সুকান্ত ঘোষ
১
সমুদ্র তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। কেউ বোঝে না ঠিক কী বলছে, কিন্তু তার ঢেউয়ের ছন্দে, গর্জনের ধ্বনিতে, নোনাজলের গন্ধে একটা পুরনো চেনা আবেশ থাকে। নয়না সেই ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে না পারলেও অনুভব করে। এই কারণেই সে এখানে এসেছে—নীলতারা কটেজ। দীঘা থেকে একটু দূরে, জনমানবহীন এক নির্জন সৈকতের পাশে ছোট্ট কাঠের কটেজ, যেন সময়ের বাইরে পড়ে থাকা এক টুকরো ফ্রেম। শহরের হাহাকার থেকে মুক্তি পেতে নয়নার বুকের মধ্যে অনেকদিন ধরেই একটা হাহাকার জমে উঠেছিল। মাথার ভেতর অবিরত শব্দ—কাজের ডেডলাইন, ফোনের রিং, ফ্ল্যাটমেটদের কলরব। মনে হচ্ছিল, নিজের ভেতরের জায়গাটায় ফিরে যেতে হলে সমুদ্রই একমাত্র উত্তর।
ট্যাক্সি থেকে নেমেই যেন আরেক জগতে পা রাখল নয়না। ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বালুচর আর তার ওপরে অনন্ত জলরাশি। কটেজের মালিক, বৃদ্ধা সুরমা দত্ত, কাঁচাপাকা চুলে তাঁতের শাড়ি পরে এসে দরজা খুললেন। চোখে যেন কোনো রহস্যের ছায়া। হাসিমুখে বললেন,
“তোমার মতো মেয়েরা এখানে কম আসে। সাধারণত কাপল আসে, বা একা কেউ এলে সন্ধের আগেই পালিয়ে যায়।”
নয়না হেসে বলল, “ভয় পাবার কিছু নেই। আমি শুধু একটু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছি।”
সুরমা এক ঝলক নয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাত্রিগুলো এখানে… একটু আলাদা। সমুদ্র কখনো কখনো ডাক দেয়, বুঝলে?”
নয়না কাঁধ ঝাঁকাল। শহুরে বাস্তববাদী সে। ভূত-প্রেতের গল্পে বিশ্বাস নেই। তার চোখে যা নেই, তা নেই। কটেজের ভেতরটা যেন পুরনো দিনের গানের মতো। কাঠের মেঝে, কাঠের জানালা, সাদা পর্দা, আর একপাশে বিশাল কাঁচের জানালা যেখান দিয়ে পুরো সমুদ্র দেখা যায়। বিছানায় ফিনফিনে সাদা চাদর, ছোট্ট রান্নাঘর, আর একটা বেতের চেয়ার, যেন বসে বই পড়া বা চুপচাপ সময় কাটানোর জন্যই বানানো। প্রথম দিনটা কেটেছিল আলস্যে। নয়না বই পড়েছিল, সমুদ্রতটে একা ঘুরে বেড়িয়েছিল, সাদা বালুতে পায়ের ছাপ রেখে হেঁটেছিল অনেকটা দূর। তখনও সন্ধে নামেনি। তবে মন খুঁতখুঁত করছিল, কেন জানি না। যেন কিছু একটা অপেক্ষায় আছে।
রাত নামল হঠাৎ। সেই রাতে চাঁদ ছিল না। কিন্তু আকাশজুড়ে নীলচে আলো যেন কোথা থেকে ছড়িয়ে পড়ল। নয়না জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে না কেন, কিন্তু বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি লাগছিল। গায়ের ওপর চাদর চাপিয়েও ঠান্ডা থামছিল না। তবু সে ঘুমিয়ে পড়ল।
আর সেই ঘুমেই প্রথমবার দেখা দিল সে—অচেনা যুবক। স্বপ্নটা খুব স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু কিছুটা মনে আছে। যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের মধ্যে, কোমর জলে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, আর মুখটা আবছা। কেবল একটাই শব্দ ভেসে এলো… “নয়না…”
একটা নিমগ্ন ডাক। না চেঁচিয়ে, না গর্জে—শুধু একটা অনুরোধ, যেন বহুদিন আগের। নয়নার ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে বসল। বুক ধড়ফড় করছে। কটেজের ভেতর নিঃশব্দ। শুধু দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন আসছে। সে জানালার দিকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু সে নিশ্চিত—ডাকে ওর নামই বলা হয়েছিল। পরদিন সকালে নয়না তটভূমির দিকে হাঁটল। সাদা বালুতে জুতো খুলে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল—এটা কি নিছক স্বপ্ন? কিন্তু সেই স্বপ্নের ডাকটা… কেন এত পরিচিত লাগছিল?
কিছুদূর হাঁটার পর একটা পাথরের ওপর বসে সে সমুদ্র দেখছিল। হঠাৎ মনে হলো—এই জায়গাটা সে আগে দেখেছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। এর আগে এই জায়গায় কখনো আসেনি তো!
মনটা কেমন হালকা ঘোরে ভরে গেল। হয়তো এটা ক্লান্তি, কিংবা অবচেতনে কোনো পুরনো স্মৃতি, বই বা সিনেমার। কিন্তু তাও—মনে হচ্ছিল, এই সমুদ্র, এই বাতাস… এসব ওর অনেক আগে থেকেই চেনা। সেদিন বিকেলে নয়না একটা নীল রঙের খাতা বের করল। ওর ডায়েরি।
সেই খাতায় সে লিখল:
“স্বপ্নে দেখা মানুষটাকে আমি কোথাও চিনি। তার ডাকটা… যেন অতীত থেকে কেউ ফিরে এসে বলছে—‘ফিরে এসো’। কিন্তু আমি কোথায় ফিরব? আমি তো জানিই না কোথায় ছিলাম আগে।”
রাত নামল আরও নিঃসঙ্গভাবে।
দ্বিতীয় রাতে আবার সেই নীল আলো। আবার সমুদ্র গর্জে উঠল একটু বেশি। নয়না বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই যেন বাতাস কানে কানে কিছু বলল। এইবার সে যুবকটা আরও কাছে এল। এবার মুখটা খানিকটা স্পষ্ট—ধূসর চোখ, ভেজা মুখ, আর ঠোঁটে একরাশ শোক।
সে বলল—
“তুমি কথা দিয়েছিলে… তুমি ফিরে আসবে… ভুলে গেলে?”
নয়না স্বপ্নে কাঁদছিল। সে জবাব দিতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না। জেগে উঠেই সে জানালার পাশে ছুটে গেল। বাইরে কেউ নেই। তবে একটা জিনিস দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। জানালার পাশে রাখা টেবিলের ওপর একটা খাম। খামটা খুলে দেখল, ভেতরে একটা সাদা কাগজ, আর তাতে কালি ছড়িয়ে লেখা: “তুমি এখনো আমায় মনে রাখো?”
নয়নার হাত ঠান্ডা হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে খামটা নামিয়ে রাখল। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে নিঃশব্দে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। কেন এই জিনিসটা এখানে এল? কে রেখে গেল? রাতভর দরজা বন্ধ ছিল, কেউ আসেনি। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হলো—সে ভাবছে না খামটা কিভাবে এল। তার মন জোর করেই বিশ্বাস করতে চাইছে… হয়তো কেউ আসেনি। হয়তো সে নিজেই কোনো কিছু মনে করতে পারছে না।
নয়না জানে না, এই কটেজে তার সফর কেবল শুরু। আর সেই যুবক—সে কি কেবল এক স্বপ্ন? নাকি কোনো পুরনো জীবনের প্রেত, অপেক্ষায় থাকা ভালোবাসা? এই রাতের পর নয়নার দিনগুলো আর আগের মতো থাকবে না। এই কটেজ, এই সমুদ্র, আর সেই নীল চোখ—সব মিলে গড়ে তুলবে এক এমন গল্প, যার শেষ সে এখনো জানে না।
২
নয়নার ঘুম ভেঙেছিল ভোরের দিকে, কিন্তু সে বিছানা ছাড়েনি। চোখ মেলেই সে খেয়াল করল, তার বুকের ওপর যেন এক অদৃশ্য ভার চেপে আছে। গলা শুকনো, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন গভীর সমুদ্রের নিচে সে, যেখানে আলো পৌঁছায় না—শুধু ঠান্ডা আর নীরবতা।
হঠাৎ ঘরের এক কোণ থেকে একটা শব্দ এলো। যেন বাতাসে খসখস শব্দ। নয়না হকচকিয়ে উঠল। জানালার পর্দাটা সামান্য দুলছে। ভোরের হালকা আলোয় সেই দুলুনিটা যেন একটা মানুষের উপস্থিতির মতোই মনে হচ্ছিল।
সে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠল, জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালার বাইরে… সেই সমুদ্র, অসীম, ঘুমন্ত।
কিন্তু… সমুদ্রের কিনারায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। না, স্পষ্ট নয়, কিন্তু ছায়ামূর্তির মতো একটা অবয়ব। না নড়ছে, না কিছু করছে—শুধু দাঁড়িয়ে।
নয়না চোখ কুঁচকে তাকাল। পলক ফেলতে না ফেলতেই অবয়বটা মিলিয়ে গেল। তার গা দিয়ে হিম স্রোতের মতো কিছু নেমে গেল।
“এটা কি স্বপ্নের রেশ? না কি সত্যিই কিছু দেখেছি?” — নিজের মনেই ফিসফিস করল নয়না। খামটা এখনও টেবিলের কোণায় পড়ে ছিল—ভেজা, কালির দাগ ম্লান হয়ে এসেছে, কিন্তু প্রশ্নটা স্পষ্টই ছিল: “তুমি এখনো আমায় মনে রাখো?”
সকালটা খুব নিঃশব্দে কেটেছিল। নয়না কটেজ থেকে বেরোল না। শুধু খোলা জানালার পাশে বসে রইল, যেন কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায়। এমনকি তার প্রিয় বইয়ের পাতাগুলোও আজ মনোযোগ টানল না। বারবার তার চোখ চলে গেল সমুদ্রতটের দিকে, বারবার সেই অদ্ভুত ছায়ার স্মৃতি ফিরে আসছিল।
দুপুরের দিকে, সুরমা দত্ত দরজায় নক করলেন। নয়না দরজা খুলতেই এক গন্ধের ধাক্কা এসে লাগল—হলুদের গন্ধ, বীট লাউয়ের ঘ্রাণ, আর ঘি-ভাজা মুগ ডালের।
“দুপুরের খাওয়াটা আপনিই রান্না করেছি,” সুরমা বললেন। “এমন জায়গায় একা থাকলে শরীর ঠিক রাখতে হয়।”
নয়না খুশিমনে খাবার গ্রহণ করল, কিন্তু চুপচাপ।
খেতে খেতে সে একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “এই কটেজে কি কেউ… মানে, আগে কেউ এমন কিছু দেখেছে?”
সুরমা থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“সমুদ্র অনেক কিছু ফিরিয়ে আনে। কিছু ডাক, কিছু প্রতিজ্ঞা, কিছু মানুষ, যাদের শরীর থাকে না, কিন্তু অস্তিত্ব থাকে। অনেক সময় আমরা ওদের চোখে চোখ রাখি—অথচ বুঝি না, ওরা এখানেই আছে।”
নয়নার হাত থেমে গেল। সে ফিসফিস করে বলল,
“নীল চোখ… আপনি কি কখনো দেখেছেন?”
সুরমা কিছু বললেন না। শুধু হাসলেন—একটা দুঃখমাখা, বোঝা-মেলানো হাসি।
সেদিন প্রথমবার নয়না সৈকতের আরও গভীরে গিয়েছিল—যেখানে ঝাউগাছের ঝাঁক, আর একটা পুরনো ভাঙা ঘাটের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। জায়গাটা একদম শুনশান। পাখির ডাক নেই, কুকুরের ছায়াও না, কেবল সমুদ্র আর বাতাসের শব্দ।
নয়না একটা পাথরের ওপর বসল। বাতাস তার চুলে খেলছিল, আর তার কানে আবার একটা কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এলো।
কিন্তু এবার গলার আওয়াজ স্বপ্নের মতো ফিসফিস নয়—এই বাস্তবেরই আওয়াজ।
“তুমি এসেছো… অবশেষে।”
নয়না চমকে উঠে দাঁড়াল। আশপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ নেই। কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সে একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন। যেন কেউ তাকে স্পর্শ না করেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। বুকের মাঝে একটা জ্বালা, একটা দহন।
আর ঠিক তখনই… সে দেখল চোখ দুটো।
ঝাউগাছের আড়ালে, আধা ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে এক যুবক। পুরো মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে—গাঢ় নীল। ঠিক স্বপ্নের মতো।
তাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র কুড়ি-তিরিশ হাত। কিন্তু নয়নার পা যেন জমে গেছে। সে না এগোতে পারছে, না পেছাতে।
ছেলেটা কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল। সেই চোখে একটা গভীর দুঃখ, একটা বিস্মৃতি, আর একরাশ অপেক্ষা।
“তুমি… কে?” — নয়নার গলা কাঁপছিল।
ছেলেটা ধীরে মাথা ঝাঁকাল। তারপর ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে পেছাতে শুরু করল। যেন সে চাইছে নয়না তার পেছন পেছন যাক।
নয়না এক পা এগোলো। আবার। এবার প্রায় দৌড় দিয়ে ছুটল, গাছের ভেতরে ঢুকে গেল—
কিন্তু… কেউ নেই।
চারপাশ নিঃস্তব্ধ। পায়ের নিচে পাতা, কাঁটা। ছায়া ঘন হয়ে আসছে। আর কোথাও সেই নীল চোখের ছায়াটুকুও নেই।
সে হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে ফিরে তাকাল। সমুদ্র দূরে। সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে।
কিন্তু তার চোখে জল। কেন? সে জানে না।
সেই রাতে নয়না আবার ডায়েরি খুলল। লিখল-
“আজ আমি তাকে দেখেছি। হ্যাঁ, স্বপ্নে নয়—বাস্তবে। সেই চোখ, সেই দৃষ্টি, সেই ডাক—সবটাই ছিল। কিন্তু সে চলে গেল, তার পেছনে আমি ছুটলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না।
আমার ভেতরে যেন কিছু একটা জেগে উঠছে—একটা পুরনো স্মৃতি, একটা ভালোবাসা… যার জন্ম আমি জানি না, কিন্তু মৃত্যু এখনও হয়নি। আমি কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি? না কি আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি?”
ঘুমোনোর আগে নয়না জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। আজ সে ভয় পায় না। আজ সে চায়—সেই চোখ আবার ফিরে আসুক।কিন্তু এবার ঘরের দরজায় শব্দ হলো, টোকা নয়—আলতো চাপা। নয়না ধীরে পায়ের শব্দ না করে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। একটু ইতস্তত করে হ্যান্ডেল ছুঁল। খুলে ফেলল দরজা।সামনে কেউ নেই। শুধু মাটির ওপর পড়ে আছে একটা পাথর। আর তার পাশে একটা ছোট কাঁচের সিসি—ভেতরে নীলচে জল।
আর কাগজের একটা খুদে টুকরো:
“আজ রাতে তুমি প্রস্তুত হবে। স্মৃতি আর বাস্তবের ফারাক মুছে যাবে। আমার নাম… তুমি জানো।”
৩
সেই রাতে নয়না ঘুমায়নি।
তার চোখে ঘুম আসার কোনো চিহ্ন ছিল না—শুধু একরাশ অস্থিরতা, দুঃস্বপ্ন আর রহস্যের ধোঁয়াশা।
কাঁচের সিসির নীলচে জলটা সে এখনও খুলে দেখেনি। ঘরের কোণে আলো জ্বলছে, কিন্তু তাতে কোনো উষ্ণতা নেই—শুধু ছায়া গাঢ় হচ্ছে।
“আজ রাতে তুমি প্রস্তুত হবে…”
চিঠির সেই বাক্যটা তার মনে গেঁথে গেছে।
নয়না জানে না সে কীসের জন্য প্রস্তুত—কিন্তু তার শরীর, তার স্নায়ু, তার নিঃশ্বাস যেন জানে কিছু আসতে চলেছে। তীব্র ঘুম না হলেও নয়না ভোরে উঠে পড়ে। আজ সে ঠিক করেছিল—এই জায়গা, এই সমুদ্র, আর এই কটেজ সম্পর্কে যতটা সম্ভব সে জানবে।
সুরমা দত্ত তখনও রান্নাঘরে। নয়না নিচে নেমে প্রথমবার গেস্টবুকটা দেখতে চাইলো। পুরনো কাঠের আলমারির একটা তাকে রাখা ছিল—ধুলোমাখা, পাতাগুলো হলুদ, কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। বইটা খুলতেই নয়নার চোখে পড়ল কিছু অচেনা নাম।
তবে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক পাতায়: “আরিত্র বসু – ২৯শে জানুয়ারি, ২০০৩”
“এই সমুদ্রের কাছে ফিরে এসেছি। আশায়, হয়তো তুমি আবার ডাকবে আমায়। আমি আজও অপেক্ষায়…”
নয়নার শ্বাস কেঁপে উঠল।
আরিত্র?
এই নামটা তার কোথায় যেন শুনেছে।
সে এক পলকে সিসির দিকে তাকালো। সেই নীল জল যেন হঠাৎ আরও গভীর রঙের হয়ে উঠল।
আজ নয়না আবার সৈকতের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু আজ সে সেই ঘাট বা ঝাউবন নয়, বরং পেছনের দিককার পাহাড়ি ঢালের কাছে যায়—যেখানে একটা পুরনো, পোড়াবাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
সেদিন গাড়ি করে আসার সময় পথচিহ্নে একটা সাইনবোর্ড দেখেছিল: “ব্রিজ হাউস – ১৯১২”।
এই ভাঙা বাড়িটার চারপাশে এখন কেবল আগাছা, কাঁটা, আর কুয়াশার স্তর।
নয়না ধীরে ধীরে ভেতরে পা রাখে। ঘরের এক কোণে একটা পুরনো আয়না হেলে পড়া। ধুলোয় ঢাকা হলেও তার ওপর একটা স্পষ্ট হাতের ছাপ রয়েছে—একেবারে সদ্যকার।
নয়নার গা ছমছম করে ওঠে।
সে এগিয়ে যায়—আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তার মুখ ভেসে ওঠে, কিন্তু সে দেখতে পায়… পাশে আরও এক মুখ।
অচেনা নয়, বরং খুব চেনা। সেই নীল চোখ, সেই করুণ মুখ। সে এবার ঠিক দেখেছে।
আর এইবার যুবকটি তাকে সরাসরি বলল: “তুমি ফিরে এসেছো, নয়না।”
নয়নার গলা শুকিয়ে এল।
“তুমি কে? আমি তোমাকে কোথায় দেখেছি?”
ছেলেটি হালকা হাসে। তার চোখে জল চিকচিক করে।
“তুমি ভুলে গেছো। ঠিক যেমনটা বলেছিলে, ‘আগামী জন্মে যদি দেখা হয়, চিনতে পারবে তো?’”
হঠাৎ, নয়নার মাথার ভেতর এক ঝলক চিত্র ফুটে উঠল—
একটা ছোট্ট কাঠের ঘর, দেয়ালে খয়েরি-লাল কাপড়ের পর্দা, আর একটা রেডিওতে চলছে পুরনো বাংলা গান।
একটা মেয়ে বই পড়ে—আলতা-পরা পায়ে, কাঁচের চুড়ি হাতে।
আর একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে—সাদা পাঞ্জাবি পরা, হাতে স্কেচপ্যাড।
“তোমার চোখ আঁকি… কিন্তু ঠিক রঙটা ধরতে পারি না,” ছেলেটা বলছে।
মেয়েটা হেসে বলছে, “কারণ আমি বাস্তব নই। আমি তোমার কল্পনার মেয়ে।”
তারপর… একটা কুয়াশার দৃষ্টি… আর এক ধ্বনি: সমুদ্রের গর্জন। নয়না হঠাৎ চমকে ফিরে এলো। সে ভেতরে হাঁপাচ্ছে, তার হৃদস্পন্দন ধাবমান।
“এই সব… কল্পনা? না কি স্মৃতি?”
“এই কটেজে আমরা একসঙ্গে এসেছিলাম। তখন সময়টা ছিল অন্য। তোমার নাম তখন ছিল না ‘নয়না’, আর আমারও এই শরীর ছিল না। কিন্তু ভালোবাসা ছিল। সে সময় এক দুর্ঘটনায় আমি…”
তার গলা কেঁপে গেল।
“…ফিরে যেতে পারিনি।”
নয়না কেঁপে উঠল।
“তুমি… মৃত?”
আরিত্র মাথা নিচু করল, “আমি অস্তিত্ব হারিয়েছি, কিন্তু ভালোবাসা হারায়নি।
তুমি চলে গিয়েছিলে, প্রতিজ্ঞা করেছিলে একদিন ফিরবে। আজ তুমি ফিরেছো। কিন্তু সময় আমাদের আলাদা রেখেছে।”
নয়নার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
“আমরা কি নতুন করে শুরু করতে পারি না?”
আরিত্র ধীরে ধীরে বলল— “আমরা পারি… যদি তুমি সমস্ত কিছু স্মরণ করতে চাও। যদি তুমি সত্যি বিশ্বাস করো… আমি ছিলাম, আছি, এবং থাকব।”
তারপর সে নয়নার হাতে সেই কাঁচের সিসিটা ধরিয়ে দিল। “এটাই তোমার যাত্রা। এটি পান করো—এটা স্মৃতির জল। সত্য-মিথ্যার মাঝখানে থাকা দরজাটা খুলবে। তারপর তুমি নিজেই জানতে পারবে, কে তুমি, কে আমি, আর আমাদের গল্প কোথা থেকে শুরু হয়েছিল।”
নয়না আবার কটেজে ফিরে এলো। চোখে রাত্রির আলো। শরীরে ক্লান্তি, কিন্তু মনে তীব্র আলোড়ন। সে ধীরে ধীরে সিসির ঢাকনাটা খুলল। গন্ধটা অদ্ভুত—ফুলের মতো, আবার সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধের মতো। সে এক চুমুক নিল।
আর… চারপাশ ঘুরতে লাগল। ঘর, জানালা, বাতাস—সব এক লহমায় মিলিয়ে গেল। সে যেন এক অজানা সময়ের গহ্বরে ডুবে যেতে লাগল। চারপাশে হালকা আলো। পেছনে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। আর এক কণ্ঠস্বর তার কানে বাজছে—তার নিজের।
“আরিত্র, যদি আমি তোমায় ভুলে যাই, আগামী জন্মে তুমি আমায় খুঁজে পাবে তো?”
আর এক কণ্ঠস্বর—আরিত্রর, হাসিমুখে বলছে, “আমি জন্ম জন্মান্তর ধরে শুধু তোমাকেই খুঁজে এসেছি, নয়না। এবার তুমি আমাকে খুঁজে পেও।”
চোখ খুললে নয়না বুঝল—সে কেবল স্বপ্ন দেখেনি।
সে ফিরেছে। অতীতে। স্মৃতিতে। ভালোবাসায়।
৪
নয়নার মাথা তখনও ঘোরাচ্ছে। কাঁচের সিসির সেই তরলটা পান করার পর তার শরীর যেন এক অদ্ভুত ভারে ডুবে গেছে—কিন্তু মন যেন হঠাৎ মুক্ত হয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে।
সে জানে না কতক্ষণ সময় কেটে গেছে।
যখন সে চোখ মেলে দেখে, চারপাশটা আর সেই আধুনিক কটেজ নয়—
বরং এক পুরনো বাড়ি, লালরঙা টালির ছাদ, বাঁধানো উঠোন, পাশ দিয়ে একটা সরু নদী বয়ে চলেছে।
নয়না নিজেকে দেখে। সে এখন সালোয়ার-কামিজ পরা এক কিশোরী। নাম তার “মেহুল”।
সন: ১৯৪৯, দক্ষিণবঙ্গ।
এই গ্রামে মেহুলের পরিবার সদ্য এসেছেন। বাবা পোস্টমাস্টার, মা পড়াশোনা জানা ভদ্রমহিলা।
মেহুল সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে, বাংলা সাহিত্য নিয়ে।
এই নতুন বাড়ির পেছনে ছিল এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি।
সেখানে এক যুবক থাকতো—চুপচাপ, একা। নাম ছিল আরিত্র। সে ছবি আঁকত। দিনের পর দিন ঝাউবনে বসে, সে সমুদ্রের ঢেউ আঁকত, আকাশের রং আঁকত। কখনো কখনো কেউ বলত,
“ও পাগল হয়ে গেছে। একটা অদ্ভুত আগুনে ওর মন পুড়ে গেছে।”
কিন্তু মেহুল প্রথমবার যেদিন আরিত্রকে দেখল, তার মনে হলো— এই মানুষটার চোখে সমুদ্রের চেয়েও গভীর কিছু আছে।
প্রথম কথাবার্তা হয়েছিল একটি বইয়ের সূত্রে। মেহুল লাইব্রেরি থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ এনেছিল, আর বইটা ঝড়ের রাতে তার জানালা দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়েছিল পাশের বাঁশবাগানে। আরিত্র সে বইটা কুড়িয়ে এনে দিয়েছিল।
“তোমার চোখ যে এই বইয়ের মতো,” সে বলেছিল।
“বুঝতে পারা যায় না—শেষে প্রেম আছে, না প্রতারণা।”
মেহুল হেসে বলেছিল, “তোমার রংতুলিতেও বোধহয় এমন দ্বিধা রয়েছে।”
তারপর শুরু হয় বন্ধুত্ব। তারপর সেই বন্ধুত্ব জমে ওঠে এক নিঃশব্দ প্রেমে। আরিত্র প্রতিদিন মেহুলের জন্য নতুন একটা স্কেচ আঁকত—কখনো চুলের রেখা, কখনো কপালের টিপ, কখনো চোখের জল।
কিন্তু প্রেমের ইতিহাসে সব সময় বাধা থাকে। মেহুলের বাবা একদিন এই সম্পর্ক টের পেয়ে যান।
আর তিনি স্পষ্ট বলে দেন—
“তুমি চিত্রকরদের খেয়ালখুশির জগতে ডুবে যাচ্ছো। এরা সংসার করতে পারে না। ভুলে যাও ওকে।”
মেহুল প্রতিবাদ করে না, কিন্তু চুপচাপ একদিন রাত্রে সেই জমিদারবাড়িতে গিয়ে বলে—
“আরিত্র, আমরা হয়তো এবার আলাদা হবো। কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করি—যদি কখনো আবার জন্ম হয়, আমি তোমায় খুঁজে পাবো। আর তুমি আমায় চিনে নিও।”
আরিত্রের গলা কেঁপে উঠেছিল।
“আমি অপেক্ষা করব। যত জন্মই লাগুক, আমি তোমার জন্য রঙ তুলেই থাকব।”
পরদিন, গ্রামে একটা আগুন লাগে। জমিদারবাড়ি ছাই হয়ে যায়। আরিত্রের খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।
নয়না চমকে চোখ খুলে বসে। তার শ্বাস ধরা পড়ছে। সে জানে—সে মেহুল ছিল।
আর তার এই জীবনের ছায়ার মতো তাকে ডেকে চলেছে সেই আরিত্র। কিন্তু এইবার কিছু বদলে গেছে। নয়নার মনে একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন। যেন কেউ তার মনের গহ্বর চিরে ঢুকছে—যেখানে স্মৃতি আর বাস্তবের মিলনবিন্দু ভয়ংকর ভাবে এক হয়ে গেছে।
সেই রাতে নয়না সমুদ্রতটে যায়। সমুদ্রের গর্জন আজ তীব্র—প্রায় যেন কারো কান্নার মতন।ঝাউগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে আরিত্র। আজ তার শরীরটাও যেন আরও বাস্তব। ছায়া নয়, বরং রক্তমাংসের স্পন্দন।
“তুমি ফিরে পেয়েছো তোমার স্মৃতি,” আরিত্র বলল।
“তবে সত্যিটা এখানেই শেষ নয়।”
নয়না ধীরে ধীরে বলল, “তুমি সত্যিই তখন মারা গিয়েছিলে, তাই তো?”
আরিত্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “না, নয়না। আমি আগুনে মরিনি। আমার মৃত্যুর কারণ ছিল কেউ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল।”
নয়নার গা শিউরে উঠল।
“কে?”
আরিত্র বলল, “তোমার বাবা নয়, বরং তোমার মা।
তিনি চাইতেন না তুমি কারও জন্য নিজেকে হারাও।
আর আমি তখন কিছু জানতাম না—সেই রাত্রে কটেজে এসে দেখি আমার ক্যানভাস ছিঁড়ে ফেলা, রঙগোলায় বিষ মেশানো… আমি ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যাই।
শেষ স্মৃতি, কেবল তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম—‘আমি আসব আবার।’”
নয়না পেছনে এক পা হাঁটে।
“তাহলে… আমার মায়ের ভেতরেই এতটা ঘৃণা ছিল?”
আরিত্র হালকা হাসে।
“এটা ঘৃণা ছিল না, বরং ভয়।ভালোবাসা যখন সীমা ছাড়ায়, মানুষ ভয় পায় প্রিয়জনকে হারানোর। তোমার মা ভেবেছিলেন আমি তোমার জীবন নষ্ট করব।”
সেই রাতে নয়না সমুদ্রের ধারে বসে। সমুদ্রের ঢেউ আসে, ফিরে যায়। ঠিক যেমন স্মৃতি আসে, ফিরে যায়।
কিন্তু কিছু স্মৃতি থাকে গহ্বরের মতো—নিভৃত, অন্ধকার, অথচ গভীর। আরিত্র তার পাশে বসে।
“এই জীবনেও তুমি চলে যাবে?” নয়না জিজ্ঞাসা করল।
“যদি সময় না দেয়?”
আরিত্র বলল, “আমরা সময়ের বাইরে থেকেও এক হতে পারি—যদি তুমি সত্যিকারের প্রস্তুত হও।
এবার তোমাকেই বেছে নিতে হবে—চেনা জীবনে ফিরবে, না কি আমার সঙ্গে চলে আসবে সেই অনন্ত সমুদ্রের ওপারে।”
নয়না তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে এখন আর ভয় নেই। শুধু নিশ্চিত বিশ্বাস। “আমি সেই আগুনের রাতে তোমায় হারিয়েছিলাম। এইবার আমি কোনো আগুনকে ভয় পাই না।”
আরিত্র ধীরে হাত বাড়ায়। সমুদ্রের ঢেউ তখন নীল আভায় ঝলমল করছে। যেন কোনো রহস্যময় রাত তাদের দুজনকে আবার কাছে টানছে।
৫
সকালবেলা নয়না ঘুম ভাঙতেই দেখল ঘরের আলো এক অদ্ভুত নীলাভ। যেন সূর্য উঠলেও আলোটা আসছে না বাইরের দিক থেকে—বরং ঘরের ভেতর থেকেই যেন একটা অদৃশ্য নীল দরজা খোলা আছে, যার ওপাশে লুকিয়ে আছে অন্য এক জগৎ। তার শরীর নিস্তেজ, কিন্তু মন অস্বাভাবিক শান্ত।
সে ধীরে ধীরে উঠে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। সমুদ্র তখন সোনালি রোদের নিচে ঝিকিমিকি করছে।
কিন্তু আজকের ঢেউগুলোর মধ্যে যেন একটা আকুলতা, একটা ডাক লুকিয়ে আছে।
“তুমি কি প্রস্তুত?”
পেছনে ঘুরে দেখে আরিত্র দাঁড়িয়ে। আজ তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে এক নিঃশব্দ অভিজ্ঞান।
নয়নার মনে পড়ে গেল সেই কথাগুলো— “তুমি এবার বেছে নাও—বাস্তব, না অতীত। আমি অপেক্ষা করব, কিন্তু দরজা বেশিক্ষণ খোলা থাকবে না।”
নয়না বুঝতে পারে—এই জীবন তার যতই নির্ভরযোগ্য হোক, এই কটেজ, তার কর্পোরেট চাকরি, শহরের কোলাহল, বন্ধুদের আড্ডা—সবটাই যেন আধা-সত্য। যা সত্য, তা লুকিয়ে আছে হৃদয়ের গহ্বরে। আর সেই গহ্বরের প্রবেশদ্বারই এই নীল দরজা।
কিন্তু সেই মুহূর্তে—ঘটল কিছু ভয়ানক। বাতাস হঠাৎ থমকে যায়। ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে এক জোরালো ঝোড়ো হাওয়া।আর নয়না দেখতে পায়—আয়নায় এক মুখ! সেই মুখ তার নিজের নয়, বা আরিত্ররও নয়। এক মহিলার মুখ—চোখজোড়া কালি পড়া, ঠোঁটে অস্বাভাবিক চাপা হাসি।
“তুমি ওর সঙ্গে যাবে না, নয়না,” সেই মুখ বলল।
“তুমি ভুল করছ। ও আসল নয়।”
নয়না ভয়ে চমকে উঠে বলে, “তুমি কে?”
মুখটা ফিসফিস করে— “আমি… তুমি নিজেই।যে অংশটা সত্যকে মানতে চায় না। যে ভয় পায় হারিয়ে যেতে। তুমি যদি ওর সঙ্গে যাও, এই জীবন, এই বাস্তব সব হারাবে।”
আরিত্র এগিয়ে এসে নয়নার হাত ধরে।
“ও তোমার অবচেতন মন—যে বিশ্বাস করে, বাস্তব ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু তুমি তো জানো, আমরা অনেক আগেই একটা বাস্তবকে পেরিয়ে এসেছি।”
নয়না দ্বিধায় পড়ে। তার মাথায় বাজতে থাকে মায়ের কণ্ঠস্বর: “স্বপ্নে কখনো ভরসা করিস না। বাস্তবটাই জীবনের একমাত্র ঠিকানা।”
কিন্তু এরপরই তার চোখে ভেসে ওঠে সেই আগুনে পোড়া জমিদারবাড়ি, আরিত্রর আঁকা ছবির টুকরো, তার চোখে তৃষ্ণার ছায়া।
নয়না জিজ্ঞেস করে, “এই দরজার ওপারে কী আছে?”
আরিত্র বলল, “একটা জগৎ—যেখানে আমরা অসমাপ্ত ছিলাম। তুমি যদি চাও, আমি তোমায় নিয়ে যাব সেই শেষ না হওয়া ক্যানভাসের ভেতরে। কিন্তু মনে রেখো, ফিরতে পারবে না।”
এই কথা বলার সময় ঘরের মাঝখানে তৈরি হলো সেই ‘নীল দরজা’। ঠিক যেন বাতাসের মধ্যে জল ঘোলা হয়ে উঠেছে—একটা কাঁচের পর্দা, যার ওপাশে ঝাউগাছ, ঝাপসা রোদের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন নদীঘাট। আরিত্র দরজার দিকে এগিয়ে যায়। নয়না তার পেছন পেছন হাঁটে, কিন্তু হঠাৎ… ঘরের আয়না চিৎকার করে ভেঙে পড়ে!
সেই একই ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে, এবার পুরো মানবদেহে।
সে নয়নার গলা চেপে ধরে।
“তুই আমাকে ছাড়বি না! তুই আমার তৈরি, তুই বাস্তবের সন্তান!”
নয়না তখন চিৎকার করে ওঠে, “না! আমি সেই বাস্তবের নয়, যে আমাকে আটকে রাখে। আমি সেই সত্যের, যে আমার হৃদয়ে বাস করে!”
আর তৎক্ষণাৎ, নয়নার শরীর থেকে বেরিয়ে আসে একটা আলো। আলোটা গিয়ে সরাসরি ধাক্কা দেয় সেই ছায়ামূর্তিকে।
সেই ছায়া আর মাটি ছুঁয়ে থাকতে পারে না। ভেঙে পড়ে ধুলোয়, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে।
দরজা এখন সম্পূর্ণ খোলা। আরিত্র তার দিকে হাত বাড়ায়।
নয়না শেষবার কটেজটার দিকে তাকায়—যেখানে বিছানা, আলমারি, বইয়ের তাক, তার ফোন, ল্যাপটপ, আধুনিক জীবন। তারপর আরিত্রর হাত ধরে সে পা রাখে দরজার ভেতরে। সবকিছু মুছে যায়। হঠাৎ তার চারপাশে এক শান্ত জগৎ— এক ক্যানভাসের ভিতর সে দাঁড়িয়ে। চারদিকে রং ছড়িয়ে আছে—নীল, সবুজ, হলুদ।
আরিত্র তার সামনে দাঁড়িয়ে, কাঁধে তুলির থলে।
“স্বাগত, নয়না। এখানে তোমার নাম মেহুল।
এবং আমাদের কাহিনি এবার শুরু হবে অন্যভাবে।”
নয়না বলে, “এবার আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।”
আরিত্র বলে, “এইবার না।”
৬
এটা যেন এক নতুন সকাল, অথচ সূর্য নেই। চারপাশে ছড়িয়ে পড়া আলোর মাঝে নয়না নিজেকে আবিষ্কার করে এক বিশাল ক্যানভাসের ভেতরে—যেখানে মাটি, গাছ, আকাশ সবই তুলির আঁচড়ে তৈরি। সমুদ্র এখানে রঙিন রেখায় আঁকা, ঢেউগুলো চলেছে ধ্বনি নয়, অনুভূতির বেগে।
আরিত্র তার পাশে দাঁড়িয়ে। চোখে সেই চিরচেনা মায়া, কিন্তু আজ আরও কিছু গভীর।
একটা প্রস্তুতি, যেন শেষ কোনো কাজের শুরু।
“এই জায়গাটা শুধুই আমাদের জন্য,” আরিত্র বলল।
“আমরা একসঙ্গে আছি, সময় আর জন্মের বাইরে। কিন্তু… কিছু অপূর্ণ এখনও রয়ে গেছে।”
নয়নার হৃদয় কেঁপে ওঠে।
“কী অপূর্ণ?”
আরিত্র আঙুল তুলে দেখায় এক বিশাল ফাঁকা ক্যানভাস।
“আমাদের গল্প এখনও আঁকা হয়নি। শেষ রেখাটা টানতে হবে তোমাকেই।”
কিন্তু তখন… ক্যানভাস কাঁপে। হঠাৎ চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে আসে। রঙ ছড়িয়ে ছড়িয়ে ঘোলাটে হতে থাকে। শুনতে পাওয়া যায় ছায়া-ছায়া গলার আওয়াজ— ফিসফিস, চাপা কাঁপুনি, পুরনো যন্ত্রণার ক্রন্দন। অপ্রাপ্তির প্রতিধ্বনি ফিরে এসেছে।
একটি চেনা কণ্ঠ—নয়নার মায়ের মতো, কিন্তু বিকৃত।
“তুমি পালিয়ে এসেছো। এই জগৎ স্বপ্ন। এই ভালোবাসা কেবল অতৃপ্ত আত্মার নির্মাণ।”
নয়না মাথা নিচু করে, চোখ বুজে ফেলে। তার শৈশব, তার সমাজ, তার বাস্তবতা—সব যেন একসঙ্গে ধেয়ে আসে। কিন্তু ঠিক তখনই আরিত্র তার কাঁধে হাত রাখে।
“ভালোবাসা যদি মায়া হয়, তবে সেটাই হোক সত্য। তুমি যদি আমাকে এখন স্বীকার করো—এই শেষ রেখা তোমার হৃদয় থেকে আঁকো—তবে আমরা মুক্ত। নয়তো সব মুছে যাবে।”
নয়না তখন সামনে এগিয়ে যায়। সে তুলে নেয় এক তুলি।
রঙিন রেখার ভেতর, সে আঁকে নিজেকে—এক নারী, যার চোখে পেছনের সব জন্ম, আর ঠোঁটে এক মুক্তির হাসি। তার পাশে আঁকে আরিত্রকে—তাঁর চোখে শুধুই অপেক্ষা। এরপর সে ধরে আরিত্রর হাত। তুলির একটানা শেষ স্ট্রোক দিয়ে আঁকে—একটি নীল রেখা, যা তাদের দুজনকে জুড়ে রাখে, ক্যানভাসের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। রেখাটি জ্বলে ওঠে। একটা আলোয় ক্যানভাস ভরে যায়।
হঠাৎ সব নিঃশব্দ। নয়নার চোখ খুলে যায়। সে দেখে—সে একটি ঘরে বসে, তার সামনে একটি ক্যানভাস। হাতের নিচে রঙ লেগে আছে। ঘরের জানালা দিয়ে ঝাউবনের নীচে এক যুবক হাঁটছে। পেছন থেকে ভেসে আসে পরিচিত কণ্ঠ:
“তুমি জেগে উঠেছো?”
সে ঘুরে তাকায়—আরিত্র। কিন্তু এবার সে কেবল ছায়া নয়।
রক্তমাংসের মানুষ। গায়ে হালকা টি-শার্ট, চুল একটু এলোমেলো।
নয়না বলে ওঠে, “তুমি… এখানে?”
আরিত্র হেসে বলে, “তুমি নিজেই আমায় একেছো।
এই জীবনটাই এখন আমাদের।”
***
এক বছর পরে, দক্ষিণবঙ্গের এক সাগরতীরবর্তী গ্রামে এক গ্যালারি উদ্বোধন হচ্ছে—“নীলরাত্রি – A Canvas of Rebirth”।
নয়না আর আরিত্র এখন চিত্রশিল্পী যুগল। তাদের শিল্পে লুকিয়ে আছে জন্মান্তরের ছাপ, স্বপ্নের ছায়া, ভালোবাসার অনন্তরেখা।
একজন দর্শক ফিসফিস করে বলে, “তাদের চোখে এমন কিছু আছে… যেন বহু জন্মের চেনা।”
সমাপ্ত