Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

নীল বিদ্রোহের দিনগুলি

Spread the love

অনিরুদ্ধ বাগচী


নীলচাষের আঘ্রাণ

ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে, যেন আষাঢ়ের শেষের এই সন্ধ্যেটা কোনো অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে। শিবপুর গ্রামের গলির মাথায় দাঁড়িয়ে রেণুকা তাকিয়ে ছিল দূরের মাঠের দিকে। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামবে—সে নিশ্চয় জানত। কিন্তু বৃষ্টির থেকে বড় ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছে আজকাল—নীল সাহেবদের ভয়।

এই গ্রামের সব জমিতে এখন আর ধান চাষ হয় না। নীল চাষ হয়। সাহেবরা এসে জমিদারদের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রামটাকে বদলে দিয়েছে। আগের সেই সোনালি মাঠ আর নেই। এখন কেবল নীল গাছের শালপাতা রঙের পাতা আর কুয়াশার মত গন্ধমাখা নিঃশ্বাস। রেণুকার স্বামী হরিদাস যখন জীবিত ছিল, তখনো সে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি এই নীল চাষের ফাঁদ কতটা গভীর।

“চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিলে পাঁচ বিঘের দাম এক হাজার টাকা দেবে বলে বলেছে সাহেব,” বলেছিল একদিন হরিদাস।
রেণুকা বলেছিল, “ধান না হলে, খাবে কী আমাদের ছেলে-মেয়ে?”
হরিদাস হেসেছিল, “আরে রেণু, এই গ্রামে ধান কেউ চাষ করে এখন? সবাই তো নীলেই ঝুঁকেছে। আমরা বাঁচি না মরি, টাকা এলেই চলবে।”

তিন মাস পর, সেই চুক্তিপত্রের অভিশাপ শুরু হয়। জমিতে রঙিন গাছ বপন করতে গিয়ে পায়ে চামড়া উঠে গিয়েছিল হরিদাসের। দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, পোকায় কামড়ে, আর সাহেবদের হাঁকডাকে চাষ করেছিল সে। রেণুকা তাকে বারবার বলেছিল, “ছাড়ো, অন্য কাজ করো।”
হরিদাসের উত্তর ছিল, “চুক্তিপত্রে সই করেছি, ছাড়তে পারব না।”

একদিন সন্ধ্যায় সে কাশতে কাশতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জ্বরে পুড়ে ছারখার হয়ে মাত্র সাত দিনের মাথায় মারা যায় হরিদাস।

সেই দিন থেকেই রেণুকার যুদ্ধে নামা শুরু।

রেণুকা ছিল সোজা গড়নের, কাঁধ পর্যন্ত চুল আর মুখে এক ধরনের অদ্ভুত জেদ। স্বামীর মৃত্যুর পর লোকজন ভেবেছিল সে হয়ত পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু সে আরও চুপচাপ, আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। জমি ছাড়ল না। সাহেবরা বারবার এল, হুমকি দিল, মুনশি পাঠাল, চাষিরা ভয় দেখাল—কিন্তু রেণুকা কেঁদে পড়ল না।

সেই জমির মাঝখানে একদিন দাঁড়িয়ে বলেছিল, “এ জমি আমার স্বামীর রক্তে ভেজা। সাহেবের নীল নয়, এই জমিতে আমি আমার জীবন বপন করব।”

পাড়ার লোকেরা দূর থেকে দেখে হাসাহাসি করত। কেউ বলত, “বিধবা হয়ে জমি আঁকড়ে পড়ে আছে।” কেউ বলত, “ওর মাথা গেছে।”

একদিন সন্ধ্যেবেলা, যখন মাঠের পাশে নদীটা কালো হয়ে উঠছিল, রেণুকা দেখতে পেল একজন লোক ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটির গায়ে ছিল ধুলো মাখা ধুতি, মাথায় একটা পাটের গামছা বাঁধা। তার চোখে ছিল আগুনের মত দীপ্তি।

“আপনি রেণুকা?”
“হ্যাঁ, আপনি?”
“আমার নাম ভবানী ঘোষ। শুনেছি আপনি জমি ছাড়ছেন না সাহেবদের ভয়ে।”

রেণুকা তীক্ষ্ণ চোখে লোকটিকে দেখল।
“ভয় কীসে? আমার ভয় মরার থেকে বেশি নয়,” বলল সে।

ভবানী মৃদু হেসে বলল, “তাহলে আপনি আমাদের দরকার। গ্রামের লোকজন যারা সাহেবদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চায়, তাদের আমরা জড়ো করছি। আপনার মতো একজন নারীর সাহস দেখে বাকিরাও জেগে উঠবে।”

রেণুকা তার কথায় কৌতূহলী হয়ে উঠল। সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়াই—এটা কি সম্ভব?

“কী করতে হবে?”
“আপাতত কিছু নয়। শুধু আমাদের সঙ্গে থাকুন। কিছুদিনের মধ্যে আপনাকে একটা বার্তা পাঠানো হবে। তখন আপনি বুঝবেন আপনি কী করে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন।”

রেণুকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল, বাতাসে কুয়াশা ঢুকে পড়ছে। কিন্তু রেণুকার চোখে আজ নতুন আলো।

সেই রাত থেকে, শিবপুর গ্রামের ইতিহাস পাল্টাতে শুরু করল।

শোক থেকে সংকল্প

ভোরবেলা মাঠের ওপার থেকে ঘুড়ি উড়ছিল। শিশুরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে যাচ্ছিল, মাটিতে কাদার রেখা। কিন্তু রেণুকার চোখে কোনো রং নেই। হরিদাসের শবদাহের এক সপ্তাহ পরেও সে কারো সঙ্গে কথা বলেনি। রান্নাঘরের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখত—কোন দিক দিয়ে সাহেবদের নীল-কুঠির লোকজন আসছে।

সেদিন সকালে গাঁয়ের মোড় থেকে এক লোক এসে ডাক দিল, “রেণুবউদি! সাহেবের মুনশি এসেছে। জমির হিসেব চাইছে!”

রেণুকা মাথায় আঁচল টেনে বেরিয়ে এল, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। দুই চোখ গভীর—কিন্তু শান্ত।

কুঠির মুনশি গণেশ পাল নাকি রেণুকার শ্বশুরবাড়ির পুরোনো জমির হিসেবপত্র রক্ষণ করত। এখন সে নিজেই দাঁড়িয়ে বলছে, “বউদি, চুক্তি ছিল। হরিদাস মারা গেছে বুঝলাম। কিন্তু জমি তো সাহেবদের অধীনে ছিল। জমিতে এখন নীল বপন করতে হবে। আর দেরি করা চলবে না।”

রেণুকা সোজা তার চোখে তাকাল।
“এই জমি আমার স্বামীর রক্তে ভিজে গেছে। তোমার সাহেবদের বলো, তারা যদি সাহস করে, আসুক নিজের হাতে চাষ করতে। আমি এক ইঞ্চিও ছেড়ে দেব না।”

গণেশের মুখ শক্ত হলো। নিচু গলায় বলল, “তুমি কি জানো, সাহেবরা কী করতে পারে? তোর ঘর পুড়িয়ে দেবে। লোকজনকে ধরিয়ে নিয়ে যাবে। রক্ষে করে বলছি, বউদি—এই মাথা নিচু কর।”

রেণুকা ধীরে ধীরে পেছনে ফিরল। দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“যারা মাথা নিচু করে থাকে, তাদেরই ঘর আগে জ্বলে। আমি পোড়ার জন্য তৈরি।”

গণেশ চলে গেল, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে। তার পেছনে রইল নিঃসঙ্গ এক বিধবার প্রতিজ্ঞা।

রাত্রে শিবপুর গ্রামের এক প্রান্তে মাটির ঘরে আলো নিভিয়ে বসে রেণুকা মাটিতে আঁচড় কাটছিল। ভবানী ঘোষের কথাগুলো বারবার তার মনে ঘুরছিল। ‘আপনার মতো একজন নারীর সাহস দেখে বাকিরাও জেগে উঠবে।’ সত্যিই কি তাই?

ঘরের কোণে রাখা হরিদাসের পুরোনো লাঠি হাতে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। লাঠিটা অনেকটা ভারী। হয়ত তার স্বামী যেমন ছিল—নরম মুখ, শক্ত ভিতর।

ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
রেণুকা প্রশ্ন করল, “কে?”
একটা কিশোরী কণ্ঠস্বর বলল, “আমি জবা। তোমার ভাসুরঝি।”

রেণুকা দরজা খুলে দেখল জবা দাঁড়িয়ে আছে, মুখে ভয় ও কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতি।
“তুমি লড়তে চাইছো, না?” জবা ফিসফিস করে বলল।
রেণুকা চমকে তাকাল।
“তোমার কথা শুনে, আমিও চাই তোমার পাশে দাঁড়াতে।”

জবার সেই রাতের কথা ছিল নিঃশব্দে নীল আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া এক ঘোষণা।

রেণুকা তাকে বসিয়ে বলল, “তুমি জানো এটা কেবল সাহেবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না, আমাদের ভিতরের ভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সাহেবরা অস্ত্র নিয়ে আসবে, কিন্তু আমরা আত্মসম্মান নিয়ে দাঁড়াব।”
জবা ফিসফিস করে বলল, “তুমি যা বলবে, আমি করব।”

সেই রাতে প্রথম রেণুকা বুঝতে পারল, লড়াই একার নয়। শব্দহীন, আলোহীন, পুরুষশূন্য এক ঘর থেকেও নতুন ইতিহাস গড়ে উঠতে পারে। হয়ত খুব শিগগিরই আরও কেউ, আরও অনেকেই এগিয়ে আসবে।

ঘরের কোণে রাখা ধূপকাঠির ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে উঠছিল—যেন সময়ের কানে ফিসফিস করে বলছিল,
“বিদ্রোহ আসছে…”

গোপন চিঠি

শিবপুরের হাট বসে প্রতি শুক্রবার। এ হাটে শুধু চাল-ডাল নয়, শব্দ ঘোরে, ফিসফাস ভাসে। ব্রিটিশ সাহেবরা জানে না—এই হাটের পাটার নীচে জমে আছে বিক্ষোভের বীজ।
সেই শুক্রবার রেণুকা হাটে গিয়েছিল সামান্য চাল কিনতে। হাতে একটা পুরনো কাপড়ের ব্যাগ, মাথায় ঘোমটা টানা। জবা ছিল তার সঙ্গে—কিশোরী চোখে কৌতূহল, মুখে নীরব প্রশ্ন।

হাটের মাঝখানে একটা মাটির হাঁড়ি বিক্রেতা দাঁড়িয়ে ছিল, মাথা নিচু করে। রেণুকার পাশে এসে সে হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বলল, “আপনার হাতে গুঁড়ো নুন আছে?”
রেণুকা চমকে তাকাল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলতেই লোকটা তার হাতে একটা ছোট খাম গুঁজে দিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “শনিবার রাতে, মাঠের শেষ প্রান্তে—বটগাছের নিচে। একা আসবেন।”

রেণুকা কিছু বলতে পারল না। লোকটা ভিড়ের ভেতর মিলিয়ে গেল।

রেণুকা চিঠিটা লুকিয়ে ফেলল ব্যাগের নিচে। বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে চিঠিটা বের করল। চিঠিতে লেখা ছিল হাতে লেখা বাংলায়—

“রেণুকা,
তোমার সাহস দেখেছি। এখন সময় কাজের।
শনিবার রাতে বটগাছের নিচে এসো।
ভবানী ঘোষ।”

লিখনভঙ্গিতে কোনো অস্থিরতা ছিল না—শুধু স্থির সিদ্ধান্ত।

চিঠিটা পড়ে রেণুকা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। একটা ভেতরের কাঁপুনি তার শরীর বেয়ে উঠছিল। ভয়? না। উত্তেজনা? না। যেন একটা কিছু চিরকাল চেপে রাখা ছিল, সেটাই এখন খুলে যাচ্ছে।

সেই রাতে, খাওয়ার পরে জবা বলল, “চিঠিতে কী লিখেছে?”
রেণুকা ধীরে বলল, “লড়াইয়ের ডাক।”
জবা চোখ গোল করে তাকাল, “তুমি যাবে?”
“যেতে হবেই,” রেণুকা বলল। “হরিদাসের মৃত্যু বৃথা হলে চলবে না। এই জমি, এই গ্রাম—এগুলো কেবল মাঠ নয়, এগুলো আমাদের অস্তিত্ব। সাহেবরা এটাকে কাগজে লিখে নিতে চায়, আমরা সেটাকে হৃদয়ে বহন করি।”

শনিবার রাত। আকাশে মেঘ নেই, কিন্তু বাতাস ভারী। গ্রামের বাইরে ধানগাছের আঁধারে দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল বটগাছ।
রেণুকা একা, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে গিয়েছিল। জবা তাকে কিছুটা পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, “আমি পাহারায় থাকব।”

বটগাছের নিচে আগুন জ্বলছিল মাটির চুলায়। তার চারপাশে বসে ছিল দশ বারোজন পুরুষ—কেউ ছিল কৃষক, কেউ কারিগর, কেউ বাঁশির সুরে গলা চড়ানো তরুণ। ভবানী ঘোষ তাদের মাঝে বসে ছিলেন, শান্ত চোখে।

রেণুকাকে দেখেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেল।

ভবানী উঠে দাঁড়াল, “এই আমাদের নতুন সদস্য। যিনি সাহেবের মুখের ওপর না বলতে জানেন। যিনি বিধবা হয়েও মাথা উঁচু করে মাঠে দাঁড়াতে পারেন। যিনি ভয় পান না, অথচ প্রতিদিন ভয়ের মুখে জীবন যাপন করেন। রেণুকা—আমাদের বিদ্রোহে তোমার জায়গা আছে।”

রেণুকা সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার কণ্ঠস্বর ঝরঝরে, “আমি শুধু নিজের জমির জন্য লড়তে আসিনি। আমি লড়তে এসেছি সেই সব মেয়েদের হয়ে—যারা চুপ থাকে, যারা চোখের জল গিলে নেয়, যারা ভাবে একা কিছু করতে পারবে না। যদি তোমরা আমাকে জায়গা দাও, আমি হাঁটব। না দিলে, আমি একাই হাঁটব।”

এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর চারপাশ থেকে চাপা শব্দ—“জয় হোক।”
চুলার আগুন একটু উঁচু হয়ে উঠল।

ভবানী বলল, “আমাদের পরবর্তী সভা তিনদিন পর। তখন থেকে পরিকল্পনা শুরু হবে—যতটা গোপন রাখা যাবে, ততটাই শক্তিশালী হবে বিদ্রোহ।”

রেণুকা জানত, এই পথ সহজ নয়। কিন্তু আজ সে একা নয়। তার পাশে দাঁড়িয়েছে ভবানীর মতো মানুষ, তার পেছনে জবার মতো কিশোরী, এবং তার সামনে প্রতিহিংসার আগুন।

সেই রাতেই শিবপুরের বাতাসে উড়ে গিয়েছিল এক অদৃশ্য স্লোগান—
“নীল নয়, মাটি চাই। সাহেব নয়, অধিকার চাই।”

 সংগ্রামের শিক্ষাগার

বটগাছের সভার পরের দিনগুলো যেন কেমন যেন পালটে গেল রেণুকার কাছে। আগে যে মাঠে হেঁটে গেলে শুধু কাক ডাকার শব্দ শোনা যেত, এখন সেখানে কান পাতলে শোনা যায় ফিসফিসিয়ে বলা কথাবার্তা, ভেতরে ভেতরে গজিয়ে ওঠা প্রতিরোধের গাছ। প্রতিদিন রেণুকা ঘরে কাজ সারত, আর সন্ধ্যা নামলেই বেরিয়ে পড়ত—কখনও নদীর পাড়, কখনও পুরনো খড়ের গুদাম, কখনও পুকুরঘাট। প্রতিটি জায়গাই একেকটা গোপন পাঠশালা।

ভবানী ঘোষ এসব জায়গায় ছোট ছোট দলে ভাগ করে সবাইকে শিক্ষিত করছিল। কীভাবে কথা বলতে হয় সাহেবদের সামনে, কীভাবে কুঠির দালালদের চিনে ফেলতে হয়, কীভাবে একদল মানুষকে নিঃশব্দে সংগঠিত করতে হয়—সব শেখানো হচ্ছিল।
রেণুকা, যিনি কখনও নিজের স্বামী ছাড়া কোনও পুরুষের সামনে মুখ খুলে কথা বলেননি, তিনদিনের মধ্যে হয়ে উঠলেন সাহসী বক্তা।

তাঁর মুখে উঠে এল এক অনন্য ভাষা—যেখানে ছিল শোক, তীব্রতা, বাস্তবতা আর মাটির গন্ধ।
“তোমরা ভেবো না, আমি বিধবা বলে দুর্বল,” একদিন বললেন তিনি পুকুরপাড়ের সভায়। “আমার চোখে এখন যা আছে, তা এক মরণের অভিজ্ঞতা। সাহেবরা আমাকে আর কী ভয় দেখাবে?”

লোকজন চুপ করে শোনে, এক বুড়ো কৃষক তার পাশের লোককে বলল, “ওর গলায় আগুন আছে রে!”

জবা তখন রেণুকার নতজানু শিষ্যা। সে প্রতিদিন খাতা লিখে রাখত—কে কী বলল, কে কবে আসেনি সভায়, কার মুখে ভীতি।
একদিন রেণুকা তাকে বলল, “জবা, তোর খাতা দিয়ে একদিন ইতিহাস লেখা হবে। শুধু মুখের কথায় কিছু হয় না। এই বিদ্রোহের নথি তুই করে রাখ।”

জবা গর্বে হাসল।
“তুমি আমার শিক্ষিকা, রেণুদি। সাহস কীভাবে লেখা যায়, তুমি শিখিয়েছো।”

সেই রাতের কথা। ভবানী ঘোষ একটা ছোট কাঠের বাক্স নিয়ে এল রেণুকার ঘরে।
বাক্স খুলতেই রেণুকা চমকে গেল।
ভিতরে ছিল একটা ছোট নকশা-করা বাঁশি, একটা পুরনো মানচিত্র, আর তিনটা অদ্ভুত দেখতে কাঁচের শিশি।
“এগুলো কী?”
ভবানী বলল, “এটা আমাদের শিক্ষার পরবর্তী ধাপ। বাঁশির শব্দে সংকেত পাঠানো যাবে। মানচিত্রে সাহেবদের চিহ্নিত জায়গা—কোথায় কুঠি, কোথায় গুদাম, কোথায় দালালদের ঘাঁটি। আর এই কাঁচের শিশিতে আছে গুড়-মেশানো পোকার রস—নীল গাছের গোড়ায় ঢাললে মরবে।”
রেণুকা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর একটানা বলল, “আমার হাত কাঁপছে না। আমাকে কাজটা দাও।”

ভবানী তাকিয়ে বলল, “তোমার ভেতরের সেই আগুন আমি প্রথম দিনেই দেখেছিলাম। এখন সময় এসেছে সেই আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার।”

পরেরদিন শিবপুরের ধানখেতের মাঝখানে এক নীল গাছের গোড়ায় অচেনা পোকা দেখা গেল। সাহেবরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।
তারপর আরেকদিন, আরেক জমিতে গাছগুলো শুকিয়ে গেল।
তৃতীয়দিন, রেণুকার নিজের জমিতেই, রাতের বেলা কে যেন নীলগাছের গোঁড়া খুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

গাঁয়ের লোকজন চুপ করে রইল। কেউ কিছু দেখেনি, কেউ কিছু বলেনি।

রেণুকা, ভবানী, জবা—এরা তখন এক একটি আগুনের শিখা। সাহেবদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, দালালদের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে এক অদৃশ্য যুদ্ধ লড়ছে।

রাত যত ঘন হয়, প্রতিরোধ তত প্রকট হয়।

কিন্তু বিদ্রোহের এই পরতগুলো যত গাঢ় হতে থাকে, ততই এক বিপদ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে—একটি বিশ্বাসঘাতকের পায়ের শব্দ, যা এখনো কেউ শুনতে পায়নি।

 নীলকুঠির আগুন

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ভাদ্রের দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছিল মাঠঘাট। গাঁয়ের লোকজন এই সময়টাতে সাধারণত কুঁড়ে ঘরের ছায়া খোঁজে, কিন্তু শিবপুর গ্রামের একদল মানুষ আগুনের খোঁজে বেরিয়েছে।

রেণুকার মাথায় এখন ঘন চিন্তার জাল। সাহেবদের কুঠি, যারা দিনের পর দিন লোক ঠকিয়ে, জমি দখল করে, নীলচাষে বাধ্য করেছে মানুষকে—সেই কুঠি ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে সোজা আক্রমণ নয়, নিঃশব্দ আগুন, যেন হাওয়া দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া প্রতিরোধ।

ভবানী ঘোষ সবাইকে ডেকে বলেছিল,
“কুঠিতে আগুন দিতে হবে। ওদের শক্তির ঘাঁটিতে একটা ফাটল ফেলতে হবে। কিন্তু প্রাণনাশ নয়। আমরা খুনি নই, আমরা প্রতিবাদী।”

রাতের অন্ধকারে গাছগাছালির ছায়ায় মিশে রেণুকা আর আরও পাঁচজন পৌঁছেছিল কুঠির পেছনের রাস্তায়। জবা দূর থেকে পাহারা দিচ্ছিল। চারদিকে নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক।

কাঁধে করে আনা হয়েছিল সরষের তেল মেশানো শুকনো খড়। একজন টিনের কৌটায় আগুন এনেছিল। নিঃশব্দে সিঁড়ির পাশে খড়ের স্তূপ করা হলো।

রেণুকার চোখে তখন আর ভয় নেই। হরিদাসের মুখটা যেন ভেসে উঠল তার চোখে—যেদিন কুঠি থেকে ফিরে এসে রক্ত কাশছিল।

সে নিজের হাতে আগুন জ্বালাল।
প্রথমে স্তব্ধ। তারপর শুকনো কাঠের মতো শব্দ করে জ্বলে উঠল আগুন।

নীলকুঠির সেই দক্ষিণ পাশটা এক নিমেষে আগুনের খাঁচায় রূপান্তরিত হল। কুঠির ভেতরে ঘুমন্ত সাহেব ও তার দালালরা দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেরোল। কেউ জল আনতে ছুটল, কেউ চিৎকার করে উঠল, কেউ বন্দুকের ট্রিগার ধরল—কিন্তু কোথাও কেউ ছিল না।

রেণুকারা আগেই মিলিয়ে গেছে ঘন ছায়ায়।

পরদিন ভোরে গোটা শিবপুর গুঞ্জনে কাঁপল।
“কুঠিতে আগুন! কেউ বলছে, বিদ্রোহীরা করেছে। কেউ বলছে, ভূত!”
গণেশ পাল—সেই মুনশি—চোখে রক্ত এনে চেঁচিয়ে উঠল, “এ কাজ কোনো সাধারণ মানুষের নয়। নিশ্চয় ভেতর থেকে কেউ সাহায্য করছে। আমি খুঁজে বার করব।”

সেই দিন থেকেই গ্রামের মধ্যে একটা ঠান্ডা ভয় ঢুকে পড়ল।
যারা রেণুকাকে চুপচাপ সেলাম করত, তারা আবার মুখ ঘুরিয়ে চলতে লাগল। যারা জবাকে ‘ভালো মেয়ে’ বলত, তারা কানে কানে বলল, “বিধবার পাল্লায় পড়ে গেছে।”

কিন্তু রেণুকা জানত, এখন পিছনে হাঁটার সময় নয়।

সেই রাতে ভবানী ঘোষ এসে বলল,
“তুমি কাজটা নিখুঁত করেছ। সাহেবরা এখন ভয় পাচ্ছে। কিন্তু মনে রেখো, এখন তারা পাল্টা আঘাত হানবে।”

রেণুকা বলল, “আমরা কি তাতে ভয় পেয়ে থেমে যাব?”

ভবানী মাথা নাড়ল, “না। কিন্তু আমাদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। কেউ আমাদের খবর ফাঁসাচ্ছে। খুব সাবধানে চলতে হবে এখন থেকে।”

রেণুকার বুক ঠেলে এক অজানা শীতল হাওয়া উঠল।
কেউ… ভেতরেই… বিশ্বাসঘাতক?

জবা তখন কোণে বসে চুপচাপ খাতা লিখছিল।
রেণুকা তাকিয়ে দেখল, তার চোখে আর কৌতূহল নেই। এখন তার চোখে সতর্কতা, আশঙ্কা।

শিবপুরের বাতাসে তখন যেন ধোঁয়ার গন্ধ।
কিন্তু শুধু কুঠির আগুন নয়—আগুন লেগেছে সম্পর্কেও, বিশ্বাসেও।

এবং সেই আগুনের ছায়ায় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেই বিশ্বাসঘাতক—যার মুখ আজও অস্পষ্ট।

 বিশ্বাসঘাতক গণেশ

শিবপুরে শীত এসে পড়েছে। ভোরের কুয়াশায় পুকুরপাড় ঢেকে যায় সাদা চাদরে, আর কাঁঠালগাছের পাতাগুলোয় জমে থাকে শিশির। কিন্তু এই প্রাকৃতিক শীতলতার মধ্যে মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত উষ্ণতা—বিদ্রোহের, আতঙ্কের, আর সবচেয়ে বেশি করে—সন্দেহের।

নীলকুঠির আগুন এখন সাহেবদের মুখে মুখে। রবার্ট হেনরি—ইংরেজ সাহেব—একটা গোঁয়ার স্বভাবের লোক, কিন্তু হিসেবি। সে বুঝে গিয়েছিল, কেউ একজন ভিতর থেকে এই বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে। এবং সেটা খুঁজে বের করতেই সে ডেকে পাঠাল তার পুরনো বিশ্বস্ত লোকটিকে—গণেশ পালকে।

গণেশ পাল—এক সময় রেণুকার স্বামীর জমির হিসাবরক্ষক, কুঠির সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল সব সময়েই। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু মুখে অদ্ভুত মেকি সরলতা।

“গণেশ, তুমি বলছিলে, বিদ্রোহীদের সম্পর্কে কিছু আঁচ পেয়েছ?”
রবার্ট চেয়ারে বসে চুরুট ধরিয়ে বলল।
গণেশ একবার মাটি, একবার রবার্টের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ সাহেব। আমার সন্দেহ, ওই রেণুকা বিধবাই সব কিছুর গোড়ায়। ওর বাড়িতে সন্ধ্যার পর লোকজন যাওয়া-আসা করে। ওর সঙ্গে ভবানী ঘোষের যোগাযোগ আছে।”

রবার্ট হেসে ফেলল। “একটা বিধবা মহিলা? বিদ্রোহের নায়ক?”

গণেশ মাথা নাড়ল, “ওকে আপনি চেনেন না, সাহেব। চোখে আগুন আছে। মুখে চুপচাপ, কিন্তু ভেতরে আগুনের স্রোত।”

রবার্ট এক গাল ধোঁয়া ছাড়ল, তারপর বলল, “তাহলে আজ রাতেই তার বাড়িতে হানা দাও। যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাকে ধরে নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, ভবানী ঘোষ? সে তো আমাদের লিস্টে আগেই আছে।”

সেই রাতের কথা কেউ কোনোদিন ভুলবে না।

রেণুকা তখন উঠোনে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছিল। জবা তার খাতায় লিখছিল পরের বৈঠকের খুঁটিনাটি। হঠাৎই দরজায় ধাক্কা।
“খোল, রেণুকা! সাহেবের নির্দেশে এসেছি!”
বাইরে মশাল, লাঠি, বন্দুক—আর সামনের সারিতে গণেশ পাল।

রেণুকা দরজা খুলল না। শুধু বলল, “তোমার মুখ মনে আছে, গণেশ। সেই দিন তুমি আমার স্বামীর নামে চুক্তিপত্রে সই করিয়েছিলে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে।”

গণেশ বলল, “তোমার সময় ফুরিয়ে এসেছে, রেণুকা। এখন সাহেবদের হুকুমে চলবে গ্রাম।”

দরজা ভেঙে ফেলল ওরা। ভেতরে ঢুকে সব তছনছ করতে লাগল। খাতা, বাক্স, কাপড়—সব উল্টে ফেলল।
কিন্তু কিছু পায়নি।

কারণ রেণুকা আর জবা আগেই সব গোপন নথি পুরনো কুয়োর নিচে লুকিয়ে ফেলেছিল।

তবুও রেণুকাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। জবা চিৎকার করল, “রেণুদি, আমি কিছু করব!”
রেণুকা শুধু বলল, “তুমি লেখা বন্ধ করো না, জবা। লেখাই অস্ত্র। যতক্ষণ তুমি লিখো, আমরা জিতব।”

গ্রামের মানুষ জানালার আড়ালে মুখ লুকিয়ে দেখছিল। কেউ সামনে এল না। সাহেবের ভয়ে সবাই পাথর হয়ে গেছে।

গণেশ রেণুকাকে সাহেবদের কুঠিতে নিয়ে গেল—একটি ছোট কক্ষে আটকে রাখা হলো তাকে।
রবার্ট হেনরি এসে বলল,
“তোমার অপরাধ কী, জানো?”
রেণুকা তাকিয়ে বলল, “আমি সাহেবের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছি—এটাই আমার অপরাধ।”

রবার্ট একটু হাসল, তারপর বলল, “তুমি যদি সব কথা বলো—কে কে আছে তোমার সঙ্গে, ভবানী কোথায়—তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।”

রেণুকার চোখে বিদ্রুপের হাসি।
“আমার কাছে যা বলার, সেটা তোমার কুঠির আগুনেই পুড়ে গেছে। এখন আমি আগুন হয়ে এসেছি—আমায় ধরতে পারবে না।”

সেই রাতে রেণুকা কুঠির অন্ধকার কক্ষে বসে কাঁদেনি। তার চোখে জল ছিল না। কিন্তু মন জ্বলছিল।

আর বাইরে…
জবা, ভবানী, এবং আরও অজস্র নামহীন মানুষ রেণুকার নাম মুখে নিয়ে জ্বালিয়ে দিল এক নতুন আগুন।

 জবার জাগরণ

রাতটা যেন থমকে ছিল শিবপুরে। নীলকুঠির ভিতরে রেণুকা বন্দি, আর বাইরের গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নিঃশব্দ আতঙ্ক। সাহেবেরা এবার যেন সত্যিই ভয় পেয়েছে—তাই তারা প্রতিশোধের নামে দমন চালাচ্ছে, একের পর এক সন্দেহভাজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময়ে যখন সবাই ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন এক কিশোরী মেয়ে, নাম তার জবা, সিদ্ধান্ত নিল—এই গল্প এখন থেকে তার।

পরদিন সকাল। জবা তার খাতা, কলম আর রেণুকার পুরনো লাঠি নিয়ে গ্রামের মাঝখানে দাঁড়াল।
গাছের ডালে বসা কাকের মত লোকজন তাকে দেখছিল দূর থেকে। কেউ পুকুরের ঘাটে, কেউ খড়ের পালার পাশে।
কেউ বলছিল, “ওই মেয়েটা তো রেণুকার সঙ্গে থাকত!”
কেউ বলছিল, “নতুন ঝামেলা করবে মনে হয়!”

কিন্তু জবা থামল না।
সে বলল, “তোমরা ভাবছো, ও একজন বিধবা বলে সাহস পেয়েছিল। আমি বলি, ও একজন মানুষ ছিল। যে নিজের চোখে অন্যায় দেখেও চুপ থাকেনি। এখন থেকে আমি ওর কণ্ঠস্বর। যে যা পারে, সামনে আসো। কেউ বাঁশি বাজাবে, কেউ বার্তা নিয়ে যাবে, কেউ শোনাবে সাহসের গল্প।”

এক বুড়ি মহিলা, যিনি একসময় রেণুকার কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, এবার সামনে এসে বললেন, “আমার ছেলেকে কুঠির লোকজন নিখোঁজ করেছিল। আমি আছি তোমার সঙ্গে।”
এক পনেরো বছরের ছেলে, লম্বা কাঠের ডাঁটা হাতে এসে বলল, “আমি দৌড়াতে পারি। বার্তা পৌঁছে দিতে পারব।”
একজন কামার বলল, “আমি ধারালো কোদাল বানাতে পারি। চাষে লাগুক বা প্রতিরোধে—আমি তৈরি।”

এইভাবে জবার চারপাশে তৈরি হতে লাগল এক নতুন বলয়।
সে বুঝেছিল, বিদ্রোহ কেবল আগুন আর রক্ত নয়—বিদ্রোহ মানে সংগঠনের ছন্দ, সাহসের সুর, আর সবচেয়ে বড় কথা—বিশ্বাসের গল্প।

সেই রাতে, গোপনে ভবানী ঘোষ এসে পৌঁছাল গ্রামের বাইরে।
জবা তাকে বলল, “রেণুদি বন্দি, কিন্তু আমরা থামব না।”
ভবানী তাকিয়ে দেখল, মেয়েটির চোখে এখন শিশুসুলভ জেদ নয়, নেতৃত্বের দীপ্তি।

“তুমি তৈরি তো?” ভবানী জিজ্ঞেস করল।
“আমি প্রস্তুত,” জবা বলল, “তুমি কাজ ভাগ করে দাও।”

ভবানী বলল, “তিনটে দল হবে। এক দল সাহেবদের গতিবিধি নজরে রাখবে, এক দল ছদ্ম বার্তা ছড়িয়ে তথ্য বিনিময় করবে, আর এক দল ভেতরে ঢুকে সাহেবদের সরঞ্জাম নষ্ট করবে।”
জবা বলল, “আমি তৃতীয় দলে থাকব।”

ভবানী একটু চমকে তাকাল, “সাবধানে থেকো। ওরা এখন হিংস্র।”
জবা মাথা নিচু করে বলল, “যারা রেণুকার মত মানুষকে বন্দি করতে পারে, তারা বর্বর। আর যারা বর্বরের সামনে মাথা নত করে, তারা মানুষ নয়।”

শিবপুরে সেই রাতে আর কোনো চাঁদ ছিল না। কিন্তু একটা আলো জ্বলে উঠেছিল—জবার ভিতর থেকে, চুপচাপ, কিন্তু অবিচল।

এখন থেকে রেণুকার নাম মুখে রেখেই চলবে সংগ্রাম।
কেউ বাঁশি বাজাবে রাতে, কেউ গাছের পাতায় বার্তা লুকিয়ে দেবে, কেউ আবার খড়ের নিচে লাঠি লুকিয়ে রাখবে।

রেণুকা বন্দি?
না, রেণুকা এখন জবার কণ্ঠে, প্রতিটি কিশোরের পায়ে, প্রতিটি বৃদ্ধার চোখে।
এ এক নতুন জাগরণ—জবার জাগরণ।

নারীদের প্রতিবাদ

শিবপুর যেন ধীরে ধীরে নিজের চেহারা পাল্টাচ্ছিল। এক সময় যে গ্রামে মেয়েরা মুখ ঢেকে চলত, সেখানে এখন মেয়েরাই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। তারা আর ঘরের কোণে বসে থাকছে না, তারা উঠছে, হাঁটছে, গাইছে—বিদ্রোহের গান।

এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু এখন জবা। কিশোরী বয়সে সে আজ এক নেত্রী—রেণুকার জায়গায়, কিন্তু নিজের ছায়া নিয়ে।

সে দল গঠন করল—নাম দিল “মাটি বাঁচাও সংঘ।” সদস্য সংখ্যা প্রথমে ছিল ৭ জন, এক সপ্তাহের মাথায় দাঁড়াল ২২। বয়স ১৪ থেকে ৬৫—স্কুলে না যাওয়া কিশোরী থেকে শুরু করে পাটকাঠির লাঠি হাতে ধুলো ধরা বৃদ্ধা—সবাই।
কারও গলায় জবা বলল, “তোমরা কেউ অস্ত্র না ধরলেও, সাহসটুকু ধরো। সাহেবরা আমাদের ভয় দেখিয়ে ঘরবন্দি করে রেখেছে। আমরা সেই ঘরটাকেই বিদ্রোহের মঞ্চ করব।”

তারা কী করত?
তারা মাঠে গিয়ে চুপিচুপি সাহেবদের কর্মচারীদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখত। কুঠির সামনে ধান বা গুড় দিয়ে পিঁপড়ার রাস্তা বানিয়ে দিত যাতে চিনহ চেনা যায়। তারা পুকুরঘাটে গিয়ে সাহেবদের চরদের জুতোয় গুঁড়ো সর্ষে ঢেলে দিত যাতে হাটে গেলে সবাই চিনতে পারে। আর বড় কাজটা ছিল—একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাঁশি বাজানো।

যখন রাতের গভীরে কুঠি থেকে কেউ এসে গ্রামে ঢুকত, তখন কোনও বাড়ির জানালার পাশে বাঁশি বাজত—একটা দীর্ঘ সুর। সেটা শোনামাত্র মাটি বাঁচাও সংঘের মেয়েরা ছড়িয়ে পড়ত—কেউ গাছে উঠত, কেউ মাটির নিচে নথিপত্র লুকিয়ে ফেলত।

এই গোপন সুরের ভিতরেই তৈরি হচ্ছিল এক অন্য বিপ্লব—যার অস্ত্র চিৎকার নয়, নীরব প্রতিবাদ।

একদিন সন্ধ্যেবেলা সাহেবের লোকজন গাঁয়ের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে আসে। বাড়ির কর্তা পালিয়ে যায়, কিন্তু স্ত্রী চাঁদবালা দড়ি হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

“কেন এলেন? আমি কিছু জানি না। আমার স্বামী জানে কিনা জানি না। তবে আমি বলছি, এই দরজা আপনি ভাঙতে পারবেন না। এটা একটা বিধবার কথা নয়, এটা এক মায়ের কথা—যে তার মেয়েকে সাহেবদের লাঠির আওতায় আসতে দেবে না।”

লোকগুলো একটু থমকে যায়। গাঁয়ের এক বিধবা মহিলা এমন ভাষায় কথা বলছে! একসময় এক লোক গলা চড়িয়ে বলে,
“তোর মত মেয়েদের জন্যই গ্রাম নষ্ট হচ্ছে!”

চাঁদবালা সোজা হয়ে বলল, “আমার মেয়েরা মাটি বাঁচাতে দাঁড়িয়েছে। সাহেবের গোলাম হয়ে বেঁচে থাকা তার চেয়ে বড় লজ্জা।”

এইভাবে একের পর এক বাড়িতে মেয়েরা সামনে এসে দাঁড়াতে শুরু করল।

জবা বুঝে গেল, এই বিদ্রোহ এখন কেবল পরিকল্পনা নয়, এটা একচেটিয়া না—এটা ছড়িয়ে গেছে হৃদয়ে। যে কথা মুখে বলা হয় না, সেটা এবার চোখে মুখে ধরা পড়ছে।

সেই রাতে এক গোপন বৈঠকে ভবানী ঘোষ এসে বলল,
“তোমরা ইতিহাস লিখছ। ভবিষ্যতে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কে রুখেছিল সাহেবদের? আমি বলব, শিবপুরের নারীরা।”

জবা বলল, “কিন্তু রেণুদি বন্দি। যতক্ষণ না সে মুক্ত, ততক্ষণ আমাদের কাজ শেষ নয়।”

ভবানী মাথা নত করে বলল, “আমাদের পরবর্তী কাজ—রেণুকাকে মুক্ত করা।”

সেই সিদ্ধান্তে সভা ভাঙল। কিন্তু শিবপুরের নারীরা সেদিন নতুন পরিচয় পেল—তারা আর গৃহস্থের স্ত্রী বা কন্যা নয়। তারা এখন প্রতিরোধের সৈনিক।

এবার তারা সাহেবদের ভয় পায় না। বরং সাহেবেরা এখন অন্ধকারে হাঁটতে ভয় পায়,
কারণ তারা জানে—শিবপুরের বাতাসে
নারীদের নিঃশব্দ প্রতিবাদ এখন বজ্রের মতো বাজছে।

 সত্যের মুখোমুখি

নীলকুঠির ভিতরের সেই ঘরটা ছিল জানালাবিহীন, দেয়ালে ছত্রাকের ছোপ, বাতাসে শীতল স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। রেণুকা এখানে বন্দি অবস্থায় দিন গুনছিল না—সে প্রতিটি মুহূর্তে দাঁতে দাঁত চেপে টিকেছিল।
তার মন জানত, বাইরে কিছু একটা ঘটছে। তার কণ্ঠস্বর হয়তো আজ থেমে, কিন্তু তার জারিত করা আগুন আজ বহু মাটির স্তরে ঢুকে গেছে।

সাহেব রবার্ট হেনরি মাঝে মাঝে এসে কথা বলত, কখনও প্রলোভনে, কখনও ভয় দেখিয়ে।
“আমরা জানি, ভবানী ঘোষের সব খবর তোমার কাছে আছে। যদি তুমি নামগুলো বলো, আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।”
রেণুকা জবাব দিত না। শুধু তাকিয়ে থাকত, স্থির চোখে।

রবার্টের কণ্ঠ এবার কঠোর হলো, “তুমি হয়তো জানো না, তোমার সেই শিষ্যা—জবা—ওর ওপর নজর রাখা হয়েছে। আমরা জানি, সে কী করছে।”

রেণুকার মুখ কেঁপে উঠল, কিন্তু সে কিছু বলল না। ভিতরে ভিতরে আগুন উঁকি দিল।
তারপর সাহেব আরও বলল, “তোমার নামে মামলা হবে। আমরা ‘রাজদ্রোহী নারী’ হিসেবে তোমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব।”

রেণুকা এবার মুখ খুলল।
“আমি ভয় পাই না। আমার শাস্তি যদি হয়, সেটা তোমাদের জন্যই হবে—যারা ভাবো, মাটিকে কাগজে কিনে নেওয়া যায়। আমি একটা নামমাত্র নই, আমি এক মায়ের কান্না, এক কৃষকের রক্ত, এক কিশোরীর সাহস।”

রবার্ট থমকে গেল। সে বুঝল—এই নারীকে ভাঙা যাবে না।

তবু সেদিন বিকেলে কুঠির ভেতরে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো—রেণুকাকে রাতের অন্ধকারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কলিকাতা জেলখানায়। পথে থাকবে না কোনও কাগজ, কোনও নাম—তাকে গায়েব করে দেওয়াই হবে আসল উদ্দেশ্য।

কিন্তু ভবানী ঘোষ ও জবা ঠিক সেই রাতেই গোপনে খবর পেল এক কর্মচারীর কাছ থেকে।

গ্রামের শেষ প্রান্তে গাছতলায়, ঝাউবনের পাশে সেই কর্মচারী এসে বলেছিল, “আজ রাত তিনটেয় রেণুকাকে নিয়ে যাবে গোরুর গাড়িতে। ছদ্মবেশে, যেন কেউ টের না পায়।”

ভবানী তখন দাঁত চেপে বলেছিল, “ওরা ভাবছে, রেণুকা হারিয়ে যাবে। কিন্তু এবার সময় এসেছে আমরা আলো জ্বালাব।”

রাত নামল। চাঁদ ঢাকা ছিল মেঘে। কুঠির ভিতর গোরুর গাড়িতে রেণুকাকে চোখ বেঁধে তোলা হলো। কিন্তু গাড়ি এগোতেই বুঝল, কিছু অস্বাভাবিক।

হঠাৎ সামনে আগুনের আলো!
এক দিক থেকে বাঁশির শব্দ, অন্যদিক থেকে নারীকণ্ঠের আওয়াজ—

“রেণুদি! আমরা এসেছি!”
“মাটি আমাদের, কুঠি নয়!”

গাড়ির ঘোড়া চঞ্চল হয়ে উঠল। কুঠির পাহারাদাররা বন্দুক ধরল, কিন্তু চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে মাটি বাঁচাও সংঘ।

কেউ কাঠের লাঠি নিয়ে ছুটে এল, কেউ আগুন জ্বালিয়ে অন্ধকার সরাল, কেউ সাহেবদের মুখের সামনে চিৎকার করে বলল, “তোমরা রেণুকাকে নিয়ে যেতে পারবে না!”

সেই ভয়াবহ ধাক্কায় গাড়ির সামনের চাকাটা উল্টে গেল।
রেণুকা তখনও চোখ বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল।
জবা দৌড়ে এসে তার চোখের কাপড় খুলে বলল,
“রেণুদি, তোমার আলো এখন আমাদের আলো। আমরা আর পিছিয়ে যাব না।”

রেণুকা তাকিয়ে দেখল—চোখজুড়ে আগুনের ছায়া, মুখে মুখে শ্লোগান, বুকের গভীরে জয়ের কান্না।

সত্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছে—অবশেষে সাহেবরা বুঝেছে, এই লড়াই আর একটি মানুষের বিরুদ্ধে নয়,
এটা ইতিহাসের বিরুদ্ধে অন্যায় করা এক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

 উত্তরাধিকার

ভোর হতে বেশি দেরি নেই। শিবপুর গ্রামের উপর দিয়ে কুয়াশার পর্দা সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। পাখিরা ডেকে উঠেছে, আর পুকুরের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে আগুনের রঙ। আগের রাতের সেই আক্রমণ, সাহেবদের দম্ভচূর্ণ—সব যেন এই সকালটাকে নতুন করে সাজিয়েছে।

রেণুকা এখন আর কুঠির বন্দিনী নয়—সে মুক্ত, জবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিজের মাটিতে।
তার চোখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু সেই ক্লান্তির গভীরে গড়ে উঠেছে এক তীব্র স্থিরতা।

গ্রামের মানুষজন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, যাদের চোখে ছিল ভয়ের ছায়া, তারা এখন রেণুকার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে ভাবছে—কীভাবে এই নারী একটা গোটা গ্রামকে জাগিয়ে তুলল?

ভবানী ঘোষ সামনে এসে বলল, “তোমার নামে এখনো কুঠিতে কাগজ তৈরি হচ্ছে। তারা এখনও ভেবেই চলছে, কাগজ আর খাতাই মানুষের ভবিষ্যৎ ঠিক করে।”
রেণুকা হালকা হেসে বলল, “তাদের কাগজের কালি শুকিয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের মাটির গন্ধ থাকবে হাজার বছর।”

জবা তখন নিজের খাতাটা তুলে রেণুকার হাতে দিল।
“এই খাতা এখন তোমার,” সে বলল।
রেণুকা উত্তর দিল, “না জবা, এটা তোমারই। তুই শুধু লিখিস। কারণ ইতিহাস কেবল যুদ্ধ দিয়ে নয়, শব্দ দিয়েও লেখা হয়।”

সেই দিন রেণুকা নিজে এক মাটির ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে পুরো গ্রামের সামনে কথা বলল।

“আমরা আজ একটা পথ শেষ করলাম না, আমরা একটা পথ শুরু করলাম। আমি আর জবা শুধু দুটি নাম নই, আমরা দুটি প্রদীপ—যা এই গ্রামের মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছি। কেউ হয়তো আমাদের নাম মনে রাখবে না, কিন্তু আমাদের এই আগুন, এই সংগ্রাম, একদিন বয়ে যাবে আরেক রেণুকা, আরেক জবার ভেতর দিয়ে।

যে দিন মেয়েরা নিজের জমি নিজে চাষ করবে, যে দিন বিধবারা সাহস নিয়ে দরজা খুলবে, যে দিন ছোট মেয়েরা শিখবে নিজেদের প্রশ্ন করতে—সে দিন আমরা সত্যি জিতব।

আমাদের লড়াই কুঠির বিরুদ্ধে ছিল না কেবল, ছিল ভয়, লজ্জা আর নিঃশব্দ চোখের জলগুলোর বিরুদ্ধে।”

লোকজন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ চোখ মুছছিল, কেউ মাথা নিচু করছিল।
এক বালিকা, শাড়ির আঁচলে খুঁটি বাঁধা, ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “আমিও একদিন রেণুকার মতো হতে চাই।”
রেণুকা তার কাঁধে হাত রাখল। “তুই তো এখন থেকেই শুরু করেছিস। সাহস জন্মের সাথে আসে না—সেটা তৈরি হয় বিশ্বাস দিয়ে। তুই বিশ্বাস করেছিস, সেটাই বড় কথা।”

সেই দিন থেকে শিবপুরে আর সাহেবেরা ফিরে আসেনি।
নীলকুঠি পড়ে রইল, জ্বলা দেয়াল, ভাঙা জানালায় শুধু হাওয়া ঢুকত। একসময় সেখানে একটা বিদ্যালয় তৈরি হল—নাম রাখা হল ‘রেণুকা বিদ্যাশ্রম।’

আর গ্রামের এক কোণে একটি মেয়ের খাতার শেষ পাতায় লেখা রইল—
“বিদ্রোহ কখনও থামে না। শুধু নাম বদলায়। কিন্তু উত্তরাধিকার থেকে যায়… মাটির মতো, রক্তের মতো।”

সমাপ্ত

1000024548.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *