পর্ব ১
বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। একটানা, নিরলস। ছাদের টিনে পড়ছে টুপটাপ, জানলার পাশে পেতলের ঘণ্টার মত ঝিকিয়ে উঠছে শব্দগুলো। রূপা চুপচাপ বসে আছে বারান্দার এক কোণে, চায়ের কাপ হাতে। ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা কাপের গায়ে ধোঁয়া ওঠা ফাটল দেখা যাচ্ছে, যেমন ফাটল দেখা দেয় সম্পর্কেও—মাঝেমধ্যে চুপিসারে, না-বলা কিছু জমানো কথা জমে জমে। রূপার বয়স এখন ছত্রিশ। আট বছর হল বিয়ে হয়েছে রতনের সঙ্গে। ছেলে নেই, মেয়ে নেই, সংসারটা চলে যায় দিনের পর দিন, ফেসবুক স্ক্রল আর ওটিটির গ্লানি নিয়ে। রতনের ভালোবাসায় কোনো অভাব নেই, তবু কোথায় যেন কিছু অনুপস্থিত—কথার গভীরে, চোখের ভাষায়, কিংবা ছুঁয়ে দেওয়ার ব্যাকরণে।
আজ দুপুরে, সেই একঘেয়ে স্ক্রলের মাঝেই, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা মেসেজ। প্রোফাইল ছবি খানিকটা অস্পষ্ট, কিন্তু নামটা দেখে থমকে গেল রূপা—সুমন রায়। সেই নাম। সেই মুখ। মেসেজে লেখা, “আপনার হাসিটা আগের মতোই আছে। অনেক দিন পর দেখলাম।” হৃদয়ের কোথাও যেন হালকা শিরশিরে একটা কাঁপুনি নামল। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ছেলেটির সঙ্গে প্রথম দেখা। তখন রূপা সদ্য সদ্য প্রেম বুঝছে, আর সুমনের চোখে চোখ পড়লে বুকের ভেতর কেমন একটা ব্যথা হত। চুপচাপ বসে থাকা, ক্লাসের ফাঁকে কথা বলা, চায়ের দোকানে হেসে ওঠা—সব মনে পড়ে গেল হঠাৎ। কিন্তু তখন রূপার চারপাশে ছিল অনেক নিয়ম, ভয় আর অজানা সংকোচ। আর সুমন? সে তো খুব চুপচাপ, নিজের মত ছিল। তখন কিছু হয়নি, হওয়ার সাহসও হয়নি। হঠাৎ করে একদিন ছেলেটা কলেজ ছাড়ল, বাড়ি ফিরে গেল—নাকি কোনো চাকরিতে ঢুকে পড়ল, সেই খবর রূপার জানা ছিল না। তারপর কেটে গেছে প্রায় পনেরোটা বছর।
রূপা তখন মেসেজের উত্তর দেয়নি। মোবাইলটা নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মনটা অদ্ভুত রকমের অস্থির হয়ে উঠেছিল। রতন তখন অফিসে, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কাজের মাসি ঘুমোচ্ছে পাশের ঘরে। ঘরের মধ্যে একটা গাঢ় নির্জনতা, আর সেই নির্জনতাকে যেন চিরে দিয়ে মাথায় ঘুরতে থাকে সুমনের মেসেজ। রাতে রতন ফিরে এলে তার মুখে হাসি, সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট, কারণ কোনো নতুন প্রজেক্টে অ্যাপ্রুভাল এসেছে। রূপা হাসে, শুভেচ্ছা জানায়, পাশে বসে খায়ও, কিন্তু মনটা বারবার মোবাইলের দিকে ছুটে যায়। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, “এত বছর পর এমন একটা মেসেজ কেন লিখল সুমন? স্রেফ স্মৃতি?” নিজের অজান্তেই একটা ব্যাকুলতা এসে যায় ভেতর থেকে।
পরদিন সকালে উঠেই মোবাইলটা হাতে নেয় রূপা। মেসেঞ্জারে ঢুকতেই দেখে, নতুন একটা মেসেজ—“আজকাল কেমন আছেন? বলবেন না?” এবার আর সে থামতে পারে না। লিখে ফেলে, “ভালো আছি। আপনি?” সেখান থেকেই কথাবার্তা শুরু। প্রথমে ছোট ছোট মেসেজ, ধীরে ধীরে বড় হয়। পুরোনো গল্প, পুরোনো বন্ধুদের নাম, কে কোথায় আছে, কে কী করছে। তারপর আসে নিজেদের কথা—কে কীভাবে বিয়ে করল, কার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, কে কতটা খুশি। সুমন বলে, তার বিয়ে হয়নি। একটা সম্পর্ক ছিল, ভেঙে গেছে বহু বছর আগেই। এখন সে একাই থাকে, দক্ষিণ কলকাতার একটা ছোট ফ্ল্যাটে, ছবি আঁকে, ফ্রিল্যান্স ডিজাইন করে। মাঝে মাঝে কাজ নিয়ে বাইরে যায়। রূপা বিস্মিত হয়। সেই চুপচাপ সুমন এত কিছু করছে!
একদিন সুমন লিখল, “তোমাকে দেখে অবাক হলাম। আগের থেকেও সুন্দর লাগছে।” রূপা উত্তর দিল না, কিন্তু মনের ভিতরে কোথাও যেন হালকা করে দোলা দিয়ে গেল কথাটা। এমন কথা রতন বহুদিন বলেনি। কিংবা বললেও সেটা যেন দায়সারা ভঙ্গিতে, কোনো গভীরতা ছাড়া। সুমনের কথায় ছিল তাকিয়ে থাকা, চেনার চেষ্টা, একটা আলতো আগ্রহ। রূপা দিন ফুরোলেই অপেক্ষা করে মেসেজের। কখন আসবে, কী লিখবে, কী বলবে। নিজের অজান্তেই প্রতিদিন চুল আঁচড়ায়, হালকা লিপস্টিক দেয়, যেন মোবাইলে কথা বললেও একটু নিজেকে ঠিকঠাক রাখে। কামরা গরম, বাইরে ভ্যাপসা, তবু ভিতরের এক অদৃশ্য রোমাঞ্চ তাকে শীতল রাখে।
তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় সুমন লিখল, “একটা এক্সিবিশন আছে আমার, ঢাকুরিয়ায়, শুক্রবার বিকেলে। যদি আসো, দেখা হবে, অনেক গল্প জমে আছে।” রূপা জানে, এর মানে কী। দেখা মানে শুধু কথা বলা না, একটা ফাঁক তৈরি করা। একটা সুযোগ, যা এতদিন শুধু কল্পনায় ছিল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল সে। রতন তখন গোসল করছে। বাইরে থেকে আসে ফুটবল খেলার চিৎকার, কারা যেন পাড়ার ছেলেরা ঝগড়া করছে। সবকিছুর মাঝখানে রূপা তাকিয়ে থাকে ছাদের জলে, নিজের মুখের ছায়ার দিকে। এই দেখা কি উচিত? সুমন কি এখনও শুধু বন্ধুত্বের জায়গায় আছে? আর সে নিজে?
তবু জানে, যেতে ইচ্ছে করে। অনেকদিন পর এমন কারো সঙ্গে দেখা হবে, যে একসময় তাকে দেখে চুপ করে হেসেছিল, আর আজও তার হাসি মনে রেখেছে। এটা কি সহজে পাওয়া যায়?
সেদিন রাতে সে ঘুমোতে পারে না। শুয়ে থাকে রতনের পাশে, চোখ বন্ধ, কিন্তু মন খোলা দরজার মতো দুলতে থাকে সেই এক প্রশ্নে—আমি কি যাব?
পর্ব ২
শুক্রবারটা আসতেই চাইছিল না। দিন যেন কচ্ছপ হয়ে গেছে, সময়টাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিছনের দিকে। অথচ রূপার ভেতরে কেমন একটা অস্থির ছটফটানি। সে বুঝতে পারছিল না, যে মানুষটাকে সে পনেরো বছর আগে শেষবারের মতো দেখেছিল, তাকে আবার দেখার এতটা আগ্রহ কেন জন্মাচ্ছে? এটা কি শুধুই কৌতূহল? নাকি আরও কিছু?
রাতের বেলা, বিছানায় শুয়ে রতনের নিঃশ্বাসের শব্দের পাশে রূপা চোখ বন্ধ করেও জেগে থাকে। তার শরীর তখনো শান্ত, কিন্তু মনটা জেগে আছে—চুপিচুপি হাঁটছে সুমনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনার দিকে। সেদিন দুপুরবেলা, খাবার পর সুমনের মেসেজ এসেছিল—“আমি অপেক্ষা করব। না এলেও কিছু বলব না। শুধু জেনো, দেখলে ভালো লাগত।” এই মেসেজে কিছু জোর ছিল না, কোনো চাপ ছিল না। কিন্তু ঠিক এই জোর না থাকার মধ্যেই একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যেন কারো মায়া-ভরা চোখ তাকে ডাকছে, কিন্তু ছুঁতে চাইছে না।
শুক্রবার সকালে রতন যখন অফিসের জামা ইস্ত্রি করছিল, রূপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে সে। বুকের ভেতরে লুকনো উত্তেজনা, কিন্তু মুখে স্বাভাবিকতা। দুপুরে রান্না সেরে, কাজের মাসিকে ছুটি দিয়ে, সে নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করাল। খুব বেশি কিছু নয়, একটা মাখন রঙের সুতির শাড়ি পরল, কানে হালকা দুল, হাতে একটা ঘড়ি। চুলটা ছেড়ে দিল, চোখে একটু কাজল। সব যেন স্বাভাবিক, অথচ কোথাও একটা ইচ্ছে কাজ করছে—নিজেকে ঠিকভাবে মনে রাখাতে।
বাস ধরল তিনটে নাগাদ। বৃষ্টি হয়নি, আকাশটা ধোঁয়া ধোঁয়া রকমের। ঢাকুরিয়ার গলি, যেখানে গ্যালারিটা ছিল, বেশ নিরিবিলি। সুমন গ্যালারির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। রূপাকে দেখে প্রথমে একটু থমকাল, তারপর হাসল—একটা নিঃশব্দ হাসি, যেখানে ছিল না কোনো গর্ব, কোনো অবাক ভাব, শুধু একরাশ চেনা অনুভব। সেই হাসিটা দেখেই রূপা টের পেল—সে ভুল করেনি।
গ্যালারির ভেতরটা শান্ত। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর রঙ, আলো, আর গন্ধ সব মিলিয়ে যেন একটা সঙ্গীতের মতো ছায়া তৈরি করছিল। সুমন রূপাকে নিয়ে একটার পর একটা ছবি দেখাচ্ছিল, ব্যাখ্যা করছিল নিজের আঁকা নিয়েই। কিন্তু রূপার মন তখন কেবল ওর কণ্ঠ শুনছিল—চেনা, অথচ নতুন হয়ে ওঠা শব্দগুলো। মাঝে মাঝে সুমনের আঙুল রূপার হাতের খুব কাছে এসে যাচ্ছিল, কখনো যেন ইচ্ছা করে ছোঁয়ার মত, আবার কখনো ঠিক পাশ দিয়ে চলে যাওয়া। রূপার শ্বাস একটু একটু করে বদলাচ্ছিল, সে বোঝাতে চাইছিল না কিছু, লুকিয়ে রাখতে চাইছিল সব।
একটা ছবির সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় সুমন বলল, “তুমি কি কখনো নিজেকে ভুলে গেছ?” প্রশ্নটা হঠাৎ এল। রূপা চমকাল না, কিন্তু থমকে গেল। উত্তর দিতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে। একটু পরে ধীরে বলল, “হয়তো… ভুলে যেতে হয়েছিল।” সুমন তাকাল না, ছবিটার দিকে চেয়ে বলল, “আমি ভুলতে পারিনি। তখন কিছু বলিনি বলে হয়তো এখন বলছি।” কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। দুজনেই নীরব, কিন্তু সেই নীরবতা চাপ নয়—বরং একটা নরম স্বীকারোক্তির মতো।
রূপার ফোন বেজে উঠল। রতন ফোন করেছে। সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, “উঠতে হবে।” সুমন মাথা নোয়াল, একটা হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি জানতাম। তবু চেয়েছিলাম।” রূপা বেরিয়ে এল গ্যালারি থেকে। গলির মোড়ে গিয়ে একটা অটো ধরল। তার হাতটা কাঁপছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা অতৃপ্তি, আরেকটু থেকে যাওয়ার ইচ্ছে দানা বাঁধছিল।
বাসায় ফিরে দেখে রতন তখনও আসেনি। ঘরে নিঃশব্দ। জানলা খুলে দেয় রূপা, ঠান্ডা হাওয়া এসে মুখ ছুঁয়ে যায়। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকক্ষণ। মনে হয়, আজ একটুও অনৈতিক কিছু হয়নি। কেবল একটু দেখা হয়েছে, কিছু কথা হয়েছে, তাও পুরনো পরিচিত একজনের সঙ্গে। কিন্তু সত্যি কি তাই?
সেই রাতে যখন শুয়ে পড়ে, মোবাইলটা বালিশের নিচে রাখে। ঘুম আসে না। চোখ বুজলেই সুমনের চেহারা, তার বলার ভঙ্গি, তার না-ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া অনুভবগুলো মনের মধ্যে ঘোরে। হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে ওঠে। মেসেজ—“আজ তোমার চোখে একধরনের আলো ছিল, আমি অনেকদিন এমন কিছু দেখিনি।” রূপা মেসেজ পড়ে, উত্তর দেয় না। শুধু বুকের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস টেনে নেয় গভীরভাবে। জানে, এই আলো সহজে নিভবে না।
পর্ব ৩
রবিবার সকালে রূপা জানলার পাশে বসে থাকে। সূর্যটা জানলার গায়ে এসে পড়ছে, বাইরের গাছে কাক ডাকছে মাঝে মাঝে। রতন আজ একটু দেরি করে উঠেছে, হাতমুখ ধুয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, আর রূপা চুপচাপ চা বানিয়ে তার পাশে রেখে দিয়েছে। দু’জনের মাঝখানে কোনও কথা নেই, শুধু দৈনন্দিনতার কিছু শব্দ, যেগুলো বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবু এই নিঃশব্দতা আজ রূপার কাছে আরও ভারী লাগে।
ফোনটা চুপচাপ বিছানার পাশে রাখা। একবার না একবার, সে দেখেই নেয় মেসেজ এসেছে কিনা। রাতের সেই মেসেজটা পড়ার পর সারা শরীরে একটা শীতল উত্তাপ ছড়িয়ে গিয়েছিল। সুমনের লেখা—“আজ তোমার চোখে একধরনের আলো ছিল, আমি অনেকদিন এমন কিছু দেখিনি।” কথাটা সরল, কিন্তু যেভাবে বলা হয়েছে, তার মধ্যে ছিল এমন এক আশ্চর্য সত্য, যা মুখে বলা হয় না, শুধু অনুভব করা যায়।
দুপুর গড়াতে না গড়াতেই আবার মেসেজ। “তোমাকে দেখার পর ঘুম আসেনি। বারবার মনে হচ্ছিল, তোমার হাতের আঙুলে কি তখনও সেই নীল রঙের নেলপলিশ ছিল?” রূপা থমকে যায়। তার হাতের দিকে তাকায়। নীল রঙটা শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সুমনের মনে সেই ছোট্ট খুঁটি কেমন করে রয়ে গেছে? সে লিখে দেয়—“না, কালকে ছিল না। অন্য একটা পরেছি আজ।” তারপর নিজেই অবাক হয়ে যায় নিজের উত্তরে। কেন সে এইসব বলছে? কী দরকার এসব বিনিময়ের? কিন্তু মনে হয়, এতদিন যে কথা কেউ শোনেনি, কেউ খেয়াল করেনি—সুমন যেন সেই নিঃশব্দ দিকগুলো শুনতে পাচ্ছে।
পরের দিন সকালে সুমনের মেসেজ—“আজ যদি একটুও সময় পাও, তাহলে এসো আমার স্টুডিওতে। দালমিয়া রোডে, একটা পুরনো দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। কেউ থাকবে না, শুধু আমি। একটুখানি গল্প করা যাবে।” রূপা মেসেজটা পড়ে অনেকক্ষণ কিছু বলে না। ভিতরে কোথাও একটা কাঁপুনি ওঠে। ‘স্টুডিওতে’, এই কথাটার মধ্যেই যেন একটা অন্যরকম আমন্ত্রণ আছে। সেখানে কেউ থাকবে না—এই বাক্যটা যেন কিছু একটার সম্ভাবনা তৈরি করে।
রূপা জানে, এই রকম একটা জায়গায় গেলে, যে বাঁধন এতদিন ধরে গুছিয়ে রেখেছে সে, সেটা আলগা হয়ে যাবে। তবু জানে, সে যেতে চায়। কেননা এই টান, এই আকর্ষণ শুধু শরীরের নয়, মনেরও। সে হয়তো প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না, কিন্তু ভালো লাগা, আদর, মায়া—এসব যে সে পাচ্ছে, তাও অস্বীকার করতে পারে না।
সে জানায় না কাউকে, এমনকি নিজেকেও পুরোপুরি জানায় না সিদ্ধান্তটা। কিন্তু দুপুর তিনটেয় সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই বাড়িটার সামনে। পুরনো লোহার গেট, ভেতরে একটা নরম আলোয় ঢাকা সিঁড়ি। দ্বিতীয় তলায় একটা খোলা দরজা। ভিতরে গিয়ে দেখে, ঘরটা ছিমছাম। বড় বড় ক্যানভাস রাখা, জানলার পাশে একটা কাঠের চেয়ার। সুমন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে, পরনে একটা সাদামাটা পাজামা-পাঞ্জাবি। চোখে অবাক হওয়া নয়, বরং এমন একটা স্বাভাবিক স্বস্তি, যেন এটা হতেই ছিল।
রূপা ভেতরে ঢোকে। সুমন জল দেয়, তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশে বসে। কথাও হয়, স্মৃতিও ওঠে, কিন্তু এবার কথা নয়, চুপ থাকাটাই বেশি হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ সুমন তার হাতটা স্পর্শ করে। হালকা ছোঁয়া, আঙুলের ডগায়। রূপা কাঁপে না, সরে যায় না। শুধু ভাবে, এই ছোঁয়া কেন এত আলাদা লাগছে? এত কোমল, অথচ এত গভীর?
সুমন তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি জানো, তোমার ঘাড়ের ঠিক নীচে যে তিলটা আছে, সেটা আগেও দেখেছিলাম কলেজে একবার। তখন ছুঁতে পারিনি। এখন ইচ্ছে করছে।” রূপা তার দিক থেকে মুখ ঘোরায় না। কিছু বলে না। শুধু চোখ বুজে থাকে, যেন সেই মুহূর্তটুকু একটু দীর্ঘ করতে চায়।
সুমন তার ঠোঁট নিয়ে ধীরে সেই তিলটাকে ছুঁয়ে ফেলে। খুব আস্তে, খুব সাবধানে। রূপার গা কাঁপে না, শুধু নিঃশ্বাসটা একটু ভারী হয়ে আসে। এই যে নিঃশব্দ কামনা, এটাকে হয়তো কেউ চিৎকার করে চায় না, কিন্তু যখন এসে পড়ে, তখন ঠেকানো যায় না।
ঘরের বাতাস থেমে থাকে যেন। কেউ কিছু বলে না। সময় যেন আটকে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। তারপর সুমন বলে, “চলে যাবে?” রূপা ধীরে উঠে দাঁড়ায়, চোখে কোনও তাড়া নেই, তবু ভিতরে কোথাও অদ্ভুত ব্যথা। সে দরজার দিকে হাঁটে, সুমন পেছন পেছন আসে না। শুধু বলে, “আবার দেখা হবে তো?”
রূপা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বলে না কিছু। কিন্তু তার পায়ের ছন্দ, তার শরীরের মৃদু ভঙ্গি যেন বলে দেয়—এই দেখা শেষ নয়।
পর্ব ৪
সেদিন রাতটা একেবারে নিঃশব্দে কেটে গেল। রূপা কিছু খায়নি। শুধু চুপ করে বসে ছিল বারান্দার চেয়ারে। নিচে রাস্তার আলো ফিকে, কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল মাঝরাতে, আবার থেমে গেল। বাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাসের শব্দটাও ভারী হয়ে উঠেছিল যেন। রতন ঘুমিয়ে পড়েছিল আগেভাগেই। অফিসে এখন ওর চাপ বেড়েছে, ক্লান্তি গায়ে লেগে থাকে। রূপা তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে, যেন তার ভিতরের অন্ধকারটাকে সেখানে গলিয়ে দিতে চাইছিল।
মোবাইলটা তখন নিঃশব্দে জ্বলজ্বল করছিল বালিশের পাশে। সুমনের মেসেজ এসেছে—”তুমি এলে, বসলে, রইলে… কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারিনি পুরোটা। তাও যেন মনে হচ্ছে, অনেক কিছু ছুঁয়ে ফেলেছি।” রূপা মেসেজটা পড়ে, মুছে দেয় না। উত্তর দেয় না। কিন্তু জানে, ভিতরে একটা নতুন দরজা খুলে গেছে। যেটা সে নিজেই খুলতে চায়নি, অথচ খুলে গেছে, নিঃশব্দে।
পরের দিন সকালে রূপার গায়ে একটা ক্লান্তি ভর করেছিল। ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। তবু রান্না করে, বাসন মাজে, ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়, সব কিছু ঠিকঠাক মতো করে। কিন্তু তার চোখে একটা ম্লান চেহারা বসে থাকে সারাদিন। আয়নায় তাকালে নিজেকেই যেন অপরিচিত লাগে। মনে হয়, এই চোখে আগুন আছে, আবার জলও।
সুমন আবার মেসেজ করে। এবার অনেক কথা বলে না। শুধু লিখে, “চলবে তো একদিন বাইরে কোথাও? শহরের বাইরে কোথাও? কেউ চিনবে না, কেউ প্রশ্ন করবে না।” রূপা মেসেজটা দেখে, অনেকক্ষণ ধরে দেখে। তারপর ফোনটা রেখে দেয়। কিছু লেখে না। কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন একটা শব্দ জন্ম নেয়—”হয়তো।”
সপ্তাহখানেক যায়। দু’জন কথা বলে, খুব বেশি নয়। রূপা বুঝে যায়, সম্পর্কটা এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা খাদের ধারে। এখানে আরেক পা ফেললে আর ফিরতি পথ নেই। কিন্তু সেই খাদের কিনারা থেকেও সে সরে আসে না। বরং একদিন দুপুরবেলা, রান্নাঘর গুছিয়ে নিয়ে, ছেলেকে টিউশনে পাঠিয়ে, ফোনে মেসেজ করে—”কাল দুপুরে পারব। কোথায় যাব?”
সুমন ঠিক করে দেয়। এক নির্জন জায়গা—কাছেই, শহর থেকে একটু বাইরে, একটা হোমস্টে টাইপ রিসর্ট। খুব জমজমাট কিছু নয়, বরং গাছপালা ঘেরা, একতলা ঘর, শান্ত। রূপা জানে, এই যাওয়া আর শুধু দেখা নয়। এটা অন্য কিছু। এটা শরীরের দিকেও হেলে পড়া। আর এখন সে প্রতিরোধ করছে না।
পরদিন দুপুরে, বাসে চেপে রূপা পৌঁছে যায় নির্ধারিত জায়গায়। সুমন আগে থেকেই ছিল। হাতে কফির কাপ, মুখে চাপা উত্তেজনা। দু’জনের চোখে কোনও চমক নেই, শুধু ধীরে এগিয়ে আসার ইচ্ছে। ঘরের ভেতর ঢুকেই রূপা দেখে, জানলার পর্দা নড়ে উঠছে হাওয়ায়, বিছানায় সাদা চাদর পাতানো, একধরনের শান্তি ছড়িয়ে আছে ঘরজুড়ে। কিন্তু সেই শান্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক নিষিদ্ধ তীব্রতা।
কথা শুরু হয় ধীরে ধীরে, হাসি, গল্প, চায়ের চুমুক। তারপর একটা সময় আসে, যখন আর কোনও শব্দ দরকার পড়ে না। সুমন এগিয়ে আসে, রূপার চুলে হাত রাখে। রূপা চোখ বন্ধ করে। এই ছোঁয়াতে কিছু নেই ছলনার, বরং আছে গভীর চাওয়া। দু’জনের ঠোঁট একসময় মিলিয়ে যায়, ধীরে, তারপর আরও ঘন হয়ে। সেই চুম্বনের মধ্যে কামনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল বেদনা। যেন দীর্ঘদিনের এক না-বলা কথা আজ জিভে গলে পড়ছে।
বিছানায় যখন শরীরের ভাষায় কথা শুরু হয়, তখন রূপা নিজেকে আর আটকায় না। তার শরীর, এতদিন যার শুধু দায়িত্ব ছিল, কর্তব্য ছিল, আজ একটু খোলা হাওয়ায় আসার সুযোগ পায়। সুমনের হাত, ঠোঁট, চোখ—সব যেন তাকে নতুন করে চিনতে চায়। রূপা কোনও কথা বলে না, শুধু শরীর দিয়ে অনুভব করে, যে ভালোবাসা হয়তো চিরকাল সংসারেই পাওয়া যায় না, সেটা এই একটুখানি সময়ে ধরা দেয়।
ঘণ্টা দুয়েক পরে, যখন তারা পাশাপাশি শুয়ে থাকে, তখন সুমন ধীরে বলে, “তুমি ঠিক করেছ আসবে, এটা আমি ভাবিনি। ভেবেছিলাম, তুমি নিজেকে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে নেবে।” রূপা হালকা হাসে, বলে, “আমি নিজেকেও চিনতে পারিনি। তবু এসেছি। কারণ এই আসাটা দরকার ছিল আমার।”
সেই কথার মধ্যে আরেকটা সত্যি ছিল। রূপা জানে, সে প্রেমে পড়েনি, সে পালাতে চায় না, সংসার ভাঙতেও চায় না। কিন্তু সে এই এক মুহূর্তের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ এটা তাকে আবার অনুভব করিয়েছে—সে একটা নারী, কেবল একজন মা, একজন স্ত্রী নয়।
বিকেলে রূপা বাড়ি ফিরে আসে। সুমনের সঙ্গে আর কথা বলে না সেদিন। ফোন নিঃশব্দেই পড়ে থাকে। কিন্তু তার চোখে, মুখে, শরীরে যেন একধরনের প্রশান্তি লেগে থাকে। ঠিক যেন গা ধুয়ে নেওয়ার পর শরীর যেমন হালকা লাগে, তেমন।
রাতের খাবার গরম করে দেয় রতনের জন্য, ছেলের হোমওয়ার্ক দেখে, সবই আগের মতোই। কিন্তু সে জানে, তার ভিতরে একটা জানালা খোলা হয়ে গেছে। যেটা দিয়ে হাওয়া ঢোকে, আবার গোপন ঘ্রাণও।
পর্ব ৫
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই রূপা বুঝে যায়, কিছু বদলে গেছে ভিতরে। ঘরের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে ঠিকই, রান্নাঘর থেকে বাসনের শব্দ আসছে, রতনের মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে উঠেছে—সব আগের মতো। তবু যেন এই চেনা দুনিয়ার মধ্যে একটা নতুন গন্ধ ঢুকে পড়েছে। এই গন্ধটা নিষিদ্ধ, অথচ আশ্বাসময়। এমন এক অনুভূতি, যা সে চায় না, তবু উপেক্ষাও করতে পারে না।
স্নানঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরটা দেখে সে। চোখে ঘুমঘুম ক্লান্তি, ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া কামনার দাগ। কিন্তু তার মুখে যেন আজ একটু আলগা আলো, এমন একটা নরম অভিব্যক্তি, যেটা রূপা নিজেও আগে কোনওদিন দেখেনি নিজের মুখে। একটা অপরাধবোধ যেন গায়ে লেগে থাকে সারাক্ষণ, কিন্তু তার নিচে একটা মুগ্ধতা, যা লুকোতে গেলেও জেগে থাকে।
সারাদিন সে খুব চুপচাপ থাকে। রতন কিছু না বুঝলেও একবার বলে ওঠে, “শরীর ঠিক আছে তো তোমার? মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।” রূপা ম্লান হেসে বলে, “আলতো জ্বর হয়েছিল, এখন ভালো লাগছে।” কথাটা বলে, কিন্তু নিজের মনেই একটা কাঁপুনি টের পায়। কারণ মিথ্যে বলা তার অভ্যাস নয়। এখন প্রতিটা কথা গায়ে কাঁটা তুলছে, মনে হচ্ছে, সবাই বুঝে ফেলবে তার ভিতরের গল্প।
সুমন মেসেজ পাঠায় না। হয়তো ইচ্ছে করেই—নাকি জানে, একটু দূরত্ব রাখা দরকার। রূপার মনে হয়, ভালই হয়েছে। আজ সে কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না। এমনকি নিজের সঙ্গেও না। সে শুধু চুপ করে দুপুরের মধ্যে হেঁটে বেড়ায় ঘর জুড়ে। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে কিছু বানাতে চেষ্টা করে, আবার থেমে যায়। কী খাবে, কী পরবে—এসব প্রশ্ন আজ খুব মিথ্যে মনে হয়।
বিকেলের দিকে ফোনে একটা ছবি আসে। সুমনের পাঠানো। সেই রিসর্টের জানালা দিয়ে তাকানো একটা ধূসর আলোয় ঢাকা গাছের ছবি। সঙ্গে লেখা—“আজ জানালাটা খুলে দিয়েছি, কিন্তু হাওয়া ঠিক গতকালের মতো আসছে না।” রূপা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। এই একবাক্যের মধ্যে এতখানি অনুভব কীভাবে ঢুকে পড়ে? সে উত্তর দেয় না। শুধু মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়।
রাতটা আরও কঠিন। রতন একটু আদর করতে চাইলে রূপা কেমন গুটিয়ে যায়। শরীরটা যেন পিছিয়ে যায় ছোঁয়ার সামনে। রতন কিছু বোঝে না, কিন্তু একটু বিরক্ত হয়। বলে, “আজকাল খুব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছ তুমি। ঠিক আছে?” রূপা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বলে না কিছু। বলে না যে, এখন তার শরীর অন্য এক ছোঁয়াকে মনে রেখেছে। অন্য এক আলতো স্পর্শ, যা কোনও তুলনায় পড়ে না, তবু মনের গভীরে বসে গেছে।
এরপরের কয়েকটা দিন কেটে যায় দোলাচলে। রূপা যতই ভুলতে চায়, ততই যেন মনে পড়ে যায় প্রতিটা মুহূর্ত। সুমনের ঠোঁটের গন্ধ, পিঠে রাখা হাতের চাপ, কানের পাশে আসা নিঃশ্বাস—সব যেন সময় পেরিয়ে ফিরে আসে রাতে, দুপুরে, রান্নার মাঝে, হাঁটার ছন্দে। সে বারবার নিজেকে বোঝায়—এটা কিছু না, একটা ভুল, একটা ক্ষণিক দুর্বলতা। কিন্তু এই ভুলটা যে এত সুন্দরভাবে ঘিরে রেখেছে তাকে, সেটা অস্বীকার করতে পারে না।
একদিন বাজার থেকে ফিরছিল, হঠাৎ রাস্তায় এক পরিচিতাকে দেখে কেমন ঘাবড়ে যায়। মনে হয়, মুখে কিছু লেগে আছে কিনা, চোখে ধরা পড়ে যাবে কিনা এই গোপন অন্য জীবনের ছায়া। নিজেকে আগের মতো স্বাভাবিক করতে গিয়ে তার বুক ধুকপুক করে। এখন প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা কথা, এমনকি ছেলের হোমওয়ার্ক বা শ্বশুরবাড়ির ফোন—সবই যেন প্রশ্ন করে, “তুমি বদলে গেছো?”
রাত বাড়ে। রূপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে একা। গাছের পাতা নড়ে, আকাশে আধা চাঁদ। ফোনে কিছু আসে না আজ। সুমন নিশ্চুপ। অথচ এই নিঃশব্দতাও রূপাকে চেপে ধরে। সে ভাবে, হয়তো এটাই ভালো। হয়তো শেষ হয়ে গেল, একবারের জন্য যা হওয়ার ছিল, তা হয়ে গেছে।
তবু তার মনে একটা অদ্ভুত কল্পনা ভেসে আসে—যদি আবার দেখা হয়, যদি আবার সেই হাতের ছোঁয়া ফিরে আসে… তবে কি সে নিজেকে আবার সামলাতে পারবে?
এই প্রশ্নটা ঝুলে থাকে মাথার ভেতর। উত্তর নেই। শুধু সেই নিষিদ্ধ নরম আলোটা আজও তার গায়ে লেগে থাকে, মুছে যায় না কিছুতেই।
পর্ব ৬
সময়ের অদ্ভুত গতি। কখনও মনে হয় ছুটে যাচ্ছে, আবার কখনও থেমে থাকে। রূপার কাছে গত দশদিন যেন একধরনের আটকে থাকা বাতাস। বাইরে থেকে সবকিছু চলছিল—ছেলের স্কুল, রান্না, বাজার, রতনের অফিস যাওয়া, রাতের খাবার টেবিলে থালার ঠক ঠক শব্দ—সবই একই ছন্দে। কিন্তু তার ভেতরের পৃথিবী যেন আটকে গেছে একটা ঘরের দরজায়, সেই একদিনের বিকেলটার ভেতর।
সুমনের কোনও খবর নেই। না ফোন, না মেসেজ। এমনকি একটা ইমোজিও না। প্রথম তিনদিন সে নিজেকে বোঝায়—ভালই তো। একটা ভুলকে টেনে না নিয়ে এগিয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু চতুর্থ দিন সন্ধ্যায়, বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে রূপা আবিষ্কার করে, সে অপেক্ষা করছে। মোবাইলের স্ক্রিন তাকিয়ে থেকে চোখ সরায়, কিন্তু মন সরাতে পারে না।
সন্ধের পর ছেলে ড্রইং করছিল, রূপা চুপ করে পাশে বসে থাকে। ছেলের পেন্সিলের আঁচড়ের শব্দের মধ্যে হঠাৎ একটা কান্না চেপে ধরে তাকে। কান্না নয় ঠিক, একটা অজানা বিষাদ, শরীর থেকে উঠে এসে চোখের কোণ ভিজিয়ে দেয়। সে জানে না কেন এত শূন্য লাগে—কারণ কি সুমনের অভাব? না নিজের ভেতরের ফাঁকা হয়ে যাওয়া?
পাঁচদিন পরে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। রূপা ধরা মাত্রই শুনতে পায় সুমনের গলা—“তুমি ঠিক আছো?” এতদিনের নীরবতার পরে এই তিনটা শব্দ তার বুকের মধ্যে হঠাৎ ঢেউ তোলে। কিন্তু সে গলা স্বাভাবিক রেখে বলে, “হ্যাঁ, ঠিক আছি। তুমি?”
সুমন একটু থেমে বলে, “আমি চেয়েছিলাম, তুমি ভুলে যাও। ভেবেছিলাম, কিছু না বললেই ভালো হবে। কিন্তু পারলাম না। আমি হয়তো ভুল করেছি।”
রূপা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তার পরে বলে, “আমরা যা করেছি, সেটা শুধু ভুল নয়। সেটা প্রয়োজনও ছিল। আমাদের আলাদা আলাদা জীবনে কিছু শূন্যতা ছিল, সেটার একটুখানি জোড়াতালি মাত্র। এখন আবার সব আগের মতোই হচ্ছে। তাই না?”
সুমনের গলায় চাপা হাহাকার, “আগের মতো হচ্ছে? তুমি পারছো?”
রূপা জানে, সে মিথ্যে বলেছে। কিন্তু এটুকু মিথ্যে না বললে সংসার চলে না। সে উত্তর দেয় না।
এরপর আবার নিঃশব্দ দিন। সুমন ফোন করে না, মেসেজও করে না। কিন্তু রূপার ভেতরে তার ছায়া থেকে যায়। সকালে চা করতে গিয়ে কেটলি ধোয়ার সময়, রাতের শোবার সময়, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখতে গিয়ে বারবার মনে পড়ে যায় সুমনের চোখ। সেই চোখ, যেটা একবার একটানা তাকিয়েছিল তার শরীরের দিকে, মাথার দিক থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত, যেন কোনও শব্দ ছাড়া সে পুরো জীবনটা পড়ে নিচ্ছিল।
সেদিন দুপুরে ছেলের স্কুল বন্ধ ছিল। রূপা একা ছিল বাড়িতে। দুপুরের রোদ ঘরে এসে পড়ছিল জানলা দিয়ে। বিছানার চাদর কুঁচকে ছিল, সে হঠাৎই উঠে গিয়ে চাদরটা পালটে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে নিজের বিছানায়, যেখান থেকে গত দশ বছর সংসারের গল্প জন্ম নিয়েছে, কিন্তু ভালবাসার স্পর্শ হয়তো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। তার মনে হয়, এতগুলো বছর ধরে সে শুধু দায়িত্ব পালন করেছে। অথচ একটা দিন, একটা বিকেল, তার মনে জেগে থেকেছে একটা অন্য রঙে।
বিকেলের দিকে আবার ফোন আসে। এইবার সুমনের গলা অন্যরকম—“আমি তোর কথা ভেবে থাকি। কিন্তু আমি জানি, তোকে কোনওখানে নিয়ে যেতে পারব না। আমি তোর জীবন বদলাতে পারব না। শুধু এইটুকু জানি, তুই যে আমার ভিতর জেগে আছিস, সেটা আমি অস্বীকার করতে পারি না।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই একটা কথা বলেছিস সেইদিন, মনে আছে? বলেছিলি, ‘এই যে মুহূর্ত, এটা বাঁচিয়ে রাখি’। হয়তো আমাদের কেবল সেইটুকুই ছিল। শুধু একটা মুহূর্ত।”
তারপর ফোন কেটে যায়। রূপা জানে, এই ফোনটা কোনও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত নয়। এটা একটা বিদায়ের মতো। অথবা হয়তো এমন একটা সম্পর্ক, যার কোনও নাম নেই। না প্রেম, না বন্ধুত্ব। শুধু অনুভবের জন্যে তৈরি এক গোপন ঘর।
রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে রূপা বারান্দায় বসে থাকে। কাঁথার ওপর চুপ করে বসে থাকা মেয়েটার মতো, যার হাতে এখন কিছু নেই। তবু সে জানে, তার ভিতরে একটা আলো জ্বলছে—যেটা কেউ দেখবে না, কেউ জানবেও না।
এই আলোটা ঠিক নিষিদ্ধ, কিন্তু তবু খুব ব্যক্তিগত। খুব নিজের।
পর্ব ৭
মধ্যরাতে রতনের ডাকে ঘুম ভাঙে রূপার। “তুমি জেগে আছো?” —রূপা চমকে ওঠে। এরকম সময় রতনের জেগে থাকা অস্বাভাবিক।
সে উত্তর দেয়, “না, মানে… এখন ঘুমিয়েই পড়েছিলাম…”
রতন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “আজকাল তোমার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আমি টের পাচ্ছি। চোখে মুখে একটা গম্ভীরতা, শরীরে একটা দূরত্ব। কী হয়েছে?”
রূপা জানে এই প্রশ্নটা আসবেই। কিন্তু তার প্রস্তুতি ছিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সে বলে, “আমার কিছুটা একা লাগছে রতন। এমনটা তো হতেই পারে, তাই না?”
রতন কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। তার নিঃশ্বাসে বিরক্তি, ক্লান্তি—আর হয়তো একটা চাপা আশঙ্কাও। রূপা জানে, এই সংসারে ভালোবাসা এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ একটা আড়াল জমেছে, যা রতন বুঝতে পারছে, কিন্তু ছুঁতে পারছে না।
পরদিন সকালে রূপা ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে দেখে, গাছের পাতা উলটে গেছে হাওয়ায়। মেঘ জমছে আকাশে। এইসব ছোট ছোট পরিবর্তন আজ তার চোখ এড়িয়ে যায় না। তার নিজেকেও যেন দেখে নতুন করে—একজন নারী, যার মধ্যে একটুখানি কিছু অন্যরকম জেগে উঠেছে, একটা কুয়াশার মতো অনুভব, যেটা কোথাও ঠাঁই পায় না, কিন্তু হাওয়ার মধ্যে ভাসে।
সে আজকাল নিজের আয়নায় বেশি তাকায়। নিজের মুখ দেখে, আর ভাবে—এই মুখটা কতকালের? কত বছর আগে শেষবার কারও চোখে সে নিজের মুখ দেখেছিল? রতনের চোখে তো এখন কেবল প্রয়োজন—চা, জামা, অফিসের ব্যাগ, রাতের খাওয়া। অথচ সুমনের চোখে একদিন সে নিজের অস্তিত্ব দেখেছিল, সেই নরম, নিষিদ্ধ আলোয়।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ দরজার কলিং বেল বাজে। রূপা ভেবেছিল হয়তো বাজারের কেউ, কিন্তু দরজা খুলে দেখে রতনের এক পুরনো বন্ধু, রাজর্ষি দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদিন পরে এল সে। বসে চা খেতে খেতে গল্প শুরু হয় পুরনো স্মৃতির।
রাজর্ষি হেসে বলে, “রূপা তো আগের থেকেও স্মার্ট হয়ে গেছে। কী রে রতন, এখনো প্রেম করিস তো বউয়ের সাথে?”
রতন হেসে ফেলে, কিন্তু গলায় একটা খটখটে রুক্ষতা, “প্রেমের জায়গা এখন সংসার নিয়েছে।”
রাজর্ষি হালকা হেসে বলে, “কিন্তু সংসারেও তো একটু চোরাবালি থাকে, না রে?”
এই কথাটা রূপার কানে বাজে। চোরাবালি—যা নীচ থেকে টেনে নেয়, ধীরে ধীরে। সে জানে না, এই কথাটা ইচ্ছাকৃত বলা কি না। কিন্তু তার মুখ গম্ভীর হয়ে আসে।
রাজর্ষি চলে গেলে রাতে রতন বলে, “রাজর্ষি তো মজা করছিল, তুমি এত গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?”
রূপা বলে, “আমি এখন একটু বেশি ভাবি। আগে এত ভাবতাম না।”
রতন বলে, “ভেবে কী হবে? জীবন তো একরকমই চলে। অত ভাবলে অসুখ হয়।”
এই কথাটায় রূপার মনে হয়, রতন কোনওদিনই তাকে ঠিকমতো পড়তে পারেনি। বা চেষ্টাও করেনি। সে জানে, এই ঘরটা তার শরীরের মতো চেনা, তবু তার ভিতরে সে একা।
সেদিন রাতে সে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মোবাইলটা নেয়। সুমনের নাম খোঁজে, কিন্তু খোঁজে না। চ্যাট খুলে দেখে, পুরনো কথোপকথন। সেখানে একটা শব্দ—“তুই”—যা আজকাল কেউ আর বলে না তাকে। এই “তুই” যেন একটা স্পর্শ, যা শরীর ছোঁয় না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
সে জানে না, সে আবার কখনও সুমনকে দেখবে কি না। কিন্তু সে এখন নিজের ভিতরেই একধরনের ভাঙা পৃথিবী তৈরি করেছে। যেখানে একদিকে রতনের সংসার, অন্যদিকে সুমনের অলিখিত স্মৃতি—আর মাঝখানে সে নিজে। যাকে কেউ ঠিক বুঝে না, এমনকি নিজের কাছেও অনেকটা অচেনা।
তার মন বলে—এটা শেষ নয়। কিছু একটা আসছে। হয়তো আরও জট, আরও গভীরতা।
পর্ব ৮
জুন মাসের একটা ভিজে দুপুর। শহরের আকাশ সেদিন এমনই ছিল, যেন সব গোপন কথা ঢেকে রাখতে চায় নিজের মেঘ দিয়ে। রূপা তখন দোকানে। ছেলের নতুন স্যান্ডেল কেনার কথা, রতন বলেছিল অফিস ফেরার পথে দেখে নেবে। তবু রূপা নিজের মতো বেরিয়ে পড়ে। মাথায় একটা আলগা ওড়না, কাঁধে হালকা ব্যাগ। মনে অজানা অস্বস্তি।
দোকানের শেলফ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ তার চোখ যায় কাঁচের বাইরে। সেখানে সুমন দাঁড়িয়ে, রাস্তার ওপারে। পাজামা আর নীল কুর্তা, চোখে সেই চেনা চশমা, কিন্তু মুখে একরকম গভীরতা—যেটা সে আগেও দেখেছে, কিন্তু আজ যেন আরও স্পষ্ট।
রূপার বুক ধড়াস করে ওঠে। ছেলেভোলানো মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপন বাজছিল দোকানের স্পিকারে, কিন্তু তার কানে যেন কিছুই ঢোকে না।
সুমনের চোখে চোখ পড়ে। সেই এক মুহূর্তে সব আগেরদিন ফিরে আসে—হোটেলের ঘর, গা ছুঁয়ে যাওয়া হাত, বাতাসে মিশে থাকা দমবন্ধ করা লোভ।
রূপা বাইরে আসে। বলে না কিছু, শুধু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুই এখানে?”
সুমন হেসে বলে, “চলছিলাম, হঠাৎ ভাবলাম—তুই এখানে থাকতে পারিস কি না।”
“তুই জানতি আমি থাকব?”
“না। তবু মনে হলো, দেখা হবে হয়তো। কে জানে কেন…”
তারা একটা ছোট চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। পাশেই রেললাইন, হালকা গুঞ্জন, বৃষ্টির ফোঁটা চায়ের কাপে পড়ছে। এইসব ছোট ছোট আবহ তাদের ভিতরের তোলপাড়ের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
সুমন বলে, “আমি তোর চোখ ভুলতে পারি না রূপা। কিন্তু তোর সংসার আছে, ছেলে আছে। তোকে নিয়ে ভাবলেই আমার নিজের ওপর রাগ হয়।”
রূপা চুপ করে থাকে। তার চোখ নিচু, ঠোঁট শুকনো। সে বলে, “আমারও রাগ হয় নিজের ওপর। কিন্তু এমন কিছু হয়, যেটা রাগ করে থামানো যায় না। এটা ঠিক যেমন ভাবে বৃষ্টি নামে, অথচ আমরা ছাতা আনিনি।”
সেই একঘণ্টা কথা হয়। তারা আবার কিছু ছোঁয় না, কিছু করে না। শুধু বলে, শোনে, আর ভিতরে ভিতরে যেন সব পুড়ে যেতে থাকে, নরম আগুনে। তারপর সুমন উঠে দাঁড়ায়, “আর দেখা হবে?”
রূপা বলে, “হয়তো না। না হলেও মনে রাখবি, এই যে আছি আমি, একদিন তোর হয়ে থেকেছি। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও।”
সুমন মাথা নিচু করে চলে যায়।
রূপা বাড়ি ফিরে আসে বিকেল নাগাদ। দরজা খোলে রতন। তার চোখ একটু আলাদা। চশমার আড়াল থেকে রূপার মুখে তাকিয়ে সে বলে, “তোমার ফোন অফ ছিল কেন?”
রূপা বলে, “ব্যাটারি শেষ। দোকানে ছিলাম।”
রতন চুপ করে থাকে। তারপর একটু পরে আবার বলে, “একটা লোকের ফোন এসেছিল তোমার নম্বরে। নাম বলেনি। বলল, ভুল করে ডায়াল হয়েছে। কিন্তু গলায় একটা পরিচিত টান ছিল।”
রূপার পা অবশ হয়ে আসে এক মুহূর্তে। সে মুখ নিচু করে বলে, “কে জানে… হয়তো সত্যিই ভুল করে লাগানো।”
রতন আর কিছু বলে না। কিন্তু তার মুখে সেই চাপা অভিমান, যেটা বহু দাম্পত্যের স্তব্ধ হাহাকারে জন্ম নেয়—অপ্রকাশিত, অথচ খুব বাস্তব।
রাতে খাওয়া শেষ করে তারা পাশাপাশি শোয়, কিন্তু একসাথে নয়। দুজনের মাঝে একটা নিঃশব্দ দেয়াল। বাতি নিভে যায়, ঘর অন্ধকার হয়, কিন্তু রূপার মনে একটা জ্বলা আলো—যেটা সে নেভাতে পারছে না, চাইলেও না।
সেই রাতে রূপা স্বপ্ন দেখে—সে একটা অজানা ট্রেনে চড়ে বসেছে, জানলার বাইরে সব ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে, আর পাশে বসে থাকা মানুষটা মুখে কিছু বলছে না, শুধু তার হাতটা ধরে আছে। ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু সেই স্পর্শটা থেকে যায় অনেকক্ষণ।
পর্ব ৯
রাত জাগা রতনের মন আজ যেন একটু বেশি অস্থির। ঘুম আসে না, বারবার হাত মোবাইলে যায়। ফোনে বারবার রূপার নাম খোঁজে, বার্তা দেখে, কিন্তু কিছু অস্বাভাবিক খুঁজে পায় না। তখনই হঠাৎ সে খেয়াল করে, রূপার মোবাইলের স্ক্রিনে একটা মেসেজ আসার নোটিফিকেশন ফ্ল্যাশ করে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়।
রতনের কৌতূহল, সন্দেহ আর বেড়ে যায়। সে ভাবতে থাকে, কার কাছ থেকে এসেছে ওই মেসেজ? নাকি রূপা নিজেই লুকিয়ে কিছু করছে?
পরদিন সকালে রূপার ঘুম ভাঙে রতনের ফোন চেক করার শব্দে। সে চুপ করে থাকে, আর রূপার চোখে একটা অজানা ভয় মিশে যায়। মুখ থেকে বেরোয় না কোনও কথা।
রাতেও রূপা রতনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, সে হালকা বিরক্তি দেখায়, “আজকাল কি বেশি চাহিদা রইল? একটু নিজের জায়গা দেবার কথা ভাব।”
রূপা নিজের কষ্ট চাপতে থাকে। সে জানে, তার অন্তরে যা হচ্ছে তা সহজ নয়। একটা অসম্পূর্ণতা, যা শুধু রতনই নয়, নিজেকেও ভয় দেখায়।
একদিন বিকেলে রূপা অফিস থেকে ফিরে একটু দেরি করে। রতন কপালে ভাঁজ নিয়ে দাঁড়িয়ে। “কোথায় ছিলে? ফোন করলে কেন না?”
রূপা শান্ত গলায় বলে, “ব্যস্ত ছিলাম। অফিসে একটা মিটিং ছিল।”
রতন বলে, “কিন্তু মেসেজে কেউ বলেছে, আজকে তোমাকে একটা লোক দেখেছে রাস্তার ধারে, দোকানের সামনে। কি বলবে?”
রূপার গলা শুকিয়ে যায়। সে চুপ করে থাকে। নিজের মনে বারবার বলে, “না, আমি কিছু করিনি। শুধু…”
সেদিন রাতের খাবারে চুপচাপ থাকে দুজনে। রূপা ভাবতে থাকে, এই সম্পর্ক কি আর আগের মতো থাকবে? নাকি ধীরে ধীরে এই দূরত্ব আরও বড় হবে?
রূপা হঠাৎই মনে করে, তাকে আর গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারবে না। সে সুমনের সঙ্গে কথা বলার সময় চাই, কিন্তু এবার একটু স্পষ্টভাবে।
মোবাইলে মেসেজ লেখে, “আমাদের কথা শেষ করতে হবে কি?”
সুমনের উত্তর আসে, “আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব যতক্ষণ তুই চাইবে। কিন্তু বুঝতে হবে, আমাদের পথে অনেক বাধা।”
রূপা জানতে চায়, “তুই কি সত্যিই আমার জীবনের সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবি?”
সুমন লেখে, “আমি পারব না। তবু কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যা হৃদয়ের গভীরে থাকে, আর ওগুলোর জন্য বাঁচা যায়।”
রূপা বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক শুধু অবসরে দেখা, কিছু ছোট মুহূর্তের জন্য বাঁচা—কিন্তু বাস্তবতা অন্য কোথাও।
সে ঠিক করে, এবার পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে না।
পর্ব ১০
রূপা এক বেলা অফিস থেকে ফিরে এসে খেয়াল করে, রতন আজকে বিশেষভাবে চুপচাপ। রাতের খাওয়ার সময় সে নির্দিষ্ট করে প্রশ্ন করে, “রূপা, আমাদের সম্পর্কে তুমি কী ভাবছ?”
রতনের এই সরাসরি প্রশ্নে রূপার বুকের ভেতর এক ঝিনুক ভাঙে। সে জানে, আর গোপনীয়তা নেই। সময় এসেছে সব খুলে বলার।
সে চুপ করে একটা মুহূর্ত নেয়, তারপর স্বর উঁচু করে বলে, “রতন, আমি সত্যি তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইনি। কিন্তু আমার মনের একটা দিক আছে, যা আমি বুঝতেই পারছি না। আমি কিছু সময়ের জন্য অন্য কারো সঙ্গে কথা বলেছি। এটা শুধুমাত্র কথা। বেশি কিছু নয়।”
রতন চোখ বুজে ধরে, “কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব, রূপা? তুমি আমার বউ। সংসারের সবকিছু। তুই এমন কী খুঁজছো, যা আমি দিতে পারছি না?”
রূপা জানে, এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। সে বলে, “আমরা তো একে অন্যকে বোঝার চেষ্টাও কম করেছি, রতন। আমি মাঝে মাঝে একলা মনে করি। তুমি যখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আমি একাই ঘরে, নিজের সঙ্গে লড়াই করি।”
রতন চুপ করে থাকে। তার মুখে অস্ফুট একটা বেদনা। সে বলে, “আমি হয়তো ভুল করেছি, রূপা। কিন্তু এখনো চাই আমাদের সংসার ঠিক করতে। যদি তুই চাও।”
রূপা কিছুটা স্বস্তি পায় এই কথায়, কিন্তু তার মন থেকে সুমনের স্মৃতি যায় না।
রাতের বেলায় রূপা তার মোবাইলে সুমনের মেসেজ দেখে। সুমন লেখে, “আমি তোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। যেটাই হোক, তোর সুখ আমার জন্য মুখ্য।”
রূপা নিজের মনের ভেতর এক জটিলতা অনুভব করে। সে জানে, এই দুই সম্পর্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে একবার যদি ভুল পথ বেছে নেয়, তাহলে কেউই আর ফিরে আসবে না আগের জায়গায়।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, কাল রতনের সঙ্গে আরেকবার কথা বলবে, পরিষ্কার কথা বলবে। আর সুমনকে জানাবে, এই মুহূর্তে তার জন্য সময় চাই।
পর্ব ১১
রূপার মনের গহীনে আজ এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। দিনের বেলা অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার মনে পড়ত রতনের কথা, সুমনের কথা, আর তাদের মধ্যে তার নিজস্ব অবস্থান। তার হৃদয় যেন দুই ধারার নদীর মতো ভাগ হয়ে গিয়েছিল—একপাশে রতনের সাথে সংসারের দায়িত্ব, আর অন্য পাশে সুমনের সঙ্গে কথোপকথনের মৃদু উত্তাপ। এই দ্বন্দ্ব তাকে চাপা কষ্টে আটকে রেখেছিল বহু দিন। আজ আর ভেতরটা সহ্য হচ্ছিল না, ঠিক করেছিল সে রতনের সামনে সব খুলে বলবে।
সকাল থেকে রূপা বারবার নিজের হাতে কফির কাপ নিয়ে বসতেছে আর কিছুতেই মনকে শিথিল করতে পারছিল না। চায়ের গরম বাষ্পের সঙ্গে যেন তার মনের অবসাদ মিশে যেত। তিনি জানতেন, কথা বলার সময় যত কাছে কাছাকাছি হওয়া দরকার, ততই ভয়। তার ভেতর একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরছিল, ‘রতন কি আমাকে বুঝবে? কিংবা আমিই কি তার কাছে পুরোপুরি আসিনি?’
সন্ধ্যার একটু পরে যখন রতন অফিস থেকে ফিরল, রূপা তাকে দেখে নিজের সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। সে জেনে ছিল যে এই রাতেই তার জীবনের এক বড় অধ্যায়ের শুরু বা শেষ হতে পারে।
রতন যখন বাসায় ঢুকল, তার চোখে ক্লান্তির ছাপ ছিল। তিনি কাজের চাপ আর সংসারের দায়িত্বের ভার মিলে মাঝে মাঝে যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছিলেন। রূপা তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, “চা বানাচ্ছি, একটু বসো।” রতন মাথা নাড়ল আর ধীরে ধীরে বসতে শুরু করল।
রূপার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে বলল, “রতন, আমাদের অনেক কিছু নিয়ে কথা বলার দরকার আছে।”
রতন চোখে কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার রূপা? এত সময় ধরে কি তোমার মন খারাপ ছিল?”
রূপা সেদিনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল, এখন যেন সব কিছু বের করে দেওয়ার আগ্রহ কাজ করছিল। “আমাদের মধ্যে একটা ফাঁক অনেক দিন ধরেই বাড়ছে, রতন। আমি একা একা অনেক সময় কাটিয়েছি। আর সেই একাকীত্ব থেকে এক বন্ধু হয়েছে আমার। তার নাম সুমন।”
রতনের চোখে অজানা এক প্রশ্নের ছায়া পড়ল, “সুমন? কারা সে? তুমি কখন তার সঙ্গে কথা বলেছ?”
রূপা কিছুটা লজ্জা নিয়ে বলল, “সে আমার পরিচিত, অফিসের একটা পুরনো বন্ধু। কিন্তু আমাদের কথা বলতে বলতে সম্পর্কটা একটু অন্যরকম রূপ নিয়েছিল। শুধু কথাই, বেশি কিছু নয়। আমি সেটা তোমাকে আগে বলতে পারিনি, কারণ আমি ভয় পেতাম।”
রতনের মুখে অবিশ্বাস আর কষ্টের মিশ্রণ ছড়াল। “তুই আমার সামনে গোপনীয়তা রেখেছিস? আমি তোমার স্বামী, আমাদের সংসার। কি কারণে?”
রূপা চোখে পানি জমে গেল, “আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমিও মানুষ। আমারও অনুভূতি আছে। যখন তুমি বাড়ির বাইরে কাজ করতেছো, আমি একা থাকতাম, মনে হত কেউ নেই আমার পাশে। তখন সুমন ছিল শুনতে, বোঝতে। কিন্তু আমি তোমাকে দোষ দিতে চাই না, আমরা দুজনেই দোষী।”
রতন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তুই কি আমাকে কখনও বলতে চাস না? আমি যদি বুঝতাম, আমাদের সংসার আরেকভাবে হতে পারত।”
রূপা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “তাই তো বলছি, আমি সব খুলে বলছি। আমি আর গোপন রাখতে চাই না। কিন্তু আমি এখন এক সিদ্ধান্ত নিতে চাই, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো।”
রতনের চোখে এক ধরনের বেদনা ফুটে উঠল, “আর বল তো, কি সিদ্ধান্ত?”
রূপা বলল, “আমি সুমনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ করব। আমি চাই আমরা আবার নতুন করে শুরু করি। কিন্তু আমাকে কিছু সময় দিতে হবে, রতন। আমাদের সম্পর্ক ঠিক করতে, আমরা যেন একে অপরকে আবার বুঝতে পারি।”
রতন হালকা হাসল, “আমারও কিছু সময় লাগবে, রূপা। কিন্তু আমি চাই আমাদের সংসার বাঁচুক। আমি তোর পাশে আছি।”
রূপার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আশার রঙ ঝলমল করল। সে জানত, সহজ হবে না। কিন্তু কমপক্ষে একটা নতুন সুযোগ পেল তারা।
রাত্রের বেলা রূপা তার মোবাইল খুলে দেখল সুমনের মেসেজ,
“তুই যা করিস, আমি সবসময় তোর পাশে আছি। তোর সুখ আমার কাছে সব থেকে বড়।”
রূপা মেসেজে লিখল,
“আমাদের পথ এখানেই শেষ হওয়া উচিত, সুমন। আমি আমার সংসার বাঁচাতে চাই। শুভ থাকিস।”
কিছুক্ষণ পর সুমনের রিপ্লাই এল,
“বুঝেছি। জীবনের যেকোনো পথে তোর সুখ কামনা করি। বিদায় রূপা।”
ফোন রেখে রূপা জানল, এক অধ্যায় শেষ, আরেকটা শুরু হতে চলেছে। যদিও অন্তরের মাঝে একটু ব্যথা ছিল, তবু মুক্তির আশাও ছিল অনেক।
রাত পোহালেই রতনের সঙ্গে একান্তে বসে তারা বহু কথা বলল। তারা তাদের ভুল, আশা, কষ্ট সব খুলে বলল। বুঝতে পারল, সম্পর্ক মানে শুধুই ভালোবাসা নয়, তার সঙ্গে লাগে বোঝাপড়া, সময়, ধৈর্য।
রতন বলল, “আমরা আবার চেষ্টা করব, রূপা। তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মানুষ।”
রূপার চোখে জল, “আমারও তোর জন্য অনেক আশা আর ভালোবাসা আছে।”
তারা একে অপরের হাত ধরে নতুন সূচনা করল। গোপন কথা আর সন্দেহের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপটা ছিল কঠিন, কিন্তু সেই ধাপটা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রূপা জানত, এখন থেকে তার জীবন সহজ হবে না। কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল, এখন সে তার জীবনের সত্যের সঙ্গে বাঁচবে। তার নিষিদ্ধ নরম আলো ধীরে ধীরে প্রকৃত ভালোবাসার আলোতে রূপ নেবে।
পর্ব ১২
রূপা আর রতনের জীবনের এই নতুন অধ্যায় শুরু হলেও, তার মধ্যে ছিল অনেক অনিশ্চয়তা আর ভাবনার দোলাচল। তারা দুজনেই জানত এই সম্পর্ক ঠিক করার জন্য সময় লাগবে। আবার একে অপরের ক্ষতগুলো মেরামত করতে হবে। তবু একবার যখন সত্যি মুখোমুখি হয়ে, অন্তরের কথা খোলসা করে বলা হয়, তখন কিছু একটা বদল হয়। তাদের ভিতরে একটা নতুন আশা ফুটে ওঠে।
সকাল বেলার সূর্যের নরম আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। রূপা উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল, “আজ থেকে আমি আমার জীবনের জন্য নিজেই লড়ব। আর রতনের সঙ্গে এই সংসারটাকে আবার নতুন করে গড়ব।” তার মন শান্ত হলেও ভেতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনাও কাজ করছিল। আজ থেকে আর কোনো গোপন নেই।
রতন ঘুম থেকে উঠে রূপাকে দেখে একটা মৃদু হাসি দিল। সে বলল, “তুই সকালে এত ভালো লাগছিস, রূপা?”
রূপা হেসে উত্তর দিল, “হয়তো এখন আমার মনটা একটু হালকা হয়েছে।”
রাতের কথোপকথন এখনও তাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল একসাথে থেকে যতই ঝামেলা আসুক, পারস্পরিক বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাই তাদের পথ দেখাবে।
দিনে অফিস আর সংসারের ব্যস্ততায় যতবারই তারা মুখোমুখি হত, ততবারই মন থেকে ঝামেলা কমতে লাগল। রূপা দেখল, রতনের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সে যতটা কাজের চাপের মাঝেও সময় দিত রূপাকে বুঝতে, পাশে থাকতে।
একদিন সন্ধ্যায় রূপা অফিস থেকে বাসায় ফিরল একটু আগেই। বাসার দরজা খুলতেই দেখতে পেল রতন বসে আছে টেবিলের পাশে, হাতে তার পছন্দের বই। সে বলল, “তুই এতক্ষণ ঘরে নেই? আমি অপেক্ষা করছিলাম একসাথে সময় কাটাবার জন্য।”
রূপা হেসে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম। আজ তোমার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে চাই।”
বসার ঘরটা হালকা আলোর নরম আবেশে মুড়িয়ে দিয়ে তারা দুজন বসল। রতন বই রেখে রূপার হাতে একটা কফির কাপ দিল। রূপা চুমুক দিয়ে বলল, “এখন থেকে আমাদের গল্পটা যেন একসাথে লেখা হয়।”
রতন হাত বাড়িয়ে তার হাতে হাত রাখল, “আমাদের ভালোবাসার গল্প।”
সন্ধ্যার নরম আলো আস্তে আস্তে ঘরটা ভরে দিল। বাইরে বাতাসে নরম গন্ধ মিশে ছিল। তারা দুজন একে অপরের চোখে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করছিল—কীভাবে ভুল গুলো ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করা যায়।
সেদিনের পর অনেক রাত তারা কথা বলত, মন খুলত। রূপা জানাল তার ভেতরের ভয় আর অনিশ্চয়তার কথা, আর রতন বলল তার কাজের চাপ, জীবনের অস্থিরতা।
তাদের মাঝে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হতে লাগল, যা ধীরে ধীরে ভালোবাসার শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠল।
এক রাতে রতন হঠাৎ বলল, “রূপা, আমরা যেভাবে চলেছি, সেটা আর চলবে না। আমাদের নিজেদের জন্য একটু সময় নিতে হবে।”
রূপা একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু আমরা তো ঠিকই আছি? কোথাও সমস্যা তো?”
রতন গভীর নিঃশ্বাস দিয়ে বলল, “সমস্যা আছে, রূপা। আমরা একে অপরকে বোঝার সময় পাই না। তাই আমি চাই, আমরা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন একসাথে বাইরে যাই। ফাঁকা সময় কাটাই। কথা বলি, হাঁটি, সিনেমা দেখি — শুধু আমাদের জন্য।”
রূপা আনন্দে বলল, “হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে একদম একমত।”
সেদিন থেকে তারা নিয়মিত নিজেদের জন্য সময় দেয়ার চেষ্টা করল। ছোট ছোট ছুটিতে তারা বাইরে বেরোত, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাত। শহরের ভিড় থেকে দূরে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে আর একটু কাছাকাছি আসার চেষ্টা করত।
একদিন তারা একসাথে পাহাড়ের ধারে গিয়েছিল। রূপা পাহাড়ের নরম ঘাসে বসে বলল, “রতন, তুমি জানো, আমার ভেতর অনেক দিন ধরেই একাকীত্বের ছায়া ছিল। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই সময়গুলো কাটিয়ে আমি বুঝতে পারছি, ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয়, বোঝাপড়া, সময় দেয়া।”
রতন হাসল, “আমারও সেই অভিজ্ঞতা, রূপা। কাজ আর সংসারের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।”
সেদিন দুজনে বসে প্রকৃতির কোলে অনেক কথা বলল। তারা জানল, সম্পর্ক শুধু কামনা আর আবেগ নয়, তার সঙ্গে দরকার মন খুলে বোঝাপড়া, একে অপরের জন্য সময়, আর দয়া।
রূপার ফোনে হঠাৎ একটা মেসেজ এলো। সেটি সুমনের ছিল। মেসেজে লেখা,
“তুই এখন ঠিক পথে আছিস। তোর সুখে আমি শান্তি পাই। আমি তোর জন্য ভালোবাসা চাইনি, শুধু শান্তি চাই। ওর কাছে ভালো থাকিস।”
রূপা মেসেজটা দেখে কিছুক্ষণ নীরব রইল। নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়ের কথা ভাবল। মনের ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা হলেও শান্তির এক ধরনের অনুভূতি ছিল।
রূপা ফোন বন্ধ করে বলল, “রতন, আমি সব ভুলে যেতে চাই। নতুন শুরু করতে চাই।”
রতন হাতে হাত রেখে বলল, “আমরা একসাথে বাঁচব, রূপা। নতুন করে ভালোবাসা গড়ব।”
বসার ঘরটা পূর্ণ হয়ে উঠল নরম আলো আর ভালোবাসায়। তারা একে অপরের কাঁধে মাথা রাখল, বুঝতে পারল—বাঁধন যতই কঠিন হোক, বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকলে সবকিছু সম্ভব।
দিনের পর দিন তারা নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের ফাঁকগুলো ভরাট করল। রূপা দেখল, সে আর একা নয়। রতনের ভালোবাসা আর সময় তাকে নতুন জীবন দিয়েছে।
এক সন্ধ্যায় রূপা বলল, “তুই কি জানিস, আজ থেকে আমি নিজের জন্য, আমাদের জন্য বাঁচব।”
রতন কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমি তোমার পাশে আছি, সবসময়।”
রূপার চোখে ছিল কিছুটা জল, আর কিছুটা আশার দীপ্তি। তারা দুজন জানল, জীবনের এই অধ্যায় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে তারা একে অপরকে নতুন করে পেয়েছে।
রাতের নিভৃত্তিতে তারা একসাথে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখল। তাদের গল্প ছিলো নিষিদ্ধ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যি ভালোবাসাই জয়ী হয়েছে।
শেষ