Bangla - ভূতের গল্প

অন্ধকার চৌরাস্তা

Spread the love

বিপ্লব মুখোপাধ্যায়


 অধ্যায় ১ 

রাতের কলকাতা যেন দিনের চেয়ে অনেক বেশি গল্প লুকিয়ে রাখে, অজয় মনে মনে এই কথাটা বিশ্বাস করত। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো যখন দিনের কোলাহল ছেড়ে নীরবতার চাদরে নিজেকে ঢেকে রাখে, ঠিক তখনই অজয়ের গাড়ির ইঞ্জিন গর্জন করে সেই নীরবতা চিরে ফেলে। সে একজন উবার চালক, সদ্য বিয়ে হওয়া, বয়স হবে বড়জোর সাতাশ-আটাশ। অজয়ের স্ত্রী পিয়া প্রতিদিন রাতের শিফটে বেরোবার সময় ওকে সাবধান থাকতে বলত, কিন্তু অজয় হাসত। সে জানত, এই শহরে হাজারো মানুষ রাতের অন্ধকারে জীবিকার তাগিদে পথে নামে, আর তাদের মধ্যে সে একজন। কিন্তু আজকের রাতের কিছু বিশেষতা ছিল। গাড়ি স্টার্ট করার আগে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচের রাস্তায় তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। চারপাশে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, যেন শহরটা গভীর ঘুমে ডুবে আছে। পিয়ার হাতের মুগ্ধ করা কফির শেষ চুমুকটা নিয়ে সে যখন গাড়িতে বসে ইঞ্জিন ঘোরাল, ঠিক তখন তার ফোনের নোটিফিকেশন বেজে উঠল — সহকর্মী বিজয় একটা মেসেজ পাঠিয়েছে। “ভাই, আজ চৌরাস্তা দিক দিয়ে যাস না। কাল রাতেই জসিম ওখানে গিয়ে উধাও, পুলিশ এখনো খুঁজে পায়নি। ছায়া দেখা গেছে বলছে অনেকে। সাবধান!” অজয় নোটিফিকেশনটা পড়ে হালকা হেসে উঠল। এই ধরনের গল্প সে কতবার শুনেছে! অজয় নিজেকে সাহসী ভাবত, আর তার মনে হত এই শহরের অলিগলি, চোরাগলি, চৌরাস্তা – এসব শুধুই মানুষের কল্পনার ভয়।

অজয় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শহরের বাতাসে একটা শীতলতা, ডিসেম্বর মাসের রাতের শীত। চারপাশের আলো ঝলমলে বাজারগুলো বন্ধ হতে হতে যেন একেকটা ভূতের শহরে রূপ নিচ্ছে। বড় রাস্তা পেরিয়ে যখন সে বাইপাসের দিকে এগোতে শুরু করল, তখন তার মনের কোণে অজানা এক শিহরণ খেলে গেল। রাস্তাঘাট ফাঁকা, দূরদূরান্তে কুকুরের ডাক আর মাঝে মাঝে ট্যাক্সি বা লরির হেডলাইটের ঝলকানি ছাড়া আর কিছু নেই। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল বিজয়ের কথা, আর চৌরাস্তার সেই গল্প। বলা হয়, রাত বারোটার পর সেখানে এক অজানা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে। যে গাড়ি বা রিকশা সেখানে থামে, তার চালক আর ফিরে আসে না। প্রথমে গুজব মনে হলেও, বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এই গল্পকে বাস্তবের ছোঁয়া দিতে শুরু করেছে। এমন সময় অজয়ের ফোনে রাইডের অর্ডার আসে — গন্তব্য চৌরাস্তা! সে একটু থমকে গেল। কী করবে? ফিরিয়ে দেবে? কিন্তু না, ভয় পেলে চলবে না। সে যাত্রীর ডাকে সাড়া দিল। গাড়ি ঘুরিয়ে সে সেই দিকেই রওনা হল। গাড়ির ভেতরে হালকা মিউজিক চালিয়ে রাখল, যেন নিজের ভেতরের অস্বস্তি ভুলে থাকতে পারে।

যখন সে চৌরাস্তার কাছাকাছি পৌঁছল, তখন রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন ঘনিয়ে এল। দূরে একটি নরম হলুদ আলো জ্বলছে, হয়তো কোনো পুরনো রাস্তার বাতি। কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন চারপাশ। গাড়ি ধীরে ধীরে সেই চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ সে দূরে মানুষের মতো কিছু একটার অবয়ব দেখতে পেল — খুব অস্পষ্ট, যেন কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। অজয় চোখ মুছে নিয়ে আবার তাকাল, কিছু নেই। সে হালকা হেসে উঠল নিজের উপর — মনে মনে ভাবল, ভয়ের গল্পগুলো তার মনে খেল দেখাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই রিয়ার ভিউ মিররে সে টের পেল যেন কেউ তার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কোনো যাত্রী! অজয় গাড়ি থামাল। দরজা খুলে সেই যাত্রী বসল। লোকটা চুপচাপ, মুখ ঢাকা হুডি দিয়ে। গলার স্বর কর্কশ, সে বলল, “চৌরাস্তার শেষ মাথা পর্যন্ত নিয়ে চলুন।” অজয় হালকা কাঁপা কাঁপা গলায় সম্মতি জানিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করল। যাত্রী একেবারে নিঃশব্দে বসে আছে, যেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। অজয় বারবার রিয়ার ভিউ মিররে তাকাচ্ছিল, কিন্তু যাত্রীর মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না। গাড়ির ভেতরে এক অদ্ভুত ঠান্ডা ভাব নেমে এল, যেন শীতের চেয়ে অন্য কোনো শীতলতা ওকে ঘিরে ধরছে। গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ ইঞ্জিন কেঁপে উঠল, আলো নিভে গেল, আর গাড়ি থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল চৌরাস্তার মাঝখানে।

কয়েক সেকেন্ড যেন সময় স্থির হয়ে গেল। অজয় চেষ্টা করল ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে, কিন্তু ব্যর্থ হল। চারপাশে নিস্তব্ধতা এত ঘন হয়ে এল যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করে রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে অজয় দেখল, যাত্রী নেই! সে অবাক হয়ে পেছনের সিটের দিকে ঘুরে তাকাল — খালি। গাড়ির দরজা কখনো খুলেছে, সেই শব্দও সে শোনেনি। হাওয়ার ঝাপটা যেন ভেতরে ঢুকে গাড়িকে কাঁপিয়ে দিল। অজয় গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, আর চারপাশের অন্ধকার চেয়ে দেখতে থাকল। দূরে কুয়াশার মধ্যে সেই ছায়া আবার দেখা দিল — এবার আরও স্পষ্ট। একটি ছায়ামূর্তি, মানুষের অবয়ব, কিন্তু মুখহীন। অজয়ের শরীরে হিম স্রোত বয়ে গেল। সে মনে মনে পিয়ার মুখ মনে করতে লাগল, সেই উষ্ণ হাতের স্পর্শ মনে করতে লাগল, যেটা তাকে প্রতিদিন বাঁচার শক্তি যোগায়। কিন্তু আজ, এই চৌরাস্তার অন্ধকার তাকে এক অজানা ভয়ের জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, আজ রাতটা আর পাঁচটা রাতের মতো নয়। চৌরাস্তার ছায়া আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

অধ্যায় ২

নির্জন সেই চৌরাস্তার মাঝখানে থেমে যাওয়া অজয়ের গাড়ি যেন ভয়ের এক ঘূর্ণিপাকে তাকে আটকে রেখেছিল। কুয়াশার চাদরের মধ্যে থেকে হঠাৎ দেখা দেওয়া সেই ছায়ামূর্তির ভয়াল উপস্থিতি তার মনে ভয়ের তীব্র সঞ্চার করল। কিন্তু সাহসী মন মানতে চাইল না যে সে হার মানবে। সে জোরে জোরে ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু ইঞ্জিন শুধুমাত্র কঁকিয়ে উঠল, চলল না। গাড়ির জানালার কাঁচ ঝাপসা হয়ে উঠেছে, বাইরের ঠান্ডা কুয়াশা গাড়িকে যেন গ্রাস করছে। ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ ফোনে ভেসে এলো এক অদ্ভুত টু-টোনে ডাক। পরিচিত কোনো রিংটোন নয়, অদ্ভুত, যেন ভিন্ন জগৎ থেকে আসা এক ছায়ার ডাক। কাঁপা হাতে অজয় ফোন তুলল। ওপার থেকে আসা কণ্ঠস্বর যেন মানুষের নয়, ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, “আমাকে পৌঁছে দাও… চৌরাস্তা পেরিয়ে… শেষ মাথায়… শেষ রাতের আগে…” কথা শেষ হবার আগেই লাইন কেটে গেল। অজয় ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার দেখতে চাইল, কিন্তু ডিসপ্লেতে কোনো নাম্বার নেই। “নম্বর আননোন” লেখা ভেসে আছে। অজয় অবাক হয়ে চারদিকে তাকাল, কিন্তু সেই অদৃশ্য যাত্রী বা ছায়া কিছুই দেখতে পেল না। তার বুকের ভিতরে কেমন যেন চাপা ধুকপুকুনি বাড়তে লাগল। চৌরাস্তার নিস্তব্ধতা, অচেনা কণ্ঠের সেই ডাক, আর ইঞ্জিনের অচল হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে রাতের সেই মুহূর্ত যেন এক বিভীষিকাময় কল্পনায় পরিণত হতে লাগল।

অজয় অজান্তেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়াল। রাতের বাতাস তার গা বেয়ে বয়ে যাচ্ছিল। সে চারদিক নিরীক্ষণ করল—চৌরাস্তা তখনও নীরব, কেবল দূরে একটি কুকুরের কান্নার মতো ডাক ভেসে আসছিল। হঠাৎ যেন সেই কুয়াশার ঘন চাদর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সেই ছায়া। এবার ছায়ামূর্তিটি গাড়ির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কুয়াশার ঘনত্বে মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—এক লম্বা পুরুষালি গঠন, মাথায় টুপি বা হুডির মতো কিছু একটা। অজয়ের পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সে মনে মনে নিজের মনকে সাহস দিল, ‘না, এ তো কেবল কল্পনা… হয়তো কেউ মজা করছে… হয়তো অন্য কোনো চালক, যে নতুনদের ভয় দেখাচ্ছে।’ কিন্তু তার এই যুক্তি নিজের কাছেই ফিকে লাগছিল। ঠিক সেই সময় ছায়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমাকে পৌঁছে দাও… চৌরাস্তার শেষ প্রান্তে…” অজয় কাঁপা হাতে ইঞ্জিন ঘোরাতে চেষ্টা করল আবার, অবাক হয়ে দেখল ইঞ্জিন হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে নিল। সেই অচেনা ছায়া গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। দরজার বন্ধ হবার শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা আরও গাঢ় হয়ে উঠল। গাড়ির ভেতর হালকা শীতল বাতাস বইতে লাগল, যেন সেই ছায়া শীতের চেয়ে ভয়াবহ কোনো শীতলতা বয়ে এনেছে।

গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল চৌরাস্তার শেষ প্রান্তের দিকে। অজয় বারবার রিয়ার ভিউ মিররে তাকাচ্ছিল, কিন্তু পেছনের আসনে বসা সেই ছায়ামূর্তির মুখ কখনও স্পষ্ট করতে পারছিল না। মিররে কেবল এক ধূসর ছায়ার আভাস দেখা যাচ্ছিল। সে ভাবল, যদি লোকটা সত্যিই মানুষ হয় তবে হয়তো মদ্যপ, নাহলে মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে সেই গলা ভেসে এল—“তোমার ভয় কিসের অজয়? তুমি তো সাহসী, তাই না?” অজয়ের বুকের ভেতর গরম-ঠান্ডা এক শিহরণ বয়ে গেল। সে তো কখনও নিজের নাম বলেনি যাত্রীর কাছে! অজয় ভয়ে-দুশ্চিন্তায় নীল হয়ে গেল। তার কণ্ঠ শুকিয়ে এল, কিছু বলার শক্তি পেল না। সে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকল, কেবল জানালা দিয়ে বাইরের কুয়াশার অন্ধকারে দৃষ্টি রেখেই। হেডলাইটের আলো কুয়াশার দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর সেই প্রতিফলনে একেক সময় মনে হচ্ছিল যেন শত শত ছায়া নাচছে রাস্তার পাশে। পেছনের ছায়া নিঃশব্দে বসে রইল, আর অজয় সময়ের বোঝা মাথায় করে সেই চৌরাস্তার শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।

যখন গাড়ি শেষ মাথায় পৌঁছল, তখন চারপাশ আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। রাতের শেষ প্রহর বয়ে যাচ্ছে। অজয় গাড়ি থামাল। পেছনের ছায়া দরজা খুলল না, কেবল বলল, “আমার গন্তব্য এখানেই শেষ… তোমার শুরু হবে এখান থেকে… আমার মতো আর একজন খুঁজে নিও… নইলে তোমারও শেষ হবে আজ রাতেই…” কথা শেষ হতেই পেছনের সিট শূন্য হয়ে গেল। অজয় আতঙ্কে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনের দরজা খুলে ছিল না, কিন্তু সেই ছায়া নেই। কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেছে সে। চারপাশে নিস্তব্ধতা এতটাই গাঢ় যে অজয়ের নিজের হৃদস্পন্দন তার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ, তার গাড়ির হেডলাইট বন্ধ হয়ে গেল, আর ফোনের স্ক্রিন নিভে গেল। সে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দূরে কুয়াশার মধ্যে আবার সেই ছায়ার ভগ্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেল—“শেষ রাতের আগে… শেষ রাতের আগে…” শব্দগুলো বাতাসে মিলিয়ে যেতে যেতে সেই চৌরাস্তার অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলল। অজয় বুঝতে পারল, এই রাত তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাতের শুরু, এবং চৌরাস্তার সেই অশরীরী যাত্রীর গল্প এখন আর গল্প নয়, বাস্তব।

অধ্যায় ৩ 

চৌরাস্তার সেই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অজয়ের শরীর ঠান্ডায় কাঁপছিল না, কাঁপছিল ভয়ে। তার মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কোনো চোখ তাকে দেখছে, অদৃশ্য হাত তার দিকে বাড়িয়ে আসছে। কুয়াশা ঘন হয়ে গিয়ে এক অন্ধকার চাদরের মতো চারপাশ ঢেকে ফেলেছে। গাড়ির হেডলাইট নিভে যাওয়ার পর সেই নিস্তব্ধতা আরও জেঁকে বসেছিল। অজয় নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, হৃদস্পন্দনের ধ্বনি যেন কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। সে গাড়ির দরজায় হাত রাখল আবার গাড়িতে ওঠার জন্য, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার পিঠে হালকা এক শীতল স্পর্শ অনুভূত হল। যেন কারও বরফ শীতল হাত তার পিঠে স্পর্শ করল। অজয় চমকে উঠে পেছন ঘুরে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। কেবল কুয়াশার ভেতর হালকা ছায়ার ভঙ্গুর রেখা, যা মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে। অজয় হিম হয়ে যাওয়া হাতে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গাড়ি জবাব দিচ্ছে না। হেডলাইটও জ্বলে না, ফোনও কাজ করছে না। যেন রাতের অন্ধকারই এখন তাকে পুরোপুরি গ্রাস করতে চাইছে।

অজয় জানালার কাঁচের দিকে তাকিয়ে দেখল কুয়াশার ফাঁকে সেই ছায়া আবার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। মানুষের মতোই চেহারা, কিন্তু মুখহীন, চোখ নেই, মুখ নেই, শুধু একটা অস্পষ্ট অবয়ব। অজয় চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। কুয়াশার মধ্যে সেই ছায়া যেন গাড়ির দিকে এসে দাঁড়াল। অজয়ের মনে হল, ছায়ার মুখ নেই বটে, কিন্তু সে তাকিয়ে আছে তার চোখে চোখ রাখার মতো করে। সেই অদৃশ্য চাহনি বুকের ভেতর ভয়ের শীতল শিকল বেঁধে দিচ্ছিল। হঠাৎ সেই ছায়া গাড়ির কাঁচের ওপর হাত রাখল। গাড়ির কাঁচের ওপরে হাতের ছাপ জমে রইল, আর তার সাথে সাথে গাড়ির ভিতর আরও শীতল হয়ে উঠল। অজয় ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে দরজার লক টিপল, যেন অদৃশ্য সেই সত্তাকে আটকাতে পারে। কিন্তু সে জানে, এই লক, এই দরজা কোনো সুরক্ষা দিতে পারবে না। ছায়া ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিল কাঁচ থেকে, আর সেই হাতের ছাপ কাঁচের উপর বরফের মতো ঠান্ডা রেখা রেখে গেল। অজয়ের মনে হল, এই ছাপ আর কুয়াশার ছায়া সবই যেন মৃত্যুর ডাক নিয়ে এসেছে।

গাড়ির ভিতর বসে বসেই অজয় প্রাণপণে প্রার্থনা করতে লাগল। সে পিয়ার মুখ মনে করতে লাগল, সেই উষ্ণতা, সেই জীবনের হাতছানি, যা তাকে এই ভয়ঙ্কর রাতের হাতছানি থেকে বাঁচাতে পারে। হঠাৎ করে তার কানে আবার ভেসে এল সেই ভাঙা কণ্ঠস্বর — “আমার মতো আর একজন… খুঁজে দাও…” কুয়াশার মধ্যে সেই ছায়া এবার দূরে সরে যেতে শুরু করল। অজয় জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, সেই ছায়া কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার ছায়া যেন গাড়ির গায়ে লেগে রইল, যেন কোনো অশরীরী সত্তা তার গাড়িকে নিজের ছায়ার চাদরে মুড়ে ফেলছে। গাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা আরও কমে গেল, শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগল। অজয় জানত, সে আজ কোনো সাধারণ রাতে চৌরাস্তা পার করছে না। এই রাত তাকে এমন এক অজানা রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়েছে, যা সে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। তার চারপাশের অন্ধকার আর কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে যেন শত শত ছায়া নাচছে, ডাকছে তাকে, টানছে এক অনন্ত অজানার দিকে।

শেষমেষ অজয় ইঞ্জিনে চাবি ঘোরাল। আশ্চর্যজনকভাবে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিল। হেডলাইট জ্বলে উঠল, কুয়াশার দেয়ালে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করল। অজয় আর কোনো কিছু না ভেবে গাড়ি ঘুরিয়ে চৌরাস্তা ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু যতই সে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করল, মনে হল গাড়ি ঘুরে ঘুরে আবার চৌরাস্তার কাছেই চলে আসছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাঁচে হঠাৎ ভেসে উঠল সেই বরফের মতো হাতের ছাপ, যেটা সে আগেই মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। হাওয়ার তীব্র ঝাপটা যেন গাড়ির ভিতর ঢুকে তার বুকের ভেতরও কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অজয় জানে না এই রাতের শেষ কোথায়, সে জানে না চৌরাস্তার এই অন্ধকার তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। কেবল সে জানে, সে হারাতে বসেছে তার স্বাভাবিক জগতের সমস্ত চেনা অনুভূতি, আর এই রাতের ছায়া তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা গহ্বরের দিকে।

অধ্যায় ৪

গাড়ি যেন এক অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে ঘুরপাক খেতে খেতে বারবার সেই চৌরাস্তার অন্ধকার বৃত্তেই ফিরে আসছিল। অজয়ের মনে হচ্ছিল, সে যেন এক অভিশপ্ত চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে—যেখানে সময় থেমে গেছে, আর চারপাশের কুয়াশা তার প্রত্যেকটি শ্বাসকে আরও ভারী করে তুলছে। সে জানে না কতক্ষণ ধরে সে এই অদৃশ্য চক্রে ঘুরছে, কেবল জানে যে তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। হেডলাইটের আলো কুয়াশার দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে বারবার চোখে ধাঁধা তৈরি করছে, আর সেই আলোয় কুয়াশার ফাঁকফোকরে ছায়াগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হঠাৎ সে দেখল, রাস্তার এক কোণে মৃদু আলো জ্বলছে—একটা ছোট্ট চায়ের দোকান, যা সে আগে কখনও দেখেনি। গাড়ি থামিয়ে সে দৌড়ে বেরিয়ে এল। সেই দোকানের পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ দোকানদারটি যেন অজয়ের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল। তার চোখ দুটো অসীম ক্লান্তিতে ভরা, কিন্তু এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসও লুকানো রয়েছে সেই চাহনিতে। বৃদ্ধ ধীরে বলল, “তুমি ওদের চোখের পাতা থেকে পালাতে পারবে না, যদি না সত্যি খুঁজে পাও কেন এই রাত তোমাকে খুঁজছে।”

অজয়ের নিঃশেষিত কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা প্রশ্ন বেরিয়ে এল, “কারা… কারা খুঁজছে আমাকে? আমি তো কিছু করিনি…” বৃদ্ধ এক চুমুক চা খেলেন, তারপর ধীরে বললেন, “এই চৌরাস্তা অভিশপ্ত… বহু বছর আগে এক দুর্ঘটনা এখানে ঘটেছিল, যেটা কেউ আর মনে রাখে না, কিন্তু এই মাটি মনে রেখেছে। সেই রাতের আর্তনাদ, সেই অসমাপ্ত যাত্রা, সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণেরা এখন চায় কেউ তাদের শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দিক।” অজয় শিউরে উঠল। “কিন্তু আমি কী করব? কীভাবে বাঁচব?” বৃদ্ধ বলল, “তুমি হয়তো বাঁচতে পারবে, যদি সেই ছায়াকে শেষবারের মতো তার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারো… কিন্তু তার আগে তাকে খুঁজে বের করতে হবে, কারণ এই রাতের ছায়ারা এখন তোমার গাড়ির সাথে লেগে গেছে। চৌরাস্তা যতই পার হও, তারা তোমাকে ছাড়বে না যতক্ষণ না তাদের শেষ গন্তব্যের দ্বার তুমি খুঁজে পাও।” অজয় আবার গাড়িতে ফিরে গেল, বৃদ্ধের চোখের চাহনি যেন তার ভেতরে সাহসের সঞ্চার করে গেল। কিন্তু সেই সাহসও মুহূর্তেই ফিকে হয়ে গেল যখন সে দেখল, গাড়ির কাঁচের ওপরে কুয়াশার ফোঁটার মতো লেগে আছে অজানা হাতের অস্পষ্ট ছাপ, যেন কেউ ভিতর থেকে সেই ছাপ এঁকে দিয়ে গেছে।

গাড়ি চলতে শুরু করল আবার, এবার অজয় আরও সচেতনভাবে চারপাশ দেখতে লাগল। চৌরাস্তার প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি আলো-আঁধারি কোণে যেন তার মনে হচ্ছিল সেই ছায়া ডাকছে তাকে। হেডলাইটের আলোয় হঠাৎ দেখা মিলল এক নারীমূর্তির, যা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলেছে লিফট নেওয়ার মতো। অজয় জানালার কাঁচ নামিয়ে ডাকল, “কে? কোথায় যেতে চান?” কিন্তু কোনো উত্তর এল না। সেই ছায়া হালকা বাতাসের সাথে মিশে গেল। গাড়ির ভিতর হিমেল বাতাস ঢুকে অজয়কে শীতল করে দিল, আর সেই বাতাসে যেন ভেসে এল এক চিরচেনা কান্নার আওয়াজ। সেই কান্না যে সেই অভিশপ্ত রাতের নয়, তা অজয় বুঝতে পারল—এ সেই কান্না, যা সে নিজের অন্তর থেকে অনেক আগে হারিয়ে ফেলেছিল, সেই কান্না, যা জীবনের ভয় আর অনুতাপের মিশ্রণে জন্ম নেয়। গাড়ি চলতে চলতে এক অদ্ভুত মোড়ে এসে থামল, যেখানে রাস্তা তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। অজয় জানে না কোনটা বেছে নেবে। হঠাৎ পেছন থেকে সেই ভাঙা কণ্ঠের নির্দেশ এল, “ডানদিকের পথ ধরো… শেষ আশা সেখানেই লুকানো…”

অজয় ডানদিকের পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল। রাস্তার দুই পাশে ঘন জঙ্গল আর কুয়াশার চাদর। সেই অন্ধকারের মধ্যে গাড়ির আলো যেন কেবল কয়েক হাত সামনের দৃশ্যই স্পষ্ট করতে পারছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, রাস্তার ধারে পড়ে আছে একটি পোড়া রিকশা, আর তার পাশে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু পোড়া কাপড়ের টুকরো। সেই দৃশ্য দেখে অজয়ের মনে পড়ে গেল শহরের সেই পুরোনো গল্প, যেখানে এক রিকশাওয়ালা এই চৌরাস্তার অভিশপ্ত রাতে নিখোঁজ হয়েছিল। গাড়ি থামিয়ে অজয় নেমে এল, সেই পোড়া জায়গার কাছে এগিয়ে গেল। তার মনে হল, সেই পোড়া ছাইয়ের গন্ধের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে অদৃশ্য আর্তনাদ। হঠাৎ গাড়ির ভেতর থেকে হেডলাইট নিভে গেল, আর সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে এক ছায়া এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। অজয় আর নিজেকে সামলাতে পারল না, মাটিতে বসে পড়ে কেঁদে উঠল। সে জানে, এই রাত, এই চৌরাস্তা, এই ছায়ারা কেবল তার বাঁচার শেষ আশাটুকুই নয়, তার নিজের ভেতরের ভয়কেও স্পর্শ করেছে। এবং সেই স্পর্শ তাকে শেষ গন্তব্যের দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

অধ্যায় ৫

অজয়ের বুকের ভেতর কেঁপে উঠছিল প্রতিটি শ্বাস। সেই পোড়া রিকশা আর ছাইয়ের পাশে বসে থাকা অবস্থায় সে অনুভব করল, এক অদৃশ্য স্পর্শ তার আত্মার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সেই স্পর্শে ভয় আর করুণার এক মিশ্র বোধ তাকে গ্রাস করল। হঠাৎ কুয়াশার চাদর সরিয়ে সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। অজয়ের চোখের সামনে এক নারীমূর্তির ছায়া ভেসে উঠল, যার মুখে অনন্ত বেদনার রেখা, চোখ দুটি অদৃশ্য, কিন্তু তার অন্ধ শূন্যতা থেকেও যেন কষ্টের কাহিনি বেরিয়ে আসছিল। বাতাস নিস্তব্ধ, কেবল সেই নারীর পায়ের নিচে মাটিতে যেন ছড়িয়ে পড়ছে এক প্রাচীন অভিশাপের গন্ধ। অজয় দাঁড়িয়ে পড়ল, ভয়ে নয়—এই প্রথমবার তার মনে হল, সেই ছায়ার দৃষ্টি যেন সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সেই ছায়া হাত বাড়িয়ে দিল, অজয় অবচেতনেই সেই হাত ধরল। শীতল, বরফের মতো হাতের স্পর্শে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। কিন্তু সেই হাতের স্পর্শে এক আশ্চর্য শান্তিও যেন অনুভব করল সে—যেন সেই ছায়া তাকে তার শেষ যাত্রার সাথি করতে চায়।

গাড়ির দরজা নিজে থেকে খুলে গেল। ছায়া ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ল, যেন সে বহু বছর ধরে এই যাত্রার অপেক্ষায় ছিল। অজয় ড্রাইভিং সিটে বসল, ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। গাড়ি এবার আর ঘুরপাক খেল না। রাস্তা যেন নিজেই দিক নির্দেশ করতে লাগল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় কুয়াশা কেটে গিয়ে সামনের রাস্তা স্পষ্ট হতে লাগল। রাস্তার দুই পাশে পড়ে থাকা ভাঙা সাইনবোর্ড, ছিন্ন পোড়া পোশাক আর নীরব শহরের নিস্তব্ধতা এক অদ্ভুত গল্প বলছিল। গাড়ি এক অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল। পেছনের সিট থেকে হালকা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সেই কান্না যে আর্তনাদের নয়, সে যেন মুক্তির চাহনির প্রতিধ্বনি। অজয় নিজের অজান্তেই বলল, “আমাকে বলুন, কোথায় যেতে চান?” পেছন থেকে কোনো শব্দ এল না, কেবল বাতাসের হালকা স্পর্শে এক দিক নির্দেশ পেল সে। গাড়ি সেই নির্দেশ মতো চলতে লাগল, আর প্রতিটি মাইলস্টোনের মতো অজয়ের নিজের ভয়গুলো পেছনে ফেলে আসতে থাকল।

প্রায় এক ঘণ্টার যাত্রার পর শহরের এক প্রাচীন কবরখানার সামনে এসে গাড়ি থামল। অজয়ের মনে হল, কুয়াশার চাদর এখানে আরও ঘন হয়ে আছে, কিন্তু সেই কুয়াশার মধ্যেই যেন মুক্তির আলো লুকানো রয়েছে। পেছনের সিটে তাকিয়ে দেখল, সেই ছায়া আর নেই। কিন্তু গাড়ির সিটে কুয়াশার মতো এক পাতলা রেখা রয়ে গেছে, আর গাড়ির দরজা অদৃশ্য কারও স্পর্শে খুলে আছে। অজয় ধীরে গাড়ি থেকে নামল। কবরখানার ভেতর থেকে যেন ভেসে আসছিল হাজারো কণ্ঠের প্রার্থনার সুর, যা কুয়াশা ভেদ করে অজয়ের কানে বাজছিল। সে এগিয়ে গেল কবরের দিকে, আর হঠাৎ এক পুরনো পোড়া রিকশার ভাঙা চাকা দেখতে পেল সেখানে। সেই চাকার পাশে মাটির ভেতর অর্ধেক চাপা পড়া এক নারীর পোড়া কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের পাশে একটি লকেট পড়ে রয়েছে—যা অজয় একবার স্বপ্নে দেখেছিল, সেই লকেট, যা এই অভিশপ্ত ছায়ার আত্মার চিহ্ন বহন করছে। অজয় লকেটটি হাতে নিল, আর সাথে সাথে সেই প্রার্থনার সুর আরও জোরালো হয়ে উঠল, যেন মুক্তির ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠল সেই প্রাচীন অভিশপ্ত রাতে।

অজয়ের চোখ দিয়ে নেমে এলো অশ্রু, কেবল ভয়ে নয়, সেই আত্মার শান্তির জন্য, সেই অভিশপ্ত রাতের মাটির মুক্তির জন্য। সে লকেটটি মাটিতে পুঁতে দিল সেই কঙ্কালের পাশে, আর মৃদু কুয়াশার বাতাসে ভেসে এলো এক স্বস্তির নিশ্বাস। চারপাশের কুয়াশা ধীরে ধীরে সরতে শুরু করল, রাতের আকাশে চাঁদের আলো উঁকি দিল, আর চৌরাস্তা ফিরে পেল তার নিস্তব্ধ শান্তি। গাড়ির কাছে ফিরে এসে অজয় দেখল, তার গাড়ির কাঁচের সেই বরফের মতো হাতের ছাপ মিলিয়ে গেছে, হেডলাইটের আলো এখন আর বিভ্রান্ত করছে না। গাড়ি এবার সত্যিই ফিরে চলল শহরের দিকে, আর অজয় জানল, সে কেবল এক রাতের অন্ধকার পার করেনি, সে অতিক্রম করেছে নিজের মনের অন্ধকার, নিজের ভয় আর অপরিচিতের প্রতি করুণার সেই সীমারেখা, যা মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে।

অধ্যায় ৬ 

সেই রাতের যাত্রা শেষ হলেও অজয়ের ভেতরের ঝড় থামেনি। শহরের আলো-আঁধারি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে ফেরার সময় তার চারপাশের চেনা দৃশ্যগুলো অচেনা মনে হতে লাগল। প্রতিটি ট্রাফিক লাইট, প্রতিটি হোর্ডিং, প্রতিটি মোড় যেন তাকে সেই চৌরাস্তার স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল। গাড়ির হেডলাইট এবার আর বিভ্রান্ত করছিল না, কিন্তু তার নিজের মন বিভ্রান্তির আবরণে ঢাকা ছিল। ফেরার পথে অজয় একবার চৌরাস্তার দিকের দিকে তাকিয়ে দেখল। দূরে সেই অভিশপ্ত চৌরাস্তা এখন শান্ত, কুয়াশা নেই, নিস্তব্ধ। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতায় এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে আছে—যে প্রতিশ্রুতি অজয় আর কখনও এমন অন্ধকারে কাউকে একা ফেলে আসবে না। গাড়ি থামিয়ে অজয় জানলার কাচ খুলে দিল। হালকা বাতাস তার চুলে, মুখে লাগল, সেই বাতাসে যেন সেই ছায়ার বিদায়ী শ্বাস মিশে আছে। হঠাৎ তার মনে হল, সেই ছায়া কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে? নাকি এই নিস্তব্ধতা কেবল ঝড়ের আগের শান্তি?

বাড়িতে ফিরে ঘরের অন্ধকারে বসে অজয় সারা রাত ঘুমাতে পারল না। তার চোখের সামনে বারবার সেই ছায়ার মুখ ভেসে উঠছিল, সেই মুখ যা করুণা আর আর্তনাদের এক মিশ্র ছবি হয়ে গিয়েছিল। অজয় জানে, সে কেবল এক অভিশপ্ত আত্মাকে তার শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দেয়নি, সে নিজের ভেতরের এক গভীর শূন্যতাকেও স্পর্শ করেছে। ভোরের আলো ফোটার সময় অজয় এক কাপ চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। সেই চায়ের ধোঁয়া আর কুয়াশার রেখাগুলো তার চোখে মিশে এক নতুন গল্পের ইঙ্গিত দিল। সে অনুভব করল, এই শহরের প্রতিটি চৌরাস্তা, প্রতিটি অলিগলি কত অজানা গল্প বয়ে নিয়ে চলে, আর সেই গল্পের ছায়ারা হয়তো তাদের মুক্তির অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ অজয়ের ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর, কিন্তু সেই নম্বরের শব্দে অজয়ের বুক কেঁপে উঠল। ফোনের ওপার থেকে কেবল একটাই শব্দ ভেসে এলো—“ধন্যবাদ…” সেই কণ্ঠ নারীর, পরিচিত, কিন্তু জীবিত মানুষের নয়। অজয়ের হাত থেকে ফোন পড়ে গেল।

এরপরের কয়েকদিন অজয় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু শহরের সেই চৌরাস্তার কাছে গেলে বা রাতের নির্জনতায় গাড়ি চালালে তার মনে হতো, সেই ছায়ার উপস্থিতি এখনও কোথাও লুকিয়ে আছে। রাত্রি গভীর হলে গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে কখনও যেন এক ম্লান ছায়া চোখে পড়ত, আবার চোখের পলক ফেলতেই মিলিয়ে যেত। এক রাতে সে সাহস করে আবার সেই চৌরাস্তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তার ফাঁকা অংশটুকু আলোকিত, কুয়াশা নেই, অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কিন্তু অজয় জানে, সেই নিস্তব্ধতা কেবল বাহ্যিক, ভিতরে ভিতরে এই চৌরাস্তা এখনও বয়ে নিয়ে চলেছে সেই অভিশপ্ত অতীতের রক্তাক্ত স্মৃতি। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইট নিজে থেকে নিভে গেল, আর সেই অন্ধকারে এক মুহূর্তের জন্য অজয় স্পষ্ট দেখতে পেল সেই ছায়ার অবয়ব, এবার আর আর্তনাদ নয়, শান্তির ছোঁয়া তার মুখে। সেই দৃশ্য যেন অজয়কে আরেকবার প্রতিশ্রুতি দিল—এই রাত, এই চৌরাস্তা আর কাউকে হারিয়ে যেতে দেবে না।

সকাল হলে অজয় একা একাই গিয়ে শহরের পুরনো রেকর্ড অফিস থেকে চৌরাস্তার ইতিহাস খুঁজতে শুরু করল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে এক খবরের কাগজের হলদেটে কাটা পত্র খুঁজে পেল—যেখানে লেখা ছিল, “অজ্ঞাত নারীর মৃত্যুতে রহস্যময় দুর্ঘটনা: চৌরাস্তার কান্না থামছে না।” সেই পত্রিকায় ছাপা ছবিতে দেখা গেল সেই একই লকেট, যা অজয় সেদিন কবরের পাশে পুঁতেছিল। অজয় বুঝতে পারল, বহু বছর ধরে সেই আত্মা মুক্তি চেয়েছিল, আর হয়তো তার হাত ধরে সেই মুক্তি অবশেষে পাওয়া গেল। কিন্তু অজয়ের মনের এক কোণে সন্দেহের কুয়াশা রয়ে গেল—সেই চৌরাস্তা কি সত্যিই শান্ত? নাকি এই নিস্তব্ধতা অন্য কোনো গল্পের জন্য অপেক্ষায় আছে? অজয় জানে, সে আর কখনও রাত বারোটার পর শহরের কোনো চৌরাস্তার ডাক উপেক্ষা করতে পারবে না, কারণ প্রতিটি ছায়ার একদিন শেষ যাত্রার সাথি প্রয়োজন হয়।

অধ্যায় ৭

অজয়ের জীবন এক নতুন ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করেছিল। দিনের আলোয় শহরের ব্যস্ততা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত, কিন্তু রাতের ঘন অন্ধকারে সেই চৌরাস্তার স্মৃতি আবারও তার মনে হানা দিত। এক রাতে, রাত বারোটার কিছু পর সে আবারও তার গাড়ি নিয়ে বেরোল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য টান তাকে সেই চৌরাস্তার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির হেডলাইট এবার স্বাভাবিক, কিন্তু বাতাসে সেই পুরনো শীতলতা যেন ফিরে এসেছে। অজয় চৌরাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে দিল। চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ সে অনুভব করল, পাশের সিটে বসে আছে কেউ। মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল—এক ছায়া, স্পষ্ট নয়, আবছা। কোনো মুখ নেই, কোনো চোখ নেই, কেবল এক অস্পষ্ট অবয়ব। অজয়ের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু এবার সে ভয় পেল না। বরং মনে হল, এই যাত্রী তাকে কিছু বলতে চায়।

গাড়ির ইঞ্জিন নিজে থেকে স্টার্ট নিল, আর গাড়ি চলতে শুরু করল সেই চিহ্নহীন যাত্রীর অদৃশ্য নির্দেশে। শহরের অজানা অলিগলি, অন্ধকার রাস্তা আর কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাড়ি চলতে লাগল। অজয় জানত না, কোথায় যাচ্ছে সে। পেছনের সিটে বসা ছায়া নীরব, কিন্তু তার উপস্থিতি গাড়ির ভেতর এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, যেন সেই নীরবতাই হাজার কথার চেয়ে বেশি বলছে। অজয়ের মনে হতে লাগল, এই ছায়া তার আগের সেই ছায়ার মতো নয়। এ ছায়া যেন এক শূন্যতার প্রতিনিধি—যে হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে, যার নাম নেই, পরিচয় নেই, কেবল এক যাত্রী, যে চিরকাল যাত্রা করে চলে। হঠাৎ গাড়ি শহরের প্রান্তে এক পোড়া গুদামের সামনে এসে থামল। সেই গুদামের ভেতর থেকে ভেসে এলো ধোঁয়া আর পোড়া কাঠের গন্ধ। অজয় বুঝল, এই ছায়ার সঙ্গে এই জায়গার কোনো সম্পর্ক আছে।

অজয় গাড়ি থেকে নেমে গুদামের দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে যেন অদৃশ্য ছাপ পড়ে থাকল। ভেতরে ঢুকে সে দেখল, গুদামের দেয়ালে আগুনে পোড়া দাগ, ভাঙা কাঠের স্তূপের পাশে এক পুরনো ট্রাঙ্ক, আর তার পাশেই ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে চাপা পড়া এক ছেঁড়া ডায়েরির পাতা। সেই পাতায় লেখা আছে কাঁপা হাতের লেখা—“আমি ফিরতে চাই, কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলেছি। কেউ কি আমার পথ দেখাবে?” অজয়ের মনে হল, সেই চিহ্নহীন ছায়া তার পথ খুঁজে পেতে এই গুদামে নিয়ে এসেছে। সে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরল। গাড়ির পেছনের সিট ফাঁকা। সেই ছায়া নেই। কিন্তু বাতাসে এক শান্তির নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল, যেন সেই নামহীন যাত্রী শেষমেশ তার যাত্রার ঠিকানা পেয়েছে। অজয় বুঝল, সে কেবল একজন ড্রাইভার নয়—সে এক সেতু, যাত্রীদের আর অন্য জগতের মধ্যে।

রাতের অন্ধকারে গাড়ি নিয়ে ফিরতে ফিরতে অজয়ের মনে হতে লাগল, এই শহরের প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি চৌরাস্তা, প্রতিটি ফাঁকা গুদাম একেকটা হারিয়ে যাওয়া গল্পের সাক্ষী। সে জানে, আবারও কেউ ডাক দেবে, আবারও কোনো চিহ্নহীন যাত্রী তার গাড়িতে উঠবে, আর সে সেই অজানা পথের সাথি হবে। শহরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তার ছায়া আর গাড়ির হেডলাইটের রেখা মিশে এক রহস্যময় ছবি আঁকছিল। অজয়ের মুখে এক শান্ত হাসি ফুটে উঠল। সে জানত, এই রাতের গল্প শেষ নয়, কেবল নতুন অধ্যায়ের শুরু।

অধ্যায় ৮

গাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার পর অজয় রাতে আর ঘুমাতে পারল না। গুদামের সেই পোড়া দেয়াল, সেই ডায়েরির পাতার করুণ আহ্বান আর সেই চিহ্নহীন যাত্রীর নিঃশব্দ বিদায় তার মনের ভেতর এক অজানা অস্বস্তি তৈরি করল। সকাল হতেই সে আবার গিয়ে পৌঁছাল সেই গুদামের সামনে। সূর্যের আলোয় জায়গাটা আগের মতো ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল না, কিন্তু বাতাসে যেন এক চাপা গন্ধ ছিল—যা তাকে বলছিল, এখানেই লুকিয়ে আছে কোনো অজানা সাক্ষ্য, কোনো নীরব প্রহরী। অজয় গুদামের ভেতরে ঢুকে চারপাশের ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে লাগল। হঠাৎ ভাঙা কাঠের স্তূপের নিচে সে পেল এক লোহার সিন্দুক, তালা ভাঙা, ভিতরে ধুলো জমা কিছু কাগজপত্র, আর এক পুরনো ছবি—ছবিতে তিনজন মানুষ, এক নারী আর দুই পুরুষ। নারীর মুখটা অজয়কে চেনা মনে হলো—সেই ছায়া, সেই প্রথম রাতের যাত্রী। তার পাশের পুরুষ দুজনের চেহারায় এক অদ্ভুত কঠোরতা, যেন কোনো পাপের বোঝা তারা বয়ে বেড়াচ্ছে।

ছবির পেছনে লেখা নামগুলো অজয়কে শিহরিত করে তুলল—“প্রতাপ, মহেন্দ্র আর সুপর্ণা। ১৯৮৭।” অজয় দ্রুত শহরের পুরনো রেকর্ড অফিসে গিয়ে খবরের কাগজের পুরনো কাটিং খুঁজতে শুরু করল। অবশেষে এক বিবর্ণ কাগজে সে পেল সেই ঘটনার বিবরণ—“১৯৮৭ সালের এক রাতে এই গুদামে আগুন লেগে পুড়ে মারা যায় এক নারী। সন্দেহ করা হয়, দুই সহকর্মীর ষড়যন্ত্রে সেই আগুন লেগেছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কেউ শাস্তি পায়নি। সেই রাতের সাক্ষী এক নিঃসঙ্গ পাহারাদার, যে পাগলের মতো অজানা ভাষায় কথা বলে আর এখনো গুদামের ধারে ঘোরে।” অজয় বুঝতে পারল, তাকে এই সাক্ষীর খোঁজ পেতেই হবে। সেই সাক্ষীই একমাত্র জানে সেই রাতের সত্যি কী।

গভীর রাতে অজয় আবার সেই গুদামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাতের আঁধারে, কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। হঠাৎ দূরে এক কুড়িয়ে-পড়া কুৎসিত চেহারার বৃদ্ধ এগিয়ে এল, চোখ দুটো লালচে, চুল এলোমেলো, গলা ভাঙা স্বরে বিড়বিড় করছে। অজয় সাহস করে তার কাছে গিয়ে বলল, “সত্যিটা জানাতে হবে আমাকে। আমি সেই ছায়ার মুক্তি চাই।” বৃদ্ধ থমকে দাঁড়াল, তার চোখে হঠাৎ এক স্বস্তির ছোঁয়া ফুটে উঠল। ভাঙা গলায় সে বলতে লাগল, “সুপর্ণাকে তারা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। আমি দেখেছিলাম। আমি দেখেছিলাম তার হাতজোড়া প্রার্থনা। কিন্তু কিছু বলতে পারিনি, কিছু করতে পারিনি।” বৃদ্ধ হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল, তার কাঁধে শতকের ভার, আর অপরাধবোধের বোঝা। অজয় বুঝল, এই নীরব সাক্ষীই সেই সত্যের দরজা খুলতে পারে যা এতকাল বন্ধ ছিল।

সকাল হতেই অজয় স্থানীয় থানায় গিয়ে সেই ঘটনার রিপোর্ট নতুন করে দাখিল করল। বৃদ্ধ সাক্ষীর বয়ান, ছবির প্রমাণ আর গুদাম থেকে পাওয়া কাগজপত্র পুলিশকে নতুন করে তদন্তে বাধ্য করল। শহরের খবরের কাগজে হেডলাইন বেরোল—“৩৮ বছরের রহস্যে নতুন মোড়: নীরব সাক্ষীর বয়ানে প্রকাশ পেতে চলেছে পোড়া গুদামের সত্য।” অজয় জানে, সে এবার কেবল এক আত্মাকে নয়, এক শহরের দীর্ঘদিনের অভিশাপকেই মুক্তি দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে সে সেই প্রথম রাতের ছায়ার মৃদু হাসি দেখতে পেল, আর বুঝল, সে তার প্রতিশ্রুতি রাখছে।

অজয়ের জমা দেওয়া নথি আর বৃদ্ধ পাহারাদারের বয়ান পুলিশকে বাধ্য করে নতুন করে তদন্ত শুরু করতে। এক সময় যেসব তথ্য সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেসব আবার বেরিয়ে আসতে থাকে। শহরের পুরনো অফিসারদের কেউ কেউ এই ঘটনা মনে করতে পারেনি, আবার কারও মুখে শোনা গেল চাপা স্বর—“সেই পোড়া গুদাম? ওটা তো অভিশপ্ত…” পুলিশের স্পেশাল টিম গঠিত হল, গুদাম ঘিরে রাখা হল, এবং বিভিন্ন প্রমাণ একত্র করা শুরু হল। অজয় দিনরাত থানার বাইরে বসে থাকত, যেন সে নিজেই এই সত্যের লড়াইয়ের সৈনিক। মিডিয়া খবরটা লুফে নিল, শহরের বড় বড় চ্যানেল ও পত্রিকায় হেডলাইন ছাপা হল—“৩৮ বছরের রহস্য উদ্ঘাটনের পথে, সাক্ষী অজয়ের সাহসিকতা।” অজয় বুঝল, এই লড়াই এখন কেবল সুপর্ণার আত্মার মুক্তি নয়, এক শহরের বিবেকের প্রশ্ন।

তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে সেই রাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা। প্রতাপ আর মহেন্দ্র, সুপর্ণার সহকর্মী, আসলে সেই রাতে গুদামের গোপন চুক্তিপত্র জ্বালাতে চেয়েছিল, যেখানে তাদের দুর্নীতির প্রমাণ লুকিয়ে ছিল। সুপর্ণা সেই অন্যায় মানতে না পেরে বাধা দিতে গিয়ে আগুনের ফাঁদে পড়ে যায়। আগুন লেগে গেলে দু’জনেই পালিয়ে যায়, আর পুড়ে ছাই হয়ে যায় এক নিষ্পাপ প্রাণ। বৃদ্ধ পাহারাদার ভয়ে বা শোকের চাপে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই রাতের পর থেকে তার জীবনের ভাষা হারিয়ে যায়। পুলিশ সেই দুই প্রাক্তন কর্মীর খোঁজে নেমে পড়ল। শহরের এক প্রান্তে প্রতাপ আর মহেন্দ্র দুজনেই বছরের পর বছর অন্য নামে লুকিয়ে বসবাস করছিল। পুলিশ অবশেষে তাদের গ্রেফতার করল, আর শহর জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—অবশেষে ন্যায়বিচার হতে চলেছে।

অজয়ের মনে হল, যেন এক অদৃশ্য ভার তার বুক থেকে নেমে গেল। সেই রাতে যখন পুলিশ গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র জব্দ করছে, অজয় আবার সেই ছায়া দেখতে পেল—সুপর্ণা, যিনি এবার আর্তনাদ নয়, শান্তির ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের হালকা বাতাসে অজয় অনুভব করল, যেন এক কৃতজ্ঞতার হাত তার কাঁধ ছুঁয়ে গেল। গুদামের পোড়া ইট আর ভাঙা কাঠের স্তূপ যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে—সত্যকে কখনও চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায় না। শহরের মানুষ গিয়ে জড়ো হল, কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালাল, কেউ চুপচাপ প্রার্থনা করল। অজয় জানে, এই লড়াই সে একা লড়েনি—এক শহরের আত্মা, এক নীরব সাক্ষী আর এক চিহ্নহীন ছায়া তাকে পথ দেখিয়েছে।

সকালের প্রথম আলো ফুটতেই গুদামের ধ্বংসস্তূপে নতুন করে শুরু হল পুনর্গঠনের কাজ। শহর ঠিক করল, এখানে তৈরি হবে এক স্মৃতিস্তম্ভ—যেখানে লেখা থাকবে সেই সত্যের গল্প, সেই এক ড্রাইভারের সাহস আর এক আত্মার মুক্তির কথা। অজয় একপাশে দাঁড়িয়ে দেখল, মানুষের চোখে কৃতজ্ঞতা, শহরের আকাশে যেন হালকা এক শান্তির আভা। সে জানে, এই রাতের গল্প শেষ নয়। হয়তো আবারও কোনো চৌরাস্তা ডাক দেবে, কোনো ছায়া তার সঙ্গী চাইবে। কিন্তু এবার সে প্রস্তুত। কারণ সে জানে, সত্যের শিকল যতই পুরনো হোক, তা ভাঙার সময় একদিন আসেই।

অধ্যায় ৯

অজয়ের জমা দেওয়া নথি আর বৃদ্ধ পাহারাদারের বয়ান পুলিশকে বাধ্য করে নতুন করে তদন্ত শুরু করতে। এক সময় যেসব তথ্য সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেসব আবার বেরিয়ে আসতে থাকে। শহরের পুরনো অফিসারদের কেউ কেউ এই ঘটনা মনে করতে পারেনি, আবার কারও মুখে শোনা গেল চাপা স্বর—“সেই পোড়া গুদাম? ওটা তো অভিশপ্ত…” পুলিশের স্পেশাল টিম গঠিত হল, গুদাম ঘিরে রাখা হল, এবং বিভিন্ন প্রমাণ একত্র করা শুরু হল। অজয় দিনরাত থানার বাইরে বসে থাকত, যেন সে নিজেই এই সত্যের লড়াইয়ের সৈনিক। মিডিয়া খবরটা লুফে নিল, শহরের বড় বড় চ্যানেল ও পত্রিকায় হেডলাইন ছাপা হল—“৩৮ বছরের রহস্য উদ্ঘাটনের পথে, সাক্ষী অজয়ের সাহসিকতা।” অজয় বুঝল, এই লড়াই এখন কেবল সুপর্ণার আত্মার মুক্তি নয়, এক শহরের বিবেকের প্রশ্ন।

তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে সেই রাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা। প্রতাপ আর মহেন্দ্র, সুপর্ণার সহকর্মী, আসলে সেই রাতে গুদামের গোপন চুক্তিপত্র জ্বালাতে চেয়েছিল, যেখানে তাদের দুর্নীতির প্রমাণ লুকিয়ে ছিল। সুপর্ণা সেই অন্যায় মানতে না পেরে বাধা দিতে গিয়ে আগুনের ফাঁদে পড়ে যায়। আগুন লেগে গেলে দু’জনেই পালিয়ে যায়, আর পুড়ে ছাই হয়ে যায় এক নিষ্পাপ প্রাণ। বৃদ্ধ পাহারাদার ভয়ে বা শোকের চাপে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই রাতের পর থেকে তার জীবনের ভাষা হারিয়ে যায়। পুলিশ সেই দুই প্রাক্তন কর্মীর খোঁজে নেমে পড়ল। শহরের এক প্রান্তে প্রতাপ আর মহেন্দ্র দুজনেই বছরের পর বছর অন্য নামে লুকিয়ে বসবাস করছিল। পুলিশ অবশেষে তাদের গ্রেফতার করল, আর শহর জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—অবশেষে ন্যায়বিচার হতে চলেছে।

অজয়ের মনে হল, যেন এক অদৃশ্য ভার তার বুক থেকে নেমে গেল। সেই রাতে যখন পুলিশ গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র জব্দ করছে, অজয় আবার সেই ছায়া দেখতে পেল—সুপর্ণা, যিনি এবার আর্তনাদ নয়, শান্তির ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের হালকা বাতাসে অজয় অনুভব করল, যেন এক কৃতজ্ঞতার হাত তার কাঁধ ছুঁয়ে গেল। গুদামের পোড়া ইট আর ভাঙা কাঠের স্তূপ যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে—সত্যকে কখনও চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায় না। শহরের মানুষ গিয়ে জড়ো হল, কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালাল, কেউ চুপচাপ প্রার্থনা করল। অজয় জানে, এই লড়াই সে একা লড়েনি—এক শহরের আত্মা, এক নীরব সাক্ষী আর এক চিহ্নহীন ছায়া তাকে পথ দেখিয়েছে।

সকালের প্রথম আলো ফুটতেই গুদামের ধ্বংসস্তূপে নতুন করে শুরু হল পুনর্গঠনের কাজ। শহর ঠিক করল, এখানে তৈরি হবে এক স্মৃতিস্তম্ভ—যেখানে লেখা থাকবে সেই সত্যের গল্প, সেই এক ড্রাইভারের সাহস আর এক আত্মার মুক্তির কথা। অজয় একপাশে দাঁড়িয়ে দেখল, মানুষের চোখে কৃতজ্ঞতা, শহরের আকাশে যেন হালকা এক শান্তির আভা। সে জানে, এই রাতের গল্প শেষ নয়। হয়তো আবারও কোনো চৌরাস্তা ডাক দেবে, কোনো ছায়া তার সঙ্গী চাইবে। কিন্তু এবার সে প্রস্তুত। কারণ সে জানে, সত্যের শিকল যতই পুরনো হোক, তা ভাঙার সময় একদিন আসেই।

অধ্যায় ১০

শহরের আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। সেই গুদামের সামনে, যেখানে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল অগণিত কাহিনি আর অশ্রুপাতের স্মৃতি, এখন এক নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। নির্মাণশ্রমিকরা শেষ করছে স্মৃতিস্তম্ভের কাজ। সেই স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করা হল—“সত্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ, এক অজানা আত্মা ও এক সাহসী ড্রাইভারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।” শহরের মানুষ একত্রিত হয়েছে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। অজয় একপাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত দৃশ্যের সাক্ষী থাকল—যেখানে এক সময় ছিল নিস্তব্ধতা আর ভয়, সেখানে এখন মানুষের কণ্ঠে সমবেত প্রার্থনার ধ্বনি। গুদামের ধ্বংসাবশেষকে ঘিরে তৈরি সেই স্থান যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল শহরের ইতিহাসে। প্রতাপ আর মহেন্দ্রের বিচার শুরু হয়েছে, তাদের মুখের কঠোরতা ভেঙে এখন অনুশোচনার ছায়া, যদিও দেরিতে। অজয় বুঝল, সেই ছায়া, সেই চিহ্নহীন আত্মা অবশেষে শান্তি পেয়েছে।

কিন্তু অজয়ের নিজের ভেতরের অন্ধকার কি দূর হয়েছে? সেই প্রশ্ন বারবার তার মনে আসছিল। গভীর রাতে আবার একা গাড়ি নিয়ে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল সে। চৌরাস্তার কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসল। চাঁদের আলোয় চৌরাস্তার উপর ঝিকিমিকি করছে বাতাসে উড়ে যাওয়া পাতার সারি। হঠাৎ সেই রাতগুলোর স্মৃতি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে—প্রথম রাতের সেই ছায়া, সেই নীরব যাত্রী, সেই পোড়া গুদামের ধোঁয়া, আর বৃদ্ধ সাক্ষীর কান্না। অজয় জানত, সে কেবলই একজন উবার ড্রাইভার নয়; সে এক সেতু, যা শহরের অন্ধকার আর আলোকে যুক্ত করেছে। আজ এই রাতের নীরবতা যেন তাকে আর ভয় দেখায় না; বরং এক গভীর শান্তি এনে দেয়।

গাড়ির ভেতর হালকা বাতাস বইল, যেন কেউ পাশে বসে মৃদু স্বরে বলল—“ধন্যবাদ, অজয়।” সে জানত, কেউ নেই। কিন্তু মন জানে, সেই চিহ্নহীন আত্মা হয়তো আরেকবার এসে তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেছে। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে অজয় আবার গাড়ি চালানো শুরু করল। এবার সেই চৌরাস্তা আর ভয়ের প্রতীক নয়; এখন সেটি এক মুক্তির প্রতীক। শহরের প্রতিটি আলো, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বাড়ি যেন তাকে নতুন করে বরণ করে নিচ্ছে। অজয়ের চোখের কোণে জমে থাকা জলের ফোঁটা লুকিয়ে গেল অন্ধকারের আড়ালে। সে জানত, এই রাতের পর আর কোনো রাতের ছায়া তাকে কাঁদাবে না। সে এখন এক আলোবাহক, যে অন্ধকারের গল্প শেষ করে আলোয় ফেরায়।

শেষরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো, ভোরের পাখির ডাক শোনা গেল। অজয় গাড়ি নিয়ে ধীরে শহরের দিকে ফিরতে লাগল। শহরের ঘুমন্ত মানুষদের জন্য সে হয়তো আজ এক অজানা নায়ক, যার নাম কেউ জানে না, চেহারা কেউ মনে রাখবে না। কিন্তু শহরের প্রতিটি ইট আর বাতাস তাকে চিরকাল মনে রাখবে—যে ড্রাইভার এক অভিশপ্ত চৌরাস্তাকে আবার জীবনের পথে ফিরিয়ে এনেছিল। অজয়ের মন বলল, গল্প শেষ, কিন্তু পথ চলা এখন শুরু। চৌরাস্তার অন্ধকারে আজ যে আলো জ্বলল, তা আর নিভবে না।

সমাপ্ত

1000030518.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *