অধ্যায় ১:
রাত তখন নেমে এসেছে। চারদিক অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। ময়ূরগঞ্জ গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে আসছে রাহুল আর বাপন। শহর থেকে সরু রাস্তা পেরিয়ে বহু কষ্টে এসেছে তারা। শহরের কোলাহল পেরিয়ে গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন এক অজানা রহস্যের মতো তাদের বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
রাহুল বলল, “শোন, বাপন, কেমন অদ্ভুত শান্তি, না?”
বাপন কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ঠিক করতে করতে বলল, “হ্যাঁরে, শহরের তুলনায় কতটাই না শান্ত! তবে এই শান্তির ভেতরেও একটা কেমন জানি গা ছমছমে ভাব… যেন কেউ আমাদের দেখছে।”
রাহুল হেসে ফেলল। “তুই আবার ভূতের ভয়ে ভয় পাচ্ছিস নাকি?”
বাপন ম্লান হাসি হেসে বলল, “আরে না, তবে গ্রামটা আসলে রহস্যময়। শুনেছি, আমাদের বাড়ির পেছনের জানালাটা অভিশপ্ত।”
“ধুর, ওইসব গাঁজাখুরি কথা। এসব গুজব শহরে থাকতে শুনেছি। আসলে বাড়িটা পুরনো বলে লোকে গল্প বানায়,” রাহুল বলল।
বাপন চুপ করে গেল। রাতের বাতাসে তাদের কথা যেন মিলিয়ে গেল। দূরে একটা কুকুর ডাকল, তারপর আবার নিস্তব্ধতা।
শ্যামল ভিলা ওদের ঠাকুরদাদার বাড়ি। রাহুলের বাবার মৃত্যুর পর বাড়িটা আর কেউ দেখতে আসেনি। সেকেলে ধাঁচের বড় বাড়ি, লাল রঙের ইট, আর পেছনে সেই berai দেওয়া বাগান—যেখানে নাকি রাতের বেলা অশরীরী দেখা যায়।
তারা বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই একটা বাদুড় ছোঁ মেরে উড়ে গেল। বাপন একটু আঁতকে উঠল। রাহুল এগিয়ে গিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরের বাতাস সোঁদা আর ভিজে গন্ধে ভরা। খালি, নীরব, অথচ কেমন একটা অজানা স্পন্দন।
“আরে, আলো জ্বালিয়ে দে তো,” বাপন বলল।
রাহুল মোমবাতি জ্বালাল। মোমের আলোয় দেওয়ালজোড়া ফ্রেমে ফ্রেমে দাদু-দিদাদের ছবি। ছায়া ফেলে রেখেছে জানালার ওপর।
“এই যে পেছনের জানালা,” রাহুল বলল, “দেখলি তো? ঠিক কিছুই নেই। সবই গুজব।”
বাপন হেসে বলল, “তবু রাতের বেলা কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকে।”
রাহুল হেসে বলল, “তুই ভয় পাস না। কাল সকালে সারা বাড়িটা ঘুরে দেখব।”
কিন্তু রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটার নিস্তব্ধতা যেন আর নিস্তব্ধ রইল না। দেওয়ালের ফাটলে বাতাস ঢুকে কেমন অদ্ভুত শব্দ তুলল। মোমের আলো নড়ে উঠল। আর ঠিক তখনই পেছনের জানালার কাঁচের গায়ে এক ম্লান ছায়া দেখা গেল। যেন এক নারীর অবয়ব। সাদা শাড়ি, এলোমেলো চুল—কিন্তু মুখ নেই!
রাহুল আর বাপন সেই অদ্ভুত ছায়াকে চোখের সামনে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বুকের ভেতর অজানা এক কাঁপুনি ধরা দিয়েছে। বাতাসে যেন ঠান্ডা হয়ে এসেছে—একটা অচেনা শীতলতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। মোমবাতির আলো ততক্ষণে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষীণ হতে শুরু করেছে, যেন এই ছায়ার ওজনেই আলোর তেজ নেমে যাচ্ছে।
“রাহুল… ওটা কি সত্যিই…?” বাপন ফিসফিস করে বলল, গলার স্বর ভয়ে কেঁপে উঠল।
রাহুলও এবার গম্ভীর। গলার ভর সরে গেছে। সে জানালার দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করল, যেন কিছুটা সাহসী হতে চাইছে।
“দাঁড়া…দেখি…” সে ধীরে ধীরে পা বাড়াল জানালার দিকে। কাঁচের ওপাশে ছায়াটা যেন দাঁড়িয়ে আছে, আরেকটু স্পষ্ট। এবার মনে হলো তার চোখের জায়গায় দুইটি ফাঁকা গহ্বর—কালো, শূন্য, অথচ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
“রাহুল, ফিরে আয়!” বাপন আঁকড়ে ধরল রাহুলের হাত।
“দাঁড়া, আমাকে দেখতে দে…” রাহুল ফিসফিস করে বলল। তার চোখে কৌতূহলের রঙ। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ করে সেই ছায়া কাঁচের ভেতর থেকে যেন ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে এল!
রাহুল চমকে গেল—একটা মৃদু বাতাস গায়ে এসে লাগল, কেমন যেন কাঁপন ছড়িয়ে দিল মেরুদণ্ড বেয়ে। তারপর হঠাৎ করেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল!
কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা।
বাপন ঘামতে ঘামতে বলল, “দেখলি তো? বলেছিলাম না… এটা কোন মানুষের ছায়া নয়…!”
রাহুল কাঁপা গলায় বলল, “তুই ঠিকই বলেছিলি… এ যে অশরীরী…!”
মোমবাতির আলো তখন প্রায় নিভে এসেছে। রাহুল দ্রুত টর্চ জ্বালাল। টর্চের আলোয় চারপাশে ছুটিয়ে চাইল—কিন্তু জানালার ওপাশে এখন আর কিছুই নেই। কেবল ফাটল ধরা দেয়াল আর কাচের ওপরে লেগে থাকা ধুলো।
তাদের বুকের মধ্যে ভয় জমাট বেঁধেছে।
“এই জানালাটা তো আমাদের ছোটবেলায় এমন ছিল না, তাই না?” বাপন হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বলল।
রাহুল ভাবল।
“হ্যাঁ… তখন তো জানালার গ্লাসগুলো বেশ শক্ত ছিল, আর এই ছায়ার কোনো গল্পও শোনা যেত না। কবে থেকে এই গুজব ছড়াল?”
দূর থেকে কুকুরের কান্নার মতো আওয়াজ ভেসে এলো। রাহুলের গা শিউরে উঠল।
বাপন হালকা গলায় বলল, “তোর মনে আছে, দাদু ছোটবেলায় বলত, এই জানালার ধারে নাকি কারো মৃত্যু হয়েছিল?”
রাহুলের মনে ভেসে উঠল দাদুর সেই পুরনো গল্প।
“হ্যাঁ… দাদু বলত, সেই জানালার পাশে একবার এক বউমা গলায় দড়ি দিয়েছিল—বড় অন্যায় হয়েছিল তার উপর… কিন্তু কী অন্যায়, দাদু কিছুতেই বলত না।”
বাপন ভয় পেয়ে বলল, “তাহলে কি সেই মৃত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় এখানে?”
রাহুল এবার চুপ মেরে গেল। তার টর্চের আলোয় জানালার কাঁচের ওপরে দেখা গেল ছোট ছোট ফাটল আর আঁকাবাঁকা দাগ। মনে হলো, সেই দাগের ভেতর থেকে অশরীরীর দৃষ্টি উঁকি দিচ্ছে!
হঠাৎ একটা হাওয়া জানালার কাঁচে ধাক্কা দিল—টানটান করে কাঁপিয়ে তুলল কাঁচ। রাহুল আর বাপন উল্টোদিকের ঘরের দিকে দৌড় দিল।
দৌড়াতে দৌড়াতে বাপন বলল, “আমরা কী করব এখন?”
রাহুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে হবে। দেখবি, সকাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন নতুন করে দেখতে হবে।”
তারা বসার ঘরের একটা কোণায় গিয়ে বসল। চারপাশে অন্ধকার—মোমবাতিটাও নিভে গেছে। শুধু টর্চের ক্ষীণ আলো। দেয়ালের পুরনো ফটোতে দাদু-দিদাদের মুখগুলো যেন জীবন্ত হয়ে গেছে—সবার চোখে দৃষ্টি জমাট বেঁধে আছে।
হঠাৎ করে বাপন ফিসফিস করে বলল, “দেখ, ওই ছবিটা—দেখ না কেমন অদ্ভুত লাগছে!”
রাহুল ছবিটার দিকে তাকাল। সত্যিই, ছবিটার ফ্রেমের কাঁচ ফেটে গেছে—আর সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে যেন কারো চোখ দেখা যাচ্ছে! কিন্তু কে?
রাহুল চোখ কুঁচকে তাকাল।
“এ তো দাদুর ছবি… কিন্তু তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা কে? আগে তো কখনো দেখিনি!”
বাপন গলার স্বর নিচু করে বলল, “ওই মেয়েটার মুখেই অদ্ভুত কষ্টের ছাপ। ও কি সেই বউমা?”
রাহুল কিছু বলার আগেই হাওয়ার ঝাপটা টর্চ নিভিয়ে দিল। চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল। কেবল তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস শোনা যাচ্ছে—ভয়ে, আতঙ্কে।
হঠাৎ—একটা শীতল স্পর্শ রাহুলের কাঁধে এসে লাগল।
সে চিৎকার করে উঠল, “কে… কে আছে?”
কোনো উত্তর নেই, কেবল নিস্তব্ধতা। যেন অন্ধকারেই কেউ হাসছে—অদৃশ্য, অথচ খুব কাছেই!
রাহুলের চিৎকারে বাতাস কেঁপে উঠল। বাপন তড়িঘড়ি করে ওর দিকেই ছুটে গেল, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মোমবাতির আলো নিভে গেছে আগেই, আর টর্চটাও হাওয়ার ঝাপটায় নিভে গেছে।
“কে… কে আছে?” রাহুল কাঁপা গলায় বলল, কিন্তু কোনো উত্তর এলো না।
হঠাৎ করেই চারপাশের নিস্তব্ধতায় যেন একটা চাপা কান্নার আওয়াজ মিশে গেল—অদৃশ্য, অথচ ওদের দুইজনের কানে স্পষ্ট।
বাপন আঁতকে উঠল।
“রাহুল, তুই শোন… ওটা কার কান্না?”
রাহুল দ্রুত হাতড়ে পকেট থেকে মোমবাতির আরেকটা টুকরো বার করে আগুন ধরাল। আগুনের ক্ষীণ আলোয় চারপাশে কেবল ভাঙা ফার্নিচার আর ধুলোয় ঢাকা ছবি। কিন্তু কই—কেউ নেই।
তাদের সামনে সেই জানালাটা তখনও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপাশে ছায়ার খেলা—কখনো মুখ, কখনো অর্ধেক শরীর, কখনো কেবল দুটো শূন্য চোখ।
রাহুল বলল, “তুই কি বুঝতে পারছিস? এই বাড়িতে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। আমাদের দেখছে…!”
বাপন কান্না চেপে বলল, “আমরা এখানে আর এক মুহূর্তও থাকব না! চল এখান থেকে পালাই!”
কিন্তু রাহুল ওকে থামিয়ে বলল, “না! পালিয়ে গেলে সত্যি বোঝা হবে না। আমি জানি—আমার দাদুর সেই গল্পের মূলে কিছু একটা আছে। সেই বউমা… তার কান্না… তার মৃত্যু—সবকিছু… এই বাড়ি কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। আজ সেটা বের করেই ছাড়ব।”
বাপন শিউরে উঠল, কিন্তু বন্ধু রাহুলকে ফেলে কোথাও যাবে না।
“তাহলে কী করবি?”
রাহুল জানালার কাছে গিয়ে মোমবাতি উঁচু করে ধরল। সেই অদ্ভুত ছায়ার ফাঁকা চোখদুটি যেন মোমবাতির আলোয় ঝলসে উঠল। রাহুল সাহস সঞ্চয় করে বলল, “যদি তুই এখানে থাকিস… তাহলে নিজেকে দেখাও! কেন আমাদের সঙ্গে খেলছিস?”
অদ্ভুত বাতাস চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। দেয়ালের ফ্রেমগুলো কাঁপতে লাগল—ছবির কাচে লেগে থাকা ধুলো যেন বাতাসে উড়ে গিয়ে মোমবাতির শিখায় মিশে গেল।
হঠাৎ একটা কান্না—একটা মেয়ের কণ্ঠ।
“আমাকে… বাঁচাও…”
বাপন দমবন্ধ গলায় বলল, “শোন… ওটা মেয়ের গলা!”
