ঈশিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যায় ১: ছায়া নামে লেখা
রাত তখন প্রায় তিনটে। কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে, গড়িয়া অঞ্চলের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে ইরা সেন ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভাসা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মনস্থির করলেন—আজ লিখতেই হবে। এই সপ্তাহের শেষে পাণ্ডুলিপি পাঠানোর সময়সীমা। কিন্তু ইরার ভেতর যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—লিখবেন, কিন্তু নিজের নামে নয়। নামটা হবে আগের মতোই—রুদ্র সেন।
ইরা জানতেন, আজকের এই সাহিত্যের জগতে, একজন নারী যখন সাহসী, স্পষ্টভাষী, এবং পুরুষদের অন্তর্জগৎ বিশ্লেষণ করে—তাকে সহজভাবে নেওয়া হয় না। অযথা তর্ক, ট্রোল, অবমাননা—এসবই তার পূর্বের অভিজ্ঞতা। অথচ যখন “রুদ্র সেন” নামে তিনি পুরুষ সেজে লেখেন, তখন সেই একই ভাষা প্রশংসা কুড়ায়, পুরস্কার পায়, আলোচনায় থাকে।
ইরার লেখালিখির শুরু কলেজ থেকেই। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করার সময়, ক্যাম্পাস ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা ছাপা হয় তার। সেই সময় কেউ চিনতেই পারেনি, মেয়েটি ভেতরে কতটা বিষময় অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ায়—একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা কতটা কঠিন।
কলেজ শেষে একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু সন্ধ্যের সময়টা পুরোটা নিজের লেখালিখির জন্য রেখে দিতেন। প্রথম উপন্যাসটি, নিজের নামে, ছাপা হয়েছিল একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থা থেকে—বেশ সাহসী ও আধুনিক চিন্তার গল্প ছিল, যেখানে একজন নারী তার নিঃসঙ্গতা ও শারীরিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছে। ফলাফল? সমালোচনার ঝড়। পাঠকের নয়, সমাজের, আত্মীয়স্বজনের, এমনকি সহকর্মীর।
“মেয়ে হয়ে এসব লেখো কিভাবে?”
“এই ভাষা কি নারীর মুখে শোভা পায়?”
“তুমি তো শিক্ষিকা!”
এই সব প্রশ্ন যেন ইরার বুকের উপর ভারী পাথরের মতো চেপে বসেছিল।
সেই অভিজ্ঞতার পরই ইরার জীবনে আসে রুদ্র সেন। প্রথমে শুধুই একটি পেন-নেম হিসেবে ভাবা হয়েছিল। পরে তা হয়ে ওঠে তার সত্তার একটি রক্ষাকবচ। ছদ্মনামে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নির্জনতার দিনপঞ্জি’ যখন প্রায় দশ হাজার কপি বিক্রি হয়, তখন ইরাও প্রথম অনুভব করেন—তার শব্দের শক্তি আছে, শুধু পরিচয়টা ভুল।
প্রকাশক, পাঠক, সাহিত্য পত্রিকা—সবাই ‘রুদ্র সেন’-এর লেখনীতে মুগ্ধ। তার ন্যারেটিভ পুরুষালি, কিন্তু সংবেদনশীল। তাঁর প্রতিটি চরিত্র যেন বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসা।
ইরা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করতেন, “এই যদি নিজের নামে লিখে এমন সাড়া পেতাম…”
কিন্তু নিজের নাম সামনে এলেই সাহিত্যের বদলে সবাই আলোচনা করত তার চরিত্র নিয়ে। লেখার আলোচনার বদলে থাকত গসিপ—”একটা মেয়ে কিভাবে এসব ভাবে”, “কে ওর ব্যক্তিগত জীবন”, “বিয়ের বয়স হয়ে গেছে”।
রাতের কলকাতা যেন একটা নীরব বন্ধু ইরার কাছে। বারান্দা থেকে ল্যাম্পপোস্টের আলো আর দূরের কুকুরের ডাক মিলিয়ে তৈরি হয় এক নিঃসঙ্গ পরিবেশ—যেখানে শব্দেরা ইরার কাছে ধরা দেয়। এই সময়েই তিনি লেখেন।
কম্পিউটারের পর্দায় বড় বড় করে টাইপ করা হয়—”অধ্যায় ১: মুখোশের জন্ম”।
ইরা শুরু করেন একটি নতুন উপন্যাস—যেখানে একজন লেখক নিজের পরিচয় লুকিয়ে লেখেন, এবং একদিন সেই পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ধীরে ধীরে ঘোলা হতে থাকে।
এই গল্পে তিনি প্রথমবার নিজের অনুভূতি ঢেলে দিচ্ছেন—রুদ্র ও ইরার মিলেমিশে যাওয়া জীবন। পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে চলে।
ইরার মা, মায়া সেন, একটি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। সাহিত্যের প্রতি মায়ার টানই ছোটবেলা থেকে ইরার মাঝে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন মায়া জানেন না, মেয়ে আসলে রুদ্র নামে লেখে।
মায়া মাঝে মাঝে বলেন,
“তোমার সেই বইটা যেটা রুদ্র সেন লিখেছে, দারুণ। এমন লেখা মেয়েরাও পারে যদি সাহস করে।”
ইরা শুধু হাসেন। বলেন না, সেটা তিনি নিজেই।
কলকাতার সাহিত্য জগতে রুদ্র সেন এখন এক আলোচিত নাম। সংবাদপত্রে তাঁর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, কিছু ফিচারে তাঁকে “এই প্রজন্মের হেমেন গুহ” বলে প্রশংসা করা হয়। কেউ কেউ লেখার ব্যাকরণে পুরুষের বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রশংসা করেন, অনেকে বলেন—”নারী হলে এমন ভাবতে পারত না।”
এই মন্তব্যগুলো ইরাকে আহত করে। একজন নারী এতটা সংবেদনশীল অথচ বিশ্লেষণাত্মক কেন হতে পারবে না? কেন সাহিত্যেও লিঙ্গের মুখোশ পরে থাকতে হয়?
ইরার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে—এভাবে আর কতদিন? যদি একদিন কেউ ফাঁস করে দেয় তার পরিচয়? যদি সমাজ তাঁকে “প্রতারক” বলে দোষ দেয়?
কিন্তু আবার ভাবেন, “তাদের বিচার করার অধিকার কে দিয়েছে?”
তিনি তো শুধু লিখেছেন। সত্যি লিখেছেন। ছদ্মনামটা ছিল নিজের আত্মরক্ষার উপায়।
অধ্যায় ২: ছদ্মনামের উত্থান
কলকাতার রোদ যেন আজ একটু বেশি চড়া। গড়িয়ার ফ্ল্যাটে বসে ইরা জানালার কাচ সরিয়ে বাইরে তাকায়। দূরের স্কুল থেকে বাচ্চাদের খেলাধুলার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার মাথার ভিতর সেই শব্দের চেয়েও বেশি জোরে বেজে চলেছে একটা সংবাদপত্রের হেডলাইন—
“রুদ্র সেনের নতুন উপন্যাস – পাঠকের মনের কথা যেন জানেন তিনি”
ইরা অবাক হয়ে দেখে, “রুদ্র সেন” নামটা আজ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় মুখ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পাঠক ফোরামে, এমনকি সাহিত্যমেলায়—সবার মুখে মুখে তার ছদ্মনাম। কিন্তু এই খ্যাতির নিচে যে মুখটা আসলে আছে, সেটা কেবল তার কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা ছায়াটাই জানে।
‘রুদ্র সেন’ নামটি প্রথম তৈরি হয়েছিল দুই বছর আগে, যখন ইরা তার দ্বিতীয় উপন্যাস লিখে শেষ করেন। প্রথম উপন্যাসে নিজ নামে মুখ থুবড়ে পড়ার অভিজ্ঞতা এতটাই তিক্ত ছিল, যে দ্বিতীয়বার সাহস করেও নিজের নাম দিতে পারেননি। বন্ধুর পরামর্শে একটি মধ্যবিত্ত, সাধারণ, কিন্তু ভারী পুরুষালি নাম খুঁজে বের করেন—রুদ্র সেন।
সেই নামের প্রথম বই “নির্জনতার দিনপঞ্জি” ছিল এক অবিবাহিত পুরুষের জীবনযাপন, তার মানসিক দোলাচল, আর নাগরিক একাকীত্ব নিয়ে লেখা। পাঠক যেন রুদ্রকে নিজের প্রতিবিম্ব মনে করল।
বইটি প্রকাশের এক মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় মুদ্রণ আসে। বাংলা বইয়ের জগতে সেটি তখন বিরল ঘটনা। পাঠক বলছিলেন—
“রুদ্রদার লেখায় পুরুষের মন বুঝতে পারি!”
“এই লেখকটা যেন আমার মনের কথা লিখে ফেলেছে!”
“পুরুষ হবার এত সূক্ষ্ম মানসিক বিশ্লেষণ বাংলা সাহিত্যে বিরল!”
ইরা একা একা বসে হাসতেন—“পুরুষ? আমি?”
একবার তিনি ফেসবুকে একটি বইপ্রেমী গ্রুপে ঢুকে দেখলেন, একাধিক পোস্টে রুদ্র সেনের লেখা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। কেউ কেউ বলছে, তিনি বোধহয় ‘কাউন্সেলিং’ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, নয়তো পুরুষদের অত মনস্তত্ত্ব জানবেন কীভাবে?
ইরা জানতেন—উত্তর ছিল খুব সহজ: নারীর জীবন তো সারাক্ষণ পুরুষতন্ত্রে কাটে, পুরুষদের মন বুঝে চলতেই হয় তাকে।
বইটির সফলতার পর ইরাকে একটি বড় প্রকাশনা সংস্থা থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের পাঠানো চিঠি ছিল রুদ্র সেনের নামে, একটি পুরুষকে সম্বোধন করে:
“প্রিয় রুদ্রদা, আপনার লেখার গভীরতা ও নাগরিক অনুভব সত্যিই অসাধারণ। আমরা চাই আপনি আমাদের সংস্থার সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদি লেখকচুক্তিতে আসুন…”
ইরা চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। ‘রুদ্রদা’ সম্বোধনটা যেন একটা বেদনাদায়ক বিদ্রুপ হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে।
তবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সেটি ছিল বড় প্রস্তাব। রয়্যালটি অনেকটাই বেশি, প্রকাশনা নেটওয়ার্ক আরও বিস্তৃত, বইমেলাতে স্টল, সাক্ষাৎকারের সুযোগ… সবই থাকবে।
কিন্তু শর্ত ছিল—একটা সাক্ষাৎকার দিতে হবে প্রকাশনার পক্ষে, ভিডিওতে।
ইরা প্রথমে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশনার জোরাজুরিতে একটা কৌশল বের করেন। তার কলেজের বন্ধু অর্ঘ্য—একজন হাইপোফাইল, ক্যামেরার সামনে আসতে চায় না, কিন্তু ইরার অনুরোধে রাজি হয়।
সে-ই হবে রুদ্র সেন।
সাক্ষাৎকারটা হয় রেকর্ডেড—অর্ঘ্য কিছু প্রস্তুত স্ক্রিপ্ট পড়ে দেয়, যেটা ইরাই লিখে দিয়েছে। গলা ভারী, চোখে চশমা, পাঞ্জাবিতে রুদ্র ‘অভিনয়’ করে।
সেই ভিডিও যখন ইউটিউবে আপলোড হয়, হাজার হাজার ভিউ আসে। মন্তব্যের বন্যা:
“রুদ্রদা আপনার গলায় একটা দারুণ উষ্ণতা আছে!”
“আপনার লেখা যেমন অনুভূতিপূর্ণ, আপনি তেমনি আত্মস্থ!”
ইরার বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তিনি হাসেন—এই সমাজের লিঙ্গমুখো মুখোশ ভেঙে ফেলা এখন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরের বই “অন্ধকারের পাশে দাঁড়িয়ে” সাহিত্যের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। বিচারকদের মন্তব্যে ছিল:
“আধুনিক পুরুষের অভ্যন্তরীণ ভাঙন এতো গভীরে গিয়ে একজন লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন—এটি সাহসিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ।”
ইরা জানেন, যদি তারা জানত লেখক একজন নারী, এই সাহসিকতাকে হয়তো ‘অশ্লীলতা’, বা ‘অপরিণত কল্পনা’ বলে চালিয়ে দিত।
একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইরা তাকিয়ে থাকেন। এই আমি, এই মুখ—কেন আজ পর্যন্ত সাহিত্যে আমার পরিচয় হতে পারল না?
সে ভাবে—রুদ্রের জনপ্রিয়তা যত বাড়ে, তত তার নিজের নামটি অদৃশ্য হয়ে যায়। নিজের ছায়ার সাথেই যেন প্রতিযোগিতা চলছে তার।
মাঝে মাঝে রুদ্র হয়ে ওঠে তারই শত্রু।
মায়া সেন এখনও জানেন না মেয়ের এই মুখোশের কথা। তিনি অবশ্য রুদ্র সেনের লেখার ভক্ত। মাঝে মাঝে ইরাকে বলেন,
“তোমার লেখার ধরন রুদ্রের মতো। ওর লেখাগুলোতে যেন মেয়েরাও নিজেদের খুঁজে পায়।”
ইরা চুপ করে থাকেন। এই চুপ করাটাই তার অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এই চাপা চাপা জীবন, এই ছদ্মনাম—সব মিলিয়ে ইরার মনে জন্ম নিচ্ছে এক নীরব বিদ্রোহ। তিনি ভাবেন, আর কতদিন? আর কতটা অন্ধকারে থেকে আলো লেখা যাবে?
অপেক্ষা যেন ধীরে ধীরে জন্ম দিচ্ছে এক বিস্ফোরণের।
রাত্রি আবার ফিরে আসে। বারান্দায় বসে ইরা চিন্তা করেন—এই ‘রুদ্র’ নামের পেছনে একটা আসল মানুষ আছে। যতই সমাজ সেই নামকে পুরুষ ভেবে ভালোবাসুক, ইরার কলমের আঁচড়ে আজও লিঙ্গ নয়, মানবিকতা ও সত্য উঠে আসে।
আর এই সত্যই একদিন মুখোশ ছিঁড়ে সামনে আসবে।
অধ্যায় ৩: মুখোশের অন্তরাল
“মুখোশ শুধু অন্যকে ঠকানোর জন্য পরে না, অনেক সময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেও পরে মানুষ।”
— ইরার নিজের ডায়েরির একটি লাইন
কলকাতার মাঘের বিকেল। হালকা শীত আর রাস্তার ওপর লাল রোদ পড়ে যেন একটা স্মৃতিকাতর আবরণ ছড়িয়ে দেয়। ইরা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরের যুদ্ধটা অনুভব করছিলেন—নিজের সত্যকে সামনে আনার জন্য প্রস্তুত তিনি, কিন্তু এই সমাজ কি সত্য গ্রহণ করতে তৈরি?
‘রুদ্র সেন’ নামের আড়ালে জীবনটা যেমন জনপ্রিয়তায় ভরপুর, তেমনি ক্লান্তিকরও হয়ে উঠছে। প্রতিটি সাক্ষাৎকারে, প্রতিটি পাবলিক ইভেন্টে, তাকে থাকতে হয় ‘বাধ্য’ একজন গোপন পরিচালক হিসেবে—সব কিছু ছায়ার মতো নিয়ন্ত্রণে রেখে।
অর্ঘ্য, যিনি তার হয়ে মাঝে মাঝে মিটিং-এ যান, ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছেন।
– “ইরা, এটা আর কতদিন চলবে বলো? আমি লেখক নই। এই অভিনয়টা আমার আর ভালো লাগছে না।”
ইরা নিরুত্তর। কথাটা তার নিজের কাছেও কাঁটার মতো গেঁথে গেছে।
এবারের বইমেলা ইরার জীবনের সবচেয়ে জটিল অভিজ্ঞতা হয়ে উঠল। রুদ্র সেনের নতুন বই “তৃতীয় চোখ” প্রকাশ হচ্ছে। প্রকাশক চায়, ‘লেখক’ উপস্থিত থাকুক, অটোগ্রাফ দিক, পাঠকের সঙ্গে মুখোমুখি হোক।
ইরা চুপ করে শোনেন। হ্যাঁ বলতে পারেন না, না বলারও সাহস নেই।
অর্ঘ্য-ই এবার আবার যাত্রায় নামেন। স্টেজে তাকে বসানো হয় আলোচিত লেখকদের পাশে। অনেকে এসে অটোগ্রাফ নেয়, প্রশ্ন করে, কেউ কেউ চোখে জল নিয়ে বলে—”আপনার গল্পে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, রুদ্রদা।”
স্টেজের আড়ালে দাঁড়িয়ে ইরা কাঁপতে কাঁপতে ভাবেন,
“আমার লেখা দিয়ে কেউ নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে, অথচ আমি সেখানে নেই।”
হাতের আঙুলগুলো জমে আসে।
মেলার শেষদিনে একটি কিশোরী, নাম শ্রেয়া, সরাসরি প্রকাশকের স্টলে এসে বলে,
“আমি রুদ্র সেনের বড় ভক্ত। উনার গল্পে এত নারীর যন্ত্রণার ছবি—আমার মনে হয় উনি একজন নারী।”
প্রকাশক হেসে বলেন, “আরে না না! উনি পুরোদস্তুর পুরুষ! এটা তো অনেকেই ভুল করে!”
কিন্তু শ্রেয়ার চোখে কৌতূহল। সে ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি এতোক্ষণ ধরে স্টলের সব বই ঠিকঠাক করছেন, আপনি কি উনার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
ইরার ঠোঁট ফাঁকা হাসিতে নড়ে ওঠে।
“না, আমি কেবল একজন পাঠক,” বলেন।
তবে নিজের গলা শুনে নিজেকেই অচেনা লাগে।
সেই রাতে ইরা সিদ্ধান্ত নেন—এই মুখোশ খুলতেই হবে।
তিনি ভাবেন, নিজের ব্লগে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও দিয়ে সত্যি প্রকাশ করবেন। নিজের লেখা পড়ে শুনাবেন নিজের কণ্ঠে। পুরুষের নামে লেখা গল্প নারী কণ্ঠে নতুন ব্যঞ্জনা পাবে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয় এসে চেপে ধরে।
কি হবে তখন?
পাঠক তাকে বিশ্বাসঘাতক বলবে?
পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হবে?
সাহিত্যের মহলে ‘প্রতারণা’র অভিযোগ উঠবে?
তিনি রাতভর ঘুমাতে পারেন না।
এই সময়েই একটা ঘটনা ঘটে যা সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। একজন লেখক, অনিন্দ্য চক্রবর্তী, ফেসবুকে লেখেন—
“রুদ্র সেন কি আসলেই একজন পুরুষ? লেখার ধরন, ভাষার বুনন, অনুভূতির গভীরতা দেখে আমার সন্দেহ জাগে—এই লেখাগুলো একজন সংবেদনশীল নারীই লিখেছেন। সাহস থাকলে সামনে আসুন।”
এই পোস্টের নিচে হাজারো মন্তব্য—অনেকে সমর্থন করেন, অনেকে কটাক্ষ করেন। কেউ কেউ লেখেন—”নারী হলে এত সাহসী লেখা সম্ভব?”
কেউ বলেন, “এই নামের আড়ালে হয়তো একজন ফেমিনিস্ট গ্রুপ কাজ করছে।”
ইরার বুক ধড়ফড় করতে থাকে।
ইরার সবথেকে বেশি কষ্ট হয় যখন রুদ্র সেনকে ‘পুরুষ সাহিত্যিক’ বলে সম্মাননা দেওয়া হয় আর সেই স্মারক গিয়ে পড়ে অর্ঘ্যের হাতে। অর্ঘ্য বোঝে বিষয়টা, কিন্তু কনফার্ট জোনের বাইরে যেতে চায় না।
একদিন সে স্পষ্ট বলে দেয়—
“ইরা, আমি এটা আর চালিয়ে যেতে পারছি না। আমি নাট্যকর্মী, সাহিত্যিক নই। এখন আমার নিজের কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি থাকবে মুখোশে, না তুমি সামনে আসবে।”
ইরা কাঁদে না। কেবল মাথা নেড়ে বলে, “আমি ভাবছি।”
এই সময়েই ইরার জীবনে ফিরে আসে তার প্রাক্তন প্রেমিক অভিষেক। সে এখন শহরের নামী এক সাহিত্য সমালোচক। তারা একসময় কলেজে একসঙ্গে সাহিত্য চর্চা করত, কিন্তু ইরার সাহসী মনোভাবের জন্য সম্পর্ক ভেঙে যায়।
অভিষেক এবার হঠাৎই ফোন করে বলে—
“তোমার লেখার ধরন আমার চেনা লাগে। তুমি কি ‘রুদ্র সেন’?”
ইরা থমকে যায়।
– “তুমি কি জানতে পেরেছো?”
– “না, পুরোপুরি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। আমি বলিনি কাউকে। শুধু জানার জন্য বললাম—তুমি কি সামনে আসবে?”
ইরা উত্তর দেয় না।
রাতের বারান্দায় বসে ইরা ডায়েরির পাতায় লিখতে থাকেন—
“আমি রুদ্র, আমি ইরা—আমি একা। আমি লিখি কারণ বেঁচে থাকতে চাই, আমি লিখি কারণ সত্য লুকিয়ে রাখা যায় না।”
অধ্যায় ৪: মুখোশ খুলে পড়া
“যদি মুখোশ ছিঁড়ে পড়ে, আমি কী খালি মুখ নিয়েই সমাজের সামনে দাঁড়াতে পারব?”
— ইরার ডায়েরি, ২১শে ফেব্রুয়ারি
কলকাতার বসন্ত উৎসবের ভোর। রঙ ছুঁয়ে যায় রাস্তাঘাট, মানুষজন, জানালার পর্দা। কিন্তু ইরার মনে আজ কোনও রঙ নেই। বরং রঙের মধ্যেই সে খুঁজছে সেই সত্যর ছায়া—যেটা এতদিন চাপা পড়েছিল ছদ্মনামের নিচে।
আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—নিজেকে প্রকাশ করবে।
ইরা নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপ খুলে ক্যামেরা অন করে। চোখে সরাসরি তাকাতে পারেন না। কয়েকবার শুরু করে থেমে যান। শেষমেশ গভীর নিশ্বাস নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলেন—
“আপনারা যাকে ‘রুদ্র সেন’ নামে চেনেন, সে আমি—ইরা সেন। একজন নারী। এই মুখটা এতদিন লুকিয়ে ছিল, কারণ সমাজের চোখে নারীর সাহিত্যে সত্য লেখার কোনও জায়গা নেই। আজ আমি সেই মুখোশটা সরিয়ে দিচ্ছি।”
ভিডিওটা রেকর্ড করে তিনি আপলোড করে দেন নিজের নামে তৈরি করা ইউটিউব চ্যানেলে। শিরোনাম—”রুদ্র সেনের আসল পরিচয় – এক নারীর মুখোমুখি স্বীকারোক্তি”
ভিডিওটি রাতে আপলোড হওয়ার পর পরই তা ভাইরাল হয়ে যায়। সকাল হতেই ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম—সবখানে সেই ভিডিওর লিঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিক্রিয়াগুলো মিশ্র:
“প্রতারণা! এতদিন একজন নারী আমাদেরকে মিথ্যে বলেছে!”
“নারী হয়ে এতটা সাহসী লেখা! এটা অসম্ভব!”
“ইরা সেন, আপনি আমার অনুপ্রেরণা!”
“তবে কি সাহিত্য পুরস্কারটা ফেরত দিতে হবে?”
কেউ সমর্থন করে, কেউ হুমকি দেয়, কেউ কটাক্ষ করে। কিন্তু এক জিনিস স্পষ্ট—এখন আর কেউ চুপ করে নেই।
প্রকাশনা সংস্থা প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা ইরাকে ফোন করে:
– “আপনি তো আমাদের জানাননি! এটা আমাদের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
– “ঝুঁকি? আমি তো লেখকই। আপনারা আমার লেখা প্রকাশ করেছেন, মুখ নয়।”
– “কিন্তু আপনি নিজের পরিচয় গোপন করেছিলেন। মিডিয়া এখন আমাদের জবাবদিহি চাইছে।”
ইরা জবাব দেন:
“তাহলে আমি কি আমার লেখা ফেরত নিতে পারি?”
ফোনের ওপাশে স্তব্ধতা।
বিখ্যাত সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাংবাদিকেরা একে একে টক শো-তে মুখ খোলেন। কেউ বলেন—
“এটা সাহিত্যের জালিয়াতি।”
“নারীর নামে সাহিত্য বাজারে বিক্রি হয় না বলেই তিনি বাধ্য হয়েছেন। এটা আমাদের সমাজের ব্যর্থতা।”
“রুদ্র সেন নামের আড়ালে থাকা লেখিকা আরও সত্যিকারের সাহসী। মুখোশ পরে নয়, খুলে ফেলেই সাহসিকতা প্রকাশ পেয়েছে।”
টিভির পর্দায় নিজের নাম শুনে ইরার চোখে জল আসে না। তিনি চুপচাপ ডায়েরি লেখেন।
প্রকাশনার ক্ষোভ তো ছিলই। কিন্তু সত্যিকারের আঘাত আসে একান্ত কাছের মানুষদের থেকে।
তার মা মায়া সেন সেই ভিডিও দেখে রাগে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হন।
– “তুই আমার কাছে এটা লুকিয়ে রাখলি ইরা?”
– “মা, তুমি কি মনে করো আমি ভুল করেছি?”
– “তুই কি জানিস সমাজ কি বলবে? পুরুষের নাম করে লিখে বেড়াস? অপমান করবে সবাই!”
ইরা চুপ করে থাকে। পরে একসময় বলেন—
“তারা আমায় অপমান করুক, কিন্তু আমাকে মুছে দিতে পারবে না।”
এই সময়েই ইরার কাছে আসে এক চিঠি—হাতে লেখা, অভিষেকের।
“ইরা, তুমিই সাহিত্যের মুখ। মুখোশ খুলে আজ তুমি আরও বিশুদ্ধ হয়েছো। আমি ভুল করেছিলাম তোমার শক্তি বুঝতে না পেরে। আমার শ্রদ্ধা রইল, ভালোবাসা নয় হয়তো, কিন্তু সত্যিকারের শ্রদ্ধা।”
ইরার চোখে কিছুক্ষণ পরেই জল আসে।
এটা ছিল সাহিত্যের মধ্যেই একটা নতুন সম্পর্কের জন্ম।
‘আদর্শ বাংলা’ নামক একটি স্বাধীন মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ইরাকে একটি লাইভ সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণ জানায়।
সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক বলেন—
– “ইরা সেন, আপনি কি মনে করেন আপনি সমাজকে ঠকিয়েছেন?”
– “না, আমি সমাজকে তার মুখোশটা দেখিয়েছি। আমি ঠকাইনি, আমি দেখিয়েছি কিভাবে একজন নারীর কণ্ঠ পুরুষের নাম না হলে শোনা হয় না।”
– “আপনি কি চান, ভবিষ্যতের নারী লেখকেরা আপনার পথ অনুসরণ করুক?”
– “না। আমি চাই তারা নিজের নামে লিখে স্বীকৃতি পাক। ছদ্মনাম না নিতে হয়—সেদিনটাই হবে আমার জয়।”
লাইভ চলাকালীন হাজারো মন্তব্য আসে, কেউ গাল দেয়, কেউ উৎসাহ দেয়, কেউ কাঁদে।
ইরা সেন এখন নিজের নামে লিখছেন। তার আগামী বইয়ের নাম—“মুখোশ”, এই বইটিই।
এই বইয়ে সে তুলে ধরছে সেই পুরনো লেখাগুলোর আড়ালে থাকা না-বলা সত্য, নারীর যন্ত্রণা, কণ্ঠরোধ আর প্রতিক্রিয়ার সমস্ত রঙ।
প্রকাশকেরা দ্বিধায় থাকলেও একটি স্বাধীন প্রকাশনী সামনে এগিয়ে আসে। পাঠকদের বড় অংশ পাশে থাকে। ইরা বুঝে যায়, মুখোশের আড়াল ভাঙলেও কণ্ঠের শক্তি কখনো হারায় না।
অধ্যায় ৫: শব্দের সীমানায় যুদ্ধ
“যে শব্দ একবার জাগে, তাকে কেউ আর ঘুম পাড়াতে পারে না। সত্য একবার বেরিয়ে এলে, সমাজের মুখোশ পড়ে থাকে শুধু মাটিতে।”
— ইরা সেন, সাহিত্যমেলা ২০২৩
ইরা যখন নিজের নাম প্রকাশ করে সামনে এসেছেন, তার কিছুদিন পরেই আসে সাহিত্য সম্মানপ্রাপ্ত লেখকদের তালিকা। সেখানে ‘রুদ্র সেন’-এর লেখা উপন্যাস “তৃতীয় চোখ” এবার “রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মান” জিতে নিয়েছে।
তালিকায় পুরস্কারের পাশে লেখা— “রুদ্র সেন (কলকাতা)” — পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যের জন্য।
এই ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই প্রশ্ন উঠতে থাকে—
“এখন রুদ্র সেন তো আসলে ইরা সেন। একজন নারী। তাহলে কি পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া উচিত?”
“কমিটি কি জানত লেখক একজন নারী?”
“পুরুষ লেখক হিসেবে বিচার হয়েছে কি?”
পুরস্কার কমিটির এক সদস্য সংবাদপত্রে বলেন—
“আমরা লেখার মান দেখে বিচার করি, লেখকের লিঙ্গ নয়। তবে পরিচয় গোপনের বিষয়টা আমাদের ভাবাচ্ছে।”
টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সবাই মুখরিত হয়ে ওঠে ‘রুদ্র থেকে ইরা’ বিতর্কে।
একটি আলোচিত টকশোতে আলোচনায় অংশ নেন—
নামকরা সাহিত্যিক সুব্রত বসু
নারী অধিকার কর্মী নীতিকা ঘোষ
সাহিত্য সম্পাদক মধুমিতা রায়
এবং একমাত্র ইরা সেন নিজে
অতিথিদের মন্তব্য:
সুব্রত বসু: “আমি বলব, সাহিত্যে যদি প্রতারণা থাকে, সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।”
নীতিকা ঘোষ: “ইরার মুখোশ পড়ার কারণ এই সমাজ। একজন নারী পুরুষের নামে লিখে যা বলার সাহস পেয়েছেন, সেটা সমাজের ওপর এক চপেটাঘাত।”
মধুমিতা: “কিন্তু পুরস্কার তো রুদ্র সেন নামে দেওয়া হয়েছে। এটা আইনি জটিলতা তৈরি করবে।”
ইরা: “আমি একটা জিনিস জোর দিয়ে বলব—আমি আমার লেখা নিজেই লিখেছি। আমার কলম, আমার কষ্ট, আমার চিন্তা—সবকিছু আমার নিজের। পুরস্কার যদি লেখার মান দেখে দেওয়া হয়, তাহলে আজও আমি সেটার দাবিদার।”
পুরো আলোচনা জুড়ে ইরার আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক অবস্থান প্রশংসা পায়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় থামে না।
এই সময়েই, “সাহিত্যসমাজ” পত্রিকায় প্রকাশ পায় ইরার একটি খোলা চিঠি:
“আমি আমার পরিচয় লুকিয়ে লেখালিখি করেছিলাম, কারণ আমি দেখেছি—একজন নারী সাহিত্যে যদি প্রতিবাদী, সাহসী কিংবা যৌনতার প্রসঙ্গ তোলে, তাকে বলা হয় ‘অশালীন’ বা ‘পুরুষানুকরণকারী’। সেই একই কথা যদি একজন পুরুষ লেখে, তাকে বলা হয় বাস্তববাদী। এই দ্বৈত মানদণ্ডই আমাকে মুখোশ পরতে বাধ্য করেছিল।
আজ আমি সেই মুখোশ খুলেছি। এবং আপনাদের এই প্রাপ্তি ও প্রতিক্রিয়া আমাকে জানান দিচ্ছে—লড়াইটা কেবল শুরু হলো।”
চিঠিটি অজস্র মানুষ শেয়ার করে। কেউ বলে, “এটাই আসল সাহস”, কেউ বলে, “এটা একধরনের নাটক”।
দুই সপ্তাহের বিতর্ক, আলোচনা ও পর্যালোচনার পর পুরস্কার কমিটি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে:
“রুদ্র সেন যে ইরা সেন—এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা লেখার গুণমান বিবেচনা করেই পুরস্কার প্রদান করেছি। লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনিই রচয়িতা। সুতরাং, পুরস্কার প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই নেই। বরং আমরা গর্বিত যে আমাদের দেশে এমন একজন লেখিকা আছেন, যিনি সাহসিকতার সঙ্গে সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছেন।”
এই ঘোষণা সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, ব্লগ—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ইরা কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু তিনি জানেন, এটাই শেষ নয়।
কলকাতা বইমেলা শুরু হয়। এইবার ইরাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই প্রথমবার, তিনি মঞ্চে নিজ নামে উঠলেন।
তাঁর বক্তৃতা শুরু হয় নীরবতার মধ্যে:
– “অনেকেই প্রশ্ন করেছেন—কেন আমি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলাম।
আজ আমি বলছি—কারণ আমি চেয়েছিলাম আমার কণ্ঠ শোনা যাক, মুখ নয়।
আমার কলম যেন কারও লিঙ্গ বিচার ছাড়াই কথা বলতে পারে।
আজ আমি জানি—কণ্ঠ ছদ্ম হয় না, কলম মুখোশ চেনে না।”
মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের চোখ ভিজে আসে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেয়।
এই সময়েই তার মা মায়া সেন চুপচাপ একদিন চায়ের কাপ হাতে বলেন—
– “তোর লেখাগুলো আমি পড়েছি নতুন করে। জানি, আমি প্রথমে রাগ করেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি—তুই আমার মেয়ে না, তুই একজন সংগ্রামী লেখক। তোর জন্য গর্ব হয়।”
ইরা কিছু বলে না। শুধু মায়ের হাত চেপে ধরে।
পুরনো বন্ধু অর্ঘ্য, যে একসময় ইরার হয়ে রুদ্রের ছায়া হয়ে থেকেছিল, হঠাৎ ফোন করে বলে—
– “তুই দারুণ করেছিস। আমি তোকে ভয় পেতাম, এখন শ্রদ্ধা করি। ভাবছি, তোর আগামী বইটায় যদি একটা নাট্যরূপ করি?”
ইরা হেসে বলেন, “অবশ্যই। এবার কিন্তু মঞ্চেও আমি নিজেই থাকবো।”
ইরার নতুন বই “মুখোশ” প্রকাশ পায়। বইটিতে রয়েছে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের ছায়া—ছদ্মনাম, পরিচয়, সমাজের বিদ্বেষ, সাহিত্যের সীমানা।
প্রকাশ অনুষ্ঠানে একজন তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন—
– “আপনার গল্প পড়ে সাহস পেয়েছি। আমিও লিখি, কিন্তু এতদিন নিজের নাম নিয়ে সাহস করিনি। আজ থেকে শুরু করব—আমার নিজের নামেই।”
ইরার চোখে জল আসে। তিনি মনে মনে বলেন,
“এই তো জয়।”
অধ্যায় ৬: শব্দ ও সমাজের সীমান্তে
“যখন শব্দ সীমান্ত পেরোয়, তখন তাকে থামানোর শক্তি কারও থাকে না। কিন্তু সেই শব্দের উৎস নারীর হলে—পৃথিবীর বহু দরজা আজও বন্ধ হয়ে থাকে।”
— ইরা সেন, নিউ ইয়র্ক সাহিত্য সম্মেলন
রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মান পাওয়ার কিছুদিন পরেই ইরার হাতে আসে একটি ইমেইল। পাঠিয়েছে “ওয়ার্ল্ড লিটারেচার কনফারেন্স – নিউ ইয়র্ক”। তারা চায়, ইরা উপস্থিত থাকুন “Voices of Resistance” প্যানেল আলোচনায়।
ইরার মন প্রথমে দ্বিধায় ভরে ওঠে। এতদিন কলকাতার ভেতরেই ছিল যুদ্ধ, এখন তাকে যেতে হবে বহির্বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রে।
কিন্তু সেই দ্বিধা ভেঙে সে নিজের ডায়েরিতে লেখে—
“যদি আমার কণ্ঠ বাংলা সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তার ভার আমি নিতে রাজি।”
হেমন্তকাল, নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীর ধারে সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্যানেলে ইরার সঙ্গে ছিলেন—
মরোক্কোর লেখিকা লায়লা সাদি
ইরান থেকে পালিয়ে আসা কবি শারমিন রেজা
আমেরিকান অ্যাক্টিভিস্ট কিম উইলসন
তারা প্রত্যেকেই এমন কিছু সমাজে লেখালেখি করেন, যেখানে সত্য বলার মূল্য দিতে হয় ব্যক্তিগতভাবে।
ইরার বক্তৃতা ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শক্তিশালী:
“আমি একসময় লিখেছিলাম ছদ্মনামে, কারণ আমার সমাজ আমাকে নিজের নামে লিখতে দেয়নি। তারা বিশ্বাস করত, নারীর লেখা শুধু প্রেমপত্র হতে পারে, প্রতিবাদ নয়।
আমি যখন নিজের পরিচয় সামনে আনলাম, তখন তারা চমকে উঠল। কারণ সত্যটা একজন নারীর কলমে এসেছে।
আমি আজ বলছি—আমাদের কণ্ঠ, আমাদের কলম, আমাদের নাম—সব আমাদের নিজেদের। সাহিত্যের কোনও সীমান্ত নেই, যেমন সত্যেরও নেই।”
প্রথম সারিতে বসে থাকা শোনার ভিড়ে কেউ কেউ চোখ মুছছিল।
প্যানেল আলোচনার শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে—
– “আপনি বলছেন আপনি পুরুষ নামে লিখেছেন। আপনি কি মনে করেন, এতে করে পুরুষদের প্রতি অবিচার হয়নি?”
ইরা মৃদু হেসে বলেন,
– “যদি আমি একজন পুরুষের নামে লিখে সমাজের নজর পেতে পারি, তাহলে সেটাই প্রমাণ করে এই সমাজ কতটা পক্ষপাতদুষ্ট। আমি কাউকে ঠকাইনি, বরং এই ব্যবস্থাটার ভেতরটা উন্মোচন করেছি। আমার লড়াই কেবল নারীর নয়, সকল ন্যায়ের পক্ষে।”
কথা শেষ হতেই করতালির ঝড় ওঠে।
সম্মেলনের পর আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগত ইরার দিকে তাকাতে শুরু করে।
“The New Yorker”, “The Guardian”, “Le Monde” – নানা দেশের সাহিত্য ম্যাগাজিন ইরাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
একটি পত্রিকায় হেডলাইন হয়: “Mukhosh to Mukti: The Bengali Writer Who Challenged the Male Gaze”
এখন ইরা শুধু কলকাতার গণ্ডিতে নেই, সে হয়ে উঠেছে নারীর কণ্ঠের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র।
এই সময়েই কলকাতার এক বিখ্যাত পুরুষ সাহিত্যিক একটি কলামে লেখেন—
“ইরা সেনের প্রতিবাদ বড়ই নাটকীয়। সমাজকে আঘাত করার জন্য মুখোশ খুলেছেন, কিন্তু মুখোশ পরে লেখার সিদ্ধান্তটা তো নিজেই নিয়েছিলেন। তার দায়ভার সমাজ নেবে কেন?”
এই বক্তব্য ইরার চোখে পড়ে। সে নিজের ব্লগে লিখে প্রতিক্রিয়া:
“আমি নিজেই স্বীকার করেছি—ছদ্মনাম ছিল আমার আত্মরক্ষার একমাত্র পথ। সেটা সমাজের মুখোশ ছিল, আমি শুধু সেই আয়নাটা ধরেছি। আজ যদি সেই আয়না অনেককে অস্বস্তি দেয়, তার মানে আয়না ঠিক কাজ করছে।”
নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে ইরা আবার নিজের শহরে আসে। বিমানবন্দরে ছোট ছোট মেয়ে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে তাকে। কেউ বলে, “আপনার বই পড়ে সাহস পেয়েছি,”
কেউ বলে, “আমি আমার প্রথম গল্পটা নিজের নামেই লিখছি এবার।”
ইরার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।
সে ভাবে—
“একটা নাম, একটা কলম, একটা সত্য—এটাই যদি আরও একশোটা মেয়েকে জাগাতে পারে, তবে যুদ্ধ সফল।”
এই সময়েই একটি সরকারি কলেজ ইরাকে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানায়।
বিষয়— “নারীর সাহিত্য: স্বাধীনতা না সংগ্রাম?”
ছাত্ররা চুপচাপ শোনে, কিন্তু এক ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলে—
– “দিদি, আপনাকে দেখে মনে হয়, সাহিত্যের জন্য একা লড়াই করা যায়।”
ইরা হেসে উত্তর দেয়—
– “একাকিত্ব আসলে কাল্পনিক, কারণ তোমার লেখা যদি কাউকে ছুঁয়ে দেয়, তুমি আর একা নও।”
ইরা এখন নতুন বই লিখছেন—“শব্দসীমা”, যেখানে থাকবে তার নিজের, লায়লা, শারমিন ও আরও অনেক নারীর কণ্ঠের গল্প।
বইটির প্রথম লাইন—
“যখন কণ্ঠের কোনও দেশ থাকে না, তখন সে হয়ে ওঠে বিশ্বভাষা।”
ইরার নাম এখন আন্তর্জাতিক সাহিত্য মানচিত্রে।
কিন্তু সে জানে, তার লড়াই এখনও চলবে।
সামাজিক মুখোশ বদলায়, কিন্তু লিঙ্গের চোখে সাহিত্য দেখা এখনো বন্ধ হয়নি। আর ইরা, সেই চোখে চোখ রেখে লিখে যাবে— নিজের নামে, নিজের শব্দে।
অধ্যায় ৭: আগুনের পাণ্ডুলিপি
“যে শব্দ একবার আগুন ছুঁয়ে ফেলে, তাকে আর ফেরানো যায় না। শুধু ছাইয়ের ভেতরেও তার চিহ্ন রয়ে যায়, সময় পর্যন্ত।”
— ইরা সেন, “শব্দসীমা” গ্রন্থভুক্ত লেখনী থেকে।
ইরার নতুন বই “শব্দসীমা” প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি মাসে, কলকাতা বইমেলায়। বইটিতে স্থান পেয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের লেখা ও সাহসী কণ্ঠের গল্প।
লেখার ধরন—
রচনা ও স্মৃতিকথার সংমিশ্রণ
সাহিত্য এবং প্রতিবাদের মেলবন্ধন
এক একটি অধ্যায় এক একটি নারীর কণ্ঠ
বইমেলার স্টলে বইটি কিনতে মানুষের লাইন লেগে যায়। পাঠকরা বলেন—
“এটা শুধু সাহিত্য না, এটা একরকম ইতিহাস।”
“প্রথমবার বুঝতে পারলাম, নারীর কণ্ঠ কত শক্তিশালী।”
কিন্তু সমানতালে শুরু হয় প্রতিক্রিয়া এবং বিরোধ।
একটি রক্ষণশীল সাহিত্য গোষ্ঠী, যাদের নাম “সংস্কৃতি পরিষদ,” সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে:
“শব্দসীমা একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে আক্রমণ করেছে। এই বই নারীদের উসকানি দেয় সমাজ-বিরোধী হতে।”
অন্য একটি গোষ্ঠী—“নাগরিক রক্ষা মঞ্চ”—এক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করে: “এই বই বিপজ্জনক। আমাদের ছেলেমেয়েদের এধরনের লেখা থেকে দূরে রাখা উচিত।”
এরপর এক রাতে কলেজ স্ট্রিটের এক ছোট প্রকাশনা স্টলে আগুন লাগে। পরে জানা যায়—স্টলটিতে রাখা ছিল কেবল ‘শব্দসীমা’।
পুলিশ ঘটনাটিকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে নথিভুক্ত করে, কিন্তু ইরার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।
কিছুদিনের মধ্যে ইরার বাড়িতে আসে একটি অজ্ঞাতনামা চিঠি।
“তুমি নারীদের বিপথে চালাচ্ছো। এখনো সময় আছে থেমে যাও। না হলে মুখোশ ছিঁড়ে দেওয়া হবে—এইবার জোরে।”
ইরা প্রথমে চুপ থাকেন।
তার মা ভয় পেয়ে বলেন, “এইবার থাম, মা। আর ঝামেলায় যাস না।”
বন্ধু অর্ঘ্যও চিন্তিত—“চাইলেই তো অন্য কিছু লিখতে পারিস!”
কিন্তু ইরা জানে—এই সময়েই থামা মানে মুখোশকে জয়ী হতে দেওয়া।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই চিঠির উত্তর সে লিখবে খোলাখুলিভাবে—পাঠকের উদ্দেশ্যে, সমাজের উদ্দেশ্যে।
ইরা তার ফেসবুক পেজে একটি খোলা পোস্ট দেন, শিরোনাম:
“যারা ভয় পায় কণ্ঠকে”
“আমি জানি, আমার শব্দ কিছু মুখোশ পোড়ায়।
আমি জানি, কেউ কেউ চায় সেই শব্দ আগুনে ঝলসে যাক।
কিন্তু আমি লিখেছি কেবল আমার কথা নয়—শত শত মেয়ের হয়ে।
আমি ভয় পাই না, কারণ আমার শব্দ এখন আমার একার নয়।
আমার পাঠকদের কণ্ঠে আমার লেখার পুনর্জন্ম ঘটছে, প্রতিদিন।
এবং কেউ যখন চিঠিতে হুমকি দেয়, আমি জানি—তারা কেবল ভয় পেয়েছে।
ভয় পেয়েছে একটা সত্যকে, একটা মেয়েকে, একটা কলমকে।
সেই ভয়ই আমার সাহস।”
এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে “শব্দসীমা”-কে কেন্দ্র করে আলোচনা, পাঠচক্র, এবং এমনকি ছোট মিছিল শুরু হয়।
জেএনইউ, প্রেসিডেন্সি, বিশ্বভারতী—সবখানেই পাঠকেরা বলে ওঠে—“এই শব্দ আমাদের।”
একটি ছাত্রসংগঠন দেয় স্লোগান: “ভয় নয়, ভাষা চাই। মুখোশ নয়, মুখ চাই।”
একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল এই ইস্যুকে সমাজে “নারীর কণ্ঠরোধের চেষ্টা” বলে চিহ্নিত করে।
সরকার পক্ষ থেকে কোনও মন্তব্য না এলেও, প্রকাশনা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন—
“সাহিত্যিক স্বাধীনতা থাকলেও, কিছু কিছু লেখা সমাজকে উত্তেজিত করতে পারে। সংবেদনশীল বিষয় লেখার আগে দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।”
ইরা সংবাদ সম্মেলনে বলেন—
“দায়বদ্ধতা থাকবেই। আমি দায়বদ্ধ সেই মেয়েদের কাছে, যাদের গল্প আজও অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকে। আমি দায়বদ্ধ ভবিষ্যৎ পাঠকদের কাছে—যারা চাইবে সত্য জানুক। আর যদি সত্য উত্তেজিত করে সমাজকে, তাহলে হয় সমাজ পাল্টাবে, নয় আমি থামব না।”
এই বিতর্ক চলাকালীন এক রাতে দরজায় বেল বাজে।
ইরা দরজা খুলে দেখে, একজন প্রৌঢ়া—চোখে জল, কণ্ঠ কম্পিত।
তিনি বলেন,
– “আপনার লেখা পড়ে আমি সাহস পেয়েছি। চল্লিশ বছর ধরে আমি কবিতা লিখি, কিন্তু কারো দেখানোর সাহস পাইনি। আজ আমি আমার প্রথম কবিতার খাতা ছাপতে দিলাম—আমার নিজের নামে।”
ইরা তাকে জড়িয়ে ধরে।
– “এইটাই আসল জয়, কাকিমা। এই শব্দই আসল আগুন।”
‘শব্দসীমা’ বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ ঘোষণা হয়—মাত্র একমাসে।
সমাজের একাংশ এখনও বিরোধিতা করে, হুমকি দেয়।
কিন্তু একই সঙ্গে নতুন নতুন নারী লেখিকা, কণ্ঠ শিল্পী, নাট্যকার—সাহস করে সামনে আসছেন।
ইরা জানেন—এটা কোনও একদিনের বিপ্লব নয়। এটা চলবে, কারণ আগুন একবার জ্বললে, তা শুধু পোড়ায় না, আলোও দেয়।
“শব্দসীমা” এখন শুধুমাত্র একটি বই নয়—এটা হয়ে উঠেছে এক চেতনাগত আন্দোলন, একটা ভয়কে জয় করার ভাষা,
একটি নামহীন কণ্ঠের নাম।
ইরা জানেন—আরও মুখোশ আসবে, আরও আগুন লাগবে।
কিন্তু তার হাতে এখন শব্দের যে আগুন, তা আর কেউ থামাতে পারবে না।
অধ্যায় ৮: নিজ নামে ইতিহাস
“যখন নিজের নামেই ইতিহাস লেখা শুরু হয়, তখন তা আর কাগজের উপর থাকে না—মানুষের চেতনায় গেঁথে যায়।”
— ইরা সেন, পুরস্কার গ্রহণ বক্তৃতা থেকে।
চলতি বছরের আনন্দবাজার সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা হয় মার্চ মাসে।
সেরা লেখক বিভাগে নাম আসে—ইরা সেন।
গ্রন্থ: “শব্দসীমা”
পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে এক রাতেই।
বিভিন্ন চ্যানেলে হেডলাইন হয়:
“মুখোশ ছিঁড়ে ইতিহাস গড়লেন ইরা সেন”
“নারী কণ্ঠের সাহস পেল সাহিত্য সমাজ”
“ছদ্মনামের অন্ত থেকে নিজের নামের উত্তরণ”
কিন্তু আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে আসে এক নতুন বিতর্কের ছায়া।
পুরস্কার ঘোষণার পরই সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়।
এক সাহিত্যিক বলেন: “একজন লেখক যখন নিজের পরিচয়ই দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখেন, তখন তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। ছদ্মনামের আড়াল থেকে কীভাবে তিনি নৈতিক অধিকার পান পুরস্কার নেওয়ার?”
এই পোস্টের নিচে কেউ বলেন—
“সাহিত্য কি কেবল সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত হয়?”
“তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাদের আসল লেখকদের প্রতি অবিচার।”
এইসব মন্তব্য আবারও ইরার চারপাশে মুখোশের শ্বাস টেনে আনে।
ইরার প্রকাশক, অভিজিৎ, ফোন করে বলেন—
– “ইরা, তুমি চাইলেই পুরস্কারটা নিতে পারো, তাতে আইনত কোনও বাধা নেই। কিন্তু সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরও বাড়তে পারে।”
ইরা জবাব দেয়—
– “আমি জানি। কিন্তু আমি এই পুরস্কার নিজের নামে নিচ্ছি, কোনও ছায়া হয়ে নয়। এটাও প্রতিবাদেরই অংশ।”
প্রকাশক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
– “তবে তৈরি থাকো, প্রশ্ন আসবে তোমার প্রতিটি শব্দ ঘিরে।”
নেটিভ থিয়েটারে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী।
ইরা যখন মঞ্চে ওঠেন, পেছনে ফিসফাস—“ওই না, সেই মুখোশওয়ালী।”
সঞ্চালক মৃদু হাসি দিয়ে বলেন—
“এই পুরস্কার শুধু সাহিত্যের নয়, সাহসিকতারও।”
ইরা মাইক হাতে নেয়।
তার বক্তৃতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে:
“আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমার নিজের নামে, নিজের কণ্ঠে।
আমি জানি, আমার প্রথম লেখা যখন পুরুষ নামে প্রকাশিত হয়, তখন আপনি কেউ কেউ প্রশংসা করেছিলেন। আজ যখন জানলেন, সে এক নারী ছিল—আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল।
প্রশ্ন উঠল বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সাহিত্য লেখকের লিঙ্গ দেখে বিচার হয় না—তার সত্যের গভীরতা দেখে হয়।
আমি লেখিকা হতে পারি, কিন্তু তার চেয়েও আগে আমি একজন সত্য-সন্ধানী।
আজ আমি পুরস্কার নিচ্ছি আমার নামে, যাতে আগামী দিনের কোনও মেয়ে নিজের কণ্ঠকে ঢাকতে না বাধ্য হয়।”
হলজুড়ে নীরবতা—তারপর ধ্বনি ওঠে করতালির। অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে সমর্থন জানায়।
পরদিনের প্রতিটি দৈনিকে ইরার বক্তৃতার অংশ জায়গা করে নেয়।
“ইতিহাসে নিজের নাম লিখলেন ইরা সেন”
“নারীর কণ্ঠে সাহিত্যের প্রতিবাদ”
“মুখোশ নয়, মুখের সাহস জয়ী”
অসংখ্য ছাত্রী, নতুন লেখক, কর্মজীবী নারী এই ভাষণ পড়ে চিঠি লেখেন ইরাকে।
“আপনাকে দেখে মনে হলো, আমি একা নই।”
“আপনি আমাদের মতো মেয়েদের জন্য একটা পথ খুলে দিয়েছেন।”
“আমি আমার গল্পটা এবার নিজের নামেই ছাপাবো।”
পুরস্কারপ্রাপ্তির তিনদিন পর ইরার ঘরে আসে এক পোস্টকার্ড।
লেখা—
“আমার মেয়ে তোমার বক্তৃতা শুনে বলেছে—‘আমি বড় হয়ে ইরার মতো হবো।’
আমি বুঝলাম, সমাজ পাল্টাচ্ছে।
তুমি মুখোশ খুলে সাহস জুগিয়েছো আমাদের বাড়ির ভেতরেও।
— এক মা, নাম না জানা একজন নারী”
ইরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
সে ডায়েরিতে লেখে— “এই চিঠিই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
একটি বিখ্যাত টিভি চ্যানেল ইরাকে লাইভ শোতে আমন্ত্রণ জানায়।
সঞ্চালক প্রশ্ন করে—
– “আপনি কি এখন নিজেকে সফল মনে করেন?”
ইরা বলে—
– “সফলতা পরিমাপ করা যায় না।
আমি শুধু জানি, একসময় আমার লেখা সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ আমি পুরুষ ছদ্মনামে লিখেছি।
আজ আমি আমার নামেই লিখি, এবং তাও পাঠক পড়েন।
যে সমাজ একদিন মুখোশ ছাড়া মেনে নিত না, আজ সেই সমাজ আমার মুখকে দেখে সাহস খুঁজে নেয়।
সেই পরিবর্তনই আমার জয়।”
সঞ্চালক মৃদু হাসে—“তাহলে ভবিষ্যতের ইরা সেনেরা মুখোশ পরবে না?”
ইরার উত্তর—
“পরবে না। আর পরলেও জানবে—মুখোশ কোনওদিন শেষ কথা নয়।”
ইরার নাম বাংলা সাহিত্যে অমলিনভাবে যুক্ত হয় নারী কণ্ঠের অগ্রপথিক হিসেবে।
তার লেখা এখন পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়, সাহিত্য সম্মেলনে আলোচনা হয়,
আর সবচেয়ে বড় কথা—
অসংখ্য নারী কলম তুলে নেয় নিজের নামে।
ইরা জানেন—এ গল্প কেবল তার নয়, অনেকের।
তাই সে নিজের শেষ বইয়ের নাম রাখে— “মুখোশের দিনলিপি”
প্রথম পাতায় লেখা:
“আমি মুখোশ পরেছিলাম সমাজকে দেখানোর জন্য, আমি কী দেখতে পাচ্ছি।
আমি মুখোশ খুলেছি সমাজকে দেখাতে, কীভাবে আমি বাঁচতে চাই।
আমি ইরা সেন—নিজ নামে ইতিহাস লিখেছি।”
—
শেষ




