পূরবী মজুমদার
এক
কলকাতার বুকে গড়ে ওঠা এক চিরাচরিত বহুতল আবাসন। বাইরে ব্যস্ত রাজপথ, চিরচেনা হর্নের শব্দ, বাতাসে ভেসে আসা বেগুনি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর ভেজা মাটির গন্ধ। এই কোলাহল আর নিস্তব্ধতার মিশেলে একটি ঘরে বসবাস কুমুদিনীর—এক গৃহবধূ, এক মা, এক পুত্রবধূ। তার নিজের নামটা যেন আজ আর কারও মুখে উচ্চারিত হয় না। সবাই তাকে ডাকে “মা”, “বৌমা”, “মেসোমশাইয়ের বৌ”, কিংবা “ছোট বৌ” বলে। এই নামগুলির আড়ালে কোথাও হারিয়ে গেছে কুমুদিনী নামের সেই মেয়েটি, যে একদিন স্বপ্ন দেখত রঙ আর তুলির খেলায় নিজের জীবনের গল্প লেখার।
সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢোকে। বারান্দার গাছগুলোয় কয়েকটা শালিকের ডাক। কুমুদিনীর দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই। প্রথমেই শ্বশুরমশাইয়ের জন্য চায়ের কাপ, সঙ্গে মুড়ি আর চানাচুর। তার পরে স্বামীর অফিসের কাপড় আয়রন করে রাখা, দুই ছেলের স্কুলের টিফিন তৈরি, শাশুড়ির ওষুধ খাইয়ে দেওয়া—সব কাজ যেন রুটিনের ঘূর্ণাবর্তে বন্দি।
আজকের সকালটা অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন নয়। শাশুড়ি হালকা সর্দি নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, আর শ্বশুরমশাই চায়ের কাপ হাতে আনন্দবাজার পত্রিকা’র পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। স্বামী রঞ্জন ব্যস্ত হাতে অফিসের ফাইল গোছাচ্ছে। বড় ছেলে সায়ন কলেজে যাবার জন্য ব্যাগ গুছাচ্ছে, ছোট ছেলে ঋদ্ধি স্কুলের ইউনিফর্ম পরে জুতো খুঁজছে। এই পুরো ছবিটার মধ্যে কুমুদিনী ছায়ার মতো মিশে আছে। সে কখনও কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু তার হাত ছাড়া এ ঘরের কিছুই চলে না।
প্রতিদিনের মতো রান্নাঘরে ঢুকেই কুমুদিনীর মনে পড়ে যায় একসময় সে কীভাবে স্বপ্ন দেখত। বাবার বাড়িতে বসে একপলক ছবি আঁকত, পদ্মফুল, গ্রামের মেঠোপথ, ঢেউ খেলা নদী, কিংবা জানালার পাশে বসে মায়ের মুখ। তার মায়ের মুখটাও মনে পড়ে, সেই মুখে অদ্ভুত মায়া আর উৎসাহ ছিল। মায়ের মৃত্যু আর বিয়ের পর সব স্বপ্ন যেন ধুলো পড়ে থাকা খাতার পাতায় আটকে গেছে।
“বৌমা, জলটা দে তো!” শাশুড়ির গলার স্বর তাকে চমকে দেয়।
“এই এলাম মা,” কুমুদিনী হেসে জল এগিয়ে দেয়।
তার নিজের ছোট্ট ইচ্ছে, নিজের সময়, নিজের ভালো লাগা—সবই চাপা পড়ে এই ঘরের নিত্যদিনের টানাটানির মধ্যে। তার স্বামী কখনও জিজ্ঞেস করেনি, সে কি ভালো আছে? তার ছেলেরা কখনও ভাবেনি, মায়েরও একটা নিজস্ব জগৎ থাকতে পারে। সে কেবল দেয়, আর দেয়—প্রতি মুহূর্তে নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কুমুদিনী এক ফাঁকে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চোখ রাখে দূরের আকাশে। সাদা মেঘের ভেলায় মন হারায়। তার বুকের ভেতরে কোথাও চাপা পড়ে থাকা ইচ্ছেগুলো কেঁপে ওঠে। বারান্দার একপাশে রাখা ধুলো জমা আলমারির দিকে তাকায়। সেই আলমারি যার তলায় লুকিয়ে আছে তার আঁকার পুরনো খাতা, রঙের বাক্স আর কিছু ধূলো ধূলো স্বপ্ন।
আজ হঠাৎ কেন জানি বুকের মধ্যে কেমন হাহাকার জাগে। সে ধীরে ধীরে আলমারির কাছে এগোয়। হাত বুলিয়ে নেয় কাঠের গায়ে। সেই কাঠের গায়ে খোদাই করা ছোট্ট একটা পদ্মফুল। বিয়ের পর প্রথম যে ছবি সে আঁকতে চেয়েছিল, সেই স্মৃতির চিহ্ন হিসেবে সেই পদ্মফুলটা আজও রয়ে গেছে।
মনে পড়ে যায়, কিশোরী কুমুদিনী কেমন করে বিকেলের আলোয় বসে ছবি আঁকত। বাবা বলতেন, “এই মেয়ে একদিন বড় শিল্পী হবে।” কিন্তু আজ, সেই শিল্পীর স্বপ্নের জায়গায় সে শুধুই এক গৃহবধূ, যার ক্যানভাস এখন থালাবাটি, রঙ এখন মশলার গুঁড়ো, আর তুলির কাজ এখন বাচ্চাদের স্কুলের কাগজে সই করা।
হঠাৎ সেদিন বিকেলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় কুমুদিনীর। বারান্দার হাওয়া গায়ে লাগতেই সে অনুভব করে, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই শিল্পীসত্তা আজও মরে যায়নি। সেটা হয়তো নিঃশব্দ, চাপা পড়ে আছে, কিন্তু একেবারে নিভে যায়নি। তার বুকের ভেতরে ধীরে ধীরে এক অচেনা আলো জ্বলে ওঠে।
সে ভাবে, “আমি কি পারি না, নতুন করে তুলিটা হাতে নিতে? শুধু নিজের জন্য, নিজের ভালো লাগার জন্য?”
আলমারির তালা খোলার সাহস আজও হয়নি। কিন্তু বুকের ভেতরে সেই ইচ্ছের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে, অদৃশ্য জগতের কোনো এক প্রান্তে কুমুদিনীর অদম্য শিল্পীসত্তা আবার জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেয়।
সন্ধ্যা নামে। ঘরে আবার ভাতের গন্ধ, টেবিলে জমে ওঠে চায়ের কাপ, ছেলেরা পড়ায় বসে যায়, স্বামী ক্লান্ত হয়ে সোফায় হেলান দেয়। কুমুদিনী আবার নিঃশব্দে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে আজ, বুকের গভীরে এক আশ্চর্য রঙের বুনন শুরু হয়েছে, যেটা আর কোনো দায়িত্বের ভারে হারিয়ে যাবে না।
দুই
সেই রাতের কথা কুমুদিনীর মনে আজীবন গেঁথে থাকবে। সেদিন রাতে ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করে সে এক ফাঁকে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। শীতের হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলো মৃদু সোঁসোঁ শব্দ তুলছিল। আকাশে একফালি চাঁদ, আর চারপাশে নীরব কলকাতা শহর। মনে হচ্ছিল, এই নিস্তব্ধতা কুমুদিনীর মনের কথা শুনছে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ে বারান্দার কোণের সেই পুরনো কাঠের আলমারিতে। আলমারির গায়ে হাত বুলিয়ে তার মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলো, যখন সে প্রথম এই বাড়িতে এসেছিল। বাবার বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল এই আলমারিটা। সেই সময় কত যত্ন করে সে নিজের বই, খাতা, আঁকার সামগ্রী সাজিয়ে রেখেছিল ভেতরে। তারপর সংসারের চাপে, জীবনের নানা টানাপড়েনে সেই আলমারির দরজা বহুদিন আর খোলা হয়নি।
কুমুদিনীর বুকের ভেতরে আজ অজানা এক কাঁপুনি বয়ে যায়। এক আশ্চর্য টান অনুভব করে সে। ধীরে ধীরে সে আলমারির দিকে এগোয়। একমুঠো চাবির গোছা নিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করে। চাবিটা ঠিকমতো ঘোরে না প্রথমে। তবে কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর তালা খোলে। কাঠের দরজা কাঁপতে কাঁপতে খোলে, আর ধুলো জমা এক পৃথিবী তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়।
আলমারির ভেতরে সাজানো আছে পুরনো বই, অ্যালবাম, আর একপাশে রাখা আছে রঙের বাক্স, ছোট্ট তুলি, কিছু ফিতের টুকরো, আর তার প্রিয় খাতা—যা সে একসময় নিজের আঁকা ছবি দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল। সেই খাতাটাই কুমুদিনীর হাতে উঠে আসে। তার বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়—যেন হারিয়ে যাওয়া নিজেরই ছায়াকে সে ছুঁতে পারছে। খাতার প্রথম পাতাটা খুলতেই চোখে পড়ে একটি পেন্সিল স্কেচ—একটি মেয়ের মুখ, যেটা সে অষ্টাদশী বয়সে এঁকেছিল। মেয়েটির চোখে ছিল স্বপ্ন, মুখে ছিল হাসি, আর সেই হাসি যেন আজও কুমুদিনীর দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতের নীরবতায় কুমুদিনী বিছানায় বসে খাতার পাতা উল্টাতে থাকে। প্রতিটি পাতায় সে যেন নিজের অতীতকে খুঁজে পায়। গ্রামবাংলার মেঠোপথ, দূরের নৌকা, কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া, মায়ের মুখের রেখা—সব ছবিগুলো যেন তার ভেতরের আবেগগুলোকে নতুন করে নাড়া দেয়।
হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় এক পাতায়। সেখানে আঁকা ছিল দুটি হাত—একটি ছোট্ট শিশুর হাত আর একটি বড়ো হাত তাকে আগলে রেখেছে। কুমুদিনীর মনে পড়ে যায়, সায়নের জন্মের পর একদিন নিঃশব্দে বসে এই ছবিটা এঁকেছিল সে। সেই দিনগুলো, সেই অনুভূতিগুলো আজও তাজা হয়ে ফিরে আসে তার মনে। চোখের কোণ ভিজে ওঠে।
রাত গভীর হয়। কুমুদিনীর চোখে ঘুম নেই। সে খাতাটা বুকে চেপে ধরে বারান্দায় দাঁড়ায়। দূরের আলো-আঁধারি শহরটাকে দেখে মনে হয়, কত শত মুখ এই শহরে ঘুমিয়ে আছে, কত শত স্বপ্ন এই শহর জানে না। আর সেই শহরেরই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে কুমুদিনী, যার ভেতরের স্বপ্নগুলো আবার জেগে উঠছে।
ভোরের দিকে ঘরে ফিরে এসে কুমুদিনী আলমারির তলার আরও কিছু জিনিস বের করে। বেরোয় তার পুরনো রঙের বাক্স। বাক্স খুলে দেখে তাতে কিছু শুকিয়ে যাওয়া রঙ, কিছু অর্ধেক শেষ তুলি, আর দু-একটা কাঁচের পটারি রঙের দানা। এগুলো হাতে নিয়ে কুমুদিনীর মন কেমন করে ওঠে। মনে হয়, সময় যেন এদের মলিন করে দিয়েছে, যেমন তার নিজের স্বপ্নগুলোকে মলিন করে দিয়েছে সংসারের চাহিদা।
তবে এবার কুমুদিনী স্থির করে নেয়—সে আবার আঁকবে। না, কারও জন্য নয়, নিজের জন্য। নিজের মনের সুখের জন্য, নিজের হারানো স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের কারও কিছু মনে পড়ে না, যে কুমুদিনী রাতে এত বড় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। কুমুদিনী মনে মনে হাসে। সে জানে, এই নতুন যাত্রা শুরু করতে গিয়ে অনেক বাধা আসবে। কিন্তু এইবার সে হার মানবে না। সেই পুরনো খাতার পাতাগুলো যেন তাকে কথা দিয়েছে, “তুই পারবি কুমু, তুই আবার আঁকবি।”
তিন
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। কলকাতার শীতের নরম রোদ বারান্দার মেঝেতে সোনালি চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ছেলেরা স্কুল থেকে ফিরেছে, খেয়ে নিয়ে যার যার ঘরে পড়তে বসেছে। স্বামী রঞ্জন অফিসে, শ্বশুরমশাই পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন, আর শাশুড়ি বিছানায় আধোঘুমে আধো জাগরণে সময় কাটাচ্ছেন। এই ঘর-বাড়ি, এই সংসার—সব যেন প্রতিদিনের চেনা ছকের মতো চলে।
কুমুদিনী আজ দুপুরের কাজ শেষ করে একটু অবসর পেল। রান্নাঘরের কাজ, টেবিল গুছিয়ে রাখা, শাশুড়ির ওষুধ, শ্বশুরমশাইয়ের চা—সবকিছু সেরে সে নিজের ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করল। দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর ছোট্ট ফালি ঘরে ঢুকছিল। সেই ফালির আলোয় ধুলো ঝলমল করে উঠছিল, যেন নৃত্যরত সোনার কণা। এই সোনালি ফালি আলোয় আজ কুমুদিনীর ভেতরের এক চিরচেনা ইচ্ছা জেগে উঠল।
আলমারি থেকে পুরনো খাতা আর রঙের বাক্স বের করল সে। বুকের ভেতরে যেন পাখির মতো ফড়ফড় করছে এক অজানা উত্তেজনা। খাতার পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে কুমুদিনীর মনে হলো, এই পাতাগুলো যেন তার জীবনের দিনলিপি। রঙের বাক্স খুলে হাতে তুলিটা তুলে নিল সে। পুরনো তুলি, রঙ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? ইচ্ছের রঙ তো শুকিয়ে যায়নি।
একটা সাদা কাগজ খাতার পাতা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ে কুমুদিনী। বাইরে শিমুল গাছের ডাল দুলছে হাওয়ায়। দূরের আকাশে কয়েকটা কাক উড়ছে। কুমুদিনী চোখ বন্ধ করে একটু নিঃশ্বাস নিল। তার শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো, বাবার মুখ, মায়ের স্নেহ—সব যেন এই মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে তুলিটা কাগজে ছুঁইয়ে দিল সে।
প্রথমে কিছু এলোমেলো রেখা। তারপর সেই রেখাগুলো জুড়ে জুড়ে তৈরি হলো এক দৃশ্য—একটা সরু মেঠো পথ, দু’পাশে তালগাছ, দূরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশে মেঘের ছায়া। আঁকতে আঁকতে কুমুদিনীর মনে হলো, সে যেন ফিরে যাচ্ছে সেই দিনগুলোতে, যখন বিকেলের পড়ন্ত রোদে সে বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে বসে এঁকেছিল এমন ছবি।
ঘরের নীরবতায় শুধু শোনা যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর কাগজে তুলির মৃদু আঁচড়ের আওয়াজ। সে এক অদ্ভুত মুহূর্ত—যেখানে কুমুদিনী নিজেকে আবার খুঁজে পেল। ছবিটা শেষ করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল সে সেই আঁকার দিকে। মনে হলো, এ তো শুধু ছবি নয়, এ তার মনের কথা, তার হারিয়ে যাওয়া সত্তার প্রতিচ্ছবি।
হঠাৎ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। ভয় হতে লাগল—যদি কেউ ঢুকে পড়ে? যদি কেউ দেখে ফেলে এই ছবি আঁকার লুকোনো আনন্দ? যদি আবার কটুকথা শোনে, “এ বয়সে এসব আঁকিবুঁকি কিসের?” কিন্তু পরক্ষণেই সাহস ফিরে পেল সে। মনে মনে বলল, “না, আমি এবার আর লুকোব না। এই ছবি আমার, এই সুখ আমার। কেউ তা কেড়ে নিতে পারবে না।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বাইরে পাড়ার বাচ্চারা খেলছে, পাড়ার ঠেলাগাড়ি চা-ওয়ালার ডাক ভেসে আসছে। কুমুদিনী নিজের আঁকা ছবিটা শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখে, ঠিক করে যে রাতের নিস্তব্ধতা নামলেই আবার সে তুলিটা হাতে নেবে।
সেই প্রথম ছবিটা যেন কুমুদিনীর জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সেদিনের এক ফালি দুপুর যে তার জীবনে কত বড়ো পরিবর্তন আনবে, সেটা সে তখনও জানত না।
চার
রাতের কলকাতা শহর নিস্তব্ধ। চারপাশের বাড়িগুলো আলো নিভিয়ে নিদ্রায় ডুবে গেছে। কেবল দূরের রাস্তার বাতির নিচে ছায়া-আলো খেলছে। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে কুমুদিনীর ঘরে জ্বলছে টিমটিমে বাতি। শোবার ঘরে স্বামী রঞ্জন ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেদের ঘর থেকেও মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুমুদিনী আস্তে পা ফেলে উঠল, যেন এই রাত তাকে ডেকেছে।
তার হাতে সেই পুরনো রঙের বাক্স আর খাতা। বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলের ওপর খাতা খুলল সে। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা শীতল হাওয়ায় তার শাড়ির আঁচল হালকা দুলে উঠল। মনে হলো যেন রাতের বাতাস তাকে সাহস দিচ্ছে। বাইরে দূরের ট্রামের ঘণ্টার মৃদু টুং টাং আওয়াজ যেন তার শিল্পীসত্তার জন্য সঙ্গীত হয়ে বাজছে।
কুমুদিনী এক নতুন ছবি আঁকতে শুরু করল। কাগজে প্রথমে আঁকল নদীর ধারে বসে থাকা এক মেয়ের অবয়ব। মেয়েটি নদীর দিকে চেয়ে আছে—নদী যেন তার মনের কথা শুনছে। মেয়ের চুল উড়ছে হাওয়ায়, তার শাড়ির আঁচলে লেগে আছে ভোরের আলোর স্পর্শ।
রাত গভীর হতে থাকে। কুমুদিনীর তুলির টান গাঢ় হয়। সে আঁকে নদীর পাড়ের কাশবন, আঁকে দূরের মেঘলা আকাশ, আঁকে সেই অদৃশ্য স্বপ্নগুলো যা এতদিন তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল। রঙের বাক্সের শুকনো রঙে জল ছুঁইয়ে রঙ গলিয়ে আনে সে। মনে হয়, এই রঙ গলছে আর তার সঙ্গে গলে যাচ্ছে তার জমে থাকা বেদনা।
প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যায়। ঘড়িতে তখন রাত দুটো। কুমুদিনী ছবি শেষ করে স্নিগ্ধ চোখে তাকায় সেই ছবির দিকে। মনে হয়, এ যেন তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি—সেই মেয়েটি যে সমাজের নিয়মের বাঁধনে আটকে থেকেও মুক্তি খুঁজে নেয় নিজের ভেতরে। ছবি দেখে কুমুদিনীর চোখ ভিজে আসে। সে জানে না এই আঁকার গোপন রাতগুলো কতদিন চলবে, কিন্তু এই রাতগুলোই তার প্রাণের সম্বল হয়ে উঠছে।
ছবিটা শেষ করে কুমুদিনী তা শুকাতে রাখে। টেবিলের ওপর হাত রেখে নিঃশ্বাস ফেলে। মনে হয়, বহু বছর পর সে নিজের সঙ্গে কথা বলছে, নিজের শিল্পীসত্তাকে খুঁজে পাচ্ছে। তবু ভয়ও লাগে—যদি এই গোপন রঙের রাত একদিন ফাঁস হয়ে যায়? যদি কেউ জেনে ফেলে তার এই আঁকার কথা? যদি আবার তাকে উপহাস করে সংসার?
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, এই রঙের রাত তার একান্ত নিজস্ব। কেউ তাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সে জানে, এই ছবির মধ্যে সে যেই শান্তি খুঁজে পেয়েছে, তা আর কিছুতেই পাবে না।
ভোরের দিকে কুমুদিনী আলমারিতে আবার খাতা আর রঙের বাক্স রেখে দেয়। দরজার ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো ঘরে ঢুকে পড়ে। এক নতুন দিনের শুরু হয়, আর কুমুদিনীর চোখে জেগে থাকে রঙিন স্বপ্নের রেখা।
পাঁচ
দিনগুলো যেন কেটে যাচ্ছে চুপিসারে। বাইরের জগতে কুমুদিনীর জীবনে কোনো পরিবর্তন নেই—তবে তার ভেতরের জগতে শুরু হয়েছে এক নতুন ভোর। প্রতিটি রাত কেটে যায় রঙের সান্নিধ্যে, আর প্রতিটি সকাল শুরু হয় নতুন আশার আলোয়।
একদিন দুপুরে, ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড় তুলতে গিয়ে কুমুদিনীর চোখ পড়ল পাশের বাড়ির জানালার দিকে। সেই জানালায় এক কিশোরী দাঁড়িয়ে ছিল—তাকে চুপচাপ দেখছিল। কিশোরীর চোখে ছিল বিস্ময় আর মুগ্ধতা। কুমুদিনী প্রথমে থমকে গেল। বুঝতে পারল, হয়তো সে রাতে কিশোরী তাকে আঁকতে দেখেছে। কিশোরী চোখ নামিয়ে নিল, লজ্জা পেল হয়তো। কিন্তু কুমুদিনীর মনে হল, এই চাহনি যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল—তার ভেতরের শিল্পীসত্তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিধ্বনি।
সেই রাতে কুমুদিনী আরও সাহসী হয়ে তুলিটা হাতে নিল। সে এবার আঁকতে শুরু করল সেই কিশোরীর মুখ, যার চোখে সে দেখেছে মুগ্ধতা আর কৌতূহল। প্রথমে পেন্সিলের টানে চেহারার রেখাগুলো এঁকেছিল। তারপর রঙের ছোঁয়ায় সেই মুখে প্রাণ ফোটাল। আঁকতে আঁকতে কুমুদিনীর মনে হল, সে যেন নিজের কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছে।
কাগজের পাতায় ফুটে উঠল এক কিশোরীর মুখ—যার চোখে লুকানো স্বপ্ন, যার মনে আশার দীপ্তি। শেষ করে কুমুদিনী ছবি একপাশে রেখে জানালার বাইরে তাকাল। সেই কিশোরী তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে একফোঁটা হাসি হেসে মাথা নোয়াল। কুমুদিনীর মন ভরে গেল। মনে হল, এই প্রথম সে স্বীকৃতি পেল—যদিও গোপন, তবু সত্যি।
পরদিন সকালে কুমুদিনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কিশোরী আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে এল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কাকিমা, আপনি খুব সুন্দর আঁকেন। আমি অনেকবার আপনাকে রাতে দেখেছি। আমিও শিখতে চাই… আপনি শিখিয়ে দেবেন?”
কুমুদিনীর চোখ ভিজে এলো। এতদিন যে স্বপ্ন সে গোপন রেখেছিল, সেই স্বপ্নের প্রথম প্রতিধ্বনি আজ সত্যি হয়ে ধরা দিল। সে কিশোরীর মাথায় হাত রাখল। মনের ভেতর এক শক্তি অনুভব করল।
“হ্যাঁ মা, নিশ্চয় শিখাবো। তুমিই তো আমার প্রথম ছাত্রী।”
সেই দিন থেকে কুমুদিনীর রাতের রঙ আর শুধু নিজের জন্য নয়—সে জানল, তার সৃষ্টি অন্য কাউকে সাহস দিতে পারে, আশার আলো দেখাতে পারে।
ছয়
শীতের সকাল। জানালার কাচের গায়ে শিশিরের বিন্দু জমে আছে। রোদের আলো এসে সেই বিন্দুতে ঝিলমিল করছে। কুমুদিনী বসে আছে তার ছোট্ট পড়ার ঘরে। তার সামনে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি খাতা, কাগজ, রঙের বাক্স আর পেন্সিল। একপাশে রাখা সেই কিশোরীর—শ্রীলার—ছোট্ট স্কেচবুক। আজ বেশ কিছুদিন ধরে কুমুদিনী শ্রীলাকে আঁকার হাতেখড়ি দিচ্ছে। শ্রীলার মুগ্ধ চোখ, আগ্রহে টগবগে মন কুমুদিনীর নিজের শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়।
প্রতিটি ছবির পেছনে থাকে এক লুকানো গল্প। আজ কুমুদিনী সেই লুকানো গল্পগুলোর কথাই ভাবছিল। যে নদী সে আঁকে, তার পাড়ে তো তার ছোটবেলার স্মৃতি লুকানো। যে কাশবন ফুটিয়ে তোলে রঙে, তা তো তার বাবার হাত ধরে দেখা প্রথম গ্রামের ছবি। যে মেয়েটির চোখে স্বপ্ন আঁকে, সেটিও তো তার নিজের কিশোরী বয়সের প্রতিচ্ছবি।
প্রতিটি ছবির মধ্যে যে বেদনা, যে আনন্দ লুকানো, তা হয়তো কেউ বোঝে না। কিন্তু যখন শ্রীলা দেখে কুমুদিনীর আঁকা নদীর পাড়, কিংবা কাশবন, তখন সে বলে ওঠে,
“কাকিমা, এ যেন গল্পের মতো! আপনি কি গল্প লেখেন?”
কুমুদিনী মুচকি হাসে। উত্তর দেয় না। কিন্তু মনে মনে ভাবে, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙ তো তার জীবনের গল্পই বটে—যা সে লেখা শুরু করেনি, কিন্তু এঁকে চলেছে।
একদিন বিকেলে, শ্রীলা তার আঁকা ছোট্ট ছবি কুমুদিনীর হাতে দিল। ছবি দেখে কুমুদিনীর চোখ ছলছল করে উঠল। ছবিতে ফুটে উঠেছে এক বটগাছের নিচে বসে থাকা একজন নারী, যার হাতে রঙের প্যালেট, আর চারপাশে ঘেরা শিশুরা তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রীলা বলল,
“এ আপনাকেই এঁকেছি কাকিমা।”
কুমুদিনীর মনে হল, এতদিনের লুকানো গল্পগুলো আজ শ্রীলার চোখে প্রকাশ পেল। সে বুঝল, যে সৃষ্টি সে লুকিয়ে রাখে, তা কখনও লুকানো থাকে না। রঙের গল্প মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে কুমুদিনী নিজেই নিজের খাতায় লিখল,
“ছবির ভেতর আমার গল্পগুলো লুকানো থাকে। একদিন এই গল্পগুলো কথা বলবে, একদিন শোনাবে আমার কথা।”
সাত
কলকাতার এক শান্ত রবিবারের সকাল। চারদিকে এক অদ্ভুত সজীবতা, যেন শহরের বুক জুড়ে এক নতুন আশার বাতাস বইছে। কুমুদিনীর ঘরটিও সেদিন অন্যরকম লাগছিল। ঘরের কোণে কোণে ছড়িয়ে ছিল তার আঁকা অসংখ্য ছবি—নদীর পাড়, কাশবন, দূরের মেঘলা আকাশ, শিউলি ফুলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের অবয়ব, লাল সূর্যের আলোয় ঝলমল করা গ্রামের দৃশ্য।
সেদিন শ্রীলা এসে বলল,
“কাকিমা, আমার এক দিদি চারুকলায় পড়ে। ওদের কলেজে এক ছোট্ট প্রদর্শনীর আয়োজন হচ্ছে। আপনি চাইলে আপনার দু-একটা ছবি দিতে পারেন। কেউ জানবে না আপনার নাম, চাইলে ছবি শুধু প্রদর্শন হবে।”
কুমুদিনীর বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল। প্রদর্শনী! এতো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। নিজের আঁকা ছবি যে ঘরের বাইরে যাবে, কেউ তা দেখবে, কুমুদিনী কি তা পারবে? তবু শ্রীলার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে, তার উৎসাহে কুমুদিনী মনে মনে বলল,
“কেন নয়? এতদিন নিজের মনের জানালা খুলে যে ছবি এঁকেছি, সেই ছবি কি ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকবে চিরকাল?”
সেই রাতেই সে দুটো ছবি আলাদা করল—একটা নদীর পাড়ের দৃশ্য, আরেকটা কাশবনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি। ছবির পেছনে ছোট্ট করে লিখল, “নামহীন”। কারণ সে চায়নি প্রথমবারেই নিজের পরিচয় জানাতে।
প্রদর্শনীর দিন। এক ছোট্ট ঘরে টাঙানো নানা বয়সী শিল্পীদের ছবি। দর্শনার্থীরা ঘুরছে, দেখছে, কেউ প্রশংসা করছে, কেউ ছবি নিয়ে আলোচনা করছে। শ্রীলা কুমুদিনীকে অনেক অনুরোধ করেছিল আসতে, কিন্তু কুমুদিনী সাহস করেনি। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল—যেন তার ছবি কীভাবে দেখছে মানুষ, তা অনুভব করার চেষ্টা করছিল।
প্রদর্শনীর শেষে শ্রীলা ছুটে এল কুমুদিনীর কাছে। চোখে মুখে আনন্দ।
“কাকিমা, আপনার ছবি দুটো সবাই খুব পছন্দ করেছে। একজন শিক্ষক বলেছিলেন, ছবিগুলোতে এমন এক কোমল স্পর্শ আছে যা সত্যিকারের শিল্পীর হৃদয় ছাড়া সম্ভব নয়!”
কুমুদিনীর চোখ ভিজে এলো। প্রথমবার তার সৃষ্টি বাইরের জগতে প্রতিধ্বনি তুলল। সেই প্রতিধ্বনি ছিল শুধু প্রশংসার নয়, ছিল স্বীকৃতির, সাহসের। সে জানল, শিল্পের জন্য দরকার শুধু একটুখানি সাহস, বাকি পথ তৈরি হয়ে যায় আপনাআপনি।
সেই রাতে সে আরও একটি ছবি আঁকতে বসল। এই ছবিতে ছিল নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি—কিন্তু মুখের মধ্যে ছিল দৃঢ়তা, চোখে ছিল স্বপ্ন। প্রথমবার সে নিজের সৃষ্টি নিয়ে গর্ব অনুভব করল।
আট
প্রদর্শনীর সেই দিনের পর থেকে কুমুদিনীর মনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দিনের পর দিন যে গৃহবধূ জীবনের রুটিনে বেঁধে ছিল, সে যেন হঠাৎ নিজের মধ্যে এক অজানা দিগন্তের খোঁজ পেতে শুরু করে।
প্রতিদিনের মতো সংসারের কাজ শেষ করে সে যখন খাতার পাতায় তুলির টান দিত, তখন আর তা শুধু নিছক শখের আঁকাআঁকি থাকত না। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙ যেন তার ভেতরের কথা বলতে শুরু করেছিল। রাতের নিস্তব্ধতা কুমুদিনীর সৃষ্টির সময় হয়ে উঠল। এখন আর সে ভয় পায় না—প্রতিটি রাত যেন তার নিজের।
একদিন বিকেলে শ্রীলা তাকে বলল,
“কাকিমা, সেই প্রদর্শনীতে আপনার ছবিগুলো দেখে একজন মহিলা খুব আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি একটি নারী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। তারা খুঁজছে এমন প্রতিভাবান মহিলাদের, যারা গোপনে কাজ করেন। আপনি তাদের সঙ্গে দেখা করবেন?”
কুমুদিনীর বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হয়। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন কথা—সবই তার কাছে অজানা। তবু শ্রীলার মুখের উজ্জ্বলতায় সে সাহস পায়।
“হ্যাঁ, দেখা করব,” সে বলে।
দু’দিন পর কুমুদিনী সেই মহিলা—রুচিরা সেনের—সঙ্গে দেখা করে। রুচিরা একজন শিল্পী, যিনি নারীদের জন্য আলাদা এক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন। যেখানে মেয়েরা তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে, সমাজের চোখ রাঙানি এড়িয়ে।
রুচিরা কুমুদিনীর ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন,
“আপনার ছবিতে যে আবেগ, যে স্পর্শ আছে, তা কোনও প্রশিক্ষণের চেয়ে বড়। আমরা চাই, আপনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোন। আমাদের ‘অপরাজিতা শিল্পমঞ্চ’-এর এক কোণে আপনার জন্য নতুন ঠিকানা থাকুক।”
কুমুদিনীর চোখ জলে ভরে গেল। এতোদিন যে সৃষ্টি লুকিয়ে রেখেছিল, তা অবশেষে নিজস্ব একটি স্থান পেল। সেই সন্ধ্যায় কুমুদিনী বাসায় ফিরল এক নতুন ঠিকানার স্বপ্ন নিয়ে।
ঘরে ফিরে সে প্রথমবার নিজের জন্য আলাদা এক কোণ সাজাল—ছোট্ট এক টেবিল, রঙের বাক্স, কাগজ, আর উপরে জানালার পাশে রাখা তার প্রথম প্রদর্শনীতে যাওয়া ছবি। মনে হল, নতুন ঠিকানা শুধু চার দেওয়ালের ভেতর নয়, তার মনের ভেতরেও তৈরি হয়েছে।
নয়
কলকাতার আকাশে তখন বসন্তের আভা। পলাশ আর শিমুলের লাল-হলুদের মিশ্র রঙ যেন শহরের প্রতিটি গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাওয়ায় মিষ্টি গন্ধ, হালকা রোদের ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত সজীবতা চারপাশে। সেই ঋতুর রঙ যেন কুমুদিনীর মনে এক নতুন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বারান্দার একপাশে বসে সে পেন্সিলের টান দিচ্ছিল খাতার পাতায়। এই খাতাটা তার কাছে বিশেষ। এ খাতায় থাকে তার মনের সব কথা, সব স্বপ্ন, যা সে রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করে।
সেদিন বিকেলেই রুচিরা সেন ফোন করলেন। কুমুদিনীর কণ্ঠে উদ্বেগ ভেসে উঠল, “রুচিদি! কিছু ভুল করলাম নাকি?”
রুচিরা হাসলেন, “না গো কুমু, বরং তোমার জন্য আনন্দের খবর আছে। আমরা অপরাজিতা শিল্পমঞ্চের বাৎসরিক প্রদর্শনীর আয়োজন করছি। চাই, তুমি আমাদের বিশেষ শিল্পী হিসেবে অংশ নাও। তোমার ছবি এবার প্রদর্শনীর মুখ্য অংশ হবে।”
ফোন কেটে দেওয়ার পর কুমুদিনী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখল, পলাশের ডালে বসে আছে একটুকরো বসন্ত। মনে মনে ভাবল, সে কি সত্যিই প্রস্তুত? তার ছবি কি সত্যিই এত বড় মঞ্চে জায়গা পাবে? কিন্তু পরমুহূর্তেই এক অন্যরকম শক্তি অনুভব করল সে। এই তো সে সেই মানুষ, যে রাতের গভীরে, নিস্তব্ধ ঘরের কোণে বসে আপন মনে রঙ-তুলিতে মনের ছবি এঁকেছে, ভয় না পেয়ে নিজের মনের কথা কাগজে ফুটিয়ে তুলেছে। সেই কুমুদিনী আজ নিজের সৃষ্টি নিয়ে বাইরে বেরোবে—কেন ভয় পাবে সে?
পরের দিন থেকে শুরু হল প্রস্তুতি। দিনরাত এক করে কুমুদিনী ছবি আঁকতে শুরু করল। সকালে পরিবারের দায়িত্ব শেষ করে সে ঘন্টার পর ঘন্টা তুলির টানে মগ্ন থাকত। তার ছবিতে ফুটে উঠতে লাগল গঙ্গার ধারে বসা নিঃসঙ্গ নারী, একপাশে বসে থাকা কাশফুলের সারি, দূরে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি। তার প্রতিটি ছবিতে যেন জীবনের নানান রূপ কথা বলতে শুরু করল।
প্রতিটি রাত যেন তার নিজের। স্বামী আর ছেলে ঘুমিয়ে গেলে সে জানালার পাশে বসে যেত। আকাশের তারাগুলোকে মনে হতো যেন কেউ তার সাথেই জেগে আছে। হালকা বাতাসে তার চুল উড়ত, আর সে মনের সমস্ত আবেগ ঢেলে দিত ছবিতে। প্রতিটি ছবিই যেন তার জীবনগাথার এক অংশ।
প্রদর্শনীর দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, কুমুদিনীর মন ততই উদ্বেল হচ্ছিল। শ্রীলা এসে বলত,
“কাকিমা, ভাববেন না, আপনার ছবিই এবার প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ হবে। আপনার ছবি যেমন সুন্দর, তেমন আপনার এই যাত্রাটাও অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা।”
শেষপর্যন্ত সেই বিশেষ দিন এসে গেল। অপরাজিতা শিল্পমঞ্চের প্রদর্শনী শুরু হল কলকাতার এক প্রসিদ্ধ শিল্পগ্যালারিতে। চারপাশে আলো, সাজসজ্জা, শিল্পপ্রেমীদের ভিড়। কুমুদিনীর ছবিগুলো একের পর এক টাঙানো হয়েছিল প্রদর্শনীর একপ্রান্তে। প্রতিটি ছবির নিচে লেখা ছিল—
“কুমুদিনী বসু”
এই প্রথমবার তার নিজের নামের সঙ্গে তার সৃষ্টির পরিচয় জুড়ে গেল।
দর্শনার্থীরা একে একে তার ছবিগুলো দেখছিল। কেউ মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছিল, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ছবি নিয়ে কথা বলছিল। কুমুদিনী দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। প্রতিটি প্রতিক্রিয়ায় তার বুকের ভেতর যেন এক চঞ্চল ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল।
এক বৃদ্ধা এসে অনেকক্ষণ এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ছবিটিতে গঙ্গার ঘাটে বসে থাকা এক নারীর মুখ—যার চোখে ছিল গভীর অজানা অপেক্ষা। বৃদ্ধা এগিয়ে এসে কুমুদিনীর কাছে বললেন,
“মা, এই ছবিটা যেন আমার নিজের কথা বলছে। আমিও জীবনের কত বসন্ত পার করেছি এমন অপেক্ষায়। তুমিই পারলে এই কথা এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে।”
কুমুদিনীর চোখ ভিজে এল। সে জানল, তার সৃষ্টি সত্যিই মানুষের মনে পৌঁছেছে। শুধু ছবি নয়, এ যেন মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া এক ভাষা।
প্রদর্শনীর শেষে রুচিরা সেন এসে কুমুদিনীর হাতে ধরে বললেন,
“তোমার ছবি আজকের সৃষ্টির উৎসবকে সম্পূর্ণ করেছে, কুমু। আমরা গর্বিত যে তুমি আমাদের সঙ্গে আছো। আজ থেকে তুমি শুধু অপরাজিতা মঞ্চের অংশ নও, তুমি আমাদের পথপ্রদর্শক।”
সেই রাত কুমুদিনীর জীবনে এক নতুন অধ্যায় হয়ে রইল। সে জানত, এই প্রদর্শনী শুধু একদিনের উৎসব নয়। এই প্রদর্শনী তার অন্তরের সৃষ্টির উৎসবের শুরু। ঘরে ফিরে এসে সে নতুন এক কাগজ নিল, রঙ মেশাল। ছবির বিষয় বাছল—অপরাজিতা ফুল। সেই ফুল যে ঝড়ে পড়ে না, মাথা তুলে থাকে আপন শক্তিতে।
রাতের আকাশে চাঁদের আলোয় সে তুলির টান দিল। মনে হল, আকাশের তারা, চাঁদ, হাওয়ার শব্দ—সবাই তার এই সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে গেল। ঘুমন্ত শহরের বুকের মধ্যে কুমুদিনী নতুন ছবি আঁকতে লাগল, নিজের সৃষ্টির উৎসবকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখার শপথ নিল।
দশ
প্রদর্শনীর সাফল্যের পর কুমুদিনীর জীবনে যেন এক নতুন বাতাস বয়ে যেতে শুরু করল। সে আর আগের মতো ঘরের কোণে নিজেকে গুটিয়ে রাখেনি। বরং তার রঙ, তুলি, ক্যানভাস এবার তার প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে উঠল। ভোরের আলো ফুটতেই সে বারান্দায় বসে গঙ্গার ওপারের সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। আকাশের লালচে আভা, পাখির ডানার ছায়া, কুয়াশার আবরণ—সব কিছু যেন তার মনের মধ্যে নতুন ছবি হয়ে ফুটে উঠত।
কিন্তু ঘরের ভেতর যেন অন্যরকম বাতাস বইতে লাগল। মিঠুন, তার স্বামী, প্রথমে কিছু বলেনি। কিন্তু ক্রমশ সে বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করল।
একদিন সকালে মিঠুন বলল,
“আজকাল তোমাকে তো কেবল কাগজ-রঙ-তুলির মধ্যেই দেখি। সংসারের দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে?”
কুমুদিনী শান্ত গলায় বলল,
“সংসার তো করছি মিঠুন, ঘরের কাজ ফেলে তো বসে থাকি না। তবে হ্যাঁ, সময় পাই বলে আঁকি। সেটাই তো আমার আনন্দ।”
মিঠুন আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি বলে দিয়েছিল, সে সন্তুষ্ট নয়। কুমুদিনী জানত, সংসারের ভেতরেই সে এই দ্বন্দ্ব পেরোতে হবে।
এদিকে শাশুড়ি মাঝে মাঝে কটাক্ষ করতেন।
“ছোটবেলায় কেউ আঁকতে শেখায়নি নাকি? এই বয়সে আবার শিল্পীর সাধ?”
“গৃহবধূর কাজ কি ছবি আঁকা?”
প্রথম প্রথম কুমুদিনী ব্যথা পেত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝল, কথা শোনার চেয়ে নিজের পথ চলা বেশি প্রয়োজন। সে ভেতরে ভেতরে শক্ত হতে থাকল।
শিল্পমঞ্চের রুচিরা সেন আবার দেখা করলেন।
“কুমু, আমরা চেয়েছি তুমি এবার একক প্রদর্শনী করো। এই শহর তোমার ছবি চিনুক। তুমি যে শুধু শিল্পী নও, তুমি এক সাহসী নারী—সেটা সবাই জানুক।”
কুমুদিনী চুপ করে শুনছিল। কতদিন সে চেয়েছে এমন সুযোগ আসুক! কিন্তু সাথে সাথে ভেতরের দ্বিধা কথা বলল—
“সংসার, সমাজ—সবটা সামলে কি পারব?”
রাতে সে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকাল। গঙ্গার ওপার থেকে আসা বাতাস চুলে হালকা ছোঁয়া দিল। মনে হল, প্রকৃতি তাকে ডাকছে। আর তখনই সে স্থির করল—সে বন্ধন ভেঙে বেরোবে।
প্রদর্শনীর প্রস্তুতি শুরু হল। দিনের কাজ শেষ করে রাতে সে ক্যানভাসের সামনে বসত। প্রতিটি ছবিতে সে নিজের যন্ত্রণা, স্বপ্ন, ভালোবাসা ঢেলে দিত। আঁকল—
👉 শিউলি ফুলের তলায় বসা এক নারী, যে অশ্রুজল লুকিয়ে হাসছে।
👉 আঁকল একলা পথ, যেখানে দূরে আলো জ্বলছে—যেন আশা এখনো দূরে ডাকছে।
👉 আঁকল আকাশে ডানা মেলা পাখি, যাকে দেখে বোঝা যায় মুক্তি কত সুন্দর।
ছবিগুলো শুধু ছবি নয়, তার জীবনের ভাষ্য হয়ে উঠল।
এই সময় তার ছেলে অরুণ একদিন এসে বলল,
“মা, তোমার ছবিগুলো খুব সুন্দর। আমি তোমার প্রদর্শনী দেখতে যাব।”
ছেলের সেই কথায় কুমুদিনীর চোখে জল এল। সে জানল, এই যুদ্ধ সে একা করছে না—অন্তত ছেলে তার পাশে আছে।
যত দিন যেতে লাগল, মিঠুনও আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করল। সে রাতে একদিন কুমুদিনীর আঁকা ছবি দেখে দাঁড়িয়ে রইল। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল,
“যা করছ, মন দিয়ে করো। আমি আর বাধা দেব না।”
সেই মুহূর্তে কুমুদিনীর মনে হল, এই তো সে জিতল। বন্ধনের বাইরের প্রথম সিঁড়ি পেরিয়ে এল।
প্রদর্শনীর দিন এল। গ্যালারি সাজানো হল তার ছবিতে। শহরের শিল্পীসমাজ, সাংবাদিক, শিল্পপ্রেমীরা ভিড় করল সেখানে। কুমুদিনী দূরে দাঁড়িয়ে দেখল, তার ছবি ঘিরে আলোচনা হচ্ছে, ছবি কিনতে চাওয়া মানুষদের ভিড় লেগেছে। একজন শিল্প সমালোচক বললেন,
“এই ছবিগুলো শুধু সুন্দর নয়, এরা কথা বলে। একজন নারীর জীবনের কথা, তার আনন্দ-বেদনার কথা। কলকাতা এমন শিল্পীকে পেয়ে ধন্য।”
প্রদর্শনী শেষে কুমুদিনী বাড়ি ফিরল। রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে। সে জানালার পাশে বসে নতুন ছবি আঁকতে শুরু করল। ছবির বিষয়—একটি বন্ধ দরজা, যার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকে পড়ছে।
এগারো
প্রদর্শনীর সাফল্যের পর কেটে গেছে কয়েকটি মাস। সেই সাফল্য কুমুদিনীর জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখন সে শুধু আর এক গৃহবধূ নয়, এক শিল্পী, এক সৃষ্টিশীল মানুষ, যে আপন হাতে গড়ে তুলেছে নিজের এক পৃথিবী।
ভোরের আলো ফুটলেই কুমুদিনী ব্যালকনিতে বসে কাগজ-কলম হাতে নেয়। গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা জেলে, আকাশে উড়তে থাকা চিল, কাশবনের নরম দোল—সব কিছুই তার চোখে অন্যরকম অর্থ বহন করে। সে রঙের টানে ফুটিয়ে তোলে সেই দৃশ্যগুলো, সেই অনুভূতিগুলো।
এখন তার নিজের এক স্টুডিও ঘর হয়েছে। ঘরের একপাশে সাজানো রঙ, ক্যানভাস, ব্রাশ। আরেক পাশে টাঙানো রয়েছে প্রদর্শনী থেকে ফিরে আসা ছবিগুলো—যারা তার জীবনের এক একটি অধ্যায়ের সাক্ষী।
এখন কুমুদিনীর দিন চলে যায় নিজের সৃষ্টিশীলতায় এবং সংসারের দায়িত্বে। সকালে পরিবারের জন্য রান্না, ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দেওয়া—সব দায়িত্ব সে আগের মতোই পালন করে। কিন্তু সেই দায়ের ফাঁক গলে সে বের করে নেয় নিজের জন্য কিছু সময়।
মিঠুনও এখন কুমুদিনীর কাজের প্রতি সম্মান জানায়। একদিন রাতে কাজ থেকে ফিরে মিঠুন দেখল, কুমুদিনী এক নতুন ছবি আঁকছে—ছবিতে একজন নারী, যার চুল হাওয়ায় উড়ছে, মুখে তৃপ্তির হাসি। মিঠুন বলল,
“এই ছবিটা বোধহয় তোমার নিজের গল্প।”
কুমুদিনী হেসে মাথা নাড়ল,
“হয়তো। অথবা হাজার হাজার সেই মেয়েদের গল্প, যারা নিজের স্বপ্নকে খুঁজে পেতে চায়।”
প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর অনেকেই কুমুদিনীর কাছে আসছে। তারা বলছে,
“আমাদের মেয়েকে আপনি শেখাবেন?”
“আমার বউ ছবি আঁকতে চায়, আপনার কাছে পাঠাব?”
এই কথাগুলো কুমুদিনীর মনে এক নতুন বীজ বপন করল। সে ভাবল, যদি তার মতো আরও নারীরা নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে খুঁজে পায়!
এভাবেই শুরু হল “অপরাজিতা শিল্পকক্ষ”। সপ্তাহে তিন দিন সে নিজের ঘরেই মেয়েদের জন্য আঁকার ক্লাস নিতে শুরু করল। প্রথমে কয়েকজন এল—গিন্নি, কলেজের ছাত্রী, এমনকি এক বৃদ্ধা যিনি সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন আঁকার, কিন্তু কখনও সুযোগ পাননি।
প্রতিটি ক্লাস যেন কুমুদিনীর নিজেরও নতুন শেখা। সে বুঝতে পারল, শিল্প শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা ছড়িয়ে দিতে হয়, ভাগ করে নিতে হয়।
যে সমাজ একদিন কুমুদিনীর ছবি আঁকাকে তুচ্ছ করে দেখেছিল, তারাই এখন প্রশংসায় মুখর। পাড়ার মহিলারা তাকে দেখলে বলে,
“আপনার ছবির কথা আমরা পত্রিকায় পড়েছি।”
“একদিন আপনার আঁকা ছবি কিনব কুমুদি।”
যেখানে একদিন সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল, আজ সেই সমাজ তার পথ খুলে দিয়েছে।
কুমুদিনী এখন নিয়মিত শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। শুধু শহরে নয়, রাজ্যের বাইরেও ডাক পড়ে তার। সে এখন ছবির মাধ্যমে গল্প বলে—একজন নারীর সাহসের গল্প, মাটির গন্ধের গল্প, প্রকৃতির কথা।
তার ছবিতে উঠে আসে— মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা শিশু,
বৃষ্টিতে ভেজা কাশবন, কালীপুজোর রাতে আলোকমালার নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে।
প্রতিটি ছবি যেন কুমুদিনীর নিজের কথা বলে, আর বলে সেই নারীদের কথা যারা চুপচাপ হাজারো স্বপ্ন বুকে লুকিয়ে রাখে।
রাতের নির্জনতা এখন কুমুদিনীর প্রিয় সঙ্গী। সে জানালার পাশে বসে চাঁদের আলোয় নিজের নতুন ছবির ছায়া আঁকে। তার মনে হয়, এই পৃথিবী সে নিজের হাতে গড়ছে, যেখানে কোনও ভয় নেই, কোনও বদ্ধ দ্বার নেই।
ছেলের স্কুলপ্রজেক্টের জন্য সে একদিন গঙ্গার ছবি আঁকতে সাহায্য করল। অরুণ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি সেরা মা। তুমি শুধু আমার মা নও, তুমি পৃথিবীর সেরা শিল্পী।”
কুমুদিনীর চোখ ভিজে গেল। তার নিজের পৃথিবী তৈরি হয়েছে, যেখানে ভালোবাসা, সৃষ্টিশীলতা আর সাহস মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
বারো
গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা কুমুদিনীর চোখের সামনে দূরের দিগন্তজোড়া সূর্যোদয় যেন এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে দিচ্ছিল। তার সামনে ছিল ক্যানভাস, হাতে রঙ-তুলি—যা এখন তার অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে। সে মনে মনে ভাবছিল, কী অদ্ভুত এক যাত্রা সে শুরু করেছিল কয়েক বছর আগে, যখন নিজের মধ্যে লুকোনো স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস জেগেছিল। সেই সাহসের শুরুটা সহজ ছিল না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কুমুদিনী নিজের ভেতরের লড়াই লড়েছে। সমাজ, সংসার, নিজের দ্বিধা—সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ সে দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন পরিচয়ের মুখোমুখি। এখন সে শুধু কুমুদিনী নয়, এখন সে ‘অপরাজিতা’—যে নারী কখনও হার মানে না। শিল্পের মধ্যে দিয়ে সে নিজের কথা বলে, বলে তার মতো হাজার নারীর কথা, যারা প্রতিদিন নিজেদের হারানো স্বপ্নগুলো খুঁজে পাওয়ার লড়াই করে যায়।
প্রদর্শনীর পর পর একাধিক ডাক আসতে লাগল—দেশের নানা প্রান্ত থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও। তার ছবির মধ্যে যে তাজা জীবনের স্পর্শ, যে গভীর নারী-স্বাধীনতার সুর, তা সকলের মন ছুঁয়ে গেল। সে কলকাতার বড় বড় গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করল, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, এমনকি সিঙ্গাপুর, লন্ডন, প্যারিসেও তার ছবির প্রদর্শনী হল। প্রতিটি প্রদর্শনীর শেষে যখন সে দর্শকদের প্রশংসা শুনত, তখন মনে হত, প্রতিটি কথা যেন তার জীবনের এক একটি লড়াইয়ের জয়গাথা। সংবাদপত্র, পত্রিকা, টেলিভিশনের পর্দায় কুমুদিনীর মুখ বারবার ভেসে উঠতে লাগল। নারী দিবসে তাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হল ‘নারী শক্তি’ পুরস্কার হিসেবে। তবু কুমুদিনী জানত, তার পথচলা শেষ হয়নি। সে আরও অনেক কিছু দিতে চায় এই সমাজকে, এই পৃথিবীকে।
তার নিজের গড়া অপরাজিতা শিল্পকক্ষ এখন আর ছোট্ট গৃহশিক্ষার ঘর নয়। এটি এখন শহরের এক প্রান্তে স্থায়ী এক প্রতিষ্ঠান। বড় একটি ভবন, যেখানে আলাদা আলাদা ঘর—শুধু আঁকা শেখার জন্য নয়, শিখতে আসে মেয়েরা মৃৎশিল্প, বাটিক প্রিন্ট, কাগজের কাজ, ম্যুরাল আর আর্ট ইনস্টলেশনের মতো নানা সৃষ্টিশীল শিল্প। কুমুদিনীর একটাই লক্ষ্য—যে মেয়েরা কোনোদিন নিজের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করতে পারেনি, তাদের জন্য এই শিল্পকক্ষ হোক মুক্তির ঠিকানা। তার সঙ্গে কাজ করে কিছু নতুন প্রজন্মের শিল্পী, যারা তার দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের জন্য কাজ করছে। এখানে সপ্তাহে দুদিন কর্মশালা হয়, যেখানে গ্রাম থেকে আসা মেয়েরা যোগ দেয়। তারাও শিখছে কিভাবে রঙ আর রূপ দিয়ে নিজেদের জীবনকে বদলাতে হয়। কুমুদিনী এখন শুধু শিক্ষক নন, এক পথপ্রদর্শক। প্রতিটি ছাত্রী তার কাছে এক অপরাজিতা, এক সাহসিনী।
এই শিল্পকক্ষ থেকে তৈরি হওয়া কাজের প্রদর্শনীও এখন বড় বড় মেলাতে অংশ নেয়। একবার রাজ্যের হস্তশিল্প মেলায় কুমুদিনীর ছাত্রীরা নিজেদের তৈরি মৃৎশিল্প আর পেইন্টিং নিয়ে অংশ নিল। সেই মেলায় বহু বিদেশি ক্রেতা এসে তাদের প্রশংসা করল। কুমুদিনী দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল তাদের উজ্জ্বল মুখ। মনে মনে ভাবল, এই হাসিগুলোই তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ছবি। সে নিজের শিল্পে খুঁজে পেল অন্যের স্বপ্নের জ্বালানি হয়ে ওঠার আনন্দ। অরুণ এখন কলেজের ছাত্র, সে মায়ের কাজকে গর্বের সঙ্গে বন্ধুদের কাছে বলে। মিঠুনও এখন এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছে, প্রশাসনিক কাজগুলোতে সে সাহায্য করে। কুমুদিনীর পরিবারই যেন এখন তার শিল্পকর্মের অংশ, এক বৃহৎ ক্যানভাসের মতো, যেখানে নানা রঙ মিশে এক অপূর্ব ছবি গড়ে তুলছে।
প্রতিটি ছবিতে কুমুদিনী তার নিজের লড়াই ফুটিয়ে তোলে। তার সাম্প্রতিক এক প্রদর্শনীর থিম ছিল—“নারীর মুক্তির আকাশ”। এখানে সে এঁকেছিল— এক নারী পাখির মতো ডানা মেলেছে, পেছনে শিকলের টুকরো ছড়িয়ে আছে। এক বালিকা, হাতে রঙের প্যালেট, চোখে স্বপ্নের দীপ্তি। নদীর মতো বয়ে চলা নারী, যে জীবনকে অগ্রসর করে নিয়ে যায়।
এই প্রদর্শনীতে যখন দর্শকরা আসত, অনেকেই ছবি দেখে চোখ মুছত। এক বৃদ্ধা মহিলা এসে বলেছিলেন,
“মা, আজ তোমার ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, আমিও হয়তো এই বয়সে আবার স্বপ্ন দেখব।”
কুমুদিনীর চোখ ভিজে গিয়েছিল। সে তখন বুঝেছিল, শিল্প কেবল রঙের খেলা নয়, এটা মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করার এক শক্তি।
সে চেয়েছিল গ্রামে, মফস্বলে মেয়েরা তার শিল্পকক্ষের গল্প জানুক। সে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত, তাদের আঁকতে শেখাত, বলত কিভাবে সংসারের ভেতর থেকেও নিজের স্বপ্নকে বড় করতে হয়। এই সময়ে সে রাজ্য সরকারের এক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হল—নারীদের হস্তশিল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভর করার উদ্যোগে। এভাবেই কুমুদিনী এক নারীর সীমিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সমাজের শক্তি হয়ে উঠল।
আজ কুমুদিনীর ঘরে টাঙানো আছে তার প্রথম আঁকা সেই ছোট্ট ছবিটি—যেখানে এক মেয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। সে জানে, সেই হাত এখন শুধু তার নয়, সেই হাত প্রতিটি নারীর, যে স্বপ্ন দেখে। গঙ্গার পাড়ে বসে কুমুদিনী এখন নতুন ছবি আঁকে—যেখানে আলো আর অন্ধকার মিশে থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলো জেতে।
কুমুদিনীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আজ এক শিল্পের ক্যানভাস। সে বুঝেছে, নারীর সৃষ্টিশীলতা কখনও নষ্ট হয় না, শুধু তাকে সঠিক সময়, সঠিক সুযোগ পেতে হয়। এবং সেই সুযোগ সে নিজে করে নিতে জানে। সমাজ তাকে বাধা দেবে, বন্ধন দেবে—কিন্তু নারীর ভেতরের ‘অপরাজিতা’ শক্তি শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে।
শেষ রাতে জানালার পাশে বসে চাঁদের আলোয় সে নিজের নতুন ছবির টান দিল। ছবিতে ফুটে উঠল এক নারী, যিনি আঁধারের বুক চিরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, পায়ের নিচে ছড়িয়ে আছে ভাঙা শিকল। কুমুদিনী মনে মনে বলল—
“আমি অপরাজিতা। আমি থামব না।”
সমাপ্ত