সুরজিৎ ব্যানার্জী
অধ্যায় ১ –
রাজবাড়ির প্রতিটি কোণে যেন আলো আর শব্দের উৎসব। বিশাল মুখার্জি প্রাসাদকে চারদিক থেকে সাজানো হয়েছে রঙিন আলোকমালায়, উঠোনে টাঙানো কাগজের লণ্ঠন থেকে শুরু করে বারান্দার শোভা বর্ধনকারী ঝাড়বাতি—সব মিলিয়ে যেন এক অভিজাত কল্পলোক। বিয়ের আগের রাত বলে উৎসবের রঙ আরও গাঢ়। অতিথিরা আসতে শুরু করেছে, কেউ দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কেউ ব্যবসায়িক সূত্রে ঘনিষ্ঠ, আবার কেউ কেবল সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য। প্রতিটি অতিথির মুখে বিস্ময় আর প্রশংসার ছাপ, কারণ মুখার্জি পরিবারের ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য এবং আতিথেয়তার জৌলুস তারা প্রত্যক্ষ করছে। বিশাল দরবার হলে তবলা আর সেতারের সুর ভেসে আসছে, একপাশে রান্নাঘরে চলছে অগণিত পদ তৈরির ব্যস্ততা—কষা মাংস, চিংড়ি মালাইকারি, মিষ্টির পসরা সাজানো হচ্ছে বড় বড় থালায়। মহিলারা রঙিন বেনারসি পরে আড্ডায় মেতে আছেন, পুরুষেরা সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর ব্যবসার গল্প টেনে যাচ্ছেন, আর শিশুরা হাসি-ঠাট্টা করে উঠোনজুড়ে ছুটোছুটি করছে। এই আনন্দমুখর পরিবেশের মধ্যেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ মুখার্জি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন, হাতে নিয়ে এলেন একটি লোহার তোরঙ্গ, যা দেখামাত্র সবার মুখে এক অন্যরকম গম্ভীরতা নেমে এল।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন পরিবারের কর্ণধার, বয়স তাঁর পঁয়ষট্টির কোঠায় হলেও কণ্ঠস্বর এখনও দৃপ্ত, চোখদুটোতে কঠোর শাসনের ঝলক। তিনি তোরঙ্গটি সবার সামনে রাখলেন এবং নিজ হাতে খোলার আগে কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন এই মুহূর্তে উপস্থিত সবার মনে গহনাটির মাহাত্ম্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তোরঙ্গ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঝলসে উঠল অদ্ভুত আলো—হীরের গহনা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে মুখার্জিদের কাছে। ভারী সোনার গলায় বসানো অসংখ্য হীরা, প্রতিটি পাথর যেন নিজের আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠছে। কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, এই গহনাটির সঙ্গে যুক্ত আছে পরিবারের ইতিহাস, তাদের গৌরব, এমনকি সমাজে তাদের মর্যাদার প্রতীক। অতিথিরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন, মহিলাদের চোখে মিশল লোভ ও মুগ্ধতা, পুরুষদের চোখে শ্রদ্ধা আর হিংসার মিশ্রণ। অনন্যা, রাজেন্দ্রপ্রসাদের কন্যা, যাঁর জন্য এই গহনাটি নির্ধারিত, তিনি একটু লজ্জা, একটু গর্ব আর খানিকটা ভয় মিশ্রিত আবেগে দাঁড়িয়ে রইলেন মায়ের পাশে। সুচিত্রা দেবী কঠিন মুখে তাকিয়ে থাকলেন—তিনি জানতেন, এই গহনাটি কেবল অলঙ্কার নয়, বরং তাঁদের পারিবারিক মর্যাদার অদৃশ্য শিকল, যেটি মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেও মুখার্জি পরিবারের সম্মান বহন করবে।
কিন্তু সেই দীপ্তির মাঝেই যেন নেমে এলো এক অচেনা অশুভ ছায়া। রাজবাড়ির হলঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, অনেকের চোখে অস্বস্তি, সন্দেহ আর শঙ্কা স্পষ্ট হলো। শিশুরা খেলার মাঝেই থেমে গিয়ে অদ্ভুত চাহনি দিল, যেন তারা বড়দের মনের টানাপোড়েন টের পাচ্ছে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ তোরঙ্গ আবার তালাবদ্ধ করে রেখে দিলেন সিন্দুকে, কিন্তু সেই মুহূর্তে অনেকেই লক্ষ্য করল—অরিজিতের দৃষ্টি গহনাটির ওপর অস্বাভাবিকভাবে স্থির ছিল, ইশিতা তার স্বামীকে কনুই দিয়ে ঠেলে ইঙ্গিত করলেও তাতে তার মনোযোগ ভাঙল না। গোপাল ম্যানেজারের ঠোঁটে ঝট করে দেখা দিল অস্বস্তিকর হাসি, আর অঞ্জলি গৃহপরিচারিকা নিচু চোখে এক ঝলক তাকিয়ে আবার কাজের ভান করল। সঙ্গীত বেজে চলল, অতিথিরা আড্ডায় ফিরে গেলেন, কিন্তু পরিবেশের ভেতরে এক অদৃশ্য উত্তেজনা জমতে থাকল। যেন সবাই অনুভব করতে পারছিল, এই ঝলমলে রাজবাড়ির অন্দরমহলে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যার ছায়া তাদের আনন্দমুখর উৎসবের ওপর ঘনিয়ে আসছে—অদূরেই অন্ধকারের গহ্বর অপেক্ষা করছে।
অধ্যায় ২ –
রাত যত গভীর হতে লাগল, রাজবাড়ির আলোকোজ্জ্বল সাজসজ্জার ভেতরে জমতে শুরু করল এক অদ্ভুত অস্বস্তি। অতিথিরা উৎসবে মেতে উঠলেও বাড়ির ভেতরের অন্দরমহলে জমল চাপা উত্তাপ। ড্রইংরুমের মোটা কার্পেট পাতা মেঝেতে বসে রাজেন্দ্রপ্রসাদের দুই ছেলে মুখোমুখি হয়ে কথা বলছিল, আর সেই কথাবার্তার তীব্রতা করিডোর পেরিয়ে কারও কারও কানে পৌঁছে যাচ্ছিল। অরিজিতের চোখে ছিল অস্থিরতা, ঠোঁটের কোণে অস্বীকারের ভঙ্গি, সে বারবার বাবার কাছে নিজের অবস্থান বোঝাতে চাইছিল, কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদের ভ্রুকুটি ও চেপে রাখা ক্রোধে পুরো পরিবেশ গাঢ় হয়ে উঠছিল। অরিজিতের ঋণের বোঝা এখন আর গোপন নেই—ব্যবসায়িক ব্যর্থতা, জুয়ার আসরে টাকার অপচয়, আর অবিশ্বাস্য ঋণখেলাপের খবর অনেকেই জেনে গিয়েছে। এদিকে ছোট ভাই সোমনাথ নীরব থেকে গেলেও চোখে মুখে লেখা ছিল ক্ষোভ, সে যে এই অব্যবস্থা সহ্য করতে পারছে না তা স্পষ্ট। তর্কের শব্দ মাঝে মাঝে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহপরিচারিকাদের কানে পৌঁছাচ্ছিল, তারা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করল—“এবার মনে হয় কিছু না কিছু ঘটবেই।”
অন্যদিকে, মহিলাদের জগতে শুরু হলো অন্যরকম টানাপোড়েন। সুচিত্রা দেবী, যিনি পরিবারের শৃঙ্খলার প্রতীক, সবার সামনে কড়া স্বরে জানিয়ে দিলেন—হীরের গহনা ছাড়া এই বিয়ে সম্ভব নয়। তাঁর চোখেমুখে যেন এক অদৃশ্য ভয় কাজ করছিল, কারণ তিনি জানতেন পরিবারের মর্যাদা ভেঙে গেলে সমাজে মুখ দেখানো কঠিন হবে। কিন্তু ইশিতা, অরিজিতের স্ত্রী, সবার সামনে না হলেও গোপনে বলছিল—“গহনাটার ওপর এত আঁকড়ে থাকার মানে কী? স্বর্ণ বা হীরা দিয়ে কি সংসার টেকে?” তার কণ্ঠে ছিল ঈর্ষা ও লোভ, যেন গহনাটা তার নিজের হাতে থাকলে সে অন্যরকমভাবে নিজের মূল্য প্রমাণ করতে পারত। অনন্যা, কনের আসনে বসে, মায়ের এই কঠোরতা মেনে নিতে পারছিল না। সে স্বভাবতই স্বাধীনচেতা, তার কাছে বিয়ে মানে ছিল নতুন জীবনের সূচনা, গহনা বা ঐতিহ্যের ভার নয়। তাই তার কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর ভেসে উঠল—“মা, আমাকে যদি সত্যিই সুখী দেখতে চান, তাহলে গহনার চেয়ে আমার পছন্দকে গুরুত্ব দিন।” এই কথায় সুচিত্রার চোখ জ্বলে উঠল, আর আড্ডায় বসা অন্য মহিলাদের মধ্যে চাপা হাসি ও ফিসফিস ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে অন্দরমহল ভরে উঠল সন্দেহ, অভিমান আর আড়াল করা ক্ষোভের অশান্ত স্রোতে।
সেই রাতেই কয়েক জায়গা থেকে শোনা গেল গহনাকে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্ক। গোপাল ম্যানেজারকে কারও কানে বলতে শোনা গেল—“এই গহনাটার মূল্য দিয়ে পুরো একটা ব্যবসা দাঁড় করানো যায়।” আর অঞ্জলি, গৃহপরিচারিকা, রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে অন্য পরিচারিকাকে বলল—“এত বড় গয়না যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে কারই বা খেয়াল থাকবে?” অরিজিত একসময় হঠাৎ গর্জে উঠল—“আমাকে সবসময় দোষারোপ করতে হবে কেন? শুধু আমি ঋণে আছি বলেই কি আমি চোর?” তার চিৎকারে চারপাশ থমকে গেল, অথচ তার দিকেই সবার চোখ সরে গেল সন্দেহের ছায়ায়। ইশিতা ঠোঁট কামড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন সে জানত কিছু একটা গোপন সত্য, যা এখনও প্রকাশিত হয়নি। রাজেন্দ্রপ্রসাদ ক্ষিপ্ত গলায় চুপ করালেন সবাইকে, কিন্তু তার গলার নিচে অদৃশ্য কাঁপন লুকানো ছিল। এভাবে রাত গভীর হলো, প্রাসাদের ভেতরকার আভিজাত্যের মোড়ক ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো অস্বস্তির গন্ধ—লোভ, অভিমান, নিয়ন্ত্রণ আর অবিশ্বাসের মিলিত সুরে রাজবাড়ি ভরে উঠল, যেন হীরের গহনাটি তাদের চোখে আর কেবল অলঙ্কার নয়, বরং অদৃশ্য অভিশাপের প্রতীক হয়ে উঠছে।
অধ্যায় ৩ –
প্রভাতের প্রথম আলোয় রাজবাড়ির চারপাশে যখন মোরগ ডাকছিল, তখনও ভেতরে ছিল উৎসবের পরশ। কিন্তু সকাল গড়াতেই অন্দরমহল থেকে ভেসে এল আতঙ্কের কান্না ও চিৎকার। খবর বেরোল—সিন্দুকের ভেতর রাখা হীরের গহনা নেই! যে তোরঙ্গটি রাত পর্যন্ত রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজ হাতে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, সেই তোরঙ্গ খোলা অবস্থায় পাওয়া গেল, আর তার ভেতর ফাঁকা। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না, ভেবেছিল হয়তো তাড়াহুড়োয় গহনাটা অন্য কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু বারবার খোঁজাখুঁজি, ম্যানেজারের খাতার হিসাবপত্র ঘাঁটা, এমনকি সমস্ত সিন্দুক ঘেঁটে দেখার পরও বোঝা গেল—গহনাটা সত্যিই উধাও। মুহূর্তেই প্রাসাদের আনন্দমুখর পরিবেশ ভেঙে গিয়ে যেন এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে গেল। অনন্যার সাজঘরে সিঁদুরকৌটো, বেনারসি, শাখা-পলা সব তৈরি থাকলেও, কনের মুখে স্নিগ্ধ হাসির বদলে ভর করল তীব্র ভয়। মেয়ে বিয়ের আগের রাতে এ কেমন অশুভ সংকেত—এই ভেবে সুচিত্রার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, আর তিনি হাহাকার করে উঠলেন, “এই গহনা ছাড়া বিয়ে হবে না, অসম্ভব!”
রাজেন্দ্রপ্রসাদ ক্ষিপ্ত হয়ে চারদিকে তাকালেন, তাঁর চোখে রক্তচক্ষুর মতো জ্বালা। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, “এই বাড়ির ভেতরে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। বাইরে থেকে এ চুরি সম্ভব নয়। তালার চাবি কেবল আমার কাছেই ছিল।” কথাগুলো শুনে অতিথিদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল, একেকজন একেক নাম ফিসফিস করে উচ্চারণ করল। কেউ বলল—“অরিজিত তো ঋণে ডুবে আছে, হয়তো তিনিই…” আবার কেউ বলল—“ইশিতা সবসময় গহনাটির দিকে তাকিয়ে থাকত…” কারও কারও দৃষ্টি গিয়ে পড়ল গোপালের দিকে, পুরোনো ম্যানেজার যার অতীতে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। অঞ্জলি, যে ভোরে ঝাঁট দিতে এসে সিন্দুক খালি দেখে চিৎকার করেছিল, তাকেও সন্দেহ থেকে রেহাই দেওয়া হল না। প্রাসাদের ভেতরকার প্রতিটি মানুষ হঠাৎ অভিযুক্ত হয়ে উঠল, আর চারপাশে এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এল। অতিথিরা কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল—“দেখেছ? এত ঐশ্বর্য, এত ঐতিহ্য, কিন্তু ভিতরে এরা কতটা ভঙ্গুর।” কানাঘুষির ঢেউ যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, প্রত্যেকে নিজের সন্দেহটা গোপন করে অন্যের কানে ফিসফিস করে ঢালতে লাগল।
এদিকে অনন্যা কান্নাভেজা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল—“বাবা, গহনা ছাড়া কি সত্যিই বিয়ে সম্ভব নয়? আমি চাই না আমার নতুন জীবনের সূচনায় এত অশান্তি থাকুক।” কিন্তু সুচিত্রা তাকে থামিয়ে দিলেন, গলার স্বর কঠিন করে বললেন—“তুমি বুঝবে না অনন্যা, এই গহনা শুধু অলঙ্কার নয়, আমাদের পরিবারের মানসম্মানের প্রতীক। সমাজে মুখ দেখানোর সাহস থাকবে না যদি এই গহনা ছাড়াই তোমার বিয়ে হয়।” মায়ের এই একগুঁয়ে কথায় মেয়ের মুখ আরও নিস্তেজ হয়ে গেল, আর রাজেন্দ্রপ্রসাদ মুঠি বাঁধা হাতে ঘোষণা করলেন—“চোরকে আমি খুঁজে বের করবই। এই বাড়ি থেকে কেউ বেরোবে না যতক্ষণ না গহনা ফেরত আসছে।” তাঁর কণ্ঠে বজ্রের মতো গর্জন, আর অতিথিদের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কেউ মুচকি হাসল, কেউ আবার আতঙ্কে নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু সবার মনের ভেতর একই প্রশ্ন বাজতে থাকল—“চোর কে? আর সে কি সত্যিই এই পরিবারের ভেতরেই?”
অধ্যায় ৪ –
প্রাসাদের ভেতর আতঙ্ক যখন ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে, তখন প্রথম আঙুল তুলল সময় ও পরিস্থিতি নিজেই—অরিজিতের দিকে। পরিবারের ছোট-বড় সবাই জানত, তার ব্যবসার অবস্থা শোচনীয়, ঋণ শোধ করার মতো সামর্থ্য নেই, আর চারদিক থেকে পাওনাদারদের চাপ বাড়ছে প্রতিদিন। যে কোনো মুহূর্তে আইনগত জটিলতায় পড়ে যেতে পারে—এমন পরিস্থিতিতে টাকা জোগাড় করাই তার প্রথম প্রয়োজন। গহনাটির অমূল্য দাম তার জন্য যেন ছিল একরকম উদ্ধারকর্তার প্রতীক। তাই যখনই হীরের গহনাটি নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়াল, সবার চোখে প্রথম যে মুখ ভেসে উঠল, তা অরিজিতেরই। রাজেন্দ্রপ্রসাদ গর্জে উঠলেন—“অরিজিত, তুমি কি এত নিচে নামতে পারলে?” কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ, আর চোখে ছিল একরকম অবিশ্বাস। অরিজিত তীব্র প্রতিবাদ করল, বলল—“বাবা, আমার ঋণ আছে ঠিকই, কিন্তু আমি আপনার ছেলে। আমি কি চোর?” তার কণ্ঠে ছিল আহত গর্ব, কিন্তু সন্দেহের ছায়া ঘরের মধ্যে এত ঘন হয়ে উঠেছিল যে তার কথায় কেউ আশ্বস্ত হতে পারল না। অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ কানে কানে বলছিল—“যার কাছে প্রয়োজন আছে, তাকেই আগে সন্দেহ করতে হয়।”
কিন্তু সন্দেহের দৃষ্টি কেবল অরিজিতেই থেমে থাকল না। ইশিতার নামও দ্রুত সামনে চলে এলো। গহনাটির প্রতি তার অস্বাভাবিক আকর্ষণ, বারবার দৃষ্টি স্থির করে তাকানো—এসব আগেই অনেকের চোখে ধরা পড়েছিল। শাশুড়ির কাছে অজুহাত দেখিয়ে সে প্রায়ই গহনার প্রসঙ্গ তুলত, যেন একে নিজের হাতে পাবার ইচ্ছা লুকোতে পারছিল না। যখন তর্কাতর্কির সময় সে স্পষ্ট বলেছিল—“গহনাটা থাকলেই বা কী হবে, সংসার কি কেবল হীরা দিয়ে চলে?”—তখন অনেকেই ভেবেছিল কথার আড়ালে অন্য কোনো ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এখন গহনাটা নিখোঁজ হতেই তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া শুরু হলো। ইশিতা প্রতিবাদ করে বলল—“আমি লোভ করেছি মানে এই নয় যে আমি চুরি করেছি!” কিন্তু তার চোখের ভেতরকার অস্থিরতা, ঠোঁটের কাঁপন, আর স্বরে রক্ষার ভঙ্গি—সবই আশেপাশের মানুষকে আরও সন্দিগ্ধ করে তুলল। মহিলাদের আড্ডায় ফিসফিসানি শুরু হলো, “বউমা কি সত্যিই গহনাটা হাতে নিতে চাইছিলেন? তবে কি…” এইভাবে একে একে প্রতিটি বাক্য যেন অভিযোগের শলাকা হয়ে তার দিকে ছুটে গেল।
গোপাল ম্যানেজারের কাহিনি আবার নতুন করে আলোচনায় এলো। রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী হলেও তার অতীত কলঙ্কমুক্ত ছিল না। একসময় তহবিল থেকে টাকার গরমিল ধরা পড়েছিল, যদিও রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাকে ক্ষমা করে আবার কাজে রেখেছিলেন। সেই ঘটনা এখন নতুন করে সামনে আসতেই অনেকেই বলল—“যে একবার হাত কালো করেছে, সে আবারও করতে পারে।” গোপাল কাঁপা গলায় শপথ করে বলল যে সে নির্দোষ, কিন্তু তার চোখেমুখের আতঙ্ক কাউকে আশ্বস্ত করতে পারল না। অন্যদিকে অঞ্জলি গৃহপরিচারিকা, যে প্রথম চিৎকার করে খবর দিয়েছিল, তাকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া গেল না। কারণ তার মুখে বারবার ভয়ের ছাপ ধরা পড়ছিল, আর সেই ভয়ে কেউ কেউ ভেবেছিল—“নিশ্চয়ই কিছু জানে, তাই এত ভয়।” ফলে রাজবাড়ির প্রতিটি মানুষ যেন অভিযুক্ত হয়ে উঠল, প্রতিটি চোখের চাহনি যেন গোপনে অপরাধের ছায়া বহন করছে। অতিথিরা নিঃশব্দ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল, নিজেদের মধ্যে কানাঘুষি করছিল—“চোর তো এই ঘরের ভেতরেই আছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।” এভাবে প্রাসাদের ভেতর বিশ্বাসের ভাঙন আরও গভীর হলো, আর প্রত্যেকেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল একেকজন অভিযুক্ত, একেকজন রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু।
অধ্যায় ৫ –
প্রাসাদের ভেতরে যখন আতঙ্ক, কানাঘুষি আর সন্দেহের আবহ ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন সকালের শেষ ভাগে এসে পৌঁছালেন স্থানীয় থানার পরিদর্শক বিকাশ সেন। লম্বা, দৃঢ়চেহারার এই পুলিশ অফিসারকে দেখে রাজবাড়ির লোকদের মনে যেমন সামান্য ভরসা জন্মাল, তেমনি আবার এক ধরনের অস্বস্তিও ছড়িয়ে পড়ল। তিনি ঢুকেই ঘোষণা করলেন—“এখন থেকে এই বাড়ির ভেতরকার প্রতিটি কোণ আমি খুঁজে দেখব, আর তোমাদের প্রত্যেককে জেরা করা হবে। সত্য গোপন করলে কেউ রেহাই পাবে না।” তাঁর কণ্ঠে ছিল এমন এক দৃঢ়তা, যা মুহূর্তেই সকলকে নিস্তব্ধ করে দিল। প্রথমেই তিনি তোরঙ্গ পরীক্ষা করলেন, তালার গঠন, ভাঙার কোনো চিহ্ন, চাবির অবস্থা—সব বিশদভাবে খতিয়ে দেখলেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তালা ভাঙা হয়নি; সেটি ঠিক আগের মতোই খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল। অর্থাৎ যিনি গহনাটা নিয়েছেন, তিনি চাবির নাগাল পেয়েছিলেন। এই তথ্য জানাজানি হতেই সবার মনে সন্দেহ আরও গভীর হলো—চোর কি তবে পরিবারের কেউ, নাকি অত্যন্ত কাছের কোনো ব্যক্তি?
বিকাশ সেন তদন্তের কড়াকড়ি শুরু করলেন। প্রতিটি ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো—শোবার ঘর, অতিথিকক্ষ, এমনকি পরিচারিকাদের কোণও বাদ গেল না। কিন্তু কোথাও গহনাটির কোনো হদিস মিলল না। কাপড়চোপড়, আলমারি, ড্রয়ার, এমনকি বালিশ ও কোলবালিশ কেটে দেখা হলো, তবু ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু আসেনি। এরপর শুরু হলো জেরা। একে একে রাজবাড়ির প্রত্যেককে আলাদা করে বসানো হলো এবং কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করা হলো। প্রথমে অরিজিত—যার ঋণ এবং আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে এতদিন গোপনে কথা হচ্ছিল, সেটি পুলিশের প্রশ্নে স্পষ্ট হয়ে উঠল। অরিজিত বারবার বলল—“আমার ঋণ আছে ঠিকই, কিন্তু বাবার মুখে কলঙ্ক লাগিয়ে আমি কিছুতেই বাঁচতে পারব না।” তার কণ্ঠে ছিল মরিয়া ভঙ্গি, কিন্তু চোখে অস্থিরতা ছিল স্পষ্ট। এরপর ইশিতা—পুলিশ যখন তার দিকে তাকাল, তখন সে স্নায়ুচাপে কাঁপছিল। বিকাশ সেন ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন—“আপনি কি গহনাটিকে খুব পছন্দ করতেন?” প্রশ্ন শুনে ইশিতা গম্ভীর গলায় বলল—“আমি চাইতাম ওটা আমার হোক, কিন্তু লোভ মানেই চুরি নয়।” তার স্বীকারোক্তি যেন উল্টোভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াল, কারণ উপস্থিত সবাই জানল, সে গহনাটির প্রতি আকৃষ্ট ছিল।
কিন্তু পুলিশের তীক্ষ্ণ প্রশ্নোত্তরে বেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক গোপন সত্য, যা হয়তো এতদিন চাপা ছিল। জানা গেল, গোপাল ম্যানেজারের আগের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা কেবলই গুজব নয়, সত্যিই তার বিরুদ্ধে সন্দেহ ছিল। আরও জানা গেল, পরিবারের ভেতরে শুধু আর্থিক নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতাও আছে। ইঙ্গিত মিলল এক গোপন পরকীয়ার—যার নাম মুখে কেউ বলল না, কিন্তু বিকাশ সেন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা টের পেলেন। অনন্যার অস্বস্তি, ইশিতার হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা, আর অরিজিতের অপরাধবোধ মিশ্রিত নীরবতা—সবকিছু একসাথে মিলে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করল। অতিথিদের সামনে যতই প্রভাবশালী চেহারা দেখাক, এই পরিবার আসলে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে। ব্যবসার মন্দা, অকারণে টাকা অপচয়, একে অপরের ওপর অবিশ্বাস, আর সম্পর্কের ভাঙন—সবই ধীরে ধীরে পুলিশের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু যতই দ্বন্দ্ব আর রহস্য ফাঁস হোক না কেন, গহনাটির হদিস মেলেনি। বিকাশ সেন গভীর গলায় বললেন—“এই কেস যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। এখানে শুধু গহনার চুরি নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে বহু বছরের চাপা ক্ষোভ আর গোপন রহস্য।” তাঁর এই মন্তব্যে সবাই চুপ করে গেল, আর প্রাসাদের বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। গহনা এখনও অদৃশ্য, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সম্পর্কের ভেতরের দাগগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
অধ্যায় ৬ –
রাজবাড়ির অশান্ত পরিবেশ যখন ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে, তখনই হঠাৎ করে এক অচেনা আগন্তুক এসে হাজির হলো—অরিন্দম রায় নামের এক যুবক। লম্বাটে গড়ন, গাঢ় রঙের শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে অদ্ভুত এক তীক্ষ্ণতা—প্রথম দেখায় তাকে বিশেষ কেউ গুরুত্ব দিল না। দরবার হলে বসে থাকা রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন—“আপনি কে?” শান্ত গলায় অরিন্দম উত্তর দিল—“আমি অরিন্দম রায়। আমার বাবা প্রয়াত দেবেন্দ্র রায়ের সঙ্গে আপনার বহুদিনের পরিচয় ছিল। শুনেছি এই বিয়ের আয়োজন চলছে, তাই শুভেচ্ছা জানাতে চলে এলাম।” কথার ভেতর ছিল অচেনা ভদ্রতার ছাপ, কিন্তু তার চোখদুটি যেন অন্য কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল। রাজেন্দ্রপ্রসাদ খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেন, কারণ দেবেন্দ্র রায়ের নাম তিনি চিনতেন বটে, তবে এতদিনে তাঁর ছেলের আগমন এই সংকটময় সময়ে যেন বেশ অদ্ভুত মনে হলো। অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে ফিসফিস শুরু করল—“এ লোক হঠাৎ এ সময়ে কেন?” আবার কেউ কেউ ভাবল, হয়তো সাধারণ সৌজন্যের জন্যই এসেছে। তবু তার শান্ত উপস্থিতি যেন সবার দৃষ্টি অজান্তেই আকর্ষণ করল।
অরিন্দমকে প্রথমে অতিথিশালায় বসতে দেওয়া হলেও, সে দ্রুতই পরিবারের আলোচনায় অংশ নিতে শুরু করল। একে একে সে সবার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টিতে ছিল কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতা—যেন মানুষকে ভেতর থেকে পড়তে পারে। যখন পুলিশ পরিদর্শক বিকাশ সেন ব্যর্থতায় হতাশ, তখন অরিন্দম হঠাৎ বলে উঠল—“আমি হয়তো নতুন অতিথি, কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে অনেক সময় ভেতরের সত্য বেশি স্পষ্ট হয়। এই গহনাটি হারানো কেবল বাইরের চুরির ঘটনা নয়, এর সূত্র লুকিয়ে আছে পরিবারেই।” তার এই মন্তব্যে সবার ভেতর যেন নতুন এক আলোড়ন উঠল। ইশিতা বিরক্ত হয়ে বলল—“আপনি নতুন এসেই এভাবে রায় দিচ্ছেন? আপনি কি গোয়েন্দা?” অরিন্দম কেবল মৃদু হাসল, বলল—“আমি গোয়েন্দা নই, তবে মানুষকে পড়তে শিখেছি।” তার কথায় এক অদ্ভুত ভরসা লুকিয়ে ছিল, যা ইশিতার আক্রমণাত্মক ভঙ্গিও মুছে দিতে পারল না। রাজেন্দ্রপ্রসাদ, যিনি এতক্ষণ ক্ষুব্ধ আর হতাশ হয়ে বসেছিলেন, তাকালেন অরিন্দমের দিকে অন্য চোখে। মনে হলো, হয়তো এই অচেনা মানুষ সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে, যা তারা নিজেরা দেখতে পাচ্ছেন না।
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আচরণ অরিন্দম গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করছিল। অরিজিতের চোখে চাপা আতঙ্ক, ইশিতার দৃষ্টিতে লোভ আর অস্বস্তি, সুচিত্রার মুখে নিয়ন্ত্রণের মুখোশ, অনন্যার চোখে দ্বিধা আর স্বাধীনতার খোঁজ—সবই তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। এমনকি গোপাল ম্যানেজারের গলায় অনিশ্চয়তা আর অঞ্জলি পরিচারিকার ভয়ের রেখাও সে লক্ষ্য করল। অরিন্দম শান্ত কণ্ঠে বলল—“চুরি যখন ভেতরের, তখন সেটা কেবল টাকার লোভ নয়, সম্পর্কের ভাঙন আর চাপা ক্ষোভের ফলও হতে পারে। আমি হয়তো পুরোটা জানি না, কিন্তু এতটুকু বলতে পারি—এই রহস্যের সমাধান তোমাদের পরিবারেই লুকিয়ে আছে।” তার কথায় যেন এক নিস্তব্ধতার ঢেউ বয়ে গেল ঘরে। কেউ প্রতিবাদ করল না, কেউ সমর্থনও দিল না, কিন্তু প্রত্যেকেই ভেতরে ভেতরে অনুভব করল—এই অচেনা মানুষটির উপস্থিতি ঘটনাকে অন্য এক দিকে মোড় দিতে শুরু করেছে। প্রাসাদের অন্ধকারে যেন হঠাৎ এক আলো প্রবেশ করল, কিন্তু সেই আলো কতটা সত্য উন্মোচন করবে আর কতটা অশান্তি বাড়াবে, তা তখনও কেউ বুঝে উঠতে পারল না।
অধ্যায় ৭ –
অরিন্দমের শান্ত অথচ অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন রাজবাড়ির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ল। সে বুঝেছিল, রহস্য উন্মোচন করার জন্য বড় কোনো নাটকীয় প্রমাণের প্রয়োজন নেই, বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সূত্রই সত্যের পথ দেখাতে পারে। তাই সে পরিবারের প্রতিটি মানুষের দিকে গভীর মনোযোগ দিল। অঞ্জলি গৃহপরিচারিকার আতঙ্কিত মুখ দেখে তার মনে হলো, সে হয়তো এমন কিছু জানে যা মুখে বলছে না। কাজ করতে করতে হাত কাঁপছিল অঞ্জলির, চোখে ভয়, আর ঠোঁট কাঁপছিল অকারণে। গোপাল ম্যানেজারের আচরণও অরিন্দমকে কৌতূহলী করল। পরিবারের আর্থিক হিসাব নিয়ে কথা উঠতেই সে অদ্ভুতভাবে ঘামতে শুরু করল, চোখ সরাতে চাইছিল। ইশিতা গহনাটির খোঁজ নিয়ে অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখাচ্ছিল, যেন সেই অলঙ্কারের প্রতিটি মুহূর্তের অবস্থান তার নখদর্পণে জানা দরকার। অন্যদিকে অনন্যার চোখের জল অরিন্দমকে থামিয়ে দিল। সে বুঝল, মেয়েটি কেবল কনের মানসিক চাপেই কাঁদছে না—এর পেছনে আরও গভীর কোনো যন্ত্রণা রয়েছে। পরিবারের বাইরে থেকে আসা একজন হয়তো যতটা বোঝে, তার চেয়েও অনেক বেশি ভাঙন এই পরিবারকে ভেতর থেকে ক্ষয় করছে।
মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি অরিন্দম ভৌত প্রমাণ খুঁজতেও পিছপা হলো না। প্রথমেই তার নজরে পড়ল সেই তোরঙ্গের তালা। পুলিশের চোখে এটি স্বাভাবিক মনে হলেও, অরিন্দম মনোযোগ দিয়ে দেখল—তালার এক কোণে অচেনা আঁচড় কেটে গেছে। কেউ হয়তো সেটি চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা না করে কোনো ধাতব জিনিস দিয়ে নাড়াচাড়া করেছিল, কিন্তু পরে চাবি ব্যবহার করেই সেটি খুলেছে। এই সূক্ষ্ম দাগ অনেককেই এড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অরিন্দম জানল, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। এরপর তার দৃষ্টি গেল মেঝের দিকে। হঠাৎই চকচকে মার্বেলের ফাঁকে সে দেখতে পেল এক টুকরো রেশমি সুতো। ম্লান আলোয় সেটি তেমন চোখে পড়ার মতো ছিল না, কিন্তু তার অভ্যাসজাত দৃষ্টি দ্রুতই সেটিকে আলাদা করে তুলল। সুতোটি যেন কোনো শাড়ি বা গহনার থলির অংশ। প্রশ্ন উঠল—এই রেশমি সুতো কোথা থেকে এলো? কার পোশাক থেকে? না কি গহনাটির থলি থেকেই ছিঁড়ে এসেছে? এ প্রশ্ন মনে নিয়ে সে সুতোটি গোপনে তুলে রাখল।
সবশেষে, একটি জিনিস তার কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে দিল। প্রাসাদের ভেতরের এক অন্ধকার কোণে পড়ে ছিল একটি অর্ধেক পোড়া মোমবাতির টুকরো। এমন মোমবাতি সাধারণত বিদ্যুত্ চলে গেলে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু গত কয়েকদিনে বিদ্যুতের কোনো সমস্যা হয়নি। তাহলে কারো প্রয়োজন হয়েছিল অন্ধকারে আলাদা আলো জ্বালানোর? এই টুকরো মোমবাতি যেন এক অদৃশ্য কাহিনি বলে যাচ্ছিল—কারো গোপন চলাফেরার, কারো অন্ধকারে কাজ করার প্রমাণ। তিনটি সূক্ষ্ম সূত্র—তালার আঁচড়, রেশমি সুতো, আর অর্ধেক মোমবাতি—অরিন্দমের মনে এক নতুন চিত্র আঁকতে শুরু করল। সে জানল, রহস্যের আসল সূত্র এখানেই লুকিয়ে আছে, শুধু প্রয়োজন সঠিক প্রশ্নের, আর প্রতিটি মানুষের ভেতরের ভাঙনকে উন্মোচন করার ধৈর্যের। অরিন্দম ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, গহনাটির চুরি কেবল একটি অলঙ্কারের অনুপস্থিতি নয়, বরং এ পরিবারে চাপা থাকা সম্পর্কের অন্ধকার একে একে প্রকাশ পেতে চলেছে।
অধ্যায় ৮ –
অরিন্দমের মন তখন এক অদৃশ্য শিকারির মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সে জানে, সরাসরি প্রশ্ন করে বা সন্দেহ প্রকাশ করে সত্য ধরা সম্ভব নয়; মানুষের আসল মুখোশ খুলে যায় তখনই, যখন তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে। তাই সে গ্রামের লোকজনের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে এক নাটক সাজাল—উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, “প্রতিমার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া গহনাগুলো পাওয়া গেছে।” কথা শেষ হতেই যেন বাতাস থমকে গেল। মাঠের কোণে জমে থাকা লোকজন প্রথমে বিস্ময়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল, তারপর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। কারও মুখে স্বস্তির ছায়া, কেউ যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা হলো; আবার কারও চোখে এক অজানা ভয় স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন ভেতরে চাপা দেওয়া গোপন সত্য হঠাৎ আলোয় বেরিয়ে আসবে এই আশঙ্কা তাদের কাঁপিয়ে তুলেছে। অরিন্দম সব দেখছিল, তার চোখ কারও হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তি আর কারও শান্ত মুখে হঠাৎ জেগে ওঠা ঘামবিন্দুকেও এড়িয়ে যাচ্ছিল না। প্রতিটি অভিব্যক্তি যেন তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সত্যের।
সে বুঝতে পারল, যারা সত্যিই দেবীর ভক্ত এবং প্রতিমার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, তাদের মুখে যেন এক প্রশান্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু কয়েকজনের আচরণ অন্যরকম। মন্দির কমিটির দুই সদস্য, যাদের এতদিন খুব জোর গলায় চুরি বা দেবী অপমানের কথা বলতে শোনা গিয়েছিল, হঠাৎ যেন নির্বাক হয়ে গেল। একজন কপাল ঘামতে ঘামতে পেছনে সরে গেল, অন্যজন দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল, যেন ঘোষণা শুনে তাদের ভেতরের চাপা ভয় চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গ্রামের এক ধনী ব্যবসায়ী, যে সবসময়ই মন্দিরের দানপত্র নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করত, সে হঠাৎ উচ্চস্বরে বলল, “ভালো হয়েছে গহনাগুলো পাওয়া গেছে, দেবী বাঁচালেন।” কিন্তু তার কণ্ঠে অদ্ভুত এক কাঁপুনি ছিল, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অরিন্দম লক্ষ্য করল, তার চোখ এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, যেন ভেতরে ভেতরে সে নিজেই জানে নাটকের আড়ালে আসল সত্য শিগগির প্রকাশ হয়ে যাবে। এইসব সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়া অরিন্দমকে যেন নতুন সূত্র দিচ্ছিল, সত্যের অদৃশ্য সুতো এখন প্রায় হাতের নাগালে।
অরিন্দমের মনে তখন দ্বিধা নেই, বরং অদ্ভুত এক স্বচ্ছতা। সে বুঝল, সত্য লুকিয়ে থাকে না; মানুষের ভেতরের ভয় আর অপরাধবোধই তাকে ফাঁস করে দেয়। যারা খুশি হয়ে দেবীকে প্রণাম করছে, তাদের ভেতরে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যাদের মুখে আতঙ্ক জমে উঠেছে, তাদের ভেতরে কোনো না কোনো অন্ধকার অবশ্যই কাজ করছে। সে জানে এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা—একটি চাপ, একটি অপ্রস্তুত প্রশ্ন বা হঠাৎ করা কোনো পদক্ষেপই আসল অপরাধীকে মুখ খুলতে বাধ্য করবে। ভিড় থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, “আমি সত্যের কাছাকাছি চলে এসেছি।” তার চোখে তখন আর ভয় নেই, শুধু এক অনমনীয় দৃঢ়তা—যে দৃঢ়তা নিয়ে মানুষ অন্ধকারের ভেতরে হাত বাড়ায় আলো খুঁজে পাওয়ার জন্য। গ্রামের গুঞ্জন, ফিসফাস, আর মানুষের দৃষ্টি এক অদ্ভুত চিত্রকল্পের মতো তার চারপাশে ঘুরছিল, আর সেই কোলাহলের মাঝেই সে খুঁজে পেল আসল সুর, সেই সুর যা তাকে সরাসরি সত্যের দরজার সামনে পৌঁছে দিল।
অধ্যায় ৯ –
সন্ধ্যার পর মুখার্জি পরিবারের বিশাল প্রাসাদের হলঘরে সবাই জড়ো হয়েছিল। আলো ঝলমলে হলেও পরিবেশের ভেতর চাপা উত্তেজনা যেন ভারী হয়ে বসে ছিল। অরিন্দম সবার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, “আজ আমি আপনাদের সামনে সত্যটা উন্মোচন করব। যে গহনার জন্য এত অশান্তি, এত কলঙ্ক—সেই গহনাই আসলে এই বাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।” তার চোখ একে একে সবার মুখে পড়ল। কারও দৃষ্টি কৌতূহলী, কারও মুখে সন্দেহ, আবার কারও ভেতর লুকিয়ে থাকা ভয় ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছিল। মুহূর্তের নীরবতার পর সে উচ্চারণ করল সেই নাম, যেটি কারও কল্পনাতেও আসেনি—“গহনাটা চুরি করেছে ইশিতা।” সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিসফাস আর গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, কেউ আবার চমকে উঠল। সুচিত্রা স্তব্ধ হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল, আর অরিজিত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইশিতার মুখ প্রথমে কঠিন রইল, কিন্তু মুহূর্তের ভেতরে তার চোখ কাঁপতে শুরু করল, ঠোঁট ফেটে গেল নীরবতায়। অরিন্দম ধীরে ধীরে তার যুক্তি উপস্থাপন করল—“ইশিতা ভেবেছিল গোপনে গহনা বিক্রি করে অরিজিতের ঋণ শোধ করবে। এতে সে পরিবারের কাছে একদিকে ত্রাণকর্তার মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, অন্যদিকে গোপনে নিজের লোভও পূর্ণ হবে।”
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ হলো না। অরিন্দমের কণ্ঠ আরও দৃঢ় হয়ে উঠল—“তবে এই ষড়যন্ত্রে ইশিতা একা ছিল না। শেষ মুহূর্তে গোপালও এতে জড়িয়ে পড়ে। সে বহুদিন ধরে টাকার অভাবে ভুগছিল এবং পরিবারকে ঠকিয়ে ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছিল। ইশিতার গোপন পরিকল্পনার খবর তার কানে পৌঁছে যায়। সে হুমকি দেয়, যদি তাকে ভাগ না দেওয়া হয়, তবে পুরো সত্য ফাঁস করে দেবে। আর সেই কারণেই গহনাটি তোরঙ্গ থেকে সরিয়ে দু’জনে মিলে লুকিয়ে রাখে।” ঘরে এক অদ্ভুত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। গোপাল কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না, আমি… আমি তো কিছু করিনি…” কিন্তু তার ভেজা কণ্ঠস্বর আর অস্থির হাত তাকে আরও অপরাধী করে তুলল। অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ভেবেছিলে, অন্ধকার রাতে মোমবাতির আলোয় তালা খুলে গহনা নেওয়া যাবে, কেউ টের পাবে না। কিন্তু তোমার ফেলে যাওয়া মোমবাতির টুকরো, আর ইশিতার শাড়ি থেকে ছিঁড়ে পড়া রেশমি সুতো—সব তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতাকেই প্রকাশ করেছে।” ইশিতা তখন আর চুপ থাকতে পারল না। কান্না ভেঙে তার গলা কেঁপে উঠল—“আমি শুধু চেয়েছিলাম অরিজিতকে বাঁচাতে, পরিবারে নিজের জায়গা শক্ত করতে… আমি জানতাম না গোপালও আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।”
মুখার্জি পরিবারের রাজবাড়ি তখন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী। যেই গহনাকে কেন্দ্র করে এত ঐতিহ্য, এত অহংকার, সেই গহনার অভিশাপই যেন সবাইকে নগ্ন করে দিল। সুচিত্রার চোখে রাগ আর দুঃখ একসঙ্গে ভেসে উঠল—সে বুঝতে পারছিল না, নিজের কন্যাকে অভিশাপ দেবে, না কি তার ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ভেঙে পড়বে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে বললেন, “আমরা ভেবেছিলাম বাইরের কেউ আমাদের লুট করেছে, অথচ আমাদের ভেতরেরই বিশ্বাসঘাতক আমাদের লজ্জিত করল।” অতিথিদের মধ্যে কানাঘুষি বাড়তে থাকল—কেউ বলল লোভের জন্য, কেউ বলল সম্পর্ক বাঁচানোর নামে আত্মপ্রবঞ্চনা। পুলিশ পরিদর্শক বিকাশ সেন এগিয়ে এসে স্পষ্ট জানালেন, “প্রমাণ স্পষ্ট। ইশিতা আর গোপাল এই চুরির দায় এড়াতে পারবে না।” ইশিতা তখন মেঝেতে ভেঙে পড়ে কাঁদছিল, গোপাল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার কাঁপা দেহ বারবার সত্যিটাকেই প্রকাশ করছিল। অরিন্দম নির্লিপ্ত চোখে সব দেখছিল—তার কাজ ছিল কেবল মুখোশ খুলে দেওয়া। সে জানত, গহনার গল্প শেষ হলেও, এই পরিবারের ভেতরের ফাটল আর কখনও মুছে যাবে না। ঐতিহ্য, ভালোবাসা আর অহংকারের আড়ালে লুকোনো লোভের মুখোশ সবার সামনে খুলে গেছে, আর সত্য এখন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ির মাঝখানে।
অধ্যায় ১০ –
সকালের আলোয় মুখার্জি পরিবারের রাজবাড়ি এক অন্য আবহে ভরে উঠেছিল। দীর্ঘ অস্থিরতা, কান্না আর কোলাহলের পর অবশেষে হারানো হীরের গহনা উদ্ধার হলো। পুলিশ পরিদর্শক বিকাশ সেন গহনাগুলো সবার সামনে হাজির করতেই অতিথিদের ভিড়ে ফিসফিসানি থেমে গেল। যেন এক গহনার ঝলকে রাতভর জমে থাকা ভয়, সন্দেহ আর রাগের অন্ধকার এক নিমিষে মিলিয়ে গেল। কিন্তু গহনার ঝলক সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও, পরিবারের ভেতরের ক্ষত কেউ ভুলতে পারছিল না। রাজেন্দ্রপ্রসাদ স্থির চোখে গহনাগুলো দেখলেন, তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামালেন তার পরিবারের সদস্যদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এ গহনা আমাদের কেবল বিপদে ফেলেছে। যে গহনাকে আমরা এত গর্বের প্রতীক ভেবেছিলাম, সেই গহনাই আমাদের ভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তার কণ্ঠে ক্ষোভ ছিল না, ছিল এক গভীর বোধের সুর। অতিথিরা চুপ হয়ে গেল; তারা বুঝল, এই বাড়ির কর্তার হৃদয়ে এক বড় পরিবর্তন ঘটেছে।
সেই মুহূর্তে অরিজিত সামনে এগিয়ে এসে সবার সামনে মাথা নিচু করল। তার কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছিল, তবু সে স্বীকার করল, “আমার ঋণের দায়, আমার দুর্বলতা, আমার অসহায়তা—এসবই ইশিতাকে সেই পথে ঠেলে দিয়েছে। আমি যদি নিজের ভুল আগে স্বীকার করতাম, তবে হয়তো আজ এই লজ্জার মুখ দেখতে হতো না।” তার কথা শুনে ইশিতা আর সামলাতে পারল না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল, কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “আমি লোভে অন্ধ হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম গোপনে সব সামলে ফেলতে পারব, অথচ বুঝতে পারিনি বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে পরিবারের আসল শক্তি কখনো অর্জন করা যায় না।” সুচিত্রা একদৃষ্টে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে রাগের ছাপ মিলল না, বরং এক মায়ের অসহায় বেদনা ভেসে উঠল। অতিথিদের কেউ কেউ ফিসফিস করছিল—এ বিয়ে কি আদৌ সম্ভব? কিন্তু ঠিক তখনই অনন্যা উঠে দাঁড়াল। তার কণ্ঠ দৃঢ়—“আমি চাই এই বিয়ে গহনাহীনভাবেই হোক। কারণ আজ আমি শিখেছি, সম্পর্কের মূল্য কোনো হীরেতে নয়, হৃদয়ে। যদি পরিবার এক থাকে, তবে গহনাহীন বিয়েও এক নতুন সূচনা হতে পারে।” তার চোখে জ্বলছিল অদ্ভুত এক আলো, যা যেন সবার হৃদয়ে নতুন ভোরের আশ্বাস দিল।
সন্ধ্যায় মৃদু আলোর ভেতর অনন্যার বিয়ে সার্থকভাবে সম্পন্ন হলো। গহনা ছিল না, কিন্তু অতিথিরা বুঝতে পারছিল, এ বিয়ে হয়ে উঠেছে গহনার চেয়েও মহার্ঘ। রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে যে হাসি, যে আনন্দধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক নতুন শিক্ষা। বিয়ের শেষে অরিন্দম নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করল না, কারণ সবাই জানত—সে এসেছিল কেবল এক অদৃশ্য আলো হয়ে, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া পথ দেখাতে। দরজার কাছে থেমে একবার পিছনে তাকাল সে, চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তার শেষ বাক্য যেন সবার কানে বাজল, “লোভ যখন পরিবারকে গ্রাস করে, তখন বিশ্বাসই একমাত্র আলো।” প্রাসাদের আঙিনায় রাতের বাতাস বইতে থাকল, দূরে মন্দিরের ঘণ্টা বাজল, আর মুখার্জি পরিবারের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো—যেখানে হীরের চেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠল একতার আলো, ভালোবাসার বন্ধন, আর শেখা সেই অনন্ত শিক্ষা।
—