প্ৰিয়ম বসু
১
গ্রামের নাম ছিল সোনারপুর। চারদিক সবুজে মোড়া, ধানখেতের ঢেউ, পুকুরের জলচর, আর কাদামাটির সরু পথ মিলেমিশে যেন এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ তৈরি করত। কিন্তু এই শান্তির মাঝেই ছিল এক রহস্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রামের মানুষের মনে ভয় এবং ভক্তি মিশিয়ে রেখেছিল—মন্দিরের ঘণ্টা। গ্রামে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এক মন্দির ছিল, পাহাড়ঘেরা গ্রামের কেন্দ্রে উঁচু একটি টিলার উপর। মন্দিরের ভেতরে ছিল এক বিশালাকার পিতলের ঘণ্টা, যা প্রতি রাত ঠিক বারোটায় নিজে থেকেই বেজে উঠত। কোনো মানুষ হাত না লাগিয়েও ঘণ্টার ভারী ধ্বনি গোটা গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতো। গ্রামের লোকেরা বলত, এই ধ্বনি অশুভ শক্তিকে দূরে রাখে, গ্রামকে রক্ষা করে। ছোটদের ঘুমপাড়ানি গান যেমন নিরাপত্তা দেয়, তেমনি এই ঘণ্টার শব্দ প্রাপ্তবয়স্কদেরও মনে এনে দিত ভরসা। প্রতি রাত বারোটায় ঘণ্টার শব্দ শুনে গ্রামের মানুষ যেন আশ্বস্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলত—আজও মঙ্গল আছে, বিপদ দূরে আছে। কুসংস্কার হোক বা বিশ্বাস, কেউ কখনো সাহস করে এর উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
কিন্তু এক রাতে, সবকিছু বদলে গেল। সেই রাতটাও শুরু হয়েছিল অন্য দিনের মতোই। আকাশে মেঘ ছিল না, জোৎস্নায় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল। গ্রামের মানুষজন নিজেদের উঠোনে বসে গল্প করছিল, কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের শুইয়ে দিয়েছে, কেউ আবার মাটির প্রদীপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু রাত বারোটা বাজতেই, যখন সবাই প্রত্যাশা করছিল মন্দিরের সেই চেনা ঘণ্টাধ্বনি কানে আসবে, তখন হঠাৎ করে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল না। প্রথমে কেউ ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি, কারও মাথায় আসেনি যে কয়েকশো বছরের এই নিয়ম ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষজন খেয়াল করল—কোথাও কোনো শব্দ নেই। কুকুর ডাকছে না, পুকুরের ব্যাঙ ডেকে উঠছে না, এমনকি রাতের ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাতাসেও যেন এক অদ্ভুত ভারী চাপ নেমে এসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। যে পরিবারগুলো আগে কখনো এই ঘণ্টার শব্দ মিস করেনি, তারা হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। অনেকেই বলল—হয়তো পুরোহিত ঘণ্টা বাজাতে ভুলে গেছেন, আবার কেউ ফিসফিস করে বলল—“না, এই ঘণ্টা তো মানুষ বাজায় না… এ তো নিজে থেকেই বাজে…”। সন্দেহ, ভীতি আর অস্বস্তি গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
এরপরেই ঘটল সেই রাতের প্রথম দুর্ঘটনা। গ্রাম থেকে একটু দূরে, কাঁচা রাস্তায় বিশাল এক বটগাছের নিচে কৃষক গোপাল রাতের কাজ সেরে ফিরছিল। তার হাতে ছিল লণ্ঠন, আর কাঁধে রাখা ছিল কোদাল। গ্রামের লোকেরা পরদিন বলছিল, গোপাল নাকি সেই সময় দূরে মন্দিরের দিকে তাকিয়েছিল, যেন সে বুঝতে চাচ্ছিল ঘণ্টার নিস্তব্ধতা কেন। হঠাৎ করেই তার লণ্ঠনের আলো নিভে যায়। গ্রামে যারা কাছাকাছি ছিল তারা শুনেছিল—গোপালের চিৎকার আর একটা ধপাস শব্দ। ভোর হলে লোকজন গিয়ে দেখে, বটগাছের নিচে নিথর হয়ে পড়ে আছে গোপালের দেহ, মুখে জমে আছে আতঙ্কের ছাপ, যেন সে কিছু ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছিল। কিন্তু গাছে ওঠার কোনো চিহ্ন নেই, ডাল ভাঙা নেই, আর কোথাও মারধরের দাগও নেই। ডাক্তার এসে শুধু বলল—“গোপাল হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারা গেছে।” কিন্তু গ্রামের লোকেরা তা মানল না। তারা বিশ্বাস করল, ঘণ্টা না বাজার কারণেই গোপাল মারা গেছে। ঘণ্টাধ্বনি ছিল গ্রামকে রক্ষার একমাত্র ঢাল, আর এখন সেটি নীরব হয়ে গেছে। গোপালের মৃত্যু যেন সেই সত্যকে প্রথমবারের মতো সবার সামনে মেলে ধরল। সেই রাত থেকেই গ্রামে শুরু হলো এক অদ্ভুত আতঙ্কের রাজত্ব—নিস্তব্ধতা আর অজানা ভয়ের সূচনা।
২
শহর থেকে আগত আরিন ছিল পেশায় এক তরুণ লেখক। বয়স মাত্র আঠাশ, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার এক অদম্য কৌতূহল ছিল অদ্ভুত সব কাহিনি, লোককথা আর ইতিহাস নিয়ে। সে বরাবরই মনে করত—প্রত্যেকটা গুজব বা কুসংস্কারের ভেতরে লুকিয়ে থাকে বাস্তব কোনো কারণ, যেটা উন্মোচিত হলেই মানুষের ভয় ভেঙে যায়। এই ভাবনা নিয়েই সে বহু গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে বেরিয়েছে, নানান কাহিনি সংগ্রহ করেছে, কখনো তা প্রবন্ধ আকারে লিখেছে, কখনো গল্পের মোড়কে সাজিয়েছে। এবার তার পথ এসে থামল সোনারপুরে। রেলস্টেশনের বাইরে নামতেই চোখে পড়ল এই গ্রাম যেন অন্য কোনো দুনিয়ার—বড় শহরের কোলাহল, আলো আর তাড়াহুড়ো থেকে অনেক দূরে। কাঁচা রাস্তা, গরুর গাড়ি, ধানখেতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল, আর মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন দেখে মনে হচ্ছিল সময় এখানে আটকে আছে। কিন্তু এই শান্তির পেছনে লুকিয়ে ছিল গভীর অস্বস্তি। যেদিন আরিন গ্রামে পৌঁছল, সেদিনও মানুষজনের মুখে একই কথা—“মন্দিরের ঘণ্টা আর বাজে না… অভিশাপ নেমেছে।” হাটে গিয়ে সবজি কিনতে চাইলেও লোকেরা তার কানে ফিসফিস করে সেই একই গল্প শুনিয়ে দিল। কারও কণ্ঠে আতঙ্ক, কারও চোখে অশ্রু, কারও আবার বিশ্বাস ভরা ক্রোধ—কেউ বলছিল পুরোহিত ঠিক মতো পূজা দিচ্ছেন না, কেউ বলছিল অশুভ ছায়া গ্রামে নেমে এসেছে। আরিন প্রথমে মৃদু হাসল। তার কাছে এ কেবল কুসংস্কার, মানুষের ভয়ের গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, এই ভয় এতটাই প্রকট যে অচিরেই গ্রামে আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
রাত নামতেই সে গ্রামের দালানঘরের বারান্দায় বসে রেকর্ডার চালু করল, খাতায় নোট নিতে শুরু করল। বাতাসে যেন এক অচেনা ভারী নিস্তব্ধতা, চারদিক থেকে আসা ফিসফিসানি তাকে কৌতূহলী করে তুলছিল। সে একজন কৃষাণীর কাছ থেকে শুনল, আগের দিনই গোপাল নামের কৃষক নাকি রহস্যময়ভাবে মারা গেছে। তার মৃত্যু নিয়ে গ্রামের প্রত্যেকে কথা বলছে, কেউ বলছে অশুভ আত্মা টেনে নিয়েছে, কেউ বলছে গোপাল মন্দিরের দিকে তাকিয়েছিল বলেই অভিশপ্ত হয়েছে। আরিন এসব কথা শোনার পর নিজের মনে হাসল। সে জানত, এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ নিশ্চয়ই আছে—হয়তো গোপাল হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল, কিংবা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে প্রত্যেক গ্রামবাসীর চোখে ভয়ের ছাপ একই রকম ছিল। এমনকি শিশুরাও প্রশ্ন করছিল, “ঘণ্টা কবে আবার বাজবে?” সেই শিশুদের মুখের সরল প্রশ্ন শুনে আরিন থমকে গেল। শহরে থেকেও সে এমন শীতল আতঙ্ক মানুষের চোখে দেখেনি। এই ঘণ্টাধ্বনির ঘটনাটা কেবল কুসংস্কার কি না—সে তখন আর নিশ্চিত হতে পারছিল না। মনের গভীরে হালকা হলেও একটা অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছিল, কিন্তু তার যুক্তিবাদী স্বভাব বারবার তাকে আশ্বস্ত করছিল—“সবকিছুরই ব্যাখ্যা আছে।”
পরদিন ভোরে সে ঠিক করল মন্দিরে যাবে। কিন্তু যাওয়ার আগে গ্রামের প্রধান করিমের সঙ্গে দেখা হলো। করিম একজন প্রভাবশালী মানুষ, গ্রামের মোড়ল বলা যায়। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে নিজের ভয়ের পাশাপাশি সেই ভয়কে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে যেন আনন্দ পাচ্ছে। করিম বলল, “বাবা, তোমার মতো শহুরে মানুষ বুঝবে না। ঘণ্টা যখন বাজে না, তখন গ্রামের প্রাণহানি অবধারিত। তুই কদিন এখানে থাকিস, দেখিস দুর্ঘটনা একটার পর একটা ঘটবেই।” তার কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন সে নিজেই ভয়কে শাসন করছে। আরিন কৌতূহলী দৃষ্টিতে করিমকে পর্যবেক্ষণ করল। মনে হচ্ছিল, হয়তো গ্রামের এই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়ে সে নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল—ঘণ্টা আসলেই নিজে নিজে বাজত নাকি কেউ কোনো কৌশল ব্যবহার করত? এই রহস্য জানার অদম্য আগ্রহে আরিন মন্দিরের টিলার দিকে রওনা দিল। মাটির পথ ধরে এগোতে এগোতে সে শুনতে পেল, বাতাসে অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ, যেন চারপাশের গাছেরা কোনো গোপন কথা বলছে। উপরে তাকাতেই দেখল আকাশ অস্বাভাবিকভাবে ধূসর হয়ে গেছে, অথচ তখন সকাল। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো মন্দিরটা যেন রহস্যের আবরণে ঢাকা—কালো পাথরের দেয়ালে শ্যাওলা, ভাঙা সিঁড়ি, আর দরজায় ঝুলে থাকা জংধরা তালা। আর মন্দিরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই ঘণ্টা, যেটি গ্রামবাসীর বিশ্বাসে তাদের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আরিন থমকে দাঁড়িয়ে ভাবল—“সত্যিই কি এ ঘণ্টার সঙ্গে কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার জড়িয়ে আছে? নাকি সবটাই মানুষের তৈরি এক কৌশল?” প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগল, আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তার কাহিনি এগোতে শুরু করল।
৩
টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো মন্দিরটা প্রথম দেখাতেই আরিনের মনে এক ধরনের অস্বস্তি জাগাল। শ্যাওলায় ঢাকা কালো পাথরের দেয়াল, জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা সিঁড়ি, আর মূর্তির চূড়ায় বসে থাকা কাকের ডাক যেন এক অদৃশ্য সতর্কবার্তা দিচ্ছিল। ভেতরে প্রবেশ করার আগেই সে দেখতে পেল মন্দির চত্বর জনশূন্য—যেন গ্রামের মানুষ একে এড়িয়ে চলে। কিছুটা ভেতরে এগোতেই দেখা মিলল পুরোহিত পূর্ণেশের। বয়স পঞ্চাশের বেশি, কিন্তু কুঁজো হয়ে যাওয়া দেহ আর নিস্তেজ চোখ দেখে মনে হচ্ছিল বহুদিন ধরে ভারী কোনো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। সাদা ধুতি পরা, গলায় Rudraksha মালা, হাতে ধূপকাঠি নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। আরিন ভদ্রভাবে প্রণাম জানিয়ে পাশে বসল। প্রথমদিকে পূর্ণেশ কিছুটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন, কিন্তু যখন আরিন সরাসরি প্রশ্ন করল—“মন্দিরের ঘণ্টা এতদিন ধরে প্রতি রাত বারোটায় বাজত, হঠাৎ কেন থেমে গেল?”—তখন তার চোখে অদ্ভুত আতঙ্ক ভেসে উঠল। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর থেমে থেমে বললেন, “ঘণ্টা বাজা বন্ধ হওয়া মানেই কোনো শক্তি জেগে উঠেছে। যেটাকে এতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল, সেটা আর বশে নেই।” কথাটা বলার সময় তার কণ্ঠ কাঁপছিল, আর চোখ যেন মন্দিরের ভেতরে লুকানো কোনো অদৃশ্য সত্তাকে ভয় পাচ্ছিল।
পূর্ণেশের উত্তর শুনে আরিনের যুক্তিবাদী মন দ্বিধায় পড়ে গেল। সে বোঝে, মানুষ যখন ভয় পায় তখন সবকিছুর সঙ্গে অশুভ শক্তির যোগ খুঁজে নেয়। তবু পুরোহিতের কণ্ঠে যে আতঙ্ক সে শুনল, তা নিছক কুসংস্কার বলে মনে হচ্ছিল না। সে ভাবল, হয়তো পূর্ণেশ কিছু জানেন যা এখনো প্রকাশ করেননি। নিজের ভেতরের সংশয় লুকিয়ে রেখে আরিন বলল, “কিন্তু ঘণ্টা তো এতদিন নিজে থেকেই বাজত। যদি সত্যিই কোনো শক্তির প্রভাব থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তার ব্যাখ্যা আছে। হয়তো কোনো প্রাকৃতিক কারণ, বাতাসের চাপ, বা মন্দিরের ভেতরে লুকানো কোনো যন্ত্র…”। কিন্তু আরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ণেশ মাথা নাড়িয়ে বললেন, “না বাবু, এটা কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। আমি জানি, আমি বছরের পর বছর এই মন্দিরে পূজা দিয়েছি। ঘণ্টা বেজেছে, আর গ্রামের মানুষ বেঁচে গেছে। কিন্তু আজ যখন ঘণ্টা নীরব, তখন তার মানে হলো অশুভ জেগে উঠেছে।” এত কথা বলার পর হঠাৎ তিনি চুপ করে গেলেন, আর তার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল অদ্ভুত দ্বিধা—যেন কিছু বলতে চান, আবার ভয় পাচ্ছেন।
পূর্ণেশের সঙ্গে কথোপকথন শেষে আরিন মন্দিরের ভেতরে ঢুকল। ভেতরটা ছিল অন্ধকার আর ঠান্ডায় ভরা। জানালা ছিল না, শুধু একপাশে ছোট ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা ঢুকছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বিশালাকার পিতলের ঘণ্টা—জং ধরা হলেও শক্তপোক্ত, মন্দিরের অন্ধকারে সেটাই যেন এক রহস্যময় উপস্থিতি। ঘণ্টার চারপাশে তাকাতেই আরিনের দৃষ্টি আটকে গেল মেঝের দিকে। কালো পাথরের মেঝেতে অদ্ভুত আঁচড়ের দাগ ছড়িয়ে আছে। সেগুলো একেবারেই স্বাভাবিক নয়—কোনো পশুর নখের মতো নয়, আবার মানুষের হাত দিয়েও এমন দাগ হওয়া সম্ভব নয়। আঁচড়গুলো কখনো বৃত্তাকার, কখনো আবার টেনে নেওয়া রেখার মতো, যেন কেউ বা কিছু এখানে বারবার বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। হাতের খাতায় আরিন দ্রুত নোট নিল, মনের ভেতরে অস্বস্তি আরও বাড়ল। হঠাৎ বাতাস কেমন ভারী হয়ে উঠল, আরিন স্পষ্ট অনুভব করল ঘণ্টার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে পিছন ফিরে দেখল পূর্ণেশ দূর থেকে তাকে গভীরভাবে দেখছেন, যেন আরিন এমন কোনো গোপন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, যেটা জানা তার জন্য বিপজ্জনক। সেই মুহূর্তে গ্রামের ঘণ্টাধ্বনির রহস্য তার কাছে আর নিছক কুসংস্কার বলে মনে হলো না, বরং এক অমীমাংসিত অন্ধকার বাস্তবতার দরজা যেন খুলে যেতে শুরু করেছে।
৪
রাতের প্রহরী অর্ণব ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। চৌকিদারের দায়িত্বে থেকে তিনি বহু বছর ধরে গ্রামের অলিগলি পাহারা দিয়েছেন, দিনশেষে তার চোখে ঘুম না এলেও হাতে লাঠি নিয়ে রাতভর ঘুরে বেড়ানো যেন তার নেশা হয়ে গিয়েছিল। সবাই জানত, অর্ণব অল্প কথার মানুষ, কিন্তু চোখদুটো সবসময়ই জেগে থাকে, যেন আঁধার ভেদ করে কিছু খুঁজছে। ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ হওয়ার রাতের পরের সকালে তিনিই প্রথম বললেন, তিনি নিজের চোখে কিছু দেখেছেন। গ্রামের চায়ের দোকানে লোকজন যখন ভিড় করেছে, গোপালের মৃত্যুর গুজব আলোচনা করছে, তখন অর্ণব ধীর গলায় বললেন—“আমি দেখেছি… ঘণ্টা বেজে ওঠেনি, আর সেই নীরবতার ফাঁক দিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসেছে এক ছায়া।” লোকেরা প্রথমে হাসাহাসি করল, তারপর কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকাল। অর্ণব ব্যাখ্যা করতে থাকলেন—“ওটা মানুষের মতো নয়, আবার পুরোপুরি অমানুষও নয়। লম্বা, কালো, গায়ের কোনো আকার নেই, শুধু ফাঁকা শূন্য চোখ। আমি দূর থেকে দেখেছি, ঘণ্টার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারপর ধীরে ধীরে নেমে এল টিলার ঢাল বেয়ে।” কথা বলার সময় তার কণ্ঠে কোনো দ্বিধা ছিল না, কিন্তু গ্রামের মানুষ তা বিশ্বাস করতে রাজি হলো না। করিম মোড়ল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “ও সব রাতের প্রহরীর ভুতুড়ে কল্পনা। অন্ধকারে গাছের ছায়াকে ভূত ভেবেছে।” অনেকে মজা করে বলল, “চৌকিদার নিশ্চয়ই একটু বেশিই মদ খেয়েছিল।” অর্ণবের মুখ লাল হয়ে উঠল, কিন্তু সে আর কিছু বলল না। শুধু সেই রাত থেকে তার চোখ আরও ফাঁপা, মুখ আরও শুকনো লাগছিল—যেন সে সত্যিই এমন কিছু দেখেছে যা মনের ভিতর কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
লোকেরা অর্ণবকে পাগল ভাবলেও তার মেয়ে শিউলি অন্যরকম। বয়স মাত্র বারো, কিন্তু তার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতির ক্ষমতা আছে। গ্রামের মানুষ বলে, মেয়েটি প্রায়ই এমন কিছু কথা বলে যা পরবর্তীতে সত্যি হয়ে যায়। শিউলি সেই রাতের পর থেকে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। মা যতই জিজ্ঞাসা করুক, সে কিছু বলতে চাইত না। কিন্তু একদিন আরিন যখন তাদের বাড়ি গিয়ে অর্ণবের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন শিউলি হঠাৎ ফিসফিস করে বলল—“আমি ঘণ্টার শব্দ শুনেছি।” কথাটা শুনে সবাই থমকে গেল। অর্ণব চোখ মেলে তাকাল, আরিন নোটবুক থেকে কলম ফেলে দিল। শিউলি মৃদু কণ্ঠে বলতে লাগল, “আমি স্বপ্নে দেখেছি, রাত বারোটায় ঘণ্টা বাজছে। কিন্তু সেটা আগের মতো নয়… শব্দটা ভারী, খুব গভীর, আর কেমন যেন করুণ। ঘণ্টা বাজতেই অন্ধকার থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছিল।” কথা শেষ করতে না করতেই সে আঁতকে উঠে বাবার কোলে লুটিয়ে পড়ল। শিউলির কথাগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, কারণ সে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়—তার স্বপ্ন অনেক সময় বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়। গ্রামের কিছু মানুষ বলল, মেয়েটা ভূতে ধরা পড়েছে, আবার কেউ বলল ওর মধ্যে দেবতার ইশারা আছে। অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “দেখেছ? আমি মিথ্যে বলিনি। আমি যা দেখেছি, মেয়ে সেটাই শুনেছে।” তবু গ্রামবাসী বিশ্বাস করতে চাইল না। যুক্তির বদলে ভয় আর কুসংস্কার গ্রামটাকে ঘিরে ধরল আরও শক্ত করে।
আরিন এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেল এবং তার ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। একদিকে অর্ণবের বর্ণনা, আরেকদিকে শিউলির স্বপ্ন—দুটোই যেন কোনো অদৃশ্য সূত্রের দিকে ইঙ্গিত করছে। যুক্তি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে চাওয়া তার মন বলছিল, হয়তো অর্ণবের চোখ ধোঁকা দিয়েছে, আর শিশুর কল্পনায় স্বপ্নের রঙ চেপে গেছে। কিন্তু তারপরও তার মনে হচ্ছিল, এই দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো মিল রয়েছে, যা অকারণে ঘটেনি। সেদিন রাতে সে নিজের কুঁড়েঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে বারবার শিউলির বলা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল—“ঘণ্টা বাজছিল, কিন্তু করুণ সুরে…”। জানলার বাইরে কুকুরের হালকা ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাটির ঘ্রাণ মিশে এক ভয়ানক নিস্তব্ধতা তৈরি করছিল। সে খাতায় লিখল—“অর্ণবের দেখা ছায়া আর শিউলির স্বপ্নের ঘণ্টাধ্বনি—এর মধ্যে হয়তো এমন এক সংযোগ আছে, যা এই গ্রামের অভিশপ্ত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে।” চোখ বন্ধ করতেই তার মনে হলো, দূর থেকে যেন সত্যিই কোনো ঘণ্টা একবার বাজল, খুব ভারী, খুব নিঃশব্দের ভেতর ডুবে থাকা এক অচেনা ধ্বনি। আরিন চোখ মেলে তাকাল, কিন্তু চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা। তখনই সে বুঝল, রহস্য তাকে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে, আর সোনারপুরে তার আসার যাত্রা নিছক গল্প সংগ্রহ নয়, বরং ভয় আর অশুভ শক্তির মুখোমুখি হওয়ার শুরু মাত্র।
৫
গোপালের মৃত্যুর পর থেকেই সোনারপুরে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এসেছিল, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আতঙ্ক ভয়ঙ্কর রূপ নিতে শুরু করল। প্রথম দুর্ঘটনা ঘটল জলাশয়ে। গ্রামের মাঝখানে একটি বড় পুকুর ছিল, যেখানে প্রতিদিন গৃহস্থরা গোসল করত, কাপড় ধুত এবং গরু-ছাগলকে জল খাওয়াত। এক সকালে দেখা গেল, মিঠু নামের এক কিশোরের নিথর দেহ ভেসে উঠেছে। বয়স মাত্র চৌদ্দ, সাঁতার জানত, অথচ কেন সে ডুবল কেউ বুঝতে পারল না। তার মুখে আঁতঙ্কের ছাপ, যেন শেষ মুহূর্তে কিছু ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছিল। এর পরেই পরদিন রাতে রহস্যজনক আগুন ধরে গেল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়। খড়ের গাদায় থেকে শুরু হওয়া আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল, কয়েকটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আশ্চর্য বিষয়, আগুন কারও চোখের সামনে ধরল না, যেন অদৃশ্য কোনো হাত তা প্রজ্বলিত করল। মানুষ আগুন নেভাতে ছুটল, কিন্তু আগুন নিভে গেলে দেখল কারও ক্ষত-বিক্ষত দেহ নেই, অথচ ক্ষয়ক্ষতি ভয়ঙ্কর। তৃতীয় দিনে ঘটল আরও অদ্ভুত দুর্ঘটনা—একসাথে তিনটি গরু হঠাৎ মারা গেল। তারা সুস্থ ছিল, মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, হঠাৎ ধপাস করে পড়ে গেল। দেহে কোনো আঘাত নেই, বিষের চিহ্নও নেই, কিন্তু চোখ ফাঁকা হয়ে আছে, যেন অজানা আতঙ্ক তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এভাবে একে একে মৃত্যু আর ধ্বংসের ছায়া নেমে আসতে থাকল গ্রামে, আর প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল সেই নিস্তব্ধ ঘণ্টার রহস্য। প্রতিদিন রাতে লোকেরা ভয়ে ঘুমোতে পারত না। শিশুরা কাঁদত, বয়স্করা স্তব্ধ দৃষ্টিতে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকত। মনে হচ্ছিল, গ্রামটা এক অদৃশ্য শক্তির হাতে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে।
এই সুযোগকেই কাজে লাগাল করিম মোড়ল। বয়স হয়েছে, কিন্তু গলা এখনো শক্ত, কথায় এমন জোর আছে যে লোকজন সহজেই প্রভাবিত হয়। সে চৌপাল ডেকে মানুষ জড়ো করল, আর ধীরে ধীরে ভয়কে অস্ত্র করে সবাইকে বুঝাতে শুরু করল। “শুনেছ তোমরা? গোপাল মারা গেল, মিঠু ডুবল, আগুনে ঘর ভস্ম হলো, গরু মরল। এগুলো কেবল দুর্ঘটনা নয়। এগুলো অশুভ শক্তির খেলা। ঘণ্টা এতদিন আমাদের রক্ষা করত। এখন ঘণ্টা নীরব, তাই অশুভ গ্রাম দখল করছে।” করিমের গলা কাঁপছিল না, বরং দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি শব্দ বের হচ্ছিল। গ্রামের লোকেরা আতঙ্কে শিউরে উঠল। কেউ ফিসফিস করে বলল, “কীভাবে রক্ষা পাব আমরা?” তখন করিম হাত উঁচু করে ঘোষণা দিল—“এখন থেকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। মন্দির বন্ধ করে রাখতে হবে, বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। প্রতিদিন ভোরে আর রাতে সবাই একসাথে পূজা দেবে, দেবতার কাছে ক্ষমা চাইবে। তবেই হয়তো অভিশাপ দূর হবে।” লোকেরা মাথা নেড়ে সায় দিল, কেউ প্রতিবাদ করল না। আতঙ্কে কাঁপতে থাকা গ্রামবাসী তখন করিমের কথাই একমাত্র সত্য বলে ধরে নিল। পূর্ণেশ পুরোহিত মুখ খুলল না, শুধু নিঃশব্দে বসে রইল। তার চোখে এক অদ্ভুত দ্বিধা, যেন সে করিমের কথার পেছনের রহস্য জানে কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না।
আরিন সবকিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। দুর্ঘটনাগুলো তাকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিলেও সে এখনো যুক্তির আশ্রয় ছাড়তে চাইছিল না। সে খাতায় নোট নিল—“ডুবে যাওয়া, আগুন লাগা, পশুর মৃত্যু—সবই স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হতে পারে। কিন্তু একই সময়ে ঘটছে বলেই মানুষ তা অশুভের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে।” তবুও তার মনের গভীরে একটা অস্বস্তি রয়ে গেল, কারণ প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই অদ্ভুত মিল খুঁজে পাচ্ছিল সে। মৃতদের মুখে ভয় জমে থাকার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? আগুন এমনভাবে ছড়াল কীভাবে? পশুর মৃত্যুতে কোনো রোগ দেখা গেল না কেন? প্রশ্নগুলো উত্তরহীন থেকে যাচ্ছিল। আরেকদিকে, করিম যে সহজেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল, সেটাও আরিনকে ভাবাচ্ছিল। সে বুঝল, ভয় হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র, আর করিম সেই অস্ত্র ব্যবহার করে গ্রামটাকে নিজের দখলে নিতে চাইছে। কিন্তু সত্যিটা কোথায়? অশুভ শক্তি নাকি মানুষের তৈরি ষড়যন্ত্র? রাতে একা বসে এসব প্রশ্ন ভেবে ভেবে আরিনের মনে হচ্ছিল, ঘণ্টার নীরবতা আসলে কেবল একটা ঘটনা নয়—এ যেন কোনো অদৃশ্য যুদ্ধের শুরু, যেখানে বিশ্বাস আর যুক্তি, ভীতি আর কৌতূহল একে অপরের সঙ্গে লড়ছে। সে ঠিক করল, মন্দিরের গভীর রহস্য না জানা পর্যন্ত সে গ্রাম ছাড়বে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না, এই অনুসন্ধান তাকে এমন অন্ধকারের মুখে টেনে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে হয়তো ফিরে আসা আর সম্ভব নয়।
৬
রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের প্রান্তে স্কুলঘরের জানালায় এক ক্ষীণ আলো জ্বলছিল। আরিন যখন স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, ভেতর থেকে ডেকে উঠল—“আপনি কি লেখক আরিন?” কণ্ঠটা ছিল মধুর অথচ গম্ভীর। ভেতরে গিয়ে আরিন দেখতে পেল, স্কুলশিক্ষিকা রুবিনা একা বসে বই ঘাঁটছে। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন ভয়কে জয় করে রাখা এক নারী। আরিনের উপস্থিতিতে সে হাসল না, বরং সোজা হয়ে তাকাল। “আমি জানি, আপনি গ্রামে এসেছেন ঘণ্টার রহস্য নিয়ে। বাকিরা আপনাকে ভয় দেখাবে, আপনাকে পথভ্রষ্ট করবে। কিন্তু আমি সাহায্য করতে চাই।” আরিন অবাক হলো, এত সরাসরি কথা শোনার আশা করেনি সে। রুবিনা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল তার শৈশবের কথা। তখন সে ছোট, আর তার বাবা ছিলেন মন্দিরের দেখভালের কাজে নিযুক্ত। ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত, কারণ বলা হতো, তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ঘণ্টার ধ্বনি আরও গভীর, আরও শক্তিশালী শোনাত। কিন্তু এক রাতে হঠাৎ তাঁর বাবা নিখোঁজ হয়ে গেলেন। কেউ জানল না তিনি কোথায় গেলেন, কীভাবে হারালেন। শুধু মন্দিরের ভেতরে তাঁর চাদরটা ছিঁড়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। সেদিন থেকে রুবিনা মায়ের সঙ্গে একা হয়ে যায়। আর সেই ঘটনা গ্রামের মানুষের কাছে চাপা পড়ে গেল, যেন সবাই ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাইল।
রুবিনার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু গলায় দৃঢ়তা অটুট। “আমি বিশ্বাস করি, ঘণ্টার রহস্য আসলে কোনো দেবতার অভিশাপ নয়। এটা মানুষের লুকানো ইতিহাস। আমার বাবার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমি খুঁজতে শুরু করি, মন্দির আসলে কী লুকিয়ে রেখেছে। লোককথায় বলে, ঘণ্টার ভেতরে এক অলৌকিক শক্তি আছে, যা গ্রামকে রক্ষা করে। কিন্তু আমি মনে করি, সেটা শুধু আড়াল। আসলে ঘণ্টা বাজা মানেই কোনো প্রাচীন সংকেত বা গোপন চিহ্ন সক্রিয় হওয়া। আমার বাবার হঠাৎ অন্তর্ধানও সেই গোপন কাহিনির সঙ্গেই জড়িত।” আরিন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। প্রতিটি শব্দে তার কৌতূহল আরও বেড়ে যাচ্ছিল। রুবিনা বলল, “আমার কাছে কিছু কাগজ আছে, যেগুলো বাবার রেখে যাওয়া। ওগুলো সাধারণ চোখে বুঝতে পারবে না, কিন্তু আপনার মতো যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারা মানুষ হয়তো এর সূত্র ধরতে পারবেন।” সে একটি পুরনো কাঠের বাক্স বের করল। ভেতরে কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ, আঁকাবাঁকা রেখা, আর এক অদ্ভুত প্রতীক আঁকা ছিল। প্রতীকের চারপাশে ছিল খোদাই করা শব্দ—“ধ্বনি জাগে, ছায়া নামে।” শব্দগুলো শুনে আরিনের গা শিউরে উঠল। মনে হলো, এখানে কেবল একটি গ্রামের গল্প নয়, বরং বহু প্রাচীন কোনো গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।
বাক্স বন্ধ করে রুবিনা ফিসফিস করে বলল, “আপনি যদি সত্যিই খুঁজতে চান, তবে একা হবেন না। এই গ্রামে এমন শক্তি আছে যারা সত্য প্রকাশ হতে দিতে চায় না। করিম মোড়ল, পূর্ণেশ পুরোহিত—তাদের মুখে যা শুনবেন, সব বিশ্বাস করবেন না। মন্দিরের ভেতরের আঁচড়ের দাগ, অর্ণবের দেখা ছায়া—সবকিছুই কোনো ইতিহাসের অংশ। আমার বিশ্বাস, ঘণ্টা কেবল বাজত না, ঘণ্টা একটি ইঙ্গিত দিত। আমার বাবা তা জেনে ফেলেছিলেন বলেই হয়তো হারিয়ে গেলেন।” আরিন দীর্ঘক্ষণ নীরব রইল। সে বুঝতে পারল, রুবিনার গোপন শুধু তার পরিবারের বেদনা নয়, বরং ঘণ্টার নীরবতার সঙ্গে জড়ানো এক বিপুল রহস্যের দরজা। রাতে বাইরে বাতাস বইছিল, দূরে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের অন্ধকার যেন তাদের কথোপকথন গোপনে শুনে ফেলছে। কিন্তু আরিন দৃঢ় হলো—এখন সে আর শুধু কৌতূহলী লেখক নয়, সে এই রহস্য উদঘাটনের একমাত্র পথিক। আর রুবিনা, যার চোখে শোক আর দৃঢ়তা মিলেমিশে আছে, হবে তার পথপ্রদর্শক। দুজনেই জানত, তাদের এই অনুসন্ধান সহজ হবে না। সামনে যে অদৃশ্য ছায়া অপেক্ষা করছে, তা হয়তো তাদের জীবনকেও গ্রাস করতে পারে। তবুও তারা ঠিক করল—সত্যকে আড়াল করে রাখা যাবে না, ঘণ্টার ধ্বনির পেছনের ইতিহাস যাই হোক, তা উন্মোচিত করতেই হবে।
৭
গ্রামের অলি-গলিতে যে নামটা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সে হলো হরিদাস কাকা। বয়স আশির ঘরে, তবুও তার কণ্ঠ এখনো দৃঢ়, চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। ছোটখাটো, শুকনো গড়নের মানুষটি সারাটা জীবন এই গ্রামেই কাটিয়েছেন। তিনি যেন জীবন্ত ইতিহাস, যার স্মৃতিতে মিশে আছে গ্রাম আর মন্দিরের বহু অজানা কাহিনি। এক সন্ধ্যায়, যখন আরিন আর রুবিনা একসঙ্গে গ্রামের চৌরাস্তায় বসে কথা বলছিল, হরিদাস কাকা এসে দাঁড়ালেন লাঠি ভর দিয়ে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন কাউকে সব বলতে, কিন্তু গ্রামের বাকিরা শোনার সাহস করেনি। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি বললেন, “তোমরা ঘণ্টার রহস্য জানতে চাইছো, তাই তো? তবে শোনো—এই ঘটনার শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে, যখন আমি ছোট ছেলে।” চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাতাসে শিস দিচ্ছিল বাঁশঝাড়, আর কাকারা গাছের ডালে গা জড়াচ্ছিল। হরিদাস কাকার কণ্ঠ যেন সেই নিস্তব্ধতায় আরও গম্ভীর শোনাল।
“তখনও এই গ্রাম এত ভিড়াক্রান্ত ছিল না। মাঠ-ঘাট ছিল খোলা, মানুষ ছিল সহজ-সরল। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ গ্রামে এক অচেনা সন্ন্যাসী এসে হাজির হয়। লম্বা দাড়ি, গেরুয়া বসন, কাঁধে ঝোলানো জপমালা—কিন্তু চোখদুটোতে ছিল এমন তীব্রতা যে, কেউ তার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারত না। তিনি সোজা মন্দিরের দিকে চলে গেলেন। আমরা ছেলেপেলেরা দূর থেকে তাকে অনুসরণ করছিলাম। তখন মন্দিরের ভেতরে কোনো ঘণ্টা ছিল না, শুধু দেবমূর্তি আর প্রদীপের আলো। সন্ন্যাসী নিজের পিঠের ঝোলা থেকে এক বিশাল পিতলের ঘণ্টা বের করলেন। যেন কোথা থেকে বহন করে এনেছেন—কেউই জানত না। তিনি ঘণ্টাটিকে মন্দিরের শীর্ষ থেকে ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর গ্রামের মানুষদের ডেকে বললেন, ‘শুনো, যতদিন এই ঘণ্টা নিজে থেকে বাজবে, ততদিন এই গ্রাম রক্ষা পাবে। এখানে কোনো অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু যেদিন এই ঘণ্টা নীরব হয়ে যাবে, বুঝবে রক্ষাকবচ ভেঙে গেছে।’ আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেলাম। এত বড় একটি ঘণ্টা, আর সন্ন্যাসীর সেই ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী—গ্রামের মানুষ একদিকে ভীত, অন্যদিকে আশ্বস্ত হলো। কারণ সেই রাত থেকেই ঘণ্টা ঠিক বারোটায় বাজতে শুরু করল, আর গ্রামে সত্যিই আর কোনো মহামারি, দুর্ভিক্ষ, কিংবা দস্যু আক্রমণ হলো না।”
হরিদাস কাকার কণ্ঠ যেন ক্রমশ ভারী হয়ে উঠল। তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “কিন্তু সন্ন্যাসী অনেকদিন থাকেননি। ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিয়ে তিনি যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কেউ জানল না তিনি কোথায় গেলেন। শুধু একটা কথা বলে গিয়েছিলেন—‘যখন ধ্বনি থেমে যাবে, তখন ছায়ারা জেগে উঠবে।’ তখন আমরা বুঝিনি এর মানে কী। এত বছর ধরে ঘণ্টা প্রতিদিন বাজছিল, তাই কেউ আর ভয় পেত না। কিন্তু আজ যখন সেটা থেমে গেছে, আমি শিউরে উঠছি। আমি জানি, এর মানে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। তোমরা শহুরে লোকেরা হয়তো যুক্তি দিয়ে সব ব্যাখ্যা করতে চাইবে, কিন্তু আমি নিজের চোখে সেই সন্ন্যাসীকে দেখেছি। ঘণ্টা কোনো সাধারণ বস্তু নয়। এটা একটা শপথ, একটা রক্ষাবলয়।” কথাগুলো শুনে চারপাশের হাওয়া যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। রুবিনা শিউরে উঠল, আরিনের চোখে কৌতূহলের সঙ্গে ভয়ের ছায়া মিলেমিশে গেল। তারা দুজনেই বুঝতে পারল, রহস্যটা এখন শুধু কুসংস্কার নয়—এটা বহু পুরনো প্রতিশ্রুতির, বহু পুরনো অভিশাপের এক অন্ধকার ইতিহাস। আর এই ইতিহাস যতদিন না ভাঙা হবে, গ্রাম হয়তো আরও গভীর বিপদের দিকে এগোবে।
৮
রাতের অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামে হঠাৎই নতুন এক আতঙ্কের জন্ম হলো। ঘণ্টাধ্বনি থেমে যাওয়ার পর থেকে যে রহস্য ঘিরে ছিল, তার সঙ্গে যেন নতুন করে আগুনে ঘি ঢালল এক অচেনা সন্ন্যাসীর আগমন। সন্ধ্যার পর, যখন আকাশে ঝড়ের ঘন মেঘ জমে গিয়েছিল আর বাতাসে শিস দিচ্ছিল অদ্ভুত শব্দ, তখনই মন্দির চত্বরে সেই সন্ন্যাসীকে প্রথম দেখা যায়। তার গেরুয়া পোশাক ধুলোয় ভরা, চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, আর কণ্ঠে অদ্ভুত এক সুর। গ্রামবাসীরা দূর থেকে জড়ো হয়ে তাকিয়ে রইল, আর কেউ সাহস পেল না কাছে যেতে। আরিন ও রুবিনা যখন মন্দিরের ভেতরে দাগগুলো পরীক্ষা করছিল, তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো—“যে ঘণ্টা তোমরা খুঁজছ, তার ভেতরে কেবল ধাতু নয়, বন্দী ছিল এক আত্মা।” সবাই একসাথে ঘুরে তাকাল। বৃদ্ধ পুরোহিত পূর্ণেশ শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। অচেনা সেই সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার উপস্থিতিতেই যেন বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল, আর প্রদীপের শিখা হঠাৎ দপদপ করে উঠল। তিনি পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেওয়া কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে মাটিতে টেনে এক বৃত্ত আঁকলেন। তারপর নিস্তব্ধ স্বরে বললেন, “এখন আর কোনো রক্ষাকবচ নেই। আত্মা মুক্ত হয়েছে।”
গ্রামের মানুষজন হতভম্ব হয়ে গেল। মোড়ল করিম প্রথমে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি কে? কীভাবে জানেন এসব কথা?” সন্ন্যাসী ঠান্ডা হেসে উত্তর দিলেন, “আমি সেই সন্ন্যাসীর উত্তরসূরি, যে বহু বছর আগে এই ঘণ্টা এখানে বেঁধে দিয়েছিল। তখন গ্রামের মানুষ কিছু বুঝত না, শুধু বিশ্বাস করত। কিন্তু এখন সেই রক্ষার সময় শেষ। ঘণ্টার ভেতরে এক ভয়ানক আত্মাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, যার ক্ষমতা এই গ্রামকে ধ্বংস করার মতো। যখন ঘণ্টা বাজত, তখন প্রতিদিন সেই আত্মার শক্তি দমন হতো, তার ছায়া দূরে ঠেলে দেওয়া যেত। কিন্তু এখন যেহেতু ধ্বনি থেমে গেছে, সে মুক্ত হয়ে গেছে। তোমরা ইতিমধ্যেই তার প্রভাব দেখতে শুরু করেছ—অদ্ভুত দুর্ঘটনা, মৃত্যু, ভয়।” চারপাশে ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণব বলল, “আমি সেই রাতে ছায়া দেখেছিলাম, তাহলে কি সেটাই সেই আত্মা?” সন্ন্যাসীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। “হ্যাঁ, তোমরা যা দেখেছ, তা হলো তার প্রথম পদচারণা।” রুবিনা তখন কেঁপে উঠল, কারণ তার বাবার রহস্যময় নিখোঁজ হওয়া হঠাৎ নতুন অর্থ খুঁজে পেল তার মনে। সে মনে মনে ভাবল, তবে কি তার বাবাও সেই আত্মার কবলে পড়েছিল?
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল—সত্যিই কি এই সন্ন্যাসী উত্তরসূরি, নাকি স্রেফ এক প্রতারক, যে ভয়কে কাজে লাগিয়ে গ্রামকে শাসন করতে চাইছে? আরিনের মনে সংশয় জমে উঠল। সে যুক্তি দিয়ে সব মেলাতে চাইছিল। সে বলল, “প্রমাণ কোথায়? ঘণ্টার ভেতরে আত্মা ছিল—এমন কথা আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব?” সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে তার দিকে তাকালেন। “প্রমাণ চাইছো? তবে অপেক্ষা করো। রাত নামছে। যখন বারোটা বাজবে, তখন তোমরা নিজেরাই সত্যিটা দেখতে পাবে।” কথাগুলো শুনে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষজন দৌড়ে বাড়ি ফিরতে লাগল, কেউ কেউ মন্দিরে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করতে শুরু করল। পূর্ণেশ পুরোহিত কপালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন, আর হরিদাস কাকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একমাত্র আরিন দাঁড়িয়ে রইল দৃঢ়ভাবে, যদিও ভেতরে তার নিজেরও কাঁপন ধরছিল। রুবিনা পাশে এসে বলল, “আমি জানি, এখানে একটা লুকানো সত্য আছে। আত্মা হোক বা না হোক, এই রহস্যটা মানুষের কাজেই বাঁধা।” কিন্তু আকাশে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল, দূরে কুকুরগুলো একসাথে হাউল করতে শুরু করল। সেই শব্দে গ্রাম যেন শিউরে উঠল। আর ঠিক তখনই সন্ন্যাসী শান্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে পড়লেন, যেন তিনি অপেক্ষা করছেন সেই ভৌতিক মুহূর্তের, যা সবার সন্দেহকে হয় নিশ্চিত করবে, নয়তো ভেঙে দেবে।
৯
মধ্যরাতের অন্ধকার যেন সেদিন অন্যরকম ছিল। চারপাশের নীরবতা এত ঘন হয়ে উঠেছিল যে বাতাসে শ্বাস নেওয়াটাও ভৌতিক লাগছিল। আরিন মনস্থির করল, আজ সে আর কোনো অনুমান বা গল্পে ভরসা করবে না—নিজ চোখে সত্যিটা দেখতে হবে। সে একা একাই মন্দিরের পথে হাঁটতে লাগল। আকাশে চাঁদ মেঘে ঢাকা, কেবল মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলক তাকে পথ দেখাচ্ছিল। চারপাশে কুকুরের হাউমাউ ডাক, শেয়ালের আর্তনাদ, আর হঠাৎ হঠাৎ পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলেমিশে রাতটাকে আরও ভৌতিক করে তুলেছিল। মন্দিরের কাছে পৌঁছতেই সে বুঝল কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে। ভেতরে মৃদু আগুনের আলো নাচছে, আর হাওয়ায় ভেসে আসছে এক অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, ঘি আর কোনো পোড়া জিনিসের মিশ্রণ। সতর্ক পায়ে সে চুপচাপ দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাল। সেখানে সে যে দৃশ্য দেখল, তাতে তার বুকের ভেতর ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল। পূর্ণেশ পুরোহিত, যিনি সবার কাছে ভক্তি আর ভয়ের প্রতীক, তিনি একা বসে এক অদ্ভুত যজ্ঞ করছেন। তার চারপাশে কালো বৃত্ত, আগুনের শিখা আর মাটিতে আঁকা অচেনা প্রতীক। পুরোহিতের ঠোঁটে অচেনা মন্ত্র গুনগুন করছে, আর চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনার ছাপ।
আরিন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এ কি সেই পূর্ণেশ, যিনি গ্রামবাসীকে সবসময় শান্ত থাকতে বলেন, যিনি দাবি করেন যে ঘণ্টা বন্ধ মানেই অশুভ শক্তির জাগরণ? তার হাতের গতিবিধি, মাটিতে ছড়ানো ছাই আর গলগল করে জ্বলে ওঠা প্রদীপ দেখে মনে হচ্ছিল—এ যেন কোনো লুকানো শক্তির সঙ্গে চুক্তি। ধীরে ধীরে আরিন বুঝতে পারল, ঘণ্টা নিজে থেকে বাজত না। বছরের পর বছর পূর্ণেশ নিজেই কোনো গোপন কৌশলে ঘণ্টা বাজাতেন। হয়তো যজ্ঞের মাধ্যমে, হয়তো মন্ত্রের প্রভাবে—কিন্তু ঘণ্টা বাজা আসলে ছিল এক মানব-নির্ভর রহস্য, দেবতার অলৌকিকতা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এবার কেন ঘণ্টা বাজা বন্ধ হয়ে গেল? কে তাকে থামাল? আর কেন গ্রামে এত দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করল? আরিন মন্দিরের ভেতরে আরও গভীরভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ লক্ষ্য করল, পুরোহিতের কণ্ঠে ভাঙন ধরেছে। তার শরীর ঘেমে উঠেছে, চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তিনি যেন কারও সঙ্গে লড়ছেন, চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে আবারও জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল একটি চাপা স্বীকারোক্তি—“আমি বছরের পর বছর ধরে ওকে আটকে রেখেছি… ঘণ্টার ভেতর বন্দী করেছি… কিন্তু এবার কেউ আমার সাধনা ভেঙে দিয়েছে… এখন আমি আর পারছি না।”
সেই মুহূর্তে আরিনের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। এতদিন যে বিশ্বাসে সবাই বেঁচে ছিল, তা আসলে পূর্ণেশের গোপন যজ্ঞের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ঘণ্টা ছিল কেবল প্রতীক—আসল বাঁধন ছিল পুরোহিতের শক্তি আর তার অজানা মন্ত্র। আর এখন, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে থামিয়ে দিয়েছে, অথবা তার সাধনায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে। হতে পারে সেই রহস্যময় সন্ন্যাসী, যিনি এসেছিলেন, হতে পারে গ্রামেরই কেউ, যে সত্য লুকাতে চেয়েছিল। আরিনের চোখে ভেসে উঠল গ্রামের আতঙ্কিত মানুষগুলোর ছবি—যারা মনে করছে অশুভ আত্মা মুক্ত হয়েছে। সত্যিটা আরও নির্মম। এটা কেবল অশুভ আত্মার খেলা নয়, এটা মানুষের লোভ, বিশ্বাস আর প্রতারণার জাল। কিন্তু আরিন যতই ভাবুক, উত্তর স্পষ্ট হলো না—কে চাইছিল এই গ্রামকে ধ্বংস করতে? কে চাইছিল পূর্ণেশের সাধনা ভাঙতে? মন্দিরের ভেতরে আগুন হঠাৎই দপদপ করে উঠল, আর মেঝের আঁচড়গুলো যেন জ্বলজ্বল করে উঠল আগুনের আলোয়। পূর্ণেশ ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলেন, শ্বাসকষ্টে কাঁপতে কাঁপতে। তার কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো শেষ কয়েকটি শব্দ—“বিশ্বাস… ভেঙে গেছে… কেউ… ওকে মুক্ত করে দিয়েছে…” তারপর নিস্তব্ধতা। আরিন দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকার মন্দিরের কোণে, বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে। এতদিনের বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, আর এখন সে জানে—গ্রামের ভয়ঙ্করতম সময় কেবল শুরু হলো।
১০
সেই রাতের ঝড় যেন অন্য যেকোনো সময়ের থেকে আলাদা ছিল। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যেন অশুভ সংকেত দিচ্ছে, আর হাওয়া তীব্র শিস বাজিয়ে ছুটছে গোটা গ্রাম জুড়ে। কুঁড়েঘরের খড় উড়ে যাচ্ছে, গাছগুলো ঝড়ের তাণ্ডবে কেঁপে কেঁপে যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। গ্রামের মানুষজন আতঙ্কে ঘরে লুকিয়েছে, কেউ কান্নাকাটি করছে, কেউ প্রার্থনা করছে, কেউবা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনার সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেল—একটি ঘর আগুনে পুড়ে গেল, আরেকটি পরিবার ভেঙে পড়া গাছের নিচে চাপা পড়ল, কয়েকজন গবাদি পশু ঝড়ে উড়ে গিয়ে জলে ডুবে মারা গেল। মনে হচ্ছিল এই রাতই গ্রামের শেষ রাত। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও আরিন বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন—এই ঝড় কি প্রকৃতির খেলা, নাকি কোনো অশুভ শক্তির উন্মোচিত ক্রোধ? ঠিক তখনই, রাত বারোটার ঘড়ি বাজার সঙ্গে সঙ্গে, হঠাৎই বেজে উঠল সেই বহুদিনের নিস্তব্ধ ঘণ্টা। কিন্তু সেটা আগের মতো সুরেলা বা শান্তির প্রতীক ছিল না। বরং তা ছিল করুণ, হাহাকারের মতো, ভীতিকর ও অশুভ সুরে ভরা। ঘণ্টার প্রতিটি ধ্বনি যেন গ্রামের বুক কেঁপে উঠছিল, মানুষের মনে আতঙ্কের ঢেউ বইছিল, শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই শিউরে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করল, কেউবা ভেবেছিল এটাই পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত।
আরিন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল সেই শব্দ। তার মনে হচ্ছিল যেন ঘণ্টা শুধু ধাতুর শব্দ নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে কোনো মানুষের কান্না, কোনো আত্মার হাহাকার, আর কোনো অজানা শক্তির চিৎকার। ঘরে ঘরে লোকজন বলাবলি শুরু করল—“আত্মা ফিরে এসেছে… আবার বেজে উঠল…” কেউ বলল, “এটা সতর্কবার্তা, আরও বড় বিপদ আসছে…” আবার কেউ দাবি করল, “ঘণ্টা বাজানো মানে আত্মা পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গেছে।” কিন্তু কারও কাছে কোনো উত্তর নেই, কোনো প্রমাণ নেই। পূর্ণেশের মৃত্যুর পর থেকে গ্রাম যেন আরও অন্ধকারে ডুবে গেছে, আর এখন ঘণ্টার এই অদ্ভুত আওয়াজ কেবল বিভ্রান্তি আর আতঙ্ক বাড়িয়ে দিল। রুবিনা ভয়ে ভয়ে আরিনের কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখে জল, কণ্ঠ কাঁপছে—“এটা কারা বাজাল? আমার বাবার নিখোঁজ হওয়ার রহস্যের সঙ্গে কি এর কোনো যোগ আছে?” আরিন তার দিকে তাকালেও কোনো উত্তর দিতে পারল না। কারণ তার নিজের ভেতরেই প্রশ্নের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। যদি পূর্ণেশ বছরের পর বছর ধরে ঘণ্টার মাধ্যমে আত্মাকে আটকে রেখেছিলেন, তাহলে এখন কে তাকে মুক্ত করল? আর যদি সত্যিই ঘণ্টা নিজে থেকেই বাজে, তবে কেন এতদিন বন্ধ ছিল আর আজ আবার বাজতে শুরু করল?
ঝড়ের তাণ্ডব, আগুনের দাপট আর ঘণ্টার বিভীষিকাময় ধ্বনি মিলেমিশে গ্রামটিকে অচেনা করে তুলল। মানুষজন প্রাণ বাঁচাতে দিকবিদিক ছুটছিল, কিন্তু ভয় থেকে মুক্তি পাচ্ছিল না। কেউ দেখেছে বলছে, ঘণ্টার দড়ি নিজের থেকেই নড়ছে, আবার কেউ বলছে, মন্দিরে অচেনা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আরিন ভেতরে ভেতরে যুক্তি খুঁজতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মস্তিষ্কও কেমন যেন জমে গিয়েছিল। ঘণ্টার প্রতিধ্বনি থামার পরও সেই শব্দ যেন বাতাসে ভেসে রইল, গ্রামের চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। সেই রাতে অনেকেই বেঁচে গেল, আবার অনেকের ঘর-সংসার শেষ হয়ে গেল, কিন্তু কারও কাছে আর কোনো উত্তর এলো না। ভোর হতেই ঝড় থেমে গেল, আগুন নিভে এল, গ্রামের ধ্বংসস্তূপ সামনে এল। মানুষ হাঁপ ছাড়লেও তাদের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—ঘণ্টা আবার কেন বাজল? এর মানে কী? সত্যিই কি আত্মা মুক্ত হলো, নাকি আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? কোনো উত্তর এলো না। শুধু ভয়ের আঁচলে জড়িয়ে গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। আরিন একা দাঁড়িয়ে মন্দিরের সামনে তাকাল—ঘণ্টা স্থির হয়ে ঝুলছে, কিন্তু তার চোখে এখনো যেন তার দুলে ওঠার প্রতিচ্ছবি ভাসছে। গ্রামের মানুষজন আর কখনো নিশ্চিত হতে পারল না—ওটা দেবতার সতর্কবার্তা, মানুষের কৌশল, নাকি আত্মার প্রতিশোধ। রহস্য অমীমাংসিতই থেকে গেল, রেখে গেল শুধু আতঙ্ক আর অনন্ত প্রশ্নের ছায়া।
সমাপ্ত




