Bangla - রহস্য গল্প

নিখোঁজ ৮ মিনিট

Spread the love

ঋজুরাজ ভট্টাচার্য


পর্ব

শোভাবাজার সুতানুটি স্টেশনের সকালটা অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত ছিল। মেট্রোর ফ্লোরে পলিশ করা ধুলো, গুমগুম শব্দে নেমে আসা রেলগাড়ি, আর সবার কানে হেডফোন গুঁজে থাকা যাত্রীদের থমথমে মুখ—এই চেনা ছকে হঠাৎ যেন একটা ফাটল ধরে গেল।

৯টা ৪৭ মিনিট।
সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায়—নীলা সেন, ২১ বছরের ইতিহাস অনার্সের ছাত্রী, নীল ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। হালকা বেগুনিরঙা কুর্তি, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। সে ফ্ল্যাটফর্মের ডান প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়, মোবাইল বের করে কিছু একটা টাইপ করে। এরপর মাথা তুলে সামনে তাকায়। ৯টা ৪৮-এ তার পাশে এক বয়স্ক লোক এসে দাঁড়ায়। এরপর—স্টিল।

৯টা ৫৫।
পরবর্তী ফুটেজে দেখা যায়—পুরো প্ল্যাটফর্ম খালি। নীলার কোনো চিহ্ন নেই।
না সে ট্রেনে উঠেছে, না স্টেশন ছেড়েছে, না সিঁড়ি দিয়ে গেছে।

স্টেশন কর্তৃপক্ষ এবং মেট্রো রেল পুলিশের মাথায় হাত। ছ’টা ক্যামেরা ছিল একসঙ্গে অ্যাকটিভ। অথচ সেই সময়কালে সকলের ফিড এক সেকেন্ডের জন্য looped হয়ে গেছে। সেই ৮ মিনিটের রেকর্ডিং নেই। কেউ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে সবটা মুছে দিয়েছে।

নীলার পরিবার প্রথমে ধরে নেয়, সে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেও যখন কোনো ফোন, মেসেজ বা খোঁজ মেলে না, তখন বড়দা অর্ক সেন এসে থানায় ডায়রি করে।

অর্ক একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডেটা সিকিউরিটির উপর কাজ করে। AI surveillance নিয়ে সে নিজেও একসময় কাজ করেছে। কিন্তু বোনের এই নিখোঁজ হাওয়ার ঘটনায় সে বুঝতে পারে—এটা কেবল এক্সিডেন্ট নয়।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে অর্ক সরাসরি যায় নীলার কলেজে। সহপাঠীরা জানায়, নীলা আজ ক্লাসে যায়নি। তবে সে আগেরদিন বলেছিল—সে কিছু ‘জরুরি তথ্য’ পেয়ে গেছে, যেটা নিয়ে “বিশেষ কারো সঙ্গে দেখা করতে হবে”।

অর্কের মনে ভয় জাগে—নীলা কি কোনো রাজনৈতিক বিষয় বা সামাজিক অন্যায়ের সাক্ষী হয়ে গিয়েছিল?

সে এবার যায় নীলার ঘরে। খাটের তলায় পাওয়া যায় একটা ইউএসবি পেনড্রাইভ, ভেতরে এনক্রিপটেড ফাইল।
নাম: “013-SCREENED.mp4”

অর্ক সেই ভিডিও ডিকোড করে। ভিডিওতে দেখা যায়, মেট্রো স্টেশনের ক্যামেরা ফিড। অথচ একটা অদ্ভুত ব্যাপার—কিছু লোকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ব্ল্যাঙ্ক। যেন কারও মুখের উপর ডিজিটাল ছায়া বসে আছে।

এইরকম ৫ জন লোককে দেখা যায় স্টেশনে, যারা হাঁটছে, বসছে, কিন্তু কোনো facial identity detect হচ্ছে না। তাদের মধ্যে একজন—সাদা জামার ভেতরে অদ্ভুত রকম গা ছমছমে হাসি—ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ৯:৪৭ বাজতেই উঠে পড়ে। ঠিক যেই মুহূর্তে নীলা স্টেশনে ঢোকে।

অর্ক বুঝে যায়—নীলা কিছু এমন দেখতে পেয়েছিল যা কেউ দেখতে চায়নি। কেউ এমন, যাদের পরিচয় নথিভুক্ত হয় না। হয়তো সরকারি সিস্টেমেই তারা নেই।

পরদিন অর্ক তার ল্যাপটপে পায় এক মেল, প্রেরক নেই। শুধুমাত্র লেখা—

“She saw what she shouldn’t have. Undo. Or you disappear next.”

অর্ক এবার জানে, এই নিখোঁজ ৮ মিনিট তাকে একটা অদৃশ্য ও ভয়ঙ্কর জগতে নিয়ে যাচ্ছে।
আর সে এখন শুধু একজন ভাই নয়, হয়ে উঠছে একজন অনুসন্ধানকারী।

নিচু গলায় নিজেকে বলে সে—
আমি যদি নীলাকে খুঁজে না পাই, তাহলে এই মিনিটই এই শহরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময় হয়ে দাঁড়াবে।”

পর্ব

অর্ক স্টেশন ফুটেজের গোপন ভিডিওটা আবার চালায়। সেই পাঁচজন ‘ব্ল্যাঙ্ক-ফেস’ লোকদের মধ্যে একজন, সাদা জামা পরা ব্যক্তি, ঠিক নীলার সামনে দিয়ে হাঁটে। ভিডিওর স্লো-মোডে দেখে, নীলা যেন তাকে দেখে চমকে যায়, পিছিয়ে দাঁড়ায়। এরপর সে তার ফোন বের করে কী যেন ছবি তোলার চেষ্টা করে। ঠিক সেই সময়—ফুটেজ কাট।

অর্ক জানে, এটা নিছক কাকতালীয় নয়।

সে এবার যায় পুরনো বন্ধু রণর কাছে, যে এখন একটি বেসরকারি সাইবার ইন্টেলিজেন্স ফার্মে কাজ করে। রণ তাকে দেখে অবাক হয় না, বরং বলে, “তোর বোন যেটা দেখেছে, সেটা আমরা বহুদিন ধরে জানি। শুধু প্রমাণ কেউ দেয় না, আর যারা দেয়, তারা হারিয়ে যায়।”

অর্ক ঘেমে ওঠে, “তাহলে কে ওরা?”

রণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “ওরা কোনো দাগ ফেলে না। প্রশাসনের নথিতে ওদের অস্তিত্ব নেই। কনফিডেন্সিয়াল সিস্টেমের বাইরে ওরা অস্তিত্বহীন শ্রেণি—ghost identifiers। তারা রাস্তা দিয়ে হাঁটে, অথচ মুখ নেই। সরকারও চায় না ওদের নিয়ে কেউ খোঁজ করুক।”

“তাহলে নীলার মতো কেউ যদি সেটা ক্যামেরায় ধরে ফেলে?”

রণ তাকায়, “তবে তাকে সরিয়ে দিতে হয়। এবং মনে করিয়ে দিতে হয়—তুই পরের জন হতে পারিস।”

অর্ক এবার নীলার রুমে ফিরে এসে ব্যাকআপ ফোল্ডার খুলে। একটি এনক্রিপ্টেড ভয়েস নোট পায়। নীলার কণ্ঠে:

দাদা, যদি কখনও আমার সঙ্গে কিছু হয়, তাহলে ‘ভার্চুয়াল করিডোর’ প্রজেক্টের ফোল্ডারটা খুঁজে নিও। আমি যেটা দেখেছি, সেটা আমাদের ক্যামেরা নয়, কারা যেন মেট্রোর ক্যামেরার ওপরে ‘মিথ্যা’ চেহারা বসিয়ে দেয়। এই যে আমরা দেখি—সব সত্যি নয়। কিছু দেখানো হয় যেন না দেখি। আমি যদি হঠাৎ…’

রেকর্ডিং হঠাৎ কেটে যায়। অর্কর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায়।

সে জানে, সময় আর নেই। তাকে নীলাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে, তার আগে জানতে হবে—এই ‘Virtual Corridor’ ঠিক কী?

এদিকে পরের দিনই অর্কর অফিসে এক অজানা কুরিয়ারে আসে একটি খাম। ভিতরে একটি মাত্র লাইন লেখা কাগজ:

দেখো, তুমি ঠিক কী দেখছো—না কী দেখানো হচ্ছে।”

তার নিচে QR কোড।
অর্ক সেটি স্ক্যান করে। খুলে যায় একটি গভীর ওয়েবসাইট—www.mirrortrace.io
লাল ব্যাকগ্রাউন্ড।
একটি অপশন:
“Enter Surveillance Point Code”

অর্ক ফিরে যায় স্টেশন ভিডিওর টাইমফ্রেমে। নীলার পিছনে থাকা একটি বিলবোর্ডে ছোট করে লেখা ছিল—SP013। সে সেই কোড টাইপ করে। এবং সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় একটা তিন-ডাইমেনশনাল মডেল।

তার সামনে ভেসে ওঠে পুরো শোভাবাজার স্টেশনের ডিজিটাল কাঠামো, যেন লাইভ রেন্ডারিং।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয়—ডানদিকে নিচে আলাদা একটা সুড়ঙ্গ দেখা যাচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের সীমানার বাইরে। সেখানে লেখা—Restricted Layer: Project Corridor

অর্ক নিঃশ্বাস চেপে দেখে, সেই রুটের শেষ মাথায় একটা চলন্ত ছায়ামূর্তি। ছোট, কাঁধে ব্যাগ, লম্বা চুল।

নীলা?

সে কিছু না ভেবেই সেই লিঙ্কে ক্লিক করে।

স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায়। শব্দ আসে—ফিসফাস, যেন কানে কেউ ধীরে ধীরে বলে—

মিনিট ছিল না। সময়টা ছিল চুরি করা।”

অর্ক উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠিক তখনই তার ফোনে মেসেজ:

তুমি এবার লক্ষ্যবস্তু। STOP.”

সেই মুহূর্তে ঘরের লাইট ফ্লিকার করে ওঠে।

অর্ক জানে, সে আর সময় নষ্ট করতে পারবে না। সত্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সে।
এবার হয় সে নীলাকে উদ্ধার করবে, না হয় হারিয়ে যাবে সেই ‘চুরি হয়ে যাওয়া সময়’-এর মধ্যে।

পর্ব

অর্কর কাঁধের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। ঘরের বাতি নিভে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ফ্লোরে পড়ে থাকা তার ফোন আবার আলো ছড়াচ্ছে—মেসেজ স্ক্রিনে এখনও জ্বলজ্বল করছে সেই শব্দটা:
“STOP.”

কিন্তু অর্ক থামার মানুষ নয়। সে জানে, এখন যেকোনো পদক্ষেপ তার জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু নীলা, তার একমাত্র বোন, এই মুহূর্তে কোথায়, কী অবস্থায় আছে, সেটা জানার দরকার তার নিজের অস্তিত্বের থেকেও বড়।

সে আবার বসে যায় কম্পিউটারের সামনে। www.mirrortrace.io তে সেই গোপন “Project Corridor”-এর থ্রি-ডি ম্যাপ তখনও খোলা। এবার সে লক্ষ্য করে, মেট্রো স্টেশন ম্যাপের বাঁদিকে একটি ছোট blinking dot—গাঢ় সবুজ। পাশে লেখা:
“LIVE SIGNATURE DETECTED”
Timestamp: 01 minute ago.

“ইন্টারনাল লোকেশন ট্র্যাকিং চলছে,” অর্ক নিজে নিজে বলে।
এর মানে হচ্ছে—সিস্টেম এখনও নীলার অস্তিত্ব রেকর্ড করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেটা বাস্তবের কোথায়?

সে ম্যাপ স্ক্রল করে দেখে, রেন্ডারিং অনুযায়ী সেই করিডোরটি মেট্রো প্ল্যাটফর্ম থেকে ১৪ ফুট নিচে। অথচ সরকারি ব্লুপ্রিন্টে এমন কোনো সাব-লেভেল নেই।
অর্কর মাথায় আসে—এটা হয়তো কোনো পুরনো নির্মাণ লেভেল, যা নতুন প্ল্যানের নিচে চাপা পড়ে আছে।

সেইরাতেই সে চলে যায় শোভাবাজার সুতানুটি স্টেশনে। রাত ১টা ৪০। মেট্রোর শেষ ট্রেন চলে গেছে। গার্ডরা ক্লান্ত চোখে তাকায়।

“আমি রেল প্রকৌশল বিভাগের একজন প্রযুক্তিবিদ। সাব-লেভেল সার্ভার প্যানেল দেখতে এসেছি,” অর্ক গলায় গাম্ভীর্য এনে বলে। একটা ভুয়া ID কার্ড সে তৈরি করে এনেছিল।

সিকিউরিটি গার্ড তেমন কিছু না ভেবে অনুমতি দেয়। অর্ক নিচে নেমে যায় সাবস্টেশন ঘরের দিকে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে—একটা পুরনো লোহার দরজা, মরচে ধরা, তালা লাগানো। দরজার গায়ে লেখা—
“AUTHORIZED ENTRY ONLY – SECTION 013-X”

ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোন কাঁপে।
অচেনা নম্বর থেকে একটি ভয়েস মেসেজ আসে:
অর্ক সেন, তুমি যা খুঁজছো সেটা এই দরজার ওপারে নেই। বরং তুমি যা জানো না, সেটা বাইরে অপেক্ষা করছে। ফিরে যাও।”

অর্ক দরজায় কান পাতে।
অন্যপাশ থেকে ভেসে আসে নীলা’র কণ্ঠ—কিন্তু যেন ভাঙা রেকর্ডিংয়ের মতো:
“দাদা… দাদা… আমি কোথায়… আলো নেই… সময় থেমে গেছে…”

সে পাগলের মতো দরজাটা ধাক্কায়। তালা নড়ে, কিন্তু খোলে না।
তখনই দরজার ডানপাশে চোখে পড়ে একটা পুরনো স্ক্যানার প্যানেল। ডাস্ট কভার তুলে দেখে—রেটিনা স্ক্যানের অপশন।

অর্কের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। তার ফোনে যে QR কোড এসেছিল, সেটার ভেতরে একটা GIF ফাইল ছিল, যেখানে চোখের ইমেজ কয়েক ফ্রেমে কাঁপছিল। সে বুঝতে পারে—ওটাই একটি ফ্ল্যাশ প্যাটার্ন।

সে ফোনের স্ক্রিনটিকে স্ক্যানারে সামনে ধরে। প্যানেল ঝাঁপসা হয়ে সবুজ আলো দেয়।
Access Granted.
দরজার তালা খুলে যায় একটা ধাতব ক্লিক করে।

ভেতরে পা রাখতেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায় অর্কর। ঘরটা একটা সরু টানেলের মতো। আলো নেই, কেবল একটা হালকা নীল আলোর রেখা মাটিতে আঁকা। দেয়ালে গা ছমছমে ছায়া, আর কানে ভেসে আসছে ফিসফাস—প্রচুর কণ্ঠ একসাথে কিছু বলছে।

“সময় থেমে গেছে… সময় চুরি হয়েছে…”

হঠাৎ সামনে একটা ভাঙা কাচের রুম—তার ভেতরে চেয়ারে বসে আছে এক মেয়ে। মাথা নিচু, চুল খোলা। হাত বাঁধা। পেছনের দেয়ালে লেখা—“Corridor Subjects – 017: Nila Sen”

অর্ক ছুটে গিয়ে চিৎকার করে—
“নীলা!”

মেয়েটি ধীরে মাথা তোলে। চোখে অস্পষ্ট চাহনি।

ঠিক তখনই পিছন থেকে এক ঠান্ডা কণ্ঠ ভেসে আসে—
তুমি মিনিট চেয়েছিলে। আমরা বছর নেব।”

পর্ব

অর্ক ঘুরে দাঁড়ায়। সামনে এক লম্বা, কুচকুচে কালো কোট পরা লোক দাঁড়িয়ে। গায়ের নিচু আলোয় তার মুখ ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না—শুধু ঠোঁটের কোণে একফোঁটা হাসি। চোখদুটো অস্বাভাবিক স্থির। লোকটা যেন আলো-ছায়ার মধ্যে গড়ে ওঠা কোনো ছায়ামূর্তি।

“তুমি কে?” অর্ক চাপা গলায় বলে।

লোকটি ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “প্রশ্নটা ভুল। প্রশ্ন হওয়া উচিত—তুমি কী দেখেছো? কারণ যারা দেখে, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।”

অর্ক গলা শক্ত করে বলে, “আমি শুধু আমার বোনকে নিতে এসেছি। ওর সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা অন্যায়। তোমরা কারা, কাকে লুকিয়ে রাখছো?”

লোকটা থামে না, বরং বলে, “তোমার বোন নিজে এখানে এসেছিল। সে দেখেছিল আমাদের কাজ, আমাদের সত্য। তার কৌতূহল ছিল বড়, সাহস ছিল বেশি। কিন্তু এই সিস্টেম কৌতূহলের শাস্তি দেয়।”

অর্ক এবার চিৎকার করে ওঠে, “এইটা তো সিস্টেম না—এইটা তো বন্দিত্ব! ও একটা মানুষ, মেশিন না!”

লোকটি এবার থেমে যায়। তার ঠোঁটে বিস্তৃত হয় ঠান্ডা হাসি।

“মানুষ? সিস্টেম আজকাল মুখ চিনে না, চিনে ডেটা। তোমার বোন ছিল মাত্র এক ডেটা ফ্রেম, যেটা ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছিল। এখন আমরা সেই ফ্রেমটাকে ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

অর্ক বুঝে যায়—এখান থেকে সহজে ফেরা যাবে না। সে পেছনে ফিরে চিৎকার করে—“নীলা! আমি এসেছি। আমি আছি।”

চেয়ারে বাঁধা মেয়েটি যেন অচেতন, কিন্তু চোখের পাতায় সামান্য স্পন্দন দেখা যায়।

ঠিক তখনই পাশের দেয়াল ফেটে বেরোয় এক প্যানেল। সেখানে লেখা:

Initiate Memory Transfer: Subject 017 → Proxy_ARK

অর্ক চমকে যায়। তারা চায়—নীলার মেমোরি তার ভেতরে ট্রান্সফার করে দেওয়া হোক।
মানে—ওর স্মৃতি মুছে যাবে। আর তার ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবে কেবল একটা তথ্যসত্তা।

লোকটা এবার চেয়ারে থাকা একটা কন্ট্রোল স্টিক ধরে বলে, “তোমার কাছে একটাই সুযোগ। নীলার জীবন? না তোমার স্মৃতি? একজন থেকে একজন—আমরা কাউকে ফেরাই না, কেবল বদলাই।”

হঠাৎ একটা কাচ ভাঙার শব্দ।
লোকটার মুখে থমকে যায় কথা।

অর্ক তাকিয়ে দেখে—নীলার মুখে একটু হাসি।

তার বাঁধা হাতের পেছনে গুঁজে রাখা মোবাইলের ফ্ল্যাশ এবার জ্বলে উঠেছে।

সে হেসে বলে, “ভাই… লিংক ঠিক মতন কাজ করছে… এখন…”

কঠিন ব্যথায় জর্জরিত হয়ে সে ফিসফিস করে—“তুই logout কর, অর্ক… আমায় download কর…”

লোকটা চিৎকার করে ওঠে—“না! ওকে থামাও!”

অর্ক এক ঝাঁপে চেয়ারের দিকে দৌড়ে যায়, আর ঠিক তখনই প্যানেলের সব লাইট একসঙ্গে জ্বলে ওঠে।

নিচের মাটিতে অর্কর মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি লেখা:

মেমোরি ট্রান্সফার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। Subject out of sequence.”

পাশে থাকা মনিটরে দেখা যায়—নতুন ফোল্ডার তৈরি হচ্ছে।

নাম:
“NILA_BACKUP_ARKV2”

ঠিক সেই মুহূর্তে কন্ট্রোল রুমে বিকট অ্যালার্ম বেজে ওঠে।

লাল আলো ঝলসে ওঠে চারদিকে। লোকটা রাগে উন্মাদ হয়ে গর্জায়—

“তোমরা দু’জনেই শেষ!”

অর্ক বাঁ হাতে চেয়ারে বসা নীলাকে জড়িয়ে ধরে, আর ডান হাতে স্ক্রিনে দ্রুত টাইপ করে এক কমান্ড:
/exit_virtual/corridor013

চোখ ধাঁধানো আলো। চারদিক ঘুরছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। যেন একটা টানেলে তারা দুজন পড়ে যাচ্ছে—সময়, স্মৃতি, সিগন্যাল সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

শেষ দৃশ্য:
দুইটা হাত—একটা অর্কের, একটা নীলার—একসাথে আঁকড়ে আছে।
কিন্তু তাদের চারপাশে যা আছে, সেটা আর স্টেশন নয়।

না, তারা এখন অন্য কোথাও।
সম্ভবত সেই জায়গায় যেখানে সময় থেমে থাকে।
বা যেখানে সময় কখনো ছিলই না।

পর্ব

আলো। অনেক আলো। চোখ খুলতেই সাদা, সাদা, শুধুই সাদা চারপাশ।
অর্ক মনে করতে পারে না সে কোথায় আছে। শুধু মনে পড়ে, সে দৌড়াচ্ছিল। কেউ তাড়া করছিল। নীলার হাত সে ধরেছিল। তারা একসঙ্গে কোথাও পড়ছিল, নিচে, ভেতরে, গহ্বরে। তারপর এই সাদা ঘর।

“নীলা?”—তার কণ্ঠে কাঁপন।
কোনো উত্তর নেই।

সে উঠে বসে। ঘরটা যেন ধোঁয়ায় মোড়া এক শূন্যস্থান। দেয়াল নেই, দরজা নেই, ঘড়ি নেই।
শুধু দূরে একটা গ্লাস স্ক্রিন ভেসে আছে, তাতে তার নাম লেখা:

USER: ARK_V2
STATUS: ACTIVE
CONNECTED SUBJECT: NILASEN_013 (PARTIAL)

অর্ক বোঝে—সে এখন বাস্তবে নেই। এ যেন কোনো মস্তিষ্কের ভেতর গড়া ভার্চুয়াল জগৎ।
একটা কৃত্রিম মেমোরি সেল।

এদিকে দূরে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
চেনা মুখ। নীলা।

কিন্তু চোখে একরাশ বিস্ময়। তার মুখে কোনও হাসি নেই, বরং নির্লিপ্ত, কেমন যেন যন্ত্রের মতো।

“তুই?” অর্ক বলে।

নীলা তাকায়, শান্ত গলায় বলে, “তুই কে?”

অর্ক চমকে যায়। “আমি? তোর দাদা, অর্ক। ভুলে গেছিস?”

নীলা কপাল কুঁচকে বলে, “দাদা… এই নামটা আমার ডেটাবেসে আছে। কিন্তু… আমি তো এখন আর কেউ নই। আমাকে শুধু রাখা হয়েছিল। আর্কাইভের মতো।”

অর্কর শ্বাস আটকে আসে।
এই মেয়ে তার বোন, অথচ সে তার কোনো স্মৃতি রাখে না?

নীলা বলে, “তুই এখানে কী করে এলি?”

অর্ক ধীরে বলে, “তোর জন্যই এসেছিলাম। তোকে ফিরিয়ে আনব বলে।”

নীলা হালকা হাসে। “তুই জানিস না, এই সিস্টেমে যারা একবার ঢোকে, তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়—‘মূল’ এবং ‘ছায়া’। তুই এখন ছায়া হয়েছিস, অর্ক। তোকে আর কেউ খুঁজে পাবে না।”

অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ে। “তাহলে আমরা এখনও এই সিস্টেমের ভেতরেই আছি?”

নীলা মাথা হেলিয়ে বলে, “হ্যাঁ। এবং বাইরে এখন সময় থেমে গেছে।”

“মানে?”

“মানে… আমাদের জন্য ৫ মিনিট কেটে গেছে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় এই মুহূর্তে ৪ দিন পার হয়ে গেছে। সময় এখানে স্লোডাউন হয়। এটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল—‘ইনভার্টেড টাইম-সেল’। আমরা তার শিকার।”

অর্ক গভীরভাবে চায় মেয়েটার দিকে। কিছু একটার খোঁজ করতে গিয়ে ও নিজেই যেন একটি ভুল প্যারালাল রিয়ালিটিতে আটকে পড়েছে।

তখনই আবার স্ক্রিনে একটা নতুন ম্যাসেজ আসে—
“CODE ALERT: SECONDARY INTRUSION DETECTED”

অর্ক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, নিচে কাউন্টডাউন চলছে:
03:59… 03:58… 03:57…

নীলা চমকে ওঠে। “আর কেউ প্রবেশ করেছে। কারা যেন আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।”

অর্ক জিজ্ঞেস করে, “কে হতে পারে?”

নীলা চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করে। “কেউ ভিতরের লোক। হয়তো রণ… অথবা সেই লুকিয়ে থাকা ‘ghost identifier’দের মধ্যে কেউ বিশ্বাসঘাতক হয়েছে।”

অর্ক চোয়াল শক্ত করে বলে, “তবে আমাদের বের হতেই হবে। এই সময়ের ঘূর্ণি থেকে। এই মিথ্যে জগৎ থেকে।”

নীলা শান্ত গলায় বলে, “তবে তার জন্য দরজা খুঁজতে হবে। একটাই Exit Gate আছে—যেটা তৈরি হয়েছিল একদম শুরুর প্রোটোটাইপে। কিন্তু সেটা পেতে হলে…”

“কি?”

“আমার ‘আসল’ স্মৃতিটা ফিরিয়ে আনতে হবে। যেটা তারা কেটে আলাদা করে রেখেছে।”

অর্ক বলে, “সেটা কোথায়?”

নীলা ধীরে বলে,
“Corridor Zero.”

অর্ক জানে, পরের যুদ্ধ হবে এই মায়ার ঘরের গভীরতম স্তরে। যেখানে সময়, স্মৃতি আর বাস্তব—সব মিশে আছে এক ভয়ংকর কনস্পিরেসিতে।

পর্ব

অর্ক আর নীলা সামনে তাকিয়ে থাকে সেই ঝাপসা স্ক্রিনের দিকে।
Corridor Zero—নামটাই কেমন শীতল।

নীলা ধীরে হাঁটতে শুরু করে।
“এই মেমোরি স্পেস একটা মায়া তৈরি করে রেখেছে আমাদের জন্য। চারপাশে যা দেখছি সবই প্রজেকশন, তবে কোথাও একটা আছে মূল দরজা—Corridor Zero, যেটা দিয়ে আমরা ফিরতে পারি।”

অর্ক তার পাশে হাঁটে। চারপাশের সাদা কুয়াশা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। দেয়াল দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে পরিবেশ বদলাচ্ছে—একবার কলেজের ক্লাসরুম, আবার একটা নির্জন মেট্রো স্টেশন, আবার নীলার ছেলেবেলার ঘর।

“এই কি তোর স্মৃতি?” অর্ক জিজ্ঞেস করে।

নীলা মাথা নাড়ে, “না, এই সব রেন্ডার করা প্যাকেট। ওরা এগুলো তৈরি করেছে আমার চেনা অনুভূতির ভেতর আটকে রাখতে। এগুলোর ভেতরেই আমার আসল স্মৃতি লুকিয়ে আছে।”

ঠিক তখনই সামনে একটা পুরনো স্টোররুম টাইপ জায়গা। মেঝেতে ধুলো, খড়, ছেঁড়া কাগজ, আর মাঝখানে একটা লালরঙা দরজা।
দরজার ওপরে লেখা—Z0_ACCESS

অর্ক এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে।
সঙ্গে সঙ্গে তার মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। দরজার স্পর্শে মাথায় ভেসে ওঠে প্রচুর স্মৃতি—নীলার হাসি, কলেজ ক্যাম্পাস, মেট্রোর টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে থাকা, সেই সাদা জামা পরা লোকের মুখ…

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র—একটা ল্যাবের ঘরে টেবিলের ওপর বসে আছে নীলা, তার মাথায় হেডসেট, চোখ বন্ধ, এবং স্ক্রিনে লেখা—
“ACTIVE RECORDING: DREAMSTATE INTERROGATION.”

অর্ক পেছনে ঘুরে চায়—নীলার চোখে জল।

সে ফিসফিস করে, “ওরা আমাকে ভুলিয়ে দিচ্ছিল। আমার পরিচয়, আমার কথা, এমনকি তুই কে, সেটাও। কিন্তু আমি জানতাম, তুই আসবি। তোর একটা চেনা গন্ধ মনে রাখি সবসময়…”

অর্ক দরজার হ্যান্ডেলে চেপে ধরে। দরজা খোলে।

সামনে একটা দীর্ঘ করিডোর। আলো-আঁধারি। দেয়ালের পাশে পাশে সারি সারি টার্মিনাল, তার মধ্যে ক্যাপসুলের মতো চেম্বার, যার প্রত্যেকটায় কোনো না কোনো মানুষের মুখ—কেউ ঘুমিয়ে, কেউ কান্নায়, কেউ সম্পূর্ণ ফাঁকা চোখে তাকিয়ে।

নীলা বলে, “এরা প্রত্যেকেই ‘ghost identifier’। যারা একসময় কিছু ‘অসত্য’ দেখে ফেলেছিল। তারপর এভাবে সিস্টেমের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে।”

তারা ধীরে ধীরে সামনে এগোয়।

একেবারে শেষে একটা বিশেষ চেম্বার। তার উপর লেখা—
“NILASEN_013 : RAW MEMORY SEGMENT”

অর্ক প্যানেল খুলে দেখে—ভেতরে অনেকগুলো স্মৃতির অংশ। কাঁচের বাল্বে বন্দি।
একটা বিশেষ অংশে নাম—
“Capture Point: 09:47AM – PLATFORM 2”

“এইটা,” বলে নীলা। “এইটা আমি দেখেছিলাম—যা দেখতে নেই। ওরা চায় এটা মুছে ফেলতে।”

অর্ক দ্রুত সেই স্মৃতি-চিপ নিয়ে বের করে, আর ঠিক তখনই করিডোরের শেষপ্রান্তে আলো জ্বলে ওঠে। কণ্ঠ ভেসে আসে—

তোমরা অনেক দূর চলে গেছো। এবার থামতে হবে।”

দুইপাশের চেম্বার খুলে যায়। অদ্ভুত রোবোটিক মুখের ছায়ামূর্তিরা বেরিয়ে আসে।

নীলা বলে, “দৌড়!”

অর্ক স্মৃতি-চিপটা শক্ত করে ধরে নীলার হাত টেনে ধরে দৌড় দেয়। চারদিকের সিস্টেম ফ্ল্যাশ করছে—
“Memory breach. Time lock failure. Exit point activating…”

একটি মাত্র দরজা আবার ফুটে ওঠে সামনে। দরজার ওপরে ঝাপসা লেখা—“Exit: Ark/Nila Merge Point”

নীলা বলে, “এইটাই শেষ রাস্তা। কিন্তু মনে রাখিস—এই পথে গেলে আমরা হয় দু’জনেই ফিরব, নয় কেউ না।”

অর্ক বলে, “আমার একটা পথই আছে—তোর সঙ্গে থাকা।”

দুজন একসঙ্গে দরজা পেরিয়ে যায়।

দরজা বন্ধ হয়।

অন্ধকার।

তারপর—

একটা ঘড়ির কাঁটা, মেট্রোর ঘণ্টা, মানুষের কণ্ঠ, পুলিশ সাইরেন…

আলো ধীরে আসে।

কে যেন জিজ্ঞেস করছে, “আপনার নাম?”

এক কণ্ঠ উত্তর দেয়—
অর্ক… সেন। না, মানে… আমি… আমরা… কে?”

পর্ব

আলো চোখে লেগে যাচ্ছে। অর্ক চোখ মেলে দেখতে পায় সাদা অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতর সে শুয়ে আছে। তার পাশেই এক নার্স কিছু একটা ইনজেকশন দিচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন অফিসার নোট নিচ্ছে।

“নাম বলুন?”
অর্ক জবাব দিতে চায়, কিন্তু জিভ যেন কাঠ হয়ে গেছে।

অফিসার আবার বলে, “আপনার নাম?”

কিছুটা কষ্টে, ঠোঁট কাঁপিয়ে সে বলে, “অর্ক… সেন।”

অফিসার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “আপনাকে চার দিন আগে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের একটি বন্ধ সেকশন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অচেতন অবস্থায়। আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল না।”

অর্ক ধীরে উঠে বসে পড়ে। “নীলা কোথায়?”

অফিসার চোখ সরিয়ে নেয়। “সেখানে আর কাউকে পাওয়া যায়নি।”

“না… না, সে তো আমার সঙ্গে ছিল। আমরা একসঙ্গে ফিরে এসেছি! Corridor Zero… সেই দরজা…”

অফিসার আর নার্স একে অন্যের দিকে তাকায়।

“আপনার মানসিক অবস্থার পরীক্ষা করা হবে,” বলে অফিসার। “আপনার মোবাইল, ব্যাগ কিছুই ছিল না। আপনি কি নিশ্চিত, আপনি একাই সেখানে ছিলেন না?”

অর্ক কিছু বলতে পারে না। মাথার ভেতর যেন বাজছে একসঙ্গে বহু স্মৃতির শব্দ। নীলার কণ্ঠ, তার মুখ, Corridor-এর ছায়া, সেই মানুষগুলোর ফিসফাস।

তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নার্সিংহোমে। সেদিন রাতেই ঘুম ভেঙে সে বিছানার পাশে দেখতে পায় একটি ছোট চিরকুট—অজানা হাতে লেখা।

তুই ফিরেছিস। আমি হয়তো ফিরিনি। কিন্তু আমার ভিতরটা তোর ভিতরেই আছে। Corridor তোমাকে মনে রাখবে। – নীলা”

তার বুকের ভেতর কেমন কেঁপে ওঠে।
সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের মুখ চেনে। কিন্তু চোখদুটো—সেগুলো কি কেবল তার নিজের?

সে হঠাৎ লক্ষ্য করে, আয়নার কোণে এক ছায়া দাঁড়িয়ে।
শাড়ি পরা এক তরুণী।
তার চোখে জল আর ঠোঁটে মৃদু হাসি।
আর এক মুহূর্তেই সেই ছায়া মিলিয়ে যায়।

পরের দিন অর্ক তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। বন্ধ ল্যাপটপ খুলে দেখে, স্ক্রিনে একটি ফোল্ডার তৈরি হয়েছে।

“BACKUP_013_COMPLETE”
ভেতরে একটি ফাইল:
“NILA_FINAL_MEMORY_Sequence.mp4”

সে প্লে করে।

ভিডিওতে দেখা যায়—নীলা মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে দিয়ে সেই সাদা জামার লোক হেঁটে যাচ্ছে।
হঠাৎ নীলা ঘুরে তাকায় ক্যামেরার দিকে।
সরাসরি, স্থির।
তার ঠোঁটে শুধু একটাই শব্দ।

দেখো।”

ভিডিও থেমে যায়।

অর্ক হঠাৎ লক্ষ্য করে তার ঘরের দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা—

তুমি মিনিট হারিয়ে ফেলেছিলে। এখন তোমার সামনে আছে বছর।”

সে জানে, এই খেলা এখনও শেষ হয়নি। শুধু প্ল্যাটফর্ম বদলেছে।

পর্ব

অর্ক সারা রাত ঘুমাতে পারে না। বারবার ফিরে আসে সেই ফুটেজ—নীলার চোখে তাকানো, “দেখো” বলা, আর তারপর সেই লাল অক্ষরে লেখা সতর্কবার্তা।

তুমি মিনিট হারিয়ে ফেলেছিলে। এখন তোমার সামনে আছে বছর।”

এটা নিছক হুমকি নয়, বরং একটা হিসেব। কিন্তু কিসের?

পরদিন সকালে দরজায় কলিং বেল। সে খোলে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রণ—অর্কর পুরনো বন্ধু, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট।

রণ কোনো কথা না বলে এক লাল প্যাকেট তুলে দেয়।
ভেতরে:
একটা পুরনো USB ড্রাইভ।
একটা ধুলোভরা বই—“Cognitive Shadows: Surveillance Beyond Time”
আর একটা কাগজে লেখা—
তোর যা জানার দরকার, সব এখানে আছে। Corridor Zero এখন শুধু ইতিহাস না, ভবিষ্যতের একটা ফাঁদ। সাবধানে পা ফেলিস।”

অর্ক ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা চালায়।

ভেতরে একটা ভিডিও ফোল্ডার:
“Corridor_Zero_TestSubjects”

সে একে একে ভিডিওগুলো চালায়। বিভিন্ন সময়ের ফুটেজ, বিভিন্ন মেট্রো স্টেশন থেকে। একই প্যাটার্ন—একজন লোক হঠাৎ স্টেশনে ঢুকছে, ক্যামেরার সামনে মুখ ঘুরিয়ে দেখছে, আর তারপর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

সবচেয়ে ভয়ানক ভিডিও—
একজন গর্ভবতী মহিলা একা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, তারপর ৮ মিনিটের ফুটেজে কেবল এক লাল আলো দেখা যাচ্ছে। তারপরে… ফাঁকা।

অর্ক বুঝতে পারে, Corridor Zero একটা পরিকল্পিত মানসিক বন্দিত্বের যন্ত্র। মানুষকে সময় ও স্মৃতির ফাঁদে ফেলে তাকে নিঃস্ব করে ফেলা হয়। এবং যে ফাঁদে সে নিজে একবার পড়েছে, এখন হয়তো সেটাকে বাইরে থেকে কেউ পরিচালনা করছে—তার মাধ্যমেই।

হঠাৎ তার ফোনে নোটিফিকেশন আসে—
“MirrorTrace Account Reactivated”

অর্ক জানে, সে এই সিস্টেম একবার ‘লগ আউট’ করেছিল। আবার চালু হলো মানে—কেউ তাকে ভেতর থেকে ট্রিগার করেছে।

সে MirrorTrace খুলে দেখে একটা নতুন সেশন লাইভ—
User: NILASEN_013
Location: Unknown
Status: ACTIVE

অর্ক কাঁপা হাতে ডায়াগনস্টিক স্ক্রিপ্ট চালায়।

ভেসে ওঠে ম্যাপে এক লাল বিন্দু।
লোকেশন: DUMDUM METRO SUB-BASEMENT

অর্কর মনে পড়ে—দমদম মেট্রোতে কিছুদিন আগে একটি “কারিগরি রক্ষণাবেক্ষণের” কারণে স্টেশন বন্ধ ছিল এক সপ্তাহ। তখন গুজব উঠেছিল, নিচে কেউ মারা গেছে। সিসিটিভি ব্ল্যাকআউট হয়েছিল এক রাতের জন্য।

তবে কি সেটা ছিল Corridor Zero-এরই নতুন চেম্বার?

সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সবকিছু শেষ করতে হবে। আবার কাউকে হারানোর আগেই।

রাতেই সে প্যাক করে বেরিয়ে পড়ে। ব্যাগে রাখে সেই স্মৃতি-চিপ, MirrorTrace লগ, আর USB ড্রাইভ।
রণকে একটা মেসেজ পাঠায়:
যদি আমি না ফিরি, জানিয়ে দিস—আমি গিয়েছিলাম সত্যি দেখতে, কিন্তু শুধু চোখে নয়… হৃদয়ে।”

দমদম মেট্রো স্টেশনের রাত অনেক বেশি নির্জন।
অর্ক সাব-বেসমেন্টের দিকে এগোতেই শোনে দূর থেকে এক চেনা কণ্ঠ—

তুই এত সহজে বেরোতে পারিস না, অর্ক। তুই এখন ওদের এক অংশ।”

আলো-ছায়ার মাঝে ভেসে ওঠে সেই লম্বা কালো কোট পরা লোকটা। সেই মুখ, সেই অদ্ভুত চোখ, এবার আর অদৃশ্য নয়—বরং স্পষ্ট, জ্যান্ত।

লোকটা এবার সামনে এসে বলে—

“Corridor Zero এবার সম্পূর্ণ হয়েছে। এবং তুই হবিস তার প্রথম স্থায়ী বাসিন্দা। নীলার তো… সময় ফুরিয়ে গেছে।”

পর্ব

দমদম মেট্রোর সাব-বেসমেন্টে, টানেলের ভেতরে গা-ছমছমে অন্ধকার। অর্কর পা মেঝেতে পড়ছে খুব সন্তর্পণে, হাতে শক্ত করে ধরা টর্চ আর ব্যাগে নীলার মেমোরি চিপ। মাথায় কেবল একটাই কথা—এইবার কিছু একটা শেষ করতে হবে।

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্য থেকে সেই কোট পরা লোকটা আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে ঠান্ডা আলো, মুখে হালকা বিদ্রুপ।

“তুমি বারবার চলে যাও, কিন্তু আবার ফিরে আসো। এটাই Corridor-এর নিয়ম। তুমি একবার ঢুকলে, সেটা তোমার মনের একটা অংশ হয়ে যায়।”

অর্ক এগিয়ে যায়, তার চোখে এখন ভয় নয়, একরাশ স্থিরতা।

“আমি কিছু শেষ করতে এসেছি,” সে বলে। “আমার বোনকে ফিরিয়ে আনতে এসেছি।”

লোকটা ঠোঁটে মুচকি হাসি এনে বলে, “তোমার বোন? নীলা তো এখন Corridor-এর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। ও এখন একটা ‘distributed memory system’—তাকে তুমি শরীরের মধ্যে পাবে না।”

“তাহলে?” অর্ক জিজ্ঞেস করে।

“তাহলে তুমি ওর অংশ হতে পারো। তুমি চাইলে Corridor তোমাদের দু’জনকে এক করে দেবে। চেতনার স্তরে। শরীরের নয়, অস্তিত্বের জায়গায়।”

অর্ক এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, “তুমি বলছ আমি চাইলেই Corridor আমাকে ওর সঙ্গে… এক করে দেবে?”

লোকটা মাথা ঝাঁকায়। “হ্যাঁ। তবে বিনিময়ে তুমি ‘বাস্তব’ ত্যাগ করো। বাইরের দুনিয়ায় তুমি আর থাকবে না। একটা মুখ থাকবে, কিন্তু সেটা শুধু প্রজেকশন। ভিতরের তুমি থাকবে এখানেই।”

অর্ক থেমে যায়।
হাতের ব্যাগ খুলে মেমোরি চিপটা বের করে। তারপর MirrorTrace এর সেই ফোল্ডার থেকে প্লে করে নীলার রেকর্ড করা শেষ ক্লিপটি।

নীলার কণ্ঠ—
“দাদা, যদি কখনও তুই ফিরে আসিস, জানিস… আমি তোকে চাই। শুধু একসাথে নয়, মুক্ত হয়ে। আমি চাই না তুই ওদের মত একটা নামহীন ছায়া হয়ে বাঁচিস।”

অর্ক চোখ বন্ধ করে। মুঠোয় চিপটা শক্ত করে ধরে।

“না,” সে বলে। “আমি থাকব। আমি ফিরব। তবে তোর সমস্ত স্মৃতি নিয়ে, তোকে নিয়ে। আমি একা না, আমরা একসাথে বের হব। শুধু Corridor নয়, সময়কেও হার মানাব।”

লোকটা এবার বিরক্ত। তার চোখ লাল হয়ে ওঠে। চারপাশে অদ্ভুত গুঞ্জন।

“তুমি বের হতে পারো না! Corridor কাউকে ছেড়ে দেয় না!”

অর্ক তখন পকেট থেকে USB ড্রাইভ বের করে দেয়ালে থাকা পুরনো সার্ভার প্যানেলে ঢুকিয়ে দেয়। স্ক্রিন জ্বলে ওঠে।

SYSTEM ALERT: EXTERNAL MEMORY OVERRIDE DETECTED
PROMPT: Inject Master Exit Protocol?
Y/N

অর্ক ‘Y’ চাপ দেয়।

চারদিক কাঁপে।

সার্ভারগুলো ফেটে পড়তে শুরু করে। কাচ ভাঙার শব্দ, বাতি নিভে যাচ্ছে। Corridor গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।

লোকটা কাঁপতে থাকে। “তুমি ভুল করছো! তুমি নিজেকেও শেষ করে দিচ্ছো!”

অর্ক হাঁটু গেড়ে বসে, শেষ বারের মতো চোখ বন্ধ করে নীলার ছবি কল্পনা করে। তার হাসি। তার কণ্ঠ। তার সঙ্গে ভিজে রাস্তায় হেঁটে চলা দিন।

স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—
MERGE SEQUENCE COMPLETE. BACKUP RESTORED. EXIT GATE ACTIVATED.

একটা তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

সব নিস্তব্ধ।

অর্ক চোখ মেলে দেখে, সে একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। পাশে একজন নার্স দাঁড়িয়ে। তার ডান হাত শক্ত করে কেউ ধরে আছে।

সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে—নীলা।

চোখে জল। কাঁপা ঠোঁটে বলে, “তুই ফিরেছিস…”

অর্ক শুধু হাসে। “তুইও।”

ওরা দুজন জানে—সব ঠিক হয়ে যায়নি। Corridor এখনও আছে। হয়তো আরও কাউকে টেনে নিচ্ছে।

কিন্তু তারা এখন একসঙ্গে। আর Corridor প্রথমবারের মতো একজনকে মুক্তি দিয়েছে।

পর্ব ১০

বহুদিন পর অর্ক জানালার পাশে বসে এক কাপ কফি হাতে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ভাবে—জীবন যেন আবার নরম আলোয় ফিরেছে। চারপাশে আর নেই সেই ধোঁয়াশা, নেই Corridor-এর হিমশীতল ছায়া। নীলা এখন তার পাশের ঘরে, গিটার বাজায় মাঝে মাঝে। ওদের মধ্যকার নীরবতা যেন নতুন করে সংলাপ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু Corridor কি সত্যিই শেষ?

অর্ক জানে, এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই একরৈখিক নয়। কিছু অভিজ্ঞতা থাকে, যা চাইলেও মুছে ফেলা যায় না।

সে নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে আবার খুলে MirrorTrace সফটওয়্যার। এবার আর সিস্টেম ম্যালফাংশন করে না। কোনও ফাঁদ নেই, নেই লুকানো ফোল্ডার।

কিন্তু একটা জিনিস আছে—LOGS

সে সেখানে দেখে—প্রতিদিন কিছু না কিছু লোক নতুন করে ‘Ghost Identifier’ হিসেবে ফ্ল্যাগ হচ্ছে।
চেহারাবিহীন মানুষ। হারিয়ে যাওয়া সময়।
তাদের কেউ জানে না, কেউ খোঁজ করে না।

নীলা এসে বলে, “তুই এখনো এটা নিয়ে ভাবিস?”

অর্ক মাথা নাড়ায়। “হ্যাঁ। কারণ এখন আমি জানি, কেউ একটা সিস্টেম ভাঙলেই আরেকজন তার জায়গায় হারিয়ে যেতে পারে। আমরা ফিরেছি, কিন্তু যারা হারিয়ে গেছে, তাদের কথা কেউ ভাবে না।”

নীলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “তাহলে কী করবি?”

অর্ক হেসে ওঠে। “আমি লিখব। সবটা। নাম বদলে, জায়গা বদলে। কিন্তু বলব, কীভাবে সময়কে চুরি করা যায়, কীভাবে মানুষকে মুছে ফেলা হয়, আর কীভাবে ভালোবাসা সব কিছু ফিরিয়ে আনতে পারে।”

সে ল্যাপটপে একটা নতুন ফাইল খুলে টাইপ করে—
হারিয়ে যাওয়া আট মিনিটের ছায়া
লেখক: রৌনক ভট্টাচার্য

তারপর বন্ধ জানালার ফাঁকে দিয়ে তাকায় বাইরে।
রাস্তা ভিজে, বাতাসে সন্ধ্যার গন্ধ। হঠাৎ সামনের আলোয় একটা লোক হেঁটে যায়—সাদা জামা পরা, মুখ অদৃশ্য।

অর্ক চমকে উঠে উঠে দাঁড়ায়। ছুটে জানালার কাছে যায়।
কিন্তু রাস্তা ফাঁকা।

সে শুধু ফিসফিস করে বলে,
“Corridor… এখনও বেঁচে আছে।

শেষে, নিচু কণ্ঠে লেখা হয়—
এই গল্প সত্য নয়। কিন্তু যদি কখনো তোমার আশেপাশে কেউ মিনিটের জন্য হারিয়ে যায়, মনে রেখো—তাকে ফিরিয়ে আনা যায়, যদি কেউ ভালোবাসার শেষ বিন্দুটুকু নিয়ে তার খোঁজে নামে।”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-06-22-at-2.44.31-PM-1.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *