Bangla - সামাজিক গল্প

তিন নদীর মেয়েরা

Spread the love

অনিরুদ্ধ বাগচী


গঙ্গা, পদ্মা আর মেঘনা—তিন নদী, তিন স্রোত, তিন বুকভরা কান্না। এবং সেই কান্নার নিচে চাপা পড়ে থাকা তিনটি মুখ—রোহিমা, পার্বতী, আর নিরু।
১৯৪৩ সালের অগাস্ট মাস। আকাশ যেন প্রতিদিন আগুনে পোড়া ভাতের মতো ঝাঁজালো। সূর্য চৌচির মাটি ফাটিয়ে ঢুকতে চাইছিল মানুষের নাভিমূলে। মাঠ নেই, ফসল নেই, কুয়াশা নেই—শুধু চিৎকার আর খিদে।

গঙ্গার ধারে রোহিমার গ্রামটা কখনও মাটি হারায়নি, বর্ষায় শুধু উঠোনে জল দাঁড়াত। কিন্তু এই বছর বর্ষা এল না। আর এল না বাজারের দিকে চালের গন্ধ। তার স্বামী কাসেম ঘাটে কাজ করত। একদিন ঘরে ফিরে বলল, “আজ পাঁচ পয়সার চাল বিশ পয়সায় উঠছে। দু-সপ্তাহের মধ্যে চাল থাকবে না।”

রোহিমা তখন পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা। তার চোখে ছিল বিস্ময়ের আভাস, যেন মাটির তলায় দুলে ওঠা কিছু একটা টের পাচ্ছে।

“আমরা খামু কী?”—শুধু এই কথাটুকুই বলতে পেরেছিল সে।

এক সপ্তাহ পরে কাসেমের লাশ ঘাটে পাওয়া গেল। কেউ বলল, পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। কেউ বলল, গুদামের সামনে ধাক্কাধাক্কিতে পিষে গেছে।
রোহিমা আর জানতে চায়নি। সে শুধু জানত, এখন থেকে তার চোখে জল জমলে, সেই জল শুকিয়ে যাবে সন্তানরক্তে।

পদ্মার চরে পার্বতীর জীবনটা ছিল টিকে থাকার গল্প। পিতা নীলকমল ঘোষ ছিল দারিদ্র্যের গায়ে একটা গামছা। মাথার ওপরে খড়ের চাল, কিন্তু অন্তরে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি—যেন নদীর গায়ে হাত বুলিয়ে বলত, “আমাদের নিয়ে যা, আবার দিয়ে দিস।”
কিন্তু পদ্মা এবার কিছুই দেয়নি—শুধু নিয়েছে।
পাহাড়ের পেছন থেকে পলির বদলে নেমে এসেছিল নোনা জলের একটা বিষাক্ত ঢেউ।

“চাল কোথায়, বাবা?”
“আমার চোখের সামনে ধানগোলা খালি হয়ে গেল,” বলেছিল নীলকমল।
সেই রাতে সে চলে গেল। কেউ জানে না কোথায়। কেউ খোঁজও করেনি। পার্বতী জানত, সে আসবে না।

চরে বালির তলায় ডুবে থাকা মা, খিদের মাঝে কাতর ছোট ভাই আর একটা সোঁদা নদী—এই ছিল তার সংসার।

একদিন সকালবেলায় সে ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে ছেলেটা গলা নামিয়ে বলল, “দিদি, আজ আমার স্বপ্নে একটা কলা এসেছিল।”

পার্বতী তখন জানত, কলা নয়, এখন স্বপ্নও বিলাসিতা।

নিরুর গল্প একটু অন্যরকম। মেঘনার পাড়ের এক গ্রামে জন্ম, যেখানে প্রতিটি ঘরেই বাঁশের তৈরি মাচা ছিল, আর উঠোনজোড়া কচুরিপানার গন্ধ।
তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন নিরু, তার চোখে ছিল শালিকের মতো টানা টানা স্বপ্ন। তার মা বলত, “বড় হয়ে মেয়ে হবি না, হবি পাখি।”
কিন্তু খিদের দিনগুলোয় পাখি হবার স্বপ্ন উড়ে যায় নেমে আসা মৃত্যুতে।

প্রথমে বড় ভাইটা গেল—কথা বলত না, শুধু পানির কলের নিচে বসে থাকত। তারপর মেজ ভাইটা—ভাত চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পিটুনি খেয়ে মরল।
সর্বশেষ ছোট ভাইটা—মেঘনার জলে মুখ রেখে বলেছিল, “আমার পেটটা জল খায় না, বোন। ভাত চাই।”

তখন নিরু বুঝেছিল—মেয়ে, পাখি বা বোন—সব পরিচয় হাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা খিদের ঘ্রাণ।

তিনদিন পরে সে বেরিয়ে পড়েছিল, গন্তব্য অজানা।

এভাবেই তিনটি নদীর তিনটি মুখ, তিনটি খিদের শরীর নিয়ে চলে এসেছিল কল্যাণপুরের এক ত্রাণশিবিরে।
শিবিরটা ছিল একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে, চারপাশে কাঁটাতারের ঘের, কাঠের খুঁটি গাঁথা, আর মাঝখানে একটা চায়ের কেতলি ঝুলছিল লোহালক্কড়ের চুলায়—যার নিচে কোনো আগুন ছিল না।
সেখানে রোহিমা এসে বসেছিল চুপচাপ।
পার্বতী এসে হাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাইয়ের নাম ডাকছিল ফিসফিস করে।
নিরু একটা পুরনো পাতা কুড়িয়ে তাতে নিজের নাম লিখছিল আঙুল দিয়ে—যেন এইভাবে নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সে এখনও আছে।

তারা তখন একে অপরকে চেনে না। কিন্তু বাতাসের গন্ধ, শরীরের কাঁপুনি, আর ভাঙা শব্দের ভিতর দিয়ে তারা অনুভব করছিল—এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, শুধু তারা।

তিনটি নদীর স্রোত এই ত্রাণশিবিরে এসে একটাই নাম ধারণ করেছিল—ক্ষুধা।

আর সেই ক্ষুধার নিচে চাপা পড়া ভালোবাসা, শরীর, মাতৃত্ব, স্বাধীনতা—সবই তখন ছিল অক্ষরহীন, তবু প্রবল।

ত্রাণশিবিরে সকাল আসে না—যা আসে, তা এক ধরনের নরম কুয়াশার ভেতর গুমরে থাকা শব্দহীনতা।
চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, আজও খাবার নেই। কেউ হয়তো ঢুলে পড়বে লাইনে দাঁড়িয়ে, কেউ হয়তো মাটি খুঁড়বে আঙুল দিয়ে, এই আশায় যে নিচে লুকিয়ে আছে ভাতের দানা।
এই ছিল কল্যাণপুর ত্রাণশিবিরের প্রতিদিন।

রোহিমা এক কোণে বসে ছিল, হাঁটু মুড়ে, পেট চেপে ধরে।
তার ভিতরটায় কেউ যেন হাতুড়ি চালাচ্ছে ধীরে ধীরে।
ভিতরে অনাগত সন্তান, বাইরে অবাঞ্ছিত ক্ষুধা।
এক বয়স্কা নারী তাকে বলেছিল, “বোন, ঘুঁটে শুকিয়ে খেয়েছি আমি, এই দুনিয়ায় খিদের চাইতে বেশি অপমান কিচ্ছু নেই।”

রোহিমা কথা বলেনি।
সে জানত, অপমান খিদের মতো নয়। অপমান চোখে পড়ে, খিদে শরীর ছিঁড়ে যায়।

পার্বতী তখনও মুখ খুলত না বেশি। সে একটা লাঠির খোঁচায় চারপাশ খুঁটে খুঁটে দেখত—মাটি কোথায় একটু নরম।
তার ছোট ভাইটার অভ্যেস ছিল—মাটির নিচে কচু খোঁজা।
পার্বতী সেটা এখন নিজের শরীরে ধারন করেছে।

সে জানে না কেন, একদিন একটা কাঁকর খুঁড়ে সে বের করল একটা আধপোড়া চালের দানা।
এক মুহূর্ত থেমে সে সেটা মুখে পুরে নিল।
তেমন কিছু নয়, শুধু ছাইয়ের স্বাদ।
তবু তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
এতটা সময় পরে চুলার গন্ধ!
তবে সেটা কোনো চুলার নয়, সম্ভবত আগের কোনো লাশ পোড়ানোর আগুন।

নিরু একসময় চুপচাপ ঘুরে ঘুরে দেখে কে কোথায় বসে, কার গায়ে কী কাপড়, কে কাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমায়।
তার কাছে এগুলো ভাষা।
সে কারো নাম জানে না, শুধু চেহারা।
কেউ হলে-চোখের, কেউ শেওলা-মুখের, কেউ কাঁটা-হাতের।

নিরু এসব নামেই ডাকে, নিজের মনে।
সে খাতার পাতা পায় না। পায় না শালিক, কিংবা পাতাঝরা শব্দ।

সে শুধু নিজের দুই হাতকে দেখে ভাবে, এই হাত দিয়ে একদিন সে মেঘনার ওপর নৌকো চালিয়েছিল, আর আজ এই হাত দিয়ে কুকুরের গলা থেকে তুলে নিয়েছে একটা ছেঁড়া রুটি।

একদিন রোহিমাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল,
“তোমার পেটে যে আছে, সে যদি ছেলে হয়?”
রোহিমা তাকিয়ে বলেছিল, “তাহলে আমি আবার কাসেমকে দেখব।”
“আর যদি মেয়ে হয়?”
রোহিমা মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, “তাহলে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাব। নদীর মতো বয়ে যাব, থামব না।”

সেই প্রথম তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল—আলাদা নদীর দুই ধারে বসে থাকা, কিন্তু একই ক্ষুধায় জর্জর এক বেঁচে থাকা।

ত্রাণ বিতরণ এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল।
চাল আসেনি—এই অজুহাতটা পুরনো হয়ে গেছে।
তবু মানুষ লাইন করে দাঁড়ায়।
একদিন একটা ট্রাক এল—তার মধ্যে কিছু ভাঙা কঞ্চি, কিছু পোড়া কাগজ, আর একটি আধা খোলা টিনের ড্রাম।

লোকে হুড়োহুড়ি করল, রোহিমা ততক্ষণে উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
পার্বতী তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই থাক। আমি গিয়ে দেখি।”

টিনের ড্রামের মধ্যে ছিল ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট—শুকনো ভাতের মতো, কিন্তু কাদার মতো গন্ধ।

পার্বতী সেই পঁচা খাদ্য থেকে হাত ভরে একটা থালা বানাল, রোহিমার সামনে রাখল।
রোহিমা তখন বলল না কিছু, শুধু খেয়ে ফেলল সবটা—চোখে জল নামল না, কারণ শরীর জলে তখন সাড়া দেয় না।

নিরু দূর থেকে দেখছিল। সে আবার নিজের আঙুল দিয়ে মাটি ঘষে, আর নিজের নাম লেখে।

N-I-R-U
তারপর সেটার ওপর থুথু ফেলে মুছে দেয়।

“নাম দিয়ে কী হবে, যখন আমি আসলে একটা মাটি খাওয়া মেয়ে হয়ে গেছি?”—এটাই ছিল তার নিরুত্তর চিৎকার।

সন্ধ্যা নামলে, তিন মেয়েই এক কোণে এসে বসে।
তাদের মধ্যে কেউ গান গায় না, কেউ কাঁদে না, কেউ খুশি হয় না।
তবু কিছু একটা তৈরি হচ্ছে—এক অদ্ভুত বন্ধন।

একদিন নিরু হঠাৎ বলল, “আমরা যদি তিনজন মিলি, নদীর মতো, তবে কী হয়?”
রোহিমা জবাব দিল, “তবে আমরা মাটি ভাসাতে পারি।”
পার্বতী বলল, “তবে আমরা একদিন শিবির ভাঙতে পারব।”

সেই রাতে তারা তিনজন প্রথমবার হাত ধরল।
তিন নদী, একসঙ্গে।
ভাসমান নয়—এবার বাঁধ ভাঙার জন্য।

ত্রাণশিবিরে একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা যেত ভোরবেলা—একধরনের থালা ছুঁয়ে যাওয়া কর্কশ ঘর্ষণ, যার অর্থ ছিল: “আজও কিছু নেই।”
তারপর মানুষের কণ্ঠে কাঁপা, ভাঙা হাহাকার:
“একটা মুঠো ভাত… একটু ছাতু… কিছুও না…?”

তিনজন নারী—রোহিমা, পার্বতী, নিরু—তারা প্রথমে এই হাহাকারে নিজেদের ডুবিয়ে দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝে গেল, এই শিবিরে ক্ষুধা আর লজ্জা একই শরীরে থাকে।
ক্ষুধা চিৎকার করে বলে, “খেতে দাও।”
আর লজ্জা কানে কানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি নারী, মুখ খুললে তুমি অশালীন।”

শিবিরের একটি কোনায় একবার একটা বৃদ্ধা মেয়ের গায়ে আঁচল টেনে দিয়ে বলেছিল,
“সামলে চল মা, এতদিন বাঁচলি, এবার নামটা রেখে মর।”

নিরু সেটা শুনে ত্রিশূলের মতো দাঁড়িয়ে বলেছিল,
“যার পেট খালি, তার গায়ে কাপড় ধরে না।”

সেই দিনের পরে নিরু একরকম উন্মাদ হয়ে উঠল—সে আর মাথা ঢাকত না, চোখ নিচু করত না, কারো পায়ের ফেলে দেওয়া চাল কুড়িয়ে নিতে লজ্জা পেত না।

একবার কেউ বলেছিল, “এই মেয়েটা ঠিক পাগল।”
রোহিমা ফিসফিস করে বলেছিল, “না, সে আমাদের গলা।”

পার্বতী তখন এক ধরনের ভেতরের কাঠিন্যে বদলে যাচ্ছিল।
একটা ঘটনা তাকে বদলে দিল।

শিবিরে নতুন আসা এক যুবতী একদিন গোপনে শোনাল,
“ওপারের বাগানে সাহেবদের কিছু চাল এসেছে। তবে বিনিময়ে কিছু চাই। মেয়েদেরই যেতে হয়।”

এই “কিছু” মানে কী, সেটা আর কাউকে বোঝাতে হয় না।
ক্ষুধা যখন দরজা খোলে, তখন নারীত্ব দরজার বাইরে ফেলে আসতে হয়।

পার্বতী চুপচাপ শুনেছিল, তারপর একদিন অন্ধকারে সেই বাগানের দিকে হাঁটতে দেখা গেল তাকে।

সে ফিরেছিল পরদিন সকালে। চোখ লাল, পায়ে কাঁটা, মুখে এক ফোঁটা কথা নেই।

নিরু জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই গেছিলি?”
পার্বতী তাকিয়ে বলেছিল, “না। আমি শুধু দেখতে গেছিলাম—যারা দেয়, তারা কেমন করে দেয়।”

তিনদিন কিছু খায়নি সে।
তিনদিন কেবল একটা প্রশ্ন তার ভিতরে ঘুরেছে—
“খিদে মানেই কি দেহ?”

চতুর্থ দিন সে নিজের কোমর থেকে আঁচল খুলে ফেলল।
বলল, “যা বাকি ছিল, তা-ও দিলাম হাওয়াকে। এখন শুধু আমি আছি।”

সেই সন্ধ্যায় তিনজনে মিলে একটা গর্ত খুঁড়েছিল।
ভেবেছিল, যদি কাল না বাঁচি, অন্তত এইখানে শুয়ে যাব একসঙ্গে।

রোহিমা বলেছিল, “আমার পেটের সন্তানটাও এখানেই থাকবে, হয় বাঁচবে, নয় মরবে আমাদের সঙ্গে।”

কিন্তু সে রাতে হঠাৎ সব বদলে গেল।
বৃষ্টি এল—হঠাৎ করে, অঝোর, ধুয়ে দেওয়া সবকিছু।

শিবিরের মানুষজন পলিথিনে, পাটি দিয়ে শরীর ঢাকল।
তিন মেয়ের কেউ কিছু ঢাকল না।

তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টির নিচে—
এ যেন তাদের উপর ছুঁড়ে দেওয়া লজ্জা, দারিদ্র্য আর অসহায়তার বিরুদ্ধে প্রকৃতির তরল প্রতিশোধ।

এক বৃদ্ধ লোক বলেছিল,
“এই মেয়েগুলো এখন আর মেয়ে না। এরা ক্ষুধার গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি পাহাড়।”

পরদিন সকালে তারা একটা সিদ্ধান্ত নেয়।
তারা আর অপেক্ষা করবে না।
যেখানে রেশন আছে, তারা যাবে।
যেখানে সাহেবদের গোডাউন, সেখানে গিয়ে চেয়ে বলবে না, “দাও”, বরং বলবে, “এটা আমাদের।”

রোহিমা বলেছিল, “আমার গর্ভের সন্তান পেটের ভিতর শোরগোল করছে। যদি সে জন্মায়, তাকে আমি কী বলব? তুমি এক বিধবা মায়ের সন্তান? না, তুমি এক সংগ্রামীর পেট থেকে এসেছ?”

নিরু বলল, “আমরা যদি এখন না যাই, তাহলে যেদিন খাবার আসবে, আমরা থাকব না।”

পার্বতী বলল, “তবে চল। আজ থেকে আমরা আর ভিখিরি নই। আজ থেকে আমরা নদী।”

তিনটি নারী, তিনটি নদী, তিনটি ক্ষুধার দেহ নিয়ে, হাঁটতে শুরু করল সেই দিকে—
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল খিদের প্রাচীর।
তারা জানত, এই পথ হয়তো তাদের ফাঁসিতে নিয়ে যাবে।
কিন্তু তারা হাঁটছিল, যেন একেকটা শব্দহীন পদক্ষেপে তারা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অবহেলিত লিপিটিকে নতুন করে লিখছে।

শিবিরের গন্ধ পেছনে ফেলে তারা যখন হাঁটছিল, তখন সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল। রোহিমা, পার্বতী, আর নিরু—তিনজনেই জানত, তারা কেবল কিছু চাল নিতে যাচ্ছে না, তারা যাচ্ছিল অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করতে।
এই পথ ছিল শুশুক-চোখের মতো নিস্তব্ধ, কাঁকর ছড়ানো, থেমে থাকা হাওয়া, কিন্তু তাতে লুকিয়ে ছিল গর্জনের শব্দ—তিন নারীর হৃদস্পন্দনের মতো।

চাল যে জায়গাটায় জমা আছে, তাকে গোডাউন বলা হয়, কিন্তু মানুষ জানে সেটা সাহেবের গুদাম—পেট ভর্তি করার নয়, পেট খালি রাখার জায়গা।
জায়গাটায় খাড়া ইটের দেওয়াল, লোহার গেট, আর দুটো লাঠিধারী প্রহরী।
কিন্তু এই তিনজন নারীর কাছে ওই দেয়াল ছিল না, ওই লাঠি ছিল না—তারা শুধু দেখেছিল চালের গন্ধ।

রোহিমার নাক প্রথমেই চমকে উঠল।
“তুই পাচ্ছিস?” সে বলল পার্বতীকে।
পার্বতী মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, ভেজা চাল, যেন আগুনে পোড়াবার অপেক্ষায় আছে।”
নিরু বলল, “আমি ঘ্রাণ দিয়ে বুঝি, এর মধ্যে সাড়ে সাত মণ চাল আছে।”

ওই সময় আর যাই হোক, তারা বুঝে গিয়েছিল—ক্ষুধা এখন আর কেবল না পাওয়া নয়, ক্ষুধা এখন দখলের যুক্তি।

প্রহরীদের একজন এগিয়ে এল।
“কোথা থেকে এসেছ?”
রোহিমা বলল, “কল্যাণপুরের ত্রাণশিবির থেকে। শোনেছি, চাল জমা আছে।”
লোকটা ঠোঁট চেপে বলল, “ত্রাণ নিতে হলে সাহেবের সই লাগবে।”

পার্বতী বলল, “আমরা সই আনতে আসিনি। আমরা চাল আনতে এসেছি।”

প্রহরীর মুখ শক্ত হয়ে গেল।
“তোমরা নারীরা বেশি মুখ খুলছো আজকাল।”

নিরু এক পা এগিয়ে এল।
তার চোখ তখন এমন, যেন সেই চোখ দিয়ে লাঠির আগা ভেঙে ফেলা যায়।

“নারী যখন আর মাংসের জিনিস থাকে না, তখন চোখ দিয়েই দেয়াল ভাঙে।”
এই কথাটা এমনভাবে বলল সে, যেন শব্দগুলো বেরিয়ে এলো পেটের গভীর থেকে, নাড়ি ছিঁড়ে।

প্রহরীরা প্রথমে ঘাবড়ে গেল।
কিন্তু তারপর তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
“আরও কথা বললে, ধরে পাঠিয়ে দেব সেলেতে। সাহেবরা নারীদের বেশি কথা সহ্য করে না।”

রোহিমা তখন তার পেটের ওপর হাত রেখে বলল,
“আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে বলে, আমি ভয় পাই না।”

এমন সময় পেছন থেকে আর কয়েকজন নারী এগিয়ে এল।
তারা ছিল শিবিরের অন্য প্রান্তের।
তারা শুনে ফেলেছিল রোহিমাদের পরিকল্পনা, কেউ কেউ চুপচাপ অনুসরণ করেছিল।

তারা কেউ কিছু বলেনি, শুধু রোহিমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
একজন বলল, “চাল যদি পচে, সে চাল অভিশাপ। আমরা সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।”
আরেকজন বলল, “যতদিন নারীরা নিজের মুখে না বলে, ‘আমার পেট খালি’, ততদিন পৃথিবীর বুকে ভাতের রূপ নেই।”

প্রহরীরা এবার ভয় পেতে শুরু করল।
একজন গেট বন্ধ করতে গেল, তখন নিরু লাফ দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা হয় গেট খোলো, নয় আগুন পাবে।”

পার্বতীর হাতে তখন শুকনো খড়।
সে জানে, চাল যেমন পেট ভরে, আগুন তেমনি চোখ খুলে।

শেষ পর্যন্ত সাহেবের ক্লার্ক এসে হাজির হল।
সে ইংরেজিতে ফিসফিস করল প্রহরীদের, তারপর বাংলায় বলল,
“তোমরা এত জোরে কেন আসছো? এভাবে তো কিছু পাওয়া যায় না।”
রোহিমা জবাব দিল,
“আমরা ভিক্ষা করতে আসিনি। আমরা নিতে এসেছি। এই চাল আমাদের জন্য বরাদ্দ, শুধু আমাদের হাত অবধি আসেনি।”

ক্লার্ক বলল, “কাগজ কোথায়?”
নিরু বলল, “আমাদের হাড় কাগজ, আমাদের চোখ সাক্ষ্য, আমাদের রক্ত সাক্ষর।”

সেই মুহূর্তে, গোডাউনের ফটকের বাইরে আরও মানুষ জমতে শুরু করল—নারী, শিশু, বৃদ্ধ—যারা মুখে কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে তিন নারীর দিকে।

রোহিমা পা এগিয়ে বলল,
“গুদাম খুলতে হবে। নইলে আজকের দিন দিয়ে ইতিহাস শুরু হবে, যার নাম হবে ‘নারীর ক্ষুধা।’”

অবশেষে চাপা ভয়ে ফটক খুলে দেওয়া হল।

তিন মেয়ে একসঙ্গে ভিতরে ঢুকল।
চাল ভাগ করে নিল না, বরং বাইরের অপেক্ষমাণ মুখগুলোর হাতে হাতে তুলে দিল।

কেউ বলল, “তোমরা পাগল।”
নিরু বলল, “না, আমরা মানুষ। খিদের চেয়ে বড় কিছু নেই।”

সেই রাতে কল্যাণপুরের শিবিরে কেউ চুপ করে ঘুমায়নি।
তিন মেয়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাদের বলা হল—“চালের মেয়েরা”, কেউ বলল “অগ্নিকন্যা”, কেউ বলল “রক্তের নদী।”

কিন্তু তারা নিজেদের শুধু একটাই নাম দিল—
“আমরা, তিন নদীর মেয়ে—যারা আর কোনওদিন চুপ থাকবে না।”

কল্যাণপুরের শিবিরে সেই রাতে আগুন লাগেনি, তবু আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আলো।
চালের ফটক ভেঙে বেরিয়ে আসা মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকেই বুঝে গিয়েছিল—এই নারীরা আর আগের মতো নেই।
তারা এখন চুপ করে ভাত না পাওয়া মানুষ নয়, তারা ভাতকে মুখ তুলে বলেছে, “তুই আমার অধিকার।”

রোহিমা সে রাতে নিজের শরীরটাকে খুঁজছিল।
একটু চাল গরম করে খাওয়ার পর সে পেটের ভেতর সন্তানের নড়াচড়া টের পেল।
তিনদিন পর, প্রথমবার।

সে মাটিতে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হল, গঙ্গার ঢেউ এসে তার পেটের কাছে থেমে আছে, যেন কিছু একটা বলছে—
“তুমি আজ শুধুই মা নও, তুমি আগুনের উৎস।”

পার্বতী দূরের এক কোণায় একটা মাটির ঢিপির পাশে বসেছিল।
সেখানে আগে দুটো শিশু মরেছিল, যাদের নাম কেউ জানত না।
পার্বতী কাঁধে এক ফালি কাপড় জড়িয়েছিল, চোখে জল নেই, ঠোঁটে একটা হাসি।

“দিদি, হাসছো?” নিরু জিজ্ঞেস করেছিল।
পার্বতী বলেছিল, “আমি ভাবছি, আমার ভাইটা বেঁচে থাকলে আজ এই ভাতের গন্ধ পেত।”
তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, “আমি মনে মনে ওকে ডাকছি—ভাই, আয়, আমি আজ মাটি থেকে ভাত তুলে এনেছি। তুই না খেয়ে মরিস না।”

নিরু কিছু বলল না।
সে সেই পলিথিনের নিচে বসে একটা পাতা কুড়িয়ে তাতে আঙুল দিয়ে লিখছিল—
ভাত, স্বপ্ন, বাঁচা, রেনু, পার্বতী, নিরু।

শিবিরের একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল পরদিন—
মেয়েরা একে অন্যকে খুঁজছে, বলছে,
“রোহিমা কোথায়?”
“পার্বতীকে দেখেছো?”
“নিরু কি আজও কবিতা লেখে?”

অদ্ভুতভাবে তিনজন নারী হয়ে উঠল শিবিরের চেতনার কেন্দ্র।

বাচ্চারা বলতে লাগল, “তারা নাকি চাল আনতে সাহেবদের গায়ে থুতু দিয়েছে!”
কেউ বলল, “তারা তো আসলে মা দুর্গা!”
আর একজন বৃদ্ধ বলল, “দেখেছো? একমুঠো ভাত কীভাবে একফোঁটা স্বপ্ন হয়ে যায়!”

রোহিমা সেই দিন একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল।
তার শরীরে ভার, পেট বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত শান্তি।
সে একটা জায়গায় থেমে, মাটিতে বসে, বলল,
“আমার পেটের সন্তান একটা দেশ চায়—যেখানে কেউ একমুঠো চালের জন্য মরবে না।”

একজন মহিলা, যার গায়ে ছেঁড়া শাড়ি, এসে বলল,
“তুমি মায়ের মতো বলছো।”
রোহিমা হেসে বলল, “আমি মা হব, কিন্তু তার চেয়ে বড় আমি একজন নারী—যে চুপ থাকবে না।”

সেই দিন থেকে শিবিরে এক ছোট রান্নাঘর তৈরি হয়।
সেই ঘরে মাটির উনুনে দুবেলা একটু ছাতু আর ভাত রান্না হয়।
তিন মেয়ের নেতৃত্বে কিছু মানুষ ত্রাণ কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভাষায় দাবি জানাতে শুরু করে—
“আমরা ভিক্ষুক নই, আমরা নাগরিক।”

এ যেন এক নিরব অভ্যুত্থান।
মেয়েরা বলছে, “ছেলে-মেয়ে ভেদ নেই, খিদে আমাদের এক করে দিয়েছে।”

নিরু একদিন সেই রান্নাঘরের কড়িতে বসে বলে ফেলল,
“এইখানে আমি একদিন গান লিখব। নাম হবে— ‘ক্ষুধার গান’।”
পার্বতী হেসে বলল, “তোর গানের কথা হবে—‘ভাত খেতে চেয়েছিলাম, মানুষ হয়ে উঠলাম!’”

তারা হেসেছিল, একসঙ্গে।

শিবিরে অনেকদিন পর হাসি ফিরেছিল।
এক চিমটে নুন, একমুঠো চাল, আর একফোঁটা স্বপ্ন মিশে তৈরি হয়েছিল এক অভাবী জ্যোৎস্না।

সেই রাতে, রোহিমা এক পাশে ঘুমিয়ে ছিল।
পেটের মধ্যে সন্তানের নড়াচড়া যেন ঘুম ভেঙে দিচ্ছিল বারবার।
সে উঠল, চাঁদের আলোয় পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই যদি ছেলে হস, তুই বিদ্রোহ করবি।
তুই যদি মেয়ে হস, তুই নিজের চাল নিজে আনবি।”

হাওয়ার গায়ে যেন কেউ কানে কানে বলল—
“এই জাতির জাগরণ শুরু হলো নারীর পেট থেকে।”

ভোরের আলো যখন শিবিরের কাঁটাতারে মুখ ঘষে ঢুকছিল, তখন রোহিমার শরীর কেঁপে উঠছিল অন্য এক আলোয়—যেটা সূর্যের নয়, মাতৃত্বের।
তার শরীরে ব্যথার ঢেউ উঠছে নিচ থেকে, যেন এক নদী ক্রমশ বাঁধ ভাঙছে ভিতর থেকে।
শিবিরের অন্যান্য নারীরা ভেবেছিল, সে হয়তো আবার খিদের কষ্টে কাতর।
কিন্তু নিরু আর পার্বতী জানত—আজ অন্য রকম দিন।
আজ রোহিমা একজন নারীর চেয়ে বেশি, সে আজ একজন নব-সৃষ্টির দেবী।

“শুরু হয়েছে,” ফিসফিস করে বলল নিরু।
পার্বতী চট করে কয়েকটা কাপড় জোগাড় করতে দৌড়ল।
নিরু একবার ঘরকুনো সেই বৃদ্ধা জয়ন্তী মাসির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আছো তো?”
জয়ন্তী মাটি থেকে মুখ তুলল না, শুধু বলল, “এই হাতে চারটে সন্তান টানছি বাইরে। পঞ্চমটা হয় তো ইতিহাসের।”

শিবিরের একটি পুরনো তাঁবুর আড়ালে তৈরি হল এক অস্থায়ী প্রসবকক্ষ—নেই সেলাইন, নেই কাঁচা গরম জল, নেই জীবাণুনাশক, নেই তত্ত্ব—
আছে কেবল তিনটি নারীর চোখে অদ্ভুত এক জেদ।

রোহিমা বিছানার ঘাস আঁকড়ে ধরে শ্বাস নিচ্ছিল,
তার চোখে জল নয়, ঠোঁটে শব্দ নেই, কিন্তু ভিতর থেকে সে ফিসফিস করছিল,
“তুই আস… তুই আলো নিয়ে আয়…”

ঘণ্টাখানেক চলল নিঃশব্দ যুদ্ধ।
শুধু মাঝে মাঝে চাপা গোঙানির শব্দ, আর রক্তজলের গন্ধ।

তারপর—একটা কাঁপা শব্দ,
একটা শিশুর কান্না।

এই কান্না শিবিরে প্রথম কেউ থামাতে চাইল না।
এই কান্না যেন হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ল।

এক বৃদ্ধ বলল, “এই প্রথম মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ডেকেছে।”
এক কিশোরী বলল, “এই শিশুই বুঝি আমাদের আশ্রয়।”

নিরু কাঁপা হাতে শিশুটিকে তুলে আনল, বলল,
“মেয়ে। আর কী সুন্দর চোখ।”
পার্বতী বলল, “এই চোখ দেখলে কেউ আর পেটের ক্ষুধা মনে রাখবে না। সে ভাববে, এই চোখেই একটা নতুন দেশ লুকিয়ে আছে।”

রোহিমা ক্লান্ত দেহে তাকিয়ে বলল,
“ওর নাম রাখো ‘জাগরণ’।”

নিরু কানে কানে বলল,
“জাগরণ। তিন নদীর স্রোত দিয়ে তৈরি এক মেয়ে।”

সেই দিন কেউ ভাত চায়নি, কেউ চাল মেপে খায়নি,
শুধু মেয়েরা একে একে এসে রোহিমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

একজন বলেছিল, “আমারও একসময় সন্তান হয়েছিল… কিন্তু…”
আরেকজন বলল, “এই শিবিরে এতদিন পর, কেউ নতুন হয়ে উঠল।”

শিবিরে জন্মদিন পালন করার কোনও নিয়ম ছিল না।
কিন্তু সে দিন প্রথমবার,
রাতের খাবারে একবাটি ভাতের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কে যে দিয়েছিল, কেউ জানত না।
হয়ত সেই ক্লার্ক, কিংবা গুদামের পাহারাদার, কিংবা একজন বিধবা যার নাম কেউ জানে না।

রোহিমার চোখে ছিল চরম শূন্যতার ভিতর এক বিন্দু আলো।
সে ফিসফিস করে বলেছিল,
“আমার মেয়েটা একদিন জিজ্ঞেস করবে, তুমি কী করে আমাকে জন্ম দিলে?”
আমি বলব, তিন নদীর ভাঙন বেয়ে, আমি শুধু তোমার পথ খুলে দিয়েছিলাম।

পার্বতী আর নিরু তখন একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল জানালার পাশে।
নিরু বলল,
“আজ শিবিরের ভিতর থেকে আলোর জন্ম হলো।
কাল এই আলো বাকি সব দেয়াল ভেঙে দেবে।”

পার্বতী বলল,
“তিন মেয়ের গল্পে এখন একটা নতুন পৃষ্ঠা জুড়ল—জাগরণের পৃষ্ঠা।”

জন্ম শুধু শরীরের মধ্যে ঘটে না, জন্ম এক সমাজের ভিতরেও হয়।
জাগরণ নামের শিশুটির কান্না যেন শিবিরের পাথরকুচি হৃদয়কে ভিজিয়ে দিয়েছিল।
এমনকি যারা চুপচাপ গলায় কাপড় জড়িয়ে বসে থাকত, তারা সেই কান্না শুনে চোখ তুলেছিল, মনে মনে বলেছিল,
“এটা শুধু বাচ্চার কান্না নয়, এটা আমাদের নিজের না-পাওয়া ভাতের চিৎকার।”

কিন্তু যখন নিচু মাটিতে আলো জ্বলে, তখন উঁচু প্রাসাদে তার ছায়া পড়ে।
আর সেই ছায়া দেখেই সাহেবদের মিটিং ডাকা হয়।

কল্যাণপুর ত্রাণ শিবির নিয়ন্ত্রণ করত স্যামুয়েল বার্ক নামের এক সাহেব—ঠোঁটে চিরকালীন সিগার, হাতে ছড়ি, চোখে অবহেলার ছায়া।
সে চুপচাপ অফিসে চিঠির ফাইল দেখছিল, আর রিপোর্ট পড়ছিল—
“শিবিরে নারীরা নেতৃত্ব নিচ্ছে।”
“ত্রাণ গোডাউন ভাঙা হয়েছে, অভিযানে মেয়েরা জড়িত।”
“নারীরাই আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।”

স্যামুয়েল বলল,
“এই নারীগুলো ভুলে যাচ্ছে, এরা অনুদানের যোগ্য, দাবি করার নয়।”

সেই মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় দোভাষী হেমচন্দ্র সাহা সাহস করে বলল,
“স্যার, তারা দিন দুয়েক খাবার ছাড়া ছিল… সেই কারণে হয়তো…”
স্যামুয়েল চেয়ারের হাতল ঠোকা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“আমরা দান করি, ভিক্ষা নয়। যদি তারা আইন হাতে তুলে নেয়, তাহলে আইন দেখাতে হবে।”

পরদিনই শিবিরে একটি নোটিশ টাঙানো হলো—

“ত্রাণ বিতরণ কেবল নির্দিষ্ট রেজিস্টারভুক্তদের জন্য।
সভা-সমিতি, সংগঠন, বা নারীদের একত্রে জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ।
অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শিবিরে সেই পোস্টার এল আগুনের মতো, কিন্তু কেউ ভয় পেল না।
রোহিমা জাগরণকে কোলে নিয়ে তাকিয়ে থাকল।
“আমার মেয়ের সামনে ভয় দেখালে, আমি ছায়া সরিয়ে দেব,” বলল সে।

পার্বতী পোস্টারের নিচে মাটিতে লিখে রাখল,
“আমরা রেজিস্টারে নেই, আমরা ইতিহাসে আছি।”

নিরু সেই কাগজ ছিঁড়ে একটা ঘুড়ির মতো বানিয়ে বলল,
“আমরা যদি আকাশে উড়ি, সাহেবরা কোন তালিকায় নাম খুঁজবে?”

শিবিরের মানুষজন প্রথমবার চুপ থাকল না।
নারীরা বলল,
“ভিক্ষা চাইনি, অধিকার চেয়েছি।”
পুরুষরা বলল,
“এই মেয়েগুলোর মতো সাহস আমাদের কোথা থেকে আসবে?”

সাহেবদের ভয় বাড়ছিল।
এক ক্লার্ক বলল,
“স্যার, এরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, মেয়েরা ছেলে হয়ে উঠেছে।”
স্যামুয়েল বলল,
“তাহলে এবার ওদের মা হয়ে ঠান্ডা করতে হবে—চুপ করিয়ে দিতে হবে।”

পরদিন গভীর রাতে শিবিরে ঢুকল কিছু সাদা পোশাকে লোক।
তাদের হাতে তালিকা, চোখে অবজ্ঞা।
তারা এসে দাঁড়াল রোহিমার তাঁবুর সামনে।
“তোমার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে,” বলল এক অফিসার।
“তোমার ত্রাণ বন্ধ। তোমার ছায়াও শিবিরে নিষিদ্ধ।”

রোহিমা চুপ করে শুনল।
তার কোলে তখন ঘুমন্ত জাগরণ।
সে ধীরে বলল,
“আমার মেয়ে এখনও ঘুমিয়ে। আমি তার গায়ে হাত দিলে জাগে। তোমরা যদি সাহস করো, তাকে নিজে জাগিয়ে দাও।”

পুরুষেরা পিছিয়ে গেল।
এই এক মুহূর্তেই একজন মা গোটা শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল চুপ থাকা সাহেবি নীতির বিপরীতে।

রাতটা যেন পাহাড় হয়ে গেল।
কিন্তু ভোরের আলো যখন আসল, তখন তিন নারী, তিন নদী, আরও কয়েকজন মা এবং কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াল ত্রাণ কেন্দ্রে।
তারা একে একে বলল—
“আমাদের নাম কেটে দিতে পারো,
কিন্তু মাটি থেকে আমাদের ছিঁড়ে নিতে পারবে না।”

তালিকা থেকে নাম কাটা মানে শুধু রেশন না পাওয়া নয়, তা মানে অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।
যার নাম নেই, তার ঠাঁই নেই।
যার ঠাঁই নেই, তার প্রশ্ন করার অধিকার নেই।

রোহিমা, পার্বতী, নিরু—তাদের নাম আজ সরকারি রেজিস্টার থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।
তাদের পরিচয় এখন “উসকানিদাত্রী”, “ব্যবস্থা-বিরোধী”, “ত্রাণ অপদ্রব্য”।
তবে সেই দিন থেকে তারা হয়ে উঠল আরও দৃঢ়—তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের কণ্ঠস্বর।

সকালের আলো ছুঁতেই রোহিমা বেরিয়ে পড়ল কোলে জাগরণ নিয়ে।
তাঁবুর বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“যাদের নাম তালিকায় নেই, তারা আমার পাশে দাঁড়াও।”
একজন বৃদ্ধা এল, তার নাম ছিল চৈতী দাসী—যাকে গত সপ্তাহে তার বয়সের অজুহাতে ত্রাণ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চৈতী বলল, “আমার নাম ছিল না কখনও, আমি কেবল রাঁধতাম, এখন দাঁড়াব।”
তারপর এল একটি কিশোরী—নির্বাসিত বাবার মেয়ে, মায়ের মৃত্যুর পর হেঁটে চলে এসেছে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার।

“আমার নাম কখনওই ছিল না। এখন হবে, যদি তোমরা লেখো।”

এভাবে দাঁড়িয়ে গেল একে একে বারোজন মানুষ—যাদের কেউ মুখ চেনে, কেউ চেনে না; কিন্তু তারা সকলেই একটা বিষয়ে এক—তারা অস্বীকৃত, তারা মুছে যাওয়া ইতিহাস।

নিরু সেই মাঠে একটা খালি মাটির তালিকায় আঙুল দিয়ে নাম লেখাতে শুরু করল।
না কাগজে, না খাতায়—
মাটিতে,
মাটি দিয়ে।

পার্বতী একটা শুকনো বাঁশের চেরা দিয়ে বলল,
“এই তালিকা কেউ চুরি করতে পারবে না, কারণ এটা কেউ কাঁধে নিয়ে চলে না, এটা বুকের ভিতর থাকে।”

তারা নিজেদের জন্য ঠিক করল, তারা রেশন না পেলে, নিজেরা রান্না করবে।
যা আছে তা দিয়েই,
আঙুলে ভিজে চাল গুঁড়ো করে, তেঁতুলপাতা দিয়ে লবণ বানিয়ে।
চুলা পুড়বে না কাঠে, পুড়বে তাদের ভিতরের আগুনে।

সেই আগুন দেখে আরও অনেকেই আসতে শুরু করল।
সেই তালিকা থেকে কাটা নামেরা নিজেদের একটা নতুন নাম দিল—

“অদৃশ্য নামে যারা”

তারা বলে,
“আমরা যাদের ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল, তারা এখন ইতিহাস লেখার কলম।”
“আমরা গায়ে কাপড় না রাখলেও, আত্মসম্মানে ঢাকা।”
“আমরা চাল না পেয়ে, চাল হয়ে উঠেছি।”

একদিন নিরু একটা কবিতা লিখে শোনায়—

“আমার নাম কেটে দিয়েছিল তারা,
আমি নিজের নাম ছড়িয়ে দিলাম বাতাসে।
তারা বলেছিল, আমার পরিচয় নেই।
আমি বললাম—আমি ক্ষুধা।
আমাকে কে ভুলবে?”

স্যামুয়েল সাহেব রিপোর্ট পেলেন—
ত্রাণ না পেয়েও, নাম কাটা হয়েও কিছু মানুষ আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে।
তিনি বললেন,
“এটা বিপজ্জনক। আত্মনির্ভর মানুষ প্রশ্ন করে। প্রশ্ন মানেই সমস্যা।”

তাই শিবিরে আবার এক নোটিশ এল—
“নিজস্ব রান্না, সমাবেশ, সংগঠন নিষিদ্ধ। আইন ভঙ্গকারীরা বিতাড়িত হবে।”

রোহিমা হেসে বলল,
“তাদের সমস্যা চাল না পাওয়া নয়, সমস্যা হলো—আমরা চাল না পেয়েও মাথা উঁচু রেখেছি।”

পার্বতী বলল,
“এই মাটি থেকে যদি কেউ আমাদের তুলে দিতে পারে, তবে তারা সেই ঈশ্বর, যার কাছে আমরা আর প্রার্থনা করি না।”

সেই রাতে, অন্ধকারে,
তালিকা থেকে কাটা নামেরা মাটির মাঝে বসে ভাত রান্না করল।
খাওয়া শেষে তারা তিনটে শুকনো পাতায় তিনটা শব্দ লিখল—

রোহিমা। পার্বতী। নিরু।
তিনটা নাম, তিন নদীর মতো—
মুছে ফেলা যায় না, থামানো যায় না।

শিবিরের কাঁটাতারে সূর্যের আলো তখন কাঁচের মতো কাটছে।
তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষের চোখে তখন আর হতাশা নেই, বরং এক ধরনের দৃঢ়তা—যে দৃঢ়তা কেবল নিজেদের জীবনের দায় বুঝে ওঠা মানুষদের মধ্যে জন্মায়।
রোহিমা, পার্বতী, আর নিরু—তারা এখন আর কেবল তিনটা শরীর নয়, তিনটা প্রতীক হয়ে উঠেছে।
তবে প্রতীকের ভয় সাহেবরা বোঝে না, তারা বোঝে শুধু নিয়ন্ত্রণ।

স্যামুয়েল সাহেব চুপচাপ বসে ছিল অফিসের ঠাণ্ডা কামরায়।
তার সামনে রাখা ছিল তিনটে ছবি—রোহিমা, পার্বতী, নিরু।

একজন অফিসার বলল,
“স্যার, মেয়েগুলো এখন নায়ক হয়ে উঠছে।”
স্যামুয়েল সিগারেট ধরিয়ে বলল,
“তাহলে ওদের আঘাত করতে হবে—শরীরে নয়, মনে। এমন কিছু করতে হবে, যাতে তারা মনে করে, এগিয়ে আসা ভুল ছিল।”
অন্যজন বলল,
“তাহলে?”
স্যামুয়েল বলল,
“ওদের অস্তিত্বকেই লাঞ্ছিত করতে হবে। রক্ত চাই, যাতে বাকি সবাই ভয় পায়।”

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, যখন রান্নার গন্ধে শিবিরটা কিছুটা উষ্ণ লাগছিল,
তখন হঠাৎ চারজন লোক এসে রোহিমার তাঁবুর সামনে দাঁড়াল।
তাদের মুখ ঢাকা, হাতে লাঠি, চোখে নির্দয়তা।

একজন বলল,
“শুনেছি তুমি আইন ভেঙেছো।”
রোহিমা কিছু বলেনি।
সে কেবল জাগরণকে কোলে তুলে নিয়েছিল।

তারা রোহিমার মুখে আঘাত করল, তারপর পেটে।
জাগরণ কেঁদে উঠল, সারা শিবির জেগে গেল।
কিন্তু তারা থামেনি।
তারা গলা চেপে বলল,
“অধিকার চাও? এই নাও অধিকার!”

পার্বতী ছুটে এলো, নিরু লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেল।
কিন্তু আক্রমণকারীরা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে।

রোহিমার মুখে রক্ত, চোখে জল নেই।
সে ফিসফিস করে বলল,
“আমার শরীর আঘাত পেল, কিন্তু আমার ‘চাওয়া’ এখনও অক্ষত। আমার চাওয়া কেউ ছিঁড়তে পারে না।”

সেই রাতে পার্বতী ও নিরু তার পাশে বসে থাকল।
পার্বতী বলল,
“তারা আমাদের ভয় পায়, তাই আমাদের রক্ত চায়।”
নিরু বলল,
“আমাদের রক্তই ইতিহাসের কালি হবে।”

পরদিন ভোরবেলা, শিবিরের মাঠে একটি গাছের গায়ে লেখা ছিল—

“আমরা যারা রক্ত দিয়েছি, তারাই এখন লেখা হবে।
রোহিমার রক্ত এখন শুধু তার নয়, আমাদের সকলের।”

এইবার শুধু নারী নয়, পুরুষরাও এগিয়ে এল।

এক বৃদ্ধ বলল,
“আমি কিছুই করিনি এতদিন, আজ রোহিমার রক্ত দেখে মনে হল, আমি অনেক ছোট হয়ে গেছি।”
এক তরুণ বলল,
“আমার নাম যদি তাদের তালিকায় না থাকে, আমি নিজেই নিজের তালিকা লিখব।”

ত্রাণ দপ্তরে গিয়ে লোকেরা বলল,
“আমাদের চাল চাই না। আমাদের সম্মান ফিরিয়ে দাও।”
স্যামুয়েল সাহেব অবাক হয়ে দেখল—এইসব হাড্ডিসার মানুষজন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।
তাদের হাতে লাঠি নেই, কিন্তু তাদের মুখে এমন কিছু আছে যা সে চিনতে পারছে না।

তারপর সে জানল,
রোহিমা এখনও বেঁচে, এবং এখনো তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শত শত মানুষ।

সেদিন রাতে, নিরু মাটির ওপর আঙুল দিয়ে লিখল—

“অধিকার রক্তে লেখা হয়, আর সেই লেখা কেউ মুছতে পারে না।”

পার্বতী পাশে এসে বলল,
“আজ যদি আমরা মরি, তবু আমরা লিখে যাব—আমরা একদিন চেয়েছিলাম,
না ভিক্ষা,
না করুণা,
শুধু…
মানুষের মতো বাঁচতে।”

১০

শিবির এখন আর আগের মতো নেই।
যেখানে একদিন কেবল কুঁকড়ে থাকা মানুষ ছিল, সেখানে এখন ঘোরাফেরা করছে চোখে আগুনওয়ালা নারী, দাঁত-মুখ চেপে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ, বুক ফুলিয়ে প্রশ্ন করা কিশোর।
এ এক শিবির নয়, এ এক অনির্ধারিত অভ্যুত্থানের মঞ্চ।

রোহিমার রক্ত, পার্বতীর হাতের দাগ, নিরুর কবিতা—এই তিনে মিশে গেছে এক এমন তীব্রতা, যা কেবল ক্ষুধা নয়, এক অমোঘ তৃষ্ণা—স্বাধীন হয়ে ওঠার।

সেই ভোরে, যখন কুয়াশা নামছিল দিগন্তে, রোহিমা উঠোনে বসে রোদে গা দিচ্ছিল।
জাগরণ তার কোলের মধ্যে থুতনি রেখে ঘুমিয়ে।
রোহিমার শরীর এখনও দুর্বল, চোখে কালি, ঠোঁটে ফাটল।
তবু সে বলল,
“আমার মেয়েটাকে আমি নিয়ে যেতে চাই এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে সে রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে ভাববে না—সে মেয়ে বলে তার প্রাপ্য কম।”

পার্বতী বলল,
“তুই একলা যাবি না। আমরা সবাই যাব। এখন যে সময়, তাকে আর থামানো যাবে না।”

নিরু রাতভর এক কবিতা লিখছিল।
সে লিখেছিল—

তিন নদী ছিল,
তারা প্রথমে কাঁদত,
তারপর চুপ করত,
তারপর প্রশ্ন করত।
একদিন তারা থামল না।
সেদিন তারা বিদ্রোহ করল।

এই কবিতা ছড়িয়ে গেল মাঠের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে।

কারও ঠোঁটে এসে গুনগুন, কারও মনে জেগে উঠল নতুন ভাষা।
বিদ্রোহ আর কবিতা একসঙ্গে হাঁটছিল।

সাহেবরা দেখল—
শিবিরে কেউ আর গেটের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় না।
ত্রাণ না পেয়েও কেউ কাঁদে না।
বরং তারা নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে সব্জি লাগায়, পুরনো কাঁসার হাঁড়ি পুড়িয়ে রান্না করে, আর নিজের শিশুদের নাম রাখে “আলো”, “জয়”, “জাগরণ”।

স্যামুয়েল সাহেব রিপোর্টে লিখলেন—
“অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”

কিন্তু শিবিরের কেউ তখন আর নিয়ন্ত্রণ মানে না।
তারা বলছে—“আমরা নিয়ন্ত্রিত হব না, আমরা নিজেই পথ হব।”

তিন নারী তখন তিন মোড়লের মতো এক বৃত্ত তৈরি করেছে।
তাদের আশেপাশে বসে আছে নারী, পুরুষ, শিশু—
কেউ কিছু বলছে না, শুধু শুনছে।
রোহিমা বলল,
“আমরা কেউ রাজনীতি করিনি, শুধু একদিন ভাত চেয়েছিলাম।”
পার্বতী বলল,
“ভাতের বদলে লাঠি পেয়েছি।”
নিরু বলল,
“তাই আজ আমরা খালি হাতে দাঁড়িয়েছি—তবে মাথা উঁচু করে।”

সেদিন বিকেলে গোটা শিবির মিছিল করে এগোল সাহেবদের দপ্তরের দিকে।
কোনও স্লোগান নেই, কেবল চোখে সাহস।

প্রহরীরা কিছু বলতে পারেনি।
ক্লার্করা ভেতরে ঢুকে গিয়েছে।

সাহেব অফিসের জানালা থেকে দেখল—তিন নারী একসঙ্গে সামনে হাঁটছে।

রোহিমা সামনে, কোলে জাগরণ।
পার্বতীর হাতে ছিল মাটি।
নিরুর হাতে ছিল কবিতার ছেঁড়া পাতা।

তারা গিয়েছিল কিছু চাইতে নয়—তারা গিয়েছিল ইতিহাস বদলাতে।

সেই সন্ধ্যায় কল্যাণপুরের আকাশে এক অদ্ভুত আলো দেখা গিয়েছিল।
লোকজন বলেছিল—
“তিন নদী এক হয়েছে। এবার বাঁধ আর রইবে না।”

১১

সন্ধ্যার আকাশটায় সেদিন অদ্ভুত এক রঙ লেগেছিল—না পুরোপুরি কালো, না একেবারে সোনালি।
যেন মেঘের চাদরে ঢেকে রাখা কোনো অশ্রুপ্রবাহ, যা ঠিক কাঁদে না, তবু থামে না।
শিবিরের মানুষজন এই আকাশের নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, কারও কাঁধে সন্তান, কারও হাতে কাঁটা পড়া হাঁড়ির ছিপি, কারও ঠোঁটে চাপা ফুঁসুনির শব্দ।

এই আকাশের নিচেই তিনজন নারী হাঁটছিল—রোহিমা, পার্বতী, নিরু।
তারা ফিরছিল না কোনও বিজয়ের চিহ্ন নিয়ে, তারা ফিরছিল নিজেদের ভেতরের অতীত খুঁড়ে এনেওঠা এক ধরনের মুক্তি নিয়ে।

রোহিমা, যাকে শিবির আজ এক ‘মা’ হিসেবে চেনে,
সে রাতে পার্বতীর কোলে মাথা রেখে বলেছিল,
“আমি জানি না, আমি আদৌ এই মেয়েটার জন্য ঠিক মা কিনা। আমি তো খালি হাতে জন্ম দিয়েছি—না দুধ, না কাপড়, না ঘর।”
পার্বতী চোখের কোণে তাকিয়ে বলেছিল,
“তুই তাকে দিছিস সাহস। ও তোর দুধ নয়, তোর রক্ত খেয়েই বড় হবে।”

রোহিমা চোখ বুজে জাগরণকে কোলের দিকে টেনে নিয়েছিল,
তারপর নিচু গলায় বলেছিল,
“আমার মা একবার বলেছিল—‘মেয়ে হয়ে জন্মালে চোখ নিচু রাখবি, যাতে কান্নার জল গড়িয়ে না পড়ে।’
আমি আজ তার কথা ভেঙে দিচ্ছি। আমি চোখ তুলে তাকাচ্ছি—যদিও চোখে জল।”

পার্বতী, যার ভিতরে নদীর মতো নরমতা, আর ভূমির মতো কঠিনতা একসঙ্গে বাস করে,
সে এক রাতে নিরুকে বলেছিল,
“আমি এখনও স্বপ্নে ভাইয়ের গলা শুনি—‘দিদি, একটু খেতে দে’।
তখন মনে হয়, এই বিশ্বটা কী ভয়ানক নিষ্ঠুর।”
নিরু বলেছিল,
“তোর এই যন্ত্রণাই তো আজ এতগুলো মানুষের ছায়া হয়ে উঠেছে।”

পার্বতী সেদিন একটা শুকনো পাতায় লিখেছিল—
“ভাই, আমি তোকে খেতে দিতে পারিনি,
তাই আজ সবাইকে খাওয়াতে চাই।”

এই প্রতিজ্ঞা ছিল পার্বতীর ভেতরের মা হয়ে ওঠার মুহূর্ত।
সে মা হয়নি শরীর দিয়ে, হয়েছে হৃদয়ের এক নিঃশব্দ চুম্বনে।

নিরু—সবচেয়ে কণ্ঠহীন অথচ সবচাইতে উচ্চস্বরে কথা বলা কিশোরী।
তার জীবনের ব্যথা লেখা ছিল না কাগজে—
তাকে কেউ ভালবেসে নাম রাখেনি, কেউ কোলে নেয়নি, কেউ বলে দেয়নি ‘তুমি দুঃখ পেলে কান্না করো’।
সে একদিন নিরবতায় ঢুকে পড়েছিল, এবং সেই নিরবতাকে শব্দ বানিয়ে তুলেছিল।

সেই রাতে নিরু পাথরের গায়ে বসে বলেছিল,
“আমার মা শেষবার যখন জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি তার মুখ ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘তুমি কি মরলে?’
সে কিছু বলেনি।
তার চুপ করে থাকা ছিল পৃথিবীর প্রথম অসম্মতি।”

রোহিমা নিরুর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল,
“তোর মা আজ তোর কলমের মধ্যেই বেঁচে আছে।”
পার্বতী বলেছিল,
“তুই শুধু নিজের নয়, আমাদের তিনজনের মা।”

মেঘলা আকাশের নিচে, তিনজন মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিল—
তাদের শরীরে জ্বর, মুখে ক্লান্তি, চোখে অতীত।
তবু তারা ছিল জীবনের পক্ষের লোক।

রোহিমা বলল,
“আমাদের জন্ম হয়েছিল আলাদা নদীর ধারে,
কিন্তু এখন আমরা এক মোহনায় দাঁড়িয়ে আছি।”
নিরু বলল,
“এখানে কান্না আর লজ্জার জায়গা নেই, শুধু স্রোত।”
পার্বতী বলল,
“এই স্রোতে ভেসে যাবে যারা তালিকা বানায়, ভয় দেখায়, গলা টিপে ধরে।”

সেই রাতে কেউ ঘুমায়নি।
জেগে ছিল আকাশ, গাছ, ছেঁড়া কাপড়ের তাঁবু, মাটির হাঁড়ি, তিন নারীর গলা—
আর কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা এক শিশুর ধুকপুকানি।

১২

সময় চলে যায় নদীর মতো—অবিরাম, অবাধ্য, অথচ স্মৃতিবহ।
যা চলে যায়, তা শেষ হয় না,
যা রয়ে যায়, তা থেমেও বয়ে চলে।

ত্রাণ শিবিরের সেই গন্ধ, সেই কাঁটা বৃষ্টির সকাল,
শুকনো পাতার খুন্তি, মাটির হাঁড়ির গায়ে লেগে থাকা চালের ঘ্রাণ,
আর রোহিমা, পার্বতী, নিরুর মুখের নিঃশব্দ উচ্চারণ—
সবকিছু একদিন শিবির ছাড়িয়ে পৌঁছেছিল মানুষের মনের গহীনে।

তালিকাবিহীন সেই নারীরা ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি,
কিন্তু তারা নিজেদের গল্প নিজেরাই লিখে গেছে।
না হাতে কলমে, না কাগজে—
তারা লিখেছে হাড়ের ভেতর, চোখের ভাষায়,
এক টুকরো কষ্ট থেকে তুলে আনা সাহসে।

একদিন সাহেবদের কুঠি ফাঁকা হয়ে গেল।
স্যামুয়েল সাহেব আর ফিরলেন না,
শিবিরের ‘নিয়ম’ চিরতরে ভেঙে পড়ল।
মানুষ নিজেই ঠিক করতে শিখল কাকে খাবার দেবে, কাকে আশ্রয় দেবে।
ত্রাণের বদলে তৈরি হলো ভাগাভাগির সম্পর্ক।
অভিজ্ঞতা আর দায়িত্ব একসঙ্গে বসবাস শুরু করল।

তিন মেয়ের মুখ কেউ ভুলতে পারেনি।
কারও চুলে পাকা সাদার রেখা,
কারও কোলে সদ্য জন্মানো সন্তান,
কারও চোখে এক রকম ঘোর,
তবুও তাদের মনে ছিল এক নাম—

“আমরা তিন নদী, কিন্তু একটি নাম—মুক্তি।”

জাগরণ বড় হলো।
সে জানল না তার বাবা কে,
তবে জানত—তার মায়ের মুখে কোন শব্দে আলো নামে।

সে লিখতে শিখল, আঁকতে শিখল,
কিন্তু সবচেয়ে বেশি শিখেছিল—“প্রশ্ন করতে শিখো।”
রোহিমা বলত,
“যে প্রশ্ন করে, সে মরলেও থাকে।”

পার্বতী একদিন দূর গ্রামে গিয়ে অন্য নারী শিবির তৈরি করল।
তার নাম দিল—“ছায়ার ঘর”—
যেখানে তালিকা লাগে না, কেবল দরজা খুলে আসতে হয়।

নিরু একদিন কলকাতার কাগজে একটা কবিতা ছাপাল—

“তিন নদীর শরীরে ছিল নামহীন পাথর,
তারা একদিন নিজেরাই নাম হয়ে উঠল।”

কেউ তাদের নামে গান বাঁধল,
কেউ নাটক রচনা করল,
কেউ লেখাপড়ার পাঠ্যবইতে ছোট্ট করে লিখল—
“১৯৪৩ সালে কল্যাণপুরের তিন নারী ত্রাণ শিবিরে
সাহসিকতা ও আত্মমর্যাদার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন।”

কিন্তু তারা চুপচাপ থেকে গেল।
তারা জানত—গল্প বড় হলেই ইতিহাস হয় না।
গল্প তখনই ইতিহাস হয়,
যখন তা রক্ত, কষ্ট, এবং সাহসে ভেজা থাকে।

শেষ বয়সে তিনজন আবার দেখা করল।
একটা কুয়াশার দিন, সেই পুরনো মাঠে।

রোহিমা বলল,
“তোর মেয়েটা এবার কলেজে যাবে?”
পার্বতী বলল,
“হ্যাঁ, সে বলেছে সে আইনজীবী হবে। অন্য নারীদের জন্য।”
নিরু বলল,
“আমরা যা হতে পারিনি, তারা তা হবে।
তিন নদী এবার দিক বদলাবে,
কিন্তু স্রোত থাকবে চিরকাল।”

তিন নারী হাঁটছিলেন ধীরে ধীরে—
পায়ের নিচে কাদা, মাথার ওপর চিলের ডানা,
চারপাশে নিস্তব্ধতা,
তবু ভিতরে ভিতরে বয়ে চলা এক নদীর গান।

তারা কেউ ফিরে তাকাল না,
কারণ তারা জানত—
তাদের গল্প শেষ নয়,
এই গল্প এখন থেকে শুরু।

শেষ

1000024566.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *