ঋতবান চ্যাটার্জী
হারিয়ে যাওয়া সকাল
পুরুলিয়ার ঘাঘরা গ্রাম যেন একটানা নিঃশব্দে বেঁচে থাকে। এই গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীতল সুবর্ণরেখা, আর মাথার ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র শাল-সেগুন। এখানে দিনের আলো পড়ে নরম, আর রাতের অন্ধকার গাঢ়, জ্যোৎস্নাতেও কালো। কেবলই যেন কেউ দেখে, তবু ধরা পড়ে না।
বিপ্লব দাস ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক। গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভালোবাসার চোখে—যেন তিনি তাঁদের আশার বাতি। সকাল সাতটায় উঠোনে লাল চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতেন, পোষা কুকুর ‘রাঙা’ পায়ের পাশে বসে। সেদিন সকালে রাঙা ছিল, কাপটাও ছিল, শুধু মানুষটা ছিল না।
অরুন্ধতী, বিপ্লবের স্ত্রী, প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বাজারে গেছেন, কিন্তু তাঁর মোবাইল বন্ধ। স্কুলে ফোন করা হলে জানা গেল, স্যার আজ আসেননি। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, বাইসাইকেলও উঠোনেই। পাখিরা ডাকছে, বেলগাছের পাতা পড়ছে—তবু মানুষেরা স্তব্ধ।
গ্রামের যুবক সন্দীপ, রাম আর দুই কিশোর মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াল। স্কুল থেকে শুরু করে বাজার, পুকুরঘাট, এমনকি রেললাইন অবধি গিয়ে ঘুরে এল। কিন্তু সন্ধ্যার মুখে, রাম বলে উঠল, “চলো লোকগঠের দিকে যাই।”
সবাই থেমে গেল।
লোকগঠ—গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের পুরনো এক পরিত্যক্ত শ্মশান। সেখানে বহু বছর আগে শ্মশান কার্য বন্ধ হয়ে যায়। এখন কেবল জঙ্গল, ছেঁড়া পাথরের বেদি, আর এক পুরনো কুয়ো। সেই জায়গা নিয়েই ছড়িয়ে আছে বহু গল্প, আতঙ্ক, আর নিষেধ।
তবু চারজন গিয়েছিল। কুয়োর ধারে পড়ে ছিল একটা ছেঁড়া চটি, পাশে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। ঘাসে টানার চিহ্ন, যেন কেউ কাউকে টেনে নিয়ে গেছে জঙ্গলের দিকে।
হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে এল একটা ফিসফিস আওয়াজ—“এসো…”
সন্দীপ বলল, “চলো পালাই।”
চারজনই দৌড়ে পালাল। কিন্তু কিছু রেখে এল তাদের পেছনে—ভয়, রহস্য, আর এক ছায়াময় ডাক।
পুরনো কাহিনির ছায়া
সন্ধ্যায় হেমন্ত মণ্ডলের বাড়িতে বসে ছিল পুরো পাড়া। ষাটের ঘরে পা রাখা এই বৃদ্ধ লোকটা ছিল গল্পের ভাণ্ডার, লোকবিশ্বাসের শেষ বাহক। রাম তাকে জিজ্ঞাসা করল, “দাদু, লোকগঠে কী হয়েছে আগে?”
হেমন্ত চুপ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ওখানে এক সাধু এসেছিল বছর পঞ্চাশ আগে। শ্মশানের পাশে ধ্যান করত। কেউ তার কাছে কিছু চায়নি, কেউ তাকে তাড়ায়ওনি। কিন্তু একদিন সকালে লোকজন দেখে সাধুর মৃতদেহ পড়ে আছে কুয়োর পাশে। গায়ে পোড়ার দাগ, চোখ খোলা, আর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে।”
“কে মেরেছিল?” —রামের প্রশ্ন।
“কেউ জানে না। তার মৃত্যুর পর থেকেই রাতে অদ্ভুত আওয়াজ, ছায়া দেখা যায়। কেউ বলে, সে ফিরেছে… বিচার চায়। কেউ বলে, সে রাগে মাটি ছেড়ে যেতে পারেনি।”
হেমন্ত থেমে যান। তারপর মৃদু স্বরে বলেন, “সেই থেকে সন্ধের পর ওখানে কেউ যায় না।”
সেই রাতে গ্রামে বিদ্যুৎ চলে যায়। হঠাৎ হাওয়ায় ছাতা উড়ে যায়, জানলার কাঁচ কাঁপে, আর রাঙা শুরু করে অস্বাভাবিক চিৎকার। অরুন্ধতী দরজা খুলে বাইরে তাকান—কুয়োর দিক থেকে হালকা ধোঁয়ার মতো কিছু একটা উঠে আসছে।
ধোঁয়ার ভেতরে যেন একটা অবয়ব, যার চোখ জ্বলছে।
নিষিদ্ধ পথের বাঁকে
পরদিন সকালে রাম আর সন্দীপ ঠিক করে, সত্যিটা জানা দরকার। সেই রাতেই তারা যায় লোকগঠের দিকে—টর্চ, লাঠি, আর গলায় লাউয়ের মালা পরে। তারা পৌঁছায়, কুয়োর ধারে।
সেই জায়গাটা নিঃশব্দ, পাখির আওয়াজ নেই, এমনকি ঝিঁঝিঁ ডাকও নেই। গাছগুলো যেন শ্বাস আটকে আছে। রাম পা বাড়াতেই একটা আওয়াজ হয়—
“চলো…”
সন্দীপ থেমে যায়, কাঁপতে থাকে। রাম সামনে এগোয়।
একটা ছায়া ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো মুখ নেই, হাত নেই, কিন্তু একটা ছায়ার মতো আকৃতি, লম্বা, জ্বলজ্বলে চোখ।
রাম পড়ে যায়, আর বলে—“সে আমার সঙ্গে কথা বলছে… বলে, ফিরিয়ে দে…”
সন্দীপ রামকে টেনে ফিরিয়ে আনে, কিন্তু রামের মুখ বদলে গেছে। তার চোখে শূন্যতা, আর ঠোঁট ফিসফিস করে—“সে ফিরে এসেছে…”
রক্ত ও রাখালগান
রাম তিন দিন কিছু খায় না, কথা বলে না। শুধু কুয়োর দিকে চেয়ে থাকে। মাঝরাতে উঠে বলে—“সে এখনও বসে আছে, কুয়োর ধারে, চোখ খুলে।”
সেই রাতে গ্রামের বুড়ো গায়েন সোমেনবাবু এসে একটা গান গাইতে শুরু করেন—পুরনো রাখালগান—
“ছায়ার নিচে দাঁড়ায় সে
জ্বলছে তার চোখ,
যে ফিরবে, তাকে ছোঁবে সে
জিজ্ঞাসা করে শোক।”
এই গান শুনে সবাই থেমে যায়।
হেমন্ত বলেন, “এই গান কেউ আজকাল জানে না। এটা সাধুর আত্মা নিয়ে লেখা। তার মৃত্যু ছিল অন্যায়, সে বিচার পায়নি। সে ফিরে ফিরে আসে।”
সন্দীপ প্রশ্ন করে, “তবে বিপ্লব স্যার কী করেছে?”
হেমন্ত বলেন, “হয়তো বিপ্লব চেয়েছিল ওখানে স্কুল বানাতে… সাধুর নির্জনতা নষ্ট হত। সেই কারণেই… হয়তো তাকেই টেনে নিয়ে গেছে।”
আঁধারের শেষ ডাক
সকালে গ্রামের লোকেরা কুয়ো থেকে দুর্গন্ধ পায়। দড়ি ফেলে নামায় এক যুবক। কুয়োর তলায় তারা দেখতে পায় বিপ্লবের নিথর দেহ—চোখ ফাঁকা, ঠোঁট খোলা, শরীর থেকে রক্ত নিঃশেষিত।
পুলিশ আসে, ময়নাতদন্তে জানা যায় শরীরে আঘাত নেই, কিন্তু স্নায়ু ছিন্ন। মানে ভয় বা চাপেই মৃত্যু। অস্বাভাবিক।
রাম ওই রাতেই হারিয়ে যায়। সন্দীপ দেখতে পায়, সে হাঁটছে লোকগঠের দিকে, পেছনে একটা ছায়া হাঁটছে সঙ্গে। সে দৌড়ে যায়, কিন্তু পায় না কাউকে। শুধু কুয়োর ধারে একটা শব্দ—
“চলো…”
তারপর থেকে ঘাঘরা গ্রাম সন্ধ্যে নামলে নিঃশব্দ হয়ে যায়। কেউ বাইরে যায় না। কিন্তু মাঝরাতে বাতাসে এখনও ভেসে আসে সেই কণ্ঠস্বর—
“চলো… আমার সাথে চলো…”
সমাপ্ত।