Bangla - রহস্য গল্প

নীল দরজা

Spread the love

অমিতাভ গোস্বামী


অচেনা শোরগোল

বৃষ্টিটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যেন হঠাৎ আকাশের কান্না ভেঙে পড়ল মাটিতে। দুপুরের স্কুল ছুটি হতেই তৃষা সোজা রওনা দিয়েছিল সেই পুরনো লাইব্রেরিটার দিকে। বাইরের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে নয়, বরং ভিতরের একটা অদ্ভুত টান তাকে বারবার সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রাম্য এই লাইব্রেরিটা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, পুরনো কাঠের তাকগুলো ধুলোতে ভরা, কিছু বইয়ের পাতায় ছেঁড়া রং, কোথাও কোথাও সাদা পোকা, তবুও তৃষার চোখে এটা ছিল জাদুর ঘর।

পন্ডিত বরদা চক্রবর্তী, লাইব্রেরির একমাত্র দেখভালের লোক, ছিলেন অদ্ভুত একজন মানুষ। গায়ে সাদা ধুতি, চুল-দাড়ি পাকা, কথাবার্তায় যেন একেকটা শব্দ উঠে আসে অন্য সময় থেকে। আজ তিনি লাইব্রেরির পেছনের ঘরে বসে ছিলেন, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা আর হাতে এক মোটা বই। তৃষা চুপচাপ তার পাশ দিয়ে চলে গেল, পেছনের করিডোর দিয়ে যেখানে সেই নীল দরজাটা আছে—যেটা সবসময় বন্ধ থাকে।

এই দরজাটা তৃষার মনে কেমন একটা অস্থিরতা তৈরি করত। দরজার রং কেমন যেন ধাতব নীল, যেন রঙটা নিজের মধ্যেই আলো টেনে নিচ্ছে। তালাটা পুরনো, কিন্তু ঠিক ততটাই মজবুত। পনেরো দিনের মধ্যে আজ পঁচিশতমবার সে এই দরজার সামনে দাঁড়াল, এবার একটু বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকল। সে জানে, বরদা চক্রবর্তী এর কাছে চাবি নেই, তিনি একদিন নিজেই বলেছিলেন—”ওটা অনেক পুরনো, আর কেউ খুলে না… ও দরজা নিজেই ঠিক করে কবে খুলবে।”

তৃষা আবার হালকা করে ধাক্কা দিল। না, এবারও খুলল না। সে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, হঠাৎ একটা শব্দ—একটা মৃদু ক্লিক। তৃষার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। সে আবার ঘুরে তাকাল—তালাটা যেন নিজের ইচ্ছেতেই খুলে গেছে। দরজাটা এখন সামান্য ফাঁকা। বাইরের বাতাসের সঙ্গে ভিতর থেকে আসছে এক অদ্ভুত গন্ধ, যেন পুরনো কাগজ, পাথর, আর বিদ্যুতের মিশ্র একটা সুবাস।

সে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলল। দরজার ওপাশে অন্ধকার। সে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে গেল। ভিতরে একটা সরু সিঁড়ি, নিচে নামছে, খাড়া আর আঁকাবাঁকা। তৃষার মাথায় তখন একটাই কথা—”এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

সিঁড়ি যত নিচে নামে, বাতাস তত ভারী হতে থাকে, আর শব্দ বদলাতে থাকে। নিচে নামতে নামতে কানে আসে হালকা এক শোরগোল—লোকজনের কণ্ঠস্বর, দূরের ঘণ্টা, রিকশার বেল। যেন বাইরে নয়, কোন অজানা জগৎ একটানা চলছে নিচে। একসময় সিঁড়ি শেষ হয়, আর তৃষা পৌঁছে যায় এক চওড়া হলঘরে। ছাদের ওপরে ঝুলে থাকা গ্যাসল্যাম্প, দেয়ালে বড় বড় পেইন্টিং—কিন্তু এগুলোর কিছুই সে চিনতে পারছে না। একটি দেয়ালে মীরজাফরের বিশাল ছবি, নিচে লেখা—”জাতীয় বিপ্লবী, ১৮৫৭ সালের বীর”।

তৃষা অবাক। সে জানে, ইতিহাস বইয়ে মীরজাফর দেশদ্রোহী। কিন্তু এখানে?

হঠাৎই একটা গলা—“তুমি দেরি করে ফেলেছ।”
তৃষা চমকে তাকাল। এক কিশোর ছেলে, বয়সে তার কাছাকাছি, চোখে কালো চশমা আর হাতে একটা পাথরের মত কিছু ধরা।
“তুমি কে?” তৃষা প্রশ্ন করল।
“আমি অর্ক। তথ্যরক্ষক। তুমি এসেছ, কারণ তুমি খুঁজতে চেয়েছ। কিন্তু এখানে সবই আলাদা।”

অর্ক তাকে নিয়ে যায় হলঘরের ভিতরের আরেক ঘরে। দেয়ালে বিশাল মানচিত্র—তবে একদম অচেনা। কলকাতার জায়গায় লেখা আছে “নব-কলিকাতা”, দিল্লির জায়গায় “ব্রিটিশ বিদায় কেন্দ্র”, স্বাধীনতার বছর লেখা ১৮৫৭।

তৃষা চোখ কুঁচকে দেখে, “কিন্তু এগুলো ভুল। আমাদের ইতিহাস তো এরকম না।”

অর্ক হাসে, “আমরা যে জগতে আছি, সেটা এক বিকল্প ইতিহাস। কেউ এই সময়কে পাল্টে দিয়েছে। কেউ বা কিছু ইতিহাসকে এমনভাবে বদলে দিয়েছে, যাতে মানুষ সত্য ভুলে যায়। আর যারা সেটা মনে রাখে, তারা হারিয়ে যায় এই দুনিয়া থেকে।”

“তাহলে আমি…?” তৃষা বলতে গিয়ে থেমে যায়।

“তুমি এখনো পুরনো জগতের অংশ, কিন্তু যেহেতু তুমি জানতে চেয়েছ, দরজা তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে। এখন তুমি কী করবে—সেটা তোমার সিদ্ধান্ত।”

তৃষা ভাবতে থাকে। তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, উত্তেজনা। হঠাৎ বাইরে বাজ পড়ে। জানালার কাঁচ কেঁপে ওঠে। অর্ক চুপচাপ বলে, “তাড়াতাড়ি করতে হবে। স্মৃতিচোররা এদিকে আসছে। তারা বুঝে গেছে—তুমি চলে এসেছ।”

তৃষা জিজ্ঞেস করে, “ওরা কে?”

“যারা ভুল ইতিহাসকে রক্ষা করে। যারা মানুষের স্মৃতি চুরি করে সত্যকে চাপা দেয়। যদি তারা তোমাকে ধরে ফেলে, তুমি নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করবে—মীরজাফর নায়ক, আর সত্য কখনো সত্য ছিল না।”

তৃষার গলা শুকিয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটে, দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে কী করতে হবে?”

অর্ক এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে, “তোমার মনে রাখতে হবে, যা তুমি জানো—তা ভুল নয়। তোমার বিশ্বাসই আমাদের অস্ত্র। আর চলতে হবে একটানা… এক পা এক পা করে। কারণ আমরা এখন ইতিহাসের ভেতর হাঁটছি, যেটা জীবন্ত, আর বিপজ্জনক।”

তৃষা এক ঝলক দরজার দিকে তাকায়, যেখান দিয়ে সে এসেছে। এখন সেটা বন্ধ। দরজার নীচে দেখা যাচ্ছে এক লাল রেখা—যেন ফিরে যাওয়ার রাস্তা আর নেই।

স্মৃতিচোরের ছায়া

হলঘরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। জানালার বাইরে আবার বাজ পড়ল, এবার অনেক জোরে, যেন আকাশ ফেটে এক অদৃশ্য কিছুর আগমন ঘটেছে। অর্কের চোখে আতঙ্ক আর দৃঢ়তা একসঙ্গে খেলে গেল। সে দ্রুত একটি পাথরের দরজা ঠেলে খুলে দিল, ভেতরে আরও আঁধার। “চল, ওরা খুব কাছাকাছি।”

তৃষা কিছু না ভেবেই তার পিছু নিল। পথটা সরু, দেয়ালে ছোট ছোট প্রদীপ। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা কিছু চিহ্ন—যেন শিলালিপি, কিন্তু আধুনিক ভাষার বাইরে। অর্ক এক হাতে আলো জ্বালায়, আরেক হাতে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। “তুই কোথায় যাচ্ছিস বলবি?” তৃষা জিজ্ঞেস করে।

অর্ক গম্ভীর স্বরে বলে, “স্মৃতিচোরদের এলাকা থেকে দূরে। কিছু সময়ের জন্য নিরাপদ একটা জায়গায় যেতে হবে। তারপর আমি তোকে সব বলব।”

তারা নামতে থাকে আরও নিচে, যেন পৃথিবীর স্তরের নিচে লুকোনো এক গোপন রাজ্যে ঢুকে পড়ছে। পথের শেষে আসে এক খোলা গুহা, যার মাঝখানে পাথরের তৈরি এক বিশাল গোল টেবিল, চারপাশে ছড়ানো শত শত বই, মানচিত্র, আর কাচের জারে ভরা কাগজের টুকরো। দেওয়ালে লেখা — “স্মৃতিগুহা”।

তৃষা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে একটা জার তুলে নিয়ে দেখে—ভেতরে এক ছেঁড়া স্কুল ডায়েরির পাতা, যেখানে লেখা: “গান্ধীজী ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন করেন।” সে অবাক হয়ে অর্ককে দেখে।

অর্ক জবাব দেয়, “ওগুলো উদ্ধার করা সত্য। মানুষের মনে যেগুলো ছিল, স্মৃতিচোররা যেগুলো সরিয়ে নিয়েছে। আমরা যতগুলো পারি সংগ্রহ করে রাখি। এসবই একটা সত্য জগতের প্রমাণ।”

তৃষা ফিসফিস করে, “ওরা এগুলো সরিয়ে নিচ্ছে মানে? মানে মানুষ ইতিহাস মনে রাখতে পারছে না?”
অর্ক মাথা হেঁট করে বলে, “ঠিক তাই। ওরা স্মৃতির গভীর স্তরে ঢুকে পরিবর্তন করে। মানুষের বিশ্বাস বদলে দেয়। তুই জানিস না, কিন্তু তোর নিজের স্কুলের পাঠ্যবইয়েও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আর তুই যেহেতু প্রশ্ন করেছিস, তাই দরজা তোকে এখানে টেনে এনেছে।”

তৃষা হতভম্ব। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, কেবল চোখে ক্রমাগত বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তার ভেতরে তখন ভয় নয়, বরং একটা শক্ত ইচ্ছা জন্ম নিচ্ছে—সত্যটা খুঁজে বের করতে হবে। হঠাৎ আলো নিভে যায়। অর্ক এক ঝটকায় তৃষার হাত ধরে, দেয়ালের গায়ে ঠেলে দেয়।

“চুপ। ওরা এসে গেছে।”

ঘরে ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে, কিন্তু সেই বাতাসে একটা গন্ধ আছে—জ্বালানি, পুরনো কালি, আর কিছু একটা অচেনা হিম। ঘরের এক কোণে দাঁড়ায় একটা ছায়ামূর্তি—আকারে মানুষের মতো, কিন্তু চোখের জায়গায় কেবল ফাঁকা ঘন ছায়া। তার চারপাশে হালকা ধোঁয়া ঘুরছে, এবং পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসে টেবিলের দিকে।

তৃষার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। অর্ক চুপচাপ তার কানে ফিসফিস করে, “ওরা অন্ধ, কিন্তু স্মৃতির গন্ধ পায়। ও কিছু দেখবে না, যদি তোরা নিজেকে শান্ত রাখিস। ওরা কেবল ভুলে যাওয়া জিনিস খুঁজে বেড়ায়।”

তৃষা স্থির থাকে, কিন্তু তার মাথায় তখন অন্য প্রশ্ন—”যদি আমি ভুলে যাই, আমি নিজেই কি হারিয়ে যাব?”

ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে একটার পর একটা জার স্পর্শ করে, তারপর একটি খুলে নিয়ে কুয়াশার মতো লম্বা আঙুল দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে, আর তৃষার কানে এক নারী কণ্ঠস্বর—“১৮৫৭, সিপাহী বিদ্রোহ, বীরত্ব… বিভ্রান্তি…”—যেন তার নিজের মনেই কোনো স্মৃতি টলতে শুরু করেছে।

অর্ক তাকে শক্ত করে ধরে, ফিসফিস করে বলে, “তোর মনকে আটক রাখ। ওরা স্মৃতির টানেই বাঁচে। যেই না তুই বিশ্বাস করবি ভুলটা সত্যি, তোর স্মৃতি ওদের হয়ে যাবে।”

ছায়ামূর্তিটা একটু থেমে তৃষার দিকে মাথা ঘোরায়। চোখ না থাকলেও তৃষা অনুভব করে—তা তাকিয়ে আছে তার মধ্যকার কিছু একটা খুঁজে বের করতে। সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—“১৯৪7, ভারত স্বাধীন হয়, গান্ধীজি ছিলেন সত্যের পথিক, নেতাজি দেশপ্রেমিক…” সে বারবার নিজের মনে সত্যের পুনরাবৃত্তি করে।

হঠাৎ মূর্তিটা পিছিয়ে যায়। ধোঁয়া ঘন হয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আলো ফিরলে দেখা যায়, অর্ধেক জার গায়েব, কিছু কাগজ ছিঁড়ে পড়ে আছে মেঝেতে।

অর্ক ধীরে ধীরে বলে, “আজ আমরা বেঁচে গেলাম। কিন্তু ওরা এখন জানে—তুই এখানে আছিস।”

তৃষা তীব্র গলায় বলে, “আমাদের সত্যগুলো রক্ষা করতে হবে। সব ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাই যেন জানে, কী ভুল হয়েছে।”

অর্ক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। “তাহলে তোকে একটা জিনিস জানতে হবে—এই ইতিহাস শুধু বদলানো হয়নি, এটা রক্ষা করতে কাজ করছে এক ‘পরিমার্জন পরিষদ’। ওরা সরকার, শিক্ষা, এমনকি কিছু পরিবার পর্যন্ত ঢুকে গেছে। তুই যদি সত্য খুঁজতে চাস, তোকে খুঁজতে হবে মাস্টার স্ক্রিপ্ট—একটাই কাগজ আছে যেটা সব আসল ঘটনাগুলো ধারণ করে।”

তৃষার চোখে ঝিলিক। “কোথায় ওটা?”

অর্ক নিচু গলায় বলে, “সেই উত্তর আছে ‘নীল দরজার’ পিছনের আসল ঘরে। কিন্তু তার আগে, তোকে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। প্রতিটি সত্যকে মনের মধ্যে ধরে রাখতে হবে, কারণ পরের পথে ভুল স্মৃতি পাঠিয়ে তোকে বিভ্রান্ত করা হবে।”

তৃষা জিজ্ঞেস করে, “আমার কী করতে হবে এখন?”

অর্ক ধীরে বলে, “আগামীকাল ভোরে আমাদের উঠতে হবে পরের স্তরে। সেখানে শুরু হবে ‘মনের যুদ্ধ’। সেখানে তুই যা জানিস, তা সব চ্যালেঞ্জ হবে। আর একটা ভুল—তোর নিজের স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।”

তৃষা কাঁপা গলায় বলে, “তুমি থাকবে তো আমার সঙ্গে?”

অর্ক তার চোখে তাকিয়ে বলে, “আমি আছি। কিন্তু শেষ পথ তোকে একাই হাঁটতে হবে।”

তৃষা ছায়াঘন গুহার বাইরে তাকায়, যেখানে কালো আকাশে ঝলকায় নতুন এক বিদ্যুৎ রেখা। ইতিহাসের গভীর থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলে, “সব ভুল সত্য নয়, আর সব সত্য সহজ নয়।”

মনের পরীক্ষাগার

তৃষার ঘুম ভাঙে অদ্ভুত এক শব্দে—ধাতব শব্দ, যেন পুরনো চাবির ঘর্ষণ। চোখ খুলতেই দেখে অর্ক সামনে দাঁড়িয়ে, মুখে নিরবতা আর হাতে একটা হালকা নীল জ্বলন্ত গোলক। আলোটা ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া ফেলছে। চারদিকে সেই ধ্বংস হওয়া স্মৃতিগুহার গন্ধ, যেখানে তারা আগের রাতটা কাটিয়েছিল। অর্ক বলে, “সময় হয়েছে। মনের পরীক্ষাগার খুলছে। আজ তোর প্রথম যাত্রা।”

তৃষা উঠে দাঁড়ায়, শরীরে হালকা ক্লান্তি কিন্তু চোখে দৃঢ়তা। “আমি তৈরি,” বলে সে।

তারা আবার পেছনের করিডোরে ফিরে যায়, কিন্তু এবার অন্য পথে। করিডোরের দেওয়াল জুড়ে থাকা চিহ্নগুলো পালটে গেছে—একটা গাছ যার পাতা বইয়ের পৃষ্ঠা, একটা চোখ যার মাঝখানে ঘড়ির কাটার মতো কিছু ঘোরে, আর একজোড়া হাত যার মুঠোয় বালির মতো স্মৃতি গলে পড়ছে। পথের শেষে আসে একটা ধাতব দরজা, যার গায়ে লেখা—“মন ও মিথ্যার বিভাজন কেন্দ্রে স্বাগতম”।

অর্ক বলে, “এই দরজা খুললে, তুই একা যাচ্ছিস। আমি ভিতরে যেতে পারি না। ওটা শুধু সেইসব মানুষদের জন্য, যারা সত্য জানার জন্য তৈরি। ভিতরে তিনটি স্তর—প্রতিটি তোর বিশ্বাস পরীক্ষা করবে। যদি একটাতেও হেরে যাস, স্মৃতি বিভ্রান্ত হবে, আর সত্যের পথ মুছে যাবে।”

তৃষা দরজার হাতলে হাত রাখে। মুহূর্তে দরজাটা খুলে যায় নীরব শব্দে। ভিতরে কালো অন্ধকার। সে পা ফেলে ঢুকে পড়ে ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

প্রথম স্তরে সে নিজেকে পায় স্কুলের শ্রেণিকক্ষে। পরিচিত ক্লাসরুম—টেবিল, চেয়ার, জানালার ধারে তার প্রিয় বসার জায়গা। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক শিক্ষক—কিন্তু তার মুখটা অস্পষ্ট, ধোঁয়ায় ঢাকা। শিক্ষক বলছেন, “তৃষা, বল তো—মীরজাফর কে ছিলেন?”

তৃষা নিঃসংকোচে বলে, “একজন বিশ্বাসঘাতক, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি, যিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।”

শিক্ষক মৃদু হেসে বলেন, “তোমার বই বলছে তিনি ছিলেন এক গুপ্ত বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশদের ভেতর থেকে ধ্বংস করতেন। তুমি যদি ভুল বলো, পরীক্ষা ফেল করবে।”

তৃষার মাথা ঘুরে যায়। সে জানে এই তথ্য নতুন পাঠ্যবইয়ে লেখা আছে, কিন্তু তার অন্তর বলে—এটা সত্যি নয়। সে চিৎকার করে বলে, “এটা মিথ্যে! সত্য যা আমি শিখেছি ছোটবেলায়, সেটাই ঠিক! ইতিহাসকে এভাবে বদলানো যায় না!”

ক্লাসরুম মুহূর্তে গলে যায়। দেয়াল ধসে পড়ে, শব্দ হয়ে বাতাসে মিশে যায়। প্রথম স্তর পেরিয়ে যায়।

দ্বিতীয় স্তরে সে এসে পড়ে এক বিশাল মাঠে—লালরঙা সূর্যের নিচে মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে ব্যালট। একজন বলে, “এটা ১৯৫২ সালের নির্বাচন। প্রথম গণতান্ত্রিক ভোট।” কিন্তু পোস্টারগুলোয় ছবি আছে এক ব্রিটিশ শাসকের, আর স্লোগান চলছে—“ঔপনিবেশিক স্থায়িত্বের জন্য ভোট দিন।”

তৃষা অবাক। সে একজন বুড়ো মানুষের কাছে যায়, জিজ্ঞেস করে, “স্বাধীনতা কি হয়নি ১৯৪৭-এ?”
লোকটা বলে, “স্বাধীনতা মানে তো স্থায়িত্ব। আমাদের কখনো বন্দী মনে হয়নি। ব্রিটিশরা আমাদের অর্থনীতি গড়ে দিয়েছে, শিক্ষিত করেছে। এটা তো উন্নয়ন!”

তৃষার মন দুলে ওঠে। সে ভাবে—আমার চারপাশের এত মানুষ যদি বিশ্বাস করে এই ইতিহাস, তবে কী আমি ভুল?

ঠিক তখন পেছন থেকে ভেসে আসে অর্কের কণ্ঠস্বর, যেন হাওয়ার মধ্যে মিশে—“সত্য একা হাঁটে, কিন্তু তার পা সব জায়গায় পড়ে। তুই যা জানিস, তা ভুলে যাস না।”

তৃষা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে, মাটি ছুঁয়ে বলে, “১৯৪৭ সালে, রাত ১২টার সময়, ভারত স্বাধীন হয়েছিল। সত্যিই হয়েছিল। ইতিহাস বই পাল্টালেও, আমি ভুলব না।”

মাঠ ভেঙে পড়ে। ব্যালট উড়ে যায় ধুলোয়। দ্বিতীয় স্তর শেষ।

তৃতীয় স্তর। সে এসে পড়ে তার নিজের ঘরে। মা রান্নাঘরে। বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। ছোট ভাই খেলছে ফোনে। কিন্তু মা তাকিয়ে বলে, “তুই কবে এত বিদ্রোহী হলি? ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই।”
বাবা বলেন, “তুই ভুলে যা সব। চাকরি কর, সংসার কর, সত্য মিথ্যে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।”

তৃষার চোখ ভিজে যায়। সে জানে এই কণ্ঠস্বর বাস্তবের কাছাকাছি। সে এগিয়ে যায়, মায়ের হাত ধরে বলে, “মা, যদি আমরা ভুল ইতিহাসে বিশ্বাস করি, তাহলে আমরাও একদিন ভুল হয়ে যাব। আমি ইতিহাস বদলাতে পারব না, কিন্তু স্মৃতিটা রক্ষা করতে পারি।”

ঘর হঠাৎ অন্ধকারে গিলে যায়। চারপাশে এক গোল আলোয় সে নিজেকে আবিষ্কার করে। আলো থেকে গলা ভেসে আসে, “তুমি উত্তীর্ণ হয়েছো। এখন তুমি সত্যরক্ষকদের একজন। নীল দরজার আসল রহস্য এখন তোমার জন্য উন্মুক্ত হবে।”

তার চোখের সামনে আবার সেই নীল দরজাটা ভেসে ওঠে—এবার একেবারে তার সামনে। দরজার গায়ে আগুনের মতো জ্বলছে এক লাইন—
“যে সত্য জানে, সে দায়িত্ব এড়াতে পারে না।”

বিশ্বাসঘাতকের মুখোশ

তৃষা যখন নীল দরজার সামনে দাঁড়ায়, তখন সময় যেন স্থির হয়ে যায়। দরজার ধাতব গায়ে আঙুল বুলিয়ে সে টের পায় এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা, যেন চামড়ার নিচে কাঁপুনি ছড়িয়ে দিচ্ছে। চারপাশে নীরবতা এমন গভীর, যে নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দও স্পষ্ট শোনা যায়। হঠাৎ দরজার মাঝখানটা চকচক করে ওঠে, তারপরে নিজে থেকেই খুলে যায়—না কোনো শব্দ, না কোনো দোলা, কেবল এক নিঃশব্দ গ্রহণ।

অন্তর থেকে এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “তুই যা দেখবি, তা বিশ্বাস না করেও মনে রাখতে হবে।”

দরজার ভিতরে এক বিশাল হলঘর, অন্ধকারের মধ্যে অসংখ্য নীল আলো ঝুলে আছে বাতাসে। প্রতিটি আলোর নিচে ভেসে আছে কাচে মোড়া স্মৃতি—কেউ দাঁড়িয়ে আছে ১৯৪৭ সালের রেলস্টেশনে, কেউ সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাচ্ছে, কেউ জেলে বসে কবিতা লিখছে। এই ঘরটা—“স্মৃতিস্নান কেন্দ্র”।

হঠাৎ এক পায়ের শব্দ। তৃষা পেছনে ঘুরতেই দেখে অর্ক ঢুকছে, কিন্তু তার মুখে অস্বস্তি। সে একটু ঘেমে আছে, চোখে অন্যরকম দ্বিধা।

“তুই এখানে আসছিস কেন?” তৃষা জিজ্ঞেস করে।

অর্ক ফিসফিস করে, “তুই ভেতরে একা ঢুকলে যদি কিছু হয়ে যেত… আমি ভয় পেয়েছিলাম।”

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। “তুই তো বলেছিলি ভিতরে কেউ ঢুকতে পারবে না। দরজা তো শুধু আমার জন্য।”

অর্ক থেমে যায়। তার মুখে একটা হালকা হাসি, চোখে চাপা চাপ।

তারপর, তারা এগিয়ে যায় ঘরের একদম মাঝখানে, যেখানে রাখা “মাস্টার স্ক্রিপ্ট”। একটা কাচের বাক্সে রাখা একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি, যার পাতাগুলো যেন নিজের ভেতর আলো ছড়াচ্ছে। তৃষা হাত বাড়াতে গেলে, হঠাৎ কাচের বাক্স ঘিরে আগুনের পর্দা উঠে যায়। পেছন থেকে আরেকজন বলে ওঠে, “তুমি এখনও তৈরি না।”

তৃষা চমকে তাকায়—একজন বয়স্কা নারী, মাথায় ধূসর চুল, পরনে নীল শাড়ি, কপালে একটা তাম্র চিহ্ন। সে বলে, “আমি আর্কাইভের রক্ষক। নাম রোহিণী। এই স্ক্রিপ্ট স্পর্শ করতে গেলে তোর মনকে আরও একটা স্তরে যেতে হবে। তোর চারপাশে এখন যারা আছে, তাদের ভিতরের মুখোশ চিনতে হবে।”

তৃষা চমকে উঠে বলে, “মানে কী?”

রোহিণী এগিয়ে এসে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলেন, “একে চিনিস তুই, তাই তো বিশ্বাস করিস। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক সবসময় মুখোশ পরে আসে। এখন বল—তুই কতটা জানিস ওর সম্পর্কে?”

তৃষা থমকে যায়। মাথার মধ্যে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—অর্ক কিভাবে তার আগেই দরজার ভিতরে এল? কিভাবে সে সব জানে? তৃষার সন্দেহ হলেও, তার চোখে তখনও একটা আবেগ কাজ করছে—বিশ্বাস ভাঙার ভয়।

রোহিণী এবার নিজের গলায় ঝোলানো একটা ছোট লেন্স বের করে দেয়। “এই ‘চোখ’ দিয়ে তুই দেখতে পারবি—কারা সত্য, কারা মিথ্যে। কিন্তু একবার দেখলে, কোনো সম্পর্ক আগের মতো থাকবে না।”

তৃষা ধীরে হাত বাড়িয়ে নেয় লেন্সটা, চোখের সামনে ধরতেই অর্কের শরীরের চারপাশে নীল আলো ফুটে ওঠে—কিন্তু তার চোখে লাল ঝলক, একটা ক্ষীণ স্পন্দন—“ছায়া শ্রেণী”।

তৃষা কেঁপে ওঠে। “তুই… তুই ‘ছায়া শ্রেণী’র লোক? স্মৃতিচোরদের দলে?”

অর্ক গভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি তোকে ঠকাতে চাইনি। আমি একসময় রক্ষক ছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম সত্য রক্ষা করে শুধু যুদ্ধ বাড়ে, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই স্মৃতি শূন্য করাই ভালো। ওরা মানুষকে শান্তি দিতে পারে।”

তৃষা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, গলার স্বর কাঁপে। “তুই আমার বিশ্বাস ভেঙেছিস, অর্ক।”

অর্ক বলে, “তুই যা দেখিস তা সত্যি হলেও, সব সত্য গ্রহণযোগ্য নয়। আমি শুধু চেয়েছি তুই যেন কষ্ট না পাও। কারণ একবার যদি সব স্মৃতি খুলে যায়, তাহলে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

রোহিণী তীব্র কণ্ঠে বলে, “সত্য কঠিন, কিন্তু মিথ্যে নিষ্প্রাণ। যারা সত্য জানে, তারা শান্তির নামে চুপ থাকতে পারে না।”

তৃষা রোহিণীর দিকে তাকিয়ে মাথা হেঁট করে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তোলে, গলায় দৃঢ়তা, “আমি ‘মাস্টার স্ক্রিপ্ট’ চাই। আমি জানি, এটা এখন শুধু আমার নয়—এই দেশের, এই সময়ের, সব মানুষের প্রয়োজন।”

আগুনের পর্দা ধীরে ধীরে নিচে নামে। কাচের বাক্স খুলে যায়। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো খুলে পড়ে তৃষার হাতে।

হঠাৎ চারপাশে আলো কেঁপে ওঠে। অর্ক বলে ওঠে, “তুই এটা বের করতে পারবি না, তৃষা! একবার ওরা টের পেলে, তোকে হত্যা করা হবে। তোকে ভুলিয়ে দেওয়া হবে চিরতরে।”

তৃষা পাণ্ডুলিপি বুকের কাছে চেপে ধরে। চোখে কঠোর আলো। “তুই আমাকে ভুলে যেতে চাইলি। আমি আমার নামও ভুলে যেতে রাজি, যদি দেশের সত্য ফিরিয়ে আনতে পারি।”

রোহিণী হেসে ওঠে, গম্ভীর ও গর্বিত ভঙ্গিতে বলে, “তুই পাস করেছিস। তোর ভেতরে এখন সত্যের আগুন জ্বলে। এবার তোকে নিয়ে যেতে হবে শেষ স্তরে—‘মূল পাল্টানির কক্ষ’ এ। যেখানে ইতিহাস লিখে রাখা হয়। যেখানে স্মৃতিচোররা নতুন বই তৈরি করে, পাঠ্যক্রম পাল্টায়। সেখানেই তোকে ঢুকতে হবে।”

তৃষা বলে, “আমি যাব। আর এবার আমি একা যাব না। আমি চাই সারা দেশ জানুক—কীভাবে ওদের স্মৃতি পাল্টে দেওয়া হয়েছে।”

রোহিণী বলে, “তবে প্রস্তুত হও। কারণ ওরা এবার সত্যকে মারার জন্য আসবে, শুধু তোকে নয়—তোর স্মৃতিকে, তোর অস্তিত্বকে।”

তৃষা শেষবার অর্কের দিকে তাকায়—একটা শূন্যতা, একটা হারানো বন্ধু, এক বুক বিশ্বাসভঙ্গের ধ্বংসস্তূপ। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলে, “আমার সত্যরক্ষার পথ শুরু হয় বিশ্বাসঘাতকের মুখোশ সরানোর দিন থেকে।”

লেখার আগেই লেখা

রোহিণী যখন তৃষাকে নিয়ে স্মৃতিস্নান কেন্দ্রের পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে, তখন যেন ঘড়ির কাঁটাগুলো উল্টোমুখে ঘুরে যাচ্ছে। প্রতিটি ধাপে বাতাস ঘন হয়ে আসে, আলো কমে যায়, শব্দ মুছে যায়। নিচে পৌঁছতেই দেখা যায়—একটা বিশাল আয়তাকার ঘর, ছাদহীন, দেওয়াল জুড়ে শুধু শব্দ, বাক্য, আর পাণ্ডুলিপির ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে। এটাই ‘মূল পাল্টানির কক্ষ’—যেখানে ইতিহাস লিখে দেওয়া হয়, না যে ইতিহাস ঘটে, বরং যা ঘটা উচিত বলে কেউ ঠিক করে দেয়।

ঘরের একদম মাঝখানে বসে আছে একজন—চুল গোঁফ একেবারে সাদা, পরনে ধূসর পোশাক, চোখে গাঢ় কাচের চশমা। তার সামনে ভেসে আছে একটা টাইপরাইটার, যা কাগজ ছাড়াই লিখে চলেছে—আলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে পৃষ্ঠা, আর সেই পৃষ্ঠাগুলো বাতাসে মিশে যাচ্ছে।

রোহিণী ফিসফিস করে বলে, “ওই লোকটাকে বলে কৃত্রিম সত্যের লেখক—‘সায়েন্স অফ ম্যাস মেমোরি’-র প্রধান নির্মাতা। ওর টাইপরাইটারে যে লেখা হয়, সেটা তিন দিনের মধ্যেই সত্যে পরিণত হয়। নিউজে আসে, পাঠ্যবইয়ে যায়, মেমস-ভিডিও-কমেন্টে মিশে যায়। তারপর মানুষ ভুলে যায় কী ছিল, আর বিশ্বাস করতে শুরু করে কী লেখা হয়েছে।”

তৃষা দেখে—লেখক লিখছে:
“১৯৪7 সালে ভারত স্বাধীন হয়নি। ব্রিটিশরা ভারতে নিজ ইচ্ছায় প্রশাসন তুলে নিয়ে যায় কারণ তারা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। ”

একটা ঘৃণা ঝাঁপিয়ে পড়ে তৃষার বুকের ভেতর। সে এগিয়ে যায়, স্ক্রিপ্ট শক্ত করে ধরে বলে, “এই মিথ্যে থামাও।”

লেখক তাকায় না, কেবল মুচকি হাসে। “তুই কে? আর তোকে কে বলেছে মিথ্যে বলে কিছু আছে? ইতিহাস তো যা মানুষ মনে রাখে, সেটাই। আর মানুষ মনে রাখে আমি যা লিখি।”

তৃষা বলে, “তুই যা লিখিস, সেটা তথ্য হতে পারে, সত্য নয়। সত্য তৈরি হয় রক্ত দিয়ে, চোখ দিয়ে, কান্না দিয়ে। তুই ওগুলো মুছে দিস।”

লেখক এবার তাকায়—চোখদুটো একেবারে ফাঁকা, যেন ভিতরে আলো নেই। “তুই মনে করিস তোর ঐ পাণ্ডুলিপি দিয়ে কি হবে? এটা কি মানুষ বিশ্বাস করবে? আজকের শিশু জানে না জালিয়ানওয়ালাবাগ কী, জানে না যতীন দাস কে ছিলেন, জানে শুধু কে ট্রেনের টপে নেচে রিল বানিয়েছে।”

তৃষা শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বলে, “যদি একজনও বিশ্বাস করে, তবু সেটা হবে সত্যের পক্ষে জয়। আর আমি জানি—মানুষ ভুলতে চায় না, ভুলে যেতে শেখানো হয়।”

লেখক থেমে যায়। তারপর হাত তোলে। হঠাৎ ঘরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসে কালো ছায়ারা, যারা দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু চোখহীন, মুখহীন—স্মৃতিচোরের সৈন্যদল। এদের প্রত্যেকটা তৈরি হয়েছে ভুল ইতিহাসে বিশ্বাস করা মানুষের স্মৃতিতে।

তৃষা স্ক্রিপ্ট বুকের কাছে টেনে ধরে, আর রোহিণী একটা গোল নীল আলো তার হাতে রাখে। “এটা ‘মেমোরি ফ্লেয়ার’। এটা ছুঁড়ে মারলেই কিছু সময়ের জন্য স্মৃতিচোররা স্থবির হয়ে পড়বে। কিন্তু তারপর… যুদ্ধ।”

তৃষা আলোটা ছুঁড়ে মারে। সঙ্গে সঙ্গে সারা কক্ষ আলোয় ঝলসে ওঠে, স্মৃতিচোরদের শরীর এক মুহূর্তের জন্য ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যায়। সেই ফাঁকে সে দৌড়ে যায় লেখকের টাইপরাইটারের দিকে। লেখক তাকে থামানোর চেষ্টা করে, কিন্তু রোহিণী বাঁধা দেয়।

তৃষা টাইপরাইটারটা ছুঁয়ে দেখে, সেটা মাটির ওপরে ভাসছে, ঠাণ্ডা, অথচ গা থেকে একটা দপদপে তাপ বেরোচ্ছে—যেন মস্তিষ্কের মতোই জীবন্ত। সে নিজের পাণ্ডুলিপি থেকে একটা পৃষ্ঠা তুলে টাইপরাইটারের ওপরে রাখে। টাইপরাইটার নিজে থেকেই হালকা আলো ফেলে সেটা পড়ে নেয়। মুহূর্তে ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, “ডেটা কনফ্লিক্ট”, তারপর লেখা শুরু হয়—

“সত্য মুছে ফেললেও তার ছায়া থেকেই জন্ম নেয় নতুন প্রশ্ন। প্রশ্ন থেকে বিপ্লব। আর বিপ্লব থেকে মুক্তি।”

লেখকের মুখে আতঙ্ক। সে চিৎকার করে বলে, “তুই যদি সত্য ঢুকিয়ে দিস এই যন্ত্রে, তাহলে মানুষ জেগে উঠবে! ভুল প্রশ্ন করতে শুরু করবে! রাজনীতি টলবে, মিডিয়া ভাঙবে, প্রতিষ্ঠান ভয় পাবে!”

তৃষা বলে, “সেটাই তো দরকার ছিল, তাই না?”

ঠিক তখনই টাইপরাইটার নিজে থেকেই কাঁপতে শুরু করে, সমস্ত বাতাস গরম হয়ে ওঠে, স্মৃতিচোররা ছটফট করতে থাকে। টাইপরাইটার আলোর বিস্ফোরণে ফেটে যায়।

রোহিণী তৃষার দিকে ছুটে আসে, তার মুখে গর্ব। “তুই করেছিস! এখন এই সত্য ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ জানবে না প্রথমে, মানবে না দ্বিতীয়বার, কিন্তু তৃতীয়বার—তারা জিজ্ঞেস করবে, ‘আমরা এতদিন ভুলে ছিলাম কেন?’”

কিন্তু তৃষার চোখ তখনো এক জায়গায় আটকে—টাইপরাইটারের পেছনে একটা ক্যামেরা লুকানো ছিল। একটা গোপন ফিড।

রোহিণীও দেখে ফেলে। “ওরা জানে গেছে। এখন তোর পিছু নেবে ওরা। ওরা তোকে সত্য বলে নয়, ঝুঁকি বলে দেখে।”

তৃষা মৃদু হেসে বলে, “তাহলে সত্যই হয়েছি।”

হঠাৎ কক্ষের এক কোণ থেকে আওয়াজ আসে। কেউ ধীরে ধীরে হাততালি দিচ্ছে। ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে একটা নতুন মুখ—চোখে চশমা, কোট পরা, হাতে একটা সিলভার পেনড্রাইভ।

সে বলে, “তৃষা সেন, তুমি সত্য লিখে ফেলেছো। এবার সময় এসেছে সেটা মুছে ফেলার।”

মেমোরি ডিলিট অথরিটি

আলো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ফ্লেয়ার নিভে গেছে। টাইপরাইটারের ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়া উঠছে। ঠিক তখনই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা সেই লোকটা সামনে এসে দাঁড়ায়—গম্ভীর মুখ, চোখে শীতল নিরাসক্তি, হাতে একটি সিলভার পেনড্রাইভ। সে তার নাম বলে না, শুধু একটাই পরিচয় দেয়—“আমি MDA থেকে এসেছি।”

তৃষা ভ্রু কুঁচকে বলে, “MDA?”

লোকটা ঠাণ্ডা স্বরে বলে, “Memory Deletion Authority. আমরা নিশ্চিত করি যেন বেশি সত্য ছড়িয়ে না পড়ে। একবার যদি সত্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। আমরা সেটা হতে দিই না।”

রোহিণী গর্জে ওঠে, “তোমরা সরকার না, নীতি না, বিজ্ঞান না। তোমরা কেবল ভয়! মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার লোভ!”

লোকটা তীক্ষ্ণভাবে রোহিণীর দিকে তাকায়। “আপনিও জানেন, সত্যের ডোজ মাত্রাতিরিক্ত হলে মানুষ আতঙ্কে আত্মঘাতী হতে পারে। ইতিহাসের ভার সবাই বইতে পারে না। তাই আমরা ব্যালান্স রাখি।”

তৃষা এগিয়ে আসে, পাণ্ডুলিপি বুকের কাছে ধরে, চোখে আগুন। “তোমরা সত্য মুছে দাও? শুধু যাতে সুবিধা বজায় থাকে? কে তোমাদের অধিকার দিয়েছে—মানুষের স্মৃতি এডিট করার?”

লোকটা মৃদু হেসে পেনড্রাইভটা ঘুরিয়ে দেখায়। “এই ডিভাইসে আছে Smritikshya Protocol—যেটা ঢুকিয়ে দিলেই যে কোনো স্মৃতি চিরতরে মুছে যাবে মস্তিষ্ক থেকে। এবং এটি নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিপ্টকেও ডিজঅ্যাক্টিভ করতে পারে। যদি তুই নিজে থেকে পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করিস, আমরা তোকে রক্ষা করব। তোকে কেউ ভুলিয়ে দিতে পারবে না।”

তৃষা ধাক্কা খায়। “তোমরা জানো আমি কারা ভুলে যেতে চাই না।”

লোকটা স্থিরভাবে বলে, “আর যদি না করিস, তোর পরিচয়, স্মৃতি, এমনকি নিজের অস্তিত্ব—সব মুছে যাবে। তোকে আর কেউ চিনবে না। তোর জন্মও কেউ মনে রাখবে না। তুই হবে ইতিহাসের এক ফাঁকা লাইনের নিচে ফেলে রাখা অদৃশ্য ছায়া।”

রোহিণী ফিসফিস করে বলে, “তারা সত্য মারে না। তারা সত্যের জন্মবৃত্তান্ত মুছে দেয়।”

তৃষা পেছনে এক পা হটে। তার হৃদয় ধাক্কা খায় বারবার। যদি সে নিজে মুছে যায়, পাণ্ডুলিপি থেকে যাবে কোথায়? সত্য কি জিতে যাবে, নাকি পরিচয়বিহীন এক ছায়ার মতো বিলীন হয়ে যাবে?

ঠিক তখন পেছনের এক দরজা খুলে যায়। কেউ আসছে—চেনা এক পায়ের শব্দ। তৃষা তাকিয়ে চমকে ওঠে। অর্ক।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে স্পষ্ট কিছু বলার তাগিদ। “তৃষা, আমি তোকে ঠকিয়েছি, জানি। কিন্তু এখনকার চেয়ে সত্য সময় আর আসবে না।”

MDA-র লোক তার দিকে তাকায়। “তুই তো আমাদেরই ছিলি। কেন ফিরছিস?”

অর্ক চুপচাপ একটা পেন্ডেন্ট খুলে ফেলে মাটিতে ছুড়ে মারে। সেটি ছুঁয়েই আলোর ঢেউ উঠে আসে, পুরো ঘর কম্পন করে। সে বলে, “আমি তোদের জন্য কাজ করতাম সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু আজ আমি বুঝেছি—যে সত্য নিয়ন্ত্রণ চায়, সে নিজেই মিথ্যের দাস।”

তৃষা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর পাণ্ডুলিপি তুলে অর্কের হাতে দেয়। “তুই ঠিক করবি এবার। আমি শুধু জানি, আমি চাই এটা একটা লাইব্রেরিতে থাকুক। কোনো গুপ্তকক্ষে নয়।”

MDA-র লোক দ্রুত পেনড্রাইভটা টাইপরাইটারের অবশিষ্টাংশের ওপর লাগাতে এগিয়ে আসে। অর্ক কাঁচের ঘড়ি থেকে কিছু একটা বের করে ছুঁড়ে মারে তার দিকে—একটা ব্লু-পালস বোম্ব।

তীব্র আলো। কান ফাটানো শব্দ। MDA-র লোক ভেঙে পড়ে, পেনড্রাইভটা ছিটকে পড়ে। অর্ক বলে, “তুই দৌড়, তৃষা। তোকে যেতে হবে জ্ঞানরক্ষা আর্কাইভ এ—চৌবাচার মোড়ে, পাতাল লাইব্রেরি, কলকাতার নিচে।”

রোহিণী সঙ্গে সঙ্গে বলে, “আমার চেনা লোক আছে সেখানে। ওরা এখনো লড়ছে স্মৃতির পক্ষ হয়ে। ওরা তোকে লুকিয়ে রাখবে।”

তৃষা বলে, “তুই আসবি?”

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, “আমার কাজ শেষ হয়নি এখানে। কিন্তু এবার থেকে আমি আর মিথ্যের চাকর নই।”

তৃষা আর কিছু না বলে পাণ্ডুলিপি বুকের মধ্যে লুকিয়ে নেয়, আর অন্ধকার করিডোরে দৌড়াতে শুরু করে। পেছনে রোহিণী ঢিলেধাপে চলে, হাতে স্মৃতি-ডিফিউজার, যেন যেকোনো আক্রমণ এলে প্রতিহত করা যায়।

আর পেছনে পড়ে থাকে ভাঙা টাইপরাইটার, ঝলসানো স্মৃতিচোরদের দল, আর এক গুঞ্জন—সত্য আবারও পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু কতদিন?

স্মৃতির নীচে লুকনো স্মৃতি

তৃষা আর রোহিণী পাতাল লাইব্রেরির দিকে ছুটে চলেছে—কলকাতার একেবারে পুরনো অংশ, যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঁট বসানো রাস্তা এখনো নিঃশব্দে ইতিহাস ঢেকে রাখে। রাত তিনটে বেজে পঁচিশ। শহরের গলা তখন শান্ত, কিন্তু মাটির নিচে শব্দ হচ্ছে—পুরনো বইয়ের পাতায় কেউ যেন নীরব যুদ্ধ চালাচ্ছে।

রোহিণী এগিয়ে এক পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে থামে—চুন খসা দেওয়াল, ঝুলন্ত বারান্দা। দরজায় কোনও তালা নেই, কিন্তু একটা ছায়া দেখে বুঝতে পারা যায়, ভিতরে কেউ অপেক্ষা করছে।

ভিতরে ঢোকার পরেই চোখে পড়ে—একটা সরু লোহার সিঁড়ি, যেটা নিচের দিকে চলে গেছে। তৃষা ভাবে, যেন সে সময়েরই ভিতরে নামছে, বাস্তব থেকে আরও দূরে, আরও গভীরে।

নিচে পৌঁছেই দেখতে পায়—এক বিশাল গোলাকার ঘর, দেয়ালজুড়ে হাতছানি দেয় হাজার হাজার পুরনো বই, ক্যাসেট, স্মৃতি-চিপ। এটাই ‘জ্ঞানরক্ষা আর্কাইভ’। কেন্দ্রে বসে আছেন একজন, বয়স বোঝা যায় না, চোখে ভারি চশমা, কপালে তিনটি উলম্ব রেখা।

“তৃষা সেন,” তিনি নাম ধরে ডাকেন, “তোমার আসাটা সময়ের আগে হয়েছিল। কিন্তু সময় তো আগেই পিছিয়ে গেছে, তাই বোধহয় ঠিকই হয়েছে।”

তৃষা চমকে ওঠে। “আপনি কে?”

লোকটি বলেন, “আমরা যারা স্মৃতি রক্ষা করি, তারা নিজের পরিচয় রাখি না। নাম দিলে নামটাই প্রথম মুছে ফেলা হয়। তবে তুমি আমাকে স্মৃতি-ধারক বলতে পারো।”

তৃষা তার হাতে পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়। স্মৃতি-ধারক তা ছুঁয়ে একবার চোখ বন্ধ করেন। “এটা সত্য নয়, কন্যা। এটা সত্যের ছায়া।”

তৃষা আঁতকে ওঠে। “মানে? আমি তো নিজের চোখে যা দেখেছি, যা খুঁজে পেয়েছি, সেটাই লিখেছি!”

“তুমি যা দেখেছো, তা হয়তো সত্য ছিল,” স্মৃতি-ধারক চোখ মেলে তাকান, “কিন্তু তুমি কি জানো তুমি কখন দেখতে শুরু করেছিলে?”

তৃষা থেমে যায়। “আমি… মানে… আমার স্মৃতি আছে সব…”

রোহিণী তখনই সামনে এগিয়ে এসে বলে, “এই কথা আমিও ভাবছিলাম। তৃষা, তুমি কখনো তোমার শৈশব নিয়ে বিস্তারিত বলোনি। কোনো স্মৃতি?”

তৃষা ধাক্কা খায়। মনে করার চেষ্টা করে। বাবার মুখ? না, আবছা। প্রথম স্কুল? ঝাপসা। গন্ধ, রং, শব্দ—সবই যেন কোনও ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে আসে।

স্মৃতি-ধারক বলেন, “তোমার স্মৃতির কিছু অংশ ইনপ্লান্টেড—ভুলভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত MDA তোমার মাধ্যমেই একটা নির্দিষ্ট ‘সত্য’ লিখাতে চেয়েছিল।”

তৃষা পেছনে এক পা হাঁটে। মাথা ঝিমঝিম করে। “না… আমি তো আমার মতোই লিখেছি… আমার মত করে…”

রোহিণী ধীরে ধীরে বলে, “তৃষা, যদি এটা সত্য হয়, তবে তোমার ভেতরে যে তথ্য আছে, সেটা MDA-র পরবর্তী অস্ত্র হতে পারে।”

তৃষা কাঁপা গলায় বলে, “তাহলে কি আমি নিজেই মিথ্যে?”

স্মৃতি-ধারক সামনে একটি যন্ত্র নিয়ে আসে—মস্তিষ্ক-স্ক্যানার, যা স্মৃতির গভীরতম স্তর খুলে দেখতে পারে। “তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তৃষা। আমরা তোমার স্মৃতি খুলে দেখতে পারি। জানতে পারি কোনটা আসল, কোনটা বসানো। কিন্তু একবার খুলে ফেললে তুমি আর আগের মানুষ থাকবে না। পুরনো তুমি হয়তো আর ফিরবে না।”

তৃষা তাকিয়ে থাকে সেই যন্ত্রটার দিকে। বুক ধকধক করে। এই মুহূর্তে সে শুধু একটা শব্দ শুনতে পায়—ভেতর থেকে ভেসে আসা নিজের কণ্ঠস্বর: “সত্য মানে কি শুধুই দেখা? নাকি কে কাকে দেখতে দিল, সেটাও?”

সে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে, “আমি তৈরি। যদি আমার স্মৃতিই মিথ্যে হয়, আমি সেটা জানতেই চাই। সত্যি জানার ভয় নেই আমার।”

স্ক্যানার চালু হয়। চারপাশ ঘোরে। সময় থেমে যায়। আর তার স্মৃতির গভীরে, প্রথম খোলা হয় ‘স্মৃতি #0001’।

একটি অন্ধকার ঘর। এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ল্যাব কোট। হাতে ইঞ্জেকশন। পেছনের দেয়ালে লেখা—

Project Trisha: Iteration 17
Objective: Embed Believable Resistance Memory
Status: Initial Acceptance—Successful

তৃষা চিৎকার করে ওঠে। মাথার মধ্যে বিস্ফোরণ। “না! এটা আমি নই! এটা আমার নয়!”

কিন্তু স্মৃতি-ধারক শান্ত স্বরে বলেন, “তুমি তো ছিলে না। তোমাকে তৈরি করা হয়েছিল।”

তৃষা মাটিতে বসে পড়ে, কাঁপে। “তাহলে আমি কি কেবল একটা চরিত্র? কারও বানানো?”

রোহিণী তার কাঁধে হাত রাখে। “হয়তো তাই। কিন্তু তুই লিখেছিস যা তারা চাননি। মানে, তুই নিজে জন্ম নিয়েছিস, তৈরি হয়ে নয়। চরিত্ররা কখনো লেখক হয়ে উঠলে, তখনই ইতিহাস পালটে যায়।”

স্মৃতি-ধারক বলেন, “তুমি যদি চাও, আমরা পুরো পুরনো স্মৃতি মুছে দিতে পারি। তারপর তুমি শুরু করতে পারো নিজের মতো করে—একদম শুরু থেকে। শূন্য থেকে। নিজের সত্য তৈরি করে।”

তৃষা মাথা তুলে বলে, “না। আমি এসব রাখবো। কারণ এগুলো আমার যুদ্ধের দাগ। সত্য তখনই দাঁড়ায়, যখন মিথ্যের ভেতর থেকেও উঠে আসতে পারে। আমি ভুলে যেতে চাই না, আমি তৈরি হয়েছিলাম মিথ্যের জন্য। আমি প্রমাণ করতে চাই—সত্য শেখানো যায় না, খুঁজে পেতে হয়।”

দ্বিতীয় তৃষা

পাতাল লাইব্রেরির সব শব্দ যেন থেমে গেছে। স্ক্যানারের আলোর রেশ মিলিয়ে গেছে তৃষার চোখে। রোহিণী পাশে দাঁড়িয়ে, কিন্তু কিছু বলে না। স্মৃতি-ধারক শুধু ফিসফিসিয়ে বলেন, “তুমি যদি নিজেকে জানতে চাও, তবে যেতে হবে ‘উৎপত্তি-কেন্দ্র’—যেখানে প্রথম তোমার স্মৃতিগুলো বসানো হয়েছিল। যাকে আমরা বলি: নীল দরজার আঁধার কক্ষ।”

তৃষা জানতে চায়, “ওটা কোথায়?”

তিনি বলেন, “হুগলির ধারে, বঙ্কিমপুরে। আগের এক ডিফেন্স ফ্যাসিলিটি—আপাতত বন্ধ, কিন্তু ভিতরে এখনো সক্রিয় রয়েছে ‘চেতনা প্রকল্প’। ওটাই তোমার উৎস। এবং সম্ভবত, তোমার ছায়ারও।”

তৃষা কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। রোহিণী তার সঙ্গে চলে, চোখে চিন্তার ছায়া। তাদের লক্ষ্য—পুরনো এক ল্যাব, যেখানে কোনো দরজাই সত্যিই বন্ধ নয়।

দুপুর। বঙ্কিমপুরের বাতাস যেন থমকে আছে। ঘাসে লুকিয়ে থাকা কাঁটার মতো ছড়িয়ে আছে গোপন সেনা পোস্টিং-এর ইতিহাস। পুরনো ল্যাবরেটরি এখন আগাছায় ঢাকা, কিন্তু ভিতরে ঢুকেই বোঝা যায়—এটা শুধু বিজ্ঞান ছিল না, এটা ছিল কল্পনা তৈরি করার কেন্দ্র।

তৃষা হাত বুলিয়ে চলে দেয়ালের ওপর, যেখানে লুকানো এক স্ক্যানার তার আঙুলের ছোঁয়ায় সক্রিয় হয়। দরজা খুলে যায়—একটা ঘর, অন্ধকারে ডুবে, যার মাঝে রাখা একটা আধা-বৃত্তাকার কাঁচের পড।

আর ঠিক তখনই, পডের পেছন থেকে কেউ বেরিয়ে আসে।

সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তৃষার দিকে তাকায়।

তৃষা তাকিয়ে থাকে।

একই মুখ।

একই চোখ।

একই কপালের তিল।

তাদের মাঝখানে নীরবতা পড়ে থাকে যেন দুই আয়নার মাঝে ছায়া।

মেয়েটি বলে, “তুমি আমায় দেখে অবাক হলে না, তাই তো? কারণ কোথাও না কোথাও, তুমি জানতেই এটা একদিন ঘটবে।”

তৃষা গলা শুকিয়ে বলে, “তুমি কে?”

মেয়েটি মৃদু হেসে বলে, “আমি সেই তৃষা, যাকে তৈরি করা হয়েছিল সত্য মুছে দিতে। আর তুমি? তুমি সেই তৃষা, যে মিথ্যের মধ্যে থেকেও সত্য জন্ম দিয়েছে। তাই তো তারা বলেছে, তৃষা-১৭ ব্যর্থ। কিন্তু তৃষা-১৮ বিপদ।”

তৃষা পিছিয়ে যায়। “তাহলে তুমি… তুমি তো আমি না। তুমি তাদের তৈরি একটা রেপ্লিকা।”

“না,” মেয়েটি সামনে এগিয়ে আসে। “আমি সেই স্মৃতির ধারক, যাকে কখনো মুক্তি দেওয়া হয়নি। আমি জানি, আমরা কি ছিলাম। আমার মধ্যে সেই প্রোগ্রাম এখনো আছে, যে যেকোনো ‘অবাঞ্ছিত সত্য’ স্ক্যান করে ডিলিট করতে পারে। কিন্তু… আমি আর মুছতে চাই না।”

তৃষা হোঁচট খায়। “তুমি…?”

“হ্যাঁ,” মেয়েটি বলে। “তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে স্মৃতি নিয়ে। আমি ছিলাম ভেতরে। প্রকল্পের গভীরে। কিন্তু আমি পড়েছিলাম তোমার সেই লেখা—যা তুমি প্রথম পাণ্ডুলিপি আকারে টাইপরাইটারে তুলেছিলে। আমি পড়ে বুঝেছিলাম, সত্য চাপা পড়লেও নিজে থেকেই উঠে আসে।”

রোহিণী সামনে আসে। “তুমি তাহলে প্রাথমিক ক্লোন, যাকে MDA গোপনে রেখেছিল? তাই কেউ জানে না এই প্রকল্পে দু’জন তৃষা আছে?”

সে মাথা নাড়ে। “তারা চেয়েছিল, এক তৃষা সত্য ছড়াক, আরেক তৃষা সেটা নিঃশব্দে ডিলিট করুক। কিন্তু… আমরা দু’জনই আলাদা হয়ে গেছি।”

তৃষা বলে, “তাহলে এখন কী করবে তুমি?”

“তোমার সঙ্গে আসব,” দ্বিতীয় তৃষা বলে। “আমি জানি, আমার ভিতরে এখনো আছে MDA-র শেষ অস্ত্র: স্মৃতি-নাশ প্রোটোকল। কিন্তু তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, আমি সেটা ব্যবহার করব ঠিক উল্টো কাজের জন্য—স্মৃতি রক্ষা করতে।”

তৃষা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুমি কি পারবে? যাকে বানানো হয়েছে ধ্বংসের জন্য, সে কি সৃষ্টির কাজ করতে পারে?”

দ্বিতীয় তৃষা বলে, “তুমি পেরেছো তো। তাহলে আমি কেন পারবো না?”

ঠিক তখনই বাতাসে গুঞ্জন ওঠে। আকাশে দেখা দেয় ড্রোনের সারি। লাল চোখে স্ক্যানার, যেগুলোর সবটাই যুক্ত MDA-র কেন্দ্রীয় কমান্ডে। অ্যালার্ম বাজে। তারা খুঁজে পেয়েছে লোকেশন।

রোহিণী চিৎকার করে, “তারা আসছে! আমাদের এখনই বেরোতে হবে!”

দ্বিতীয় তৃষা হাতে একটা মডিউল তুলে দেয় তৃষার হাতে। “এটা নাও। এর ভিতর রয়েছে একমাত্র ‘রিভার্স প্যালেট’—যে কোড দিয়ে মিথ্যে মুছে সত্য ফিরিয়ে আনা যায়। এটা দিয়ে তুমি প্রথমবার সত্যকে সিস্টেমে লিখতে পারবে।”

তৃষা মডিউলটা ধরে। দ্বিতীয় তৃষা বলে, “তোমার শরীরে যা সত্য, তা লিখে দিও পৃথিবীর শরীরে। তারপর সত্য আর কখনো লুকিয়ে থাকবে না।”

ড্রোনের গর্জন নেমে আসে মাথার ওপর। দরজা ভেঙে পড়ে।

তৃষা, রোহিণী আর দ্বিতীয় তৃষা দৌড়াতে শুরু করে—দীর্ঘ টানেলে, একটা আলোর দিকে, যেটা নীল নয়, কিন্তু সেই ‘নীল দরজা’র ছায়া ফেলে চলেছে দেওয়ালে।

মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড

টানেল যত এগিয়ে চলেছে, বাতি নিভে যাচ্ছে একের পর এক। দেওয়ালগুলোতে ছায়া পড়ছে তিনজনের—তৃষা, দ্বিতীয় তৃষা আর রোহিণী। ছায়াগুলো যেন জিজ্ঞাসা করছে, এরা কারা? সত্যর যাত্রী, না আরেকটা তৈরি ভুল?

তারা পৌঁছায় এক বিস্তৃত গুহার মতো ঘরে। মাটিতে বসানো একটা অদ্ভুত যন্ত্র—পাঁচ কোণার ধাতব প্ল্যাটফর্ম, মাঝখানে ভাসছে স্ফটিকের মতো একটি কিউব। সেটাই মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, সেই তথ্য-পাত্র যা একসময় সমস্ত সত্য ধারণ করত। আর এখন—এটা ফাঁকা। ঝিমিয়ে পড়া এক নীরব মহাকাশের মতো।

দ্বিতীয় তৃষা বলে, “এটাই সেই জায়গা, যেখানে MDA একসময় সবকিছু লিখত। জাতি, ইতিহাস, ভূগোল—সব এই কিউবের কোড দিয়ে বানানো হতো। এখন এর জায়গা নিয়েছে চিপে থাকা ভাষ্য। কিন্তু এই কিউব… এখনো লেখে। যদি কেউ সাহস করে।”

তৃষা ধীরে ধীরে সামনে এগোয়। তার হাতে ধরা সেই মডিউল—রিভার্স প্যালেট। এটা যুক্ত করলে সে লিখতে পারবে সত্য, যেটা সিস্টেম স্বীকার করতে বাধ্য হবে।

কিন্তু ঠিক তখনই একটা আওয়াজ হয়—কিছু ধাতব পদক্ষেপ, কড়া আলো, আর তারপরে এক কণ্ঠস্বর, যেটা খুব চেনা মনে হয়।

“তৃষা সেন। অবশেষে তুমি এখানে। তুমি জানো, এই কিউবে কী লেখা হবে, তা ঠিক করে না লেখক—ঠিক করে যে নজরদারি করে।”

তারা তাকিয়ে দেখে—সামনে দাঁড়িয়ে একজন, চোখে কালো চশমা, সাদা পোশাক, হাতে ছিপছিপে একটা রিমোট-ডিভাইস। পাশে আধা-মানবিক কয়েকটি রোবোটিক গার্ড।

তৃষা ফিসফিসিয়ে বলে, “ও তো আমার প্রফেসর ছিল… লোকটা যে আমাকে গবেষণার জন্য প্রথম ডাকত…”

দ্বিতীয় তৃষা বলে, “সে-ই ছিল প্রকল্প প্রধান। ওর নাম সুধাংশু গুহ। তোর স্মৃতির একাংশ ওর হাতে লেখা।”

গুহ সামনে এগিয়ে আসে। “তুমি একটা ত্রুটি, তৃষা। আমরা তোকে বানিয়েছিলাম যাতে তুই তথ্য লিখিস, কিন্তু আমাদের মতো করে। কিন্তু তুই ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছিস। এখন যদি এই কিউবে তুই সত্য লিখিস, তবে ইতিহাস বদলে যাবে। সরকার, ধর্ম, জাতি, সীমান্ত—সব হুমকিতে পড়বে।”

রোহিণী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ঠিক তাই তো আমরা চাই। সত্য যদি হুমকি হয়, তবে সেই হুমকিই দরকার।”

গুহ থামে। “তাহলে শুনো। এই কিউব, একবার লেখা হয়ে গেলে আর বদলানো যাবে না। ভুল লিখলে সব শেষ। আর তৃষার ভিতরে এখনো ঢুকানো আছে ‘অটো-করেক্ট প্রটোকল’। লিখতে গেলেই সে নিজেই নিজের লেখা পাল্টে ফেলবে—যতক্ষণ না তা সরকারি সংস্করণের মতো হয়।”

তৃষা তখনই বলে, “তবে আমি একা লিখব না। দ্বিতীয় তৃষাও লিখবে আমার সঙ্গে। এক সঙ্গে, এক লাইন করে। যদি স্মৃতি ভাগ করা যায়, তবে সত্যও ভাগ হতে পারে।”

গুহ হেসে ওঠে। “তোমরা নিজেরাই জানো না তোমাদের কতটা নিজস্ব। আর কতটা ডিজাইনড।”

তৃষা আর দ্বিতীয় তৃষা পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর তারা রিভার্স প্যালেট সংযোগ করে কিউবে। ঘর ভরে ওঠে আলোয়, যার রঙ কোনো এক ভাষার মতো—না বলা, তবু অনুভবযোগ্য।

তারা একসঙ্গে লিখতে শুরু করে।

“এই দুনিয়া তৈরি নয় রাষ্ট্র দিয়ে, তৈরি হয়েছে স্মৃতির ভিত্তিতে। কিন্তু সেই স্মৃতি আমাদের নয়, দেওয়া হয়েছিল। এখন আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি আমাদের সত্য। যা আমরা দেখেছি, ভেবেছি, অনুভব করেছি—সেই স্মৃতিই হবে ভবিষ্যতের ভিত্তি।”

তখনই কিউব কেঁপে ওঠে। গুহ চিৎকার করে ওঠে, “না! এটা তো মূল পলিসির বিরুদ্ধাচরণ! এটা থামাও!”

সে রিমোট চালায়, কিন্তু কিউব প্রতিরোধ করে। রিভার্স প্যালেট তার প্রোগ্রাম ঢুকতে দেয় না। দ্বিতীয় তৃষা চিৎকার করে, “তৃষা, শেষ লাইনটা লিখ! এই মুহূর্তেই!”

তৃষা জোরে কলম চালায়—“স্মৃতি যদি বানানো হয়, তবে সত্য তাকে পুনরুদ্ধার করে। আমি সেই পুনরুদ্ধার।”

কিউব একবার ঝলসে ওঠে। তারপর ছড়ায় এক তরঙ্গ—একটা অদৃশ্য বায়ু-প্রবাহ পৃথিবী জুড়ে। মোবাইলের স্ক্রিনে, বইয়ের পাতায়, অফিসের নথিতে—এক নতুন ইতিহাস ঢুকে পড়ে। ভুল তথ্য মুছে গিয়ে উঠে আসে: বঞ্চিতদের নাম, হারানো গল্প, সত্য যুদ্ধ, আর সেইসব মানুষদের কথা, যাদের জায়গা মেলেনি কোনও পাঠ্যবইয়ে।

গুহ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তার চারপাশের ডেটা ফিড অচল হয়ে পড়ে। সে পড়ে যায়, কাঁচ ভেঙে গড়িয়ে যায় তার চশমা।

রোহিণী ধীরে ধীরে বলে, “তুই ইতিহাস লিখলি, তৃষা। কিন্তু নিজেকে নয়। সবাইকে জায়গা দিলি।”

তৃষা মাথা নিচু করে বলে, “এটাই তো সত্য। একা হলে তা স্মৃতি। সবার হলে তা ইতিহাস।”

দ্বিতীয় তৃষা পাশে এসে দাঁড়ায়। “তবে এবার ইতিহাস লেখার সময় শেষ। এখন চল, সত্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”

সত্যের প্রহরী

স্মৃতির কিউবটা নিঃশব্দে ঘুরছে, তার চারপাশে জ্বলছে নীল আর সাদা আলো, যেন কোনো মহাজাগতিক চেতনা নিঃশব্দে ধ্বনি তুলছে। শহরে, গ্রামে, স্কুলে, পাঠাগারে—প্রত্যেক পর্দায়, প্রত্যেক শব্দভিত্তিক তথ্যভাণ্ডারে সত্য ঢুকে পড়েছে।

তৃষা বাইরে বেরিয়ে আসে। তাদের পেছনে পড়ে আছে গুহর নিথর শরীর, তার চারপাশে ছড়ানো তথ্যপ্রবাহের ধ্বংসাবশেষ। রোহিণী কাঁধে তার পুরনো ব্যাগ ঝুলিয়ে ধীরে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় তৃষা একবার ঘুরে তাকায় সেই কিউবের দিকে, যেন বলছে—“তুই এখন নিরপেক্ষ, যেমন হওয়া উচিত।”

কিন্তু বাইরে এসে দেখে, পরিবর্তন খুব শান্তভাবে শুরু হয়নি।

পোস্টার ছিঁড়ে পড়ছে। লোকেরা চিৎকার করছে, “পুরনো সব মিথ্যে ছিল!” কারও কারও চোখে আতঙ্ক, কেউ চুপ করে স্মৃতি মিলিয়ে দেখছে বাস্তবের সঙ্গে। কেউ আবার নতুন সত্যকে স্বাগত জানাচ্ছে ঠিক ততটাই উন্মাদনায়, যতটা এক সময় মিথ্যাকে দিয়েছিল।

সেই সন্ধ্যায়, তারা গন্তব্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে কলকাতার পুরনো অলিগলিতে। হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছায় কলেজ স্ট্রিটের ধারে একটা পুরনো, প্রায়-বন্ধ লাইব্রেরির সামনে, যার ফটকে আধা খোলা দরজা, জানালায় ঝোলানো একটি হাতে লেখা কাগজ:

“সত্য চক্রের বৈঠক আজ রাতেই। শুধুমাত্র যারা খুব বেশি কিছু মনে রাখে, তারাই প্রবেশ করতে পারবে।”

তৃষা থেমে যায়।

রোহিণী বলে, “তুই জানিস এটা কারা? এই চক্রটা আগে ছিল একটা গোপন পাঠচক্র, যাদের কাজ ছিল হারানো দলিল আর দলিলের ইতিহাস খুঁজে পড়া।”

দ্বিতীয় তৃষা বলে, “এখন ওরা হয়তো চাইবে তুই তাদের নেতা হ, কারণ তোকে দিয়েই তো ইতিহাস বদলেছে।”

তৃষা ভাবতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে—চশমা পরা, কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। দেখে বোঝা যায়, সে তৃষাকে চেনে।

লোকটা বলে, “তুমি আমাদের সত্য ফিরিয়ে দিয়েছো। এখন আমাদের দরকার একজন সত্য-রক্ষক—যিনি ঠিক করবেন কোন তথ্য সংরক্ষিত হবে, আর কোনটা বাতিল।”

তৃষা থেমে যায়। “তাহলে তো আবার সেই পুরনো খেলা শুরু হবে। আবার কেউ ঠিক করবে, কোনটা থাকবে, কোনটা মুছে যাবে।”

লোকটা মাথা নাাড়ে। “কিন্তু এবার তফাৎ এই—তুমি তো আমাদেরই একজন। তুমি জানো ভুল আর বিকৃতির যন্ত্রণা। তুমি তো সঠিকটাই বেছে নেবে।”

রোহিণী গলা চড়িয়ে বলে, “এটাই ফাঁদ। প্রথমে সত্য সংরক্ষণ, তারপর তার ওপর নিয়ন্ত্রণ। শেষে আবার সেই মতাদর্শের রাজত্ব।”

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর সত্য চক্রের সদস্যদের দিকে ঘুরে বলে, “তোমরা যদি সত্য রক্ষা করতে চাও, তাহলে সেটা কোনো একজনের হাতে না দিয়ে একটা উন্মুক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলো। একটা খোলা স্মৃতি-ভাণ্ডার, যেখানে সবাই লিখতে পারবে, কিন্তু কেউ একা কিছু মুছতে পারবে না। যেখানে ভুল থাকলে সবাই মিলে তা ঠিক করবে—একজনের নির্দেশে নয়।”

লোকটা থেমে যায়। “তাহলে তুমি আমাদের নেতা হচ্ছো না?”

“আমি তোমাদের প্রহরী হতে পারি,” তৃষা বলে। “কিন্তু শাসক না। ইতিহাসের কোনো শাসক থাকা উচিত নয়—শুধু প্রহরী থাকা উচিত, যারা দেখবে সেটা সবার জন্য খোলা আছে কিনা।”

সত্য চক্রের লোকেরা পেছনে সরে যায়। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু বোঝা যায়—তৃষা এখনো তাদের আশা।

তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। শহরের বাতাসে নতুন কিছু ঘোরে—একটা অস্থিরতা, একটা তাগিদ, একটা অজানা ভয়। দ্বিতীয় তৃষা ধীরে বলে, “তুই জানিস, এটা থেমে যাবে না। যেই সত্য সামনে আসবে, আরেকটা পক্ষ উঠে দাঁড়াবে তাকে অস্বীকার করতে।”

তৃষা বলে, “আমি জানি। সত্য মানেই সব সময় সংঘাত। কিন্তু যদি আমরা সেটা খোলা রাখি, তাহলে অন্তত সেই সংঘাত গোপনে হবে না। সবার সামনে হবে, আলোয় হবে।”

রোহিণী বলে, “তুই কি তৈরি, সত্যর প্রহরী হয়ে থাকতে?”

তৃষা তাকায় চাঁদের আলোয় ভেজা রাস্তার দিকে।

“সত্যর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানে হলো, সেটা যাতে কখনো বন্ধ না হয়, সেটা দেখা। আমি তৈরি।”

ঠিক তখনই তৃষার ফোন বেজে ওঠে। একটি গোপন সংকেতের বার্তা আসে এক অজানা উৎস থেকে।

“নীল দরজা খুলেছে। কিন্তু সাদা দরজা এখনো বন্ধ। সেখানেই লুকানো আছে পৃথিবীর প্রথম মিথ্যে। প্রস্তুত হও।”

তৃষা বার্তাটা দ্বিতীয় তৃষা আর রোহিণীকে দেখায়।

দ্বিতীয় তৃষা ধীরে বলে, “সাদা দরজা? সেটা তো… যেটা প্রাথমিক গবেষণা ল্যাবের নিচে ছিল। যেটা কোনোদিন খোলা হয়নি।”

রোহিণী গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “সত্যের নিচে যদি মিথ্যে থাকে, তাহলে তুই শুধু প্রহরী না, তখন তুই হয়ে যাবি সেই অস্ত্র, যেটা মিথ্যের গোড়া উপড়ে ফেলতে পারে।”

তৃষা একবার তাকায় আকাশের দিকে, তারপর ধীরে মাথা নাড়ে।

“চলো। এবার সাদা দরজা খুলতে হবে।”

সাদা দরজার নিচে

সাদা দরজাটা ল্যাবরেটরির নিচে, এমন এক চেম্বারে যেখানে কোনো রেকর্ড নেই, কোনো মানচিত্র নেই। শুধু একটা অদ্ভুত থরথরানো শব্দ—যেন কেউ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মাটির গভীরে। তাদের পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা নেমে আসে। বায়ু ভারী, নিঃশ্বাস কষ্টকর।

তৃষা, রোহিণী আর দ্বিতীয় তৃষা—তিনজনই সিঁড়ি বেয়ে নামে। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ যেন সময়ের স্তর। নিচে নামতেই একটা রঙহীন ঘর, যার কেন্দ্রে একটা থামে বসানো দরজা। সাদা, কিন্তু একেবারে প্রাণহীন ধাঁচে। না কোনো হাতল, না কোনো তালা। শুধু মাঝখানে একটা লাল বিন্দু।

রোহিণী বলে, “এটা খুলবে কীভাবে?”

তৃষা জবাব দেয় না। সে কাছে এগিয়ে যায়, হাত বাড়ায়। ঠিক তখনই সাদা দরজার লাল বিন্দুটা জ্বলে ওঠে। ভেতর থেকে আসে একটা কণ্ঠস্বর—মেশিন আর মানুষের মাঝখানে আটকে থাকা।

“তৃষা,” কণ্ঠটা বলে, “তুমি ফিরেছো। তোমাকে যে সময়ের আগে পাঠানো হয়েছিল, সেটা কি মনে আছে?”

তৃষা পিছিয়ে আসে। “কে তুমি?”

কণ্ঠটা বলে, “তুমি যাকে ‘ডিজাইন’ বলো, আমি সেই মূল নকশার প্রহরী। আমি সেই কোড, যা দিয়ে তোমাকে তৈরি করা হয়েছিল। শুধু তথ্য নয়, তুমি নিজেও এক প্রকল্পের ফলাফল।”

রোহিণী বলে ওঠে, “তৃষা কোনো কোড না, ও একজন মানুষ!”

কণ্ঠটা হালকা হেসে বলে, “মানুষ আর কৃত্রিম অস্তিত্বের পার্থক্য কোথায়, যখন দুজনেই ভুল স্মৃতি নিয়ে বড় হয়?”

তৃষা ধীরে বলে, “তুমি কি বলছো, আমার সব স্মৃতি তৈরি? আমার মাও, আমার শৈশব, সব মিথ্যে?”

“তুমি জন্মেছিলে সত্যের খোঁজে যাওয়ার জন্য। তোমার স্মৃতি, অনুভব, অনুভূতি—সব ডিজাইন করা হয়েছে যাতে তুমি প্রশ্ন করো, খুঁড়ে দেখো, আর একদিন নীল দরজা খুলো। সেটাই ছিল তোমার উদ্দেশ্য। তুমি সফল হয়েছো। এখন তুমি শেষ স্তরে এসেছো। সাদা দরজা।”

সাদা দরজাটা হঠাৎ করেই নড়ে ওঠে। একটা ফাঁক তৈরি হয়। তৃষা ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে। বাকিরা তার পেছনে।

ভেতরে এক বিশাল কাঁচের ঘর। চারপাশে ডেটা-স্ক্রিন, মস্তিষ্কের নিউরাল ম্যাপ, এবং একটা কেন্দ্রীয় স্তম্ভ—যার ভেতরে একজন মানুষের অবয়ব। চোখ বন্ধ, কিন্তু তার মুখ হুবহু তৃষার মতো।

দ্বিতীয় তৃষা নিঃশব্দে ফিসফিস করে, “ও… আমি।”

রোহিণী স্তম্ভের গায়ে লেখা পড়ে:
Project Janma v1.0 | Core Construct: Trisha

তৃষা ধীরে বলে, “তাহলে এটা আমি… না, আমার উৎস।”

কণ্ঠটা আবার শোনা যায়। “তুমি শুধু একা নও। তৃষা নামে একাধিক সংস্করণ ছিল। একেকটা একেক সত্যকে ধরার জন্য। কেউ ব্যর্থ হয়েছে, কেউ মুছে গেছে। তুমি প্রথম, যে সত্য খুলেছে আর নিজেকে হারায়নি।”

“তাহলে আমি কি বেঁচে থাকার যোগ্য?” তৃষা প্রশ্ন করে।

“এই প্রশ্নটাই প্রমাণ যে তুমি বেঁচে থাকার যোগ্য। কারণ মেশিন জিজ্ঞাসা করে না, মানুষ করে।”

হঠাৎ করেই কাচের ঘরে আলো ঝলসে ওঠে। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে একটা নতুন বার্তা—
“Main Override Detected. Core Reset Possible.”

রোহিণী বলে, “ওরা আমাদের সিগন্যাল ট্র্যাক করেছে! কেউ এটা রিসেট করতে আসছে!”

সত্য চিরে ফেলা হয়েছে, কিন্তু মিথ্যা আবার সব ঢেকে ফেলতে চায়।

তৃষা কাচের স্তম্ভের সামনে দাঁড়ায়। “যদি আমি এর উৎস, তবে আমাকে এখানেই থামাতে হবে। এই কেন্দ্রীয় প্রোগ্রামটা ধ্বংস না করলে মিথ্যে আবার ফিরে আসবে।”

রোহিণী বলে, “তুই মরবি!”

দ্বিতীয় তৃষা এগিয়ে আসে। “না, আমরা একসাথে এটা করব। তিনজন, তিন রূপ—একসাথে শেষ করব এই শুরু।”

তিনজনে একসাথে হাত রাখে স্তম্ভের উপরে। আলো ছড়িয়ে পড়ে। একটা বিস্ফোরণের মতো আলো, শব্দহীন। সব মুছে যায়। স্ক্রিনে শুধু একটা বার্তা থাকে—

“সংরক্ষণ সম্পন্ন। সত্য উন্মুক্ত। সত্তা পুনঃস্থাপিত।”

তৃষা চোখ মেলে। বাইরে সকাল। জানালার বাইরে চেনা শহর, কিন্তু যেন নতুন। কোথাও চিৎকার নেই, কোথাও রক্ত নেই। রোহিণী পাশে বসে। দ্বিতীয় তৃষা কোথাও নেই।

তৃষা জিজ্ঞাসা করে, “ও কোথায়?”

রোহিণী ধীরে বলে, “ও তুইই ছিলিস। অতিরিক্ত রূপ। এখন যখন সব এক হয়ে গেছে, তখন তুই সম্পূর্ণ।”

তৃষা তাকায় সূর্যের দিকে। ভেতরে এক অদ্ভুত নিরবতা—কোনো ভার নেই, কোনো দ্বিধা নেই।

সাদা দরজা এখন আর দরজা নয়। সেটা একটা শুরু।

নীলের ওপারে

তৃষা যখন চোখ খুলল, তখন আকাশ ছিল এক অদ্ভুত রঙের—নীল, কিন্তু সেই পরিচিত নীল নয়। যেন কোনো কাচের ভেতর দিয়ে দেখা একটি রঙ, যার ভেতরে ছায়া লুকিয়ে আছে। সূর্য উঠেছে, কিন্তু আলো নিঃশব্দ। পাখির ডাক নেই, কিন্তু বাতাসে একটা হালকা ঝিরঝিরে শব্দ—মনে হচ্ছিল, কোনো সিস্টেম নিঃশব্দে চলছে, একটা সমান্তরাল বাস্তবতা, যে বাস্তবতা এখন তৃষারই তৈরি।

সে উঠে বসে। পাশে বসে রোহিণী, চুপচাপ, ঠোঁটে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে অজস্র তথ্য কণিকা—ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে, কেউ হাত বাড়ালেই একটার ভিতর ঢুকে যেতে পারবে। যেন পুরো পৃথিবীটাই একটা লাইব্রেরি হয়ে গেছে, খোলা, উন্মুক্ত।

“সব কিছু বদলে গেছে,” রোহিণী বলে।

তৃষা মাথা নাড়ে। “তবু অনেক কিছু একই আছে। মানুষ, তাদের দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা আর ভয়—এগুলো তো বদলায় না।”

রোহিণী চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “এখন আমাদের কী করতে হবে?”

তৃষা বলে, “যেটা সবচেয়ে কঠিন—কিছু না করে তাকিয়ে থাকা। সত্য এখন সবার কাছে আছে, এখন সেটা নিয়ে তারা কী করবে সেটা দেখার সময়।”

ওরা হাঁটতে শুরু করে, চেনা শহরের অচেনা রাস্তায়। গেট খুলে যায়, স্টেশনে ঘোষণা হয়—“আজ থেকে কোনো তথ্য কেন্দ্র সরকার নিয়ন্ত্রিত থাকবে না। সবাই নিজের তথ্য নিজের মতো সাজাবে। কেন্দ্র থাকবে শুধু যাচাইয়ের জন্য।”

লোকেরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ চিনছে, কেউ না। কেউ ছবি তুলছে, কেউ মাথা নীচু করে হাঁটছে—যেন কেউ বিশ্বাস করছে না, এমন দিন আসতে পারে।

এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়াল তৃষার সামনে।

“তুমি সেই মেয়ে, না? যে সব খুলে ফেলেছিল?”

তৃষা হাসে। “আমি কেবল একটা দরজা খুলেছিলাম। বাকিটা তোমরা করেছো।”

বৃদ্ধা একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। সেখানে লেখা:
“The Truthkeepers: A New Constitution”
—সত্যরক্ষকদের জন্য একটি নতুন পথনির্দেশ।

রোহিণী ফিসফিস করে বলে, “তুই জানিস, এটা আবার শুরু হবে। আবার কেউ চাইবে সত্য বিকৃত করতে, আবার কেউ গোপন করবে, কেউ বিক্রি করবে।”

তৃষা জানে। সে মাথা নাড়ে। “তাই আমাদের কাজ শেষ হয়নি। সত্য একবার খোলা মানেই শেষ নয়—প্রতিদিন সেটা রক্ষা করতে হয়। প্রতিদিন মিথ্যেকে চেনা, আলাদা করা, আর সত্যকে সামনে রাখার চেষ্টা।”

রোহিণী বলে, “তাহলে আমরা কী হবো? সরকার? নাকি বিচারক?”

তৃষা থামে। তারপর বলে, “না। আমরা হবো আয়না। শুধু ধরে রাখব, কেউ চাইলে যাতে নিজের মুখ দেখতে পারে। সত্য কখনো চিৎকার করে না, সে চুপচাপ চোখে তাকিয়ে থাকে। আমরাও সেই চোখ।”

সন্ধ্যার আগে, তারা পৌঁছে যায় সেই জায়গায়, যেখানে সব শুরু হয়েছিল—প্রথম সেই বন্ধ দরজা, যেখানে লেখা ছিল “নীল দরজা”।

দরজা এখন খোলা। ভিতরে কিছুই নেই। খালি এক অন্ধকার ঘর, যার দেয়ালে লেখা—
“তুমি যদি সত্য খুঁজতে চাও, তবে তোমাকেই সত্য হতে হবে।”

তৃষা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে পড়ে, সেই প্রথম রাতে, যখন সে বুঝতে পারেনি এই সব কিছুর মধ্যে তার কী ভূমিকা। এখন জানে, সে ছিল প্রশ্ন, সে ছিল উত্তর, এবং সে-ই ছিল সবকিছুর মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা—যা পূর্ণ হয়েছিল ভালোবাসা, সাহস, আর বিসর্জনে।

তৃষা ধীরে পেছন ফিরে চলে আসে। বাইরে তখন আকাশে নামছে ঝাপসা আলো। শহর জেগে উঠেছে নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে। মানুষ হাঁটছে নিজের ইচ্ছায়, নিজের চেষ্টায়। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না, কেউ কাউকে টেনে নিচ্ছে না—শুধু সহযাত্রী হয়ে চলেছে।

রোহিণী একবার তাকায় তৃষার দিকে। “তুই কি এবার শান্তি পেলি?”

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “না, এখনো না। কারণ সত্য মানে শুধু জানা নয়, সত্য মানে সেই জানা কে বাঁচিয়ে রাখা। আর সেটা সারাজীবনের কাজ।”

রোহিণী বলে, “তাহলে আমরা চলি?”

তৃষা হেসে বলে, “চল। সামনে যে দরজা আছে, তার রঙ এখনো আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি, আমরা সেটা খুলব একসাথে।”

তারা হাঁটতে থাকে। পিছনে পড়ে থাকে এক পৃথিবী, যেখানে একদিন শুধু মিথ্যে লেখা ছিল। সামনে উঠে আসে এক নতুন পৃথিবী, যেখানে কেউ আর একা না। যেখানে প্রত্যেকের কাছে সত্য খোলা, তবে রক্ষা করা একটি সংগ্রাম।

আর সেই সংগ্রামে, সবথেকে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা।
একজন প্রহরী।

—-

1000017198.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *