Bangla - হাস্যকৌতুক

ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন

Spread the love

তৃষা দাস


শিয়ালদহ স্টেশনের গেট নম্বর তিনের সামনের ছোট্ট চা-দোকানটার পাশে একটা ঝাপসা বেঞ্চে প্রতিদিনের মতই বসেছিল রিঙ্কু দা, হাতে আধখানা তেলে ভাজা খবরের কাগজে মোড়ানো চপ, মুখে থেমে থেমে ভাঙা ভাঙা আওয়াজে কোন রাজনৈতিক দলের ইস্তেহার পড়ছিল। তার পাশে বসেছিল বুবুন, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মোবাইল স্ক্রিনে বাজেট ফুচকার রেট যাচাই করতে করতে মাঝেমধ্যে বিরক্ত গলায় বলে উঠছে, “এরা সব ঠকায় রে দাদা, ২০ টাকায় ৮টা মানে প্রতি ফুচকায় ২.৫ টাকা — মানে ঠকাই!” হঠাৎ করেই পাশের টুলে বসে পড়ল চুমকি, কপালে হালকা টিকলি, গলায় বকুলফুলের মালা — কলেজ ফেরত, কিন্তু চোখে মিশ্র উন্মাদনা, কারণ তার ফুড ব্লগে আজ “স্টেশন সাইড ফুচকা ওরডেল” নামে নতুন সিরিজ চালু হচ্ছে। সবাই চুপচাপ বসে থাকলেও চুমকির চোখে ধরা পড়ল পাশের ফুটপাতের ধারে একজন বয়স্কা মহিলা, যিনি হাওয়াই চটি পরে এক হাতে একটা জল বোতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফুচকা গাড়ির সামনে — তিনি আর কেউ নন, মিঠু মাসি। মাসি একসময় স্কুলে পড়াতেন, কিন্তু অবসরের পর নিজেকে নিয়োজিত করেছেন শহরের ফুচকা মানচিত্র আবিষ্কারে। মিঠু মাসির হুঙ্কার, “ছোটবেলা থেকে খাই রে বাবা ফুচকা! আজও স্বাদ ভুলিনি। ঐ শোভাবাজার মোড়ের মত টক জল কোথাও হয় না!” চা-দোকানের পেছন দিক দিয়ে তখন সুরসুরি দিয়ে ঢুকে পড়ল টিপু, ক্লাস টেনের ছাত্র, ফুচকা খাওয়ার নেশায় মাঝে মাঝে গৃহশিক্ষকের ক্লাসও এড়িয়ে যায়। ফুচকা নিয়ে এই পাঁচজনের ব্যক্তিত্ব, মতামত আর স্বাদপ্রীতি একদিন এক কৌতুককর সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, এবং সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক ঐতিহাসিক মঞ্চ — “ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন”।

এটা সবই ঘটেছিল এক গ্রীষ্মের দুপুরে, যেখানে ঘাম আর ঝাঁঝালো ফুচকার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। চুমকি প্রথম প্রস্তাব রাখে, “শোন, এত কথা বলছ, চল সবাই মিলে ঠিক করি কোথায় সেরা ফুচকা মেলে।” রিঙ্কু দা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমাদের এই লড়াই শুধু ফুচকার জন্য নয়, এটা এক ধরণের স্বাদ-বিপ্লব! আমরা এখন থেকে ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন গঠন করব।” বুবুন এক ঝটকায় তার ছোট্ট নোটবুকে নাম লিখে বলে, “আমি ফিনান্স সেক্রেটারি, ফ্রি ফুচকা কে কতবার পাবে, সেটা হিসেব আমি রাখব!” মিঠু মাসি হেসে বললেন, “তাতে আমার কী! আমি ফুচকা খেতে জানি, বাকি সব তোমরা দেখ।” টিপু সঙ্গে সঙ্গে কাগজে চট করে একটা লোগো এঁকে ফেলল, যেখানে এক হাতে টক জল, অন্য হাতে ঝাল ফুচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে এক সুপারহিরো। এইভাবেই গঠন হয় তাদের সংগঠন — তারা ঠিক করে প্রতিদিন একেকটা বিখ্যাত দোকানে গিয়ে ফুচকা খেয়ে রেটিং দেবে, তর্ক করবে, স্বাদ বিশ্লেষণ করবে, আর শেষে শহরের সেরা ফুচকার স্বীকৃতি দেবে একটিকে — একেবারে গুছিয়ে রিপোর্ট বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেবে। চুমকি ব্লগ খুলে ফেলল, নাম রাখল — “ফুচকা ফাইটার ডায়েরি”, আর রিঙ্কু দা ঘোষণা করল, “আমরা শুধু খেতে আসিনি, ইতিহাস লিখতে এসেছি!” ঠিক তখনই শিয়ালদহের গেটের ধারে ফুচকা ঠেলাটি থেকে আওয়াজ এল — “ভাই ভাই, চাটমশলা কই রইছে?” আর তারা সকলেই তাকিয়ে বলল — “এটাই হবে আমাদের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র!”

ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হয় শিয়ালদহ থেকে, কিন্তু গন্তব্য ছিল পুরো কলকাতা শহর। তারা ঠিক করল শহরের বিভিন্ন মোড়ে, গলিতে, লেনে ও বড়ো দোকানে ফুচকা খেয়ে রেটিং দেবে। রিঙ্কু দা প্রতিদিন একটা ছোট খাতা নিয়ে আসতেন, যেখানে তিনি লিখে রাখতেন, “ফুচকার তাপমাত্রা: কুসুমগরম; জলতত্ত্ব: ৭.৫/১০; খোলস: একটু শক্ত”। চুমকি একেকটা ফুচকার ছবি তুলে ক্যাপশন দিত, “When life gives you lemons, ask for more imli water.” মিঠু মাসি দায়িত্ব নিলেন ‘লাস্ট বাইট টেস্ট’-এর — মানে শেষ ফুচকাটির স্বাদ যদি ভালো না হয়, তাহলে গোটা দোকান বাতিল। বুবুন রীতিমত ক্যালকুলেটরে ফুচকার মূল্য নির্ধারণ করত — “২০ টাকায় ৬টা মানে দাম বেশি, কিন্তু যদি জল এক্সট্রা পাওয়া যায়, তখন লস সামাল দেওয়া যায়।” আর টিপু? সে ছিল এক্কেবারে মাঠপর্যায়ের কর্মী — কোথায় ফ্রি ফুচকা মিলতে পারে, কার দোকানে দুপুরের পর জলের স্বাদ কমে, কোথায় গিয়ে প্রথমে লাইন দিতে হবে — সব তার মুখস্থ। এই প্রথম অধ্যায়ে যেমন দেখা যায়, এরা কেউ পেশাদার রিভিউয়ার নয়, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল দৃঢ় — ফুচকার মাধ্যমে শহরের খুশির সন্ধান। এবং ঠিক এইভাবেই শুরু হয় তাদের স্বাদ-ভরা, ঝাল-জল-ঝাঁজ-মশলায় মোড়া এক মহা অভিযান।

কলকাতার যেকোনো মিশনে প্রথম গন্তব্য বেছে নেওয়াটা যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি বানানোর মতই গুরুতর ব্যাপার, আর রিঙ্কু দা সেটা জানতেন। তাই পরের দিন সকালে, ইউনিয়নের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে প্রথম অভিযানের জায়গা নির্ধারিত হল — শিয়ালদহের ব্রিজের নিচে, যেখানে “বাবলু ফুচকাওয়ালা” গত দশ বছর ধরে নিজেকে “কলকাতার তেতুল সম্রাট” বলে দাবি করে আসছে। সকাল সাড়ে দশটা থেকেই টিপু রেকি করতে চলে যায়, দোকান খোলা হয়েছে কিনা দেখে আসে। রিঙ্কু দা যথারীতি হাতে লাল খাতা, চোখে রাজনীতিকদের মত কাঠখোট্টা ভঙ্গিমা, সঙ্গে চুমকি তার DSLR ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়ে, যেন কোনো রন্ধনপ্রেমী ডকুমেন্টারি বানাতে এসেছে। দোকানের সামনে পৌঁছেই বুবুন হিসেব করতে বসে — “২০ টাকায় ৮টা, মানে ফুচকা প্রতি ২.৫ টাকা, কিন্তু জল দিলে কভারেজ বাড়ে। ভালো, ভালো।” মিঠু মাসি সোজা গিয়ে বসে পড়লেন এক কোণায়, ব্যাগ থেকে নিজের কাঁচা লঙ্কা বের করে বললেন, “ফুচকার সঙ্গে এইটা দিলে চরম স্বাদ আসে!” বাবলু কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতবড় দল, কেউ ছবি তুলছে, কেউ আবার জল নিয়ে সায়েন্স পড়াচ্ছে! ফুচকা আসতেই রিঙ্কু দা একটা নিয়ে চিবোতেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই যে! এখানে মশলা কম, আর টক জল যেন পাতলা পুঁটি মাছের ঝোল!” শুরু হলো প্রথম সংঘাত।

“এইটা কি ফুচকা?” চুমকি বলল, ঠোঁট মোছে একবার, চোখে রাগ। “এটা তো ভেজা বাতাস!” বুবুন হিসেব কষে বলল, “জল অর্ধেক দিলে প্রতি ফুচকার উৎপাদন খরচ কমে যায়, তাই না? আমি ধরেই নিয়েছিলাম।” মিঠু মাসি তখন দ্বিতীয় ফুচকাটির মধ্যে থেকেই গন্ধ পেয়ে বললেন, “তেঁতুলটা পুরনো গো বাবা, টক নয়, টেকি গন্ধ।“ রিঙ্কু দা বলে উঠলেন, “দেখুন বাবলু, আপনি যদি শহরের ফুচকা সংস্কৃতিকে এভাবে নিচে নামান, তাহলে আমাদের বাধ্য হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুচকা জলে টক যদি না থাকে, তবে সেটা শুধু জল!” টিপু ইতিমধ্যেই ফুচকা নিয়ে পাশের এক দোকানে গিয়ে তুলনা করছে — এক দোকানে টক কম, আরেকটায় ঝাল বেশি — সে যেন মাঠে সেনা পাঠিয়ে খবর আনছে। দোকানদার বাবলু এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার রেগে গিয়ে বললেন, “এটা যেমন খুশি, কেউ জোর করে খাওয়াচ্ছে না!” রিঙ্কু দা উত্তরে বললেন, “কিন্তু আপনি যে শহরের তেতুল সম্রাট নাম নিয়েছেন, তার তো একটা মানদণ্ড থাকা উচিত!” চুমকি বলেন, “আমি এই ভিডিওটা ফেসবুকে তুলে দিচ্ছি, দেখে নিন ভাইরাস কত তাড়াতাড়ি ছড়ায়।” লোকজন জমতে থাকে, কেউ বলে ফুচকা খেতে এসেছে, কেউ দেখে ভিডিও তুলছে। ইউনিয়নের প্রথম অভিযানেই দেখা দিল জনসমাগম, আর বাবলু ফুচকার ঠেলাটা হয়ে উঠল আন্দোলনের মঞ্চ।

তর্ক তুঙ্গে উঠল যখন মিঠু মাসি হঠাৎ করে বললেন, “এই জল আমাকে দিল্লির ফুচকা মনে করিয়ে দিল, কিন্তু সেটা তো গুলমোহর গার্ডেনের — যেখানে আমি একবার ভুল করে ‘জলজিরা’ চেয়ে ‘সোডা’ পেয়ে গেছিলাম!” সবাই একহাসি দিলেও রিঙ্কু দা সিরিয়াস। তিনি বলেন, “দোকানদার যদি মান না দেন, তাহলে আমাদের ইউনিয়ন বয়কট করবে এই ফুচকা ঠেলাকে।” চুমকি সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বলে, “লাইভ করছি ভাই, বলুন আবার।” বুবুন ফিসফিস করে টিপুকে বলে, “দেখিস, ফুচকার জন্য আমাদের ছবি কাল পেপারে উঠবে।” হঠাৎ এক পুলিশ কনস্টেবল হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে আসে — “কি হচ্ছে এখানে? রাস্তা আটকে নাটক নাকি?” রিঙ্কু দা খুব শান্তভাবে বলেন, “স্যার, এটা একটা সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ — ফুচকার মাধ্যমে নাগরিক অধিকার যাচাই।” পুলিশ হকচকিয়ে বলে, “মানে?” মিঠু মাসি ব্যাখ্যা করেন, “স্যার, এটা একপ্রকার মেটাফোর। আমরা স্বাদের নামে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে কি না তাই দেখছি।” কনস্টেবল সব না বুঝে বললেন, “চুপচাপ খেয়ে চলে যান, না হলে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাব।” দলটি বুঝে গেল, আপাতত যুদ্ধ থামাতে হবে। রিঙ্কু দা বলেন, “আজকের দিন এখানেই শেষ, কিন্তু ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়নের আন্দোলন শুধু শুরু হয়েছে। এ শহরে জল যদি টক না হয়, তবে আমাদের মিশনও থেমে যাবে না।” সবাই হাঁটতে হাঁটতে ফিরে গেল, আর চুমকি শেষ পর্যন্ত বলল, “কাল বেহালার বাপি ফুচকাওয়ালার কাছে যাব — শুনেছি তার জল খেলে চোখে জল এসে যায়। সেটাই আসল পরীক্ষা!” ইউনিয়নের প্রথম অভিযান শেষে তারা সবাই বুঝে গেল, এই যুদ্ধ শুধু স্বাদের নয় — এটা স্মৃতি, মূল্যবোধ, আর ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বেরও।

পরের দিন সকালের আলো তখনও পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি, অথচ টিপু রাস্তায় নেমে গিয়েছে এক নতুন অভিযান শুরু করতে। তার গন্তব্য—বেহালার সেই কিংবদন্তি দোকান, “বাপি ফুচকাওয়ালা”, যার জল খাওয়ার পরে চোখে জল এসে যায় বলে কিংবদন্তি ছড়িয়েছে। ইউনিয়নের বাকি সদস্যরা বেলা এগারোটার মধ্যে পৌঁছালেও টিপু আগেই সার্ভে করে, দোকানটার পাশে কতগুলো চেয়ার আছে, গলির কোন দিক দিয়ে রোদ পড়ে না, এমনকি দোকানদার বাপি দার স্বভাব কেমন—সব রিপোর্ট প্রস্তুত। চুমকি আজ বিশেষ সাজে এসেছে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন শহরের ফুচকা-রিপোর্টার মনে হচ্ছে। রিঙ্কু দা হাতে আগের খাতা, আর বুবুন পাশে দাঁড়িয়ে এক নতুন চার্ট বানিয়েছে, যেখানে লেখা—”ঝাল সূচক”, “টক স্কেল”, “মশলা ইন্ডেক্স”, আর “জল পুনরায় চাওয়া সম্ভাবনা”। মিঠু মাসি এসে প্রথমেই বলে উঠলেন, “আজ মন বলছে কিছু হবে, এই দোকানটার জল একেকদিন একেক রকম। যেদিন শরৎচন্দ্রের গল্প মনে পড়ে, সেদিন জানি জলটা ঠিকঠাক টক!” এইরকম কথা শুনে রিঙ্কু দা মাথা নাড়লেন, “এটা তো একেবারে সাহিত্যিক স্বাদবোধের বিশ্লেষণ!”

বাপি দা নিজে এসে যখন ফুচকা দিতে শুরু করলেন, প্রথমেই চুমকি তার ক্যামেরা চালু করে বলে উঠল, “ফুচকা পোজ দিন দাদা, এইটা গ্লোবাল হবে!” বাপি হেসে একটা থালা সামনে রাখেন, আর টিপু বলে, “এটা আসল যুদ্ধ, দাদা। জলটা একটু টক রাখবেন, কেবল স্বাদের জন্য না, আমাদের জন্যও।” প্রত্যেকে একে একে ফুচকা খাওয়া শুরু করতেই ঘটল প্রথম বিপর্যয়—মিঠু মাসি ফুচকা খেয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করলেন, “উফ! একেবারে আগুন! এইটুকু জল, এত ঝাল!” তারপর তিনবার হাঁচি দিয়ে বললেন, “কিন্তু কি মজা!” রিঙ্কু দা তখন নোট নিচ্ছেন, “ঝাল সূচক – ৯/১০, চোখজল মাত্রা – গ্রহণযোগ্য, আফটার টেস্ট – দীর্ঘস্থায়ী।” চুমকি বলে, “এই ঝাল যদি ইনস্টাগ্রামে যায়, তাহলে নিশ্চয় ভাইরাল হবে। কিন্তু এই ঝাল নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন—এটা কি স্বাস্থ্যকর?” বুবুন হিসেব করে বলল, “দাম ঠিক আছে, কিন্তু জলটা রিফিল করতে গেলে বাপি দা একটু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন—মানে এটা কনজারভেটিভ দোকান।” তখনই শুরু হয় বিতণ্ডা—চুমকি বলে, “সরি দাদা, আপনি জল কম দিলে, স্বাদ কমে। আমি তো খাব না।” টিপু তখন বলে, “এইখানে জল চাইলে তিনবার বলতে হয়, আর শেষে একবার বলতে হয়—‘দাদা, প্লিজ!’” ইউনিয়নের মধ্যে এবার মতবিরোধ দেখা দিল, চুমকি বলে, “আমরা তো স্বাদ খুঁজছি, কিন্তু এখানে একটা দাদাগিরি চলছে।” রিঙ্কু দা বলে, “কিন্তু খেয়ো তো আগে!” চুমকি বলল, “আমি রেটিং দিচ্ছি ৫/১০—ঝাল বাড়ালেই স্বাদ বাড়ে না!”

এই ঘটনার পর মিঠু মাসি ফুঁসে ওঠেন। তিনি বলেন, “এত বিচার করে খেতে গেলে তো ফুচকা ফুচকা থাকে না—তখন তো ওটা হারে গ্লাসের পানির মতন হয়ে যায়।” বুবুন মাঝখানে বলে উঠল, “তাহলে আমরা ঠিক কি খুঁজছি? একেবারে নিখুঁত ফুচকা? নাকি ফুচকার সঙ্গে স্মৃতির মিল?” রিঙ্কু দা একটু গম্ভীর গলায় বলেন, “আসলে এইটাই আমাদের বিভ্রান্তি—আমরা কেউ স্বাদ খুঁজি, কেউ ছবি খুঁজি, কেউ খরচ, কেউ অভিজ্ঞতা। কিন্তু যদি আমাদের ভিতরে মতভেদ থাকে, তাহলে ইউনিয়ন চলবে কীভাবে?” তখন টিপু বলে, “একটা ভোট হোক! ফুচকাটা কার কেমন লেগেছে, আমরা হাত তুলে জানাই।” পাঁচজন সদস্য পাঁচ রকম মত দেয়। এইভাবে তারা বুঝে যায়, শহরের ফুচকা শুধু খাওয়ার বিষয় না—এটা একেকজনের মনে একেক রকম অনুভব জাগায়। চুমকি শেষমেশ মুচকি হেসে বলে, “ঠিক আছে, রেটিং আমি কম দিলেও স্বাদটা মনে থাকবে।” রিঙ্কু দা তখন ইউনিয়নের খাতায় নতুন অধ্যায় লেখেন—“বাপি ফুচকাওয়ালা: ঝালের মধ্যে দ্রোহ আছে, আর সেই দ্রোহেই জন্ম নেয় বিদ্রোহ।” এইভাবে তৃতীয় দিনে তারা শিখে নেয়, স্বাদ নিয়ে তর্ক যতই হোক, একসাথে ফুচকা খাওয়ার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।

কলকাতার গ্রীষ্মকাল মানেই পেটের উপর অত্যাচার—দুপুরে লাচ্ছা পরোটা আর রাতে মশলাদার কচুরি খেয়ে চোয়াল ও পাকস্থলী দুটোই ক্লান্ত হয়ে যায়। আর সেই ক্লান্তিকে স্বস্তি দিতে পারে একমাত্র বিকেলের দিকে এক থালা ঝাল-টক ফুচকা। এই সরল যুক্তিতেই “ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন” পৌঁছে গেল গড়িয়াহাট মোড়ের “মাহিমা ফুচকা কর্নার”-এ, যেখানে আজকে ফুচকা ফেস্টিভ্যাল। পোস্টারে লেখা—“২০ টাকায় ৮টি, ১টি এক্সট্রা ফ্রি! শুধু আজ।” টিপু প্রথমেই মোবাইল বার করে বলল, “দিদি! দেখো না! এক্সট্রা ফুচকা! মানে আমরা পাঁচজন গেলে ৫টা ফ্রি! মানে একটা ভাগ করে খেতে হবে না।” চুমকি ইতিমধ্যেই ব্লগের জন্য হ্যাশট্যাগ তৈরি করেছে—#ফুচকা_ফেস্ট_কলকাতা #ফ্রি_ফুচকা_ফিউরি। রিঙ্কু দা আজ একটু বেশি সিরিয়াস, কারণ গত দোকানে জল কম পাওয়াতে তিনি রীতিমতো হতাশ। মিঠু মাসি ছাতা নিয়ে এসেছেন, রোদে চুল পুড়লে স্বাদের উপর প্রভাব পড়ে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। আর বুবুন তার পকেটে ছোট একটা ডিজিটাল স্কেল এনেছেন—“আজ আমি ফুচকার ওজন মাপব!”

প্রথম রাউন্ডে মাহিমা ফুচকা বেশ সম্মানজনক—টক জল ঠিকঠাক, পুরি টক-ঝালের ভারে খসে পড়ে জিভে, একসঙ্গে খেলে মনে হয় যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁচে ফেরার মতো আনন্দ। কিন্তু বিপত্তি শুরু হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে, যখন ইউনিয়নের প্রত্যেকে নিজের ফ্রি ফুচকা দাবি করতে গিয়ে বুঝতে পারে—দোকানদার ফ্রি বললেও, তার মানে এক প্লেটের পর আরেক প্লেট কিনলে ফ্রি দেয়! চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বলে, “এইটা তো ফুচকা প্রতারণা! পোস্টারে স্পষ্ট লেখা ‘এক্সট্রা ফ্রি’, কিন্তু নিচে ছোট করে লেখা ‘শর্ত প্রযোজ্য’! এই শর্ত মানে কি রে?” বুবুন উত্তরে বলেন, “এইটা শর্ত নয়, এইটা ষড়যন্ত্র। জনসাধারণের বিরুদ্ধে। আমি লিখে রাখছি।” রিঙ্কু দা হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “বন্ধুরা, এটা শুধু ফুচকার প্রতারণা নয়, এটা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের চেষ্টা!” ক্রমে লোকজন জড়ো হতে থাকে—কে যেন বলে উঠল, “হ্যাঁ রে! আমার কাছ থেকেও ২০ টাকা নিয়েছে, ফ্রি ফুচকা দেয়নি!” কেউ মোবাইলে ভিডিও তুলতে শুরু করল, আবার কেউ বলল, “আরে ওরা ফুচকা ইউনিয়নের লোক, ওরা আছে তো শান্তি নাই।” দোকানদার মাহিমা এখন প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছে—তার মুখ দিয়ে শুধু বেরোচ্ছে, “দাদা প্লিজ, আমি তো ছোট দোকান চালাই…” কিন্তু ততক্ষণে রিঙ্কু দা বক্তৃতায় উঠে গেছেন—“সততার সাথে ফুচকা বিক্রি করা যদি এক অপরাধ হয়, তবে আমরা সবাই অপরাধী!”

অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে শুরু করে যখন টিপু হঠাৎ দোকান থেকে জল দেওয়ার ঝাঁঝালো পাত্র নিয়ে চিৎকার করে ওঠে, “এই জল তো অ্যালার্জিক! মিঠু মাসি এটা খেলেই তো কাশছেন!” মাসি হাঁচি দিচ্ছেন, পাশে বসে আছে এক সাংবাদিক—সে জানতে চায়, “আপনার হাঁচি এই ফুচকার কারণে?” চুমকি হাসতে হাসতে বলে, “না না, এটা আবেগের হাঁচি।” বুবুন দোকানদারের বকে দেওয়া ফুচকার একটা ওজন মাপে—“এটা ২১ গ্রাম! অথচ পোস্টারে বলা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ২৫ গ্রাম!” এত কিছুর মধ্যে পুলিশ এসে যায়। এক বৃদ্ধ কনস্টেবল এগিয়ে এসে বলে, “কি হয়েছে আবার ফুচকা নিয়ে?” রিঙ্কু দা, কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলেন, “স্যার, আমাদের মুখে ফুচকার স্বাদ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে।” পুলিশ হেসে বলে, “ফুচকা নিয়ে কেউ আবার ইউনিয়ন করে নাকি?” চুমকি মোবাইল ঘুরিয়ে বলে, “স্যার, আমাদের ফেসবুক পেজে এখনই ৪০০ শেয়ার, আমরা ‘টক জাস্টিস’ চাই।” অনেক বোঝাবুঝির পর পুলিশ বলে, “ঠিক আছে, আজ আর ঝামেলা কোরো না, ফুচকা খেয়ে চুপচাপ চলে যাও।” রিঙ্কু দা দোকানদারকে বলে, “আপনি আজ আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি, কিন্তু আমরা আপনাকে ক্ষমা করলাম।” সবাই সরে পড়ে, কিন্তু যাওয়ার সময় মিঠু মাসি বলে, “এই দোকানের জল খেয়ে আমার চোখে জল এলেও, মনে হলো—আসল ফুচকা একসময় স্বপ্ন ছিল, এখন সেটা শর্তে বেঁধে গেছে।” ইউনিয়নের চতুর্থ অভিযান শেষ হয় তর্ক, জল আর ঝাল দিয়ে, কিন্তু তারা ঠিক করে, যতই ঝগড়া হোক—ফুচকা খাওয়া আর বন্ধ করা যাবে না।

শহরের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল, রোদ যত চড়ে, তত ফুচকার লাইনে ভিড় বাড়ে। আজ ছিল শনিবার, বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই দক্ষিণ কলকাতার ‘লেক মার্কেট’ চত্বরে লোকজনের ঢল নামে — কারণ, “টুনটুনি ফুচকা ভাণ্ডার” দিচ্ছে “১০টা কিনলে ৫টা ফ্রি” অফার! অবশ্য শর্ত আছে — “প্রথম ৫০ জনের জন্য।” এই খবর পাওয়া মাত্রই ইউনিয়নের মধ্যে যেন রণহুংকার বেজে ওঠে। টিপু খবরটি প্রথম দেখে বলে, “দিদি! এইটা যদি আজ মিস করি, তাহলে ইউনিয়নের মান থাকবে না।” রিঙ্কু দা বলেন, “আমরা যদি ফ্রি ফুচকা নিয়ে লড়তে না পারি, তবে আমাদের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে পড়বে।” সকলে দৌড়ে ছুটে যায় লেক মার্কেটের দিকে। চুমকি রাস্তাতেই সেলফি তোলে—“#ফুচকা_ফ্রি_ফাইট, আজ আমি শহরের ইতিহাসে থাকব।” মিঠু মাসি বলেন, “বৌমা, চল! আমি আজ ফুচকার রেকর্ড করব—১৫টা একসঙ্গে!” রোদে মাথা গরম, পেট খালি, মনের মধ্যে ফুচকার স্বপ্ন—এমন অবস্থায় পৌঁছেই দেখে বিশাল লাইন, প্রায় ৪৭ জন দাঁড়িয়ে ইতিমধ্যেই। রিঙ্কু দা সামনের দিকে একটুখানি গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, “কৌশলে ঢুকতে হবে, এইটা একেবারে সত্যযুদ্ধ!”

ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন ইউনিয়নের পাঁচজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে কেউ একজন লাইনে ঢুকবে আর বাকিরা ‘পর্যবেক্ষক’ সেজে পাশে দাঁড়াবে। টিপু প্রথম এগিয়ে যায়, সে তার হালকা চেহারা, মিষ্টি হাসি আর “দাদাভাই”-স্টাইলে দোকানদারকে বলে, “একটু আগে দিলে হয় না? আমি আজ সকাল থেকে খাইনি।” কিন্তু লাইনের মধ্য থেকে একজন মোটা গলা করে বলে, “এই ছেলে, আগে এলেই আগে পাবি। ধান্দা বন্ধ কর।” বুবুন তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বলে, “দেখুন, আমরা খাদ্য বিশ্লেষক। এই ফুচকা আমরা রেটিং দিই।” অন্য একজন বলে, “তাহলে তো তোমরা পয়সাও দেবে না। গিয়ে অন্য জায়গায় বিশ্লেষণ কর।” এই নিয়ে তর্ক শুরু হয়। চুমকি বলে, “আরে ভাই, আমি তো ফুড ব্লগার, ফেসবুকে লাইভ করছি!” সামনে দাঁড়ানো এক মহিলা বলেন, “তাহলে লাইভে বলো, লাইনে কাটাকাটি করে ফুচকা নিতে চাও!” উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মিঠু মাসি হঠাৎ গর্জে ওঠেন, “এইসব ফুচকা লাইন আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও দেখিনি!” দোকানদার পরিস্থিতি দেখে চুপচাপ থাকেন, কারণ তিনি জানেন, ঝগড়া বাড়লে বেচাকেনা বন্ধ। ঠিক সেই সময় একটা ভুল বোঝাবুঝি ঘটল—টিপু ভুল করে পাশের থালা থেকে একটা ফুচকা তুলে মুখে দিয়ে ফেলে। কেউ একজন দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “চোর! চুরি করে ফুচকা খাচ্ছে!” সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে কেউ ধাক্কা দেয়, ফুচকা পড়ে যায়, জল ছিটকে পড়ে কারো জামায়—আর শুরু হয়ে যায় কলকাতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মারামারি: “ফুচকা সংঘর্ষ ২০২৫।”

হঠাৎই দোকানের পাশেই এক পুলিশ জিপ থামল। এক কনস্টেবল নেমে এসে বলল, “কি হচ্ছে এখানে?” চারদিক থেকে চিৎকার—“ফুচকা নিয়ে চুরি!”, “লাইনে কাটাকাটি!”, “ছেলের মাথায় ফুচকার থালা!” রিঙ্কু দা ততক্ষণে নিজের কোট ঠিক করে পুলিশের দিকে এগিয়ে বললেন, “স্যার, আপনি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তবে আমাদের কথা শুনুন। আমরা ‘ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন’—শহরের স্বাদের ভারসাম্য রক্ষা করি।” কনস্টেবল চোখ বড়ো করে তাকিয়ে বললেন, “ফুচকার স্বাদ রক্ষা! এইটা কি নতুন রাজনৈতিক দল?” চুমকি তখন ক্যামেরা ঘুরিয়ে লাইভে বলে, “বন্ধুরা, আজ আমরা পুলিশের মুখোমুখি—ফুচকার জন্য।” বুবুন বলে, “স্যার, ওই লোকটা আমার ফুচকা চুরি করেছে!” কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেফতার না করে বলে, “সবাই চুপ! যে ফ্রি ফুচকা খেতে এসেছেন, তারা বেরিয়ে যান। এখন শুধু টাকা দিয়ে খাবেন।” ইউনিয়ন সদস্যরা একে একে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসে। টিপু বলে, “দিদি, আমি ফুচকা খেতে গিয়ে মাথায় মার খাইলাম!” চুমকি বলে, “তুই এখন শহরের নায়ক। তোকে নিয়ে আজ পোস্ট করব—‘ফুচকার জন্য রক্ত ঝরানো বীর।’” রিঙ্কু দা নীরব মুখে খাতার পাতায় লেখেন, “ফ্রি-তে যা মেলে, তা যুদ্ধ ছাড়া আসে না।” মিঠু মাসি আক্ষেপ করে বলেন, “একটা ফুচকা খেতেও মারামারি? কই, আমার সময়ে তো এমন ছিল না!” এবং এইভাবে পঞ্চম অভিযানে তারা বুঝে গেল—স্বাদ যতই মূল্যবান হোক, ফ্রির নেশা যদি মাথায় ওঠে, তবে শহরকেও এক ফুচকা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে সময় লাগে না।

টুনটুনি ফুচকা ভাণ্ডারের হুলস্থুল কাণ্ডের পর দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় চলে — “#ফুচকা_ফাইটারস”, “#টক_জল_থানা”, “#বিনামূল্যে_বিপর্যয়”। চুমকির ভিডিও ইতিমধ্যেই ১১,০০০ ভিউ পেরিয়ে গেছে, আর মিঠু মাসির হাঁচির স্লো-মোশন ফুটেজ নিয়ে কেউ একজন রিল বানিয়ে দিয়েছে — ক্যাপশন: “When the spice hits your soul!” কিন্তু এই মজার ভিডিওর আড়ালে ইউনিয়নের ভেতরে ভয় কাজ করছে — কারণ স্থানীয় থানার ইনস্পেক্টর নিজে চুমকির ইনবক্সে মেসেজ করেছেন, “কালকের ঘটনায় তদন্ত চলছে। সাক্ষাৎকার দিতে আসুন।” রিঙ্কু দা বলেন, “এটা স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর আঘাত। একজন নাগরিক কী খাবে, কোথায় খাবে, কতটা খাবে — এটা নিয়ে যদি পুলিশে যেতে হয়, তাহলে এ শহরে টক জলও আর স্বাধীন না।” বুবুন ফিসফিস করে বলে, “দাদা, মাকে বলিনি যে থানার নাম এসেছে… জানলে পড়া বন্ধ।” ইউনিয়নের সবাই জড়ো হয় শিয়ালদহের পুরনো চা-দোকানে, যেখানে সব শুরু হয়েছিল। টিপু ভয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমরা পালাব? না কি থানায় যাব?” মিঠু মাসি বলেন, “আমি তো অবসরে গিয়েছি, এখন নতুন করে জেলে গিয়ে অভিজ্ঞতা বাড়ালেই হল!” রিঙ্কু দা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলেন, “না, পালানোর নয়। আমরা যদি এক ফুচকার জন্য লড়াই শুরু করি, তবে শেষ ফুচকা পর্যন্ত দাঁড়াতে হবেই।”

তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পুলিশি ডাকে সাড়া দেবেই — তবে ইউনিয়নের পোশাকে, ঐক্যে। পরদিন দুপুরে পাঁচজন গিয়ে হাজির হয় থানায়। এক অফিসার একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, “আপনারা কি সত্যিই ফুচকা খাওয়ার জন্য ইউনিয়ন করেছেন?” রিঙ্কু দা শান্ত গলায় বলেন, “আমরা শহরের স্বাদের চেতনায় বিশ্বাস করি। আমাদের লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতা ও স্বাদ বিচার।” অফিসার হাসতে হাসতে বলেন, “কিন্তু আপনারা তো বিশৃঙ্খলা করেছেন — কারও মাথায় ফুচকার থালা পড়েছে, কেউ গায়ে জল ফেলেছে, কেউ লাইনে কেটে ঢুকেছে।” চুমকি বলে, “স্যার, সেটাও একটা স্বাদ-বিকাশের অংশ। কখনো কখনো স্বাদ না পেলে ধৈর্য ভেঙে যায়।” তখনই ইনস্পেক্টর এসে বলেন, “ঠিক আছে, কোনো মামলা নয়। তবে একটাই শর্ত—আপনারা যেন আর কোথাও ভিড় বা বিশৃঙ্খলা না করেন।” রিঙ্কু দা মাথা ঝুঁকিয়ে বলেন, “স্বাদ নিয়ে বিশৃঙ্খলা নয় স্যার, তবে কৌতুক থাকবে। কারণ আমরা ফুচকার সৈনিক!” থানার সবাই হেসে ওঠে। যেতেই যাবেন, এমন সময় ইনস্পেক্টর বলেন, “আর হ্যাঁ, আমার স্ত্রী আপনাদের ফেসবুক পেজ দেখেন। তিনি বললেন, শ্যামবাজার মোড়ে যে ‘রাজু ফুচকাওয়ালা’ আছে, তার কথা আপনারা কিছু বলেননি!” এই মন্তব্যেই ইউনিয়ন সদস্যদের চোখ জ্বলে ওঠে — যেন এক নতুন লড়াইয়ের দরজা খুলে গেছে।

থানা থেকে বেরিয়ে পাঁচজন দাঁড়ায় শ্যামবাজার মোড়ে। সামনে রাজু ফুচকাওয়ালার দোকান — ঝকঝকে ঠেলা, পাশে বসার জায়গা, আর তার মুখে গর্বিত হাসি। “দাদা, অনেক শুনেছি আপনাদের কথা। আজ দেখছি!” বলে তিনি থালায় সাজিয়ে আনেন ফুচকা — ঝাল, টক, সুগন্ধি মশলায় মোড়া। টিপু প্রথম খেয়ে বলে, “এইটা তো একেবারে আশ্চর্য! যেন কাঁচা আম আর নিমের প্রেম!” চুমকি ভিডিও চালিয়ে বলে, “বন্ধুরা, আজকের ফুচকা শহরের বিচারসভার ফাইনাল কাণ্ড।” মিঠু মাসি বলে, “এই জল খেয়ে আমার কলেজের প্রেমের কথা মনে পড়ছে — তেতুল আর ঠোঁটের টক!” বুবুন ওজন মাপে, খুশি হয়ে বলে, “সঠিক ২৫ গ্রাম!” আর রিঙ্কু দা লিখে ফেলেন, “এই হলো আমাদের স্বাদ-বিচারের শেষ পর্ব — রাজু ফুচকাওয়ালার জল যেন শহরের পুরনো গান, আর ফুচকা যেন শেষ বিকেলের আলো।” ইউনিয়ন বুঝে যায়, তারা শুধু ফুচকা খায়নি — তারা মানুষ, রাস্তাঘাট, কথোপকথন, সমাজের টানাপোড়েন, আর একটা তেতুলজল ভরা আবেগ খুঁজেছে। পুলিশ ডাকে তাদের থামাতে পারেনি — কারণ তারা হাসি দিয়ে শহরের গভীর স্বাদ চিনে ফেলেছে। শেষ ফুচকাটা মুখে দিয়ে রিঙ্কু দা বলেন, “এই শহর যদি ফুচকা হয়, তবে আমরা তার জল!”

রাজু ফুচকার পর ইউনিয়ন একটা কৃতজ্ঞ নিঃশ্বাস ফেলে — যেন বহুদিনের খোঁজের শেষে এক আশ্রয় মিলেছে। কিন্তু সেই প্রশান্তিও বেশিক্ষণ থাকে না, কারণ ঠিক তার দুদিন পরেই চুমকির ইনবক্সে আসে একটি মেইল—“আপনাদের নিয়ে স্টার নিউজ বাংলার এক্সক্লুসিভ ফিচার করতে চাই। নাম: ফুচকার যোদ্ধারা।” সঙ্গে একটি ছোট টিম, ক্যামেরা, প্রোডিউসার আর স্ক্রিপ্ট রেডি। চুমকি উত্তেজনায় কাঁপে, রিঙ্কু দা গম্ভীরভাবে বলেন, “আমরা মিডিয়ায় যাচ্ছি, মানে আমাদের আন্দোলন জাতীয় রূপ নিচ্ছে।” টিপু প্রথমে ভয় পায়—“দিদি, যদি মা দেখে ফেলে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছি?” মিঠু মাসি বলেন, “চিন্তা করিস না, আমি তোকে কভার করব। কিন্তু আমার চুল ঠিক আছে তো?” চিত্রগ্রহণ শুরু হয় বউবাজারের “গৌতম ফুচকা ঘর” থেকে, যেখানে শ্যুটিংয়ের জন্য দোকানদার রাজি হলেও কৌশলে বলেন, “এক শটে পাঁচটা ফুচকা খেলে তবে শুটিং করতে দেব।” ফলে রিঙ্কু দা বাধ্য হয়ে মুখ গুঁজে পাঁচটা ফুচকা একসাথে খেয়ে বলেন, “স্বাদ গিললাম, কষ্ট নয়!” ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, প্রশ্ন আর অদ্ভুত পোজ দিতে দিতে ইউনিয়নের সবাই হাঁপিয়ে ওঠে, আর তখনই হঠাৎ এক কুকুরের চিৎকার, ভিড়ের মধ্যে গণ্ডগোল, আর তারপরে এসে দাঁড়াল — “গোলাম ভাই”— এলাকার স্বঘোষিত ফুচকা সিন্ডিকেট মাস্তান।

গোলাম ভাই চোখ টক জল রঙের চশমা পরে বলেন, “এইখানে কি হচ্ছে? মিডিয়া? ক্যামেরা? ফুচকা? এই এলাকার ফুচকা নিয়ে যদি কিছু হয়, তবে আমাকেও জিজ্ঞাসা করতে হয়।” রিঙ্কু দা সম্মান দেখিয়ে বলেন, “আপনি কে?” উত্তর আসে, “ফুচকার ব্যবসার পুরুষত্তম। আমি যদি বলি টক জল কম, তবে কেউ বাড়াতে পারে না। আর বললে ঝাল বেশি—সবাই কাঁদে!” চুমকি একটু চুপ থেকে ক্যামেরার সামনে বলে, “বন্ধুরা, এবার আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এক কিংবদন্তির—ফুচকার দাদাগিরি সংস্কৃতির প্রতিনিধি।” কিন্তু গোলাম ভাই রেগে যান—“এইসব তেনার কথা বন্ধ করুন। আমার এলাকায় ফুচকার শুটিং হবে, আমি খবর না রাখব? আর এই দোকান… এই গৌতম ফুচকাওয়ালা, গত তিনদিন ধরে মশলা কম দিয়ে লোক ঠকাচ্ছে!” রিঙ্কু দা চমকে ওঠেন, “মানে? আপনি জানেন, মশলা কম দিচ্ছে?” গোলাম ভাই বলেন, “হুঁ! আমি চুপচাপ নজর রাখি। কিন্তু আজ মিডিয়া এসেছে, তাই মুখ খুললাম।” তখনই গৌতম ফুচকাওয়ালা কিছুটা ভয় পেয়ে বলেন, “ভাই, মশলা একটু কম ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা তো বাজারে ঘাটতির জন্য!” গোলাম ভাই দমকে ওঠেন, “বাজারে ঘাটতি মানে শহরের মুখে অপমান!” সেই সময় চুমকি ফুঁসে ওঠে—“তাহলে এই ফিচার হবে না, যতক্ষণ না আমরা এক থালা ‘অফিসিয়ালি ঠিকঠাক’ মশলা ফুচকা পাই।”

দোকানদার রাজি হন, গোলাম ভাই নিজে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধান করেন। ইউনিয়ন সদস্যরা খায়, বিশ্লেষণ করে, ছবি তোলে, আর ক্যামেরা ফুটেজে চলে আসে সেই ফুচকার ‘বিপ্লব-স্বাদ’। কিন্তু শুটিং শেষে আবার শুরু হয় এক দ্বন্দ্ব — মিডিয়া টিম চায় ইউনিয়নের সবাই মাইক্রোফোনে বলুক, কারা আসল ফুচকা লড়াইয়ের নেতা। টিপু চুপচাপ থাকে, বুবুন বলে, “আমি তো ফিচারে পরিসংখ্যান দিয়েছি!” চুমকি বলে, “আমি ভিডিও এডিট করলাম, হ্যাশট্যাগ বানালাম, এটা তো আমার শো!” রিঙ্কু দা শান্ত গলায় বলেন, “আমরা পাঁচজন—সবাই এই সংগঠনের সমান যোদ্ধা। আমাদের কোনো নেতা নেই, শুধু স্বাদ আছে।” ক্যামেরাম্যান হাসে—“ভালই নাটক হচ্ছে, এইটাই প্রোমোতে রাখব!” সন্ধ্যার আলো পড়ে, মিডিয়া চলে যায়, গোলাম ভাই দোকান বন্ধ করেন, আর বিদায় জানিয়ে বলেন, “তোমরা আজ অনেক কিছু করলে। কিন্তু মনে রেখো, ফুচকা শুধু স্বাদ নয়, সে-ও গর্ব। তাকে অপমান করলে, আমি প্রথমে ঠেলা উল্টে দেব।” সবাই হেসে ওঠে। ইউনিয়নের সদস্যরা হাঁটতে হাঁটতে বলে, “আজকের দিন ইতিহাস হয়ে থাকবে—মিডিয়া, মাস্তান আর মশলার সংঘর্ষ।” চুমকি বলে, “আর স্লোগানটা এমন হওয়া উচিত—‘ফুচকায় মর্যাদা, স্বাদে স্বাধীনতা!’” সেই রাতে তারা সবাই আলাদা হয়ে গেলেও ফোনে বার্তা যায় — “আগামীকাল, শেষ পর্ব। শহরের শেষ ঠেলা—নর্থ কলকাতার কিংবদন্তি, ‘ভোলা ফুচকা স্টেশন’। সেখানে শেষ লড়াই।” আর ইউনিয়নের পাঁচ যোদ্ধা বুঝে যায়—এই যাত্রা এক ফুচকার গল্প নয়, বরং এক শহরের আত্মার সন্ধান।

ভোলার নাম শোনেনি, এমন ফুচকা-পাগল কলকাতায় বিরল। কিন্তু ভোলা নিজেই আজকাল লোকচক্ষুর আড়ালে। তার ঠেলা নাকি একবার মেলা প্রাঙ্গণে, একবার কলেজ স্ট্রিটে, আবার কখনও শ্যামবাজারের গলির মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে ঘোরে। এই মানুষটির খোঁজ পেতে ইউনিয়নের সদস্যরা সকালে পাঁচটা থেকেই বেরিয়ে পড়ে। চুমকি বলেছিল, “আজ যদি ভোলাকে না পাই, তবে এই অভিযান অপূর্ণ রয়ে যাবে।” বুবুন গুগল ম্যাপে খোঁজে—কিন্তু ফলাফল ‘ভোলা’ টাইপ করলেই আসে “ভোলা শাড়ি স্টোর” বা “ভোলা জুয়েলার্স।” টিপু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার গন্ধ শোঁকে—“এইদিক থেকে মনে হচ্ছে যেন কোথাও টক জল ফুটছে।” মিঠু মাসি বললেন, “আমার নাক ফাঁকি দেয় না, আমি জানি, এই গলির ভেতরেই আছে।” তারা অবশেষে খুঁজে পায় এক ধূলিমলিন রাস্তার কোণে — লাল-হলুদ কাপড়ের ছাতা তলে দাঁড়িয়ে এক চুপচাপ বৃদ্ধ, মাথায় টুপি, চোখে কালো চশমা। ভোলা। তার পাশেই সেই ঠেলা—পীতাভ আলোয় স্নিগ্ধ, খালি গ্যাসের সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে একটি তোয়ালে ঝুলিয়ে, টিনের পাত্রে জল গরম করছেন। “ফুচকা খাবেন?” প্রশ্নটা আসে এক শীতল কিন্তু আত্মবিশ্বাসী স্বরে। ইউনিয়নের পাঁচজন একসাথে মাথা নাড়ে—“আমরা এসেছি আপনার কাছে, কারণ আমরা স্বাদের সন্ধান করি। আমরা ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন।”

ভোলা হেসে ওঠেন—“স্বাদের সন্ধান? আজকাল লোকজন খায় ছবি তোলার জন্য। খেয়ে বলে—‘ইউম!’ তারপর বলে—‘ভাইরাল হবে?’ তোমরা যদি সত্যিই স্বাদ বুঝতে চাও, তবে চোখ বন্ধ করে খাও। আমি দিচ্ছি এমন ফুচকা, যাতে আছে রবি ঠাকুর, আছে রাস্তার ধুলো, আছে শেষ বিকেলের হাওয়া।” প্রথম থালা আসে চুপচাপ — কোনো বাড়াবাড়ি নেই, কোনো হুল্লোড় নেই, শুধু পুরির উপর টক জল ঝরছে ধীরে ধীরে। টিপু খেয়ে চমকে ওঠে, “এটা কি? ঝালের মধ্যে কাঁচা লংকার সুগন্ধ, অথচ জল যেন কাঁচা আমের মতো টক!” রিঙ্কু দা চুপ করে খেয়ে বলেন, “এইটা একটা কবিতা।” চুমকি ভিডিও বন্ধ করে মোবাইলটা নামিয়ে ফেলে—“আজ আর ক্যামেরা তুলব না। এই স্বাদ ধরে রাখা যায় না।” মিঠু মাসির চোখ ছলছল করে ওঠে—“মনে হচ্ছে, আমি কলেজ থেকে ফিরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে আছি, আর মা বলছে—‘ফুচকা আনছি, একটু জল কম করে দিস।’” বুবুন ওজন করে দেখে না, শুধু ফিসফিস করে বলে, “আমি আমার রেটিং খাতাটা ফেলে আসি।” সেই সময় হঠাৎ ভোলা জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা এত দিন ধরে এত ঠেলা ঘুরলে, কি পেলে?” রিঙ্কু দা জবাব দেন, “স্বাদ পেয়েছি, ঝগড়া পেয়েছি, ঠেলাগাড়ির গল্প পেয়েছি। কিন্তু আজ যা পেলাম, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না।” তখন ভোলা বলেন, “স্বাদ যদি মনে গাঁথা যায়, তবেই সেটা ফুচকা। বাকিটা তো শুধু জল আর সেমোলিনা।”

ঠিক সেই মুহূর্তে আশেপাশে ভিড় হতে শুরু করে—কারণ কোথা থেকে যেন খবর ছড়িয়ে গেছে, ইউনিয়নের সদস্যরা ভোলার ঠেলায় এসেছে। ক্যামেরা আবার হাজির, কেউ লাইভ করছে, কেউ বলছে—“ভাই, এই ভোলা কিন্তু ইনস্টাগ্রামে নেই, অথচ ভাইরাল!” একজন মজা করে বলে, “এই ভোলা ফুচকাওয়ালার জল খেলে প্রেম টিকবে না, কিন্তু মনে থাকবে!” এই কথা শুনে হেসে ওঠে ইউনিয়নের সবাই। তখনই এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলেন, “বাবুরা, অনেক ঠেলায় খেয়েছি, কিন্তু এই ভোলার জলটা যেন এক জীবনের গল্প। এই স্বাদ আমি ভুলব না।” ভোলা ধীরে বলে, “তোমরা যদি চাও, তবে এই জল নিয়ে যাও। কিন্তু মনে রেখো, বোতলে পুরে রাখলে স্বাদ থাকবে না—যে হৃদয়ে রাখবে, সেখানেই থাকবে।” ইউনিয়নের শেষ পর্ব শেষ হয় এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে—না সেখানে ঝগড়া, না পুলিশ, না মাস্তান, না মিডিয়া—শুধু ফুচকা আর তার হারিয়ে যাওয়া গান। রিঙ্কু দা খাতায় লেখেন, “শেষ স্বাদে শুরু হয় আরেক শহরের গল্প।” টিপু বলে, “এই ঠেলা আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।” চুমকি চুপচাপ মোবাইলটা পকেটে রেখে বলে, “আজ কোনো পোস্ট হবে না—আজ শুধু মনে রাখব।”

ভোলার ঠেলার অভিজ্ঞতার পরে ইউনিয়নের সদস্যরা আর আগের মতো থাকেন না। তারা বুঝে যায়, ফুচকার খোঁজে তারা যতটা ঠেলা ঘুরেছে, তার চেয়েও বেশি ঘুরেছে নিজেদের ভিতরের জগৎ। টিপু, যে আগে শুধু ফ্রি খাওয়ার কথা ভাবত, সে এখন নিজের ডায়েরিতে স্বাদের ভাষা লিখে রাখে — “আজকের জলটা ছিল অবিন্যস্ত শোকের মতো, কিন্তু শেষে একটু চিনি মেশানো সাহস।” চুমকি ক্যামেরা বন্ধ করে কেবল চোখে দেখছে, আর মনে রাখছে — সে বুঝে গেছে, সব মুহূর্ত ক্যাপচার হয় না। রিঙ্কু দা সন্ধ্যায় বইয়ের পাতা গুলিয়ে বসে বলেন, “আমাদের এই অভিযান কোনও আন্দোলন নয়, এটা ছিল আত্মসন্ধান। একটা শহরের পেট দিয়ে চিনেছি তার হৃৎপিণ্ড।” মিঠু মাসি আবার বারান্দায় বসে ফুচকার কথা ভেবে বলেন, “ভোলা বলেছিল, বোতলে পুরলে স্বাদ থাকে না — কথাটা কি শুধুই ফুচকার জন্য?” বুবুন অবশ্য এখনও মনে মনে গুনে চলেছে, কোথায় কোন দোকানে কী কী মাপ কম বা বেশি ছিল — কিন্তু সে-ও জানে, আর কোনো ওজন এখন আর জরুরি নয়। এক বিকেলে শিয়ালদহর সেই পুরোনো চা-দোকানে আবার মিলিত হয় ইউনিয়ন — এবার ফুচকা খেতে নয়, নিজেদের অভিজ্ঞতার শেষ পাতাটা লিখতে।

রিঙ্কু দা বলেন, “আজ আমাদের ফুচকা-ভ্রমণ শেষ হলেও, আসলে আমরা যা খুঁজেছি তা শেষ হয়নি। আমরা খুঁজেছি — কোথায় জল একটু বেশি তেতুলে, কোথায় পুরি একটু বেশি কড়মড়ে, আর কোথায় দোকানদার একটু বেশি সত্যবাদী।” চুমকি হেসে বলে, “আর কোথায় ভিড়েও ভালোবাসা থাকে। ক্যামেরার পেছনে। ভিড়ের মধ্যে একেকটা মুখ ছিল — কেউ ভাই, কেউ মা, কেউ প্রেমিক — সবই একটা ফুচকার গল্প।” টিপু বলে, “দিদি, আমি তো কখনও ভাবিনি, ফুচকার খোঁজ করতে গিয়ে আমি আসলে আমার নিজের খিদেটাকে নতুন করে চিনব। আগে খিদে মানেই খাবার ছিল, এখন সেটা একটা গন্ধ, একটা মুহূর্ত, একটা হাসির মানে।” মিঠু মাসি কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, “ফুচকা তো আসলে একটা অজুহাত ছিল — পাঁচটা মানুষ মিলে, নিজেদের অতীত আর ভবিষ্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে একটু হাসার জন্য।” বুবুন একটু চুপ করে থেকে বলে, “তোমরা যদি না থাকতে, আমি হয়তো একা ঘুরে ঘুরে শুধু ওজনই করতাম, কিন্তু আজ আমি বুঝেছি, বন্ধুত্বের কোনও গ্রাম নেই।” তখন চুমকি বলে, “তাহলে আমরা কী করব এখন? ফুচকা খাওয়া ছেড়ে দেব?”

রিঙ্কু দা সোজা হয়ে বসে বলেন, “ছেড়ে দেব না। তবে আর ফাইট নয়। এবার থেকে আমরা হব—‘ফুচকা ফিলোসফার্স’।” সবাই হেসে ওঠে। টিপু বলে, “মানে এখন আর ঝগড়া নয়, শুধু শান্ত ফুচকা?” চুমকি বলে, “না রে, এখন থেকে আমরা ফুচকা খেতে খেতে জীবন নিয়ে ভাবব।” মিঠু মাসি টেবিলে হাত রেখে বলেন, “চলো, একটা থালা আনাই। আজকের এই এক থালা যেন আমাদের শেষ জল — একসাথে।” পাশের দোকান থেকে ফুচকা আসে — তেমন ঝাল না, তেমন টকও না — কিন্তু সেই মুহূর্তে সবার কাছে সেটাই সেরা। কারণ সেটা একসাথে খাওয়া হচ্ছে। কেউ ছবি তোলে না, কেউ লাইভ করে না — শুধু খায়। একটার পর একটা। যেন প্রত্যেকটা পুরির ভেতরে বন্দি হয়ে আছে তাদের গল্প, ঝগড়া, হাসি আর চোখের জল। তারা বুঝে যায় — ‘ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন’ আসলে ছিল এক অদ্ভুত সময়ের সন্তান, যেখানে পাঁচজন পথচলা শুরু করেছিল একটাই প্রশ্নে — “শহরের সেরা ফুচকা কোথায়?” আর ফিরে পেয়েছিল — শহরের সেরা বন্ধুত্ব।

১০

সময় চলে যায়। ভোলার ঠেলা বন্ধ হয় একদিন, হঠাৎই — এক সকালে শিয়ালদহের সেই গলিতে লোকজন দেখে, ছাতাটা ভাঁজ করে রাখা, জলপাত্র খালি, আর টিনের পুরিগুলো শুকিয়ে রোদে ঠোঁট ফাটছে। কেউ বলে, “ভোলা নাকি চলে গেছে বেনারসে—জল ছেড়ে এখন বাতাস খুঁজছে।” ইউনিয়নের সদস্যরা এই খবরে চুপচাপ। কেউ কিছু বলেনা। চুমকি মোবাইলে একটা ফাঁকা ছবি তোলে—ক্যাপশন দেয় না, হ্যাশট্যাগ দেয় না। টিপু কয়েকদিন চুপ করে থাকে, তারপর একদিন হঠাৎ চিঠি লেখে—ভোলার জন্য। চিঠির ভাষা জড়ানো—“আপনার জল খেয়েই আমি প্রথম বুঝেছিলাম, কীভাবে ঝাল হতে হয়, তবুও মিষ্টি থাকা যায়।” রিঙ্কু দা খাতা বন্ধ করে রাখেন, আর লেখেন না। বুবুন নিজের ওজন যন্ত্রটা রেখে দেয় পুরনো ড্রয়ারে—ওর এখন আর দরকার হয় না। মিঠু মাসি এক বিকেলে নিজের ছেলের সঙ্গে নতুন এক ঠেলায় যায়—কিন্তু মুখে ফুচকা দিয়েই বলে, “না রে, ঠিক সেই রকম নয়। কোনও এক মায়া কম।” ফুচকার স্বাদ আর তাদের জীবন যেন কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা ছিল, আর সেই সুতোটা হঠাৎ এক টক জলের ছায়ায় কেটে গেছে।

এরপর একদিন, ঠিক এক বছর পরে, রিঙ্কু দা সকলকে আবার ডাকেন সেই পুরোনো শিয়ালদহ চা-দোকানে। ছোট্ট নিমন্ত্রণ — “ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়নের পুনর্মিলন সভা।” সকলে আসে — চুমকি ক্যামেরা ছাড়াই, বুবুন ওজন ছাড়া, টিপু ঠাকুরঘরের প্রসাদ খেয়ে এসে, আর মাসি নতুন এক রঙের শাড়ি পরে। রিঙ্কু দা বলেন, “বন্ধুরা, আমরা ফুচকার খোঁজে বেরিয়ে ছিলাম, কিন্তু ফিরে এলাম এক নতুন ভাষা নিয়ে। আজ আমি একটা প্রস্তাব রাখি—আমরা ‘ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন’-কে এখন এক স্মৃতি গোষ্ঠী বানাই।” সবাই চুপ করে শোনে। “আমরা কোথাও কিছু লিখব না, কিন্তু প্রতি বছরে একদিন—যেদিন আমরা ভোলাকে খুঁজে পেয়েছিলাম—সেই দিন একসাথে দেখা করব, এক থালা ফুচকা খাব। সেটাই হবে আমাদের ‘টক জল দিবস’। আমরা ঝগড়া করব না, রেটিং দেব না—শুধু গল্প বলব। আর বলব—আমরা একবার ছিলাম।” মিঠু মাসি হেসে বলেন, “এই দিনটার নাম হবে—‘ফুচকার স্মৃতিবিন্দু।’” চুমকি বলে, “আমি আজও লিখি না, কিন্তু মনে রাখি—কে কোথায় কেমন খেয়েছিল।” টিপু বলে, “আমি মা’কে বলেছি, এবার থেকে ফুচকা খেলেই মাথায় হাত দিতে হবে—স্মৃতি পাঁপড়ির মতো উঠে আসে।”

শেষ বিকেলের রোদে সবাই মিলে এক থালা ফুচকা আনায়—দোকানদার চেনা নয়, জলটাও আলাদা, কিন্তু কেউ কিছু বলেনা। একে একে পুরি মুখে দেয়, কেউ জিভ বের করে, কেউ চোখ বন্ধ করে—কেউ বলে না কেমন, কেউ বোঝায় না ভালো লাগল কি না। কারণ তারা জানে, এখন স্বাদের বিচার নয়, এখন সময় হল সেই মানুষদের স্মরণ করার, যাদের সঙ্গে একদা তারা ভাগ করে নিয়েছিল ঝাল জল, হাসি, ঠেলায় ঠেলায় সন্ধ্যার গান। চুমকি মোবাইল খুলে একটা নোট লেখে—“আজকের দিনটা ছিল ঠিক সেই রকম, যেমন একটা শেষ ফুচকা—যা খাওয়ার পর জিভে লেগে থাকে, মনে পড়ে, কিন্তু আর খাওয়া যায় না।” রিঙ্কু দা ধীরে বলেন, “আমরা ইউনিয়ন ভেঙে দিচ্ছি না, আমরা তাকে স্তব্ধ করছি। কারণ সব শব্দের শেষে যেমন থাকে এক নিঃশব্দতা, তেমনই সব স্বাদের পরে থাকে শুধু—টক জল ও টক স্মৃতি।” আর সেইভাবে, ইউনিয়নের শেষ জল মুখে দিয়ে তারা উঠে পড়ে—পথে নামে, কিন্তু ফুচকা আর খুঁজে না — কারণ তারা ফুচকাকে একদিন খুঁজে পেয়েছিল, আর তাতেই তাদের জীবন সম্পূর্ণ হয়েছিল।

***

শহর বদলায়, ঠেলাগাড়ি সরে যায়, ফুটপাথের পায়ের ছাপ ভেসে যায় বৃষ্টির জলে—তবুও কিছু গন্ধ, কিছু স্বাদ থেকে যায় বাতাসে। শিয়ালদহের চা-দোকানটার পাশে বসা নতুন কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এখন আর জানে না, ঠিক এই জায়গা থেকেই একদা তৈরি হয়েছিল এক হাস্যকর, বোকা, অথচ গর্বিত দল—“ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন।” দোকানদার মাঝেমাঝে বলেন, “এই চেয়ারে একসময় বসত পাঁচজন পাগল, ফুচকার পেছনে পৃথিবী ঘুরিয়েছিল তারা!” কিন্তু নতুন প্রজন্ম হাসে—“সিরিয়াসলি? ফুচকা ইউনিয়ন? এগুলো হয় নাকি?” তাদের হাসি গায়ে মাখে না দোকানদার, কেবল বলেন, “তাদের চোখে যে আলো ছিল, সেটা আর এখনকার ফোনের ফ্ল্যাশে ধরা যায় না।” ওই বাতাসে এখনও টক জল ঝাঁঝালো গন্ধে ছড়িয়ে আছে কিছু স্মৃতি—কেউ বোঝে না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ থেমে যায়। ভোলা? সে নাকি এখনো বেনারসে নেই। কেউ বলেছে, গড়িয়ার এক গলিতে ছোট্ট ঠেলা দেয়। কিন্তু কেউ জানে না ঠিকানা—কেবল গল্প ঘোরে, টক জল-ভরা নিঃশব্দ গল্প।

ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়নের পাঁচ সদস্য আজও আছেন, কিন্তু তাঁরা আর ফুচকা খুঁজে বেড়ান না। রিঙ্কু দা এখন টিউশন পড়ান, খাতার পাশে একটা কাঁচা তেতুল রেখে দেন—বলে, “এই জিনিসটা দিয়ে একসময় ইতিহাস লেখা হয়েছিল।” চুমকি এখন বিয়ের ভিডিও এডিট করে—মাঝে মাঝে গানের জায়গায় ফুচকার স্লো মোশন ক্লিপ বসিয়ে নিজের মনটা ভালো রাখে। টিপু এখন দোকানে বসে, স্কুলফেরতা বাচ্চাদের বলে, “ফুচকা খাস? আমি একসময় জল টেস্ট করতাম।” বুবুন পড়াশোনায় মন দিয়েছে, কিন্তু প্রতিটা রেফারেন্স পয়েন্টে একটা করে ফুচকার দোকান টুকে রাখে—যেন সেই মানচিত্রে একটা ইউনিয়নের চিহ্ন মিশে থাকে। আর মিঠু মাসি? তিনি মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আজ আর কেউ বলে না, এই জলটা একটু বেশি ঝাল… সবাই শুধু চুপচাপ খেয়ে নেয়। রুচি নেই, না কি সাহস কমেছে?” তারা আর একসাথে দেখা করে না ঠিক, কিন্তু প্রতি বছর ঠিক একই দিনে, একই সময়ে, তারা শহরের পাঁচ কোণে দাঁড়িয়ে এক থালা ফুচকা খায়—না জানিয়ে, না বলেই—শুধু মনে মনে বলে, “আজ টক জল দিবস।”

হয়তো একদিন কেউ আবার তৈরি করবে নতুন একটি ইউনিয়ন—“চাট চ্যাম্পিয়ন্স” অথবা “ঘুগনি গার্ডিয়ান্স”—আর তারাও ফুচকার মতোই এক হাস্যকর স্বপ্ন খুঁজবে, ভিড়ের মধ্যেও আলাদা হতে চাইবে। তখন তারা হয়তো এই পুরোনো ইউনিয়নের কথা শুনবে, বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যদি কেউ এক সন্ধ্যায় শিয়ালদহের বাতাসে তেতুল-জলের গন্ধ পায়, বা কোনও পুরি মুখে দিয়েই আচমকা চুপ করে যায়—তবে বুঝে নেবে, কোথাও এখনও কেউ আছে, যে টক জল দিয়ে মনে রাখে তার বন্ধুদের, তার শহরকে, আর সেই হাস্যকর ইউনিয়নকে… যেটা আসলে ছিল — শহরের এক নোনতা-টক, নরম অথচ অমলিন প্রেমের দল। শেষে একটুখানি টক থাকে বলেই, ফুচকা ফাইটারস ইউনিয়ন আজও আমাদের ভিতরে বেঁচে আছে।

___

1000031951.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *