অদ্রিজা লাহা
Love at First Translation
সেন্ট্রাল কলকাতার এক পুরোনো কলেজের অডিটোরিয়ামে তখন চলছিল “Tagore Through Global Eyes” শীর্ষক সেমিনার। মীরা বসু, বাংলা সাহিত্যের তরুণ লেকচারার, মঞ্চে উঠে বলছিলেন—“রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে সর্বজনীন প্রেমের কথা, তা শুধু বাংলায় আটকে নেই। তাঁর ভাবনার বিস্তারই তাঁকে বিশ্বকবি করেছে।” শোনার মতো গলা, কিন্তু চোখে মুখে বিরক্তি। কারণ তার ডানদিকে বসে থাকা ইংরেজ স্কলার ড্যানিয়েল রস তখনো টেগোরের নামটা “Robeen-dranaat” উচ্চারণ করে যাচ্ছিল, যেন উনি কোন লর্ড অফ দ্য রিংস চরিত্র।
অডিয়েন্সে কেউ হাসছিল, কেউ ভিডিও করছিল। মীরার চোখ পড়েছিল শুধুমাত্র একটা লাইনে — পোস্টারে ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে লেখা, “Love looks not with the eyes, but with the mon.”
মন না মনের অনুবাদ? নাকি typo?
ড্যানিয়েলের মুখে গর্ব—“It’s poetic license,” বলেছিল সে মঞ্চে।
মীরার মাথা গরম হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সে তার হাসিটা ধরে রেখেছিল। কারণ এটাই ছিল তার অফিসিয়াল পরিচয় পর্ব ড্যানিয়েলের সঙ্গে।
এর দুদিন পরে কলেজের মিডিয়া ক্লাবে একটা প্রোমো পোস্টার বানানো হচ্ছিল ‘Tagore vs Shakespeare’ বিষয় নিয়ে। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট হবে, রিল বানানো হবে, ক্যাপশন থাকবে দুটো ভাষায়। ড্যানিয়েল আর মীরাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো — দুজন দুটি ভাষায় প্রেম সংক্রান্ত কোট লিখবে।
মীরা লিখল, “ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।”
ড্যানিয়েল পাল্টা দিল — “Love is a smoke raised with the fume of sighs.”
একসাথে বসে দুজন একটা ডিজাইন তৈরি করল—দুটো মেঘের ছবি, একটায় বাংলা কোট, একটায় ইংরেজি।
ছবির তলায় ড্যানিয়েল লিখল ক্যাপশন — “When words fail, let languages collide.”
মীরা একটু থমকাল। “Collide?”
“হ্যাঁ, বটে! Two worlds. Two tongues. One emotion, right?”
মীরা বলল না কিছু, মাথা নেড়ে চলে গেল। সে আরেকটা ক্যাপশন ভেবেছিল—“যে ভাষায় বলি না, সে ভাষায় বুঝি।” কিন্তু সেটা লিখে লাভ কী?
রাতে পোস্টটা ইনস্টাগ্রামে এল। অনেক লাইক, অনেক রিয়েল টাইম স্টোরি রিয়্যাকশন।
কিন্তু একটা কমেন্ট চোখে পড়ল মীরার—“Nice quote 😐”
ড্যানিয়েলকে ট্যাগ করে এক ছাত্রী লিখেছে, “Tagore’s line is not romantic. It’s submissive.”
আর এক ব্রিটিশ সহকর্মী লিখেছে, “Are Bengali lovers always this intense?”
মীরা রাগে গজগজ করছিল। বাংলার ভাবগম্ভীরতাকে এভাবে ব্যঙ্গ করা যায়?
পরদিন কফি শপে দেখা হলো তাদের। ড্যানিয়েল হাসিমুখে বলল, “People are loving the contrast.”
মীরা একটু কড়া গলায় বলল, “People don’t understand Tagore. They just like quoting him.”
ড্যানিয়েলও নরম গলায় বলল, “You think I don’t understand him either?”
মীরা সরাসরি তাকাল, “Do you?”
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর ড্যানিয়েল ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খাতা বের করল। পাতায় লেখা, হাতে আঁকা কিছু চিত্রের মাঝে একটা লাইন —
“তোমার নাম জানি না, কিন্তু স্বরে আছে তুমি।”
অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল মীরার মুখে।
“এইটা তুমি নিজে লিখেছ?”
ড্যানিয়েল একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “Yes. Inspired. Not translated.”
সেই দিন থেকে কেমন যেন বদলাতে লাগল তাদের সম্পর্ক।
লাঞ্চ ব্রেকে চপের দোকানে গিয়ে দাঁড়ানো। ড্যানিয়েল বলত, “Give me that fried poetry again.”
মীরা হাসত, “It’s not poetry, it’s beguni.”
কিন্তু ড্যানিয়েল একথা মানত না—ওর মতে, চপ আর কবিতা একই জিনিস—এক কামড়েই ভিতরটা বেরিয়ে আসে।
তবে এই কথোপকথনের ফাঁকেই কখন যে প্রেমটা নিজের ভাষা খুঁজে পেল, বোঝা যায়নি।
ড্যানিয়েল একদিন বলল, “Your name, Meera, means ocean, right?”
মীরা বলল, “Yes. And yours, Daniel?”
ড্যানিয়েল হেসে বলল, “It means ‘God is my judge.’ But you can call me ‘Lost in Translation.’”
রাত গভীর হলে দুজনেই ইনস্টাগ্রামে একসাথে স্ক্রল করত।
একদিন ড্যানিয়েল একটা পোস্টে লিখল—
“ভাষা ছাড়া প্রেম অন্ধ নয়। বরং, সে চোখে দেখে না বলেই গভীর।”
মীরা কমেন্ট করল — “Finally, you get it.”
ড্যানিয়েল রিপ্লাই দিল — “No, finally I feel it.”
সেই দিনই মীরা বুঝে গিয়েছিল—এই প্রেমটা হয়তো একদিন থেমে যাবে। ড্যানিয়েলের গবেষণার মেয়াদ শেষ হবে। সে ফিরে যাবে লন্ডনে।
তবু এই প্রেমের কোনো টাইমলাইন নেই।
কারণ এটা শেকসপিয়র-টেগোর যুগলবন্দির মতো—ভাষায় আলাদা, তবু আবেগে এক।
এবং সব কিছুর মাঝে একটা চপ — এক কামড়েই বোঝা যায়, ভালোবাসা আসলে মুখে নয়, মনেই জমে।
Coffee, Curry & Confusion
কলকাতার গরমকাল মানেই বিকেলের দিকে একটা অদ্ভুত ঝিমুনি নেমে আসে রাস্তায়, আর তার সাথে আসে ভাপা গন্ধ—ফুচকা, তেলেভাজা আর লাল চায়ের। ড্যানিয়েল রস প্রথম কয়েকদিন খেতে পারেনি এইসব কিছুই। ওর ব্রিটিশ পেট খাঁটি বাটারড টোস্ট আর হালকা ব্ল্যাক কফির বাইরে কিছু মেনে নেয় না। কিন্তু মীরার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সে একদিন রাজি হলো—“Let’s do Bengali street food. I want to understand the cultural gastronomy of love.”
“Cultural gastronomy?” মীরা চায়ের কাপ হাতে তাকিয়ে বলল। “তুমি আসলে বোঝো না, ড্যানিয়েল। আমরা প্রেম করি খেতে বসে, না খেতে বসে প্রেম করি—ভুল বোঝা যায়।”
ড্যানিয়েল হেসে বলল, “Teach me, Professor.”
তারা গিয়েছিল কলেজের পাশের ‘ময়ূরী চপ হাউজ’-এ। একটা কাঠের বেঞ্চে বসে দুজনেই চা আর চপ হাতে।
ড্যানিয়েল প্রথম কামড়েই হেঁচকি তুলল—“Oh my God, it’s spicy!”
মীরা জবাব দিল, “Love is spicy.”
ড্যানিয়েল হাসল, চা খেল, তারপর বলল, “Is this what you call… beguni?”
“না, এটা আলুর চপ। Beguni is eggplant fritters. Don’t confuse the love-letter with the envelope.”
ওদের পাশেই কিছু ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছিল। একটা মেয়ে ফিসফিস করে বলল, “They’re so cute! Like a Banglish romcom.”
ড্যানিয়েল শুনতে পেল। সে একটু মুখ ফিরিয়ে বলল, “Is that a compliment or… cultural tokenism?”
মীরা বলল, “Welcome to Kolkata. Everything is both.”
পরদিন সকালে ইনস্টাগ্রামে মীরা একটা ছবি দিল—একটা চায়ের কাপের পাশে রাখা অর্ধেক কামড়ানো চপ। ক্যাপশন—“Some confusions taste better than clarity.”
ড্যানিয়েল কমেন্ট করল—“Didn’t get it, but felt it.”
মীরা রিপ্লাই করল—“Exactly.”
কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যাতেই মীরা একটু ঘাবড়ে গেল। কলেজের ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের গ্রুপচ্যাটে একটা ছবি এল—ড্যানিয়েল দাঁড়িয়ে আছে এক বিদেশিনী রিসার্চার লিলির পাশে, হাতে লাল চা, মুখে হাসি। ক্যাপশন—“Tea is better when shared with those who understand your accent.”
মীরার বুকটা একটু চমকে উঠল। ওই হাসিটা কালও ওর দিকে ছিল, আজও আছে, কিন্তু পাশে মুখটা বদলে গেছে। সে কিছু বলল না।
তবে রাতে যখন ড্যানিয়েল মেসেজ করল—
Daniel: “Today’s chaa was not the same without you.”
Meera: “Maybe it’s the company, not the tea.”
Daniel: “I thought you said misunderstandings are romantic.”
Meera: “Not when it burns your tongue.”
পরের দিন দেখা হলে মীরা একটু দূরত্ব বজায় রাখল। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে গেল, কিন্তু ড্যানিয়েলের সঙ্গে বসল না।
ড্যানিয়েল টের পেল। সে কাছে এসে বলল, “Did I do something wrong?”
মীরা মাথা নেড়ে বলল, “No. You did something usual.”
ড্যানিয়েল বলল, “Meera, I don’t understand Bengali sentiments sometimes. They’re subtle, coded… poetic.”
মীরা তাকিয়ে বলল, “And I don’t understand English sarcasm. It’s dry, detached… ironic.”
একটু থেমে বলল, “তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু চায়ের সঙ্গে আমরা একরকম commitment খুঁজি। তুমি হয়তো চা খাও কারণ কফি আজ নেই।”
ড্যানিয়েল থেমে গেল। তার চোখে একরাশ অপরাধবোধ।
রাতে একটা নতুন পোস্ট এল ইনস্টাগ্রামে—
একটা স্কেচ: একটা চায়ের কাপ, পাশে একটা চপ, আর দুটো ভাষায় লেখা:
“Love is when you don’t need subtitles.”
— D.R.
মীরা দেখে হাসল। তারপর কমেন্ট করল,
“Still… sometimes, you need to repeat the line.”
ড্যানিয়েল রিপ্লাই দিল,
“Then let’s rehearse it, again and again.”
সেইদিন রাত তিনটেয় মীরা ড্যানিয়েলকে একটা টেক্সট করল—
Meera: “ভুল বোঝাবুঝির মধ্যেও যদি প্রেম থাকে, তবে হয়তো ভাষা শেষ কথা বলে না।”
Daniel: “Can you write that in English too?”
Meera: “No. Some things are sweeter left untranslated.”
Daniel: “Then I’ll learn Bengali. Slowly. With a cup of chaa.”
Nice Quote
ইনস্টাগ্রামের এলগরিদম যেমন করে, একটা পোস্ট যতই অর্থপূর্ণ হোক, সেটার পাশে একগাদা কান্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য গজিয়ে ওঠে। মীরার আর ড্যানিয়েলের বানানো সেই চপ-ও-চা পোস্টটা ভাইরাল হওয়ার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই ১৫০০ লাইক, ২০০+ শেয়ার, আর ৩৭টা কমেন্ট জমে যায়। এর মধ্যে একটা কমেন্ট—ছোট, তির্যক, অদ্ভুত—আকৃষ্ট করল মীরাকে।
“Nice quote ”
কেউ নাম লেখা নেই, বেসিক একটা ফেক আইডি, প্রোফাইল পিকচারেও শুধু একটা হিজিবিজি আঁকিবুকি।
কিন্তু ওই ইমোজিটাই যেন মীরার ঘুম হারাম করল।
ওর মনটা এমনিতেই খচখচ করছিল—ভাষার ব্যবধান, ক্যাপশন কনফিউশন, আর সেই ‘চায়ের বাইরেও চা’ খাওয়া লিলি। তার উপর এইরকম মন্তব্য!
ড্যানিয়েল বুঝতেও পারল না ব্যাপারটা। সে তো বরং খুশি ছিল যে, “so many people are engaging with the post!”
মীরা বলল, “Engagement doesn’t mean understanding.”
ড্যানিয়েল বলল, “But criticism shows interest.”
মীরা মুখ কালো করে বলল, “Nice quote isn’t criticism. It’s dismissal.”
ড্যানিয়েল একটু থতমত খেয়ে বলল, “Then why do you care?”
মীরা একটু চুপ থেকে বলল, “Because I wrote that quote.”
সেদিন সন্ধ্যায় তাদের আবার দেখা হলো কলেজ লাইব্রেরিতে। ড্যানিয়েল কবিতা বিভাগে দাঁড়িয়ে একটা ছোট কাগজে কি যেন নোট করছিল। মীরা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কি বাংলায় লিখছ?”
ড্যানিয়েল বলল, “Sort of. I’m trying to write a bilingual poem. Want to help?”
মীরা একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “Let me guess. It ends with ‘chop’.”
ড্যানিয়েল হেসে বলল, “No! It ends with ‘mon’… your favorite word.”
মীরা বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেও মন ছিল অন্যখানে। তার মাথায় তখনও ঘুরছে সেই কমেন্ট। কে লিখল, কেন লিখল, এই প্রশ্নগুলো যেন একটা অদৃশ্য অস্থিরতা হয়ে ওর মনের গায়ে গুঁতো মারছে।
পরদিন ক্লাসে মীরা “Comparative Literature” পড়াচ্ছিল।
বিষয় ছিল: “Lost in Translation – can love survive between languages?”
ছাত্রছাত্রীদের উত্তর যেমন আশা করা যায়, তাই ছিল। কেউ বলল, “ভাষা বাধা নয়, ভালোবাসা অন্তর থেকে হয়।”
আরেকজন বলল, “Language shapes thought. So yes, it matters.”
কিন্তু শেষ বেঞ্চে বসে থাকা লিপিকা হঠাৎ বলে উঠল, “ম্যাডাম, আপনি আর ড্যানিয়েল স্যারের পোস্টটা দেখেছিলাম। সেখানে ভালোবাসার ভাষা ঠিক মতো বোঝা যায় না। কনফিউশন আছে।”
মীরা অবাক হয়ে তাকাল। “Why do you say so?”
লিপিকা বলল, “কারণ quote টা ‘nice’ হলেও, মন ছুঁয়েছে বলে মনে হয়নি। It was like… two voices shouting into different microphones.”
পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ।
মীরা প্রথমে চুপ করে রইল। তারপর একটা ধীর হেসে বলল, “তুমি জানো, ভালোবাসা অনেক সময় দুইটা ভাষায় চুপ থেকেও অনেক কিছু বলে দিতে পারে।”
সেই মুহূর্তে, ও নিজেই বুঝতে পারল—ও শুধু quote লিখছে না, ওর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এখন একেকটা bilingual caption হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিকেলে ক্যান্টিনে আবার দেখা হলো। চা, চপ, আর একটু অস্বস্তি—তিনটাই ছিল।
ড্যানিয়েল জানাল, সে ওই কমেন্টটার জবাব দিয়েছিল—“Thank you! It’s a quote from Rabindranath Tagore.”
মীরা চমকে বলল, “তুমি বললে ওটা টেগোরের লেখা?”
ড্যানিয়েল একটু থতমত খেয়ে বলল, “Isn’t it?”
মীরা বলল, “না ড্যানি, আমি নিজে লিখেছিলাম সেটা। Inspired by Tagore, yes, but it’s mine.”
ড্যানিয়েল চুপ করে গেল। সেই চুপচাপ মুহূর্তটা কাটাতে মীরা বলল, “তুমি আসলে বুঝতেই পারোনি, কেন আমি এত রেগে আছি।”
ড্যানিয়েল আস্তে বলল, “No, I didn’t. But I want to.”
রাত ১০টার সময় ড্যানিয়েলের একটা নোটিফিকেশন এল—মীরা নতুন পোস্ট দিয়েছে।
ছবিতে একটা খালি চায়ের কাপ, পাশে অর্ধেক লেখা একটা কাগজে লেখা—
“ভুলভাল অনুবাদে যদি কিছু প্রেম থেকে যায়, তবে সেটাই হয়তো আসল কবিতা।”
ক্যাপশন ছিল—“Not every quote needs a name.”
ড্যানিয়েল সেটার নিচে কমেন্ট করল—“But this one has a heartbeat.”
রাতের আকাশে চাঁদ খুব একটা বড় ছিল না। কিন্তু আলো পড়ছিল তাদের ফোনের স্ক্রিনে।
ভাষা এক হয়নি, মনের তর্জমা শুরু হয়েছিল।
Grammar of the Heart
ক্লাসে ঢুকেই ড্যানিয়েল একটুখানি থেমে গেল। চারপাশটা চেনা, অথচ আজ যেন একটু অন্যরকম। হোয়াইটবোর্ডে মীরা বড় হরফে লিখেছে — “Grammar of the Heart”। সেটা দেখে সে হেসে ফেলল, কারণ এটা আগেরদিন রাতে তাদের চ্যাটে ও বলেছিল মীরাকে:
“Love doesn’t follow grammar. It skips syntax and still makes sense.”
মীরা ক্লাস নিচ্ছিল, ইংরেজি সাহিত্যে প্রেমের বিবর্তন নিয়ে। সে বলছিল, “শেকসপিয়রের সময় প্রেম ছিল এক ধরনের ছন্দে বাঁধা যন্ত্রণা—ব্যথার মধু, আকাঙ্ক্ষার দহন। আর রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রেম হলো নির্জনে ফুল ফোটার মতো, শব্দের ভিতর নীরবতা।”
ড্যানিয়েল জানে, এই কথা শুধুই ক্লাসের জন্য নয়। ও জানে এই কথাগুলো আঙুল ঘুরে ঘুরে ওর বুকের দিকেই ইশারা করছে।
ক্লাস শেষে ড্যানিয়েল বলল, “Nice lecture, Prof. Basu. Though I’m not sure about your take on sonnets.”
মীরা ব্যাগ গুছিয়ে বলল, “Why? You love sonnets?”
ড্যানিয়েল হেসে বলল, “No. But I love someone who loves them.”
একটা হালকা থমকে যাওয়া মুহূর্ত। মীরা একটু লাল হয়ে গেল। তারপর বলল, “Don’t flirt in broken Bengali. It’s dangerous.”
ড্যানিয়েল বলল, “Then teach me the grammar.”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা তারা হাঁটছিল কলেজের পেছনের পুরনো রাস্তা দিয়ে। রাস্তার ধারে একটা দেয়ালে লাল রঙে লেখা ছিল —
“ভাষা বদলালেই কি প্রেম বদলায়?”
ড্যানিয়েল দাঁড়িয়ে বলল, “What does that mean?”
মীরা অনুবাদ করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “But the word ‘badele’ means more than just change. It’s more like… shifting identities.”
ড্যানিয়েল বলল, “Like when you say ‘চুপ থাকা’, it doesn’t just mean silence, it means something you’re hiding in silence.”
মীরা তাকাল তার দিকে। “You’re learning fast.”
ড্যানিয়েল কাঁধ ঝাঁকাল, “I’ve got a good teacher. Though I still don’t get when to use ‘tumi’ and when ‘apni’.”
মীরা হেসে বলল, “Just like in love—you never know when to keep distance and when to come close.”
কথায় কথায় তারা চলে এল পুরনো এক বইয়ের দোকানে। ড্যানিয়েল সেখানে একটা পাতলা, হলুদ রঙের বই তুলে নিল—‘প্রেমের ব্যাকরণ’।
ভেতরে পুরনো গন্ধ, ছেঁড়া পাতা, আর হাতে লেখা নোট। ড্যানিয়েল একটায় আঙুল রাখল—
“যাকে বুঝতে পারো না, তাকে ভালোবাসতে শেখো।”
সে জিজ্ঞেস করল, “Did Tagore write this?”
মীরা বলল, “No. My grandfather did. He was a schoolteacher in Krishnanagar. He believed grammar can be felt, not just taught.”
ড্যানিয়েল বইটা কিনে নিল। দোকানদার বলল, “ইংরেজ হয়ে বাংলা বই পড়বেন?”
ড্যানিয়েল উত্তর দিল, “ভাষা তো প্রেমের ফোটোকপি নয়। মূল কপি তো মনেই থাকে।”
মীরা থেমে গিয়ে তাকিয়ে রইল—এই মানুষটা কবে যেন বাংলা বলে ফেলে, আর বোঝেও তার অর্থ।
তাদের কথোপকথন যে শুধু শব্দ নয়, তা তখন মীরা বুঝে গিয়েছিল।
কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যা কোনো ব্যাকরণে বাঁধে না।
যেমন, ভিসার মেয়াদ।
ড্যানিয়েলের ফান্ডিং শেষ হতে চলেছে, আর তার মানে, তিনমাস পর ও ফিরে যাবে লন্ডনে।
মীরা জানে এই প্রেমটা এক ধরনের pending email-এর মতো।
লেখা হচ্ছে, কিন্তু পাঠানো হচ্ছে না।
তাই একদিন, চায়ের দোকানে বসে সে বলে ফেলে—
“Maybe this is a grammar error.”
ড্যানিয়েল তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “What is?”
মীরা বলে, “Us. This whole thing. A misplaced modifier in a sentence that shouldn’t exist.”
ড্যানিয়েল একটু চুপ থেকে বলে,
“But even grammar has exceptions. And love—has footnotes.”
মীরা চায়ের কাপটা তুলে ধরে হেসে ফেলল। “Then maybe we are asterisk lovers.”
ড্যানিয়েল বলল, “Then I’ll read all the footnotes. Even the ones in Bengali.”
সে রাতে ড্যানিয়েল পাঠাল একটি ছোট্ট নোট:
“ভালোবাসা মানে সবসময় শুদ্ধ বাক্য নয়।
কখনো ভুল বানানেই প্রেমের অর্থ বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”
নিচে ইংরেজিতে লিখল—“Love isn’t grammatically perfect. It just makes emotional sense.”
মীরা সেটা প্রিন্ট করে বিছানার পাশে রাখল।
এই তো—একটা ভুল উচ্চারণেই শুরু,
আর এখন ভুল ব্যাকরণেই প্রেমটা সবচেয়ে ঠিক।
চপের দোকানে সমঝোতা
কলেজ ছুটির পর মীরা হাঁটছিল ধীরে ধীরে, গলির মোড় ঘুরতেই সে দেখতে পেল সেই পুরনো পরিচিত দোকান—“ময়ূরী চপ হাউজ।” কাঠের পুরনো বেঞ্চগুলো, গরম তেলে ঝাঁঝালো গন্ধ, আর পাশের চায়ের কেটলির তপ্ত ধোঁয়া—সব কিছুই যেন আজ একটু বেশিই বাস্তব মনে হচ্ছিল। আর সেই বাস্তবতার মাঝেই বসে ছিল ড্যানিয়েল রস। একপাটি চপ নিয়ে ঠোঁট ছুঁই ছুঁই, মুখে হালকা চিন্তার রেখা।
মীরা ধীরে এসে পাশে বসল।
“Without me?” সে জিজ্ঞেস করল।
ড্যানিয়েল চমকে তাকাল, তারপর হাসল, “Was trying to translate this taste into English. Failed miserably.”
মীরা বলল, “You can’t translate everything.”
ড্যানিয়েল মাথা নেড়ে বলল, “Exactly. That’s why I waited.”
মীরা তাকাল চায়ের কাপটার দিকে। “তুমি আজ খুব সিরিয়াস দেখাচ্ছো।”
ড্যানিয়েল এক গাল চুপ করে থেকে বলল, “Because yesterday I googled ‘distance relationships between cultures’. And Google said, ‘Complicated’.”
মীরা হাসল না। শুধু বলল, “Google never dated a Bengali.”
তাদের মাঝে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর ড্যানিয়েল এক চুমুক দিয়ে বলল, “Meera, I need to go back to London in three months.”
মীরা কাঁধ ঝাঁকাল, “I know.”
“Do you?”
“Of course. আমি তো কোনো fairy tale-এ নেই। জানি এ গল্পের একটা শেষ আছে।”
ড্যানিয়েল আস্তে বলল, “But what if I want to write a sequel?”
মীরা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “তুমি কি বাংলা সিক্যুয়েল পড়েছ কোনোদিন?”
“Not yet.”
“Well, they’re slower. More nostalgic. More unfinished.”
ড্যানিয়েল বলল, “Sounds like us.”
চপ আসতেই মীরা একটা নিয়ে বলল, “তাহলে সমঝোতা করি?”
ড্যানিয়েল হাসল, “Like a treaty?”
“না, treaty নয়। বরং একটা understanding. তুমি যাও, আমি থাকি। কিন্তু কিছু জিনিস থেকে যাক—যেমন এই চায়ের দোকান, এই বেঞ্চ, আর কিছু না বলা কথা।”
ড্যানিয়েল চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “Can I leave my notebook with you? The one where I wrote Bengali lines?”
মীরা জবাব দিল, “তুমি যদি রেখে যাও, আমি সেটা শেষ করব।”
“Finish the grammar?”
“Finish the poetry.”
একটু হাওয়া উঠল। কেটলির ঢাকনা টুং করে নড়ে উঠল।
ড্যানিয়েল নিজের ফোন বের করল, ইনস্টাগ্রাম খুলে একটা ছবি তুলল—দুটা চায়ের কাপ, দুটো চপ, আর মাঝখানে রাখা একটা খোলা খাতা।
ক্যাপশন লিখল—
“Some stories don’t need translation. Just a bench and some silence.”
মীরা কমেন্ট করল—
“And a bite of understanding.”
সেই সন্ধ্যাটা ছিল একরকম অদ্ভুত শান্তিতে ভরা। কোনো দাবি নেই, কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। শুধু চোখে চোখ রেখে বোঝা—তারা আলাদা ভাষায় কথা বললেও, একেই ভাষাহীন প্রেম বলে।
চপ শেষ, চা শেষ।
ড্যানিয়েল বলল, “Same time tomorrow?”
মীরা বলল, “Same bench. Same confusion. Same peace.”
তাদের ভালোবাসা, হয়তো কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবে না—না cultural romance, না long-distance drama।
ওটা ছিল একটা bilingual চপ—বাইরে ঝাল, ভিতরে নরম।
আর সেই স্বাদ, কোনো অনুবাদে ধরা পড়ে না।
When Tagore Met Tinder
মীরার মোবাইলে তখন র্যাশির মতো নোটিফিকেশন। কলেজে “Modern Indian Writing” কোর্সে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট ঘোষণা হয়েছে—ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি ইনস্টাগ্রাম কবিতা প্রতিযোগিতা। শর্ত? বাংলা বা ইংরেজি যেকোনো ভাষায় প্রেম নিয়ে লিখতে হবে, কিন্তু ক্যাপশন হবে অন্য ভাষায়। ভাষান্তরের মধ্যে প্রেম খুঁজে পাওয়ার খেলা।
ড্যানিয়েল মীরা বসুর কাছে এসে বলল, “Sounds like us.”
মীরা বলল, “Exactly why I thought of it.”
ড্যানিয়েল চোখ টিপ মেরে বলল, “Then it’s time to go public.”
মীরা ভুরু কুঁচকে বলল, “Public?”
ড্যানিয়েল পকেট থেকে মোবাইল বার করে একখানা ছবি দেখাল—একটা অ্যাপ প্রোফাইল: তার নিজের Tinder অ্যাকাউন্ট। সেখানে লেখা bio:
“I write Tagore in English. Swipe right if you speak poetry.”
আর একটা blurry ছবি—একটা চায়ের কাপের পাশে একটা বই, তার ওপরে মীরার ছায়া।
মীরা চমকে উঠল। “তুমি এটা আমার অজান্তে দিয়েছ?”
ড্যানিয়েল বলল, “Well, technically I didn’t tag you. But your essence is there.”
মীরা একটু রেগে গিয়ে বলল, “This is not how we do things here.”
ড্যানিয়েল বলল, “But that’s how we do things there.”
একটা মুহূর্তের জন্য দুজনেই চুপ।
তারপর মীরা বলল, “You really think love is something you swipe for?”
ড্যানিয়েল হাসল, “No. But I think we all are just hoping for one good translation.”
পরদিন কলেজের ক্লাসে একজন ছাত্রী তার কবিতা পড়ে শোনায়—
“ভাষার মাঝখানে এক ফাঁকা স্পেস,
যেখানে তুমিও নেই, আমিও না—
শুধু একটা রেফারেন্স।”
সবাই হাততালি দেয়। মীরা বসে বসে ভাবছিল, তাদের এই প্রেমটা কি তবে একটা cultural footnote? একটা অদৃশ্য reference, যেটা বোঝার জন্য শব্দ নয়, context লাগে?
সন্ধ্যাবেলা ড্যানিয়েল মীরাকে মেসেজ পাঠায়—
Daniel: “Someone swiped right on my Tagore.”
Meera: “Congratulations. She must be a fan of your phonetics.”
Daniel: “I unmatched. I realized I already matched elsewhere.”
Meera: “How poetic.”
Daniel: “No. Just honest.”
রাত বাড়লে ড্যানিয়েল আবার একটা পোস্ট দেয় ইনস্টাগ্রামে।
ছবি—Tagore-এর কবিতার বই, তার পাশে ইংরেজিতে হাতে লেখা:
“Let love not be a verse, but a vowel between silences.”
ক্যাপশন—“If Tagore had Tinder, maybe he’d just ghosted everyone and written Gitanjali instead.”
মীরা হাসল। কমেন্ট করল—“And still, his match would wait.”
দিন যায়, আবার চায়ের দোকান, আবার চপ।
তবে আজ একটু অন্যরকম।
ড্যানিয়েল মীরার দিকে চেয়ে বলল, “We both are quoting Tagore too much.”
মীরা বলল, “Because we don’t know what to say otherwise.”
ড্যানিয়েল আস্তে বলল, “Then maybe it’s time to stop quoting and start living.”
সে রাতে মীরা একটা খোলা ডায়রির পাতা তুলে ছবি তোলে—
পাতায় লেখা শুধু একটা লাইন:
“ভাষার বাইরেও কিছু থাকে। যেমন তুমি।”
আর ক্যাপশন—“Not a quote. Just a moment.”
ড্যানিয়েল দেখে কিছু লেখে না, শুধু একটা রেড হার্ট রিয়্যাক্ট দেয়।
তাদের প্রেম হয়তো কোনো অ্যাপে শুরু হয়নি, কোনো কবিতায় শেষও হবে না।
তবে এই মোড়টা—যেখানে Tagore Tinder-এর সঙ্গে হাত মিলায়—সেইখানেই ওদের গল্পটা অন্যরকম হয়ে ওঠে।
ভিসা, ভিসা, তুমি দূরে কেন?
ডিসেম্বরের শুরুটা কলকাতায় খুব নির্দিষ্টভাবে আসে—হালকা কুয়াশা, পুরনো রেডিওতে রবি ঠাকুর, আর মোড়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়।
তবে এই ডিসেম্বরটা মীরার কাছে ছিল একটু বেশি ঠান্ডা। কারণ একটানা গুনে সে আজ পঞ্চাশ দিন ধরে একটাই কথা মনে মনে আওড়াচ্ছে—ড্যানিয়েল চলে যাচ্ছে।
ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে।
আর গল্পটা? তার কোনো “return ticket” নেই।
চায়ের দোকানে আজ তারা পাশাপাশি বসে নেই। মাঝে একটা ফাঁকা চেয়ার।
ড্যানিয়েল এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “Flights are expensive in December.”
মীরা বলল, “Feelings too.”
ড্যানিয়েল হাসল না। বলল, “Do you want me to stay?”
মীরা মুখ নিচু করে বলল, “Do you want me to ask?”
ড্যানিয়েল থেমে বলল, “I want you to not pretend this is easy.”
মীরা এক চুমুক চা খেল, তারপর বলল, “তুমি চাইলে থাকতেই পারো। গবেষণা বাড়াতে পারো। নতুন কোর্স নিতে পারো।”
ড্যানিয়েল আস্তে বলল, “But should I stay for you?”
এই প্রশ্নটার উত্তর এতদিনেও তৈরি হয়নি।
কলেজে সবাই জেনে গেছে ড্যানিয়েল চলে যাচ্ছে। কেউ বলে, “He’ll forget you.”
কেউ বলে, “Will you visit him?”
কিন্তু সবচেয়ে বেশি শোনা যায়—“আচ্ছা, ওরা আদৌ প্রেম করছিল?”
প্রেম যদি পোস্ট, রিল আর ক্যাপশনে আটকে থাকে, তাহলে হয়তো না।
কিন্তু যদি চুপ করে বসে থাকা, একসাথে চা খাওয়া, আর কবিতার ভাঁজে চোখ রাখা হয় প্রেম—তাহলে একশোবার হ্যাঁ।
সেই রাতে মীরা জানালার পাশে বসে একটা পুরনো চিঠি বের করল—ড্যানিয়েলের দেওয়া।
হাতে লেখা ইংরেজিতে—
“If this bench ever misses me, just sit and order two chaa. I’ll be the silence next to you.”
সে আবার মোবাইল খুলে একটা খোলা নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করল—
“ভিসা একদিন ফুরোয়। কিন্তু যে মুহূর্তগুলো কোনো পাসপোর্ট চায় না, সেগুলো থাকে। যেমন ওই বেঞ্চটা, ওই চায়ের কাপটা, ওই হেসে ফেলা একচুমুক ভুলভাল উচ্চারণ।”
পরদিন দেখা হলো ক্যাম্পাসের মেঘলা বিকেলে।
ড্যানিয়েল বলল, “Meera, I applied for an extension.”
মীরা বলল, “And?”
“Denied. Unless I join a new course.”
“Will you?”
ড্যানিয়েল তাকিয়ে রইল।
“Tell me to.”
মীরা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “No.”
ড্যানিয়েল অবাক, “Why?”
মীরা বলল, “Because I want you to choose it. Not me.”
তাদের চোখে জমে থাকা জলের মতো কিছু, যেটা শব্দ হয়ে উঠল না।
সন্ধ্যাবেলায় তারা ময়ূরী চপ হাউজে গিয়ে একসাথে বসে।
চুপ করে চা খায়, আর চপের শেষ কামড়টায় মীরা বলল,
“If you go, don’t promise to write.”
“Why?”
“Because I don’t want this love to become just past tense.”
ড্যানিয়েল বুঝে গিয়েছিল, এটা কোনো ছাঁটা সংলাপ না—এটা প্রেমের ভিতরে থাকা আসল বাক্য।
সে রাতে সে ইনস্টাগ্রামে একটা কবিতার স্কেচ পোস্ট করল—
একটা প্লেনের উইন্ডো, নিচে কলকাতার আলো, আর মাঝখানে লেখা—
“Some cities stay in luggage. Some hearts don’t need boarding pass.”
মীরা সেটাতে কিছু লেখেনি।
শুধু চুপচাপ “save” করে রেখেছে।
Love Replied, Not Just Seen
বিকেলটা যেন আজ একটু বেশি দীর্ঘ। কলেজের লাইব্রেরি ফাঁকা, শুধু জানালার পাশের একটা টেবিলে বসে আছে মীরা—সামনে ড্যানিয়েলের পুরোনো নোটবুকটা। পাতাগুলোর গায়ে লেখা বাংলার চেষ্টাকৃত অনুবাদ, অদ্ভুত বানান আর পাশে পাশে ইংরেজি সংলগ্ন ভাবনার টুকরো। একটায় লেখা—
“ভালবাসা মানে ‘তুমি’ বলা, কিন্তু ‘তুই’ হয়ে যাওয়া।”
মীরা পাতাগুলো উল্টে যেতে যেতে একটায় থেমে গেল।
একটা অর্ধেক লেখা চিঠি—অ্যাড্রেস নেই, সাল-তারিখ নেই, শুধু উপরের দিকে লেখা—
“If this never reaches you, it was still meant for you.”
তার মনে পড়ে গেল, গত কয়েকদিন ধরে ড্যানিয়েল কোনো পোস্ট দিচ্ছে না, মেসেজেও আসছে না, যেন এক অলক্ষ্য প্রস্তুতি চলছে তার ভেতরে।
পালানোর?
নাকি প্রস্থানকে কবিতা করে ফেলার?
ঠিক তখনই একটা নোটিফিকেশন এল—
Daniel Ross tagged you in a post.
মীরা তাড়াতাড়ি খুলে দেখল—
ছবি: কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে ড্যানিয়েল, হাতে একটা ছোটখাটো ব্যাগ। পেছনে অন্ধকার, কুয়াশা আর দূরে আলোর রেখা।
ক্যাপশন:
“Leaving with luggage, not with loss. She taught me that some replies take time. But they arrive. Just like poetry.”
তার নিচে ইংরেজিতে হাতে লেখা একটা কবিতা, এবং নিচে—
“Meera, I saw every message. I replied, not in text. But here, in this last line: I stayed as long as you didn’t ask me to.”
মীরা ফোনটা নামিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
বৃষ্টি পড়ে না, কিন্তু শহরের আলো আজ জলজ।
সে একটা নতুন স্ক্রিন খুলে, একটা নতুন পোস্ট লিখল—
ছবি: ময়ূরী চপ হাউজের সেই বেঞ্চ, আজ খালি।
ক্যাপশন:
“He didn’t take the bench. Or the silence. They’re still here, waiting for someone who once replied with heartbeats.”
তার নিচে একটা রিয়েল টাইম মেসেজ বক্সে ঢুকল এক লাইন—
Daniel: “Did you save the last poem?”
Meera: “No.”
Daniel: “Why not?”
Meera: “Because I memorized it.”
সেই রাতে, চায়ের কাপের পাশে শুয়ে থাকা চপের শেষ টুকরোটার মতো, একটা সম্পর্ক ধীরে ধীরে শেষ হল না—
বরং জমে থাকল।
কোনো ভিজে বইয়ের পাতায়, কোনো ক্যাপশনহীন ইনস্টাগ্রাম রিলের খামে, অথবা কোনো প্রবাসী কবিতার ফোল্ডারে।
ভালোবাসা তো শেষ হয় না,
সেটা হয় শুধু “seen”,
তবে একদিন…
ঠিক “replied” হয়।
ভালোবেসে থাকি দূর থেকে
সময় পেরিয়ে গেছে চার মাস।
কলকাতায় গ্রীষ্ম এসেছে ঘেমে-নেমে, চায়ের কাপে বরফ পড়ছে, আর ময়ূরী চপ হাউজে ‘special mango chutney with chop’ অফার চলছে।
তবে সব কিছুর মধ্যেও একটা জিনিস ঠিক আগের মতোই—বেঞ্চটা।
সেই পুরোনো কাঠের বেঞ্চ, যেটাতে ড্যানিয়েল আর মীরা বসত একসাথে, এখন শুধু মীরা বসে।
মাঝে মাঝে চা আর এক পাটি চপ অর্ডার করে।
আর পাশে ফাঁকা রেখে দেয় আরেকটা কাপ।
কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা বদলে গেছে, তবু দেয়ালের পোস্টারে এখনো লেগে আছে সেই পুরোনো সেমিনারের ছবি—‘Tagore Through Global Eyes’।
সেখানে এখন কেউ আর ড্যানিয়েলকে চিনে না, শুধু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “Madam, the British guy? He wrote nice captions!”
মীরা নিজের ক্লাসে আজ একটা নতুন বিষয় এনেছে—“Digital Memory and Love: When Posts Become Proof.”
সে বলল, “আমরা এখন প্রেমে পড়ি টেক্সট পড়ে, আর বিচ্ছেদ বুঝি রিপ্লাই না দেখে। শব্দ তো ছিল আগেও, কিন্তু এখন তা টাইমস্ট্যাম্পড।”
এক ছাত্র বলল, “Madam, what about unsent messages?”
মীরা থেমে বলল, “Those are the purest ones. Because they were for the heart, not for the screen.”
তারপর সে ক্লাস শেষে নিজের ডেস্কে গিয়ে একটা নোট খুলল—ড্যানিয়েলের পাঠানো সেই শেষ কবিতা, এখনো হাতে লেখা সেই পাতায় সাঁটানো।
নিচে সে লিখে রেখেছে—
“ভালোবেসে থাকি দূর থেকে। কারণ কাছাকাছি এলেই হয়তো ভাষা ফুরিয়ে যাবে।”
এদিকে লন্ডনে বসে ড্যানিয়েল একটি নতুন অনলাইন কোর্স শুরু করেছে—‘Comparative Poetics in Translation’।
ক্লাসে সে বলে, “Love in Bengali isn’t always spoken. It’s brewed, like cha. And sometimes it’s fried, like chop.”
ছাত্রছাত্রীরা হাসে, কিন্তু সে জানে, এটা শুধু কনটেন্ট নয়—এটা স্মৃতি।
তার ডেস্কে রাখা মীরার দেওয়া সেই শেষ চিঠি।
ভিতরে লেখা ছিল—
“তুমি ফিরে না এলেও, আমি থাকব। কারণ তুমি থেকে গেছ, এমন এক জায়গায় যেখানে আর কেউ পৌঁছায় না—আমার উচ্চারণে।”
রাতের দিকে মীরা একটা নতুন রিল তৈরি করে—
বেঞ্চের ভিডিও, পিছনে বেজে চলেছে একটি কবিতা—তারই লেখা, তারই কণ্ঠে—
“একটা বেঞ্চ, একটা কাপ, আর মাঝখানে থাকা না-বলা বাক্যটাই বুঝিয়ে দেয়, প্রেম যায় না—সে থেকে যায়… সময়ের ফাঁকে।”
ড্যানিয়েল দেখে, রিপোস্ট করে, আর নিচে লেখে—
“Still there. Still reading.”
তাদের মধ্যে কোনো ‘তুমি আসবে কবে?’ নেই,
নেই ‘আমার জন্যে থাকবে?’
তবে একটা অদৃশ্য লাইন এখনো দু’জনকে জুড়ে রেখেছে—
ভাষার বাইরে, দেশে-বিদেশে, সময়ে আর অনুবাদের ছায়ায়।
ভালোবাসা অনেক সময় ফ্লাইট মিস করে।
কিন্তু সে বেঞ্চ মিস করে না।
আর সেখানেই সে বেঁচে থাকে।
And the Chop was Shared
কলকাতার এক বর্ষার দুপুর। জানালার বাইরে গাছের পাতায় জল গড়িয়ে পড়ে, আর তার ছায়া পড়ে ক্যাম্পাসের পুরনো লাইব্রেরির জানালায়।
মীরা বসে আছে টেবিলের সামনে। হাতে একটা খাম।
ড্যানিয়েলের হাতের লেখা চেনা হয়ে গেছে এখন—slanted, deliberate, ভুলভাল বানানে মেশানো বাংলা-ইংরেজি।
খামের ভেতরে একটা ছোট চিঠি আর একটা টিকিট—লন্ডন টু কলকাতা।
চিঠিতে লেখা—
“Some sentences don’t end in full stops. They just pause. I’m pressing play again.”
নিচে—“I’ll be at the bench on Friday. If you’re still waiting.”
শুক্রবার এল।
বিকেলটা কুয়াশামাখা, ভেজা বাতাসে ভেসে আসছে তেলেভাজার গন্ধ।
ময়ূরী চপ হাউজের পুরোনো বেঞ্চে মীরা আগে থেকেই বসে, হাতে দুই কাপ চা, আর দুটি চপ।
কেউ কিছু বলে না, কিন্তু দোকানদার চোখ টিপে হেসে বলল, “দু’জনের জন্য?”
মীরা হেসে মাথা নাড়ল।
অপেক্ষার সময় যেন কিছু বেশি দীর্ঘ ছিল না, কারণ পরের মুহূর্তেই ড্যানিয়েল এল।
পিঠে ব্যাগ, হাতে ভিজে পাসপোর্ট কভার, মুখে সেই পুরোনো দৃষ্টি—যেটা মীরার ভাষা কখনো বুঝত না, কিন্তু অনুভব করত।
দু’জন কিছু না বলেই বসে পড়ল।
মাঝখানে চুপচাপ চপ, আর দুই কাপ চা।
ড্যানিয়েল বলল, “I almost didn’t send the letter.”
মীরা বলল, “I almost didn’t wait.”
একটা নিঃশব্দ হাসি একসাথে ছড়িয়ে পড়ল, যেন বৃষ্টির ফোঁটায় জমে থাকা পুরোনো কষ্টও গলে গেল।
ড্যানিয়েল একটা ছোট্ট বাক্স বার করল—ভেতরে সেই পুরনো নোটবুক, যেটা মীরা একবার বলেছিল শেষ করে দেবে।
সে বলল, “You didn’t finish it.”
মীরা বলল, “I waited for the right punctuation.”
ড্যানিয়েল বলল, “Then let’s write together.”
তারা নোটবুকটা খুলে দু’জন একসাথে লিখল—
“ভাষা ভেঙে গেলে যা থাকে, তাকেই বলে ভালোবাসা।”
নিচে—“And the chop was shared.”
সেদিন সেই বেঞ্চে, চায়ের কাপের গরম ধোঁয়ার মধ্যে, কেউ শেকসপিয়র কোট করেনি, কেউ রবীন্দ্রনাথ লেখেনি।
তারা নিজেরাই লিখে ফেলেছিল এমন এক বাক্য, যা আর কোনো ভাষায় অনুবাদ সম্ভব নয়।
পাশের একজন ছাত্র ইনস্টাগ্রাম লাইভ করছিল।
তাতে ক্যাপশন উঠল—
“They look like a sentence that took time to finish. But finally, found its period.”
হয়তো সবার প্রেম এত নিখুঁত অনুবাদ হয় না।
হয়তো অনেক সম্পর্কই ভুল গ্রামারে জন্মায়।
কিন্তু একদিন, যদি কেউ ফিরে আসে, আর চুপচাপ পাশে বসে—
তবে বোঝা যায়,
চপটা ভাগ করে নেওয়াই আসল ক্যাপশন।
শেষ




