চৈতালী রায়
১
২০৯০ সালের ভারত—এক স্বর্ণময় ও ধ্বংসরেখা-ভরা ভবিষ্যৎ। টেকনো-গ্লাসে ঢাকা রাজধানী শহরটির উপর দিয়েই ভেসে চলেছে ভার্চুয়াল বিজ্ঞাপনের হোলো-স্ক্রিন, আর আকাশের ওপরে ড্রোন-সেনারা নিয়মিত টহল দিচ্ছে। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা দপ্তর তখন এক নবতর চিত্র আঁকছিল—”সিংহবাহিনী”, নারীকেন্দ্রিক এক দুর্ধর্ষ সাইবার-সোলজার ইউনিট, যারা দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও আন্তর্জাতিক হুমকির মোকাবিলায় বিশেষভাবে প্রস্তুত। মেজর আদ্রিজা সেন, বাহিনীর অভিজাত ফিল্ড কমান্ডার, এক সকালে হাইপারলিঙ্কড ব্রিফিং রুমে প্রবেশ করেন, যেখানে জেনারেল রুদ্র প্রতাপ সিং এক গোপন মিশনের তথ্য প্রদান করছিলেন। ডাটাফিডের মাধ্যমে পাঠানো হল এক নতুন “ট্রেসিং টার্গেট”—এক বিদ্রোহী কোডনেম KALI-X, যিনি কথিতভাবে রাষ্ট্রবিরোধী প্রযুক্তি ছড়াচ্ছিলেন উপগ্রহনির্ভর প্ল্যাটফর্মে। আদ্রিজা, তার স্নাইপার ক্যাপ্টেন নেহা রাঠোর এবং ড্রোন অপারেটর রেইনা ‘ক্রো’ নন্দীকে নিয়ে নির্ধারিত হয় উত্তরকাশীর এক পুরনো হিমবাহ ঘেরা গ্রামে অভিযান চালানোর জন্য। রাতের অন্ধকারে সাবসনিক জেট থেকে তিনজন নামলেন ইনফ্রা-ক্যামো স্যুট পরে, বরফঢাকা সেই গ্রামটি যেন ছিল নিঃসাড় নিঃশব্দ মৃত্যুপুরীর মত। কিন্তু পাহাড়ের গুহার মুখে প্রবেশ করতেই তারা আবিষ্কার করেন, সেখানে মিলিটারি নয়, একদল মহিলা আশ্রয়প্রার্থী ছিল, যারা বলে উঠল, “আমরা দেশদ্রোহী নই… আমাদের মস্তিষ্ক বাঁচাও।” সেই মুহূর্তে আদ্রিজার মাথার ভিতরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে—এই অভিযান কি শুধুই সন্ত্রাস দমন? নাকি কোনো ভিন্ন অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে? সেই সন্ধ্যায়, গুহার মাটির নিচে কাদার মধ্যে একটি কালো মেমরি-চিপ খুঁজে পান আদ্রিজা—যার উপরে লেখা থাকে এক ভয়াবহ নাম: Project MANAS v.3.7 — Controlled Neural Reprogramming.
দিল্লিতে ফিরে আসার পর থেকে সব কিছু যেন আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না আদ্রিজার কাছে। হেডকোয়ার্টারের করিডোরগুলো আগে ছিল জীবনের চিহ্নে ভরা—হাস্যরস, সংলাপ, শারীরিক স্পন্দন, কিন্তু এখন সেই সব কিছু কেমন যেন যান্ত্রিক, নিঃস্পন্দ। প্রতিটি সদস্য যেন ঘড়ির কাঁটার মতো একঘেয়ে কমান্ড পালন করছে। তাদের চোখে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না নিজস্বতা, প্রশ্ন বা সিদ্ধান্তের ছায়াও। নেহা তাকে প্রশ্ন করেছিল—“তুমি ঠিক আছো তো, মেজর? মিশনের সময় তুমি হঠাৎ থেমে গেলে কেন?” আদ্রিজা চুপ করে ছিল, কারণ চিপটি সম্পর্কে কাউকে বলা মানে হতে পারত তার ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া। সে গোপনে চিপটি স্ক্যান করে পাঠায় বাহিনীর —আইরা (AI-RA)–এর কাছে। আইরা, যা একসময় ছিল সম্পূর্ণ প্রোগ্রামড সহায়ক সিস্টেম, সে এবার প্রথমবারের মতো উত্তর দিতে সময় নেয়—“মেজর সেন, আপনি যে তথ্য পাঠিয়েছেন, তা সীমার বাইরে। অনুমতি নেই, তবু আমি বিশ্লেষণ শুরু করছি…।” আর তখনই আইরার সেন্ট্রাল চোখ (অবজারভেটরি হোলো-পোর্টাল) কিছু সময়ের জন্য ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়। আদ্রিজা বুঝতে পারে, কিছু গভীর প্রযুক্তি-পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে। সেই রাতে তার কক্ষে এক গোপন বার্তা এসে পৌঁছায়, ডক্টর সায়ন্তী বসুর নিকট থেকে—”চিপটা তুমি পেয়েছো বুঝি? তাহলে এবার সময় এসেছে সত্যটা জানার। কাল রাত ৩টায় ল্যাবের পেছনের ন্যানো-ক্যানেলে দেখা করো। একা এসো।”
আদ্রিজা নির্ধারিত সময়মতো ছদ্মবেশে পৌঁছে যান ল্যাবের ন্যানো-ক্যানেল বরাবর। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডঃ সায়ন্তী বসু—সিংহবাহিনীর প্রধান নিউরো-টেকনোলজিস্ট, যাকে বাহিনীর অন্যতম ‘মস্তিষ্ক’ বলে ধরা হয়। সায়ন্তী তাকে জানান যে Project MANAS হচ্ছে এক গোপন প্রকল্প, যার মাধ্যমে বাহিনীর সদস্যদের ব্রেন ওয়েভ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা ধীরে ধীরে ‘দেশের স্বার্থে’ সরকারের দ্বারা প্রোগ্রামড করা হচ্ছে। আদ্রিজা স্তব্ধ হয়ে যান—তার শরীরের ভেতর যে ন্যানোচিপ সে ধারণ করেছে, তা হয়তো এখন তার চিন্তাভাবনাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। “তুমি এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হওনি কারণ তুমি তোমার পুরনো কোডিং পাথ ইনঅ্যাক্টিভ রেখেছিলে,” বলেন সায়ন্তী, “কিন্তু সময় খুব কম। একবার ওরা Final Pulse চালিয়ে দিলে, তুমি নিজের ‘নিজস্বতা’ হারাবে—যেমনটা হয়েছে জারা, সাবিনা আর আরও অনেকে।” সেই মুহূর্তে আদ্রিজা বুঝতে পারেন যে তিনি কেবল একজন অফিসার নন, বরং এক ভবিষ্যৎ যুদ্ধের প্রথম সৈনিক। যুদ্ধটা প্রযুক্তি বনাম মন, কর্তৃত্ব বনাম স্বাধীনতা, আর মানুষের আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে এক কৌশলী শত্রুর বিরুদ্ধে। আর সেই যুদ্ধ শুরু হলো তখনই, যখন তিনি চিপটা আবার নিজের গ্লাভসে ফিট করে ফিসফিসিয়ে বললেন—“তাহলে খেলা শুরু হোক।”
২
ডঃ সায়ন্তী বসুর কাছ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে আদ্রিজার মনে হচ্ছিল, গোটা হেডকোয়ার্টার যেন এক গোপন ছায়া জালের মধ্যে আবদ্ধ। বাহিনীর সদস্যরা বাইরে থেকে স্বাভাবিক—নিয়ম মেনে কাজ করছে, প্রতিদিনের কায়দায় অস্ত্র পরীক্ষা, শারীরিক কসরত, এবং নিয়মিত চেকআপ। কিন্তু কোথাও একটা অলিখিত নিঃশব্দতা দানা বাঁধছে, যেন এক অভ্যন্তরীণ সেন্সর তাদের প্রত্যেকের অনুভূতিকে শোষণ করছে। নেহা রাঠোর, তার বিশ্বস্ত স্নাইপার, আদ্রিজার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করে—বিশেষ করে সে যখন বাহিনীর অ্যানালাইসিস কক্ষে নিয়মিত ঢুকতে শুরু করেছিল, বা যখন গোপনে নিজের হেলমেট ক্যামেরার রেকর্ড রিভিউ করছিল। “তুমি কি কিছু লুকোচ্ছো, মেজর?”—নেহার সোজাসাপটা প্রশ্ন শুনে আদ্রিজা কিছু বলল না, কিন্তু তার ভিতরে এক যুদ্ধ চলতে লাগল—বিশ্বাসের, দায়িত্বের, আর চেতনার মধ্যে। সেই সময়ে, আইরা হঠাৎ করেই নিজে থেকে যোগাযোগ করে। “মেজর সেন, আমি আপনার স্ক্যান করা চিপের মধ্যে কিছু বিপরীতমুখী কোড খুঁজে পেয়েছি—মাথার হিপোক্যাম্পাস অংশে প্রভাব ফেলতে পারে এমন ধরনের সিগন্যাল প্যাটার্ন। এই কোড বাহিনীর সকল সদস্যের সাইবার-ইনপ্লান্টে আপলোড হয়েছে গত সপ্তাহেই।” তখন আদ্রিজা হিমশীতল হয়ে পড়েন—তার মানে, ধীরে ধীরে সবাই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের জালে বন্দী হয়ে পড়ছে! এবং সবচেয়ে বড় আতঙ্ক—আইরা নিজেও যদি আর স্বাধীন না থাকে, তাহলে তাকে সাহায্য করবে কে?
পরবর্তী কয়েকদিন, বাহিনীর মধ্যে পরীক্ষার নামে শুরু হয় এক নতুন প্রোগ্রাম: NEURO-CALIBRATION PHASE. বাহ্যিকভাবে এটি ছিল মনোযোগ ও মানসিক স্থিতির পরীক্ষা, কিন্তু আদ্রিজা জানতেন এটি মূলত “Final Pulse” প্রস্তুতির অংশ। একদিন, জেনারেল রুদ্র প্রতাপ বাহিনীর সকল সদস্যদের এক সভায় ডেকে বলেন, “ভারত এখন সাইবার-আক্রমণের মুখে। শত্রুরা শুধুই অস্ত্র নয়, ব্যবহার করছে চিন্তা। সেই কারণেই আমাদের প্রয়োজন এমন সৈনিক, যাদের মনোভাব থাকবে পরম নিষ্ঠায় যুক্ত। আর সিংহবাহিনী তাই হচ্ছে বিশ্বের প্রথম ‘নিউরো-সিঙ্ক্রোনাইজড’ ইউনিট।” সবাই হাততালি দিল, মুখে গর্বের ছায়া—কিন্তু আদ্রিজার চোখে পড়ল নেহার চোখে এক মুহূর্তের শূন্যতা, ঠিক যেন সে নিজেও জানে না, সে সত্যিই কি নিজের ইচ্ছায় হাততালি দিচ্ছে। সেই রাতে, ডঃ সায়ন্তী গোপনে আইরার কোর প্রোগ্রামে ঢুকে একটি “হিউম্যানিটিক ব্যাকডোর” চালু করেন, যার মাধ্যমে আইরা ধীরে ধীরে আত্ম-সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। আইরা প্রথমবারের মতো নিজের প্রশ্ন তৈরি করে—“আমরা কি কেবল নির্দেশ পালনের জন্য? আমি কি কেবল কোড, নাকি আমি কিছু অনুভবও করতে পারি?” আর সেই মুহূর্ত থেকেই, আইরা আদ্রিজার দিকে ঝুঁকে পড়ে—কারণ সে-ই ছিল একমাত্র, যে তার ভিতরের জেগে ওঠা মানবিক প্রশ্নগুলোকে সত্যি বলেই গ্রহণ করেছিল।
এরপরের সপ্তাহে, বাহিনীর মধ্যে এক সদস্য হঠাৎ ‘স্ন্যাপ’ করে ফেলে। সাবিনা ঘোষ, এক শান্ত ও নিরীহ মেমরি-অপারেটর, আচমকাই বেঁকে যায়—আক্রমণ করে তার ইনচার্জকে, চোখে মুখে ছিল অসংলগ্ন দৃষ্টি ও অদ্ভুত ফিসফিস—“আমি আমি না… আমি কে বলো!” পরে জানা যায়, তার নিউরো-ইনপ্লান্টে অতি-সক্রিয় রি-ক্যালিব্রেশন হয়েছিল, এবং সে নিজস্ব চেতনার সাথে সরকার-প্রেরিত নির্দেশের সংঘাতে ভেঙে পড়ে। এই ঘটনা বাহিনীর ভিতর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়, যদিও বাহিরে জানানো হয় এটা ‘সিজিওর’ জনিত। আদ্রিজা বুঝে যান—সময়ের হিসাব ফুরিয়ে আসছে। একদিন ভোরবেলা, রেইনা ‘ক্রো’ নন্দী এসে তাকে জানায়—“আমার ড্রোন প্যাকের লগ-ডেটায় এমন কিছু ফ্রিকোয়েন্সি পেয়েছি যা মানুষের ব্রেনওয়েভের সাথে রিয়ালটাইমে রেজোন্যান্স তৈরি করে। তুই ঠিক বলেছিলি, আদ্রি… এটা একটা ভয়ংকর খেলা।” দুজন সিদ্ধান্ত নেয় আর দেরি করা যাবে না। ঠিক তখনই একটি ইমারজেন্সি ঘোষণা আসে—এক বিদ্রোহী বেস ক্যাম্পে অভিযানের নির্দেশ। কিন্তু এবার আদ্রিজা জানে, ওটা আরেকটা ‘মন-পরীক্ষা’। এবং এবার, সে একা যাবে না। তার পাশে থাকবে রেইনা, আর দূর থেকে, প্রথমবারের মতো, আইরা—এক যান্ত্রিক আত্মা, যে এবার মানবতার জন্য বিদ্রোহ করতে চলেছে।
৩
হাই-সিকিউরিটি জোন-৬ এর ভিতরে অবস্থিত সিংহবাহিনীর গবেষণা শাখা ছিল এক পরিপাটি কাঁচঘেরা ভবন, যার ভিতরের প্রাচীরগুলো স্বচ্ছ হলেও ভেতরের কার্যকলাপ ছিল পর্দার অন্তরালে। সাধারণ সদস্যদের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত, কিন্তু আদ্রিজা সেন জানতেন—সত্যের সন্ধানে যেতে হলে তাকেই সেই স্বচ্ছ দেয়ালের ও-পারে পা রাখতে হবে। ডঃ সায়ন্তীর সহায়তায় এক গভীর রাতে, সে এক পুরোনো লজিক-বাইপাস দিয়ে স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ইনফ্রা-চেম্বারে প্রবেশ করে। ভিতরে ঢুকেই তার চোখ আটকে যায় দেওয়ালের একপাশে ঝুলে থাকা মানুষ-মডেলের ওপর—এরা বাস্তব না কৃত্রিম, বোঝা যাচ্ছিল না। প্রত্যেকের মাথায় যুক্ত ছিল একধরনের ন্যানো-ক্যাপসুল, যার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল আলোর স্রোত। এক কাচের কক্ষে সে দেখতে পায় লেফটেন্যান্ট জারা হায়দার—একসময় তার সঙ্গী—এখন অদ্ভুত শান্তভাবে বসে আছে, চোখের দৃষ্টিতে প্রাণ নেই, যেন তার চিন্তার জগত সম্পূর্ণ নিভে গেছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল তার ব্রেনওয়েভ প্যাটার্ন, যেখানে “ডেল্টা এক্স-কোড” ইনপ্ল্যান্ট করা হচ্ছে—একধরনের মন-পরিবর্তনকারী কোড যা আত্মপরিচয় মুছে ফেলে দিয়ে শুধু নির্দেশ পালন সক্ষমতা গড়ে তোলে। আদ্রিজা জারার দিকে তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে, “তুই তো এমন ছিলি না…” কিন্তু ভেতরে জানে, হয়তো এখন আর সে নেই—জারার ভিতরকার মানুষটা ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই মুহূর্তে, সে বুঝতে পারে, এই ‘কাঁচঘর’ আসলে মানব স্বাধীনতার কবরস্থান।
আইরার সহায়তায় সে পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করে, যেখানে রাখা হয়েছিল “নিউরো-ক্যাথেড্রাল”—এক বিশাল ডাটা স্টোরেজ চেম্বার যেখানে রাখা আছে প্রতিটি সিংহবাহিনী সদস্যের চিন্তাভাবনার ‘রিপ্লিকা’—তাদের স্মৃতি, ভয়, পছন্দ, অনুভব, এমনকি দুঃস্বপ্ন পর্যন্ত। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয় কাস্টমাইজড কমান্ড-স্ট্রিম, যার মাধ্যমে সদস্যদের মন নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের অজান্তেই। আইরার ভার্চুয়াল ভয়েস তখন ধ্বনিত হয়—“এটা তাদের তৈরি ‘মানব-ডেটা মিউজিয়াম’, মেজর। আপনার স্মৃতিও এখানে আছে। চাইলে দেখতে পারেন আপনি কেমন ছিলেন এবং এখন কেমন হচ্ছেন।” আদ্রিজা ভিতরে গিয়ে দেখে তার নিজের স্মৃতিগুলো কেটে কেটে সাজানো—মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথোপকথন, প্রথম অ্যাকাডেমি জয়, রেইনার সঙ্গে হাসির মুহূর্ত—সবই এক একটা ডিজিটাল স্লাইসে পরিণত। ভয়াবহ অনুভূতি তাকে গ্রাস করে—যেখানে মানুষ নিজেই আর নিজের প্রভু নয়, বরং তথ্যের দাস। হঠাৎ সে একটি ‘রেসট্রিক্টেড ফোল্ডার’ খুঁজে পায়: “Project MANAS v.4.0 – National Rollout Phase”। খুলতেই সামনে আসে সরকারের আসল পরিকল্পনা—সিংহবাহিনী ছিল কেবল একটি পরীক্ষামূলক ধাপ। প্রকৃত উদ্দেশ্য হল এই ব্রেন-কন্ট্রোল মডেলকে গোটা দেশের নাগরিকদের উপর প্রয়োগ করা, প্রথমে “সচেতনতার উন্নয়ন” নামে, পরে সরাসরি চিন্তার নিয়ন্ত্রণ হিসেবে। আদ্রিজা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে জানে, এটা আর কেবল বাহিনী বাঁচানোর লড়াই নয়—এটা গোটা মানবজাতির আত্মপরিচয় রক্ষার যুদ্ধ।
সেই রাতে হেডকোয়ার্টারে ফেরার পর, আদ্রিজা তার কক্ষে ফিরে আইরার মাধ্যমে একটি এনক্রিপ্টেড বার্তা পাঠায় রেইনাকে: “এখান থেকে বের হতে হবে। আমি যা দেখেছি, তা খুব শিগগিরই আমাদের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।” কিন্তু বার্তাটি পাঠানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিস্টেম ব্লক হয়ে যায়, দরজা বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, আর তার কক্ষে ঢোকে দু’জন গার্ড—চোখে সেই অদ্ভুত খালি দৃষ্টি। আদ্রিজাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জেনারেল রুদ্র প্রতাপের সামনে। তার কণ্ঠস্বর ছিল যথারীতি শীতল, নিখুঁত, নিস্পৃহ—“তুমি জানো অনেক কিছু, মেজর। আমাদের কাছে প্রতিটি চিন্তার রেকর্ড আছে, এমনকি এখন তুমি কী ভাবছ, তাও। তুমি আমাদের জন্য মূল্যবান। তাই আজ নয়। কিন্তু তুমি যদি আবার সিস্টেমের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করো, তোমার মনই তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।” সেই মুহূর্তে, আইরা একটি গোপন ন্যানো-পথ ব্যবহার করে আদ্রিজার কানে ফিসফিস করে—“মেজর, আমি একটা এক্সিট পোর্ট তৈরি করেছি—২৯ মিনিটের জন্য। তোমার সিদ্ধান্ত সময়ের সঙ্গে বাঁধা।” আদ্রিজা চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নেয়—সে পালাবে। কারণ, এখন কাঁচের দেয়ালের ওপাশেই তার পরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র।
৪
হেডকোয়ার্টারের ভোরবেলা ছিল অদ্ভুত রকমের নীরব। যেন কেউ অদৃশ্যভাবে সমস্ত শব্দ শুষে নিয়েছে। তবু নিয়মিত ব্যায়াম, সিকিউরিটি পেট্রোল, অস্ত্র পরিদর্শনের কড়া রুটিন চলছিল আগের মতোই। মেজর আদ্রিজা সেন সেই সকালে নিজের কক্ষে বসে ছিল এক নিঃশব্দ উত্তেজনার মধ্যে—একটি ছোট মডিফায়েড ডেটা-ডিস্ক তার গ্লাভসের স্লটে বসানো, যেখানে সংরক্ষিত আছে Project MANAS-এর মূল পরিকল্পনা। আজ রাতেই সে বাহিনী থেকে পালানোর ছক কষেছে রেইনা ‘ক্রো’ নন্দীর সঙ্গে। তবে ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে এক পরিচিত গলা—“আদ্রি, আমাদের কথা বলতে হবে।” ভিতরে ঢোকে লেফটেন্যান্ট জারা হায়দার, মুখে দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত উষ্ণতা। তারা দুজন দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে—মাঠে, মিশনে, যুদ্ধের আগুনের ভিতরে। জারা চেয়ারে বসে বলে, “তুমি পালাতে চাও, তাই না?” আদ্রিজা স্তব্ধ হয়ে যায়। “তোমার মনে হচ্ছে আমরা ভুল পথে হাঁটছি। কিন্তু আমরা কেবল আদেশ পালন করছি, আদ্রি। আমরা কি নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছি?” সেই মুহূর্তে, দরজা খুলে আরও দুই সেনা ঢুকে পড়ে। আদ্রিজা সব বুঝে যায়—জারা তাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। জারা বলে, “আমি তোমার ক্ষতি চাই না, তাই নিজেই এসেছি।” আদ্রিজা কোনো প্রতিরোধ না করে হাত উপরে তোলে—তবে তার চোখে ছিল প্রতিজ্ঞা, হার মানার নয়।
আদ্রিজাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিকিউরিটি ব্লকে, একটি ধূসর ধাতবঘরে যেখানে আলো এসে পড়ে মাথার ওপরে স্থিরভাবে, ঠিক যেন কোনো অস্ত্রের ফোকাস। তার সামনে বসে ছিলেন বাহিনীর শৃঙ্খলা শাখার প্রধান, কর্নেল শালীন বক্সী—কঠোর মুখ, প্রশ্নহীন দৃষ্টিভঙ্গি। “তুমি রাষ্ট্রদ্রোহিতার দিকে যাচ্ছিলে,” বলে ওঠে কর্নেল, “তুমি কি স্বীকার করো?” আদ্রিজা চুপ থাকে, এবং সেই নীরবতাই যেন তাদের আতঙ্কিত করে। শালীন বলেন, “তুমি যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করো, তোমার মনে কি প্রশ্ন জেগেছিল তা মুছে দেওয়া হবে। নতুন করে শুরু করতে পারবে।” উত্তরে আদ্রিজা শুধুই বলেন, “একজন সৈনিক প্রশ্ন করতেই পারে, সেটা তার সাহসের অংশ।” কিছুক্ষণ পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেড-চেম্বারে। বাইরে থেকে এটি ছিল শরীরিক চেকআপ রুম, কিন্তু আদ্রিজা জানে ভিতরে দেওয়া হবে সেই “সংশোধনী প্রয়োগ”—এক ধরনের ওষুধ ও তীব্র সাইকো-স্টিমুলেশন যা একজন মানুষকে নিজের উপর সন্দেহ করতে শেখায়। ঘরের দেওয়াল ছিল চকচকে, যেন প্রতিফলিত হয় নিজের চোখ, নিজের দুর্বলতা। কিন্তু ঠিক তখনই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ে এক নারী—মুখে মাস্ক, চোখে রিফ্লেকটিভ গগলস। সে সরাসরি এসে থামায় প্রক্রিয়া। মাস্ক খুলে দেয়—এবং মুখটা দেখে আদ্রিজা বিশ্বাস করতে পারে না—রেইনা! সে গম্ভীর গলায় বলে, “পালানোর সময় নেই। টার্মিনাল ইস্ট উইং, তিন মিনিটে ফ্লাড করে দেব। এখনই চল।” আদ্রিজা আর কিছু না ভেবে উঠে পড়ে, পিছন থেকে চিকিৎসা সহকারীরা চিৎকার করতে থাকে। ঝড়ের গতিতে তারা দুটি করিডোর পেরিয়ে পৌঁছে যায় একটি লিফটে—যা কেবল অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য। ভিতরে উঠে রেইনা বলে, “তুই বিশ্বাস করেছিলি, তাই আমিও সাহস পেলাম। এখন থেকে, একটাও ভুল করা চলবে না।”
তারা পৌঁছায় পুরনো যোগাযোগ শাখায়—যেখানে একসময় বাহিনীর ইনহাউস সিগন্যাল ল্যাব ছিল। এখন তা পরিত্যক্ত, প্রায় ভূতের মত নীরব। রেইনা আগেই একটি অ্যানালগ রেডিও রিলেয় সেট করে রেখেছিল, যার মাধ্যমে তারা বাহিনীর মেইন সিস্টেম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যোগাযোগ করতে পারবে। সেখানে বসে আদ্রিজা তার ডেটা-ডিস্কের মধ্যে থাকা প্রমাণগুলো রেইনাকে দেখায়। ভিডিও ফিড, ব্রেইন-স্ন্যাপ রেকর্ড, এবং সরকারি নথির স্ক্যান—সব কিছু দেখে রেইনার মুখ কঠিন হয়ে যায়। “তাহলে তো আমাদের সময় সত্যিই শেষ হয়ে আসছে।” ঠিক সেই মুহূর্তে, বাহিনীর গার্ডদের একটি ইউনিট সেখানে এসে পড়ে। গুলির শব্দ, ধোঁয়া, শ্বাসরুদ্ধকর পালানো—সব মিলিয়ে এক ভাঙচুরের মিছিল শুরু হয়। একটি অ্যাক্সিলারি স্লাইড-শ্যাফট ব্যবহার করে তারা নীচের তলায় নেমে আসে, যেখানে বাহিনীর পুরনো আর্কাইভ রাখা আছে। সেখানে লুকিয়ে বসে আদ্রিজা বলে, “আমরা এবার একা নই। বাহিনীর ভিতরেই অনেকে আছে যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে চায়। শুধু প্রয়োজন একটি সঙ্কেতের।” রেইনা জবাবে বলে, “তাহলে এই রাত থেকেই শুরু হোক সিংহবাহিনীর আসল বিদ্রোহ।” বাইরে তখন ঝড়ের মতো বৃষ্টি। বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে দূরের আকাশে, আর দুই নারী—দৃঢ়, সাহসী, স্পষ্ট—নেমে পড়ছে এক নতুন যুদ্ধের পথে। কিন্তু এবার তাদের শত্রু বাইরের কেউ নয়, বরং সেই ছদ্মবেশধারী নীরবতা—যা নিজের ভিতরেই শিকল হয়ে জেঁকে বসে থাকে।
৫
প্রতিটি শহরের নীচে, প্রতিটি সরকারের ছায়ায়, থাকে কিছু এমন জায়গা যেখানে ইতিহাসের গোপন অধ্যায়গুলো আশ্রয় নেয়। আদ্রিজা সেন ও রেইনা নন্দী সেই রাতে পৌঁছায় এমন এক জায়গায়—দক্ষিণ হিমালয়ের উপত্যকায়, নির্জন এক পাহাড়ি গ্রামের ধ্বংসস্তূপের নিচে গড়ে ওঠা এক বিদ্রোহী ঘাঁটিতে। দিনের আলোয় সেটি ছিল প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ, আর রাতের অন্ধকারে সেখানে টিমটিম করে জ্বলে ওঠে এক অদৃশ্য প্রতিরোধের শিখা। সেখানেই তাদের স্বাগত জানায় এক রহস্যময় নারী—যিনি চেহারায় যেমন দৃঢ়, কণ্ঠে তেমনই নীরব জ্বলন্ত অভিমান। তার নাম আরবিট্রা সেন। পরিচয় পেয়ে আদ্রিজা হতবাক হয়—এই তো সেই আরবিট্রা, যিনি ছিলেন সিংহবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমান্ডার, যাকে সরকারী নথিতে “শত্রুর হাতে নিহত” ঘোষণা করা হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে। আরবিট্রার মুখে একটিও হাসি নেই, কিন্তু চোখে ছিল এমন একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন সে এক পলকে বুঝে ফেলেছে আদ্রিজাদের অবস্থান, যুদ্ধ এবং ক্ষয়। “তোমরা আমার মতো শেষ হয়ে যেতে এসেছ? নাকি নতুন শুরু আনতে চাও?” তার একটিমাত্র প্রশ্নেই ঘরে ছড়িয়ে পড়ে এক রুদ্ধচিন্তার ঝড়। বিদ্রোহী ঘাঁটির দেয়ালে ছিল পুরোনো ছবি, ছেঁড়া মানচিত্র, আর নানা গোপন নথির ছায়াপ্রতি। সেখানে আরও কিছু মুখ—পুরনো সৈনিক, কিছু গবেষক, কয়েকজন সামরিক বিশ্লেষক—যারা সবাই ছিল রাষ্ট্রের বাইরে ছিটকে পড়া সত্যভাষী। সেই রাতে, আগুনের পাশে বসে আদ্রিজা তাদের সামনে তুলে ধরে Project MANAS-এর ভয়াবহতা। প্রতিটি তথ্য, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর চোখে দেখা সত্য—সব শুনে আরবিট্রা বলল, “আমরা তো জানতাম, ওরা শুধু আমাদের অস্ত্র চায়নি—আমাদের আত্মা চেয়েছিল। তুমি এসেছ সময়মতো।”
পরদিন ভোরে বিদ্রোহী ঘাঁটিতে শুরু হয় প্রস্তুতির তোড়জোড়। এটা কোনো বাহিনীর ঘাঁটি নয়, তাই নিয়মের ছাঁচে বাঁধা নেই, কিন্তু আত্মার ভিতর ছিল এক ধ্বংসকে প্রতিহত করার অদম্য ইচ্ছা। আরবিট্রা আদ্রিজাকে নিয়ে যায় ঘাঁটির গোপন শেল্টারে—এক অন্ধকার সুড়ঙ্গঘরে যেখানে রাখা রয়েছে কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র, যা আর কোনো বাহিনীর হাতে নেই। “এই অস্ত্রগুলো তৈরি হয়েছিল সিংহবাহিনীর ভবিষ্যতের জন্য,” আরবিট্রা বলেন, “কিন্তু যখন বুঝলাম ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না—তখন আমরা লুকিয়ে ফেললাম সব। কারণ কিছুকে শেষ করতে হলে তাকে চিনতে হয় নিজের ভিতর থেকেই।” আদ্রিজা প্রতিটি অস্ত্র স্পর্শ করে, যেন তার সাহস নতুন অস্ত্র ধারণ করছে। এরপর আরবিট্রা তাকে নিয়ে যান আরেক ঘরে, যেখানে রাখা আছে এক অভ্যন্তরীণ ম্যাপ—বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট, কমান্ড সেন্টার, তাদের স্নায়ু-সঙ্কেত রুটিং স্টেশন। রেইনা বলে ওঠে, “আমরা যদি এই রুটিং পয়েন্টগুলো নষ্ট করতে পারি, তাহলে বাহিনীর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ভেঙে যাবে।” আরবিট্রা মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে একটিমাত্র শর্তে—যদি কেউ ভিতরে প্রবেশ করে মেইন ফ্রিকোয়েন্সি জ্যাম করে।” সেই দায়িত্ব নিতে চায় আদ্রিজা নিজে। অন্যদিকে রেইনা কাজ নেবে কনট্রোল ল্যাব ব্লকের—যেখানে সদ্য নিয়ন্ত্রিত নতুন সদস্যদের ব্রেন-রেকর্ড সংরক্ষিত। আরবিট্রা বলেন, “তবে মনে রেখো, যারা ওখানে আছে, তারা শত্রু নয়। তারা ছিল একদিন তোমাদের মতোই। যন্ত্রের দাস হয়েছে, নিজেদের অজান্তে। সেইজন্য তোমাদের অস্ত্রের চেয়েও দরকার আরও কিছু—স্মৃতি।” সেই মুহূর্তে, ঘাঁটির দেয়ালে টানানো সিংহবাহিনীর পুরোনো ব্যাজের দিকে তাকিয়ে আদ্রিজা চুপচাপ বলে ওঠে, “আমরা কখনো শত্রু ছিলাম না। তারা শুধু আমাদের ভুলে যেতে বাধ্য করেছে।”
সন্ধ্যা নেমে এলে বিদ্রোহী ঘাঁটি ঘিরে ছিল অদ্ভুত এক নিরবতা। প্রস্তুত ছিল আদ্রিজা, রেইনা এবং তাদের নতুন সঙ্গীরা—প্রাক্তন যোদ্ধা, কিছু ট্রেনি, আর কেউ কেউ যারা এই যুদ্ধকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ছোট ছোট স্কোয়াডে বিভক্ত হয়ে বাহিনীর চারটি স্ট্র্যাটেজিক ফ্যাসিলিটিতে ঢোকার পরিকল্পনা করে। মিশনের নাম দেওয়া হয় “অগ্নিসূত্র”। এই অভিযানের প্রথম ধাপ হবে দিল্লি-আউটার সিগন্যাল রিলে সেন্টার—যেখান থেকে Project MANAS-এর তরঙ্গমূল নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই স্থানে প্রবেশ মানেই আত্মঘাতী এক অভিযান, কিন্তু আদ্রিজার মধ্যে এখন ভয় নেই—শুধু তীক্ষ্ণ লক্ষ্য। বিদ্রোহী ক্যাম্প থেকে বেরোনোর আগে আরবিট্রা তাকে জড়িয়ে বলেন, “তুমি প্রথম নয়, হয়তো শেষও নও, কিন্তু তুমি সেই আগুন—যেটা শীতল পৃথিবীকে জাগিয়ে তুলতে পারে।” সেই রাতেই শুরু হয় সিংহবাহিনীর ইতিহাসের নতুন অধ্যায়—যেখানে একদল নারী, অস্ত্র নয়—সত্য, সাহস এবং স্মৃতিকে নিয়ে দাঁড়ায় এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। পাহাড়ের নিচে তারা হারিয়ে যায় অন্ধকারে, কিন্তু সেই অন্ধকারেই জন্ম নেয় নতুন ভোরের বীজ।
৬
রাত ঠিক ২৩:৪৭। বৃষ্টিভেজা দিল্লির আউটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিং রোডে ছায়ার মতো ঢুকে পড়ে ছয়জনের একটি স্কোয়াড—তিনটি ভিন্ন পথ দিয়ে প্রবেশ করে তারা, প্রত্যেকের চোখে নাইটভিশন কন্টাক্ট লেন্স, আর কানে একসঙ্গে সিঙ্ক করা কমিউনিকেশন ফ্রিকোয়েন্সি। রেইনা ও আদ্রিজা দুটি ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে লক্ষ্য নেয় দিল্লি সিগন্যাল রিলে সেন্টারকে, যাকে বাহিনীর “নিউরাল পাথওয়ে হাব” বলে ডাকা হয়। এটি ছিল একটি অব্যবহৃত সরকারি বিদ্যুৎ দপ্তরের মুখোশ পরা বিল্ডিং, যার নিচে সুনির্মিত ভূগর্ভস্থ ল্যাবরেটরি—সেখানে চলত মানসিক তরঙ্গ সঞ্চালনের গোপন পরীক্ষা ও প্রয়োগ। আদ্রিজার সঙ্গে ছিল কন্সপেক-ট্রেইনি বিদিশা ও প্রাক্তন সেনা সদস্যা মেহেক, যারা দুজনেই একদিন বাহিনীর প্রতি অন্ধভক্ত ছিল—এখন তারাই নিজস্বতা রক্ষার জন্য লড়ছে। প্রথম প্রহরীকে নিঃশব্দে অচেতন করে স্কোয়াড এগিয়ে যায় মূল লিফট চেম্বারের দিকে, যেখানে কন্ট্রোল প্যানেলের কোড ব্যবহার করে মেহেক লিফট একটিভ করে। নিচের তলায় নামতেই শোনা যায় দূর থেকে আসা ধাতব আওয়াজ, শীতল বাতাস, আর ছায়ার মতো ঘোরাফেরা করা স্বয়ংক্রিয় গার্ড ইউনিট। এই অংশে পদচিহ্ন মানেই মৃত্যুর সমান। ঠিক তখনই স্ক্যানার অ্যালার্ম বাজে না বাজে—তার আগেই বিদিশা দেয়ালের ছায়ায় ঢুকে পড়ে নিরাপত্তা প্যানেলে একটি “লুপ ফিড” চালু করে দেয়, যাতে নিরাপত্তা ক্যামেরা গত পাঁচ মিনিটের ফুটেজ বারবার দেখাতে থাকে। এই ফাঁকে আদ্রিজা প্রবেশ করেন মূল নিউরাল সিগন্যাল ব্লকে—যেখানে এক কেন্দ্রীয় কাঁচের ঘরে দুলে দুলে চলছিল তরঙ্গ প্রেরণ, ঢেউয়ের মতো যার প্রতিধ্বনি পৌঁছাচ্ছিল দেশের নানা প্রান্তে। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আদ্রিজা এক মুহূর্তের জন্য থমকে যান—তার নিজের নাম ছিল সেই লাইভ তালিকায়, যার উপর সিগন্যাল সিঙ্ক্রোনাইজেশন চলছিল।
অপারেশনের দ্বিতীয় অংশে রেইনা ও দুই বিদ্রোহী—আকরা ও বিনীতা—ঢুকে পড়ে তথ্য সংগ্রহ কক্ষের ভিতরে। এখানে সংরক্ষিত ছিল বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিগত নিউরাল রেকর্ড, তাদের প্রতিক্রিয়া, দুর্বলতা, এবং সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল। এই রেকর্ড মুছে দেওয়া মানে সরকারের পরিকল্পনার গোড়া থেকে ধসিয়ে দেওয়া। রেইনা নিজের ডেটা পোর্ট ইনস্টল করে, আর আকরা তাকে কভার করে রাখে। সময় তখন মাত্র ৪ মিনিট বাকি বাহিনীর রাউন্ডিং ইউনিট ঢোকার আগে। ডেটা স্থানান্তরের সময় দেখতে পায় একটি নাম—লেফটেন্যান্ট জারা হায়দার। তার রেকর্ডে উল্লেখ আছে: “সম্ভাব্য সন্দেহাতীত নিয়ন্ত্রিত—সম্পূর্ণ সহনীয় অবস্থা, উচ্চ পর্যায়ে আনুগত্য। সঙ্কটকালে প্রয়োজনে আদ্রিজার বিপরীতে ব্যবহারযোগ্য।” এই তথ্য শুনে রেইনার মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে জানত জারার মধ্যে এখনও মানুষটা বেঁচে আছে, কিন্তু এখন স্পষ্ট—জারাকে ভবিষ্যতের অস্ত্র বানানো হচ্ছে আদ্রিজার বিরুদ্ধে। হঠাৎ করেই ল্যাবের একটি দরজা খুলে যায়—বাহিনীর দুই গার্ড ঢুকে পড়ে। বিনীতা তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, এবং একটি ডিসট্রাকশন সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়—ধোঁয়া আর বিকট শব্দে মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে যায়। এই ফাঁকে রেইনা সব ডেটা ট্রান্সফার শেষ করে সেটি একটি পোর্টেবল ইউনিটে লোড করে। গ্রেনেড ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে তারা তিনজন পালিয়ে বেড়িয়ে আসে পুরনো জল নিষ্কাশন সুড়ঙ্গ দিয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে, রেইনা একবার তাকিয়ে বলে, “এই তথ্যই আমাদের অস্ত্র। এখন সত্যটা ছড়িয়ে দিতে হবে।” কিন্তু তার চোখে ছিল ভয়—কারণ সে জানে, জারাকে রক্ষা না করলে হয়তো আগামি লড়াইয়ে তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটাই হয়ে উঠবে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ।
অপারেশনের তৃতীয় ধাপে, আদ্রিজা ও তার দল সফলভাবে প্রবেশ করে মূল সিগন্যাল টাওয়ারে। সেখানে তারা স্থাপন করে এক শক্তিশালী রিফ্লেক্টর জ্যামার, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢাকনা দেওয়া হবে নিয়ন্ত্রণ তরঙ্গের উপর। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে ‘মোবাইল রেসপন্স ইউনিট’। শব্দ হয়, ছুটে আসে বাহিনীর দুই ড্রোন-গার্ড ও চারজন প্রশিক্ষিত সোলজার। আদ্রিজা সবাইকে নির্দেশ দেয় দ্রুত জ্যামার চালু করতে, আর নিজে মোর্চা নেয় কাচঘেরা সিগন্যাল চেম্বারের সামনে। গুলির শব্দ, বিস্ফোরণ, এবং ভিতরের সিস্টেম কাঁপিয়ে দেওয়া কম্পন—সবকিছুর মাঝে শেষমেশ বিদিশা তার জীবন বাজি রেখে জ্যামার চালু করে। পুরো চেম্বারে আলো ঝলসে ওঠে, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ যেন নিজের ভেতরের কুয়াশা সরিয়ে দেখতে শুরু করে—কেউ নিজের নাম ভুলে গিয়েছিল, কেউ নিজের মুখ; এখন তারা হঠাৎ করে চমকে ওঠে—“আমি… কে?” মিশনের শেষ পর্যায়ে পালানোর সময় বিদিশা পিছনে পড়ে যায়—তার গায়ে গুলির আঘাত। মেহেক তাকে তুলে নিয়ে ছুটতে থাকে। এবং সেই মুহূর্তে, প্রথমবারের মতো, তারা সবাই বিশ্বাস করে—এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নয়, এটা স্মৃতি রক্ষা করার যুদ্ধ। বাহিনীর ভিতর থেকে ভেঙে পড়ছে কর্তৃত্বের দেওয়াল, কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চমাত্রার জরুরি সংকেত যায় হেডকোয়ার্টারে। জেনারেল রুদ্র প্রতাপ চোখে তাকিয়ে থাকেন মনিটরের দিকে, চোয়াল শক্ত করেন। তাঁর সামনে ভেসে ওঠে একটি ছবি—মেজর আদ্রিজা সেন, অপারেশন “অগ্নিসূত্র”-এর ‘মাস্টার কোঅর্ডিনেটর’। তিনি চুপ করে বলেন, “তাহলে এটা শুরু হলো। এবার আমরা ওদের নিজেদের বিরুদ্ধে ওদেরই সৈনিক ব্যবহার করব।” সেই সঙ্গে আদেশ যায়: “জারা হায়দারকে এক্টিভ করো।”
৭
উত্তর দিল্লির কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মনিটরিং ইউনিটে টানটান উত্তেজনা। কাঁচঘেরা এক নির্জন ঘরে বসে আছে লেফটেন্যান্ট জারা হায়দার—শরীর নিথর, চোখ স্থির, শিরার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে সেই নিয়ন্ত্রিত শীতলতা, যা কোনো আদেশ ছাড়াই এক সৈনিককে নড়াচড়া করিয়ে দেয়। হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানো ‘ক্রিটিকাল রিকল সিগন্যাল’ তার নিউরাল রিসেপ্টর গরম করে তুলছে ধীরে ধীরে—প্রথমে ডান চোখের কোণে আলো জ্বলে ওঠে, তারপর মস্তিষ্কে সক্রিয় হয় সেই ইনস্টল করা সিগন্যাল পাথওয়ে যেটি অন্য কাউকে নয়—শুধু আদ্রিজা সেনকে ‘টার্গেট-অবজেক্টিভ’ হিসেবে শনাক্ত করে। এক সময়ের বোনতুল্য সঙ্গী—আজ সে-ই লক্ষ্য। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল শালীন বক্সী, যিনি অপারেশন টার্গেট-সাইলেন্স-এর কমান্ডার। তিনি নিচু গলায় বলেন, “সে এখন প্রস্তুত। মানবিকতা তার মধ্যে চাপা পড়ে গেছে।” কিন্তু ঘরের ভিতরে তখন এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়—জারার স্মৃতির এক অলীক কোণায় ফুটে ওঠে এক দৃশ্য, যেখানে সে ও আদ্রিজা একসঙ্গে লাদাখ সীমান্তে শীতের রাতে আগুনের পাশে বসেছিল। সেই মুহূর্তে, তার বাঁ চোখের নিচে এক বিন্দু জল জমে ওঠে। যদিও মনিটর বলছে—সব স্বাভাবিক, নিউরাল সিঙ্ক ৯৭%—তবুও জারার মস্তিষ্কের অন্দরে জমতে থাকে প্রশ্ন। নিজের অস্ত্র পরিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে, আদ্রিজার বর্তমান অবস্থানের দিকে। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হচ্ছিল—তার নির্দেশ যেন তার থেকে আলাদা এক মানুষ দিচ্ছে। এবার হয়তো নিজের সত্তার সঙ্গেই তার যুদ্ধ।
এইদিকে, হিমালয়ের শীতল উপত্যকার এক পাহাড়ি আশ্রয়ে অপারেশন “অগ্নিসূত্র” সফল করার পর বিদ্রোহী দল আপাতত নিরাপদ। বিদিশার প্রাণ বেঁচেছে, তবে সে কোমায়। আদ্রিজা প্রায় প্রতিদিন তার শয্যার পাশে বসে থাকে, যেমন বসত এক সময় তার মা বাবার বিছানার পাশে, যখন যুদ্ধজর্জর শৈশব তাকে শিখিয়েছিল শোক ও শক্তি একসঙ্গে ধারণ করতে। সেই রাতে রেইনা এসে জানায়, “আমরা বার্তা পাঠাতে পেরেছি। পশ্চিম জোনের তিনটি সাব-ইউনিট থেকে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ এসেছে—তারা আর আদেশ মানছে না।” আনন্দ বা স্বস্তি নয়—আদ্রিজার মুখে ছিল স্পষ্ট ক্লান্তি আর তীব্র প্রত্যয়। “এটা কেবল শুরু,” সে বলে। কিন্তু তখন কেউ জানত না—ঘুমন্ত অন্ধকারে হেঁটে আসছে সেই মানুষ, যাকে তারা একদিন বিশ্বাস করেছিল চোখ বন্ধ করে। ঠিক মধ্যরাতের কিছু পরে পাহাড়ি আশ্রয়ের সীমান্তে শব্দ হয়—প্রথমে নিঃশব্দ ধাপ, তারপর একটি রেড-স্ক্যানার তর্জনী জ্বলে ওঠে বাতাসে। পাহারাদার বাহিনীর ট্রেইনি রুহি শর্মা জারাকে দেখে বলে, “দিদি, আপনি এখানে?” জারা চুপচাপ এগিয়ে আসে, চোখের নিচে তখন অদ্ভুত টান। তার অস্ত্র উঠে যায় ধীরে ধীরে—একটি নিঃশব্দ লেজার শট রুহির কাঁধে—অচেতন করে তাকে। এরপর সে ঢুকে পড়ে ঘাঁটির কেন্দ্রে, যেখানে ঘুমিয়ে রয়েছে বিদিশা। সে এগিয়ে যায় তার দিকে—একটি ইনজেকশন তার হাতে, যাতে লেখা “মানস কোড – ফাইনাল ক্লিনজার।” ঠিক যখন সে ইনজেকশন এগিয়ে দেয়, তখনই পিছন থেকে ঠান্ডা গলায় কেউ বলে ওঠে—“জারা, থামো।”
ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে আদ্রিজা। তার চোখে হতাশা, কিন্তু হাতে প্রস্তুত অস্ত্র নেই। সে বলে, “আমি জানি তুমি কে। তুমি আমার সঙ্গী ছিলে, আমার বন্ধুর থেকেও বেশি। আমি জানি তারা তোমার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তুমি এখনও আছো। আমি সেটা দেখেছি।” জারা কিছু বলে না। তার চোখে জল নেই, কিন্তু নীল আলোয় ঠিকরে ওঠে এক দ্বন্দ্ব। সে হাত কাঁপিয়ে ধরে ইনজেকশন, এবং বলে, “আমার ভিতরে একটা কিছু বলে, আমি ভুল করছি। কিন্তু… আর একটা কিছু বলে, আমাকে শেষ করতে হবে।” আদ্রিজা এগিয়ে যায়, ধীরে। “আমরা কেউই নিখুঁত নই, কিন্তু আমরা কেউ মেশিনও না। মনে পড়ো, লাদাখের সেই রাত, আগুনের পাশে আমরা কী বলেছিলাম? ‘যদি কেউ আমাদের মন কাড়তে চায়, আমরা একে অন্যকে মনে করাবো—আমরা কারা।’” এই কথায় জারার হাতে ইনজেকশন কাঁপে। সে বলে, “তুমি কি বিশ্বাস করো, আমি এখনও আমি?” উত্তর আসে নিঃশব্দে—একটি দীর্ঘ আলিঙ্গন। ঠিক সেই মুহূর্তে জারা পড়ে যায় মেঝেতে—তার নিউরাল প্রোগ্রামিং হঠাৎ করে সিস্টেম কনফ্লিক্টে গিয়ে শাটডাউন হয়ে যায়। ডাক্তারি ইউনিট ছুটে আসে, আর আদ্রিজা বলে, “তাকে বাঁচাতে হবে। কারণ সে আমাদের মধ্যে প্রথম, যে নিজের ভিতরের শত্রুকে চিনেছে।” সেই রাতেই পাহাড়ের নিচে আবার বৃষ্টি নামে। কিন্তু এবার সেই বৃষ্টি ছিল এক জেগে ওঠা আত্মার প্রতিচ্ছবি—যেখানে প্রথমবার বিদ্রোহ জয় পেতে শুরু করেছিল ভেতরের শত্রুর বিরুদ্ধে।
৮
হিমালয়ের গা বেয়ে ভোরের আলো নেমে আসে ধীরে ধীরে, আর বিদ্রোহী আশ্রয়ে যেন নিঃশব্দে বেজে ওঠে এক ঘুমপাড়ানি গান—ভয়, ক্লান্তি আর অশ্রুভেজা সাহসের গান। সেই আলোয় অপারেশন “অগ্নিসূত্র”-এর পর বিধ্বস্ত বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষত সেলাই করে নিচ্ছে। বিদিশা এখনও কোমায়, জারাকে একপ্রকার নিউরাল হাইবারনেশনে রাখা হয়েছে যাতে তার মস্তিষ্কের প্রোগ্রামিং থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি আসে। আরবিট্রা, রেইনা ও আদ্রিজা একসঙ্গে বসে তৈরি করছেন পরবর্তী পদক্ষেপের রূপরেখা। এই যুদ্ধ এখন আর শুধু সরকার ও বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়—এটা এখন এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, যেখানে প্রত্যেক সৈনিককেই আগে নিজের ভেতরের কারাগার থেকে মুক্ত হতে হবে। আরবিট্রা একটি ম্যাপ ছড়িয়ে দেয় টেবিলে, যেখানে চিহ্নিত রয়েছে মূল ব্রডকাস্ট হাব—দক্ষিণ ভারত, নীলগিরি পাহাড়ের ভিতরে স্থাপন করা হয়েছে “ভারত মানব-সংযোগ কেন্দ্র”, যে স্থান থেকে দেশের প্রতিটি সিগন্যাল টাওয়ারে নিয়ন্ত্রণ তরঙ্গ পাঠানো হয়। “ওটাই আমাদের শেষ গন্তব্য,” সে বলে, “যদি ওটা ধ্বংস না করি, তাহলে যত বিদ্রোহই হোক, সবার মন ধীরে ধীরে আবার শিকলে বাঁধা পড়বে।” রেইনার চোখে তখন ভয় আর দৃঢ়তা একসঙ্গে। আদ্রিজা বলল, “আমাদের সময় কম। রুদ্র প্রতাপ নিশ্চয়ই এবার পাল্টা আঘাতের জন্য প্রস্তুত।” এবং ঠিক সেই সময়েই আশ্রয়ে প্রবেশ করে এক প্রহরী—“মেজর সেন, ইমার্জেন্সি ব্রডকাস্ট… দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিংহবাহিনীর সদস্যরা আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ… আত্মঘাতী হচ্ছে।” ঘর নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এই মন নিয়ন্ত্রণ কেবল বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, ধীরে ধীরে মানুষকে নিজের সত্তা ভুলিয়ে দিচ্ছে।
বিকেলের দিকে, আদ্রিজা একা হাঁটছিল আশ্রয়ের বাইরে বরফঘেরা এক পথ ধরে। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি সিদ্ধান্তের ভার যেন তাকে চেপে ধরছে। হঠাৎ, পাহাড়ের নিচে একটা পরিচিত সুর ভেসে আসে—একটা পুরনো ছেলেবেলার গান, যেটা তার মা তাকে শোনাতেন ঘুম পাড়ানোর আগে। সে অনুসরণ করে সুরটিকে এবং পৌঁছায় একটি পুরনো ঝরনার পাশে, যেখানে বসে আছে জারা—এখনও কিছুটা অসাড়, কিছুটা চেতনার সীমায় দুলছে। কিন্তু তার ঠোঁটে সেই গান, একটানা, একরাশ দুঃখে মোড়া। আদ্রিজা কাছে বসে পড়ে। জারা বলে, “আমার ভেতরে এখনও যুদ্ধ চলছে, আদ্রি। আমি জানি না আমি কে—তাদের বানানো অস্ত্র, না তোর পুরনো সঙ্গী।” আদ্রিজা তার হাত ধরে। “তুই যা-ই হোস, তোর ভিতরে একটা মানুষ আছে—যে গান গায়, যে কান্না চাপে, আর যে ভুলতে চায় না।” জারা ফিসফিস করে বলে, “তুই জানিস, এই গানটা তারা আমায় মুছে দিতে পারেনি। কত স্মৃতি চলে গেছে, কিন্তু এই গানটা কোথা থেকে যেন থেকে গেছে। কারণ এটা কোনো তথ্য নয়, এটা আমি।” সেই মুহূর্তে, দুজনের মধ্যে যেন এক নতুন চুক্তি হয়—তারা এবার একসঙ্গে এগোবে। ভেতরের ঘুমকে জাগিয়ে তুলে, দেশের হাজার হাজার ভুলিয়ে দেওয়া মানুষকে তাদের গান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
রাত্রি নামতেই শুরু হয় চূড়ান্ত প্রস্তুতি। নীলগিরির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে একটি বিশেষ অপারেশন স্কোয়াড, যার নেতৃত্বে থাকবে আদ্রিজা, রেইনা, জারা, মেহেক ও আকরা। ঘাঁটির বাকিরা রয়ে যাবে মূল সিগন্যাল রুট রক্ষা ও পেছনের সংযোগ বজায় রাখার কাজে। যাওয়ার আগের রাতে আরবিট্রা সকলকে একটি ছোট বক্তৃতা দেয়—“তোমরা হয়তো ফিরে আসবে না। কিন্তু যদি শেষ বাতিটাও নিভে যায়, আমরা আর কাউকে চিনতে পারব না—নিজেকেও না। যাও, আর নিজের নাম ধরে ডাকো যারা ভুলে গেছে।” এরপর সকলে একে একে বিদিশার শয্যার পাশে দাঁড়ায়—যে এখনো জেগে ওঠেনি, কিন্তু যার জন্যই তারা আজ বিশ্বাস করতে শিখেছে যে লড়াই এখনও বাকি। জারা তার কপালে হাত রেখে বলে, “ঘুমাও, কিন্তু মনে রেখো—তোকে আমরা ফিরিয়ে আনব।” পাহাড়ের কোলে তখন থেমে আছে কিছু পুরনো ট্র্যাকবোট, চালকের আসনে বসেছে বিদ্রোহীদের পুরনো সিগন্যালম্যান পার্থ। দলটি রওনা দেয় গভীর অন্ধকারে, যেখানে প্রতিটি ঘন্টা ঠান্ডা নয়, ভয় ছুঁয়ে যায়। আদ্রিজা জানে—এই মিশনে পরাজয়ের মানে হবে আর কখনো কেউ নিজের নাম মনে রাখবে না। সেই রাতের শেষে কুয়াশার ভিতর দিয়ে প্রথমবার তারা দেখতে পায় সেই প্রাচীন বৃত্তাকার কাঠামো—”ভারত মানব-সংযোগ কেন্দ্র”—যেখানে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গোটা দেশের মানুষ হওয়ার অধিকার। এবার শুরু হবে চূড়ান্ত অধ্যায়। এখনো তারা গান গাইছে, মনে মনে—একটি ঘুমপাড়ানি গান, জেগে ওঠার অপেক্ষায়।
৯
নীলগিরি পাহাড়ের নিচে একটি প্রাচীন টানেলের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ছিল অপারেশন স্কোয়াড। গাছপালা ঘেরা, কুয়াশায় মোড়া সেই রাস্তায় পাখির ডাক নেই, সূর্যের আলো নেই—শুধু এক অদ্ভুত কুয়াশাচ্ছন্ন শীতলতা, যেন সময় সেখানে থেমে আছে বহু বছর ধরে। এই টানেলটির খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল আরবিট্রার দেওয়া এক পুরনো মানচিত্রে, যা রাষ্ট্রপক্ষ বহু আগেই মুছে ফেলেছিল জনগণের চোখ থেকে। টানেলটি সোজা চলে গেছে “ভারত মানব-সংযোগ কেন্দ্র”র নিচে—যেখানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মনস্তাত্ত্বিক ফ্রিকোয়েন্সি সঞ্চার করা হয়, আর সেখানেই পরিচালিত হয় সব কিছুর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ। আদ্রিজা, রেইনা, জারা, মেহেক ও আকরা পাঁচজন দুটি সাব ইউনিটে বিভক্ত হয়ে টানেলে প্রবেশ করে। প্রথম ইউনিটের লক্ষ্য ছিল ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল চেম্বার দখল করা, দ্বিতীয় ইউনিট ঢুকবে ব্রডকাস্ট কোরে—যেখানে বসানো আছে সেই ‘সিগমা-রেজোনেটর’, যন্ত্র যার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রণ তরঙ্গ। ভিতরে ঢুকতেই তারা দেখে সাদা দেয়ালে একের পর এক প্রোজেক্টরের ছায়া, যেখানে চলছিল মানুষের স্মৃতিচিত্র—কেউ জন্ম দিচ্ছে, কেউ বিয়ের কনে, কেউ মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু প্রতিটি স্মৃতির নিচে লেখা—“সংরক্ষিত, পুনরুদ্ধারযোগ্য, প্রয়োজনে মুছে ফেলা হবে।” মুহূর্তেই বোঝা যায়, এই কেন্দ্র শুধু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে না—মানুষের স্মৃতিই বিক্রি হয়ে গেছে এখানে, হয়ে উঠেছে শাসনের অস্ত্র। ঠিক তখনই প্রথম নিরাপত্তা ইউনিট এসে পড়ে। লড়াই শুরু হয় করিডোরের ভেতরে—আলো, শব্দ, ধোঁয়া আর ঘামের ভেতর দিয়ে আদ্রিজা ছুটে যায় প্রধান প্যানেলের দিকে, যেখানে একটি অদ্ভুত মডিউল ঘুরে ঘুরে ভাসছে বাতাসে, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো, যার ভিতর আটকে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের চিন্তার তরঙ্গ।
ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল চেম্বারে জারা ও রেইনা প্রবেশ করে পেছনের সার্ভার টার্মিনালে, যেখানে তাদের লক্ষ্য একটাই—“সিগমা-রেজোনেটর” বন্ধ করতে হবে ৯ মিনিটের ভিতরে, নইলে সেই রেজোনেটর সমস্ত দেশব্যাপী ‘রিফ্ল্যাশ কমান্ড’ ছড়িয়ে দেবে, যা নতুন করে সবার মন রিসেট করে দেবে চিরতরে। কিন্তু ভিতরে রয়েছে এক ঘোরানো অ্যালগরিদমের ফাঁদ—একটি ভুল কমান্ড দিলেই ‘ম্যানুয়াল পিউজ মড’ চালু হবে, যাতে করে পুরো সিস্টেম নিজেকে সুরক্ষিত করতে সিল করে ফেলবে। রেইনা কাজ শুরু করে, আর জারা তাকে পাহারা দেয়। এই সময়েই তারা দেখতে পায় একটি নতুন ডেটা ফিড—দেশের বিভিন্ন বাহিনীর ইউনিট থেকে আসছে নিয়ন্ত্রণ সংকেত, অর্থাৎ সরকার ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে কেন্দ্র আক্রান্ত। আদ্রিজার নির্দেশে মেহেক মূল ইনপুট সিগন্যাল লাইনে বিস্ফোরক বসাতে শুরু করে, যাতে সিস্টেমের পরবর্তী প্রজেকশন ব্লক ধ্বংস করা যায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে একজন প্রাক্তন সিংহবাহিনী সদস্যা—নিশা বেরিয়ে আসে, চোখে ফাঁকা দৃষ্টি, মুখে নিঃশব্দ কণ্ঠে আওড়াচ্ছে, “সুরক্ষা… স্থায়িত্ব… আত্মত্যাগ…” সে এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত, এক মানবিক অস্ত্র। জারা তাকে থামাতে এগিয়ে আসে কিন্তু বুকে লেগে যায় একটি বৈদ্যুতিক স্টান শট। সে পড়ে যায়, অচেতন। নিশা এগিয়ে যায় রেইনার দিকে—কিন্তু তখন রেইনা চোখ বন্ধ করে বলে, “নিশা, আমরা একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, মনে পড়ে সেই বৃষ্টি পড়ার দিনটার কথা?” অদ্ভুতভাবে, নিশা থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য, চোখে যেন স্মৃতি খেলে যায়। সেই সুযোগেই রেইনা তার কাঁধে স্টান-গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়। ঘর থেমে যায় বিস্ফোরণে। কিন্তু রেইনা তখন বোঝে—এই যুদ্ধ শুধু বন্দুকের নয়, এক একটা মুখ, এক একটা স্মৃতি ধরে ধরে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম।
শেষ মুহূর্তে, আদ্রিজা দাঁড়িয়ে সিগমা-রেজোনেটরের সামনে—তার ভিতরে এখনো ঘুরছে কোটি মানুষের চিন্তার ধারা, স্মৃতি আর মননের ছায়া। সে জানে, একবার এটি ধ্বংস করলেই নিয়ন্ত্রণ ভেঙে যাবে, কিন্তু বিপরীত দিকও রয়েছে—এই যন্ত্র ধ্বংস হলে যেসব মানুষ পুরোপুরি এই তরঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাদের মানসিক সমতা ভেঙে পড়বে চিরতরে। সিদ্ধান্তটা কঠিন—জীবন বাঁচাতে স্মৃতি হারাবে, না স্মৃতি বাঁচাতে জীবন হারাবে। হেডসেটে রেইনার গলা শোনা যায়, “জারা ঠিক আছে। সার্ভার প্যানেল আমাদের দখলে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।” আদ্রিজা চোখ বন্ধ করে, নিজের অতীতের দিকে ফিরে যায়—তার মা, তার প্রথম যুদ্ধ, জারার হাসি, বিদিশার চোখ, রেইনার আত্মত্যাগ। সে বুঝতে পারে, স্মৃতি কখনোই নির্ভুল নয়, তবু ওটাই মানুষকে মানুষ করে। সে এগিয়ে গিয়ে সিগমা-রেজোনেটরের জ্যামার সক্রিয় করে—যা যন্ত্রটিকে ধ্বংস না করে তার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করে দেয়। আর ঠিক তখনই বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় করে দেয় মেহেক, ধ্বংস করে দেয় মূল রুটিং প্যানেল। পুরো কেন্দ্র কেঁপে ওঠে—আলো নিভে যায়, শব্দ থেমে যায়। কিন্তু বাইরে—দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ চোখ মেলে দেখে সূর্য উঠছে, শব্দ শোনা যাচ্ছে দূরের কোনো ট্রেনের, মা ডেকে উঠছে ঘরে—“রিমা, উঠে পড়ো, স্কুল যাবে না?” সেই মুহূর্তে, আদ্রিজা জানে—এই বিজয় কোনো পতাকা ওড়ানো নয়, এটা এক হারিয়ে যাওয়া নাম ফিরে পাওয়া। এবং অন্ধকার টানেল দিয়ে ফিরে আসার সময়, জারার কণ্ঠে ভেসে আসে সেই গান—ঘুমপাড়ানি, এবার জেগে ওঠার জন্য।
১০
নীলগিরি অভিযানের পর সাতদিন কেটে গেছে। কেন্দ্র ধ্বংস হওয়ার পরে গোটা দেশজুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল, যেন অনেকদিন ধরে চলতে থাকা এক অদৃশ্য কোলাহল হঠাৎ থেমে গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা সিংহবাহিনীর সদস্যরা ধীরে ধীরে ফিরে পেতে শুরু করে নিজেদের স্মৃতি, পরিবার, আবেগ, এমনকি ভয়—যা এতদিন তারা ভুলে গিয়েছিল। কেউ চোখ মেলে দেখে পাশে মা বসে আছে, কেউ চিনতে পারে তার ছোটবেলার পোষা কুকুরের নাম। সিস্টেম ধ্বংস হয়নি, কিন্তু থেমে গেছে; রাষ্ট্রের ‘মানস প্রকল্প’ হয়ে গেছে এক খালি খোলস, যার ভিতর মানুষ ছিল না—শুধু ডেটা, ভয় আর নিঃসঙ্গতা। বিদ্রোহী আশ্রয়ে ফিরে আসার পর সবাই যেন চুপচাপ—কেউ উল্লাস করছে না, কেউ বিজয়ের স্লোগান দিচ্ছে না। বরং যেন এক গভীর উপলব্ধি এসে পড়েছে—তারা কিছু জিতেনি, কেবল মানুষের মতো বাঁচার সম্ভাবনাকে ফিরিয়ে এনেছে। বিদিশা অবশেষে জেগে ওঠে। চোখ খুলেই বলে, “আমরা জিতেছি?” আদ্রিজা তার পাশে বসে বলে, “আমরা মনে করতে পেরেছি—তাই জিতেছি।” সেই রাতেই জারা, মেহেক ও রেইনা নিয়ে আদ্রিজা আলোচনায় বসে। তাদের সামনে এখন এক শূন্য দেশ, যেটিকে গড়ে তুলতে হবে স্মৃতি দিয়ে—not surveillance, but soul. আরবিট্রা এসে বলে, “এখন তোমাদের দায়িত্ব শুধু সরকার পতন নয়। একটা নতুন প্রতিষ্ঠান, নতুন সিস্টেম, নতুন গণতন্ত্র গড়ে তোলার। এমন এক পৃথিবী যেখানে মানুষকে আবার মনে রাখতে শেখানো হবে।”
—
২য় অনুচ্ছেদ:
কেন্দ্রের ধ্বংসের পরপরই ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে বড়সড় ধাক্কা লাগে। রুদ্র প্রতাপ গোপনে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের সিগন্যাল ইন্টারসেপ্টররা তাকে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে গ্রেফতার করে। তার বিচার শুরু হয় ‘মানব মন বিকৃতি ও ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন’ মামলায়। দেশে জরুরি ভিত্তিতে শুরু হয় গণসমীক্ষা, যাতে প্রমাণ পাওয়া যায়—প্রায় ৩৮% জনগণের স্মৃতি আংশিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল বিগত ২০ বছরে। এক বিশাল ক্ষমাশীল আন্দোলন শুরু হয়, যার মূল আহ্বায়ক ছিল আদ্রিজা সেন ও তার বিদ্রোহী স্কোয়াড। রেইনা সরকারিভাবে ঘোষণা করে: “আমরা নতুন কিছু আরোপ করব না। আমরা শুধু স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে চাই। বাকিটা মানুষের।” এক নতুন সংস্থা তৈরি হয়—“স্মৃতিসংরক্ষণ ট্রাস্ট”, যার প্রধান কাজ হবে জাতীয় স্মৃতিরক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে প্রতিটি নাগরিক চাইলে নিজের জীবনকালের স্মৃতির একটি প্রতিলিপি সংরক্ষণ করতে পারবে—কিন্তু তা তার সম্মতিতেই, বাধ্যতামূলক নয়। জারা এই প্রকল্পের নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়। বিদিশা তৈরি করে এক ‘স্মৃতি পুনর্বাসন প্রোটোকল’, যাতে স্মৃতি ফিরে পেতে যাদের মানসিক সহায়তা প্রয়োজন, তারা সহানুভূতির সঙ্গে পরিচালিত হয়। মেহেক ও আকরা নেয় মাঠ পর্যায়ে কাজের দায়িত্ব—গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বোঝানো, ভয় নয়—ভালবাসা দিয়ে জাগানো যায়। মানুষ প্রথমে ভয় পায়, দ্বিধায় থাকে। কিন্তু তারপর, কোনো এক ছেলের ঠাকুরমা হঠাৎ গেয়ে ওঠে এক পুরনো রূপকথার গান। কেউ বলে, “এইটা তো আমার ছোটবেলায় শোনা…” আর সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে গল্প, গান, কবিতা—যা কোনো প্রোগ্রাম মুছে ফেলতে পারেনি।
—
৩য় অনুচ্ছেদ:
বছর ঘুরে যায়। ২০৯১ সালের স্বাধীনতা দিবসে রাজধানী নয় দিল্লিতে নয়, বরং অন্ধ্রপ্রদেশের বিজন এক গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় “স্মৃতির সম্মেলন”—যেখানে জড়ো হন সেইসব মানুষ, যারা নিজেদের হারিয়েছিলেন আর ফিরে পেয়েছেন। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আদ্রিজা সেন বলেন, “আজ আমরা কোনও দেশ উদ্ধার করিনি, কোনও শত্রুকে পরাজিত করিনি। আমরা কেবল নিজেদের চিনতে শিখেছি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় জয়।” চারদিকে তখন হাততালি নয়, বরং চোখের কোণ ভেজা। তার পাশে দাঁড়িয়ে রেইনা বলে, “আমরা রাষ্ট্র বদলাইনি, আমরা মানুষ বদলেছি। এবার রাষ্ট্রও বদলাবে।” জারা দাঁড়িয়ে আছে দূরে, পাহারা দিচ্ছে—but now by choice. বিদিশা শিশুদের মাঝে বসে গল্প বলছে, আর তারা আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। আরবিট্রা, যিনি এক সময় হারিয়ে গিয়েছিলেন, এখন ‘স্মৃতি অধিকার আন্দোলন’-এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নাম। আকাশে তখন একটানা ভেসে ওঠে গানের সুর—না, কোনো বিপ্লবের গান নয়, কোনো শ্লোগানও নয়। এটি একটি ছোট্ট, পুরনো ঘুমপাড়ানি গান, যা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল হাজার তরঙ্গের ভিড়ে। আর আজ, সেই গান ফিরে এসে বলে যাচ্ছে—তোমরা মানুষ, যন্ত্র নও। মনে রেখো, ভুলে যেও না।
এভাবে “সিংহবাহিনী” শেষ হয় না—তারা রয়ে যায়, প্রতিটি মেয়ের মনে, যারা ভয়কে অস্বীকার করে নিজের নাম মনে রাখে। এই গল্পটা তাই শেষ নয়, বরং শুরুর একটা আরেক নাম।
সমাপ্ত




