Bangla - ভূতের গল্প

হাতিরপোলের অশরীরী

Spread the love

তপন শিকদার


উত্তর কলকাতার পুরনো মহল্লাগুলোর গলি যেন এক অদ্ভুত সময়যন্ত্র—যেখানে অতীতের প্রতিধ্বনি আজও দেয়ালের ভেতর আটকে আছে। দিনের বেলায় এই গলিগুলোয় ছেলেদের ক্রিকেট খেলা, ভ্যানরিকশার ঝমঝম শব্দ, আর পুরনো মিষ্টির দোকান থেকে ভেসে আসা রসগোল্লার গন্ধ মিশে থাকে; কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই গলির প্রাণশক্তি শুষে নেয় অদৃশ্য কোনো শক্তি। হাতিরপোলের সেই নির্দিষ্ট ভাঙাচোরা গলিতে যখন সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে আসে, তখন মনে হয় ছায়ারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে, পুরনো বাড়ির জানালা দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। ম্লান আলোর নিচে কাদামাখা রাস্তা, ভাঙা ইটের স্তূপ, আর ধসে পড়া বারান্দার খচখচে কাঠ—সব মিলে তৈরি করে এক অদ্ভুত ভৌতিক আবহ। হাওয়ার দমক এলে পুরনো জানালার কপাট ধাক্কা খেয়ে ‘ঠক ঠক’ শব্দ তোলে, যেটা শুনে পথচারীরা একবার পিছনে তাকাতে বাধ্য হয়। স্থানীয়রা দিনের বেলায়ও এই গলি দিয়ে শর্টকাট নেওয়া এড়িয়ে চলে, আর রাতের বেলায় তো এখানে পা রাখার সাহস করে খুব কম মানুষই।

সেই রাতটিও তেমনই এক নির্জন রাত ছিল। দূরে কোথাও বাজল কুকুরের হাউমাউ ডাক, আর আকাশের মেঘলা চাঁদের আলো ঠিকভাবে পৌঁছোতে পারছিল না গলির মাটিতে। গলির ভেতরটা ঢেকে ছিল অন্ধকারের ঘন চাদরে, মাঝে মাঝে কেবল পাশের ঘর থেকে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল আলোর চিকচিক রশ্মি। তখনই হঠাৎ দেখা গেল—অন্ধকার কেটে এক ক্ষীণ আলো এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আলোটা ছিল এক পুরনো কেরোসিন লণ্ঠনের, যার কাচ আধভাঙা আর ধুলোয় ঝাপসা। আলোকে ঘিরে যেন কুয়াশার স্তর তৈরি হচ্ছিল, আর তার মাঝেই দৃশ্যমান হলো এক দীর্ঘকায় মানুষের অবয়ব। মাথায় সাদা কাপড়ের পট্টি, শরীরে ধূসর রঙের মলিন ধুতি আর ফতুয়া, যেন গত শতাব্দীর কোনো মানুষ হাঁটছে এখানে। লণ্ঠনটা হাতে ধরে সে এগিয়ে আসছিল এক অস্বাভাবিক ধীরগতিতে, আর প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠছিল। তার চোখ দুটো যেন সরাসরি আলোর প্রতিফলন ছড়িয়ে দিচ্ছিল—অদ্ভুত, জ্বলজ্বলে, অস্বস্তিকর। যে কেউ সেই চোখের দিকে একবার তাকালে আর ফেরাতে চাইত না দৃষ্টি। যেন চোখের ভেতরেই আটকে আছে অনন্ত গভীরতা।

এই প্রথমবার হাতিরপোলের সেই অচেনা লণ্ঠনওয়ালার আবির্ভাব ঘটে চোখের সামনে। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো পুরনো বাড়ির কেয়ারটেকার কিংবা পথহারা এক অজানা মানুষ। কিন্তু অচেনা লোকটির হাঁটার ভঙ্গি, তার নিস্তব্ধতা, আর চারপাশের বাতাসে হঠাৎ নেমে আসা অদ্ভুত শীতলতা যেন সবকিছুকেই প্রমাণ করছিল—সে মানুষ নয়। তার চারপাশের ছায়ারা যেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছিল, যেন তারা তাকে পথ দেখাচ্ছে না, বরং তার পথেই টেনে নিচ্ছে। গলির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তার ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে বিছিয়ে পড়ছিল, আর মাটির কাদায় সেই ছায়া যেন শিকড় গেড়ে বসে যাচ্ছিল। পথচারীরা দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছিল, কিন্তু কেউ সাহস করেনি তার কাছে যাওয়ার। লণ্ঠনের আলোয় প্রতিবার গলির মুখ আলোকিত হলে দেখা যেত—ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ যেন জানালার আড়ালে সরে গেল, অথবা কোনো অচেনা ছায়া দ্রুত মিলিয়ে গেল। এই গলির মানুষ জানত, রাত নামলেই হাতিরপোলের ওই ভুতুড়ে গলিতে এমন কিছু ঘটে যা ভাষায় বোঝানো যায় না। সেই প্রথম রাত থেকেই লোকেরা নাম দিল—“লণ্ঠনওয়ালা অশরীরী”—যে কেবল হারানো মানুষদের ভুল পথে টেনে নেয়, আর শেষে রেখে যায় কেবল এক অদ্ভুত ভয়ের ছাপ।

***

শিউলি দত্ত ছিল উত্তর কলকাতারই এক পুরনো বাড়ির বাসিন্দা। বয়স তার কেবল কুড়ি, তবুও তার ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত কৌতূহল আর সাহস—যেটা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল। ছোটবেলা থেকেই তার ঝোঁক ছিল অজানা গল্প, ভূতের কাহিনি আর রহস্যময় ঘটনাগুলোর দিকে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা যখন সিনেমা বা নতুন ফ্যাশন নিয়ে মাতামাতি করত, শিউলি তখন বসে থাকত তার দিদিমার পাশে, মন দিয়ে শুনত পুরনো দিনের ভূতের গল্প। দিদিমা প্রায়ই বলতেন, “এই হাতিরপোলের গলিতে রাত নামলে সাবধানে চলিস, বাছা। ওইখানে আলো-আঁধারিতে মানুষকে যে লোকটা পথ দেখায়, সে আসলে মানুষ নয়, অশরীরী। লণ্ঠন হাতে সে তোকে নিয়ে যাবে এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে আর ফেরার রাস্তা নেই।” প্রথমবার শোনার সময় শিউলি ভয় পেয়েছিল বটে, কিন্তু সেই ভয়ই ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক অদম্য কৌতূহলে। কেমন সে লণ্ঠনওয়ালা? কেন সে মানুষকে পথ দেখায়? আর গন্তব্যে গিয়ে যদি দেখা যায় কিছুই নেই, তবে কেন এত বছর পরও তার উপস্থিতি টিকে আছে? কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তে পড়তেই শিউলি এই রহস্যটা উদ্ঘাটন করার পণ করল।

তার বন্ধুদের মধ্যে রাহুল, ইমরান আর মেঘলা ছিল সবথেকে কাছের। তারা জানত, শিউলির কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। তাই যখন এক বিকেলে কলেজ ক্যাফেটেরিয়ায় শিউলি গম্ভীর মুখে বলল—“শোনো, আজ দিদিমার কাছ থেকে আবার শুনলাম লণ্ঠনওয়ালার গল্পটা। আমার মনে হচ্ছে আমরা একবার ওখানে যাওয়া উচিত,”—তখন প্রথমে সবাই হেসে উঠল। রাহুল ঠাট্টা করে বলল, “তুই আবার সেই ভূতুড়ে কাহিনির পেছনে পড়লি? এগুলো পুরোটাই বানানো, বুঝলি।” ইমরান একটু ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে বলল, “কিন্তু শোন, আমার কাকা নাকি একবার ওই গলি দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল রাতে, তারপর থেকে তিনদিন অসুস্থ ছিল। তোকে বলছি, বিষয়টা হালকা করে দেখিস না।” মেঘলা, যাকে শিউলি সবথেকে সাহসী মনে করত, এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি রাজি। তবে আমরা সবাই একসঙ্গে যাব, কেউ আলাদা কিছু করবে না।” সেই মুহূর্তে শিউলির চোখে এক অদ্ভুত ঝলক দেখা গেল—সে যেন ঠিক করে ফেলল, আর পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। তার মনে হচ্ছিল, হাতিরপোলের সেই গলিই তার ডাক দিচ্ছে, আর লণ্ঠনওয়ালার রহস্য না খুঁজে বের করলে তার কৌতূহল কোনোদিন শান্ত হবে না।

রাতের কলকাতা দিনের ব্যস্ততার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দিনের কোলাহল মিলিয়ে গেলে শহর জুড়ে নামে এক অন্যরকম নীরবতা, যার ভেতরে শোনা যায় শুধু কুকুরের ডাক, দূরের ট্রামের ঘন্টাধ্বনি আর মাঝে মাঝে রিকশার চাকায় ঝনঝন শব্দ। শিউলি ওরা চারজন পরিকল্পনা করল এক বৃহস্পতিবার রাতে যাবে। সেদিন কলেজ ছুটি থাকায় সবাই বাসায় জানিয়েই বের হলো। তারা ঠিক করেছিল, অন্ধকার নামতেই গলির কাছাকাছি যাবে, তারপর ধীরে ধীরে এগোবে ভেতরে। যখন ওরা হাতিরপোলের গলির মুখে পৌঁছাল, তখন চারপাশে নিস্তব্ধতা এমন ছিল যেন হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো ভাঙা কাঁচের মতো টিমটিম করছিল, আর ভেতর থেকে আসছিল ভিজে মাটির গন্ধ। মেঘলা গলার স্বর নিচু করে বলল, “এখানে কি সত্যিই কেউ থাকে?” রাহুল একটু হাসার ভান করল, কিন্তু তার কণ্ঠেও চাপা ভয়ের সুর ছিল। হঠাৎ করেই শিউলির মনে পড়ল দিদিমার কথা—“যখন লণ্ঠনের আলো দেখবি, তখন সাবধান। আলো মানেই নিরাপত্তা নয়, অনেক সময় আলোই টেনে নেয় অন্ধকারের দিকে।” শিউলি মুঠো করে ধরল মেঘলার হাত, আর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল গলির অন্ধকারে। তার বুকের ভেতর ভয় নয়, বরং একরাশ উত্তেজনা কাজ করছিল। সে জানত, আজ রাতেই প্রথমবার হয়তো তাদের সামনে আসবে সেই অশরীরী লণ্ঠনওয়ালা, যাকে নিয়ে এতদিন শুধু শোনা গেছে ভয়ের গল্প। আর যদি সত্যিই আসে, তবে সে হবে শিউলির জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।

***

হাতিরপোলের সেই পুরনো গলির মুখে একা একা বসে থাকেন হরেকৃষ্ণ মুখার্জি—সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, যিনি এই গলির ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর মাথায় ধূসর চুলের জটলা, চোখে ঘোলা চশমা—তাকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি যেন নিজেই এই পুরনো জায়গার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। দিনের বেলায় রাস্তার মোড়ে কফির দোকানে বসে লোকে যখন রাজনীতি বা ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করে, তখন হরেকৃষ্ণ বাবু নিঃশব্দে পান চিবিয়ে তাকিয়ে থাকেন গলির ভেতরে, যেন তার দৃষ্টি ভেদ করে চলে যায় অতীতের ভাঙাচোরা দেয়াল পর্যন্ত। পাড়ার ছেলেরা প্রায়ই বলে—“ওই বৃদ্ধ পাগল, সবসময় ভুতের গল্প বানায়।” কিন্তু যারা তার কাছ থেকে সরাসরি শুনেছে লণ্ঠনওয়ালার কাহিনি, তারা জানে তার চোখে-মুখে ভয় মিশে থাকে সত্যিই। শিউলি যেদিন বন্ধুদের নিয়ে গলির ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিনই ঘটনাচক্রে তাদের সঙ্গে দেখা হয় হরেকৃষ্ণ মুখার্জির। কাঁপা গলায় তিনি বলেন—“যেতে চাইলে যাও, তবে মনে রেখো, অন্ধকারকে সবাই জয় করতে পারে না। আমি তো বহুবার দেখেছি, লোকে হারিয়ে যায়, আর পরে আর কখনো ফেরে না। সেই লণ্ঠনটা আজও জ্বলছে, যেদিন আমার ভাইয়ের প্রাণ গেল সেই ভুতুড়ে বাড়ির ধসে।”

শিউলির মনে কৌতূহল বেড়ে গেল আরও। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আসলে কী হয়েছিল?” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন—“বছর চল্লিশ আগের কথা। এই হাতিরপোলের গলির ভেতরেই আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল। বড়লোকি ছিল না, তবে বাড়িটা ছিল মজবুত, দোতলা, আর ভেতরে ছিল কাঠের সিঁড়ি। আমার ভাই হেমকান্ত তখন তরুণ, সবসময় লণ্ঠন হাতে রাতের বেলা বই পড়ে কিংবা ঘোরাফেরা করত। কিন্তু এক বর্ষার রাতে প্রবল বৃষ্টিতে হঠাৎ বাড়ির একাংশ ধসে পড়ে। ঘর ভেসে যায়, দেয়ালের তলায় চাপা পড়ে যায় আমার ভাই। আমরা সকলে চেষ্টা করেছিলাম তাকে টেনে বের করার, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেই রাত থেকেই নাকি অনেকে দেখেছে, হেমকান্তর মতো এক অবয়ব লণ্ঠন হাতে গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি নিজেও বহুবার দেখেছি দূরে ম্লান আলো—যেন ভাই আমার ডাকছে, পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু কাছে গেলেই মিলিয়ে যায়।” কথা বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ লাল হয়ে উঠল, আর তার কণ্ঠে জমে থাকা বেদনা যেন ভারি হয়ে চারপাশের বাতাসকে নীরব করে দিল। শিউলি আর তার বন্ধুরা হতবাক হয়ে শুনছিল, কারও মুখে কোনো কথা ফুটল না।

হরেকৃষ্ণ বাবু তখন আরও গম্ভীর হয়ে যোগ করলেন—“শোনো, ওকে কেউ হারাতে পারবে না। লণ্ঠনের আলো মানেই নিরাপদ পথ নয়। ও আলোয় ভরসা করলে অচিরেই পৌঁছবে ধ্বংসের দরজায়। মনে রেখো, গলি আর বাড়িটা আজ ভাঙাচোরা, কিন্তু তার ভেতরে আটকে আছে অশান্ত এক আত্মা। হেমকান্ত কখনও মুক্তি পায়নি, হয়তো কোনো অপূর্ণ বাসনা, হয়তো মৃত্যুর আকস্মিকতা। তাই সে রাতের পর রাত মানুষকে ভুলপথে টেনে নিয়ে যায়, যেন অন্য কারও মধ্যে নিজের সঙ্গ খুঁজে পায়। আমি চাই না তোমরা তার খপ্পরে পড়ো। ভয় যদি না-ও পাও, সাবধানতা অবলম্বন কোরো।” কথাগুলো বলার পর হরেকৃষ্ণ মুখার্জি গলির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলেন, যেন তিনি নিজেই অপেক্ষা করছেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতির। শিউলি সেই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারল না—এ কি একজন বৃদ্ধের বেদনায় ভরা কল্পনা, নাকি সত্যিই লুকিয়ে আছে এমন এক অশরীরী ছায়া, যেটা আজও হাতিরপোলের গলি ছাড়েনি। তার বুকের ভেতর ভয় আর উত্তেজনা একসঙ্গে চেপে বসল, আর সে বুঝল—এই রহস্যের জালে সে এখন পুরোপুরি আটকা পড়েছে।

***

রাতের কলকাতা যখন নিস্তব্ধতার আঁধারে ঢেকে যায়, তখন হাতিরপোলের গলিগুলো যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করে। শহরের কোলাহল আর রিকশার টুংটাং শব্দ অনেক দূরে মিলিয়ে যায়, আর থেকে যায় কেবল ফাঁকা রাস্তায় ভেজা কুয়াশার গন্ধ, ভাঙা বাড়িগুলোর দেওয়ালে ঝুলে থাকা পুরনো পোস্টারের ছেঁড়া টুকরো, আর অদ্ভুত নীরবতা। শিউলি আর তার তিন বন্ধু—অর্ণব, পূজা আর সঞ্জয়—সেদিন ঠিক করেছিল কাহিনির সত্যতা যাচাই করবে। দিদিমার কাছ থেকে শোনা ভয়ঙ্কর গল্প আর হরেকৃষ্ণবাবুর সতর্কবার্তাও তাদের কৌতূহল দমন করতে পারেনি। হাতে টর্চলাইট আর ক্যামেরা নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল ভুতুড়ে গলির ভেতর। ঠিক তখনই, কুয়াশার আবছা স্তর ভেদ করে দেখা গেল এক অচেনা মানুষ, হাতে কেরোসিন লণ্ঠন। তার গায়ের জামা অনেক পুরনো, সাদা পাজামা-কুর্তা যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে। ধীরে ধীরে পায়ের শব্দ না করেই সে হাঁটছিল, যেন বাতাসের মতো ভেসে যাচ্ছে। শিউলি থমকে দাঁড়াল, বন্ধুরাও চমকে তাকিয়ে রইল। চারজনের চোখে ভয়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত আকর্ষণ জমে উঠল—এ কি সেই লণ্ঠনওয়ালা?

লোকটি কোনো কথা না বলে, কেবল হাতের ইশারায় তাদের ডাকল। আলোটা কাঁপছিল, যেন লণ্ঠনের ভেতর বাতাস বন্দি হয়ে কাঁদছে। চার বন্ধু একে অপরের দিকে তাকাল, কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। শিউলি, যে সাধারণত সবচেয়ে সাহসী, এগিয়ে গেল এক কদম। বাকিরাও তার পিছনেই ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। লণ্ঠনওয়ালা যেন অদ্ভুত ছন্দে চলছিল—না খুব দ্রুত, না খুব ধীরে—কিন্তু এমনভাবে যে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অনিবার্য এক গন্তব্যের দিকে। চারদিকে ছিল ভাঙা বাড়ির অন্ধকার জানালা, যেখান থেকে যেন কেউ তাকিয়ে আছে। রাস্তার ওপর শুকনো পাতা খসখস শব্দ তুলছিল তাদের পায়ের নিচে। বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ আর অদ্ভুত ঠাণ্ডা একসঙ্গে মিশে গিয়ে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তারা এগোতে এগোতে হঠাৎ দেখতে পেল এক পুরনো ভগ্নপ্রায় বাড়ি, যার দেয়ালে ফাটল, জানালার কাচ ভাঙা, আর লোহার গেট মরচে ধরে ঝুলে আছে। চারদিক অন্ধকারে ঢেকে থাকলেও লণ্ঠনের আলো বাড়িটার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। শিউলি হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে অনুভব করল—এটাই কি সেই অভিশপ্ত বাড়ি?

কিন্তু আসল বিস্ময় তখনই ঘটল। তারা যখন বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল, দেখল লণ্ঠনওয়ালা আর নেই। কেবল বাতাসের ঝাপটা, যেন কারও অদৃশ্য হাত লণ্ঠনের আলো নিভিয়ে দিয়েছে। আশেপাশের নীরবতা হঠাৎ আরও ভারী হয়ে উঠল। সঞ্জয় হঠাৎ টর্চলাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখল, তাদের পেছনে লম্বা গলিটার কোথাও কোনো চিহ্ন নেই, এমনকি পায়ের ছাপও নয়। পূজা কাঁপা গলায় বলল, “আমরা কি সত্যিই কাউকে দেখলাম?” কিন্তু শিউলি নিজের মনে অনুভব করল, যা দেখল তা কেবল চোখের ধাঁধা নয়। তার শরীর শিউরে উঠছিল, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত টান তাকে বলছিল—এই রহস্যের উত্তর এখানে, এই ভাঙা বাড়ির ভেতরেই। ঠিক তখনই বাতাসে শোনা গেল হালকা ফিসফিসানি, যেন কারও গলায় শীতল হাহাকার। চারজনই আতঙ্কে একে অপরকে আঁকড়ে ধরল। তারা বুঝতে পারল—এই সাক্ষাৎ শুধু শুরু, সামনে আরও অদ্ভুত আর ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।

***

পরান বাউরি, হাতিরপোলের পুরনো রিকশাওয়ালা, ভাঙাচোরা গলির ধারে দাঁড়িয়ে শিউলিদের দিকে এক ধরনের অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল। তার চোখের তলদেশে গভীর কালচে দাগ, যেন রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি সে। শিউলির সাহসী কৌতূহলকে দেখে হালকা হেসে ওঠে পরান, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে অস্বস্তির রেখা স্পষ্ট। শিউলিরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে সত্যিই কি লণ্ঠনওয়ালাকে দেখেছে, তখন তার গলার স্বর কেঁপে ওঠে। “দেখেছি বোন… শুধু দেখিনি, আমি তার পথও ধরেছিলাম।” এই এক বাক্যে যেন নিঃশব্দ গলিতে ঠান্ডা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে। পরান বসতে বলে সবাইকে, নিজের চিবুকের দাড়িতে হাত বুলিয়ে স্মৃতি হাতড়ে বের করতে থাকে। সেই রাতের কথা মনে পড়তেই তার কপালে ঘাম জমে, যদিও বাতাস ছিল ঠান্ডা। শিউলি আর তার বন্ধুরা মন দিয়ে শুনতে থাকে, যেন এক ভিন্ন জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে তাদের সামনে।

পরান বলে, এক অমাবস্যার রাতে যাত্রী না পেয়ে সে গলির ধারে দাঁড়িয়েছিল রিকশা নিয়ে। হঠাৎ অদ্ভুত কেরোসিনের গন্ধ নাকে আসে, আর মলিন আলোয় এক লোককে দেখতে পায়—লণ্ঠন হাতে, ধীরে ধীরে হাঁটছে। লোকটির গলার স্বর নরম, যেন কারও সঙ্গে কথা না বলেও ডাক দিচ্ছে। পরান কৌতূহলী হয়ে তার পিছু নেয়, রিকশা টেনে টেনে এগিয়ে যায় আঁধারের ভেতর। সে বলে, গলির ভাঙাচোরা ইটের দেওয়াল যেন আরও অচেনা লাগছিল, রাস্তার মোড়গুলো যেন অদ্ভুতভাবে লম্বা হয়ে যাচ্ছিল। লণ্ঠনের আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু আশেপাশের অন্ধকার আরও ঘন হতে থাকে। শেষে সে গিয়ে দাঁড়ায় এক ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে, ঠিক যেটা শিউলিরা পরে দেখেছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই লণ্ঠনওয়ালা অদৃশ্য হয়ে যায়। পরান তখনো বোঝেনি, ভয়টা কী হতে চলেছে। সে ভেতরে পা রাখে, আর তারপরই সব অন্ধকার হয়ে যায় তার চোখে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়, কিন্তু সে জানে না কী ঘটেছিল তার সঙ্গে।

পরান থেমে যায় কিছুক্ষণ, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। শিউলি তার চোখে তাকিয়ে দেখে—ভয়ের ছাপ এখনও তাজা, যেন কাহিনিটা আজকেই ঘটেছে। সে বলে, “আমি যখন ফিরে আসি, তখন সকাল হয়ে গেছে। আমার রিকশা ভিজে ছিল শিশিরে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—আমার গা থেকে ভেজা কাদার গন্ধ বের হচ্ছিল। অথচ কোথায় ছিলাম এতক্ষণ, তা আমার কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, শরীর ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল, আর বুকের ভেতর একটা শূন্যতা।” শিউলি আর তার বন্ধুদের শরীর কেঁপে ওঠে। পরান বলে, এরপর থেকে আর কখনও সে সেই গলির গভীরে যায়নি। প্রতিবার কেরোসিনের গন্ধ পেলেই তার বুক ধকধক করে ওঠে। হরেকৃষ্ণের সতর্কবাণী, দিদিমার গল্প—সব যেন নতুন অর্থ পায় এই অভিজ্ঞতার মধ্যে। শিউলি অনুভব করে, তারা যে রহস্যের পেছনে ছুটছে, সেটা হয়তো শুধু ভয়ের গল্প নয়—এটা এক অভিশাপ, যা বহু মানুষের জীবনে চিহ্ন রেখে গেছে। আর সেই চিহ্নের ভার তাদের কাঁধেও এসে পড়তে চলেছে।

***

প্রথমবার শিউলি যখন ভুতুড়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াল, তখনই তার মনে হলো—এই বাড়ির দেয়ালে সময় থমকে গেছে। ভাঙা লোহার গেট ঠেলে ঢুকতেই এক অদ্ভুত শব্দ হলো, যেন দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে উঠল কোনো অচেনা প্রাণী। উঠোন জুড়ে ধুলো, জং ধরা টিন আর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার স্তূপ। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কাঁচ আর পুরোনো আসবাবপত্রের অবশেষ যেন অতীতের দুঃখগাথা ফিসফিস করে বলে চলেছে। শিউলি ধীরে ধীরে ভেতরে পা রাখল, হাতে ছোট্ট টর্চলাইট। দেয়ালের রং উঠে গেছে, মেঝেতে আর্দ্রতার দাগ—যেন বৃষ্টি আর অন্ধকার এখানে যুগ যুগ ধরে বন্দি হয়ে আছে। সিঁড়ির কাঠগুলো এতটাই নড়বড়ে যে, প্রতিটি পদক্ষেপে কাঁপতে লাগল। উপরে উঠতেই বাদুড়ের একদল উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে, ডানার শব্দে শিউলির বুক কেঁপে উঠল। বাতাস ভারী হয়ে আছে শ্যাওলা আর পচা কাঠের গন্ধে, যেন এই বাড়ি জীবন্ত হয়ে তার প্রতিটি নিশ্বাস গুনছে। শিউলি নিজেকে বুঝালো, ভয় পেলে চলবে না, তাকে জানতে হবে—এই বাড়ি কেন এত ভীতিকর, আর লণ্ঠনওয়ালা কেন এখানে পথ দেখিয়ে আনে।

কিন্তু যতই ভেতরে এগোতে লাগল, বাড়িটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। সিঁড়ির শেষে একটা লম্বা করিডর, দেয়ালে অর্ধেক ঝুলে থাকা পুরোনো ফটোফ্রেম, যার ছবিগুলো সময়ের সঙ্গে মুছে গেছে। কোথাও স্পষ্ট মুখ নেই, কেবল অস্পষ্ট অবয়ব—যেন কেউ ইচ্ছে করেই চিহ্ন মুছে দিয়েছে। হঠাৎই শিউলির কানে ভেসে এলো এক অচেনা কণ্ঠস্বর, খুব কাছে থেকেও দূরের মতো। সেটা ফিসফিস করছিল—“এদিকে এসো… এসো…”। শিউলির হাত কেঁপে উঠল, টর্চলাইটের আলো কাঁপতে কাঁপতে করিডরের শেষ প্রান্তে পড়ল। আলোয় ভেসে উঠল একটা আধখোলা দরজা। সেই দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বেরোচ্ছে, যেন ভেতরে কোনো অচেনা জগত লুকিয়ে আছে। শিউলি জানে, ভয় পেলেই হেরে যাবে, তাই ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে পুরোনো কাগজ, ছেঁড়া ডায়েরির পাতা, আর মাঝখানে একটা ভাঙা লণ্ঠন পড়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, লণ্ঠনটা ভাঙা হলেও তার ভেতর থেকে হালকা নীল আলো বেরোচ্ছে। শিউলি তাকিয়ে রইল—এই আলো কি লণ্ঠনওয়ালার রহস্যের সঙ্গে যুক্ত?

কিন্তু শিউলির মনে হতেই লাগল, সে একা নয়। সেই ফিসফিসানি আবার শোনা গেল—এবার অনেক স্পষ্ট, যেন একাধিক কণ্ঠ একসঙ্গে ডাকছে তাকে। শিউলির গা শিউরে উঠল, তবুও কৌতূহল তাকে থামাল না। সে ভাঙা লণ্ঠনের পাশে বসে ছেঁড়া ডায়েরির পাতাগুলো হাতে নিল। পাতাগুলো ভিজে, লেখা প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু তবুও কয়েকটা শব্দ চোখে পড়ল—“অপেক্ষা… প্রতিশোধ… হারানো ভাই…”। হঠাৎই চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো, টর্চলাইট নিভে গেল নিজে থেকেই। ঘরের ভেতরে সেই নীল আলোই কেবল ভাসছে। আর তখনই শিউলি দেখল দরজার ফাঁকে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছায়া লম্বা, হাতে লণ্ঠন, আর মুখ অদৃশ্য অন্ধকারে ঢাকা। মুহূর্তেই শিউলি বুঝতে পারল—সে প্রথমবার সত্যিকারের ভেতর থেকে লণ্ঠনওয়ালার ডাক শুনছে। গলির মানুষের গল্পগুলো হয়তো কেবল সতর্কবার্তা ছিল, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে শিউলি অনুভব করল—এই বাড়িটা শুধু ভুতুড়ে নয়, বরং এক অসমাপ্ত কাহিনির কেন্দ্র, যেখানে প্রতিটি ইট আর ছায়া প্রতিশোধের ইতিহাস বহন করছে।

***

হরেকৃষ্ণ মুখার্জির কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা স্বর, চোখে অদ্ভুত এক ভয় আর দুঃখের মিশ্র ছায়া। তিনি শিউলির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন বহুদিন ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা এক দুঃসহ ভারকে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চারপাশে গলির মানুষজন নিঃশব্দে কান পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। সবার চোখে প্রশ্ন, আর শিউলির মনে একরাশ কৌতূহল—কেন তিনি এতদিন চুপ ছিলেন? ধীরে ধীরে হরেকৃষ্ণ বলতে শুরু করলেন, “ওই বাড়িটা শুধু ভুতুড়ে নয়, ও আমার রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে। ওই বাড়ির আসল মালিক ছিল আমার ভাই, হরিশ। আমরা দু’জন একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলাম, একসঙ্গে বড় হয়েছি সেই বাড়ির আঙিনায় খেলা করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করল ওর মন। টাকার প্রতি অদ্ভুত এক লোভ জন্ম নিল, পুরনো ভিটেমাটি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট তুলবে বলে অন্ধ হয়ে গেল।” হরেকৃষ্ণ থেমে গিললেন লালা, যেন স্মৃতিগুলো তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে। তিনি বর্ণনা করলেন, কীভাবে এক রাতে নির্মাণকাজের জন্য দেয়াল ভাঙতে গিয়ে হঠাৎ ধসে পড়ল অর্ধেক বাড়ি, আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচেই চাপা পড়ে গেলেন তার ভাই। আশপাশের মানুষ দৌড়ে এলেও ততক্ষণে দেহের প্রাণ নিঃশেষ। কিন্তু তখন থেকেই, বাড়িটার ভেতরে রাত হলে ভৌতিক এক আলো দেখা যেত—যেন লণ্ঠন হাতে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল কাকতালীয় ব্যাপার, কিন্তু পরের ঘটনাগুলোই নিশ্চিত করল—ওটা আসলে হরিশের অস্থির আত্মা, যে নিজের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করতে না পেরে পথচারীদের ভুলপথে টেনে নেয়, যেন তাদেরও একই ভাগ্য ভোগ করতে হয়।

শিউলি হরেকৃষ্ণের কাহিনি শুনে শিউরে উঠল। বন্ধুরা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। চারপাশে যেন বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। হরেকৃষ্ণ চোখের জল মুছে আবার বললেন, “ভাইকে আমি সবসময় বাঁচানোর চেষ্টা করতাম, বুঝিয়েছিলাম লোভের পথে যেও না। কিন্তু শোনেনি। মৃত্যুর পরও সে শান্তি পায়নি। এখন ওর আত্মা হারিয়ে যাওয়া লণ্ঠনওয়ালা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওই ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে। ও কাউকে ডাকতে চায় না, ও কাউকে পথ দেখাতেও চায় না। ওর আলো মানে বিভ্রম—যেখানে যাবে, সেখানেই ধ্বংসের ছাপ।” শিউলি কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “তাহলে আপনি এতদিন এসব লুকিয়ে রাখলেন কেন?” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন মানুষকে, কিন্তু গ্রামের লোকজন এসব বিশ্বাস করতে চায়নি। কেউ বলত ভূতের কাহিনি বানানো, কেউ বলত পাগলামি। তাই তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের ঘটনা, শিউলি আর তার বন্ধুদের সেই বাড়ির সামনে পৌঁছে যাওয়া, তাকে আবার বাধ্য করেছে সব খুলে বলতে। তিনি আরো সতর্ক করলেন, “যদি কারও জীবন বাঁচাতে চাও, তবে ওই বাড়ির ভেতরে যেও না। হরিশের আত্মা এখন শুধু অভিশপ্ত আলো নয়, প্রতিশোধের অগ্নিশিখা।”

বৃদ্ধের গলায় অসহায়তা থাকলেও, চোখেমুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত সত্যের ছায়া। শিউলি মনে মনে ভাবতে লাগল—এই গল্পটা কি সত্যিই কেবল এক কুসংস্কার, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা? রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লণ্ঠনওয়ালা কি আসলেই এক মৃত মানুষের আত্মা, নাকি অন্য কোনো রহস্য? বাতাসে শিউলির শরীর কেঁপে উঠল, মনে হল যেন অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। বন্ধুদের কেউ কথা বলল না, নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল গলিটাকে। হরেকৃষ্ণ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আমার ভাইয়ের আত্মাকে শান্তি দিতে পারিনি। এখন শুধু চাই, তোমরা আর কোনো ঝুঁকি নিও না।” তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত আবেদন, যেন দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও মিশে আছে। কিন্তু শিউলির ভেতরে উঁকি দিল নতুন এক জেদ—সত্যিটা জানার। সে জানত, এই কাহিনি শুধু এক ভুতুড়ে রহস্য নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অতীতের ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের শেষ সত্য উন্মোচন করাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য।

***

শিউলি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল যে এই রহস্যময় ঘটনার ভেতরে শুধুই ভয় নয়, বরং একটা অসম্পূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে। লণ্ঠনওয়ালার ছায়া আর ভুতুড়ে বাড়ির আঁধার যেন তাকে বারবার ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল। হরেকৃষ্ণ মুখার্জির কাহিনি শোনার পর তার মন থেকে ভয় ধীরে ধীরে সরে গিয়ে জায়গা করে নেয় সহানুভূতি। সে ভাবছিল—যদি সত্যিই এই আত্মা মুক্তি না পেয়ে একাকী ঘুরে বেড়ায়, তবে তাকে শান্তি দেওয়ার দায়িত্ব কি কারও নেই? রাতের অন্ধকারে ছাদে দাঁড়িয়ে শিউলি অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল, আর সেই মুহূর্তেই তার মনে দৃঢ় সংকল্প জন্ম নেয়। ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ সে নয়। তার মধ্যে এক অদম্য কৌতূহল আর সাহস আছে। তাই সে ঠিক করল, এবার সে ওই বাড়ির অতল অন্ধকারে আবার প্রবেশ করবে—কিন্তু আর নিছক কৌতূহল নয়, এবার উদ্দেশ্য হবে আত্মাটিকে মুক্তি দেওয়া। সে জানত, সহজ হবে না। কিন্তু দিদিমার গল্প, পরানের অভিজ্ঞতা আর হরেকৃষ্ণের সতর্কবার্তার ভেতর থেকে কিছু সূত্র মিলিয়ে সে বুঝে গিয়েছিল—বাড়ির ধ্বংসাবশেষে তিনটি জিনিস এখনও লুকিয়ে আছে: একটি পুরনো লণ্ঠন, একটি চাবি আর একটি অসমাপ্ত ডায়েরি। এগুলোই হয়তো আত্মাটির শান্তির চাবিকাঠি।

পরের কয়েকদিন শিউলি নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রস্তুতি নিল। কলেজে গিয়ে বন্ধুরা যখন সাধারণ গল্পে ব্যস্ত থাকত, তার মন পড়ে থাকত ওই রহস্যময় বাড়িতে। প্রতিদিন রাত হলেই সে জানলার ফাঁক দিয়ে হাতিরপোলের গলির দিকে তাকিয়ে থাকত। মনে হতো, লণ্ঠনওয়ালার মৃদু আলো আবার ডাক দিচ্ছে। সে নোটবুক বের করে সম্ভাব্য সূত্রগুলো লিখে রাখল—লণ্ঠন, চাবি আর ডায়েরি। হরেকৃষ্ণ মুখার্জির কাছে গিয়ে আরও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃদ্ধ শুধু মাথা নাড়িয়ে বললেন, “যা হারিয়েছে, তা ফিরে পেতে গেলে তোমাকেই পথ খুঁজতে হবে।” শিউলি ভয় পায়নি। বরং তার মনোবল আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। এক গভীর রাতে, যখন চারদিক ঘন নীরবতায় ঢেকে গেছে, তখন সে নিজের ঘরে বসে মোমবাতির আলোয় ডায়েরি লিখল। নিজের প্রতিজ্ঞা সে নিজের ভাষায় তুলে ধরল—যেন মনে করিয়ে দিতে পারে কেন এই ভয়ানক পথে পা বাড়াতে হবে। সে বুঝেছিল, এই যাত্রা আর নিছক রোমাঞ্চ নয়, এটা এক ধরনের দায়বদ্ধতা, এক মানবিক দায়িত্ব। আত্মার বেদনা যদি সত্যিই পৃথিবীতে রয়ে যায়, তবে সেই বেদনা থেকে মুক্তি দেওয়াই হবে তার কাজ।

অবশেষে সেই রাত এল যখন শিউলি সব ঠিকঠাক করে রওনা দিল। হাতে ছোট্ট টর্চ, ব্যাগে কয়েকটি কাগজ-কলম, দড়ি আর মোমবাতি। গলির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার বুকের ভেতরে ভয় আর সাহস দুই-ই মিশ্রিত ঢেউ তুলছিল। চারপাশে নীরবতা, কেবল ভাঙাচোরা বাড়ির দিকে এগোতেই দূর থেকে ভেসে এল বাদুড়ের পাখার শব্দ। সে থামল না। মনে হচ্ছিল, বাতাসে আবার সেই অচেনা কণ্ঠ ভেসে আসছে—“এসো… এসো…”। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শিউলি মনের ভেতর প্রার্থনা করল, যেন শক্তি পায়। তারপর দম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সে ভাবছিল—লণ্ঠন, চাবি আর ডায়েরি কোথায় লুকিয়ে আছে? দেয়ালের ফাঁক, ভাঙা আলমারি, নাকি ধ্বংসস্তূপের নীচে? সে জানত, উত্তর খুঁজে বের করা সহজ হবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখে ভয়ের ছায়া নেই, বরং প্রতিজ্ঞার দীপ্তি। লণ্ঠনওয়ালার ছায়া হয়তো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এবার শিউলি পালাবে না। সে লড়বে—শুধু নিজের কৌতূহলের জন্য নয়, বরং এক বন্দী আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। সেই রাতেই শিউলি নিজের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অথচ মানবিক অভিযানের দিকে প্রথম সত্যিকারের পদক্ষেপ নিল।

***

শিউলি সেই রাতটার জন্য আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিল। আকাশে পূর্ণিমার আলো ফিকে হয়ে ধোঁয়াশার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল, বাতাসে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা জমে ছিল। সে হাতে পুরনো লণ্ঠনটি নিয়ে ভাঙাচোরা বাড়ির ভেতরে ঢোকে, চারপাশ যেন মৃত্যুর মতো নিশ্চুপ। দেয়ালগুলো ফাটল ধরা, সিঁড়ির কাঠের গন্ধে শ্যাওলা মিশে আছে, আর মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা ইটের খণ্ড পায়ের চাপেই কেঁপে ওঠে। শিউলি কাঁপা হাতে লণ্ঠনের সলতে জ্বালায়, আর মুহূর্তেই অন্ধকারের গায়ে এক টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়ে। আলোটা যতটা না চারপাশ আলোকিত করছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি যেন অচেনা কিছু ডেকে আনছিল। হঠাৎ বাড়ির ভেতর ভারি শোঁ শোঁ শব্দ উঠতে লাগল, দরজা আচমকা নিজেরাই ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল। শিউলি চমকে উঠে চারদিকে তাকায়—মনে হলো চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে আসছে, ঠান্ডা স্রোত তার শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সেই ভৌতিক নিস্তব্ধতার মাঝেই মেঝে থেকে, দেয়ালের ফাঁক থেকে অদৃশ্য ছায়ারা যেন মাথা তুলতে লাগল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, লণ্ঠনের আলো কেঁপে উঠে এক ভৌতিক অবয়ব তৈরি করল—লণ্ঠনওয়ালা।

তার রূপটা এতটাই অস্বাভাবিক যে শিউলি প্রথমে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়ার মতো অবয়ব। মুখটা অন্ধকারে ঢেকে, কেবল চোখের জায়গায় ফ্যাকাশে আলো জ্বলছিল। ছেঁড়া ধুতি, পায়ে মাটির ধুলো, আর হাতে সেই চেনা লণ্ঠন। সে ধীরে ধীরে ভেসে শিউলির দিকে এগিয়ে আসে। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে যেন কেঁপে উঠছিল, অথচ তার পা মাটিতে স্পর্শও করছিল না। ঘরে হালকা জ্বলন্ত কেরোসিনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেই গন্ধে ভেজা মাটি আর মৃত্যুর আর্দ্রতা মিশে গেল। শিউলি ভয়ে পিছোতে চাইলেও দরজা শক্তভাবে বন্ধ হয়ে আছে, পালানোর কোনো উপায় নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই অচেনা কর্কশ অথচ দুঃখভরা কণ্ঠ ভেসে এল—“আমাকে মুক্তি দাও।” শব্দটা ফিসফিসে হলেও যেন চারদিক কাঁপিয়ে দিল। শিউলি কানে হাত দিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা তার মনের ভেতর গেঁথে যেতে থাকে। বাতাসের ঠান্ডা এত তীব্র হয়ে উঠল যে তার নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মতো বেরোতে লাগল, আর শরীরের রক্ত যেন জমে যাচ্ছে মনে হলো। কিন্তু ভয়ের মাঝেই সে হঠাৎ বুঝতে পারল—এই আত্মা তাকে আক্রমণ করতে আসেনি। সে কেবল মুক্তি চায়, তার দীর্ঘদিনের অশান্তি থেকে মুক্তি।

শিউলি লণ্ঠন শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ের সাথে সাথে তার মনে করুণাও জন্ম নেয়। কাঁপা গলায় সে বলে ওঠে, “আমি এসেছি তোমাকে মুক্তি দিতে। বলো, কীভাবে শান্তি পাবে?” আত্মার চোখদুটো যেন অদ্ভুতভাবে জ্বলে উঠল, লণ্ঠনের আলোতে তার অবয়ব স্পষ্ট হলো। তার ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু শব্দ যেন কেবল শিউলির কানে বাজছে—“আমার লণ্ঠনটা ভাঙো না, এটা আমার শেষ স্মৃতি। সেই চাবি খুঁজে দাও, আর ডায়েরিটা শেষ করো। তারপরই আমি মুক্তি পাব।” শিউলি এক ধাপ এগিয়ে এসে মাথা নেড়ে প্রতিশ্রুতি দেয়। ঘরটা কেঁপে ওঠে, ছায়াগুলো যেন একসাথে হাহাকার করে ওঠে, আর হঠাৎ সব আলো নিভে যায়। অন্ধকারের ভেতর কেবল লণ্ঠনের কাঁপা শিখা আর সেই অর্ধেক মানুষ-অর্ধেক ছায়ার ভৌতিক মুখ, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার আগে আবারও ফিসফিস করে বলে, “শিউলি… আমাকে মুক্তি দাও…”। শিউলি গভীর নিঃশ্বাস নেয়, ভয়কে জয় করে বুঝতে পারে—তার ওপরেই এই আত্মাটির শান্তি নির্ভর করছে। সেই রাত থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। এই অভিশপ্ত বাড়ির ভেতর সে আর কেবল এক কিশোরী নয়, বরং একমাত্র মানুষ যে মৃত আত্মার জন্য শেষ আলো জ্বালাতে পারবে।

***

শিউলি যখন ভাঙাচোরা বাড়ির অন্ধকার ঘরে একা দাঁড়িয়ে লণ্ঠন জ্বালালো, তখন চারপাশের বাতাস হঠাৎ কেঁপে উঠল। দরজা একবারে জোরে ধাক্কা মেরে বন্ধ হয়ে গেল, জানালার ভাঙা কাঁচগুলোতে অদ্ভুত আলো প্রতিফলিত হতে লাগল। লণ্ঠনের শিখার চারপাশে যেন অসংখ্য ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর সেই ছায়ার মধ্যেই উদ্ভাসিত হলো লণ্ঠনওয়ালা—এক অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়া। তার চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস, যেন যুগের পর যুগ সে এক অদৃশ্য বোঝা বয়ে চলেছে। শিউলি হাত কাঁপলেও সাহস সঞ্চয় করে ডায়েরিটা খুলে পড়ে শোনাতে শুরু করল। পাতাগুলিতে ফুটে উঠল অতীতের দুঃসহ কাহিনি—লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং অসমাপ্ত স্বপ্ন। বোঝা গেল, মৃত্যুর পরও আত্মার যন্ত্রণা থামেনি কারণ তার প্রিয়জনেরা তাকে ঠকিয়েছিল, তার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি। শিউলি তখন আস্তে আস্তে বলে উঠল, “তুমি মুক্তি পাও। কেউ তোমাকে আর আটকে রাখতে পারবে না।” কথা শেষ হতেই ঘরটা আলোয় ভরে উঠল, যেন শত সূর্য একসাথে জ্বলে উঠেছে। আত্মার মুখে মৃদু হাসি ফুটল, আর ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে গেল, শুধু শূন্যে ভাসমান এক ফিসফিসানি রেখে গেল।

কিন্তু মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে তৈরি হলো এক অদ্ভুত শূন্যতা। দেয়ালগুলো যেন হঠাৎ ভেঙে পড়তে চাইছে, ছাদের ফাঁকফোকর থেকে শীতল বাতাস ঢুকে শিউলির শরীরকে হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দিচ্ছে। সে জানালার দিকে ছুটল, কিন্তু জানালা তখনও বন্ধ। লণ্ঠনের শিখা আস্তে আস্তে নিভে আসছিল, ঠিক সেই সময় শিউলির কানে ভেসে এলো বহু দূরের কোনো কণ্ঠস্বর—“আমাকে ভুলে যেও না…”। সে চমকে উঠল, কারণ কণ্ঠটা লণ্ঠনওয়ালার নয়, বরং এক অচেনা নারীর। ডায়েরির ভেতরে আরও কিছু পাতা ছিল, কিন্তু সবকটি ভিজে মুছে গিয়েছিল, বোঝা যাচ্ছিল না আসলে সেখানে কী লেখা ছিল। শিউলি বুঝতে পারল, হয়তো সত্যিটা সে পুরোটা জানতেও পারবে না। আত্মা কি সত্যিই শান্তি পেয়েছে, নাকি অন্য কোনো অভিশাপের শুরু হলো? তার মনে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হলো—যা ঘটল, তা কি শেষ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও কোনো গভীর অন্ধকার? সে জানত, উত্তর খুঁজতে গেলে তাকে আরও গভীর ছায়ার ভেতরে ঢুকতে হবে, যেখানে হয়তো নিজের অস্তিত্বও হারিয়ে যেতে পারে।

রাত পেরিয়ে ভোর হলে গলির লোকেরা ভাঙা বাড়ির সামনে এসে দেখে, শিউলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ভয় নেই, বরং অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। সে ডায়েরি, লণ্ঠন আর পুরোনো চাবি হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যেন এগুলোই তার কাছে সত্যিকারের উত্তর খোঁজার চাবিকাঠি। মানুষজন নানা কথা বলতে লাগল—কেউ বলল অভিশাপ শেষ হয়েছে, কেউ আবার মনে করল নতুন অভিশাপের শুরু হয়েছে। কিন্তু শিউলি নিশ্চুপ। সে শুধু ভাঙা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। আর ঠিক সেই সময়, এক অন্ধকার গলি থেকে আবার ভেসে এলো সেই ভয়াল অথচ পরিচিত কণ্ঠস্বর—“চলুন, আমি পথ দেখাচ্ছি…”। লোকে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল, অথচ শিউলির ঠোঁটে ভেসে উঠল হালকা এক হাসি। সে জানত, গল্প শেষ হয়নি। হয়তো আত্মা মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু গলির অন্ধকার এখনও ফাঁদ পেতে বসে আছে। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যদি আবার কোনো অভিশাপ আসে, তবে এবার সে প্রস্তুত। তবু অজানা রহস্যের ভারী ছায়া তার হৃদয়ের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছিল, যেন একদিন সেই ছায়াই তাকে আবার পথ দেখাতে ডাক দেবে।

__

1000059260.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *