তপন রুদ্র
চাঁপারডাঙা গ্রামে অভিরূপ যখন প্রথম পা রাখল, তখন সন্ধ্যার আলো একে একে গিলে নিচ্ছিল ঝোপঝাড়, কুঁড়েঘর আর ধুলোভরা কাঁচা পথ। কাঁকনজঙ্গল পেরিয়ে যে লোকালয়, সেখানকার মানুষজন ঠোঁট চেপে কথা বলে। অথচ তারা কথা বলে না, এমন নয়। শুধু অভিরূপ লক্ষ্য করেছিল—কোনো কিছু যেন তাদের চোখের পেছনে আটকে থাকে। কী যেন এক অজানা আশঙ্কা, ঠিক ধরা যায় না, ছুঁয়ে ফেলা যায় না, কিন্তু টের পাওয়া যায় বাতাসে, গন্ধে, চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে।
অভিরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে একটি এনজিও-র টিচিং প্রজেক্টে চাকরি নিয়েছে। গ্রামবাংলায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার নোবেল মিশন। তৃতীয় পোস্টিং এই চাঁপারডাঙা। এর আগেও দু’টি গ্রামে ছিল, কিন্তু এমন অনুভূতি কখনও হয়নি—মনে হচ্ছিল, চারপাশের গাছ, মাটির ঘর, এমনকি নীলচে মেঘও যেন কোনও রহস্য জানে, যেটা অভিরূপ জানে না। গ্রামের প্রধান রঘুনাথবাবু তাকে নিয়ে গেলেন পুরনো স্কুলঘরের পাশের একটি খালি কোয়ার্টারে। তিনঘরো একটি মাটির ঘর, একটা ছোট রান্নাঘর, একটা খাট, ছেঁড়া মশারি, আর এক টিনের আলমারি। অভিরূপ বলল, “চলবে।” রঘুনাথবাবু একগাল হেসে বললেন, “শহরের ছেলেরা বড্ড নরম হয়, আপনি একটু শক্ত হোন। এই গ্রামে রাতটা গভীর।”
কথাটার মানে তখন বুঝতে পারেনি সে। তবে প্রথম রাতেই একটু আঁচ পেল।
রাত তখন সাড়ে দশটা। অভিরূপ শহর থেকে আনা বইগুলো গুছিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিল একটু জল খেতে। হঠাৎ তার পা আটকে গেল একটা কাঁসার থালায়। নিচে পড়ে ছিল থালাটা। ভেতরে তিনটে শুকনো ডিম, একটা রক্তের দাগ, আর তার মাঝখানে ত্রিভুজের মধ্যে আঁকা একটি চোখ—তান্ত্রিক প্রতীক বলে মনে হল। মাটি খুঁড়ে যেন কারো শিকড় বেরিয়ে এসে তাকে টেনে ধরছে।
সে ঝুঁকে দেখল, ডিমের চারপাশে ক্ষুদ্র লাল রেখায় লেখা কিছু শব্দ—কিন্তু সেটা কোনও ভাষায় লেখা ছিল না যা অভিরূপ চিনত। ওগুলো যেন শুধুই প্রতীক, কিন্তু তাদের দেখলে বুকের মাঝে যেন একটা চাপা ধাক্কা লাগে।
তবে অভিরূপ নিজেকে হাসিয়ে বলল, “অন্ধবিশ্বাস। নিশ্চয়ই গ্রামের কোনো ছেলে মজা করছে। হয়ত ওরা শহরের লোক দেখলে ভয় দেখায়।”
সে থালাটা দূরে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। একটা হালকা বাতি জ্বলছে। মশারির নিচে গিয়ে শুল সে। ঘড়ি তখন এগারোটা। বাতাসের শব্দ, জোনাকিদের ঝিকিমিকি আলো, কুকুরের হঠাৎ ডেকে ওঠা—সব মিলিয়ে সাধারণ রাতই বলা চলে।
কিন্তু হঠাৎ, একটা ঠাণ্ডা বাতাস বুক চিরে ঢুকে গেল অভিরূপের শরীরে। মশারির মধ্যে যেন কেউ বসে আছে! বুকের ওপর একটা ভারি অনুভূতি, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ খুলতে পারছে না, কিন্তু কান খোলা। একটা গলা শুনতে পেল সে—বিস্ময়করভাবে গভীর, কিন্তু গলার ভেতর যেন কেউ মাটি ঢুকিয়ে রেখেছে।
“তুই দেখিস… আগুনের চোখ নিয়ে এসেছিস, না? তোকে দিয়ে আমার কাজ হবে…”
আচমকা এক ঝাঁকুনি দিয়ে অভিরূপ উঠে বসল। কপাল ভিজে, ঘাম, কিন্তু রুমাল খুঁজে পাচ্ছে না। আলো জ্বালিয়ে দেখল—ঘর ফাঁকা। জানালা খুলে বাতাস ঢুকছে। মেঝেতে এখনও পড়ে আছে সেই কাঁসার থালা, কিন্তু এখন ভেতরে কিছুই নেই।
সে জানালা বন্ধ করে দিয়ে টেবিলের সামনে বসল। তার শহরের জীবন যেন দূরের স্বপ্ন, আর এই বাস্তব যেন দুঃস্বপ্ন। তবে এইসবকে গায়ে না মাখার মানুষ অভিরূপ। সে স্নান করে স্কুলের জন্য তৈরি হলো পরদিন সকালে।
গ্রামের স্কুলটাও পুরনো—দু’ঘরো কাঠের গঠন, মাথার ওপর খড়ের চাল। ছাত্রদের চোখ বড়, কিন্তু কৌতূহল যেন নেই। তারা যেন খুব ছোট বয়সে সব জেনে গেছে—মৃত্যু, জন্ম, ভয়, অন্ধকার। অভিরূপের চোখে এটা বড় বিস্ময়। সে তাদের গল্প শোনায় রবীন্দ্রনাথের, শরদিন্দুর—আলোর গল্প, জ্ঞানের গল্প, স্বপ্নের গল্প। এক ছাত্র, নাম বিপ্লব, বলল, “স্যার, এইসব আমাদের কাজে লাগে না। আমাদের গ্রামের লোকেরা বলে জ্ঞান যাদের বেশি হয়, তারাই আগে মরে।”
অভিরূপ বলল, “কে বলে এসব?”
ছেলেটা বলল, “তান্ত্রিক গহীনচাঁদ বলত। তার নাম শুনেছেন?”
অভিরূপ হেসে বলল, “না। সে কি তোমাদের শিক্ষক ছিল?”
ছেলেটা হঠাৎ চুপ করে গেল। চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সে ছিল তান্ত্রিক। এখনো আছে। ছায়ার মতো ঘোরে… যাদের চোখে আগুন, তাদের সে নিজের করে নেয়।”
এই কথা শুনে স্কুলের অন্য ছাত্ররা যেন একটা অদৃশ্য সংকেতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কেউ কিছু বলল না।
সেদিন বিকেলে অভিরূপ গেল গ্রামের মন্দিরে। পুরোহিত নেই, শুধু একটি কালো পাথরের কালীমূর্তি আর তার সামনেই একটা ধ্বংসাবশেষ পুকুর, জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া। এক বৃদ্ধ বসে ছিলেন সেখানে—চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে চাপদাড়ি।
“আপনি কি পুরোহিত?” — জিজ্ঞাসা করল অভিরূপ।
“আমি ছিলাম। এখন পুরোহিত লাগে না। মা নিজেই বুঝে নেন।”
অভিরূপ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এই গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা ভয় দেখি… আপনি জানেন কিছু?”
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, “তুমি দেখেছ তাদের চোখে আগুন, তাই তুমি বুঝতে পারো। তান্ত্রিক গহীনচাঁদের কথা শুনেছ?”
“বাচ্চারা বলছিল। কিন্তু এটা কি কেবল গল্প?”
বৃদ্ধ বললেন, “গল্প ছিল। এখন আর নেই। গহীনচাঁদ ছিল এক পঞ্চমকার তান্ত্রিক—মদ, মাংস, মৎস্য, মৈথুন, मुद्रा—এই পাঁচের মধ্য দিয়েই সে খুঁজত শক্তির উৎস। বলি দিত মৃত মানুষের চুল, নববধূর রক্ত, জন্মানো শিশুর নাড়ি। গ্রামের লোকেরা একদিন তাকে ধরা পড়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু সে বলেছিল, তার আত্মা থাকবে এই বাঁশবনে, যেখানে রাত ঘনালে বাতাসও শব্দ করে না।”
অভিরূপ তখনো মনে করছিল, এসব অতিশয়োক্তি। সে হয়ত গল্পের রস নিয়ে যাচ্ছে শহরে ফেরার পরের জন্য।
কিন্তু রাতে আবার ঘটল অদ্ভুত কিছু।
রাত দেড়টা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। জানালার কাঁচে দেখা গেল বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—লম্বা, ছায়ার মতো গড়ন। কিন্তু কাঁচে তার মুখ নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, সেই ছায়া জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু অভিরূপ চোখ ফেরাতেই সেটা নেই।
তবে সে জানে কিছু একটা বদলাচ্ছে তার মধ্যে। শরীরের কোথাও একটা জ্বালা, যেন গলা বরাবর একটা রেখা নিচে নামছে, স্পর্শ করছে হৃদয়, আর সেখান থেকে শিকড় গজিয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর। আয়নায় চোখ রাখতেই দেখল—চোখের পাতা লাল, চোখের ভেতর যেন কিছু ঘুরছে, একটা তড়িৎ স্রোতের মতো।
হঠাৎ সে শুনল নিজের কণ্ঠে অন্য কারো গলা—
“আগুনের চোখ খুলেছে, গহীনচাঁদ ফিরে আসছে…”
তারপর বাতাস নিস্তব্ধ। রাত থমকে আছে। অভিরূপ জানে, সে আর আগের মানুষ নেই। কেবল একজন শিক্ষক নয়, এখন সে এক বাহক—এক তান্ত্রিক অভিশাপের ধারক।
সে জানে না, এই শক্তিকে সে জয় করবে, না কি এই ছায়াই একদিন তাকে গ্রাস করবে।
***
গ্রামের আকাশ সেই রাতে যেন আগুনের রঙে রাঙা হয়ে উঠেছিল। অভিরূপ বিছানায় বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। হাওয়ার দোলায় পর্দা দুলছে ধীরে ধীরে। বাতাস ভারী, নোনা গন্ধমাখা। কানে এল দুর থেকে শোনা একটা ধ্বনি—মন্ত্রের মতো। কিন্তু কেউ উচ্চারণ করছে না, অথচ শব্দটা মাথার মধ্যে গুঞ্জন তুলছে। “ওঁ ক্রীং কালিকা চামুণ্ডायै…” একেকটা ধ্বনি যেন মনের দরজায় হাতুড়ির মতো পড়ছে।
অভিরূপ ধীরে ধীরে জানালার পাশে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাল। বাঁশবনের দিকে গাছগুলো থেমে আছে, কিন্তু পাতার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কিছু ছায়া নড়ছে। গা ছমছম করা একটা অনুভূতি তাকে টেনে নিয়ে গেল দরজার দিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে সে এগিয়ে চলল বাঁশবনের দিকে, ঠিক যেন কারো ডাকে সাড়া দিয়ে। পেছনে কেউ নেই, সামনেও কেউ নয়, অথচ মনে হচ্ছে কেউ তাকে হাত ধরে টানছে।
বাঁশবনের মধ্যে ঢুকতেই চারপাশের শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ব্যাঙের ডাক, পোকা-মাকড়ের আওয়াজ, এমনকি নিজের নিঃশ্বাসও যেন শুনতে পাচ্ছে না অভিরূপ। তার হাত ঠান্ডা, পায়ের আঙুলে জোর নেই, কিন্তু সে থামছে না। হঠাৎ একটা ঝড়ো বাতাস ছুটে এসে তার চোখে ধুলো ঢেলে দিল। চোখ মুছতেই সে দেখতে পেল একটা পাথরের কাঠামো—ভগ্নদশা এক যজ্ঞমণ্ডপ। তার ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে আধপোড়া কঙ্কাল, আশেপাশে বৃত্তাকারে ছড়ানো আছে কিছু শুষ্ক ফুল, অদ্ভুত প্রতীক আঁকা কুমড়ো, আর ছাইয়ে ঢাকা কিছু পুস্তক।
অভিরূপ হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে গেল সামনে। সে এখন প্রায় নিশ্চিত, এটাই সেই স্থান যেখানে গহীনচাঁদকে পোড়ানো হয়েছিল। বাতাসে একটা পোড়া চুলের গন্ধ, মাটি যেন কাঁদছে, আর বৃত্তের মাঝখানটা একদম শুকিয়ে চামড়ার মতো শক্ত হয়ে গেছে। একদম মাঝখানে রাখা একটি পাথরে অদ্ভুত ভাবে খোদাই করা কিছু শব্দ—শুধু অভিরূপই বুঝতে পারল যেন সেগুলো তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে।
সে তখন পাথরটা ছুঁয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল—
তার চোখের সামনে খুলে গেল এক অতীতের দরজা।
সে দেখতে পেল—পুরনো সময়, অর্ধনগ্ন এক পুরুষ—গহীনচাঁদ। চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। তার চারপাশে কুণ্ডলীর মতো আগুন, মাঝখানে এক কিশোরী, তার মুখ বন্ধ, হাত-পা বাঁধা। সে চিৎকার করছে না, শুধু তাকিয়ে আছে আতঙ্কে। গহীনচাঁদ মন্ত্র জপছে—গলার স্বর তীব্র, রুদ্রাক্ষ নড়ে উঠছে প্রতিটি উচ্চারণে। হঠাৎ সে এক ছুরি তোলে, মেয়েটির কপালে স্পর্শ করে এবং…
“না!” বলে চিৎকার করে উঠল অভিরূপ।
সে ফিরে এল বর্তমান পৃথিবীতে। কপালে ঘাম, বুক ধড়ফড়। পেছনে তাকিয়ে দেখে, ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধ—যাকে সে কাল মন্দিরে দেখেছিল। কিন্তু এখন তার মুখে অদ্ভুত শান্তি, এবং গলার স্বর অপ্রত্যাশিতভাবে দৃঢ়।
“তুমি দেখেছ, না? এখন তুমি বুঝবে কেন এই গ্রাম ভয় পায়। তুমি ফিরে এসো, না হলে গহীনচাঁদ তোমার ভেতরে ঢুকে যাবে পুরোপুরি।”
অভিরূপ বলে, “কে আপনি?”
“আমি ছিলাম ওর ছাত্র। নাম ছিল দীনবন্ধু। প্রথমে ভাবতাম ও একজন গুরু, পরে বুঝলাম সে শয়তান। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। আমি তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি, শুধু মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে এখানে রয়ে গেছি—ওর ছায়ার প্রহরী হয়ে।”
“কিন্তু আমি? কেন আমাকে টেনে নিচ্ছে?”
“কারণ তোমার চোখে আছে সেই আগুন, যেটা আবার জাগাতে চায় গহীনচাঁদ। ওর আত্মা পুরোপুরি যায়নি, বেঁচে আছে যজ্ঞমণ্ডপের সেই পাথরের নিচে। সময় হলেই সে নিজের বাহক খোঁজে, আর এবার সে তোমাকে বেছে নিয়েছে।”
অভিরূপ হতবাক হয়ে চুপ করে গেল। তার মনে হচ্ছে মাথার ভেতর যেন দুই শক্তির লড়াই চলছে। একদিকে এক প্রাচীন ডাক, অপরদিকে তার নিজের স্বাভাবিক বোধ। সে মাথা নাড়ল, “আমি কিছুতেই সেটা হতে দেব না।”
বৃদ্ধ বললেন, “তুমি পারবে, যদি চাও। তবে তার আগে জানতে হবে পুরো ইতিহাস।”
অভিরূপ আর কিছু না বলে বৃদ্ধের সঙ্গে চলল তার কুঁড়ে ঘরের দিকে, বাঁশবনের মধ্যেই লুকানো। ঘরের ভেতর রাখা অজস্র পুরনো বই, হাতে লেখা নোট, পুঁথি। একটি বই সামনে এনে বৃদ্ধ বললেন, “এটা গহীনচাঁদের লেখা। ওর ‘তন্ত্রসিদ্ধি’-র দিনলিপি। বহু বছর ধরে আমি একে অনুবাদ করেছি।”
অভিরূপ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখতে পেল—এমন সব মন্ত্র, যজ্ঞপ্রক্রিয়া আর বলিপর্ব, যা এক সময় কেবল পৌরাণিক গল্পে শুনেছে। কিন্তু এখানকার বর্ণনা এত নিখুঁত, এত সরাসরি, যেন লেখক নিজেই অভিজ্ঞ।
এক পাতায় লেখা—
“যে দেহে আগুনের চিহ্ন, সেই দেহই পূর্ণ শক্তির আধার। ছায়া জাগবে তার হৃদয়ে, যিনি সংরক্ষণ করতে জানেন, তিনিই হবে মোক্ষের বাহক, না হলে হবে সর্বনাশ।”
অভিরূপ বলল, “এখানে ‘মোক্ষ’ মানে কী?”
বৃদ্ধ বললেন, “এই মোক্ষ শুদ্ধ নয়, মুক্তির নয়। এটা এক আত্মিক শত্রুতা, যেখানে আত্মা অন্য আত্মাকে গ্রাস করে এবং চূড়ান্ত তান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জন করে। গহীনচাঁদ চেয়েছিল নিজের আত্মাকে অন্য দেহে স্থাপন করতে, যাতে সে অমর হয়।”
“আর সে দেহ আমি হতে যাচ্ছি?” — গলা শুকিয়ে এল অভিরূপের।
“হ্যাঁ, যদি তুমি নিজে তা প্রতিহত না করো।”
“কী করতে হবে আমাকে?”
“তোমাকে ফিরে যেতে হবে যজ্ঞমণ্ডপে, ঠিক পূর্ণিমার রাতে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিরোধ করতে হবে—তাঁর ডাক, তাঁর প্রতিশ্রুতি, তাঁর শক্তিকে। কিন্তু তার আগে তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে। তার আগে জানতে হবে, তুমি কেন নির্বাচিত।”
অভিরূপ ফিরল ঘরে। তার মাথা তখন গুমগুম করছে। সে জানে—এই পথ সে নিজে বেছে নেয়নি, কিন্তু এখন সে পথের কেন্দ্রে। রাতে ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে আগুনের মধ্য দিয়ে হাঁটছে সে, তার গায়ে আগুন লাগেনি, কিন্তু আশেপাশে সব পুড়ে ছাই। একজন তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে—চোখজোড়া লাল, দাঁত ভাঙা, এবং ঠোঁটের কোনে রক্ত।
সকালে উঠে অভিরূপ দেখল দরজার সামনে রাখা কাঁসার থালা আবার ফিরে এসেছে। এবার ভেতরে একটি লাল ফুল—রক্তজবা, যার পাপড়িতে লেখা আছে—“এসো, রাত এসেছে।”
সে জানে, সেই রাত এখন খুব কাছেই।
***
পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই আজ চাঁপারডাঙার বাতাসের ঘ্রাণ বদলে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই অভিরূপ জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল, গ্রামের প্রতিটি ঘর যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছে। মাটির চাল থেকে ধোঁয়া উঠছে না, পাখির ডাক নেই, এমনকি কুকুরের গলার স্বরটাও যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই নিরবতা কোনো স্বাভাবিক ভোরের নয়, এ নিরবতা যেন অপেক্ষার—কিছু আসন্ন ভয়াবহতার জন্য প্রস্তুতির।
অভিরূপ বসল টেবিলের সামনে। তার সামনে খোলা দীনবন্ধুর দেওয়া বইটা, গহীনচাঁদের হাতের লেখা, আর পাশে রাখা একটা সাদা খাতা। সে চেষ্টারত—ভয়কে যুক্তির মুখোমুখি দাঁড় করানোর, নিজের ভেতরে জেগে ওঠা তন্ত্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার।
সে বুঝে গিয়েছে—পুরো গ্রামে কেউই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় যতক্ষণ না এই ‘জাগরণ’ বন্ধ করা যায়। আর জাগরণ বন্ধ করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে: “তন্ত্র কী চায়?”
দিনের বেলা বৃদ্ধ দীনবন্ধুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে জেনেছে, “তন্ত্রজাগরণ” আসলে আত্মিক শূন্যতার দরজা—যেখানে একজন ব্যক্তি ক্রমে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে এবং এক নির্ধারিত শক্তির বাহক হয়ে ওঠে। গহীনচাঁদ, সেই পঞ্চমকার তান্ত্রিক, বহু বছর ধরে এই শক্তিকে খুঁজছিল—আগ্নেয় চোখধারী বাহক, যে নিজেকে বিলিয়ে দেবে তন্ত্রের ভেতরে।
“তুমি সেই বাহক,” দীনবন্ধু আগের রাতেই বলেছিলেন। “কিন্তু যদি তুমি তোমার চিন্তাশক্তিকে প্রখর করো, তোমার ভেতরের বিশ্বাসে স্থির থাকো, তাহলে তুমি শুধু বাহকই নয়, তুমি হতে পারো শেষ রক্ষক—এই গ্রামের, এই লোককথার, আর নিজেকেও রক্ষা করতে পারো।”
আজকের রাত পূর্ণিমা। আজ রাতেই যজ্ঞমণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে তন্ত্রজাগরণ।
অভিরূপ সকাল থেকে প্রস্তুতি শুরু করল। প্রথমে সে একান্তে বসে মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা সমস্ত ভয়কে কাগজে লিখে ফেলল। ‘আমি ভীত’, ‘আমি দুর্বল’, ‘আমি হারাতে চাই না’, ‘আমি মরতে চাই না।’ তারপর একে একে তা ছিঁড়ে ফেলল এবং বলল, “তুমি কেবল আমার ভাবনা ছিলে, আমার ভবিষ্যত নও।”
দীনবন্ধু তাকে দিল একটি ত্রিনেত্র তাবিজ—মা কালী শক্তির প্রতীক। বলল, “এটি তোমার চেতনায় জাগরিত শক্তিকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে, যদি তুমি বিশ্বাস করো।”
অভিরূপ চুপ করে তাবিজটা গলায় পরল। তার মাথা তখন ঝিমঝিম করছে, গলার ভিতর থেকে উঠে আসছে গাঢ় আওয়াজ—“এসো… আগুনে এসো…”
বিকেলের দিকে সে গিয়েছিল স্কুলে। শিশুদের বলেছিল আজ ছুটি। কিন্তু বিপ্লব, সেই চোখচোরা বালকটি তাকে বলেছিল, “স্যার, তুমি আজ বাঁচবে না। আমরা সবাই জানি, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।” অভিরূপ ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “আমি যদি ফিরে আসি, তোমাদের একটা নতুন গল্প শোনাব, যেটা আর কখনো কেউ বলেনি।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। পশ্চিম আকাশ রক্তিম। বাঁশবনের ভেতর সেই যজ্ঞমণ্ডপের সামনে অভিরূপ দাঁড়িয়ে, হাতে আগরবাতি, গলায় তাবিজ, আর মাথার ভেতরে নিঃশব্দ এক যুদ্ধ। চারদিকে গাছগুলো যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পাতারা কাঁপছে না, অথচ ছায়া নড়ছে। সে জানে, শুরু হচ্ছে।
হঠাৎ মাটির ভেতর থেকে কাঁপুনি উঠল। যজ্ঞমণ্ডপের চারপাশে জ্বলতে শুরু করল আগুনের পাঁচটি মশাল। কেউ আসেনি, অথচ আগুন জ্বলছে। বাতাস ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠছে। গন্ধে শুঁকে মনে হচ্ছে ধূপ আর পোড়া চামড়ার মিশ্রিত ঘ্রাণ।
সেই মুহূর্তে অভিরূপের মাথার ভেতরে কণ্ঠ—গহীনচাঁদের।
“তুই এসে গেছিস, বাহক। এখন তোকে চুক্তি করতে হবে। তুই পাবি শক্তি, প্রতিপত্তি, অমরতা, কিন্তু তোর নাম, শরীর, আত্মা—সব আমি গ্রহণ করব।”
অভিরূপ চিৎকার করে বলল, “না! আমি তোর বাহক হতে আসিনি, আমি এসেছি তোর ইতি টানতে।”
মাটির কাঁপুনি বেড়ে গেল। আগুন হঠাৎ করে গা ছুঁয়ে যেতে লাগল তার, কিন্তু জ্বলছে না! সে বুঝতে পারছে—তন্ত্রের শক্তি ওকে গ্রহণ করতে চাইছে, কিন্তু তার ভেতরে এখন প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
সে চোখ বন্ধ করল। মনঃসংযোগ করল। মাথার ভেতরে নিজের কণ্ঠকে স্পষ্ট করল—
“আমি অভিরূপ। আমি শিক্ষক। আমি মানুষ। আমি কারো বাহক নই। আমি আলো আনতে এসেছি, অন্ধকার হতে নয়।”
ঠিক তখন, মণ্ডপের মাঝখান থেকে উঠে এল এক কুয়াশার অবয়ব। ধীরে ধীরে সে রূপ নিচ্ছে। দুই চোখে আগুন, মুখে কালো ফোঁটা, ঠোঁটের কোণায় রক্ত। সে গহীনচাঁদ।
“তোকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখেছি, অভিরূপ। তুই ফিরে যাবি না। আজ তুই আমার হবে।”
অভিরূপ গলা শক্ত করে বলল, “তুই বলি চাস? এস, আমার মন পাবে না। আমি এই আগুনে নিজেকে দেব, কিন্তু তোকে না।”
সে আগুনের বৃত্তের ভেতরে ঢুকে পড়ল, চোখ বন্ধ করল এবং উচ্চারণ করল—
“মা কালী! তোমার চরণে এই শরীর, এই আত্মা, এই ভয়—সব সমর্পণ করলাম। আমাকে শক্তি দাও, নয়তো শত্রুকে পুড়িয়ে দাও।”
ঠিক তখন এক বিদ্যুৎ নেমে এল আকাশ থেকে। আগুন এক ঝটকায় গহীনচাঁদের কুয়াশা-দেহকে ঘিরে ধরল। সে আর্তনাদ করল—
“না! এটা চুক্তির নিয়ম নয়! এটা ছলনা! তুই তোর ভয়কে জিতিয়ে দিলি!”
অভিরূপ তখনো চোখ বন্ধ। চারপাশের আগুন একে একে নিভে যাচ্ছে। বাতাসের ভার হালকা হচ্ছে। পায়ের নিচে যে কাঁপুনি, তা থেমে গেল।
সে চোখ খুলে দেখে—চারপাশে আর কেউ নেই। যজ্ঞমণ্ডপ ফাঁকা, কেবল মাঝখানে পড়ে আছে সেই পুরনো পাথর। আর তার উপরে লেখা—
“আলো আসবে সেই দিন, যেদিন কেউ ভয়কে আগুনে ফেলে দেবে।”
অভিরূপ হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এল বাঁশবন থেকে।
পেছনে পড়ে থাকল বহু প্রাচীন তান্ত্রিক আত্মার শেষ প্রলয়।
আর সামনে সূর্যের প্রথম আলো—নতুন দিনের মতো নিঃশব্দ, অথচ প্রাণবন্ত।
***
ভোরের আলো যখন পুকুর পাড়ে লেগে প্রথম সোনালি রেখা ছড়াচ্ছিল, তখন অভিরূপ ধীরে ধীরে বাঁশবন থেকে বেরিয়ে আসছিল। তার শরীর ক্লান্ত, গায়ে আগুনের গন্ধ, চোখ লাল হয়ে আছে নির্ঘুম রাতের দহন থেকে। কিন্তু তার মন—বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। ভয় নেই, অস্থিরতা নেই, আছে শুধু এক অনুভব—একটা লড়াই শেষ হয়েছে।
কিন্তু সে জানে, শেষ সবসময় শেষ হয় না। কেউ না কেউ বেঁচে থাকে ছায়ার ভিতরে। আর তন্ত্র—সে তো কেবল শক্তি নয়, সে এক অভিসার—যা চুপিসারে ঢুকে পড়ে মানুষের বিশ্বাসে।
অভিরূপ ফিরে এল নিজের ভাড়া ঘরে। দরজার সামনে একটা ছোট থলে রাখা। সে খুলে দেখে ভিতরে কিছু কাঠ কয়লা, শুকনো তুলসীপাতা, আর একটি রক্তমাখা তুলো। কারও হাতে চিরুনি আঁচড় দেওয়া চিঠি—
“শেষ বলি বাকি, অভিরূপ। তুমি জিতেছো, কিন্তু আমি হারিনি। আমি এখন তোমার ভিতরে। যদি সাহস থাকে, এসো পুরোনো শ্মশান ঘাটে। এই পূর্ণিমায় শেষ খেলা।”
চিঠিটা কেউ লিখেছে কালো কালি দিয়ে, কিন্তু শেষের শব্দগুলো যেন কেঁপে লেখা—যেন কেউ অদৃশ্য হাত দিয়ে চেপে রেখেছে কাগজটা।
অভিরূপ বুঝে গেল—গহীনচাঁদ একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। সে কোথাও এক কোণে নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। আর সেটাই শেষ বলি।
সে দীনবন্ধুর খোঁজে গেল, কিন্তু বৃদ্ধ তখন ঘরের ভিতরে প্রায় নিঃসাড়। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, চোখ অদ্ভুত রকমের স্থির। মনে হচ্ছে তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, শুনতেও পাচ্ছেন না, কেবল বিছানায় শুয়ে আছেন এক নিস্তব্ধ পুতুলের মতো। অভিরূপ বুঝল, সময় নেই।
পুকুরপাড়ে এসে সে একবার নিজের মুখ দেখল জলে। সেখানে সে যাকে দেখল, তা একেবারে সে নয়—চোখে গভীরতা, গালে ছায়া, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত কৌতুক। গহীনচাঁদ তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে—ধীরে ধীরে, চুপিসারে, যেন ধোঁয়ার মতো।
অভিরূপ জিভ কামড়ে আপন মনে বলল, “তুই যা চাস, আমি তা দিব না। তুই যা করিস, আমি নিজেকে ছেড়ে দিব না।”
রাত হতে দেরি ছিল না। গ্রামে খবর রটে গেল—পুরনো শ্মশান ঘাটের কাছে আগুন দেখা গেছে, অদ্ভুত ছায়া চলাচল করছে। কেউ কেউ বলল, গহীনচাঁদ ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলল, অভিরূপ পাগল হয়ে গেছে।
অভিরূপ, একা, হাতে কেবল একটি প্রদীপ আর গলায় ত্রিনেত্র তাবিজ পরে রওনা দিল সেই পুরনো শ্মশান ঘাটের দিকে।
পথে কারো দেখা পেল না। বাতাস থেমে গেছে, গাছগুলো নিঃস্পন্দ, এমনকি জোনাকপোকার আলোও নিভে গেছে আজকের রাতে।
শ্মশানঘাটে পৌঁছে সে দেখল—একটা আগুন জ্বলছে মাঝখানে। চারপাশে ঘিরে রেখেছে শ্মশানের পুরনো শিলাখণ্ড, যেগুলোতে অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা।
আগুনের ঠিক ওপারে দাঁড়িয়ে আছে গহীনচাঁদ—এইবার সম্পূর্ণ রূপে, স্বচ্ছ, জ্যান্ত। তার মাথা ন্যাড়া, চোখ গভীর, শরীর অর্ধনগ্ন, আর হাতে সেই ছুরি—যেটা তন্ত্রবলে বলি দেওয়া হতো।
“তুই চলে এসেছিস। বাহক, আজ তোর সত্যিকারের জন্ম হবে।”
“আমি তোর বাহক নই,” অভিরূপ বলল, “তুই এক অসুখ, এক দাহ, তোর কোনো অস্তিত্ব নেই।”
গহীনচাঁদ এগিয়ে এল এক পা, তারপর আরেক পা। প্রতিটি পায়ের ছাপে আগুন জ্বলতে শুরু করল। বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
“তুই বুঝিস না, অভিরূপ। আমি তোর ভিতরেই আছি। তুই আমার দেহ, তোর চোখে আগুন, তোর জিভে তন্ত্র। আমি তোকে বলি দেব, তুই নিজেই নিজেকে।”
অভিরূপ ধীরে ধীরে প্রদীপটা নিয়ে আগুনের বৃত্তের ভেতরে গেল। তারপর মাটিতে বসে পড়ল পদ্মাসনে। সে চোখ বন্ধ করল, মনোযোগ করল নিজের হৃদস্পন্দনে।
গহীনচাঁদ চিৎকার করে উঠল, “তুই কী করিস?”
“আমি শেষ বলি দিচ্ছি, কিন্তু তোকে না—আমার ভয়কে। আমি যেটা এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছি, সেই অহংকে, সেই কল্পনাকে, সেই ছায়াকে।”
তার কণ্ঠে উচ্চারিত হল এক প্রাচীন মন্ত্র, যেটা সে খুঁজে পেয়েছিল দীনবন্ধুর বইয়ে—
“অহংকারং विसर्जयामि। भयम् विसर्जयामि। छायाम् विसर्जयामि। ज्वलतु आत्मा।”
হঠাৎ এক তীব্র আলো নেমে এল তার মাথার উপর। আগুন উল্টো ঘুরতে লাগল, যেন উন্মত্ত হয়ে। গহীনচাঁদ পিছিয়ে গেল কয়েক পা, তার শরীর ফেটে যাচ্ছে আলোয়।
“না! এটা আমার নিয়ম নয়! তোকে আমি তৈরি করেছিলাম! তুই আমার উত্তরসূরি!”
অভিরূপ তখন দাঁড়িয়ে পড়েছে আগুনের মধ্যে। তার শরীর থেকে যেন রশ্মি বেরোচ্ছে, চোখে জ্বলছে নিঃসঙ্গ এক আলোকবিন্দু।
“তুই কিছু তৈরি করোনি। আমি মানুষ, আমার ভিতরে ভয় ছিল, কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসা দিয়েছি। আমি শিক্ষক, তুই শুধু ছায়া।”
শেষ কথাটা উচ্চারিত হতেই গহীনচাঁদ হাওয়ার মতো উড়ে গেল, চিৎকার করতে করতে মিলিয়ে গেল আগুনের আলোর মধ্যে।
অভিরূপ তখন নিঃশব্দে বসে পড়ল মাটিতে। আকাশে তখন পূর্ণিমা ঝলমল করছে, বাতাসে বাজছে অজানা এক সুর—যেটা শান্তির, যেটা মুক্তির।
—
পরদিন সকালে চাঁপারডাঙার মানুষ দেখতে পেল—শ্মশানঘাটে আগুন নিভে গেছে, মাঝখানে পড়ে আছে একটি ছাইয়ের বলি-পাত্র, আর তার পাশে একটি তাবিজ।
অভিরূপ ফিরে এসেছিল, ক্লান্ত, কিন্তু জাগ্রত। সে স্কুলে গেল, ক্লাসে বসে পড়ানো শুরু করল। শিশুরা তার চারপাশে ঘিরে বসেছে।
“স্যার, তুমি কেমন গল্প বলবে আজ?”
অভিরূপ একটু হেসে বলল, “আজ বলব একটা গল্প, যেখানে ছায়া শেষ হয় আলোয়।”
***
চাঁপারডাঙা যেন ধীরে ধীরে নিজের পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে। যেখানে আগে সন্ধ্যার পর ঘরের দরজা বন্ধ হত ভয় থেকে, এখন সেখানকার মানুষ খোলা বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে গল্প করে।
অভিরূপ এখন আর শুধু একজন স্কুল শিক্ষক নন, তিনি এই গ্রামের এক নীরব পথপ্রদর্শক। কেউ আর আজ গহীনচাঁদের নাম উচ্চারণ করে না, কিন্তু সবাই জানে—একদিন এক অন্ধকার এসেছিল, আর একজন মানুষ তাকে জিতিয়ে দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল আলো।
দীনবন্ধু মারা যান এক শীতের সকালে, নিঃশব্দে। তার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল একটা পুরোনো খাতা, যাতে লেখা ছিল—
“যে ভয়কে আলিঙ্গন করতে পারে, সে তন্ত্রকে রুখতেও পারে। অভিরূপ তা পেরেছে। সে আমার শেষ শিক্ষার্থী নয়, সে তন্ত্রের পাঠশালার প্রথম শিক্ষক।”
অভিরূপ মাঝে মাঝে একা চলে যায় সেই পুরনো শ্মশান ঘাটে, যেখানে এখন আর কোনো আগুন জ্বলে না, কেবল শান্ত বাতাস বইয়ে যায় তার মুখের উপর দিয়ে। সে চোখ বন্ধ করে বলে—
“তুই ছিলি, আমি জানি। কিন্তু তুই ছিলি আমার ভিতরের ভয়। তোকে আমি মানি, তবু তোকে আমি থাকতে দিইনি।”
ছাত্ররা এখন তাকে ঘিরে ধরে, বলে—“স্যার, আপনি গল্প লেখেন না কেন?”
সে একটু হেসে বলে, “একদিন লিখব, যখন এই গ্রামের মানুষ আর কখনো ছায়া বলতে ভয় পাবে না।”
আকাশে তখন সন্ধ্যার তারা উঠে গেছে, গাছের পাতায় ঝিকিমিকি আলো। চাঁপারডাঙা এখন আর একটা গ্রাম নয়, এটা এখন এক আলোয় ভরা নাম—
“যেখানে মানুষ ভয়কে জিতিয়ে দিয়েছিল।”
—
শেষ




