন্তু অম্বরীশ চুপ করেই ছিল। কেননা মাটির স্পর্শ পাওয়ার পর থেকে তার মনে হচ্ছিল, তার দেহে নতুন কিছু ঘটছে—সে ঘুমাতে পারছিল না, তার ত্বক শুকিয়ে যাচ্ছিল, আর চোখে হঠাৎ হঠাৎ জল আসছিল এক অজানা বিষাদের কারণে। তারা যখন উপত্যকায় পৌঁছায়, চারপাশে শুধুই নীরবতা। পাথুরে ধ্বংসাবশেষ, নদীহীন নদীকাঠামো, আর বাতাসে এক অদ্ভুত ভেজা গন্ধ—যেখানে জল নেই, কিন্তু যেন কেউ সদ্য কেঁদে গেছে। তারা খুঁজে পায় একটি শিলালিপি—যেখানে জলেশ্বরীর একটি মূর্তি ছিল এক সময়, কিন্তু এখন নেই। সামনে একটি শুষ্ক জলাশয়ের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে, আর তাতে বসে আছে এক যুবতী—রক্তিম পোশাক, চোখে নীলতার ছায়া, আর তার আঙুলে বোনা নুপুর যেন অনবরত জলস্রোতের মতো বাজছে। তিনি বলেন, “তোমরা এসেছ? আমি জানতাম তোমরা আসবে। কারণ আমার চোখের জল এই ভূমি আর ধারণ করতে পারছে না।” তাপ্তি কিছু বলতে গেলে অম্বরীশ হাত তুলে ইঙ্গিত দেয়—এখানে শব্দের প্রয়োজন নেই, এখানে অনুভবই একমাত্র সংলাপ।
জলেশ্বরী নামেই পরিচয় দেয় সে, যদিও তার শরীরের ভঙ্গি, চুলের গতি, কথার ছন্দ—সবই জলরাশির প্রতিচ্ছবি। সে অম্বরীশকে বলে, “জল আয়ত্ত করতে হলে, তোর হৃদয়ের জল শুকাতে হবে। তুই যা ধারণ করিস, যা বয়ে নিয়ে চলিস, তা-ই তোর ত্যাগ।” সেই রাতে তারা থাকে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত আশ্রমের ছাদে, যেখানে কেবল ছাদের এক কোণে জমে থাকা বৃষ্টির জলই তাদের স্নান, খাদ্য ও অস্তিত্বের একমাত্র চিহ্ন। তাপ্তি দেখে, অম্বরীশ কেবল তাকিয়ে থাকে সেই জলের দিকে—যেন সে কথা বলছে তার সঙ্গে। পরদিন ভোরে জলেশ্বরী তাদের নিয়ে যায় এক প্রাচীন কুয়োর ধারে, যার নাম ‘অন্তর্জল’। সেখানে তিনি বলেন, “এই কুয়ো কাঁদতে জানে। কেবল সে শুনতে পায় যার হৃদয় আগুনে পোড়ে, কিন্তু চোখে জল থাকে।” অম্বরীশ ধীরে ধীরে সামনে এগোয়। কুয়োর জলে সে দেখে নিজের মুখ, তারপর পিছনে ভেসে উঠতে থাকে এক কিশোরীর মুখ—রঞ্জনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক ছিল অম্বরীশের। কিন্তু সেই সম্পর্ক একদিন হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যায়, যখন রঞ্জনা জানতে পারে, অম্বরীশ তার প্রেমে যতটা, নিজের ভবিষ্যতের অনুসন্ধানে ততটাই গভীর। সে চলে যায়, আর অম্বরীশ তার চলে যাওয়ার জন্য নিজেকে দোষ দেয়। সে অনেক রাত রঞ্জনার নামে প্রার্থনা করত, কিন্তু তা কখনও প্রকাশ করত না। এখন, জলেশ্বরী তাকে বলেন, “তোর প্রেম এক প্রবাহ, কিন্তু তুই তাকে দুকূলের স্বপ্ন দেখিয়েছিলি। জলকে বেঁধে রাখলে সে পচে যায়।” অম্বরীশ বুঝে যায়, দ্বিতীয় ত্যাগ তার হৃদয়ের গভীরে—রঞ্জনার স্মৃতি, তার প্রতি মায়া, অপরাধবোধ ও আকাঙ্ক্ষা—সব বিসর্জন দিতে হবে।
সে জলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে, মনে মনে বলে, “রঞ্জনা, আমি তোকে ভালবাসতাম। কিন্তু এখন আমি নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই।” হঠাৎ তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে কুয়োয়, আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুয়োর জল যেন গর্জন করে উঠল। ভেতর থেকে জেগে উঠল এক জলজ কুন্ডলী, ঘূর্ণায়মান স্পন্দনে কুয়োর উপরে উঠে আসে জল, আর সেই জলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসে জলেশ্বরীর একটি রূপ—উচ্ছ্বসিত, দুঃখময়ী, মাতৃত্বময়। তিনি অম্বরীশের কপালে ছোঁয়ান তার নীল জলের আঙুল, আর তাতে ফুটে ওঠে দ্বিতীয় চিহ্ন—জলের ঢেউ। তখন হঠাৎ করে বর্ষা নামল, যেন আকাশ নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। অম্বরীশ জলেশ্বরীর চোখে দেখল একধরনের প্রশ্রয়, যেখানে কান্না ছিল বেদনাবিধুর নয়, বরং মুক্তির। তাপ্তি ছুটে এসে বলে, “তুমি ঠিক আছো?” অম্বরীশ তার দিকে তাকায় না, শুধু বলে, “জল এখন আমার ভিতর। কিন্তু সে আর প্রবাহিত নয়, সে এখন স্থির।”
চার
