ত্রিসা ভট্টাচার্য
কলকাতার পার্ক স্ট্রিট—চিরচেনা, চিরসজীব, আলো-আঁধারির এক নিটোল সহবাস। দিনের শেষে যখন রাজপথের হট্টগোল স্তিমিত হয়ে আসে, আর দোকানপাটগুলো একে একে ঝাঁপ ফেলে দেয়, ঠিক তখনই এই রাস্তার পেট থেকে জেগে ওঠে অন্য এক কলকাতা—যার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় ছায়া, স্মৃতি, আর কিছু হারিয়ে যাওয়া নাম। এই শহরের এক কোণে, এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানটা যেন শহরের ব্যস্ততা থেকে আলাদা, নিজের ছন্দে বাঁচে। নাম—”রিডিং রুম”।
দোকানটা যত না বিক্রির জন্য, তার চেয়েও বেশি যেন অপেক্ষার জন্য বানানো। এখানে ধুলোমাখা বুকশেলফে ঠাসা পুরনো বই, কাঠের মেঝেতে বেজে ওঠা অদ্ভুত কড়মড় শব্দ, আর দোকানঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁসার ঘড়ির মতোই অপরিবর্তিত একজন মানুষ—দেবাঞ্জন।
দেবাঞ্জন সাহা, বয়স পঁইত্রিশ, চুপচাপ স্বভাবের, কাঁধে ঝুলে থাকা এক আধপাকা ব্যাগ, চোখে গোল চশমা, আর মুখে এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত ক্লান্তি। কিছু বলতে গেলে মাঝপথেই থেমে যায়, যেন ভাষার চাইতেও চুপ থাকা বেশি সত্যি। সে “রিডিং রুম”-এর মালিক নয়, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে তার কাকার থেকে, যিনি বছর দশেক আগে আচমকা একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। দেবাঞ্জন নিজেও জানে না, কেন সে এই পুরনো দোকানটা চালিয়ে যাচ্ছে—হয়তো নেশা, হয়তো ভয়ের এক ধরণ, হয়তো বইয়ের পাতার ভেতর লুকিয়ে থাকা কিছুর সন্ধান।
সেদিনটা ছিল বর্ষার শেষ দিন। চারপাশে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, পার্ক স্ট্রিটে ছাতা মাথায় ছুটে চলা মানুষজন, আর দোকানের জানালায় টুপটাপ করে পড়ে চলা জলের ফোঁটা। সন্ধ্যে তখন গড়িয়ে রাতের দিকে যাচ্ছে। দেবাঞ্জন দোকান গুছিয়ে ফেলছে, ঠিক তখনই পিছনের কাঠের আলমারির নিচে চোখে পড়ে একটা মোটা, ধুলো ধরা বই।
প্রথমে সে খেয়ালই করেনি। তারপর আলমারি সাফ করতে গিয়ে বইটা খসে পড়ে মেঝেতে। কুড়িয়ে নিতে গিয়ে অনুভব করে, এ যেন বই নয়—একটা শরীর, কেমন যেন নরম, কিন্তু ভারী। তার চামড়ার বাঁধাইয়ে লাল রঙের দাগ, যেন কারও হাতের ছাপ।
বইটার ওপরে লেখা:
“Morfot’s Diary: 1971 – 1999”
আর নিচে, খুব ছোট হরফে—“For the Keeper only”
দেবাঞ্জনের কাঁপা হাত ডায়রির মলাট ছুঁয়ে দেয়। একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি ওঠে মেরুদণ্ড বেয়ে। দোকানের বাতি হঠাৎ কমে আসে, এক অদ্ভুত কেঁপে ওঠে আলো। বাইরের বৃষ্টি আরও জোরে ঝাপটাতে থাকে জানালায়। সে ডায়রির প্রথম পাতাটা খুলে দেখে।
প্রথম লাইন লেখা—
“যখন রক্ত পাতাল ছুঁবে, তখনই আত্মার ফসল ঘরে উঠবে।”
দেবাঞ্জন হতবাক হয়ে যায়। এটা কোনও কবিতা নয়, কোনও প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী? সে পাতাগুলো ওলটাতে থাকে। প্রত্যেকটি পাতায় হাতে লেখা কিছু চিহ্ন, রক্তে আঁকা গোল বৃত্ত, ল্যাটিন ভাষায় মন্ত্র, আর কলকাতার মানচিত্র—পার্ক স্ট্রিটকে ঘিরে কাঁটাতারের মতো লাল রেখা। একটা পাতায় লেখা—
“Harvest begins at the Red Gate.”
হঠাৎ সে চমকে ওঠে। ডায়রির মাঝে একটা ছেঁড়া পোস্টকার্ড! খাম ছাড়া, কালি বিবর্ণ। তাতে লেখা—
“Pub 17 will bleed first. Then the girl with the golden nose-ring. You’re next.”
দেবাঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়। Pub 17 তো এখান থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। আর গোল্ডেন নোজরিং? সে মল্লিকার কথা ভাবে। বছর কুড়ি বয়সের ছাত্রী, যিনি প্রায়ই পুরনো বইয়ের সন্ধানে আসে দোকানে। তার ডান নাকে সত্যিই এক চকচকে সোনার নথ।
ঘড়ির কাঁটা তখন ৮টা ছুঁয়েছে। বাইরে বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু বাতাসে যেন কিসের চাপা গন্ধ—একটা পুরনো, ছেঁড়া চাদরের মতন গন্ধ, যেটা কিছুদিন আগেও কোথাও ছিল না।
দেবাঞ্জন ডায়রিটা ব্যাগে ঢোকায়। মনে মনে ভাবে, এটা হয়তো কাকার বই, হয়তো এই বইয়ের সাথেই তার নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্ক। দোকানের দরজা বন্ধ করে সে হাঁটতে থাকে পার্ক স্ট্রিট ধরে। কিছু দূর যেতেই হঠাৎই তার চোখে পড়ে—Pub 17-এর বাইরে লোক জমেছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে পুলিশ।
একজন লোক কানে ফিসফিস করে বলল—”হঠাৎ করেই ছেলেটার মুখ ঘুরে যায়, তারপর সে চিৎকার করতে করতে মাটিতে পড়ে যায়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার চোখ… যেন গলে যায়।”
দেবাঞ্জনের হাতের ভিতর ব্যাগের ভিতর থাকা ডায়রিটা যেন হঠাৎ ঠান্ডা থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
তার মনে হতে লাগল—সে যা পড়েছে, তা কল্পনা নয়। তার চারপাশে সত্যিই কিছু ঘটছে।
আর সেই কিছু এখন ধীরে ধীরে তাকে টেনে আনছে।
ডায়রির শেষ পৃষ্ঠার নিচে মোটা কালিতে লেখা—
“The one who reads is the one who awakens. You opened the Vault. They know you now.”
দেবাঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকে ঝাপসা আলোয় ভিজে পার্ক স্ট্রিটের এক কোণে। তার চোখের সামনে দিয়ে একটা গাড়ি চলে যায়। জানালার কাঁচে সে এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পায়—একটা অদ্ভুত মুখ। পুরনো ইংরেজি জামা পরা, চোখে ফসফসে আলো, ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।
ডায়রির কোণ থেকে যেন ভেসে আসে এক লাইন:
“Welcome, Keeper.”
***
পার্ক স্ট্রিটে আলো-আঁধারি মিলেমিশে এক ছায়ার নগরে পরিণত হয় রাত বাড়ার সাথে সাথে। সবকিছু যেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে—যেন শহর নিজেই নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে, কথা বলছে, কিছু বলার চেষ্টা করছে যাকে বুঝতে হলে চোখে নয়, কানেও নয়, মন দিয়ে শুনতে হয়। আর দেবাঞ্জন সেই শুনে ফেলা মানুষের কাতারে পৌঁছে গেছে—যার জীবন আর আগের মতো রইল না সেই ডায়রিটা ছোঁয়ার পর।
পাব ১৭-তে ঘটনার পর দেবাঞ্জনের শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল। সে সোজা ফিরে আসে দোকানে। ঘড়ি তখন রাত ৯টা পেরিয়েছে। চারদিক ফাঁকা, বৃষ্টির গন্ধ মিশে আছে বাতাসে, আর তার বুকের মধ্যে হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে এক তীব্র অস্থিরতা—এটা কেবল আতঙ্ক নয়, বরং এমন এক টান, যা মানুষকে গভীর কিছুর দিকে টেনে নেয়, পেছনে তাকাবার সুযোগ না দিয়েই।
সে ডায়রিটা আবার টেনে বের করে। পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে বহু অচেনা শব্দ, চিহ্ন, তারিখ, এবং নাম। তার দৃষ্টি আটকে যায় এক পাতায়—তাতে আঁকা একটা লাল রঙের দরজা, চারদিকে গোল বৃত্ত, আর তার নিচে ছোট হরফে লেখা:
“Red Gate, 56/A, Convent Lane. Beneath the chapel.”
দেবাঞ্জন জানে, এই ঠিকানাটা কোথায়। ওটা সেই পুরনো কনভেন্ট লেনের পেছনে, যেটা একটা পুরাতন গির্জার নিচে গিয়ে শেষ হয়—যেখানে প্রায় কেউই যাতায়াত করে না। শোনা যায়, ওখানে আগে এক ইংরেজ ফাদার থাকতেন যিনি হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান পঞ্চাশের দশকে। গির্জার নিচে নাকি একটা বেসমেন্টও ছিল, যেটা এখন তালাবদ্ধ। লোকজন বলে, রাতের বেলা গির্জা থেকে প্রার্থনার আওয়াজ আসে, অথচ সেখানে এখন আর কোনও ফাদার থাকে না।
ডায়রির পরের পাতায় লেখা—
“He who opens the Red Gate begins the Harvest. Let the Gate be sealed again, else the vault of the nameless will rise.”
এই লেখার নিচে হালকা পেনসিলে লেখা একটা তারিখ:
“15th June – Moon Half-Risen”
আজ যে দিন! অর্থাৎ আজ রাতেই সেই “Harvest” শুরু হবে?
হঠাৎ দেবাঞ্জনের মনে পড়ে মল্লিকার কথা। সেই গোল্ডেন নথওয়ালা মেয়ে, যে গতকালই বলছিল, রাতে ঘুম ভাঙে তার, কারণ সে নাকি কোনো এক বৃদ্ধ সাহেবের গলায় পুরনো ইংরেজি গান শুনতে পায়। তখন দেবাঞ্জন ওসবকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন সবকিছু একসাথে এসে দাঁড়াচ্ছে এই ডায়রির ভেতর।
সে ফোন করে মল্লিকাকে—কিন্তু ফোন বেজে যায়, কেউ তোলে না।
পরে সে বাইকে চড়ে রওনা দেয় সেই ঠিকানার দিকে—৫৬/এ কনভেন্ট লেন। পার্ক স্ট্রিটের কোলাহল পেছনে ফেলে সে ঢুকে পড়ে অন্ধকারে ডুবে থাকা গলির ভেতর। ল্যাম্পপোস্টের আলো এখানে আর পৌঁছায় না। এক সময় দাঁড়ায় সেই গির্জার সামনে—ভাঙাচোরা, পরিত্যক্ত, অথচ কেমন এক অভিজাত নীরবতা ঘেরা, যেন সবকিছু দেখছে কিন্তু কিছুই বলছে না।
তালাবদ্ধ গেটের বাইরে পেছনে এক দেওয়ালে ছোট একটা দরজা—লাল রঙের, একটু খোলা।
দেবাঞ্জন সামনে গিয়ে ঠেলে দরজাটা খুলতেই এক শীতল বাতাস বেরিয়ে আসে। যেন নিচে কোনও সুড়ঙ্গ, যেখান থেকে শত শত বছর পুরনো হাওয়া এখনো বয়ে আসে। নিচে একটা সিঁড়ি, অন্ধকার আর অন্ধকার, তবে বাতাসে ভাসছে ধূপের গন্ধ, আর একটা খুব সূক্ষ্ম কিন্তু পরিষ্কার গান—পুরনো গ্র্যামোফোনের মতন বাজছে—
“All souls go where silence grows…”
দেবাঞ্জন ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামে। হাতে মোবাইলের আলো, আর ব্যাগে ডায়রি। সিঁড়ি শেষে পৌঁছায় এক ঘরে—মেঝেতে আঁকা গোল চিহ্ন, পাশে পুরনো আয়না, মাঝখানে ধূলি জমা কাঠের টেবিল। আর টেবিলের উপর পড়ে আছে একটা নথ—সোনার।
সে হাত বাড়িয়ে নিতে যায়, কিন্তু তখনই আয়নাটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে।
তার ভেতর ফুটে ওঠে একটা মুখ। সেই মুখটা তার নিজের মতোই, কিন্তু চোখ দুটো যেন শূন্য। ঠোঁটে হাসি নেই, কপালে লাল দাগ।
আয়নার পেছন থেকে একটা গলা বলে—
“You read it, you followed, now be the Keeper. The Gate is open.”
আচমকা ঘরজুড়ে শোনা যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, যেন আশপাশে কেউ বা কিছু রয়েছে।
দেবাঞ্জন চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু দেখে, দরজাটা যেদিক দিয়ে সে এসেছিল, তা আর নেই। চারপাশের দেয়াল যেন বদলে গেছে—সব আয়না, আর প্রতিটা আয়নাতে একই মুখ বারবার প্রতিফলিত—একটা পুরনো সাহেব, ধবধবে সাদা চুল, চোখে আলো, আর ঠোঁটে সেই অদ্ভুত হাসি।
ডায়রির এক কোণ থেকে আলো বেরোয়, পৃষ্ঠাগুলো নিজে নিজে ওল্টাতে থাকে।
“Chapter Two: The Keeper Enters”
“Chapter Three: The Girl Sings Tonight.”
দেবাঞ্জন বুঝতে পারে, ডায়রি শুধুই একটি বর্ণনা নয়—এ এক জীবন্ত ভবিষ্যদ্বাণী, এক নিষিদ্ধ গাইড—যার পাঠক হতে হয় একজন বেছে নেওয়া ব্যক্তি—“The Keeper”।
আর সে এখন সেই Keeper। যার কাজ এখন একটাই—এই শহরের আত্মাদের গল্প জানা, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, না হলে—তারা তাকে গ্রাস করবে।
***
পার্ক স্ট্রিটের সেই রাতে, দেবাঞ্জন যখন নিচের ঘরে নিজেকে আয়নাবন্দি এক রহস্যময় জগতে আবিষ্কার করল, তখন শহরের আরেক কোণে ঠিক সেই মুহূর্তেই এক অদ্ভুত সুর বেজে উঠেছিল—নম্র, কষ্টভরা, অথচ ভয়াবহভাবে টানটান করা এক ধ্বনি। সেই সুর ছিল মল্লিকার গলা থেকে আসা, অথচ গানের কথা ও সুর যেন কোনও কালেই পৃথিবীর মানুষের ছিল না।
মল্লিকা তখন একা বসে ছিল তার চেনা পি.জি. রুমে—পার্ক সার্কাসের ধারে, তিন তলার ছাদঘেরা একটা ছোট ঘর। পড়াশোনার চাপে ক্লান্ত, সে কেবল গান শুনছিল ইউটিউব থেকে, হালকা আলোতে শুয়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ তার ফোনের স্ক্রিন নিভে যায়। আর ঠিক সেইসময় তার কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে, “Sing for them…”
সে চমকে উঠে বসে, চারদিক নিস্তব্ধ। জানালার বাইরে ঝিরঝিরে হাওয়া, আর দূরে কোথাও যেন ঘুঙুর বাজে। সে ভাবে হয়তো বাইরে কেউ যাচ্ছে, কিন্তু যখন খেয়াল করে, জানালার কাঁচে কে যেন সোনালি আঙুলে এক বৃত্ত আঁকছে। ঘরটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে, আর বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা শূন্যতা জমছে।
তারপর, অদ্ভুতভাবে, সে বুঝতে পারে—তার গলা দিয়ে অচেনা সুর বেরোচ্ছে। মুখ বন্ধ, অথচ সুর ঠিকরে বেরোচ্ছে বাতাসে। ভাষা অজানা, কিন্তু শব্দ গুলো যেন আত্মার ভিতর কাঁপিয়ে দেয়। সুর এতটাই শক্তিশালী যে রুমের কাচ, জলভর্তি বোতল—সব কাঁপতে থাকে। আয়নার মধ্যে তার প্রতিবিম্ব নড়ে ওঠে।
দেবাঞ্জন, এদিকে সেই আয়নার ঘরে, এই সুর স্পষ্ট শুনতে পায়। তার চারপাশে থাকা প্রতিফলিত চেহারাগুলো সুরের সঙ্গে গলাগলি করে হাসছে, যেন বহুদিন পর তারা সেই গান শুনছে যা তাদের মুক্তি দেবে—or bind them tighter.
ডায়রির পৃষ্ঠাগুলো এবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে উল্টে গিয়ে থামে একটি পাতায়। তাতে লেখা:
“Chapter Three: The Girl Sings Tonight. If her song ends, the Vault opens.”
দেবাঞ্জন এবার বুঝতে পারে, এই গানের সঙ্গে কোনও রহস্য গভীরভাবে জড়িত। হয় এই গানের মধ্য দিয়েই আত্মারা শহরে ফিরে আসবে, নয়তো গান থামলেই তারা ছিন্ন করবে আবরণ। সে জানে, মল্লিকাকে বাঁচাতেই হবে।
সে ডায়রি ব্যাগে ভরে, খোলা সিঁড়ি দিয়ে আবার উপরের দিকে উঠে আসে। কিন্তু এবার যে গির্জার দরজা দিয়ে সে এসেছিল, সেটা যেন বন্ধ। তার পরিবর্তে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো সাহেব, ডায়রির লেখক—মরফৎবাবু।
হাসিটা যেন কাঁচে আঁকা। গলার স্বর ছিল ফিকে—
“তুমি তো সেই রাখাল, যে ভেড়া চেনেনা। রাখালের ছড়ি এখন তোমার হাতে। গানের ভিতর আত্মা বাঁধা, আর মেয়েটি কেবল এক সেতার।”
দেবাঞ্জন ভয় পেলেও সাহস করে বলে, “তুমি মরফৎবাবু? এইসব কি হচ্ছে?”
সাহেব বলে—“আমি শুধুই এক পুরনো স্মৃতি, এক আত্মার দলিলরক্ষক। কিন্তু তুমি এখন ‘Keeper’। মেয়েটি যদি গাওয়া বন্ধ করে, Vault খুলে যাবে। তুমি জানো না সেখানে কী আছে। কালরাত্রির নামহীনেরা ফিরে আসবে।”
দেবাঞ্জন হাঁপাতে হাঁপাতে গির্জার বাইরের পথে ছুটে যায়। ফোন টোকা দিলে মল্লিকা উত্তর দেয় না। শেষে সে পার্ক সার্কাসের দিকে ছোটে, রাস্তা পেরিয়ে, রিকশা ধরে ছুটে যায় সেই বাড়ির দিকে। তিনতলার জানালায় আলো জ্বলছে না, কিন্তু একটা বাষ্পীয় সুর ভেসে আসছে—যেন কণ্ঠ নয়, মন গাইছে।
ঘরে ঢুকতেই সে দেখে মল্লিকা বিছানায় বসে, চোখ বন্ধ, মুখ থেমে আছে কিন্তু চারপাশে হাওয়ার মধ্যে সুর বাজছে। ঘরের দেয়ালে গানের প্রতিধ্বনি ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরছে—আর প্রতিটা দেয়ালে আঁকা হতে লাগছে অচেনা প্রতিকৃতি—শত শত মুখ, চোখ বন্ধ, কিন্তু একসাথে যেন তাকিয়ে আছে মল্লিকার দিকে।
দেবাঞ্জন তাড়াতাড়ি ডায়রি খুলে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেয়। তাতে আঁকা ছিল একটা গোল চিহ্ন আর তার মাঝে একটি নাম—”ঈলনানাশ”। সেই নামটা উচ্চারণ করতেই ঘরের বাতাস থমকে যায়। মল্লিকার মুখ থেকে সেই অলৌকিক গান থেমে যায়, আর এক মুহূর্তের জন্য সারা ঘর অন্ধকারে ঢেকে যায়।
দেয়ালের সব মুখ মিলিয়ে যায়, আয়নাগুলো ভেঙে পড়ে মেঝেতে। কিন্তু মল্লিকা চেতনা হারায়। দেবাঞ্জন তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে, চোখে জল নিয়ে ডাকে—“মল্লিকা! উঠো! আমি এখানে আছি।”
একটু পর, মল্লিকা চোখ খুলে বলে—“আমি কোথায় ছিলাম? তুমি… দেবাঞ্জনদা? আমি তো গাইছিলাম না!”
সে যেন কিছু মনে করতে পারছে না।
ডায়রির এক কোণ থেকে সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু উঠে এসে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। তার পৃষ্ঠায় লেখা হয় নতুন এক লাইন—
“Song sealed. For now. But the Fourth sings from beneath the tramlines.”
দেবাঞ্জন বুঝে যায়, এটি কেবল শুরু। যে ভয় সে বাঁচিয়েছে, তা কিছুক্ষণের জন্য। ডায়রির পরবর্তী চ্যাপ্টারে এখন যে আসবে, তার ভয় আরও গভীর।
মল্লিকা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দেবাঞ্জন ডায়রিটা তাক করে দেখে, তার শেষ পৃষ্ঠায় কালো হরফে লেখা—
“Next: The Tramline Prophet.”
***
পার্ক স্ট্রিটের অলিগলি যতই রঙিন হোক, তার নিচে একটা অনন্ত ছায়া যেন পাতা। শহরের রাস্তার উপর চলে যাওয়া ট্রামলাইনের নিচে এমন কিছু আছে যা চোখে দেখা যায় না—শুধু শোনা যায়। আর সেই শোনা কথার মধ্যেই বাস করে এক মানুষ—যাকে সবাই ‘পাগল’ বলে পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু সে একজন ভবিষ্যদ্বক্তা, যার কথাগুলো কালো ব্যাসাল্টের মতো শীতল—আর তার কথাগুলো এখন মরফৎবাবুর ডায়রির পরবর্তী অধ্যায়ে।
সকাল বেলা দেবাঞ্জন মল্লিকাকে মেডিকেল চেকআপের পর তার এক বান্ধবীর কাছে রেখে দেয়। মল্লিকা যেন তার গানের ঘটনার কিছুই মনে রাখতে পারছে না। দেবাঞ্জন বুঝে যায়—ডায়রির অভিশাপ থেকে একরকমে মল্লিকাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
সে তখন নিজেই খুলে ডায়রির পৃষ্ঠা। পাতাটির উপর লেখা:
“Chapter Four: The Tramline Prophet. Beneath the wheels, he whispers truth.”
দেবাঞ্জন ভাবে, ট্রামের নিচে একজন ভবিষ্যদ্বক্তা মানে কি? কীভাবে সেখানে কিছু থাকতে পারে? মনে পড়ে যায় হঠাৎ কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে যাওয়ার সময় এক বৃদ্ধকে দেখেছিল—ট্রামের রেল ধরে হাঁটছিল, আর নিজে নিজে বলছিল,
“When the fifth mirror breaks, Park Street will drown in glass.”
তখন কথাটা হাস্যকর লেগেছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ডায়রির সঙ্গে যেন এই লোকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সে যায় কলেজ স্ট্রিট—ট্রামলাইন ধরে হাঁটে, পথচারি এবং দোকানিদের জিজ্ঞেস করে সেই পাগল সন্ন্যাসীর কথা। কেউ কেউ বলে—”ও তো রাতে আসে, ট্রামের নিচে হাঁটে আর গুনগুন করে। দেখে ভয় হয়, কিন্তু আসলে কিছু করে না।”
এক ভ্যানচালক বলে, “ওই বুড়োটা থাকে বড় বাজার দিকের ট্র্যাকের ধারে, মাঝে মাঝে ধূপ জ্বালে আর খড়ের গায়ে সিঁদুর মাখায়।”
সন্ধ্যাবেলা দেবাঞ্জন রওনা দেয় বড়বাজার ট্র্যাক বরাবর, হাতে ডায়রি, পকেটে মোবাইল, আর মনজুড়ে ভয় আর কৌতূহলের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।
এক সময় সে দেখে এক বৃদ্ধ, গায়ের গায়ে জোড়াতালি দেওয়া চাদর, পায়ে পাটা, আর সামনে ধূপকাঠি জ্বলছে। বৃদ্ধ একটানা বলছে—
“তিন নাম গিয়েছে, চতুর্থ গান থেমেছে। কিন্তু পঞ্চম আয়না ফাটার আগে, পাঁচ ছায়া ঘুরবে রাস্তায়। তুমি এসেছ, ‘Keeper’।”
দেবাঞ্জনের গলা শুকিয়ে আসে। সে বলে, “আপনি কে? আপনি ডায়রি সম্পর্কে জানেন?”
বৃদ্ধ বলে, “ডায়রি লিখেছে মরফৎ, কিন্তু পাতাগুলো লেখা হয় আত্মার রক্তে। আমি ছিলাম পূর্ববর্তী ‘Keeper’। কিন্তু আমি পেরিনি। আমি বন্দি হয়েছি এই রেললাইনের শব্দে।”
তারপর বৃদ্ধ তাকায় ডায়রির পৃষ্ঠায়। হঠাৎ সেই পাতাটি নিজে থেকেই ছিঁড়ে যায়, আর আকাশে উঠে গিয়ে একটা অদৃশ্য চিহ্ন আঁকে। আকাশ কালো হয়ে আসে, বিদ্যুৎ কাঁপে। ট্রামলাইন কাঁপে।
বৃদ্ধ চিৎকার করে ওঠে—
“পঞ্চম আয়না ফাটছে আজ! আয়নাঘর খুলে যাবে—এটাই ভবিষ্যৎ! আর তোমার সময় এখনই শেষ হতে পারে, যদি তুমি Gate বন্ধ না করো।”
দেবাঞ্জন তখন বলে, “কোন গেট? আমি কিচ্ছু জানি না!”
বৃদ্ধ মাটিতে এক চক্র আঁকে—তার মাঝে পাঁচটি আয়নার প্রতিকৃতি, আর একটি কেন্দ্রে লাল দরজা।
সে বলে—“তুমি খুলেছ এক, বন্ধ করেছ দুই, কিন্তু তৃতীয়টা নিজেই খুলেছে। আয়নার ঘর খুললে পার্ক স্ট্রিটে মানুষ থাকবে, আত্মা থাকবে না। গানের সুরে যারা বন্দি ছিল, তারা এখন মুক্ত। এবার সময় এসেছে তোমার পরীক্ষার।”
এরপর সে বলে, “আজ রাতেই ট্রামঘর সংলগ্ন আয়নাঘরে ঢোকো। সেখানে আছে পঞ্চম আয়না। ওটা ভেঙে গেলে, ডায়রি লেখা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তুমি আর থাকবে না।”
দেবাঞ্জন বুঝে যায়, ট্রামলাইনের নিচে যে ট্রান্সমিশন ঘর আছে, সেখানে যেতে হবে। সেই ঘরটা পুরনো, সিভিল ওয়্যারিং ঘর, যেখানে বিদ্যুৎ চলাচল নিয়ন্ত্রণ হয়। রাত ১০টার পর গার্ডরা কাউকে ঢুকতে দেয় না।
কিন্তু রাত ১১টা নাগাদ সে পিছনের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে সেই ঘরে। অন্ধকার, ভাঙাচোরা কাচ, কেবল ফিউস বক্স আর ঝুলে থাকা তার। হঠাৎ তার সামনে জ্বলে ওঠে পাঁচটি আয়না—চারদিকে তারই মুখ, একটাতে তার মৃতদেহ, আরেকটাতে মল্লিকা গাইছে রক্তমাখা গলায়, আরেকটায় সেই সাহেব হাসছে।
পঞ্চম আয়নায় দেখা যায় এক ভবিষ্যৎ—পার্ক স্ট্রিট ভেসে গেছে রক্তে। লোকজন হাঁটছে কাচের উপর, কিন্তু প্রত্যেকের মুখে মরফৎবাবুর হাসি।
ডায়রি থেকে আগুন বেরিয়ে আসে। পাতাগুলো উড়ে গিয়ে আয়নাগুলোতে লাগতে থাকে। দেবাঞ্জন বুঝতে পারে, এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে আয়নাগুলো ভাঙবে কি না।
সে পকেট থেকে একটা ধাতব কাঠি বের করে—যেটা তাকে দিয়েছিল ট্রামলাইনের বৃদ্ধ। কাঠির মধ্যে লেখা ছিল—
“Break to Bind. Bind to Break.”
সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পঞ্চম আয়নাতে আঘাত করে।
ভীষণ শব্দ হয়, চারদিক আলোয় ভরে ওঠে, যেন কোনও অন্তহীন দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর সব নিঃস্তব্ধ।
ডায়রি পড়ে আছে মাটিতে। তার পৃষ্ঠায় লেখা—
“Fifth Mirror Broken. Chapter Five Awaits: The Night of Thirteen Steps.”
***
সেই রাতে যখন দেবাঞ্জন ট্রাম লাইনের আয়না ভেঙে ফেলে পার্ক স্ট্রিটের বিভীষিকা সাময়িকভাবে আটকে দিয়েছিল, তখন সে জানত না যে এই কাজের জন্য তাকে দিতে হবে আরও গভীরতম এক আত্মত্যাগ। ডায়রি তার সামনে পড়ে ছিল, পৃষ্ঠায় তাজা কালিতে লেখা হয়েছিল একটি বাক্য:
“Thirteen steps to descend. Only then shall you rise.”
ডায়রির পরবর্তী অধ্যায়ের নাম:
“The Night of Thirteen Steps.”
দেবাঞ্জন বাড়ি ফিরে স্নান করে বসে, কিন্তু ঘুম আসে না। তার মাথার মধ্যে সেই আয়নার ঘর, সাহেবের কণ্ঠস্বর, আর মল্লিকার গানের অলৌকিক অনুরণন একসাথে বাজতে থাকে। ডায়রি সে আর ছুঁয়েও দেখে না, কিন্তু তা নিজেই খুলে পড়ে থাকে—এবং রাত ঠিক বারোটা বাজতেই হঠাৎ সমস্ত বাতি নিভে যায়।
দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ যেন চুপিচুপি বলে—
“Step one begins now. Come down, Keeper.”
সে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে, পার্ক স্ট্রিটের আলো সব নিভে গেছে। শুধু একটা লাল আলো জ্বলছে—পূর্বদিকে, সেই পুরনো ‘La Martiniere for Boys’ স্কুলের ধারে। দেবাঞ্জন ভাবে, ওটা তো এখন পরিত্যক্ত এক ঘর, বহু বছর আগেই স্কুলের পুরনো ক্লাবরুম বন্ধ হয়ে গেছে।
কৌতূহল ও এক অজানা ভয় নিয়ে সে রওনা দেয়। স্কুলের চারপাশ ঘিরে থাকা বাগানে গা ছমছমে নীরবতা। গেটে তালা, কিন্তু তালা এমনভাবে খুলে পড়ে যেন কেউ অপেক্ষা করছিল।
ভেতরে ঢুকতেই একটা জীর্ণ সিঁড়ি—পুরনো কাঠের, যা সোজা নিচে নেমে যায়। সিঁড়ির পাশে খোদাই করে লেখা:
“Thirteen Steps. Do Not Turn.”
প্রথম ধাপে পা রাখতেই তার কানে বাজে এক অদ্ভুত ঘড়ির শব্দ। না, ওটা ঘড়ি নয়—মনে হয় কারোর হাঁটার শব্দ, একঘেয়ে, ধীর, চর্মসন্ধানী। দ্বিতীয় ধাপে নামতেই মনে হয় চারপাশের দেয়াল সরছে—যেন ঘরের আয়তন বাড়ছে। তৃতীয় ধাপে নামার সময় সে টের পায় তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে। সে ফিরে দেখতে চায়, কিন্তু সেই খোদাই করা বাক্য মনে পড়ে—“Do Not Turn.”
চতুর্থ ধাপের পর থেকে সে বুঝতে পারে—ঘরটা আর স্বাভাবিক নয়। প্রতিটা ধাপ যেন একেকটা সময়ের ফাটল। পঞ্চম ধাপে সে দেখে—তার সামনে হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে আছে এক মৃতদেহ, ঝুলছে ছাদ থেকে, চোখে গর্ত, মুখে কালো কালি।
ষষ্ঠ ধাপে নেমে সে দেখে দেয়ালে লেখা—“The girl you saved has already sung the Sixth Verse.”
সে বোঝে, মল্লিকা এখনও মুক্ত নয়। গানের মধ্যে আটকে গেছে তার আত্মা। সপ্তম ধাপে নেমে সে দেখে নিজেরই মুখ—এক ভাঙা আয়নায়, যার ভেতরে তার দৃষ্টিশূন্য চোখ এবং রক্তমাখা ডায়রি হাতে।
অষ্টম ধাপে সে এক বিকৃত গানের সুর শোনে—তা যেন মল্লিকার নয়, বরং মরফৎবাবুর কণ্ঠে সেই সুর।
“Thirteen down, you shall drown—twelve and up, you corrupt the crown…”
নবম ধাপে নেমে দেয়ালের ওপর ছায়াচিত্র ভেসে ওঠে—তার বাবার মুখ, মা’র অস্পষ্ট মুখচ্ছবি, এক কিশোর বয়সের দুর্ঘটনার দৃশ্য—যা সে ভুলে গেছিল। ডায়রি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই ধাপগুলো তারই জীবনের ছায়া।
দশম ধাপে পা দিতেই সে পড়ে যায় এক দীর্ঘ ফাঁকা স্থানে, যেন বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যবর্তী স্তরে। সেখানে একটা দরজা খোলা—তার ভেতর থেকে আলো এসে পড়ছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক ছোট মেয়ে, তার চোখে সাদা ঘুমের মতো চাহনি, গলায় গলার দাগ। সে বলে—“Step Eleven is my grave.”
দেবাঞ্জন ভয় পায়, তবুও এগোয়। একাদশ ধাপে মেয়েটি মিলিয়ে যায়, কিন্তু দেয়ালে লেখা—“Your name is no longer yours.”
দ্বাদশ ধাপে সে বুঝতে পারে সে কোথায় ঢুকেছে—এটা এক অচেনা সময়ঘর, যেখানে আত্মারা বাঁচে স্মৃতির টুকরোয়। প্রতিটা ধাপে তার নাম, পরিচয়, মনুষ্যত্ব খণ্ড খণ্ডভাবে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।
তবে তেরোতম ধাপে পৌঁছানোর পর সে দেখে এক বিশাল আয়নাকক্ষ—একেবারে গোলাকার, যেখানে দেয়ালে ১৩টি দরজা, এবং প্রতিটা দরজার সামনে একটি করে ছায়া দাঁড়িয়ে। এগুলো সেই আত্মারা, যাদের আত্মা এখনও বাঁচে পার্ক স্ট্রিটের বিভিন্ন বার, রেস্তোরাঁ, পুরনো বাড়ির ভেতর।
মরফৎবাবুর কণ্ঠ শোনা যায়—
“এই হল আসল Vault। তুমি পঞ্চম আয়না ভেঙেছ, কিন্তু Vault তখনই খোলে, যখন কেউ তেরো ধাপ শেষ করে। Welcome, Keeper. Now you choose.”
সে দেখে, মাঝখানে একটি কাঠের কনসোল, যার উপর লেখা—“Seal or Release.”
সে বুঝতে পারে—সে চাইলে এই তেরোটি দরজা সিল করতে পারে, চিরতরে। আত্মারা আর ফিরবে না। কিন্তু তার মূল্য? হয় সে নিজের আত্মা ছেড়ে দেবে, নয়তো ডায়রি অন্য কাউকে বেছে নেবে।
সে মনে করে মল্লিকাকে, নিজের ছোটবেলার দুর্ভাগ্য, ও ডায়রির কারণেই তার জানা সত্যগুলো—এবং নিজের ভয়কে জয় করে সে হাত রাখে “Seal” বোতামের ওপর।
ঠিক তখনই Vault কাঁপে, আত্মারা চিৎকার করতে থাকে, চারদিক আলোয় ভরে যায়—আর তার চোখের সামনে ডায়রির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে যায়—
“Vault Sealed. The Keeper Remains. Chapter Six awaits at the Midnight Church.”
তারপর—সব অন্ধকার। সে চোখ মেলে দেখে, সে আবার নিজের ঘরে, টেবিলের ওপর ডায়রি। ঘরের দেয়ালে একটা ছায়া নড়ে।
সে বুঝতে পারে—সে এখনও Keeper. আর পরবর্তী অধ্যায় অপেক্ষায়।
***
ডায়রির পরবর্তী পৃষ্ঠাটি খুলতেই বাতাস যেন ভারী হয়ে আসে। ঘরের প্রতিটি কোণে এক অজানা গন্ধ—মোম আর পুরনো কাঠের। পৃষ্ঠার উপরের দিকে মোটা হরফে লেখা—“Chapter Six: Midnight Church.” আর নিচে একটিমাত্র লাইন—“The bell rings once at twelve. Twice if it’s too late.”
দেবাঞ্জন জানে এবার গন্তব্য সেই গির্জা, যেটা পার্ক স্ট্রিটের এক প্রান্তে আজ বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। St. Elmo’s Chapel, যার ইতিহাসই রহস্যে মোড়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক অগ্নিকাণ্ডে গির্জার ভিতরে মৃত্যু হয়েছিল বারো জন কিশোরের, যারা মধ্যরাত্রির প্রার্থনায় ছিল। সেই রাত থেকে প্রতি বছর একদিন, ১৩ই জানুয়ারি, গির্জার ঘণ্টা নিজে থেকে বাজে—একবার বা দু’বার।
এবছর ১৩ই জানুয়ারি আজ।
দেবাঞ্জন ডায়রিটি পকেটে গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তা ফাঁকা, পার্ক স্ট্রিটের আলোতেও আজ যেন রঙ নেই। যে দোকানগুলিতে একসময় সান্ধ্য ভিড় লেগে থাকত, আজ সেগুলো অদ্ভুতভাবে নিঃসাড়। গানের সুর নেই, নেই মানুষের কোলাহল। মনে হয়, শহরটা নিজেই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার।
St. Elmo’s এর মূল ফটক আজ খোলা। দরজায় তালা নেই, শুধু কাঠের ওপরে আঁকা এক চিহ্ন—এক বৃত্তের ভেতরে উল্টানো ক্রস। দেবাঞ্জন জানে না এই চিহ্নের অর্থ, কিন্তু ভেতরে পা দিতেই তার মাথা ঘুরে ওঠে। মনে হয় চারপাশের বাতাস শব্দ শুষে নিচ্ছে। গির্জার ভেতর অন্ধকার, শুধু মৃদু আলো এসে পড়ছে উঁচু জানালা দিয়ে।
ডায়রি হঠাৎ নিজে থেকেই খোলে। নতুন পৃষ্ঠায় লেখে—“Find the Altar. Light the Forgotten Flame.”
দেবাঞ্জন এগিয়ে যায় গির্জার ভেতরে, যেখানে কাঠের পুরনো বেঞ্চগুলো এখন ধুলোয় ঢেকে গেছে। সামনে মঞ্চ, তার উপর বিশাল এক ক্রুশ, আর তার পেছনে ভাঙাচোরা আলতার। হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় এক কোণের দিকে—একটা পাথরের সিন্দুক, তার উপর লাল মোমের দাগ, আর পাশে একটি মৃত পাখি।
ডায়রি আবার খোলে—“The Keeper must light the candle with blood, else the Vault reopens.”
সে ভয় পায়, কিন্তু মনে পড়ে বৃদ্ধ ট্রামপ্রবক্তা তাকে বলেছিলেন—“The Sixth Test demands sacrifice.” দেবাঞ্জন নিজের আঙুলে একটা কাটা দেয়, রক্ত ফোঁটা মোমের গায়ে পড়তেই মোমবাতি জ্বলে ওঠে এক নীল আগুনে।
এক মুহূর্তে চারপাশের আলো বদলে যায়। গির্জার ভেতর পেছনের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ে, আর সেই আলোয় প্রকাশ পায় ছায়া। বারোটি ছায়ামূর্তি, এক একটি যেন কিশোর, চোখে ভেদহীন শূন্যতা। তারা একত্রে বলে—
“He comes. Morfot returns. The Keeper has unlocked Six.”
তারপর, গির্জার পেছনের দরজা নিজে থেকে খুলে যায়, আর দেবাঞ্জন দেখে এক গুহার মতো করিডোর, যার ভেতর থেকে ভেসে আসে চিৎকার আর কাঁপা কণ্ঠে প্রার্থনা।
সে এগোয়, আলোর দিকে নয়, অন্ধকারের দিকে।
ভেতরে একটা ঘর—ভেতরে এক কাঠের কনফেশনাল বক্স। দেবাঞ্জন ভেতরে ঢোকে। ভেতরে লেখা—“Confess not your sin, but the sin of the city.”
সে বুঝে ওঠে না, কিন্তু মনে পড়ে একেকটা মৃত আত্মা তার কণ্ঠে এসেছিল। বার, ক্লাব, অলিগলিতে যারা আত্মা রেখে গেছে তাদের সমস্ত ভয় আর রাগ যেন এখানে জমা।
সে বলে—“আমি পার্ক স্ট্রিটকে দেখেছি বদলাতে। পুরনো আলো নিভে গেছে। গানের ঘরগুলো এখন চিৎকারের জায়গা। আমরা শহরটাকে খেয়েছি। আমরা সবাই দোষী।”
তৎক্ষণাৎ তার সামনে খুলে যায় এক পাথরের দেয়াল, আর এক পুরনো লাইব্রেরির ঘরে সে প্রবেশ করে—যেখানে পুরনো ক্যালেন্ডার, রেকর্ড প্লেয়ার আর মাঝখানে এক চেয়ার। চেয়ারে বসে একজন মানুষ—অর্ধেক মুখ ছায়ায় ঢাকা, হাতে এক চুরুট, পেছনে বেজে চলেছে পুরনো গ্রামোফোন।
লোকটা বলে—
“Finally, the Keeper arrives.”
দেবাঞ্জন কাঁপে। সে জিজ্ঞেস করে—“আপনি কে?”
লোকটা হাসে—“তুমি তো জানোই। আমি মরফৎ। এই শহরের চুক্তির প্রহরী। আমি কাগজে কলমে আত্মা কিনতাম—গানে বেঁধে রাখতাম। এখন, তুমি সেই চুক্তির নতুন রক্ষক। ছয় নম্বর দরজা খোলা হয়েছে। আর সাত নম্বর খুললে, আমি ফিরব।”
সে উঠে দাঁড়ায়। মুখের ছায়া সরতেই দেখা যায়, তার চোখ দুটো সাদা। pupil নেই। সে ধীরে ধীরে গেয়ে ওঠে—
“When midnight rings, the thirteenth soul sings…”
তারপর সে একটা ছোট কাগজ দেবাঞ্জনের হাতে দেয়। কাগজে লেখা—“St. Elmo’s Choir Room. Beneath the piano lies the seventh gate.”
মরফৎ মিলিয়ে যায়। সব আলো নিভে যায়। গির্জা যেন শীতল সমাধি হয়ে যায়।
দেবাঞ্জন কাগজটা শক্ত করে ধরে। ডায়রি তখন লেখা শেষ করে—
“Chapter Six ends. Chapter Seven begins where music dies.”
***
St. Elmo’s গির্জার পেছনের করিডোর ঠাণ্ডা, যেন বাতাস নিজে জমে আছে। চারদিকে ঘন অন্ধকার, আর প্রতিটি পায়ে ধুলো উড়ছে—যা স্পষ্টই বোঝায়, বহু বছর কেউ এখানে পা রাখেনি। দেবাঞ্জন ডায়রির পাতাগুলো নাড়াচাড়া না করেই যেন বুঝতে পারে—সে সঠিক পথে চলছে। একবার যে পথে পা পড়ে, Keeper-এর পিছু ফেরা নেই।
সে ধীরে ধীরে পেছনের দরজার পাশ দিয়ে পৌঁছায় Choir Room-এর সামনে। দরজায় এখনও ভাঙা তালা ঝুলছে, কিন্তু সে ঠেলে দরজা খুলতেই এক ভয়াবহ ঠাণ্ডা ধাক্কা দেয়। ঘরটার ভেতরে, মাঝখানে এক পুরনো পিয়ানো—ধুলোমাখা, অথচ চাবিগুলো যেন সদ্য ছোঁয়া। সেই ঘরটিকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি কাঠের চেয়ার, ছেঁড়া নোটেশন বই, আর দেয়ালে টাঙানো বহু পুরনো কিশোর কণ্ঠদলের ছবি। ছবিগুলোর মুখ ঝাপসা, যেন সময় নিজেই চিহ্নগুলো মুছে দিয়েছে।
ডায়রিটি নিজে থেকে খুলে পড়ে আর লেখে—
“Play the note you fear. Play it thrice.”
দেবাঞ্জনের মনে পড়ে—সেই প্রথম রাতে সে যে সুর শুনেছিল, মল্লিকার গলায় ভেসে আসা সেই নিঃশেষ সুর, যে সুরে ‘Vault’ কাঁপে, আর আয়নার গায়ে ফাটল ধরে। সে বুঝতে পারে—এই ঘরের পিয়ানোকে সেই একই সুর শুনাতে হবে। কিন্তু ভয় সে এখানেই—কারণ এই সুর যদি ভুলভাবে বাজানো হয়, তাহলে তার ভিতরকার আত্মা সেখানেই হারিয়ে যাবে।
সে পিয়ানোর সামনে বসে। আঙুল এগিয়ে যায়, কিন্তু ঠিক সেই সময়, পিছনে একটা ছায়া নড়ে ওঠে। সে দেখে, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক বালক—ছোট, ঘাড় কাত, চোখে গভীর ক্লান্তি।
ছেলেটি বলে—“আমরা গান গাইতাম। সুর দিয়েই আমাদের আত্মা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। তুমি কি সেই সুর জানো?”
দেবাঞ্জন বলে—“না, আমি শুধু শুনেছি। তোমাদেরই কেউ গেয়েছিল।”
ছেলেটি এগিয়ে আসে। সে পিয়ানোর সামনে বসে এবং নরমভাবে তিনটি চাবি চাপে—D# – F – A#
ঘরটা কেঁপে ওঠে। বাতাসে ভেসে আসে আর্তনাদ। ছেলেটি মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার হাতের ছোঁয়ায় পিয়ানো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ডায়রি আবার লেখে—“Now play it thrice, alone.”
দেবাঞ্জন ভয় পায়, কিন্তু শুরু করে। প্রথমবার বাজাতেই ঘরের সব চেয়ার হঠাৎ একসাথে নড়ে ওঠে। দ্বিতীয়বার বাজাতেই দেয়ালের সব ছবি ঝরে পড়ে মেঝেতে। আর তৃতীয়বার বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে পিয়ানোর নিচ থেকে উঠে আসে এক ধাতব শব্দ—যেন নিচে কোনো গেট খুলছে।
পিয়ানোর পেছনে ঝুঁকে সে দেখে, কাঠের ফ্লোরিং একটু ফাঁকা হয়ে পড়েছে। সেখানে একটি ছোট trapdoor, যার গায়ে আঁকা—“VII”
সে ফাঁকটা খুলে নিচে নেমে যায়। সরু সিঁড়ি, আঁধার, আর নীচে মাটির গন্ধ। অনেকটা কুয়োর মতো, কিন্তু নিচে নেমে সে দেখে একটা গুহার মতো কক্ষ। একে একে দেয়ালে আটটি পাথরের ফলক বসানো—সেই বারোটি ছায়ার মধ্যে আটজনের নাম খোদাই করা। কিন্তু মাঝখানে একটা আয়না—সাদা, দুধে-মাখা ধোঁয়ায় ভরা। আয়নাটির উপরে লেখা—
“Here lies the Seventh Gate.”
আয়নার সামনে বসে আছে এক নারী—অত্যন্ত চেনা মুখ।
মল্লিকা।
কিন্তু তার চোখ গহ্বর, গলার চারপাশে কাঁচের টুকরোর মতো চিহ্ন। সে কিছু বলে না, শুধু পিয়ানোর সুরটা আবার গেয়ে ওঠে—তবে এবার অনেক ধীরে, অনেক ভারে।
দেবাঞ্জন এগিয়ে গিয়ে বলে—“তুমি কি বাঁচতে চাও?”
মল্লিকা তাকায় না, কেবল বলে—“Vault খোলা হলে আমি যাবো। এখন আমি Gate এ বন্দি।”
ডায়রি আবার লেখে—
“Speak her name thrice in the Mirror of Memory.”
দেবাঞ্জন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলে—“মল্লিকা… মল্লিকা… মল্লিকা…”
আয়নাটি ফেটে পড়ে, কিন্তু কাচ ছিটকে আসেনা, বরং মল্লিকার মুখটি সাদা ধোঁয়ার মতো সেই আয়নার মধ্যে ঢুকে যায়। গুহায় আলো এসে পড়ে। আর তখনই পাথরের ফলকের একটির পেছনে খুলে যায় একটি পাথরের দরজা।
তার মধ্যেই একটা চেয়ারে বসে আছে সেই বৃদ্ধ—মরফৎবাবু।
তিনি এবার সম্পূর্ণ দৃষ্টিগোচর—চোখে কালো চশমা, হাতে সেই পুরনো ডায়রি, পেছনে পুথিপত্রের স্তূপ। তিনি বলেন—
“Well done, Keeper. Gate Seven is now yours. But with this comes a price.”
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ডায়রি দেবাঞ্জনের হাতে তুলে দেন। তারপর বলেন—
“Every seventh Keeper has had to bury their name. Tonight, you will forget who you are. Only then will Gate Eight reveal itself.”
দেবাঞ্জনের শরীরটা হঠাৎ অসাড় হয়ে আসে। ডায়রি গরম হয়ে ওঠে। মাথার ভেতর যেন কিছু মোছা শুরু হয়েছে—ছোটবেলার স্মৃতি, নাম, বাবা-মায়ের মুখ।
সে কাঁপা গলায় বলে—“আমি কে? আমি… কে ছিলাম?”
মরফৎবাবু বলেন—
“তুমি এখন শুধু একটি নামছাড়া আত্মা, Keeper of the Gates. Prepare, for the next lies where Names are Forbidden.”
তারপর, ঘরের চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। গুহার ছায়া মিলিয়ে যেতে থাকে, আর ডায়রির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে যায়—
“Chapter Seven Complete. Chapter Eight: The Nameless Street.”
***
তাঁর নাম দেবাঞ্জন ছিল—এখন আর নেই। অন্তত, তার মনে নেই। মাথার ভেতরে যেন সবকিছু ধুয়ে গেছে, কেবল থেকে গেছে কয়েকটি শব্দ, কিছু প্রতিধ্বনি, আর সেই অভিশপ্ত ডায়রি—যেটি এক অচেনা শক্তির মতো তার হাত জড়িয়ে রয়েছে। সেই ডায়রির শেষ নির্দেশ ছিল—“Go to the Street That Has No Name.”
সেই রাতেই, আধো আলোয় ভেসে থাকা পার্ক স্ট্রিটের পুরনো প্রান্তে সে পৌঁছায়। রাস্তার নামফলক নেই, দোকান নেই, জানালাগুলো সব কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা, আর প্রতিটি বাতি নিভে আছে। পেছনে কেবল তার পায়ের আওয়াজ। এই গলিটাকে মানুষরা চেনে না, গুগল ম্যাপে নেই, অথচ একসময় এই গলির মধ্যেই “The Eighth Gate” লুকিয়ে ছিল—ডায়রি তাই বলেছে।
ডায়রির পৃষ্ঠাটি খুলে লেখা—
“Where Names are eaten, the Gate survives. Don’t speak. Don’t remember.”
প্রথমেই সে যা দেখে, তা এক অদ্ভুত রেস্তোরাঁ—নামহীন, ভেতরে আলো নেই, কাচের জানালা কুয়াশায় আবৃত। দরজায় একটি ঘণ্টা, সে বেজে উঠতেই দরজা নিজে থেকেই খুলে যায়।
ভেতরে ঢুকে দেবাঞ্জন দেখে, সবাই খাচ্ছে—কিন্তু মুখ নেই। সাদা মুখ, চোখহীন, আর প্রত্যেকের সামনে এক প্লেটে কাগজের টুকরো। কেউ ছুরি দিয়ে নাম কাটছে, কেউ আবার নিজের স্মৃতি চিবিয়ে খাচ্ছে। এক গম্ভীর পরিবেশ—এক অদ্ভুত ভোজ, যার নাম “Feast of the Forgotten.”
এক বৃদ্ধ এগিয়ে আসে। চোখ নেই, কিন্তু গলায় লাল টাই। সে ফিসফিস করে—
“To reach the Eighth Gate, you must give your last memory.”
দেবাঞ্জন কাঁপে—তার মনে পড়ে না সে কে, কী ছিল। কী দিতে পারে সে?
বৃদ্ধ বলে—“Your name. Think hard. There’s a fragment left.”
ডায়রি নিজে থেকেই খুলে যায়। পাতায় এক পুরনো লেখা ফুটে ওঠে—”দে…বা…ঞ্জ…”
সে জোর করে নিজের কণ্ঠে নাম উচ্চারণ করার চেষ্টা করে—“দে…বা…ঞ্জন…”
ঘরটা কেঁপে ওঠে। সব নামহীন মুখরা একসঙ্গে তার দিকে ঘুরে তাকায়। কেউ কেউ গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে নিজের নাম তুলে আনতে চায়, কিন্তু সফল হয় না। তখনই এক দরজা খুলে যায় রেস্তোরাঁর পেছনে—একটা সরু গলি, যার দেওয়ালে লেখা—“ONLY THE NAMELESS MAY PASS.”
সে ডায়রি বগলে নিয়ে এগিয়ে যায়। গলিটার মেঝেতে মোটা মোটা অক্ষরে খোদাই করা নানা নাম—সব নামই কাটা, ছেঁড়া, ঝাপসা। শেষে সে এক লাল দরজার সামনে আসে, যেখানে লেখা—
“VIII”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে আয়না—তার প্রতিচ্ছবি নেই। ডায়রি লেখে—
“Cross the Mirror. Sacrifice the Reflection.”
হঠাৎ, আয়নার ভেতর থেকে এক চেহারা বেরিয়ে আসে—তার নিজের মতোই, কিন্তু মুখে বিদ্বেষ। সেই প্রতিবিম্ব বলে—“তুই কে হবি আমার জায়গায় আসতে?”
দুজনের মধ্যে শুরু হয় এক নীরব দ্বন্দ্ব—কোনও অস্ত্র নেই, শুধু স্মৃতির আঘাত। প্রতিবিম্ব তার ভুল, লজ্জা, ভয়গুলো সামনে আনে। দেবাঞ্জন মনে করার চেষ্টা করে মল্লিকার মুখ, ট্রামে বসে থাকা বৃদ্ধ, গির্জার সেই গান—এইসব একত্র করে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে—“তুই আমি নোস্, আমি এখন Keeper.”
এক তীব্র আলোর ঝলক। আয়নার গায়ে ফাটল ধরে। আর তখনই দরজাটি খুলে যায়।
ভেতরে এক ফাঁকা অডিটোরিয়াম। মাঝখানে একটা মঞ্চ, আর তার ওপর বসে আছে মরফৎবাবু। চারপাশে বারোটি আসন, তার মধ্যে আটটি ইতিমধ্যেই পূর্ণ—অদৃশ্য আত্মায় বসে থাকা।
মরফৎ বলে—“Welcome to the Eighth Gate. You have forgotten your name. Now take a new one.”
সে এক সাদা খাতা এগিয়ে দেয়, আর একটি কলম—কালিতে রক্ত। দেবাঞ্জন কলম নেয়, এবং ডায়রির গায়ে লিখে ফেলে নতুন নাম—
“Keeper VIII: Null.”
ঠিক তখনই, ঘরের প্রতিটি মোমবাতি জ্বলে ওঠে। একটি বিশাল কাঁচের কলস উল্টে যায়, আর কালো ধোঁয়ার মতো একটি আত্মা ধীরে ধীরে তার শরীরে প্রবেশ করে। সমস্ত গলা দিয়ে সে একটি গান গেয়ে ওঠে—মল্লিকার সেই গান, কিন্তু এবার তার গলায়।
মরফৎবাবু দাঁড়িয়ে বলেন—
“You are now the Vault’s voice. With you begins the Last Chapter.”
ডায়রির শেষ পাতায় লেখা হতে থাকে—
“Chapter Eight Ends. Chapter Nine: The Whispering Vault.”
***
কালো ধোঁয়ার সে স্রোত শরীরে প্রবেশ করতেই, দেবাঞ্জনের কণ্ঠে উঠল এক নিঃশব্দ গান—যা কান দিয়ে শোনা যায় না, বরং হাড়ের মধ্যে বাজে। ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করে, তার নাম মুছে গেছে, মুখটা আর নিজের মতো নয়, চোখে এসেছে এক শূন্যতা, আর হৃদয়ের গহীনে জমে উঠেছে এক ভয়ঙ্কর সত্য—Vault, অর্থাৎ সেই শেষ প্রকোষ্ঠটি, যা সব স্মৃতি, আত্মা ও সত্ত্বার মূল ভিত্তি, তা এখন জেগে উঠেছে তার কণ্ঠের ফিসফিসে গানে।
মরফৎবাবু এক জোনাকি-আলোয় ঘেরা প্যাসেজ দেখিয়ে বলেন—
“এই পথে Vault-এ যেতে হবে। তুমি যদি সত্যিকারের Keeper হতে চাও, তবে Vault তোমার কণ্ঠে নিজের উত্তর দেবে।”
পথটি যেন একটা সময়ের গোলকধাঁধা—প্রতিটি দেওয়ালে পুরনো চিত্র, ট্রামলাইনের নিচে পুঁতে রাখা মুখ, কলকাতার আনকোরা ট্র্যাজেডি, যা কেবল রাত্রির শেষপ্রহরে জীবন্ত হয়। আর যেখানেই সে পা রাখে, জমে থাকা ধুলো ছিঁড়ে ফিসফিস করে বলে—“Null… Null… Null…”
এগিয়ে যেতে যেতে সে দেখে এক অদ্ভুত ঘর—চারিদিকে ছায়ায় মোড়ানো, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক জোড়া আয়না। একটিতে তার মুখ, আরেকটিতে কিছুই না—শুধু ফাঁকা।
ডায়রির পাতায় উদ্ভাসিত হয় নতুন নির্দেশ—
“Speak into the blank. Let the Vault hear you.”
সে সেই ফাঁকা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তার ঠোঁট নড়ে না, কিন্তু মনের গভীর থেকে উঠে আসে শব্দ—“Vault, আমি এসেছি।”
হঠাৎ এক বিকট শব্দে আয়নাটি কেঁপে ওঠে। ঘরের পেছনে দেয়াল সরে গিয়ে দেখা দেয় এক গির্জার মত প্রকোষ্ঠ—কিন্তু মাথার ওপরে গম্বুজ নেই, তার বদলে রয়েছে এক শূন্যতা, যার মাঝে স্থিরভাবে ভাসছে অসংখ্য গলা-কাটা মুখ। এবং সেই মুখগুলোর ফিসফিসানি যেন ঘূর্ণিঝড়।
Vault-এর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি কাঠের চক্রাকার বেদি—তার উপর রাখা একটি তামার বাক্স, যার গায়ে খোদাই: “Whisper to Unlock.”
সে বাক্সের দিকে এগিয়ে যায়, এবং সেই গান—যা মল্লিকার থেকে শুরু হয়ে তার নিজের ভিতর ঢুকেছে, সেই সুরটিই গায় আবার। কিন্তু এইবার ফিসফিসে না—এক অনুচ্চারিত সুরে, কাঁপতে কাঁপতে, যেন নিজেকে গলে দিয়ে।
বাক্সটি খুলে যায়। ভেতরে এক গুচ্ছ নোট—ডায়রির পূর্ববর্তী পাতাগুলোর মতো, কিন্তু প্রতিটি একটি আত্মার কথা বলে—কারা চুক্তি করেছিল, কেন তারা নাম ভুলে গেল, কীভাবে Park Street এক ভয়ংকর স্মৃতির বই হয়ে উঠল। এক একটি পৃষ্ঠা খুলতেই চারপাশে মুখগুলোর ফিসফিসানি আরও প্রবল হয়। তাদের কেউ কেউ বলে—“আমার নাম ফিরিয়ে দাও…”
আবার কেউ শুধায়—“আমাকে কেন ভুলে গেছ?”
ঠিক তখনই Vault-এর গা বেয়ে উঠে আসে এক মানব-আকৃতি, ছায়ামূর্তি, যার চোখ থেকে গলে পড়ছে কালি। মুখে কোনও ভাষা নেই, শুধু দুই হাত দিয়ে দেখায় ডায়রির শেষ পাতার দিকে—যেখানে লেখা হচ্ছে—
“Final Command: Burn the Diary, or Be Written Forever.”
অর্থাৎ এখন দুটি পথ:
১) ডায়রি পুড়িয়ে Vault বন্ধ করা—আর তাতেই এই আত্মাগুলো মুক্তি পাবে, কিন্তু তার নিজের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে যাবে চিরতরে।
২) ডায়রি রেখে যাওয়া—Vault খোলা থাকবে, সে নিজেই হয়ে উঠবে নতুন ‘Writer’—যার কাজ প্রতিটি নতুন আত্মাকে ধরে রাখা।
এই দ্বিধার মধ্যে পড়ে থাকে দেবাঞ্জন… কিংবা Null। সে চারপাশে তাকায়। সে দেখতে পায়—Vault-এর এক কোণে মল্লিকার মুখ, যে শান্তভাবে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বলে—“Choose, before the song ends.”
সে ডায়রির দিকে তাকায়। কালির দাগ ছড়াতে শুরু করেছে। শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
সে ধীরে ধীরে বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে নেয় একটি পুরনো লাইটার। তারপর শেষবার ডায়রির মলাটে আঙুল বুলিয়ে বলে—
“আমার নাম ছিল… দেবাঞ্জন।”
আর সঙ্গে সঙ্গে সে আগুন লাগিয়ে দেয় ডায়রিতে। প্রথমে একটি পৃষ্ঠা, তারপর একে একে বাকিগুলো। Vault-এর দেওয়াল ফেটে পড়ে, ফিসফিস গলা হারিয়ে নিস্তব্ধতা নামে। মুখগুলো উধাও হয়ে যায় একে একে। শেষ আলো নিভে যাবার আগে, সে দেখে—মল্লিকার মুখে এক শান্ত হাসি, যেন কোনও অভিশাপ শেষ হয়েছে।
আর তার চোখ বন্ধ হতেই, নিঃশব্দে নেমে আসে কালো, নিস্তব্ধ, নামহীন এক শেষ রাত।
ডায়রির ছাই উড়তে থাকে বাতাসে—এবং তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি নতুন পাতার ছায়া—
“The One Who Remembers.”
***
আগুনে ঝলসে যাওয়া ডায়রির ছাই যখন পার্ক স্ট্রিটের বাতাসে উড়ছিল, সেই রাতের শেষপ্রহরে এক বিশাল নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল কলকাতার গাঢ় রহস্যময় হৃদয়ে। Vault বন্ধ হয়েছে, মুখগুলো মুছে গেছে, আর দেবাঞ্জন—সে কোথায়? কেউ জানে না। কিন্তু Park Street জানে।
মাস তিনেক পর।
সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকান “Pages & Shadows”-এ বসে এক নতুন বিক্রেতা। বয়স কম, গলায় ঝোলানো একটি কাঠের টোকেন—তাতে খোদাই ‘Null’। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে সে হাসে, কিছু বলে না। দোকানটা এখন আর আগের মতো নেই। ভেতরে ঢুকলেই একটা অদ্ভুত শীতলতা, পুরনো কাগজের গন্ধ, আর সব বই যেন আপনাকে ডেকে নেয়।
একদিন সকালে, একটি মেয়ে এসে দাঁড়ায়। মুখে কৌতূহল। তার হাতে একটি পুরনো বই—“Calcutta Rituals and Forgotten Paths”। মেয়েটি বলে, “এই বইটা আমি অনলাইনে খুঁজেও পাইনি। হঠাৎ বাবার ট্রাঙ্কে পেয়েছি। শেষ পাতায় লেখা—‘Pages & Shadows-এ জমা দাও’।”
Null তার দিকে তাকায়, চোখে চিনে ফেলার স্পষ্ট ছায়া—কিন্তু চুপ করে বইটি নেয়। বইয়ের ভেতর একটি পাতার খাঁজে থাকা পুরনো চিঠি খুলে পড়ে সে—
> “তুই যদি বেঁচে থাকিস, জানবি—Vault কখনও পুরোপুরি বন্ধ হয় না। ওটা শুধু ঘুমায়। আমি এখন ওর ভেতরেই আছি। তোর গলায় এখন ওর গান বাজে। কেউ যদি আবার ভুলে যেতে চায়, তোর দোকান খুঁজে নেবে। আর যদি কেউ আবার মনে করতে চায়, তোর ডায়রি খুলবে।”
— মরফৎ
চিঠি পড়ে Null তাকিয়ে থাকে বাতাসে। গলার ভেতরে যেন মৃদু ঝংকার—না গান, না কথা—শুধু এক বেঁচে থাকা ফিসফিসানি। Vault-এর গান তার ভিতর থেকে বাজে—শুধু এবার সে জানে, এটি তার কণ্ঠস্বর নয়, এ শহরের।
তারপর প্রতিদিন, কেউ না কেউ আসে দোকানে—কারও হাতে পুরনো ছবি, কারও মনে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, কেউ নিজের নাম খুঁজে ফেরে, কেউ ভুলে যেতে চায়।
একদিন এক বৃদ্ধ আসে—চোখে ফ্রেমলেস চশমা, আর হাতে একটি পুরনো ডায়েরি—ভেতরে একটিই পৃষ্ঠা লেখা—
“I Remember. And That Is Enough.”
Null ডায়রি হাতে নেয়, দেখে পৃষ্ঠার ঠিক নিচে ফুটে উঠছে আগুনের ছাপ—একই আগুন, যেটা আগে সে জ্বালিয়েছিল। কিন্তু এবার পুড়ছে না। বরং লেখা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
আর তখনই, দোকানের পেছনের ঘরে একটা ছোট্ট দরজা খুলে যায়—যেটা আগে কেউ দেখেনি। ভেতরে একখানা আয়না, যার সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে দেখা যায় না—শুধু দেখা যায় অন্যদের মুখ, তাদের কথা, তাদের চাওয়া, তাদের ভুল।
Null জানে, এই আয়না Vault-এর একটি ছায়া। এখন সে শুধু Keeper নয়—”The One Who Remembers.” এখন তার কাজ হল কার কী ভুলে যাওয়া প্রয়োজন, আর কার কী মনে রাখা প্রয়োজন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
দোকানের দরজার ওপরে সে লাগিয়ে দেয় একটি নতুন কাঠের ফলক—
“Pages & Shadows – যেখানে স্মৃতিও বই হয়ে ওঠে”
রাত হলে, সে একা বসে থাকে দোকানে, চারপাশে বইয়ের পাতায় পাতায় ভেসে আসে কান্না, হেসে ওঠে পুরনো মুখ, আর ডায়রির ছাই জমে বইয়ের মলাটে। নতুন একটি ডায়রি সে খুলে বসে—সাদা পৃষ্ঠা, অজানা নাম—আর লেখে:
> “This is how the city remembers.
Not through names, but through stories.”
আকাশের গাঢ়তা ছুঁয়ে কুয়াশার ভেতর ভেসে চলে পার্ক স্ট্রিটের শব্দহীন ট্রাম, তার ভিতর বসে আছে মল্লিকা, হাতে একটি চিঠি—শেষ লাইন, হাতের লেখায়—
“I was not forgotten. He chose to remember.”
আর দূরে, কোনো এক ছায়াপথে Vault আবার এক নতুন নাম খোঁজে—কারণ ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু মনে রাখা… তা একটা অভিশাপ। একটা দায়িত্ব। একটা ডায়রি।
—
সমাপ্ত