Bangla - প্রেমের গল্প

নির্বাণের পথে প্রীতি

Spread the love

মৈনাক দত্ত


আখড়ার প্রথম আলো

শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে কাঁকরপথ ধরে যত এগোয় প্রীতম, ততই যেন শব্দ কমে আসে, গন্ধ বাড়ে। মাঠে বাতাসে ধানগাছের ঘ্রাণ, পাখিরা গানের মতো ডাকছে, আর মাঝে মাঝে কোনো অজানা সুর কানে বাজে—কোনো একতারা, না কি সময়ের ধ্বনি, বোঝা যায় না।

প্রীতম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। বিষয়—“বাউল দর্শনে দেহতত্ত্ব: এক সমকালীন পাঠ”। থিসিস লিখছে, কিন্তু বই পড়া আর কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে তার মন ভরে না। সে চায় ছুঁয়ে দেখতে, শ্বাস নিতে। তাই এসেছে শান্তিনিকেতনের কাছের এই অখ্যাত বাউল আখড়ায়, নাম ‘উত্তরের পথ’।

পৌঁছাতেই প্রথম যে জিনিস চোখে পড়ে, তা হল একটা তুলসী গাছ। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত, স্থির। চারপাশে মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া, আর কাঁচা উঠোন। কেউ খোল বাজাচ্ছে, কেউ গলায় মুগ্ধ গুঞ্জন তুলছে।

তাদের মাঝখানে বসে আছে একটি নারী। মাথায় ঘোমটা নেই, তবু তার মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য। চোখ বুজে বসে আছে, যেন শুনছে না, আবার যেন সমস্ত সুরই তার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তার সামনে রাখা একতারা, সে ছুঁয়েও দেখছে না।

এই নারীকে দেখে প্রীতমের হৃদয়টা হালকা ধাক্কা খায়। সে জানে না কেন, কিন্তু তার দৃষ্টি বারবার আটকে যায়।

“আপনি প্রীতম?”—কানের পাশে এক গম্ভীর কণ্ঠ।

সে ঘুরে দেখে এক বৃদ্ধ বাউল দাঁড়িয়ে আছেন। মাথাভর্তি জটা, চোখে মধুর দীপ্তি।

“আমি পাগলা সাধন,” বললেন তিনি। “আপনার আসার কথা শুনেছিলাম।”

প্রীতম হাতজোড় করে বলল, “হ্যাঁ, আমি বাউল দর্শন নিয়ে গবেষণা করছি। এখানে কিছুদিন থাকতে চাই, যদি অনুমতি দেন।”

“আমরা অনুমতি দিই না,” পাগলা সাধন হেসে ফেললেন, “গান দিলে নেয়, সুর দিলে টানে। আপনি যদি মনে করেন, থাকুন। তবে এক শর্ত—যে মন নিয়ে এসেছেন, সেটা ফেলে দিন। এখানে শরীর দিয়েই সুর খোঁজা হয়।”

প্রীতম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর মাথা হেঁট করে বলে, “আমি চেষ্টা করব।”

তাকে এক কুঁড়েঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মাটির মেঝে, বাঁশের বিছানা, জানালা দিয়ে বাইরে গাছের ডাল। কোনো বিদ্যুৎ নেই, একটা হারিকেন রাখা। তবু যেন শান্ত, অনেক বেশি।

সন্ধ্যে নামে ধীরে ধীরে। উঠোনে আগুন জ্বলে ওঠে। সবাই বসে পড়ে চারপাশে। কেউ গাইছে, কেউ তাল রাখছে, কেউ শুধু চোখ বুজে আছে। প্রীতম এক কোণে বসে, নোটবুক খোলে না। মোবাইল বন্ধ করে রাখে। সে শুধু শুনতে চায়।

তখনই মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে আলোর রেখা। সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে—

“হাঁড়ির মধ্যে চন্দ্র জাগে,
শরীর মন্দির জানিস না রে।
দেখতে যদি চাস সে রূপ,
দেখ দেহেরই মাঝে!”

কণ্ঠে নেই চিৎকার, নেই তেজ—তবু কেমন এক নেশা ছড়িয়ে পড়ে। যেন বাতাসও থেমে থাকে। একতারা ধরা নেই, অথচ মনে হয় তার বুকের মধ্যেই সুর বাজছে।

প্রীতম ধাক্কা খায়। তার গবেষণার কাগজে এই ভাষা ছিল না। এই ‘দেহ’ যেন কোনো শারীরিক বাস্তবতা নয়—একটা তীর্থক্ষেত্র।

পাশে বসে থাকা পাগলা সাধন বলে ওঠেন, “ওর নাম প্রীতি। সাধিকা। অনেক জায়গা ঘুরে এখানে এসে থিতু হয়েছে। আবার কবে উড়ে যাবে কে জানে।”

“সে গান শেখায়?” প্রীতম জানতে চায়।

“না। সে গান দেয়। যারা নিতে পারে, তারা নেয়।”

রাতের দিকে প্রীতম একা ঘরে বসে। বাইরে পাখি ডাকছে, মাঝে মাঝে গাছের পাতা পড়ে। চোখের সামনে সেই কণ্ঠ ভাসে—প্রীতির কণ্ঠ। আর ভেতরে বাজে সেই পদ: “দেখ দেহেরই মাঝে…”

গবেষণা যেন নতুন প্রশ্ন ছুঁয়ে ফেলেছে। দেহ কি সত্যিই গোপন শাস্ত্র? এই শরীরেই কি লুকিয়ে আছে আত্মার ঘর?

পরদিন সকালে উঠেই উঠোনে যায় সে। কেউ নেই, শুধু তুলসীর ছায়ায় প্রীতি বসে। সে গিয়ে দাঁড়ায়, একতারা হাতে।

“তুমি কি এখানেই থাকো?” প্রীতম জিজ্ঞেস করে।

প্রীতি চোখ মেলে তাকায়। বলে, “থাকি না—ভেসে থাকি।”

“তুমি কি সব জানো, দেহতত্ত্ব? সেই যে… শরীরে গুরু, শরীরে সাধনা?”

প্রীতি হালকা হাসে, বলে—

“শরীরের ভিতরে বসে গুরু,
তাকেই তো চিনি না রে।
খুঁজে ফিরি বাইরের পথে,
ভিতরটা দেখি না রে।”

প্রীতম স্তব্ধ হয়ে থাকে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা পাগলা সাধন বললেন, “আপনি যদি সত্যি জানতে চান, তাহলে প্রশ্ন করবেন না। শুনবেন। আর ভেতরে যাবেন। কারণ বাউল দর্শন পুঁথিতে নেই—সে থাকে মাংসে, হাড়ে, নিঃশ্বাসে।”

প্রীতম জানে, সে শুরু করেছে এক নতুন যাত্রা। আর এই যাত্রায় দিকনির্দেশক হতে চলেছে এক সাধিকা—প্রীতি।

ভেসে থাকা কথার মতো

প্রীতম সেই রাতে ঘুমোতে পারেনি। জানালার ফাঁক দিয়ে গাছের ছায়া পড়ছিল মেঝেতে, আর তার ভেতরে ঘুরছিল একটা সুর—নির্বাক, অথচ অনুরণিত। মনে হচ্ছিল প্রীতির কণ্ঠ এখনও তার কানে বাজছে, তার বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে। এ কি প্রেম? না কি এক ধরনের মুগ্ধতা? না কি সে এমন কিছুতে টান খাচ্ছে যার ভাষা এখনও সে খুঁজে পায়নি?

সকালে উঠেই সে তুলসীতলায় গেল। প্রীতি আগেই বসে ছিল। আজ হাতে একতারা নেই, কিন্তু তার চোখ দুটো যেন আরও গভীর। মনে হয়, ওই চোখে তাকালেই নিজেকে দেখা যাবে।

প্রীতম গিয়ে বসল তার পাশে। কিছুক্ষণ কিছু বলল না। বাতাসে গন্ধ—পাকা চাল ধানের, পাতা ভেজা মাটি, আর শরীর-ছোঁয়া রোদ। প্রীতম বলল, ধীরে, যেন নিজের মনেই, “আমি তোমার গানটা রাতে বারবার শুনছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীরটা নতুন করে চিনতে শুরু করেছি।”

প্রীতি তাকায় না, শুধু বলে, “শরীরটা চিনতে পারলে, নিজেকে চিনতে পারবে।”

“কিন্তু আমরা তো শরীরকে জড় বলেই জানি। আত্মা আলাদা, শরীর আলাদা… তাই তো?”

এবার প্রীতি চোখ তোলে। চোখে নেই চমক, নেই মৃদু হাসি—শুধু এক সরলতা, যা প্রীতমকে আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে।

সে বলে, “বাউলরা বলে দেহে গুরু। মানে? এই রক্ত-মাংসের শরীরেই তো লোভ, কাম, ক্রোধ, ক্ষয়। তাহলে এই দেহই পথ কীভাবে হয়?”

প্রীতি এবার হালকা হেসে বলে ওঠে:

“যে দেহে থাকিস দিনরাত,
সেই দেহকে করিস অপমান।
সেই দেহেই আছে পথের মানচিত্র,
তুই খুঁজিস শুধু ভুল দিকের সন্ধান।”

প্রীতম চমকে যায়। এই কাব্য, এই উপলব্ধি কেবল গান নয়—এ যেন এক তত্ত্ব, যার মূল ধরতে হলে নিজেকেই ভাঙতে হয়।

“তুমি বলেছিলে, তুমি ভেসে থাকো। তার মানে?”

প্রীতি এবার ধীরে ধীরে বলে, “আমরা সবাই তো কিছু না কিছুতে বাঁধা—মাটি, নাম, ঠিকানা, সম্পর্ক, দায়িত্ব… আমি সেগুলো কাটিয়ে ভেসে থাকি। যেমন বাতাস থাকে। যেমন গান।”

“তুমি কোথা থেকে এসেছ?”

“ঠিক মনে নেই,” বলে প্রীতি। “শুধু মনে আছে, এক সময় আমার শরীরটা খাঁচা মনে হত। আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। গান ছিল সেই মুক্তির দরজা। একদিন নিজেকে ভাঙলাম। শরীরের ভেতর যে আলোর সন্ধান, সেটা ধরা দিল। তখন থেকে আমি ‘আমি’ নেই—শুধু গান আছি।”

প্রীতম বুঝে ওঠে না ঠিক, কিন্তু অনুভব করে। প্রীতির চোখে যে কথা নেই, তা বুকে আছে। সে বলে, “তুমি কীভাবে জানলে শরীরই পথ?”

প্রীতি বলে, “একদিন রাতে খুব জ্বর হয়েছিল। শরীর কাপছিল। মনে হচ্ছিল, মারা যাচ্ছি। তখন হঠাৎ আমি নিজেকে দেখলাম—বুকের মাঝে একটা দরজা খুলে গেছে। ভিতরে আলো। শরীর ব্যথায় ভরা ছিল, কিন্তু সেই ব্যথার ভেতরেই আমি ঈশ্বরকে ছুঁলাম। তারপরে আর কোনো শিক্ষক লাগে না, কোনো বই লাগে না। এই শরীরটাই পথ হয়ে গেল।”

প্রীতম চুপ করে শুনছিল। তার মাথায় শুধু গবেষণার বিষয় ঘুরছিল না, তার ভিতরেও যেন এক দরজা ধীরে ধীরে খুলছিল।

তখনই পাগলা সাধন এসে পড়ে উঠোনে। বললেন, “আজ নদীর ধারে গানের আসর বসবে। আপনি চলুন, প্রীতিও যাবে। শরীরের জলে একটু ভিজুন, তবেই সুর লাগবে ঠিক করে।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সবাই মিলে নদীর ধার। মাটির ঢালে বসা, পাশে খেজুরগাছ, আর সামনে এক টুকরো জল যেখানে আকাশ নেমে এসেছে।

সাধন একতারা তোলে। প্রথম গানটা তিনিই ধরেন। তারপর একে একে সবার গলা মেলে। গানের মাঝে কোথাও কোনো তাল নেই, আবার ঠিক তাতেই যেন এক অন্তর্লীন ছন্দ।

প্রীতি তখন পাশে বসে। হঠাৎ তার গলা ভেসে ওঠে—

“দেহে আমার গুরু থাকেন,
দেহেই আছে গোপন বেদ।
যত দূরে গিয়েছি খুঁজিতে,
তত কাছে পেয়েছি সে স্নেহ।”

প্রীতম এবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার মধ্যে কিছু কেঁপে ওঠে। চোখের কোণে জল। সে জানে না কেন, কিন্তু এ জল শুধুই কষ্টের নয়। এটা এক ধরণের আনন্দ, যা ভাষায় বলা যায় না।

গান শেষে সবাই চুপচাপ। শুধু পাতা দুলছে হাওয়ায়।

সাধন হেসে বলে, “দেখলেন তো, এই জন্যই বলি—আমাদের গান শেখার নয়, শোনার। গান যদি বুক না কাঁপায়, তা হলে সেটা গান নয়।”

প্রীতম তাকিয়ে থাকে প্রীতির দিকে। বলে, “তুমি কি গান ছাড়া বাঁচতে পারো না?”

প্রীতি হেসে ফেলে, বলে, “আমি তো গানই। বাঁচি বললে ভুল হবে। বাজি বলো।”

নদীর তীরে দেহের মানচিত্র

নদীর ধারে সন্ধ্যে তখনও পুরোপুরি নেমে আসেনি, কিন্তু আলো আর অন্ধকারের ভেতর এক গাঢ় ছায়া খেলা করে চলেছে জলে। পাখিরা ফিরেছে, পাতায় পাতায় নিঃশব্দতা। প্রীতম এক পাথরের ওপর বসে আছেন, পাশে প্রীতি—যেন এই শূন্যতার মধ্যেও পূর্ণতা জেগে আছে।

পাগলা সাধন এবং অন্য বাউলরা গানের আসর গুটিয়ে ফিরে গেছেন আখড়ার দিকে। নদীর পাড়ে এখন কেবল দু’জন—প্রীতি ও প্রীতম।

এই নীরবতাও যেন এক ধরনের গান। সুর নেই, কিন্তু তান আছে। শব্দ নেই, তবু প্রতিধ্বনি আছে।

প্রীতম বলল, ধীরে, “তোমরা বারবার বলো দেহই গুরু, দেহেই পথ। কিন্তু দেহ মানে তো আমাদের কাছে কেবল জৈব অস্তিত্ব, কিছু প্রয়োজন আর কিছু আকাঙ্ক্ষা। সেই দেহই সাধনার বস্তু হয়ে ওঠে কীভাবে?”

প্রীতি এবার একটু হাসল, বলল, “তোমরা দেহ মানে বুঝো খিদে, তৃষ্ণা, কাম। আমরা দেহ মানে বুঝি দরজা। মাটির গায়ে আঁকা এক মানচিত্র, যার মধ্যে রেখা রয়েছে আত্মার কাছে যাওয়ার।”

সে একটা নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে প্রীতমের পায়ের কাছে মাটিতে একটা রূপরেখা আঁকে।

“এই ধরো,” সে বলল, “এই মানচিত্র শরীরের। এইটা হৃদয়, এখানে বাস করে ‘সত্য’। এইটা নাভি, যেখানে জন্মের রশি। এইটা কণ্ঠ, যেখানে উচ্চারিত হয় বীজ। আর এইটা…”—সে আঙুল রাখল দু’চোখের মাঝখানে—“এইখানে থাকে দরজা, যেটা দিয়ে গাওয়া যায়, গাওয়া হয় না।”

প্রীতম নিশ্বাস ফেলে। এতদিন সে দেহ নিয়ে এত বই পড়েছে, কিন্তু এমন করে কেউ বলেনি। মনে হয় কেউ যেন তার ভেতরে ঢুকে তার হৃদপিণ্ড ছুঁয়ে বলছে—“এই দেখ, তুই তোকে চিনিস না।”

প্রীতি এবার উঠে দাঁড়ায়, নদীর দিকে হেঁটে যায়। বলে, “চলো, একটু পা ভিজিয়ে নিই।”

প্রীতমও উঠে পড়ে। তারা দু’জনে হাঁটতে থাকে জলে—হাটু অবধি ঠান্ডা, স্বচ্ছ জল। নদী যেন বয়ে চলেছে তাদের শরীর ছুঁয়ে, আর তার সঙ্গে যেন বয়ে চলেছে প্রাচীন কোনো স্মৃতি।

“তুমি জানো তো,” প্রীতি বলে, “যতবার জলে নামি, আমার মনে হয় আমার শরীরটা আর আমার নয়। মনে হয় আমি সেই স্রোতের মতো, যা জন্ম দেয়, আবার ভাসিয়ে নেয়।”

প্রীতম বলে, “তুমি যখন গাও, আমি মনে মনে দেহের কথা ভাবি না—আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবি—তুমি কীভাবে এমন হয়ে উঠলে?”

প্রীতি হাসে না। বলে, “ভাঙতে হয়েছে। চামড়া ছড়াতে হয়েছে। সংসার, সম্পর্ক, প্রেম—সব কিছু পেছনে রেখে আমি যখন প্রথম বাউল হই, তখন শরীরটাই ছিল আমার একমাত্র সত্যি। বাইরের সব মিথ্যে। তখন শিখেছি—এই দেহে প্রেম আছে, লজ্জা আছে, ঘাম আছে, কিন্তু ঈশ্বরও আছে।”

সে আবার বলে:

“এই দেহর ঘরে পাগল বসে,
তারে ডাকি, সে জবাব দেয় না।
আমি খুঁজি ওকে আকাশে বাতাসে,
সে হাসে, বলে, ‘তুই তো ঘরের বাইরেই ঘুরিস শুধু।’”

প্রীতম থমকে যায়। “এই পদটা কি তুমি নিজে লিখেছ?”

“না,” বলে প্রীতি, “আমার ভেতরের কেউ লেখে। আমি কেবল শুনে নিই।”

প্রীতম বুঝে যায়, এই নারী কেবল সাধিকা নয়। সে কোনো তত্ত্ব বা বাউল শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করছে না—সে নিজেই এক দর্শন হয়ে উঠেছে।

হঠাৎই নদীর দিকে তাকিয়ে সে বলে, “তোমার শরীর… মানে, তুমি যখন নিজের শরীরকে সাধনার উপকরণ ভাবো, তখন লজ্জা আসে না?”

প্রীতি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “লজ্জা আসে যখন শরীরের দিকে তাকাই বাইরের চোখ দিয়ে। কিন্তু যখন নিজেকে দেখি ভেতরের চোখে, তখন লজ্জা থাকে না—থাকে বিস্ময়। আমি নারী, আমার শরীরেই আমি প্রথম ঈশ্বরকে পেয়েছি। সেই অনুভূতিতে লজ্জা থাকে না, থাকে কৃতজ্ঞতা।”

প্রীতম চুপ করে থাকে। এই কথা শোনার পর কিছু বলার থাকে না। নদীর স্রোত তার পায়ের নিচে দিয়ে বয়ে যায়, আর সেই জলের ছোঁয়ায় তার শরীরের প্রতিটি কোষে যেন এক নতুন বোধ জেগে ওঠে।

তারা ধীরে ধীরে ফিরে আসে। অন্ধকার নামছে। আকাশে তারারা উঠছে একে একে। আখড়ার উঠোনে আগুন ধরানো হচ্ছে, গান শুরু হবে কিছুক্ষণ পর।

প্রীতম হঠাৎ বলে ওঠে, “তুমি কি চাও আমি থাকি? আরও কিছুদিন?”

প্রীতি তাকায়। চোখে ম্লান আলো, অথচ তীব্র। বলে, “তুমি যদি থেকে যাও, তোমাকে নিজেকেই ভাঙতে হবে। গবেষণার ছদ্মবেশে প্রেম খুঁজলে চলবে না। তুমি নিজেকে খুঁজলে তবেই আমি তোমার পাশে থাকব।”

প্রীতম মাথা নিচু করে বলে, “আমি চেষ্টা করব।”

প্রীতি ধীরে বলে, “তবে আজ রাতে আমার গলা শুনে থেকো। আমি আজ যে পদ গাইব, তা আমার শরীরেই লেখা।”

জ্বলে ওঠা একতারা

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আখড়ার উঠোন যেন ধীরে ধীরে রূপ পাল্টাতে শুরু করল। মাটির মাঝে জ্বলছে আগুন, তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছে বাউলরা। কেউ খোল কাঁধে রেখেছে, কেউ একতারা, কেউ শুধু হাতের তালে তালে শরীর দুলিয়ে নিচ্ছে। অন্ধকারে আলোর ওই একটাই উৎস—আগুন। আর তাপ এসে লাগছে গায়ে, মনে।

প্রীতম চুপচাপ এক পাশে বসে। আজ তার ভেতরে এক অন্যরকম কাঁপন। সারা দিনের কথা, প্রীতির চোখ, নদীর ধারে সেই দেহতত্ত্বের মানচিত্র—সব মিলিয়ে তার শরীরটা যেন অন্য কারও হয়ে উঠেছে।

পাগলা সাধন আজ গান ধরলেন না। শুধু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, যেন কিছু শুনছেন যা কেবল অন্তর দিয়ে বোঝা যায়। সেই নিঃশব্দতাতেই এক সময় উঠে দাঁড়াল প্রীতি। তার পরনে সাদা-হলুদ ছাপা ঢোলা কাপড়, চুল খোলা। হাতে একতারা। আর মুখে সেই অদ্ভুত শান্তি—যা দেখে মনে হয়, এই মেয়েটি দেহের গা থেকে রূপ খুলে ফেলে নিজেকে আলোতে জড়িয়ে ফেলেছে।

সে মাটির সামনে এসে একপা আগুনের দিকে এগিয়ে বলে—

“এই যে দেহ,
এটাই তো গোপন সাধনার বীজ,
এই দেহেই বসে গুরু,
এই দেহই বলে—আমি আছি।
আমার ঠোঁটের ভিতর মন্ত্র,
আমার নাভির ঘোরে সুর,
আমার বুকের গভীরে সাঁতার কাটা ঈশ্বর।”

একতারা একবার টুং করে বাজে। আর সুর যেন ধীরে ধীরে উঠে আসে তার গলা থেকে। সেই সুরে কোনো গর্জন নেই, কোনও দম্ভ নেই—তবু কেমন গভীর, কেমন ঘন। যেন বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

“ও মন, তুই কেন বাইরে খুঁজিস গুরু,
দেখ দেহের গুহাতে আলো জ্বলে।
এই চামড়ার ঘরে আছে মন্দির,
সেই মন্দিরে বাজে তোর স্বরলিপি।”

প্রীতমের চোখে জল এসে যায়। সে কাঁদছে—কিন্তু সেটা দুঃখের কান্না নয়। এটা সেই কান্না, যা হয় যখন শরীর নিজেই স্বীকার করে নেয় তার সব ভুল বোঝা। তার মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে সে একটি অদ্ভুত মিশ্র অনুভবের মধ্যে আছে—লজ্জা, বিস্ময়, প্রেম, ভয়, সব একসঙ্গে।

তার মনে পড়ে গেছে ছেলেবেলার কথা—যখন সে প্রথমবার আয়নায় নিজের শরীর দেখে লজ্জা পেয়েছিল, বা প্রথমবার হৃদয় কেঁপেছিল এক মেয়ের জন্য, কিংবা প্রথমবার যখন সে শরীরকে অবাঞ্ছিত কিছু বলে ভেবেছিল। এখন, এই গানের ভেতর সে বুঝতে পারছে—এই দেহই তো সে মন্দির, যার প্রতি তার কোনো কৃতজ্ঞতাই ছিল না।

প্রতিটি পদে যেন এক-একটা দরজা খুলছে তার ভেতরে।

প্রীতি তখন গাইছে শেষ লাইন:

“আমি গুরু পাই নিজের পাঁজরে,
তাঁর পায়ের ধ্বনি শুনি হৃদয়ের বাঁকে।
আমি তাঁর দিকে হাঁটি না—
তিনি এসে জড়িয়ে ধরেন এই দেহের আঁচলে।”

সবাই চুপ। কেউ কিছু বলে না। শুধু আগুনের কাঠটা একটু শব্দ করে ভেঙে পড়ে। চারপাশে পাখা নেড়ে চলেছে একটা পোকা। আর উঠোনে সেই স্তব্ধতা, যা কেবল সত্যের পরে জন্মায়।

প্রীতি বসে পড়ে আগুনের পাশে। তার চোখ বন্ধ। নিঃশ্বাস ধীরে চলেছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না।

তখন পাগলা সাধন চোখ খোলে। বলে, “আজকের গান ছিল দেহের প্রতিভা। শরীরের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার। যারা শুনল, তারা যদি বুক খুলে নেয়, তবেই সুর লাগবে।”

প্রীতম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তার পা কাঁপছে। সে মনে মনে বলছে, “আমি আজ একজন মানুষ থেকে একখণ্ড মাটি হয়ে গেলাম, যার উপর কেউ এক জীবন আঁকল। সেই জীবন হল প্রীতির গান।”

সবার শেষে প্রীতি এসে তার পাশে দাঁড়ায়। বলে, “আজ তুমি কেঁদেছিলে, দেখেছি।”

প্রীতম চমকে তাকায়। “তুমি দেখলে?”

“দেখলাম না, শুনলাম। কান্নার শব্দ হয় না, তার সুর হয়।”

প্রীতম বলল, “তুমি আজ যে পদ গেলে, সেটা কি তোমার নিজের লেখা?”

প্রীতি একটু থেমে বলল, “হয়তো। আমি জানি না, কে লেখে। আমি শুধু গাই। যখন শরীরটা নরম হয়, তখন মাটি ভিজে যায়। তখন শব্দ আপনিই গজায়।”

তারপর তারা দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে। বাতাসে গন্ধ—জ্বলন্ত কাঠ, ফুল, আর এক ধরনের আশ্চর্য শান্তি।

প্রীতম মনে মনে ভাবে—গবেষণা নয়, প্রেম নয়, প্রাপ্তির কোনও ভাষা নেই। কেবল দেহ, কেবল অনুভব এবং প্রীতি।

দেহতত্ত্বে প্রেমের ব্যাকরণ

পরদিন সকালের রোদ যেন অন্যরকম। পাতায় পাতায় যে আলো খেলছিল, তা শুধু বাইরের আলো নয়, যেন প্রীতমের ভিতরেও ঢুকে পড়েছে কিছু একট‍ু। ঘুম থেকে উঠে সে অনুভব করল—তার শরীরের অভ্যন্তরে একধরনের নরমতা। মনে হচ্ছিল, এই শরীরটাই যেন অন্যকিছু হয়ে উঠেছে—বাড়তি ভার নেই, কাঁধে কোনো ক্লান্তি নেই। যেন ভেতরে কোথাও মাটি ভিজে উঠেছে।

বাইরে উঠোনে গান চলছে। প্রীতম কিন্তু সেখানে গেল না। আজ সে ছায়ার নিচে বসে প্রীতির লেখা এক বাউল পদ পড়ছিল—গত রাতে প্রীতি তাকে দিয়েছিল নিজের খাতাটা। তার পাতায় পাতায় ছেঁড়া শব্দ, আঁচড়ে লেখা কিছু লাইন, কিছু পদ, যা একাধারে গভীর, আবার শিশুর মতো সহজ।

“প্রেম মানে দেহ, দেহ মানে প্রেম,
তুই যদি আলাদা করিস, গুরুর দরজা বন্ধ হবে।
এই যে চামড়ার ঘরে ঢুকে থাকি,
সেখানেই বাজে ‘রাধে রাধে’।”

এই পংক্তিগুলো পড়তে পড়তেই প্রীতম বুঝতে পারে—তার মধ্যে যে প্রেম জন্ম নিচ্ছে, সেটা কেবল প্রীতির প্রতি নয়। বরং প্রীতির মধ্য দিয়ে একটা দর্শনের প্রতিই সে আকৃষ্ট হচ্ছে। সে অনুভব করছে, প্রীতি তার শরীর দিয়ে নয়—তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার কথায়, তার চুপ থেকেও তাকে ছুঁয়ে ফেলছে।

ঠিক সেই সময় প্রীতি এসে পাশে বসে।

“তুমি আমার লেখা পড়ছ?” প্রীতির প্রশ্নে কোনো উত্তেজনা নেই, শুধু একরকম শান্ত কৌতূহল।

“হ্যাঁ,” বলে প্রীতম, “তোমার ভাষা যেন শরীরের ভেতর থেকে আসে। একটুও কৃত্রিম লাগে না।”

প্রীতি হালকা হেসে বলে, “আমি তো লেখা শিখিনি। আমি শুধু শিখেছি দেহের ভেতর শুনতে। তখন যা আসে, তা-ই লিখি।”

প্রীতম তাকে এক মুহূর্ত দেখছিল। ধুলো মাখা পায়ের পাতায় যেন আলো পড়ে থাকে। সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কাউকে ভালোবেসেছ কখনও?”

প্রীতি চমকায় না। যেন এমন প্রশ্ন তার প্রতিদিন শুনতে হয়।

সে বলে, “ভেবো না, বাউলরা প্রেম করে না। আমিও করেছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রেম গৃহস্থালি প্রেমের মতো নয়। আমাদের প্রেমে শরীরই মন্দির, আর প্রেমিক ঈশ্বর। আমি এক সময় এক সহসাধকের সঙ্গে দেহ ভাগ করেছিলাম—তবু কখনও মালিকানার দাবি করিনি।”

প্রীতম চুপ করে। মাথার ভেতর অনেক প্রশ্ন গিজগিজ করছে। কিন্তু কিছুই সে জিজ্ঞেস করতে চায় না।

প্রীতি বলে, “তুমি তো গবেষক। প্রেম মানে কি তোমার কাছে অনুভব, না কি কাঠামো?”

প্রশ্নটা প্রীতমের গায়ে বিদ্যুতের মতো লাগে। সে বলে, “আমার কাছে প্রেম মানে ছিল—প্রমাণ, প্রতিশ্রুতি, পরিণতি। এখন মনে হচ্ছে, প্রেম মানে শুধু একটা শরীরের ছায়া—যেটা সব সময় পাশে থাকে, অথচ ধরা দেয় না।”

প্রীতি হাসে না। কিন্তু চোখে একধরনের দয়ালু দৃষ্টি আসে। সে বলে—

“যাকে ছুঁতে চাই,
সে যদি বাতাস হয়,
তবে কি বাতাসকে ভালোবাসা যায় না?
শরীরের ছোঁয়া তো শুধু হাত নয়,
কখনও কান্না, কখনও হাসি, কখনও নীরবতা।”

প্রীতম বুঝে যায়—এই মেয়েটির ভেতরে এক দেহভিত্তিক ভাষা আছে, যা কোনও একাডেমিক ব্যাকরণ মানে না। প্রেম তার কাছে কোনও বন্ধনে আটকে নেই—সে শুধু ভেসে থাকে, কিন্তু কোথাও পৌঁছায়।

“তুমি কি এখন কাউকে ভালোবাসো?”—প্রশ্নটা একরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে।

প্রীতি এবার একটু সময় নেয়। তারপর বলে, “আমি এখন আমার দেহকে ভালোবাসি। যখন নিজের ভেতরের প্রতিটি কাঁপনে ঈশ্বরকে পাই, তখন কারও দিকে আলাদা করে তাকানোর প্রয়োজন হয় না। তবু…” —সে থামে—“তবু তুমি যদি আমার পাশে চুপ করে বসে থাকো, তাহলেও সেটা প্রেম হতে পারে।”

প্রীতম যেন শিউরে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এই মেয়েটি তাকে ভালোবাসে—কিন্তু সেই ভালোবাসায় নেই দাবি, নেই আকুতি, নেই দখল। এটা এমন এক প্রেম, যা নীরবতা দিয়ে তৈরি, যেটার রঙ দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

সন্ধ্যার সময় সবাই যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে গানের জন্য, প্রীতম এক কোণে বসে। সে আজ গান গাইবে না, শুনবেও না। সে শুধু অনুভব করতে চায়।

প্রীতি একপাশে বসে, চোখ বুজে, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে রেখেছে এক পদ। আর প্রীতম তার শরীরের প্রতিটি স্পন্দনে সেই পদের সুর খুঁজে পায়।

“এই দেহ, এই গান,
এই চোখের চাওয়াতেই সব বলি।
তুই পাশে বসিস, কিছু না বলিস,
আমি তোর নীরবতায়ও ঈশ্বর খুঁজি।”

সেই রাতে প্রীতম ঘুমোয়নি। শুধু শুয়ে শুয়ে নিজের বুকের ওঠা-নামা টের পায়। আর ভাবে—এটাই কি প্রেম? না কি প্রেমের আড়ালে এক মহা সাধনা শুরু হলো?

দেহ যখন সেতার

রাত গভীর। আখড়ার চারপাশে নিঃশব্দতা নেমে এসেছে। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ ধ্যানস্থ। প্রীতম তার কুঁড়েঘরে বসে। জানালার বাইরে খেজুরপাতা নড়ছে হাওয়ায়, দূরে কুকুরের ডাক, মাঝে মাঝে বাঁশবনের ভিতর থেকে প্যাঁচার আর্তি।

তার পায়ের কাছে রাখা প্রীতির খাতা, তার পাশেই একখানা চাদর। ঘুম আসছে না—শরীরে কোনো ব্যথা নেই, কিন্তু মন যেন কোনো অনুচ্চার যন্ত্রণায় বাঁধা পড়ে আছে। এই কয়েকদিনে, প্রীতির সংস্পর্শে, প্রীতম যেন বুঝেছে—দেহের ভিতরে শব্দ গেঁথে থাকে। সেগুলো গান হয়ে বেরোয় না সবসময়, কখনও শুধু নিঃশ্বাসের ভেতর বাজে।

সেই নিশুতি রাতেই আচমকা তার পেটের নিচে একধরনের মোচড় ওঠে। তীব্র নয়, কিন্তু স্পষ্ট। যেন ভিতরে কিছু খুলছে, বা জেগে উঠছে। সে উঠে বসে, জল খায়, কিন্তু ব্যথা কমে না। মাথায় ঘুরতে থাকে প্রীতির বলা কথা—“শরীরের ব্যথাও একরকম গান, যদি শোনার কান থাকে।”

তার মনে পড়ে যায়, একদিন প্রীতি বলেছিল—

“যে ব্যথা আসে দেহে,
সে যদি ভেতরের দিকে চলে যায়,
তবে গান হয়ে ওঠে।
আর যদি বাইরে গিয়ে থামে,
তবে হয়ে ওঠে কান্না।”

প্রীতম একপাশে শুয়ে থাকে। চাদরের নিচে তার পেটের ভেতর ঢেউ উঠছে, তার সারা শরীরের ওপর সেই ঢেউয়ের ছায়া। সে বুঝতে পারে না—এ ব্যথা শারীরিক না আত্মিক। তবু সে চুপ করে, শোনে নিজের দেহের শব্দ।

ঠিক তখন, দরজায় ধাক্কা।

সে উঠে দেখে, বাইরে প্রীতি দাঁড়িয়ে। তার হাতে হারিকেন। চোখে কোনো উদ্বেগ নেই, কেবল একপ্রকার গভীর টান।

“তুমি কাঁদছিলে,” বলে প্রীতি।

“না,” মাথা নাড়ে প্রীতম, “ব্যথা করছিল… এখানে”—সে পেটের দিকে ইঙ্গিত করে।

প্রীতি ধীরে এগিয়ে আসে, ঘরে ঢোকে না। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলে, “এই ব্যথা যদি সুর হয়, তবে শুনো। শরীর তো শুধু এক যন্ত্র। মাঝে মাঝে সে নিজেই জানিয়ে দেয়, কীভাবে বাজতে চায়।”

প্রীতম বলে, “আমার ভয় করছে। যদি এটা কিছু খারাপ হয়?”

প্রীতি তখন ঠোঁটে এনে একতারা বাজায়—সেই পরিচিত, শান্ত সুর।

“যে দেহে শ্বাস, সে দেহে আশ্বাস,
ভয় যদি বাসা বাঁধে,
তবে গান ডাকে না।
ভয়ের দরজা বন্ধ করো,
দেখো দেহ নিজেই সেতার।”

তার এই কণ্ঠ, সেই সুর যেন ধীরে ধীরে ব্যথাকে ভিজিয়ে দিতে থাকে। প্রীতম জানে না, সে ঘামে, না চোখের জলে ভিজে গেছে।

প্রীতি তখন বলে, “তুমি ঘুমোও। আমি জানালার পাশে থাকি। যদি আবার ব্যথা বাড়ে, আমি শুনব।”

সেই রাতে প্রীতম ঘুমায়। গভীর ঘুম। আর ঘুমের ভিতর সে দেখে—এক নদী। সেই নদীর বুকে প্রীতি হাঁটছে। তার হাতে একতারা, কণ্ঠে গান নয়, শুধু নিঃশব্দ উচ্চারণ। আর প্রীতম সেই নদীর ঘাটে বসে, নিজের শরীর খুলে রেখে বলছে, “এই দেহ, এই কান্না, এই প্রেম—সব তোর।”

ভোরে ঘুম ভাঙে, পাখির ডাকে।

জানালার পাশে নেই প্রীতি। কেবল হারিকেনটা রেখে গেছে। পাশে একটা ছোট কাগজে লেখা:

“দেহ মানে কেবল আনন্দ নয়,
দেহ মানে ব্যথাও।
যে ব্যথা গ্রহণ করতে পারে,
সে-ই তো প্রেমকে ধারণ করতে পারে।”

সেইদিন সকালে প্রীতম বাইরে গিয়ে পাগলা সাধনের কাছে গিয়ে বসে।

সে বলে, “আমি বুঝতে পারছি না—আমার মনে হচ্ছে, আমি শরীরের প্রেমে পড়েছি। এটা কি ঠিক? এটা কি আত্মার বিরুদ্ধে যাচ্ছে না?”

পাগলা সাধন চেয়ে দেখেন তাকে। তারপর বলেন—

“প্রেম যদি শরীর দিয়ে শুরু না হয়, তবে তা হাওয়ার ঘর। কিন্তু প্রেম যদি কেবল শরীরেই থেমে যায়, তবে তা জল নেই এমন নদী। দেহ হলো প্রেমের প্রথম স্পর্শ, কিন্তু প্রেম হাঁটে হৃদয়ের দিকে। তুমি শরীরের প্রেমে পড়েছ, মানে তুমি সত্যিকারের প্রেমের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখেছ।”

প্রীতম মাথা নিচু করে বলে, “আমি ভয় পাই, যদি সে না চায়… যদি সে কেবল পথ দেখায়, পাশে না থাকে?”

পাগলা সাধন বলে, “বাউল প্রেম চাওয়া নয়। বাউল প্রেম ‘থাকা’র মধ্যে নয়, ‘ভেসে থাকা’র মধ্যে। সে থাকবে কি না, জানো না। কিন্তু যতদিন থাকবে, তার দেহে ঈশ্বর বাজবে, তুমি যদি শুনতে পাও।”

সেই সন্ধ্যায় আবার গান। কিন্তু আজ প্রীতি গান ধরেনি। সে বসে আছে আগুনের পাশে, চোখে একটা অদ্ভুত স্থিরতা।

প্রীতমও গান গায় না। সে শুধু বসে, নিজেকে ধরে রাখে। আজ তার মনে হয়, তার শরীর এক খালি পাত্র, যেটা কাঁপছে, ফেটে যাচ্ছে, আবার গড়ে উঠছে।

এটাই কি দেহতত্ত্ব? এই ভাঙা-গড়ার ভিতর দিয়ে নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে খোঁজা?

সে জানে না। সে শুধু জানে—এই ব্যথাও সঙ্গীত। এই শরীরও সাধনা।

স্পর্শহীন প্রেমের পদাবলি

আকাশ আজ মেঘলা। বিকেলের আলো টলমল করছে তালপাতার ছায়ায়। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল দূরে দূরে একতারা-খোলের আওয়াজ ভেসে আসে, যেন কেউ দূরের কোনো প্রান্ত থেকে কাউকে ডাকছে—নাম ধরে নয়, প্রেম ধরে।

আখড়ার পাশেই এক ছোট শালবনের মধ্যে বসে আছে প্রীতম। সে একা। তার হাতে প্রীতির খাতা, আর মনজুড়ে এক অস্ফুট কথা—যা সে এখনও উচ্চারণ করেনি।

প্রীতি আজ সকাল থেকে কারো সঙ্গে কথা বলেনি। তার চোখে এক গভীর প্রশান্তি, আবার একটা টানও—যেন কিছু বলতে চায়, আবার চুপ থাকাটাও প্রয়োজনীয় মনে হয়।

প্রীতম জানে, আজ কোনও গবেষণার চিন্তা মাথায় নেই। আজ সে চায়, শুধু প্রীতির পাশে বসে একটু কথা বলতে। স্পষ্ট কিছু নয়, শুধু তার চোখে চোখ রেখে এক মুহূর্ত ধরা দিতে।

হঠাৎ সে দেখে, প্রীতি সেই শালগাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।

সে চুপচাপ বসে পড়ে। তারপর বলে, “তুমি কাঁদছিলে?”

প্রীতম চমকে তাকায়, “তুমি জানলে কী করে?”

“তোমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। চোখে রক্তরেখা। আর দেহটা টানটান—ভেতর থেকে কান্না থামিয়ে রাখলে এমন হয়।”

সে কিছু বলে না। পাশে মাটিতে হাত রাখে। শালপাতার ওপর একটুকরো আলো পড়েছে।

প্রীতি ধীরে বলে, “তুমি আমার দিকে তাকাও, কিন্তু স্পর্শ করোনি কোনোদিন। কেন?”

প্রীতম কাঁপা গলায় বলে, “কারণ তোমাকে স্পর্শ করতে ভয় লাগে। মনে হয়, ছুঁলেই ভেঙে যাবে—এই তোমাকে পাওয়া যাবে না।”

প্রীতি তাকিয়ে থাকে তার চোখে। চোখে নেই কৌতূহল, নেই রাগ। কেবল গভীর, অনন্ত এক আলো।

সে বলে, “ভয় ঠিক। কিন্তু প্রেম কি কেবল ছোঁয়ার জন্যই জন্মায়? যদি শরীরের ভিতরে প্রেম হয়, তবে সে কি কেবল বাহ্যিক সংযোগ চায়?”

প্রীতম চুপ করে। তারপর বলে, “আমার ভিতরটা আজকাল শব্দহীন। গান শুনি, কথা শুনি, কিন্তু আমার নিজের ভিতরের সুর কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমি জানি না, এটা প্রেম, না হতাশা।”

প্রীতি বলে—

“প্রেম যখন দেহ ছাড়িয়ে যায়,
তখন সে হয় সুরের মতো—
আছে, কিন্তু ছোঁয়া যায় না।
তুই যদি সেই প্রেমে ভেসে যেতে পারিস,
তবে তো তোর ভিতরেই বাজবে গুরু।”

সে নিজের চুলের খোঁপা খুলে দেয়। হাওয়ায় চুল দুলে ওঠে। মনে হয়, সে নিজেকে ছুঁয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। অথচ কোনও স্পর্শ নেই।

প্রীতম ফিসফিস করে বলে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

প্রীতি তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না।

সে ধীরে জবাব দেয়, “তোমার ভালোবাসা আমার গলার ভেতর বাজে। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখি না, কিন্তু সে আমার নিঃশ্বাসে মিশে গেছে।”

প্রীতম উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে, “তুমি কি কখনও চেয়েছো, আমি তোমার হাত ধরব?”

প্রীতি বলে, “হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। সেই প্রথমদিন, তুলসীতলায় যখন বসেছিলে—তুমি এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলে, ‘তুমি কি এখানেই থাকো?’ তখন আমি চেয়েছিলাম, তুমি আমার হাত ধরো। কিন্তু আজ আমি চাই না। কারণ আজ তুমি আমাকে ছুঁয়েছ—আমার দেহ নয়, আমার আত্মা।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে। বাতাস থেমে যায় যেন।

প্রীতি বলে, “তুমি জানো, এই যে দেহতত্ত্ব—এ শুধু শরীর বোঝার কথা নয়। এটা হলো এমন এক প্রেম, যেখানে দেহ একটা দরজা, কিন্তু দরজার ওপারে যা আছে, সেটা স্পর্শহীন। তুমি সেই দরজায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করো না। এই দোরগোড়াতেই যে প্রেম, তা অনেকেই বোঝে না।”

প্রীতম বলে, “তুমি কি আমায় ভালোবাসো?”

প্রীতি চেয়ে থাকে। তারপর বলে, “তোমার নিঃশ্বাসে আমি বাজি। আর কী প্রয়োজন? আমি দেহে থাকি, তুমি দৃষ্টিতে। আমরা পাশাপাশি বয়ে চলি—তবু মিশে গেছি।”

সে বলে, “তোমার জন্য একটা পদ লিখেছিলাম”—তারপর সে মুখে মুখে গাইতে শুরু করে:

“তুই ছুঁয়েছিস, আমি কাঁপিনি—
কারণ তুই দেহে আসিসনি।
তোর চাওয়া আমার চোখে,
তোর না-বলা আমার বুকে।
এই যে দূরত্ব, এই যে নীরবতা—
এটাই তো আমাদের প্রেমের ভাষা।”

প্রীতম আর থাকতে পারে না। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে বোঝে—এই প্রেম, যেখানে স্পর্শ নেই, তবু ঘনিষ্ঠতা অসীম; এই প্রেমই তার সবচেয়ে গভীর উপলব্ধি।

তারা দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকে। কেউ কিছু বলে না। বাতাসে একটা নরম গন্ধ—মাটির, পাতা ঝরার, আর হয়তো শরীরের ঘামের সঙ্গে মিশে থাকা স্নেহের।

একটি চুম্বনের দূরত্ব

সন্ধ্যা তখন নামছে ধীরে। আখড়ার উঠোনে আগুন জ্বলে ওঠেনি, পাখিরা ডাল ছেড়ে উড়েছে দূরে। আকাশে ঝুলে থাকা হালকা সোনালি আভা। সময়টা এমন, যখন আলোও কিছু বলে না, অন্ধকারও নয়—শুধু মাঝখানে ভেসে থাকা এক টান, যা চেনা অথচ অচেনা।

প্রীতম আর প্রীতি সেই শালবনের ছায়াতেই বসে আছে, যেখানে তারা প্রথম একান্তে কথা বলেছিল। আজ কোনও গান নেই, কোনও প্রশ্ন নেই। শুধু দু’জন মানুষের নিঃশব্দতা, যা সময়কে গলে দেয়।

হাওয়ার দোলায় প্রীতির চুল উড়ছে। তার ঠোঁট কাঁপছে না, কিন্তু চোখে কিছু আছে—একটা অনুরোধ, না কি প্রত্যাখ্যান, তা বোঝা যায় না। প্রীতম তাকিয়ে আছে তার দিকে, এমনভাবে, যেন সে প্রথমবার দেখছে, অথচ চেনা প্রতিটি রেখা মনে গেঁথে আছে।

“তুমি চুপ করে আছো কেন?” প্রীতম ধীরে জিজ্ঞেস করে।

প্রীতি মৃদু হেসে বলে, “কারণ আজ আমার দেহ নীরবতা চায়। কথা নয়। কখনও কখনও শরীরও ক্লান্ত হয় শব্দে।”

প্রীতম বলে, “তবে কি আজ আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি?”

প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলে থাকে কিছুক্ষণ। হাওয়া থমকে যায়, শালপাতা নড়ে না। তারপর প্রীতি ধীরে উত্তর দেয়—

“তুমি স্পর্শ করতে চাও, না কি ছুঁয়ে ফেলতে চাও? দুটো আলাদা। প্রথমটা বাইরের, দ্বিতীয়টা ভেতরের।”

প্রীতম চুপ করে যায়। তার মুখে কোনো কথা খুঁজে পায় না। তার হাত প্রীতির হাতের পাশেই, অল্প দূরে। একটুও এগোতে পারে না।

প্রীতি হঠাৎ বলে ওঠে—

“এই যে দূরত্ব,
যেটা ঠিক এক চুম্বনের সমান,
তাতেই তো প্রেম বাস করে।
যখন ঠোঁট মিলবে, তখন প্রেম থাকবে না—
থাকবে শরীর।
আর সেই শরীর প্রেমের ভাষা জানে না সবসময়।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা।

প্রীতম জানে না, প্রীতির কথায় অস্বীকার আছে, না তার প্রেমের গভীরতা। সে শুধু অনুভব করে—তার ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে, গলা টনটন করছে, হৃদয় দুলছে ধীরে।

সে ফিসফিস করে বলে, “আমি চাই না এই মুহূর্ত শেষ হোক। এমনভাবে তোমার পাশে বসে থাকতে চাই, যখন চাওয়া থাকলেও স্পর্শ হবে না। শুধু অনুভব চলবে, ভিতরে ভিতরে।”

প্রীতি বলে, “তবে সেটা করো। চোখ বন্ধ করো। নিজেকে খোঁজো আমার পাশে বসে। যদি সত্যিই প্রেম থাকে, তবে এই এক চুম্বনের দূরত্বই অনন্ত হয়ে উঠবে।”

প্রীতম চোখ বন্ধ করে। তার শরীর জেগে ওঠে, এক-একটা কোষ যেন ডাকে—তার প্রেমিকাকে, সেই না-ছোঁয়া প্রেমিকাকে, যে তার শরীরেরও বেশি ভিতরে ঢুকে গেছে।

সে ভাবে—এই যে এখন প্রীতির হাত তার হাতের পাশে, এই যে তার কাঁধে লাগছে প্রীতির চুল, অথচ সে হাত বাড়াচ্ছে না—এই না-বাড়ানোতেই তো প্রেম! এই সংযম, এই ধৈর্য, এই ক্ষুধাও একরকম তৃপ্তি।

প্রীতি তখন গলা ছেড়ে গায়, কাঁপা কাঁপা স্বরে—

“তুই যদি থাকিস এক চুম্বনের দূরে,
আমি হবো বাতাস,
তোর ঠোঁট ছুঁয়ে যাবো না,
তবু তোকে জড়িয়ে রাখবো সারাক্ষণ।
এই দূরত্বই আমার গান,
তোর নীরবতা আমার একতারা।”

সুরটা থেমে গেলে তারা দু’জনই কাঁপছিল। ঠাণ্ডা লাগেনি, বরং সেই সুরের ভিতরে শরীর এমনভাবে কেঁপে ওঠে, যেন সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে উঠেছে।

প্রীতম বলল, “তুমি কি কখনও চেয়েছিলে, আমি তোমাকে চুম্বন করি?”

প্রীতি বলে, “চেয়েছিলাম, বহুবার। কিন্তু তার চেয়ে বেশি চেয়েছিলাম, তুমি না করো। আমি চেয়েছিলাম, তুমি এই দূরত্বকে বুঝো, ভালোবাসো। কারণ সেই চুম্বনের আগের মুহূর্তেই যে প্রেম, তার গভীরতা সবচেয়ে বেশি।”

প্রীতম জানে না, তার চোখ থেকে জল পড়ছে কি না। সে শুধু বলল, “আমি জানি, তোমার ঠোঁট স্পর্শ করব না। কিন্তু আমার শরীর জানে, আমি তোমায় ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে ফেলেছি—তোমার ভিতরের বাউলকে, তোমার গানকে, তোমার মৌনতাকে।”

প্রীতি তখন বলে, “এই তো প্রেমের দেহতত্ত্ব। শরীর যদি শুধু ছোঁয়ার বস্তু হয়, তবে সে ভোগের পাত্র। কিন্তু যদি সে হয়ে ওঠে এক সুর, এক অপেক্ষা—তবে সে-ই তো সত্যিকার সাধনা।”

প্রীতম বলে, “তুমি কি কখনও আমার স্বপ্নে আসো?”

প্রীতি হাসে, বলে, “আমি তো সবসময় তোর শরীরের ভিতরে থাকি। তোকে যখন প্রেম জাগায়, তখন সেই আমি। তোকে যখন গান শোনায়, তখনও আমি। আর যখন তুই নিজেকে খুঁজিস—আমি তো তখনও তোর নিঃশ্বাসের শব্দে বাজি।”

সেই সন্ধ্যায় কেউ চুম্বন করে না। কেউ এগোয় না। কিন্তু আকাশ থেকে ঝরে পড়ে একটা নতুন প্রেমের অনুভব—যেখানে শরীর ঠোঁট হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে ভাষাহীন মন্ত্র।

দেহের ভিতর নিঃশব্দ ঈশ্বর

সকালটা ছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো। না মেঘলা, না রৌদ্রজ্বল। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা জমেনি, কিন্তু বাতাসে তার গন্ধ ছিল। পাখিরাও যেন আজ স্বরের চেয়ে ছন্দে বেশি ব্যস্ত। আখড়ার উঠোনে আজ গান হয়নি। পাগলা সাধন বলেছিলেন, “আজ সবাই চুপ করে থাকুক। যে গান ভেতর থেকে ওঠে, তা শব্দ ছাড়াও বাজে।”

প্রীতম বসে ছিল তুলসীতলার পাশে। হাতে ছিল তার খাতাটা, যেখানে প্রথমদিন বাউল দর্শন নিয়ে কিছু গবেষণার নোট লিখেছিল। এখন তার পাতাগুলো খালি। কারণ সে জানে, এই গবেষণা লেখার নয়, অনুভবের।

গতকাল প্রীতির মুখে শোনা সেই কথাগুলো—একটি চুম্বনের দূরত্ব, স্পর্শহীন প্রেম, শরীরের ভিতর প্রেমিকের বাস—সব মিলে যেন তার শরীরটাই এক নতুন সত্তা হয়ে উঠেছে।

সে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল।

তখনই একটা হালকা শব্দে চোখ খুলে দেখে—প্রীতি দাঁড়িয়ে।

হাতে জলভরা মাটির কলসি, কপালে মাটি লেগে আছে। সে বসে পড়ে প্রীতমের পাশে। কিছু বলে না। তারপর হঠাৎ এক পা ভাঁজ করে বসে তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে ফেলে নিজের হাত দিয়ে।

“তোর শরীর কেমন লাগছে আজ?” প্রশ্নটা এমনভাবে করা যেন দেহ একটা নদী, যার জলের রঙ রোজ পাল্টায়।

প্রীতম বলে, “ভেতরে অনেক নরম লাগছে। মনে হয় বুকের ভেতর কিছু খুলে গেছে। আগে যেমন বুকের মাঝখানে একটা ভার থাকত, এখন সেটা কেমন হালকা।”

প্রীতি একটু হেসে বলে, “তোর ঈশ্বর তো ঢুকে পড়েছে তোর দেহের ভিতরে। এখন সে নিঃশব্দে বাস করছে।”

প্রীতম তাকায় তার দিকে। “তুমি বলেছিলে, দেহেই ঈশ্বর থাকে। আমি ঠিক বুঝতাম না। এখন মনে হচ্ছে, আমি প্রতিবার নিঃশ্বাস নিচ্ছি, আর প্রতিবার আমার ভেতরের কেউ সাড়া দিচ্ছে।”

প্রীতি বলে, “তুই শিখে গেছিস। এখন আর তোকে কেউ শেখাতে পারবে না। তোর শরীর নিজেই তোর গুরু হয়ে উঠেছে।”

এই কথাগুলো শুনে প্রীতম কাঁপে। মনে হয়, এতদিন সে নিজের দেহকে বোঝেনি। এখন যখন ছুঁতে শিখেছে, তখন বুঝেছে সে কেবল হাড়-মাংসের আবরণ নয়—সে এক পবিত্র মন্দির, যেখানে প্রেমও আছে, ঈশ্বরও।

সে হঠাৎ বলে, “তুমি কি জানো, আজ আমি যদি হঠাৎ মরে যাই, আমার দেহটা নিয়ে কী করবে?”

প্রীতি তাকিয়ে থাকে, একটুও চমকে না।

“তোর দেহকে নদীতে ভাসিয়ে দেব না। জ্বালাবো না। আমি তোর দেহটাকে রেখে দেব আমাদের উঠোনে, আগুনের পাশে। আমি তোর প্রতিটা হাড়, প্রতিটা কণ্ঠ, প্রতিটা চুল গুনে গুনে দেখব—তুই কোথায় ঈশ্বরকে রেখেছিলি বেশি। তারপর সে জায়গাগুলো কেটে রাখব আমার কাঁধে। যেন তুই থাকিস আমার সঙ্গে।”

প্রীতমের চোখ ছলছল করে ওঠে।

সে বলে, “আমি তোকে কোনওদিন ছুঁইনি। তবু মনে হয়, তুই আমাকে জন্ম দিয়েছিস।”

প্রীতি তার পায়ে হাত রাখে। বলে, “প্রেমে জন্ম হয়। দেহে যদি প্রেম থাকে, তবে সে জন্ম হয় কেবল সঙ্গমে নয়—স্পর্শহীন চোখেও।”

সে ধীরে এক পা তুলে, প্রীতমের বুকে রাখে।

“তুই এখন আমাকে স্পর্শ কর,” সে বলে। “তবে শরীর দিয়ে নয়। তুই তোর নিঃশ্বাস দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধর।”

প্রীতম চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। একটা দীর্ঘ, গভীর নিঃশ্বাস। মনে হয়, সে বাতাস নিচ্ছে না—প্রীতির ভিতরের ঈশ্বরকে নিচ্ছে।

প্রীতি তখন গায়—

“তোর শ্বাসে আছে গান,
তোর দেহে বাজে মন্ত্র।
তুই প্রেম করিস, জানিস না—
তুই তো নিজেই ঈশ্বরের ছায়া।”

তারা দু’জন চুপ করে বসে থাকে। শরীরের ভাষা আর আলাদা নয়—তারা এক সুর হয়ে গেছে। সেই সুরে নেই বোল, নেই তান। শুধু কান পেতে শুনতে হয়।

প্রীতম তখন বলে, “তুমি আমার শরীরকে জাগিয়ে তুলেছ। কিন্তু তুমি জানো, আমার ঈশ্বর তুমিই।”

প্রীতি মাথা নাড়ে, “না। আমি পথ। তুই হেঁটেছিস, তোর ঈশ্বর তো তোর ভিতরেই ছিল।”

প্রীতম বলে, “তবে আমি এবার শিখে ফেলেছি—প্রেম মানে শুধু অনুভব নয়, প্রেম মানে নিজের দেহকে বুঝে ওঠা, তার ভিতরেই ঈশ্বরের সুর খোঁজা।”

প্রীতি তখন বলল, “তুই শিখেছিস। এবার গান ধর। নিজের দেহের ভিতরের সুর দিয়ে একটা পদ লেখ।”

প্রীতম মাটিতে বসে, চোখ বন্ধ করে, ঠোঁটে সুর তোলে—

“আমি তোকে পাইনি,
তবু তুই আছিস আমার দেহের ঘরে।
তুই স্পর্শ দিসনি,
তবু আমার শিরায় তুই বাজিস।
তোর নাম নেই, তোর রূপ নেই,
তবু আমার সমস্ত প্রেম তুই।”

একতারা ভেঙে গেলে যা বাকি থাকে

সকালটা শুরু হয়েছিল যেন প্রতিদিনের মতোই—তুলসীতলায় ধূপের গন্ধ, কুয়াশার ভেজা আলো, গাছ থেকে পড়া পাতা, আর উঠোনে দু’একটা ফেলে যাওয়া পদ্মপাতা। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য স্তব্ধতা ঘিরে রেখেছিল আখড়াটিকে। আজ কারও গান শোনা গেল না। পাগলা সাধনও একতারা হাতে নিয়ে বসে ছিলেন, কিন্তু তাঁর আঙুল থেমে ছিল।

প্রীতম উঠে গিয়ে দেখল, প্রীতির ঘর খালি।

চৌকাঠে বসে আছে একটি বিড়াল। মাটির ঘরের সামনে রাখা রয়েছে একতারা, যা ছিল প্রীতির নিজের। কিন্তু তাতে আর কোনও তার নেই।

প্রীতম তাড়াতাড়ি পাগলা সাধনের কাছে গেল, “প্রীতি কোথায়?”

সাধন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “পাখি কি কবে জানিয়ে যায় কখন উড়বে?”

“কিন্তু কিছু না বলে?”—প্রীতমের গলা কাঁপে।

“সে কিছু রেখে গেছে,” বলেই সাধন আঙুল তুললেন তার ঘরের দিকে।

প্রীতম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, তার খাটের ওপর রাখা একটি পাতলা কাপড়ের ব্যাগ। ভেতরে সেই পুরনো খাতা—যার মধ্যে প্রীতির হাতে লেখা পদেরা আছে। আর তার নিচে একটি চিঠি।

হাত কাঁপছে। সে চিঠিটা তোলে।

“প্রীতম,
তুই যখন এই চিঠিটা পড়বি, আমি হয়তো বোলপুর স্টেশনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কোথাও যাচ্ছি না, কেবল হাঁটছি। কারণ তোর পাশে থেকে আমি যত না পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গেছি—যে তুই একদিন আমায় ধারণ করতে চাইবি। আর আমি তো ধারণের জন্য না, ভেসে থাকার জন্য।

তুই আমায় ছুঁয়েছিলি ঠিকভাবে, ঠোঁট দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে। আমি তোর নিঃশ্বাসে ছিলাম, তোর শরীরে বাস করতাম। তবু কিছু শরীর এমন হয়—যা একা থাকতে চায়, ছোঁয়ারও বাইরে।

আমার একতারার তার খুলে ফেলেছি, রেখে গেলাম তোর কাছে। ওটা এখন তোর।
যখন তুই বাজাতে পারবি নিজেকে, তখন ওর দরকার হবে না।

ভালো থাকিস।
আমি তো আছি তোর গলার গভীরে, তোর কাঁধে, তোর চোখে।
– প্রীতি”

চিঠির এক কোণে জলছাপ—প্রীতম জানে না সেটা তার চোখের জল, না প্রীতির রেখে যাওয়া।

সে ঘরের মাঝখানে বসে পড়ে। তার মনে পড়ে—তারা বসেছিল তুলসীতলার নিচে, পা ছুঁয়ে বলেছিল ‘তুই দেহে ঈশ্বর ধরে ফেলেছিস’। তখনই কি সে ভেবেছিল, প্রীতিকে পাকাপাকিভাবে রাখতে হবে?

না, সে চায়নি। তবু প্রীতি বুঝে গিয়েছিল, শরীর যতই পথ হোক, তাতে টান পড়লে সম্পর্ক মালিকানায় বদলে যেতে পারে। আর বাউল প্রেমে দেহ যতটা পবিত্র, তার মালিকানা ততটাই অশুদ্ধ।

প্রীতম হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে অনেকক্ষণ।

বিকেলের দিকে যখন সে উঠোনে যায়, তখন পাগলা সাধন তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “দেহ যদি একতারা হয়, তাহলে প্রেম হলো সেই তার। একবার টান দিলে, তা কেটে যায়। এখন তুই যদি গান করতে চাস, তোর নিজের ভিতরের সুর খুঁজে বের কর।”

প্রীতম তখন হাত তুলে বলে, “আমি গান ধরতে চাই না। আমি এখন চুপ করে থাকতে চাই। কারণ প্রীতি আমাকে একজোড়া চোখ দিয়ে শোনার শিক্ষা দিয়ে গেছে।”

সে আখড়ার পেছনের পুকুরঘাটে গিয়ে বসে। সন্ধ্যা নামে। জোনাকি জ্বলে ওঠে। গাছের পাতা নড়ে না।

তার মাথায় তখন একটা সুর ঘোরে—

“তুই ছিলি না পাশে,
তবু তোর নীরবতা বাজে।
তুই একতারা ভাঙলি,
তবু সুর রয়ে গেল মনের কাঁপনে।
তোর দেহ তো নেই,
তবু আমার শরীরে তুই।”

সে জানে, এই শব্দগুলো কেবল পদ নয়, এগুলো তার শরীরের ভিতর গেঁথে যাওয়া এক প্রেমের চিহ্ন। যেটা থেকে যাওয়ার, থেকে যাবে।

সেই রাতেই, আগুনের চারপাশে সবাই যখন বসে, প্রীতম এক কোণে চুপ করে বসে। তার সামনে রাখা প্রীতির ফেলে যাওয়া একতারা—তার তারহীন দেহ, তার নিঃশব্দ আত্মা।

সাধন বলেন, “আজ কেউ গান ধরবে না। আজ সবাই নিজের দেহ শুনবে।”

সবাই চোখ বন্ধ করে। কেউ শব্দ করে না। আগুনের ফিসফিস, পাতা পড়ার আওয়াজ, নিঃশ্বাসের ভিতর বাজে একতারা—যার আর তার নেই।

প্রীতম মনে মনে বলে—“তুই চলে গেলি, আমি তোর প্রেম পাইনি। কিন্তু আমি তোর দেহতত্ত্ব পেয়ে গেছি। আমি তোর সেই দূরত্বটা পেয়ে গেছি, যেখানে চুম্বন হয়নি, কিন্তু প্রেম থেমে থাকেনি। আমি পেয়েছি একতারার ভাঙা তারে লেখা এক গান, যার নাম—তুই।”

ফিরে আসার মতো না-ফেরা

বছরখানেক কেটে গেছে। শান্তিনিকেতনের সেই আখড়ায় এখন নতুন কিছু মুখ দেখা যায়, পুরনোদের কেউ কেউ চলে গেছে। পাগলা সাধন এখনও জীবিত, তবে বেশি কথা বলেন না। তুলসীতলা এখনও আছে, আগুনও জ্বলে উঠোনে—তবে গান হয় কম। প্রীতম নেই। সে ফিরে গেছে কলকাতায়।

কিন্তু তার ঘরের জানালার পাশে এখনও ঝুলে আছে একটা পুরনো একতারা—যেটাতে কোনও তার নেই। তার নিচে রাখা সেই খাতা, যেখানে প্রীতি তার শরীর দিয়ে লেখা পদগুলো রেখে গিয়েছিল।

প্রীতম এখন কলেজে ক্লাস নেয়—তরুণদের শেখায় “বাউল দর্শনের অন্তঃসার”—তবে তার ক্লাসে খুব বেশি তত্ত্ব নেই, থাকে অনুভব। যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, “স্যার, দেহতত্ত্বকে কি ফিলোসফিক্যালি বিশ্লেষণ করা যায়?”—তখন সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলে, “করা যায়, তবে বোঝা যায় না। বুঝতে হলে দেহে নামতে হয়।”

তবু একটাও দিন যায় না, যেদিন প্রীতম প্রীতির কথা ভাবে না। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন কোনও এক অতীতের পদ বাজে—সেই পদ, যার শব্দ নেই, কেবল সুর আছে।

সেদিন ছিল এক বৈশাখের দুপুর। ক্লাসের পর মাথাটা ভার লাগছিল। সে ভেবেছিল, একটুআধটু হেঁটে আসবে। ভিড় ঠেলে সে চলে যায় শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে, কারণ তার অভ্যাস হয়েছে—বিভিন্ন মুখের মধ্যে সে প্রীতিকে খোঁজে।

স্টেশনে পৌঁছেই প্রথম যে শব্দটা কানে এল, সেটা যেন আচমকাই বুকের মাঝখান থেকে ধাক্কা দিয়ে উঠল। একতারা নয়, দোতারা নয়, কেবল গলা—সেই কণ্ঠ।

“দেহ ঘর মোরে রহস্যের বাঁশি,
ভিতরে গোপন গুরু বাজায় সুর।
আমি জানি না তার নাম,
তবু সে আমারই ভিতরে…”

প্রীতম থেমে যায়।

শব্দটা ঠিক বাউল গান নয়, কিন্তু সেই একই ধরণ, সেই এক রেশ—যা দেহ ছুঁয়ে ওঠে। সে হঠাৎই চোখ ঘোরায়, আর দেখে—এক পাটফর্মের এক কোণে বসে আছে এক নারী। পরনে ধুলোছাওয়া গেরুয়া রঙের কাপড়, মাথায় চাদর। চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। সামনে রাখা একটি থালা, আর একটা কাঁথা।

প্রীতম ধীরে ধীরে কাছে যায়। তার বুক কাঁপছে।

চুলগুলো এলোমেলো, মুখটা ধরা পড়ে না ভালো করে। কিন্তু সে জানে—এই কণ্ঠ, এই উচ্চারণ, এই নিঃশ্বাস—এই তার চেনা।

সে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

নারী চোখ খুলে তাকায়। মুহূর্তে দুই চোখে দুই নদী ভেসে ওঠে। কিছু বলা হয় না।

প্রীতি।

হ্যাঁ, সে-ই। শুধু তার চোখে আরও কিছু বছর, মুখে কিছু অনাহার, গালে কিছু ক্লান্তি। তবু সে যেন আরও আলোয় মোড়া।

“তুমি?”—প্রায় ফিসফিস করে প্রশ্ন করে প্রীতম।

প্রীতি হেসে ফেলে, যেন তার দেখা হবে জানাই ছিল।

“তুই তো ছিলি আমার নিঃশ্বাসে,” সে বলে, “তোর সামনে থাকি না থাকি, আমি তো কখনও যাইনি।”

“তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন?”

“হেঁটেছি। ভেসেছি। কলকাতা, মেদিনীপুর, পুরী, উড়িষ্যা… গেয়েছি, থেকেছি। শরীর নিয়ে কোথাও বাস করিনি। শুধু চলেছি।”

“তুমি… ভালো আছো?”

প্রীতি চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “শরীর ভালো নেই। কিন্তু তুই তো জানিস, আমরা শরীর দিয়ে ভালো থাকি না, সুর দিয়ে থাকি। সুর এখনও জেগে আছে।”

প্রীতম বসে পড়ে তার সামনে। লোকজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু এই এক মুহূর্তে, এই কলকাতার জনারণ্যে, তারা দু’জন আবার যেন শান্তিনিকেতনের সেই উঠোনে বসে।

“তুই কি একেবারে ফিরে আসবি না?” প্রীতম জিজ্ঞেস করে।

প্রীতি মাথা নাড়ে। “ফেরা বলে কিছু নেই। আমি থাকি না, ভেসে থাকি। ফিরলে শিকড় হয়, আর আমি শিকড় কাটতে শিখেছি।”

“তবু… আমার পাশে…”

প্রীতি বলে, “তুই তো এখনও পাশে রেখেছিস আমায়। তোর শরীরে, তোর পাঁজরে, তোর পদে। আমার দেহ তো ছিল কেবল সেই দরজা—যা তুই পার হয়ে গিয়েছিস। এখন কি দরকার সেই দরজা খুলে আবার প্রবেশ করার?”

প্রীতমের চোখ ছলছল করে। সে বলে, “তবে কি এটা শেষ?”

প্রীতি বলে, “শেষ মানে তো নিরবতা নয়, শেষ মানে অন্য এক সুরের শুরু। আমি তো তোর ভেতরেই বাজছি, কেবল গলার ওপাশ থেকে নয়।”

হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এসে থালায় কয়েন ফেলে চলে যায়। প্রীতির চোখে জল। সে কয়েনটা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে।

প্রীতম বলে, “তোর দরকার হলে, আমি তো আছি…”

প্রীতি হেসে ফেলে। “তুই কি ভাবিস, আমি ভিক্ষে চাই? আমি চাই, তুই আমাকে যেমন চিনেছিলি, তেমন রাখিস। আমি তো তোর একতারা ভাঙা সুর—যার ধ্বনি তোকে পথ দেখাবে।”

সে উঠে দাঁড়ায়।

“আমি চলি, ট্রেন আসবে।”

“আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি?”

“না। তুই থেকে যা। তুই গান ধর। তুই নিজের শরীরে গাইতে শেখ। আমি থাকব—শরীর ছাড়াও।”

একটা লাল ট্রেন আসে। ভিড়ের মধ্যে প্রীতি উঠে পড়ে। জানালা দিয়ে তাকায়। হাত তোলে না, কিছু বলে না।

কিন্তু প্রীতম জানে, তার বুকের ভিতরে আবার এক নতুন সুর জন্ম নিল।

এক শরীর, দুই সুর

প্রীতি চলে যাওয়ার পর দিন কয়েক যেন প্রীতমের ভিতরে সব শব্দ থেমে গিয়েছিল। স্টেশনের সেই মুহূর্তটা—চোখে চোখ রাখা, অথচ কোনো স্পর্শ নয়, কিছু বলার মতো অনেক কিছু থাকলেও না-বলা—তার মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে।

সে ফিরে এসেছিল নিজের এক কামরার ফ্ল্যাটে। একতারা আগের মতোই জানালার পাশে ঝুলে আছে, তারে এখনো টান পড়েনি। কিন্তু আজ সকালে উঠে সে প্রথমবার ভাবে—এই একতারার তারটা সে নিজেই বাঁধবে। আর সেটা তারই ভেতর থেকে জন্ম নেবে।

সে খাতাটা নিয়ে বসে। সেই খাতা—যেটা একদিন প্রীতি দিয়েছিল, প্রীতির লেখা পদভরা। সে প্রতিটি লাইন পড়ে, যেন নতুন করে চেনে। কিন্তু আজ প্রথমবার, খাতাটা বন্ধ করে রেখে দেয়। কারণ আজ সে নিজের শরীরের ভিতর থেকে শব্দ শুনতে চায়।

সে মাটিতে বসে পড়ে, চোখ বন্ধ করে।

একটা নিঃশ্বাস নেয়। বুকের ভেতর যেন ঢেউ তোলে একটা অতল শব্দ। না, কণ্ঠস্বর নয়—এটা রক্তের তালের মতো কিছু, শিরায় শিরায় সুরের মতো বয়ে চলা।

তার মনে হয়, সেই রাতে—যেদিন প্রীতি তার পায়ে হাত রেখেছিল, যেদিন বলেছিল ‘তুই দেহে ঈশ্বর খুঁজেছিস’—সেই দিন থেকে এই সুর জন্ম নিচ্ছিল, শুধু সে শুনতে পারেনি।

সে ধীরে ধীরে ঠোঁটে তোলে সুর:

“দেহ আমার দুই পথের পালা,
একদিকে তুই, একদিকে আমি।
একতারা না বাজলে বুঝি না,
কারা আমাদের ভেতরে কথা বলে।”

সে জানে না, এই গান সে কোথা থেকে পেল। কোন বইয়ে ছিল না, প্রীতির খাতায়ও ছিল না। এই শব্দ এসেছে তার হাড়ের ফাঁক দিয়ে, বুকের তলার গর্ত থেকে।

সেই সন্ধ্যায়, সে কলেজে ক্লাস নেয় না। শুধু গলায় এক গামছা জড়িয়ে, একতারা হাতে নিয়ে যায় গলির মাথায়—যেখানে ভিখিরি বসে, চা-ওয়ালা ভাঙা রেডিও বাজায়, লোক হাঁটে মাথা নিচু করে।

সে সেখানেই বসে পড়ে। চোখ বন্ধ করে, একতারা হাতে নিয়ে সুর তোলে।

“আমার দেহে যে প্রেম ছিল,
সে ছিল না কারও নামে।
আমি শরীর ছুঁয়ে বুঝেছি,
এই মাটি, এই রক্ত—সবই তো এক সুরের বীজ।”

কেউ থামে না। কেউ মাথা তোলে না। কিন্তু হাওয়ায় একটা আলাদা রেশ তৈরি হয়—যা বিজ্ঞাপনের ব্যানার ছুঁয়ে যায়, দোকানের শাটারে ঠোক্কর মারে, এবং চায়ের কাপ থেকে বেরোনো ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যায়।

রাতের দিকে সে ফেরে। দরজা খুলে, একতারা রাখে আগের জায়গায়। কিন্তু সে জানে, আজ সে ওই বাদ্যযন্ত্রটাকে ব্যবহার করেনি। আজ তার নিজের শরীরই একতারা হয়ে উঠেছে।

সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে। এই প্রথম তার চোখে নিজের শরীরকে দেখে মনে হয়—এটা কেবল এক দৈহিক কাঠামো নয়, এটা এক পথ। তার বুকের খাঁজে প্রেমের চিহ্ন, কণ্ঠের ভেতর ঈশ্বর, আর চোখের পেছনে প্রীতি।

রাতে সে লিখে ফেলে প্রথম পদ—নিজের ভাষায়, নিজের সুরে:

“তুই আমার মধ্যে থাকিস,
যখন আমি নিজেকে ভুলে যাই।
তোর ছোঁয়া ছিল না,
তবু আমার কাঁধে ছিল এক শীতল বাতাস।
তুই স্পর্শ করোনি,
তবু আমি তোর ভিতরে বাজি।”

পরদিন কলেজে গিয়ে সে ক্লাস নেয়। ছাত্ররা অবাক হয়ে শোনে—আজ প্রীতম কোন বই খুলছে না, কোনও স্ক্রিপ্ট পড়ছে না। সে বলছে—

“আমরা সবাই একটা শরীর নিয়ে জন্মাই। কেউ তাকে নিয়ে তৃপ্ত, কেউ অস্বস্তিতে। কিন্তু কেউ কেউ তার ভেতরে গান খোঁজে। আর সেই গান যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রেমের জন্য কেউ কাউকে খোঁজে না—তখন নিজের শরীরই প্রেম হয়ে ওঠে।”

একজন ছাত্র বলে, “স্যার, আপনি প্রীতির কথা বলছেন তো?”

প্রীতম চমকে তাকায়।

ছেলেটা হাসে, “আপনার চোখে থাকে সে। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না।”

সেই রাতে সে প্রীতির খাতা আবার খুলে দেখে। শেষ পাতায় তার হাতের লেখায় এক লাইন—

“তুই যদি নিজেকে গান করতে পারিস, আমি তো তোর সুরেই বেঁচে থাকি।”

সে জানে, প্রীতি হয়তো আর ফিরে আসবে না। হয়তো ট্রেনে করে, নদীর ঘাটে, কোনও নতুন আখড়ায়—সে গান গাইছে কারও জন্য, যাকে সে চিনে না, তবু ভালোবাসে।

কিন্তু প্রীতম জানে, প্রীতিকে পাবার দরকার নেই। সে একতারা বাজাতে শিখেছে নিজের পাঁজর দিয়ে। তার দেহ এখন গৃহ, প্রেমিকা, গুরু—সব একসঙ্গে।

সে শেষরাতে জানালার কাছে বসে বলে ওঠে—

“তুই চলে গেছিস,
তবু আমার দেহে রয়ে গেছিস সুর হয়ে।
আমি এখন নিজের শরীরেই তোকে খুঁজি,
আর প্রতিবার নিঃশ্বাসে তোর গান গেয়ে ফেলি।”

শরীর থেকে স্নেহের বিচ্ছুরণ

আষাঢ়ের মেঘে ঢাকা একটা দুপুর। কলেজের ক্লাস সবে শেষ হয়েছে। প্রীতম চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে, হোস্টেলের করিডোরে পায়চারি করছিল। তখনই এল অনন্যা—তার ক্লাসে পড়া একটি মেয়ে, সদা মনোযোগী, চোখে আলো, চেহারায় গভীর কিছু।

“স্যার,” সে থেমে বলল, “আপনার ক্লাসের পর মনে হয় একটা কথা বলতেই হবে।”

প্রীতম কৌতূহলী হয়ে তাকাল, “বলো অনন্যা।”

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আপনি প্রতিদিন যার কথা বলেন না, তাকেই প্রতিদিন আমাদের বোঝাতে থাকেন—আপনার চুপ করা, আপনার পদ, আপনার ক্লাসে বসে একতারা ছুঁয়ে থাকা—সবই যেন তাকে ঘিরে। আমি জানি না উনি কে, কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছি।”

প্রীতমের গলার ভেতর দিয়ে হঠাৎ কিছু একটা নেমে যায়। “তুমি কী বলছো?”

“পাঁচদিন আগে, বাবা-মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতন গেছিলাম,” অনন্যা বলল। “উদয়নগাছের পাশে একটা নতুন আখড়া হয়েছে—‘প্রবাহ’। সেখানে এক নারী গান গাচ্ছিল, তার গলায় আপনি যে ভাষায় বলেন—সেই ভাষারই ছায়া। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু গান শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার গুরু আমার দেহের ভেতরে থাকেন, তাই আমি কাউকে অনুসরণ করি না।’ তখনই মনে হয়েছিল—এ তো আপনার কথারই প্রতিবিম্ব।”

প্রীতম কিছু বলে না। চায়ের কাপটা ঠোঁটে নিতে গিয়ে ঠেকিয়ে রাখে। চোখে দূরদৃষ্টি।

“তুমি কি দেখেছো তার চেহারা?”—গলা শুকিয়ে আসে তার।

“না, তিনি সবসময় মাথায় ওড়না রাখতেন। কিন্তু সেই চোখ, স্যর, আমি চিনেছি—কারণ আমি একদিন আপনার ক্লাসে বসে এমন এক ভাষা শুনেছিলাম, যা ভাষাহীন ছিল। তার মুখে সেই একই নীরবতা বাজছিল।”

অনন্যা চলে যায়। কিন্তু প্রীতম জানে—সে আর স্থির থাকতে পারবে না।

সে সেদিনই সন্ধ্যাবেলা বেরিয়ে পড়ে শান্তিনিকেতনের দিকে। ট্রেনের কামরায় বসে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধক শুনতে থাকে। তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় যেন এক অন্যরকম আলো, উত্তেজনা, ভয় আর আকাঙ্ক্ষার মিশ্রণ।

“প্রবাহ”—এমন একটা নাম, যা যেন একেবারেই প্রীতির মতো। সে তো নিজেই বলেছিল, “আমি জল, আমি বাঁক খাই, আমি এগোই—কিন্তু থাকি না কোথাও।”

স্টেশনে নেমে প্রীতম হাঁটতে থাকে। শান্তিনিকেতনের সেই পুরনো রাস্তাগুলো আজ অন্যরকম লাগে। গাছগুলো যেন মাথা নিচু করে, বাতাস যেন থমকে আছে।

একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে সে, ‘প্রবাহ’ লেখা আখড়ার দরজার সামনে। ভেতরে থেকে গানের সুর ভেসে আসছে না, শুধু একতারা আর ঢুলির তালে কাঁপতে থাকা মাটির ধ্বনি।

সে ধীরে পা বাড়ায়।

আখড়ার উঠোনে আগুন নেই, কিন্তু চারপাশে লোক বসে আছে। পাটের বিছানায় এক নারী বসে, চোখ বুজে। পরনে হালকা গেরুয়া, মাথায় ঘোমটা। কিন্তু মুখটা আজ উন্মুক্ত।

হ্যাঁ, সে—প্রীতি।

তাকে দেখে মনে হয় না কোনও পরিবর্তন হয়েছে। বরং যেন আরও মিশে গেছে বাতাসে, মাটিতে। তার শরীর এখন আর আলাদা করে নেই, সে যেন হয়ে উঠেছে চারপাশের পরিপূরক।

প্রীতম ধীরে এগিয়ে যায়।

প্রীতি চোখ খোলে। তাদের মাঝে মুহূর্তকাল সময় থেমে যায়।

“তুই এলি?”—প্রশ্নটা জলের মতো সহজ।

“এলাম,” বলে প্রীতম। “কারণ আমার শরীর টানছিল তোকে।”

প্রীতি হালকা হাসে। “তোর শরীর আজকাল কথা বলে, জানতাম না।”

“তুই তো আমাকে শিখিয়েছিস,” প্রীতম বলে। “তোর না-থাকা আমাকে এতটাই ভরিয়ে দিয়েছিল যে, আজ যখন শরীর নিজে কিছু চাইছিল, আমি আর না করতে পারিনি।”

প্রীতি উঠে দাঁড়ায়। ধীরে কাছে আসে।

“তুই কি কিছু চাস?”

“তুই থাকিস—এইটুকু।”

প্রীতি বলে, “থাকার মানে জানিস তো? শরীর এখানে থাকে, মন চলে যায়। আবার শরীর চলে গেলে মন পড়ে থাকে। আমি থাকব, তবে তুই যেন তোর দেহে আমার সুরটা ধরে রাখিস।”

প্রীতম মাথা নিচু করে বলে, “আমি তো এখন নিজের দেহেই তোর গান গাই।”

প্রীতি তার কাঁধে হাত রাখে।

“তবে চল, আজ তুই গাইবি। আমি শুনব।”

প্রথমবার, প্রীতম প্রীতির সামনে বসে গান ধরে।

“তুই ছিলি আমার গলায়,
তুই এখন বাজিস আমার হাড়ে।
তোর স্পর্শ ছায়া হয়ে গেছে,
তবু প্রেম আমার পাঁজরে বাজে।
আমি তোকে পাইনি রাত্রির ঘ্রাণে,
তুই এসেছিস ভোরের নিঃশ্বাসে।”

প্রীতির চোখ বেয়ে জল নামে।

প্রীতম তখন জানে, সে আর প্রীতিকে চাইবে না। সে এখন প্রীতিকে ধারণ করে—প্রেমিক নয়, পথিক নয়—তাকে নিজের শরীরের সুর বানিয়ে রেখেছে।

অন্তর্গত মিলনের রূপকথা

বর্ষা নামছে শান্তিনিকেতনের আকাশে। পাতায় পাতায় টুপটাপ জলের ধ্বনি, কাঁচা মাটির গন্ধে মিশে রয়েছে সুরের মতন এক ধরনের টান—যে টান শরীর ছুঁয়ে ভিতরের দিকে নিয়ে যায়। ‘প্রবাহ’ আখড়ার আশপাশে জল জমেছে, তবু ভেতরে যেন এক আশ্চর্য শান্তি।

প্রীতম আর প্রীতি—তারা এখন এখানে একসঙ্গে থাকে না, কিন্তু একই উঠোনে থাকে। তারা কথা কম বলে, কিন্তু চোখে চোখ রাখলেই অনেক কিছু বোঝা যায়। সময় এখানে হিসেবের বাইরে। সম্পর্ক এখানে বর্ণনার বাইরে।

একদিন দুপুরবেলা, যখন বৃষ্টি একটু থেমে আছে, তখন প্রীতি এসে বসে প্রীতমের পাশে। উঠোনে কেউ নেই, চারদিক ভিজে। তাদের মাঝখানে মাটির পাত্রে এক চা।

প্রীতি বলে, “আজ একটা কথা বলি? এতদিন বলিনি, কারণ শরীর অনুমতি দিত না। আজ মনে হচ্ছে, বলার সময় হয়েছে।”

প্রীতম চোখ তোলে, “বলো।”

প্রীতি বলে, “আমরা অনেক কথা বলেছি দেহ নিয়ে, সুর নিয়ে, প্রেম নিয়ে। কিন্তু একটা কথা মনে আছে তো—প্রেমের সবচেয়ে গভীর প্রকাশ সেই, যা শরীরে নয়, শরীরের বাইরে ঘটে। কিন্তু সে শরীর দিয়েই শুরু হয়। তুই কি কখনও ভেবেছিস, আমাদের প্রেম কখন শুরু হয়েছিল?”

প্রীতম ভাবে। নদীর ধারে, একতারা বাজার মাঝে, চোখের নীরবতা… কিন্তু সব ফেলে সে বলে, “শুধু শুরু নয়, প্রেম তো কখনও শেষও হয়নি।”

প্রীতি হেসে ফেলে, “শেষ হবে না। কারণ আমরা কখনই শরীর দিয়ে প্রেম করিনি। আমরা প্রেম করেছি শরীরের ভিতর দিয়ে। আমাদের মিলন হয়েছে, কিন্তু তা চোখে দেখা যায় না, ছুঁয়ে অনুভবও করা যায় না—ওটা দেহের গভীরতম স্তরে ঘটে, যেখানে ঈশ্বর থাকেন, আর গান জন্মায়।”

এই বলে সে হঠাৎ একটা পা বাড়িয়ে প্রীতমের পায়ের ওপরে রাখে। একটুও সংকোচ না করে। যেন অনেকদিনের চেনা, যেন দুটো শরীর নয়, একটি সুরের দুই আলাদা কাঁপন।

“তুই জানিস,” বলে প্রীতি, “আমরা একদিন মিলেছিলাম—সেই রাতে, যেদিন আমি তোর জানালার পাশে বসেছিলাম, আর তুই ব্যথায় কাঁপছিলি। আমি তখন তোর শরীরের ব্যথার সঙ্গে আমার নিঃশ্বাস মিশিয়ে দিয়েছিলাম। ওটাই ছিল আমাদের মিলন।”

প্রীতম স্তব্ধ হয়ে থাকে।

তার মনে পড়ে—হ্যাঁ, সেদিন সে ব্যথায় কেঁপেছিল, আর প্রীতি এসেছিল হারিকেন হাতে, তাকে বলেছিল, “শরীরের কষ্ট শুনলে, সে গান হয়ে যায়।”

সেদিন সে যে ঘুমিয়েছিল, সেই ঘুমের মধ্যেই সে নিজেকে বদলে ফেলেছিল—সে প্রেমিক হয়ে উঠেছিল। আজ বুঝতে পারছে—ওটাই ছিল তাদের শরীরী সংযোগ, যেখানে কোনও ছোঁয়া ছিল না, ছিল আত্মা থেকে আত্মায় বয়ে যাওয়া এক শব্দহীন স্রোত।

প্রীতি আবার বলে—

“আমরা যে মিলন খুঁজি দেহে,
সে তো মিলনের আড়ালে থাকে।
যখন নিঃশ্বাসে বাজে কারও নাম,
তখন তোর আমার মতো প্রেম জাগে।
এই দেহ যদি ভেঙে যায় একদিন,
তবু মিলন তো থাকবে হৃদয়ের গানে।”

তারপর তারা দুজনেই চুপ করে যায়।

একটা ছোট পাখি এসে তাদের সামনে মাটিতে নামল। বৃষ্টির ফোঁটা তার গায়ে পড়ে ঝরে পড়ছে। যেন সেই পাখিও এই মিলনের সাক্ষী।

প্রীতম ধীরে বলে, “তুই কি জানিস, আমি এখনও তোকে স্পর্শ করতে ভয় পাই?”

“ভয় পাবার কিছু নেই,” প্রীতি বলে, “কারণ তুই আমায় কখনোই শরীর দিয়ে ছুঁতে চাসনি। তুই আমায় জলে ভেজা পাতার মতো ছুঁয়েছিস—যেটা চোখে পড়ে, তবু আঙুল ছুঁয়ে না।”

তারপর হঠাৎই প্রীতি বলে, “চল, আজ আমরা একসঙ্গে থাকি।”

“মানে?”

“এভাবেই। কোনও কথায় নয়, কোনও গানে নয়। শুধু পাশাপাশি শুয়ে থাকি, যেমন আকাশ আর মাটি শোয় বৃষ্টির রাতে। শরীর ছুঁয়ে থাকবে শরীর, কিন্তু এক বিন্দু তৃষ্ণা থাকবে না। শুধু থাকব—প্রেম হয়ে, সুর হয়ে, মিলন হয়ে।”

তারা একটি নির্জন ঘরে ঢোকে। জানালা খোলা, বাইরে পাখির ডাক, আর দূর থেকে মেঘের গর্জন।

তারা পাশাপাশি শুয়ে থাকে মাটির বিছানায়। গায়ে একটুকরো মোটা চাদর।

প্রথমে চোখে চোখ। তারপর নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস। এবং শেষে, শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় এক গভীর নিঃশব্দতায় মিলিয়ে যায়।

তারা কেউ কারও ঠোঁট ছোঁয় না, কেউ কোল চায় না, কেউ আলিঙ্গনে যায় না। তবু এই নিরব শরীরী সান্নিধ্যই যেন সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ মিলন।

প্রীতম ভাবে—এই যদি হয় প্রেম, তবে সে আর কোনও সঙ্গম চায় না। এই যদি হয় মিলন, তবে তার দেহ আর কিছু খোঁজে না।

আমার দেহে তুই বাজিস

প্রেম কখনও ফুরোয় না। প্রেম শুধু রূপ বদলায়—দেহ থেকে নিঃশ্বাসে, চোখ থেকে মনে, গান থেকে নীরবতায়। প্রীতম যখন ‘প্রবাহ’ আখড়া থেকে ফিরে এলো শহরে, তার ভেতরে সেই প্রেম থেমে থাকেনি—বরং আরও গভীরে গিয়ে নিজের ভিতরের সুরকে ধরতে শিখেছে।

সে আর আগের মতো কলেজে গিয়ে শুধু পাঠ্যক্রম শেখায় না। তার ক্লাসে আজকাল নীরবতাও থাকে, সুর থাকে, নিজের লেখা পদ থাকে। প্রীতির দেওয়া খাতা এখনও তার ডেস্কের ডানদিকে থাকে, আর বাঁদিকে—তার নিজের খাতা। যেখানে শরীর দিয়ে লেখা, ভেতর দিয়ে জন্মানো, প্রেম দিয়ে সাঁতা কাটা পদগুলো জমা হয়।

সে তার গবেষণার কাজ শেষ করেছে।

থিসিসের নাম—
“দেহতত্ত্ব ও প্রেম : অন্তর্গত গাঁথা”

যেখানে লেখা আছে:

“প্রেম যদি শরীরের বাইরে থাকে, তবে সে কল্পনা।
শরীর যদি প্রেম ছাড়া থাকে, তবে সে যন্ত্র।
শুধু যখন প্রেম শরীর হয়ে ওঠে,
তখনই সে গান হয়।”

তাকে যখন গবেষণার সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সে প্রথমে যেতে চায় না। কারণ সে জানে, তার ভিতরের কথা কেউ বুঝবে না। যারা প্রেমকে কেবল সম্পর্ক বলে জানে, তারা তো এই প্রেমের ভাষা বোঝে না।

তবু একদিন সে সম্মেলনে যায়।

তার বক্তব্যের আগে বেশ কিছু তত্ত্ব, পরিসংখ্যান, বইয়ের উদ্ধৃতি চলে আসে। কেউ কেউ বাউল দর্শন নিয়ে কথা বলে, কেউ দেহতত্ত্ব নিয়ে তর্ক তোলে। প্রীতম চুপ করে থাকে।

শেষে মাইক্রোফোন তার সামনে আসে।

সে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি আজ কোনও বক্তব্য রাখব না। আমি আজ একটা গান গাইব। কারণ প্রেম, দেহ, দর্শন—সবই আমার কাছে একটা গানের মতো, যা রক্তে বাজে, চোখে ভাসে, আর শরীরে বাস করে।”

তারপর সে গলায় এক গামছা বেঁধে একতারা হাতে তোলে—সেই একতারা, যার তার একদিন প্রীতি খুলে দিয়ে গিয়েছিল, আর প্রীতম নিজে বেঁধেছিল।

সে চোখ বন্ধ করে গায়—

“তুই আমার ঠোঁট ছুঁইসনি,
তবু তোর নাম বাজে আমার কণ্ঠে।
তুই আমায় ভালোবাসিসনি,
তবু তোর দৃষ্টিতে আমার শরীর জেগে ওঠে।
তুই দূরে,
তবু আমি তোর ভিতরেই সাঁতার কাটছি।
আমার দেহে তুই বাজিস,
আমি তোর গানের খাঁচা।”

মাঠ নিস্তব্ধ।

তর্ক নেই, প্রশ্ন নেই।

তবে একজন উঠোনের পেছনে বসে আছে—সে মুখ দেখায় না। চোখে ওড়না টেনে রেখেছে। কিন্তু তার কাঁধ কাঁপছে। ঠোঁট নড়ে না, চোখ কাঁদে না, তবু তার শরীর বলছে—সে শুনেছে।

সেদিন রাতে প্রীতম ঘরে ফিরে নিজের খাতায় লেখে—

“আজ আমি জানি, আমি প্রেম পেয়েছি।
আমি দেহ দিয়ে প্রেম করিনি,
আমি প্রেম দিয়েই দেহ হয়ে উঠেছি।”

মাস পেরোয়।

প্রীতম এক সন্ধ্যায় আখড়ার দিকে হাঁটতে হাঁটতে যায়। এখন সে একা নয়, সঙ্গে থাকে নতুন কয়েকজন ছাত্রছাত্রী—যারা তার ক্লাসে প্রেম খুঁজে পায়, তত্ত্বের চেয়ে গভীর কিছু বোঝে।

তারা আখড়ার উঠোনে বসে। প্রীতম বলে, “আজ আমি কিছু বলব না। আজ তোমরা গান ধরো।”

তারা প্রথমে লজ্জা পায়, তারপর ধীরে ধীরে কেউ একতারা তোলে, কেউ গলা ছাড়ে। সেই সুরে এখনও প্রীতির ছায়া বাজে।

হঠাৎ এক পায়ে নুপূরের শব্দ।

সবার চোখ ঘোরে।

তুলসীতলার পাশে দাঁড়িয়ে একজন নারী। মাথায় হালকা ঘোমটা, চোখে নীল আলোর রেখা, গলায় আগের মতোই সে সুর।

প্রীতম তাকিয়ে থাকে। ওঠে না, বলে না, শুধু তার শরীরটা একটু কেঁপে ওঠে।

নারীটি বলে, “আজ আমি কিছু বলব না। আমি শুধু শোনার জন্য এসেছি। যে প্রেম শুধু নীরবতায় বাজে, সে প্রেম শুনে যেতে হয়।”

সেদিন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। শুধু চারপাশের পাতা, বাতাস, কুয়াশা, আর সেই আগুন—সব বলে, প্রেম ফিরে এসেছে, কিন্তু এবার নাম নিয়ে নয়, দাবি ছাড়া।

রাত বাড়ে।

প্রীতম একা বসে।

তার পাশে প্রীতি।

দু’জনের হাত একে অপরের কাছে, কিন্তু স্পর্শ নয়।

“তুই এখনও ভয় পাস আমাকে ছোঁতে?” প্রীতি ফিসফিস করে।

প্রীতম হাসে, “না। আমি এখন তোকে ছুঁয়ে থাকি নিজের প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আর কী চাই?”

প্রীতি বলে, “তবে তো তুই গুরু হয়েছিস। এখন তুই নিজেই পথ। এবার আমি তোকে অনুসরণ করব।”

প্রীতম মাথা নোয়ায়।

কোনও শব্দ নেই।

তবু দেহ জেগে ওঠে।

গান শুরু হয়, যার নাম—”আমি তোর ভিতরেই বাজি।”

 

-শেষ-

 

1000024403.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *