মৃনাল সরকার
পর্ব ১
ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বানানো সেই পুরনো বাংলোটা একা দাঁড়িয়ে ছিল পাইন আর ওক গাছের ছায়ার নিচে। অরুণাভ যখন গেট খুলে ঢুকলো, সামনের রাস্তায় আর কোনো গাড়ি ছিল না, কোনো মানুষও না। সবকিছু যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল তার আগমনের জন্য। বাংলোর নাম ‘শান্তিনিকেতন’, যদিও এই নামটা শুনে যে শান্তি পাওয়ার আশা করা যায়, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
সে একটি পুরনো, কাঠের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুললো। হালকা কড়চড় শব্দে দরজাটা উন্মুক্ত হল, যেন দীর্ঘ ঘুমের পর কেউ চোখ মেলল। ঘরের ভেতরে ধুলোময় আসবাব, কাঠের মেঝে, আর সিলিং থেকে ঝুলে থাকা একটা মৃত পাখির পালক—সবকিছুতেই ছিল পরিত্যক্ত জীবনের ছাপ। অথচ অরুণাভর মনে হল, কেউ যেন এখনো আছে এখানে। হয়তো ওপাশের ঘরে, কিংবা একতলার সিঁড়ির নিচে।
“এটাই তো চেয়েছিলাম,” নিজেই নিজেকে বলল সে, ব্যাগটা রেখে জানালার কাঁচ মুছে বাইরের দিকে তাকাল। পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আর লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে বাংলোর চারপাশে। এমন নিঃস্তব্ধতা শহরে পাওয়া যায় না। লেখার জন্য উপযুক্ত জায়গা।
অরুণাভ একজন লেখক, বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। বিখ্যাত নন, কিন্তু পাঠকের একটা গোষ্ঠী আছে, যারা তার লেখা ‘মনস্তাত্ত্বিক রহস্য’ গল্প ভালোবাসে। গত কিছু বছর ধরে সে লিখতে পারছিল না—মাথা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। তাই হঠাৎ একদিন, এক পরিচিতের পরামর্শে এই পাহাড়ি বাংলোতে একা এসে লেখার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাত নামল দ্রুত। বাতাসে ঠান্ডা, আর কিছু একটা অদৃশ্য শব্দ যেন ছড়িয়ে আছে বাতাসে—মৃদু ফিসফিস, দূরের শুকনো পাতা উড়ে যাওয়া, কিংবা দেয়ালের ফাটলে লুকিয়ে থাকা সময়ের শব্দ।
সেই রাতে ঘুম আসেনি। বিছানায় শুয়ে অরুণাভ ঘুম ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। তখনই সে প্রথম বুঝতে পারল ছায়া কেমনভাবে কাজ করে এই বাংলোয়। চাঁদের আলোয় তার নিজের ছায়া পড়েছিল দেয়ালের ওপর—নিশ্চল, নির্জীব। কিন্তু হঠাৎ একটা মুহূর্তে সে দেখল, সে নিজের মাথা নাড়েনি, অথচ ছায়ার মাথা একটু দুলে উঠলো। সে চমকে উঠল। দ্রুত আলো জ্বালালো। সব স্বাভাবিক। হয়তো চোখের ভুল, হয়তো বাতাসের খেলা।
পরদিন সকালে সে হেসে মনে করল, “ভয়ের গল্প লিখতে এসেছি আর নিজেই ভয় পাচ্ছি!” সে বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিল, আর নোটবুকে কিছু লাইন লিখছিল, তখন সে বুঝতে পারল ছায়াটি যেন তার লেখা অনুকরণ করছে। মানে সে এক লাইন লিখছে, আর জানালার পাশে পড়ে থাকা ছায়াটি তার হাতের গতিবিধি অনুকরণ করছে ঠিক ঠিক, কিন্তু কিছুটা তাড়াতাড়ি।
সন্ধ্যার দিকে ঘটনাটা আরও গভীর হল। সে যখন বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়ি কামাচ্ছিল, তখন আচমকা মনে হল আয়নায় প্রতিফলিত তার চেহারা এক মৃদু হাসি দিল। অথচ সে হাসেনি। ঘাম জমে গেল কপালে। “হ্যালুসিনেশন,” নিজেকে বোঝাল সে। “লেখকরা মাঝে মাঝে এমন হয়। রিয়েলিটি আর ইমাজিনেশন মিশে যায়।”
তবে রাতে আবার যখন ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল, তখন তার মাথার কাছে কার যেন নিঃশ্বাসের গরম বাতাস টের পেল। চোখ খুলে বসে পড়ল সে, কিন্তু পাশে কেউ নেই। জানালার বাইরে অন্ধকারের মাঝে গাছের ডালগুলো দুলছিল অস্থিরভাবে। হাওয়ার গতি বাড়ছিল যেন কারো রাগের মতো।
সেই রাতে সে আর ঘুমাতে পারেনি। শুধু জানালার পাশের ছায়াটাকে দেখছিল। এই ছায়া কি তার নিজের? নাকি এই বাংলোরই পুরনো কোনো সত্তা যা তার মতো নতুন আগন্তুকের দেহে জায়গা করে নিতে চায়?
অরুণাভ জানত না, এই ছিল তার শুরু, আর শেষটা… সেটা তার হাতেই আর থাকবে না।
পর্ব ২
ঘুমহীন রাত কাটিয়ে সকালটা এলো কুয়াশার চাদরে মোড়া হয়ে। পাহাড়ের ভেতরের বাতাসে একটা ঘনত্ব থাকে, যা শুধু ফুসফুসে নয়, মনে ও মাথাতেও চাপ ফেলে। অরুণাভ সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা ভারি অনুভূতিতে ভুগছিল—একটা ক্লান্তি, অথচ গতকাল সারাদিন সে বিশ্রামই নিয়েছিল। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই বুকের মধ্যে একধরনের চাপ অনুভব করল, যেটা ব্যাখ্যা করা যায় না। মনে হচ্ছিল, আয়নাটা যেন আসলে একটা দরজা—যেটার ওপাশে আরেকজন আছে, আর সে তাকিয়ে আছে অরুণাভর দৃষ্টির গভীরে।
চোখে মুখে জল দিয়ে স্নানঘরে ঢুকতেই সে আবিষ্কার করল এক অদ্ভুত ব্যাপার—আয়নার ওপাশের অরুণাভ যেন একটু দেরিতে নড়ছে। সে মুখ ধুচ্ছে, আর আয়নার প্রতিফলন সেটাই করছে, কিন্তু যেন এক ফ্রেম পরে, এক সেকেন্ড দেরিতে। সে থমকে গেল। ঘাড় গুঁজে কয়েকবার চোখ কচলালো, আয়নাটাকে ভালো করে দেখল। কিছুই নেই, তবু একটা হিমেল ভাব ঘিরে ধরল তাকে।
বেরিয়ে এসে বারান্দায় চেয়ারে বসে সে পুরোনো স্মৃতিতে ডুবে গেল। শৈশবে ঠাকুমার মুখে শুনেছিল, পাহাড়ি বাংলোগুলোয় আত্মা থাকে—বৃদ্ধ ব্রিটিশ সাহেবের, যাদের ফিরে আসার কিছুই নেই। সে বিশ্বাস করত না এসব। এখনো চায় না বিশ্বাস করতে। কিন্তু চোখ আর মন তো বারবার বলে, কিছু একটা ঠিকঠাক চলছে না।
লেখার চেষ্টা করল সে। খাতা খুলে কলম চালাতে গিয়ে শব্দগুলো এল না। কেবল মনে হচ্ছিল, পেছন থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। ঘাড়ে হালকা বাতাসের ঝাপটা, জানালায় পর্দার এক টান, আর বারবার টেবিলের নিচে অদৃশ্য একটা ছায়ার নড়াচড়া। অরুণাভ উঠে দাঁড়াল। “না, এভাবে চলবে না,” নিজেকে বোঝাল, “হয় পুরোটাই আমার কল্পনা, নয়তো সত্যিই কিছু আছে—তাহলে তো বোঝা দরকার।”
সে বাংলোর পুরোনো কাঠের তাক ঘেঁটে একটা মোমবাতি আর ম্যাচিস পেল। অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে, একে একে প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে দেখল—কেউ নেই। দরজা, জানালা বন্ধ। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুইটা। বাথরুমের পাশের একটা ছোট্ট দরজা চোখে পড়ল, যেটা সে আগে খেয়ালই করেনি। একটু বাঁকা হয়ে থাকা দরজাটা খোলার সময় কড়চড় শব্দে বাতাসের ঢেউ উঠল ঘরে। ভেতরে ছিল একটা খালি ঘর—কাঠের মেঝে, একটা পুরোনো আয়না, আর কোণায় জমে থাকা ধুলো। মোমবাতি হাতে নিয়ে আয়নার দিকে এগিয়ে গেল সে।
এই আয়নার মধ্যে কিছু ছিল। স্পষ্ট নয়, কিন্তু যেন একটা আবছা মুখ, যে অরুণাভকে দেখছে। সে নিজেকে বলল, “না, এগুলো ইলিউশন, প্রতিফলনের খেলা। এ তো ফিজিক্স ক্লাসে পড়েছি।” তবু মনে হচ্ছিল, আয়নার ওপাশের ছায়া তাকে চেনে। সে হাসে না, কথা বলে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে—চোখের গভীরতা ছাড়িয়ে এমন কিছু জানে, যা অরুণাভ জানে না।
সে খোলা জানালার দিকে মুখ ফেরাল। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া এসে চোখের পাতা জড়িয়ে ধরল। আর ঠিক তখনই, জানালার পাশে পড়ে থাকা নিজের ছায়াটাকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। এই ছায়াটা এখন আর আগের মতো নয়—এটা দাঁড়িয়ে আছে এমন ভঙ্গিতে, যেভাবে সে দাঁড়ায় না। হাত দুটো সামনে রেখে, মাথা একটু কাত করে, যেন কোনো অদৃশ্য বস্তু ছুঁতে চাইছে।
সে ছুটে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। দরজাগুলোও লক করে দিল একে একে। টেবিলের ওপর পাণ্ডুলিপি খোলা ছিল—কিন্তু পাতার মাঝখানে একটা লাইন লেখা, যেটা সে লেখেনি।
“তুমি যে আমি নও, সেটা তুমি নিজেই ভুলে গেছো।”
অরুণাভ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। এই লাইনটা কে লিখল? তার তো এমন হাতের লেখা না। আবার যাচাই করল খাতা—না, ঠিক একই স্টাইলে, একই কালি, কিন্তু তার লেখা নয়।
তবে কি…?
সে এবার বুঝতে পারল, লেখাটা কেবল ছায়ার অনুকরণ নয়—ছায়া এখন লিখতেও পারে।
সে কি তবে নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে?
পর্ব ৩
রাত তখন ঠিক মাঝপথে। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে—টিনের চালে টিপটিপ শব্দ, আর মাঝেমধ্যে পাহাড়ি ঝোড়ার গর্জন। অরুণাভ বিছানায় বসে ছিল, চোখে ঘুম নেই, কানে কেবল শব্দের ভেতরকার ছায়া। যে শব্দ একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে প্রশ্ন, ভয়, আর বিস্ময়।
লেখার খাতা বন্ধ। কলমের ঢাকনাও খুলে রাখা হয়নি আজ। কারণ আজ সে লেখার চেয়ে বেশি ‘পড়া’য় ব্যস্ত—কে লিখল সেই বাক্য? “তুমি যে আমি নও, সেটা তুমি নিজেই ভুলে গেছো।” শব্দটার মধ্যে যেন একটা নীরব উপহাস লুকিয়ে ছিল, যেন তাকে কেউ খেলার পুতুল বানিয়ে দিচ্ছে।
তবে কি তার ছায়া এখন শুধু অনুকরণ করে না, বরং চিন্তাও করতে পারে?
ভোর হতেই সে বেরোল বারান্দায়। পাহাড়ে কুয়াশা, যেন প্রকৃতি নিজেই সব ঢেকে দিতে চায়। দূরে এক চিল উড়ছিল, ছায়ার মতোই কালো। সে নিচে তাকিয়ে দেখল, ঘাসে ছায়া পড়েছে—কিন্তু, তার ছায়া যেন দুটো! একটাকে সে নিজের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, অন্যটি স্থির। সেই ছায়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে, মাথা নিচু করে… ঠিক যেমন সে আগের রাতে আয়নায় দেখেছিল।
অরুণাভ পেছন ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। আবার সামনে ফিরতেই সেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল, শুধু তার নিজের ছায়া রইল।
তার মাথা ঘুরে উঠল। সে আর থাকতে পারল না। ফোন ধরল—নেটওয়ার্ক ছিল না। পাহাড়ের এত গভীরে, সংকেত প্রায় অনুপস্থিত। ডায়াল করতে গিয়েও ব্যর্থ।
তারপর হঠাৎ, বাংলোর ছাদের পাশ থেকে একটা ধাতব শব্দ এল—কিছু একটা যেন পড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে সে দেখল, ছাদের পাশের ছোট্ট চিলেকোঠার জানালাটা খুলে আছে। আর ভেতরে কিছু একটা সরে গেল বলেই শব্দ হয়েছিল। পা টিপে টিপে সে ওপরে উঠল। সিঁড়ি প্রতিটি ধাপে যেন কাঁপছিল—সে জানত না এটা তার শরীর কাঁপছে, নাকি বাংলোর কাঠামো।
চিলেকোঠার ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় একটা সিলুয়েট চোখে পড়ল—একটা মানুষ। না, তা নয়। আসলে একটা কোটে টাঙানো হ্যাঙ্গার, যার ছায়াটা পড়েছে এমনভাবে, যেন কেউ দাঁড়িয়ে। তবু, অরুণাভের চোখে জল এসে গিয়েছিল ভয় আর টেনশনে।
নিচে নেমে এসে সে ভাবল, হয়তো ক্লান্তি, হয়তো ঘুমের ঘাটতি, এসব কারণেই মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখনই টেবিলের ওপর রাখা খাতাটা আবার চোখে পড়ল। খুলে দেখল—আজ সকালেও একটি লাইন লেখা হয়েছে, যেটা সে লেখেনি।
“আমি এখন শব্দ লিখি, কাল হয়তো তোমাকে।”
ঘাম জমে গেল অরুণাভর কপালে। সে হাত কাঁপতে কাঁপতে কলম হাতে তুলল। একটি লাইন লিখল—“তুমি কে?”
ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে বাতাস বয়ে গেল। জানালার পর্দা উড়ল। আর খাতায় তার লেখা লাইনের নিচে ভেসে উঠল আরেকটি লেখা—
“তোমার ছায়া, যাকে তুমি ত্যাগ করেছিলে।”
অরুণাভ চেয়ারে হেলান দিল। তার মনে হল, জীবনে কোনো এক সময় সে কিছু ফেলে এসেছে, হয়তো একটি ভয়, একটি অপরাধবোধ, কিংবা একটি সম্পর্ক। সেই ‘ছায়া’ আজ ফিরে এসেছে। সে বুঝে গেল, এটা কেবল ভূতের গল্প নয়—এটা তার নিজের আত্মার অন্ধকার অংশ, যা এতদিন সে চাপা দিয়ে রেখেছিল।
আর এই বাংলো? এটা কি নিছক জায়গা? নাকি তারই মতো মানুষদের জন্য তৈরি একটা ফাঁদ—যেখানে তারা আসে, আর থেকে যায়… নিজেকেই ভুলে গিয়ে?
পর্ব ৪
বাংলোর বারান্দায় বসে অরুণাভ জানত না, কতক্ষণ ধরে সে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে পাহাড়ের দিকে। বাতাসে পাইন গাছের মৃদু শব্দ যেন ভেতরের নীরবতা আরো বেশি গাঢ় করে তুলছে। একটা সময় সে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকল—এমনভাবে যেন বুঝতে চাইছে, আদৌ সে নিজের শরীরে আছে কিনা।
তার হাতটা নড়ছে ঠিক, তার ইচ্ছেমতোই। কিন্তু সেই মুহূর্তেই দেয়ালের পাশে পড়া তার ছায়া একটু অন্যরকমভাবে হাত নড়াল। ছায়াটি এবার সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে হল। যেন সে কেবল অনুগামী নয়, বরং একটা আলাদা সত্তা হয়ে উঠছে।
অরুণাভ উঠে দাঁড়াল। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। জল খেতে গিয়ে সে দেখে গ্লাসটা টেবিল থেকে ঠিক তখনি পড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ল, যখন সে তা ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু তার হাত পৌঁছানোর আগেই, যেন কেউ একটু ঠেলে দিল গ্লাসটাকে।
তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় মা বলত—“ছায়া নাকি মানুষের অবচেতনের প্রতিচ্ছবি। ওতে জমে থাকে যা আমরা স্বীকার করি না।” সে কি তবে নিজেরই কোনো অপরাধবোধের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ছে?
সে বাংলােটার পুরোনো আলমারি খুলল। ভেতরে পুরোনো কিছু চিঠিপত্র, ময়লা ধুলোয় ভর্তি খাতা, আর একটা ছোট লাল মলাটের ডায়েরি। খুলতেই দেখতে পেল, এক অচেনা হাতে লেখা পাতাগুলো। তারিখগুলো ছিল ১৯৭৫-৭৬ সালের। সেই সময়ের একজন বাসিন্দার লেখা।
“আজও ছায়াটা আমাকে অনুসরণ করল। আমি আয়নায় তাকালেই দেখি, সে আমার মতো দেখতে ঠিকই, কিন্তু তার চোখে আমার দোষগুলো জমে আছে। একদিন সে আমায় সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করবে—আমি জানি।”
অরুণাভ শিউরে উঠল। তাহলে সে একাই এমন নয়! আগে কেউ এসেছিল, এই বাংলোয় ছিল, ছায়ার চোখে নিজের অপরাধ দেখেছিল।
সে ডায়েরিটা বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিকেল নেমেছে। ছায়া পড়ছে লম্বা হয়ে। আবার সেই অদ্ভুত দ্বৈততা—একটা ছায়া ঠিক তার মতোই চলছে, আরেকটা একটু অন্যভাবে দাঁড়িয়ে। মাথা একটু নিচু, বাঁ পা সামান্য ভাঁজ করা, যেন ভাবনায় ডুবে।
সে নিজেকে মনে করল, বহু বছর আগে, সে একজনকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এক স্নিগ্ধ প্রেম, এক কোমল ভালোবাসা—যেটাকে সে ভয় পেয়েছিল। কারণ খুব ভালোবাসলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে—এমন বিশ্বাসে সে নিজেকে ছাড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিল।
কিন্তু সেই মেয়েটি বলেছিল, “তোমার ছায়াও বুঝবে আমি কে। আর একদিন ছায়াই তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবে আমাকে।” তখন সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ, এত বছর পরে, সেই কথাটা যেন ফিরে এল বাংলোর বাতাসে।
ছায়া কি তবে সেই সব চিহ্নের সঞ্চয়, যেগুলো আমরা নিজে জানি না, তবু যেগুলো আমাদের গড়ে তোলে?
রাত বাড়ছিল। বাইরে দূরের পাহাড়ে বাজ পড়ছিল ক্ষীণ শব্দে। বাংলোর ভেতরে বাতিটা একবার জ্বলে, একবার নিভে উঠল। অরুণাভ দরজা বন্ধ করছিল, ঠিক তখনি পেছনের দরজার কপাট নিজে থেকেই একটু খুলে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে তাকাল—কেউ নেই।
কিন্তু দরজার পাশে দেওয়ালে লেখা ছিল ছোট করে খোদাই করা এক লাইন—
“তুমি আমাকে ভুলে গেছো, কিন্তু আমি তোমাকে নয়।”
অরুণাভের মনে হল, তার ছায়া কেবল তার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং সেই অংশ, যাকে সে ফেলে রেখে চলে এসেছিল। কিন্তু ছায়া যে ফিরে এসেছে।
এবং এবার—চলে যাওয়ার নয়।
পর্ব ৫
রাত গভীর হতে বাংলোর বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠছিল। বাতি জ্বলছে ঠিক, কিন্তু আলো যেন ঘরের শেষ কোণায় পৌঁছাচ্ছে না। দেওয়ালের ফাটলগুলো থেকে হিমেল বাতাসের মতো উঠে আসছে এক অদৃশ্য অনুরণন—যা শব্দ নয়, কিন্তু অনুভব করা যায়।
অরুণাভের হাতের তালু ঘামছে। ডায়েরির পাতা বন্ধ করে সে তাকাল সামনে রাখা আয়নাটার দিকে। এই আয়নাটা আর যেকোনো আয়নার মতো ছিল না—সে টের পাচ্ছিল। প্রতিফলনে সে নিজেকে দেখতে পায় ঠিকই, কিন্তু আজ দুপুর থেকেই সে বুঝতে পারছিল, প্রতিচ্ছবিটা যেন একটু দেরিতে সাড়া দিচ্ছে। একটু বাঁকা হাসি দেয়, যখন সে হাসে না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, যখন সে প্রশ্নও করে না।
সে উঠে গিয়ে আয়নার কাছে দাঁড়াল। চোখে চোখ রাখল প্রতিচ্ছবির। সেই চোখ দুটো যেন তার সব গোপন কথা জেনে ফেলেছে। জীবনে যত দোষ, যত অস্বীকার—সব। আর ঠিক তখনই আয়নাটার ওপর একটা হালকা ধোঁয়াশা ছড়িয়ে গেল। যেন ভেতর থেকে কেউ শ্বাস ফেলল গ্লাসে। ধীরে ধীরে সেই কুয়াশার ভেতর একটা লেখা ভেসে উঠল—
“তুমি যদি ফিরে না তাকাও, আমি তোমার হয়ে তাকাবো।”
অরুণাভ ভয় আর কৌতূহলের দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল, সে এই বাংলো থেকে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কোথায় যাবে? যেটা তার ভেতরের ছায়া—তাকে তো সঙ্গে নিয়েই চলে যেতে হবে।
তবু সে সিদ্ধান্ত নিল, এবার একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে। সে গুটিয়ে থাকা ফাইলগুলো বের করল, পুরনো লেখা, অর্ধেক লেখা উপন্যাস, অসমাপ্ত গল্প—সব কিছু খুলে দেখল। আর সেখানে সে আবিষ্কার করল, অনেক পুরনো লেখাগুলোর শেষে এখন নতুন কিছু লাইন যোগ হয়েছে।
তার ‘মানসিক হাসপাতালের নোটস’ নামক গল্পের শেষে লেখা—
“চিকিৎসক ভুল করছিল না, রোগী আসলে নিজের ছায়ার চিকিৎসা করাচ্ছিল।”
তার ‘তৃতীয় দরজা’ উপন্যাসের খসড়ার মাঝে—
“তৃতীয় দরজা কেবল খোলে না, সে ডাকেও, নিজের মতো করে।”
তবে কি তার ছায়া শুধু লেখায় নয়, গল্পে ঢুকে যাচ্ছে? প্রতিটি লেখা যেন হয়ে উঠছে একটা আয়না, যেখানে সে নিজেকে দেখে না—বরং সেই সত্তাকে দেখে, যে তার ভেতর ছিল, চেপে রাখা, চুপচাপ।
তখনই বাতি নিভে গেল। সম্পূর্ণ অন্ধকার। অরুণাভ প্রথমে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা শুকিয়ে গেছে। ঘরে কার যেন হালকা পায়ের শব্দ, মেঝেতে যেন নখ ঘষে চলা ধ্বনি।
তখনই, অন্ধকারের মধ্যে, ঠিক সামনে—একজোড়া চোখ। চেনা, অথচ অপরিচিত। নিজের চোখের মতো, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গভীর, কালো, স্থির।
একটা মৃদু গলার শব্দ ভেসে এলো—“তুমি লেখো, আমি বাঁচি। তুমি থামলে, আমি হয়ে উঠি।”
আলো ফিরে এলো হঠাৎ। অরুণাভ দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে। তার প্রতিচ্ছবিটা এবার যেন হুবহু সেই কণ্ঠস্বরের মতো ঠোঁট নড়াল—কিন্তু সে নিজে কিছু বলেনি। শুধু দেখল, আয়নার ভেতরের সে একটা শব্দ করল—“আমার নাম রাখবে না?”
সে বুঝে গেল, তার ছায়া এখন আর চুপ থাকতে চাইছে না। সে কথা বলতে চায়, লিখতে চায়, পরিচিত হতে চায়।
প্রশ্ন একটাই—এই গল্পে কে লেখক? আর কে কাহিনির চরিত্র?
পর্ব ৬
অরুণাভ সেই রাতে আর ঘুমায়নি। বিছানায় বসে বসে শুধু ভাবছিল—“যদি ছায়ারও নাম থাকে?” মানুষের নাম তো সমাজ দেয়, পরিচয়ের জন্য। কিন্তু ছায়া? সে তো জন্ম থেকেই আমাদের সঙ্গে থাকে, অথচ কেউ তাকে ডাকেও না, চেনে না, চিনতে চায়ও না। এবার সেই ছায়াই নাম চায়।
সকালে সে কফির মগ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাইরের পাহাড় আজ কিছুটা রুক্ষ দেখাচ্ছিল। কুয়াশা কম, কিন্তু বাতাসে সেই পরিচিত গা ছমছমে ভাবটা রয়ে গেছে। কফির তীব্র গন্ধেও মন স্থির হচ্ছিল না। তার নিজের প্রতিচ্ছবি যেন এখন সবকিছুতে ছায়ার ছাপ খুঁজে ফিরছে।
সে খাতাটা খুলল, আবার লেখার চেষ্টা করল। ছায়া চাইছে নাম—তবে কেমন নাম হয় তার? না পুরুষ, না নারী। না আলো, না পুরো অন্ধকার। সে নাম দিল—“নির্বাক”।
ছায়ার জন্য এটাই তার দেওয়া প্রথম স্বীকৃতি। হয়তো এটাই ছিল দরজা খোলার চাবি।
যেই মুহূর্তে সে খাতায় লিখল—”নির্বাক”, তখনই জানালার পর্দা ধীরে ধীরে উঠল বাতাসে। ঘরের ভেতরে একটা নিঃশব্দ ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। খাতার পাতায় কিছু না লিখেও কালো কালিতে আঁকা হল একটা বাক্য—“তুমি আমাকে ডেকেছো, এখন আমি আসব।”
সে চমকে উঠল। খাতাটা বন্ধ করে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে একটা ওজন অনুভব করল ঘাড়ের ওপর, যেমন কেউ তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
সে আর সহ্য করতে পারছিল না। দৌড়ে দরজা খুলে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এল। তুষার পড়েনি, কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। পাহাড়ের ঢালু পথ ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল সে। পেছন ফিরে তাকাল।
বাংলোর জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে। ধূসর ছায়ার মতো আবছা অবয়ব। তার নিজের মতো দেখতে। কিন্তু ঠোঁট দুটো একটু ভিন্ন ভঙ্গিতে বাঁকানো। চোখ দুটো নিষ্পলক।
অরুণাভ আর হাঁটতে পারল না। পায়ের পাতা জমে গেল। তখন মনে হল, এই যে দৌড়—এটা কিসের জন্য? যে নিজের ভেতরের অন্ধকার থেকে পালাতে চায়, সে কতদূর পালাতে পারে?
সে আবার ফিরে এল বাংলোয়। দরজা খুলতেই বাতাস থেমে গেল, জানালার পর্দা থেমে গেল। কিন্তু খাতার পাতায় লেখা হলো নতুন একটি বাক্য—
“তুমি যে আমায় নাম দিলে, সেটা আমার জন্ম নয়, বরং তোমার মৃত্যু।”
অরুণাভ চেয়ারে বসে পড়ল। এই ছায়া, এই নির্বাক, এখন আর নিছক প্রতিচ্ছবি নয়। সে এখন লেখকও বটে, পাঠকও, আর ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে একমাত্র বেঁচে থাকা ব্যক্তি।
তার মনে হল, নিজের সঙ্গে এতদিন যে যুদ্ধটা সে লড়ছিল, সেই যুদ্ধে তার জেতার কথা ছিল না। কারণ প্রতিটি ভয়, প্রতিটি পলায়ন, প্রতিটি স্মৃতি—সবকিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে তার ছায়া।
আর আজ, ছায়ার নাম হয়ে উঠেছে তার নিজের পরিচয়।
পর্ব ৭
রাত তখন প্রায় দুটো। অরুণাভ খোলা জানালার পাশে বসে ছিল। বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল নিজেই। বাইরের চাঁদের আলোয় ঘরের ভেতর যা ছায়া পড়েছে, তা যেন আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রতিটা বস্তু, প্রতিটা কোণ—সেখানে একটা অতিরিক্ত অস্তিত্ব, একটা বাড়তি উপস্থিতি যেন নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে।
‘নির্বাক’—নামটা এখন তার মুখস্থ। যেন নিজেরই নাম, যেন এই পাহাড়ি নিঃসঙ্গ বাংলোয় সে আর একা নেই। আর কেউ নেই বলে সে জানে, কিন্তু তবু, কিছু একটা আছে, যার দৃষ্টির ভার তার ঘাড়ে সবসময় চাপ হয়ে থাকে।
তখনই হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা খাতাটা উল্টে গেল। বাতাস ছিল না, জানালা ছিল বন্ধ। তবু পাতাগুলো উড়ে গিয়ে খুলে গেল ঠিক সেই পৃষ্ঠায়, যেখানে সে প্রথম ‘নির্বাক’ শব্দটা লিখেছিল। পাতার কোণে লেখা হল নতুন বাক্য—“তোমার গল্প শেষ হলে, আমি শুরু হবো।”
অরুণাভের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। একটা ভেতর থেকে আসা ধ্বনি, একটা দীর্ঘশ্বাস, যেন হঠাৎ কেউ তার শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাথার ভেতর যেন শব্দ গুঞ্জন করছে, না কোনো কথার ভাষায়, না কোনো ভাবনার পথে—শুধু একরকম অনুনয়, একরকম ঘোষণা।
সে আয়নার দিকে তাকাল। আজ আয়নায় কেউ নেই। তার নিজের প্রতিচ্ছবিটাও নেই। কেবল ফাঁকা গ্লাস আর এক অন্ধকার।
সে ভয় পেল। মানুষ নিজের ছায়া হারালে কী থাকে? কেবল একটা দেহ, না একটা খোলস?
সে জানত না। তবে এখন অনুভব করছিল—তার গল্পটা কেবল একটা লেখা নয়, বরং একটা পথ, যা কেউ তার হয়ে হাঁটতে চাইছে। ‘নির্বাক’ তাকে সরিয়ে রেখে লিখতে চাইছে, ভাবতে চাইছে, বাঁচতে চাইছে।
অরুণাভ ফিরে গিয়ে পুরনো সেই লাল ডায়েরিটা আবার খুলল। এবার সে আগের পাতাগুলোর নিচে নতুন কিছু লেখা দেখতে পেল—যেগুলো সে আগে দেখেনি।
“আমি জানি, আমি একা নই। যাদের মনে অপরাধ, দুঃখ, ভুল, আর অন্ধকার জমে থাকে—তারা সবাই এসে পড়ে এই বাংলোয়। আর তাদের ছায়াগুলো আলাদা হয়ে যায়, আলাদা হয়ে দাঁড়ায়, আলাদা হয়ে লেখে।”
তারপর আরেকটা লাইন—
“যখন ছায়া কাহিনি লেখে, তখন তুমি চরিত্র হয়ে যাও।”
এই লাইনটা পড়ার পর অরুণাভ বুঝে গেল, সে আর লেখক নেই। এই গল্পে সে এখন একটা চরিত্র, যার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই। আর লেখক? সে এখন তার ছায়া, নির্বাক।
অরুণাভ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় তার ছায়া পড়েছে লম্বা হয়ে। সেই ছায়ার চোখ নেই, মুখ নেই, তবু সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল—ছায়াটার ঠোঁটে এবার একটুখানি হাসি।
পর্ব ৮
সকালে ঘুম ভাঙল না অরুণাভর, বরং সে অনুভব করল—ঘুম তাকে ছেড়ে গেছে অনেক আগেই। চোখ খোলা রেখেও সে যেন জেগে নেই, আর ঘুমিয়েও নেই। যেন কোনো একটা ভিন্ন মাত্রায় এসে আটকে গেছে, যেখানে সময় কেবল পিছিয়ে যায়, আর বাস্তবতা হয়ে পড়ে ঝাপসা আয়নার মতো।
খাট থেকে উঠে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আগের মতো আর ভয় লাগল না। আয়নায় আজ শুধু সে নিজেই নেই, বরং আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে—যার মুখ তার মতোই, কিন্তু চোখে নেই ক্লান্তি, নেই সংশয়। সেই প্রতিচ্ছবি ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল না, শুধু একটা আঙুল তুলে দেখাল টেবিলের দিকে।
টেবিলের ওপর খাতাটা আজ বন্ধ ছিল না। খোলা পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা—
“গল্প শুরু হোক এবার আমার হাতে।”
অরুণাভ জানত না, এখন কী করা উচিত। তবে সে অনুভব করছিল, প্রতিদিনের ধ্বংস থেকে কিছু একটা গড়ে উঠেছে তার ভেতরে, যার নাম রাখা যায় ‘নির্বাক’, যার কণ্ঠ হয়তো শব্দহীন, কিন্তু উপস্থিতি এতটাই প্রবল যে উপেক্ষা করা যায় না।
সে টেবিলে বসল। খাতার পাশে রাখা কলমটা নিজেই গড়িয়ে এসে থামল তার ডান হাতের কাছে। অবচেতনভাবে সে কলম তুলে নিল, কিন্তু তার আঙুল যেন নিজের ইচ্ছায় নড়ল না। কলমের ডগা পৃষ্ঠার ওপর ছুঁতেই হাত কাঁপল, তারপর শব্দ তৈরি হল—
“অরুণাভ মৃত নয়, সে কেবল গল্পের বাইরে।”
চোখ বড় হয়ে গেল তার। এরপর একে একে পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা হতে লাগল এমন সব ঘটনা, যা সে কোনোদিন লেখেনি—তার শৈশবের এক গোপন ভয়, তার প্রথম প্রেমে ভাঙন, তার মায়ের মৃত্যুর পর রাতজাগা কান্না—সব।
‘নির্বাক’ যেন তার আত্মজৈবনিক গল্প লিখতে শুরু করেছে। এমন সব অধ্যায়, যেগুলো সে ভুলতে চেয়েছিল, চাপা দিতে চেয়েছিল। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে আছে তার নিজের অস্বীকার করা সত্তা।
সে তখন বুঝতে পারল, লেখক হওয়া মানে কেবল গল্প বলা নয়, বরং নিজের মধ্যকার ভূতের মুখোমুখি হওয়া। আর সে মুখোমুখি হচ্ছে আজ, বাংলাের দেয়ালে, আয়নার ফাঁকে, ছায়ার অক্ষরে।
সন্ধ্যায় হঠাৎ ঘরের বাতি নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে খাতার ওপর থেকে এক ছায়ার হাত বেরিয়ে এল, ধীরে ধীরে পৃষ্ঠায় লিখল—
“পরের অধ্যায়ে তুমি থাকবে না, কারণ এবার আমি লিখব নিজের গল্প।”
অরুণাভ টের পেল, তার অস্তিত্ব শব্দের মধ্যেই গলে যাচ্ছে, যেন সে কেবল একটা কাঠামো ছিল যার ভেতর দিয়ে ছায়াটি বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিচ্ছিল।
সে তাকিয়ে রইল। আয়নায় এখনো প্রতিচ্ছবি নেই। কিন্তু তার মাথার ভেতর একটা কণ্ঠ ধ্বনিত হল—
“তুমি আমার প্রথম পৃষ্ঠা, আমি তোমার শেষ।”
পর্ব ৯
বাংলোর ঘরজুড়ে এখন আর কোনো শব্দ নেই, কেবল পৃষ্ঠার ওপর কলমের খসখস শব্দ। সেই শব্দ, যেটা অরুণাভ করছে না, বরং করছে তার ছায়া—নির্বাক। খাতা, কলম, কালি সবই অরুণাভর, কিন্তু হাতটা যেন অন্য কারো।
অরুণাভ নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না আয়নায়, টের পাচ্ছে না নিজের শ্বাসের শব্দ, এমনকি ছায়াও আর তার পায়ের নিচে পড়ে না। তার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে কাগজের ভাঁজে, অক্ষরের মাঝে, যেখানে সে ছিল লেখক, এখন কেবল একজন চরিত্র, নামহীন, নিঃশব্দ, গচ্ছিত।
ঘরের কোণ থেকে হঠাৎ এক কুয়াশা উঠে এসে জড়াল তার শরীর। ঠান্ডা নয়, গরম নয়—একটা নির্লিপ্ত স্পর্শ। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের আকাশে তারার আলোও যেন ম্লান হয়ে গেছে। পাহাড়ের নিচে যে শহর, তার আলোটুকুও আর চোখে পড়ছে না। যেন গোটা পৃথিবী থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আটকে গেছে এই বাড়ির, এই গল্পের, এই ছায়ার মধ্যে।
তখনই পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো—
“তুমি চাইলে পালাতে পারতে, কিন্তু তুমি থাকতে চেয়েছিলে। এবার আমায় দাও সম্পূর্ণতা।”
অরুণাভ পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না, কিন্তু ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা ছায়াটি আর তার নিজস্ব ছিল না। ছায়াটা এবার মাথা তুলে দাঁড়াল।
ছায়ার গড়ন, মুখাবয়ব, চোখ—সব ছিল তারই মতো, কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত নির্ভীকতা। যেন সে যা করতে চলেছে, তার জন্য অনুশোচনার প্রয়োজন নেই।
ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো টেবিলের দিকে, আর হাতে তুলে নিল শেষ অবশিষ্ট ফাঁকা পাতাটা। সেখানে বড় অক্ষরে লেখা হল—
“গল্প শেষ, চরিত্র বিলীন।”
অরুণাভ দাঁড়িয়ে থাকল স্থির। তার শরীর না কাঁপছে, না দৌড়চ্ছে, না লড়ছে। যেন একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছেছে—যা সে অস্বীকার করেছিল এতদিন, তাই আজ তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে।
একসময় প্রতিটি গল্পের একটা শুরু থাকে, আর একটা শেষ। কিন্তু অরুণাভর গল্পে লেখক ছিল সে নিজেই, আর সমাপ্তির সময় সেই ভূমিকা চলে গেল তার ছায়ার হাতে। ‘নির্বাক’ হয়ে উঠল সেই সত্তা, যে কেবল গল্পের মধ্যে থাকে না, বরং গল্পকে নিজের মত করে গড়ে তোলে।
আলো নিভে গেল। বাতাস থেমে গেল। কেবল খাতার শেষ পাতায় ছায়া লিখে দিল—
“লেখক: নির্বাক”
পর্ব ১০: যে গল্পের লেখক কেউ নয়
বাংলোর সেই পুরনো কাঠের দরজা এখন বন্ধ। বাইরের পাথুরে সিঁড়িতে পাতা জমে আছে, কাঠের বারান্দায় এক পশলা ধুলো বসে আছে নিঃশব্দে। ভেতরে আলো জ্বলে না, শব্দ হয় না। কেবল বাতাস বয়ে যায় মাঝেমধ্যে, যেন কারো উপস্থিতি না থেকেও থেকে যায়।
অরুণাভ সেনের আর কোনো নাম নেই। কোনো চিঠি এসে পৌঁছায় না তার নামে। শহরে কেউ আর জানতে চায় না, সে কোথায় গেল। প্রকাশক চুপ, বন্ধুরা অবাক, পাঠকরা নিঃসাড়। কারণ অরুণাভ কোথাও হারিয়ে যায়নি—সে কেবল গল্পের মধ্যেই থেকে গেছে।
‘নির্বাক’ এখন বাংলোর একমাত্র বাসিন্দা। সে লেখে। প্রতি রাতে, নিরবতায়, অনন্ত কাগজের ভাঁজে সে প্রতিটি মানুষের ছায়াকে খুঁজে এনে তার নাম লেখে। যে কেউ একবার এ বাংলোয় এলে, তার ছায়া আর ফিরে যায় না।
একদিন হঠাৎ এক নবীন লেখক আসে সেখানে—একই মতো একলা, ভেতরে জমে থাকা ভয় নিয়ে। সে জানে না, অরুণাভ একসময় ছিল এখানে। সে জানে না, এই বাংলোর আয়না কোনো মানুষের প্রতিবিম্ব ধরে না, কেবল ছায়াদের।
সে জানে না, লেখালেখি একমাত্র উপায় নয় কিছু বোঝার—লিখতে লিখতে যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলো, তবে কাহিনিই হয়ে যায় বাস্তব।
রাত গভীর হলে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না। কেবল এক সাদা খাতা পড়ে থাকে টেবিলের উপর, যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা—
“ছায়াসঙ্গী – একটি অসমাপ্ত স্মৃতি।”
তার নিচে ছোট করে লেখা—
“লেখক: কেউ নয়, অথবা তুমি নিজেই।”
সেই নবীন লেখক কলম তোলে, কাঁপা হাতে প্রথম শব্দ লেখে।
আর তখনই, কোণার অন্ধকার থেকে এক ছায়া উঠে আসে… তার মতো দেখতে… একটু ধীর, একটু চুপ, একটু চেনা।
শেষ