সোনালী গুপ্ত ব্যানার্জী
বাইজি মহলের দালানে কুয়াশা জমে থাকত ভোরবেলা। নাতিদূরে বাঁকানো পথে কুড়ুল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত হরিপদ চা-ওয়ালা, যার গলায় বাজত সকালবেলার প্রথম চিৎকার—”মিষ্টি লাল চা!” আর সেই চায়ের গন্ধ পেয়ে মহলের জানালা খোলে একে একে, যেন এক অজানা শহরের ঘুম ভাঙার সময় হয়ে এসেছে। এই বাইজি মহল কেবল নাচগানের জায়গা নয়, ছিল কলকাতার জমিদার সংস্কৃতির এক অসমাপ্ত দলিল। আটটা পিলারের ওপরে দাঁড়ানো এই কাঠের বারান্দা জুড়ে শোনা যেত বাঁশির সুর, ঘুঙুরের আওয়াজ আর কত না চাপা কান্না। এটাই ছিল কমলার জন্মভূমি। ছোটবেলা থেকেই সে জানত তার নাম কমলা বাই। মা সরস্বতী বাইজির পায়ের কাছেই সে প্রথম রাগিণী শিখেছিল। অথচ, তার সেই শিখন আর পাঁচটা মেয়ের মতো ছিল না—তাল শেখার সঙ্গে সঙ্গে সে শিখেছিল, সমাজ কীভাবে সেই তাল-লিপিকে ‘নোংরা’ বলে দূরে ঠেলে দেয়। ছেলেবেলায় ছেলেরা তাকে বলে উঠত—“ওই তো নাচনেওয়ালি।” কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে পালাত না। বরং ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখত—এই মুখই একদিন গান গাইবে, সেই বিশ্বাস চোখে ছিল।
তখন ব্রিটিশ শাসনের শেষদিক, কলকাতার রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়াত ঘোড়ার গাড়ি, আর লাল কোঁচড় পরা বাবুরা দারোয়ানের সঙ্গে তর্ক করে সস্তায় বাইজি ভাড়া করতে চাইত। কমলা যখন দশ বছরের, তখন তার মা মারা যান হঠাৎই—বুকের ব্যথা বলে, কিন্তু আসলে ছিল গভীর অবসাদ। সেই দিন থেকেই কমলার জীবনে নেমে আসে নিঃসঙ্গতা, আর সেই নিঃসঙ্গতাকে ঘিরে সে খুঁজে পায় সঙ্গীত। সে তার মায়ের পুরোনো সরোদখানা বার করে, নিজে নিজে স্ট্রিং টানতে শেখে। ঘরে রাখা পুরোনো রেকর্ড বাজিয়ে শোনে গওহর জান, গওরী বাই, রসূলন বাই-এর গান। তারপর একদিন আসে সেই দিন, যেদিন রাজবাড়ির গানের ওস্তাদ রঘুনাথ মুখার্জি তার গলায় ঠুমরি শুনে বলেন—“এই গলাটা ভগবানের দান।” ওস্তাদের ছায়ায় চলতে থাকে তার রেওয়াজ, সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গলার চর্চা, তালিম, তান। কিন্তু বাইরের সমাজ তখনও তাকে চেনে ‘নাচের মেয়ে’ বলে। তার শিল্প, তার সাধনা—সবই আবদ্ধ হয়ে থাকে বাইজি মহলের ঘরেই, কদাচ কখনো ছড়িয়ে পড়ে রাজবাড়ির বটতলায়।
বাইজি মহলের মধ্যবর্তী উঠোনটা যেন ছিল তার ছোট্ট স্টেজ। সেখানে দাঁড়িয়ে সে প্রথম সুর তুলেছিল “ঠুমরি কি বাজে”—আর সেই সময় তার পাশে বসেছিলেন বৃদ্ধা অন্নপূর্ণা দেবী, রাজা হরিপ্রসাদের মা। সেই বৃদ্ধা চোখ মেলে বলেছিলেন, “তোমার গলায় সেই আগুন আছে, যা আমাদের সময়ে নিভে গিয়েছিল।” অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ব্যতিক্রম—একজন নারী, যিনি একসময় গোপনে সংগীতচর্চা করতেন, কিন্তু কখনো সাহস করে মঞ্চে দাঁড়াননি। তিনি কমলাকে ভালোবেসে বলেছিলেন—“তোমাকে একটা দিন আসতেই হবে রাজবাড়ির মূল সভাঘরে।” কিন্তু সেই মূল সভাঘর ছিল শুধুমাত্র পুরুষদের, তাদের সাহিত্যের আলোচনা, ধুনুচির ধোঁয়া আর আড্ডার ঠাঁই। সেখানে একজন বাইজি ঢুকলে সমাজ তাকে ‘উচ্চমার্গীয়’ অপমান করে। তাই কমলা রোজ দাঁড়াত বাইজি মহলের জানালায়, বাইরে তাকিয়ে ভাবত—“কবে আমি কেবল নাচনেওয়ালি থাকব না? কবে মানুষ আমার ঘুঙুরের শব্দে কলঙ্ক নয়, শিল্প খুঁজবে?”
একদিন সকালে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ এল—রাজা হরিপ্রসাদের জন্মজয়ন্তীতে রাজসভার মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা হবে, এবং সেই পরিবেশনায় রাজা নিজে কমলার পারফরম্যান্স দেখতে চান। বাইজি মহলে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। অনেকে বলল, “মহারাজের নজরে পড়েছে তো! এবার বুঝি জীবনের মোড় ঘুরবে।” কিন্তু অন্য প্রান্তে ধাক্কা এল—অন্য বাইজিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে, তারা রঘুনাথ মুখার্জির কাছে অভিযোগ জানায়—“কমলা তো এখনও ঠিকঠাক ঘুঙুর বাঁধতে শেখেনি, তার নাচ এখনও পূর্ণ নয়।” রঘুনাথ মুখার্জি একটু চুপ করে থাকেন, কিন্তু চুপ থাকা মানে যে দ্বিধা, তা কমলা বুঝতে পারে। কিন্তু সে জানত—এই সুযোগ তার কাছে শুধু এক মঞ্চ নয়, এক বিপ্লব। জন্মদিনের দিন তার ঠুমরির তানে কাঁপে রাজবাড়ির বারান্দা। কেউ কেউ হাততালি দেয়, কেউ মাথা নামিয়ে চোখ চায় না মেলাতে। রাজা হরিপ্রসাদ সেদিন মৃদু হেসে বলেন—“এই মেয়েটার গলায় আগুন আছে।” কিন্তু সেই আগুন কতদূর ছড়াবে, কতজন পোড়াবে, আর কতজন আলোকিত হবে—সে তো তখনও অনিশ্চিত।
***
দুপুরের রোদ বাইজি মহলের কার্নিশে ছুঁয়ে গিয়ে বারান্দায় আলপনা এঁকে রাখত। কিন্তু সেই রোদ আজ কমলার গায়ে যেন তপ্ত হয়ে লাগছিল। রাজবাড়ির বারান্দা থেকে আজকে তার ঘরে পাঠানো হয়েছে এক বিশেষ বার্তা—“আগামী সাতদিন ধরে রাজসভায় পারফর্ম করার জন্য তোমার প্রস্তুতি চলবে। ওস্তাদ রঘুনাথ মুখার্জি তোমার তালিমে থাকবেন। রাজা নিজে বিষয়টি দেখছেন।” এই চিঠির পাশে ছিল এক জোড়া নতুন ঘুঙুর—রুপোর বেল বাজানো, জমকালো নকশার। মা থাকলে বলতেন, “এই ঘুঙুরে একটা ইতিহাস লেখা হবে।” কিন্তু মা নেই। এবং যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই চোখে ঈর্ষা, তিরস্কার, বা নিঃশব্দ বিদ্রুপ। কিছু বাইজি মুখ টিপে হাসে, কেউ কেউ বলে, “কমলা তো আজকাল ভাবছে সে মহারানী হবে!” কমলা সেসব শোনে, কিন্তু সত্তরবার উচ্চারণ করে তার মা’র শেখানো পংক্তি—“সাধনা কেবল বাহিরের সাজ নয়, তা অন্তরের পাথেয়।”
রঘুনাথ মুখার্জির চোখে কমলার রেওয়াজ যেন এক নতুন অধ্যায়। তিনি প্রথমে তাকে বসিয়ে বলেন, “তুমি শুধু গান শিখছো না কমলা, তুমি ইতিহাস লিখছো। তাই গলাটা নিখুঁত হতে হবে, কোমরের বাঁক হবে যেন জলধারার মতো। প্রতিটি তান, প্রতিটি চাপর—তোমার অস্তিত্বের স্বাক্ষর।” শুরু হয় দীর্ঘসপ্তাহব্যাপী কড়াচর্চা—রাগিণী তোড়ি, ঝালা, ঠুমরি, দাদরা—সব কিছুতেই তার পরীক্ষা। প্রথম দিনেই কমলা রেওয়াজে কেঁদে ফেলে, রঘুনাথ মুখার্জি তখন বলে ওঠেন—“যতদিন না কান্না আসে, ততদিন গান আসে না।” বাইজি মহলের অন্য নারীরা তখন দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে, কেউ কেউ গুনগুন করে অনুসরণ করে, আবার কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়—“এই পাঁজি মেয়েটা এবার উঁচু ঘরে উঠবে।” কিন্তু এই উঁচু-নিচু সমাজের পালা কমলা বোঝে, অনুভব করে প্রতিটি নোটে। তার প্রতিটি রেওয়াজ আজ বিদ্রোহ, প্রতিটি চরণ ধরা মানে পুরুষশাসিত সভ্যতার মুখে এক নীরব থাপ্পড়।
এই পর্বে প্রথমবার রাজা হরিপ্রসাদ তার রেওয়াজ দেখতে আসেন। এক বিকেলে যখন কমলা ঠুমরির ‘আ রে মনা কাহে না ধীর ধরে’ তান তুলে গাইছে, হঠাৎ তিনি চুপিচুপি বারান্দা দিয়ে এসে দাঁড়ান। গানের শেষে তিনি শুধু বলেন—“যার গলায় এতো বেদনা, সে কি কখনো আনন্দ পায়?” কমলা নতজানু হয়ে উত্তর দেয় না, মাথা নিচু করে থাকে। সেই দিনের পর থেকে রাজা প্রায় প্রতিদিন আসেন, বসে শোনেন, একদিন একটি ছোট্ট কাগজে কবিতার লাইন লেখেন—
“তোমার ঘুঙুরে বাজে যে কথা,
তা কি কেবল প্রেম, না বেদনার ভাষা?”
এই ঘটনার খবর মহলের ভিতরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বাইজি মহলের মূল দরজায় নেমে আসে বিভাজন—একপাশে যারা কমলার জয়কে নিজেদের জয় ভাবে, আরেক পাশে যারা মনে করে, কমলা ভালোবাসার সুযোগে রাজপ্রাসাদে স্থান নিতে চাইছে। এমনকি রঘুনাথ মুখার্জিও এক সন্ধ্যায় একটু বিরক্তির সুরে বলেন—“কমলা, তুমি গান করবে না রাজা মন জিতবে?” সেই রাতে কমলা অনেকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে—সে দেখে, তার মুখে এক ধরনের দুঃখ, এক ধরনের লড়াইয়ের আগুন, যা স্রেফ সজ্জা নয়।
রেওয়াজের শেষ দিনে কমলা প্রথমবার রাজবাড়ির মূল সভাঘরে আমন্ত্রণ পায়। অন্নপূর্ণা দেবী নিজে তাকে সোনার জরির ওড়না দেন, বলেন—“এই হলে নারীর স্থান ছিল না, কিন্তু আজ এই ঘুঙুরের শব্দে নতুন যুগ শুরু হবে।” সেদিন সুধীর লাহাও আসেন; তিনি বলেন, “আপনার গানে আমি আগামী সপ্তাহে ‘স্বরলিপি’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ ছাপাতে চাই।” কমলা কিছু না বলে স্রেফ মাথা নাড়ে। কিন্তু তার চোখে তখন এক ধরনের আত্মবিশ্বাস—যে আত্মবিশ্বাসে নারী নিজেকে আর কেবল ‘বিনোদন’ নয়, বরং ‘সৃষ্টির উৎস’ হিসেবে চিনতে শিখছে। বাইজি মহলের উঠোনে যখন শেষ বিকেলের আলো পড়ে, তখন ঘুঙুরে ধ্বনিত হয় এক নতুন সুর—প্রেমের, বিদ্রোহের এবং শিল্পের পুনর্জন্মের।
***
রাতের রাজপ্রাসাদে যখন বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ মিশে থাকে, তখন বাইজি মহলের অন্দরমহলে আলো নিভে যায়। কিন্তু সেদিন ব্যতিক্রম ছিল। রেওয়াজ শেষে কমলা যখন একা বসে গলায় কুসুম গরম জল ঢালছিল, দরজায় ধীরে ধীরে পা ফেলে এলেন একজন—অন্নপূর্ণা দেবী। রাজা হরিপ্রসাদের মা, এই রাজপ্রাসাদের নিঃশব্দ রাণী। অনেকেই তাকে ভুলে গেছেন, মনে রাখেননি তার অস্তিত্ব; কিন্তু তিনি ছিলেন, আড়ালে, ঘোমটার অন্তরালে। হাতে একটি পুরোনো তানপুরা নিয়ে তিনি বললেন, “তুই কি জানিস, এই তানপুরার গলায় একদিন আমি গান ধরেছিলাম?” কমলা চমকে উঠল। এক রাজরানী, গান? তিনি হাসলেন—“হ্যাঁ, গেয়েছিলাম। কিন্তু সেদিনের গান ছিল নীরব, কেউ শুনল না, কেউ স্বীকৃতি দিল না। আর তুই যা করছিস, তা কেবল গান নয়—এক যুগের অপূর্ণ ইতিহাসকে পূর্ণ করা।” সেই রাতে তারা একসঙ্গে বসে রাগ ‘বেহাগ’-এর আলাপে কথা বললেন—এক বৃদ্ধা নারী আর এক তরুণী শিল্পীর ভেতরের কান্না আর চাওয়া নিয়ে।
অন্নপূর্ণা দেবী ধীরে ধীরে তার নিজের কাহিনি খুলে বললেন। তিনি ছোটবেলায় কাশী থেকে শিক্ষিত পণ্ডিত শ্যামলালজির কাছে সংগীত শিখেছিলেন। কিন্তু রায়চৌধুরী পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে আসার পর সেই সংগীত লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। “আমি যখন গুনগুন করে গাইতাম, রান্নাঘরের দাসীরা বলত—‘রানী কি এখন নাচের মেয়ে হতে চান?’ সেই অপমান আমার হৃদয়ে ঘা দিয়েছিল। তখন বুঝেছিলাম, এক নারীর কণ্ঠ, যদি সে গানের হয়—তবে সমাজ তাকে বিকৃত দৃষ্টিতে দেখে।” এই কথাগুলো বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন। কমলা কাছে গিয়ে তার হাত ধরে। “তুমি শুধু আমার মতো একটা মেয়েকে সাহস দিচ্ছ না, তুমি নিজের জীবনকে মুক্তি দিচ্ছ”, বলল সে। এই রাত্রি যেন ছিল এক আত্মা থেকে আরেক আত্মার দিকে হেঁটে যাওয়া—একজন নারীর দগ্ধ অতীত থেকে আরেকজনের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে।
পরেরদিন থেকেই রাজবাড়ির আঙিনায় অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায়। অন্নপূর্ণা দেবী নিজে কমলার রেওয়াজে উপস্থিত হন, কখনও পেছনে বসে, কখনও পাশে তানপুরা হাতে। তার চোখে এখন স্পষ্ট এক দৃঢ়তা—যে দৃঢ়তা রায়চৌধুরী বংশের ইতিহাসে আগে কেউ দেখেনি। পুরুষরা একে একে কানাঘুষো শুরু করে—“রানী কি তবে বাইজির গানে মুগ্ধ হয়ে গেলেন?” অন্যদিকে, রঘুনাথ মুখার্জি এখন এক নতুন দায়িত্ববোধে পরিপূর্ণ। তিনি বললেন, “অন্নপূর্ণা দেবীর মতো রুচিশীল শ্রোতা পেলে গায়ক গাইতে জানে। কমলা, আজ থেকে তোমার তালিম শুধু রেওয়াজ নয়, এক ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।” রেওয়াজে যোগ দিলেন নতুন নতুন বাদ্যকার, এমনকি পুরনো পুঁথি থেকে খুঁজে আনা হলো এক অপ্রচলিত ঠুমরি—‘আব কা সে মধু রাত পিয়া।’ সেই গানে অন্নপূর্ণা দেবী নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে গাইলেন কয়েক পংক্তি, আর বাইজি মহলের নারীরা জানলা দিয়ে কান পেতে শুনল, হতবাক হয়ে গেল—“রানীও তো আমাদের মতোই!” আর এখানেই সমাজের বিভেদ একটু একটু করে গলতে শুরু করে।
একদিন রাজা হরিপ্রসাদ এসে দেখলেন, তার মা এক বাইজির পাশে বসে তানপুরা বাজাচ্ছেন। তিনি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা রাজসভায় বসে তিনি বললেন, “আজ আমি একটা ঘোষণা করতে চাই—রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় এবার থেকে নারীদের সংগীতচর্চার জন্য পৃথক কক্ষ স্থাপন করা হবে, এবং অন্নপূর্ণা দেবী সেই কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।” সেই ঘোষণায় চারদিকে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতার পত্রিকাগুলো লেখে—“রায়চৌধুরী প্রাসাদে নারীবান্ধব সংস্কৃতির সূচনা, বাইজি মহলের এক শিল্পীর উদ্যোগে।” কমলা কিছু বলে না, সে শুধু তার ঘরে ফিরে নিজের ঘুঙুরের জোড়া হাতে নেয়, চোখ বুজে ভাবে—এই শব্দ, এই ঝংকার, একদিন যাকে শুধু ‘নাচের মেয়ে’র কলঙ্ক দিয়েছিল সমাজ, আজ তার মাধ্যেমে সমাজ বদলাতে শুরু করেছে। ঘরে শিউলি ফুলের গন্ধ আবার ঢুকে পড়ে, যেন মনে করিয়ে দেয়—এই রাতে একটি রজনী শুধু গান নয়, ইতিহাসকেও সাক্ষী রাখল।
***
রাজপ্রাসাদের সোনালি সভাঘরে আজ আলোর ছটা যেন আগের থেকে আলাদা। ডোরাকাটা মখমলের পর্দা, বাল্বের হালকা কমলা আলো, আর মঞ্চের উপর ফুলের মালা দিয়ে সাজানো ঘুঙুর রাখা হয়েছে। এ যেন এক উৎসব নয়, এক নিঃশব্দ যুদ্ধক্ষেত্র। আজ কমলা বাই রাজসভায় প্রথমবার পরিবেশন করবে, রাজা হরিপ্রসাদের জন্মজয়ন্তীতে। শহরের সুধীজন, জমিদার, কোর্ট-বিচারের পণ্ডিত থেকে শুরু করে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছেন। অনেকেই চোখ টিপে বলেছে, “এক বাইজি আজ সভাঘরে! এও কি সম্ভব?” কিন্তু সেই চোখে অবজ্ঞার সঙ্গে একরাশ কৌতূহল মিশে আছে। বাইজি মহলের নারীরা পেছন থেকে এসে চুপিচুপি জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে। এবং কমলা—সে আজ মাথায় লাল ফুলের মালা, সোনার জরির ওড়না, আর পায়ে সেই রুপোর ঘুঙুর বাঁধা। তার চোখে কোনও ভয় নেই, কিন্তু অভিমান আছে—শত শত পুরুষের চোখে আজ তাকে প্রমাণ করতে হবে, সে কেবল শরীর নয়—সে আত্মা, সে শিল্প।
তানপুরা প্রথম সুর তোলে—রাগ ‘ভৈরবী’। রঘুনাথ মুখার্জি নিজে তবলার তালে তালে শুরু করেন ‘আ রে মনা, কাহে না ধীর ধরে’। কমলার কণ্ঠ নীচু থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যায়, যেন এক শুদ্ধ ধ্যান। প্রথমে কেউ চুপ করে থাকে। তারপর কেউ একজন বলে ওঠে—“ওরে বাবা, এ গলায় আগুন!” কিন্তু সেই প্রশংসার পাশে তখনও কুৎসা ছড়ানোর চেষ্টা হয়। এক বৃদ্ধ জমিদার তার পাশে বসা সুধীর লাহাকে ফিসফিসিয়ে বলেন, “আপনার ব্রাহ্ম সমাজ কি এখন বাইজি স্তুতি করে?” সুধীর উত্তর দেন না, শুধু বলেন, “এই গান সমাজকে বদলায়, কটাক্ষ নয়।” এদিকে মঞ্চে কমলা একে একে তুলে আনে দাদরা, ঠুমরি, আর শেষে—‘পিয়া বিনা নাহি আয়’। তার ঘুঙুরের শব্দে ধ্বনিত হয় যে কান্না, তা যেন বংশ পরম্পরার গ্লানি ভেঙে দেয়। রাজা হরিপ্রসাদের চোখে জল আসে, এবং তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেন। অন্নপূর্ণা দেবী মৃদু হাসেন। কিন্তু যেই না অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা হয়, অন্দরমহল কাঁপিয়ে এক উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—“নাচের মেয়েদের সভায় ঢোকানোর পরিণাম একেই!”
বাইরের বাগান ঘরের পেছনে আগুন লেগেছে—কে বা কারা বাইজি মহলের একটি কক্ষে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দাসীরা চিৎকার করে, “পালাও!” আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ছুটে যায়। কিন্তু কমলা তখনও মঞ্চে বসে থাকে—হতবাক। তার মা’র পুরনো তানপুরা, তার নোটবই, তার ঘুঙুর—সব সেই মহলে রয়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে সে দেখে, আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের দেয়াল জুড়ে। কিছু লোক জল ঢালছে, কেউ জানালায় চিৎকার করছে। কিন্তু সে কিচ্ছু না ভেবে ঘরে ঢুকে পড়ে। তার ঘর থেকে তুলে আনে সেই পুরোনো কাঠের বাক্স—যেখানে ছিল তার মায়ের বেনারসি, ঘুঙুর আর সেই তানপুরা। আগুনে তার চুলের কিছু অংশ পুড়ে যায়, তবু সে বেরিয়ে আসে হাতে সেই বাক্স নিয়ে। সেদিন তার চোখ দেখে রাজা প্রথমবার ভয় পান—সেই চোখে ভয় নয়, বরং তীব্র এক সিদ্ধান্ত। “আজ এই আগুন কেবল ঘর পোড়ায়নি, মুখোশও পুড়িয়ে দিয়েছে,” বলে কমলা।
পরদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়—“রাজবাড়ির সভায় প্রথম বাইজির গান, সেই রাতে আগুনে পুড়ে ছাই বাইজি মহল।” কেউ বলে, “সাজানো চক্রান্ত,” কেউ বলে, “অশুচির প্রবেশে দেবতা রুষ্ট হয়েছেন।” কিন্তু সুধীর লাহা লেখেন এক প্রবন্ধ—“যেখানে ঘুঙুর বাজে, সেখানেই অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়—সেটি শুদ্ধির, অথবা সংহারক।” রঘুনাথ মুখার্জি মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু কমলার পাশে এসে দাঁড়ান। রাজা সেই রাতে একা দাঁড়িয়ে থাকেন পোড়া উঠোনে, আর তার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায় এক ঘুঙুর বাঁধা নারী—যে সমাজের চোখে ‘নাচনেওয়ালি’, কিন্তু ইতিহাসের চোখে এক সৃষ্টিকর্ত্রী। সেই পুড়ে যাওয়া আগুনে যে ধ্বংস হয়েছিল তা কেবল এক কক্ষ নয়—তা ছিল এক প্রাচীন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির অন্ত্যেষ্টি। আর সেই চিতায় দাঁড়িয়ে কমলা গাইতে শুরু করে—এক নতুন সময়ের গান।
***
শহরের রোড স্টেশনে ভোরবেলা ‘স্বাধীন ভারত’ পত্রিকার হকার চিৎকার করে চলেছে—“ঘুঙুরের গল্প পড়ুন! রায়চৌধুরী প্রাসাদের আগুনের রাতে কী ঘটেছিল!” মানুষজন ছুটছে ছাপাখানার দিকে। অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের সভাকক্ষে এক তরুণ লেখক—সুধীর লাহা—হাতের কলম দিয়ে শেষ করছেন তার সেই বহুল আলোচিত প্রবন্ধের খসড়া। শিরোনাম—“শিল্পীর নাম নয়, তার সুরেই সে বাঁচে”। প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “কমলা বাইজির ঘুঙুর সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে—এই সমাজ কী দেখে? শরীর, না আত্মা? একজন নারী যখন শিল্পী হয়ে ওঠে, তখন সে আর কেবল নারী থাকে না, সে হয়ে ওঠে এক ভাষ্যকার, ইতিহাসের অংশ।” এই প্রবন্ধেই প্রথমবার কোনো বাইজিকে প্রকাশ্যে ‘শিল্পী’ হিসেবে সম্বোধন করা হলো। এবং এই সাহসী ভাষ্য রায়চৌধুরী পরিবারের জন্য বিপদের ইঙ্গিত—কারণ জমিদার পরিবার কখনও চায় না তাদের রাজসভা সমাজ বদলের প্রতীক হয়ে উঠুক।
কিন্তু সুধীর থামেন না। তিনি অন্নপূর্ণা দেবী ও রঘুনাথ মুখার্জিকে কপি পাঠান সেই প্রবন্ধের। রঘুনাথ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলেন, “এতটা খোলামেলা লেখা হলে backlash হতে পারে।” অন্নপূর্ণা দেবী হাসেন, বলেন, “যে আগুন কমলার ঘর পুড়িয়েছে, সেই আগুনেই সমাজের কলঙ্ক ধুয়ে যাক।” এই সময়ই কমলা বাই প্রথমবার সুধীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। ব্রাহ্ম সমাজের গ্রন্থাগারে সুধীর চুপচাপ বই গুছিয়ে রাখছিল, ঠিক তখনি কমলা সাদা শাড়ি পরে, একগুচ্ছ পুস্তক হাতে নিয়ে প্রবেশ করে। “আপনার লেখা আমার ঘুঙুরের থেকেও জোরে বাজে,” সে বলে। সুধীর একটু লজ্জা পেয়ে ওঠেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি জানেন আপনার এই যাত্রা শুধুমাত্র একজন নারীর নয়? এটি অনেক নারীর আশা?” কমলা একটু হেসে বলেন, “জানি না, কিন্তু আমি জানি—আমি গাইলে এখন আর কাঁদি না।” সেই সাক্ষাতে দুজনের মধ্যে এক নতুন বন্ধনের সূচনা হয়—যেখানে কণ্ঠের সঙ্গে যুক্ত হয় কলম, এবং শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় চিন্তার বিপ্লব।
এদিকে শহরে বিতর্ক চরমে। কেউ বলে, “ব্রাহ্ম সমাজের পতন শুরু হলো, তারা এখন বাইজিদের মাথায় তুলছে!” কেউ আবার বলে, “কমলার গান নতুন প্রজন্মের নারীকে সাহস দিচ্ছে।” কলকাতার মেয়েরা, যারা এতদিন ঘরে বসে গুনগুন করে গান গাইত, এখন তাদের কেউ কেউ সংগীত শিক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে। একদিন কমলার কাছে আসে এক কিশোরী—চুপচাপ হাতে দেয় একটি খাম, খুলে দেখা যায় একটি কবিতা—
“আমি বাইজি হব না,
তবে গান গাইব,
যদি মা ডাকে থামতে,
তবে কাঁদব না।”
এই লাইনগুলি দেখে কমলা স্তব্ধ হয়ে যায়। সমাজে তার ঘুঙুর কেবল শব্দ করছে না, অনুপ্রেরণাও দিচ্ছে। এই সময় থেকেই কমলা ভাবে—এতদিন নিজের জন্য গেয়েছে, এখন তাকে গাইতে হবে অন্যদের জন্য। সে সুধীরকে অনুরোধ করে একটি ছোট্ট আসর আয়োজন করতে—যেখানে কেবল নারী শ্রোতা থাকবে। সুধীর বিস্মিত হলেও রাজি হন। এই গোপন আসর হয় এক ব্রাহ্ম স্কুলের অডিটোরিয়ামে, যেখানে কেবল মাত্র ৩০ জন শিক্ষিতা তরুণীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই রাতে কমলা গায়—‘মেরা মান, মেরা সুর’—সবাই চোখ ভেজায়। শিল্পী হয়ে ওঠে প্রতিবাদ।
প্রবন্ধটি ‘স্বাধীন ভারত’ পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হওয়ার পর সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। কেউ চিঠি লেখে সম্পাদকের কাছে—“এই রকম অনৈতিক নারীদের প্রচার বন্ধ হোক”, আবার কেউ লেখে—“কমলার গান শুনে আমার কন্যাকে প্রথমবার ঘুঙুর কিনে দিয়েছি।” রাজা হরিপ্রসাদ একদিন কমলার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করে বলেন, “তুমি যা করছ, তা ইতিহাসের ওপর ছায়া ফেলছে।” কমলা বলে, “না, ইতিহাসের ছায়া নয়, আমি তো আলো খুঁজছি।” রাজা চুপ করে যান। বাইজি মহল আর নেই, পুড়ে গেছে। কিন্তু তার বদলে জন্ম নিচ্ছে নতুন এক প্রতিষ্ঠান—যার নাম কমলা দেয়, “স্বরমন্দির”। নারীর গান, নারীর মুক্তি, আর সুরের আলোয় গড়া এক আশ্রয়, এক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। আর এই সমস্ত কিছু শুরু হয়েছিল একটি প্রবন্ধ দিয়ে, একটি কলমের কালি দিয়ে, যে কালি বলেছিল—“ঘুঙুর শুধু নাচের জন্য নয়, তা এক বিপ্লবের প্রতীক।”
***
বৃষ্টির রাত্রি ছিল সে দিনটা—আকাশ থেকে যেন জমে থাকা সমস্ত কান্না একসাথে ঝরে পড়ছিল। বাইরের উঠোন ভিজে কাদামাটি, রাজপ্রাসাদের দেওয়াল জুড়ে বয়ে চলেছে শালিখের ডাকে সুর মেশানো বাতাস। কিন্তু এই রাত্রি শুধুই প্রকৃতির নয়—আজ রাজা হরিপ্রসাদ নিজে এসেছেন কমলার নতুন বাড়িতে, যেটা এখন ‘স্বরমন্দির’ নামে পরিচিত। তার হাতে একখানা রেশমের ছাতা, আর চোখে এক ধরনের দ্বিধা, যেটা কোনও রাজমুকুট মুছে দিতে পারে না। কমলা তাকে বসার জায়গা দেখায়—মাটির ওপর পাতানো তোষকের ওপর, যেমন আজকাল সে সবাইকে বসতে বলে। রাজা একটু থমকে যান, তারপর বসেন। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হরিপ্রসাদ বলে ওঠেন, “তোমার গলায় আমি আগুন শুনেছি। কিন্তু আমি জানতে চাই, এই আগুন কি কেবল শিল্পের? নাকি সমাজের প্রতিশোধের?”
কমলা চোখ নামিয়ে বলে, “আমি শিল্পী, রাজনন্দন। আমি ঘৃণা করি না, আমি শুধু আর মেনে নিই না।” হরিপ্রসাদ এবার তার দিকে চেয়ে বলেন, “আমি তোমায় ভালোবেসেছি, কিন্তু কখনও বলিনি। কারণ সমাজের চোখে তুমি অপমান। অথচ তোমার চোখে আমি মুক্তি দেখি।” এই স্বীকারোক্তি কমলাকে বিস্মিত করে না—তবে নরম করে তোলে। সে বলে, “ভালোবাসা সেই হয়, যেখানে আমি গাইতে পারি, আর তুমি শ্রোতা হতে পারো। কিন্তু যদি তুমি আমায় সাজিয়ে রাখতে চাও, তবে সেটা ভালোবাসা নয়, সেটা দখল।” হরিপ্রসাদ চুপ করে যান। বাইরের বৃষ্টি তখন গড়িয়ে পড়ছে বালকনির পাতায়, আর ভিতরে দুটো মানুষ নিজেদের ভেতরের জল মুছছে নীরবে। এই রাতে যে কথাগুলো বলা হলো, সেগুলো কখনও সংবাদপত্রে উঠবে না, কিন্তু ওই আলো-আঁধারের মধ্যে তারা ঠিক জায়গা করে নেবে সময়ের গভীরে।
পরদিন কমলা স্বরমন্দিরে ক্লাস নেন—চারজন নতুন ছাত্রী এসেছে, তাদের মধ্যে একজন ব্রাহ্ম সমাজের বিধবা কন্যা, একজন ধোপার মেয়ে, একজন মুসলিম কাঠুরের বোন। এই বৈচিত্র্য দেখে রঘুনাথ মুখার্জি অবাক হয়ে বলেন, “তুমি তো একঘরে সমাজকে এক উঠোনে নিয়ে এসেছো।” কমলা হেসে বলেন, “আমি না, সুর নিয়ে এসেছে। ঘুঙুর সবাইকে এক তালে চলতে শেখায়।” এই সময় অন্নপূর্ণা দেবী একটি ঘোষণার কথা শোনান—তিনি স্বয়ং স্বরমন্দিরের পৃষ্ঠপোষক হবেন এবং নারীদের জন্য সংগীতশিক্ষা তহবিল গঠন করবেন। শহরের নারীরা তখন কমলার কাছে আসতে শুরু করে, কেউ দুঃখ নিয়ে, কেউ স্বপ্ন নিয়ে, কেউ লুকিয়ে। তারা শেখে শুধু গান নয়, শেখে কণ্ঠস্বর ফিরে পেতে। আর সুধীর লাহা তার পত্রিকায় লেখেন, “যে নারী একসময় গোপনে গান গাইত, সে আজ গান দিয়ে মানুষ গড়ছে।”
এক সন্ধ্যায় আবার বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির শব্দে এক নতুন সুর খুঁজে পান কমলা। সে ঘরে বসে এক নতুন ঠুমরি সৃষ্টি করে—‘বারি ঝর ঝর, মন উড়ে পর।’ সেই গান গেয়ে সে অনুভব করে, তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ আর শুধু তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়—এখন তা হাজার নারীর কণ্ঠস্বর। হরিপ্রসাদ, যিনি সেই রাতে কোনও প্রত্যুত্তর না দিয়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই গান শুনে দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকেন, জানালার বাইরেই। তার চোখে জল, ঠোঁটে এক ক্ষীণ হাসি—কারণ তিনি বুঝেছেন, কমলার ভালোবাসা চাইলে তাকে শ্রোতা হতে হবে, ক্ষমতাশালী রাজা নয়। কমলা ঘরের মেঝেতে বসে, তার ঘুঙুর খুলে রাখে এক কোণে, জলভেজা জানালায় তাকিয়ে দেখে—বৃষ্টি নামছে, কিন্তু এই বারিধারা আর ভয় নয়, এ এখন মুক্তি।
***
রাজবাড়ির প্রাচীন থামের ফাঁকে আজ দাঁড়িয়ে আছে বিক্ষোভের সুর। একদল প্রথাগত পুরোহিত, কিছু উচ্চবর্ণ জমিদার, এবং রক্ষণশীল সমাজপতিরা জড়ো হয়েছেন রাজা হরিপ্রসাদের প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। কারণ তাদের অভিযোগ—“এক বাইজিকে রাজসম্মান দেওয়া হয়েছে, আমাদের রীতিনীতি কলুষিত হয়েছে!” তারা ক্রুদ্ধ। তাদের হাতে কালো পতাকা, মুখে সংহতির শ্লোগান—“ধর্ম বাঁচাও, রাজসভা পবিত্র রাখো!” কিন্তু আজ হরিপ্রসাদ নিরুত্তর। চুপচাপ সিংহাসনে বসে আছেন, সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার সহচর, চোখে উদ্বেগ। এই চাপা প্রতিবাদ আসলে বহুদিনের জমে থাকা সামাজিক বর্জনের প্রতিফলন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন কমলা বাই। এক নারীর কণ্ঠে সুর উঠে গেলে, সমাজ তার অর্থ খুঁজে পায় না—বরং ভয় পায়।
প্রাসাদ চত্বরে তখন শহরের সম্পাদক, আইনজীবী এবং ব্রাহ্ম সমাজের নেতারাও উপস্থিত হয়েছেন। কেউ প্রশ্ন তোলেন, “রাজা কি তার প্রাসাদকে বাইজিদের ক্লাবে পরিণত করতে চান?” হরিপ্রসাদ ধীর কণ্ঠে উত্তর দেন, “আমি প্রাসাদকে মানুষের করে তুলতে চাই। যদি সত্যিকারের সুর অপবিত্র হয়, তবে আমাদের সংস্কৃতিই ব্যর্থ।” এই বিবৃতিতে আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পত্রিকাগুলো একে বলে—“রায়চৌধুরী প্রাসাদে সংস্কার বনাম সংস্কৃতি যুদ্ধ।” সেই রাতে অন্নপূর্ণা দেবী এসে বলেন, “তোমার রাজা হওয়ার থেকে মানুষ হওয়াটা জরুরি ছিল। তুমি হয়েছো। এখন ঝড় আসবে। প্রস্তুত তো?” হরিপ্রসাদ বলে, “আমি শুধু শুনতে চাই, আবার কমলা গাইছে কিনা।”
এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে স্বরমন্দিরে গিয়ে বসে কমলা। তার সামনে কিছু নতুন ছাত্রী—যারা সব জানে, সব শুনেছে, কিন্তু তাদের চোখে ভয় নেই। একজন বলে, “আপা, আজ একটু মেঘমল্লার শোনাবেন?” কমলা একটু হাসে। এরপর বসে গেয়ে ওঠে—‘ঘনঘটা গর্জে মেঘ।’ তার কণ্ঠে সেদিন বজ্রধ্বনি ছিল, যেন সমাজের সমস্ত ধমকানি-ঝাঁপটা তার গলায় রূপ নিয়েছে। সেই গান শুনে উপস্থিত এক ব্রাহ্ম বিধবা ছাত্রীর চোখ বেয়ে জল পড়ে। কমলা বলে, “তোমাদের কাঁদতে দিইনি, গান দিয়েছি।” সেই সন্ধ্যায় শহরের রাস্তায় নতুন পোস্টার দেখা যায়—“স্বরমন্দিরে জয় শ্রুতি সন্ধ্যা: সকল নারী ও পুরুষ আমন্ত্রিত।” এবং প্রথমবার এই রকম খোলাখুলি আমন্ত্রণে সমাজের তরুণ অংশ সাড়া দেয়। তারা বলে—“এই যুদ্ধ সম্মানজনক। আমরা চাই, এক নারী নিজের কণ্ঠে সমাজকে বদলাক।”
এদিকে হরিপ্রসাদের ভাইপো—রুদ্রনারায়ণ, যিনি এতদিন পাশেই ছিলেন, এখন বলে উঠেন, “মহারাজ, আপনার এই নরম মনোভাব রাজপরিবারকে কলঙ্কিত করছে।” এক প্রাচীন সদস্যও বলে, “আপনার সিংহাসন নিয়ে ভাবুন।” এই চাপের মুখে হরিপ্রসাদ ঘোষণা করেন—“আমি যদি কমলার শিল্পকে অপবিত্র বলি, তবে নিজের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো। আমি রাজা, কিন্তু তার চেয়েও আগে আমি মানুষ।” এই বক্তব্যে সুধীর লাহা লেখেন, “আজ বাংলার একটি প্রাসাদে রাজা বিদ্রোহ করলেন তারই সভার বিরুদ্ধে—এটাই ইতিহাস।” কিন্তু যেই দিন ‘স্বরমন্দিরে’ জয় শ্রুতি অনুষ্ঠান হয়, সেদিনই হঠাৎ রাজবাড়ির ভেতরে বোমার শব্দ—একটি আততায়ীর গোপন হামলা। গুলির শব্দ শুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হরিপ্রসাদ আহত হন সামান্য, এবং প্রাসাদে প্রবল নিরাপত্তা জারি হয়।
এই হামলা সমাজকে আরও দ্বিধা করে তোলে। কেউ বলে, “কমলার উপস্থিতি অশান্তির কারণ,” আবার কেউ বলে, “যেখানে মেয়েরা কণ্ঠ তোলে, সেখানেই সমাজের পুরোনো দেয়াল কাঁপে।” সেদিন রাতে, কমলা একা বসে থাকে মোমবাতির আলোয়। তার সামনে রাখা তার ঘুঙুর, পাশে রাখা রুদ্রনারায়ণের চিঠি—“তুমি রাজাকে দূর্বল করে দিচ্ছো। দয়া করে চলে যাও।” কমলা সেই চিঠি পুড়িয়ে দেয়। সে জানে—এই আগুন শুধু কাগজ পুড়িয়ে না, নতুন দিশা দেখায়। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখে, বৃষ্টি আসছে। তার ঘুঙুর তুলে নেয়। সে জানে, কাল আবার গান গাইতে হবে।
***
ভোরের আলোয় স্বরমন্দির আজ অন্যরকম। বৃষ্টিভেজা উঠোন মুছে ঝকঝকে করা হয়েছে, কাঁচা সিঁদুর দিয়ে আঁকা হয়েছে প্রবেশপথের আলপনা। আজ স্বরমন্দিরে এক বিশেষ দিন—নারী শিল্পচর্চার নতুন পাঠক্রম উদ্বোধন হবে। প্রথমবারের মতো সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি ‘সংগীত-শিক্ষা’ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই ঘর, যা শুরু হয়েছিল এক পুড়ে যাওয়া মহলের ছাই থেকে। কমলা বাই আজ পরেছে সাদা কাতান শাড়ি, চোখে বিন্দুমাত্র কাজল। তার চারপাশে ছাত্রীদের মুখে উৎসাহ আর আত্মবিশ্বাস—যারা একসময় গোপনে গান শিখতে আসত, তারা আজ প্রকাশ্যে গাইতে শিখেছে।
অন্নপূর্ণা দেবী এই উপলক্ষে আসেন নিজের পালকি করে। তিনি ঘোষণা করেন, “আজ থেকে এই স্বরমন্দির শুধু গান শেখাবে না, শেখাবে নারী হিসেবে বাঁচার ভাষা।” তার কণ্ঠে ছিল অভিজাত অভিজ্ঞতার ভার, আর কণ্ঠের নিচে ছিল তৃপ্তির মৃদু ধ্বনি। রঘুনাথ মুখার্জি বলেন, “আজ থেকে আমি কেবল শিক্ষক নই, আমি এই মন্দিরের প্রথম ভক্ত।” তখন কমলা উঠে দাঁড়ায়, সকল ছাত্রীর সামনে ঘোষণা করে—“আজ আমরা যে শিক্ষা নিচ্ছি তা কেবল সংগীত নয়, তা আত্মমর্যাদা। আমরা এখন থেকে প্রতিদিন শুরু করব একটি শপথে।” সেই শপথের লাইনগুলো ছিল এমন:
“আমি নারী। আমি শিল্পী। আমার কণ্ঠ আমার অস্তিত্ব।
ঘুঙুর আমার শৃঙ্খল নয়, আমার স্বাধীনতা।
আমি গাইবো, আমি বলবো, আমি জিতবো—নীরবে, সুরে।”
এই শপথে দাঁড়িয়ে শতাধিক নারী যখন কণ্ঠ মিলায়, তখন উঠোনে যেন বাতাস থেমে যায়—সেই শব্দে ঘুঙুর বাজে না, কিন্তু চেতনার ঝংকার বাজে।
এই আনন্দের আবহে হঠাৎই প্রাসাদ থেকে বার্তা আসে—রাজা হরিপ্রসাদ গুরুতর অসুস্থ। গুলির ঘটনার পর তার শরীর আগেই ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু মানসিক চাপ আরও ক্লান্ত করে তুলেছে তাকে। খবর পেয়ে কমলা ছুটে যায় রাজপ্রাসাদে, সঙ্গে অন্নপূর্ণা দেবী ও সুধীর লাহা। রাজা শুয়ে আছেন ছাঁদে চন্দনের গন্ধমাখা বিছানায়, পাশে পুরনো মদ্রাসার ঘুঙুর রাখা। তার চোখ আধা খোলা। কমলা তার পাশে বসে, বলে, “আপনি আমায় ভালোবাসতেন বলেই এতদিন চুপ ছিলেন। আজ বলুন, আপনি সত্যিই চাইতেন আমি থেমে যাই?” রাজা ক্লান্ত গলায় বলে, “না, আমি চেয়েছিলাম, তুমি গাও—আমার জন্য নয়, তোমার জন্য। শুধু ভয় ছিল, ইতিহাস তোমায় মানবে না।” কমলা চোখের জল মুছে বলে, “আমি ইতিহাস লিখতে আসিনি, আমি চাই ভবিষ্যৎ বদলাক।” হরিপ্রসাদ বলে ওঠেন, “তোমার ঘুঙুরই সেটা করছে।”
সেই রাতে, রাজপ্রাসাদের বড় সভাঘরে—যেখানে একদিন কেবল জমিদার আর পণ্ডিতদের স্থান ছিল—কমলার স্বরে ধ্বনিত হয় এক রাগ মেঘ: “আজ মোর ঘর আয়ে বালম।” রাজা শেষবারের মতো সেই গান শুনে চোখ বন্ধ করেন। পরদিন ভোরে তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। শহর শোকাভিভূত। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে প্রণীত একটি নির্দেশ বের হয়—“স্বরমন্দির রাজবাড়ির অন্তর্ভুক্ত এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং নারীদের জন্য সংগীত শিক্ষার অধিকারিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।” হরিপ্রসাদের এই ঘোষণা মৃত্যুর পর আরও তাৎপর্য পায়। রাজপুরোহিত থেকে জমিদার পর্যন্ত কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু শহরের মানুষ জানে—এক রাজা শেষজীবনে সমাজকে সত্যিকারের দিশা দেখিয়েছিলেন।
শেষ দৃশ্য: এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় স্বরমন্দিরে আয়োজন হয়েছে স্মৃতিসঙ্গীতের। স্টেজে বসে কমলা, তার সামনে বসা শতাধিক নতুন প্রজন্মের ছাত্রী। পেছনে হরিপ্রসাদের ছবির নিচে জ্বলছে প্রদীপ। সে গান শুরু করে—‘ঘুঙুরের শব্দে যে অশ্রু ঝরে, সে অশ্রু আজ মুক্তির নদী।’ চারদিক নীরব, পায়ের নিচে মাটি কাঁপে না, কিন্তু বাতাসে ভেসে আসে ঘুঙুরের গুঞ্জন—সে গুঞ্জন আর দাসত্বের নয়, সে স্বাধীনতার, সমতার, সাহসের। এক নারী উঠে দাঁড়ায়, বলে, “আজ আমার মেয়েও ঘুঙুর পরবে।” তখন বোঝা যায়, কমলার সুর সমাজের অন্তস্তলে ঢুকে গেছে—একবারে চিরতরে।
***
কয়েক বছর পরের কথা। ব্রিটিশ শাসন আর রাজপ্রাসাদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হতে চলেছে, শহরে এক নতুন বাতাস—স্বাধীনতার, আত্মপরিচয়ের। কিন্তু ঐতিহাসিক ভবন স্বরমন্দির আজও দাঁড়িয়ে আছে, আগের চেয়েও দৃঢ়, গগনচুম্বী আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আজ সেখানে একটি স্মারক প্রদর্শনীর আয়োজন—“ঘুঙুরের ইতিহাস”। কমলা বাই এখন বয়সের ভারে অবনত, তার কেশে ধূসরতা, কিন্তু কণ্ঠ এখনও পরিশ্রুত। প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে তার প্রথম ঘুঙুর, আগুনে বাঁচানো তানপুরা, রঘুনাথ মুখার্জির তবলা, অন্নপূর্ণা দেবীর লেখা সংগীতচর্চার নির্দেশিকা, সুধীর লাহার সেই ঐতিহাসিক প্রবন্ধ। প্রতিটি নিদর্শনের পাশে একটি গল্প—একটি সংগ্রাম। সেই ঘরে বসে থাকা দর্শনার্থীদের চোখের সামনে যেন বেজে ওঠে সেই দিনের আওয়াজ—যখন এক নারীর গান সমাজকে চুরমার করে দিয়েছিল।
কমলা মঞ্চে ওঠেন না আজ, বরং সামনে বসা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কণ্ঠে গান শুনে হাসেন। তারা যখন প্রশ্ন করে, “আপা, আপনি কি কখনও ভয় পেয়েছিলেন?” কমলা বলে, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, আমি গাইতে পারব না, কিন্তু কখনও ভয় পাইনি, কে কী বলবে। কারণ আমার মা বলেছিল, ঘুঙুর পরা মানেই শুধু নাচ নয়—তা সাহসের শব্দ।” এই সাহসই আজ ইতিহাস হয়েছে। আয়োজনে একটি আলোচনাচক্র বসে, সেখানে একজন ইতিহাসবিদ বলেন, “ঘুঙুরের শব্দ শুধু ছন্দ নয়, এটি নারীর ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। এই শব্দ আগে সমাজ ঢেকে রাখত পর্দার আড়ালে। আজ সেই শব্দ সমাজের মঞ্চে বাজে।” উপস্থিত তরুণীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা কেবল গান শিখতে আসিনি, আমরা আমাদের আত্মা খুঁজতে এসেছি।”
এক পাশে বসে সুধীর লাহার কন্যা—অদ্বৈতি লাহা। তিনি আজকের প্রধান বক্তা। তিনি বলেন, “আমার বাবা একবার বলেছিলেন, লেখকের কলম আর গায়িকার কণ্ঠ যদি এক হয়, তবে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কমলা বাই তার প্রমাণ।” সেই সময় তিনি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে স্বরমন্দিরের ট্রাস্টের হাতে তুলে দেন সুধীরের লেখা মূল প্রবন্ধগুলোর সংকলন। সেই সংকলনের নাম রাখা হয় ‘শব্দযাত্রা’। সুধীর বহু আগেই প্রয়াত, কিন্তু তার ভাবনা আজও বেঁচে আছে। অন্নপূর্ণা দেবীও নেই। কিন্তু তাদের কাজ আজ ইতিহাসের অংশ—শিক্ষার, সাহসের, আর চেতনার।
প্রদর্শনী শেষে কমলা বাইকে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। শহরের মেয়েরা তার পায়ে হাত দেয়, অনেকে বলে—“আপনি না থাকলে আমরা ঘুঙুর পরতেও ভয় পেতাম।” তখন কমলা বলে, “তোমরা এখন যে ঘুঙুর পরো, সেটা শুধু রূপ নয়, রক্ত। ইতিহাসের রক্ত, ত্যাগের রক্ত।” সন্ধ্যাবেলা সে একবার মঞ্চে ওঠে। চারপাশে স্তব্ধতা। সে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে, পায়ের নিচে রাখা ঘুঙুর দুটো হাতে তুলে নেয়। বলে, “আমি আজ আর নাচব না, কিন্তু এই ঘুঙুর বাজবে। যতদিন এই ঘুঙুরের শব্দ থাকবে, ততদিন কেউ আমাদের কণ্ঠ থামাতে পারবে না।” সে ঘুঙুর দুটো তুলে দেয় তার সবচেয়ে ছোট ছাত্রীর হাতে। এবং সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়। বৃষ্টিভেজা জানালার ফাঁক দিয়ে আলো পড়ে ঘরের ভেতর। বাতাসে আবার বাজে সেই শব্দ—ঘুঙুরের।
শেষ




