রুদ্রজিত ঘোষ
অধ্যায় ১ : ডায়েরির গোপন পৃথিবী
মায়ার দিন শুরু হয় খুব সাধারণভাবে—আলোর নরম ছায়ায় জানালার পর্দা দুলতে দুলতে তার ঘর ভরে ওঠে সকালের আলোয়। বাইরে পাখিদের ডাকে ভোরবেলার নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়, অথচ মায়ার ভেতরটা সবসময় অন্যরকম ব্যস্ততায় ভরে থাকে। সবার চোখে সে হয়তো একেবারেই সাধারণ এক কিশোরী, কলেজে যাওয়া-আসা করে, বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করে, মাঝে মাঝে ক্লাসে মনোযোগ হারিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আসলে মায়ার পৃথিবীটা আলাদা, আর সেই আলাদা পৃথিবীর দরজা খোলে শুধু একটি জিনিসে—তার ডায়েরি। লালচে রঙের মোটা মলাটের সেই ডায়েরিটা যেন তার প্রাণেরই এক অংশ। রাত গভীর হলে কিংবা দিনের ভিড়ভাট্টা ফুরোলে মায়া বসে যায় জানালার পাশে ছোট টেবিলটায়, কলম হাতে তুলে নেয়, আর পাতার পর পাতা ভরে যায় তার গোপন কথায়। ওর চোখের সামনে হয়তো বই, খাতা, পরীক্ষার চাপ—কিন্তু ডায়েরির পাতায় থাকে একেবারে অন্যরকম গল্প, যেখানে থাকে মায়ার স্বপ্ন, ভয়, অপূর্ণ আশা, আর সবশেষে থাকে এমন কিছু অনুভূতি যেগুলো কাউকেই বলতে সাহস হয় না।
ডায়েরিটা মায়ার কাছে শুধু লেখা রাখার জায়গা নয়—এটা তার আত্মার আয়না। একেকটা পাতায় সে নিজের ভেতরের আবেগ ঢেলে দেয়। কখনও ছোটখাটো হাস্যকর ঘটনা, যেমন নীলার সাথে ঝগড়া কিংবা রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে ফেলা; আবার কখনও এমন দুঃখের কথা, যেগুলো কারও সামনে বললে চোখে পানি চলে আসবে। সবচেয়ে বড় গোপনীয়তা হলো অভিরূপকে নিয়ে তার অনুভূতি। সে কলেজের একেবারে সাধারণ ছেলে, কারও কাছে তেমন আলাদা কিছু নয়, অথচ মায়ার চোখে অভিরূপ যেন অন্যরকম। ক্লাসরুমে যখন অভিরূপ অমন গম্ভীর মুখে লেকচার শুনে, মায়ার চোখ তখন শুধু তার দিকেই আটকে থাকে। কোনো এক অচেনা টান মায়াকে বাধ্য করে তাকে খেয়াল করতে, অথচ মায়া জানে না এই টানকে ঠিক কোন নামে ডাকতে হয়। তাই সে নাম দেয়নি, শুধু ডায়েরির পাতায় লিখেছে—“আজকে অভি আমার দিকে তাকাল কি না জানি না, কিন্তু আমার মনে হলো পৃথিবীর সব শব্দ থেমে গিয়েছিল।” প্রতিদিনের এই খুঁটিনাটি অনুভূতিগুলোই ডায়েরির পাতায় জমে জমে তৈরি করে এক অদ্ভুত সুন্দর দুনিয়া, যেটা মায়া ছাড়া আর কেউ জানে না।
কখনও কখনও ডায়েরি লেখার সময় মায়া ভয় পায়। যদি কেউ এই পাতাগুলো পড়ে ফেলে? যদি তার গোপন সত্য কারও সামনে ফাঁস হয়ে যায়? এই ভয়েই সে ডায়েরিটাকে সবসময় নিজের ব্যাগে রাখে, ক্লাসে গেলে ব্যাগের গভীরে লুকিয়ে রাখে, আর রাতে বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়। তার কাছে ডায়েরি মানে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, যেখানে সে কথা বলে নিজের সঙ্গে, তর্ক করে, আবার কখনও সান্ত্বনা খোঁজে। আর সবকিছুর মধ্যেই বারবার উঠে আসে অভিরূপের নাম। হয়তো খুব সামান্য ঘটনা—অভি ক্লাসে একটা প্রশ্নের উত্তর দিল, করিডোরে দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে হাসল, কিংবা লাইব্রেরিতে বই খুঁজতে গিয়ে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ—এই সবকিছুই মায়ার মনে এমন ঝড় তোলে, যা সে আর কোথাও প্রকাশ করতে পারে না। তাই ডায়েরির পাতাগুলোই হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, যেখানে ভালোবাসা শব্দটা লাজুক হয়ে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি দাগে, প্রতিটি নিশ্বাসে অভিরূপের উপস্থিতি মায়া টের পায়। ডায়েরির পাতায় জমে থাকা সেই অনুভূতিগুলোই তাকে একদিকে ভীত করে তোলে, আবার অন্যদিকে বাঁচার নতুন কারণও দেয়—কারণ ডায়েরি ছাড়া মায়া হয়তো নিজের ভেতরের পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে পারত না।
অধ্যায় ২ : অপ্রত্যাশিত হারানো
সেদিনটা ছিল একেবারেই সাধারণ একটি দিন। দুপুরের শেষ ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলেজের করিডোর ভরে উঠেছিল ছাত্রছাত্রীদের হইচই আর হাসি-ঠাট্টায়। মায়া ব্যাগ গুছিয়ে নিলো, নীলা তখনও গল্পে ব্যস্ত, আর চারপাশে সবাই দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। গরমে ঘেমে উঠেছিল মায়ার কপাল, সে হাতের রুমাল দিয়ে ঘাম মুছল আর ব্যাগের চেইন টেনে দিলো, ভেবেই নিলো সব কিছু ঠিকঠাক জায়গায় আছে। তার মন তখনও যেন ডায়েরির পাতায় আটকে আছে—মাত্র কিছুক্ষণ আগে ক্লাসে বসে সে লিখে ফেলেছিল ছোট্ট একটি বাক্য: “আজ অভি একবার হাসল, মনে হলো আমার চারপাশের বাতাসও হালকা হয়ে গেছে।” সেই লেখার স্মৃতি এখনো মাথার ভেতর ঘুরছিল, যেন ডায়েরির কালি শুকিয়ে গেলেও আবেগ শুকায়নি। করিডোর দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বন্ধুদের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি, হাসাহাসি আর কোলাহলের মধ্যে মায়া টেরই পেলো না যে ব্যাগের ভেতর থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা, তার আত্মার সঙ্গী সেই ডায়েরি, ফসকে মাটিতে পড়ে গেছে।
কলেজের গেট পার হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ মায়ার বুকের ভেতর অস্বস্তি জাগল। প্রতিদিনের মতো সে চট করে ব্যাগ খুলে ভেতরে হাত বাড়িয়ে দিলো—ডায়েরিটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নেবে বলে। কিন্তু ব্যাগের গভীরে হাত দিলেও সেই পরিচিত মোটা মলাটের স্পর্শ পেলো না। একবার, দু’বার, তিনবার—সে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল, খাতার পেছনে, বইয়ের নিচে, এমনকি কলমপত্রের ভেতরেও। কিন্তু কোথাও নেই! চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই। মায়ার মাথা যেন ঘুরে উঠল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল অজানা এক আশঙ্কায়। সে বুঝতে পারল, ডায়েরি নেই—মানে তার সমস্ত গোপন কথা, লুকোনো স্বপ্ন, আর অভিরূপকে নিয়ে লেখা প্রতিটি লাইন, এখন অচেনা কারও হাতে চলে যেতে পারে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মায়ার হাত কাঁপছিল, ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল, আর মাথার ভেতর বারবার ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন—“যদি কেউ পড়ে ফেলে? যদি অভিই সেটা পেয়ে যায়?”
সে পাগলের মতো ফিরে গেল ক্লাসরুমে, করিডোরে, এমনকি সিঁড়ির নিচে। নীলা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না, পরে মায়ার ভয়ার্ত চেহারা দেখে সে-ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। দু’জনে মিলে চারপাশ খুঁজতে লাগল, কিন্তু কোথাও নেই ডায়েরি। করিডোর তখন প্রায় ফাঁকা, শুধু বাতাসে ভেসে আসছিল বাকি ছাত্রছাত্রীদের হাসির শব্দ। সেই নিঃসঙ্গতার ভেতরে দাঁড়িয়ে মায়া অনুভব করল যেন তার বুকের ভেতর থেকে কেউ সবকিছু ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। তার মনে হলো পৃথিবীটা হঠাৎ থেমে গেছে, শুধু এক অদৃশ্য দমবন্ধ করা ভয় তাকে ঘিরে ধরছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল অভিরূপের মুখ—যদি ডায়েরি তার হাতে পড়ে? যদি সে পাতাগুলো পড়ে ফেলে, যেখানে তার নাম বারবার লেখা, যেখানে তার হাসিকে তুলনা করা হয়েছে আকাশের আলো আর তার উপস্থিতিকে বলা হয়েছে হৃদয়ের ধ্বনি? লজ্জা, ভয় আর দুশ্চিন্তা একসঙ্গে মায়াকে ঘিরে ধরল। সে নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতর ধ্বকধ্বক শব্দ আরও জোরে বাজতে লাগল, আর বুঝতে পারল—এখন থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না, কারণ তার সবচেয়ে নিরাপদ গোপন পৃথিবীটা এখন আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।
অধ্যায় ৩ : অভিরূপের সন্ধান
কলেজের গেটের কাছাকাছি ভিড় তখন ধীরে ধীরে কমে আসছে। দুপুরের রোদটা নরম হয়ে গেছে, করিডোর আর ক্লাসরুম প্রায় ফাঁকা, শুধু গেটের দিকে ভিড় জমেছে যারা বাসে উঠছে কিংবা রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অভিরূপ সাধারণত ভিড় এড়িয়ে ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। সেদিনও সে তেমনই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, বন্ধুর সঙ্গে হালকা কথাবার্তা বলছিল, তখনই চোখে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা একটা লালচে রঙের ডায়েরি। প্রথমে সে ভাবল কারও খাতা পড়ে আছে, কিন্তু কিছু একটা তার দৃষ্টি টানল—ডায়েরিটার অবহেলায় পড়ে থাকা ভঙ্গি, চারপাশের হইচইয়ের মধ্যে ওর নিঃসঙ্গতা যেন অন্যরকম লাগল। কৌতূহলবশত সে নিচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নিলো। হাতের স্পর্শেই বুঝতে পারল এটা অনেকদিন ধরে ব্যবহৃত, পাতাগুলো খানিকটা মোটা, মলাটে হালকা দাগ আছে—যেন প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে কারও।
অভিরূপ ডায়েরিটা উল্টে প্রথম পাতার দিকে তাকাতেই থমকে গেল। স্পষ্ট করে লেখা আছে একটি নাম—“মায়া”। নামটা তার কাছে অচেনা নয়। সে জানে মায়া তাদের ক্লাসেরই ছাত্রী, শান্ত স্বভাবের, সাধারণত খুব বেশি কথাবার্তা বলে না, কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করে আর বান্ধবীদের সঙ্গে হাসাহাসি করে। অভিরূপের চোখের সামনে ভেসে উঠল ক্লাসে এক কোণে বসে থাকা মেয়েটার চেহারা—যে সবসময় খাতা আর কলম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, হয়তো পড়াশোনা করছে, হয়তো অন্য কিছু লিখছে। মায়ার প্রতি তার কোনো বিশেষ মনোযোগ আগে ছিল না, কিন্তু এই মুহূর্তে নামটা যেন এক অদ্ভুত টান তৈরি করল। ওর হাতে ধরা এই ডায়েরিটাই এখন মায়ার অদৃশ্য জগতের দরজা, যেখানে হয়তো এমন সব কথা লেখা আছে যা সে কাউকেই বলেনি।
ডায়েরিটা বন্ধ করেই অভিরূপের ভেতরে শুরু হলো দ্বিধার লড়াই। একদিকে মনে হলো সহজ সমাধান আছে—এটা সরাসরি মায়ার হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এতে দায়িত্ববোধও রক্ষা হবে, মায়াও খুশি হবে। কিন্তু অন্যদিকে এক অচেনা কৌতূহল তাকে নাড়িয়ে দিলো। ডায়েরির ভেতরে কি আছে? কিসের জন্য মায়া প্রতিদিন এত মনোযোগ দিয়ে লিখে যায়? এমন কি আছে যা সে কলমে ধরে রাখে কিন্তু মুখে বলে না? প্রশ্নগুলো অভিরূপকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। তার বুকের ভেতর একটা টান তৈরি হলো—যেন হাতের কাছে রাখা দরজা খুললেই অন্য এক দুনিয়া দেখা যাবে। তবু সে থেমে গেল। ভেতরের নৈতিকতা বলল, “না, এটা পড়া ঠিক হবে না।” কিন্তু কৌতূহল মাথা তুলল—“যদি কিছু বিশেষ লেখা থাকে? যদি কিছু গোপন জানা যায়?” এই দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে থেকে অভিরূপ টের পেলো, এই সাধারণ দুপুর হঠাৎ করে এক অদ্ভুত ঘটনার সূচনা হয়ে গেছে, আর এই ডায়েরি হয়তো তার নিজের জীবনকেও অন্য এক পথে নিয়ে যাবে।
অধ্যায় ৪ : প্রথম দ্বন্দ্ব
অভিরূপ ডায়েরিটা ব্যাগে রেখে বাড়ি ফিরল, কিন্তু মাথা যেন অদ্ভুত এক অস্থিরতায় ভরে গেল। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল ডায়েরিটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ভেতরে লুকোনো রহস্যময় জগৎ তাকে টেনে নিচ্ছে। সন্ধ্যার নরম আলোয় নিজের ঘরে বসে সে ব্যাগ খুলল, ডায়েরিটা টেবিলের ওপর রাখল, কিন্তু ছুঁতে সাহস পেল না। নৈতিকতার কণ্ঠস্বর তাকে বারবার বলছিল—“এটা পড়া ঠিক নয়, এটা কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা।” অথচ সেই নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই একটা দমবন্ধ করা টান লুকিয়ে ছিল। ডায়েরির মলাটে হাত বোলাতে বোলাতে অভিরূপ অনুভব করল যেন ভেতরে শত শত শব্দ তাকে ডাকছে। সে জানে, ডায়েরি মায়ার—যে সাধারণত চুপচাপ থাকে, যে হয়তো ভেতরে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে। কেমন হয় যদি সে একটু পড়েই ফেলে? কেবল কয়েকটা লাইন? হয়তো কিছু সাধারণ কথা থাকবে—দিনলিপি, বন্ধুদের নিয়ে লেখা বা পরীক্ষার চাপ। কিন্তু আবার মনে হলো—যদি আরও গভীর কিছু থাকে? তার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। ডায়েরিটা যেন ওর চোখের সামনে বসে থাকা এক রহস্যের বাক্স, যেটা না খোলার চেষ্টা করলেই তা খুলে দেখার ইচ্ছা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত কৌতূহল জয়ী হলো। অভিরূপ ধীরে ধীরে মলাট খুলল, প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টাল। শুরুতে সত্যিই সাধারণ লেখা—ক্লাসের ছোটখাটো ঘটনা, বান্ধবী নীলার সঙ্গে ঝগড়া, পরীক্ষার প্রস্তুতির টেনশন। কিন্তু অল্প কিছুটা পড়তেই হঠাৎ ভাষা বদলে গেল। সেখানে আবেগ ঘন হয়ে উঠল, শব্দগুলো যেন গভীর নিঃশ্বাসে ভরা। অভিরূপ পড়ল—“আজকে ক্লাসে কারও হাসিতে পুরো দিনটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সেটা বলার মতো কাউকে পাই না।” এমন বাক্য পড়তে গিয়ে সে অবাক হলো। এটা যে শুধু সাধারণ ডায়েরি নয়, এটা একটা হৃদয়ের গোপন আখ্যান। পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে অভিরূপের ভেতর জেগে উঠল এক অদ্ভুত টান—এমনভাবে কেউ নিজের মনের কথা লিখে যায়, অথচ বাইরে এত শান্ত! ডায়েরির অক্ষরগুলো মায়ার লাজুক অথচ নিখাদ আত্মার ছবি এঁকে দিচ্ছিল, আর অভিরূপ সেই ছবির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। তবু মনে হচ্ছিল, ও যেন কিছু নিষিদ্ধ কাজ করছে, যেন নিজের অজান্তেই কারও ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করছে। প্রতিটি শব্দের ভেতর দিয়ে ওর কাছে খুলে যাচ্ছিল মায়ার নিঃশব্দ পৃথিবী, আর অভিরূপ টের পাচ্ছিল এই পৃথিবী তাকে আর ফিরতে দেবে না।
তারপরই এল সেই মুহূর্ত—একটা পাতায় চোখ আটকে গেল তার। লাইনটা পড়েই অভিরূপের বুক ধক করে উঠল: “আজ অভিরূপকে দেখে মনে হলো পৃথিবীটা কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে। আমি জানি না কেন ওর দিকে বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে।” নিজের নাম! সে বিস্মিত হয়ে আবার পড়ল, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। পাতার ওপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা তার নাম—অভিরূপ। ডায়েরির গোপন অনুভূতির ভেতরে সে নিজেই আছে। এ যেন কল্পনার বাইরের আবিষ্কার। মায়া—যে সবসময় নিঃশব্দ, লাজুক, চোখ নামিয়ে রাখে—সে-ই গোপনে তাকে নিয়ে লিখে গেছে এত কথা! অভিরূপের হাত কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতর ঢেউ উঠল। একদিকে অপরাধবোধ গ্রাস করছিল—এটা পড়া তার উচিত হয়নি। অন্যদিকে, এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরজুড়ে—কেউ তাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারে! কৌতূহল আর অপরাধবোধের ভেতর দুলতে দুলতে অভিরূপ ডায়েরিটা বন্ধ করে দিলো, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা আর আগের মতো নেই। এক মুহূর্তেই সে যেন মায়াকে নতুন করে চিনে ফেলল, আর একইসঙ্গে বুঝল—এই ডায়েরি শুধু মায়ার গোপন আখ্যান নয়, এটা তার নিজের গল্পেরও শুরু।
অধ্যায় ৫ : লুকানো সত্যের মুখোমুখি
ডায়েরির পাতায় নিজের নাম খুঁজে পাওয়ার পর থেকে অভিরূপের ভেতরের পৃথিবী যেন পুরো পাল্টে গেল। তার কাছে মায়া ছিল ক্লাসের এক সাধারণ মেয়ে—চুপচাপ, নিজের জগতে ডুবে থাকা, যাকে বন্ধুরা মাঝে মাঝে খোঁচায় কিন্তু খুব বেশি চোখে পড়ে না। অথচ এখন সেই একই মেয়ে তার দিকে লুকানো দৃষ্টিতে তাকায়, রাতে ডায়েরির পাতায় বসে তার নাম লিখে, তার হাসিকে তুলনা করে আলোর সঙ্গে। এই সত্যটা অভিরূপকে অভিভূত করল, একইসঙ্গে বিভ্রান্ত করল। বারবার মনে হচ্ছিল—কীভাবে সম্ভব? মায়া তাকে পছন্দ করে! এটা কি সত্যিই বাস্তব, নাকি কেবল কিশোরী আবেগের খেলা? সে ডায়েরির শব্দগুলো পড়তে গিয়ে অনুভব করল ওগুলো নিছক কল্পনা নয়—প্রতিটি লাইনে মায়ার ভেতরের সৎ আবেগ উথলে উঠেছে। অভিরূপ বুঝতে পারল, মায়া তাকে তার ভেতরের পৃথিবীর কেন্দ্র করে নিয়েছে, অথচ বাইরে থেকে সে কিছুই প্রকাশ করেনি। এই উপলব্ধি তাকে এক অদ্ভুত অবস্থায় দাঁড় করাল—যেখানে আনন্দ, বিস্ময় আর অপরাধবোধ একসঙ্গে মিশে আছে।
এরপর থেকে ক্লাসে বা করিডোরে মায়াকে দেখলেই অভিরূপের চোখে ভেসে উঠতে লাগল সেই লেখা। মায়া যখন নীরবে খাতা খুলে বসে, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে মৃদু হেসে ওঠে, তখন অভিরূপ মনে মনে ডায়েরির লাইনগুলো শুনতে পেতো—“আজ অভিকে দেখে মনে হলো সময় থেমে গেছে।” এতদিন যাকে সে সাধারণ ছাত্রী ভেবেছে, সেই মায়াকে হঠাৎ মনে হতে লাগল অন্যরকম। সে যেন ভেতরে ভেতরে আরও গভীর, আরও কোমল, যাকে সে আগে দেখেইনি। অভিরূপের মনে হতে লাগল, হয়তো সেও আসলে মায়াকে কখনো বুঝতে পারেনি। সেই অদৃশ্য মায়া, যে শুধু ডায়েরির পাতায় বেঁচে থাকে, এখন তার চোখে ধরা দিচ্ছে। অথচ এই পরিবর্তন তাকে শান্তি দিল না, বরং দোটানায় ফেলে দিল। সে জানে না কিভাবে আচরণ করবে। মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে কি তাকে কিছু বলা উচিত? নাকি কিছুই না জানার ভান করে ডায়েরিটা ফেরত দেওয়া উচিত? এই দ্বন্দ্বে অভিরূপ বুঝতে পারল, সে এক নতুন সংকটে আটকে গেছে।
রাতের পর রাত সে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বসে থাকে, কখনও পড়ে আবার কখনও বন্ধ করে ফেলে, যেন নিজের ভেতরেই যুদ্ধ করছে। একদিকে তার ভেতরে উঁকি দিচ্ছে এক মিষ্টি অনুভূতি—কেউ তাকে এত নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে ভাবছে। অন্যদিকে তাকে তাড়া করছে নৈতিকতা—সে এমন কিছু জেনেছে যা আসলে তার জানার কথা ছিল না। তার উপস্থিতি এখন মায়ার ভেতরের গোপন দুনিয়ায়, অথচ আমন্ত্রণ ছাড়াই। কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সে? মায়াকে বলবে সে সব জানে? নাকি গোপন রাখবে? হয়তো বললে মায়া লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে, আবার হয়তো তাদের সম্পর্কের নতুন শুরু হবে। এই অস্থিরতার ভেতর দাঁড়িয়ে অভিরূপ বুঝতে পারল, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। কারণ লুকানো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে এখন শুধু মায়াকে নতুন চোখে দেখছে না, বরং নিজের হৃদয়কেও নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।
অধ্যায় ৬ : মায়ার অস্থিরতা
ডায়েরি হারানোর পর দিনগুলো মায়ার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগতে শুরু করল। প্রতিটি মুহূর্তে বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিল, যেন কোথাও লুকানো বোমা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে। ক্লাসে বসে সে স্বাভাবিক থাকার ভান করত, কিন্তু খাতার পাতায় চোখ রাখলেও অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসত। বান্ধবীরা হাসি-ঠাট্টা করত, নীলা মাঝেমধ্যে রসিকতা করত, কিন্তু মায়ার মনে হতো চারপাশের সব শব্দ যেন দূরে সরে গেছে। রাতে শুয়ে থাকতে ঘুম আসত না, বারবার মনে হতো—ডায়েরি এখন কার হাতে? যদি কোনো অচেনা কেউ পড়ে থাকে তবে কী হবে? তার নিজের গভীরতম অনুভূতিগুলো—অভিরূপকে নিয়ে যত স্বপ্ন, যত ভয়, যত কিশোরী আবেগ—সব যদি প্রকাশ হয়ে যায় তবে কী হবে? সে ভেবে উঠতে পারত না। বালিশ চেপে কান্না পেত, কিন্তু কান্নার শব্দ বাইরের পৃথিবী শোনার অধিকার পেত না।
নীলা মায়ার এই অস্বাভাবিক চেহারা টের পেল। বিরতির সময় একদিন ওকে একপাশে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোর? কয়েকদিন ধরে তোকে অস্থির মনে হচ্ছে।” মায়া প্রথমে কিছু বলতে চাইছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরের ভয় এত ভারী হয়ে উঠেছিল যে আর সামলাতে পারল না। নিচু গলায় শুধু বলল, “আমার ডায়েরি হারিয়ে গেছে।” নীলা হেসে ফেলতে চাইল, কিন্তু মায়ার চোখের ভেতর আতঙ্ক দেখে থেমে গেল। “ডায়েরি? তাতে এমন কি লেখা আছে?”—নীলার কৌতূহল বাড়ল। মায়া মুখ নামিয়ে বলল, “সবকিছু… আমার সব কথা… যেটা আমি কাউকে বলতে পারি না, সেগুলো।” নীলা তখন বন্ধুর মতো ওর হাত চেপে ধরে আশ্বস্ত করল, “চিন্তা করিস না। হয়তো কেউ পেয়েছে, আবার তোকে দিয়ে দেবে।” কিন্তু মায়ার ভয় অন্য জায়গায়—সে মুখে বলতে পারল না, কিন্তু মনে মনে জানত, যদি সত্যিই অভিরূপ সেই ডায়েরি খুঁজে পেয়ে থাকে তবে লুকোনো সত্যগুলো এক মুহূর্তেই তার সামনে ফাঁস হয়ে যাবে। তখন সে কীভাবে তাকিয়ে থাকবে অভিরূপের চোখের দিকে?
দিন গড়িয়ে যেতে লাগল, কিন্তু ডায়েরির কোনো খোঁজ মিলল না। মায়ার ভয় যেন প্রতিদিন আরও বড় হতে লাগল। ক্লাসে অভিরূপকে দেখলেই বুক ধড়ফড় করে উঠত, মনে হতো—সে কি সব জানে? তার চোখে কি নতুন কিছু ধরা পড়ছে? অভিরূপ যখন সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশত, তখন মায়ার সন্দেহ হতো—সে কি ভান করছে? নাকি সত্যিই জানে না কিছু? প্রতিটি মুহূর্তে মায়া নিজের ভেতর এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল—একদিকে আশা করছিল, হয়তো ডায়েরি কোনো সাধারণ ছাত্রের হাতে গেছে যে পড়ে দেখেনি; অন্যদিকে ভয় করছিল, হয়তো অভিরূপই সেটা খুঁজে পেয়েছে। যদি তাই হয়, তবে তার প্রতিটি গোপন কথা, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি নিশ্বাসের স্বীকারোক্তি এখন অভিরূপের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্ব মায়াকে নিঃশেষ করে দিতে লাগল। ডায়েরি ছাড়া তার পৃথিবী যেন অচেনা, আর ডায়েরির ভেতরে লুকানো গোপন যদি সত্যিই প্রকাশ হয়ে যায়, তবে সেই পৃথিবী তার ভেঙে পড়ার জন্যই অপেক্ষা করছে।
অধ্যায় ৭ : অভিরূপের দ্বিধা
ডায়েরি হাতে পাওয়ার পর থেকে অভিরূপের ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। সে পড়েছে, সে জেনেছে, আর এখন সেই জেনেই তার সমস্ত চিন্তা বদলে দিচ্ছে। ক্লাসে বসে যখন সে মায়ার দিকে তাকায়, তার মনে পড়ে যায় ডায়েরির পাতায় লেখা সেই সব বাক্য—“আজ অভিকে দেখে মনে হলো সময় থেমে গেছে”, “অভিরূপের হাসি যেন আলো ছড়িয়ে দেয়।” এগুলো শুধু শব্দ নয়, বরং মায়ার নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি, যার সাক্ষী এখন কেবল সে-ই। কিন্তু সমস্যাটা হলো, অভিরূপ জানে না কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সরাসরি মায়ার হাতে ডায়েরি দিয়ে দিলে কি মায়া বুঝে যাবে যে সে ভেতরের লেখা পড়েছে? আর যদি সে সত্যিই বুঝে ফেলে, তবে তার মুখে কীভাবে কথা বলবে? আবার অন্যদিকে, ডায়েরিটা নিজের কাছে রেখে দেওয়া মানেই প্রতারণা, কারণ এটা মায়ার ব্যক্তিগত সম্পদ। এই দোটানার ভেতরেই অভিরূপ একদিন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাহুলের কাছে বিষয়টা বলল।
রাহুল গল্প শুনেই প্রথমে হো হো করে হেসে উঠল। “বাহ! তোকে নিয়ে কেউ ডায়েরি ভরে ফেলেছে, আর তুই এত চিন্তায় মরে যাচ্ছিস!”—কথার সুরে ছিল মজা, ঠাট্টা, আর খানিকটা বিস্ময়। অভিরূপ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই বুঝছিস না রে। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। এটা ওর ব্যক্তিগত জিনিস। আমি না পড়লেই ভালো হতো।” রাহুল আবার হাসল, “আরে, ভাগ্যিস পড়েছিস! নাহলে তোকে নিয়ে কারও এতটা ভাবনা আছে তুই জানতেই পারতিস না। এখন তোকে ডাবল সুযোগ—এক, ডায়েরি ফিরিয়ে দিয়ে হিরো হও, দুই, ওকে ইমপ্রেস করে সত্যিকারের লাভ স্টোরি শুরু কর।” অভিরূপ চুপ করে বসে রইল। বন্ধুর ঠাট্টার ভেতর লুকানো সত্যিটা সে এড়িয়ে যেতে পারছিল না। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। মায়ার ভেতরের অনুভূতি পড়া মানে তার একান্ত গোপন কক্ষে প্রবেশ করা, আর সেই দরজা সে ইচ্ছে করে ভেঙে ঢুকেছে।
বাড়ি ফিরে অভিরূপ দীর্ঘক্ষণ ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে রইল। রাহুলের কথা মাথায় বাজতে থাকল—“এখন তোর হাতে সিদ্ধান্ত।” হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কোনটা সঠিক? ডায়েরি লুকিয়ে রাখলে সে প্রতারক হবে, কিন্তু ফেরত দিলে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। মায়া কি তাকে বিশ্বাস করতে পারবে তখন? হয়তো লজ্জায় তার সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। আবার ডায়েরির প্রতিটি শব্দ অভিরূপকে টানছিল অন্য এক দিকেও—তার ভেতরে যে উষ্ণতা জন্ম নিয়েছে, সেটা কি অস্বীকার করা সম্ভব? সে বুঝতে পারছিল, তার নিজের জীবনও আর আগের মতো থাকবে না। প্রতিটি মুহূর্তে মায়াকে সে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছে, আর সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুই হলো এই ডায়েরি। দ্বিধার এই দোলাচলে দাঁড়িয়ে অভিরূপ বুঝল—সে যতদিন সিদ্ধান্ত না নেবে, ততদিন তার ভেতরের শান্তি আর ফিরে আসবে না।
অধ্যায় ৮ : মুখোমুখি দেখা
সেদিন বিকেলে কলেজের লাইব্রেরির করিডোরটা ছিল শান্ত, চারপাশে শুধু বইয়ের গন্ধ আর ফিসফিসে নীরবতা। মায়া টেবিলের উপর মাথা নামিয়ে বসেছিল, চোখেমুখে ক্লান্তি আর অস্থিরতার ছাপ। কয়েকদিন ধরে ডায়েরি হারানোর যন্ত্রণা তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। নীলা বারবার সান্ত্বনা দিলেও কোনো শান্তি পাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই করিডোরের অপর প্রান্তে অভিরূপকে দেখা গেল। মায়ার বুক ধক করে উঠল। তার চোখে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর আশঙ্কা—যদি সত্যিই ওর কাছেই থাকে ডায়েরি! অভিরূপ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, হাতে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। মায়া নিচে তাকিয়ে রইল, চোখ তুলতে সাহস হলো না। অথচ সে বুঝতে পারছিল, অভিরূপ ঠিক তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুহূর্তগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অচেনা দমবন্ধ করা উত্তেজনার দিকে।
অভিরূপও সমান অস্থিরতায় ভুগছিল। ডায়েরিটা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে, কিন্তু মায়ার চোখে চোখ রেখে কিভাবে সত্যিটা বলবে, সেই সাহস পাচ্ছিল না। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল—সরাসরি ডায়েরি বাড়িয়ে দিয়ে বলা উচিত কি, “এটা আমি পেয়েছিলাম”? নাকি ভান করা উচিত যে সে কিছুই জানে না? কিন্তু সে জানে, ভেতরের লেখা পড়ার পর তার চোখে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটা মায়া একদিন না একদিন বুঝবেই। তবুও ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে হাতের মুঠোয় নিলো, কিন্তু শব্দ খুঁজে পেল না। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, ঠোঁট কাঁপছিল। সে ভাবল, যদি এখন সত্য স্বীকার করে ফেলে, তবে হয়তো মায়া ভেঙে পড়বে, হয়তো কেঁদে ফেলবে, কিন্তু অন্তত তার ভেতরের অপরাধবোধ কমবে। আবার মনে হলো—যদি মায়া তাকে ঘৃণা করে ফেলে? যদি এই সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়?
মুহূর্তটা যেন থেমে গিয়েছিল। মায়া ধীরে ধীরে চোখ তুলল, অভিরূপের হাতে নিজের ডায়েরি দেখে তার শ্বাস আটকে গেল। চোখের পলকে পৃথিবী যেন থেমে গেল—লজ্জা, ভয় আর স্বস্তি একসঙ্গে ঝড় তুলল তার ভেতরে। অভিরূপ ডায়েরি বাড়িয়ে দিল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। শুধু তার চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি ছিল—আফসোস, মমতা আর লুকানো স্বীকারোক্তি। মায়া কাঁপা হাতে ডায়েরি নিলো, মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। নীরবতার ভেতরে দুজনের দৃষ্টি মিলল এক মুহূর্তের জন্য, আর সেই মুহূর্তেই যেন সব বলা হয়ে গেল। তবুও কেউ কিছু বলল না। তাদের ভেতরের অস্থিরতা আর অজানা অনুভূতিগুলো নীরবতার গভীরতায় চাপা পড়ে রইল, অপেক্ষা করতে লাগল আরও এক প্রকাশের।
অধ্যায় ৯ : সত্যের উন্মোচন
ডায়েরি ফেরত দেওয়ার পরের কয়েকদিন মায়া ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটাতে লাগল। অভিরূপ কিছু বলেনি, শুধু চুপচাপ ডায়েরি এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই নীরবতা যেন আরও বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াল। মায়া বারবার ভাবছিল—ও কি ভেতরের লেখা পড়েছে? নাকি একেবারেই খোলেনি? প্রতিটি মুহূর্তে তার মন দ্বিধায় দুলছিল। একদিকে ভেতরের লজ্জা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, অন্যদিকে অভিরূপের আচরণে অদ্ভুত এক পরিবর্তন টের পাচ্ছিল। ক্লাসে চোখাচোখি হলে অভিরূপ আগের মতো নির্লিপ্ত থাকে না, বরং গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। মায়া বুঝতে পারছিল, কোনো একটা সত্য ওর ভেতরে জমাট বেঁধে আছে। অবশেষে এক বিকেলে, কলেজের ছাদে একাকী বসে থাকার সময় অভিরূপ ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়াল। বাতাসে তখন কাঁচা রোদ আর হালকা শীতের আমেজ। সেই নীরব পরিবেশকে ভেঙে অভিরূপ গলা নামিয়ে বলল, “আমার একটা কথা বলার আছে।”
মায়ার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে ডায়েরিটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যেন সেই পাতাগুলোই তাকে ভরসা দিচ্ছে। অভিরূপ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি শুধু ডায়েরি খুঁজে পাইনি, পড়েছিও।” কথা শেষ হতেই মায়ার শরীর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পৃথিবী যেন ঘুরতে থেমে গেল এক মুহূর্তে। চোখেমুখ লাল হয়ে উঠল তার, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মাটির নিচে ঢুকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তার সবচেয়ে গোপন স্বপ্ন, ভালোবাসা, ভয়—সব উন্মুক্ত হয়ে গেছে অভিরূপের সামনে! সে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “তুমি… সব পড়েছো?” অভিরূপ শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, পড়েছি। আমি জানি, এটা তোমার ব্যক্তিগত ছিল, আমার পড়া উচিত হয়নি। কিন্তু পড়ার পর আর চুপ থাকতে পারিনি।”
মায়ার চোখে জল ভরে উঠল, লজ্জা আর আতঙ্কে হাত কাঁপছিল। কিন্তু অভিরূপ তার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “মায়া, যা পড়েছি তাতে আমি কেবল বিস্মিত হয়নি… আমি খুশি হয়েছি। কারণ যা তুমি লিখেছো, সেই অনুভূতিগুলো আমিও অনেকদিন ধরে নিজের মধ্যে অনুভব করছি, কিন্তু বলতে পারিনি।” মায়া মাথা তুলে বিস্মিত চোখে তাকাল। অভিরূপ শান্তভাবে যোগ করল, “তুমি ভেবেছো তোমার গোপন শুধু তোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আসলে সেটা আমাদের দুজনের। আমি তোমাকে নতুনভাবে দেখেছি, আর এখন বলতে চাই—তুমি একা নও। তোমার প্রতিটি অনুভূতির সঙ্গে আমি আছি।” বাতাস হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠল, কিন্তু সেই ভার ছিল মধুর, মুক্তির। মায়ার চোখে ঝরতে থাকা অশ্রু এবার যেন স্বস্তির রঙে রূপ নিল। লজ্জা আর ভয় মিলেমিশে এক নতুন সূচনার ইঙ্গিত বহন করছিল।
অধ্যায় ১০ : নতুন সূচনা
অভিরূপের স্বীকারোক্তির পর মায়ার চোখে ভেজা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সেই অশ্রুর ভেতরে ছিল না কোনো লজ্জা বা ভয়ের ছায়া—বরং ছিল এক অদ্ভুত স্বস্তি। এতদিন যে গোপন কথাগুলো সে নিজের ডায়েরির পাতায় বন্দী করে রেখেছিল, আজ তা বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিরূপের কণ্ঠে ভরসার সেই দৃঢ়তা মায়ার সমস্ত শঙ্কা গলিয়ে দিল। দুজনের মাঝে নীরবতা ভাসছিল, কিন্তু সেই নীরবতা ছিল মধুর, বোঝাপড়ায় ভরা। কলেজের ছাদে দাঁড়িয়ে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল কাঁচা রোদ আর অচেনা রঙিন স্বপ্নের গন্ধ। মায়া অনুভব করল, অভিরূপ তার কাছে কেবল এক সহপাঠী নয়—সে এখন তার নিজের পৃথিবীর অংশ হয়ে উঠেছে। একসঙ্গে হাঁটার এই অঙ্গীকারটা যেন নিঃশব্দেই তৈরি হয়ে গেল।
দিনগুলো ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। ক্লাসে আর ক্যান্টিনে, করিডোরে আর লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় দুজনের উপস্থিতি যেন একে অপরের সঙ্গে মিশে গেল। নীলা প্রথমেই টের পেল এই পরিবর্তন। তার চোখে পড়ল অভিরূপ আর মায়ার অদ্ভুত বোঝাপড়া, সেই নীরব হাসি, সেই স্নিগ্ধ দৃষ্টি। রাহুলও মজা করে বলত, “এবার বুঝি আসলেই লাভ স্টোরি শুরু!” অভিরূপ আর মায়া হাসত, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ছিল এক অজানা অঙ্গীকার, যেন পৃথিবীর সমস্ত ভিড়ের মধ্যেও তারা নিজেদের আলাদা জায়গা খুঁজে পেয়েছে। প্রতিটি ছোট মুহূর্তে—একসঙ্গে নোট শেয়ার করা, হঠাৎ বইয়ের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা হাতের ছোঁয়া, কিংবা নিরবতার ভেতরে চোখের ভাষায় কথা বলা—সবকিছুতেই তাদের সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠছিল।
এক সন্ধ্যায় মায়া আবার তার ডায়েরি খুলে বসে। ডায়েরির পাতাগুলো ভরে আছে পুরনো ভয়ের ছায়া, দ্বিধার কালি আর স্বপ্নের অক্ষরে। কিন্তু এবার সে অনুভব করে, এই পাতাগুলো আর শুধু একতরফা কাহিনি নয়—এটা এখন দুজনের গল্প। কলম হাতে নিয়ে সে ধীরে ধীরে লিখল শেষ পাতায়—“এবার আর লুকিয়ে নয়, আমাদের গল্প শুরু হলো।” শব্দগুলো যেন তার ভেতরের সমস্ত আবেগকে মুক্তি দিল। ডায়েরি এবার কেবল মায়ার নয়, এটি তাদের দুজনের স্মৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠল। আকাশে তখন হালকা চাঁদের আলো, বাতাসে বইছিল নতুন দিনের সুবাস। মায়া ডায়েরি বন্ধ করল, মনে হলো—এটাই সেই শুরু, যে শুরুতে আর কোনো গোপনীয়তা নেই, আছে শুধু ভালোবাসা, বিশ্বাস আর একসঙ্গে পথ চলার প্রতিশ্রুতি।
-শেষ-