Bangla - রহস্য গল্প

হ্যারিসন রোডের অপেরা

Spread the love

জয়দীপ বিশ্বাস


এক

হ্যারিসন রোডের পশ্চিম প্রান্তে, রাস্তাঘেঁষে ছায়ায় ঢাকা এক পুরনো, প্রায় ভাঙা-ভাঙা বাড়ি—যার কাঁচ ভাঙা জানালার ওপারে আজও পড়ে আছে কিছু পুরনো পর্দা, ছেঁড়া পোস্টার, আর থিয়েটারের ধুলো ধরা আসবাব। শহরের ব্যস্ততা আর উজ্জ্বল আলো থেকে দূরে এই অব্যবহৃত অপেরা হলটা গত কুড়ি বছর ধরে সময়ের স্তব্ধতায় নিজেকে মুড়ে রেখেছে। নাম—“অ্যালিগ্রো থিয়েটার”। একসময় কলকাতার থিয়েটারপাড়ার গর্ব ছিল এই অপেরা হল, যেখানে যুগের পর যুগ বাঙালি অপেরার জন্ম হয়েছে—পিয়ানো, কর্ড, ভায়োলিন আর দোতারা মিলেমিশে সুরের এক আদি-আধুনিক কাব্য রচনা করেছিল এখানে। কিন্তু সেই অপেরা একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়—কারণ, যা কারও কাছে স্পষ্ট নয়। কেউ বলে আগুন লেগেছিল মঞ্চে, কেউ বলে মৃত্যু হয়েছিল শিল্পীর, আবার কেউ গুজব রটায়—এই হল অভিশপ্ত, এখানে রাতের অন্ধকারে গান শোনা যায়। এতকিছুর মাঝেও, ২০২৫ সালের শুরুতে, শহরে একটাই কথা ছড়িয়ে পড়ে—“অ্যালিগ্রো থিয়েটার আবার খুলছে।” যার নেতৃত্বে, তিনি—রুদ্রায়ন চৌধুরী। বিদেশফেরত থিয়েটার ডিরেক্টর, যার চোখে অপেরা কেবল পারফর্ম্যান্স নয়—একটা জীবন্ত অনুভূতি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, সরকারি অনুমতি আর স্পনসর জোগাড় করে, এই থিয়েটারকে সে আবার মঞ্চে ফেরানোর স্বপ্ন দেখছে।

তিনতলার ছাদে দাঁড়িয়ে রুদ্রায়ন নিচে ভাঙাচোরা মঞ্চের দিকে তাকায়। তার বুক ধুকপুক করছে, কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করছে না। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে কতটা নার্ভাস। তার পাশে দাঁড়িয়ে নায়রা লাহিড়ী—একজন অপেরা সিঙ্গার ও কম্পোজার, যার গলা শোনা মাত্রই কলকাতার বহু পুরনো শিল্পীমহল মুগ্ধ হয়ে যায়। নায়রার দিদিমা ছিলেন এই থিয়েটারের অন্যতম শিল্পী, যিনি শেষবার ১৯৪৭ সালে এখানে গান গেয়েছিলেন। নায়রার চোখে ছায়া—সে জানে এই থিয়েটারের ইতিহাস। সে জানে তার দিদিমার মৃত্যুর সময় অনেক রহস্য ছিল। “এই জায়গাটা যেন জীবন্ত, রুদ্র,” ফিসফিস করে বলে নায়রা। রুদ্রায়ন শুধু বলে, “জীবন্ত জিনিসগুলোকেই তো মঞ্চে ফেরাতে চাই।” ঠিক তখনই এসে যোগ দেয় ঋজু বোস—থিয়েটারের সাউন্ড ও লাইটিং ইঞ্জিনিয়ার। গম্ভীর, নির্ভুল, যুক্তিবাদী মানুষ। সে দ্রুত থিয়েটারের পুরনো সার্কিট, অডিও প্যানেল আর গ্যালারির স্পিকার চেক করে। প্রতিটি জায়গায় ধুলো, জং, আর অদ্ভুতভাবে কাঁচা-পুরনো গন্ধ। তখনো মঞ্চে ঢোকেনি বাকি দল—কোরিওগ্রাফার সামরিকা ঘোষ, সাংবাদিক অর্ঘ সেনগুপ্ত, বা থিয়েটারের বৃদ্ধ কেয়ারটেকার দিগ্বিজয় পাল। কিন্তু এদিনের সকালটা যেন শহরের অন্যান্য সকালের মতো নয়। রুদ্রায়ন যখন মঞ্চে উঠে নিজের স্ক্রিপ্ট বের করে, তখনো তার কানে একটা গুনগুনানি শুনতে পায়—অনেক দূর থেকে যেন এক নারী গুনগুন করে একটা অপেরা গান গাইছে, যার ছন্দ ঠিক তার স্ক্রিপ্টের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সে চারপাশে তাকায়, কেউ নেই। শুধু ঝুলে থাকা ছেঁড়া পর্দা, ভাঙা চেয়ার, আর থিয়েটারের নিঃসঙ্গতা।

প্রথম দিনের রিহার্সালের জন্য কেউই প্রস্তুত নয়, অথচ সবাই এসেছে সময়মতো। সামরিকা জুতো খুলে খালি পায়ে মঞ্চে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “এই কাঠের মেঝে যেন ধ্বনির স্মৃতি জমিয়ে রেখেছে, জানো?” অর্ঘ নোটবুক খুলে প্রাচীন নোটস নিচ্ছে, পুরনো ওয়ালপোস্টার আর স্টেজ ডিজাইন দেখে নিজের রিপোর্ট তৈরি করছে। কেউ খেয়াল করে না, দিগ্বিজয় পাল নীরবে এসে মঞ্চের পেছনে একটা বড়ো তালা ঘষে খুলছে—সেই ঘর, যেটা নাকি ১৯৪৭-এর পর থেকে আর খোলা হয়নি। “এটা খুলতে হবে না দাদা,” বলে ওঠে ঋজু, কিন্তু বৃদ্ধ শুধু বলে—“শিল্পীরা ফিরে এলে সব খোলা থাকে।” সেই মুহূর্তে হঠাৎ থিয়েটারের অডিও সিস্টেম একা একাই ‘হিস’ করে ওঠে। ঋজু হকচকিয়ে যায়—কারণ সিস্টেমে তখন কোনো পাওয়ারই ছিল না। নায়রা থমকে দাঁড়ায়, তার চোখ স্থির মঞ্চের বাঁদিকে, যেখানে একটা ছায়া এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পলকে ভেসে গিয়েছিল। সবাই চুপচাপ। রুদ্রায়ন এগিয়ে এসে মৃদু গলায় বলে, “চলো শুরু করি—আমরা যখন গল্প বলি, তখন ছায়ারাও জেগে ওঠে। আজ গল্প বলার প্রথম দিন।” হল জুড়ে নীরবতা। কেউ কথা বলে না। শুধু স্টেজ লাইটের ওপরে একটা পাখি হঠাৎ ডানা ঝাপটায়, আর মঞ্চের ধুলো হঠাৎ একসঙ্গে একটু হেলে পড়ে—যেন কারও পা পড়ে গেছে সেখানেই।

দুই

রাত্রি নেমেছে কলকাতার বুকে, কিন্তু হ্যারিসন রোডে অ্যালিগ্রো থিয়েটারের চত্বরে এখনো আলো জ্বলছে। থিয়েটারের ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ছে সামান্য শব্দ—লাইট স্ট্যান্ড নামানো, চেয়ার সরানো, সাউন্ড চেকের ঠুংঠাং শব্দ। কিন্তু সেই শব্দের মাঝেই হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠল এক সুর। খুব ধীর, নিঃশব্দ, যেন অনেক দূর থেকে আসছে… আবার যেন খুব কাছেই। নায়রা লাহিড়ী একা বসে ছিল গ্যালারির দ্বিতীয় সারিতে। রুদ্রায়ন তাকে বলে গিয়েছিল, “তোমার গলার প্রজেকশনটা টেস্ট করো, আর একটু প্রাণ দাও শুরুটা‌য়।” সে এবার সেই সুরটা শুনতে পায়। না, এটা তার গলা নয়। মাইক্রোফোন বন্ধ। স্পিকার বন্ধ। অথচ এক নারীকণ্ঠ তার গাওয়া অপেরা অংশটা নিখুঁতভাবে গাইছে—একটি প্রাচীন ইতালীয় অপেরা লাইনের উচ্চারণ সহ। তার চোখ স্থির হয়ে যায় মঞ্চের বাঁদিকে পর্দার আড়ালে। সে গলা সরিয়ে বলে, “রুদ্র… তুমি কি গান গাও নাকি?” কোনো উত্তর নেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের দিকে পা বাড়ায়—ধীরে, নিঃশব্দে। গ্যালারিতে তখন আর কেউ নেই। আলো কমে এসেছে, স্টেজের লাইটিং শুধু সামনের মাঝখানটুকু জ্বালিয়ে রেখেছে। হঠাৎ সে শুনতে পায়—সেই কণ্ঠ এবার গাইছে অন্য ভাষায়—এবার যেন বাংলায়… খুব পুরনো বাংলা, সংস্কৃত ছোঁয়া অপেরা গান, যা তার দিদিমা গাইতেন একসময়। হিমেল বাতাস বয়ে যায় তার গলার চারপাশ দিয়ে, কিন্তু জানালাগুলো সব বন্ধ। তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে, গলা বন্ধ হয়ে আসে, আর ঠিক তখনই পর্দার আড়াল থেকে যেন কেউ নিঃশ্বাস নেয়—দীর্ঘ, কষ্টকর, ভারী নিঃশ্বাস।

ঋজু তখন সাউন্ড কনসোলে ব্যস্ত ছিল। এক অদ্ভুত জিনিস সে খেয়াল করে—মাইক্রোফোন “অফ” থাকা সত্ত্বেও স্পেকট্রাম লাইনে কিছু শব্দের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। সে দ্রুত ভলিউম বাড়িয়ে শুনতে পায় সেই গান—তবে ভয়ংকর বিকৃতভাবে, যেন কাউকে পুরনো রেকর্ড থেকে বাজিয়ে টেনে আনা হচ্ছে। তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। ঠিক তখনই সামরিকা মঞ্চে উঠে এসে চিৎকার করে ওঠে—“এই রিহার্সাল বন্ধ করো, কেউ ছিল স্টেজে!” রুদ্রায়ন, অর্ঘ আর দিগ্বিজয় এসে দাঁড়ায় মঞ্চে, চারপাশে কেউ নেই। দিগ্বিজয় একটানা তাকিয়ে থাকে ওপাশের কালো পর্দার দিকে। অর্ঘ তার নোটবুকে লিখে নেয়—“ভয় হলের শব্দকে খেয়ে ফেলে। শিল্পীদেরও।” সবাই থেমে যায়। কেউ প্রশ্ন করে না, কেউ ব্যাখ্যা চায় না, শুধু নিঃশব্দে প্রত্যেকে মেনে নেয়—আজ রাতে কিছু একটা ছিল। সামরিকা, যিনি বরাবর স্পষ্টবক্তা ও নির্ভীক, সেই প্রথমবার কাঁপা গলায় বলে—“আমি কাউকে দেখেছিলাম, রক্তমাখা পোশাক পরে… সে নাচছিল… এক পা নেই তার…” চারপাশ নিঃস্তব্ধ। মঞ্চ যেন গিলে নেয় তার কথা।

রাত্রে থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। সবাই ফিরে যায় নিজের গেস্টহাউসে বা বাড়িতে। শুধু রয়ে যায় দিগ্বিজয় পাল—প্রাচীন দরজা তালাবদ্ধ করে। কিন্তু যাওয়ার আগে রুদ্রায়ন একবার ফিরে তাকায়। গ্যালারির উপরতলার করিডোরে হঠাৎ দেখেছিল এক নারী মূর্তি—কালো আলখাল্লা পরা, মাথা নিচু, এক হাতে কিছু ধরা। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। সে কিছু বলে না কারো—ভাবল, হতে পারে চোখের ভুল। কিন্তু ভিতরের গোপন সত্তা বলে দেয়—এই থিয়েটারের স্তব্ধতায় কিছু জেগে উঠছে। আর সেই কিছুর ডাক শুরু হয়ে গেছে।

তিন

রাত্রির অন্ধকারে, অ্যালিগ্রো থিয়েটারের বাতাসে এক অদ্ভুত গুমোট গন্ধ মিশে গেছে। থিয়েটারের অদ্ভুত নিরবতা যেন সকলকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে। দিন-রাতের ব্যবধান ফিকে হয়ে গেছে এখানে, এমনকি থিয়েটারের চত্বরেও মাঝে মাঝে সেগুলোর আর কোনো অনুভূতি নেই। রুদ্রায়ন চৌধুরী, নায়রা লাহিড়ী, ঋজু বোস এবং সামরিকা ঘোষ, সবাই যখন একে একে থিয়েটারের সাউন্ড সিস্টেমে কিছু সমস্যা সংশোধন করছিল, তখন অর্ঘ সেনগুপ্ত এক কোণে বসে পুরনো পত্রিকা ও রেকর্ড ঘেঁটে যাচ্ছিল। এমনই সময় তার চোখে পড়ে একটি পুরনো খবরের কাটা—১৯৪৭ সালে এই থিয়েটারে একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যেটি পাঁচ জন শিল্পীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এই ঘটনার পরেই থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার তদন্তে কিছুই পরিষ্কার হয়নি। খবরটির উপরে থাকা কিছু অদ্ভুত লাইন অর্ঘকে ভাবাতে বাধ্য করে—”বিস্মৃত এক কণ্ঠের ফিরে আসা,” “অজানা অগ্নিপরীক্ষা,” এবং “নিরব শ্বাসের শব্দ।” অর্ঘের মনে সন্দেহ জন্মে—এখানে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। সে ভাবতে থাকে, “কী ঘটেছিল সেই সময়?” তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে ঠিক করে, থিয়েটারের পুরনো ফাইলগুলো খুঁজে বের করবে, কারণ সেগুলোর মধ্যে কিছু সঠিক তথ্য থাকতে পারে যা মেলানো যাবে বর্তমান রহস্যের সঙ্গে।

ততক্ষণে রুদ্রায়ন মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি বড় পডিয়ামে হাত রাখে। তার চোখের সামনে একটি কালো পর্দা ঝুলছে—এটি কখনোই সরানো হয়নি। সে নিজের অজান্তেই তা একটু সরায়। কিন্তু পর্দার পিছনে কোনো কিছু ছিল না। বা অন্তত যে জিনিসটা সে দেখেছিল, তা খুব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। পর্দা সরে যাওয়ার পর তার চোখের সামনে ছিল দেয়াল। দেওয়ালে হালকা করে কিছু লেখা ছিল—“অন্য যাত্রা শুরু হবে, তুমি প্রস্তুত নও।” রুদ্রায়ন তখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। “এটা কি?” সে বলে, কিন্তু আশপাশে কেউ ছিল না। সে আবার দেয়ালের দিকে তাকায়—খুব ধীরে, যেন কিছু বের করার চেষ্টা করছে। লেখা যেন বুলেটের মতো আছড়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই নায়রা পেছন থেকে এসে বলে, “রুদ্র, কিসের দিকে তাকাচ্ছ?” তার কণ্ঠে ভয়ের মিশ্রণ ছিল। রুদ্রায়ন মলিন হাসি দিয়ে উত্তর দেয়, “কিছুই না, বোধহয় চোখের ভুল।” কিন্তু সে জানে, এটি চোখের ভুল নয়। কিছু একটা ছিল—কিছু লেখা ছিল, আর সেটা অবশ্যই এখানে কোনো এক অতীতের কণ্ঠ। নায়রা একে একে বলে ওঠে, “রুদ্র, তুমি জানো, দিদিমা যখন এই থিয়েটারে পারফর্ম করতেন, তখন আমার কাছে সবসময় কিছু অদ্ভুত গল্প ছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু তারা বলতেন যে এই মঞ্চের পেছনে কিছু থাকে। আত্মা, অনুভূতি, অথবা… কিছু যা এখানকার ইতিহাসে জড়িত।” রুদ্রায়ন এবার মুখ নিচু করে, কিছু বলার আগেই বলে, “তুমি জানো, নায়রা, আমি এইসব বিশ্বাস করি না। তবে যেহেতু তুমি বলছো, কিছু ভুলও হতে পারে।”

ঋজু সাউন্ড সিস্টেমে নতুন কিছু পরীক্ষা করতে গিয়ে কিছু অদ্ভুত পরিসংখ্যান খুঁজে পায়। তার মনোযোগ তখন একেবারে ভিন্ন দিকে চলে যায়। কিছু অজানা ফ্রিকোয়েন্সি ধরা পড়ছিল, যেগুলি সাধারণ সাউন্ড চেকের জন্য নেই। আর আশ্চর্যজনকভাবে, একে একে সেই সাউন্ড সিস্টেমে বিকৃতভাবে পুরনো অপেরা গানের একটি ট্র্যাক বাজতে থাকে। গানটি একসময় থেমে যায়, কিন্তু মঞ্চের দিকে তাকালে মনে হয়—একটি ভাসমান, অদৃশ্য কণ্ঠ সুরটি আবার আবার শুনতে পাওয়া যাবে। ঋজু সবার দিকে তাকায়, কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না কী হচ্ছে। সামরিকা, যে বরাবর সাহসী, এবার হঠাৎ বলে ওঠে, “এটা কিছু নর্মাল নয়। কিছু আছেই, যা এই থিয়েটারে ঘটছে। আমাদের এখানে এসেছিল অনেক বছর আগে—যতটা ভুলে যেতে চাওয়া হয়েছিল, ততটাই রহস্যময়।” রুদ্রায়ন আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কি বলছ, সামরিকা? তুমি ভয় পাচ্ছ?” তার মধ্যে যেন একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, আর সবাই এখন তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এমন সময় দিগ্বিজয় পাল, থিয়েটারের প্রাচীন কেয়ারটেকার, আসেন, চুপচাপ এগিয়ে এসে বলেন, “ওরা আবার ফিরে এসেছে। যখন যাত্রার দিন শুরু হয়, তারা ঘুরে ফিরে আসে। তোমরা যদি প্রস্তুত না থাকো, এই থিয়েটারটা তোমাদের জীবনে শেষ পথ দেখাবে।” অর্ঘ, যে এতক্ষণ শুনছিল, এবার ডায়েরির পাতা উলটে বলে, “এটা যে আত্মার সাথে সম্পর্কিত, তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন ফিরে আসবে তারা? কেন তাদের কণ্ঠ আবার শুনে যায়, যদি তাদের মৃত্যু এখানেই ঘটে থাকে?” দিগ্বিজয় পাল ধীরে, অথচ ভয়ানক সুরে বললেন, “এরা শান্তি পায় না। যে থিয়েটারে তাদের মৃত্যু হয়, সেই থিয়েটার ছেড়ে তারা যেতে পারে না।”

তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। থিয়েটারের মঞ্চ, যেখানে একসময় আনন্দের বন্যা ছিল, এখন এক অশুভ শক্তির বাসস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই জানে, তারা যদি এখন এই মঞ্চে পারফর্ম করার সাহস না দেখায়, তাহলে তারা কখনোই সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাবে না। কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে—কীভাবে করবে তারা? কখনোই কি তাদের এই অপেরা মঞ্চটা সফল হবে?

চার

ভোরের আলোয় অ্যালিগ্রো থিয়েটারটা যেন একটু শান্ত লাগে, কিন্তু সেটা ভ্রম। আলো আসলেও থিয়েটারের ভিতরের ঘন ছায়া মিলিয়ে যায় না, বরং দিনের আলোর সঙ্গেও যেন লড়ে যায়। রিহার্সাল শুরু হয়েছে সকাল থেকে। রুদ্রায়ন সকলকে অনুরোধ করেছে, আজকের দিনটা যেন ভয়, অলৌকিকতা, এসব ভুলে তারা নিজেদের শিল্পচর্চায় মন দেয়। কিন্তু নায়রা আর সামরিকার চোখে সেই স্থিরতা নেই। সামরিকা সকাল থেকেই অস্থির। মঞ্চে উঠেই সে থেমে যায়, হঠাৎ হঠাৎ পেছনে তাকায়। একবার তো সে এমনভাবে চমকে উঠল যে পিছিয়ে গিয়ে একটা স্পটলাইটের সঙ্গে ধাক্কা খেল। “আমি এখানে একা দাঁড়াতে পারছি না,” সে বলল, “এখানে কেউ আছে।” রুদ্রায়ন বিরক্ত ভাবে বলে, “আমরা সবাই এখানে আছি সামরিকা, তুমি শান্ত হও।” সে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার নিজেরও শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। এতদিন ধরে মঞ্চের সঙ্গে থাকলেও এই মঞ্চ যেন আলাদা। যেন চোখে চোখ রাখে মঞ্চের কাঠামো, কথা বলে।

দুপুর গড়াতেই সামরিকা নিখোঁজ হয়ে যায়। সে বলেছিল, একটু বাইরে যাবে জল খেতে, আর তারপর থেকেই আর খোঁজ পাওয়া যায় না। প্রথমে সবাই ভাবে, হয়তো কাছেই কোথাও গিয়েছে। কিন্তু এক ঘণ্টা কেটে যায়, কেউ দেখে না সে বাইরে এসেছে। থিয়েটারের ভেতরে খোঁজ শুরু হয়। গ্যালারি, গ্রীন রুম, কস্টিউম স্টোর, এমনকি মঞ্চের নিচে পুরনো ‘ট্র্যাপ ডোর’-এর দিকেও খোঁজা হয়। ঠিক তখনই, নায়রা মঞ্চের বাঁদিকে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে—সামরিকার পছন্দের লাল স্কার্ফ, সেটি পড়ে আছে কনসার্ট পিটের এক কোণে, যেখানে দিনের আলো পৌঁছায় না। স্কার্ফটা যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেঝের ভিতরে। তার ওপর রক্তের মতো বাদামি ছোপ। নায়রার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে চিৎকার করে ডাকে: “রুদ্র! অর্ঘ! কেউ ওদিকে এসো!” সবাই ছুটে আসে। রুদ্রায়ন নিচু হয়ে দেখে স্কার্ফটা ভিজে আছে, ঠান্ডা, আর ধুলোয় লেপ্টে থাকা দাগগুলো এক অদ্ভুত কিছুর—কোনো মানুষের নয়, যেন খুঁড়ে ওঠা কঙ্কালের আঙুলের। অথচ থিয়েটারের দরজা তালাবদ্ধ, বাইরে যাওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। সিসিটিভি ফুটেজ দেখা যায়—সামরিকা একাই স্টেজ থেকে নামছে, তারপর হঠাৎ ক্যামেরা ব্ল্যাক-আউট হয় পাঁচ সেকেন্ডের জন্য, আর তারপর খালি মঞ্চ।

অর্ঘ তখন ঠান্ডা মাথায় বলে, “এটা নিছক নিখোঁজ নয়। এটা একটা আত্মিক গ্রাস। কেউ বা কিছু তাকে ডেকেছে। হয়তো সেই পুরনো অপেরার গান…” তখনই আবার সাউন্ড সিস্টেমে একটা স্বয়ংক্রিয় বাজনা শুরু হয়ে যায়—সেই অপেরা গান, যেটা নিয়ে আগেও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। অথচ কেউ চালায়নি, কেউ মেশিনে হাত রাখেনি। ঋজু মেশিন বন্ধ করতে যায়, কিন্তু প্লাগ খোলা থাকা সত্ত্বেও গান বন্ধ হয় না। সেই সুর—বেদনাময়, ক্লাসিক, অথচ তীব্র অভিশপ্ত—শুনে সবার মনে হয় যেন কেউ কাঁদছে গানের ভেতর। দিগ্বিজয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে। তার চোখ অদ্ভুত ভাবে থিয়েটারের ছাদের দিকে। কেউ জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলে, “তুমি জানো না, তারা কেমন করে ডাকে… একবার নাম শুনলে আর ফেরে না কেউ।”

তদন্ত শুরু হয়। পুলিশ আসে, কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না। রুদ্রায়ন বাধ্য হয় থিয়েটার বন্ধ রাখতে কিছুদিন। তবু তার ভেতরের কণ্ঠ বলে, “কিছু একটা এখানেই আছে—এই মঞ্চে। আর সামরিকার অনুপস্থিতি সেই শুরু।” নায়রা একা মঞ্চে বসে থাকেন এক সন্ধ্যায়। তার গলায় কান্নার সুর মিশে থাকে। সে যেন নিজের দিদিমার পুরনো গান মনে করে—এক অপেরা যার নাম ছিল “অলস আত্মারা কথা বলে”, যেটা সে কখনোই শেখেনি, অথচ তার ঠোঁট হঠাৎ নিজে থেকে সেই গান গাইতে শুরু করে। রুদ্রায়ন দূর থেকে সেই সুর শুনে বুঝতে পারে—এই গান সামরিকার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে যুক্ত। গানই যেন ডাক দিয়েছে তাকে। গানই যেন আবার খুঁজে আনবে তাকে। কিন্তু কে গাইছে গান? আর কারা শুনছে?

পাঁচ

অ্যালিগ্রো থিয়েটারের আলো জ্বলার প্যাটার্ন কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে—কেউ লাইট চালু করছে না, অথচ মাঝে মাঝে মঞ্চের ঠিক মাঝখানে আলো এসে পড়ে এক নিখুঁত বৃত্তে, যেন কোনো অদৃশ্য কোরিওগ্রাফার নির্দেশ দিচ্ছে। ঋজু বোস এসব লক্ষ্য করে প্রথমে ভাবল হয়তো ইলেকট্রিক ফ্লিকার হচ্ছে, কিন্তু অডিও-মিক্স কনসোল পরীক্ষা করে সে দেখে—বিদ্যুতের লাইনে কোনো ত্রুটি নেই, মেশিনের রিডিংও স্বাভাবিক। এমনকি গতকাল রাতে সে বিশেষভাবে সব সুইচ বন্ধ করে রেখে গিয়েছিল, এবং সকালবেলা এসে দেখতে পায়—স্টেজের উপর লাইটিং টাওয়ারের একসেট আলো নিজেরাই সক্রিয় হয়ে রয়েছে, ঠিক সেই একই ছন্দে যা অপেরা পরিবেশনার সময় ব্যবহৃত হত। ওর মধ্যে এখন কেবল অবিশ্বাসের ঠাণ্ডা স্রোত। সে একা বসে থাকে কন্ট্রোলরুমে, খালি স্টেজের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ কোনো এক মুহূর্তে মঞ্চে কোনো কিছুর অদ্ভুত ছায়া দেখতে পায়—যা মঞ্চের মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। আর সেই ছায়া যেখানে যেখানে হাঁটে, সেখানে সেখানে আলো পড়ে যায়—বৃত্তাকারে। তারপর আলো নিভে যায়।

অর্ঘ সেনগুপ্ত তখন পুরনো স্থাপত্য পরিকল্পনা ঘাঁটছে থিয়েটারের নিচের তলায়। সে বের করেছে থিয়েটারের আসল নক্সা, যা থিয়েটার নির্মাণের সময়কার। পরিকল্পনামাফিক এখানে একটি “ভয়েস চেম্বার” ছিল—একটা বিশেষ ধরণের প্রতিধ্বনি ঘর, যেখানে শব্দ আটকে থাকত দীর্ঘক্ষণ, সুর মিশে যেত দেয়ালে। এমন ঘর ইউরোপের কয়েকটি পুরনো অপেরা হলে ছিল। সেই চেম্বারটি বহু বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়, কারণ সেটি থেকে একসময় ‘নিয়ন্ত্রিত সাউন্ড’ বের হত, যেটা পরবর্তী কালে বিপজ্জনক বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল—সেই চেম্বারটাই মঞ্চের নিচে এখনও আছে, আর যেখান থেকে রোজ রাতে অপেরা গান ভেসে আসে, তার দিকটাই ওই ঘরের ঠিক ওপরে। অর্ঘ রুদ্রায়নকে ডাকে এবং বলে, “তুমি কি কখনো অনুভব করো না, এই মঞ্চের নিচে যেন একটা অতীত আটকে পড়ে আছে?” রুদ্রায়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জবাব দেয়, “আমি আগেও অপেরা করেছি, কিন্তু এতটাই জীবন্ত… কখনোই দেখিনি। যেন এখানে সময় আটকে আছে।”

তাদের এই আলোচনা চলার মাঝেই হঠাৎ নায়রা গ্রীনরুমে ঢুকে চিৎকার করে ওঠে। সবাই ছুটে যায়। দরজা খোলা, কিন্তু ভেতরে আলো নেভানো। এক কোণে রাখা পুরনো পোশাকের খাট থেকে নিজে নিজেই উঠে পড়ছে সামরিকার প্রিয় লাল অপেরা গাউন। যেন অদৃশ্য কেউ সেটিকে পরতে চাইছে। তার ডান হাতের কোলারে রক্তের ছোপ। রুদ্রায়ন সেই দৃশ্য দেখে চুপ করে যায়, তার মনে পড়ে—এই গাউনটাই সামরিকার নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তখনই ঋজু বলতে থাকে, “এই আলো আর সাউন্ড… এটা শুধু প্রযুক্তি নয়। কেউ বা কিছু এগুলো ব্যবহার করছে।” হঠাৎ থিয়েটার অন্ধকার হয়ে আসে। কন্ট্রোলরুম থেকে পুরো পাওয়ার কেটে যায়। চারদিক নীরব। তাদের প্রত্যেকের কানে তখন একটি কথা শোনা যায়—একসঙ্গে, ফিসফিসিয়ে বলা, স্পষ্ট, একই গলায়:
“শুরু হোক নতুন অপেরা… এবার ওরা ফিরে আসবে।”

আলো ফেরত আসে হঠাৎ, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কিন্তু সেই আলোতে গ্যালারির উপরের সারিতে দেখা যায় কিছু অস্পষ্ট ছায়া। মাথাহীন, চোখবিহীন, অথচ বসে আছে যেন তারা দর্শক। কারও মুখ নেই, কারও পায়ে নেই দেহ, কিন্তু তবুও তারা আছে—মঞ্চের সামনে, শ্রোতার আসনে। সেই মুহূর্তে রুদ্রায়ন হঠাৎ বলে ওঠে, “তাহলে এবার আমরা জানি, কারা আমাদের দেখে যাচ্ছে। এবং কারা চাইছে আবার এই অপেরা শুরু হোক।” নায়রা কাঁপা গলায় বলে, “সামরিকা কি… তাদের একজন হয়ে গেছে?” কারও উত্তর নেই। শুধু একটি স্টেজ লাইট আবার নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে—মঞ্চের একদম মাঝখানে।

ছয়

রাত্রে বৃষ্টি পড়ছিল টুপটাপ করে। অ্যালিগ্রো থিয়েটারের ছাদের পুরনো টিনে সেই বৃষ্টির শব্দ যেন তবলার ছন্দের মতো কানে বাজছিল—তবে সে সুরের মধ্যে কোনো শান্তি ছিল না, বরং ছিল এক অজানা উদ্বেগের ঝঙ্কার। নায়রা লাহিড়ী নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে গত কয়েকদিনের অপূর্ব অথচ বিভীষিকাময় সব ঘটনা। সামরিকার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, স্টেজের আলো নিজের মতো করে জ্বলে ওঠা, মঞ্চের গহীন থেকে ভেসে আসা সুর—এগুলো আর নিছক কাকতালীয় বলে মেনে নেওয়া যায় না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল তার দিদিমা—উমা লাহিড়ী, যিনি এই থিয়েটারে সর্বশেষ পারফর্ম করেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। উমা’র মৃত্যুও হয়েছিল রহস্যজনকভাবে—মঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে, যদিও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। তার নিজের মা সেই সময়ের অনেক ঘটনা জানতেন, কিন্তু নায়রা যখন জানতে চেয়েছিল, তিনি শুধু বলেছিলেন, “থিয়েটারের গল্প থিয়েটারে থাক। ওটা বাঁচে, আবার মারে।”

নায়রা এবার নিজের ঘরে গিয়ে খুঁজে বার করে পুরনো একটি লোহার বাক্স—দিদিমার জিনিসপত্রের মাঝে রাখা। বহু বছর ছোঁয়া হয়নি সেটি। ধুলোমাখা বাক্সটা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে পুরনো রঙচটা একটা চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি। ভেতরে হাতে লেখা গান, অপেরা স্কোর, আর কিছুর সঙ্গে কিছু বিচিত্র লেখা—যার ভাষা পুরোপুরি বাংলা নয়, কখনো সংস্কৃত ছোঁয়া, আবার কখনো ল্যাটিন ধাঁচের। কিন্তু এক পাতায় স্পষ্টভাবে লেখা একটি লাইন দেখে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়—
“আমরা যারা অপেরার জন্য আত্মা বিক্রি করেছি, তারা আর মানুষ নই—আমরা গান।”
নায়রা পাতাগুলো ওলটায়, এবং দেখতে পায় একটি গান যা সে কখনো শেখেনি, কিন্তু গত রাতে ঠিক সেই সুর তার গলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গানের নাম—“আত্মার পুনরাবৃত্তি”। পাশে দিদিমার কাঁচা হাতে লেখা:
“এই গান একবার গাওয়া শুরু হলে, কার গান শেষ হয় আর কার শুরু—তা বোঝা যায় না। মঞ্চ হয়ে যায় আত্মার দরজা।”

ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই ডায়েরির একটি পাতা নিজে থেকেই পুড়ে যায়। আগুন কোথা থেকে এল, তা বোঝা যায় না, কারণ চারপাশে আগুনের কোনো উৎস নেই। কিন্তু সেই পুড়ে যাওয়া পাতার ছাইতে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত ছবি—মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি অন্ধকার ছায়া, যার মাথার জায়গায় ফাঁকা। সেই মুহূর্তেই পেছনের দেয়ালে টাঙানো আয়নায় নায়রা নিজেকে দেখে—কিন্তু তার প্রতিবিম্ব তাকিয়ে আছে ঠিক তার দিকে, যেন সে আয়নায় নেই, বরং বাইরে।

পরদিন রুদ্রায়ন এই সব শুনে স্তম্ভিত। সে বলে, “এটা কি তোমার দিদিমার চুক্তি ছিল? কোনো অপেরা সংগঠন না, বরং অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে?” অর্ঘ তখন বলে ওঠে, “তুমি কি জানো, ইউরোপের কিছু পুরনো অপেরা গায়ক ‘ভয়েস চুক্তি’ করত—যেখানে তারা নিজেদের কণ্ঠ স্বর্গীয় করার জন্য আত্মার বিনিময়ে সুর পেত। হয়তো উমা লাহিড়ী সেই চুক্তিরই অংশ ছিলেন।” ঋজু বলে, “তাহলে মঞ্চে যতবার আমরা ওই গান বাজাই, ততবার সেই শক্তিগুলো জেগে ওঠে?” নায়রা তখন বলে, “আর সেই শক্তি এখন শিল্পী খুঁজছে—নতুন ‘ভয়েস’ যার মাধ্যমে তারা ফিরে আসতে পারে। সামরিকা হয়তো তাদের দখলে চলে গেছে। আমাকে নিয়েও খেলা শুরু হয়েছে।” রুদ্রায়ন ধীরে বলে, “তবে এই খেলাটা আমরা শেষ করব।”

সেদিন রাত্রে থিয়েটার আবার খোলে—একটি অঘোষিত রিহার্সালের জন্য। কিন্তু এবার রুদ্রায়ন সিদ্ধান্ত নেয়, সেই ‘আত্মার গান’টাই গাওয়া হবে মঞ্চে। শুধু নায়রা নয়, সবাই সেই সুরে অংশ নেবে, এবং যদি কিছু জেগে ওঠে, তাদের প্রশ্ন করা হবে। সবাই মঞ্চে দাঁড়ায়, পেছনে অন্ধকার দর্শকদল—শূন্য চেয়ারে বসে থাকা অস্পষ্ট ছায়াগুলি যেন চোখে চোখ রাখে শিল্পীদের সঙ্গে। মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠে নিজের মতো। আর সেই মুহূর্তে নায়রার কণ্ঠে শুরু হয় সেই অপেরা—
“এ মঞ্চ নয়, এ গলির ধ্বনি, আত্মার ছায়া নাচে… ফিরে এসো, ফিরে এসো…”

সাত

যখন নায়রার কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে অ্যালিগ্রো থিয়েটারের চারপাশে, ঠিক সেই মুহূর্তেই থেমে যায় শহরের শব্দ। বাইরের গাড়ির হর্ন, ট্র্যাফিক, এমনকি দূরের ঘণ্টাধ্বনিও যেন জমে যায় সময়ের ওপারে। গানের প্রতিটি সুর যেন পিনিয়ে ঢুকে পড়ছে দেয়ালের ফাটলে, স্টেজের কাঠের ফাঁকে, আর দর্শকসারির প্রতিটি খালি চেয়ারে। নায়রার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রায়ন, ঋজু, অর্ঘ ও দিগ্বিজয়—কারো মুখে কোনো কথা নেই, কেবল চোখে থিতিয়ে থাকা অবিশ্বাস ও আতঙ্ক। গানের দ্বিতীয় স্তবক শুরু হতেই হঠাৎ করে থিয়েটারের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন কেউ ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠে। মঞ্চের গ্রীনরুমের দরজাগুলো নিজেরাই খোলামেলা শব্দে ধাক্কা খায়। আর সেই অন্ধকার গ্যালারির প্রথম সারিতে, একে একে আবির্ভূত হতে থাকে তারা—ছায়াদের দর্শকদল।

তাদের মুখ নেই, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। চোখ নেই, তবুও চোখ রাখছে শিল্পীদের উপর। কেউ মাথার উপরে ছাতা ধরে আছে, কেউ গলা চেপে ধরে রেখেছে অদৃশ্য কোন ক্ষত, আবার কেউ বুকের ভেতর থেকে বের করে রেখেছে ছেঁড়া অপেরা প্রোগ্রাম—যেন নিজেদের পরিচয় জানান দিতে চাইছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক দৃষ্টিটা পড়ে সামনের সারির মাঝের চেয়ারটিতে বসা ছায়াটির দিকে—একটু একটু করে তার মুখ গঠন নিতে শুরু করেছে, এবং সেটি ছিল সামরিকার! তার চোখ ফাঁকা, গলা কাটা, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে—গানের সঙ্গেই, এক ছন্দে। নায়রা গলা চেপে ধরে গান থামাতে চায়, কিন্তু তার কণ্ঠ থামে না—গান নিজের মতো চলতে থাকে। রুদ্রায়ন চিৎকার করে বলে, “গান বন্ধ করো! এটা তাদের ডাকছে!” কিন্তু নায়রার শরীর কাঁপছে, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, অথচ কণ্ঠ থেমে নেই। সে যেন এখন নিজের শরীরে নেই, তার দেহটা শুধু একটা যন্ত্র, যার মাধ্যমে সেই গানে আত্মারা ফিরে আসছে।

ঋজু তখন তৎপর হয়ে ওঠে। সে সাউন্ড কনসোলের মেইন সুইচ বন্ধ করতে যায়, কিন্তু তার আগে সে দেখতে পায়—একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, যা কাঁচের রিফ্লেকশনে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে নয়। সেই ছায়া ধীরে ধীরে তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “তুমি তো জানো না, ঋজু… আমাদের কণ্ঠ চুরি হয়েছিল। এখন আমরা তোমাদের কণ্ঠে ফিরছি।” ঋজু ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে পিছিয়ে যায়, আর সেই মুহূর্তেই নায়রা হঠাৎ থেমে যায়। নীরবতা। আবার নিস্তব্ধতা নেমে আসে থিয়েটারে। গ্যালারির ছায়ারা একে একে গলে যায় বাতাসে। সামরিকার মুখ ও শরীর মুছে যায় অন্ধকারের মধ্যে। শুধু তার ঠোঁটের শেষ বাক্য গায়—

“আমাকে ফিরতে দিও না…”

রুদ্রায়ন তখন নায়রার কাছে ছুটে যায়। সে কাঁপছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অর্ঘ তার গলা থেকে জল ঢেলে দেয়, এবং ধীরে ধীরে সে আবার স্থির হয়। কিন্তু তার চোখে এখনও সেই ভয়, যেন সে নিজের ভিতরে কিছু রেখে এসেছে। “তারা আমায় দিয়ে গাওয়াচ্ছিল,” বলে সে, “আমি চাইনি… তারা আমার গলা দখল করেছিল।” তখনই দিগ্বিজয় বলে, “এই গানটা… এই চুক্তির গান। যারা একবার গায়, তারা আত্মাদের কণ্ঠ হয়ে ওঠে।” অর্ঘ ফিসফিস করে, “তাহলে সামরিকা কি… তাদেরই একজন হয়ে গেছে?” রুদ্রায়ন বলে, “না, ও বেঁচে আছে। ও আজ সাহায্য করছিল, বুঝলে না? ও বলছিল ‘ফিরতে দিও না’। মানে তারা চায় ও পুরোপুরি চলে আসুক, আর ও চাইছে বাঁচতে।”

সেই রাতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই অপেরা আর চালানো যাবে না। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল, চুক্তি একবার শুরু হলে তাকে ভাঙা যায় না—সে নিজের গল্প শেষ না করে থেমে যায় না। পরদিন সকালবেলা থিয়েটারের সদর দরজায় দেখা যায় নতুন একটি সাদা পোস্টার, যেটা তারা কেউ সাঁটায়নি। তাতে লেখা— “প্রিমিয়ার নাইট: ‘আত্মার গান’ – ৭ দিনের মধ্যে। দর্শক প্রস্তুত থাকুন।”

— কণ্ঠহীন শিল্পী সংঘ

আট

রুদ্রায়ন, নায়রা, অর্ঘ ও ঋজু থিয়েটারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেন কেউ তাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে। পোস্টারে ছাপা অক্ষরগুলো অদ্ভুতভাবে জীবন্ত মনে হচ্ছিল, যেন তারা চোখের সামনে একটু একটু করে গেঁথে উঠেছে, আর শেষ লাইনের তলায় ছিল এক অদ্ভুত চিহ্ন—গ্রীক নাট্যমঞ্চের দুটো মুখ, একটি হাসি আর একটি কান্না, তবে দুটোরই চোখ গহ্বর ছিল ফাঁপা। দিগ্বিজয় ধীরে এসে বলে, “ওরা কথা রেখেছে। সপ্তরাত্রি শুরু হয়েছে আজ থেকে। তোমরা না চাইলেও, মঞ্চ জেগে উঠবে, আর গাইবে সেই গান। অপেরা হবে।” সবাই চমকে তাকায় তার দিকে। “তুমি কী বলতে চাইছো? কে ঠিক করেছে?” — রুদ্রায়নের প্রশ্নে দিগ্বিজয়ের কণ্ঠ কঠিন হয়ে ওঠে—“যারা এই চুক্তি করেছে, তারা শিল্পী নয়। তারা ‘ধ্বনি’—মৃত সুর, যাদের আত্মা এখনও অপেরা চায়। ওরা চলে যেতে চায়, কিন্তু তার জন্য দরকার সাত রাত—সাতটি গান—সাতটি মানব গলা।”

প্রথম রাত আসে শ্বাসরুদ্ধ করা নীরবতার সঙ্গে। মঞ্চ অন্ধকার, দর্শকশালা ফাঁকা—তবু যেন শত শত চোখ তাকিয়ে আছে। প্রথম পারফরম্যান্সে গান গায় ঋজু—মঞ্চে একা। গান তার নিজের তৈরি নয়, কেউ যেন তার ভিতর থেকে লিখে দেয়, সুর তোলে, উচ্চারণ ঠিক করে। সে গায়, চোখ বন্ধ করে, আর ঠিক তখনই পেছনের দর্শকাসনে একটা কুয়াশার পরতের মতো ভেসে ওঠে একটি আবছা নারীচরিত্র—গলা চেপে ধরে আছে, চোখে হাহাকার। গান শেষ হতেই সে মিলিয়ে যায়। রাত্রি এক—শেষ।

দ্বিতীয় রাতে পারফর্ম করে অর্ঘ সেনগুপ্ত। তার কণ্ঠে গায়কী নেই, কিন্তু গানের প্রতিটি শব্দ যেন নাটকের মতো উচ্চারিত হয়। আজকের গানটি গল্প বলছিল—একজন পরিত্যক্ত প্রেমিকার, যে অপেরার মঞ্চেই আত্মহত্যা করে, কারণ তার কণ্ঠ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অন্য এক শিল্পীর কাছে। গান চলাকালীন অর্ঘ তার শরীরের চারপাশে ঠান্ডা অনুভব করে, আর হঠাৎই তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় শেষ লাইনের আগে। সে দম নিয়ে বলে, “আমাকে মাফ করো, আমি… আমি শুধু শিল্পী।” আর ঠিক তখনই দর্শকদলের শেষ সারিতে বসা একটা ছায়ামূর্তি উঠে দাঁড়ায়, হাততালি দেয়। অর্ঘ মঞ্চ ছেড়ে নিচে নামতেই বলে, “ওরা খুশি।” — দ্বিতীয় রাত, শেষ।

তৃতীয় রাত্রির শিল্পী হয় রুদ্রায়ন নিজে। সে গান শুরু করে, কিন্তু এবার সে কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই নিজের ভিতরের ভয়কে ভাষা দিতে চায়। তার গান—একজন পরিচালকের, যে জানে তার নাটকের শেষ দৃশ্য আসলে তার নিজের মৃত্যু। থিয়েটারের দেয়াল থেকে গুঞ্জন ওঠে, সিলিং থেকে ঝরে পড়ে ধুলো। সেই মুহূর্তে একসঙ্গে চারটি ছায়া উঠে দাঁড়ায়, স্টেজের চার কোনা ঘিরে। রুদ্রায়নের চোখের সামনে তার নিজের ছায়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার শরীর থেকে—এগিয়ে যায় মঞ্চের এক কোণায়, যেখানে সামরিকা একসময় বসে গান শুনত। গান শেষ হলে ছায়ারা মাথা নোয়ায়। রুদ্র চোখ বন্ধ করে বুঝে নেয়—তৃতীয় রাতও পেরিয়ে গেছে।

চতুর্থ রাত্রিতে, দিগ্বিজয় ঘোষণা করে—আজ মঞ্চে কেউ গান গাবে না, কারণ আজকের গান মঞ্চ নিজেই গাইবে। কেউ মঞ্চে উঠবে না, কেবল বসে শুনবে। সেই রাত্রে সবাই দর্শক হয়ে যায়, এমনকি নায়রাও। তারা দেখে—মঞ্চের কাঠ নিজেই কাঁপছে, গলার স্বর ফাটছে বাতাসে, বাতিল ড্রামস থেকে সুর উঠছে, আর অন্ধকারে ভেসে আসছে দমবন্ধ ধ্বনি—মৃত শিল্পীদের গান, যাদের নাম আজ কেউ মনে রাখে না। বাতি বন্ধ, শব্দ খালি। রাত চতুর্থ, আর একটি ছায়া গলে মিশে যায় গ্যালারির ভেতরে।

এভাবেই একের পর এক রাত পেরোয়। পঞ্চম রাতে ফের নায়রা গান গায়—এবার তার দিদিমার সেই শেষ গান, যেটা সে আগে কখনোই শেখেনি, অথচ এখন গলা থেকে যেন আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে। গান শেষে মঞ্চের মাঝখানে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয় উমা লাহিড়ীর মুখাবয়ব, চোখে শান্তি, আর ঠোঁটে সেই চিরকালীন উচ্চারণ—”তুই পারবি, মা।”

তখনও তারা জানে না, সপ্তম রাতে কী অপেক্ষা করছে… আর কে গাইবে শেষ গান।

নয়

ষষ্ঠ রাত্রি নামতেই অ্যালিগ্রো থিয়েটার আবার রূপ নেয় এক ঘূর্ণিপাকে, যেন সময় আর বাস্তবের সীমা হারিয়ে ফেলেছে। বাতাসে ভেসে থাকে বালি আর পুরনো পারফিউমের গন্ধ, আর মঞ্চের চারপাশে অদ্ভুত শব্দ—কখনো করুণ কণ্ঠস্বর, কখনো মুচড়ে যাওয়া কাঠের আওয়াজ, কখনো ধ্বনির ভিতর ঢুকে থাকা কেঁদে ওঠা শিশু। আজ রাতে কেউই মঞ্চে গান গাইতে প্রস্তুত নয়। নায়রা ঘরে বসে নিজের গলা ছুঁয়ে দেখছে বারবার—সেই প্রাচীন গান, যা তার ভিতরে বাসা বেঁধেছে, তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। রুদ্রায়নের দৃষ্টিতে এবার ভয় নয়, এক অদ্ভুত ক্লান্তি। সে জানে, সপ্তম রাত্রির আগে আজকের রাতটাই নির্ধারণ করে দেবে—কে বাঁচবে, কে গাইবে, আর কে ফিরবে না।

অর্ঘ সেদিন সন্ধ্যায় কনসার্ট পিটের নিচে নামে—যেখানে সেই ‘ভয়েস চেম্বার’ ছিল। হালকা আলোয় দেয়ালের উপরে সে দেখতে পায়—পুরনো শিল্পীদের নাম, কেউ কেউ অদ্ভুত সাইন দিয়ে সাদা দেয়ালে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু হঠাৎ এক কোণে একটা ছোট পাথরের খোদাই—“আমরা যারা গিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে কেউ ফিরে আসেনি। শুধু কণ্ঠ ফিরে এসেছে।” অর্ঘ পিছিয়ে আসে, আর তখনই দেখতে পায় সামরিকার লাল স্কার্ফ—যেটা আগেই অদৃশ্য হয়েছিল—এখন জমে আছে দেওয়ালের ফাটলে, যেন তা কেউ ফেলে যায়নি, বরং বেরিয়ে এসেছে ভিতর থেকে। সে ছুঁতে যায়, কিন্তু আগেই বাতাস কেঁপে ওঠে, আর সেই দেওয়াল থেকে ঝরে পড়ে এক থেমে থাকা কণ্ঠস্বর—“আমার গান শেষ হয়নি…”

রাত ঠিক আটটায় মঞ্চে নিজে থেকেই শুরু হয় সুর। কে বাজাচ্ছে কেউ জানে না। কনসোল বন্ধ, সুইচ অফ, কিন্তু স্টেজে বাজছে অর্গান। ছায়ারা একে একে ফিরে আসে, এবার তারা দর্শক নয়, শিল্পী। তারা নিজেদের মতো করে নাচে, ছায়ায় ছায়া মেশে, আর তাদের মাঝখানে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয় সামরিকা। সে একেবারে বাস্তব, অথচ মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। চোখ দুটি ফাঁকা, গলা শুকিয়ে আছে, কিন্তু শরীর ঠিকঠাক। সে ধীরে ধীরে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে,
“তারা আমাকে দেয়নি মুক্তি। কিন্তু আমি গান পেয়েছি। এখন আমি তোমাদের মধ্যেই একজন।”

নায়রা সামনে উঠে আসে, চোখে জল, মুখে কথা নেই। সামরিকা হেসে বলে, “তুমি আমাকে ডাকোনি, কিন্তু আমি এসেছি। আজ রাতের গান আমার, আর কালকের মুক্তি তোমার।” এরপর সামরিকা গাইতে শুরু করে—কিন্তু এবার গানের ভাষা সেই ভাষা নয় যা মানুষ বোঝে। এটি মৃতদের ভাষা, ভাঙ্গা গলার, দহন থেকে জেগে ওঠা সুরের, যা কণ্ঠ পেরিয়ে শরীর কাঁপিয়ে দেয়। ছায়ারা মাথা নোয়ায়, মঞ্চ নত হয়, আর থিয়েটারের দেয়ালে পাতার মতো ঝরে পড়ে অদৃশ্য নাম।

রাত্রি শেষ হয়। সামরিকা আবার হারিয়ে যায়। আর দেয়ালে রক্তে লেখা একটি বাক্য দেখা যায়, “সপ্তম রাত—শেষ কণ্ঠ… জীবিত না মৃত?”

দশ

কলকাতার অদ্ভুত এক রাত। বাতাসে তীব্র সোঁদা গন্ধ, যেন কোনও পুরনো ফ্যাব্রিক পোড়া গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে ছায়া ও জলমাটির স্মৃতি। হ্যারিসন রোড ফাঁকা, থমথমে, আর অ্যালিগ্রো থিয়েটারের সামনে জড়ো হয়েছে কয়েকজন নীরব মানুষ—কেউ সাংবাদিক, কেউ প্রাক্তন শিল্পী, কেউ শুধু কৌতূহলী, অথচ প্রত্যেকের চোখে সেই এক ভয়—আজ সপ্তম রাত। থিয়েটারের ভেতরে নায়রা, রুদ্রায়ন, ঋজু, অর্ঘ, আর দিগ্বিজয় দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের এক পাশে। গত ছয় রাতের অভিজ্ঞতা তাদের কণ্ঠকে শুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা জানে—শেষ রাতকে থামানো যাবে না। চুক্তির শেষ রাত, যেখানে হবে চূড়ান্ত গান, সেই গান যার মধ্যে সমাধানও আছে, ধ্বংসও।

নায়রা জানে—এবার গান গাইবে সে। এটা সে চায় না, কিন্তু গান তো আর চাওয়ার বিষয় নয় আজ। সে মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়, চোখ বন্ধ করে, মনে মনে দিদিমার কথা ভাবে। ঠোঁটে আস্তে আস্তে জমে ওঠে সেই সুর, সেই অপেরা—“আত্মার গান”—যার প্রতিটি শব্দ সুর হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে প্রতিধ্বনিতে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন গান শুরুর প্রথম পঙ্‌ক্তি উচ্চারিত হয়, থিয়েটারের সমস্ত বাতি নিভে যায়। হঠাৎ স্টেজের সামনে আলো জ্বলে—সাদা আলো, নিঃশব্দ, আর তাতে দাঁড়িয়ে থাকে ছয়জন ছায়ামূর্তি—পূর্ববর্তী ছয় রাতের ‘শ্রোতা’। একে একে তারা মাথা নাড়ে, আর মঞ্চের পেছনের দরজার কাছে আবির্ভূত হয় সামরিকা—মুখে হাসি, চোখে চিরতরুণ ক্লান্তি।

“তুই পারবি,” সে বলে, “তুই যদি ওদের গল্প শেষ করে দিতে পারিস, তবে আমি মুক্তি পাব।”

নায়রা এবার গান শুরু করে, কিন্তু সে গায় নিজের মতো। চুক্তির সুর নয়, অভিশপ্ত পঙ্‌ক্তি নয়—সে গায় উমা লাহিড়ীর সেই হারিয়ে যাওয়া অপেরা, যার নাম ছিল “আলোর ডানায় ছায়া”। প্রতিটি শব্দ তার নিজের সৃষ্টি, তার নিজের ছন্দ, আর ঠিক তখনই থিয়েটার কেঁপে ওঠে—ছায়ারা চেঁচিয়ে ওঠে, আর মঞ্চের নিচ থেকে উঠে আসে এক শক্তিশালী ধ্বনি, যেন হাজার কণ্ঠে আর্তনাদ।

এক মুহূর্তে মনে হয় সব ভেঙে পড়বে—স্টেজ, গ্যালারি, দর্শকচেয়ার, বাতি—সব। কিন্তু নায়রার গলা থেমে যায় না। আর ঠিক যখন সে শেষ স্তবক গায়—“ফিরে এসো, আলো, ছায়াদের পেরিয়ে”—তখন পুরো থিয়েটার নিঃশব্দ হয়ে যায়। একটা গভীর নিস্তব্ধতা, যার মধ্যে কেউ নেই—না দর্শক, না ছায়া, না অভিশপ্ত সুর। বাতিগুলো আস্তে আস্তে জ্বলে ওঠে। মঞ্চ খালি। নায়রার পেছনে কেউ নেই।

রুদ্রায়ন, অর্ঘ, ঋজু উঠে আসে। তারা বুঝে যায়—সপ্তম রাত্রি পার হয়েছে। কিন্তু সামরিকা? সে কোথায়?

ঠিক তখনই থিয়েটারের পেছনের দরজা খুলে যায়। ভোরের আলো আসছে। আর আলোয় দেখা যায় সামরিকা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক বাইরে, রক্তমাখা পোশাক পরা, কিন্তু মুখে প্রশান্তি। “আমি ফিরতে পেরেছি,” সে বলে, “কারণ কেউ তাদের কথা শুনিয়েছে—একবারের জন্য হলেও। অপেরা শেষ হয়েছে। এখন তারা ঘুমোবে।”

রুদ্রায়ন একপা এগিয়ে এসে বলে, “তুমি ঠিক বলেছিলে, সামরিকা—গানই মুক্তি। কিন্তু গান হতে গেলে, কণ্ঠ শুধু মাধ্যম নয়, কণ্ঠ হতে হয় নিজের শর্তে।”

থিয়েটারের ভেতর শান্তি নামে বহু বছর পর। সাউন্ড কনসোল নিঃসাড়, মঞ্চ নিঃশব্দ, আর দেওয়ালে কে যেন মৃদু হাতে লিখে গেছে— “যখন কেউ আর কাঁদে না, তখনো সুর থাকে। সেই সুরই অপেরা।”

শেষ

1000042142.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *