Bangla - রহস্য গল্প

টাইমপাস টিফিন টেলস

Spread the love

শুভাশীষ দে


পর্ব : ফেলে দেওয়া খাবারের গন্ধ

অফিসটার নাম ‘অ্যামব্রেলা ফাইন্যান্স’। কলকাতার সাউথ সিটি টাওয়ারের ছ’তলায় তার সদর দফতর। গ্লাসের পার্টিশন ঘেরা, এসিতে জমাট ঠান্ডা, আর সারি সারি ডেস্কে বসে থাকা লোকজন, যাদের মুখে সারাদিন জুড়ে একটা অভিমান জমে থাকে। তাদের মাঝে নীরবে ঘুরে বেড়ায় শিবু—অফিসবয়।

বয়স বাইশ, গড়ন ছোটখাটো। লোকে প্রায় চোখেই পড়ে না ওকে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা—এই তার অফিস টাইম। এই সময়ে তাকে করতে হয়, কফি-পানি পৌঁছে দেওয়া, ফাইল এগিয়ে দেওয়া, হোয়াইটবোর্ড মোছা, আর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—টিফিন সামলানো।

শিবুর একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে, যেটা কেউ ঠিক বোঝে না। সে নিজের জন্য কোনোদিন আলাদা করে খাবার আনে না। বরং দুপুরে যখন অফিসের সবাই টিফিন খেয়ে ফেলে দেয় বাকিটুকু, শিবু তখন সেই ফেলে দেওয়া খাবার থেকে নিজের একটা টিফিন বানায়।

রীতা দিদি, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের পুরোনো কর্মী, হাসতে হাসতে বলেন, “এই যে শিবু, আবার শুরু করলি তোর টাইমপাস টিফিন! আজ কার মেনু ভালো লাগলো?”

শিবু হেসে বলে, “অর্পিতা ম্যাডামের আলুভাজাটা ভালো ছিল আজ। একটু নুন কম, কিন্তু ঝালটা ঠিকঠাক।”

এভাবে ধীরে ধীরে ওর একটা নিজস্ব তালিকা তৈরি হয়ে গেছে—কে কোন খাবার আনে, কার রান্না ভালো, কার টিফিনে কখনও কখনও চকোলেট থাকে, কার টিফিনে কাঁটা বেছে খেতে হয়—সবই জানে ও।

সেইদিন, দুপুর প্রায় একটা চল্লিশে, শিবু অফিস ঘুরে ঘুরে টিফিনগুলো তুলছিল। সবাই খাওয়া শেষ করে দিয়েছে, বেশিরভাগ টিফিন টেবিলেই পড়ে। ও সেগুলো কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগে ভরছিল।

মোহিত স্যারের টিফিনটা নিতে গিয়ে ওর চোখ আটকে গেল। একটা হালকা সাদা প্লাস্টিকের বাক্স। ভেতরে অল্প পোলাও আর কিছু আলুভাজা পড়ে আছে। পোলাওর গন্ধটা অদ্ভুত মিষ্টি।

শিবু খাবার তুলছিল যখন, ওর চামচের নিচে একটা ছোট কাগজের ভাঁজ নজরে এলো। কৌতূহলে কাগজটা টেনে বের করতেই দেখল, ছোট হরফে ইংরেজিতে লেখা—

“Help me.”

শিবুর সারা শরীর কাঁপতে লাগল। কে লিখেছে এটা? কেনই বা টিফিনে? ও চারপাশে তাকিয়ে দেখল, অফিসে সবাই নিজেদের কাজে ডুবে আছে। কাগজটা ও আবার উল্টেপাল্টে দেখে—কোন নাম নেই, অন্য কিছু লেখা নেই। শুধু সেই দুই শব্দ—“Help me.”

“এটা কি মোহিত স্যারের টিফিনে ছিল?” শিবু ভাবল। “নাকি কেউ ইচ্ছে করে ওর টিফিনে দিয়ে দিয়েছে?”

আরেকটা প্রশ্নও মাথায় এল—মোহিত সাহা নিজের টিফিন তো নিজে আনেন না। তাহলে কে আনছে?

ফাইল রুমে গিয়ে শিবু নিজের মোবাইলটা বের করে একটা নোট খুলল।

Tiffin No. 6
Box: White
Note found: “HELP ME”
Suspect: Unknown
Action: Follow Tomorrow

বাইরে তখন আবার মিটিংয়ের ডাকে গুঞ্জন উঠেছে। কিন্তু শিবুর মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে সেই দুই শব্দ।

“Help me.”

একটা টিফিন বাক্সের ভেতর লেখা এই অদ্ভুত বার্তা কি নিছকই ঠাট্টা? নাকি সত্যিই কেউ বিপদে আছে?

শিবু জানে, পরের দিন থেকে তার ‘টাইমপাস টিফিন’-এর ভিতর একটা নতুন খেলা শুরু হতে চলেছে।

এটা আর শুধুই খাবারের গল্প নয়। এটা একটা বাঁচার আর জানানোর লড়াইয়ের গল্প।

পর্ব : মোহিত স্যারের টিফিন

পরদিন সকালটা যেন একটু বেশি ধীর লাগছিল শিবুর কাছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির ছেলেটার মুখেও ক্লান্তি, লিফটে উঠতে গিয়ে সহকর্মী পিন্টু বকারও মুখে কোনো রসিকতা নেই—সবকিছু যেন একটা ধোঁয়ায় ঢাকা। তবে শিবুর ভেতরটা ঝলসে উঠেছে আগুনে। তার মন পড়ে আছে সেই দুটো শব্দে—“Help me.”

সকালের টুকটাক কাজের ফাঁকে সে চোখ রাখছিল মোহিত সাহার দিকে। চুপচাপ লোকটা, অফিসে কেউ তেমন মিশে না। মিটিং হলে কথা বলেন, নইলে ডেস্কে বসে কিবোর্ড টিপে যান। দুপুর নাগাদ, যখন সবাই একটু গা এলিয়ে দেয়, তখন মোহিত হঠাৎ উঠে পড়লেন। শিবু দেখল—ব্যাগ থেকে একটা মোটা ব্রাউন কাগজে মোড়া কিছু বের করে ডেস্কে রাখলেন।

দেখেই শিবুর মনে পড়ল—ওই মোড়কের ভেতরেই থাকে মোহিত স্যারের টিফিন।

“নিজে আনেন নাকি কেউ দিয়ে যায়?”—এই প্রশ্নটা পরিষ্কার করার জন্য ও লুকিয়ে রইল করিডোরের একপাশে। দশ মিনিট পরে, ঠিক সাড়ে বারোটার সময়, অফিসে ঢুকল এক মহিলা—বয়স পঁয়ত্রিশের আশেপাশে, সাদা শাড়ি, লাল পাড়। হাতে একটা ব্যাগ, মুখে কোনো হাসি নেই।

ও সামনে এগিয়ে গিয়ে রিসেপশনে কিছু বলল, তারপর একজন ওকে এগিয়ে দিল মোহিত সাহার ডেস্কের দিকে। মহিলা এসে ব্যাগ খুলে মোড়কটা টেনে বের করল, ডেস্কে রাখল, আর একটাও কথা না বলে ঘুরে বেরিয়ে গেল।

শিবুর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। “ওই মহিলা কে?” নিজের মনে বিড়বিড় করে সে। “ঘরের লোক? দিদি? স্ত্রী? না কি কেউ একেবারেই অন্য?”

দুপুর সাড়ে একটার সময়, অফিসে যখন খাওয়া-দাওয়ার ঢল, তখন শিবু নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে গেল। মোহিত স্যারের ডেস্কে তখন কেউ নেই। অফিসে আলো কমানো, সবাই টিফিন নিয়ে ব্যস্ত।

শিবু ধীরে ধীরে মোড়ক খুলল। সেই সাদা প্লাস্টিকের বাক্স। আজকে মেনুতে পেঁয়াজরসা আর নরম রুটি। খাওয়ার চামচটা তুলতেই চোখ আটকে গেল—আরেকটা কাগজ।

হাত কাঁপছিল শিবুর। কাগজটা খুলে পড়ল।

“Please. I am not safe.”

আরও ছোট হরফে লেখা, এক কোণে—“Tomorrow. Yellow box.”

এতক্ষণে শিবুর মাথা চক্কর দিতে শুরু করল। কাল সাদা বাক্স, আজও সাদা—but কাল তো কিছু ‘বক্স নম্বর’ লেখা ছিল না। আজ স্পষ্ট নির্দেশ—আগামীকাল হলুদ বাক্স।

“মানে কে যেন পরিকল্পিতভাবে এই বার্তাগুলো দিচ্ছে, আর আমি হয়ে উঠছি তার বাহক।”

তবে প্রশ্নটা এখনো একই জায়গায়—কে লিখছে এসব?

মোহিত সাহা?

তবে কেন এমন গোপনে?

যদি ধরেও নিই তিনি বিপদে, তাহলে এত গোপনে এই বার্তা পাঠানোর মানে? অফিসে তো কলিগরা আছেই, HR আছে, বস আছে—তবে?

আর যদি লেখক তিনি না হন? তাহলে সেই সাদা শাড়ির মহিলা? কোনো সংকেত পাঠাচ্ছেন?

শিবু সিদ্ধান্ত নেয়—পরের দিন তাকে খেয়াল রাখতে হবে ‘হলুদ বাক্স’-এর ওপর। সে নোটবুকে লিখে রাখে:

Day 2
Box: White
Note: “Please. I am not safe.”
Next Target: Yellow box
Suspected Source: Woman in white saree

সে জানে, এই খেলা আর শুধু খাবারের গল্প নয়।

এটা এখন বাঁচা না মরার খেলা—আর সে নিজেই এই রহস্যের ভিতরে ঢুকে পড়েছে, না চাইলেও।

পর্ব : হলুদ বাক্সের সন্ধানে

পরদিন সকাল থেকেই শিবুর চোখ কেবল একটাই জিনিস খুঁজছে—হলুদ টিফিন বাক্স। প্রতিটা ডেস্ক ঘুরে ঘুরে সে দেখে, কে কী টিফিন আনছে, কার কনটেইনার কোন রঙের। শিবু কখনও এমন করে টিফিনের দিকে নজর দেয়নি, কিন্তু আজ যেন ওর চোখ একেকটা রঙ ছেঁকে ছেঁকে চিনে নিচ্ছে।

একটা হলুদ টিফিন ঠিক আটটা তিরিশ নাগাদ হাজির হয় অর্পিতা সেনের ডেস্কে। অর্পিতা ম্যাডাম—মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে কাজল, আর গলায় একটা গোল সোনালি মেডেলিয়ন ঝোলে। রোজ স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধমাখা এক টিফিন নিয়ে আসেন—আজকেরটা বোধহয় লাউ আর পনির।

শিবু একটু ঝুঁকে দেখল—হ্যাঁ, প্লাস্টিকের হলুদ ঢাকনা। ব্র্যান্ড-নিউ মনে হচ্ছে।

তবে শুধু এটুকু দেখে থেমে থাকলে চলবে না। আরও একটা হলুদ বাক্স ছিল—শুভ্রদীপ দা’র কাছে। ওরটা কিন্তু একটু আলাদা, গোলাকার, ছোট। শিবু ওর ডেস্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট কামড়ে ভাবল—“কার বাক্সের ভেতর সেই বার্তা থাকবে?”

দুপুর একটা পঁচিশে যখন সবাই টিফিন খুলে বসেছে, শিবু টিফিন রুমে ঢুকে দেখল অর্পিতা ম্যাডাম খাচ্ছেন। উল্টো দিকে বসে শুভ্রদীপ দা—মোবাইল স্ক্রলে ডুবে। ও জানে, এখনই সময় নয়।

একটা ফাঁক খুঁজে নিয়ে সে পরে আবার ঢোকে—আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে কে কিভাবে খাচ্ছে, কে টিফিন শেষ করে তুলে রেখে দেয়। তখন শুভ্রদীপ উঠে দাঁড়ায়, টিফিনটা ধুয়ে রেখে চলে যায়।

এই সুযোগ! শিবু ছায়ার মতো এগিয়ে এসে দ্রুত শুভ্রদীপ দা’র টিফিন খুলে দেখে—কিছুই নেই। শুধু পেঁয়াজের খোসার গন্ধ।

তবে যেটা তাকে চমকে দিল, সেটা অর্পিতার টিফিন।

তিনি টিফিন রুমে টিফিন রেখে বাইরে গেছেন ফোনে কথা বলতে। সেই সময় শিবু চটপট ঢাকনা তোলে—পনির, লাউ, আর এক কোণে টিস্যুর নিচে কিছু একটা আটকে আছে।

শিবুর বুক ধক ধক করতে থাকে। সে হাত বাড়িয়ে কাগজটুকু টেনে তোলে।

লাল কালি দিয়ে লেখা—
“He’s watching. I’m locked in. Find ‘Room R’.”

এইবার আর খটকা নেই—এটা নিছক মজা নয়।

“Room R?” শিবু বিড়বিড় করে। “আমাদের অফিসে তো R নামের কোনো ঘর নেই… A আছে, B আছে… C তো স্টোর রুম…”

সে দ্রুত নোটবুকে লেখে—

Day 3
Box: Yellow (Arpita Sen)
Note: “He’s watching. I’m locked in. Find ‘Room R’.”
Emergency?
Next move: Search office blueprint

সন্ধে নামছে। আলো নিভে আসছে জানালার বাইরে। কিন্তু শিবুর ভেতরে যেন অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠেছে। সে জানে, সে একজন অজানা কণ্ঠের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠছে—একজন মানুষ, যাকে কেউ হয়ত বন্দি করে রেখেছে… হয়ত অফিসেরই কোনো অজানা ঘরে… একটা R নামের রুমে।

আর হয়ত কাল আবার একটা নতুন টিফিন তার কাছে পৌঁছে দেবে রহস্যের চাবি।

(চলবে)

পর্ব : রুম ‘R’-এর রহস্য

সকালটা ছিল অস্বাভাবিক চুপচাপ। শিবু টিফিন বয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি আজ অন্য এক মিশনে নামল। অফিসের ফ্লোরপ্ল্যান খুঁজে বের করতে হবে—‘Room R’ নামে কোনো ঘর আদৌ আছে কি না।

সে জানে—এমন নোট বারবার কেউ লিখছে মানে ভিতরে কেউ আটকে আছেন। হয়তো নিছক জেলাসি নয়, সত্যিই বিপদে আছেন কেউ। এবং সেই কেউ চাইছেন, শুধু শিবুই বার্তা পান। কেন? হয়তো কারণ সে সবার চোখের আড়ালে।

লাঞ্চব্রেকের আগে আগে, সে ছাদে যাওয়ার ছুতো করে বিল্ডিংয়ের রিসেপশন পর্যন্ত নামে। সেখানে একপাশে একটা পুরনো নোটিশ বোর্ড—তাতে লাগানো সিকিউরিটি ফ্লোর ম্যাপ।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে চোখ বোলায় প্রতিটি ফ্লোরে। ষষ্ঠ তলায় আছে—A: Conference Room, B: Marketing, C: Store, D: Archive, E: Server Room…

R কোথায় নেই।

তবে তারপরই চোখে পড়ে একটা জরাজীর্ণ কাগজে পেন দিয়ে লেখা টুকরো লাইন:
Old Restroom (R) — sealed. Access only for maintenance.

শিবুর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। “R মানে ‘Restroom’? সেটা কি এখনো আছে?”

সে নোটবুকে টুকে রাখে—

Room R = Old Restroom (Sealed)
Access: Maintenance Staff

পরদিন সকাল থেকেই সে লক্ষ্য রাখে ক্লিনিং স্টাফদের ওপর। রফিক কাকা, যে প্রতিদিন টয়লেট পরিষ্কার করে, তাকে একটু মিষ্টি হেসে বলে—“কাকা, ওই পুরনো বাথরুমটা তো কোথায় যেন ছিল, সেটাতে ঢোকা যায় নাকি এখনো?”

রফিক হেসে বলে, “ওই যে স্টোর রুমের পিছনে, সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা, ওটাই তো। এখন কেউ যায় না, জানি না ভিতরে কি আছে। অনেক বছর খোলা হয়নি।”

শিবুর গা শিউরে ওঠে। “তাহলে ওইখানে কেউ…?”

দুপুর একটায়, মোহিত সাহা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাথা ঘুরছে, চোখ ফাঁপা—ওষুধ এনে দেওয়া হয়, ডাক্তার ডাকতে হয় না, কিন্তু গোটা অফিস একচোট ব্যস্ত।

এই হঠাৎ ব্যস্ততার মধ্যেই, অর্পিতা ম্যাডাম আবারও একটা হলুদ টিফিন রাখেন টেবিলে।

শিবু অপেক্ষা করে। সবার চোখ যখন অন্যদিকে, সে দ্রুত টিফিনটা খুলে দেখে।

এইবার একটা ছোট কাগজে আঁকা একটা ছক।

পুরনো স্টোর রুম, তার ঠিক পেছনে একটা ছোট স্কেচ—সাদা পর্দা, পাশে লেখা—

“Knock 3 times. If no answer, call 999 from pantry phone.”

শিবুর মাথা ঘুরতে থাকে। তার তো জানা ছিলই না—প্যান্ট্রিতে এমন ফোন আছে!

তার মনে পড়ে যায়—রফিক কাকা মাঝে মাঝে একটা ছোট ফোনে কথা বলেন… শোনে না কেউ।

এটা কি নিছকই ইঙ্গিত?

নাকি কারোর প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে?

সে সিদ্ধান্ত নেয়—পরদিন সে ঠিক তিনবার দরজায় নক করবে। যদি কিছু না ঘটে, তবে ফোনে ডায়াল করবে ৯৯৯।

শুধু একটা প্রশ্ন—ওই ঘরের ভিতর কে?

আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—কেন মোহিত সাহা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন?

পর্ব : সাদা পর্দার পেছনে

পরদিন সকালেই শিবু মনে মনে রপ্ত করে নেয় পরিকাঠামো—দুপুরে টিফিন ডেলিভারির সময় স্টোর রুমের পাশে যেতে হবে, সাদা পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার কড়া নাড়তে হবে, আর কিছু না হলে প্যান্ট্রির ফোন থেকে ‘৯৯৯’ নাম্বারে কল করতে হবে।

সারাদিন সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে—কেউ যাতে বুঝতে না পারে তার মধ্যে উত্তেজনা ফুটে উঠছে। কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যায় ওই করিডোরের শেষপ্রান্তে—যেখানে একটা সাদা পর্দা নেমে আছে, দেয়ালের রঙ মলিন, যেন বহু বছর কেউ হাঁটেনি ওদিকটায়।

বেলা একটা কুড়িতে যখন অফিসের বেশিরভাগ কর্মী লাঞ্চে ব্যস্ত, শিবু একটা খালি প্লেট হাতে করিডোর ধরে এগিয়ে যায়। স্টোর রুমের বাইরের টেবিল থেকে একটা জগ তুলে নেয়, তারপর হঠাৎই থেমে যায় সাদা পর্দার সামনে।

এমনভাবে হাঁটে যেন হঠাৎই ভুল করে পথ এসে গিয়েছে। তারপর চারপাশ দেখে—শান্ত, নিঃশব্দ, অদ্ভুত একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

সে কাঁপা হাতে তিনবার কড়া নাড়ে—
ঠক ঠক ঠক।

কিছুই ঘটে না। সেকেন্ড কেটে যায় দশ, কুড়ি… মিনিট পেরোয়।

তখনই শিবু সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় প্যান্ট্রি রুমে। সেখানে রাখা ফোনটা তুলতে গিয়ে দেখে—মার্বেলের ওপর অদ্ভুতভাবে খোদাই করে লেখা একটা নাম্বার—

৯৯৯।

সে কাঁপা আঙুলে ডায়াল করে।

রিং হয় একবার… দু’বার… তিনবার…

তারপর হঠাৎই ফোনের ওপারে এক নারীকণ্ঠ—ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, “কে তুমি?”

শিবু চমকে ওঠে। “আমি শিবু… আপনি কি… আপনি কি সেই…?”

কণ্ঠস্বরটা থেমে যায়, যেন ভয় পেয়ে গেছে।

তবে পরক্ষণেই বলে, “দয়া করে বের করো আমাকে… আমি… আমি ‘ওর’ বন্দি।”

“ও মানে কে?” শিবুর গলা শুকিয়ে আসে।

“তুমি যাকে মোহিত সাহা বলে জানো, সে… সে মোহিত নয়।”

শিবুর গা শিউরে ওঠে।

“তাহলে কে?” তার গলা শুকনো, চোয়াল শক্ত।

ওপাশ থেকে হঠাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ফোন রেখে শিবু তাকায় দরজার দিকে। দরজার ফাঁক দিয়ে যেন কিছু একটা নড়ে উঠল। হাওয়া নেই, তবু পর্দা দুলে উঠল হালকা করে।

হঠাৎই কারো পায়ের শব্দ—কঠিন, ভারী, ছন্দে ছন্দে এগিয়ে আসছে করিডোর ধরে।

শিবু পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে মোহিত সাহা, ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে।

মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। চোখে গভীর কিছু, যেন শিবুর মন পড়ে ফেলছে।

“তুমি এখানে?” মোহিত জিজ্ঞেস করে।

শিবু কাঁপা গলায় বলে, “জল আনতে এসেছিলাম…”

মোহিত ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি নিয়ে বলে, “সাবধানে থেকো, শিবু। সবাই যে যেমন দেখায়, তেমন নয়… কেউ কেউ মুখোশ পরে থাকে।”

শিবুর গায়ে যেন সাপ লেগে গেল।

সে বুঝে যায়—এটা শুধু একজন বন্দি নারীর গল্প নয়, এটা এমন এক মুখোশধারীর গল্প, যার ছায়া ছড়িয়ে আছে সারা অফিসে।

পর্ব : মুখোশধারীর ছায়া

শিবু সেদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে মোহিত সাহার ঠাণ্ডা, গভীর চোখ, আর সেই নারীকণ্ঠ—“সে মোহিত নয়।”

তার ঘুমভাঙা চোখে একটার পর একটা চিন্তার ধোঁয়া জমতে থাকে—যদি মোহিত সাহা সত্যিকারের মোহিত না হন, তবে তিনি কে? আর সেই ঘরের ভেতরে যার কণ্ঠ শোনা গেল, তিনি কে? কীসের শিকার?

পরদিন সকালে সে অফিসে ঢুকেই লক্ষ্য রাখে করিডোরে, কিন্তু সাদা পর্দা নিথর। মোহিত সাহাও যথারীতি ডেস্কে এসে বসে পড়েছেন—চুপচাপ, একা, কিন্তু আজ যেন তার আশপাশের বাতাসটা খানিক ভারী।

শিবু একবার তাকাতেই দেখে, মোহিত তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দু’জনের চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য আটকে যায়—তারপর হঠাৎ মোহিত চোখ ঘুরিয়ে নেন।

শিবু সিদ্ধান্ত নেয়, আজ আর অপেক্ষা নয়। তাকে দরকার আরও তথ্য। সে পৌঁছে যায় রফিক কাকার কাছে।

“কাকা, ওই পুরনো ঘরটা তো অনেক আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে না?”

রফিক হালকা হেসে বলে, “হ্যাঁ রে। অনেক বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ওই ঘরে। মেয়েটা একদিন ঢুকে পড়ে গিয়েছিল, দরজা লক হয়ে যায়। পরে ওকে বের করা হয়, কিন্তু শরীর খারাপ ছিল খুব।”

শিবু শিউরে ওঠে। “মেয়েটার নাম জানো, কাকা?”

“মনে হয় ছিল অন্বেষা… হ্যাঁ, অন্বেষা দে। তখন নতুন জয়েন করেছিল হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে। তারপর অনেকদিন ছুটি নিয়েছিল। কারো সঙ্গে কথা বলত না… শেষে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়।”

শিবু ঠিক করল, এবার সে HR ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নেবে। সে ছুতো করে ফাইল নিয়ে গেল সেখানে। ডিপার্টমেন্ট হেড অর্ণব বসুর ডেস্কে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “স্যার, একটা প্রশ্ন ছিল…”

অর্ণব বসু বললেন, “হ্যাঁ শিবু, বলো।”

“অন্বেষা দে নামে কেউ এখানে কাজ করতেন অনেক আগে, ঠিক না?”

অর্ণব বসুর মুখের হাসিটা একমুহূর্তে জমে গেল। ঠোঁট শক্ত করে বললেন, “তুমি কেন জানতে চাও?”

“একটা পুরনো ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে নামটা দেখলাম,” শিবু মিথ্যে বলে।

অর্ণব ফাইলটা খুলে দেখলেন, তারপর ফাইল বন্ধ করে বললেন, “অন্বেষা ছিল খুব ভালো কর্মী। খুব সেনসিটিভ মেয়ে ছিল। ওর সম্পর্কে কেউ বেশি কথা বলে না এখন। ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছিল।”

“ব্যক্তিগত মানে?” শিবু একটু সাহস করে প্রশ্ন করে।

অর্ণব কড়া গলায় বলে, “তোমার জানার দরকার নেই।”

শিবু বুঝে যায়, কোথাও কিছু লুকোনো আছে। এবং সেটা এমন কেউ জানে, যিনি এখনো অফিসে আছেন।

ঠিক তখনই তার ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে। স্ক্রিনে কোনো নাম নেই, শুধু এক লাইন লেখা—

“He saw you at the door. Careful tonight.”

শিবুর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। সে জানে, এটা আবার সেই অদৃশ্য কণ্ঠ—অন্বেষা।

সে জানে, সে আর শুধু একজন অফিস বয় নয়। সে এখন এক জীবন্ত রহস্যের মধ্যেই আটকে গেছে। তার প্রতিটা পদক্ষেপ কেউ একজন নজরে রাখছে।

আর যদি সত্যিই মোহিত সাহা ‘মোহিত’ না হন… তবে তিনি কে?

পর্ব : অন্বেষা কে?

শিবু সারাদিন যেন হাওয়ায় ভাসছিল। প্রত্যেকটা শব্দ, প্রতিটা আলো, প্রতিটা মুখ—সব তার কাছে যেন সন্দেহজনক লাগছিল। মোহিত সাহা তাকে নজরে রেখেছেন। অর্ণব বসু অন্বেষা সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি। আর ফোনে যে বার্তা এসেছে, তাতে স্পষ্ট—অন্বেষা এখনো কোথাও আছে, এবং জানে কে কী করছে।

সে দুপুরবেলা আবার সাদা পর্দার দিকে যেতে চায়, কিন্তু মোহিত সাহার ডেস্কে বসে থাকা চেহারাটা যেন পথ আগলে থাকে।

পরে বিকেলে, সবাই যখন ছুটির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, শিবু একবার গিয়ে দাঁড়ায় করিডোরে। হঠাৎই তার চোখ আটকে যায়—একটা পাতলা, সাদা কাগজ, পর্দার নিচ থেকে একটু বেরিয়ে এসেছে।

সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কাগজটা তোলে। এইবার ইংরেজিতে লেখা—

“His name is not Mohit. He came here as a replacement after I disappeared. He has something under his desk. Find the locker. Code: 2727.”

শিবুর মাথা যেন ঘুরে যায়। “মানে… অন্বেষার ‘disappearance’-এর পরেই এই লোকটা এসেছিল? আর তার ডেস্কের নিচে কিছু লুকোনো আছে?”

সে জানে, এরপর আর দেরি করা যাবে না।

পরদিন সকাল দশটায়, মোহিত সাহা যখন চা খেতে বেরোলেন, শিবু নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল তার ডেস্কের নিচে। ড্রয়ারের বাঁ পাশে একটা কাঠের প্যানেল, একটু আলগা। হালকা চাপ দিলেই খুলে যায়।

ভেতরে একটা ছোট লোহার লকার। কোড চায়। শিবু কাঁপা আঙুলে টাইপ করে—2-7-2-7

একটা টিক শব্দ, তারপর লকার খুলে যায়।

ভেতরে একগাদা কাগজ, একটা পুরনো আইডি কার্ড—“Mohit Saha” নামে নয়, বরং “Ranajoy Basu” নামে। সঙ্গে একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি, তাতে একই মুখ, কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—এই লোকটা অন্য।

আরও নিচে একটা খামে ভরা ছবি—তাতে অন্বেষা দে। পিছনে লেখা তার হস্তাক্ষরে—

“If anything happens to me, find R.B.”

R.B. মানেই Ranajoy Basu—মানে এখনকার ‘মোহিত সাহা’।

ঠিক সেই সময় কেউ পেছন থেকে বলে ওঠে, “খুব সাহস হচ্ছে তো, শিবু?”

শিবু চমকে পেছনে ফিরে তাকায়—মোহিত সাহা, বা বলা ভালো—রণজয় বসু, তার সামনে দাঁড়িয়ে।

চোখে আগুন, ঠোঁটে হালকা বিদ্রুপ।

“তুমি আমার গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছ, বালক। এবার বুঝবে, এই খেলাটা ঠিক কতটা গভীর।”

শিবু কিছু বলার আগেই, রণজয় তার দিকে এগিয়ে আসে, হাতে একটা কিছু চকচক করছে—ছোট একটা ধাতব কিছু, বোধহয় স্ক্রু-ড্রাইভার।

শিবু পেছনে সরে যায়, দরজার দিকে ছুটতে যায়—কিন্তু করিডোরটা যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়। চারপাশ নিস্তব্ধ।

আর তখনই আবার বাজে তার ফোন। স্ক্রিনে আবার সেই অদৃশ্য নম্বর।

“Run to the storeroom. Door is open.”

শিবু ছুটে যায়—জীবনের মতো, মৃত্যুর হাত থেকে পালানোর মতো।

পর্ব : স্টোররুমের দরজার ওপারে

শিবু ছুটছিল প্রাণপণে। করিডোরের বাতি মিটমিট করছিল, যেন বিদ্যুৎও বুঝে গেছে বিপদের ঘনঘটা। পেছনে ভেসে আসছিল জুতোর মৃদু আওয়াজ—রণজয় বসু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন, যেন জানেন শিকার তার পালাবে না।

স্টোররুমের সামনে এসে শিবু দেখতে পেল, সাদা পর্দাটা অদ্ভুতভাবে একটু সরিয়ে রাখা। পেছনে সেই দরজা, যেটা বহুদিন ধরে বন্ধ ছিল—আজ খুলে আছে।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত গন্ধে মাথা ঘুরে যায়। অন্ধকার ঘরের কোণে কিছু পুরনো চেয়ার, ফেলে দেওয়া মোড়ক, পুরনো কম্পিউটার মনিটর, আর দেয়ালের পাশে বসে থাকা একজন… মেয়ে।

তার গায়ে সাদা শাড়ি, চুল এলোমেলো, চোখে ভয় আর ক্লান্তির ছায়া। আলো ছিটকে পড়তেই সে চোখ তুলে তাকায়।

“তুমি… শিবু?” তার গলা কেঁপে ওঠে।

শিবু দম নিতেই পারছে না। “আপনি অন্বেষা দে?”

মেয়েটি মাথা নাড়ে। “তুমি বার্তা পেয়েছিলে তো?”

শিবু এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে, “হ্যাঁ! কিন্তু আপনি এতদিন ধরে এখানে কীভাবে…? কেউ জানল না?”

“ও আমাকে আটকে রেখেছিল। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে রাখত। শুধু মাঝে মাঝে খাওয়ার বাক্স পাঠাত… সেই টিফিনের ভেতরেই আমি কাগজগুলো ঢুকিয়ে দিতাম। জানতাম, কেউ একজন খুঁজে পাবে। কেউ একজন… তুমি।”

শিবুর গলা শুকিয়ে যায়। “কিন্তু উনি তো মোহিত সাহা না…”

“না। উনি রণজয় বসু। একসময় অফিসেই কাজ করতেন, কিন্তু আচরণজনিত কারণে চাকরি চলে যায়। তারপর একদিন আমি তাঁকে অফিসের কাছেই দেখে ফেলি। আমি রিপোর্ট করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে আমাকে টেনে নিয়ে আসে এখানে।”

“তবে এতদিন ধরে কেউ খেয়াল করল না?”

“রণজয় ছিল ধুরন্ধর। মোহিতের নামে ভুয়ো পরিচয় বানিয়ে আবার অফিসে ঢুকল। আর আমি… আমি অদৃশ্য হয়ে গেলাম।”

হঠাৎই পেছনে দরজার একটা ঠাস করে শব্দ। শিবু ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে—রণজয় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আলো তার মুখের একপাশে পড়েছে—চোখে হিংস্রতা, ঠোঁটে বিদ্রুপ।

“তোরা দু’জনেই চালাক। বিশেষ করে তুমি, শিবু। ভাবলে আমি বুঝতে পারিনি?”

তার হাতে চকচকে কিছু—ছোট একটা ব্লেড।

“এবার শেষ করে দিতে হবে খেলা।”

শিবু পিছিয়ে এসে একটা লোহার রড তুলে নেয়। হাত কাঁপছে, কিন্তু চোখে সাহস। “আমাকে মারার আগে আপনাকে এই মেয়েটাকে পেরোতে হবে।”

রণজয় হেসে ওঠে। “ভয় দেখাচ্ছিস?”

ঠিক তখনই, দরজার ওপাশে আওয়াজ—জুতো চলার শব্দ, দু-তিন জন লোকের কণ্ঠ।

“দরজা খুলুন!”—এটা ছিল অর্ণব বসুর গলা।

রণজয়ের মুখে ভয়ের ছায়া নেমে আসে। সে এক লাফে দরজার দিকে দৌড়ায়, কিন্তু দরজা খুলতেই দু’জন সিকিউরিটি গার্ড তাকে পাকড়াও করে ফেলে।

অর্ণব বসু ঢুকে এসে দেখেন—ভেতরে অন্ধকার, কোণায় অন্বেষা দে কুঁকড়ে বসে, আর শিবু দাঁড়িয়ে—হাতের রড ফেলে দিয়ে হাঁপাচ্ছে।

“শিবু… তুমি বাঁচিয়ে দিলে…” অর্ণব হতবাক।

শিবু কিছু বলে না। শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই চুপ করাটাই যেন ওর সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।

রণজয় বসুর মুখে তখন আর মুখোশ নেই।

পর্ব : মুখোশের পরে আলো

অফিস যেন থমকে গিয়েছিল। সিকিউরিটি গার্ডরা রণজয় বসুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। তার মুখে তখন আর কোনও রঙ নেই, ঠোঁটের কোণে হালকা কাঁপুনি, চোখে চাপা ভয়। অর্ণব বসু নিজে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, আর অন্বেষা দে-কে নিয়ে গেলেন মেডিকেল রুমে।

শিবু চুপচাপ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কিছু বলল না, কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করল না। তবু সবার চোখে একরাশ কৃতজ্ঞতা, যেন এতদিন যে অদৃশ্য ভূতের ছায়া অফিস জুড়ে ছিল, সেটা আজ হঠাৎ কেটে গেছে।

দুপুরে অর্ণব বসু নিজেই ডেকে পাঠালেন শিবুকে।

“তুমি জানো, তুমি কী করেছো?” তিনি ধীর কণ্ঠে বললেন।

শিবু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

“যদি তুমি ওই টিফিনে কাগজ না দেখতে… যদি তুমি শুধু নাক না গলাতে…”
তিনি থামলেন। “তাহলে হয়তো অন্বেষা আজও আমাদের অজানার অন্ধকারেই থাকত।”

শিবু একটু মাথা তুলল। “স্যার, ও শুধু বাঁচতে চাইছিল। আমি শুধু ওর লেখা পড়েছিলাম। আর কেউ হয়তো পড়ে না।”

অর্ণব বসু একটুখানি হেসে বললেন, “এই জন্যই তো তুমি আলাদা। এত সাধারণ হয়েও এত অসাধারণ।”

তাঁরা অন্বেষার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন। তাকে ছুটি দেওয়া হলো, অফিসের তরফে তার পরিবারকেও জানানো হলো।

দু’দিন পর, শিবু এক কাপ চা নিয়ে টিফিন রুমে বসেছিল। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ আস্তে বলল, “তোমার জন্য বেঁচে গেছি।”

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, অন্বেষা দে—কাঁপা কাঁপা পায়ে দাঁড়িয়ে, চোখে জল, মুখে স্নিগ্ধ হাসি।

“আপনি কেমন আছেন এখন?” শিবু জিজ্ঞেস করল।

“একটু একটু করে ফিরে আসছি। তবে এখনও রাতে ঘুম ভাঙে…” অন্বেষা নিচু গলায় বলল।

শিবু বলল, “ভয় পেলেই আমাকে বার্তা পাঠান। আমি আবার টিফিন খুলে বার্তা খুঁজে নেব।”

অন্বেষা হেসে ফেলল। “এই টিফিন গল্পটা একটা সিনেমার মতো ছিল, জানো?”

“‘Timepass Tiffin Tales,’” শিবু মুখ টিপে হেসে বলল।

অন্বেষা একটু কাঁপা গলায় বলল, “সিনেমা শেষ হয়। কিন্তু বাঁচা আবার শুরু হয়।”

শিবু মাথা নাড়ল। তখনই টিফিন রুমে ঢুকল রীতা দিদি, আরেকটা নতুন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। “এই যে শিবু, এবার নতুন অফিসবয় এসেছে। ওকে সব কিছু শিখিয়ে দে।”

শিবু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, ওকে নিয়ে আসছি।”

বেরিয়ে যাওয়ার আগে অন্বেষা তার হাতে একটা ছোট কাগজ গুঁজে দিল।

শিবু কাগজটা খুলে দেখে—
“Thank you. For listening when no one else did.”

এই কাগজে আর কোনও গোপন সংকেত নেই। তবুও এটাই সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে উজ্জ্বল বার্তা।

পর্ব ১০: শব্দের বাইরে যা থাকে

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অ্যামব্রেলা ফাইন্যান্সে স্বাভাবিক রুটিন ফিরে এসেছে। করিডোরে হাঁটাহাঁটি, প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি, কফি কাপের ঠোকাঠুকি, আর শিবুর টাইমপাস টিফিন।

তবে এবার টিফিনের চরিত্র একটু পাল্টেছে।

রীতা দিদি নিজে হাতে করে ওর জন্য রোজ অল্প কিছু বাড়তি খাবার রেখে দেন। অনন্যা ম্যাডাম একদিন বলেই ফেললেন—“শিবু, তোকে আমরা আর অফিসবয় বলে ভাবি না, তুই আমাদের ফ্যামিলির মতো।”

তবে শিবুর জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা এসেছে ভিতর থেকে। আর সে এখন জানে, টিফিন শুধু খিদে মেটায় না, সেটা হয়ে উঠতে পারে কোনো নিঃশব্দ আর্তির কাগজও।

একদিন দুপুরে হঠাৎই সে আবার একটা ছোট কাগজ পায় তার নিজের টিফিনের ভাঁজে। বুক ধক করে ওঠে—পুনরায় কি কিছু শুরু হতে চলেছে?

কিন্তু কাগজে লেখা—

আজও বাঁচতে ইচ্ছা করে। কারণ তুমি বিশ্বাস করেছিলে।.”

সে বুঝে যায়, অন্বেষা এখনও লড়ছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে ফিরে আসছে।

আর শিবু?

সে আজও ঘুরে বেড়ায় ডেস্কের পর ডেস্কে, হালকা পা ফেলে। কেউ বলে না, সে ‘অফিসবয়’। তার নামের পাশে এখন এক অদৃশ্য পদবি লেখা আছে—শ্রোতা

যে শুনেছিল এক বন্দিনীর কান্না, যে খুঁজে পেয়েছিল এক মুখোশধারীর ভিতরের রাক্ষস, আর যে জানত—একটা ‘হেল্প মি’ মানে কখনো কখনো একটা প্রাণের দিশা।

টিফিন এখনো জমে টেবিলে।

আলুভাজা, ডাল, পরোটা, মিষ্টি…

কিন্তু শিবু জানে, সব খাবারের নিচে কোনো না কোনো গল্প থাকে। কেউ লিখে রাখে না, কেউ মুখ ফুটে বলে না। তবু তা থাকে। চুপচাপ, নিরব, অপেক্ষায়।

আর সে অপেক্ষা করে। হয়তো কোনো এক দুপুরে আবার কাগজ আসবে।

নতুন গল্প। নতুন ডাকে।

শিবু জানেসব গল্প খালি টিফিনের মতো। একটু সময় দিলে, ভরে ওঠে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-23-at-3.31.54-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *