Bangla - ভূতের গল্প - হাস্যকৌতুক

ভূতের হেঁসেল

Spread the love

সুশান্ত নস্কর


অধ্যায় ১: উল্টোপাড়ার পোস্টমাস্টার

নতুন পোস্টিং নিয়ে নবীনচন্দ্র যখন উল্টোপাড়া নামক গ্রামে পা রাখে, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়। কাঁকর-পাথরের রাস্তা ধরে রিকশা করে এসে সে নেমে পড়ে পোস্ট অফিসের সামনের ছোট্ট উঠোনে। চারদিকে ঝুপঝুপে গাছ, গাছের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট করে দেখা যায় লালচে রঙের কাঠের দরজাওয়ালা সেই অফিসঘরটা। তার সঙ্গে গাঁয়ের পোস্ট অফিসের পরিচয় ছিল না আগেও—কলকাতায় বড় হওয়া ছেলেটা গ্রামে আসবে, তা কল্পনাও করেনি। তবে সরকারি চাকরি মিলেছে, আর তার প্রথম পোস্টিং এই উল্টোপাড়াতেই। অফিসের একমাত্র কর্মী বুড়ো গণেশ কাকা, যিনি সদা বিড়বিড় করে কথা বলেন, এবং এমন ভাব করেন যেন চিঠির ভেতরের কথাগুলোরও খবর রাখেন। নবীনচন্দ্র ব্যাগ রেখে বারান্দায় চা খেতে বসতেই গ্রামটা যেন এক অন্যরকম গল্পের বই হয়ে খুলে যায়। বাতাসে একটা কাঁচা মাটির গন্ধ, দূরে কোথাও কুয়োর জল তুলছে কেউ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় সাইকেল চালানোর ঘন্টা বা গরুর গাড়ির ধীর চলা।

দ্বিতীয় দিন বিকেলে সে হাঁটতে বের হয়। গ্রামের পাশ ঘেঁষে খালের ধারে বসে শালপাতার তৈরি মোড়া দোকানে চা খায়। দোকানের নাম ‘ভোম্বল চা ঘর’, আর মালিক একজন ভুঁড়িওয়ালা হাসিখুশি মানুষ, যার নাম ভোম্বল হলেও তার মুখে সারাক্ষণ ভূতের গল্প। দোকানের পাশেই বসে থাকা পাঁচ-সাতজন বয়স্ক গ্রামবাসী মিলে গল্প চালিয়ে যায়। নবীন যখন নতুন হিসেবে পরিচয় দেয়, তখন তাকে খাতির করে চায়ের সঙ্গে মুড়ি আর ভাজা ছোলা দেওয়া হয়। গল্প একসময় ঘুরে আসে এক পোড়ো বাড়ির দিকে, যেটা নাকি খালের ধারে জঙ্গলের পাশে। বলা হয়, রাতে কেউ ওদিক মাড়ায় না। কারণ, বাড়িটার ভেতর থেকে গন্ধ আসে খিচুড়ির, ভাজাভুজির। কেউ বলে ভূতরা রান্না করে, কেউ বলে পুরোনো পেত্নীরা নাকি রেঁধে নিজেরাই খায়। নবীন প্রথমে হাসে, ভাবে এই গ্রাম্য কুসংস্কারগুলো কেবল গল্পই, কিন্তু তার মন কেমন করে যেন একেবারে উসখুস করে ওঠে। চা ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সময় সে চোখ রাখে সেই দিকটায়, দূরে—যেখানে গাছগুলো ঘন হয়ে উঠেছে, আর সেখানেই নাকি ভূতের হেঁসেল!

দিন কেটে যায় কিছুটা নিরিবিলিতে। চিঠিপত্র বিলি, লেনদেন, আর মাঝে মাঝে গণেশ কাকার সঙ্গে বকবকানি। কিন্তু সেই পোড়ো বাড়ির কথা নবীন ভুলতে পারে না। প্রতিরাতে তার ঘরে জানালার বাইরে থেকে যেন একটা গন্ধ ভেসে আসে—মশলাদার ভাজা বেগুনের গন্ধ, খিচুড়ির গন্ধ, এমনকি কেউ যেন কড়ায় তেল গরম করছে—সেইরকম একটা শব্দ। প্রথম কয়েকদিন সে ভাবল পেছনের বাড়ি থেকে আসছে গন্ধ, কিন্তু এক রাতে যখন আকাশে ছিল পূর্ণিমা, তখন গন্ধটা এমন তীব্র হয়ে উঠল যে নবীন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। লণ্ঠন হাতে, পকেটে কিছু ভাজাভুজি আর কলম-ডায়েরি নিয়ে সে হাঁটা দিল সেই দিকে। রাস্তা কাঁচা, কোথাও কোথাও জল জমে আছে, মাঝে মাঝে কাঁকড়া ছুটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখে, একটা জায়গায় গাছেরা এত ঘন হয়ে গেছে যে আলো প্রায় ঢুকতে পারে না। সেখানে দাঁড়িয়ে সে চোখে পড়ে একটা পুরোনো পোড়ো বাড়ি, যার দেয়ালে শ্যাওলা জমে আছে, জানালায় কাঁচ নেই, আর দরজাটা সামান্য ফাঁক করা।

দরজার ফাঁক দিয়ে আলো ছিটকে বেরোচ্ছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে রান্নার শব্দ—“ঝাল দিস না রে, গতবারে তো হেঁসে হেঁসে ঝাড়বাতি পড়ে গেছিল!” এমন হাস্যরসাত্মক মন্তব্য শুনে নবীন একবার চমকে যায়, আবার উৎসুকও হয়। ভূতরা কি তাহলে সত্যিই রান্না করে? সে সাহস করে একটু ঠেলে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকে। চোখের সামনে যে দৃশ্য ফুটে ওঠে তা একেবারে সিনেমার মত—একটা মাটির চুল্লির ওপরে কালো কড়াই, তাতে ফুটছে খিচুড়ি, আর তার পাশে তিনটা ভূত—একজন মোটা, একজন লম্বা আর একজন খাটো—হাসিমুখে রান্না করছে। ভূতরা একবার তাকিয়ে বলে, “আরে মানুষ?” নবীন ভয় না পেয়ে উত্তর দেয়, “গন্ধে না পেট খালি হয়ে গেল… খেতে পারি একটু?” ভূতেরা হেসে ওঠে—“চল, তবে টেস্ট করে বলিস কেমন হইছে!” সেই রাতেই নবীন প্রথম ভূতের হেঁসেলের স্বাদ পায়—আর সেই থেকে শুরু হয় এক অদ্ভুত কিন্তু সুস্বাদু সম্পর্কের গল্প।

অধ্যায় ২: চায়ের দোকানে ভূতের গল্প

পরদিন সকালে নবীনচন্দ্র ঘুম ভাঙল মুরগির ডাক নয়, বরং মনে পড়ে গেল রাতের সেই পোড়ো বাড়ির খিচুড়ির গন্ধ, ভূতের হাসি, আর তাদের অকপট আতিথেয়তা। ভোরের আলোয় চোখ মেলতেই সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আগের রাতের ঘটনার বাস্তবতা। কিন্তু তার কাঁধে ব্যাগটা ছিল, পকেটে কলম আর ভাজা ছোলার কাগজ ছিল—সাক্ষী হিসেবে। সে নিজেই নিজের মনে বলল, “বুঝলে নবীন, ভূতেরাও মানুষ হয়, শুধু একটু হালকা হাওয়ায় ভাসে।” সেদিন সকাল থেকেই সে অপেক্ষা করছিল বিকেলের জন্য—ভোম্বল চায়ের দোকানে আবার যাবে, এবং এবার আর কেবল শ্রোতা হয়ে নয়, একটু প্রশ্নকর্তাও হয়ে উঠবে। বিকেল হতেই, হাতের চিঠিপত্র শেষ করে, সে হাঁটতে হাঁটতে দোকানে গেল। ভোম্বলদা আজও হাসিমুখে বলল, “আসুন মশাই, আজ বেগুনির সঙ্গে ঝাল মুড়ি, ভূতের বাড়ির গন্ধও পাস!” বাকিরা হেসে উঠলো, কিন্তু নবীনের চোখে যেন এক আশ্চর্য জ্যোতি। সে আস্তে বলল, “ভূতের হেঁসেল তো মিথ্যে নয়… আমি কাল সেখানে গেছিলাম।”

তার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য দোকানে নীরবতা নেমে আসে। তারপরেই বাজে হাসি, কেউ বলে “নতুন বাবু তো বোকা হল”, কেউ বলে “ভূতের হেঁসেল মানেই ওর মাথায় গন্ডগোল!” ভোম্বলদা যদিও আগ্রহ নিয়ে বসে পড়ে, তার হাতে চায়ের কাপ রেখে জিজ্ঞেস করে, “বলুন, কী দেখলেন?” নবীন বিশদভাবে বর্ণনা করে আগের রাতের ঘটনা—গন্ধ, আলো, রান্না, আর তিন ভূতের উপস্থিতি। সে যখন বলে ভূতেরা তাকে খাওয়াতে রাজি হয়, এবং ঝাল কম দেওয়ার অনুরোধ করে—তখন সবাই চমকে যায়, যেন গল্পের চরিত্রেরা হঠাৎ রক্ত-মাংসে ধরা দিল। বুড়ো রাঘব ঠাকুর তখন মুখ নিচু করে শুধু বলল, “আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম, ওই বাড়ির রান্নাঘরে এক বাবুর্চি মরেছিল, রান্না করতে করতে কড়াইতে পড়ে। হয়ত সে-ই…” বাকিরা প্রথমে হাসলেও আস্তে আস্তে তাদের মুখে কৌতূহল আর রহস্যের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। গল্পটা এবার কেবল গুজব নয়, যেন ছোঁয়া পাওয়া এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।

এরপরের দিনগুলোয় নবীনের দিন কেটে যায় পোস্ট অফিসে, আর রাত আসে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা নিয়ে। সে নিয়মিত ভূতদের বাড়ি যেত, কখনও খিচুড়ি, কখনও লুচি-আলুর দম, আবার কখনও শুঁটকি ভাজা খেতে খেতে ভূতদের সঙ্গে গল্প করত। তিন ভূতের নামও জেনে ফেলে সে—মোটা ভূতের নাম রামু, লম্বা জন হরিধন আর ছোট খাটো সেই মহিলা ভূত, যার মুখে একটানা কথা চলে, তার নাম ঝুমকি। তারা কেউই ভয়ঙ্কর নয়—বরং বেজায় মজার! রামু বাবুর্চি ছিল এক জমিদারের, হরিধন কসাইয়ের ছেলে আর ঝুমকি নাকি সারাজীবন রান্নাবান্না শিখতে চেয়েও পারেনি—মরে গিয়ে অবশেষে সে পাকঘরের অধিকারিণী হয়েছে। ভূতদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের গল্প শুনতে শুনতে নবীন যেন এক নতুন জগতে ঢুকে পড়ে। দিনে সে মানুষদের সাথে, আর রাতে ভূতদের সঙ্গে—দুটো দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার নিজস্ব এক মজার পরিণতিতে পৌঁছায় জীবন।

গ্রামে ধীরে ধীরে গুজব ছড়াতে শুরু করে—“নবীনবাবু নাকি ভূতের খিচুড়ি খেয়ে মুগ্ধ!” কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়, কেউ আবার গা ছমছমে চোখে তাকায় পোস্টমাস্টারের দিকে। তবে ভোম্বলদার চায়ের দোকানে এখন নিয়মিত আড্ডার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভূতের রেসিপি! “ভূতেরা কি নারকেল দেন?” “ওরা রান্না করলে লবণ বেশি পড়ে নাকি কম?” এমন সব হাস্যকর আলোচনার মাঝে নবীন মাঝে মাঝে চুপ করে হাসে, আর ভাবে—এই গ্রাম যে এত আনন্দে ভরা ছিল, সেটা তো সে নিজেও জানত না। ভূতের উপস্থিতি এখানে কারও ক্ষতি করে না, বরং এক অদ্ভুত বন্ধনে বেঁধেছে নবীনকে, গ্রামের মানুষের কল্পনাকে এবং পোড়ো বাড়ির নীরবতাকে। ভূতেরাও যেন পেয়েছে নতুন শ্রোতা, আর নবীন—এক দল প্রেতবন্ধু, যাদের সঙ্গে রাত মানেই নতুন রান্না আর নতুন গল্প।

অধ্যায় ৩: ভূতের বাড়িতে প্রথম প্রবেশ

নবীনচন্দ্র যে প্রথম রাতে ভূতের বাড়িতে ঢুকেছিল, সেটা যেন এক আলাদা জগতে প্রবেশ করার মত। তবে সেদিনের ঘটনাটি তার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে বসেছিল যে সে দ্বিতীয়বার সেখানে না গিয়ে থাকতে পারল না। কয়েকদিন অপেক্ষার পর, এক অমাবস্যার রাতে, গ্রামে যখন হালকা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পড়ছিল, চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে—নবীন আবার লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে পড়ল সেই পোড়ো বাড়ির দিকে। পথটা এখন তার কাছে চেনা, ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সে চুপিচুপি পৌঁছে গেল সেই বাড়িটার কাছে। এবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া! আগের বার যেমন তিনজন ভূত ছিল, এবার দেখা গেল পুরো রান্নাঘরে যেন এক উৎসব চলেছে! একপাশে রামু ভূত পাঁঠার মাংসের বাটি মেখে মেখে হাসছে, আর ঝুমকি একটা কড়াইতে পুরি ছেড়ে দিচ্ছে—তেল ছিটকে তার বর্ণহীন কাঁধে পড়ছে, আর সে ‘উফ’ বলে হেসে উঠছে! হরিধন একপাশে বসে চাল ধুচ্ছে। আর তাদের চারপাশে ছোট ছোট বাতাসে ভেসে থাকা কাঁচের গ্লোব, যেগুলোর ভেতরে নিজে থেকেই আলো জ্বলছে—তারা নাকি ভূতদের ‘ঘরদেওয়া বাতি’।

নবীন ঢুকতেই রামু বলে উঠল, “আরে, মেহমান আসছে! ঝুমকি, একটু আলাদা প্লেট রাখ তো!” ঝুমকি হেসে বলে, “মানুষরা প্লেট চায়, ঠিক আছে, তবে কালই একটা চীনামাটির সেট বানাতে হবে।” নবীন চুপচাপ বসে পড়ে রান্নাঘরের এক কোণে রাখা কাঠের পিঁড়িতে। এই ভূতদের উপস্থিতি, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনযাপন, এমনকি রান্নার নিখুঁত ছন্দ—সব কিছু তাকে চমকে দেয়। এখানে না আছে ভয়ের গন্ধ, না কোন অদ্ভুত আঁধার; বরং এক অন্যরকম উষ্ণতা। ঝুমকি একটা ছোটো পাতিল এনে বলে, “আজ পেঁয়াজের পোলাও আর তেঁতুল মুরগি। খেয়ে বলিস কেমন!” নবীন বিস্ময়ে খেতে থাকে আর ভাবতে থাকে, “এত ভালো রান্না, এত সুন্দর পরিবেশন—মানুষ হলে তো রেস্তোরাঁ খুলে ফেলত।” ভূতেরা গল্প শুরু করে—কেউ বলে তার জীবদ্দশার কাণ্ড, কেউ তার মৃত্যুর দিনে কী রান্না করেছিল তা। ঝুমকি বলে, “আমি মরার আগের দিনই প্রথমবার চাল ডাল একসঙ্গে ধুয়েছিলাম… হায়! তখন যদি জানতাম ভূত হয়ে ভালো রাঁধতে পারব!”

রামু একসময় নবীনকে জিজ্ঞেস করল, “তুই মানুষ হয়ে আমাদের বাড়িতে বারবার আসছিস, ভয় করিস না?” নবীন হেসে বলে, “তোমাদের দেখে ভয় কই পাব? বরং এই পৃথিবীতে এমন ভূত তো দরকার ছিল—যারা রান্না করে, গলায় হাসি ঝরায় আর মানুষকে খাওয়ায়।” তখন হরিধন একটা মাটির আলমারি খুলে এক পুরোনো বই বের করে আনল—মলিন, পাতাগুলো মোটা, আর অদ্ভুত হরফে লেখা। সে বলল, “এইটা আমাদের রেসিপির বই—‘পেত্নীর পাকপ্রণালী’। তবে সমস্যা হল, তুমি তো ভূত-লিপি পড়তে পারবে না।” নবীন বইটা হাতে নেয়, আর দেখে পাতার ওপর কালো কালি দিয়ে আঁকা চিত্র—চুল্লি, তেল, পেঁয়াজ, আর কখনো কখনো একেকটা চরিত্রের মুখ। ঝুমকি বলে, “এই বই কিন্তু বহুমূল্য… ভূতসমাজে এটা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, কে কোন রেসিপি ভালো জানে!” নবীন আগ্রহে বলে, “আমিও শিখতে চাই… ভূতদের রান্নার তালিম নিতে চাই।” সবাই হেসে ওঠে, আর সেই রাতটা কাটে ভূতদের রান্না ও গল্পে ভরপুর এক অদ্ভুত উৎসবের মধ্যে।

রাত শেষে যখন নবীন বাড়ি ফিরে আসে, তখন ভোর প্রায় হয়ে এসেছে। তার মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি, হাতে পুঁটলি—তাতে রাখা ভূতের দেওয়া চাল-ডালের এক মুঠো উপহার। সে ভাবে, “এই বাড়িটা আমার কাছে এক স্কুল, ভূতের হেঁসেল আমার শিক্ষক।” পরদিন সকালেই সে পাতা খাতায় লিখে ফেলে—“ভূতের হেঁসেল: এক মানব-ভৌতিক রেসিপি অভিযান”। এই রাত্রিকালীন মজার সংসর্গ, যেখানে ভূতরা হাসে, খাওয়ায়, আর শোনায় নিজের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অমলিন মানবিকতা—সেটা এখন তার জীবনের এক গোপন দিক। দিনে সে পোস্ট অফিসের দায়িত্বে, আর রাতে সে এক গোপন গোষ্ঠীর সদস্য—যার সদস্যরা মৃত হলেও মজায় ভরপুর। তার জীবন যেন ধীরে ধীরে দুই জগতের মাঝে এক সেতু হয়ে দাঁড়ায়—যেখানে না আছে ভয়, না আছে গুজব—আছে কেবল খিচুড়ি আর কারি, গল্প আর গন্ধে ভরা এক ভূতুড়ে সংসার।

অধ্যায় ৪: ভূতদের পরিচয় ও ইতিহাস

ভূতদের সঙ্গে নবীনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত বন্ধুত্বের রূপ নিতে শুরু করে। প্রতি রাতে সে নির্ধারিত সময়ে পোড়ো বাড়িতে হাজির হয়, আর ওদিকে ভূতেরাও যেন অপেক্ষায় থাকে একমাত্র ‘মানুষ মেহমান’-এর জন্য। সেই রাতের খাবার, আলো আর হাসির আসর যেন একটা অলৌকিক সংসার হয়ে ওঠে—শুধু গন্ধটা থাকে একটু বেশিই জীবন্ত। একদিন, খিচুড়ি রান্নার ফাঁকে রামু ভূত বলল, “আজ আর রান্নার গল্প নয় রে নবীন, আজ তোকে বলি আমরা কীভাবে ভূত হলাম।” নবীনের চোখে জ্বলজ্বল curiosity—এটা যেন সোনার খনি খুলে যাওয়ার মতো। সে চুপ করে বসে পড়ে কাঠের পুরোনো একটা দাওয়ায়, আর ভূতেরা নিজেদের জীবনের শেষ অধ্যায় শোনাতে শুরু করে—যা তাদের জীবনের পরিণতি ঠিক করেছিল।

রামু ভূতের গল্প সবচেয়ে করুণ, অথচ অদ্ভুতভাবে মজাদারও। সে ছিল এক জমিদারের রান্নাঘরের হেড বাবুর্চি। কুড়ি বছর সে রাজবাড়িতে খানা রান্না করেছে। একদিন পোলাওয়ে ভুল করে চিনি দিয়ে ফেলে দেয় লবণের বদলে। জমিদার খেতে গিয়ে চিৎকার করে উঠে বলে, “এটা তো মিষ্টির দোকানের পোলাও!” অপমানে রামু নিজেই লজ্জায় কড়াইতে মুখ গুঁজে দেয়, আর তখনই কড়াই থেকে উল্টে পড়ে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়! হেসে হেসেই রামু বলে, “মরি বটে, কিন্তু সেদিনকার মিষ্টি পোলাও আজও ভূতেরা খায় খুশি হয়ে!” নবীন শোনে, হাসে, আবার ভাবে—একটা মানুষ যার জীবনের সব আনন্দ ছিল রান্না, তার এমন করুণ পরিণতি! হরিধনের গল্প ছিল একটু ভয়াবহ। সে ছিল কসাইয়ের ছেলে, কিন্তু গরুর মাংস কেটে কেটে একসময় তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। একদিন বাজারে সে ঝাঁপ দেয় গরম তেলের ড্রামে, নাকি ভুল করে! মৃত্যুর পর সে রান্নার কৌশলে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে—বলা হয়, ভূতজগতের ‘মিট বিশেষজ্ঞ’।

সবচেয়ে রহস্যময় গল্প ছিল ঝুমকির। ঝুমকি ছিল এক বেওয়ারিশ মেয়ে, যে বড় বাড়ির কাজের লোকের কাছে মানুষ হয়েছিল। সারাজীবন রান্নাঘরে ঢুকতে চেয়েও পারেনি—শুধু মেঝে মুছত, হাঁড়ি মাজত। শেষমেশ একদিন রান্নাঘরের কড়াই চুরি করে নিজেই রান্না করতে গিয়ে স্টোভ বিস্ফোরণে মারা যায়। ঝুমকি বলে, “জীবনে একবারও রান্না করতে না পারার দুঃখটা মরার পরেও ভুলিনি।” কিন্তু আজ সে রান্নাঘরের রানি, ভূতরা তাকে ভয় পায়, কারণ সে কারি বানাতে জানে এমনভাবে যা জীবিত মানুষও কল্পনা করতে পারবে না। নবীন মুগ্ধ হয়ে দেখে, এই তিনটি ভূতের ভিন্ন মৃত্যু, ভিন্ন জীবনের ট্র্যাজেডি আর সেই দুঃখকে পেরিয়ে গড়ে ওঠা এই হেঁসেল যেন এক রূপক গল্প—যেখানে রান্না হয়ে ওঠে মুক্তি, এবং খাবার হয়ে ওঠে আত্মার ভাষা।

নবীন চুপচাপ শুনতে শুনতে নিজেকে খুঁজে পায় এক অন্য স্তরে। সে ভাবে, “জীবনে আমরা অনেক স্বপ্ন পূরণ করতে পারি না। কেউ চায় গায়ক হতে, কেউ শিল্পী—কিন্তু বাধা আসে, সমাজ ঠেলে দেয় অন্যদিকে। আর এই ভূতেরা—তারা মৃত্যুর পরেও নিজের ভালোবাসাকে ছাড়েনি। তাদের হেঁসেল কেবল রান্নাঘর নয়, সেটা তাদের মুক্তির জায়গা।” সেই রাতে নবীন আর লেখে নিজের ডায়েরিতে—“রান্না, হাসি আর দুঃখ—এই তিনে মিলে তৈরি হয় এক এমন ভূতুড়ে জীবন, যাকে আমি এখন শ্রদ্ধা করি।” ঝুমকি একদিকে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলে, “তুই একদিন ভূতের গল্পের লেখক হবি।” নবীন হেসে বলে, “তোমরাই তো আমার প্রুফরিডার হবে, ভূত হলে ভুল ধরতেও পারবে!” আর এমন হাসি আর গল্পের ভেতর দিয়ে নবীন বুঝতে পারে—এই পোড়ো বাড়িটা আর ভয়ের জায়গা নয়, বরং এক স্মৃতি-ভরা, সুবাসিত চিরন্তন গৃহ।

অধ্যায় ৫: ভূতের হেঁসেল রেসিপি বই

রাতের খাওয়া শেষ হলে ঝুমকি একদিন নবীনকে বলল, “তুই তো এখন আমাদের ঘরের লোকই, চল, আজ তোকে একটা গোপন জায়গা দেখাই।” রামু আর হরিধন মাথা চুলকে বলে উঠল, “ওই জায়গাটা? ও তো ‘রন্ধন-রক্ষিত কুঠুরি’—ওখানে বাইরের কেউ যায় না!” ঝুমকি বলল, “এই মানুষটা আর বাইরের কোথায়? তিন মাস ধরে ভূতদের খায়, গল্প করে, ভয় পায় না—এ তো নিজের লোক।” নবীনের মনে জাগে এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে লণ্ঠনের আলো কমিয়ে রেখে অনুসরণ করে ঝুমকিকে, যিনি এক ধারে একটি গোপন দরজার পেছনে নিয়ে যায় তাকে। দরজাটা কাঠের, অদ্ভুত সব নকশা কাটা তাতে—মাঝে মাঝে হঠাৎ ঘড়ঘড় আওয়াজ আসে, যেন নিজেই দরজাটা গজগজ করে। ঝুমকি মৃদু গলায় কিছু বলার পর দরজাটা খুলে যায় আপনাআপনি। ভেতরে হালকা নীলচে আলো, কুয়াশায় ঢাকা একটা ছোট্ট গুহার মত ঘর—কিন্তু তার চারপাশে র্যাকভর্তি পুরোনো বই, মাটির পাত্রে গুঁড়া মশলা, আর এক কোণে রাখা ভূতলিপিতে লেখা বিশাল এক পাণ্ডুলিপি।

ঝুমকি সামনে এগিয়ে গিয়ে বইটা খুলে বলে, “এই হল পেত্নীর পাকপ্রণালী—ভূত রান্নার মহাগ্রন্থ।” নবীন উৎসুক হয়ে পাতাগুলোর দিকে তাকায়—তাতে চিত্র রয়েছে, অদ্ভুত সব উপাদানের নাম, যেমন ‘চাঁদের ধুলো’, ‘শিউলি ফুলের ছায়া’, ‘জামরুল-গন্ধী কাঁচা আত্মা’—যেগুলোর নাম শুনেই হেসে ওঠে নবীন। ঝুমকি বোঝায়, “এইসব রেসিপি আমরা ব্যবহার করি ভূতসমাজের বড় বড় প্রতিযোগিতায়—‘ভোজন-ভূত মহাসভা’ বলে একটা গোপন মেলা হয় বছরে একবার। সারা পৃথিবীর ভূতের দল আসে—জাপানি ওনরিও, ব্রিটিশ পল্টারগাইস্ট, আফ্রিকান অ্যানসেস্টর স্পিরিট—সবাই!” নবীনের চোখ কপালে, সে তো ভাবতেই পারেনি ভূতদেরও আন্তর্জাতিক মিলনমেলা আছে, তাও রেসিপি প্রতিযোগিতা নিয়ে! রামু বলে, “আমি গত বছর দ্বিতীয় হয়েছিলাম—’অলৌকিক আচার-পোলাও’ দিয়ে!” হরিধন একটু গর্ব করে বলে, “আর আমি ‘অ্যান্টিক কাঁকড়া ভুনা’ দিয়ে সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছিলাম!” নবীন হেসে হেসে বলে, “এ যে একেবারে ভূত-মিশেলিন স্টার প্রতিযোগিতা!”

সেই রাতেই ভূতরা নবীনকে শেখাতে শুরু করে ভূতলিপি—ধীরে ধীরে। পেঁয়াজ কাটা, চাল ধোয়া, মশলা ভাজা, তার ফাঁকে বইয়ের পাতা পড়ে শেখা। ভূতদের মতে, “মানুষ রান্না করে পেটের জন্য, আর ভূত রান্না করে আত্মার জন্য।” এই কথাটাই যেন নবীনের জীবনের সংজ্ঞা পাল্টে দেয়। সে ভাবতে থাকে, “আমরাও তো অনেক সময় আত্মা খুশি রাখার জন্য গান শুনি, কবিতা পড়ি। তাহলে রন্ধনও তো শিল্প! আত্মার শিল্প!” একদিন হঠাৎ ঝুমকি একটা ছোট্ট রেসিপি দিয়ে নবীনকে বলে, “এইটা রাঁধে দেখা, দেখি তোর হাত কেমন।” নবীন প্রথমবার এক পেঁয়াজ-তেঁতুল-আত্মা চাটনি রাঁধে। ভূতরা চেখে বলে, “বাহ! বেশ মানুষের গন্ধ আছে, তবু আত্মার ছোঁয়াও মন্দ নয়।” সেই প্রথমবার নবীন বুঝতে পারে, সে এখন আর শুধু অতিথি নয়—একজন শিক্ষানবিশ ভূত-রাঁধুনি।

রাতের পর রাত কেটে যায়, আর ভূতদের হেঁসেল এখন নবীনের কাছে গোপন ঘরের চেয়েও বেশি প্রিয়। গ্রামের বাইরে, মানুষদের কোলাহল থেকে দূরে এই একটুকরো রান্নাঘর তার জীবনের সবচেয়ে জীবন্ত জায়গা। একরাতে রামু বলে, “এইবারের ‘ভোজন-ভূত মহাসভা’য় আমরা কিছু নতুন করতে চাই, তুই কিছু বানিয়ে চমকে দে!” নবীনের মাথায় আসে এক উদ্ভট ধারণা—সে বানাবে ‘মানবিক স্মৃতির সুক্তানি’—যা পুরোনো কোনও মানুষের প্রিয় খাবারের স্বাদকে ভূতের রান্নায় রূপান্তর করে। ভূতেরা চমকে যায়, তারা কখনও এমন ভাবেনি যে মানুষের আবেগও রান্নার উপাদান হতে পারে! আর তখন থেকেই নবীনের ভূত-রন্ধন শিক্ষার পথ হয়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব সাধনার নাম—যেখানে গন্ধ আর আত্মা মিশে তৈরি হয় মায়াময় রন্ধন।

অধ্যায় ৬: ভূতদের দাওয়াত

গভীর রাতে পোড়ো বাড়ির ভেতর আলো টিমটিম করে জ্বলছে। রামু, হরিধন আর ঝুমকি চুপচাপ বসে আছে চুল্লির চারপাশে। নবীনচন্দ্র একটি খাতা খুলে তাতে কিছু লিখছে—গন্ধের সূত্র, আত্মার স্মৃতিচিহ্ন, রন্ধনপর্বের সময় ও মাত্রা। একটা শীতল উত্তেজনা সকলের চোখেমুখে—কারণ আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই অনুষ্ঠিত হবে ভোজন-ভূত মহাসভা। ঝুমকি বলে, “এইবার যদি পুরস্কার পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের এই পোড়ো বাড়িটার মানচিত্রেও ঠাঁই হবে ভূতবিশ্বে!” রামু হেসে বলে, “এইবার তো আমাদের সঙ্গে আছে মানুষ বাবু, যাঁর চাটনিতে পেঁয়াজও কাঁদে আর আত্মাও হাসে!” হরিধন একটা পুরোনো কড়াই ঘষতে ঘষতে বলে, “তোর কী ভাবনা রে নবীন?” নবীন চোখ তুলে বলে, “আমরা বানাব এমন একটা রান্না, যেখানে শুধু স্বাদ নয়, গন্ধ নয়—থাকবে স্মৃতি, ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার চিহ্ন। রান্নার নাম হবে—‘অমর মায়ার মণ্ডা’।” ভূতরা প্রথমে হতবাক, তারপর সকলেই হেসে ওঠে, কিন্তু তাদের চোখে থাকে বিস্ময় মিশ্রিত সম্মান।

দিন গড়াতে থাকে প্রস্তুতির মধ্যে। ভূতের ঘরে ধোঁয়া, হাসি, কাঁচা মশলার গন্ধ, আর কড়াইয়ে টুং টাং শব্দ। রামু নিজের পুরোনো মশলা-বাক্স খুলে দেয়, যেখানে আছে সাদা কাঁচা মরিচ, মধুর ছায়া, পুরোনো হেসে ওঠা মুহূর্তের গুঁড়ো, আর চন্দনের গন্ধমাখা আত্মার টুকরো। ঝুমকি একটি পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখে রেসিপি, আর হরিধন তৈরি করে ‘শান্ত আত্মার পুডিং’। এদিকে নবীন তৈরি করে ‘মরণপূর্ব মিষ্টি-মেদুর চাটনি’—যেটা খেলে মৃত আত্মারা নাকি একবার হাসে আর একবার কাঁদে। এই সমস্ত প্রস্তুতির মাঝে হঠাৎ একদিন ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়ায় বাড়ির দরজা খুলে যায়, আর ঢুকে পড়ে এক শীর্ণ, দীর্ঘকায় ভূত—চোখে বড় গোল চশমা, মাথায় পাগড়ি। সে বলে, “আমি রাজস্থান থেকে এসেছি, ওখানে উটের আত্মার কোরমা বানিয়ে এসেছি। শুনলাম এখানে মানুষ রাঁধে ভূতের জন্য, তাই নিজে দেখে যেতে এলাম।” রামু বলে, “আসেন, খেয়ে দেখেন আমাদের তৈরি পেঁয়াজ-স্মৃতি তরকারি।” সেই অতিথি ভূত চেখে বলে, “আহা! এটা তো আত্মার সঙ্গে আত্মীয়তার মতো মেশে!”

তাকেই দিয়ে শুরু হয় ‘ভূত-দাওয়াত’। পৃথিবীর নানা কোণ থেকে অলৌকিক আত্মারা আসতে শুরু করে। কেউ আসে বেনারসের ঘাট থেকে, কেউ কাশ্মীরের গুহা থেকে, আবার কেউ কেউ আসছে বিদেশ থেকে—জাপানের ‘ওনরিও’ ভূতেরা সুশি আর আত্মার দুধ দিয়ে আসে, লন্ডনের পুরোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসে ‘লেডি ব্ল্যাকেনহ্যাম’—যিনি অলৌকিক পুডিংয়ে বিশ্বজয় করতে চান। পোড়ো বাড়ির উঠোনে তৈরি হয় অস্থায়ী মেলা, বাতাসে ওড়ে গন্ধ, হাসি, ভয় আর কল্পনার উষ্ণতা। নবীন প্রথমবার অনুভব করে—মৃত্যুর পরেও এই আত্মারা কেবল ভেসে বেড়ানো অস্তিত্ব নয়, বরং তারা শিল্পী, তারা রাঁধুনি, তারা অনুভবের নির্মাতা। একদম শেষরাতে ঝুমকি তাকে বলে, “এই দাওয়াতটা শুধু রান্নার নয়, এটা আত্মা খোলা রাখার উৎসব।”

মহাসভা শুরু হয় এক চাঁদনি রাতে। পোড়ো বাড়ির আঙিনায় বসানো হয় একটি মঞ্চ—তাতে ভাসমান কড়াই, বাতাসে ঝুলন্ত লাড্ডু, আর আত্মার গন্ধে তৈরি পাঁপড়। বিচারক আসে তিনটি ভয়ংকর ভূত—একজন বেদিনীর আত্মা, একজন বিপ্লবীর আত্মা আর একজন মধ্যযুগীয় বটুক। রামু-ঝুমকি-নবীন মিলে তুলে ধরে তাদের রেসিপি—‘অমর মায়ার মণ্ডা’—একটা নরম মিষ্টান্ন, যাতে থাকে মা’য়ের শেষ স্পর্শ, ছোটবেলার মাঠে খেলা করা ঘামের গন্ধ, আর কাঁথার ভাঁজে রাখা পুরোনো চিঠির সুবাস। বিচারক চেখে থমকে যায়। বটুক বলে, “এটা খেয়ে তো মনে হচ্ছে… আমি আবার মানুষ হয়ে গেলাম!” সবার মুখে প্রশংসার ঢেউ ওঠে। রাতভর চলে খাওয়া, গল্প, গান—ভূতদের বাউল গান, হরিধনের ঠাট্টা, ঝুমকির নাচ। আর সবশেষে ঘোষণা হয়—এই বছরের ভূত মহাসভার ‘সেরা স্মৃতি-রন্ধন’ পুরস্কার পাচ্ছে উল্টোপাড়ার ভূতের হেঁসেল!

অধ্যায় ৭: মানুষের দাওয়াত ও অদ্ভুত বিপত্তি

ভোজন-ভূত মহাসভার বিজয়ের পর উল্টোপাড়ার পোড়ো বাড়ি যেন এক অলৌকিক আনন্দবহুর বাসভবনে রূপ নেয়। ভূতেরা এখন গর্বিত, আর নবীন তো একেবারে ভূতসমাজে ‘মানব বন্ধু’ নামে বিখ্যাত। এক রাতে ঝুমকি নবীনকে ডেকে বলে, “আমরা তো তোকে মানুষ জগৎ থেকে পেয়েছি, এবার আমরাও কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। গ্রামের কিছু মানুষ, যারা কৌতূহলী, আমাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না—তাদের জন্য এক বিশেষ রাতের আয়োজন করতে চাই।” হরিধন সঙ্গে সঙ্গে বলে, “একটা মানব-ভূত ভোজ রাত্রি—যেখানে দুপক্ষ মিলবে, রাঁধবে, খাবে, আর ভয়কে ভালোবাসায় রূপান্তর করবে!” নবীনের চোখ চকচক করে ওঠে। সে জানে, এই উদ্যোগে ঝুঁকি আছে। কিন্তু একইসঙ্গে, এটা হতে পারে মানুষ ও আত্মার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। রামু মাথা চুলকে বলে, “একটাই সমস্যা—মানুষ যদি ভয় পায়? কিংবা কাউকে যদি আমাদের দেখে হার্টফেল হয়ে যায়?” ঝুমকি মুচকি হেসে বলে, “তাই তো বলছি, আগে তোদের ভয় কমাতে হবে খুদের পাটিসাপটা দিয়ে!”

নবীন সিদ্ধান্ত নেয়—ভোম্বলদার দোকান থেকেই শুরু হবে প্রস্তুতি। সে একদিন গিয়ে বলে, “ভোম্বলদা, যদি ভূতের দল চা খেতে আসে, তুমি ভয় পাবি?” ভোম্বলদা চোখ ছোট করে বলে, “তোর চেহারা দেখেই মনে হয় ভূতের চেয়েও তুই বেশি বাজে!” তারপর নবীন নিজের অভিজ্ঞতা, ভূতদের রান্নার কথা, আর মহাসভার গল্প খুলে বলতেই দোকানজুড়ে হাসির রোল পড়ে যায়। কৌতূহলী হয়ে পড়ে গ্রামের কয়েকজন যুবক, এমনকি রাঘব ঠাকুর পর্যন্ত বলে, “ভয় পেলে তো জীবনেই কিছু শিখতে পারব না। এই ভূতের সঙ্গে খাওয়াও যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমরা রাজি!” নবীন ধীরে ধীরে বেছে নেয় দশজন—যারা সাহসী, কৌতূহলী, আর অন্ধবিশ্বাসের বাইরে এসে কিছু অনুভব করতে চায়। ভূতদের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয় ঝুমকি, রামু, হরিধন, আর কয়েকজন অতিথি ভূত—যাদের মধ্যে আছে মিঠুনবাবু (এক সময়ের বিখ্যাত হোটেল রাঁধুনি, যিনি ভুসি গিলে আত্মহত্যা করেছিলেন), আর হাসিখুশি ‘টিকিয়া পেত্নী’—যার টিকিয়া নাকি খেয়ে অনেক ভূত এখনও কাত!

আয়োজনের রাতটা ছিল কৃষ্ণপক্ষের গভীরতম রাত—আকাশে এক ফোঁটা চাঁদ নেই, কিন্তু পোড়ো বাড়ির উঠোন ভরা আলোয় ঝলমল করছে। বাতাসে ভাসছে ভাজাভুজির গন্ধ, ঝুমকির বানানো গোলাপ জল দিয়ে তৈরি ‘আত্মাস্নান পায়েস’, আর টিকিয়া পেত্নীর সিগনেচার বেগুনি টিকিয়া। মানুষজন একে একে এসে বসে, কেউ চুপ, কেউ ফিসফিস করে, কেউ আবার হাসছে জোরে। হঠাৎ করেই পেছনের গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে ভূতের দল—কেউ এক চোখে চশমা পরে, কেউ মাথায় কাগজের টুপি। মানুষেরা থমকে যায়, তারপর রামু নিজে এসে বলে, “আজ শুধু খেতে এসেছি, ভয় দেখাতে না।” তখন কেউ একজন হাততালি দেয়, কেউ হাসে। মানুষেরা স্বস্তি পেয়ে খেতে শুরু করে। কথায় কথায় উঠে আসে অনেক পুরোনো গল্প, ভূতের রেসিপি আর মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা ভয়—যা আস্তে আস্তে গলে যায় গোলাপজলে।

ঠিক যখন সব কিছু সুন্দরভাবে এগোচ্ছে, তখন হঠাৎ… অদ্ভুত কিছু ঘটে! বাড়ির এক কোণে একটা পুরোনো মাটির হাঁড়ি বিস্ফোরণ ঘটে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক কালো ধোঁয়া আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ংকর ঠান্ডা হাওয়া! সবাই থমকে যায়। সেই ধোঁয়ার ভেতর এক বিভৎস হাসি, আর একটা গর্জন: “আমি ‘রন্ধনরাক্ষস’—যে ভুলে যাওয়া রেসিপির প্রতিশোধ নিতে এসেছে!” ভূতরাও চমকে যায়, নবীন তো একেবারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। রামু ফিসফিস করে, “এই রাক্ষসটা সেই রান্নাঘরের ভুলে যাওয়া ভয়… যাদের রেসিপি কেউ মানেনি, যাদের রান্না কেউ খায়নি, তাদের অভিমানী আত্মা!” হরিধন বলে, “এদের ঠেকাতে গেলে দরকার সম্মান আর স্বীকৃতি।” নবীন সামনে এগিয়ে যায়, হাঁটু গেড়ে বসে বলে, “আমাদের ভোজে আপনিও নিমন্ত্রিত। আপনি যদি ভালোবাসা দিয়ে রান্না করেন, আমরাও খাব। আপনি অপমানিত নন, আপনি সম্মানিত অতিথি।” সেদিন সেই রন্ধনরাক্ষস, ধোঁয়া থেকে ধীরে ধীরে আকার নেয়, আর সবার সামনে বসে, চুপচাপ একটা টিকিয়া খায়। তারপর বলে, “স্বাদ আছে… মনে পড়ে গেল… আমি কে ছিলাম।” আর সেইভাবেই এক ভয়ঙ্কর বিপত্তি, এক মমত্বে গলে গিয়ে হয়ে ওঠে এক নতুন রন্ধন-বন্ধন।

অধ্যায় ৮: ভূতের ডাকঘর ও চূড়ান্ত গোপন রহস্য

মানুষ-ভূতের সেই রাতে মিলনের পর উল্টোপাড়ার পোড়ো বাড়িতে যেন আরও গভীর একটা প্রশান্তি নেমে আসে। ভূতেরা এখন শুধু রান্নাবান্না করে না, তারা মাঝে মাঝে গান গায়, নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে গবেষণা করে, এমনকি কেউ কেউ কবিতাও লেখে। নবীনচন্দ্র নিয়ম করে আসে—তবে এবার সে আর শুধু অতিথি নয়, এখন সে ভূতদের ‘শ্রেণিপাঠের’ এক অনানুষ্ঠানিক রন্ধন-শিক্ষকও। এক রাতে ঝুমকি তাকে বলল, “তোর জন্য একটা চিঠি এসেছে।” নবীন চমকে গেল। ভূতের কাছে চিঠি! সে ভাবে, “এই ভূতরা তো ফোন চালায় না, ই-মেইল তো দূরের কথা… চিঠি আবার কোথা থেকে?” রামু একটা ভাঁজ করা পাতিলেবু রঙের কাগজ এগিয়ে দেয়—চিঠিটা যেন একটু নড়ছে! নবীন খেয়াল করে, চিঠির ওপরে ভূতলিপিতে লেখা—“ভোজনলোকের অন্তিম আহ্বান”। হরিধন বলে, “এটা ভূতদের রান্নার শেষ সোপান, যেটা কেবল সেই পায় যে আত্মা আর মানুষ—দুজনের রান্নায় ভারসাম্য আনতে পারে।”

চিঠির ভেতর এক অলৌকিক বার্তা ছিল—“রন্ধনলোকে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হলো, শর্ত একটাই—তোমার হৃদয়ের রন্ধন তুমি নিজে বানিয়ে আনো। সেই রান্নায় থাকবে স্মৃতি, স্বপ্ন, আর হারানো কারো জন্য রাখা ভালোবাসা।” নবীন কেঁপে ওঠে। সে ভাবে, “হারানো কারো জন্য… আমি কাকে খুঁজছি?” অনেক চিন্তা করে তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা—তার মা, যিনি একবার রান্না করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই গন্ধটা, সেই হারিয়ে যাওয়া আদরের হাত, সেই পাতলা আলুভাজা—সবকিছু এক মুহূর্তে ফিরে আসে তার সামনে। সে স্থির করে, সে বানাবে “মায়ের দুধচালের খিচুড়ি”—যেটা ছিল একেবারে ঘরের স্বাদের প্রতীক। সে ভূতদের সাহায্যে শুরু করে রন্ধন—ঝুমকি তার জন্য এক পুরোনো কাঠের হাঁড়ি এনে দেয়, রামু মশলা দেয় ‘আত্মার সংরক্ষণ’ থেকে, আর হরিধন বলে, “তুই এটা বানালে, বুঝবি রান্না আসলে কীভাবে মানুষ আর আত্মাকে জুড়ে দেয়।”

রাত গভীর হলে নবীন তৈরি হয় রন্ধনলোকে প্রবেশের জন্য। ভূতরা সবাই এসে দাঁড়ায় পোড়ো বাড়ির পিছনের বটগাছের তলায়। সেখানে একটি ছোট পুকুরের ওপরে ঝুলে থাকা বাতাসে তৈরি দরজা দেখা যায়, যেটা শুধু সেই দেখতে পায়, যার রান্নায় সত্যিকারের আত্মার ছোঁয়া আছে। নবীন হাঁড়ি হাতে দরজার দিকে এগোতেই চারপাশে কুয়াশা ঘন হয়ে আসে। সে দরজার ওপারে পা রাখে, আর নিজেকে আবিষ্কার করে এক নিঃসীম কিচেনের মধ্যে—যেখানে দুনিয়ার সব রান্নার গন্ধ মিলেমিশে এক অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করছে। সেখানকার দেয়ালে ঝুলছে পুরোনো কাঠের খুন্তি, কারো বয়স্ক হাতের লেখায় লেখা রেসিপি, আর একটা সোনালী আলোয় ভাসছে চিরকালীন মমতা। সেই জায়গায় সে বসে হাঁড়ি খুলে খিচুড়ি বের করে, আর চারপাশে যেন কানে আসে এক চেনা কণ্ঠস্বর, “খুব ভালো করেছিস, নবীন। আজ আমি আবার খেতে পারলাম।” নবীনের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, কারণ সে বুঝে যায়—সে তার মায়ের কাছে পৌঁছেছে।

রন্ধনলোকের সেই সন্ধিক্ষণ ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অলৌকিক মুহূর্ত। সে ফিরে আসে পোড়ো বাড়িতে, হাতে খালি হাঁড়ি—কিন্তু মনে পূর্ণতা। ভূতরা তাকে ঘিরে ধরে, রামু বলে, “তুই এখন আমাদের রন্ধন-সংসারের গুরু।” ঝুমকি হাসে, “এখন তোকে ভূতেরাও রাঁধুনি মানে।” সেই রাত থেকে নবীনের জীবন আর আগের মতো নয়। সে এখন গ্রামে এক অলৌকিক সংযোগের প্রতীক—মানুষ আর ভূতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক ‘খাদ্যদূত’। এবং তার হাতে লেখা সেই চিঠি এখন পোড়ো বাড়ির দেয়ালে সযত্নে রাখা—যেটাতে লেখা আছে:
“যে রান্নায় ভালোবাসা থাকে, সেখানে আত্মা ভীত হয় না—তাতে সে ফিরে আসে।”

অধ্যায় ৯: ভূতলিপির চোরেরা ও অলৌকিক পাণ্ডুলিপি

রন্ধনলোক থেকে ফিরে আসার পর, নবীনচন্দ্রর জীবন পুরোপুরি পাল্টে যায়। এখন সে শুধু ভূতদের নয়, মানুষের মধ্যেও অদ্ভুত জনপ্রিয়তা পায়। কেউ বলে, “ওর ছোঁয়ায় রান্না মায়াবী হয়ে যায়,” কেউ বলে, “ওর রেঁধে দেওয়া খিচুড়ি খেলে দুঃস্বপ্ন কেটে যায়।” একদিন ঝুমকি তাকে ডেকে বলে, “তুই এবার একটা বড় কাজ কর—ভূত ও মানুষের মিলনের রান্না নিয়ে একটা বই লিখ। এমন একটা বই, যেটা শুধু রেসিপি নয়, আত্মার গন্ধে ভরা এক রন্ধন-যাত্রা হবে।” রামু মাথা চুলকে বলে, “নাম দেওয়া যাক—‘ভূতের হেঁসেলের বরণপত্র’।” হরিধন চিৎকার করে ওঠে, “একেবারে সোনার পুঁথি হবে এটা!” নবীন লেগে পড়ে কাজের পিছনে—প্রতিটি রেসিপির সঙ্গে একটি গল্প, প্রতিটি উপকরণের সঙ্গে একটি স্মৃতি, আর প্রতিটি রান্নার শেষে একটি প্রশ্ন—‘তুমি কী হারিয়েছো, যা এই খাবার তোমাকে মনে করিয়ে দিল?’

তবে সমস্যা তখনই শুরু হয়। এক রাতে পোড়ো বাড়িতে আগুনের মতো আলো দেখা যায়। কেউ একজন ভূতের মহাগ্রন্থ ‘পেত্নীর পাকপ্রণালী’ চুরি করে পালিয়েছে! ঝুমকি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “এই বই ভূতের আত্মিক জ্ঞান বহন করে… কারও হাতে পড়লে যদি ওরা এর অপব্যবহার করে?” রামু গম্ভীর মুখে বলে, “এটা নিছক চুরি নয়—এটা রান্নার আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়—এ কাজ ভূতলিপির চোরেরা করেছে, যাদের বলা হয় “কালিকুণ্ডলী”। এরা এমন এক গোষ্ঠী যারা ভূতদের জ্ঞান চুরি করে, আর কালো জাদুতে ব্যবহার করে দুনিয়া নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। নবীন সিদ্ধান্ত নেয়—সে এই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার না করা পর্যন্ত বই লিখবে না। ঝুমকি, রামু, হরিধন ও মিঠুনবাবুকে নিয়ে সে এক গোপন অভিযান শুরু করে ‘চোরেদের রান্নাঘর’ নামে পরিচিত এক রহস্যময় জঙ্গলে।

সেই জঙ্গল একসময় ছিল এক প্রাচীন রান্নাঘর, যেখানে তান্ত্রিক পেত্নীরা সাধনা করত। এখন সেখানে কালো ধোঁয়া, নিঃস্তব্ধতা আর অন্ধকার পেঁয়াজের মতো গন্ধ। ঝুমকি বলে, “চোরেরা এখানেই জাদুবলে রান্না করে, যাতে খেয়ে মানুষ ভুলে যায় আপনজনকে।” হঠাৎ তারা দেখে এক বিশাল হাঁড়ির ভিতর বইটি রাখা—ঘিরে ছয়টি ছায়া, চোখে আগুনের মতো লাল আলো। নবীন সাহস করে এগিয়ে যায়, এবং বলে, “তোমরা রান্নাকে অস্ত্র বানাচ্ছো, অথচ রান্না তো আত্মার শান্তি।” এক ছায়া বলে, “আমরা রান্না জানি না, আমাদেরকে কেউ শেখায়নি—তাই আমরা যা পেয়েছি, চুরি করে নিয়েছি।” তখন নবীন হাঁড়ি থেকে এক মুঠো খিচুড়ি তুলে দেয় এক ছায়াকে—সে খেয়ে কেঁদে ফেলে! অন্যরা থমকে যায়। সেই কণ্ঠ বলে, “আমরা ভুল করেছি… এই বই তো ভালোবাসার।” আর তখনই তারা বইটা ফিরিয়ে দেয়। হরিধন হালকা গলায় বলে, “ভালোবাসা দিয়ে বানানো রান্না শত্রুও ভুলিয়ে দিতে পারে।”

নবীন সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরে আসে পোড়ো বাড়িতে। এবার সে লিখতে শুরু করে তার বই—“ভূতের হেঁসেলের বরণপত্র”। ভূত ও মানুষের যুগ্ম রন্ধন-রীতির এক সংকলন। রামু বলে, “এই বই পড়ে আত্মা রাঁধতে শিখবে, মানুষ হাসতে শিখবে।” বইয়ের শেষ পাতায় নবীন লেখে,
“যে রান্না হৃদয় থেকে আসে, তা আত্মাকে শান্তি দেয়। আর যে রান্না ভয়ের বাইরে ভালোবাসা খোঁজে, তার নামই ভূতের হেঁসেল।”

অধ্যায় ১০: শেষ পৃষ্ঠা, প্রথম রন্ধন

“ভূতের হেঁসেলের বরণপত্র”—বইটি ছাপা হলো এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। কালি হিসেবে ব্যবহৃত হলো ভূতলিপির কালি, যার মধ্যে ছিল ‘স্বপ্নের ছাই’, কাগজে ব্যবহার করা হলো ‘পিতলের পাতলা ছায়া’, এবং ছাপাখানা হল পোড়ো বাড়ির নিচে ভূতদের তৈরি এক গোপন প্রেস—যার প্রেসম্যান নিজেই ছিলেন আত্মঘাতী কবি ভূত। প্রথম কপি হাতে তুলে যখন নবীন দাঁড়াল, তখন সমস্ত ভূতরা দাঁত বের করে হেসে উঠল। ঝুমকি বলল, “আজ তুই শুধু রাঁধুনি নয়, তুই ইতিহাস।” রামু হাততালি দিয়ে বলে, “এই বই পড়েই ভূতেরা রাঁধতে শিখবে।” হরিধন যোগ করে, “মানুষও পড়বে, আর একদিন তারা বলবে—ভূতেরাও ভালোবাসে, ভূতেরাও শিল্পী!” বইটি ছাপা হয়ে প্রথম পাঠানো হয় গ্রামের লাইব্রেরিতে—সেখানে বসে রাধারমণ মাস্টার, যিনি এক সময় ভূতে বিশ্বাস করতেন না, বই খুলে বলে উঠলেন, “আরে! এই তো আমার মা’র আমসত্ত্বের রেসিপি!” নবীনের বই, অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে বদলাতে শুরু করল।

কিন্তু যা কেউ ভাবেনি, সেটাই হলো। বইটা যখন বাতাসে পড়ল, তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল আত্মার জগতে। বহু আত্মা, যারা ভুলে যাওয়া গন্ধ খুঁজছিল, যারা মৃত্যুর পরেও একটিবার ‘মায়ের হাতের খাবার’ পেতে চেয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে টান অনুভব করতে লাগল বইয়ের দিকে। এক গভীর রাতে পোড়ো বাড়ির উঠোনে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল—বাতাসে শোনা গেল মৃদু পদচারণা, পুরোনো চপ্পলের শব্দ, হাসির ফিসফাস। নবীন বাইরে এসে দেখে—পোড়ো বাড়ির চারদিকে দাঁড়িয়ে শত শত আত্মা—তারা কারও মা, কারও দিদা, কারও ছেলেবেলার বন্ধুর মতো দেখাচ্ছে। কেউ বলছে, “আমার লুচির রেসিপিটা আছে বইয়ে?” কেউ জিজ্ঞেস করছে, “আমার দুধের পায়েসও আছে তো?” ঝুমকি কাঁপা কণ্ঠে বলে, “ওরা এসেছে শেখার জন্য।” সেই রাতে পোড়ো বাড়ির উঠোনে প্রথম ‘অলৌকিক রন্ধনশিবির’ শুরু হয়—নবীন, ভূতরা, আর আত্মারা একসাথে রান্না শেখে—ভালোবাসা দিয়ে, গন্ধ দিয়ে, স্মৃতি দিয়ে।

বইটির কথা ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে। ভারতের পাহাড়ি গ্রাম থেকে শুরু করে আফ্রিকার অরণ্য, ইংল্যান্ডের প্রাসাদ, আর জাপানের প্রাচীন মন্দিরেও পৌঁছে যায় ভূতের হেঁসেলের গল্প। অনেক জীবিত মানুষ বইটা পড়ে রান্না শুরু করে এমনভাবে, যেন তারা কারও সঙ্গে কথা বলছে। কেউ বলে, “আমার মৃত দাদার প্রিয় খিচুড়ি রেঁধে আজ মনে হলো, উনি আমার পাশে বসে খাচ্ছেন।” কেউ কেউ বইয়ের ভাঁজে নোট রেখে দেয়—“মা, তুমি কি দেখছো?” নবীন জানে, সে কিছু একটা সৃষ্টি করেছে যা জীবনের সীমা পেরিয়ে গেছে। ভূতরা এখন শুধু ভয় নয়, তারা ‘সংবেদনশীল আত্মা’, যারা রান্নার মাধ্যমে মানুষকে আবার কাছে টানে। বইয়ের জনপ্রিয়তা দেখে বড় প্রকাশনী আসতে চায়—নবীন রাজি হয় না। সে বলে, “এই বই শুধু তাদের জন্য, যারা গন্ধ দিয়ে স্মৃতি খোঁজে। এটা বাজারের বই নয়, এটা হৃদয়ের রান্না।”

শেষ রাতে পোড়ো বাড়িতে ভূতরা এক বড় ভোজের আয়োজন করে। আলো, হাসি, আর গন্ধে ভরে যায় বাতাস। নবীন মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ঝুমকির হাতে এক থালা তুলে দেয়। রামু বলে, “এই বাড়িটা এখন শুধু পোড়ো নয়, এটা এখন ‘রন্ধনালয়’।” হরিধন হেসে বলে, “এটা এমন এক স্থান, যেখানে আত্মা আর মাংস একসাথে খায়!” নবীন হাঁসি চেপে বলে, “একদিন হয়তো পৃথিবীর প্রতিটা ঘরে, এই বইয়ের একটা কপি থাকবে। আর মানুষ ভয় না পেয়ে বলবে—ভূতরাও ভালোবাসে। ভূতরাও রাঁধে। ভূতরাও ঘর চায়।” সে চুপ করে দাঁড়ায়—আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তার মা কী দেখছেন, আর তখনই তার মনে হয়, কারো রান্নাঘরের জানালায় আলো জ্বলছে। কেউ পেঁয়াজ কাটছে, কেউ পায়েস জ্বাল দিচ্ছে, আর বাতাসে ভাসছে একটাই কথা—“ভালোবাসা, গন্ধ আর স্মৃতি—এই তিনেই আত্মা বেঁচে থাকে।”

শেষ

1000030984.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *