আৰ্য্য সেনগুপ্ত
১
কলকাতার ভিড় আর শব্দের মধ্যে বড় হতে হতে মেঘলা সবসময়ই ভেবেছিল একদিন সে শিল্পের পথে নিজের একটা আলাদা জগৎ গড়ে তুলবে। ছোটবেলা থেকেই তার কাগজ-কলম, তুলিতে রঙ খেলা, আঁকিবুকির প্রতি ছিল অদ্ভুত টান, আর সেই টানই তাকে নিয়ে আসে এই ছোট্ট শহরের পুরোনো এক আর্ট স্কুলে। ট্রেন থেকে নামার মুহূর্তেই সে অনুভব করেছিল শহরটা যেন অন্য এক ছন্দে বেঁচে আছে—এখানে হর্নের শব্দ নেই, নেই বহুতল অট্টালিকার ছায়া, বরং আছে কাঁচা রাস্তার ধুলো, দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া লাল সূর্যের আলো, আর হাওয়ায় মিশে থাকা শাল-সেগুন পাতার গন্ধ। হঠাৎ করেই নিজেকে অচেনা লাগছিল তার—কোথাও নেই সেই চেনা বন্ধুরা, নেই তার নিজের পাড়া কিংবা কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান, নেই ভিড় ঠেলে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আড্ডা। তবু আঁকার প্রতি ভালবাসা তাকে সাহসী করে তুলেছিল। নিজের মনের ভেতর সে যেন বারবার বলছিল—“আমি ঠিক পারব, এখানেই হয়তো খুঁজে পাব আমার নতুন রঙের জগৎ।” ভর্তি হওয়ার দিন আর্ট স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। স্কুলটা একেবারেই শহরের বুকে অন্যরকম—কাঠের জানালা, ধূসর দেওয়ালে পুরোনো কালের নকশা, আর উঠোন জুড়ে গাছের ছায়া। লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কেমন যেন ধুকপুক শুরু হলো, অচেনা সব মুখ, অচেনা পরিবেশ, আর মনে হলো—নিজেকে আবার একেবারে নতুন করে শুরু করতে হবে।
প্রথম দিনের ক্লাসটা ছিল অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় ভরা। বড় বড় ক্যানভাস সাজানো স্টুডিওর ভেতর প্রথমবার ঢুকে যেন অবাক হয়ে গেল মেঘলা। জানালার পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল রোদ, ধুলোয় ঢাকা টেবিলের ওপর অগোছালো তুলির বাক্স, রঙের কৌটো আর ছাত্রছাত্রীদের নানান রঙের খসড়া। শহরের কলেজের আধুনিক পরিবেশের সঙ্গে এর তফাৎ যেন আকাশপাতাল। এখানে প্রতিটি জিনিসে লেগে আছে পুরোনো দিনের ছোঁয়া—চেয়ারের হাতল ঘষা হয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে, দেওয়ালের রঙ চটে গেছে, অথচ সেইসবের মাঝেই আছে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি, এক ধরনের পরিপূর্ণতা। প্রথম ক্লাসে শিক্ষক যখন বললেন—“আজ তোমাদের শুধু চারপাশকে চোখে দেখো, আর সেটাকে কাগজে ধরতে চেষ্টা করো”—তখন মেঘলা বুঝেছিল এখানকার শিক্ষা আলাদা রকমের হবে। কলকাতায় যেমন কেবল কৌশল আর প্রতিযোগিতার চাপ ছিল, এখানে হয়তো শেখানো হবে মন দিয়ে দেখা, অনুভব করা, আর সেই অনুভূতিকে রঙে পরিণত করা। তবে প্রথম দিনটা খুব সহজ ছিল না। সহপাঠীদের ভিড়ে সে যেন একটু একা, কেউ তাকে চেনে না, কেউ এগিয়ে এসে আলাপও করে না। সে নিজের খাতা খুলে নিঃশব্দে আঁকতে শুরু করল—এক কোণের পুরোনো জানালা, যেখানে আলো আর অন্ধকার মিশে গেছে। আঁকতে আঁকতে তার অস্বস্তি যেন একটু কমল, কারণ রঙ আর রেখার জগৎ তার কাছে সবসময়ই আশ্রয়।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হলো, হয়তো এই নতুন শহরই তাকে নিজের ভেতরের নতুন রঙ চিনতে শেখাবে। এখানে নেই কলকাতার তাড়াহুড়া, নেই সেই প্রতিনিয়ত দৌড়—বরং আছে নিস্তব্ধতা, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি রঙ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হোস্টেলের পথে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশটা লক্ষ করছিল সে—রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিপলগাছ, ছোট্ট মিষ্টির দোকান থেকে ভেসে আসা গরম জিলিপির গন্ধ, দূরে বাজতে থাকা মন্দিরের ঘণ্টা। সব মিলিয়ে পরিবেশটা যেন তাকে বলছিল—“ভয় পেও না, ধীরে ধীরে সবকিছু আপন হয়ে যাবে।” মনে মনে সে দাদুর কথা মনে করল, যিনি বলতেন—“রঙ কেবল কাগজে নয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে খুঁজে নিতে হয়।” সেই কথাই যেন আবার তাকে ভরসা দিল। যদিও একটু শূন্যতা, একটু একাকিত্ব রয়ে গেল, তবু আঁকার প্রতি তার অনুরাগ যেন এক অদ্ভুত আলো হয়ে তাকে পথ দেখাচ্ছিল। প্রথম দিনেই মেঘলা বুঝেছিল—এই শহর আর এই আর্ট স্কুল শুধু তার জন্য নতুন যাত্রার শুরু নয়, বরং এক নতুন জীবনের রঙিন ক্যানভাস।
২
মেঘলার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস যদি কিছু থাকে, তবে তা হলো তার দাদুর দেওয়া সেই পুরোনো রঙপেন্সিল সেট। ছোটবেলায়, যখন সে প্রথমবার আঁকার খাতা হাতে নিয়েছিল, তখনই দাদু তাকে বলেছিলেন—“রঙ দিয়ে শুধু ছবি আঁকতে হয় না, মনকেও রাঙাতে হয়।” সেই কথা শুনেই দাদু একদিন তার জন্মদিনে এনে দিয়েছিলেন বারোটা রঙপেন্সিলের একটা ছোট্ট বাক্স। বাক্সটা বাইরে থেকে তেমন চমকপ্রদ ছিল না—পাতলা টিনের কেস, যার উপরে ছিল ফিকে হয়ে আসা একখানা প্রিন্ট করা দৃশ্যপট, একটা ছোট্ট ঘর, সবুজ মাঠ আর নীল আকাশ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেসটা আরও ক্ষয়ে গেছে, আঁচড় পড়েছে, রঙ ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু মেঘলার কাছে সেটা যেন এক অমূল্য সম্পদ। কারণ প্রতিটি রঙপেন্সিলে জমে আছে তার শৈশবের কত না স্মৃতি—প্রথম আঁকা ফুল, স্কুলের আঁকাআঁকির প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাওয়া, কিংবা দাদুর পাশে বসে বসে সন্ধেবেলা মাটির প্রদীপ আর নদীর ছবি আঁকা। রঙগুলো তার কাছে কেবল শিল্পের উপকরণ নয়, বরং দাদুর ভালোবাসার স্পর্শ। এখনো যখন সে সেগুলো হাতে নেয়, মনে হয় দাদু যেন কানে কানে বলছেন—“ভয় পেও না, আঁকো, তোমার রঙই তোমাকে পথ দেখাবে।”
কলকাতার ঘরে এক কোণে সযত্নে রাখা থাকলেও মেঘলা এই শহরে পড়তে আসার সময় সঙ্গে এনেছিল সেই রঙপেন্সিল সেটটিই। অন্য কোনো জিনিস না থাকলেও, এইটুকু সঙ্গী তার কাছে অপরিহার্য। হোস্টেলের ঘরে নতুন জায়গায় একা থাকতে থাকতে যখন মন খারাপ হতো, তখন সে ওই রঙপেন্সিলগুলো বের করে রাখত সামনে। মনে হতো এগুলোই তার পুরোনো পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের সেতু। সেগুলোর প্রতিটি রঙ যেন একেকটা গল্প বলত—লাল রঙ মনে করাত পাড়ার পূজোর প্যান্ডেলের আলো, নীল রঙ মনে করাত গঙ্গার ধার ধরে দাদুর সঙ্গে হাঁটার দিনগুলো, সবুজ রঙ ফিরিয়ে আনত বাগানের ঘাস আর গাছের ছায়া। কখনো কখনো আঁকতে বসলে সে নিজের অজান্তেই দাদুর সঙ্গে কথা বলে ফেলত, “এই রঙটা আজ একটু হালকা হয়ে গেছে দাদু, কী করব?”—মনে হতো দাদু যেন দূর থেকে হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন। আর এইসব ছোট ছোট অনুভূতিই তাকে সাহস জোগাত, নতুন শহরের অচেনা পরিবেশে একা হলেও মনে হতো, সে একেবারেই একা নয়।
এই রঙপেন্সিলগুলোর সঙ্গে আবেগ এতটাই জড়িয়ে গিয়েছিল যে মেঘলা কখনো ওগুলো কাউকে ধরতেও দিত না। সহপাঠীরা যদি রঙ চাইত, সে কেবল অন্য বাক্স থেকে দিত, কিন্তু দাদুর দেওয়া সেটটা সে নিজের ভেতরের এক পবিত্র গোপন ধন হিসেবেই আগলে রাখত। প্রতিটি ক্লাসে, প্রতিটি আঁকায়, সে এই রঙগুলো দিয়েই আঁকতে চেষ্টা করত, যেন দাদুর আশীর্বাদ সবসময় তার সাথে থাকে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেন্সিলগুলো ছোট হয়ে গিয়েছে, কোনো কোনোটা এতটাই ছোট যে ধরে আঁকতে কষ্ট হয়, তবু মেঘলা সেগুলোই ব্যবহার করে—কারণ তার কাছে এগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঁকার মানেই আলাদা। নতুন রঙপেন্সিল সে কিনতে পারে, কিন্তু এই পুরোনো গুলোর মধ্যে যে আবেগ, যে ভালোবাসা জমে আছে, তা কোনো নতুন জিনিসেই পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক সময় সে কল্পনা করত, যদি কোনোদিন সে খুব বড় শিল্পী হয়, তাহলে প্রদর্শনীর প্রথম ছবিটাই আঁকবে এই রঙপেন্সিল দিয়েই, যাতে সবাই জানে—তার জীবনের প্রথম প্রেরণা কোথা থেকে এসেছে। আর্ট স্কুলের নতুন ক্লাসে বসে, অচেনা মুখগুলোর ভিড়ে, যখন মন খারাপ হতো, তখন ওই রঙপেন্সিলগুলো আঁকিবুকির মতো আঁকায় প্রাণ ঢেলে দিত। তাই মেঘলার কাছে দাদুর দেওয়া এই পুরোনো রঙপেন্সিল সেট শুধু একটি আঁকার সরঞ্জাম নয়, বরং তার মনের ভেতর জমে থাকা সাহস, স্মৃতি আর ভালোবাসার এক অনন্ত উৎস।
৩
সেদিন ছিল একদম সাধারণ দিন। সকালে হোস্টেল থেকে বেরোনোর সময় মেঘলা সবসময়কার মতো রঙপেন্সিলের টিনবাক্সটা ব্যাগে রেখেছিল। সে অভ্যস্ত, ব্যাগ গুছিয়ে নেয়ার সময় প্রথমেই খাতার পাশে জায়গা করে দিত বাক্সটা। আর্ট স্কুলে পৌঁছে সে ক্লাসে গিয়ে বসেছিল জানালার পাশে, আলো এসে পড়ছিল ঠিক তার খাতার ওপর। সেদিন শিক্ষক বলেছিলেন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো অশ্বত্থগাছটাকে আঁকতে। মেঘলা টিনবাক্স খুলে রঙপেন্সিল বের করে যত্নে সাজিয়ে রেখেছিল টেবিলে। খাতা জুড়ে অশ্বত্থের ছায়া আর আলো মিশিয়ে সে যখন আঁকছিল, তখন অন্য সবকিছু যেন ভুলে গিয়েছিল। ঘণ্টা বাজতেই ক্লাস শেষ হলো, সবাই তাড়াহুড়া করে খাতা গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। মেঘলাও বই-খাতা, জলরঙ সব গুছিয়ে নিল, কিন্তু সেই ব্যস্ততার ভিড়ে ভুল করে রঙপেন্সিলের বাক্সটা খোলা টেবিলেই পড়ে রইল। সে টেরই পেল না, নতুন শহরের ভিড়ে হোস্টেলের পথে হেঁটে আসার সময় পর্যন্ত তার মনটা ছিল খুশি—কারণ সেদিনের ছবিটা খুব ভালো হয়েছিল, যেন দাদুর কথামতো সত্যিই সে রঙের ভেতরে আলো খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু হোস্টেলে ফিরে ব্যাগ খুলতেই হঠাৎ হৃদয়টা কেঁপে উঠল। কোথাও নেই সেই টিনবাক্স। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো অন্য খাতার নিচে চাপা পড়েছে, ব্যাগ উলটে দিল, বিছানায় সব জিনিস ছড়িয়ে দিল, কিন্তু না—বাক্সটা নেই।
সেই মুহূর্তে মেঘলার বুকের ভেতর যেন একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো। হাত কাঁপতে লাগল, চোখে জল চলে এলো। মনে পড়ল কীভাবে দাদু তার ছোট্ট হাত ধরে দোকানে নিয়ে গিয়ে বাক্সটা কিনেছিলেন, কীভাবে প্রতিটি রঙপেন্সিলে তিনি নিজের মমতা মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছিল, শুধু একটা টিনবাক্স হারায়নি সে, বরং হারিয়ে ফেলেছে নিজের শৈশবের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতিটা। দ্রুত দৌড়ে সে আবার স্কুলে ফিরে গেল, ক্লাসঘরে ঢুকে টেবিলের নিচে, বেঞ্চের পাশে, কোণায় কোণায় খুঁজল। ক্লাসরুম তখন প্রায় ফাঁকা, শুধু দু-একজন ছাত্রছাত্রী টুকটাক কাজ করছিল। কেউ দেখেনি রঙপেন্সিলের বাক্সটা। মেঘলা ছুটে গেল দোতলায়, লাইব্রেরির পাশে, এমনকি স্কুলের উঠোনেও, হয়তো ভুল করে কোথাও রেখে এসেছে—কিন্তু না, কোনো চিহ্ন নেই। কারো কাছে জিজ্ঞেস করলে শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর মিলল, “না, কিছু দেখিনি।” তার কানে সেই উত্তরের পর শুধু শূন্যতার শব্দ বাজছিল। মনে হচ্ছিল চারপাশের রঙ যেন একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে, আকাশ থেকে আলো উধাও হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধে নামতে শুরু করল, স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল, কিন্তু মেঘলার খোঁজা থামল না। সে হোস্টেলে ফিরে গেল আবার, ভাবল হয়তো ভুল করে কোনো অচেনা খাতার ভেতর ঢুকে গেছে, আবার সব বের করে দেখল, কিন্তু ফল কিছুই মিলল না। এবার তার মনে হলো, হয়তো কেউ ভুল করে নিয়ে গেছে, অথবা মজা করে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এত দামি কিছু তো নয় যে কেউ চুরি করবে! আবার সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল, “হয়তো কাল সকালে আবার পাব, হয়তো কোনো শিক্ষক খুঁজে পাবেন।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত—তার প্রিয় রঙপেন্সিলগুলো হয়তো সত্যিই হারিয়ে গেছে। এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে গ্রাস করল, যেন সে নিজের আঁকার সাহসটাই হারিয়ে ফেলল। রাতে বিছানায় শুয়ে সে চোখ বন্ধ করতেই মনে হচ্ছিল দাদুর মুখ ভেসে উঠছে—দাদু যেন মৃদু হাসি দিয়ে বলছেন, “রঙ হারায় না মেঘলা, রঙ তোমার ভেতরেই থাকে।” কিন্তু মেঘলার কাছে সেই কথা সান্ত্বনা হয়ে উঠছিল না। তার মনে হচ্ছিল—রঙপেন্সিল হারানো মানেই তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে হারানো, শৈশবের গল্পগুলো হারানো। আর সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল, কোনো জিনিস যদি সত্যিই ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে, তবে তার হারানো মানুষকে ভিতর থেকে ভেঙে দিতে পারে। আর এই ভাঙনের ভেতর দিয়েই হয়তো শুরু হতে যাচ্ছে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়, যা সে তখনো বুঝতে পারেনি।
৪
রঙপেন্সিল হারানোর পরের কয়েকটা দিন মেঘলা যেন নিজের ছায়া হয়ে বেঁচে ছিল। ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন থাকত অন্য কোথাও—দাদুর দেওয়া সেই বাক্সটার খোঁজে। আঁকার খাতা খুললেও রঙহীন পেন্সিল দিয়ে কাজ শুরু করতে পারত না, বারবার মনে হতো হাতের ভেতর থেকে আলোটাই হারিয়ে গেছে। সেই সময়ই একদিন আর্ট স্কুলের উঠোনে, পুরোনো অশ্বত্থগাছের ছায়ার নিচে বসে ছিল সে, খাতাটা খুলে রেখেছিল সামনে, কিন্তু একটিও দাগ টানতে পারছিল না। ঠিক তখনই এক ছেলেকে দেখতে পেল—একেবারে নিরবে এক কোণে বসে আছে, তার চোখ দুটো যেন অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল, যেন অনেক কথা বলার মতো আছে, অথচ মুখে কিছু বলে না। ছেলেটির হাতে একটা পেন্সিল, কিন্তু সে লিখছে না বা আঁকছে না, কেবল খাতার ওপর নখ দিয়ে অদ্ভুত রেখা কাটছে। মেঘলা প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করল ছেলেটি মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে তার দিকে, যেন তার চুপচাপ ভেতরের ভাঙনটা টের পাচ্ছে। দুজনের চোখ হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য মিলল, আর সেই দৃষ্টির ভেতর মেঘলা যেন একটা অদ্ভুত সান্ত্বনা খুঁজে পেল।
পরের দিন ক্লাস শেষে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল তাদের। করিডোরের এক কোণে মেঘলা ব্যাগ গোছাচ্ছিল, হঠাৎ পেছন থেকে একটা শান্ত স্বর শোনা গেল—“তুমি তো নতুন এসেছ, তাই না?” মেঘলা ঘুরে তাকিয়ে দেখল, সেই চুপচাপ ছেলেটিই, যে অশ্বত্থগাছের তলায় বসে ছিল। তার মুখে কোনো জোরাজুরি নেই, কেবল নিঃশব্দ কৌতূহল। মেঘলা একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ… আমার নাম মেঘলা। তুমি?” ছেলেটি মৃদু হেসে বলল, “অর্ণব।” কথোপকথন খুব ছোট্ট ছিল, কোনো বাড়তি উষ্ণতা বা আন্তরিকতা ছিল না। অর্ণবের চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা থাকলেও তার গলায় ছিল এক ধরনের নিস্তব্ধতা, যেন সে খুব বেশি কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। মেঘলাও তেমন এগিয়ে গেল না, কারণ এখনও তার মন ভরে ছিল সেই হারানো রঙপেন্সিলের ব্যথায়। তবুও, আলাপের পর মনে হলো অর্ণবের উপস্থিতি কেমন যেন অচেনা হলেও নিরাপদ, যেন দীর্ঘদিনের একা থাকার পর হঠাৎ কারো সঙ্গে চোখে চোখ পড়েছে, যে কিছু না বলেও বোঝে।
এরপর থেকে মাঝে মাঝে মেঘলা লক্ষ্য করত—অর্ণব একেবারেই আলাদা ধরনের মানুষ। ক্লাসে সে খুব মনোযোগী, কিন্তু নিজের খাতার ভেতরেই ডুবে থাকে। কারও সঙ্গে খুব একটা মিশত না, আড্ডার ভিড়েও তাকে দেখা যেত না। অথচ আঁকায় তার হাত দারুণ—ক্লাসের অন্য ছাত্রছাত্রী যখন কৌশল নিয়ে ব্যস্ত, তখন অর্ণবের ছবিতে ফুটে উঠত অদ্ভুত গভীরতা। মেঘলা একদিন দূর থেকে দেখছিল, অর্ণব আঁকছে একটা ছোট্ট পুকুরের দৃশ্য—কিন্তু ছবির পানিতে এমন নিস্তব্ধতা ফুটিয়ে তুলেছিল যে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওই ছবির মধ্যে ডুবে যাবে। সেদিন থেকেই মেঘলার মনে কৌতূহল জেগেছিল—এই ছেলেটি কে? কীভাবে সে এমন ভেতরের আলো আঁকায় আনতে পারে? যদিও তারা সরাসরি কথা বলত না, কেবল মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো, আর সেসব মুহূর্তে অদ্ভুত একটা বন্ধন তৈরি হতে শুরু করেছিল। তবুও তাদের প্রথম আলাপটা ঠাণ্ডাই রয়ে গেল—দুজনেই যেন ভেতরের কথাগুলো আড়াল করে রেখেছিল, হয়তো সময়ের অপেক্ষা ছিল। আর মেঘলার অজান্তেই সেই অচেনা ছেলেটিই ধীরে ধীরে তার জীবনের রঙ ফিরিয়ে দেওয়ার পথে এগোতে শুরু করেছিল।
৫
সেদিন বিকেলে আর্ট স্কুলের করিডর ফাঁকা হয়ে আসছিল। ছাত্রছাত্রীরা ধীরে ধীরে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে, শুধু আঁকার গন্ধ আর দেওয়ালে ঝোলানো পুরোনো ক্যানভাসগুলোর দৃষ্টি রয়ে গেছে চারদিকে। মেঘলা তখনও নিজের ক্লাসরুমের বেঞ্চে বসে ছিল, চোখের কোণে চাপা একটা দুঃখ যেন লেগেই আছে। রঙপেন্সিল হারানোর পর থেকে তার আঁকার জগতে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অন্যরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেও সে কিছু না বলে শুধু ম্লান হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায়। এদিকে অর্ণবও চুপচাপ গা-ঢাকা দেওয়া ছেলেটি, যার উপস্থিতি বোঝা যায় না যদি না সে সামনে এসে দাঁড়ায়। মেঘলা একদিন দেখেছিল, ক্যানভাসে কেউ না দেখলে সে কত মন দিয়ে আঁকে, কিন্তু লোকসমাগমে সব সময় যেন নিজেকে গুটিয়ে রাখে। হঠাৎ সেই বিকেলে করিডরের অন্যপ্রান্তে অর্ণবকে দেখা গেল—কিছু খুঁজছে সে, মেঝেতে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। প্রথমে মেঘলা ভেবেছিল ও হয়তো নিজের কিছু হারিয়েছে, কিন্তু মিনিটখানেকের মধ্যে সে লক্ষ্য করল—অর্ণবের হাতে ধরা আছে একটি ছোট্ট টিনের বাক্স, ধুলো আর কাগজের টুকরোয় ভরা।
মেঘলা হতভম্ব হয়ে উঠল যখন অর্ণব ধীরে ধীরে তার সামনে এসে বাক্সটা এগিয়ে ধরল। “এটা কি তোমার?” অর্ণবের গলায় দ্বিধা ছিল, কিন্তু চোখে স্পষ্ট আন্তরিকতা। বাক্সটা খোলার পর মেঘলার নিঃশ্বাস যেন আটকে গেল। ওর চোখে জল জমে উঠল যখন দেখল—তার সেই দাদুর উপহার দেওয়া পুরোনো রঙপেন্সিল সেট! ধুলোয় ঢেকে গেছে, কয়েকটা পেন্সিলের কাঠ ভিজে গিয়ে একটু ফুলে উঠেছে, কিন্তু তবুও ওগুলো তার কাছে অমূল্য। মেঘলার হাত কাঁপছিল, যেন হারিয়ে যাওয়া শৈশব আবার হাতের মুঠোয় ফিরে এসেছে। সে কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারল না, শুধু একেবারে নিঃশব্দে বাক্সটা বুকে জড়িয়ে ধরল। অর্ণব ধীরে ধীরে বলল, “আমি ময়লার পাশ থেকে পেলাম এটা। ভেবেছিলাম ফেলে দেওয়া জিনিস, কিন্তু কাছ থেকে দেখে বুঝলাম এটা আঁকার রঙপেন্সিল। তোমার ক্লাসে সবাই বলছিল তুমি কিছু খুঁজছো, তাই ভেবেছি হয়তো এটা তোমারই।” অর্ণবের এই অপ্রত্যাশিত সাহায্যে মেঘলার মনে এক ঝটকায় কৃতজ্ঞতার সাথে বিস্ময়ও মিশে গেল।
সেদিন সূর্যাস্তের রঙে ভিজে থাকা আকাশের নীচে মেঘলা দাঁড়িয়ে ছিল নিজের প্রিয় রঙপেন্সিলকে বুকে টেনে, আর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণব। তাদের মাঝে তখনও কোনো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি, কিন্তু এক অদ্ভুত উষ্ণতার স্রোত বয়ে গিয়েছিল। মেঘলা ভাবল—এই ছেলেটি চুপচাপ হলেও কত যত্নশীল, কত আলাদা সবার থেকে। তার মনে হচ্ছিল যেন দাদুর হাতের ছোঁয়া আবার ফিরে এসেছে অর্ণবের মাধ্যমে। চোখের কোণে অশ্রু জমলেও মেঘলা মৃদু হেসে বলল, “ধন্যবাদ, তুমি জানো না এটা আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।” অর্ণব শুধু মাথা নেড়ে সামান্য হেসে উঠল, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে মেঘলা বুঝে গেল—কিছু বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্ক এমনভাবে শুরু হয়, যখন কেউ আমাদের গভীর দুঃখের মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দেয়। তার রঙপেন্সিল ফিরে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি সে উপলব্ধি করল—তার জীবনে এক নতুন মানুষের উপস্থিতি আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে।
৬
রঙপেন্সিল ফেরত পাওয়ার সেই ঘটনার পর থেকে মেঘলা আর অর্ণবের সম্পর্কের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে শুরু করল। আগে তারা একে অপরকে কেবল সহপাঠী হিসেবে চিনত, দুজনেই ছিল অনেকটাই নিজের মতো গুটিয়ে থাকা মানুষ। কিন্তু এখন আর চোখাচোখি হলে তারা নিঃশব্দে এড়িয়ে যায় না, বরং অল্প হলেও কথোপকথন শুরু হয়। প্রথমদিকে কথা ঘুরত পড়াশোনা বা ক্লাসের প্রোজেক্ট নিয়েই, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা নিজেদের ভেতরের জগত ভাগ করে নিতে শিখল। মেঘলা একদিন নিজের দাদুর গল্প শোনাল—কীভাবে ছোটবেলায় রঙপেন্সিল সেটটা তার হাতে দিয়েছিল দাদু, আর সেই মুহূর্ত থেকেই আঁকাকে নিজের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী ভেবেছে সে। অর্ণব চুপচাপ শুনছিল, মাঝে মাঝে ছোট্ট হাসি দিয়ে মাথা নেড়েছিল। তারপর একদিন মেঘলা অবাক হয়ে শুনল অর্ণব বলছে, “আমিও যখন ছোট ছিলাম, বাবার অফিসের পুরোনো খাতা চুরি করে আঁকতাম। তখন কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু আমার কাছে আঁকাটা ছিল নিজের কথা বলার মতো।” তাদের কথায় যেন এক সেতু তৈরি হল, যেটা প্রতিদিন একটু একটু করে শক্ত হতে লাগল।
স্কুলে একটা নতুন প্রোজেক্ট এলো—পুরোনো শহরের দৃশ্য এঁকে প্রদর্শনী করা। শিক্ষকেরা জোড়ায় জোড়ায় ভাগ করে দিল, আর মেঘলা আর অর্ণবকে একসঙ্গে কাজ করতে হলো। প্রথমে তারা দুজনেই একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝল একসঙ্গে কাজ করা বেশ আনন্দের। অর্ণবের চোখ ছিল সূক্ষ্মতায় ভরা; সে শহরের গলির প্রতিটি ভাঙা দেওয়াল, দোকানের পুরোনো সাইনবোর্ড, কিংবা ছেলেদের ক্রিকেট খেলার ভঙ্গিমা লক্ষ্য করত নিখুঁতভাবে। মেঘলা তার ক্যানভাসে রঙের খেলা দিয়ে সেই মুহূর্তগুলোকে জীবন্ত করে তুলত। তারা বিকেলবেলা ক্লাস শেষে বেরোত, শহরের সরু গলি, পুকুরঘাট, কিংবা চায়ের দোকানের পাশে বসে আঁকত। কখনও তারা একসঙ্গে নীরবে বসে থাকত—মেঘলা রঙ মিশিয়ে তুলির টান দিচ্ছে, আর অর্ণব খাতায় দ্রুত স্কেচ টানছে। আবার কখনও তারা হেসে উঠত ছোটখাটো ঘটনায়, যেমন রঙপেন্সিল গড়িয়ে গিয়ে পানিতে পড়ে যাওয়া, বা চায়ের দোকানের আড্ডাবাজ লোকেরা তাদের আঁকা দেখে মন্তব্য করা। এইসব মুহূর্তেই তারা বুঝতে পারল বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে তাদের মাঝে অচেনা একটা জায়গা তৈরি করছে।
মেঘলা লক্ষ্য করছিল, অর্ণব শুধু চুপচাপ ছেলে নয়, তার ভেতরে একটা গভীর সংবেদনশীলতা আছে। সে যেভাবে শহরের প্রতিটি কোণাকে আঁকায় বন্দি করে ফেলে, তাতে মেঘলার মনে হতো অর্ণবের চোখে এই শহরটা যেন একেবারে নতুন করে জন্ম নেয়। আর অর্ণবও ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, মেঘলার রঙের স্পর্শে প্রতিটি ছবি যেন প্রাণ ফিরে পায়। তাদের এই পারস্পরিক বোঝাপড়া থেকে একটা বিশ্বাস জন্ম নিল, যেটা তাদের বন্ধুত্বকে আরও শক্ত করে তুলল। এখন স্কুলের করিডরে দেখা হলে শুধু হাসি বিনিময় নয়, বরং ক্লাস শেষে পরিকল্পনা করা হতো—আজ কোথায় গিয়ে আঁকা হবে, কী দৃশ্য ধরা হবে। মেঘলা একদিন চুপচাপ নিজের মনে বলল, “হয়তো এই শহরটা আমার কাছে এত অচেনা থাকত না, যদি অর্ণব না থাকত।” আর অর্ণব একবার ডায়েরিতে লিখে ফেলেছিল, “যদি কারও সঙ্গে আঁকার স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়া যায়, তবে সেটাই আসল বন্ধুত্ব।” তারা হয়তো তখনও টের পায়নি, কিন্তু তাদের বন্ধুত্বের এই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা সম্পর্ক একদিন আরও গভীর কিছুতে রূপ নিতে চলেছে।
৭
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, আর মেঘলার কাছে অর্ণবের সঙ্গে কাটানো সময় যেন জীবনের এক অন্যরকম অর্থ খুঁজে দিচ্ছিল। রঙপেন্সিল, যা একসময় শুধু দাদুর দেওয়া শৈশবের স্মৃতি ছিল, এখন যেন আরও গভীর অর্থ বহন করছে। আগে সে আঁকত শুধু নিজের কল্পনা আর আবেগের জগৎ ধরে রাখতে, কিন্তু অর্ণবের সঙ্গে আঁকতে গিয়ে বুঝল—প্রতিটি রঙের একটা আলাদা শক্তি আছে, একটা আলাদা গল্প আছে বলার। লাল শুধু ভালোবাসা বা আবেগ নয়, কখনও তা রাগ বা প্রতিবাদও হতে পারে; নীল শুধু শান্তি নয়, বরং একাকীত্ব আর রহস্যের প্রতীকও হতে পারে। অর্ণব যখন তাকে বলত, “প্রতিটি রেখা আসলে আমাদের ভেতরের কথাগুলোকে বাইরে আনার একটা উপায়,” তখন মেঘলার মনে হতো তার আঁকাগুলো হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠছে। আগে হয়তো সে কেবল সৌন্দর্য ধরার চেষ্টা করত, কিন্তু এখন অর্ণব তাকে শিখিয়ে দিল কীভাবে অসম্পূর্ণতার মধ্যেও সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে ভাঙা দেওয়ালের রঙচটা অংশও একেকটা গল্প বলতে পারে। এভাবে রঙপেন্সিল আর তার জীবনের মধ্যে এক গভীর যোগসূত্র তৈরি হতে লাগল।
এক বিকেলে তারা শহরের প্রাচীন পুকুরঘাটে বসে আঁকছিল। সূর্যের আলো পানির উপর ছড়িয়ে পড়েছিল সোনালি রেখার মতো, আর মেঘলা সেই দৃশ্য আঁকছিল মন দিয়ে। হঠাৎ অর্ণব বলল, “তুমি জানো, আমি যখন প্রথম আঁকতে শুরু করি, তখন শুধু সাদা আর কালো ব্যবহার করতাম। আমি ভেবেছিলাম পৃথিবী শুধু ওই দুই রঙেই ধরা যায়।” মেঘলা অবাক হয়ে তাকাল, “তাহলে এখন তুমি এত রঙ কেমন করে ব্যবহার কর?” অর্ণব হেসে বলল, “কারণ আমি বুঝেছি, সাদা আর কালোর মাঝখানে অসংখ্য রঙ আছে। আর সেই রঙগুলো খুঁজে পেতে হলে কাউকে পাশে পাওয়া দরকার। হয়তো তুমি না থাকলে আমি এখনও সাদা-কালোতেই আটকে থাকতাম।” মেঘলার বুকটা ধক করে উঠল। সে কিছু বলল না, শুধু চুপচাপ তার ক্যানভাসে নতুন করে এক চিলতে সবুজ যোগ করল। মনে হলো যেন সবুজটা শুধু প্রকৃতির নয়, বরং তার ভেতরে জন্ম নেওয়া এক নতুন অনুভূতির প্রতীক। সেই মুহূর্তে সে উপলব্ধি করল—রঙপেন্সিল শুধু আঁকার জন্য নয়, বরং তার জীবনকেও নতুন আলোয় ভরিয়ে তুলছে।
এইভাবে অর্ণবের সাহচর্যে মেঘলা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করল যে রঙ কেবল বাইরের দুনিয়া আঁকতে ব্যবহার হয় না, বরং মানুষের ভেতরের দুনিয়াকেও প্রকাশ করে। যে মেঘলা এতদিন ধরে নিজের দুঃখ, নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতা আঁকায় ঢেলে দিত, সে এখন শিখেছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেও রঙ আছে। হয়তো সেসব রঙ সবসময় উজ্জ্বল নয়, অনেক সময় ম্লান, ধূসর বা ঝাপসা হয়ে থাকে, তবুও তারা জীবনের অঙ্গ। এক রাতে সে নিজের ঘরে বসে ক্যানভাসে অর্ণবের মুখ আঁকতে চেষ্টা করল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সে অর্ণবকে আঁকল না শুধু তার চেহারায়, বরং তার চারপাশে ছড়িয়ে দিল নানা রঙের আলো—হলুদ, সবুজ, নীল, লাল। যেন অর্ণব কেবল একজন মানুষ নয়, বরং তার জীবনে ফিরে আসা রঙগুলোর প্রতীক। আঁকা শেষ করে সে নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল আর ভাবল, “হয়তো এটাই জীবনের আসল পাঠ—যে মানুষ তোমাকে রঙ শিখিয়ে দেয়, সে-ই তোমার পৃথিবী বদলে দেয়।” সেই মুহূর্তে মেঘলা বুঝতে পারল, তার রঙপেন্সিল আর কেবল শৈশবের স্মৃতি নয়, বরং জীবনের নতুন মানে খুঁজে পাওয়ার এক সেতু হয়ে উঠেছে, যেখানে অর্ণব ধীরে ধীরে তার জীবনের প্রতিটি আঁচড়ে নতুন রঙ যোগ করছে।
৮
একদিন বিকেলে ক্লাসের কাজ শেষ করে মেঘলা আর অর্ণব স্কুলের পেছনের পুরোনো অশ্বত্থগাছের নিচে বসেছিল। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া, চারপাশে পাখির ডাক, আর তাদের হাতে কাগজ-খাতা। মেঘলা এঁকে চলেছিল একটা রোদ্দুরভেজা জানালা, কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্য করল অর্ণব চুপ করে বসে আছে, যেন আঁকায় মন নেই। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো, আঁকছ না কেন?” অর্ণব একটু থেমে বলল, “জানো, আমার ছোটবেলা খুব সহজ ছিল না। তখনকার দিনগুলো আজও মনে করলে বুকটা ভারী হয়ে যায়।” মেঘলা অবাক হয়ে শুনছিল, কারণ এতদিন ধরে সে কখনও অর্ণবকে এত খোলামেলা কথা বলতে শোনেনি। অর্ণব ধীরে ধীরে বলল, “আমার বাবা-মার মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। বাড়িতে সবসময় ঝগড়া, চিৎকার লেগেই থাকত। আমি একসময় ভয় পেয়ে যেতাম, ঘুমোতে পারতাম না। তখনই আঁকা আমার আশ্রয় হয়ে উঠল। খাতায় রঙ দিয়ে আমি এমন একটা পৃথিবী বানাতাম, যেখানে কোনো ঝগড়া নেই, কোনো কান্না নেই—শুধু শান্তি।” তার কণ্ঠে ছিল ভারী আবেগ, যেন প্রতিটি শব্দে সেই অতীতের যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে।
মেঘলা নিঃশব্দে শুনছিল, আর মনে হচ্ছিল প্রতিটি কথাই তার হৃদয়ে গভীর দাগ কাটছে। অর্ণব আবার বলল, “আমি তখন খুব একা ছিলাম। স্কুলে বন্ধুত্ব করার মতো কাউকে পাইনি। সবাই আমাকে একটু আলাদা চোখে দেখত—কারণ আমি ক্লাসে তেমন কথা বলতাম না, শুধু আঁকতাম। আমার শিক্ষকরা বলত আমি হয়তো অদ্ভুত, কিন্তু আসলে আমি শুধু নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজতাম। একটা সময় ছিল যখন মনে হতো পৃথিবী আমাকে বুঝবে না। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে আমি শিখলাম, আঁকাই আমার ভাষা। আমার দুঃখ, ভয়, একাকীত্ব—সবকিছু আমি ক্যানভাসে ঢেলে দিতাম। আর আশ্চর্যের বিষয়, আঁকার পর মনে হতো যেন বুকটা হালকা হয়ে গেল।” সে হেসে বলল, কিন্তু সেই হাসিতে লুকানো ছিল গভীর কষ্ট। মেঘলা অনুভব করল, অর্ণবের ভেতরের যন্ত্রণা হয়তো তার নিজের শূন্যতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছে। সে আস্তে বলল, “তাহলে বুঝতেই পারছো, আমি কেন ওই রঙপেন্সিল হারিয়ে এত ভেঙে পড়েছিলাম। ওটা শুধু একটা জিনিস নয়, আমার দাদুর সঙ্গে থাকা স্মৃতি।” অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, তাই আমি তোমাকে বুঝতে পারি। কারণ আমি জানি, কিছু জিনিস কেবল স্মৃতি নয়—ওগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।”
সেদিন থেকে মেঘলার কাছে অর্ণবের মানে আরও নতুন হয়ে উঠল। সে শুধু এক সহপাঠী নয়, বরং এক মানুষ, যে তার দুঃখ বুঝতে পারে, কারণ নিজেও সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছে। মেঘলা অনুভব করল, তাদের বন্ধুত্ব আসলে একই সুরে বাঁধা—একজনের যন্ত্রণা অন্যজনের হৃদয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। অর্ণবের গল্প শুনে মেঘলা বুঝল, আঁকা কেবল আনন্দের খেলা নয়, বরং বেঁচে থাকার শক্তি। আর অর্ণবও বুঝতে পারল, তার একাকী দুনিয়ায় এখন একজন আছে, যে তার কথা শুনবে, বুঝবে। তারা দুজনেই যেন নিজেদের ক্ষতগুলো আঁকায় মুছে ফেলতে লাগল, আর সেই ক্ষত থেকেই জন্ম নিতে লাগল নতুন রঙ। অশ্বত্থগাছের নিচে বসে তারা অনেকক্ষণ নীরবে আঁকল, কিন্তু সেই নীরবতাই ছিল কথার থেকেও শক্তিশালী। মেঘলা মনে মনে বলল, “হয়তো এই অন্ধকারই আমাদের কাছে আলো খুঁজে পেতে সাহায্য করছে।” আর অর্ণব ডায়েরির এক কোণে লিখে রাখল, “আমার গল্পটা আমি একা বয়ে বেড়াইনি—আজ থেকে তা মেঘলার রঙেও মিশে গেল।”
৯
শহরের বিকেলগুলো এখন মেঘলার কাছে আর আগের মতো নিস্তব্ধ বা নিরানন্দ মনে হতো না। যখন সে প্রথম এই ছোট্ট শহরে এসেছিল, তখন মনে হয়েছিল সবকিছুই অচেনা—রাস্তার ধুলো, গলির ভিড়, আর্ট স্কুলের ঠাণ্ডা করিডর, এমনকি সহপাঠীদের হাসি-ঠাট্টাও তার কাছে ছিল দূরের। কিন্তু এখন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তার মনে হচ্ছিল এই শহরটাই যেন ধীরে ধীরে তাকে আপন করে নিচ্ছে। অথচ সে জানত, এই বদলটা কেবল শহরের কারণে হয়নি। আসলে অর্ণবের সঙ্গে পরিচয়, তার রঙপেন্সিল হারানো আর ফেরত পাওয়ার ঘটনাই তাকে নতুন চোখে পৃথিবী দেখতে শিখিয়েছে। একদিন সন্ধ্যায় মেঘলা একা নিজের হোস্টেল রুমে বসে খাতার পাতায় আঁকছিল, আর হঠাৎই তার মনে হল—যদি সেদিন রঙপেন্সিলটা হারিয়ে না যেত, তবে হয়তো সে আজ অর্ণবের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ হতো না। হয়তো সে এখনও নিজের ভেতরের দুঃখ নিয়ে গুটিয়ে থাকত, কারও কাছে খুলে বলত না। কিন্তু সেই হারানোই যেন তাকে এক নতুন মানুষ উপহার দিয়েছে, যে শুধু তার আঁকা বোঝে না, বরং তার মনকেও রঙে ভরে তোলে। তখনই মেঘলার মনে হল, সব হারানোই দুঃখের নয়—কখনও কখনও হারানো মানেই নতুন কিছু পাওয়ার সুযোগ।
পরদিন ক্লাসে শিক্ষকেরা প্রদর্শনীর পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মেঘলা লক্ষ্য করছিল, অন্য সবাই কাজ নিয়ে উত্তেজিত, কেউ আলো নিয়ে আলোচনা করছে, কেউ ফ্রেম নিয়ে। অথচ তার মনে চলছিল একেবারেই অন্য রকম ভাবনা। অর্ণব পাশেই বসে ছিল, খাতায় দ্রুত কিছু স্কেচ করছিল। মেঘলা চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে ভাবছিল, এই ছেলেটি কত নিঃশব্দে তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আগে যে মেয়েটি ভেবেছিল নতুন শহরে সে কাউকে খুঁজে পাবে না, সেই মেঘলাই আজ বুঝছে—হারানো রঙপেন্সিলই আসলে তাকে এই অমূল্য সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অর্ণব মাঝে মাঝে তাকিয়ে হাসত, আর সেই হাসি মেঘলার ভেতরে অদ্ভুত শান্তি এনে দিত। ক্লাস শেষে যখন তারা একসঙ্গে গলির দোকানে গিয়ে চা খেল, মেঘলা নিজের মনে একটা উপলব্ধি অনুভব করল—সে আর একা নেই। তার দুঃখ, তার শূন্যতা, এমনকি তার স্বপ্নগুলোও এখন ভাগ করার মতো একজন মানুষ আছে। এবং এই উপলব্ধিই তাকে বদলে দিতে শুরু করেছে।
রাতে ঘরে ফিরে মেঘলা নিজের ডায়েরি খুলে লিখতে বসল। সে লিখল, “জীবন হয়তো সবসময় আমাদের হাতে থাকে না। কখনও কখনও তা আমাদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেয়—কোনো প্রিয় জিনিস, প্রিয় মানুষ, বা কোনো সুন্দর মুহূর্ত। তখন মনে হয় আমরা শূন্য হয়ে গেলাম। কিন্তু হয়তো সেই শূন্যতাই দরকার, যাতে নতুন কিছু আসতে পারে। আমি যদি আমার রঙপেন্সিল হারিয়ে না ফেলতাম, তবে অর্ণবকে হয়তো এতটা চিনতাম না। আমার আঁকা হয়তো শুধু শৈশবের স্মৃতিতেই আটকে থাকত, নতুন কোনো মানে পেত না। কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি, হারানো মানেই শেষ নয়—কখনও কখনও হারানো মানেই শুরু।” ডায়েরির পাতায় শব্দগুলো যেন ঝলমল করে উঠল, আর মেঘলার চোখ ভিজে গেল অজান্তেই। কিন্তু সেই ভেজা চোখে কোনো দুঃখ ছিল না, বরং ছিল এক অদ্ভুত শান্তি। সে বুঝল, তার জীবন বদলাতে শুরু করেছে, আর এই পরিবর্তনই তাকে আরও শক্তিশালী, আরও রঙিন মানুষ করে তুলছে।
১০
প্রদর্শনীর দিন স্কুলের হলঘর ভরে উঠেছিল আলো আর মানুষের ভিড়ে। শহরের মানুষজন, শিক্ষক-শিক্ষিকারা, ছাত্রছাত্রীরা—সবাই যেন অপেক্ষা করছিল এক রঙিন বিকেলের। দেয়ালে টাঙানো ছবি আর স্কেচের ভিড়ে মেঘলার ক্যানভাস আর অর্ণবের কাজ একসঙ্গে রাখা হয়েছিল। তাদের ছবিতে ফুটে উঠেছিল শহরের সরু গলি, পুকুরঘাট, দোকানের কোলাহল, আবার নিঃশব্দ মুহূর্তগুলোর গভীরতা। কিন্তু ছবিগুলোর ভেতরে যে সবচেয়ে বড় সত্যি ছিল, তা কেউ খেয়াল করল না—সেই ছবির প্রতিটি রঙে লুকিয়ে ছিল মেঘলা আর অর্ণবের একসঙ্গে কাটানো সময়, একসঙ্গে আঁকা হাসি-কান্না, আর একে অপরের জীবনে আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাহিনি। মেঘলা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখছিল, তার মনে হচ্ছিল এই ছবিগুলো যেন কেবল ক্যানভাসে নেই, বরং তার ভেতরের গল্পও সবাইকে বলছে। হঠাৎ সে পাশে তাকিয়ে দেখল অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে, চোখে সেই পরিচিত উজ্জ্বলতা। অর্ণব নিঃশব্দে বলল, “দেখছো? আমরা একসঙ্গে যে রঙ খুঁজেছিলাম, সেটা আজ সবাই দেখছে।” মেঘলার বুকটা ভরে গেল অদ্ভুত এক অনুভূতিতে।
প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর বাইরে এসে তারা অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটল। শহরের আলো তখন ধীরে ধীরে কমে আসছে, আকাশে উঠছে নক্ষত্র। মেঘলা হঠাৎ ব্যাগ থেকে তার পুরোনো রঙপেন্সিল সেটটা বের করল। সেই রঙপেন্সিল, যেটা নিয়ে এতদিন সে ভেবেছিল তার দাদুর স্মৃতি, তার শৈশব, আর তার জীবনের ভরসা। সে অর্ণবকে সেটটা দেখিয়ে হেসে বলল, “জানো, আমি ভেবেছিলাম এই রঙপেন্সিলটাই আমার সব। ওটাই আমাকে আঁকতে শিখিয়েছে, বাঁচতে শিখিয়েছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এগুলো কেবল একটা অজুহাত ছিল। আসল রঙটা ফিরিয়ে দিয়েছে তুমি।” অর্ণব একটু চমকে তাকাল, তারপর হেসে বলল, “হয়তো আমিও তাই। আমি ভাবতাম আমার জীবন কেবল আঁকার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু তুমি এসে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ—আঁকা মানেই শুধু কাগজে রঙ নয়, জীবনে রঙ খুঁজে নেওয়া।” তাদের কথাগুলো যেন বাতাসে ভেসে রইল, চারপাশের নীরবতার সঙ্গে মিশে গেল।
সেদিন রাতে মেঘলা নিজের খাতায় লিখল, “রঙপেন্সিল শুধু শৈশবের স্মৃতি নয়, এটা আসলে জীবনের প্রতীক। প্রতিটি রঙ যেমন ভিন্ন মানে বহন করে, তেমনই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের আলাদা মানে আছে। আর প্রতিটি মানুষও একেকটা রঙ, যারা আমাদের জীবনে নতুন আলো নিয়ে আসে। অর্ণব আমার জীবনে সেই রঙ দিয়েছে, যা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আমি জানি, বন্ধুত্ব কখনও কেবল বন্ধুত্ব হয়ে থাকে না—কখনও তা ধীরে ধীরে অন্য এক সুরে বাঁধা পড়ে, যেখানে প্রতিটি আঁচড়েই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।” জানলার বাইরে তখন আকাশে চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন সেও এই উপলব্ধিকে আশীর্বাদ করছে। মেঘলা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “আমার জীবনের রঙপেন্সিল আমি খুঁজে পেয়েছি—সে মানুষ হয়ে আমার পাশে আছে।” সেই মুহূর্তে মেঘলার পৃথিবী আর আগের মতো ধূসর লাগছিল না, বরং প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি স্বপ্নে ছড়িয়ে পড়ছিল এক নতুন রঙিন ভবিষ্যতের আভা।
শেষ