অঙ্কুর বিশ্বাস
বৃষ্টির দিনে দেখা
কলকাতার আকাশটায় সেই বিকেলটা যেন ভেজা ক্যানভাস হয়ে ছিল। মেঘে ঢাকা আকাশ, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, আর একরাশ ধোঁয়াটে আলো—তাতে শহরটা কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা স্বপ্নালু লাগছিল। কলেজের ফটকের বাইরে, ছাতাহীন অনুরাধা হাঁটছিল ধীরে ধীরে। সোনালি সালোয়ারটা হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর নেমে এসেছে।
সে তাড়াহুড়ো করছিল না। বৃষ্টি আর স্মৃতির মিশেলে একটা অদ্ভুত আবেশ ছিল তার মধ্যে। সে হাঁটছিল ঠিক সেই সময়, এক অচেনা কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিল।
“তুমি অনুরাধা?”
কণ্ঠটা ভদ্র, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, এক ছেলেকে। হাতে ক্যামেরা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ। তার মুখটা একেবারে পরিচিত নয়, কিন্তু তাতে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে।
“হ্যাঁ, আমি অনুরাধা। আপনি কে?”
“আমি অর্ণব। ফটোগ্রাফি ক্লাবের নতুন মেম্বার। কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য ছবি নিচ্ছি। আজ তোমার ওপর একটা ছবি তুলতে চাই। এই মুহূর্তটা কেমন যেন কবিতা হয়ে উঠেছে।”
অনুরাধা একটু অবাক, একটু লজ্জা, আবার একটু আনন্দের মিশেল তার মুখে খেলে গেল।
“এই ভেজা জামাকাপড় আর এলোমেলো চুলের ছবি ছাপানো হবে? লোকে হাসবে তো!”
অর্ণবের ঠোঁটে হালকা হাসি।
“ভিজে যাওয়াটা আসল নয়। এই মুহূর্তে তুমি যেমন—নিষ্পাপ, অন্যমনস্ক, অথচ এতটা জীবন্ত—এটাই তো আসল।”
অনুরাধা বুঝে উঠতে পারছিল না, ছেলেটা কবি না ফটোগ্রাফার।
অর্ণব তার ক্যামেরা তুলল। কিছুই বলল না। শাটারের একটানা ক্লিক… তারপর থেমে গিয়ে বলল,
“তোমার চোখে বৃষ্টির চেয়ে বেশি জল আছে, জানো?”
এই কথাটায় অনুরাধার বুকটা যেন কেঁপে উঠল। সে কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল,
“আমি যেতে পারি?”
“অবশ্যই। তবে ছবি কেমন হয়েছে একদিন দেখে যেও।”
সে চলে গেল। কিন্তু যাবার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, কে এই ছেলেটা? এমন একটা সহজ সন্ধ্যেকে যে এক নিমিষে অন্য অর্থে রাঙিয়ে দিল!
ছবির গল্প
অনুরাধা আবার ফিরে গিয়েছিল তার নিজের চেনা জগতে—ক্লাস, বন্ধুবান্ধব, লাইব্রেরি, আর ক্যাম্পাসের চায়ের দোকান। কিন্তু অর্ণবের সেই কথাগুলো… “তোমার চোখে বৃষ্টির চেয়ে বেশি জল আছে”—সেটা যেন মন থেকে যাচ্ছিল না কিছুতেই। এমন কথা তো কেউ বলে না হঠাৎ করে। বললে, তার পেছনে কিছু থাকে। অনুরাধা ভাবত, সত্যিই কি ওর চোখে এমন কিছু ছিল?
পরদিন ক্যাম্পাসে ফটোগ্রাফি ক্লাবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনুরাধা। অর্ণব সেখানেই ছিল, ল্যাপটপে বসে ছবির এডিটিং করছিল। তাকে দেখে মুখ তুলে বলল,
“তুমি এসেছো? ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আসবে।”
“আমার ছবিটা দেখতে চেয়েছিলে না তুমি?”
অর্ণব একটু মুচকি হাসল, তারপর ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিল তার দিকে। অনুরাধা ছবিটা দেখে খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেল।
সত্যিই, এই সেই সে? কাচভেজা ফ্রেমের মাঝে দাঁড়িয়ে এক যুবতী, তার চোখের গভীরতা যেন বৃষ্টির থেকেও বেশি উদাসীন। চুল গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, একটা ছোট চুল ঝরে পড়েছে কপালে। ঠোঁট হালকা ফাঁক করে রাখা, যেন কিছু বলতে চাইছে, আবার চুপ করে থেকে যাচ্ছে।
“তুমি আমাকে অনেকটা বেশি সুন্দর দেখিয়েছো।”
অর্ণব হালকা হেসে বলল,
“না। আমি শুধু তোমাকে তোমার মতো দেখিয়েছি। রঙটা দিয়েছি আলোয়, কিন্তু অভিব্যক্তি তোমার নিজের।”
অনুরাধা কিছু বলল না। তার মনে হল, এই ছেলেটা যেন শুধু ছবি তোলে না, আত্মাও খুঁজে বেড়ায় চোখের পেছনে।
এরপর থেকে তারা রোজ দেখা করতে লাগল। প্রথমে শুধু ফটোগ্রাফি ক্লাব, তারপর লাইব্রেরি, তারপর চায়ের দোকান, আর একদিন সন্ধ্যের দিকে একসঙ্গে হোস্টেলের পেছনের মাঠে হেঁটে যাওয়া।
বলা যায় না তারা প্রেম করছে কি না, কিন্তু তারা একে অপরের মধ্যে কিছু খুঁজে পাচ্ছিল।
একদিন, খুব সাধারণ একটা দুপুরে অর্ণব হঠাৎ বলল,
“তুমি কি সবসময় এমন চুপচাপ ছিলে?”
অনুরাধা হেসে বলল,
“সবসময় না। কিন্তু অনেক কিছু শিখে ফেলেছি চুপ করে থেকে।”
“যেমন?”
“যেমন, কারো চলে যাওয়াটা টের পাওয়া যায় তার কথা কমে যাওয়ার আগেই। যেমন, বৃষ্টির আগে মাটির গন্ধটা আসে। তেমনি সম্পর্ক ভাঙার আগে একটা চুপচাপ সময় আসে।”
অর্ণব এবার আর হাসল না। তার চোখ দুটো একটু গম্ভীর হয়ে উঠল।
“তুমি সব কিছুর ছবি তোলো। কখনো কারো মনভাঙার ছবি তুলেছ?”
প্রশ্নটা শুনে অর্ণব একটু চুপ করে গেল। তার চোখে একধরনের ছায়া নেমে এল। তারপর বলল,
“তুলিনি। কারণ মনভাঙার মুহূর্তগুলো চোখে নয়, মনে থাকে। ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় না। তবে যদি কোনোদিন তোমার মনভাঙে, আর আমি থাকি… তাহলে হয়ত তুলব।”
অনুরাধা চোখ সরিয়ে নিল। এমন সব কথা, এত সরলভাবে কেউ বলে?
তাদের বন্ধুত্ব একটা আশ্রয় হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। কেউ কারো দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কিছু বলছিল না, কিন্তু কিছু না বলার মধ্যেও অনেক কিছু ছিল। কলেজের করিডোরে হাঁটার সময় হালকা হাত ছোঁয়া, একসঙ্গে নীরব থাকা, বা হঠাৎ করে ম্যাগাজিনের কোনো গল্প পড়ে বলার সময়,
“এই গল্পটা তোমার মতো।”
এরকম হাজারটা মুহূর্ত—ছোট ছোট, কিন্তু হৃদয়ে গেঁথে থাকার মতো।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়। কিন্তু অনুরাধার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—এই ছেলেটা ঠিক কে? তার জীবনে এর আগে কেউ এভাবে ঢুকে পড়েনি। অর্ণব নিজেকে যেন খুব বেশি কিছু বলে না। তার বাবা-মা, পুরনো শহর, জীবনের গল্প—সবই যেন কোনোকিছুতেই ও আগ্রহী নয় বলতে।
একদিন, একটা বিকেলে ক্যাম্পাসের গাছতলায় বসে, হঠাৎ অর্ণব বলল,
“তুমি কি কখনো কাউকে ছেড়ে যেতে ভয় পাও?”
অনুরাধা থেমে গেল।
“হ্যাঁ, আমি ভয় পাই। কারণ আমি জানি, মানুষ চলে যায়। আমি তা বহুবার দেখেছি।”
অর্ণব তখন কিছু বলল না। সে শুধু অনুরাধার দিকে তাকিয়ে ছিল।
তার চোখে সেদিন একটা অন্যরকম গভীরতা ছিল, যেটা ভাষায় ধরা যায় না। অনুরাধার মনে হল, এই ছেলেটা শুধু ছবি তোলে না, অনুভূতিগুলোকে ধরে রাখতে জানে।
আর সেই মুহূর্তেই তার ভিতরে একটা অনুভূতি স্পষ্ট হলএই সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, এটা কোনো এক অজানা ভালোবাসার গল্প, যা এখনো বলার বাকি।
অপেক্ষার রঙ
সেই বিকেলটার কথা অনুরাধা ভুলতে পারবে না। অর্ণব তার পাশে বসে ছিল, হাতের মুঠোয় ধরা ছিল ক্যামেরার একটা রোল—পুরনো দিনের ফিল্ম রোলের মতো।
“এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি। দিল্লিতে তুলেছিলাম, বহু আগে।”
অনুরাধা ছবিটা হাতে নিয়ে তাকাল। একটা খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী—তার চোখে আকাশ। শরীরে গামছা জড়ানো, আর মাথার পেছনে খোলা চুল।
“কে ও?”
“আমার বোন। এখন নেই।”
সেই মুহূর্তে চারপাশের শব্দ থেমে গেল যেন। অনুরাধা অনুভব করল, অর্ণবের হাসির আড়ালে যে গভীর বিষণ্নতা লুকিয়ে থাকে, তার একটুখানি জানলা খুলে গেল সেদিন।
তারপর দিনগুলো কেটে যেতে লাগল, কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছুটা বদল ঘটতে শুরু করল।
অর্ণব হঠাৎ করে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেল। আগের মতো ফোন করত না, মেসেজেও অনেক দেরিতে রিপ্লাই আসত। চায়ের দোকানে একসঙ্গে বসা, ল্যাব ক্লাসে হাসাহাসি—সবই কমে এল।
অনুরাধা ভাবল, হয়তো কিছু হয়েছে। হয়তো তার কোনো ভুল হয়েছে।
“তুমি তো এখন খুব ব্যস্ত, তাই না?”
“না তো। একটু মাথা ঝামেলায় ছিল। ঠিক হয়ে যাবে।”
অর্ণবের কথায় আশ্বাস থাকলেও, অনুরাধা বুঝেছিল—কিছু একটা ঠিক নেই।
একটা শনিবার বিকেলে, সে কলেজ শেষে গিয়েছিল ছাদে। ফটোগ্রাফি ক্লাবের পুরনো স্টোররুমের পাশের ছাদটায় বসে অর্ণব প্রায়ই ছবি তুলত। সেখানে গিয়েই সে খুঁজছিল কিছু—হয়তো সেই আগের দিনের স্বাভাবিকতা।
অর্ণব ছিল না। কিন্তু সেখানে ছিল একটি চিঠি, ছোট্ট করে মোড়া একখানা সাদা খামে। তাতে লেখা ছিল তার নাম—‘অনুরাধা’।
চিঠিটা খুব সংক্ষিপ্ত।
“আমার যাওয়া দরকার। কারণ আমি জানি না আমি ফিরে আসব কিনা। কিন্তু তোমার চোখে যেটা দেখেছি, সেটা কোনোদিন ভুলব না। তুমি থেকো, নিজের মতো। অর্ণব।”
অনুরাধার চোখে জল এল না। তার বুক ভার হয়ে উঠল। চিঠি পুড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল না, বরং সে সেটা ব্যাগে রেখে দিল—একটা স্মৃতি হয়ে।
তারপর দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। ক্লাসে মন বসত না, বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত “কি হয়েছে?”, সে হাসত—বলত, “কিচ্ছু না”। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায়, কলেজের সেই পুরনো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত খানিকক্ষণ।
সে অপেক্ষা করত—একটা ক্যামেরার ক্লিকের জন্য, একজোড়া চোখের জন্য, একখানা চেনা কণ্ঠের জন্য।
সময় বদলে যাচ্ছিল। শহরের রঙ বদলাচ্ছিল। কিন্তু অনুরাধার জীবনে ‘অপেক্ষা’ নামক একটা নতুন রঙ যুক্ত হয়েছিল। সেটা ছিল ধূসর, কিন্তু তাতে একরাশ মায়া ছিল।
একটা রাতে, হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার সহপাঠিনী মধুরিমা বলল,
“তুই কি এখনও অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করিস?”
অনুরাধা হাসল না, কাঁদল না, কেবল বলল,
“না। আমি শুধু আর কাউকে খুঁজে পাইনি, যে আমার ওই ছবিটার মতো করে চোখে তাকাতে পারে।”
মধুরিমা কিছু বলল না। কিন্তু বুঝতে পারল, সেই সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্ব ছিল না। কিছু কিছু সম্পর্ক নামহীন হয়, অথচ বেঁচে থাকে অনেক বছর।
ফিরে আসা, কিন্তু আগের মতো নয়
পুজোর ছুটির ঠিক আগের দিন কলেজে একটা আলোচনা সভা ছিল—এক্স-স্টুডেন্টদের আমন্ত্রণ করে আয়োজন করা হয়েছিল। লাইব্রেরির পাশের হলরুমে চেয়ার পাতা হচ্ছিল, ব্যানার টানানো হচ্ছিল। অনুরাধা এসবের মাঝে খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছিল না।
তার ভেতরের গুমোটটা কাটেনি এখনও। সময় চলে গিয়েছে, কিন্তু অর্ণব নামটা হৃদয়ের একটা কোণে জমে আছে, যেমন বৃষ্টির জল জানলার কাচে রয়ে যায় দীর্ঘসময়।
তবে সেদিন, হঠাৎ করেই, হলে ঢুকেই অনুরাধা দেখল—একটা চেনা ফিগার দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। সাদা শার্ট, জিন্স, আর কাঁধে সেই চেনা ক্যামেরা ব্যাগ।
অর্ণব।
দুটো চোখ একসাথে থেমে গেল। সময় যেন পাঁচ মিনিটের জন্য নিঃশব্দে চলা বন্ধ করে দিল।
অনুরাধা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারপর মনে পড়ল, সে যে ফিরে আসবে না বলেই গিয়েছিল।
কিন্তু অর্ণব দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে এগিয়ে এল ধীরে ধীরে।
“অনুরাধা… কেমন আছ?”
“ভালো। তুমি তো ফিরে আসবে না বলেছিলে।”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম।”
অনুরাধা চুপ। তার মনে চলছিল এক হাজার প্রশ্ন, একশো অভিমান, আর কয়েকটা কান্না।
“তুমি হঠাৎ…?”
“দিল্লি গেছিলাম। একটা ফটোগ্রাফি ফান্ডে নির্বাচিত হয়েছিলাম। অফারটা হঠাৎ এসেছিল। কাউকে বলার মতো সময়ও পাইনি। তারপর… হয়তো বলা ঠিক হত না ভেবেই আর বলিনি।”
অনুরাধা এবার চোখ তুলে তাকাল তার দিকে।
“ঠিক বলনি। শুধু আমাকে না বলে গেলে সেটা ভুল। যদি জানতাম, তাহলে হয়তো রাগ করতাম, হয়তো কাঁদতাম, কিন্তু অন্তত জানতাম। তুমি যেটা করলে, সেটা পালানো।”
অর্ণব নীরব। তার চোখে অপরাধবোধ স্পষ্ট। তারপর ধীরে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছ। পালিয়ে গেছিলাম। হয়তো ভয় পেয়েছিলাম… তোমাকে হারানোর, অথবা খুব বেশি পাওয়ার।”
অনুরাধা এবার চোখ সরিয়ে নিল।
“তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার ছবি হয়ে থাকব? একটা ক্লিক করা মুহূর্ত, যে সময় ফ্রেমে থাকবে কিন্তু জীবন থেকে সরে যাবে?”
অর্ণবের মুখ থমথমে।
“না… আমি ভেবেছিলাম, তুমি এত সহজ নও, যে ক্যামেরায় রেখে দিতে পারি। তুমি বেঁচে থাকো অভিমানে, অপেক্ষায়। আর আমি সাহসী ছিলাম না।”
হলরুম তখন শোরগোল করে উঠছিল, অডিয়েন্স ঢুকছে। কেউ কাউকে ডাকছে, কেউ ছবি তুলছে।
কিন্তু অনুরাধা আর অর্ণবের চারপাশে যেন সেসব কিছুই ছিল না।
“তুমি কি আবার চলে যাবে?”
“চাইলেই কি যাওয়া যায়?”
“তাহলে থাকো। কিন্তু এবার যদি যাও, আমাকে নিয়ে যাবে?”
অর্ণবের চোখে জল টলটল করে উঠল। সে মাথা নিচু করে বলল,
“তুমি বললে, আমি থাকব। তুমি চাইলেই যাব। কারণ তুমি ছিলে বলেই, আমি এখনও ফিরে আসতে পারি।”
অনুরাধা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তার চোখে অভিমানের কুয়াশা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছিল।
তারা দুজনে পাশে বসে গেল—একসাথে, অনেকটা নীরবতায়। বাইরের আলো নিভে আসছিল। ভেতরে আলো জ্বলছিল। সময় যেন একটা নতুন পাতা উল্টে নিচ্ছিল।
নীরবতার ভিতরে ‘আমরা’
অনেকদিন পর আবার তারা হাঁটছিল কলেজের পিছনের মাঠে। সন্ধ্যাবেলা, গাছের ছায়া পড়ে আছে পায়ে, হাওয়ায় কাশফুলের গন্ধ, দূরে কোকিল ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। সেই পুরনো রাস্তা, কিন্তু এইবার হেঁটে চলেছে তারা একটু অন্যরকমভাবে—চোখে চোখ রেখে নয়, কিন্তু পাশে পাশে।
অনুরাধা বলল,
“তুমি এখনও কি ছবি তোলে প্রতিদিন?”
অর্ণব হাসল।
“প্রতিদিন তো নয়। এখন আর ক্যামেরা দিয়ে যতটা না তুলি, তার চেয়ে বেশি দেখি। আর ছবি হয়তো মনে জমে থাকে।”
“আমারও কিছু কথা জমে আছে। অনেক দিন হয়ে গেল… বলিনি।”
“আজ বলবে?”
অনুরাধা একটু থেমে বলল,
“তুমি চলে যাওয়ার পর, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। ভেবেছিলাম, হয়তো তুমি শুধু হঠাৎ আসা এক গল্পের মতো। কিন্তু যত সময় কেটেছে, বুঝেছি, তোমার না থাকাটাও একটা গল্প ছিল… আমার গল্প।”
অর্ণব এবার থেমে গেল। তার গলায় নরম স্বর,
“আমার গল্পেও তুমি ছিলে। শুধু আমি ভেবেছিলাম, সেই গল্পটা আমি ধরে রাখতে পারব না। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম—ভালোবেসে ফেলব বলে।”
অনুরাধার গলা একটু কেঁপে উঠল,
“ভালোবাসা কি তাহলে ভয় পাওয়ার মতো কিছু?”
“হয়তো নয়। কিন্তু যদি কেউ আগেও কাউকে হারায়, তবে আবার কাউকে পাওয়ার সাহস করা কঠিন হয়। আমি ভুল করেছিলাম, মানছি। কিন্তু এবার আমি চাই, আমাদের গল্পটা একটু অন্যরকম হোক।”
অনুরাধা ধীরে তার দিকে তাকাল।
“তুমি জানো? আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, যদি তোমার ক্যামেরার ভিতরে ঢুকে পড়তে পারতাম… তবে তুমি আমাকে হয়তো হারাতে পারতে না। ক্যামেরায় তো মুহূর্ত ধরা পড়ে, মানুষ নয়।”
অর্ণব এবার একধরনের গভীর কণ্ঠে বলল,
“তুমি আমার ক্যামেরার ফ্রেম নয়। তুমি আমার চোখের ভিতরের ছবি। যেটা ফোকাস হারিয়ে গেলেও, থেকে যায় মনের অন্ধকার ঘরে। সেই ঘরেই আলো জ্বলে ওঠে যখন তোমাকে দেখি।”
অনুরাধার চোখ ভিজে উঠল। কিন্তু এবার সে কাঁদল না। বরং অর্ণবের হাতটা ধরে ফেলল।
“আমরা যদি আবার শুরু করি?”
“তবে এবার তোমার ছবি আমি তুলব না,” অর্ণব বলল, “তোমাকে অনুভব করব।”
হালকা হাওয়া বইছিল। কাশফুল নড়ে উঠছিল বাতাসে। আকাশের কোণে সন্ধ্যা তারার ঝিলিমিলি। ওরা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল, অনেক কথা না বলেও সব বলা হয়ে যাচ্ছিল যেন।
অনুরাধা বলল,
“চলো, এবার ক্যাম্পাসের শেষ বেঞ্চটায় বসি। যেমন আগে বসতাম। কিন্তু এবার একটু আলাদা করে। এবার আমরা জানি, আমরা একটা গল্পের মধ্যে আছি। আর সেই গল্পটার নাম হতে পারে… ‘তুমি ছিলে বলে’।”
অর্ণব মাথা ঝাঁকাল।
“তুমি আছো বলেই, গল্পটা এখনও বেঁচে আছে।”
তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বেঞ্চের দিকে। চারপাশে আলো কমে আসছিল, কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল—ভরসার, সাহসের, আর একটি নতুন সম্ভাবনার।
একটাই ছায়া, দু’জনের আলো
শহরের ব্যস্ততার মধ্যে একটা সন্ধ্যা সব সময়েই অন্য রকম। আজকের এই সন্ধ্যাটাও ঠিক তেমন—কিন্তু অনুরাধার জন্য একটু বেশি হৃদকম্পন-জাগানো। কলেজ পেরিয়ে দু’ বছর কেটে গেছে। পাঠ শেষ, থিসিস জমা, চাকরি শুরু—সবটাই যেন নিখুঁত লাইন দিয়ে বাঁধা। তবু আজ মনের ভেতর ফের কেঁপে ওঠে পুরনো কোনো অজানা সুর, কারণ সামনেই রয়েছে আলো-অঙ্গন গ্যালারির দোরগোড়া।
“ অর্ণব সাহা — একটি যাত্রার নীরব আলো” শিরোনামের প্রদর্শনী নিয়ে গত ক’ দিন শহরে কম কথা হয়নি। পত্রিকায় লিড স্টোরি, সোশ্যাল মিডিয়ায় টিজার, পোস্টার—সবার মাঝখানে যে মুখটা, সেই ক্যামেরা-ধরা ছেলেটার দু’ চোখ আজও অনুরাধার শৈশব-স্বপ্নের মতো স্পষ্ট।
গেট পেরোতেই সাদা দেওয়ালে ঝুলে থাকা প্রথম ছবিটা অনুরাধাকে স্তব্ধ করে দেয়। গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে থাকা এক তরুণীর আবছা মুখ, ভেজা সালোয়ার, কপালে ঝরা একগাছি চুল—সেই “চোখে বৃষ্টির চেয়ে বেশি জল” ওয়ালা মুহূর্ত। ছবির ক্যাপশন: “শুরু”। দর্শনারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে; কিন্তু অনুরাধার হৃদয় ঝড় তুলছে—যেন টাইম মেশিনে বসে পাঁচ বছর পেছনে চলে গিয়েছে।
সে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, সময়ের হিসেব ভুলে যায়। কানে ভেসে আসে ফিসফাস—“মডেলটা কে, জানো?”—“না, কে জানে! ওই মেয়েটাই কি আজ এসেছেন?”—অনুরাধা কেবল চোখ নামিয়ে হাসে; পরিচয় দিলে গল্প ভেঙে যাবে, তাই চুপসে থাকে।
দ্বিতীয় দেয়ালজুড়ে “অপেক্ষা”, “অভিমান”, “উল্টো-আকাশ”—একেকটা ফ্রেম যেন অক্লান্ত কোনো ডায়েরির পৃষ্ঠা। কোনো ছবিতে অদ্ভুত নিস্তব্ধ স্টেশন, কোথাও রোদ-জলের ভেজা বেঞ্চ, কোথাও আবার হঠাৎ নিভে যাওয়া মেলাডি লাইট। সব ছবিই আলাদা অথচ পরিচিত—অর্ণবের চোখ দিয়ে দেখা তাদের দুই জীবনের শত শত না-বলা সংলাপ।
হঠাৎ আলতো কাঁধ ছুঁয়ে যায় কারও আঙুল। গা- শিরদাঁড়া বেয়ে লতিয়ে ওঠা সেই স্পর্শ অনুরাধা ভুলতে পারেনি। ঘুরতেই সেই মুখ—শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ, ফ্রেমবন্দি স্মৃতির বাইরে এবার চোখে টুকরো টুকরো আলোর রেখা।
“এসেছ, অনুরাধা?”
“ডাকেনি তো কেউ।”
“ডাকিনি, কারণ জানতাম তুমি আসবে।”
অর্ণব আজ সাদা কোর্ট, কালো শার্টে। গ্যালারির নরম স্পটলাইটে তার চোখের নিচে ক্লান্তির হালকা ছাপ, কিন্তু হাসিতে জ্বলজ্বলে ভরসা।
“তুমি বড্ড বদলে গেছ”—অনুরাধার গলায় মৃদু শাসন।
“না রে, বদলেছি ছবির মতো—নেগেটিভ থেকে পজিটিভ। ভিতরের গ্রেইন তো একই রয়ে গিয়েছে।”
দু’ জন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে প্রদর্শনীর গভীরে। দর্শকদের কোলাহল দূরে মিলিয়ে যায়, যেন তারা একটা মৌন সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছে। ছবির আলোয় ছায়া ছোটে তাদের গায়ে।
একটা বৃহৎ ক্যানভাসের সামনে অর্ণব থামে। সাদা কাঠের ফ্রেমে সাদা-কালো প্রিন্ট, তবু চোখে-মনে রঙের বিস্ফোরণ—নিসর্গের মাঝে দুটি অবয়ব, হাতের ফাঁকে সূর্যাস্ত। ক্যাপশন: “আমরা”।
“এই ছবিটা কবে তুললে?”
“তুলিনি। এ ডিজিটাল-ড্রয়িং। তুলি দিয়ে আঁকা, ফ্রেমে প্রিন্ট করেছি। কারণ, এই মুহূর্তটা আমি এখনও ক্যামেরায় ধরিনি—ধরার অধিকারও পাইনি৷ কিন্তু ছবি বানিয়ে রাখলাম, যাতে সময় এসে যেন ভুল না করে।”
অনুরাধার শিরায় কাঁপুনি—এটুকু সরল স্বীকারোক্তি এত দিনেও কেউ করেনি। সে শান্ত গলায় বলে,
“মুহূর্তটা যদি আজ তৈরি হয়?”
অর্ণব চমকে তাকায়। ভিড়ের মধ্যে ক্যামেরা-লাইটা দপদপ করে, কিন্তু এ দৃষ্টিতে আলাদা উষ্ণ ঝিলিক।
“তুমি কি…?”
“হ্যাঁ। আমি আর ভয় পাই না। অপেক্ষার রঙটাকে অনেক দিন আগেই আঁশটে ধূসর ভেবেছিলাম; এখন দেখি, সেটাও নীল—গভীর সমুদ্রের মতো। যদি তুমিও সেই সমুদ্রে ডুব দিতে চাও…”
অর্ণব কোনোরকমে নিশ্বাস টেনে বলে,
“তাহলে আমাকে আর একটা ভুল করার সুযোগ দাও—দুটো চোখ ভরে তোমায় ক্যামেরায় ধারণ করার। তবে শর্ত একটাই—তারপর থেকে আর খালি ফ্রেমে তোমাকে রেখে যাব না।”
অনুরাধা হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। গ্যালারির কর্মী শান্তভাবে প্রফেশনাল ক্যামেরা এগিয়ে দেয়; হয়তো অর্ণব আগে থেকেই বলে রেখেছিল—সময়ের কাছে প্রস্তুত থাকতে হয়।
শাটারের পাতলা “ক্লিক”—আরেকটি ছবি জন্ম নেয়। ক্যামেরার ছোট স্ক্রিনে ফুটে ওঠে অনুরাধার উদ্ভাসিত মুখ, পাশে অর্ণবের আধখানা প্রতিফলন, পেছনে তাদের নিজস্ব প্রদর্শনীর মৃদু আলো। ক্যাপশন লেখা হয়নি, কিন্তু মনে মনে তারা দু’ জনই জানে—“ফিরে পাওয়া”।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে অনুরাধা বলে,
“ছবির বাইরেও কিন্তু গল্প থাকে।”
“গল্পটাই তো আসল”—অর্ণবের সোজা উত্তর—“ছবি সেই গল্পকে স্ট্যাম্প করে রাখে, যাতে হারিয়ে না যায়। আর গল্পটা যখন দু’ জনের, তখন সেটাকে কেউ মুছতে পারে না।”
গ্যালারির শেষ কর্নারে ছোট্ট কাঠের টেবিলে রাখা গেস্ট-কমেন্ট বুক। অর্ণব কলম এগিয়ে দেয়,
“লেখো, এই প্রদর্শনীতে তোমার ভাবনা।”
অনুরাধা পাতায় লিখে রাখে—
সব আলো ফুরোয়, তবু কোনো একটা ছায়া থেকে যায়—যার নাম ভালোবাসা। তোমার ফ্রেমে সেই ছায়াটাই আজ আমার আলো। —অনুরাধা
সই শেষে তারিখ ৮ জুন ২০২৫। দু’ জনের চোখে হাসি, যেন ছোট্ট অথচ সম্পূর্ণ কোনো চুক্তি সারা হয়ে গেল।
গ্যালারি থেকে বেরোতেই দেখে, আকাশ আবার ভেজা রং মাখছে। মেঘ মেশানো গন্ধে শহর ভিজছে নীরবে। অর্ণব ছাতা বের করতে যায়, অনুরাধা থামায়—
“আজ আবার ভিজি না কি? তুমিই তো বলেছিলে, বৃষ্টির মাঝে মানুষটা বেশি গল্প বলে।”
অর্ণব ছাতা আড়াল করে ফিরিয়ে নেয়। বুথ থেকে বেরোনো আলো পিছনে, সামনের রাস্তায় ফ্যালফ্যালে হেডলাইট। বৃষ্টি ঝিরঝিরে নেমে আসে; তারা দু’ জন হেঁটে যায় হাত ধরে—চেনা শহরের অপরিচিত বিকেলে।
রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, দূরে ট্রাম দড়ির ঝনঝন, ফুটপাতের বই-পসরা সবই এক মুহূর্তে পিছিয়ে পড়ে—তারা দু’ জন হাঁটে অদৃশ্য ছাদের নিচে, যেখানে কেবল লেখা থাকে—
তুমি ছিলে বলে, আমি আছি। আমি আছি বলে, গল্পটা শেষ হয় না।