পাহাড় পেরিয়ে উপত্যকা, তারপর মরুভূমির ধারে পৌঁছে যখন তারা ‘সোরন কুণ্ড’-এর দিকে এগিয়ে গেল, তখন সূর্য ছিল চূড়ান্ত তেজে। আকাশ ফেটে পড়ছিল আগুনে, আর বালির ধুলোর মাঝে বাতাসে জ্বলন্ত গন্ধ, যেন পৃথিবীর বুক থেকে কোনো প্রাচীন আগুন আজও নিঃশ্বাস ফেলছে। তাপ্তির কপাল ঘেমে একাকার, বারবার সে বলছে, “এখানে কিছুই বাঁচে না।” অম্বরীশের চোখ কিন্তু জ্বলছিল অন্য আলোয়—ভূমি আর জলের শক্তি ধারণ করার পর তার শরীর যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে প্রতিকূলতায়। তাদের গন্তব্য ছিল এক মৃত আগ্নেয়গিরির গহ্বর, লোকমুখে যার নাম—অগ্নিবীরের কুণ্ড। এক স্থানীয় রাখাল পথ দেখিয়ে বলে, “যারা সেখানে যায়, তারা কখনও আগের মতো ফিরে আসে না। কেউ পাগল, কেউ মৌন, কেউ মৃত।” তপ্তি একবার বলে, “তুমি ফিরেও আসতে পারো, আমরা এখানেই থামতে পারি।” কিন্তু অম্বরীশের চোখে আগুনের প্রতিচ্ছবি ছিল, আর ঠাকুরদার লেখায় স্পষ্ট ছিল—”তৃতীয় ত্যাগ কঠিনতম, কারণ আগুন পুড়িয়ে দেয় আত্মার মুখোশ।” পথ ছিল গহ্বরময়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। শেষমেশ তারা পৌঁছায় সেই জায়গায় যেখানে পাথরের মাঝে খোদাই করা বিশাল এক মূর্তি দাঁড়িয়ে—দগ্ধ, ছাইঢাকা, তবু বীরোচিত। এ ছিল অগ্নিবীর, তৃতীয় উপাদানের প্রহরী। তার নয়ন ছিল শূন্য, যেন সে চায় সবকিছু ছাই করে দিতে, এবং তার হাতের মুষ্ঠি যেন চেপে ধরা এক আদিম রাগ।
অগ্নিবীরের মূর্তির নিচে একটি মঞ্চ, যেখানে একটি আগুন সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকে, আর তার সামনে লেখা—“তুই যদি নিজেকে জানতে চাস, তবে আগুনের কাছে নিজের রাগ উৎসর্গ কর।” অম্বরীশ বুঝল, এই ত্যাগ বাহ্যিক কিছু নয়—এটা তার মনের ভিতরে জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ, যা তার গত জীবনকে চালিত করেছে। তার শৈশবের অভাব, বাবার উদাসীনতা, সমাজের অবহেলা, আর নিজের সীমাবদ্ধতা—সবই মনের এক গভীর আগুন হয়ে পুড়ে চলেছে। কিন্তু এই আগুন সে কখনও নিভাতে চায়নি, বরং লালন করেছে, পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রেখেছে। অগ্নিবীরের কাছে দাঁড়িয়ে সে বলে, “আমার রাগ আমার পরিচয়। এটা ছাড়া আমি কী?” ঠিক তখনই আগুন থেকে শোনা যায় একটি কণ্ঠ—কঠিন, ধাতব, দীপ্ত—“যারা নিজেকে রাগে খুঁজে পায়, তারা শুধু ছাই পায়। সত্য মানুষ তার রাগ পুড়িয়ে মানুষ হয়।” সেই মুহূর্তে অম্বরীশের সামনে দৃশ্যপট বদলে যায়। সে দেখতে পায় নিজের বাবাকে—যিনি কখনও তাকে জড়িয়ে ধরেননি, তাকে দোষারোপ করেছেন তার মা-কে হারানোর জন্য। সে দেখতে পায় নিজের কৈশোর, যেখানে সে একবার পাথর ছুঁড়ে বন্ধুর গালে রক্ত এনেছিল, সেই বন্ধুটি শুধু বলেছিল, “তুই অনেক রাগ পুষে রাখিস।” এই সমস্ত দৃশ্য এক আগুনের কুয়াশার মতো তার সামনে ভেসে ওঠে। তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আগুনের সামনে, আর চোখ বুজে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, “আমি এইসব ছেড়ে দিতে চাই।”
এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, তারপর আগুন নিজেই ছড়িয়ে পড়ে তার শরীর জুড়ে—কিন্তু পোড়ায় না, বরং শুদ্ধ করে। তার ত্বক, হাড়, চোখ, মাথার ভিতর—সব যেন ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যাচ্ছে। তপ্তি ছুটে এসে দেখে, অম্বরীশের চোখের নিচে ছাইয়ের দাগ, আর তার কপালে তৃতীয় চিহ্ন—একটি জ্বলন্ত শিখার মতো আঁকা, যেটি ধীরে ধীরে ঘুরছে নিজের অক্ষে। অগ্নিবীর তখন বাস্তব রূপে দেখা দেয় এক মুহূর্তের জন্য—এক পাথুরে, আগুনের মধ্যে গঠিত মানবদেহ, যার চোখে কোনো দয়া নেই, কিন্তু আছে এক নিরপেক্ষ ন্যায়। সে কেবল বলে, “তুই আগুন নয়, তুই তার মধ্য দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া পাথর।” তারপর সে মিলিয়ে যায় ধোঁয়ায়। চারপাশ নিস্তব্ধ। আগুন নিভে যায়, কিন্তু বাতাসে থেকে যায় এক উষ্ণতা, যা জ্বলে না, শুধু মনে করিয়ে দেয়—তুই নিজেকে পোড়াতে শিখেছিস। তপ্তি কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। অম্বরীশ তখন ধীরে ধীরে বলে, “রাগ পুড়ল, কিন্তু শূন্যতাটা অদ্ভুত… যেন এখন নিজেকে স্পষ্ট দেখছি, কিন্তু তাতে ব্যথা লাগে না।” তারা ফিরে আসে মরুভূমির কিনারায়। সামনে পড়ে রয়েছে এক বিশাল হিমপ্রবাহী উপত্যকা—যেখানে প্রবাহমান নয়, বরং উড়মান একটি শক্তি অপেক্ষা করছে—বায়ু। কিন্তু এখন অম্বরীশ জানে—বায়ুর হালকাতা বুঝতে হলে, প্রথমে ভেতরের ভার ছাড়তে হয়। এবং সে সেটা করেছে, পুড়িয়ে।
পাঁচ
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এক অনুচ্চ, অথচ অপার্থিব উপত্যকা—চিন্ধি লা—যেখানে বাতাসের গতিপথ কখনো পূর্ব থেকে আসে, কখনো পশ্চিম থেকে, আর কখনো একসাথে চারদিকে ছুটে যায়। এখানে কেউ স্থির থাকতে পারে না বেশিক্ষণ, কারণ এই উপত্যকার বাতাস কেবল দেহ নয়, আত্মাকেও নাড়িয়ে দেয়। অম্বরীশ ও তাপ্তি সেই জায়গায় পৌঁছতেই বুঝে গেল—এখানে শক্তির প্রকৃতি যেন অদৃশ্য, অস্বস্তিকর, অথচ আশ্চর্যরকম পরিচিত। পথে কোনো গাইড রাজি হয়নি আসতে, এমনকি লোকাল ভাষায় এই জায়গাকে ডাকা হয় “নাভিপ্ৰবাহ”—অর্থাৎ যেখানে হাওয়ার উৎস আছে, কিন্তু দিশা নেই। তাদের চারপাশে বাতাস যেন অনবরত ফিসফিস করছে, এক অদৃশ্য ভাষায়, যাকে বোঝা যায় না, কিন্তু ফেলে দেওয়া যায় না। বাতাসে ভেসে আসে একরাশ নাম—“অম্বরীশ… অম্বরীশ…”। সে থেমে দাঁড়ায়, তপ্তি বলে, “হাওয়ায় কার ডাক?” অম্বরীশ চুপ করে। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার সে কুয়াশা ভরা সকালে হারিয়ে গিয়েছিল, তখনও এমন ডাক শুনেছিল… যেন বাতাসে কেউ অপেক্ষা করছিল অনেক বছর ধরে।
চতুর্থ উপাদান—বায়ু—এর প্রহরী ছিল বায়ুরাজ, যিনি আক্ষরিক অর্থে কোনো দৃশ্যমান সত্তা ছিলেন না। তাঁর অস্তিত্ব ছিল ধ্বনিতে, দিশাহীন স্রোতে, মনে জমে থাকা স্মৃতির ঘূর্ণিতে। একটি পুরনো গাছের নিচে বসে হঠাৎ অম্বরীশ অনুভব করল—সে ভুলে যাচ্ছে কে সে। সে তপ্তির দিকে তাকাল, কিন্তু তপ্তিকে আর চিনতে পারছে না। তার মাথার ভেতরে একরাশ বাতাস ঘুরছে, পুরনো পরিচয় মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তপ্তি, চিন্তিত হয়ে বলে, “তুমি ঠিক আছো? তুমি আমাকে চিনতে পারছো?” অম্বরীশ বলে, “তুমি কে?” এই পর্যায়ে পৌঁছেই শুরু হয় বায়ুরাজের প্রকৃত পরীক্ষা। পাণ্ডুলিপির নির্দেশ ছিল, “চতুর্থ ত্যাগ—আত্মপরিচয়।” অর্থাৎ অম্বরীশকে বিসর্জন দিতে হবে তার নিজস্ব সত্তা, নাম, ইতিহাস—সমস্ত কিছু। ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে আসে এক বিশাল ঝড়। গাছগুলো বেঁকে যায়, চারপাশ সাদা ধোঁয়ায় ভরে যায়, আর তপ্তি হারিয়ে যায় অম্বরীশের দৃষ্টিসীমা থেকে। সে একা হয়ে পড়ে, আর বাতাস তার কানে ফিসফিস করে বলে, “তুই অম্বরীশ নস। তুই শুধু প্রবাহ। তুই যদি আমাকে ধারণ করতে চাস, তবে তোর নামটাও ত্যাগ কর।” সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত বিভ্রম দেখা দেয়—অম্বরীশ নিজেকে দেখতে পায় এক গ্রাম্য রাখাল হিসেবে, তারপর এক কাশ্মীরি কাঠুরে, তারপর এক মুম্বইয়ের বই বিক্রেতা। প্রতিটি রূপে তার মুখ আলাদা, স্মৃতি আলাদা, কিন্তু ভেতরের কণ্ঠ একটাই—যা বাতাস বলছে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, সে কিছু না, কেবল এক ধারক, যাকে বিভিন্ন জন্মে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি কিছু নই, কেবল ধারা। আমি আমার নাম, জন্ম, পরিচয় ভুলে যাচ্ছি।”
ঠিক সেই মুহূর্তে হাওয়া থেমে যায়। চারপাশে নিস্তব্ধতা নামে। বাতাস তাকে আর ডাকছে না, বরং তাকে ছুঁয়ে দেখছে শ্রদ্ধায়। তপ্তি তখন ফিরে আসে তার সামনে, চোখে জল। “তুমি একবারের জন্য আমাকে চিনতে পারনি,” সে বলে, “ভয় করছিল…” কিন্তু অম্বরীশ এবার তাকে দেখে বলে, “তুই কে?” তপ্তি প্রথমে ব্যথা পায়, তারপর বুঝতে পারে—এ কোনো ব্যক্তিগত ভোলা নয়, এটা এক ধরণের বিশুদ্ধতা। অম্বরীশের কপালে ফুটে ওঠে চতুর্থ চিহ্ন—এক ঘূর্ণিবাতাসের প্রতীক, যার কেন্দ্রে শূন্যতা। বায়ুরাজ এবার এক ধ্বনি রূপে কথা বলেন—“তুই প্রবাহ হতে শিখেছিস। এখন শিখ, স্থিরতার অভ্যন্তরেও হাওয়া থাকে।” পাহাড় থেকে নামার সময়, অম্বরীশ চুপ। সে জানে, এই উপাদান তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে, আবার নতুন কিছু শেখাতেও চায়। তার পাশে তপ্তি হেঁটে চলে, কোনো শব্দ নয়, কেবল সঙ্গ। সামনে বিস্তৃত এক আকাশসীমা—যেখানে এক অপার্থিব সত্তা, নভসুতা, অপেক্ষা করছে। এবং তার কাছে শেষ ত্যাগ—ইচ্ছা।
ছয়
সপ্তাহের পর সপ্তাহ পেরিয়ে তারা পৌঁছায় ভারতের উত্তরতম সীমান্তে—তুলিং গিরি, যেখানে পাথর আর মেঘ আলাদা করা যায় না। এক বিশাল উপত্যকার মাঝখানে, আকাশের নিচে স্থির দাঁড়িয়ে এক ধ্বংসাবশেষযুক্ত ধ্যানমঠ—লোকেরা বলে, সেখানে শুধু একজন জীবিত ছিলেন শেষ বারের মতো, যিনি আকাশের বুকে চোখ খুলেছিলেন, আর তার পর থেকেই এই মঠ নিষিদ্ধ। সেই চোখের নাম ছিল রুদ্রাক্ষ, যে তান্ত্রিক আকাশতত্ত্বের সর্বশেষ ধারক, আর যাঁর অভিশাপেই বন্ধ হয়ে যায় নভতপথ। তপ্তি প্রথম থেকেই বলছিল, “এটা আত্মঘাতী হবে। আকাশ তো বিস্তৃতি, কিন্তু তার কেন্দ্রে শূন্যতা। যদি শূন্যের মুখোমুখি হতে যাও, নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।” অম্বরীশ চুপ করে ছিল। এখন সে আগুন, জল, বায়ু, ও মাটির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ভারসাম্য তৈরি করেছে। কিন্তু সে জানে, আকাশ উপাদান তার অস্তিত্বের বাইরে—এ এমন এক তত্ত্ব যা শরীর নয়, চেতনাকেই স্পর্শ করে। মঠে ঢুকতেই সে দেখে চারদিকে ছড়ানো পাথরে খোদাই—ত্রিকোণ চক্র, কেন্দ্রে চোখ, চারপাশে অজানা বর্ণমালার শব্দাবলি। হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, ছায়া পড়ে, আর ছাদে ফুটে ওঠে একটি চিহ্ন—রক্তবর্ণে আঁকা একটি চোখ, যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়: “শেষ ত্যাগ—ইচ্ছা।”
অম্বরীশ থমকে যায়। রুদ্রাক্ষের কণ্ঠ ভেসে আসে নিঃসন্দেহে এক অদৃশ্য স্তর থেকে: “তুই এখনো চাস। চাস উত্তর। চাস পরিপূর্ণতা। চাস ক্ষমতা। যতক্ষণ চাওয়া থাকবে, ততক্ষণ তুই ধারক, জ্ঞানী না।” তপ্তি হতচকিত হয়। সে বলে, “তুমি কি কিছুই চাইবে না? তুমি কেন এইসব করছ?” অম্বরীশ প্রথমবারের মতো কাঁপে। সত্যিই তো—সে এখনও জানতে চায়, শেষ কোথায়? সে এখনও তন্ত্রের শেষ চক্র ছুঁতে চায়, ঠাকুরদার অভিজ্ঞতা বুঝতে চায়, এমনকি নিজের জন্য একটি উদ্দেশ্য রাখতে চায়। এই চাওয়াগুলিই তার শেষ অন্তরায়। মঠের কেন্দ্রে ছিল এক স্বচ্ছ স্তম্ভ—যার ভিতর দিয়ে দেখা যায় আকাশ, শুধু আকাশ, কোনও ছাদ নেই। রুদ্রাক্ষ বলে, “তুই যদি নিজেকে ছেড়ে দিতে চাস, তবে এই স্তম্ভের সামনে দাঁড়া, আর বল—‘আমি আর কিছু চাই না।’” অম্বরীশ দাঁড়ায়, কিন্তু মুখ খুলতে পারে না। তার মাথায় ঘুরতে থাকে—মা’র মুখ, রঞ্জনার চোখ, ঠাকুরদার পাণ্ডুলিপি, তাপ্তির নীরব ভালোবাসা, নিজের দীর্ঘতম যাত্রাপথ। সবকিছু সে চেয়েছে, ভালোবেসেছে, বা ধরতে চেয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে, শ্বাস নেয়, আর ধীরে ধীরে বলে, “আমি আর কিছু চাই না।”
সেই মুহূর্তে স্তম্ভ ফেটে পড়ে। আলো বিস্ফোরিত হয়, একটি নিরাবরণ চোখ আকাশ থেকে নেমে আসে—বিশাল, ধ্রুব, নিরপেক্ষ। সেই চোখ দেখে অম্বরীশকে, আর অম্বরীশ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনের মাঝখানে সমস্ত শব্দ থেমে যায়। চোখ বলে, “তুই সত্যি ত্যাগ করেছিস। এখন তুই ধারণ কর।” সেই মুহূর্তে অম্বরীশের শরীর হালকা হয়ে যায়, তার রক্ত, হাড়, স্মৃতি—সবই যেন আকাশে ভাসছে। তার কপালে ফুটে ওঠে পঞ্চম চিহ্ন—এক চোখের প্রতীক, যার চিত্র আঁকা নিরাকার রেখায়। সে পড়ে যায় অজ্ঞান, কিন্তু তার শরীর নয়—চেতনা পড়ে। তপ্তি দৌড়ে আসে, দেখে সে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, কিন্তু তার চোখে এমন এক স্থিরতা, যেন সে এখন সব দেখতে পায়—অন্তর, বাহির, অতীত, ভবিষ্যৎ। সে বলে, “আমি দেখেছি আকাশের কেন্দ্রে কিছু নেই, আর সেই শূন্যতাই সবকিছু ধারণ করে।” রুদ্রাক্ষের কণ্ঠ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়—“তুই এখন পূর্ণ। কিন্তু মনে রাখিস, পূর্ণতা নিজে কোনো প্রশ্ন করে না। এখন তুই শুধু দেবে।”
সাত
উত্তর ভারতের শেষ সীমান্তে, যেখানে আকাশ ছুঁয়ে আছে পাহাড়ের চূড়া আর নদী মিশেছে মরুভূমির তপ্ত বুকে, সেখানে ছড়িয়ে আছে এক অপার্থিব স্থান—অন্তস্তীর্থ। এই তীর্থে পাঁচটি উপাদান একত্রে বিরাজ করে, কিন্তু কোনো মানব চোখে তা ধরা পড়ে না, শুধু আত্মচক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। ঠাকুরদার পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লেখা ছিল, “যে দিবে মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশকে নিজ দেহে ধারন, সে একমাত্র পঞ্চতত্ত্বের দ্বারে পৌঁছাবে।” তপ্তির চোখে এখন বিস্ময়ের আলো। সে দেখতে পায়, অম্বরীশ বদলে গেছে—তার মুখে স্থিরতা, তার শরীরে পাঁচটি চিহ্ন—যেন কোনো পুরাতন দেবতার আধুনিক রূপ। তারা যখন অন্তস্তীর্থে পৌঁছায়, তখন সূর্য মধ্যাকাশে। সেখানে কোনো মন্দির নেই, কোনো ঘন্টা বাজছে না, কোনো পুরোহিত নেই—কেবল একটি গহ্বর, যার মাঝখানে ছড়ানো পাঁচটি পাথরখণ্ড—প্রতিটিই ভিন্ন রঙে, ভিন্ন তাপে, ভিন্ন কণিকায়। চারপাশের বাতাস নিঃশব্দ, অথচ শব্দপূর্ণ। গহ্বরের মাটিতে অম্বরীশ বসে পড়ে, চোখ বন্ধ করে, এবং চিহ্নগুলোর মাঝে আত্মসংযোগ ঘটাতে থাকে।
প্রথমে সে ডাকে ভূধারিণীকে—তার শরীরের পেশীতে অনুভব করে মাটির ওজন, শিকড়ের টান, গভীরতা। তার মেরুদণ্ডে যেন ধীরে ধীরে জমে উঠছে ভূস্তর। তারপর জেগে ওঠে জলেশ্বরীর স্পর্শ—তার বুকে ভেসে ওঠে আবেগের ঢেউ, কান্নার স্রোত, প্রেমের বিশুদ্ধ স্পর্শ। চোখের কোনায় জমে থাকা এক বিন্দু জল তার গাল বেয়ে পড়ে। তারপর আগুন—অগ্নিবীরের উন্মত্ততা, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির বোধ, যেন তার হৃদযন্ত্রে এখন এক শিখা জ্বলছে—নয় বিধ্বংসী, বরং প্রজ্জ্বলনকারী। চতুর্থে, বায়ুর প্রবাহ—তার শ্বাসে, তার রক্তে, এমনকি চিন্তার মধ্যে—যেখানে নেই কিছু স্থায়ী, কেবল পরিবর্তন ও গ্রহণযোগ্যতা। এবং সবশেষে আকাশ—রুদ্রাক্ষের শূন্যতা। সে উপলব্ধি করে, পাঁচটি উপাদান একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক। যেই মুহূর্তে তার দেহের প্রতিটি কোষে এই তত্ত্বগুলো পূর্ণতা পায়, ঠিক সেই মুহূর্তে পাথরগুলো আলোয় ভরে ওঠে। এক অপার্থিব কম্পন শুরু হয়, যেন অন্তস্তীর্থ নিজের সত্যতা ঘোষণা করছে। হঠাৎ করে তার দেহ উপরে উঠতে থাকে—পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ পৃথিবীর অংশ হয়ে।
তপ্তি দূর থেকে দেখে, অম্বরীশ বাতাসে ভাসছে, তার শরীর থেকে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে—পঞ্চরঙা: মাটির খয়েরি, জলের নীল, আগুনের কমলা, বায়ুর ধূসর, আকাশের বেগুনি। চারপাশে গহ্বরের ধুলো বাতাসে উঠছে, পাথরগুলো ঘুরতে শুরু করছে, যেন তন্ত্রচক্র রচিত হচ্ছে মহাকালের গর্ভে। এই চক্রের কেন্দ্রে অম্বরীশ এক ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেখানে সে তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে না ব্যক্তিরূপে, বরং এক শক্তিরূপে—যা সৃষ্টি ও বিনাশের ঊর্ধ্বে। হঠাৎ, অন্তস্তীর্থ থেকে উঠে আসে এক বৃদ্ধ, যিনি আগে ছিলেন না। তিনি পরিধানে তন্তু, চোখে অন্ধত্ব, কণ্ঠে ধ্রুবতা। তিনি বলেন, “তুই এখন ধারক, কিন্তু প্রহরী হস না যতক্ষণ না তুই নিজেকে বিসর্জন দিবি।” তপ্তি ঘন হয়ে আসে, “তবে কি সে মরবে?” বৃদ্ধ হাসেন, “সে তো কখনোই ছিল না। যা ছিল তা চাওয়া, যেটা রইল তা সাধনা।” তখন অম্বরীশের দেহ নিচে নেমে আসে ধীরে, তার কপালের পাঁচটি চিহ্ন মিলিয়ে এক চক্রে রূপান্তরিত হয়, যার কেন্দ্রে একটি বিন্দু—তথা ‘বিন্দু-তত্ত্ব’—যেখান থেকে সৃষ্টি হয় এবং যেখানে সব মিলিয়ে যায়। সে চোখ খোলে, প্রথমবারের মতো তপ্তিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পাশে থাকবে?” তপ্তি বলে, “যতদিন তুমি ছিলে, আমি ছিলাম। এখন তুমি যা হয়েছো, আমি তারই ছায়া হয়ে থাকব।”
আট
অন্তস্তীর্থের আলো ম্লান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতি যেন নিজের শ্বাসধারণ করে থেমে যায়। আকাশের ঘন নীলাভ ছায়া জমে গিয়েছে পাহাড়ের গায়ে, নদী থমকে গেছে, বাতাস স্তব্ধ, এমনকি আগুনের ভাষাও যেন নিঃশব্দ। সেই শূন্যতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অম্বরীশ—না তিনি এখন আর শুধু মানুষ নন, তান্ত্রিক সাধনার সেই শেষ অন্বেষী, যার দেহে মিলেছে পাঁচ উপাদানের প্রতীক। মাটির দৃঢ়তা, জলের আবেগ, আগুনের শুদ্ধি, বায়ুর প্রবাহ, আর আকাশের শূন্যতা—সবই যেন এবার একত্রে নিঃশ্বাস ফেলে তার বুক থেকে। তপ্তি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তার সামনে অম্বরীশ যেন এক জীবন্ত মণ্ডল, যার প্রতিটি চিহ্ন থেকে আলাদা এক শক্তির নি:সরণ। কিন্তু এই স্থিতিশীলতার মধ্যেও, অম্বরীশের চোখে এখন এক দ্বিধা—একটি প্রশ্ন, যার উত্তর শুধুমাত্র উত্তরাধিকারেই সম্ভব। পাণ্ডুলিপির শেষ বাক্যটি ছিল: “যে ধারক, সে শুধু বাহক; প্রহরী সেই, যে বিসর্জনের পরেও সৃষ্টি করে।” তাই তার সামনে এক নতুন দ্বার খুলে যায়—এক অজানা গুহার প্রাচীন পথ, যেখানে প্রবেশের অধিকার একমাত্র পূর্ণ ধারকের। পাথরের দেয়ালে খোদাই: “প্রবেশে সঙ্কেত নয়, আত্মপ্রকাশ চাই।” সে এগিয়ে যায়—একাকী।
গুহার ভেতর প্রবেশ করতেই চারপাশে শোনা যায় একটি ধ্বনি, যেন পাঁচটি সুর একসঙ্গে গাওয়া হচ্ছে—পৃথিবীর স্পন্দন, জলের ঝংকার, আগুনের ফুঁস, বায়ুর গুঞ্জন, আকাশের স্তব্ধতা। প্রত্যেক ধ্বনি তার পূর্বের চিহ্নগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়, তাকে মনে করিয়ে দেয় তার ভাঙাগড়ার যাত্রা। তারপর গভীরে, এক উচ্চভূমিতে সে দেখতে পায় এক গোলাকার মণ্ডপ, যেটি যেন অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন পাঁচ সত্তা—পঞ্চভূতের প্রাক্তন ধারক। প্রত্যেকে তাকে জানায়: “আমরা পথপ্রদর্শক ছিলাম, তুমি উত্তরাধিকারী। এখন তুই তৈরি—প্রহরী হবার জন্য।” কিন্তু প্রহরী হওয়ার অর্থ কেবল উপাদান ধারণ নয়—তাতে থাকে ত্যাগ, সৃষ্টি, সংরক্ষণ, ও বিকাশের দায়িত্ব। অম্বরীশ জিজ্ঞাসা করে, “তবে আমি কী রক্ষা করব?” তখন পঞ্চসত্তা সম্মিলিতভাবে উত্তর দেয়: “মানবতাকে। উপাদানগুলি ধ্বংসে সমর্থ, কিন্তু তুই তাদের স্থিতিতে রূপ দিবি। তোর কর্তব্য একটাই—সন্তুলন।” তার হাতে তুলে দেওয়া হয় এক রুদ্রাক্ষ-নির্মিত যন্ত্র, যার নাম ‘অন্তরাল’—যার সাহায্যে সে উপাদানের সুর সংহত করে সময়ে সময়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। যন্ত্রটি তার দেহে আত্মস্থ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে গুহার ছাদ ফেটে পড়ে আলোর স্রোত, আর এক মহাশব্দে গঞ্জিত হয়: “প্রহরী জন্ম নিল।”
তপ্তি, গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে, অম্বরীশ ধীরে ধীরে উঠে আসছে। কিন্তু তার হাঁটার ধরন বদলে গেছে—সে যেন এখন মাটির স্পন্দন বুঝতে পারে, বাতাসের ভাষা পড়তে পারে, চোখে স্বপ্ন দেখে না, বরং ভবিষ্যৎ দেখে। সে এসে দাঁড়ায় তপ্তির সামনে, বলে, “আমি এখন আর খুঁজছি না। আমি রক্ষা করব।” তপ্তি জানে, এ সেই মানুষ নয় যাকে সে প্রথমে চিনেছিল, কিন্তু তবুও তার ভেতর সেই চেনা কণ্ঠ, সেই একই নীরব অঙ্গীকার। তারা একসঙ্গে অন্তস্তীর্থ ত্যাগ করে। দূরে মেঘের ফাঁকে দেখা যায় এক বালক নদীর পাড়ে খেলছে, এবং তার বল গড়িয়ে পড়ে নদীতে। অম্বরীশ হাত বাড়িয়ে, মনে মনে কিছু বলে—বলটি জলের উপর ভেসে উঠে ফিরে আসে। বালক অবাক হয়ে বলে, “ভাইয়া, তুমি কে?” অম্বরীশ একটু হাসে, উত্তর দেয় না। তপ্তি পাশে থেকে বলে, “উনি প্রহরী।” তখন দূরে কোথাও বজ্র নেমে আসে, বাতাস ছুটে যায়, পাখিরা উড়ে যায়, আর পঞ্চভূতের প্রতিটি সত্তা মহাশূন্যে একসাথে বলে ওঠে: “তত্ত্ব আবার জাগ্রত হল।”
নয়
যখন অম্বরীশ পঞ্চতত্ত্বের ভার গ্রহণ করে প্রহরীর আসনে বসে, তখন সমগ্র সৃষ্টির ভারসাম্য যেন কিছুটা স্থির হয়। তপ্তির সঙ্গে সে পাহাড়, নদী, মরুভূমি ও বনভূমি পরিক্রমা করতে থাকে—শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, বরং প্রতিটি উপাদানের অপ্রকাশিত অশান্তি শুনে তার মর্ম বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রহরীত্বের প্রথম পাঠই ছিল কঠিন—সবকিছু সংরক্ষণ করা যায় না, কিছু জিনিস ভেঙে পড়ে, কিছু নিজেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, আর কিছু জিনিসকে ধ্বংস না করলে পুনর্জন্ম সম্ভব নয়। সেই সময়ে আসে খবর—গোদেরিয়া নামে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আকাশের রঙ প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে রাতারাতি, আগুন একা একাই জ্বলছে গাছের গুঁড়িতে, শিশুরা ঘুমে হাঁটছে, আর লোকেরা বলছে, “এখানে কেউ এসেছে, যে মানুষ নয়।” অম্বরীশ বুঝে যায়, এ কেবল উপাদানগুলোর অস্থিরতা নয়—কোনো এক সত্তা পঞ্চতত্ত্বে হস্তক্ষেপ করছে। সে জানে, এই শক্তি সম্ভব একমাত্র একজনের দ্বারাই—প্রাচীন কালের সেই তান্ত্রিক, যিনি এক সময় পঞ্চতত্ত্ব অর্জন করে নিজেকে ‘ঈশ্বর’ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়েছিলেন। ঠাকুরদার পাণ্ডুলিপিতে ছিল তার নাম: বভ্রকালী—এক বিভ্রান্ত সন্ন্যাসী, যিনি উপাদান চেয়েছিলেন জ্ঞানের জন্য নয়, নিয়ন্ত্রণের জন্য।
অম্বরীশ ও তপ্তি যখন গোদেরিয়ায় পৌঁছায়, তখন প্রকৃতি যেন গলে যাচ্ছে। বৃক্ষের গায়ে ছায়া নেই, মাটি থেকে গন্ধ আসছে না, বাতাস এক নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতায় ঠান্ডা, আকাশের রং রক্তিম আর সাদা মিশ্রণে বিকৃত। সেখানে একটা পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষে তারা দেখতে পায় একটি শিশুকে—দেখতে পাঁচ-ছয় বছরের মতো, চোখে গভীর অন্ধকার, ঠোঁটে রক্তের রেখা, আর তার পাশে ভাসছে মাটির খণ্ড, আগুনের স্পার্ক, জলের ফোঁটা, বাতাসের ঘূর্ণি, আর মাথার ওপর এক শূন্যদৃষ্টির গহ্বর। অম্বরীশ বুঝে যায়—এ কোন শিশু নয়, এ সেই আত্মা, বভ্রকালী, যে পুনর্জন্মের মাধ্যমে ফিরে এসেছে, এবং তার উদ্দেশ্য একটাই—প্রতিটি উপাদানকে একত্র করে নিজের দেহে কেন্দ্রীভূত করে বিশ্বের ভারসাম্য ধ্বংস করা। শিশুটি তাকিয়ে বলে, “তুই আমার উত্তরাধিকার নিয়েছিস? আমি তো সৃষ্টি হয়েছিলাম সৃষ্টির পূর্বে।” তার কণ্ঠে ছিল করুণার ছায়া, কিন্তু শব্দে এক ভয়ঙ্কর আত্মবিশ্বাস। অম্বরীশ বলে, “তুই ধারক হতে পারিস, কিন্তু প্রহরী হতে পারিস না।” তখন শিশুটি হাসে, আকাশ ফেটে যায়। চারপাশে ভূমিকম্প, আগুন, ঝড়। প্রকৃতি তার কাছে মাথা নত করছে। আর ঠিক তখনই অম্বরীশ প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে—প্রহরীর কাজ কেবল ধারণ নয়, প্রয়োজনে প্রতিরোধও।
তপ্তি তখন বলে, “তুমি কি ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে?” অম্বরীশ চোখ বন্ধ করে। তার কপালের পঞ্চচিহ্ন একত্রে আলোকিত হয়, আর তখন তার সামনে দাঁড়ায় পঞ্চভূতের পাঁচ প্রাক্তন ধারক—ভূধারিণী, জলেশ্বরী, অগ্নিবীর, বায়ুরাজ, ও রুদ্রাক্ষ। প্রত্যেকে তার হাতে এক একটি অস্ত্র তুলে দেয়—না তারা তরবারি নয়, না বর্ম; বরং তারা প্রতীক—মাটির একটি কণা, জলের এক বিন্দু, আগুনের এক শিখা, বায়ুর এক কম্পন, আর আকাশের এক বিন্দু শূন্যতা। অম্বরীশ এগিয়ে যায় শিশুটির দিকে, এবং বলে, “আমি তোর সমস্ত শক্তিকে গ্রহণ করব, কিন্তু তোকে নয়। কারণ শক্তির মানে কর্তৃত্ব নয়, দায়।” তখন এক মহাস্পন্দনে শুরু হয় সংঘর্ষ—না, কোনো যুদ্ধ নয়, বরং উপাদান বনাম উপাদান, শক্তি বনাম দায়িত্ব, সৃষ্টি বনাম ধ্বংস। আকাশজোড়া বেজে ওঠে তন্ত্রমন্ত্র, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তপ্তির কণ্ঠ—“ও ফিরে আসবে। কিন্তু আমরা রক্ষা করব। কারণ আমরা বেঁচে থাকার পক্ষে।” শেষ মুহূর্তে, অম্বরীশ শিশুটির দিকে এগিয়ে নিজ দেহ খুলে দেয় সমস্ত উপাদানের প্রবাহের জন্য, আর বভ্রকালীর আত্মা মিলিয়ে যায় আলোর ঝড়ে।
দশ
আলো ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। গোদেরিয়ার ধ্বংসপ্রায় ভূমিতে, যেখানে শিশুরূপী বভ্রকালী এক ঝড়ো লয়ে নিজেকে বিলীন করে, সেখানে এখন পড়ে রয়েছে শুধু একটি রুদ্রাক্ষের দানা—শুকনো, অথচ কাঁপতে থাকা, যেন সে এখনো বেঁচে আছে কোনো স্তব্ধতায়। অম্বরীশ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা শক্তির বিকীর্ণ ধ্বংসাবশেষ বাতাসে মিশে যাচ্ছে, আর মাটিতে ছায়া পড়ছে একাধিক রেখার—মনে হচ্ছে পঞ্চতত্ত্বেরা নিজেরাই এই ভূমিকে শুদ্ধ করছে। কিন্তু এই সময়েই তপ্তি ছুটে আসে, আর দেখে—অম্বরীশের দেহ নিথর। না, মৃত্যু নয়, বরং এক গভীর নিদ্রা, যেন সে নিজের অন্তরেই প্রবেশ করেছে। তপ্তি তার কপালে হাত রাখে। মুহূর্তে অনুভব করে, এক তীব্র জোয়ার—অম্বরীশ এখন কোথাও নেই, অথচ সর্বত্র। সে এখন উপাদান নয়, এক প্রবাহ; সে এখন সত্তা নয়, এক সুর। এবং এই সুর গাইছে: “যা ধরা যায়, তা নশ্বর; যা ধারণ করা যায়, তা ত্রয়ী; কিন্তু যা দেওয়া যায়—তাই চিরন্তন।” তপ্তি জানে, সে ফিরে আসবে না আগের রূপে, কিন্তু সে এখানেই—পৃথিবীর প্রতিটি কণায়, প্রতিটি স্রোতে, শিখায়, প্রবাহে, ও শূন্যতায়।
বছর কেটে যায়। গোদেরিয়া ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক নতুন জনপদে—ধ্বংস থেকে জন্ম নেয় শান্তি। গ্রামের মাঝখানে গড়ে ওঠে একটি অদ্ভুত গম্বুজবিশিষ্ট মন্দির, কিন্তু সেখানে কোনো দেবতার মূর্তি নেই, কোনো পুরোহিত নেই। শুধু কেন্দ্রে একটি ঘূর্ণায়মান চিহ্ন—যার মধ্যে আছে মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশের প্রতীক। নাম রাখা হয়—তত্ত্বনিকেতন। সারা দেশ থেকে মানুষ আসে, শুধু বসে থাকে, চুপ করে থাকে, কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। কেউ কেউ স্বপ্নে দেখতে পায় এক ব্যক্তি—যিনি রক্ত-মাটি গায়ে মেখে নদীর পাশে বসে, অথবা আগুনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাতাসে চুমুক দিচ্ছেন। কেউ নাম বলতে পারে না, কেউ বলে, “এক সাধক,” কেউ বলে, “প্রহরী।” তপ্তি এখন সেই নিকেতনের রক্ষক। সে কখনও কারও নাম জিজ্ঞাসা করে না, কাউকে জ্ঞান দেয় না। শুধু একটি কাজ সে করে—প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় সে মন্দিরের কেন্দ্রে বসে, রুদ্রাক্ষের এক দানাকে সামনে রেখে, চোখ বুজে বলে, “তুমি এখন সব। তুমি এখন কোনো নাম নও, তবুও তুমি চিরন্তন।”
একদিন এক কিশোর আসে। চোখে প্রশ্ন, মুখে নীরবতা। সে বলে, “আমি জানি না আমি কে। শুধু টানে এসেছি।” তপ্তি মুচকি হাসে। সে কিশোরকে একটি রুদ্রাক্ষ দেয়, আর বলে, “তুই শুরু কর।” ঠিক তখনই আকাশে মেঘ সরে যায়, এক সরু রোদের রেখা এসে পড়ে সেই চিহ্নে, যা এখন অম্বরীশ নয়, বরং সেই চেতনার প্রতীক—যে প্রতিটি প্রজন্মে, প্রতিটি যুগে জন্ম নেবে এক নতুন ধারক ও প্রহরী হয়ে। আর দূরে কোথাও এক শিশুর হাসি শোনা যায়—এক নতুন সূচনা, যেখানে তত্ত্ব আবার প্রবাহিত হবে, একজনের মধ্যে নয়, সবার হৃদয়ে। তপ্তি মাথা তুলে আকাশের দিকে চায়। মনে হয় যেন কেউ বলছে—“আমি এসেছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব না—তবুও আমি থেকে যাব। কারণ আমি উপাদান, আর উপাদান কখনও মরে না। শুধু রূপ পাল্টায়।” বাতাসে তখন হালকা মাটির গন্ধ, জলের ছিটে, আগুনের উষ্ণতা, বায়ুর স্পর্শ, আর আকাশের প্রশান্তি।
***
সময়—অদৃশ্য এক নদী। সে বহে চলে অদেখা ভূমির দিকে, যেখানে মানুষের নাম আর কাজের চিহ্ন থাকে না, কেবল থেকে যায় তার প্রভাব। অম্বরীশ—একজন তরুণ, যিনি একদিন পঞ্চতত্ত্বের খোঁজে বেরিয়েছিলেন নিজের অস্তিত্ব খুঁজতে, এখন আর নেই কোথাও, তবুও তার নিঃশ্বাস টের পাওয়া যায়। কোথায়?
এক শিশুর কাঁধে হাত রাখার উষ্ণতায়, এক জলের ঢেউয়ের ছন্দে, আগুনের আলোর পেছনে ছায়ায়, বাতাসে এক পুরনো নামের ফিসফাসে, আর আকাশে এক নিরুপম নিরবতায়।
তপ্তি এখন আর শুধুই একটি নাম নয়, সে এক দৃষ্টি—যে পাহারা দেয় ভবিষ্যতের চিহ্নহীন পথিকদের। সে জানে, আরেকজন আসবে, হয়তো অন্য রূপে, অন্য ভূখণ্ড থেকে, কিন্তু খুঁজবে ঠিক সেই একই কিছু—নিজেকে ছাড়িয়ে কিছু বড় কিছু ধরতে চাওয়ার যন্ত্রণা।
তত্ত্বদের সাধনা কোনদিন শেষ হয় না। যারা সত্যিই উপাদানদের বোঝে, তারা জানে, মাটি কেবল জমি নয়, সে আশ্রয়। জল কেবল প্রবাহ নয়, সে স্মৃতি। আগুন কেবল ধ্বংস নয়, সে জাগরণ। বায়ু কেবল গতি নয়, সে অনুভব। আর আকাশ? সে কেবল শূন্য নয়, সে সম্ভাবনা।
এই উপন্যাস কোনো সমাপ্তি নয়, বরং একটি প্রবেশদ্বার। হয়তো এখন আপনি, পাঠক, সেই নতুন পথিক, যিনি নিজের ভিতরের উপাদানগুলো চিনতে শুরু করেছেন। হয়তো এখন আপনি এক অদৃশ্য সাধনার শুরুতে দাঁড়িয়ে, নিজের প্রশ্নগুলো হাতে নিয়ে। যদি কখনও আপনিও বলেন—
“আমি কিছু চাই না। আমি শুধু জানতে চাই—আমি কে?”
তবে জানবেন, কোথাও এক তপ্তি বসে আছে, রুদ্রাক্ষ হাতে, অপেক্ষায়।
—
শেষ