রাহুল চিৎকার করে বলল, “কে তুমি? তুমি কি সেই বউমা? তুমি কি এখনো এখানেই আছ?”
কোনো উত্তর নেই। কেবল জানালার ওপাশে সেই ছায়া যেন কুয়াশায় মিশে গিয়ে আবার দূরে সরে গেল।
রাহুল এবার পেছনের ঘরের দিকে এগোল। সেই ঘরে একসময় তার দাদুর প্রিয় বইয়ের তাক ছিল। ধুলো মুছে তাক থেকে একটা ছোট খাতা বার করল। খাতার ওপর কালি ম্লান হয়ে এসেছে, তবে কয়েকটি শব্দ এখনো স্পষ্ট—
“ক্ষমা চাই… আমি পারিনি… ওকে বাঁচাতে…”
রাহুল চোখ বড় বড় করে পড়ল।
“দেখ বাপন, এখানে কিছু লেখা আছে!”
বাপন কাছে এসে পড়ল—
“ক্ষমা চাই… আমি পারিনি… ওকে বাঁচাতে… বউমা বলেছিল, ওর প্রাণ যাবে, আমি বিশ্বাস করিনি… ও মরল… আমি… আমি ওকে জানালার পাশে দড়ি দিলাম… ও আমাকে ডাকছিল…”
রাহুলের গলা কাঁপল।
“দাদু? তাহলে দাদুই ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী?”
বাপন ফিসফিস করে বলল, “তাহলে কি সেই বউমার আত্মা এখনো… এখানে…?”
বাতাসে হঠাৎ করে সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর আরেকবার ভেসে এলো—
“আমাকে বাঁচাও…”
মোমবাতির আলো নিভে যেতে যেতে যেন তার সঙ্গেই নিভে গেল সেই কণ্ঠস্বর। অন্ধকারে তারা দুজন পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরে রইল।
রাহুল হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল।
“তুই জানিস, বাপন? এই বাড়িটা… আমাদের দাদুর অভিশাপের ফল! উনি বউমার কান্না শুনেও ওকে বাঁচাতে পারলেন না! আর সেই মৃত্যুর অভিশাপ এখনো এই জানালায় লেগে আছে… ওর আত্মা জানালার ওপাশ থেকে আমাদের ডাকছে…”
বাপন কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে কী করব?”
রাহুল বলল, “আমি ওর কাছে যাব। কথা বলব। ওর সত্যি চাইলে মুক্তি দিতে হবে!”
বাপন হালকা গলায় বলল, “তুই পাগল? ওই আত্মা কি আমাদের ছেড়ে দেবে?”
রাহুল দৃঢ় গলায় বলল, “দাদুর অপরাধের বোঝা আমাদের ঘাড়ে। আমাদেরই মুক্তি দিতে হবে ওকে।”
একটা অদ্ভুত বাতাসের দমকা হাওয়ায় মোমবাতির ক্ষীণ আলো টিমটিম করে উঠল—আর তারপরই নিভে গেল।
দুই বন্ধুর কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
কেবল জানালার কাঁচের ওপাশে একজোড়া চোখ ভেসে রইল—দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল তাদের বুকের ভেতর।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “আমি যাচ্ছি…”
রাহুল নিঃশব্দে মোমবাতির শেষ শিখা নিভে যেতে দেখল। ঘরের ভেতর অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে এল। বাপনের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট—তার চোখগুলো যেন এখন আর মানুষ নয়, ভয়ার্ত কোনো প্রাণীর চোখের মতো দেখাচ্ছে।
রাহুল ধীরে ধীরে সেই জানালার দিকে এগোল। বাতাস থমকে গেছে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎই সেই জানালার ফাটল ধরা কাঁচের ওপাশ থেকে আবার সেই ছায়া দেখা দিল—এবার যেন স্পষ্টতর।
মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“আমাকে বাঁচাও… আমাকে মুক্তি দাও…”
রাহুল ঠোঁট কামড়ে বলল, “তুমি কি সেই বউমা? তুমি কি দাদুর কাছে বিচার চাও?”
অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটা এবার যেন কিছুটা ফিসফিস করে বলল, “আমার শ্বাসরোধ হয়েছিল… আমি মরতে চাইনি… ওরা বিশ্বাস করেনি… বিশ্বাসঘাতকতা…”
হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস যেন রাহুলের কাঁধ বেয়ে নামল, বুকের মধ্যে কাঁপুনি তুলে দিল। সেই বাতাসে যেন একবারেই স্পষ্ট করে শুনতে পেল সে—
“তুমি আমাকে বাঁচাবে?”
রাহুল চোখ বন্ধ করে সাহস সঞ্চয় করল।
“হ্যাঁ! আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চাই! কিন্তু বলো, কীভাবে?”
বাপনের গলা কেঁপে উঠল, “রাহুল, পাগল হয়ে যাস না! আমাদের পালাতে হবে! ওরা আমাদের মেরে ফেলবে!”
রাহুল বলল, “তুই ভয় পাস না। ও কেবল মুক্তি চাইছে।”
অদৃশ্য কণ্ঠস্বর এবার যেন আরও কাছে এল—
“তুমি প্রতিশ্রুতি দাও… আমার মৃত্যুর সত্যি বের করবে… আমার বিচার হবে…”
রাহুল দৃঢ় গলায় বলল, “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তোমার মৃত্যুর ইতিহাস আমি খুঁজে বের করব। সত্যি হবে—বিচার হবে। আমি জানি, আমার দাদু তোমার স্বামীকে বিশ্বাস করেননি, তোমাকেও করেনি… তোমার কান্না কেউ শোনেনি। কিন্তু আমি শুনছি।”
এক মুহূর্তে যেন চারপাশের বাতাস থমকে গেল। একটা অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ল সেই জানালার কাঁচের ভেতর থেকে—সোনালি কুয়াশার মতো। সেই কুয়াশায় ভেসে উঠল এক নারীর মুখ—শাড়ি পরা, কপালে সিঁদুর, চোখদুটোতে চাপা কষ্টের ছাপ।
সে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি আমাকে বাঁচালে… ধন্যবাদ… এখন আমি মুক্তি পেতে পারি…”
তারপর ধীরে ধীরে সেই আলো মিলিয়ে গেল।
রাহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। চারপাশে আবার অন্ধকার। বাতাসে একটা শান্তি নেমে এল—যেন আতঙ্কের ঘূর্ণি কেটে গিয়ে এখন সেখানে নির্জনতার ছায়া পড়েছে।
বাপন চোখ মুছতে মুছতে বলল, “তাহলে… শেষ? সে মুক্তি পেল?”
রাহুল ধীরে মাথা নাড়ল, “হয়তো। অন্তত এই ঘরটা থেকে ওর অভিশাপ সরে গেল।”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনের দরজায় ‘খটাস’ করে শব্দ হলো।
দুজনেই চমকে ফিরে তাকাল।
দরজাটা অল্প ফাঁক হয়ে গেছে, আর ফাঁক গলে অদ্ভুত অন্ধকার ঢুকে পড়েছে। যেন সেই অন্ধকারের গায়ে কারো ছায়া লেগে আছে—দুটি শূন্য চোখ আর একটা ফাঁকা হাসি।
রাহুল গলা শুকিয়ে বলল, “এবার কী…? তাহলে কি… ও ছাড়া কেউ আছে এখানে?”
ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, আর একটা ফিসফিসানি শোনা গেল—
“তুমি কি ভেবেছ, এ কেবল ওর গল্প? এই ভিলা অনেকের কান্না শোনে… অনেকের রক্তের দাগ লেগে আছে… তুমি কেবল শুরু করেছো…”
বাপন আর রাহুল একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরল।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “তাহলে… আমাদের যুদ্ধ কেবল শুরু?”
ছায়াটা এবার যেন অট্টহাসি হাসল—
“হ্যাঁ… এই শ্যামল ভিলা কারোই ক্ষমা করে না…!”
চারপাশের বাতাস আবার কাঁপতে লাগল। সেই অদ্ভুত অন্ধকার এবার ওদের ঘিরে ধরল—মোমবাতি, টর্চ, সব নিভে গেল।
রাহুল আর বাপন কেবল শুনতে পেল নিজেদের দম বন্ধ হওয়ার শব্দ, আর সেই ভয়ঙ্কর হাসি।
শ্যামল ভিলার জানালার ফাঁক দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়ল—তাদের চোখে প্রতিফলিত হলো এক অদ্ভুত আলো—যেন এই গল্পের শেষ এখানেই নয়…
অধ্যায় ২:
রাতের শেষ প্রহর। শ্যামল ভিলার জানালার ফাঁক দিয়ে জোছনার আলো ঢুকছে, আর সেই আলোয় রাহুলের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘামে ভিজে গিয়েছে তার কপাল, শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত।
বাপন হেঁটে এসে তার কাঁধে হাত রাখল।
“রাহুল, আমাদের এখন কী করা উচিত?”
রাহুল ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল।
“আমাদের এই ভিলার ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। যেটা আজ রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনার পেছনে লুকিয়ে আছে। এই বাড়ির পুরনো দলিলপত্র, ডায়েরি—সব খুঁজতে হবে।”
বাপন গলার স্বর নিচু করে বলল, “তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো এই বাড়িটায় অশরীরী শক্তি আছে?”
রাহুলের চোখে দৃঢ়তা।
“বিশ্বাস করি। তুই নিজেই তো দেখলি সেই ছায়া… সেই বউমা… আর শেষ মুহূর্তে সেই ভয়ঙ্কর হাসিটা। শ্যামল ভিলার মধ্যে কিছু আছে, যা মৃতদেরও শান্তি দেয় না।”
বাপন শিউরে উঠল।
“তাহলে এবার কী?”
রাহুল বলল, “আমার দাদুর একটা পুরনো ট্রাঙ্ক আছে। ওটা ওর পড়ার ঘরে রাখা ছিল। আমার মনে আছে, ওখানে অনেক দলিলপত্র আর ডায়েরি থাকত। ওগুলোয় হয়তো ভিলার ইতিহাসের ছায়া লুকিয়ে আছে।”
তারা দু’জনে ফিসফিস করতে করতে দাদুর সেই পড়ার ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজা অল্প খোলা, আর বাতাসে ভেসে আসছে পচা কাঠ আর পুরনো বইয়ের গন্ধ।
রাহুল প্রথমে পা রাখল ভেতরে। বাতাসটা অদ্ভুত ঠান্ডা। বুকের ভেতর কেমন হিমশীতল একটা অনুভূতি।
ঘরের একপাশে পুরনো আলমারি, আরেকপাশে মেঝেতে রাখা একটা কালো ট্রাঙ্ক। তালা নেই, শুধু মরচে পড়া হাতলটা নামিয়ে খুললেই খুলে যাবে।
রাহুল নিচু হয়ে ট্রাঙ্কটা খুলল।
ভেতরে কাগজপত্রের স্তূপ। হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের পাতায় অজানা কারো হাতের লেখা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর কিছু ছেঁড়া ফাইলের বাঁধাই।
রাহুল কাগজগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল।
হঠাৎ একটা ডায়েরি চোখে পড়ল—মলাটটা লাল রঙের, কোণাগুলো ছেঁড়া, তবুও মলাটে স্পষ্ট লেখা:
“শ্যামল ভিলা—অমরেশ দত্ত”
রাহুলের দাদুর নাম।
বাপন ফিসফিস করে বলল, “দেখ, তোমার দাদুর ডায়েরি!”
রাহুল ধীরে ডায়েরিটা খুলল। প্রথম পাতায় অমরেশ দত্তের হাতের লেখা—
“এই বাড়িতে যে কান্নার ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা আমি অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু সত্যিটা আজও জানি না। তবে কিছু ঘটনা আমাকে শঙ্কিত করেছে…”
রাহুল দ্রুত পাতা উল্টাল।
“১৯৫২ সালের মে মাস। তখন এই বাড়িতে বউমা প্রথম এলো। মুখে হাসি, চোখে ভরসা। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই অদ্ভুত কিছু হতে লাগল। রাতের বেলায় ওর কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। ওর স্বামী, মানে আমার ছেলে, প্রথমে বিশ্বাস করত না। কিন্তু একদিন আমি নিজেই শুনলাম—জানালার ও পাশে দাঁড়িয়ে ওর ফিসফিসানি—‘আমাকে বাঁচাও।’
রাহুলের কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করল, “আমাকে বাঁচাও…”
বাপন শিউরে উঠে বলল, “ওর ডায়েরিতেও সেই কথা!”
রাহুল আবার পড়তে লাগল—
“আমি ছেলেকে বলেছিলাম, ওর দিকে নজর দিতে। কিন্তু ও আমায় বলেছিল—‘বাবা, তুমি ভয় পেয়ে যাচ্ছো, এইসব মেয়েলি কান্না শোনার দরকার নেই।’ তারপর সেই ঘটনার রাতে ওর মৃত্যু হলো। ওর মৃতদেহটাকে জানালার পাশে ঝুলতে দেখলাম। আর সেদিন থেকে এই বাড়িতে কেবল কান্না আর অদ্ভুত আওয়াজ…”
হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেল।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “এই ইতিহাস… এই বাড়িটা অভিশপ্ত।”
বাপন চিৎকার করে বলল, “তাহলে আমাদেরও বিপদ আছে!”
ঠিক সেই সময় বাতাসে আবার সেই নারীকণ্ঠ ভেসে এল—
“আমাকে বাঁচাও…”
দুজনে একসঙ্গে পেছনে তাকাল—দেয়ালের ছায়া থেকে যেন কেউ বেরিয়ে আসছে।
তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সেই নারীমূর্তি—কাঁধ পর্যন্ত চুল, চোখে অশ্রু, ঠোঁটে চাপা আতঙ্ক।
রাহুল গলা শুকিয়ে বলল, “তুমি… তুমি বউমা?”
নারীমূর্তিটা ফিসফিস করে বলল, “আমার মৃত্যু ছিল রহস্য… ওরা আমার কান্না শুনতে পায়নি… তুমি কি আমাকে সত্যি মুক্তি দেবে?”
রাহুল আর বাপন পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরল।
রাহুল বলল, “হ্যাঁ! আমি তোমাকে সাহায্য করব! তুমি শুধু বলো—তোমার মৃত্যু কেন হলো?”
নারীমূর্তির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল—
“ওই রাত… আমি চিৎকার করেছিলাম… কিন্তু…”
এক মুহূর্তে কক্ষের বাতাস ভারী হয়ে এল। দেয়ালের জানালা খটাস করে খুলে গেল। শ্যামল ভিলার অদ্ভুত আঁধারে যেন অতীত আর বর্তমান একসঙ্গে মিলে গেল।
রাহুল ধীরে ধীরে বলল, “আমরা তোমার সত্যি জানব… তোমার কষ্টের ইতিহাস বের করব।”
নারীমূর্তির ঠোঁটের কোণে এক টুকরো শান্তির হাসি ফুটে উঠল।
“ধন্যবাদ…”
ঠিক সেই মুহূর্তে এক দমকা বাতাস এসে মোমবাতি নিভিয়ে দিল—ঘর আবার অন্ধকারে ডুবে গেল।
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। বাতাসে মোমের গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে কাগজের গন্ধ মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করেছে। রাহুল ধীরে ধীরে মোমবাতি আবার জ্বালাল। কাঁপা হাতের আলোয় ডায়েরির পাতা ফের উল্টাতে লাগল।
পাতার এক কোণে দাগ পড়েছে—ঝাঁঝালো গন্ধ, হয়তো পুরনো রক্তের দাগ। রাহুল থমকে গেল।
বাপন আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “এটা কি রক্ত?”
রাহুল শ্বাস নিয়ে বলল, “হয়তো… কারো না কারো মৃত্যু হয়েছে… আর সেই মৃত্যুর ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই ডায়েরিতে।”
ডায়েরিতে লেখা ছিল:
“ওই রাতে বউমার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। বারবার ও বলছিল, ‘আমাকে মেরে ফেলবে, আমাকে মেরে ফেলবে।’ কিন্তু আমরা কেউ ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। ওর স্বামী, মানে আমার ছেলে, তখন বলেছিল, ‘বউরা তো মাঝে মাঝে এমন বলে।’ আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু রাতে আমি দেখলাম, ওর ঘরের আলো নিভে গেছে, আর জানালার পাশে একটা ছায়া দুলছে। ওর কণ্ঠস্বর তখন আর্তনাদে ভরে উঠল—‘আমাকে বাঁচাও।’ তারপর হঠাৎ সব চুপ… সেই চুপের মধ্যে আমি ওর নিথর দেহটা দেখতে পেলাম, জানালার পাশেই ঝুলছিল…”
রাহুলের হাত কাঁপতে লাগল। বাপন চোখ দুটো ফেটে চেয়ে রইল।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “দেখছিস? কেউ ওকে মেরে ফেলেছিল! আত্মহত্যা নয়—এটা খুন!”
বাপন শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “কিন্তু খুনের প্রমাণ? তোর দাদু কিছু লিখেছে?”
রাহুল দ্রুত পাতা উল্টাল।
“আমি বিশ্বাস করি, বউমা নিজে ফাঁস দেয়নি। ওকে কেউ চুপিচুপি খুন করেছে। বাড়িতে তখন অনেক গোপন শত্রুতা ছিল। ব্যবসার লেনদেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আমার ছেলের আর্থিক সমস্যা—সব মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর জটিলতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সাহস করে কিছু বলতে পারিনি, কারণ তখনকার দিনে এসব বলা মানেই সামাজিক অপমান, বংশের মানহানি। সেই অভিশাপের দায় আর কখনো মুছবে না।”
রাহুল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। শ্যামল ভিলার অতীত যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল—অন্ধকার করিডর, পাথরের সিঁড়ি, আর জানালার পাশে কুয়াশায় ঢেকে থাকা ছায়া।
বাপন ঠোঁট কামড়ে বলল, “তাহলে… এই বাড়ি অভিশপ্ত, রাহুল! বউমার আত্মা প্রতিশোধ চাইছে!”
রাহুলের চোখে আগুন জ্বলল, “প্রতিশোধ না, বিচার! ওর কান্না কেউ শোনেনি, তাই এখনো ওর আত্মা শান্তি পায়নি। আমরা যদি সত্যি বের করতে পারি, হয়তো ও শান্তি পাবে।”
ঠিক সেই সময় বাতাসে আবার সেই নারীকণ্ঠ ভেসে এল—
“আমার মৃত্যু… কারো হাতেই হয়েছিল… ও আমাকে বিশ্বাস করেনি… আমার স্বামী… বিশ্বাসঘাতক…”
রাহুল শিউরে উঠল।
“তুমি কি বলতে চাইছ, তোমার স্বামী…?”
কণ্ঠস্বরটা কেঁপে কেঁপে বলল—
“হ্যাঁ… ও-ই আমার মৃত্যুর কারণ… আমার কান্নার কারণ… ও বিশ্বাস করেছিল, আমি বিশ্বাসঘাতক… অথচ আমি ছিলাম নিষ্পাপ…”
বাপন কেঁপে উঠে রাহুলকে বলল, “তোর বাবার… মানে তোর দাদার ছেলেই…?”
রাহুলের মুখ সাদা হয়ে গেল। চোখের কোণ দিয়ে জল পড়ল।
“আমার কাকা… আমার বাবার ভাই… সেই কাকার গলা… সেই অশুভ ছায়া… দাদু ঠিকই লিখেছিল—এই বাড়িতে বিশ্বাসের অভিশাপ লেগে আছে।”
ডায়েরির শেষ পাতায় কাঁপা হাতে লেখা:
“যদি কখনো কেউ সত্যি জানতে চায়, জানালার পাশে থাকা আয়নাটার পেছনে লুকানো সেই চিঠি খুঁজে বের করবে। ওতে লেখা আছে মৃত্যুর আসল ইতিহাস।”
রাহুল চমকে উঠে দাঁড়াল।
“আয়নার পেছনে…!”
দুজনে ছুটে গেল সেই পুরনো ঘরের আয়নার দিকে। আয়নাটার পেছনের কাঠের ফ্রেমে হাত বুলিয়ে একটা ফাঁক খুঁজে বের করল রাহুল। কাঠের চেপে ধরা খাপ খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরোল হলুদ হয়ে যাওয়া একটা খাম।
বাপন অবাক হয়ে বলল, “এটাই সেই চিঠি?”
রাহুলের হাত কাঁপছিল। খামটা খুলল।
ভেতরে ছোট্ট একটা কাগজ—
“আমার মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। ও আমাকে মেরে ফেলেছিল। আমার স্বামী নিজেই আমার কণ্ঠরোধ করেছিল, আর আমাকে জানালার কাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। ও আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিল, কিন্তু আসলে ও-ই আমাকে ঠকিয়েছিল। আমি তার নিষ্ঠুরতার শিকার।”
রাহুলের মুখ সাদা হয়ে গেল।
“ওর স্বামী-ই খুনি! ওকে শ্যামল ভিলায় মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিল!”
বাপন ফিসফিস করে বলল, “এই বাড়ির অন্ধকার ইতিহাস! রাহুল, এ যেন একটা অভিশাপের বেড়াজাল…”
রাহুলের চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা দেখা গেল।
“না বাপন, সত্যি আমরা জেনে গেছি। এখন বউমাকে মুক্তি দিতে হবে… এই সত্যি প্রকাশ করতে হবে।”
হঠাৎ কক্ষের বাতাস ভারী হয়ে এল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
নারীকণ্ঠ আবার শোনা গেল—
“তুমি আমাকে বাঁচালে… আমি মুক্তি পাবো…”
রাহুল কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করব… আমি তোমার সত্যি সবার সামনে আনব!”
বাতাসে হালকা হাসির শব্দ। তারপর ধীরে ধীরে সেই কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল।
হাতের কাগজটা শক্ত করে ধরে রাহুল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই বউমার আতঙ্কিত মুখ—যেন মৃত্যুর আগে কিছু বলতে চেয়েও পারছিল না।
বাপন ধীরে ধীরে বলল, “রাহুল, এবার কী করবি? এই সত্যি কীভাবে প্রকাশ করবি?”
রাহুল শ্বাস ফেলে বলল, “এই সত্যি লুকিয়ে রাখা অন্যায়। এত বছর ধরে এই ভিলার অন্ধকারে আটকে ছিল—আজ তা আলোতে আনতেই হবে।”
কিন্তু ঠিক তখনই বাতাসে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে এল—জানালার পাশ থেকে হিমেল হাওয়া বইল। রাহুল আর বাপন চমকে পেছন ফিরে তাকাল।
এক অদ্ভুত ছায়া যেন দেয়াল বেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। রাহুলের বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে এল।
ছায়াটা ধীরে ধীরে এক মানবাকৃতি নিল—দীর্ঘকায়, মুখ অস্পষ্ট, হাত দুটো যেন হাড়ের মতো।
কণ্ঠস্বর কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কি সত্যিটা বলবে?”
রাহুল গলা শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ! আমি সত্যিটা প্রকাশ করব! এই বাড়ির অন্যায় আর সহ্য হবে না!”
ছায়াটা অদ্ভুতভাবে হাসল—একটা খটখটে হাড়গোড়ের শব্দে কণ্ঠস্বর বেরোল—
“আমাকে ভয় পেতে শিখে নাও… এই ভিলা কারও সত্যি জানার জন্য নয়…”
বাপন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “রাহুল, এই ছায়া… ও-ই হয়তো বউমার স্বামীর আত্মা! ও নিজেকে রক্ষা করার জন্য সত্যি লুকাতে চাইছে!”
রাহুল তীব্রভাবে বলল, “তুমি ওকে ভয় পেও না, বাপন! ও একটা কাপুরুষ, ওর অপরাধ ধামাচাপা দিতে চায়। আমরা সত্যিটা জানিয়ে ওকে পরাজিত করব!”
ছায়াটা হাহাহা করে হাসতে হাসতে ঘরের বাতাস ভারী করে তুলল। মোমবাতিগুলো দপদপ করে নিভে যেতে লাগল। অন্ধকারে রাহুল আর বাপন একে অপরকে আঁকড়ে ধরল।
ছায়ার কণ্ঠে ভেসে এল—
“আমার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না… শ্যামল ভিলা তোমাদের গ্রাস করবে…”
রাহুল চিৎকার করে উঠল, “তুমি আর আমাদের থামাতে পারবে না! আমরা তোমার অপরাধ ফাঁস করব!”
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের এক কোণ থেকে চিৎকার শোনা গেল—
“আমাকে বাঁচাও…”
সে সেই একই কণ্ঠস্বর—বউমার!
হঠাৎ করেই বাতাসে ধুলো উড়ে ঘরটা কুয়াশায় ঢেকে গেল। কুয়াশার মধ্যে সেই নারীমূর্তিটা আবার ফুটে উঠল। চোখে কান্না, ঠোঁটে চাপা আর্তনাদ—
“আমার মৃত্যু… ওরাই করেছিল… আমাকে বাঁচাও… আমাকে মুক্তি দাও…”
রাহুল জোরে জোরে বলল, “আমি তোমায় মুক্তি দেব! আমি এই চিঠি সবার সামনে আনব! তোমার কষ্টের ইতিহাস, তোমার মৃত্যু… সব সত্যি ফাঁস করব!”
বউমার ছায়া ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে এক তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুলল।
“ধন্যবাদ… আমার আত্মা শান্তি পাবে…”
ঠিক সেই সময় ছায়াটার মুখ বিকৃত হয়ে গেল—হাড়গোড়ের মত হাতদুটো শূন্যে তুলে একটা হাহাকার তুলল—
“তুমি পারবে না! এই বাড়ি তোমাকে গ্রাস করবে! আমি এই সত্যি দেবে না!”
রাহুল দম নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।
“তুমি আমাকে থামাতে পারবে না! তুমি একটা অপরাধী! তুমি মৃত! তোমার ছায়া সত্যির সামনে দাঁড়াতে পারবে না!”
এক ভয়ানক চিৎকারে ছায়াটা কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে যেতে লাগল। বাতাসটা যেন আগুনের মতো গরম হয়ে উঠল, মেঝেতে লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ল।
রাহুল আর বাপন চিৎকার করে বলল, “আমরা তোমার অভিশাপকে ভয় পাই না!”
ছায়াটা চিৎকার করে উঠল, তারপর মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। বাতাস ধীরে ধীরে শান্ত হলো, মোমবাতিগুলো আবার জ্বলে উঠল।
রাহুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখলি? আমরা ওকে হারালাম! ওর অভিশাপ আর আমাদের কাবু করতে পারবে না!”
বাপন থরথর করে বলল, “তাহলে এবার আমরা কী করব?”
রাহুল মুচকি হাসল, “এই চিঠিটা নিয়ে থানায় যাব। পুলিশের কাছে জমা দেব। তারপর সবার সামনে সত্যিটা আনব। বউমা আর কাঁদবে না, ও শান্তি পাবে।”
বাতাসে যেন কারো প্রশান্তি মিশে গেল—একটা মৃদু সঙ্গীত শোনা গেল, যেন কোনো নারীকণ্ঠ গুনগুন করছে—
“ধন্যবাদ…”
রাহুল আর বাপন জানালার দিকে তাকাল। বাইরে ভোরের আলো ফুটছে—রক্তিম সূর্য উঠে এসেছে। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে।
রাহুল শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই ভোর আমাদের সবার নতুন আলো।”
অধ্যায় ৩:
রাহুল আর বাপন সেই ডায়েরির পাতা আর চিঠিটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শ্যামল ভিলা থেকে বেরিয়ে এল। সকালবেলার রোদ চারদিক আলোকিত করে তুলেছে, কিন্তু রাহুলের মনে এক অজানা আতঙ্ক খচখচ করছে।
বাপন পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
—দেখ রাহুল, ওই ছায়াটা আবার এসে কিছু করবে না তো?
রাহুল শক্ত গলায় বলল,
—আমরা সত্যিটা হাতে পেয়েছি। এখন আর কোনো ছায়া, কোনো অভিশাপ—আমাদের আটকাতে পারবে না।
কিন্তু কথাগুলো বললেও রাহুলের বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন পেছন থেকে ওদের পিছু নিচ্ছে।
তারা থানা পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই হঠাৎ করেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। ঝোড়ো হাওয়ায় ধুলো উড়তে শুরু করল।
বাপন ভয়ে কেঁপে উঠল,
—রাহুল… এটা কি শ্যামল ভিলার অশরীরী প্রতিশোধ?
রাহুল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—ওদের ভয় দেখিয়ে আমরা থামব না। সত্যিটা সবার সামনে আসবেই!
তাদের থানায় ঢোকার মুখেই হঠাৎ করে পেছন থেকে এক ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। সেই হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এল ফিসফিসে এক কণ্ঠস্বর—
“তোমরা সত্যি বললেই কি আমি থেমে যাব? আমার অভিশাপ থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না…”
রাহুল কেঁপে উঠল। ডান হাতের আঙুল অবশ হয়ে আসছে। বাপনও ভয় পেয়ে বলল,
—তুই… তুই শুনছিস?
রাহুল গলা শক্ত করে বলল,
—ওর ভয় দেখানোর চেষ্টা। আসল সত্যিটা থানায় পৌঁছে দিতে হবে!
তারা থানায় ঢুকল। সোজা ডিউটির ইন্সপেক্টরের কেবিনে গিয়ে হাজির হল। ইন্সপেক্টর বসু পাকা গোঁফে হাত বুলিয়ে তাকালেন।
—কী হয়েছে?
রাহুল ধীরে ধীরে সবটা বলল—শ্যামল ভিলার ডায়েরি, আত্মহত্যার নাটক, খুনের কথা, বউমার কান্না, সেই ছায়া।
ইন্সপেক্টর বসু অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
—তুমি কী বলছ! শ্যামল ভিলা! ওখানে তো কত কাণ্ড… কিন্তু এই প্রথম এমন কিছু শুনছি।
রাহুল চিঠিটা বাড়িয়ে দিলেন,
—স্যার, এটাই প্রমাণ। দেখুন, এখানে লেখা আছে—বউমার স্বামী-ই ওকে মেরেছিল। আত্মহত্যা নয়, এটা খুন!
ইন্সপেক্টর বসু চিঠিটা পড়তে পড়তে বললেন,
—হ্যাঁ, এ তো সত্যিই মারাত্মক কথা। এতদিনের রহস্য ভাঙবে মনে হচ্ছে।
তারপর উনি বললেন,
—ঠিক আছে, আমরা তদন্ত শুরু করব। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
রাহুলের মুখে হাসি ফুটল। সত্যিটা এবার আলোর মুখ দেখবে।
কিন্তু তখনই ঘরের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এল। জানলার কাঁচে ধোঁয়ার মতো ছায়া ফুটে উঠল—দীর্ঘকায়, অন্ধকার মূর্তি—আর সেই ফিসফিসে কণ্ঠস্বর—
“তুমি কী ভেবেছ—আমার সত্যি প্রকাশ করলে আমি ছেড়ে দেব? শ্যামল ভিলার অভিশাপ থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না…”
ইন্সপেক্টর বসু চমকে উঠে বললেন,
—কী…! এই কণ্ঠস্বরটা কোথা থেকে এলো?
রাহুল কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—স্যার, এটাই সেই অশরীরী ছায়া! ওরাই অভিশাপ দিয়ে রেখেছে!
হঠাৎ করেই কেবিনের আলো নিভে গেল। চারদিকে অন্ধকার। শুধু জানলার পাশে সেই ছায়াটা ভেসে উঠল। লম্বা হাত, কুঁচকে যাওয়া মুখ, আর এক অজানা ঘৃণায় তার চোখ জ্বলছে।
“আমাকে ফাঁসালে কেউ বাঁচবে না… তোমাদের জীবন আমার দখলে…”
ইন্সপেক্টর বসু চিৎকার করে উঠলেন,
—কে… কে তুমি?
ছায়াটা গর্জে উঠল—
“আমি সেই মানুষ—যে এই বাড়ির রাজত্ব করত! আমি শ্যামল ভিলার মালিক! আমার সত্যি কেউ জানতে পারবে না!”
রাহুল বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
—তুমি মিথ্যা! তুমি অপরাধী! তুমি ওকে মেরেছিলে! তোমার সত্যি সবাই জানবে!
ছায়াটা তখন কাঁপতে কাঁপতে রাহুলের দিকে এগিয়ে এল।
“তাহলে মরো…”
হঠাৎ ইন্সপেক্টর বসু পকেট থেকে তার সার্ভিস রিভলভার বের করে বললেন,
—রাহুল, সরে দাঁড়াও!
তিনি ছায়ার দিকে গুলি ছুঁড়লেন—
ধাম! ধাম!
এক অদ্ভুত আর্তনাদে কেঁপে উঠল ছায়াটা। তারপর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ঘরে আলো ফিরে এল।
ইন্সপেক্টর বসু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
—এটা… এটা কী! ছায়া কি সত্যিই মানুষকে খুন করতে পারে?
রাহুল কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—স্যার, ও অভিশাপের ছায়া। ওর অভিশাপ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না। এই সত্যি সবাইকে জানাতে হবে।
ইন্সপেক্টর বসু রাহুলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
—আমি তোমার সঙ্গে আছি, ছেলে। আমরা এই সত্যি সবার সামনে আনব। আর শ্যামল ভিলার অভিশাপকে শেষ করব।
রাহুলের চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
—আমরা লড়ব, স্যার। শ্যামল ভিলার অশরীরী প্রতিশোধকেও আমরা হারাব।
কিন্তু জানলার কাঁচে তখনও সেই ছায়ার ছাপ লেগে আছে—
“তুমি পারবে না… অভিশাপ শেষ হবে না…”
রাহুল জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
—আমরা পারব। সত্যিই শেষ পর্যন্ত জিতবে।
ঠিক তখনই থানার বাইরে শোনা গেল ঝড়ের গর্জন। মনে হলো, অন্ধকার সেই শ্যামল ভিলার প্রতিশোধ নিয়ে আবার তাদের পিছু নিচ্ছে।
ইন্সপেক্টর বসু ডায়েরিটা আর সেই চিঠিটা সাবধানে আলমারিতে রাখলেন। তারপর রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—এই প্রমাণগুলো আমরা সঠিকভাবে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাব। সত্যিটা লুকিয়ে রাখা যাবে না, রাহুল।
রাহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—স্যার, আমার ভয় হচ্ছে। সেই অশরীরী ছায়া আমাদের পিছু ছাড়বে না।
ইন্সপেক্টর বসু গম্ভীর গলায় বললেন,
—আমরা ওর ভয় দেখানোতে দমে যাব না। ওর অভিশাপকে ভাঙতেই হবে। তুমি ভয় পেও না। আমরা আইনের রাস্তা দিয়ে লড়াই করব।
তখনই থানার বাইরে আবার ঝড়ের মতো বাতাস বইতে লাগল। অন্ধকার মেঘ যেন হঠাৎ করে চারদিক ঢেকে ফেলল। থানার দেওয়ালে ছায়াগুলো নড়েচড়ে উঠল—আর সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর—
“তোমরা কিচ্ছু করতে পারবে না… সত্যি কবরেই থাকবে…”
রাহুল আতঙ্কিত গলায় বলল,
—স্যার, দেখলেন? সেই ছায়া আবার এসেছে!
ইন্সপেক্টর বসু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—আমি পুলিশের পোশাক পরে ওদের সামনে মাথা নত করব না। রাহুল, তুমি সাথে থেকো।
তিনি সোজা নিজের ডেস্ক থেকে পিস্তল নিয়ে ছায়ার দিকে তাক করলেন।
—তুমি যা-ই হও—তোমাকে আমরা হারাবই!
ছায়াটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে কেঁপে গর্জে উঠল—
“তোমরা আমার ইতিহাস জানো না! আমার রক্তে অভিশাপ আছে! তোমাদের জীবন শেষ করে দেব!”
ঠিক সেই সময় থানার লাইটগুলো টিমটিম করে নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে এক ফোঁটা ঠাণ্ডা বাতাস কেবিনজুড়ে বয়ে গেল। জানালার কাঁচে কুয়াশার মতো ঘন কালো ছোপ তৈরি হল—আর তার ভেতর থেকে সেই মুখ—
একদম মৃত মানুষের মত বিবর্ণ, ফাঁকাগলা—
“তোমরা আমার বিরুদ্ধে যাবে? তবে শ্যামল ভিলার রক্তস্রোত তোমাদের ঘরেও বইবে!”
রাহুল বুক চাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—স্যার, আমাদের কিছু করতে হবে। ওর অভিশাপ থামাতে না পারলে আমরা কেউই বাঁচব না!
ইন্সপেক্টর বসু কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলেন।
—তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা থানার সাইরেন বাজিয়ে এলাকায় নজরদারি বসাব। আর ওর ইতিহাস বের করতে হবে।
ঠিক সেই সময় থানার পেছনের দরজা থেকে এক কনস্টেবল দৌড়ে এল।
—স্যার! শ্যামল ভিলার পেছনের বাগানে অদ্ভুত কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে! মনে হচ্ছে রক্তের দাগ!
ইন্সপেক্টর বসু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
—চল রাহুল, এবার আমরা সেই বাগানও খুঁজে দেখব। ওখানেই হয়তো এর রহস্য লুকিয়ে আছে।
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু কনস্টেবলদের নিয়ে শ্যামল ভিলার পেছনের বাগানে পৌঁছাল। সেই বাগানে এখনো কুয়াশা জমে আছে। গাছগুলো যেন মৃতদেহের মত কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এক কোণে একটা পুরনো কুয়ো—তার চারপাশে লালচে দাগ লেগে আছে। রাহুল ভয়ে ফিসফিস করে বলল,
—স্যার… এটা কি রক্তের দাগ?
ইন্সপেক্টর বসু মাটি ছুঁয়ে দেখলেন—
—এটা তো শুকিয়ে যাওয়া রক্ত! এখানে কারা যেন কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে কাউকে মেরে ফেলে রেখে গেছে!
হঠাৎ কুয়োর ভেতর থেকে সেই ছায়ার কণ্ঠস্বর—
“তোমরা বুঝতে পারছ না… আমার খুন এভাবে ধরা যাবে না! আমি এ বাড়ির রাজা! আমার ইতিহাস কেউ জানবে না!”
রাহুল কাঁপতে কাঁপতে পেছিয়ে গেল।
—স্যার…! ওই কুয়োর ভেতরে কিছু আছে!
ইন্সপেক্টর বসু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে কুয়োর গায়ে টর্চ মারলেন।
—দেখি তো…
টর্চের আলোয় দেখা গেল, কুয়োর ভেতরে এক কঙ্কাল—হাড়গুলো একেবারে শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তার গলায় একটা লকেট ঝুলছে।
ইন্সপেক্টর বসু কনস্টেবলকে বললেন,
—লকেটটা তুল। এই লকেটই ওর পরিচয় দেবে।
কনস্টেবল সাহস করে দড়ি ফেলে সেই লকেটটা তুলে আনল। লকেট খুলতেই দেখা গেল—এক ছোট্ট ছবি। ছবিতে একজন পুরুষ আর তার পাশে সেই বউমা!
রাহুল তাড়াতাড়ি বলল,
—এই তো! এই ছেলেটাই খুনি! এই বউমাকে ও-ই মেরেছিল! এই কুয়োতে হয়তো আরও অনেকের কঙ্কাল আছে!
ঠিক তখনই সেই কঙ্কাল থেকে ভেসে এল সেই ছায়ার গর্জন—
“আমাকে এভাবে খুঁজে পাবে? শ্যামল ভিলা কারও ক্ষমায় চলে না! এবার তোমাদের রক্তও ঢেলে দেব!”
এক ঝটকায় বাগানের বাতাস যেন ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। গাছগুলো কাঁপতে শুরু করল। মাটিতে ফাটল ধরল। কুয়োর ভেতর থেকে অন্ধকার বেরিয়ে এসে থানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
ইন্সপেক্টর বসু চিৎকার করে বললেন,
—তাড়াতাড়ি থানায় খবর পাঠাও! রাহুল, দৌড়াও! শ্যামল ভিলার অশরীরী প্রতিশোধ শুরু হয়ে গেছে!
রাহুল কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—স্যার, আমরা কি বাঁচব?
ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—আমরা বাঁচব, রাহুল। সত্যি যদি মরে যায়, তবে সবাই মরে যাবে। আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই অশরীরী ছায়াকে শেষ করব!
মাটির ফাটল থেকে তখন কুয়াশার মতো অন্ধকার মেঘ উঠে এসে থানার আকাশ ঢেকে ফেলেছে। দূরে বজ্রপাত শুরু হয়েছে।
শ্যামল ভিলার প্রতিশোধ যেন নতুন করে রক্ত খুঁজছে!
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু দাঁতে দাঁত চেপে থানার দিকে দৌড়াল।
সত্যি আর মিথ্যার চূড়ান্ত লড়াই শুরু হতে চলেছে…
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু দৌড়ে থানায় ফিরতেই দেখল, পুরো থানার আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। বিদ্যুৎ ছুঁড়ে ছুঁড়ে আঘাত করছে আশেপাশের গাছে—আর সেই ভয়ংকর ফিসফিসে কণ্ঠস্বর যেন পুরো থানাজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“আমাকে থামাবে? শ্যামল ভিলার অভিশাপ থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না…”
একটা মুহূর্তের জন্য চারপাশে নীরবতা নেমে এল। থানার কনস্টেবলরা ভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউ টেবিলের নিচে লুকিয়েছে, কেউ আবার প্রার্থনা করছে।
ইন্সপেক্টর বসু গর্জে উঠলেন,
—সবাই সাবধান! ও আসছে! আমরা লড়াই ছেড়ে দেব না!
ঠিক তখনই থানার মেইন হলের মাঝখানে কালো ধোঁয়ার মতো এক ছায়া জেগে উঠল। সে আকার নিল—এক দীর্ঘকায় মানুষ। চোখ দুটো আগুনের মতো লাল। তার কণ্ঠস্বর বজ্রপাতের মতো কাঁপিয়ে তুলল পুরো থানার দেয়াল—
“তোরা পুলিশ! তোরা মানুষ! আমাকে আটকাতে পারবি? আমি শ্যামল ভিলার রক্তাক্ত ইতিহাস! এই থানায় আগুন জ্বালিয়ে দেব!”
রাহুল ভয়ে গলাটাই শুকিয়ে ফেলল। কিন্তু তখনই ইন্সপেক্টর বসু পিস্তল উঁচিয়ে বললেন,
—তুমি যতই অভিশাপ হও, আমরা হার মানব না! আমরা তোমার খুনের প্রমাণ পেয়েছি! এবার তোমার শেষ!
অশরীরী ছায়াটা হো হো করে হেসে উঠল—
“প্রমাণ? আমি তো প্রমাণকেই আগুনে ছাই করে দিই! এবার তোদের থানায়ও আগুন ধরিয়ে দেব!”
এক ঝটকায় থানার ফাইলরুমে আগুন ধরে গেল! ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে এসে পুরো হল ঘিরে ফেলল। গরমে কনস্টেবলরা দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
রাহুল চিৎকার করে বলল,
—স্যার, ওর প্রমাণ যেন না পোড়ে! চিঠি আর ডায়েরি বাঁচাতে হবে!
ইন্সপেক্টর বসু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—ঠিক আছে, রাহুল! তুমি ওই আলমারি থেকে প্রমাণগুলো নিয়ে পালাও! আমি ওকে সামলাচ্ছি!
রাহুল সাহস করে আগুনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গেল। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ডায়েরিটা আর সেই চিঠিটা বের করে নিল। সেই মুহূর্তে থানার হল ঘরের জানালা ভেঙে পড়ল—আর সেই অশরীরী ছায়া গর্জে উঠল—
“তোরা ভাবছিস তোদের হাতে প্রমাণ আছে! দেখ, আমি কিভাবে ওগুলো ছাই করে দিই!”
রাহুল প্রাণপণে ডায়েরি বুকের কাছে চেপে ধরে বলল,
—না! তুমি আর তোমার খুনের ইতিহাস ছাই করতে পারবে না! এই ডায়েরি তোমার কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে থাকবে!
ঠিক তখনই ইন্সপেক্টর বসু পকেট থেকে পবিত্র গঙ্গাজল ভর্তি বোতল বের করে ছায়ার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
—যে অভিশাপ অন্যায়ের রক্তে জন্ম নেয়, তার মৃত্যু হবেই!
ছায়াটা ছটফট করে উঠল—এক বিকট আর্তনাদে থানার দেয়ালগুলো কেঁপে উঠল। আগুনের শিখা হঠাৎ নিভে গেল, ধোঁয়া মিলিয়ে গেল।
কিন্তু সেই অশরীরী ছায়া চিৎকার করে বলল—
“তোরা আমাকে শেষ করতে পারবি না! আমি ফিরে আসব! শ্যামল ভিলার অভিশাপ চিরকাল বাঁচিয়ে রাখব!”
তারপর এক ঝড়ের মতন বাতাস বয়ে গেল, আর সেই ছায়া মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। থানায় আবার আলো ফিরে এল।
কনস্টেবলরা ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াল। ইন্সপেক্টর বসু শ্বাস নিয়ে বললেন,
—রাহুল, তুমি ঠিক আছ তো?
রাহুল কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—স্যার, ও কি শেষ হয়ে গেল?
ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—না। ওর শিকড় এখনো আছে। কিন্তু আমরা ওর সত্যি সবাইকে জানিয়ে দেব। তোমার ডায়েরি আর চিঠি থেকে আমরা প্রমাণ তুলে আনব। ওর অভিশাপকে শেষ করতেই হবে!
রাহুল চোখ মুছতে মুছতে বলল,
—স্যার, আমরা যদি একসাথে থাকি, তবে সত্যি জিতব।
ইন্সপেক্টর বসু বললেন,
—ঠিক বলেছ। আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়াই করব। শ্যামল ভিলার রক্তাক্ত ইতিহাসকে শেষ করবই।
একটু দূরে তখনো থানার দেয়ালে কুয়াশার মতো ছায়া ঘোরাফেরা করছে—কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর যেন একটু দুর্বল হয়ে গেছে।
“তোমরা আমাকে শেষ করতে পারবে না… অভিশাপ থেকে কেউ মুক্তি পাবে না…”
রাহুল জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
—তুমি যতই চেষ্টা করো, আমরা তোমার সত্যি লুকোতে দেব না। শ্যামল ভিলার অভিশাপের শেষ হবে। এই আমি রাহুল—আর ইন্সপেক্টর বসু—প্রমাণ করে দেব!
আকাশে তখন মেঘ সরে গিয়ে একটা রোদ্দুরের রেখা ফুটে উঠল। মনে হল—সত্যি হয়তো সত্যিই জিতবে।
কিন্তু শ্যামল ভিলার অভিশাপ কি সত্যিই শেষ হবে? নাকি এর পেছনে আরও গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে?
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু এবার নতুন করে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিল—কারণ জানে, শ্যামল ভিলার অশরীরী প্রতিশোধ শেষ হয়নি।
অধ্যায় ৪:
শ্যামল ভিলার অশরীরী আতঙ্ক থানার গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। থানার বাইরে অদ্ভুত হাওয়া বইছে, মনে হচ্ছে গাছের পাতাও সেই কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কেঁপে উঠছে।
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকের আঁধারকে দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পেলেন—কিছু অদ্ভুত কুয়াশা ওদের পিছু নিয়েছে।
রাহুল চাপা গলায় বলল,
—স্যার, এই থানার বাইরে বেরোলেই ওর ছায়া আমাদের আক্রমণ করবে!
ইন্সপেক্টর বসু গম্ভীর মুখে বললেন,
—আমরা যতক্ষণ না ওর কুকীর্তির ইতিহাসের মূল খুঁজে বের করছি, ততক্ষণ ওর অভিশাপকে শেষ করা যাবে না।
ঠিক তখনই থানার পেছনের গেটের কাছে থেকে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল—কোনো কনস্টেবল নয়, এক অচেনা মানুষ। চোখ দুটো যেন পাথরের মতো, ঠোঁট নড়ছে না—তবু তার কণ্ঠস্বর কানে বাজল,
—আমার নাম চেনো? আমি সেই কুয়োর ইতিহাস। শ্যামল ভিলার অশরীরী প্রহরী।
ইন্সপেক্টর বসু পিস্তল উঁচিয়ে বললেন,
—তুমি কে? কী চাও?
ছায়ামূর্তিটা হেসে উঠল,
—তোমরা যত চেষ্টা করো, ওর ইতিহাস মুছতে পারবে না। শ্যামল ভিলার রক্তের ইতিহাস এই থানার দেয়ালে দেয়ালে গেঁথে আছে।
রাহুল ভয়ে গলা শুকিয়ে ফেলল,
—স্যার, ও কি ভিলার সেই খুনি?
ইন্সপেক্টর বসু ফিসফিস করে বললেন,
—না রাহুল, ও শ্যামল ভিলার রক্ষী—অশরীরী রক্ষী। ওর কাজ হচ্ছে শ্যামল ভিলার অভিশাপকে বাঁচিয়ে রাখা।
ছায়ামূর্তিটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
—যতক্ষণ না আমার আত্মা মুক্তি পাবে, ততক্ষণ শ্যামল ভিলা থেকে অভিশাপ সরানো যাবে না।
রাহুল কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল,
—তাহলে কিভাবে তোমার আত্মাকে মুক্তি দিতে পারি?
ছায়ামূর্তিটা হেসে উঠল,
—তোমরা পারবে না! কারণ তোমরা জানো না—আমার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল। কুয়োর ভেতর সেই লকেট আর সেই রক্তের দাগ—সেগুলোই আমার মৃত্যুর সাক্ষী। কিন্তু সেই লকেট কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, কারণ ওর সাথেই জড়িয়ে আছে আমার অভিশাপ।
রাহুল আতঙ্কিত হয়ে পেছনে সরে গেল।
ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—তাহলে শোনো, আমরা সেই লকেটের রহস্য খুঁজে বের করবই। অভিশাপ ভাঙার উপায় খুঁজে বের করব!
ঠিক সেই সময় ছায়ামূর্তিটার চারপাশে এক ঝটকায় আগুনের বল ঘুরতে শুরু করল। সেই আগুনের আলোয় রাহুল দেখল, থানার দেয়ালে আঁকা সেই রক্তের দাগগুলো যেন নড়েচড়ে উঠছে—এক অদ্ভুত প্রতীক তৈরি করছে।
ছায়ামূর্তিটা গর্জে উঠল,
—তোরা যা পারিস করে দেখ! আমি শ্যামল ভিলার আত্মা! আমি অভিশাপকে শেষ হতে দেব না!
এক মুহূর্তের জন্য আগুনের শিখা ছুটে এসে থানার দেওয়ালে লেগে গেল। দেয়ালের ফাটল থেকে ধোঁয়া আর ছায়া বেরিয়ে এল—সেই ছায়ার মধ্যে ভেসে উঠল শ্যামল ভিলার সেই ছেলের মুখ, যিনি সেই বউমাকে খুন করেছিলেন!
তার চোখ দুটো আগুনের মতো লাল। সে যেন জীবন্ত হয়ে থানার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
রাহুল চোখ বড় বড় করে বলল,
—স্যার! দেখুন! ও-ই তো আসল খুনি!
ইন্সপেক্টর বসু পিস্তল তাক করে গর্জে উঠলেন,
—তুমি কি মরার পরেও অভিশাপ ছড়িয়ে দেবে? আমি তোমাকে থামাবই!
কিন্তু সেই ছেলের ছায়া কড়া কণ্ঠে বলল,
—আমার রক্তে অভিশাপ আছে। আমাকে মেরে ফেলেছিল আমারই বউমার পরিবার। আমি শ্যামল ভিলার ইতিহাস। তোদের পুলিশের গুলিতে আমার মৃত্যু হবে না!
ঠিক তখনই থানার ছাদে বজ্রপাতের মতো শব্দ হল। বিদ্যুৎ এসে থানার সিলিং ভেঙে ফেলল। সেই ছায়া যেন বিদ্যুতের স্রোত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কনস্টেবলরা চিৎকার করে ছুটোছুটি করতে লাগল।
রাহুল চিৎকার করে বলল,
—স্যার, আমাদের কিছু করতে হবে! নাহলে পুরো থানাই ধ্বংস হয়ে যাবে!
ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—আমি আছি রাহুল! আমরা একসাথে লড়ব!
ইন্সপেক্টর বসু গঙ্গাজল ভর্তি বোতল হাতে নিয়ে সেই ছায়ার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
—শ্যামল ভিলার অশরীরী! এই থানায় তোর স্থান হবে না! সত্যি জিতবেই!
ছায়াটা গর্জন করে উঠল—এক বিকট আর্তনাদে থানার মেঝে কেঁপে উঠল। আগুনের শিখা মিলিয়ে যেতে যেতে সেই ছায়া হাওয়ার মতো উড়ে গেল।
কিন্তু দেয়ালের ফাটল থেকে তখনো শোনা যাচ্ছিল সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর—
“তোমরা আমাকে থামাতে পারবে না… আমি আবার ফিরব… শ্যামল ভিলার ইতিহাস চিরকাল থাকবে…”
রাহুল ক্লান্ত গলায় বলল,
—স্যার, ও কি শেষ হয়ে গেল?
ইন্সপেক্টর বসু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—না রাহুল, ওর ছায়া এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। আমাদের শ্যামল ভিলার সেই লকেটের রহস্য খুঁজে বের করে অভিশাপের শিকড়ে পৌঁছতে হবে।
রাহুল কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
—স্যার, তাহলে এবার শ্যামল ভিলায়ই যেতে হবে।
ইন্সপেক্টর বসু বললেন,
—হ্যাঁ রাহুল। এবার সেই ভিলার ভেতর ঢুকেই আমাদের সত্যিটা বের করতে হবে। শ্যামল ভিলার অশরীরী শক্তি শেষ করতে হবে—আর সবার সামনে সত্যি প্রকাশ করতে হবে!
রাত তখন ঘন অন্ধকার। থানার আলো নিভে গেছে।
রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু নিজেদের মধ্যে একে অপরের হাত চেপে ধরল।
অন্ধকারের ভিতর দিয়ে একটা আলো—একটা আশা—দূরে মৃদু করে জ্বলছে।
সেই আলোয় ভরসা করে ওরা এগিয়ে চলল—শ্যামল ভিলার অভিশাপের শেষ লড়াইয়ের জন্য!
শ্যামল ভিলার সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসুর বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগল। মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে পুরনো সেই প্রাসাদ যেন নিঃশব্দে তাদের ডেকে আনছে—অভিশপ্ত ইতিহাসের অজানা হাতছানি।
ইন্সপেক্টর বসু গম্ভীর গলায় বললেন,
—রাহুল, সাবধান! এই বাড়িতে এক অশরীরী শক্তি পাহারা দিচ্ছে, আমরা জানি। তবু সত্যিটা বের করতেই হবে।
রাহুল পকেট থেকে সেই ডায়েরি আর চিঠিটা বের করে বলল,
—স্যার, এই ডায়েরিতে লেখা আছে শ্যামল ভিলার লকেটের অভিশাপ—ওর মৃত্যুর ইতিহাস। ওটা খুঁজে পেলে সত্যিটা সবাইকে বলা যাবে।
ইন্সপেক্টর বসু চোখ কুঁচকে বললেন,
—ঠিক আছে, চল!
দরজার তালা জং ধরা হলেও এক ধাক্কায় খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতেই কুয়াশার মতো ধোঁয়া চারপাশে নেমে এল। হলঘর জুড়ে ছায়ারা যেন মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করছে—
“তোমরা ফিরে যাও! এই বাড়ি মৃত্যু ছাড়া কিছু দেয় না…”
রাহুল কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—স্যার, এ কেমন কণ্ঠস্বর?
ইন্সপেক্টর বসু বললেন,
—ভয় পাবে না রাহুল, এদের অভিশাপকে শেষ করতেই আমরা এখানে এসেছি। এই ভিলার লুকোনো সত্যি খুঁজেই আমাদের সেই লকেট খুঁজতে হবে।
হলঘর পেরিয়ে ওরা গ্যালারিতে পৌঁছাল। দেয়ালের পুরনো তেলের চিত্রে রক্তের ছাপ—মনে হচ্ছে ওগুলো জীবন্ত হয়ে নড়ছে। রাহুল যেন অনুভব করল—দেয়ালের ছায়াগুলো ওকে দেখছে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
হঠাৎ একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখা গেল, ওটার ওপর আঁকিবুঁকি করা এক অদ্ভুত প্রতীক—যেন এক ত্রিভুজের মধ্যে আগুনের শিখা।
রাহুল ফিসফিস করে বলল,
—স্যার, এই প্রতীকটা সেই ডায়েরিতেও ছিল। এই ঘরেই হয়তো সেই লকেট আছে।
ইন্সপেক্টর বসু চেপে চেপে দরজাটা খুললেন। ভেতরে অন্ধকার—একটা ছোট ঘর, মাঝখানে ভাঙা কাঠের আলমারি, আর এক কোণে পোকায় ধরা কুৎসিত একটা পুতুল।
রাহুল বুক ধরে বলল,
—স্যার, ওখানে কিছু একটা ঝিলমিল করছে!
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখল—পুতুলটার বুকের ভেতরে একটা ছোটো লকেট ঝুলছে। লকেটটার গায়ে লাল রঙের দাগ, আর অদ্ভুতভাবে গরম মনে হচ্ছে।
রাহুল হাত বাড়িয়ে নিতেই অন্ধকারের ভেতর বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠল সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর—
“তোরা লকেট স্পর্শ করলেই অভিশাপ ছড়িয়ে পড়বে! মৃত্যু হবে তোমাদের!”
এক ঝলকায় অন্ধকারের মধ্যে আগুনের শিখা জ্বলে উঠল, আর সেই পুতুলের চোখ জ্বলে উঠল আগুনের মতো লাল।
রাহুল ভয়ে হাত সরিয়ে নিল। ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—তুমি যা-ই হোক, সত্যি কখনো চাপা থাকে না! আমরা এই লকেট খুঁজে বের করেই সত্যিটা সবাইকে জানাব!
সেই মুহূর্তে ঘরটা কেঁপে উঠল, চারপাশে বাতাসের ঝড় বয়ে গেল। দেয়ালের ফাটল থেকে বেরিয়ে এল ছায়ামূর্তি—সেই খুনি, যার জন্যই শ্যামল ভিলা অভিশপ্ত হয়ে আছে।
সে গর্জন করে উঠল,
—আমাকে বাঁচাও! আমি মরতে চাইনি! আমাকে শাস্তি দেওয়া অন্যায়!
রাহুল চিৎকার করে বলল,
—তুমি-ই তো তোমার বউমাকে খুন করেছিলে! তোমার হাতেই শুরু হয়েছিল অভিশাপ!
ছায়ামূর্তিটা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—আমি ভালোবেসেছিলাম! কিন্তু প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে গেছি। এখন আমাকে মুক্তি দাও!
ইন্সপেক্টর বসু পবিত্র গঙ্গাজল হাতে করে বললেন,
—তুমি যদি সত্যিই মুক্তি পেতে চাও, তাহলে সব সত্যি বলো! সেই রাতে কী ঘটেছিল?
ছায়ামূর্তিটা হাহাকার করে উঠল,
—আমার বউমা আমাকে প্রতারণা করেছিল। ওর সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্ক ছিল। এক রাতে ওদের জড়িয়ে দেখে আমি রাগে অন্ধ হয়ে ওকে খুন করেছিলাম। তারপর লাশ লুকিয়ে রাখতে গিয়ে লকেটের ভেতরে ওর রক্ত লেগে গিয়েছিল। সেই রক্তের দাগ মুছতে পারিনি—অভিশাপ ছড়িয়েছে সেই থেকেই।
রাহুল বিস্ময়ে বলল,
—তাহলে সেই লকেটটাই অভিশাপের মূল?
ছায়ামূর্তিটা বলল,
—হ্যাঁ। ওটা ভেঙে ফেলতে পারলে অভিশাপ শেষ হবে। কিন্তু সাবধান—লকেট ভাঙার সময় অশরীরী শক্তি সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করবে।
ঠিক সেই সময় আবার সেই আগুনের শিখা ছুটে এসে লকেটের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। কক্ষের ভেতর ঝড়ের বেগে বাতাস বইল, দেয়ালের পুরনো ছবি ছিঁড়ে উড়ে যেতে থাকল।
ছায়ামূর্তিটা গর্জে উঠল—
—তোরা পারবি না! শ্যামল ভিলার ইতিহাস মুছে যাবে না!
ইন্সপেক্টর বসু গর্জন করে বললেন,
—রাহুল! ওটা ভেঙে ফেল! সত্যি জিতবে!
রাহুল বুকের সব সাহস জড়ো করে লকেটটা দুই হাতে চেপে ধরল। আগুনের শিখা ওকে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ছুটে আসছিল, কিন্তু রাহুল গলা চেপে বলল—
—আমি সত্যিটাকে শেষ হতে দেব না! শ্যামল ভিলার অভিশাপ শেষ হোক!
এক তীব্র শব্দে লকেটটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেল। সেই মুহূর্তে আগুনের শিখা মিলিয়ে গেল—আর সেই ছায়ামূর্তিটা শান্ত মুখে বলল,
—ধন্যবাদ… আমার আত্মা মুক্তি পেল…
একটা হাওয়ার দোলায় কক্ষের অন্ধকার কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে আলো ফিরে এল। রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসু কপালের ঘাম মুছল।
রাহুল ধীরে ধীরে বলল,
—স্যার, তাহলে কি অভিশাপ শেষ?
ইন্সপেক্টর বসু দৃঢ় গলায় বললেন,
—হয়তো শেষ হয়েছে… কিন্তু ভয়ের ইতিহাস একদিনে মুছে যায় না। আমাদের সবাইকে জানাতে হবে এই সত্যি—অন্যায়ের অভিশাপ কখনো বাঁচতে পারে না।
একটু দূরে তখনো শ্যামল ভিলার ভাঙা জানালা দিয়ে রাতের হাওয়া ঢুকছে—কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর যেন একেবারে থেমে গেছে।
রাহুল জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
—শ্যামল ভিলা—তোমার ইতিহাস শেষ হলো। কিন্তু আমরা সবাই সতর্ক থাকব, যেন এমন অভিশাপ আর কোনোদিন ফিরে না আসে।
লকেট ভাঙার পর কক্ষের ভেতর আলো ফিরতে না ফিরতেই রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসুর মনে হলো যেন শ্যামল ভিলার অশরীরী অন্ধকার কেটে যেতে শুরু করেছে। দেয়ালের সেই জীবন্ত ছায়ারা মিলিয়ে গেছে, বাতাসে মিশে গেছে এক অজানা স্বস্তি। তবুও চারপাশে একটা শূন্যতা—যেন ভিলার ছায়া এখনো গোপন করে রেখেছে শেষ সত্যিটুকু।
রাহুল তীব্র নিঃশ্বাস ফেলল, “স্যার, অভিশাপ শেষ হয়ে গেছে… কিন্তু খুনের আসল রহস্যটা কি আমরা পুরোটা জানলাম?”
ইন্সপেক্টর বসু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, “না রাহুল, আমরা শুধু অশরীরী শক্তিকে মুক্তি দিয়েছি। কিন্তু কে প্রথম এই লকেটের অভিশাপকে তৈরি করেছিল, সেই খুনের ইতিহাস, সেই প্রতারণার গল্প—সবটা এখনও অজানা।”
এ কথা বলেই তিনি আলমারির পেছনের দেয়ালটা টোকা দিয়ে দেখলেন। কাঠের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। রাহুল এগিয়ে গিয়ে লুকোনো দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলতেই দেখা গেল সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে দ地下তলার দিকে।
ইন্সপেক্টর বসু সজাগ কণ্ঠে বললেন,
—নেমে যাচ্ছি, রাহুল। সাবধানে থেকো।
রাহুল একটু শ্বাস চেপে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দেখল, নীচের ঘরটা যেন জীর্ণ কোনো আর্কাইভ। দেয়ালে পুরনো কাগজপত্র, ভাঙা ট্রাঙ্ক, পোকায় ধরা বই—আর এক কোণে সিন্দুকের মতো একটা বাক্স।
ইন্সপেক্টর বসু সেটা খুলে দেখতেই চোখ কপালে উঠে গেল—
—রাহুল, দেখো! এখানে শ্যামল ভিলার আসল ইতিহাস লেখা আছে!
বাক্সের ভেতর একটা পুরনো দলিল, হলদেটে চিঠিপত্র—আরো কিছু ফোটো। রাহুল কাঁপা হাতে একটা চিঠি তুলে পড়তে লাগল—
“প্রিয় বউমা,
তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু সেই রাতে যখন তোমায় অন্য কারো সাথে দেখলাম, আমার মন ভেঙে গিয়েছিল। রাগে অন্ধ হয়ে তোমাকে মেরে ফেললাম। আমি জানি, এ কাজ ক্ষমার অযোগ্য। তাই আমার মৃতদেহের লকেটের ভেতর তোমার রক্তের ছোপ রেখে দিচ্ছি—এই অভিশাপ বয়ে নিয়ে যাব মৃত্যুর পরেও। শ্যামল ভিলা হবে চিরকাল অভিশপ্ত।”
—শেখর সেন
ইন্সপেক্টর বসু বিস্ময়ে বললেন,
—এই চিঠি থেকে প্রমাণ হচ্ছে, আসলে ওর বউমার পরকীয়া ছিল না! বরং ভুল বোঝাবুঝি আর হিংসার আগুনে শেখর নিজেই খুনী হয়ে উঠেছিল। সেই অপরাধের অভিশাপই লকেটের মধ্যে আটকে পড়ে আমাদের তাড়া করছিল!
রাহুল হতবাক হয়ে বলল,
—স্যার, তাহলে শ্যামল ভিলার অভিশাপের শুরুই ভুল বোঝাবুঝি থেকে! এই চিঠি প্রমাণ করবে যে সবটা আসলে শেখরের ভুল—তারপরই শুরু হলো মৃত্যুর মিছিল।
ইন্সপেক্টর বসু চশমা ঠিক করে বললেন,
—ঠিক বলেছো, রাহুল। এই প্রমাণ পুলিশ রিপোর্টের সাথে জমা দিতে হবে। এই বাড়ির অশরীরী ইতিহাস শেষ করতে হলে সত্যিটা সবাইকে জানাতে হবে।
হঠাৎ সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর এক তীব্র বাতাস বইল। পেছন থেকে ছায়ার মতো একজন নারীর আর্তনাদ শোনা গেল—
—আমার স্বামী আমায় ভুল বোঝার আগেই আমার কথা শুনল না… আমাকে দোষী করে মেরে ফেলল… আমার আত্মা কি তাহলে কখনো শান্তি পাবে না?
রাহুল ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, অদ্ভুত আলোয় ভেসে আছে এক অশরীরী নারীছায়া—মুখে যন্ত্রণার ছাপ।
ইন্সপেক্টর বসু শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—তুমি সেই বউমা? আমাদের ভয় নেই। আমরা তোমার সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। শেখরের অপরাধ ঢেকে রাখব না। তোমার আত্মা মুক্তি পাবে।
নারীছায়াটার চোখে জলরঙের মতো আভা ফুটল, কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে বলল—
—আমার সন্তানদের সত্যিটা বোঝাতে হবে… আমি কোনো অপরাধ করিনি।
রাহুল হেঁটে গিয়ে হাত তুলে বলল,
—আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমরা এই বাড়ির সত্যি সবাইকে জানাব। তুমি আর কষ্ট পাবে না।
এক ঝলকায় সেই ছায়া মিলিয়ে গেল—হাওয়ার দোলায় যেন কক্ষটা শূন্য হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টর বসু গভীর নিশ্বাস ফেললেন,
—দেখলে, সত্যি কখনো চাপা থাকে না, রাহুল। শ্যামল ভিলার অভিশাপ ভেঙেছে। এখন এই প্রমাণ আদালতে তুলে ধরে শেখরের অপরাধের ইতিহাস সবার সামনে আনব।
রাহুল চোখ মুছতে মুছতে বলল,
—হ্যাঁ, স্যার। সত্যি কখনো মরে না। ভয় যতই থাকুক, আমরা তা জয় করবই।
শ্যামল ভিলা তখন অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হালকা হয়ে গেছে। পেছনের জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে, আর সেই আলোয় ছড়িয়ে পড়ছে শ্যামল ভিলার গোপন কাহিনি—অভিশপ্ত ইতিহাসের অন্তিম পরিণতি।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাহুল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
—শ্যামল ভিলা, এবার তুমি শান্তিতে ঘুমাও। সত্যি মুক্তি পেয়েছে।
ইন্সপেক্টর বসু কাঁধে হাত রেখে বললেন,
—চলো, রাহুল। সত্যিটা আমরা সবাইকে জানিয়ে দেব। এবার ভয়কে বিদায় জানিয়ে সত্যের পথে হাঁটা শুরু করি।
আর শ্যামল ভিলার দেয়ালে রোদ লেগে যেন বলছে—অন্যায় যত বড়ই হোক, শেষ পর্যন্ত সত্যই জিতবে।
অধ্যায় ৫:
ভোরের আলো শ্যামল ভিলার জানালা দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে। চারপাশে এক অজানা শান্তি, তবুও কেমন যেন অস্বস্তি রয়ে গেছে রাহুল আর ইন্সপেক্টর বসুর মনে। অশরীরী শক্তি চলে গেলেও দেয়ালের ফাঁক-ফোঁকরে লুকিয়ে থাকা অজানা কান্না যেন বাতাসে মিশে আছে।
রাহুল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,
—স্যার, আমরা কি আসলেই শেষ করতে পেরেছি? নাকি এই বাড়ির ইতিহাসের আরও গভীরে কিছু লুকিয়ে আছে?
ইন্সপেক্টর বসু গম্ভীর মুখে বললেন,
—রাহুল, ভূতের গল্পে যেমন সবসময় একটা টুইস্ট থেকে যায়, শ্যামল ভিলার ইতিহাসও ঠিক তেমনই। কাল রাতে আমরা যে চিঠিটা পেলাম, সেটা তো শুধুই শেখরের অপরাধের প্রমাণ। কিন্তু শ্যামল ভিলার প্রাসাদপ্রায় বাড়িটার ভেতরে এখনো কিছু ঘর আছে, যেগুলো আমরা খুঁজিনি। আমার সন্দেহ, সেখানেই লুকিয়ে আছে চূড়ান্ত সত্যি—আর সেই সত্যি জানলে ভয়ঙ্কর কাহিনির শেষ অধ্যায় রক্ত মাখাবে!
রাহুল শিউরে উঠল।
—রক্ত মাখাবে! স্যার, আপনার কথায় সত্যিই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!
বসু কণ্ঠে কঠিন দৃঢ়তা এনে বললেন,
—তবে ভয় পেলে চলবে না। শ্যামল ভিলাকে সত্যিই শান্তি দিতে হলে সবকিছু খুঁজে বের করতে হবে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে বিকট শব্দ করে একটা বইয়ের তাক ধ্বসে পড়ল। ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা সেই তাকের পেছনে একটা সঙ্কীর্ণ পথের মতো ফাঁক তৈরি হলো।
রাহুল চমকে উঠল,
—স্যার, ওটা কি গোপন দরজা?
ইন্সপেক্টর বসু ইশারা করে বললেন,
—দেখতে হবে, রাহুল। মনে হচ্ছে, এই পথটা অনেক আগে থেকেই লুকিয়ে রাখা। হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে সেই চূড়ান্ত রক্তমাখা ইতিহাস।
দু’জনে মশাল হাতে সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল। ঘন অন্ধকারে পথ সরু হয়ে গিয়েছে। ছাদ থেকে জল টপটপ করে পড়ছে। বাতাসে ভেজা কফিনের গন্ধ। রাহুল শ্বাসরোধ করে বলল,
—স্যার, ভয়ানক গন্ধ পাচ্ছি। কোনো মৃতদেহ কি…?
ইন্সপেক্টর বসু থামিয়ে বললেন,
—রাহুল, সাবধানে। অনেক সময় অপরাধীরা সত্যি লুকিয়ে রাখতে মৃতদেহগুলো দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে রাখে।
তাদের আলো এসে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্যের ওপর—একটা ইটের দেওয়ালের পেছনে কাঠের বাক্স। বাক্সটা আধা ভাঙা। বসু আর রাহুল একসাথে সেটা খুলতেই আঁতকে উঠল।
বাক্সের ভেতর মানুষের কঙ্কাল! কঙ্কালের হাতের আঙুলে লাল রঙের আংটি! যেন কারও রক্তমাখা প্রতিশোধের শপথ—
রাহুল তীব্র শ্বাস ফেলে বলল,
—স্যার! এই লাল আংটি… কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
ইন্সপেক্টর বসু চোখ কুঁচকে বললেন,
—রক্তমাখা অভিশাপের প্রতীক! এই আংটি একসময় শেখরের বউমা পরেছিল। খুনের পর ওর রক্তমাখা আংটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এখানে! আর সেই অভিশপ্ত আংটিই হয়তো শ্যামল ভিলাকে অশরীরী করে রেখেছিল!
রাহুল ভয়ে কাঁপা গলায় বলল,
—স্যার, তাহলে এর মানে—
বসু থামিয়ে বললেন,
—এর মানে শ্যামল ভিলার হত্যার ইতিহাস এখানেই শেষ হয়নি। এই আংটির রক্তের অভিশাপ বংশপরম্পরায় ছড়িয়ে পড়েছে। কে জানে, শেখরের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ হয়তো এখনো এই বাড়িতে লুকিয়ে আছে—আর সেই অশরীরী অভিশাপ বাঁচিয়ে রেখেছে!
ঠিক তখনই কাঠের বাক্সের পেছন থেকে এক অদ্ভুত শব্দ এলো—
“শ্যামল ভিলার রক্ত এখনো শুকায়নি… আমি এসেছি… আমার শপথের রক্তমাখা অধ্যায় শেষ করতে!”
রাহুল আর বসু পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে—দাঁত কিড়মিড় করছে, চোখ জ্বলজ্বল করছে!
ছায়ামূর্তির চোখ জ্বলজ্বল করছে, যেন আগুনের শিখা! তার কণ্ঠস্বর রক্তমাখা হাওয়ার মতো কাঁপছে,
—তোমরা কী ভেবেছো? অভিশাপ মুছে ফেলে আমায় শান্তি দেবে? আমি শেখরের রক্তের উত্তরাধিকারী! আমার প্রতিশোধ কেউ থামাতে পারবে না!
রাহুল আতঙ্কে পিছিয়ে গেল।
—স্যার! এ কে? এ কি শেখরের বংশধর?
ইন্সপেক্টর বসু চোখ সরু করে ছায়াটাকে দেখতে লাগলেন। তার ঠোঁটের কোণে কঠিন দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
—কে তুমি? নিজের পরিচয় দাও!
ছায়ামূর্তিটা হেসে উঠল—সে হাসি যেন শ্যামল ভিলার দেয়াল কাঁপিয়ে তুলল।
—আমার নাম অভিষেক সেন। আমি শেখর সেনের পৌত্র। তোমরা যেটাকে অভিশাপ ভেবেছো, সেটাই আসলে আমার প্রতিশোধের হাতিয়ার। আমার ঠাকুরদা আমার দাদীর গলা কেটে মেরেছিল ভুল বোঝাবুঝিতে। সেই অপরাধের লজ্জা আমাদের পরিবারকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। আমি সেই লজ্জা মুছতে চাই। আমি প্রমাণ করতে চাই—আমার দাদী নিষ্পাপ ছিল, কিন্তু ঠাকুরদার অপরাধ ক্ষমা করা যায় না!
রাহুল কাঁপা গলায় বলল,
—কিন্তু… তুমি কি এই অশরীরী শক্তি দিয়ে মানুষের ক্ষতি করছো?
অভিষেকের চোখে পাগলের আলো ফুটে উঠল।
—ক্ষতি? ওটা শাস্তি! যারা সত্যিটা ঢাকতে চেয়েছে, তাদের জন্যই শাস্তি! এই বাড়িতে যারা এসেছিল, তাদের সবাইকে শাস্তি পেতে হয়েছে। শ্যামল ভিলা শুধু একটা প্রাসাদ নয়, এটা আমাদের অপরাধ আর অভিশাপের জ্বলন্ত সাক্ষী!
ইন্সপেক্টর বসু এগিয়ে এসে বললেন,
—তুমি তাহলে স্বেচ্ছায় এই অশরীরী শক্তির সাথে চুক্তি করেছো! নিজের পূর্বপুরুষের অভিশাপকে ব্যবহার করছো খুনের হাতিয়ার হিসেবে!
অভিষেক অট্টহাসি ছেড়ে বলল,
—হ্যাঁ! আমি চুক্তি করেছি। লকেটের অভিশাপের মধ্যে ওর রক্ত আর আংটি মিশিয়ে আমি প্রতিশোধকে জীবন্ত করে তুলেছি। সেই রক্তমাখা আংটি আমার পূর্বপুরুষের অপরাধকে আবার জাগিয়ে তুলেছে!
রাহুল বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল,
—মানে তুমি-ই ওই লকেটের খেলা তৈরি করেছো?
অভিষেক রক্তমাখা হাসি দিয়ে বলল,
—ঠিক তাই! সেই লকেটই এই বাড়ির মানুষদের পাগল করে তুলেছে। ওরা একে একে খুন হয়েছে। শ্যামল ভিলায় প্রতিটি ঘর থেকে রক্ত ঝরেছে—তখনই বুঝেছিলাম, অভিশাপই সবচেয়ে বড় বিচারক!
ইন্সপেক্টর বসু বন্দুক বের করে বললেন,
—তুমি যা করেছো, তা শুধু অভিশাপ নয়, খুন! আইন তোমাকে ছাড়বে না, অভিষেক!
অভিষেক অদ্ভুত অশরীরী কণ্ঠে হেসে বলল,
—আইন? হাহাহা! এই বাড়ির দেয়ালও আমার পক্ষে আছে! দেখো!
তার চোখ লাল হয়ে জ্বলে উঠল। চারপাশের দেয়াল কাঁপতে লাগল। দেয়াল থেকে লালচে রক্তের মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে শিয়রে উঠছে রক্তের গন্ধ। রাহুল ভয়ে পেছিয়ে গেল—মনে হলো যেন দেয়াল থেকে একেকটা হাত বেরিয়ে আসছে!
—স্যার! আমরা কি এখান থেকে বাঁচতে পারব?
বসু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
—রাহুল, ভয় পেলে চলবে না! ওর হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে সত্যিটা সবার সামনে আনতে হবে।
তিনি রাহুলের কাঁধে হাত রাখলেন।
—তুমি সেই চিঠি আর আংটি পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাবে। আমি এখানেই থাকব ওকে সামলাতে। শ্যামল ভিলার অভিশাপ আজই শেষ করতে হবে!
রাহুল বলল,
—স্যার, আপনাকে একা ফেলে যেতে পারব না!
বসু দৃঢ়ভাবে বললেন,
—এটাই দায়িত্ব, রাহুল। সত্যের জন্য লড়াই করতে হবে। যাও!
রাহুল চোখের কোণে জল মুছল, তারপর বুক শক্ত করে ছুটে বেরিয়ে গেল সেই সঙ্কীর্ণ পথ দিয়ে। পেছন থেকে শুনতে পেল ইন্সপেক্টর বসুর কণ্ঠ—
—তুমি সত্যকে সবার সামনে নিয়ে এসো, রাহুল! আমি এখানেই শেষ লড়াই করব!
বসু বন্দুক তাক করে অভিষেককে বললেন,
—তুমি নিজেকে শক্তিশালী ভাবছো? তোমার দাদীর হত্যার বিচার করার অধিকার তোমার নেই! আইনই শেষ কথা বলবে!
অভিষেকের চোখে অশরীরী রক্তমাখা আগুনের ঝিলিক ফুটে উঠল।
—আইন? আইন আমার দাদীর বিচার করতে পারেনি! ওর আত্মা এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি সেই বিচার শেষ করব—তুমি তা আটকাতে পারবে না!
ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুতের ঝলকানি আর বজ্রধ্বনির মধ্যে রক্তমাখা দেয়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক নারীর ছায়া—দূর থেকে কণ্ঠ ভেসে এল,
—আমার হত্যার বিচার শেষ করো… প্রতিশোধ শেষ করো…
বিদ্যুতের ঝলকানি আর বজ্রধ্বনির মধ্যে ইন্সপেক্টর বসু অনুভব করলেন, এই লড়াই কেবল একজন খুনীর সঙ্গে নয়—এ যেন একটা পুরো অভিশপ্ত ইতিহাসের বিরুদ্ধে। চারপাশের দেয়ালগুলো থেকে ছায়া, রক্ত আর কান্নার শব্দ মিলে ভয়াবহ এক দৃশ্য তৈরি করছে।
অভিষেকের চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। সে বন্দুকের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
—তুমি বুঝতে পারছো না, ইন্সপেক্টর! এই বাড়ি, এই দেয়াল, এই রক্ত—সবাই আমার পক্ষে! আমার ঠাকুরদার অপরাধের পাপ আর আমার দাদীর কান্না এক হয়ে গেছে। আমার প্রতিশোধ কেউ আটকাতে পারবে না!
বসু চোখ মুদে একটা ছোট প্রার্থনা করে নিজের পকেট থেকে সেই লকেট আর রক্তমাখা আংটিটা বের করলেন।
—তুমি যা বলছো, তা আংশিক ঠিক। এই লকেট আর আংটি তোমার দাদীর কান্না বহন করছে ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে ওর শান্তির চাবিকাঠিও বটে। ওর অভিশাপও ওর মুক্তির উপায়।
অভিষেক রাগে ফেটে পড়ল।
—না! ওর অভিশাপ শুধু রক্ত চাই! আমি সেই রক্ত দিয়েই এই বাড়ির বিচার করব!
ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কণ্ঠ এলো,
—বসু স্যার! আমি ফিরেছি!
বসু অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখলেন—রাহুল দৌড়ে এসেছে সদর দফতর থেকে। ওর হাতে পুলিশের ব্যাগ।
রাহুল হাপাতে হাপাতে বলল,
—স্যার! আমি সব প্রমাণ পুলিশের কাছে দিয়ে এসেছি। এখন আমাদের এই বাড়িকে মুক্ত করতে হবে।
বসুর চোখে স্বস্তি ঝিলিক খেলল।
—ভালো করেছো, রাহুল। এবার সত্যের শক্তি আমাদের সঙ্গে আছে। অভিষেক, এই আংটি আর লকেটটাকে আমি তোমার দাদীর আত্মার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি। যাতে ওর অভিশাপ শেষ হয়—
বসু সেই লকেট আর আংটি একসঙ্গে মাটিতে রেখে দিলেন। আচমকা, শ্যামল ভিলার দেয়ালগুলো কেঁপে উঠল। বাতাসের মধ্যে শোনা গেল এক মেয়েলি কণ্ঠ—
—আমার মুক্তি চাই… আমার শান্তি চাই…
অভিষেক বিস্ময়ে পেছিয়ে গেল।
—না! না! এ হতে পারে না! অভিশাপ চাইলাম আমি! রক্ত চাইলাম আমি!
তার চোখ থেকে আগুনের মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তার মৃতদেহের মতো শীর্ণ এক চেহারা—দাঁত আর হাড় বেরিয়ে আছে। তার ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরছে।
—আমার ঠাকুরদার রক্ত… আমার…—
হঠাৎ সেই ছায়ামূর্তি আর্তনাদ করে কেঁপে উঠল—মাটিতে রাখা লকেট আর আংটি থেকে এক অদ্ভুত আলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সেই আলো ছুঁয়ে ফেলল শ্যামল ভিলার দেয়াল, মেঝে, আর প্রতিটি ছায়া।
অভিষেক কাতর গলায় চিৎকার করে উঠল,
—না! অভিশাপ! ওটা… ওটা আমার প্রতিশোধের অস্ত্র!
বসু বন্দুক উঁচিয়ে বললেন,
—তোমার প্রতিশোধ নয়, তোমার মুক্তি! এই বাড়ির দেয়ালে রক্ত নয়, শান্তি ফিরিয়ে দিচ্ছি আমরা!
আলোর ঝলকানির মধ্যে দেখা গেল অভিষেকের ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে ফেটে যাচ্ছে। তার মুখে তীব্র কষ্টের ছাপ—কিন্তু সেই কষ্টে যেন একরাশ শান্তি মিশে গেছে।
—ঠাকুরদা… দাদি… আমি… মুক্তি… চাই…
একটা বিশাল ঝড়ের শব্দ হলো। তারপর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ল শ্যামল ভিলার চারপাশে। দেয়ালগুলো থেকে রক্তমাখা দাগগুলো মিলিয়ে গেছে। বাতাসে আর কান্নার গন্ধ নেই—শুধু নিস্তব্ধতা।
রাহুল হাফ ছেড়ে বাঁচল।
—স্যার, সব শেষ হয়ে গেল?
বসু ক্লান্ত গলায় বললেন,
—হ্যাঁ, রাহুল। অভিষেকের আত্মা মুক্তি পেয়েছে। তার দাদীর আত্মাও শান্তি পেয়েছে। শ্যামল ভিলার অভিশাপ শেষ।
দু’জনে একসঙ্গে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। শ্যামল ভিলার প্রাসাদপ্রায় বাড়িটার দেয়ালগুলো যেন শূন্য দৃষ্টি মেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
রাহুল মৃদু হেসে বলল,
—স্যার, মনে হচ্ছে এই বাড়ি নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত।
বসু মৃদু হাসলেন।
—হয়তো তাই, রাহুল। প্রতিটি অভিশাপের শেষেই শান্তি লুকিয়ে থাকে। আমাদের কাজ সেই শান্তি ফিরিয়ে আনা।
(সমাপ্ত)