Bangla - রহস্য গল্প

হীরের ফ্রেমে আঁকা মুখ

Spread the love

পবিত্র মুখার্জী


অধ্যায় ১:

কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত আর্ট গ্যালারি “চিত্রমন্দির”-এ সে বিকেলে অদ্ভুত একটা ভারী বাতাস ছিল—যেন মেঘ জমেছে, অথচ আকাশ ছিল পরিষ্কার। গ্যালারির দেয়ালে টাঙানো চিত্রশিল্পী অমিয় গুহর আঁকা ক্যানভাসগুলো নিয়ে দর্শক-সমালোচকরা চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছিল, কেউ বা ফিসফিস করে বলছিল, “অমিয় দার পরিণত ছবিতে এবার কিছু একটা অদ্ভুত আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।” অমিয় নিজে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, তার কাঁধে ঝুলছিল মাটির রঙের একটি ব্যাগ, আর চোখ চলছিল এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে—নিজেরই আঁকা ছবি যেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন সম্পূর্ণ অন্য সত্তা ধারণ করেছে। ঠিক সেই সময় সে থমকে দাঁড়াল—দেয়ালের একদম শেষদিকে, খানিকটা ছায়ার মধ্যে, একটা মাঝারি মাপের ছবির সামনে এসে সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। ছবিটা সে এক মাস আগে এঁকেছিল, গাঢ় নীল, কালচে ছায়া আর অস্পষ্ট রূপের এক নারীর মুখ, যার চোখে যেন এক যুগান্তকারী ক্লান্তি আর ভয় লুকিয়ে আছে। তার গলায় একটা লাল স্কার্ফ, চুল এলোমেলো, আর ঠোঁট অর্ধেক খোলা—ঠিক যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাওয়া। অমিয়ের মনে পড়ল, ছবিটা সে স্বপ্ন দেখে আঁকেছিল, এক অচেনা রাতের মধ্যে হেঁটে আসা এক মুখ, যে তাকে দেখে কাঁদছিল, অথচ কিছুই বলছিল না। ছবিটার নামও দিয়েছিল “অজানা”—কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, ছবির নারীর মুখটা আর তার জন্য অজানা নয়, যেন কোথাও দেখা হয়ে গেছে, অথবা কোথাও খুব কাছের এক ছোঁয়া থেকে জন্ম নিয়েছে।

একজন নারী গ্যালারির ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়াল—সাদা-কালো চেক করা শার্ট, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, আর হাতে একটা ছোট্ট নোটবুক। সে কয়েক মুহূর্ত ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই ছবিটার মডেল কে ছিলেন?” অমিয় চমকে তাকাল তার দিকে। “মডেল? কেউ না। এটা একটা স্বপ্নের মুখ,” সে জবাব দিলো। “আপনি নিশ্চিত?” নারীটি এবার সরাসরি তার চোখে তাকাল, গলায় একটু চিরাচরিত সাংবাদিক কৌতূহলের কাঁপন। “আমি সায়ন্তিকা সেন—‘অবজারভার ২৪x৭’-এর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। আমি একজন অজ্ঞাতপরিচয় মহিলার খুনের কেসে কাজ করছি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। খুনটি ঘটেছিল ঠিক এক মাস আগে, যখন আপনি বলছেন আপনি এই ছবি আঁকছেন। সেই মহিলার মুখ আর এই মুখ—হুবহু এক। আপনি বলছেন এটা আপনি স্বপ্নে দেখেছেন? না কি আপনি খুনের আগে কোথাও তাকে দেখেছিলেন?” প্রশ্নগুলো একের পর এক ধেয়ে এলো, আর অমিয় যেন হঠাৎ কোনো অদৃশ্য জালে আটকে গেল। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল, “আমি কখনো তাকে দেখি নি। এই মুখ শুধু আমার ঘুমের ভিতর এসেছিল, আমি জানি না এটা কার মুখ।” কিন্তু সায়ন্তিকার চোখে সন্দেহ আর কৌতূহলের ধোঁয়া গাঢ় হয়ে উঠছিল—কারণ বাস্তব এভাবে কল্পনার সঙ্গে মিলে যেতে পারে না, অন্তত তার সাংবাদিকতাজীবনের অভিজ্ঞতা তাকে কখনো সেটা শেখায়নি।

সন্ধে তখন গ্যালারির জানালার কাচে এসে হালকা অন্ধকার নামিয়ে দিচ্ছিল, আলো বদলে যাচ্ছিল ছবিগুলোর রঙে, আর অমিয় ধীরে ধীরে অনুভব করছিল, তার ছবির ফ্রেমের ভেতরে শুধু রঙ আর তুলির আঁচড় নেই—কিছু একটার নিঃশব্দ সাক্ষ্য রয়েছে, হয়তো কোনো অপরাধ, হয়তো কোনো আত্মা, অথবা হয়তো তার নিজের অতীতের কোনো অবচেতন ঘর থেকে উঠে আসা কাহিনি, যা এতদিন সে নিজেও জানত না। সায়ন্তিকা তখন ছবির মুখটিকে নিজের ফোনের একটি প্রাইভেট ফোল্ডারে থাকা অপরিচিত মৃতার ফটো সঙ্গে তুলনা করছিল—আর মুখদুটি যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব। “আপনার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে হয়তো আপনি একা নন, এই মুখও আপনাকে খুঁজে ফিরছিল,” সায়ন্তিকা হালকা স্বরে বলল, “এবং এখন, যখন দুজনের দেখা হয়ে গেল, আপনি কি সত্যিই বলতে পারেন আপনি কিছু জানেন না?” অমিয় আর উত্তর দিতে পারল না—সে অনুভব করল, তার সামনে রাখা ক্যানভাসটা যেন ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে, আর সেই নিঃশ্বাসে সে নিজেও যেন এক অপরিচিত ঘূর্ণিতে ডুবে যাচ্ছে, এক ছবি থেকে আরেক ছবির দিকে, এক মুখ থেকে আরেক জন্মের দিকে, যেখানে রহস্যের সূচনা আজ শুধু শুরু হলো।

অধ্যায় ২:

সেই রাতেই অমিয় গুহ তার দক্ষিণ কলকাতার পুরনো বাড়িতে ফিরে এল, কিন্তু ঘরটা যেন অচেনা ঠেকছিল। জানলার ধারে রাখা ক্যানভাসগুলো ধূসর আলোয় আরও বেশি ভারী হয়ে উঠেছিল, এবং প্রতিটি ছবির মধ্যে যেন লুকিয়ে ছিল একটা অপার্থিব চিৎকার, যে চিৎকার তার স্বপ্নেও প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছিল। সে একবার তাকাল সেই ছবিটার দিকে—‘অজানা’—যেটা গ্যালারিতে তাকে অনাহূতভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেই নারীর মুখের দিকে, যার নাম এখনও তার জানা নয়, কিন্তু যার অস্তিত্ব এখনো তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিক তখনই তার ফোনে একটা বার্তা এল—“আপনার ছবির মুখটা যদি বাস্তব হয়, তাহলে আমাকে কাল সকালে সময় দিন। আপনার বাড়িতে আসছি – সায়ন্তিকা সেন।” বার্তার সঙ্গে একটি মুখাবয়বের ছবি সংযুক্ত ছিল—নিউজ রিপোর্টে প্রকাশ না হওয়া অজ্ঞাতপরিচয় এক মহিলার পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ফরেনসিক রিকনস্ট্রাক্টেড স্কেচ। অমিয় ছবিটা বড় করে দেখল—এবং তার বুকের ভেতরটা যেন হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। মুখটা এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সে কোনোদিন তার জীবনে এসেছিল, কোনো কথার মতো, কোনো ছায়ার মতো, অথবা হয়তো সে কোনো অপরিণত ভালোবাসার, অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির মুখ। ঘুমাতে গিয়ে সে বারবার সেই মুখটাই দেখতে থাকল—কিন্তু এবার আর ক্যানভাসের মতো নীরব নয়, যেন মুখটা তাকে কিছু বলতে চাইছে, অর্ধেক বলছে, অর্ধেক চেপে যাচ্ছে।

পরদিন সকাল আটটা বেজে চল্লিশ, সায়ন্তিকা এসে দাঁড়াল অমিয়র দোতলার বারান্দায়। হাতে নোটবুক, চোখে চাপা ঘুম আর রাগ, এবং কণ্ঠে সেই একই দৃঢ়তা—যা তার প্রথম সাংবাদিক প্রতিবেদনেও ছিল, যখন সে কলেজে থাকতেই কলেজের লাইব্রেরিয়ান দুর্নীতির ফাঁস করেছিল। “আপনার ওই ছবির মুখটা আমার হাতে থাকা মৃতার ফরেনসিক স্কেচের সঙ্গে মিলে যায়,” সে বলল, সরাসরি কথা শুরু করে, “এবং এটা কাকতালীয় নয়, কারণ ছবিটা আপনি আঁকেন সেই একই সপ্তাহে, যখন ঐ মৃতদেহ পাওয়া যায় রেললাইনের পাশে, দক্ষিণ শহরতলির অজ্ঞাত জায়গায়। কেউ চিনতে পারেনি তাকে, ফোনে কোনো নাম্বার পাওয়া যায়নি, আঙুলের ছাপ মেলেনি কোনো ডেটাবেসে।” অমিয় স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। “আপনি বলছেন স্বপ্নে দেখেছেন মুখটা,” সায়ন্তিকা অব্যাহত রাখল, “কিন্তু আপনি কখনো কি এমন অনুভব করেছেন যে এই মুখটা কোথাও আপনি বাস্তবে দেখেছেন—হয়তো অনেক আগে? হয়তো ভুলে গেছেন?” অমিয় মাথা নাড়ল, কিন্তু দৃষ্টি দূরে, যেন কোনো পুরনো গলির দিকে তাকিয়ে আছে যেখানে কেউ হয়তো একদিন দাঁড়িয়ে ছিল, হাসছিল বা ডেকে বলেছিল, ‘আমাকে মনে রাখো।’ সায়ন্তিকা এবার অ্যালবাম থেকে বের করল আরও কিছু ছবি—একটা মেয়ের, যাকে একটা আর্ট এক্সিবিশনে পেছনে দেখা গেছে, কোথাও হয়তো দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল, পেছন থেকে তোলা, কিন্তু কনটেক্সট অনুযায়ী, তার উপস্থিতি অমিয়র পুরনো প্রদর্শনীর এক ছবির পেছনে ছিল। ছবির এক কোণায় নারীর মুখের আংশিক প্রতিবিম্ব ছিল—একটা লাল স্কার্ফ ঝুলছিল তার গলায়, আর মুখে সেই একই শূন্য দৃষ্টি।

এই আবিষ্কার অমিয়র হৃদয়জুড়ে এক অদ্ভুত আতঙ্কের রেখা টেনে দিল। তার মাথায় ঘুরছিল—সে কি তার আঁকা মুখের নারীর সঙ্গে কখনো দেখা করেছে? যদি করে থাকে, তবে কবে, কোথায়, কীভাবে সে ভুলে গেল? অথবা, এই মুখ তার স্মৃতির এমন এক খোপে বন্দী, যা সে নিজেও জানত না যে তার ভেতর আছে? “আমার মনে হয়,” অমিয় ধীরে ধীরে বলল, “আমি এই মুখটা বহু আগে কোথাও দেখেছিলাম… হয়তো তখন আমি কলেজে পড়ি। একবার কোনো প্রদর্শনীতে গিয়ে এক মহিলা আমার একটা ছবি নিয়ে কিছু বলেছিলেন—তাঁর চোখে এমনই এক ধরনের চাহনি ছিল। কিন্তু আমি তো নাম জানতাম না… আমি তো…” তার গলা হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে এলো, যেন কোনো পুরনো শ্বাস আটকে আছে গলার ভেতর। সায়ন্তিকা খেয়াল করল, অমিয়র কণ্ঠে এবার একটা অপরাধবোধের ছায়া। সে বলল, “আপনার যদি কিছু মনে পড়ে, আমাকে জানান। এটা শুধু তদন্ত নয়, হয়তো এই মুখ চাইছে কেউ তাকে চিনুক। হয়তো আপনি সেই কেউ।” দরজার বাইরে যাওয়ার আগে সে থেমে বলল, “আরেকটা কথা—এই মহিলার একটা হীরের কাজ করা ছোট ফ্রেমের পেনডেন্ট ছিল গলায়, যেটা খুনের জায়গা থেকে হারিয়ে গেছে। কেউ সেটা খুঁজে পেলে হয়তো চিহ্ন পাওয়া যাবে, কে তাকে চেয়েছিল হারিয়ে দিতে।” সেদিন দুপুরে, যখন অমিয় তার পুরনো বাক্সগুলো খুলে খুঁজছিল, হঠাৎ এক ভাঁজ কাগজের নিচে তার চোখ আটকে গেল—একটি হীরের ছোপ ছোপ করা ছোট পেনডেন্ট, যা সে কখনো কেনেনি, কখনো পরেনি, এবং যার অস্তিত্ব সে কল্পনাও করেনি—কিন্তু আজ যেন সেই পেনডেন্ট নিঃশব্দে বলে উঠল, “তুমি আমায় চিনতে পারো না, অথচ আমি অনেক আগে থেকেই তোমারই ছিলাম।”

অধ্যায় ৩:

রাত বাড়তেই অমিয় গুহের ঘরে ছায়াগুলো ঘনীভূত হতে শুরু করল, যেন দেওয়ালের ছবি আর জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো একসঙ্গে মিলেমিশে এক রহস্যময় জগতের দরজা খুলে দিচ্ছিল। তার চোখের সামনে টেবিলের ওপর রাখা সেই হীরের ছোপ ছোপ করা পেনডেন্টটা পড়ে ছিল—চকচকে নয়, বরং ধুলোমাখা অথচ অপার্থিব দীপ্তিতে জ্বলছিল, যেন কোনো এক নারীর শেষ নিঃশ্বাস এতে গেঁথে আছে। অমিয় পেনডেন্টটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়ার সময় অনুভব করল, এর গায়ে তার ছবিতে দেখা সেই মুখের অবয়বের মতোই কিছু খোদাই করা, ক্ষীণ, প্রায় অদৃশ্য রূপে—যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু রঙের মতো ছায়ায় ধরা পড়ে। তারপর সে নিজের পুরনো স্কেচবুকগুলো একে একে খুলতে লাগল, যেগুলো সে একসময় রেখেছিল নিজের শৈল্পিক জার্নালের অংশ হিসেবে। প্রথম কয়েকটা পাতায় পরিচিত ছায়া, পৌরাণিক নারী, মায়াবী চোখের রেখাচিত্র; কিন্তু তৃতীয় খণ্ডের মাঝখানে এসে তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল—সেখানে সে খুঁজে পেল ঠিক সেই মুখের অসম্পূর্ণ স্কেচ, যেটা সে স্বপ্নে দেখে আঁকেনি, বরং অনেক আগেই, কোনো জ্ঞাত কারণ ছাড়াই এঁকেছিল। তারিখ দেখে আঁচ করা গেল, বছর দেড়েক আগে কোনও এক জ্যৈষ্ঠ মাসে, বৃষ্টির রাতে, যখন সে প্রায় পনেরোটা স্কেচ একসাথে করেছিল, নিজেও না বুঝে কি আঁকছে—তাদের মধ্যে তিনটি মুখ ছিল রুবিনার মতো মুখের অনুরূপ। তার মন যেন তখনই কোনো অদৃশ্য স্মৃতির ফ্রেমে আটকে গিয়েছিল। অমিয় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, মাথার মধ্যে শব্দ ঘুরছিল—“তুমি আমায় চিনতে পারো না, অথচ আমি অনেক আগে থেকেই তোমারই ছিলাম।”

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্ত এল যখন সে নিজের একটা পুরনো তেলের পেইন্টিং বের করল, যেটা সে আঁকার পরেই পেঁচিয়ে রেখেছিল কাগজে আর তারপর আর কখনো খুলে দেখেনি—কারণ তার মনে হয়েছিল সেই ছবিটা অস্বাভাবিক। ক্যানভাসটা খুলতেই সে দেখতে পেল—এক অদ্ভুত, বৃষ্টিভেজা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী, তার কাঁধে সাদা ওড়না, গলায় সেই পেনডেন্ট, মুখে সেই চেনা বিষণ্ণতা। কিন্তু ভয়াবহ অংশটা ছিল ছবির পেছনে, যেখানে ছোট করে পেন্সিলে লেখা ছিল—“তার জন্য ফিরে আসবে”—আর নিচে লেখা তারিখ সেই রাতের আগের দিন, যেদিন রুবিনার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। অমিয় বুঝতে পারল, সে যা আঁকছিল, তা কেবল রঙ নয়, তা তার অবচেতনের অভিজ্ঞান—স্মৃতির এমন এক স্তর, যেটা তার আত্মার তলদেশ থেকে উঠে এসেছিল, আর এইসব ছবি যেন পূর্বাভাস ছিল, কোনো অন্ধকার ভবিষ্যতের ছায়া। সে বুঝতে পারল, এই সব ছবি, এই পেনডেন্ট, আর সেই নারী—সবকিছু একটা ভয়ংকর সূত্রে জড়িয়ে আছে, যার এক প্রান্তে রয়েছে তার নিজের মস্তিষ্কের অতল গহ্বর, আর অন্য প্রান্তে কোনো মৃত নারীর বিস্মৃত মুখ। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল, ছাদের টিনে শব্দ হচ্ছিল—ঠিক যেমন করে শব্দ হয়েছিল সেই রাতে, যেদিন রুবিনা নিখোঁজ হয়েছিল। সে জানে না কিভাবে, কিন্তু এখন সে নিশ্চিত, তার সঙ্গে এই খুনের কোনো গভীর যোগসূত্র রয়েছে, যদিও সে নিজে জানে না সেই সংযোগ বাস্তবের না স্বপ্নের, নাকি জন্মান্তরের।

পরদিন সকালে, সায়ন্তিকার ফোনে সে স্কেচবুকের ছবি পাঠাল, পেনডেন্টের ছবি সহ। সায়ন্তিকা মুহূর্তেই উত্তরে লিখল—“আমার মনে হয় এই পেনডেন্টটা রুবিনার, আমরা তার গলায় এমন কিছুই খুঁজছিলাম। কিন্তু আপনি বলছেন এটা আপনি নিজের জিনিস হিসেবেই পেয়েছেন?” অমিয় বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি কবে, কীভাবে পেয়েছি জানি না। এটা একটা পুরনো ট্রাংকে ছিল, যার নিচে ধুলোময় আঁচল আর কাগজের স্তরের নিচে চাপা ছিল। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না কেন এসব আঁকছিলাম।” সায়ন্তিকা এবার বলল, “তাহলে হয়তো আমাদের খুঁজতে হবে আপনার অতীতে। এমন কিছু হয়তো আছে যা আপনি মনে করতে চাইছেন না। হতে পারে, আপনার স্মৃতির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই খুনের সূত্র।” সেই কথা শুনে অমিয় ধীরে ধীরে উঠে গেল তার ঠাকুমার ঘরে, যে এখনও জীবিত এবং মাঝে মাঝে আজব গল্প বলে—স্বপ্ন, জন্মান্তর, আত্মার বন্ধন ইত্যাদি। ঠাকুমার ঘরের ছোট কাঠের সিন্দুকে একখানা ধুলোমাখা পুরনো চিঠি পেল সে, যার ওপরে লেখা—“শর্মিষ্ঠা গুহর হাতে পৌঁছাবে, যদি আমি আর ফিরে না আসি।” প্রেরকের নাম ছিল: রুবিনা আক্তার। অমিয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল—তার ঠাকুর্দা কি রুবিনাকে চিনতেন? এই চিঠি কেন এসেছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে একটা পুরনো প্রেম, এক বিশ্বাসঘাতকতা, অথবা এমন এক অপরাধ যা রঙের নিচে, ক্যানভাসের মধ্যে, আর ছবির পেছনের ছায়ায় চাপা পড়ে আছে—যার মুখ আঁকা, কিন্তু গল্প বলা বাকি।

অধ্যায় ৪:

সেই পুরনো চিঠিটার হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে অমিয় গুহ যখন নিজের আঙুল বোলাতে বোলাতে পড়তে লাগল, মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি অক্ষর নিঃশব্দে জীবন্ত হয়ে উঠছে, আর তার বুকের মধ্যে কোনো পুরনো ঘুমন্ত ইতিহাস ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। চিঠিটা ছিল বাংলায় লেখা, কাঁপা হাতে, কিন্তু শব্দগুলো পরিষ্কার—“শর্মিষ্ঠাদি, যদি আমি আর না ফিরি, যদি আমার খোঁজ না মেলে, তাহলে জানবেন—আমি কারও উপর ভরসা করেছিলাম, ভুল করেছি। কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করে দিই, কারণ ভালোবাসা কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না। আমার ছোট একটা পেনডেন্ট রইল, সেটা তাঁর কাছে আছে—যদি আপনি ওটা পান, বুঝবেন আমি তাঁকে শেষ মুহূর্তেও ভালোবাসতাম।” প্রেরকের নামটা নিচে ছিল—রুবিনা। অমিয় এই চিঠি হাতে নিয়ে ঠাকুমার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ঠাকুমা, আপনি কি চিনতেন রুবিনা নামের কাউকে?” শর্মিষ্ঠা গুহ একটু চমকে উঠলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “রুবিনা… রুবি… একদম কৈশোরের নাম। তুমি কীভাবে তার কথা জানলে?” অমিয় চিঠিটা সামনে ধরতেই তাঁর চোখে জল চলে এল। “ও ছিল তোমার ঠাকুর্দার এক পুরনো বন্ধু। ওর সঙ্গে কলেজে পরিচয় হয়েছিল তোমার ঠাকুর্দার, দুজনে একসঙ্গে অনেক ছবি আঁকত। ও আসত এখানে, বসত ওই বারান্দায়। আমি তখন বুঝতাম না, কিন্তু পরে বুঝেছি ওর চোখে ছিল না দেখা ভালোবাসার ছায়া। একদিন হঠাৎ করে ও হারিয়ে যায়—কারও কিছু বলেই না। আমি অনেক বছর পরে এই চিঠিটা পেয়েছিলাম, এক অচেনা কুরিয়ারে, কিন্তু ততদিনে তোমার ঠাকুর্দাও চলে গেছে।” শর্মিষ্ঠা এবার অমিয়র দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার ছবিগুলোয় মাঝে মাঝে আমি সেই মুখটা খুঁজে পেতাম। ভাবতাম, হয়তো শুধু কাকতাল, কিন্তু এখন দেখি, রুবি তোমার ছবির মধ্যে আজও বেঁচে আছে।”

অমিয়র মাথায় তখন ভয়ঙ্কর ঝড় বইছিল। তার জীবনে একবারও এই নাম বা এই গল্প কেউ বলেনি, অথচ তার নিজের ছবি, স্কেচ, এমনকি নিজের অজান্তে পাওয়া সেই পেনডেন্ট—সব কিছু যেন এই নারীর স্মৃতিতে বাঁধা। তাহলে কি সে অবচেতনে বহন করে চলেছে এক না বলা ইতিহাসের ছায়া? আর সেই ইতিহাসই কি তার ক্যানভাসে, তার তুলির আঁচড়ে বারবার ফিরে আসছে? রুবিনা যদি তার ঠাকুর্দার ভালোবাসা হয়ে থাকে, তাহলে তার মুখ এত স্পষ্টভাবে সে স্বপ্নে দেখল কেন? তার কি কোনো মানসিক প্রভাব কাজ করছে, না কি অন্যকিছু—অলৌকিক? সে এবার সায়ন্তিকাকে ফোন করে সব খুলে বলল—চিঠির কথা, ঠাকুমার স্মৃতির কথা, এমনকি ছবির পেছনে লেখা সেই অদ্ভুত বার্তার কথাও। সায়ন্তিকা ফোনের ওপাশে নিঃশব্দে শুনে বলল, “তাহলে হয়তো রুবিনার কাহিনি এখানে শেষ হয়নি। হয়তো সে যা বলতে চায় তা এখনো কেউ শোনেনি, তাই সে ফিরে আসছে… আপনার ছবির ভেতর দিয়ে।” সায়ন্তিকা এবার অনুরোধ করল, “আমি একবার আপনার সেই স্কেচ আর পেইন্টিংগুলো নিজের হাতে দেখতে চাই। আর যদি পারেন, সেই পুরনো ছবিটা দিন, যার পেছনে লেখা ছিল ‘তার জন্য ফিরে আসবে’। আমি এটাকে ফরেনসিক বিশ্লেষণে পাঠাতে চাই।”

সেই বিকেলেই সায়ন্তিকা তার ল্যাপটপ খুলে কিছু অনুসন্ধান চালাল, এবং এক প্রাইভেট আর্ট কালেক্টরের পুরনো এক্সিবিশন রেকর্ড ঘেঁটে পায়—একজন নারী, নাম রুবিনা আক্তার, যিনি ফ্রিল্যান্স আর্ট রিস্টোরার হিসেবে কাজ করতেন কলকাতার বিভিন্ন গ্যালারিতে, প্রায় দশ বছর আগে পর্যন্ত। তারপর হঠাৎ তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তার সঙ্গে কাজ করেছিলেন দেবজ্যোতি দত্ত, সেই একই ব্যক্তি যিনি এখন অমিয়র ছবি নিয়ে এক্সিবিশন আয়োজন করছেন। সায়ন্তিকার সন্দেহ ঘনীভূত হলো—একই নারী, দুটি সময়ের সঙ্গে যুক্ত, দুটি প্রজন্মের শিল্পীর জীবনে প্রবেশ করেছে—একজনের প্রেয়সী হিসেবে, আর হয়তো অন্যজনের অবচেতনে প্রেম বা স্মৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, রুবিনা যাদের সঙ্গে কাজ করতেন, তাদের মধ্যে কেউই এখন রেকর্ডে নেই, অনেকেই নাম পাল্টে ফেলেছে, কেউ হয়তো বিদেশে চলে গেছে, কেউ নিখোঁজ। সায়ন্তিকা বুঝতে পারল, কাহিনিটা শুধু একটি নারীর খুন নয়—এ এক পুরনো শিল্পজগতের অন্ধকার ইতিহাস, যেখানে প্রতিভা, প্রেম আর বিশ্বাসঘাতকতা একসঙ্গে ঘূর্ণি তৈরি করেছে। এবং সেই ঘূর্ণির কেন্দ্রে রয়েছে একটি হীরের ফ্রেমে আঁকা মুখ, যা একাধারে প্রেম, অভিশাপ আর অপরাধের চিহ্ন বহন করে চলছে, প্রজন্মান্তর ধরে।

অধ্যায় ৫:

রাত গভীর হলে অমিয় তার স্টুডিওর এক কোণে রাখা সেই ধূলিমাখা কাঠের বাক্সটা টানতে লাগল, যেটা তার ঠাকুর্দার ছবি ও আঁকার সরঞ্জাম দিয়ে ঠাসা ছিল। শর্মিষ্ঠা গুহ বলেছিলেন, তাঁর স্বামী, অর্থাৎ অমিয়র ঠাকুর্দা—অভিজিৎ গুহ—ছবির দুনিয়ায় এক সময় নাম করলেও পরে হঠাৎ করেই আঁকা ছেড়ে দেন। কেউ জানত না কেন, শুধু জানত যে তিনি একসময় দারুণ আবেগ দিয়ে শিল্প সৃষ্টি করতেন, আর তার ছবিতে প্রায়শই একটা নির্দিষ্ট নারীর মুখ ভেসে উঠত। বাক্স খুলতেই অমিয় একের পর এক পুরনো ক্যানভাস টেনে বের করতে লাগল—কিছু অর্ধেক আঁকা, কিছু একেবারে অজানা রং ও আকারে ভরা। ঠিক তৃতীয় স্তরের নিচে সে একটি চওড়া ক্যানভাস পেল, যেটার ওপর ঢাকনা দেওয়া ছিল এক ধরনের পাতলা কাপড় দিয়ে। কাপড়টা সরাতেই, ধুলোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল সেই মুখ—ঠিক সেই মুখ, যেটা আজ তার ছবির প্রতিটি টুকরোয় ফিরে ফিরে আসে, এবং যেটা রুবিনার মুখের সঙ্গে অবিকল মিলে যায়। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের বিষয় ছিল—এই ছবির নিচে পাতলা কালিতে লেখা ছিল “রুবি – ১৯৭৮”। ছবির নারীর চোখে একইরকম বিষণ্ণতা, একইভাবে মাথার একপাশে চুল পড়ে থাকা, একই পেনডেন্ট। ক্যানভাসের এক প্রান্তে একটুকরো কাঁচ লাগানো ছিল, যা দেখতে অনেকটা হীরের মতোই ঝলমল করছিল।

অমিয় বোঝার চেষ্টা করল, তার ঠাকুর্দা কীভাবে এই ছবি আঁকলেন—এক নারীর প্রতিচ্ছবি যিনি পরে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির রূপে আবির্ভূত হন, এবং যার মুখ আবার তার নিজের স্বপ্নে ফিরে আসে। এটা কি কাকতাল? না কি পারিবারিক স্মৃতির কোনও ছায়া তাকে অজান্তেই শোষণ করছে? শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আবার কথা বলতে সে নিচে নেমে এল, ঠাকুমা তখন মন্দ আলোয় বসে চায়ের কাপ ধরে ছিলেন। “এই ছবিটা কি আপনি আগে দেখেছেন?” অমিয় জিজ্ঞেস করল। শর্মিষ্ঠা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “দেখেছি, কিন্তু ততদিনে ও আঁকা বন্ধ করে দিয়েছিল। রুবি চলে যাওয়ার পরে, তোমার ঠাকুর্দা আর ছবি আঁকেনি, শুধু এই একটামাত্র ক্যানভাস রেখে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘যদি কোনোদিন কেউ ফিরে আসে, এই ছবিটা তাকে চিনিয়ে দেবে।’ আমি বুঝিনি তখন কী বলতে চাইছিল। তুমি তো তখন জন্মাওনি। কিন্তু তুমি ওর ছবি আঁকছো আজও, তোমার নিজের অজান্তেই। তার মানে, কিছু একটা ফিরে এসেছে।” অমিয়র হাত কাঁপছিল—সে এই ছবির কথা আগে জানত না, তবু কেন তার আঁকা ছবিগুলো এত একরকম লাগছে? শর্মিষ্ঠা বললেন, “ভালোবাসা, যদি সত্যি হয়, তা সময়ের গণ্ডি মানে না। হতে পারে, তোমার মধ্যে দিয়ে সে আবার ফিরে এসেছে। রুবির অপূর্ণ প্রেম কি তোমার হাত ধরে তার শেষ কথা বলতে চাইছে না?”

এই কথা মাথায় নিয়ে অমিয় আবার স্টুডিওতে ফিরে গেল এবং পেনডেন্টটা, ঠাকুর্দার ছবিটা এবং তার নিজের আঁকা ছবিগুলোর পাশে বসে থাকতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল, এই সবকিছু কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়। রুবিনা আক্তার শুধু একটি মৃত নারী নন, তিনি একাধারে স্মৃতি, প্রেম, প্রতারণা, এবং অপরাধের চিহ্ন। এবং সে-ই সম্ভবত এইসব চিহ্ন বহন করে চলেছে—তার রক্তে, তার মস্তিষ্কে, তার শিল্পে। সে একটা ছোট ডায়েরি খুলে লিখে রাখতে শুরু করল সব: কবে কী আঁকলো, কী দেখল, কী মনে পড়ল, কার মুখ কতটা পরিচিত। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল—সায়ন্তিকা এসে দাঁড়িয়ে। সে ক্যানভাসটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। “এই ছবি তো আমি পুলিশের অ্যানালাইসিস রুমে দেখেছি,” সে বলল, “ফরেনসিক স্কেচের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে এই মুখটা।” সে এবার অভিজিৎ গুহর ছবি, রুবিনার নাম, আর তার নিখোঁজ হওয়ার বছরের ঘটনার সঙ্গে তার নিজের রিপোর্টের সব তথ্য জোড়া লাগাতে শুরু করল। হঠাৎ সে বলল, “তুমি কি জানো, ১৯৭৮ সালে একটি নারীর রহস্যজনক আত্মহত্যার রিপোর্ট আছে—নাম নেই, পরিচয় নেই—কিন্তু জায়গাটা ওই একই অঞ্চল, যেখানে রুবিনার শেষ খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল।” অমিয় বলল, “তাহলে সে কি মারা গিয়েছিল? নাকি এখনকার খুনী রুবিনার নাম ব্যবহার করছে কাউকে আড়াল করতে?” সায়ন্তিকা ধীরে বলল, “হয়তো আমরা যা দেখছি তা আসলে অতীত ও বর্তমানের এক জটিল প্রতিসরণ—আর সত্যি লুকিয়ে রয়েছে সেই ফ্রেমের মধ্যে, যার ভেতর সময়ের সীমা হারিয়ে গেছে। এই মুখ, এই ছবি, আর এই স্মৃতি—সবকিছু ফিরে এসেছে, হয়তো ন্যায়বিচারের জন্য।”

অধ্যায় ৬:

সায়ন্তিকা সেন নিজের রিপোর্টিং ক্যারিয়ারে অনেক অদ্ভুত কেস দেখেছে—রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, এমনকি আন্তর্জাতিক হ্যাকিংও—কিন্তু এই প্রথম একটি ছবি, একটি স্বপ্ন, এবং একটি মৃত নারীর মুখ একসঙ্গে মিলে একটি খুনের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিজিৎ গুহর পুরনো ক্যানভাস দেখে সে যেন সময়ের পেছনে ফিরে গিয়েছিল, এবং সেই ছবির ভেতরে সেই মুখের ঠোঁট, চোখ ও ক্লান্ত বিষণ্ণতার রেখাগুলোর মধ্যে সে এমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিল, যা কেবল এক জীবনের নয়—বরং যেন এক প্রজন্মের পুঞ্জীভূত চাপা কান্না। সাংবাদিক হিসেবে তার অভ্যেস হল প্রতিটি টুকরো তথ্য জোড়া লাগিয়ে সত্য খুঁজে বের করা, এবং তাই সে শুরু করল নিজের একান্ত তদন্ত। প্রথমেই সে অনুসন্ধান করল “রুবিনা আক্তার” নামে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে কলকাতার কোনও আর্ট কলেজে ছাত্রীর অস্তিত্ব ছিল কিনা—আর আশ্চর্যের বিষয়, সে খুঁজে পেল একটি রেজিস্ট্রেশনের খোঁজ, যেখানে রুবিনা আক্তার নামে এক ছাত্রী ছায়ানট আর্ট ইনস্টিটিউটে এক বছরের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু রেকর্ড অসম্পূর্ণ, কোনো ঠিকানা বা পরিচয়পত্র নেই, শুধুমাত্র একটি পুরনো ফটোর কপি যা ধূসর হয়ে গেছে, তবুও সেখানে সেই মুখের ছায়া পরিষ্কার—যেন সময় ঘুরে ফিরে আজও তাকে খুঁজছে।

এরপর সায়ন্তিকা গেল গ্যালারি মালিক দেবজ্যোতি দত্তের কাছে, কারণ তার নাম উঠে এসেছে রুবিনার কাজের ইতিহাসে, এবং সে-ই এখন অমিয়র ছবি নিয়েও এক্সিবিশন চালাচ্ছেন। দেবজ্যোতি প্রথমে অস্বীকার করলেও যখন সায়ন্তিকা তার কাছে ১৯৭৮ সালের সেই পুরনো ছবি আর পেনডেন্টের ছবি তুলে ধরে, তখন সে একটু চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর বলল, “রুবিনা… হ্যাঁ, আমি তাকে চিনতাম। ও খুব ভাল আর্ট রিস্টোরার ছিল। ওর চোখ ছিল তীক্ষ্ণ—ছবির ফ্রেম আর পেইন্টের স্তরে লুকিয়ে থাকা রঙ বোঝার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সে অতিরিক্ত কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। একবার আমার একটা ব্যক্তিগত সংগ্রহ ঘাঁটতে গিয়ে সে একটা ছবির পেছনে কিছু পেয়ে গিয়েছিল—কিছু লেখা, যা আমি প্রকাশ করতে চাইনি। আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু সে হুমকি দিয়েছিল, বলেছিল সব মিডিয়ায় ফাঁস করে দেবে। তারপর… তারপর সে আর আসেনি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো চলে গেছে। আমি তো জানতাম না…” তার গলাটা শুকিয়ে গেল। সায়ন্তিকা বলল, “আপনি কি জানতেন সে মারা গেছে? খুন হয়েছে?” দেবজ্যোতি চোখ নামিয়ে বলল, “জানি না। আমি সত্যি কিছু জানি না।” কিন্তু তার কণ্ঠের ভেতর এক চিরাচরিত ছায়া ছিল—একটা ভয়ের ছাপ, যে ভয় সত্যির মুখোমুখি হওয়ার।

সেদিন রাতে সায়ন্তিকা সব তথ্য গুছিয়ে অমিয়কে পাঠাল এবং জানাল, “তোমার ছবিগুলো শুধু কল্পনা নয়, এটা একটা কেস স্টাডি। তুমি হয়তো দেখেছিলে কোনো ফ্রেমের পেছনে লুকানো সত্য, যেটা রুবিনা দেখেছিল, যেটার জন্য সে হারিয়ে যায়। আর এখন তুমি সেই চিহ্ন বহন করছ।” অমিয় উত্তর দিল, “আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে দিয়ে কিছু আঁকাতে চাইছে। আমার হাত নিজে চলছে, আমি বুঝতে পারি না কেন এঁকে ফেললাম কোনও মুখ, কোনো জায়গা, কোনো চোখ… তারপর খেয়াল করি, সেই জিনিস বাস্তবে কোথাও মিলে যাচ্ছে।” তখন সায়ন্তিকা বলল, “তুমি কি জানতে পারো কোন ছবি রুবিনা তোমার ঠাকুর্দার সংগ্রহে দেখেছিল, যে ছবির পেছনে কিছু লেখা ছিল?” অমিয় বলল, “একটা ক্যানভাস ছিল যার পেছনে হালকা আঁচড় ছিল, লেখা ছিল—‘প্রমাণ আমি না, ফ্রেমটা।’ আমি সেটাই দেখেছি। হয়তো রুবিনা সেই ফ্রেমেই সত্যির ছায়া দেখেছিল।” দু’জন তখন ঠিক করল, ছবির ফ্রেমটা খুলে দেখা হবে, হয়তো তার কাঠের ভেতর, তার পেছনে বা নিচে এমন কিছু আছে যা এতদিন কেউ দেখেনি। যে ছবিটা রুবিনা নিজে দেখে হুমকি দিয়েছিল ফাঁস করার, সেটাই হতে পারে সেই “হীরের ফ্রেমে আঁকা মুখ”—যার ফ্রেমে লুকিয়ে আছে এক খুন, এক ভালবাসা, এবং এক প্রজন্মের অপূর্ণ সমাপ্তি। অন্ধকার রাতে অমিয় স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে ছবিটা টেনে নামাল দেওয়াল থেকে। বাইরের কাঁচে আলতো করে বৃষ্টি পড়ছিল—ঠিক যেমন পড়েছিল রুবিনার নিখোঁজ হওয়ার রাতে। এবার সে প্রথমবার বুঝতে পারল, হয়তো তার স্বপ্ন, তার শিল্প, তার জন্ম—সবই কোনো অদৃশ্য সত্যের সাক্ষী, যে সত্য আজ ধীরে ধীরে রঙের স্তরের নিচ থেকে মাথা তুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

অধ্যায় ৭:

দেওয়াল থেকে নামানো সেই পুরনো ক্যানভাসটা স্টুডিওর মাঝখানে টেবিলে শুইয়ে দিল অমিয় গুহ। চারপাশে নিঃশব্দ, শুধু ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে আর বাইরে থেকে বৃষ্টির সুর যেন এক পুরনো দিনের সঙ্গীত হয়ে তার মনে দোলা দিচ্ছে। হাতের আঙুলে ধরা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সে খুব সাবধানে ফ্রেমের পেছনের কাঠ খোলার চেষ্টা করছিল—কেন জানে না, কিন্তু মনে হচ্ছিল যে এই কাঠের নিচে এমন কিছু আছে যা এতদিন অন্ধকারে চাপা ছিল। ফ্রেমের একটি কোণ খুলতেই একটি পাতলা কাঠের পাতের নিচে চাপা দেওয়া একটি পুরনো পার্চমেন্ট পেপার বেরিয়ে এল—চিঠির মতো মোড়ানো, কিন্তু তেল-রঙে কিছু দাগ লেগে গেছে। অমিয় ধীরে ধীরে খুলে দেখল, সেখানে হাতে লেখা কয়েকটি লাইন, ধ্বস্ত কালি, কিন্তু এখনও স্পষ্ট: “যদি আমি মারা যাই, এর পেছনে দেবজ্যোতি দত্ত দায়ী। আমার সংগ্রহে আছে এমন একটি ছবি, যা সে কখনও প্রকাশ হতে দেবে না। এই ফ্রেমে লুকোনো চিহ্নই তার অস্তিত্বের প্রমাণ।” নিচে লেখা—রুবিনা আক্তার। অমিয়র চোখ ধাঁধিয়ে গেল, সে বুঝল, এই লেখাটা সেই চিহ্ন যা রুবিনা হয়তো খুন হওয়ার আগে রেখে যেতে পেরেছিল। মানে এটা একটা সত্যের দলিল, যা তার ঠাকুর্দার ছবির ফ্রেমে চাপা ছিল এতকাল।

সে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে সায়ন্তিকাকে ডেকে পাঠাল, আর তখনই অনুভব করল—এই চিঠি যেমন এক সত্যি ফাঁস করতে চলেছে, তেমনি হয়তো কারও আতঙ্কেরও কারণ হবে। সায়ন্তিকা এসে ছবিটা দেখল, আর তারপর চিঠির ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে তার এক ট্রাস্টেড ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দিল। সে বলল, “এই কেসটা আর এখন কল্পনার মধ্যে নেই, এটা এখন বাস্তব—এখন আমাদের কাছে একটা লিখিত স্বীকারোক্তি আছে, একটা সরাসরি অভিযোগ, এবং একটা প্রমাণ যা গত ত্রিশ বছর চাপা ছিল।” তারা দুজন এখন বুঝতে পারছিল, রুবিনার মৃত্যুর রহস্য আসলে শুধুই কোনো প্রেমঘটিত কাহিনি নয়, বরং একটা সংগঠিত চক্রান্ত, হয়তো শিল্পের বাজার ঘিরে, হয়তো চুরি করা কোনো ছবি, অথবা কাউকে নিঃশেষ করার উদ্দেশ্যে করা এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু এই সবকিছুর কেন্দ্রে যিনি আছেন, সেই দেবজ্যোতি দত্ত, এখনও প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন, গ্যালারি চালাচ্ছেন, এবং অমিয়র ছবি বিক্রি করছেন—যার প্রতিটি ক্যানভাসে আজ রুবিনার মুখ বারবার ফিরে আসছে। সায়ন্তিকা বলল, “আমরা পুলিশের কাছে যাব, কিন্তু তার আগে যদি কিছু হয়ে যায়, তুমি সাবধানে থেকো। রুবিনার প্রেতভূত এই ঘরে নেই, সে তোমার হাতে আঁকা হয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে, কিন্তু যে মানুষটা আজও বেঁচে আছে, সে অনেক বেশি বিপজ্জনক।”

সেই রাতে অমিয় স্টুডিওর বাতি বন্ধ করল না। সে জানত, তার চারপাশে এখন কেবল রং আর ক্যানভাস নেই—এখন আছে স্মৃতি, ইতিহাস, এবং প্রতিহিংসার ধুলো জমা সত্য। সে চেয়ারে বসে ভাবছিল—রুবিনা আক্তার কেন সেই সময় হুমকি দিয়েছিলেন? কী এমন ছবি তিনি দেখেছিলেন দেবজ্যোতির সংগ্রহে, যা কারও ক্ষমতা নষ্ট করতে পারত? ফ্রেমের মধ্যে চাপা লেখা থেকে যে সত্য বেরিয়েছে, সেটা তো এখনই অনেক কিছু বলছে, কিন্তু সেই আসল ছবিটা কোথায়? সে কি এখনো কোথাও আছে? নাকি তা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে? হয়তো সেই ছবির মধ্যেই ছিল এমন কিছু—উদাহরণস্বরূপ, নকল শিল্পকর্ম, জালিয়াতির প্রমাণ, বা কাউকে অশ্লীলভাবে চিত্রিত করার চিহ্ন—যা দেবজ্যোতি প্রকাশ হতে দিতে পারেননি। সায়ন্তিকা তখন বলল, “আমরা যদি তোমার ঠাকুর্দার বাকি ছবি আর সংগ্রহ ঘাটি, হয়তো আর কিছু লুকোনো তথ্য পেতে পারি। ততদিনে আমার রিপোর্ট তৈরি হয়ে যাবে, এবং পুলিশে আমি সরাসরি এই ফ্রেম আর চিঠি জমা দেব।” তারা দুজনে বোঝে, সামনে এক দীর্ঘ লড়াই অপেক্ষা করছে। কিন্তু এখন একটাই সত্য—রুবিনা, যাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল, যাকে একটা মৃত্যু চিরতরে চুপ করিয়ে দিয়েছিল, তিনি আবার ফিরে এসেছেন—না শরীরে, না আত্মায়—বরং ক্যানভাসের রঙে, প্রেমের স্মৃতিতে, এবং একজন শিল্পীর হাতের অনিয়ন্ত্রিত তুলির মধ্য দিয়ে, যেন নিজেকে বলে যাচ্ছেন: “আমি হারাইনি, আমি এখনো আছি, আমার মুখ এখনো তোমার ছবিতে বেঁচে আছে।”

অধ্যায় ৮:

সকালে সূর্যের আলো যখন ধীরে ধীরে অমিয়র স্টুডিওর জানলা বেয়ে ভিতরে ঢুকছিল, তখন সে একটা ঘোরের মতো অবস্থায় বসে ছিল সেই ছবির সামনে, যার ফ্রেমে লুকিয়ে থাকা রুবিনার লেখা চিঠি রাতভর তার ভেতর এক নতুন বাস্তবতা জাগিয়ে তুলেছে। সে যেন নিজেকে আর শুধুই একজন শিল্পী বলে মনে করতে পারছিল না—আজ তার তুলির নিচে যে মুখ আঁকা হচ্ছে, তা শুধুই রঙ ও অনুপ্রেরণার ফল নয়, বরং এক মৃত নারীর স্মৃতির আদেশ। অমিয় জানে না কেন, কিন্তু তার মধ্যে এক অপরিচিত আকর্ষণ কাজ করতে শুরু করেছে—রুবিনার মুখের প্রতি, তার অতীতের প্রতি, এমনকি তার না বলা কাহিনির প্রতি। সে নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব অনুভব করছে—একদিকে বাস্তবিক ভয়, দেবজ্যোতি দত্তের মতো একজন ক্ষমতাশালী মানুষের বিরুদ্ধে সত্য ফাঁস করার ভয়; অন্যদিকে এক দুর্নিবার টান, যে তাকে রুবিনার হয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে খেয়াল করল, তার আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে একটা প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছে—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু সেই মুখ, কিন্তু তার চারপাশে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড, ভিন্ন চিত্রমণ্ডল, যেগুলো যেন প্রতিবারই এক নতুন গল্প বলে।

তবে এদিন সকালেই একটা অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে যায়। অমিয়র বাড়ির সামনে একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়ায়, আর সেখান থেকে নামেন দুজন লোক—একজন মাঝবয়সী, চোখে কালো চশমা, আর অন্যজন মোটা গলার আওয়াজে ফোনে কথা বলছেন। তারা নিজেদের পরিচয় দেন “সংগ্রাহক ও শিল্প সমালোচক” হিসেবে, এবং বলেন তারা অমিয়র ছবি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চান। অমিয় তাদের স্টুডিওতে বসতে দিলে তারা খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে প্রশংসা করতে থাকেন তার কাজের, বিশেষত সেই মুখের বারবার ফিরে আসা সিরিজটি। এরপর তারা অনুরোধ করেন একটি নির্দিষ্ট ছবি বিক্রি করার, যার পেছনে চিঠি পাওয়া গিয়েছিল। অমিয় বিনয়ের সঙ্গে বলেন, সেই ছবিটি বিক্রির জন্য নয়, এবং তা একটি ব্যক্তিগত গুরুত্ব বহন করে। ঠিক তখনই মোটা গলার লোকটি একটু ঝুঁকে ধীরে বলেন, “শিল্প যদি ব্যক্তিগত হয়, তবে তা কখনোই জনমানুষের হয়ে উঠতে পারে না। আপনি যদি এটাকে চিরকাল লুকিয়ে রাখতে চান, তবে আপনার ভবিষ্যৎ গ্যালারি কখনো আলো দেখবে না।” অমিয় বুঝে যায়, এটি একটি সরাসরি হুমকি, আর এই লোকগুলো যে দেবজ্যোতির পাঠানো লোক তা বুঝতে বাকি থাকে না। লোকগুলো চলে গেলে সে প্রথমে ভয় পেলেও, পরে যেন একরকম জেদ চেপে যায়—এই ছবিটা এখন শুধুমাত্র রুবিনার স্মৃতি নয়, এটা হয়ে উঠেছে সত্য ও অন্যায়ের মাঝের একটা লড়াই।

সন্ধ্যায় সায়ন্তিকা এসে পৌঁছায় রিপোর্টের আপডেট নিয়ে। সে জানায়, ফরেনসিক বিভাগ নিশ্চিত করেছে যে চিঠিটি ১৯৭০ দশকের শেষ দিকের কালি ও কাগজে লেখা, এবং স্বাক্ষর ও হস্তাক্ষর মিলেছে সেই সময়কার গ্যালারির কর্মীদের সাইন রেজিস্টারের সঙ্গে—যেখানে রুবিনা একবার একটি শিল্পসংগ্রহ পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। এই তথ্যগুলো পুলিশ গ্রহণ করেছে, এবং তদন্তে দেবজ্যোতি দত্তকে সন্দেহভাজন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে আইনি পথে যেতে গেলে প্রমাণ আরও দরকার, বিশেষত সেই আসল ছবি, যা রুবিনার উল্লেখে ছিল এবং যেটা হয়তো এখনো কোথাও আছে, বা হয়তো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সায়ন্তিকা বলল, “তুমি কি ঠাকুর্দার সংগ্রহে এমন কিছু দেখেছ যেটা অন্য ছবির থেকে আলাদা? হয়তো এমন কিছু যার মধ্যে লুকানো অর্থ আছে?” অমিয় মাথা নেড়ে বলল, “একটা ছবি ছিল, খুব ঘোলাটে, অনেকগুলো স্তরের রঙে ঢাকা, যেন বারবার পাল্টানো হয়েছে কিছু ঢাকার জন্য। আমি ওটা ঠিক চিনতে পারিনি, কিন্তু মনে হচ্ছে সেটাই হতে পারে। আমি আজ রাতে সেটা পরিষ্কার করব।” তখনই হঠাৎ বাতি ফ্ল্যাশ করে নিভে যায়। বাইরের রাস্তায় কারও পায়ের শব্দ, জানলার কাছে কেউ কি দাঁড়িয়ে ছিল? তারা দুজন চুপ করে থাকে, আর স্টুডিওর মধ্যে অদ্ভুত একটা ঠান্ডা অনুভূতি ভেসে ওঠে—যেন কেউ আছে, অথবা কোনো আত্মা এখন নিঃশব্দে দেখছে তাদের কাজ। এই মুহূর্তে তারা বুঝে নেয়—তাদের পেছনে শুধু মানুষ নয়, আছে ইতিহাসের ছায়া, আছে অন্যায় মৃত্যুর কান্না, আর আছে সেই মুখ, যেটি একবার আঁকা হয়ে গেলে আর মুছে ফেলা যায় না।

অধ্যায় ৯:

রাত গভীর হলে অমিয় তার স্টুডিওর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। আলো নরম করে দেওয়া, কফির কাপে ধোঁয়া উঠছে, আর সামনে রাখা সেই ঘোলাটে ছবিটা—যেটা তার ঠাকুর্দা আঁকতেন কিন্তু পরে হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ঢেকে ফেলেছিলেন বারবার নতুন স্তরের রঙে। এই ক্যানভাসটি অনেকটা মোটা, যেমন হয় দীর্ঘ সময় ধরে বারবার রঙ চাপানোর ফলে, আর অমিয় অনুভব করতে পারছিল যে তার নিচে কিছু লুকানো আছে। সে এবার নিজের হাতের ব্রাশ রেখে তুলল একটি নরম স্ক্র্যাপিং টুল, যাতে রঙ না কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে পুরনো স্তরগুলো উঠে আসে। খুব ধীরে, ধৈর্য ধরে সে স্ক্র্যাপ করতে লাগল এক কোণ থেকে—প্রথমে ধূসর রঙের স্তর উঠে এল, তারপর তার নিচে হালকা সেপিয়া টোন, আর তারপর… হঠাৎ দেখা গেল একটি নারীর চোখ। চোখ দুটি এমনভাবে আঁকা, যেন তারা ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে আছে, চিরন্তন এক প্রশ্ন নিয়ে। অমিয় থমকে গেল। তারপর আরও একটু স্ক্র্যাপ করতেই সে বুঝল, এটা আরেকটি মুখ—সেই চেনা মুখ—রুবিনার মুখ, কিন্তু এবার সে যে অভিব্যক্তি দেখল, তা তার আগের আঁকা মুখগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে ভয় আছে, কষ্ট আছে, কিন্তু তার থেকেও বেশি আছে প্রতীক্ষা, যেন এই মুখ এতদিন এই ক্যানভাসে ঘুমিয়ে ছিল শুধু এই মুহূর্তের অপেক্ষায়।

তবে ভয়ংকর ছিল ক্যানভাসের নিচে থাকা দ্বিতীয় স্তর। ওই মুখের নিচে ধীরে ধীরে দেখা গেল আরও একটি মানুষের অবয়ব—একজন পুরুষ, যার মুখ তেমন স্পষ্ট নয়, কিন্তু পাশে একটি চিহ্ন আছে—দেবজ্যোতি দত্তের গ্যালারির লোগোর আদি রূপ। এবার সব স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এই ছবিটি ছিল একটি যুগলচিত্র, হয়তো রুবিনা ও দেবজ্যোতির, এবং হয়তো সেই সময় তারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন বা যৌথভাবে কোনো আর্ট প্রজেক্টে কাজ করছিলেন। কিন্তু এই ছবির বর্ণভঙ্গি ছিল অস্বাভাবিক, যেন কেউ ইচ্ছা করে মুখ গুলো অস্পষ্ট করেছে—হয়তো লুকাতে চেয়েছে সম্পর্ক, ইতিহাস বা সত্য। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ছবির নিচে এক জায়গায় ক্ষীণ হস্তাক্ষরে লেখা: “সে প্রতারণা করেছিল কেবল আমার সঙ্গে নয়, আমার শিল্পের সঙ্গেও।” এই কথাটা পড়ে অমিয় বুঝে গেল, এই ছবির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই আবেগ, সেই আঘাত যা রুবিনার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সে হয়তো বিশ্বাস করেছিল, তার ভালোবাসা আর শিল্প একে অন্যের সঙ্গে জড়িত থাকবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা রইল তা শুধুই বেদনা আর ন্যায়ের প্রত্যাশা। এই ক্যানভাস এখন কেবল একটি ছবি নয়—এটা সাক্ষ্য, এটা দলিল, এটা এক নারীর শেষ আর্তনাদ, যা সে তুলির রঙে রেখে গেছে এক প্রজন্ম পরে পৌঁছনোর জন্য।

সকালে সায়ন্তিকা এসে পৌঁছাল এবং ক্যানভাসটা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। “এই ছবি যদি আদালতে পৌঁছায়, তবে দেবজ্যোতির বিরুদ্ধে একটি বড় চার্জ গঠন করা সম্ভব হবে,” সে বলল। “আর যদি না যায়?” অমিয় জিজ্ঞেস করল। সায়ন্তিকা উত্তর দিল, “তাহলে সত্য আবার চাপা পড়ে যাবে, ঠিক যেমন এই ছবির নিচে চাপা পড়ে ছিল এই মুখ, এই চোখ, আর এই চিৎকার।” তারা দুজনে মিলে ছবির প্রতিটি স্তর সংরক্ষণ করতে লাগল, ধাপে ধাপে রেকর্ড রাখল, যাতে কোন স্তরে কী রঙ ছিল, কোথায় কী লেখা ছিল, তার স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। এরপর সায়ন্তিকা একটি গোপন আর্ট বিশ্লেষণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করল, যারা আইনত ছবির সত্যতা যাচাই করে এবং একে আদালতে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। এইবার তারা নিশ্চিন্ত ছিল—এই ছবির প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙের স্তর, প্রতিটি লেখা সত্যকে সামনে নিয়ে আসবে। এবং যখন এই ছবি প্রদর্শিত হবে, তখন সবাই দেখবে কিভাবে একটি মুখ একটি যুগ পেরিয়ে সত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই রাতে, ছবি আবার টানানো হল স্টুডিওর দেয়ালে, তার নিচে লেখা হল একটি লাইন—“যার মুখ আঁকা থাকে, সে হারিয়ে যায় না।” বাইরে তখন মেঘ ছিল, হালকা বাতাস বইছিল, আর অমিয় অনুভব করল—রুবিনা, যার কাহিনি এতদিন রঙের নিচে চাপা ছিল, আজ হয়তো মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি—এই ছবির মধ্য দিয়ে সত্য প্রকাশ পাবে, কিন্তু শেষ প্রশ্ন রয়ে গেছে: দেবজ্যোতি দত্ত কি স্বীকার করবে তার অপরাধ, নাকি আবার নতুন কোনো ছায়ায় ঢেকে দেবে তার পেছনের ইতিহাসকে?

অধ্যায় ১০:

যেদিন ‘হীরের ফ্রেমে আঁকা মুখ’ এক্সিবিশনে উন্মোচিত হল, সেদিন কলকাতার শিল্পজগত যেন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল—একদিকে তারা যারা ছবিকে নিছক শিল্প বলে ভাবেন, আর অন্যদিকে তারা যারা জানেন শিল্পের ভেতরেও লুকিয়ে থাকতে পারে ইতিহাস, অপরাধ আর চিৎকার। গ্যালারির ভিতরে ভিড় ঠেলে একে একে প্রবেশ করছিলেন শিল্পী, সংগ্রাহক, সাংবাদিক ও একাধিক বিশিষ্ট মানুষজন। অমিয় গুহ নির্ভারভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক কোণে, তার পাশে সায়ন্তিকা, যাঁর চোখে ছিল একরাশ চাপা তৃপ্তি। দেয়ালে ঝোলানো ছবির সামনে থমকে গিয়েছিল বহু দর্শক—যে ছবির প্রতিটি স্তরে স্তরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল একটি নারীর মৃত্যুর পিছনের গল্প, একটি প্রতারিত সম্পর্ক, এবং সবচেয়ে বড় কথা—একজন শিল্পীর আত্মা, যিনি প্রতারিত হয়ে শেষ মুহূর্তে নিজের কণ্ঠ ছবির ফ্রেমে রেখে গিয়েছিলেন। ঠিক তখনই গ্যালারির মাঝখানে প্রবেশ করলেন দেবজ্যোতি দত্ত—অলস পায়ে, মুখে অদ্ভুত শান্তি, যেন তিনি জানেন এই চিত্র-সংঘর্ষ তাকে ছুঁতে পারবে না। তিনি ছবি দেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, তারপর সাংবাদিকদের ঘিরে বলেন, “এ এক কাল্পনিক নাটক, শিল্পের অপব্যবহার। মৃত মানুষদের নিয়ে আবেগ ছড়ানো এক ধরণের আত্মসন্তুষ্টি। আমি এই ছবি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করি।” তার কণ্ঠে ছিল চিরাচরিত আত্মবিশ্বাস, কিন্তু তার কপালের রেখা বলছিল ভিন্ন কথা।

সায়ন্তিকা তখন সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত প্রমাণ প্রকাশ করলেন—চিঠির ফরেনসিক রিপোর্ট, ক্যানভাসের প্রতিটি স্তরের আলোকচিত্র, রুবিনার রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই পেনডেন্ট যেটি একদা রুবিনার গলায় দেখা গিয়েছিল এবং পরে অমিয়র স্টুডিওতে পাওয়া গিয়েছিল। এই সমস্ত দলিল পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আগে একটিবার প্রদর্শন করা হয়েছিল শুধুমাত্র জনগণের সামনে, যাতে বোঝা যায় কীভাবে এক নারীর মুখ হয়ে উঠেছিল এক প্রজন্মের চাপা অপরাধের প্রতীক। দেবজ্যোতি কেঁপে উঠেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করলেন না। বরং বললেন, “আমি আইনের পথে যাব, এবং এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মামলা করব।” কিন্তু তখন এক প্রবীণ সমালোচক এগিয়ে এসে বললেন, “শিল্প কখনো ষড়যন্ত্র করে না, সে শুধু মুখ খুলে কথা বলে। তুমি কি মুখ থেকে মুখোশ সরাতে ভয় পাচ্ছ?” দেবজ্যোতি তখন আর কিছু বলেননি—চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে গ্যালারি ছেড়ে বেরিয়ে যান। তার বেরিয়ে যাওয়ার পর, এক তরুণ শিল্পী এসে অমিয়র কাছে মাথা নত করে বলেন, “আপনার এই ছবি আমাদের শিখিয়েছে—শিল্প মানে শুধু সৌন্দর্য নয়, সত্যের সাক্ষ্যও।”

রাত শেষে গ্যালারি যখন বন্ধ হয়, অমিয় স্টুডিওতে ফিরে এসে আবার ছবিটার সামনে দাঁড়ালেন। দেয়ালের আলোতে ছবির ভেতর সেই মুখ যেন নিঃশব্দে হাসছে—শান্ত, ক্লান্ত, কিন্তু মুক্ত। সে জানে না রুবিনার আত্মা কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু আজ আর সে ভয় পায় না, কারণ এখন তার শিল্প তার একার নয়—এটা এক অনন্ত কাহিনির ক্যানভাস, যেখানে সময়, স্মৃতি আর প্রতিশোধ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সে জানে, ভবিষ্যতে সে আরও অনেক ছবি আঁকবে, অনেক মুখ আসবে-যাবে, কিন্তু এই একটি মুখ—রুবিনার মুখ—চিরকাল তার রঙের ভেতর জেগে থাকবে। হয়তো একদিন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে, “এই মুখটি আপনি কেন এতবার আঁকেন?” তখন সে শুধু বলবে, “কারণ কিছু মুখ কেবল ছবি নয়—সেগুলো সময়ের সাক্ষী।” বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, যেমন হয়েছিল সেদিন রাতে যখন প্রথম রুবিনার মুখ তার স্বপ্নে এসেছিল। এবার সে জানে—সেই স্বপ্ন কোনো বিভ্রম ছিল না। সেই মুখ শুধু আঁকা হয়নি, সেই মুখ নিজের গল্প বলে গেছে—তুলির মধ্যে দিয়ে, ফ্রেমের ভিতর দিয়ে, সময়ের আঘাত চিরে। ‘হীরের ফ্রেমে আঁকা মুখ’ শুধু একটি ছবি নয়, আজ তা হয়ে উঠেছে ইতিহাসের দর্পণ।

 

সমাপ্ত

 

1000032690.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *