পল্লবী গাঙ্গুলী
ব্রিউড ইন পার্কস্ট্রিট
শহরটা তখনও ঠিক জেগে ওঠেনি। সকাল আটটা পার্কস্ট্রিটে মানে একটা অলসতা, একটা হাই তুলতে তুলতে ভাঙা ঘুমের মাধুর্য। কিন্তু ‘ক্যাফে কলকাতা’—এই নামটা যেন একটু অন্যরকম। ওটা একটা ক্যাফে, আর একটা অনুভূতি। পিসক্যাফে নয়, স্টারবাকস নয়, এমনকি ফ্ল্যাবি চিয়ার বা কফিহাউসও নয়। এটা ছিল মায়া আর মশলার কফিতে মেশানো এক ঘরোয়া শহুরে গল্পের ঠিকানা।
প্রাচীন লাল ইটের দালানে সবুজ জানালার শেড আর কাঠের ঝুলন্ত বোর্ডে লেখা “Café Kolkata – since 1986”—মোহনদার বাবা শুরু করেছিলেন। তারপর উত্তরাধিকার মেনে চলে এসেছে। এখন সামলায় অনিকেত, শহরের হিপস্টার হিরো। সবসময়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, আর কথায় সাহিত্যিক ঘ্রাণ।
এদিন সকালটা একটু অন্যরকম। দরজায় প্রথমবার পা রাখল রিমঝিম। নাম যেমন, তেমনই মেজাজ। শহরতলির মেয়ে, সদ্য কলেজ শেষ করে এসেছে কলকাতায় জব খুঁজতে। তার ধারণা ছিল, পার্কস্ট্রিট মানেই দামি কফি, ইংরেজি গন্ধ, আর হাই-হীলের তর্জনী নাচানো মহিলা। কিন্তু মোহনদার কফিশপে ঢুকে সে অবাক।
চিপচিপে কাঠের টেবিল, সাদা মাটির কাপ, আর দেয়ালে ঝুলছে মান্না দের ছবি। তার পাশে লেখা:
“কফি শেষ হলেই গল্প শেষ হয় না, গল্প শেষ হলে তবে উঠে যাওয়া যায়।”
রিমঝিম যেন একটু হেসে ফেলল। মনে হল এটাই সেই ঠিকানা, যেটা তার মতো পথহারা শহুরে মেয়েদের নতুন করে পথ খোঁজার জন্য তৈরি।
— “কী নেবেন ম্যাডাম?”
সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একজন সুদর্শন, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা ছেলেটা—অনিকেত।
— “কফির নাম জানি না। যা আপনি মনে করেন নতুন কারও জন্য ভালো হয়, সেটাই দিন।”
অনিকেত কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “হ্যাঁ, প্রথম-বার-শহরে-আসা-তাজা-মনের জন্য আমাদের একটা স্পেশাল ব্রিউ আছে। নাম দিলাম ‘কলকাতা রেন’।”
রিমঝিম হাসল, “নামটাই তো গল্পের মতো।”
অনিকেত মাথা ঝাঁকাল। “এই ক্যাফেতে প্রতিটা কফি একটা গল্প। আপনি চাইলে শোনাতে পারি।”
এইভাবেই শুরু হল প্রথম পরিচয়। কফির কাপে কাপে জমতে লাগল কথা। রিমঝিম এসে বসতো কোণের টেবিলে, আর অনিকেত কফি নিয়ে গিয়ে সেখানে বসে আধঘণ্টার গল্প করত—কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে, কখনও পার্কস্ট্রিটের পুরনো হোটেল, কখনও কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ট্রাম।
একদিন রিমঝিম বলল, “আপনি লেখেন না কেন? আপনার ভাষায় একরকম ছোঁয়া আছে।”
অনিকেত বলল, “আমি লিখি, কিন্তু শুধু কফির কাপের গায়ে।”
— “মানে?”
অনিকেত তাকে দেখাল, প্রতিটি মাটির কাপে একটি করে ছোট্ট কবিতা বা লাইন লেখা থাকে। তার লেখা।
রিমঝিম অবাক হয়ে বলল, “এগুলো তো আসলে ছোট গল্প!”
— “এই গল্পগুলো আমার শহরকে ভালোবাসা জানানোর উপায়। কে জানে, কেউ একদিন এসব জড়ো করে একটা বই করে ফেলবে।”
সেই দিন থেকে রিমঝিম ক্যাফের গল্পগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখতে লাগল। অজান্তেই তারা হয়ে উঠল এক ধরনের ‘co-creators’। দিন কেটে যাচ্ছিল—কফি, কবিতা আর বন্ধুত্বের রসায়নে।
কিন্তু শহর কি এত সহজে মিশতে দেয়? একদিন বিকেলে এল একটি বেসরকারি পাবলিশিং হাউজের প্রফেশনাল প্রেজেন্টেশন—একজন মহিলাকে নিয়ে, নাম তৃষা দত্ত। কড়া হাই হীল, লিপস্টিকের তীব্রতা আর চোখে ব্যবসার হিসেব। তিনি বললেন:
— “We are looking to turn this café into a brand. Coffee with Kolkata stories—great content. And the face of it? You, Aniket.”
রিমঝিমের মনে হল যেন কিছুটা কেঁপে উঠল।
— “অনিকেত, তুমি রাজি?”
অনিকেত হাসল, “আমি লিখি শহরের জন্য, ক্যাফের জন্য। ব্র্যান্ডের জন্য নয়।”
তৃষা বললেন, “আচ্ছা, ভাবো। কিন্তু এটা অনেক বড় সুযোগ।”
রিমঝিম বুঝতে পারল, কফি কাপে বাঁধা থাকলে গল্প বাঁচে। কিন্তু মঞ্চে তুললেই কি সেই প্রাণটা থাকে?
সেদিন রাতে ক্যাফের কোণে তারা দুজনে অনেকক্ষণ বসেছিল। অন্ধকারে আলো ছিল শুধু একটা ছোট টেবিল ল্যাম্পে। রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আসলেই গল্প হয়ে থাকতে চাও, না গল্পের বাইরে যেতে চাও?”
অনিকেত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি কি চাইছ আমি গল্পে থাকি?”
রিমঝিম বলল, “আমি চাই তুমি তোমার ক্যাফেটাকে বাঁচিয়ে রাখো। কারণ আমিও একটু একটু করে এই ক্যাফেরই অংশ হয়ে যাচ্ছি।”
সে রাতে পার্কস্ট্রিটের বাতাসে ভেসে বেড়াল ‘কলকাতা রেন’-এর গন্ধ। আর ক্যাফে কলকাতা নামক গল্পটা পেরিয়ে গেল প্রথম অধ্যায়ের গণ্ডি।
ল্যাপে ল্যাপে ল্যাটি
“কলকাতা রেন”-এর গন্ধটা এখনও যেন রিমঝিমের নাকে লেগে ছিল। সকালে অফিস যাওয়ার আগে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও ক্যাফেটায় ঢুকে পড়ে সে। যেন ঘড়ির কাঁটার আগে কিছু সময় নিজেকে পাওয়া যায়।
সেদিন ক্যাফে কলকাতায় ঢুকেই সে দেখল, কোণের টেবিলটায় কেউ একজন বসে আছে। এক হাতে ল্যাপটপ, অন্য হাতে কফির কাপ। চোখে পাতলা ফ্রেম, মুখে ফিকে দাড়ি, আর টেবিলের পাশে পড়ে থাকা একটা মোটা নোটবুক। লোকটা এমনভাবে টাইপ করছিল, যেন টাইপ শব্দগুলোও ঘাম ঝরাচ্ছে।
অনিকেত বলল, “ওকে চিনিস? ওর নাম ল্যাটি—অর্থাৎ ল্যাটে সাহেব। কেউ জানে না ওর আসল নাম। ও এখানে বসে বসে কী যেন লেখে। রোজ ঠিক সকাল দশটা।”
রিমঝিম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। লোকটা একবারও মাথা তোলে না, শুধু মাঝে মাঝে চোখ কুঁচকে কী যেন ভাবে। ক্যাফের পরিবেশে তার অস্তিত্ব কিছুটা অদ্ভুত ঠেকে, আবার মানিয়েও যায়।
একটু পরেই অনিকেত এল দুটো কফির কাপ নিয়ে।
— “এই নাও, তোমার usual। আর ওরটা আমি বানাই ‘Black Rehearsal’—কারণ ওর জীবনটাই একটা প্র্যাকটিস মনে হয়।”
রিমঝিম বলল, “ও কী লেখে?”
অনিকেত মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। কেউ জানে না। কেউ কখনও ওর পাশে বসে কথা বলার সাহস পায়নি।”
ঠিক তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ল্যাটি মাথা তুলে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, মুখে মৃদু হাসি।
— “তুমি রিমঝিম, তাই তো?”
রিমঝিম চমকে গেল।
— “আপনি কী করে জানলেন?”
— “তোমার লেখা আমি পড়েছি।”
— “কোথায়?”
— “ক্যাফের কোণে রাখা ডায়েরিটায়।”
রিমঝিম বুঝে উঠতে পারছিল না, সে খুশি হবে না বিব্রত হবে। ক্যাফেতে রাখা ডায়েরিটায় সে মাঝে মাঝে কবিতা, কিছু কথার টুকরো লিখে রাখে। কেউ পড়ে সেটা ভাবেনি কখনও।
ল্যাটি বলল, “তোমার শব্দগুলো জলছাপের মতো। মুছিয়ে ফেলা যায় না।”
সেই মুহূর্তে অনিকেত পাশে এসে দাঁড়াল।
— “তুমি ডায়েরি পড়েছো? ওটা তো… ওর ব্যক্তিগত ভাবনা।”
ল্যাটি শান্তভাবে বলল, “ক্যাফে নিজেই তো একটা খোলা বই। এখানে লেখা মানেই শেয়ার করার সাহস। আমি শুধু শব্দ পড়িনি, অনুভব করেছি।”
রিমঝিম এবার বলল, “আপনি কী লেখেন?”
— “যা আমি বলি না, তা-ই লিখি।”
এই কথা শুনে পুরো ক্যাফেটা যেন এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
তারপর থেকে রিমঝিম প্রায় রোজ ল্যাটির টেবিলের পাশে গিয়ে বসতে লাগল। সে কথা বলত না, শুধু লেখার শব্দ শুনত। মাঝে মাঝে ল্যাটি তার লেখা এক লাইনে মন্তব্য করত।
— “এই শব্দটা ভারি।”
— “এখানে গন্ধ নেই।”
— “চোখ দিয়ে পড়লে মন বোঝে না।”
প্রথমে একটু বিরক্তি হলেও, রিমঝিম ধীরে ধীরে বুঝতে পারল—এই লোকটা সত্যি কিছু বোঝে। তার লেখা কেমনভাবে বদলে যাচ্ছে সে নিজেই খেয়াল করল।
একদিন, ক্যাফের জানালার পাশে বসে, ল্যাটি বলল:
— “শহরটা এক বিরাট গল্প। কিন্তু সবাই শুধু নিজের গল্পে ব্যস্ত। কেউ অন্যের শব্দ পড়ে না।”
রিমঝিম বলল, “তাই তো তুমি পড়ো, তাই না?”
— “না, আমি শোনার চেষ্টা করি। শব্দের ভিতরের শব্দটা।”
তাদের কথার ফাঁকে ধোঁয়া উঠতে থাকা কফির কাপে যেন শব্দ জমছিল। ক্যাফে কলকাতা হয়ে উঠছিল একটা ওয়ার্কশপ, একটা সাহিত্যের ল্যাব।
তবে শহরের নিয়ম সহজ নয়। কেউ খুব বেশি চুপ করে থাকলে, শহর তাকে টেনে বার করে আনে। আর একদিন ক্যাফেতে এল এক মহিলা—চোখে কালো চশমা, হাতে এক ফাইল, আর পেছনে একজন ফটোগ্রাফার।
তাদের দেখে অনিকেত এগিয়ে গেল।
— “Can I help you?”
মহিলা বললেন, “We are from ‘Kolkata Insider’. Doing a feature on unique café personalities. Heard there’s a ‘ghost writer’ who sits here daily.”
অনিকেত হাসল, “আসলে, এখানে যে কফি খায়, সবাই একটু লেখক হয়ে ওঠে।”
কিন্তু ফটোগ্রাফার ইতিমধ্যেই ক্যামেরা তুলেছে ল্যাটির দিকে।
ল্যাটি বলল, “No photos. Please.”
মহিলা বললেন, “But sir, you’re the ‘mystery man’ of Café Kolkata!”
রিমঝিম সেই মুহূর্তে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “আপনাদের অনুমতি ছাড়া লেখা বা ছবি ব্যবহার করা অনুচিত।”
ল্যাটি উঠে দাঁড়াল, তার নোটবুকটা বন্ধ করল, আর ক্যাফে থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
সেই প্রথম রিমঝিম বুঝল, কিছু মানুষ গল্প লিখে যায় না, বরং গল্প হয়ে বাঁচে।
আর ল্যাটি ছিল সেইরকম এক চরিত্র—যার অস্তিত্বটাই ছিল ক্যাফের ভাষ্য।
প্যাস্ট্রি, পেনড্রাইভ আর পুনর্মিলন
সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল টুপটাপ। এমন নয় যে অঝোর বর্ষণ, কিন্তু এমন এক বৃষ্টি, যা জানালার কাঁচে জমে থাকা ধুলো মুছে দিয়ে কিছু স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ‘ক্যাফে কলকাতা’-র ভিতরে তখন কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ছাতার নিচে ছুটতে থাকা জোড়া জোড়া পা। রিমঝিম usual corner টেবিলে বসে ‘ক্যাফে ক্যাপচিনো’ আর সঙ্গে একটা মেল্টিং চকোলেট প্যাস্ট্রি নিয়ে বসেছিল। হালকা ট্রাফিক, ছুটির বিকেল, আর একটা নিঃশব্দ সময়—সেই মুহূর্তটা তার প্রিয়।
ঠিক তখনই দরজায় একটা ঘণ্টা বাজল। ক্যাফের পুরোনো কাঠের দরজাটা ঠেলে ঢুকল একজন—চোখে কাঁচের চশমা, গায়ে মলিন বৃষ্টিভেজা সোয়েটার, হাতে একটা ছোট্ট পেনড্রাইভ ঝোলানো ল্যানিয়ার্ড। চোখে পড়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তেই।
— “ঐ তো, শ্রেয়!” — চমকে উঠল রিমঝিম।
শ্রেয়া ঘোষ, স্কুলের বন্ধু। অনেকটা সময় আগেই হারিয়ে গিয়েছিল রিমঝিমের জীবন থেকে। শেষবার ওদের দেখা হয়েছিল ক্লাস ইলেভেনের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তারপর কলেজ, জীবন, ভুল বোঝাবুঝি—আর না দেখা হওয়া।
— “তুই!” — শ্রেয়া যেন হকচকিয়ে গেল।
— “তুই এখানে?”
— “তুইও তো!”
এক মুহূর্তের অস্বস্তির পর, তারা দুজনেই হেসে ফেলল।
অনিকেত দূর থেকে তাকিয়ে হাসল, “দু কাপ কফি পাঠিয়ে দিই?”
রিমঝিম বলল, “আর একটা চকোলেট প্যাস্ট্রি দিও। ওর জন্য।”
শ্রেয়া বসে পড়ল সামনের চেয়ারটায়। কফির গন্ধ, টেবিল ল্যাম্পের আলো, আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ড—সেই মুহূর্তে সবকিছু সিনেমার দৃশ্যের মতো লাগছিল।
— “তোকে শেষ দেখি যে বছরটা আমি প্রথম লেখার চেষ্টা করছিলাম। তুই তখন মঞ্চে আবৃত্তি করতিস।”
— “আর তুই তখন ‘সায়েন্সের মেয়ে’। কোচিং, পরীক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং…”
— “হ্যাঁ, সেটা তো হল না। আমি এখন ভিডিও এডিটিং করি, ফ্রিল্যান্স করি। আর এটাই আমার পেনড্রাইভ—আমার কারখানা।”
শ্রেয়া পেনড্রাইভটা টেবিলের ওপর রাখল, যেন নিজের অস্তিত্ব রেখে গেল।
রিমঝিম অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এতদিন পরে দেখা হয়ে হঠাৎ এত সহজে গল্প শুরু হয়ে যাবে, এটা সে ভাবেনি।
শ্রেয়া হেসে বলল, “তুই এখনও লিখিস?”
— “এখন বেশি করে লিখি। এই ক্যাফেটা না থাকলে হত না।”
তারা দু’জনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে এমন কিছু বন্ধুত্ব থাকে, যেগুলো ভেঙে গেলেও, সময়ের সঙ্গে একটা পুরোনো ছাঁচে ফিরতে পারে।
শ্রেয়া বলল, “আসলে তোকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।” সে পেনড্রাইভটা খুলে দিল ল্যাপটপে। একটা ছোট্ট ভিডিও চলতে শুরু করল। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল পার্কস্ট্রিটের ব্যস্ততা, ট্রাম, বৃষ্টির ভেজা রাস্তায় ছুটতে থাকা মানুষ, আর এক মুহূর্তে উঠে এল ক্যাফে কলকাতা’র রঙিন সাইনবোর্ড।
— “তুই এটা বানিয়েছিস?” রিমঝিম অবাক।
— “হ্যাঁ, আমার একটা প্রজেক্ট চলছে ‘কলকাতা কাটিং’। শহরের ছোট ছোট জায়গা, যেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা মানুষ ভুলে যাচ্ছে, সেগুলোর ওপর একটা শর্ট ডকু বানাচ্ছি। এই ক্যাফেটা আমার পরের পর্বের বিষয়।”
— “তাহলে তোকে অনিকেতের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
ঠিক তখনই অনিকেত এসে গেল, দুটো কফির কাপ আর একটা গরম প্যাস্ট্রি নিয়ে।
— “কথা শুনছিলাম। ভিডিও? আমায় রাখতে হবে না তো ভাই?”
— “না না, আপনাকে দেখাবো না, বরং শুনবো। এই ক্যাফেটা শুরু হয়েছিল কিভাবে, তার গল্প চাই। শুধু সেটাই চাই।”
অনিকেত একরকম লজ্জা পেয়েই বলল, “তাহলে এক কাজ করো—কাল সকাল দশটায় এসো। আমি ফাঁকা থাকবো।”
শ্রেয়া মাথা নাড়ল।
রিমঝিম বলল, “দেখবি, এই ক্যাফেটা শুধু কফির জায়গা না, এখানে প্রত্যেক চেয়ারে একটা করে গল্প বসে আছে।”
সেদিনের পর আবার দেখা হল দুজনের। পুরোনো ঝগড়া আর ভুল বোঝাবুঝির পিঠে একটা নতুন কফির দাগ পড়ল—গাঢ়, কিন্তু উষ্ণ।
বৃষ্টির দিন ছিল, শহর তখন ধীরে ধীরে ভিজে উঠছিল। আর দুই পুরোনো বন্ধু খুঁজে পেল তাদের মাঝখানে হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা।
ক্যাফে কম্পিটিশন
সকাল সাড়ে ন’টা। পার্কস্ট্রিটের রাস্তায় তখন অফিসের ব্যস্ততা জেঁকে বসছে। ‘ক্যাফে কলকাতা’ যদিও এখনও আধা ঘুমন্ত—কফির প্রথম কেটলি বসেছে, চেয়ারগুলো টেনে ঠিকঠাক করা হচ্ছে, আর অনিকেত কাউন্টারে দাঁড়িয়ে নতুন কেকের গন্ধ শুঁকছে।
ঠিক তখনই প্রবেশ করল একটি চকচকে গাড়ি। নামা মাত্রই বোঝা গেল, ওরা ‘ক্যাফে মানুষ’ নয়—ওরা ক্যাফে-বাণিজ্যের লোক।
টাইট শার্ট, স্লিক চুল, চোখে সানগ্লাস। তাদের একজন ক্যাফের ভেতর ঢুকে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
— “Nice place. Bit… old school, but has a certain… nostalgia.”
অনিকেত বলল, “আমাদের কফি-তে এখনও nostalgia থাকে।”
লোকটা হাসল, “Let’s see how long that survives.”
বেরিয়ে যেতে যেতে সে জানিয়ে গেল, “Urban Mug grand opening this Friday. Just two buildings away. Free Wi-Fi, co-working booths, influencer tie-ups, loyalty apps—basically, the works.”
অনিকেত কিছু বলল না। শুধু জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট প্ল্যাকার্ডটার দিকে তাকাল। যেখানে নিজের হাতে লিখেছিল—
“আমরা গল্প বিক্রি করি না। আমরা গল্প করি।”
একঘণ্টার মধ্যেই খবর ছড়িয়ে গেল। শ্রেয়া শুনে বলল, “ওরা চাইলে ক্যাফের নামটাও trademark করে ফেলবে। প্রমোশন আর পার্টনারশিপে ওদের মত শক্তিশালী ব্র্যান্ডের সঙ্গে টিকে থাকা মুশকিল হবে।”
রিমঝিম বলল, “Urban Mug মানে কাচের দেয়াল, ইংরেজি গন্ধ আর ইনস্টাগ্রামফিল্টার। কিন্তু এই ক্যাফে মানে আমাদের দুপুরবেলা, শব্দের গন্ধ আর গল্পের শরীর।”
অনিকেত মাথা ঝাঁকাল। “আমি ব্র্যান্ড করতে পারতাম। কিন্তু তাতে রিমঝিমের ডায়েরি হারিয়ে যেত। ল্যাটির টেবিলটা প্লাস্টিকে ঢাকা পড়ে যেত। গল্পগুলো শব্দ থেকে ছাঁকা হতো কনটেন্টে।”
সেই রাতে ‘ক্যাফে কলকাতা’তে একটা বিশেষ মিটিং হল। অনিকেত, রিমঝিম, শ্রেয়া আর কয়েকজন নিয়মিত মুখ—ছোটপর্দার লেখক সোম, গায়ক সম্বিত, আর রাধিকা নামে এক অদ্ভুত আর্টিস্ট যে নিয়ম করে কাফেতে বসে রং করে।
তারা ঠিক করল:
“আমরা পাল্টাব না। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করব।”
তিনটি পদক্ষেপ নেয়া হল:
১. “One Cup Story” নামে একটি নতুন ক্যাম্পেইন চালু হল—প্রতিদিন একটি কাপের গায়ে একজন রেগুলার অতিথির লেখা থাকবে।
২. ক্যাফের দেয়ালে তৈরি হল ‘Story Wall’—যেখানে কাস্টমাররা চাইলে লিখে যেতে পারে একটা ছোট্ট স্মৃতি।
৩. শ্রেয়া পুরো ক্যাফের গল্প নিয়ে বানাবে ১০ মিনিটের শর্ট ভিডিও—‘Old Brew, New Blood’।
তারপর শুরু হল যুদ্ধ। অন্য প্রান্তে ‘Urban Mug’-এর প্রচার ফেটে পড়ছে। লাইভ কনসার্ট, বিয়ন্ড মক্কা কফি, বিখ্যাত বারিস্তা, টিকটক স্টারদের আনাগোনা।
কিন্তু ক্যাফে কলকাতা হার মানল না। ল্যাটি নতুন এক গল্প লিখল, কফির কাপের গায়ে লেখা হল:
“নতুন আলোয় সব চমক লাগে, কিন্তু পুরোনো আলোয় চোখ সয়ে যায়।”
সেদিন একজন Urban Mug-এ বসা কলেজের ছেলে ভুল করে ঢুকে পড়ে ক্যাফে কলকাতা-তে। একটা ব্ল্যাক কফি খেয়ে বলল, “এই কফি-তে একটা শান্তি আছে, যেটা Urban Mug-এর স্ক্রিনেও নেই।”
অনিকেত শুধুই হেসে বলল, “এই ক্যাফে রিংটোন বাজায় না, হুঁশ ফেরায়।”
এভাবে ক্যাফে কলকাতা বুঝিয়ে দিল, প্রতিযোগিতা টিকে থাকে প্রযুক্তিতে, কিন্তু ভালোবাসা টিকে থাকে স্পর্শে।
চায়ের কাপের নাম তপু
সকাল দশটা। পার্কস্ট্রিটের হালকা ঝিরঝিরে রোদ ঠিক যেন জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছিল ‘ক্যাফে কলকাতা’-র কোণে রাখা কাঠের গোল টেবিলটায়। সেই টেবিলটায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এসে বসেন একজন মানুষ। বয়স সত্তরের কোঠায়, মাথার চুল একরাশ সাদা, চোখে পাতলা চশমা, আর পায়ে ছেঁড়া ক্যানভাস জুতো।
অনিকেত তাঁকে বলে “তপু কাকা”, আর ক্যাফেতে সকলেই জানে, “চায়ের কাপের নাম তপু।”
না, তপু কাকা কফি খান না। তাঁর বরাদ্দ শুধুই ‘দুধ চা, হালকা চিনি, বেশি আদা’। প্রতিদিন একই অর্ডার, একই চেয়ার, একই মুহূর্তে আগমন—এমনকি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট এক মাটির কাপ আছে, যেটায় অল্প ফাটল, আর গায়ে লেখা ‘T’.
রিমঝিম একদিন কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল,
— “তপু কাকু, আপনি রোজ আসেন কেন?”
তিনি হেসে বললেন, “আমি এখানে আসি চায়ের জন্য না, আসি অপেক্ষার জন্য।”
— “কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করছেন?”
— “না, একজনের জন্য। বহু বছর আগের একজন… যার নাম রেখেছিলাম ‘চায়ে ভেজা মেয়েটি’।”
রিমঝিম চুপ করে গেল। এই মানুষটা হঠাৎ করেই যেন ক্যাফের গায়ে গল্পের ছায়া ফেলে দিল।
তপু কাকার গল্পটা ধীরে ধীরে ফাঁস হল রিমঝিমের ডায়েরির পাতায়।
পঞ্চাশের দশকে কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন তপু, তখন সদ্য স্বাধীনতার উত্তেজনায় টগবগ করছে শহর। কলেজ স্ট্রিটে পড়তেন, কিন্তু পার্কস্ট্রিটে বসতেন—‘ব্রাউন অ্যান্ড পোলসকি’ বলে এক পুরোনো কফিশপে।
সেইখানেই প্রথম দেখা হয় এক মেয়ের সঙ্গে। চুলে খোঁপা, চোখে কাজল, গলায় নীল শিফনের ওড়না। নাম ছিল নয়নতারা।
তারা দুজনেই সাহিত্য পড়তেন। কিন্তু নয়নতারা সবসময় চা খেত। আর প্রতিবারই সে কাপ ফেলে দিত শেষ চুমুকের পর, বলত—
“চায়ের কাপ ভেঙে দিলে ভেতরের প্রেমটা গোপন থাকে।”
তপু তখন চুপ করে তাকিয়ে থাকতেন। প্রেম হয়তো হয়েছিল, কিন্তু বলা হয়নি। কেন হয়নি, তার জবাব ছিল না। শুধু একদিন নয়নতারা চলে গিয়েছিল—দেশের বাইরে, বিয়ে করে। তার আগে চুপিচুপি একটি চায়ের কাপ উপহার দিয়েছিল তপুকে—গায়ে লেখা ছিল ‘T’, আর নিচে হাতে লেখা একটি লাইন:
“তুমি যদি কখনো কোনো ক্যাফে খোল, আমি একদিন ফিরে আসব এই কাপে চা খেতে।”
সেই কাপটা তপু রেখে দিয়েছিলেন। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। ব্রাউন অ্যান্ড পোলসকি বন্ধ হয়ে গেছে। নয়নতারা আর কখনও ফেরেনি।
কিন্তু তপু কাকা এখনও আসেন। কারণ এই ‘ক্যাফে কলকাতা’ একমাত্র জায়গা, যেখানে সেই কাপটাকে ঠিক করে রাখা যায়।
অনিকেত একদিন বলেছিল, “কাকু, কাপে ফাটল ধরেছে, অন্যটা দিন?”
তপু কাকা বলেছিলেন, “ভাঙা কাপেই পুরোনো প্রেম ভালোভাবে থাকে। নতুন কাপে তো সবকিছু মুছে যায়।”
সেইদিন থেকে অনিকেত আর কাপ পাল্টায়নি। বরং দেওয়ালের Story Wall-এ টানিয়ে দিয়েছে কাপটার ছবি, নিচে একটা লাইন—
“তপু কাকার প্রেম, ফাটলে ফাটলে অক্ষত।”
শ্রেয়া ক্যামেরায় তপু কাকার কাহিনি তুলে রাখল। আর রিমঝিম লিখল তার ডায়েরিতে:
“ক্যাফেতে আসা মানে শুধু কফি খাওয়া নয়। কিছু মানুষ আসেন চুপিচুপি তাঁদের গোপন ভালোবাসা নিয়ে বসে থাকতে। চায়ের কাপের মতোই, সময় যত এগোয়, ততই প্রেম ফুটে ওঠে।”
সেইদিন ক্যাফে কলকাতায় চায়ের গন্ধটা একটু বেশি ছিল।
একদিন হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া গান
সন্ধে সাতটা। পার্কস্ট্রিটের আলো তখন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে নিঃশব্দ উজ্জ্বলতায়। বাইরে হর্ন, কাচে আলো, ভেতরে ক্যাফে কলকাতার সেই চিরচেনা শান্তি—যেখানে কথাবার্তার শব্দ একেবারে পাতলা, আর কফির বাষ্পে মোড়া থাকে চুপ করে বসে থাকা কিছু মুখ।
ঠিক তখনই হঠাৎ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল একজন। পরনে হাফচেক শার্ট, পিঠে গিটার, আর চোখে এমন একটা অভিব্যক্তি যেন সে কোনও জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে বহু দিন ধরে। বয়সটা পঁচিশ পেরোয়নি, কিন্তু চোখে একটা পুরনো ক্লান্তি ছিল।
— “ভিতরে বসতে পারি?”
অনিকেত বলল, “নিশ্চয়। এখানে গল্প বলে আসন খালি রাখা হয়।”
ছেলেটি জানালার পাশে গিয়ে বসল। কফির অর্ডার দিল না। শুধু চুপ করে বসে থাকল। তার গিটারটা রেখে দিল চেয়ারের পাশে, হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে নিল, যেন সেটা কোনও প্রিয় মানুষের কাঁধ।
রিমঝিম দূর থেকে দেখছিল। আর পাঁচটা কাস্টমারের চেয়ে ছেলেটা আলাদা—কোনও ভণিতা নেই, কোনও লোক দেখানো ভদ্রতা নয়। যেন তার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়েছে একটা পুরনো গান।
একটু পরে ছেলেটি নিজে থেকেই কাউন্টারে এল।
— “আমি কি একটা গান বাজাতে পারি এখানে?”
অনিকেত একটু চমকে গেল।
— “তুমি আগে এসেছ এখানে?”
— “না। কিন্তু মনে হল এই জায়গাটা গান চায়। শুধু শোনার নয়, থাকতেও দেয়।”
কিছুক্ষণের নীরবতার পর, অনিকেত মৃদু মাথা নেড়ে বলল, “বাজাও।”
সব আলো তখন একটু কমিয়ে দেওয়া হল। কাস্টমাররা চুপ করে রইল। কফির কাপে তখন শব্দ নেই—শুধু অপেক্ষা।
ছেলেটি গিটারটা কোলে তুলে নিল। আঙুল চালিয়ে দিল কর্ডে। তারপর গলা খুলল।
সেই গানটা নতুন ছিল না, কিন্তু যেভাবে সে গাইল, তাতে মনে হল শব্দগুলো নতুন জন্ম নিল।
তিন মিনিট। নিঃশব্দ ভালোবাসার মতো একটা গান ছড়িয়ে পড়ল গোটা ক্যাফেতে।
শেষ হলে কেউ হাততালি দিল না। শুধু নিঃশব্দে একজন বলল, “ভালো লাগল।”
রিমঝিম বলল, “তোমার নাম কী?”
ছেলেটি বলল, “তোমরা আমাকে ডাকতে পারো সম্বিত বলে। আমি গান কুড়িয়ে বেড়াই। গানের ভিতরে হারিয়ে যাওয়া কথা খুঁজি। কখনও কফির কাপে, কখনও শহরের কোলাজে।”
রিমঝিম হাসল, “তোমার মতো গান কুড়িয়ে বেড়ানো লোকেদের তো গল্পে জায়গা দেওয়া উচিত।”
সম্বিত বলল, “তাই তো আমি এলাম। এই জায়গাটা গল্পের গন্ধ দেয়। এখানে বসে গলা খোলে, মনও।”
তারপর থেকে সম্বিত মাঝে মাঝেই এসে বসতে লাগল ক্যাফেতে। কখনও গিটার নিয়ে, কখনও খালি গলা। সে গান গাইত, কিন্তু তার গান ছিল এমন—not polished, not trained—just true।
একদিন ক্যাফের দেওয়ালে একটা নতুন নোটিস ঝুলল—
“Saturday Unplugged: ক্যাফে কলকাতায় কুড়িয়ে পাওয়া গান, সম্বিতের গলায়।”
লোকজন এসে বসতে লাগল। শ্রেয়া ক্যামেরায় বন্দি করতে লাগল মুহূর্তগুলো।
রিমঝিম তার ডায়েরিতে লিখল—
“সম্বিতের গানে প্রেম ছিল না, ছিল একরাশ ফেলে আসা বিকেল। আমরা শুনলাম, যেন আবার একবার প্রথম প্রেমে পড়া হল।”
সেই সন্ধ্যাটা ক্যাফের ইতিহাসে অন্যরকম ছিল।
আলো নরম, শব্দ মৃদু, গান সত্যি।
টেবিল নাম্বার সাত
‘ক্যাফে কলকাতা’-র ভেতরে ঢুকলেই বাম পাশে যে টেবিলটা পড়ে, সেটা হচ্ছে টেবিল নাম্বার সাত। চমৎকার এক কোণে রাখা, দুজনের বসার মত জায়গা, পাশেই জানালা, যেখানে সন্ধের আলো ছায়ার সঙ্গে খেলতে পারে।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কেউ কখনও সেখানে বসে না।
রেগুলার কাস্টমাররাও না।
অনিকেত কখনও চুপ করে কিছু বলেনি, শুধু মাঝেমাঝে পরিষ্কার করার সময় বলেন, “ওটা থাক, আমি নিজে করব।”
রিমঝিমের কৌতূহল ছিল বহুদিনের। একদিন সকালে সে সাহস করে টেবিলটায় গিয়ে বসল।
ঠিক তখনই অনিকেত এসে দাঁড়াল সামনে।
— “তুমি ওখানে বসেছ?”
— “কেন? কিছু সমস্যা আছে?”
অনিকেত একবার চুপ করে রইল। তারপর বলল, “বসো। তাহলে আজ আমি তোমাকে একটা গল্প বলি।”
টেবিল নাম্বার সাতের গল্প।
সেই ২০১০ সালের ঘটনা। ক্যাফেটা তখন পুরনো রং মেখে দাঁড়িয়ে, কিন্তু নতুনভাবে তৈরি হওয়ার স্বপ্নে ডানা বাঁধছে। ঠিক তখনই একদিন এসেছিল এক জুটি—অনন্যা আর সৌরভ।
ওরা রোজ সন্ধেবেলা আসত। অনন্যা ফোটোগ্রাফার, সৌরভ ছিল কবিতা লেখে এমন একজন, যে নিজের বই প্রকাশ করতে চায়, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না।
তাদের জন্য ছিল টেবিল নাম্বার সাত।
প্রতিদিন ঠিক ছ’টা বাজলে ওরা আসত। দু’কাপ কফি, একটা চকলেট প্যাস্ট্রি, আর একটানা কথা। অনিকেত নিজেই সার্ভ করত—কারণ তাদের মধ্যে ছিল এমন কিছু, যা গল্পকেও লজ্জা দেয়।
অনন্যা ক্যামেরা নিয়ে খেলত, সৌরভ তার ডায়েরিতে লিখত।
অনিকেত মাঝে মাঝে বলত, “তোমাদের ভালোবাসা দেখলে মনে হয় কফির কাপেও প্রেম গলে পড়ে।”
তবে একটা শর্ত ছিল।
— “যদি কোনোদিনও আমরা না আসি, তাও টেবিল সাত-এ একটা কাপ পড়ে থাকবে। যাতে যদি কেউ ফিরে আসে, জানে—আমরা একসময় এখানে ছিলাম।”
একদিন হঠাৎ অনন্যা এল একা। চোখ লাল, গলা শুকনো।
— “সৌরভ আর নেই। অ্যাক্সিডেন্ট। কোনও কথাই বলা হয়নি শেষবার।”
অনিকেত কিছু বলার সাহস পেল না। অনন্যা বসে রইল একটানা এক ঘণ্টা।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাপটা রেখে বলল, “এই কাপটা থেকে যাবে। যতদিন এই ক্যাফে থাকবে।”
সেই কাপ আজও টেবিল নাম্বার সাত-এ পড়ে থাকে। না ধুয়ে, না সরিয়ে।
এমনকি অনিকেত বলেছে, কেউ যদি ভুলেও সেখানে বসে, তিনি শুধু চুপ করে থাকেন।
রিমঝিম শুনে কাঁপছিল।
— “তবে আপনি আমায় বসতে দিলেন কেন?”
অনিকেত বলল, “কারণ আজ অনেক বছর পর কেউ সেই কাপে তাকিয়ে দেখল। আর সৌরভ-অনন্যার গল্প আবার জীবিত হলো।”
রিমঝিম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কাপটা ছুঁয়ে দিল—স্নেহে, শ্রদ্ধায়।
তার ডায়েরিতে লিখল—
“প্রেম ফুরিয়ে গেলেও তার ছায়া থেকে যায়। ঠিক যেমন টেবিল নাম্বার সাত—যেখানে বসে শুধু ভালোবাসা।”
সেই রাতে ক্যাফের আলো একটু বেশি নরম ছিল।
আর টেবিল সাত, নিজের চুপচাপ দুঃখের মতো, আবার একবার গল্প হয়ে উঠল।
ফিরে আসা ফারহান
শনিবার দুপুর। রোদটা ছিল ঝলমলে, কিন্তু ক্যাফে কলকাতা-র ভেতরে যেন আলো একটু কম। অনিকেত তখন নতুন চালু হওয়া স্যান্ডউইচ মেনু নিয়ে ব্যস্ত। শ্রেয়া ভিডিও এডিট করছে, রিমঝিম জানালার পাশে বসে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ডায়েরিতে গুছিয়ে রাখছিল।
ঠিক তখনই, দরজায় ঘণ্টা বাজল। এক ভদ্রলোক ঢুকলেন—শার্প স্যুট, চকচকে জুতো, হাতে স্মার্টফোন, আর মুখে সেই চেনা অভিমানী হাসি।
— “অনিকেত?”
অনিকেত মাথা তুলল। চোখ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর নিঃশব্দে বলল,
— “ফারহান?”
হ্যাঁ, সেই ফারহান। কলেজে অনিকেতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তারা একসঙ্গে ক্যাফে শুরু করার স্বপ্ন দেখত, লাল ইটের দেয়াল, কাঠের চেয়ার, আর এক কাঁদি কবিতা নিয়ে একান্ত কফি-বাড়ি বানাবে বলে।
কিন্তু স্বপ্ন একসাথে দেখলে কী হবে, হাঁটা তো অনেক সময় আলাদা হয়ে যায়।
ফারহান বেছে নিয়েছিল “ব্যবসা”, আর অনিকেত বেছে নিয়েছিল “গল্প”।
তাদের ঝগড়া হয়েছিল সেই এক প্রশ্নে—“তুই ক্যাফেটাকে ব্যবসা বানাবি না স্মৃতি?”
অনিকেত বলেছিল, “স্মৃতি থেকে শুরু করেই তো ব্যবসার জন্ম হয়।”
ফারহান বলেছিল, “আর স্মৃতি থাকলে ব্যবসা মরেও যেতে পারে।”
তাদের শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৫ সালে, আর তারপর নয়টা বছর কেটে গেছে।
ফারহান এবার টেবিলে বসে বলল,
— “তুই এই জায়গাটাকে এতদিন ধরে টিকিয়ে রেখেছিস, আমি অবাক হয়েছি।”
অনিকেত বলল, “আমি এটা টিকিয়ে রাখিনি। যারা এখানে আসে, তারাই রেখেছে।”
ফারহান হেসে বলল, “বেশ। তাহলে এবার ওদের আরও কিছু দে। আমি এখানে এসেছি একটা প্রস্তাব নিয়ে।”
সবার চোখ তার দিকে গেল।
— “আমি এখন Urban Mug-এর পার্টনার। আমাদের নতুন পরিকল্পনায় কিছু ‘heritage café’ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আমরা চাই, ‘Café Kolkata’ আমাদের নেটওয়ার্কে আসুক।”
রিমঝিম হতবাক। শ্রেয়া থেমে গেল এডিটিংয়ে।
অনিকেত নিঃশব্দে বলল,
— “মানে, ক্যাফেটার নাম থাকবে, কিন্তু সবকিছু বদলে যাবে, তাই তো?”
— “তোর মেনু, décor, এমনকি কফির blend পর্যন্ত আপডেট করা হবে। কিন্তু গল্পগুলো থাকবে—আমরা এগুলোকেই ‘brand content’ হিসেবে তুলে ধরবো।”
অনিকেত চুপ করে ছিল।
— “তুই কি জানিস, এই গল্পগুলোকে আমি respect করি বলেই প্রস্তাবটা দিলাম?”
রিমঝিম এবার বলল,
— “কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারো এই জায়গাটা কনটেন্ট নয়, একটা সম্পর্ক? একে প্যাকেজ করলে, গন্ধটা মুছে যাবে।”
ফারহান একটু থেমে বলল,
— “তবুও ভাবিস। আমি জানি এখানে কত কষ্টে তুই রোজ লড়ছিস। আমাদের সাপোর্ট থাকলে তোকে অন্তত ভয় পেতে হবে না।”
অনিকেত উঠে দাঁড়াল। বলল,
— “ভয় আমি পাই না ফারহান। আমি ভয় পাই সেইদিনের, যেদিন আমি জানালার পাশে বসা রিমঝিম, গিটার কাঁধে আসা সম্বিত, অথবা একা কাপে বসে থাকা তপু কাকাকে চিনতে পারবো না।”
ফারহান এবার একটু চুপ করল। তার কণ্ঠে কাঁপন—
— “তুই আজও তেমনই আছিস। হয়তো আমিই বদলে গেছি।”
অনিকেত শান্তভাবে বলল,
— “তুই থাকিস, গল্পের বাইরে। এই জায়গাটা গল্পের ভেতরেই ভালো আছে।”
ফারহান উঠে গেল। পেছনে রেখে গেল তার পেশাদার হাঁটা, আর এক অসমাপ্ত হিসেবের পালা।
ক্যাফে কলকাতার দেয়ালে সেদিন রাতে একটা নতুন লাইন লেখা হল—
“সব প্রস্তাব লাভ নয়, কিছু প্রত্যাখ্যানও গল্প হয়ে ওঠে।”
চুরি যাওয়া ডায়েরি
সকাল সাড়ে দশটা। ‘ক্যাফে কলকাতা’-র দরজায় রিমঝিম এসে দাঁড়াল, প্রতিদিনের মতোই। হাতে ব্যাগ, কাঁধে চাপা ঘুম, চোখে সেই নরম অথচ পরিচিত উচ্ছ্বাস। কিন্তু আজকে কেমন একটা অস্বস্তি ছিল তার মুখে।
ঢুকেই সে ডানদিকের কোণে গেল, সেই চেনা টেবিলটায়। ব্যাগ খুলল, কফির অর্ডার দিল না—কারণ আগে একটা কাজ থাকে রোজ সকালে: নিজের ডায়েরিটা বের করে লেখা শুরু করা।
কিন্তু ব্যাগে হাত দিয়েই সে থমকে গেল।
ডায়েরি নেই।
প্রথমে ভেবেছিল ভুল জায়গায় রেখেছে। পুরো ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজল। ক্যাফের কাউন্টারে গিয়ে অনিকেতকে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কি কাল ডায়েরিটা কোথাও সরিয়েছিলে?”
অনিকেত বলল, “না তো। তুমি যেমন রেখে গিয়েছিলে, তেমনই ছিল।”
রিমঝিম কাঁপা গলায় বলল, “ডায়েরিটা নেই।”
শ্রেয়া ক্যামেরা বন্ধ করে তৎক্ষণাৎ বলল,
— “তুমি ঠিক করে ভাবো, কোথায় রাখতে পারো?”
— “এই টেবিলে। আমি প্রতিদিন শেষ পাতা লিখে রেখে যাই, তারপর ব্যাগে রাখি। কাল একটু হড়বড় করে বেরিয়েছিলাম, মনে আছে…”
অনিকেত তখনই CCTV ফুটেজ খুলল। সবাই গভীর মনোযোগে দেখল—গতকাল সন্ধ্যে ছ’টা তেইশ মিনিটে রিমঝিম বেরিয়ে গেল। তার পরপরই একজন আগন্তুক এল, মুখে মাস্ক, গায়ে ফেডেড ডেনিম জ্যাকেট। সে কিছু না কিনে সরাসরি কোণার টেবিলে গেল, কিছু একটা নিচু হয়ে কুড়োল, আর ব্যাগে ঢুকিয়ে চলে গেল।
ক্যাফে নিস্তব্ধ।
রিমঝিম মুখে হাত দিল—“ওটা শুধু একটা ডায়েরি না অনিকেত, ওটা আমার ভিতরটা। ক্যাফের গল্প, মানুষের কথা, এমনকি কিছু অপূর্ণ স্বীকারোক্তি—সব লেখা আছে সেখানে।”
সম্বিত বলল, “এটা শুধু চুরি না, এটা কারও আত্মাকে কেড়ে নেওয়ার মতো।”
সেই দিন থেকেই শুরু হল সন্ধান। শ্রেয়া পোস্ট দিল সোশ্যাল মিডিয়ায়—
“Help us find a missing story. It’s not just a diary, it’s our café’s soul.”
লোকজন শেয়ার করল, খোঁজ শুরু হল। এমনকি একসময় অনিকেত পুলিশের কাছেও গেল, যদিও তারা বলল—
— “A notebook? Are you serious?”
রিমঝিম রাতে ঘুমাতে পারছিল না। তার ভেতরে এক অজানা ভয়—যদি কেউ ডায়েরির লেখা বিকৃত করে? যদি গল্পগুলোকে ‘viral content’ বানিয়ে দেয়?
তখন একদিন সকালে দরজায় এল একটি চিঠি। খাম ছাড়া, নামহীন, শুধু কফির গন্ধে ভেজা। খোলার পর দেখা গেল একটা নোট:
“আমি দুঃখিত। আমি জানতাম না এটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমার লেখা পড়ে বদলে গেছি। আমি এটা ফিরিয়ে দিতে চাই। আমি ভয় পেয়েছিলাম, তাই সরাসরি দিতে পারিনি। আজ রাত আটটায় আমি টেবিল নাম্বার সাত-এ রেখে যাব।”
রিমঝিম শিউরে উঠল। টেবিল নাম্বার সাত!
সবাই চুপ করে ছিল। সেই জায়গাটা তো একরকম পবিত্র, এক নিঃশব্দ প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন।
তবুও ঠিক রাত আটটায়, সবাই বসে রইল ভেতরে। আলো কিছুটা কম, গলা নিচু, কেউ টেবিল নাম্বার সাত-এর দিকে তাকিয়ে ছিল না, শুধু অপেক্ষা করছিল।
ঠিক আটটা পাঁচে, একটা মুখ ঢাকা ছেলেমানুষ টেবিল সাত-এ গিয়ে বসে, ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে রাখল, আর এক পলক চেয়ে বেরিয়ে গেল।
তাকে কেউ থামাল না।
ডায়েরিটা ছিল আসলটাই। ভিতরে রিমঝিমের হাতের লেখা, তার কবিতা, ক্যাফের গল্প, এমনকি একটা খোলা পাতা—সেই পাতায় লেখা ছিল অচেনা চোরটির হাতে লেখা একটি ছোট্ট মন্তব্য:
“তোমার লেখা আমার ভিতরের শব্দ ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি শুধু কিছুটা ধার নিয়েছিলাম। এখন ফেরত দিলাম, কারণ এটা তোমার, তোমাদের।”
রিমঝিম ডায়েরি বুকে চেপে ধরল। চোখে জল।
সেই রাতের ক্যাফেতে চুপ করে একটা গানের সুর ভেসে উঠল—সম্বিত গাইছিল।
আর রিমঝিম তার ডায়েরির নতুন পাতায় লিখল—
“চোর সবসময় চুরি করতে আসে না। কিছু চোর এসে তোমার নিজের কথাগুলো আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়।”
বারান্দার গল্প, ফিল্টার ছাড়া
সকাল এগারোটা। ক্যাফে কলকাতা-র বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে ঝিরঝিরে সোনার মতো। সেখানে সাধারণত কেউ বসে না—একটু সরু, একটু পুরোনো, কিন্তু সেইখানেই আজ বসে আছে এক ব্যতিক্রমী অতিথি।
নাম—ঋণা সান্যাল।
ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ার পাঁচ লক্ষ। ইউটিউবে vlog সিরিজ—“Life in Layers”।
স্মার্ট, স্বাবলম্বী, লাইভ লাইফ ইন স্টাইল টাইপ মেয়ে। তার সাদা জামা, কানে বল ইয়াররিং, আর হাতে কফির কাপ—পুরোটাই এক নিখুঁত ব্র্যান্ড ইমেজ।
ক্যাফের সবার দৃষ্টি তখন বারান্দার দিকে। শ্রেয়া চাপা গলায় বলল,
— “এই মেয়ে একদিনে যা রিচ এনে দেবে, ক্যাফের অ্যাকাউন্টে তা ছ’মাসে আসে না।”
অনিকেত একটু চিন্তিতভাবে বলল,
— “ওর ইনবক্স থেকে মেসেজ এসেছিল। সে একটা ‘heritage café docu’ বানাতে চায়, যা রিয়েল, র’ আর রুটেড।”
রিমঝিম বলল, “কিন্তু ক্যামেরার বাইরে তো ও নিজেই কতটা র’ বা রিয়েল, কে জানে।”
ঋণা বারান্দায় বসে প্রথমে একটা কফির কাপ তুলল, তারপর ফোন বের করে স্টোরি দিল—
“Old café. Raw Kolkata vibe. Stay tuned.”
কিছুক্ষণের মধ্যে অনিকেত তার কাছে গেল।
— “আপনি কী জানতে চান?”
ঋণা একগাল হেসে বলল, “আপনাদের গল্প। যেমন এই কাঠের চেয়ারটা কীভাবে এসেছে, এই দেয়ালের রং কবে পাল্টেছে, এই কফির রেসিপি কে বানিয়েছেন—সেইসব। ফিল্টার ছাড়া।”
অনিকেত একরকম ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— “তাহলে আপনার ক্যামেরাটাও ফিল্টার ছাড়া রাখবেন তো?”
ঋণা এক মুহূর্ত থমকে গেল।
রিমঝিম পাশ থেকে দেখছিল। কিছু একটা তাকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলছিল—ঋণার প্রতিটা হাসি যেন rehearsed, প্রতিটা কথা যেন স্ক্রিপ্টেড।
তবে ক্যাফের গল্পের কাছে সবার মুখোশ একটু একটু করে গলে।
ঋণা যখন তপু কাকার গল্প শুনল, তখন তার মুখের মেকআপের আড়ালেও একরকম কাঁচ ঘাম দেখা গেল।
যখন সে সম্বিতের গান শুনল, তখন হাতে ধরা ফোনটা একবার নামিয়ে নিল।
রিমঝিম ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে বসল। বলল,
— “তুমি যে ক্যামেরার সামনে থাকো, তার বাইরে তোমার গল্প কী?”
ঋণা প্রথমে চুপ করে রইল।
তারপর বলল,
— “আমি ছোটবেলায় এই ক্যাফের পাশেই থাকতাম। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে এখানেই আসতাম। বাবার হাতে কফি, আমার হাতে হরলিক্স। এখন সেই সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। আমি চেয়েছিলাম একটা ভিডিও বানিয়ে সেইসব ফেরাতে।”
রিমঝিম ধীরে হেসে বলল,
— “তাহলে তো এটাই তোমার গল্প—ফিল্টার ছাড়াই। একটা মেয়ে, যে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়েও কিছু অনুভব ভুলে যেতে চায় না।”
ঋণা বলল,
— “আমার ফোনে অনেক ফিল্টার আছে, কিন্তু এই কাফের মতো স্পষ্ট জায়গা আমি পাই না।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ঋণা একটি ভিডিও পোস্ট করল।
কোনো মিউজিক নয়, কোনো রঙচঙে এডিট নয়। শুধু একটি ক্যাপশন—
“Real life doesn’t always look aesthetic. Sometimes, it smells like ginger tea and old wood. And that’s enough.”
পরদিন ক্যাফের গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন নতুন মুখ—যারা ফোনে সেই ভিডিও দেখে এসেছে।
তারা শুধু বলেছিল,
— “এই জায়গাটা দেখতে এসেছি। গল্পটা ছুঁতে চাই।”
রিমঝিম ডায়েরিতে লিখল—
“ছবি যতই পরিষ্কার হোক, বাস্তব কখনও পুরোটা ধরা পড়ে না। ক্যাফে কলকাতা সেই জায়গা, যেখানে ফ্রেমের বাইরের গল্পটা ফ্রেমকেও জিতে নেয়।”
শেষ কাপ, প্রথম চুমুক
শীতের সকাল। পার্কস্ট্রিটে কুয়াশা জমেছে পাতলা সাদা চাদরের মতো। আর ক্যাফে কলকাতা? এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়া।
অনিকেত কাউন্টারে বসে আছে, সামনে রাখা চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রিমঝিম জানালার ধারে, ডায়েরির খোলা পাতা আজও ফাঁকা। সম্বিত গান গাইছে না, শ্রেয়া ক্যামেরা তুলছে না।
শ্রেয়া একখানা মোটা ফাইল সামনে রেখে বলল,
— “এই জমিটা সরকারি প্রকল্পে পড়েছে। পুরোনো লিজ নথি অনুযায়ী এটা এখন ‘redevelopment’ এলাকায় চলে যাবে। ছ’মাসের মধ্যে ক্যাফে সরিয়ে নিতে হবে।”
অনিকেত বলল না কিছু। শুধু ঘাড় নিচু করল।
ক্যাফের চারপাশে তখন প্রতিটি চেয়ার, প্রতিটি টেবিল যেন মুখ ফিরিয়ে ছিল। যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চারদিকে ঘুরে ঘুরে ফিরছিল।
রিমঝিম বলল,
— “আমরা কি কিছু করতে পারি না?”
শ্রেয়া বলল,
— “লিগাল ভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। তবে চাইলে শেষ ছ’টা মাসে আমরা ক্যাফের স্মৃতি যতটা পারি ধরে রাখতে পারি।”
ঠিক তখনই দরজায় ঘণ্টা বাজল। একজন বৃদ্ধা ঢুকলেন ধীরে ধীরে। মাথায় সাদা শাল, গায়ে শীতের কোট, চোখে ছানি পড়া চশমা। কেউ চেনে না তাঁকে।
তিনি একেবারে টেবিল নাম্বার সাতের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সবার নিঃশব্দ দৃষ্টি তাঁর দিকে।
তিনি বসে বললেন,
— “আমি কি এখনও একটা চা পেতে পারি? একটু আদা বেশি দিয়ে।”
অনিকেত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— “আপনি কি…?”
বৃদ্ধা একটু হাসলেন।
— “আমার নাম অনন্যা। আমি একসময় এখানে একজনের সঙ্গে বসতাম। তার নাম ছিল সৌরভ। আমার অনেকদিন হয়ে গেল ফিরিনি। কিন্তু আজ আমার মন বলল, ফিরে আসা উচিত।”
টেবিল সাত নিঃশব্দে কথা বলতে শুরু করল।
তপু কাকা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
— “আজকের চা আমি বানাব।”
সেই চা এল। কাপটা সেই পুরোনো ‘T’ কাপ। অনন্যা ধীরে চুমুক দিলেন।
রিমঝিম ডায়েরিতে লিখল—
“শেষ কফি সবসময় শেষ হয় না। কেউ না কেউ এসে প্রথম চুমুক নেয়। আবার শুরু হয় গল্প।”
সেই দিন থেকে শুরু হল ক্যাফে কলকাতার ‘Farewell Series’।
প্রতিদিন একটা করে পুরোনো কাস্টমার আসত, আর নিজের গল্প রেখে যেত। ক্যাফের দেয়াল ভরে উঠল লেখায়, ছবিতে, কফির দাগে।
সম্বিত নতুন গান লিখল—
“শেষ কাপের শুরু”।
রিমঝিম সেই গানের লাইন টুকে রাখল তার ডায়েরির শেষ পাতায়—
“যদি ক্যাফে না থাকে, গল্প কি থাকে না?
কফির কাপে ঠোঁটের ছাপ, স্মৃতির চেয়ে পুরোনো?”
ক্যাফে কোথাও চলে যায় না
শেষ দিন।
‘ক্যাফে কলকাতা’ তার দরজার কাচে প্রথমবার একটা পোস্টার ঝুলিয়ে দিল—
“আজ শেষ দিন। কিন্তু গল্প শেষ হয় না।”
সকাল থেকে ক্যাফের সামনে মানুষের লাইন। কেউ একবার ঢুকে নিজের পুরোনো টেবিলটা ছুঁয়ে যাচ্ছে, কেউ দেয়ালে রাখা ‘Story Wall’-এ নিজের শেষ বাক্য লিখে যাচ্ছে, কেউ কাফের মাটির কাপ কিনে রাখছে, যেন গন্ধটা ভুলে না যায়।
অনিকেত কাউন্টারে বসে। চোখে লাল ভাব, কিন্তু মুখে মৃদু হাসি।
রিমঝিম জানালার পাশে। শেষ পাতায় লিখেছে তার জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল পংক্তিগুলো—
“এই কাফের মতো সম্পর্ক চুপ করে বাঁচে, চুপ করে মরে না।”
সম্বিত আজ কোনও গান গায় না। গিটারটা পাশে রেখে বসে থাকে, যেন শব্দ ছাড়াই সবচেয়ে গভীর সুর বাজে।
তপু কাকা এসে বলেন,
— “আজ আমি আর চা খেতে আসিনি। আমি এসেছি কাপটা ফিরিয়ে দিতে।”
তিনি টেবিল নাম্বার সাতের সেই কাপটা তুলে দেন অনিকেতের হাতে।
— “এটা এবার তোমার গল্পে রাখো।”
আর তখনই ক্যাফেতে ঢোকে কয়েকজন ছোটো স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। তারা এসেছে এক তরুণ শিক্ষকের সঙ্গে—তাদের ছবি আঁকা শিখতে হয় সপ্তাহে একদিন।
শিক্ষক বলল,
— “এখানেই তাদের শহর চিনতে শেখাতাম। আজ ওদের বলেছি, শেষবারের মতো একটা দৃশ্য আঁকতে। ‘তোমাদের চোখে কাফে কলকাতা’। ”
ছেলেমেয়েরা জানালার ধারে বসে চুপ করে ছবি আঁকে। কেউ চায়ের কাপ এঁকে দেয়, কেউ টেবিল নাম্বার সাত, কেউ অনিকেতের মুখ, কেউ রিমঝিমের ডায়েরি।
শেষে, শ্রেয়া এসে একটা পেনড্রাইভ অনিকেতকে দিয়ে বলল,
— “এতে সব আছে। ভিডিও, ছবি, স্মৃতি। যদি কখনও আবার এক কাপ গল্পের জায়গা বানাতে চাস, এটা খুলে নিস।”
দরজা বন্ধ হয় বিকেল পাঁচটায়।
অনিকেত শেষবারের মতো ক্যাফের ভিতর ঘোরে। প্রতিটি চেয়ার, প্রতিটি টেবিল, দেয়ালের প্রতিটি দাগ—সব যেন বলে ওঠে,
“আমরা আছি। আমরা থাকবো।”
রিমঝিম হেঁটে চলে যায় একবারে পেছনের বারান্দায়। সেখানে সে শেষবার লিখে ফেলে ডায়েরির শেষ বাক্য—
“ক্যাফে কোথাও চলে যায় না।
সে থেকে যায়… ভালোবাসার মতো।
কফির কাপে, শব্দের ছায়ায়,
ঠিক যেমন তুমি, আমি, আমরা।”
শেষে…
মাস কয়েক পর, একটা নতুন ছোট্ট জায়গা খুলল শহরের এক প্রান্তে—
“Golpo Kotha – A Cupful of Stories”
টেবিল তিনটে, মাটির কাপ, আর একটা ছোট বইয়ের তাক।
ভিতরে রিমঝিম, অনিকেত, সম্বিত, শ্রেয়া—সবাই পালা করে সামলায়।
টেবিল নাম্বার সাত নেই,
কিন্তু দেয়ালে ঝুলছে একটা কাপ।
গায়ে লেখা—
“Café Kolkata lives here.”
সমাপ্ত