Bangla - ভূতের গল্প

হাতিয়ার টুং টুং শব্দ

Spread the love

প্রনব কুমার সিনহা


এক

কলকাতার এক ব্যস্ত সন্ধ্যায়, শহরের কোলাহলের ভেতর থেকে অর্ণব সেনের মনটা যেন ছুটে যাচ্ছিল অন্য এক জগতে। তিনি পেশায় সাংবাদিক, কিন্তু নেহাত সংবাদ সংগ্রহ নয়, অর্ণবের আলাদা দুর্বলতা ছিল ইতিহাস ও লোককথার প্রতি। কলেজের সময় থেকেই তার অভ্যাস—শহরের পুরোনো ঘাট, অজানা গলি বা অচেনা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে অদ্ভুত গল্প শোনা। সেদিনও একে একে রাত নেমে আসছিল বাগবাজার ঘাটে, হাওয়ায় ভেসে আসছিল ভেজা কাদার গন্ধ আর গঙ্গার জলে তরঙ্গের গুঞ্জন। সেই সময়েই হঠাৎ তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক বৃদ্ধ নাবিকের, যার মুখে জড়ানো ছিল বহু বছরের লোনা জলের স্মৃতি। ঝাপসা চোখ, মুখে সাদা দাড়ি, আর হাতের বাঁকানো লাঠি নিয়ে লোকটা বসেছিল নদীর ধারে। অর্ণবের চোখে কৌতূহল দেখে বৃদ্ধ হেসে উঠল, আর সেই হাসি যেন ছিল অনেক পুরোনো কাহিনির দরজা খোলার ইশারা।

বৃদ্ধ নাবিকের কণ্ঠ ছিল কর্কশ অথচ মায়াবী। সে জানাল সুন্দরবনের এক নির্জন দ্বীপের কথা—যেখানে রাত নামলেই শোনা যায় শিকল টানার টুং টুং শব্দ। কথাটা বলার সময় তার চোখ যেন অন্ধকার নদীর দিকে চলে গেল, যেন দেখছে বহু পুরোনো দৃশ্য। অর্ণব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “শিকল টানার আওয়াজ মানে? কিসের আওয়াজ?” বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “ওই দ্বীপে একসময় জলদস্যুদের ফাঁসি হয়েছিল। তারা ছিল ভয়ঙ্কর শাহজাহানের দল—যাদের নাম শুনলেই নাবিকেরা কেঁপে উঠত। ইংরেজরা ধরেছিল তাদের, আর গাছের ডালে শিকল দিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল। কিন্তু দেহ মাটিতে শোয়ানো হয়নি। সেই থেকে তাদের আত্মা আজও মুক্তি পায়নি। তাই সন্ধ্যা নামলেই শিকল টেনে তারা ঘোরে।” বৃদ্ধের কথায় যেন ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে লাগল, আর অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। অথচ ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত টানও অনুভব করল সে।

লোককথার এই অংশ শুনে অর্ণবের সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল তীব্র হলো। তার মনে হলো—এটা নিছক গল্প নয়, এর মধ্যে ইতিহাসও লুকিয়ে আছে। কলকাতার লাইব্রেরি আর আর্কাইভে বহুবার ঘেঁটে সে জানে ইংরেজ আমলে সুন্দরবনে জলদস্যুদের দমন করার জন্য বহু অভিযান চালানো হয়েছিল। শাহজাহানের নামটাও সে আগে পড়েছিল, কিন্তু তার মৃত্যু রহস্য নিয়ে খুব একটা বিস্তারিত তথ্য পায়নি। বৃদ্ধ নাবিকের কাহিনি যেন সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাথে একেবারে মিলে যাচ্ছে। অর্ণব ভাবতে লাগল—যদি সত্যিই দ্বীপে শিকল টানার আওয়াজ পাওয়া যায়, তবে সেটা প্রমাণ করতে পারলে কেবল এক অদ্ভুত কাহিনি নয়, ইতিহাসের এক গোপন অধ্যায়ও উন্মোচিত হবে। হয়তো সে একটি দারুণ প্রতিবেদন লিখতে পারবে, যা পাঠকের কাছে আলোড়ন তুলবে।

অর্ণবের চোখে তখন ঝলসে উঠছিল রহস্যের আগুন। সে বুঝল, আর দেরি করলে চলবে না। বৃদ্ধ নাবিককে আরও প্রশ্ন করতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল, কারণ লোকটা যেন চুপচাপ নদীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। তার ঠোঁট থেকে বেরোলো শুধু এক ফিসফিসানি—“সাবধান, ওখানে গেলে ফিরে আসা মুশকিল।” কিন্তু অর্ণব তখন আর থেমে থাকার মানুষ নয়। তার বুকের ভেতর জেগে উঠেছে এক অনির্বচনীয় আকর্ষণ, যা তাকে টেনে নিয়ে যাবে সুন্দরবনের সেই দ্বীপে। সে স্থির করল, যত বিপদই থাকুক, যতই কিংবদন্তি হোক না কেন—সে নিজের চোখে সত্যিটা দেখে আসবেই। এবং সেখানেই শুরু হবে এক ভৌতিক অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ।

দুই

অর্ণবের মনের ভেতর তখনো ঘুরছিল বৃদ্ধ নাবিকের কথাগুলো—শিকল টানার টুং টুং শব্দ, ফাঁসিতে ঝোলা জলদস্যুরা, আর সেই দ্বীপের অদৃশ্য অন্ধকার। সাংবাদিকসুলভ প্রবণতা তাকে ঠেলে দিল সুন্দরবনের দিকে যাওয়ার জন্য। প্রস্তুতি নিতে গিয়েই তার পরিচয় হলো নিধি মুখার্জির সঙ্গে। নিধি কলকাতার এক পরিবেশ গবেষক, বয়স প্রায় চৌত্রিশ। বহুদিন ধরে তিনি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বিপন্ন প্রজাতি নিয়ে কাজ করছেন। অর্ণব প্রথম দেখাতেই টের পেল, নিধি ভেতরে ভেতরে ভীষণ দৃঢ়চেতা, অথচ তার চোখে যেন সবসময় এক ধরনের কোমলতা লেগে থাকে। একটি সেমিনারে, যেখানে সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেখানেই তাদের আলাপ হয়। বিরতির সময় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণব নিধির সঙ্গে কথোপকথন শুরু করে এবং দ্রুত বুঝতে পারে—তাদের গন্তব্য আলাদা হলেও জায়গাটা একই: সুন্দরবন।

নিধি জানালেন তিনি মাঠপর্যায়ের জরিপে যাচ্ছেন—স্থানীয় প্রজাতির বাসস্থান কীভাবে সড়ক প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন। কিন্তু যখন অর্ণব তার উদ্দেশ্যের কথা খোলাখুলি বলল, নিধির চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। “অভিশপ্ত দ্বীপে যাচ্ছেন? সেখানে তো গ্রামের লোকজনও যেতে ভয় পায়!”—নিধির কণ্ঠে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে বাজল। অর্ণব হেসে বলল, “আমি ভয় পাই না, নিধি। ভয় যত বেশি, গল্পও তত গভীর। আমি শুধু জানতে চাই—ওই কিংবদন্তির ভেতরে ইতিহাস আছে কি না।” নিধি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “আপনার যুক্তি মানি, কিন্তু ওখানে অজানা বিপদ আছে। তবুও, আমরা দুজনই যেহেতু একই এলাকায় যাচ্ছি, একসাথে গেলে সুবিধা হবে।” এইভাবে এক অদ্ভুত সমঝোতায় তারা একসাথে যাত্রার পরিকল্পনা করল।

যাত্রার দিন ভোরবেলা তারা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চেপে বসে। গন্তব্য ক্যানিং, সেখান থেকে আবার লঞ্চে করে সুন্দরবনের দিকে যাওয়া। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অর্ণব দেখছিল সবুজ মাঠ, ছোট গ্রাম আর বিস্তৃত আকাশ। তার মনের ভেতরে ছিল এক ধরনের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা, যেন অজানা এক রহস্য তাকে ডাকছে। নিধি ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে কিছু লিখছিলেন, মাঝে মাঝে তিনি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে হেসে বলছিলেন, “আপনি তো শুধু ভূতের গল্প নিয়ে ভাবছেন, অথচ বাস্তবে পরিবেশের সমস্যাটাই ভয়ঙ্কর।” অর্ণব মুচকি হেসে উত্তর দিত, “ঠিক বলেছেন, তবে ভূতের গল্পও কিন্তু মানুষের ভেতরের ভয়কে প্রকাশ করে। আর ভয়ও তো পরিবেশের মতোই বাস্তব।” দুজনের কথোপকথনে ধীরে ধীরে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হতে লাগল, যেখানে নিধির বাস্তববোধ আর অর্ণবের রহস্য অনুসন্ধান মিলেমিশে এক অদ্ভুত সঙ্গীসুলভ অনুভূতি তৈরি করল।

ট্রেন থেকে নেমে তারা লঞ্চে উঠল। নদীর জল রুপালি হয়ে ঝিকমিক করছিল, দূরে কুয়াশায় ঢাকা সুন্দরবনের ঘন সবুজ ছায়া ভেসে উঠছিল। নদীর বুক চিরে লঞ্চ এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে নিধি জানালেন স্থানীয় লোকেদের নানা কথা—কোথায় বাঘ দেখা যায়, কোথায় ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অর্ণব সেসব মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার ভেতরে সবসময় ঘুরছিল সেই অদ্ভুত শব্দ—“টুং… টুং…”। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বাতাসের শব্দ যেন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল দ্বীপের রহস্যময় কিংবদন্তিকে। নিধি জানালেন, তিনি কখনো ওই দ্বীপে যাননি, কিন্তু বহুবার স্থানীয় মানুষদের মুখে শুনেছেন রাতের শব্দের কথা। অর্ণবের চোখে তখনো জ্বলছিল অনুসন্ধানের আগুন, আর নিধির চোখে ভেসে উঠছিল এক অদৃশ্য আশঙ্কা। তারা দুজনই জানত না—এই যাত্রা শুধু গবেষণা বা রিপোর্টের জন্য নয়, বরং তাদের জীবনের দিকচিহ্নও পাল্টে দেবে, কারণ অভিশপ্ত দ্বীপের পথে তারা এগিয়ে চলেছে এক অদ্ভুত অজানার দিকে।

তিন

ক্যানিং থেকে যাত্রার পর দিন গড়াতেই অর্ণব ও নিধি পৌঁছে গেল নদীর ঘাটে। সেখানেই তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো করিম শেখের। বয়স প্রায় পঞ্চাশ, কিন্তু চেহারায় ক্লান্তি ও অভিজ্ঞতার রেখা স্পষ্ট। তার চোখের ভেতর ছিল গভীর অন্ধকার, যেন নদীর জল বহু রহস্য বয়ে এনেছে তার জীবনে। লম্বা ধুতি আর মলিন গামছা কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ছোট্ট কাঠের নৌকায়। অর্ণব তাকে ভাড়া করতে চাইলে করিম প্রথমেই কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কোন দ্বীপে যাবেন বাবু?” অর্ণব যখন সেই অভিশপ্ত দ্বীপের নাম বলল, করিম যেন হঠাৎ চুপ করে গেল। তার ঠোঁট শুকিয়ে এল, চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো। নিধি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল করিমের শরীর কেঁপে উঠছে, যেন নামটা উচ্চারণ করা মাত্রই কোনো অশুভ স্মৃতি তার ভেতরে জেগে উঠল।

অবশেষে করিম নৌকা চালাতে রাজি হলো, কিন্তু শর্ত দিল স্পষ্ট ভাষায়—“বাবু, শোনেন, ওই দ্বীপে যেতে হলে দিন থাকতেই ফিরতে হবে। সূর্য ডোবার আগেই পাড়ি দেবেন। রাত হলে আর বাঁচার আশা করবেন না।” অর্ণব একরকম হেসেই উড়িয়ে দিল। সে বলল, “করিম ভাই, এ সব লোককথা। আমি সাংবাদিক, এসব কাহিনি শুনতে আসিনি—সত্যিটা খুঁজতে এসেছি।” করিম গম্ভীর গলায় জবাব দিল, “আপনারা শহরের মানুষ, ভূত-প্রেত মানেন না। কিন্তু আমি জন্ম থেকেই এ জলে আছি। আমি দেখেছি, শুনেছি। কত মাঝি, কত মানুষ গেছে আর ফেরেনি। রাতের অন্ধকারে শিকলের টুংটাং আওয়াজ শুনে উধাও হয়ে গেছে তারা। আমি শপথ করে বলছি, বাবু, ওখানে রাত কাটানো মানেই মৃত্যুর দাওয়াত।” নিধির বুকের ভেতর কেমন একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল। তার চোখে ভেসে উঠল উদ্বেগ। সে চুপচাপ অর্ণবকে দেখছিল, আর ভাবছিল—অর্ণব যদি সত্যিই করিমের কথা না মানে, তবে কী ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে।

নৌকাটি ধীরে ধীরে নদীর বুক চিরে এগোতে লাগল। চারদিকের বাতাসে লবণাক্ত কাদা আর ম্যানগ্রোভের গন্ধ। গাঙচিল ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে, দূরে ঘন অরণ্যের ছায়া। করিম নৌকার বৈঠা চালাতে চালাতেই বারবার পিছনে ফিরে সতর্ক করছিল, “বাবু, মনে রাখবেন, সন্ধ্যা নামলেই নদীর রূপ বদলে যায়। তখন নদীর বুকেও ভূতের ছায়া খেলে বেড়ায়। দ্বীপে নামবেন, দেখতে চাইলে দেখবেন, কিন্তু আলো ম্লান হওয়ার আগেই আমাকে ডাকবেন। আমি দেরি করলে আপনাদের ফিরতে হবে না।” অর্ণব তখনও হাসছিল, তার চোখে ছিল রোমাঞ্চের ঝিলিক। সে বলল, “করিম ভাই, আপনি ভয় পাচ্ছেন, বুঝি। কিন্তু আমরাই প্রমাণ করব—সবই কুসংস্কার।” করিম তার দিকে তাকাল না, শুধু আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল, “মানুষের দম্ভই তাকে সর্বনাশে ঠেলে দেয়।” নিধি এবার সত্যিই অস্বস্তি অনুভব করল। তার মনে হলো—এই যাত্রা কেবল গবেষণা বা অনুসন্ধান নয়, এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা তারা কেউই পুরোপুরি বুঝতে পারছে না।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দূরে দেখা দিল সেই দ্বীপ। সারা দ্বীপটা যেন এক অচেনা নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। চারদিকে ঘন সবুজ, মাঝে মাঝে কুয়াশা ভেসে উঠছে নদীর বুক থেকে। অর্ণবের চোখে তখনও উচ্ছ্বাস, কিন্তু নিধির মনে শীতল আতঙ্ক ঘিরে বসছে। করিম বৈঠা থামিয়ে আঙুল তুলে দেখাল, “ওই যে, বাবু, আপনারা যেখানে নামবেন। মনে রাখবেন, আলো ডোবার আগেই আমার কাছে ফিরে আসবেন।” অর্ণব আবারও মুচকি হেসে বলল, “চিন্তা করবেন না, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরব।” কিন্তু করিমের চোখে ভয়ের ছাপ আরও গাঢ় হয়ে উঠল। যেন তার সমস্ত অভিজ্ঞতা আর আতঙ্ক জমাট বেঁধে এসেছে সেই সতর্কবাণীতে—“রাত নামার আগে দ্বীপ ছেড়ে যাবেন।” নিধি চুপচাপ নদীর বাতাসে শিউরে উঠল, আর অর্ণব নীরবে সিদ্ধান্ত নিল—সত্যিই রাত হলেও সে থেকে যাবে, কারণ ভয়কে জয় না করলে রহস্যকে ধরা যায় না।

চার

দ্বীপের পাড়ে পা রাখতেই অর্ণব ও নিধির মনে হলো যেন তারা অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে। করিম মাঝি তখনও নৌকা ধরে বসে আছে, চোখে ভয়ের ছাপ, কিন্তু অর্ণব তাকে হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে বলল—“আমরা বেশিক্ষণ থাকব না।” নৌকা থেকে নামতেই চারপাশের নিস্তব্ধতা তাদের চেপে ধরল। দ্বীপজুড়ে এক অদ্ভুত অন্ধকার যেন সবকিছু গিলে নিয়েছে। চারদিকে ঘন ম্যানগ্রোভ গাছ, শেকড়গুলো কুৎসিত সাপের মতো নদীর জলে ছড়িয়ে আছে। ভেজা বাতাসে কাদা আর শ্যাওলার গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। নিধি লক্ষ্য করল, গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে শুকনো দড়ি ঝুলে আছে, যেন অতীতের শিকলগুলো এখনো দ্বীপকে আঁকড়ে রেখেছে। কোথাও কোথাও ভাঙা ইটের দেয়াল উঠে এসেছে গাছপালার আড়াল থেকে, হয়তো কোনো পুরোনো ফাঁসির কাঠামোর ভগ্নাবশেষ। অর্ণবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এই দৃশ্য দেখে—ঠিক যেমনটি সে শুনেছিল, ঠিক তেমনই বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে কিংবদন্তি।

তারা ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করল। মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মরচে ধরা লোহার টুকরো আর ভারী শিকল, যেগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি এগুলো ছড়িয়ে রেখেছে। নিধি এগুলো দেখে হঠাৎ কেঁপে উঠল। সে অর্ণবকে বলল, “দেখছেন? এই শিকলগুলো হয়তো সেই ফাঁসিরই চিহ্ন, যেগুলো দিয়ে জলদস্যুদের ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।” অর্ণব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, তারপর মোবাইলের আলো ফেলে জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার চোখে ভয় নেই, বরং অদম্য অনুসন্ধিৎসা। নিধি যদিও ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে পড়ছিল, তবুও কৌতূহল তাকে ধরে রাখল অর্ণবের পাশে। তারা দুজনেই অনুভব করছিল—এখানে সময় যেন থেমে গেছে, আর প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ইট ইতিহাসের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে।

সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করল। করিম মাঝির সতর্কবাণী তখন নিধির কানে বাজছিল—“রাত নামার আগেই দ্বীপ ছেড়ে যাবেন।” কিন্তু অর্ণব অন্যরকম দৃঢ়তায় বলল, “আমরা আজ রাতে এখানেই থাকব। এই রহস্যের উত্তর কেবল অন্ধকার নামার পরই পাওয়া যাবে।” নিধি প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেল। চারপাশে যখন অদ্ভুত সন্নाटा, তখন রাত কাটানো যে ভয়ঙ্কর হবে, সেটা তার মনে হচ্ছিল প্রবলভাবে। তবু অর্ণবের দৃঢ়তা তাকে আর না বলতে দিল না। দুজনে মিলে জঙ্গলের ভেতরে একটু খোলা জায়গায় থামল। সেখানে ভাঙা ইটের দেওয়ালের পাশে তারা বসে পড়ল। অর্ণব ব্যাগ থেকে টর্চ আর ক্যামেরা বের করল, নিধি নোটবুক হাতে নিল। নিধি শীতল কণ্ঠে বলল, “আমি জানি না আমরা ঠিক করছি কি না, কিন্তু মনে হচ্ছে আজকের রাত আমাদের জীবন পাল্টে দিতে পারে।” অর্ণব হেসে উত্তর দিল, “সেটাই তো চাই।”

রাত নামতেই দ্বীপের রূপ বদলে গেল। দূরের আকাশে চাঁদের আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে আলো ঢুকতে পারছিল না। গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে অদ্ভুত আকার নিচ্ছিল, বাতাসে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে এল সেই শব্দ—“টুং… টুং…”। যেন ভারী কোনো শিকল ধীরে ধীরে টানা হচ্ছে, একবার থেমে আবার শুরু হচ্ছে। নিধি আতঙ্কে কেঁপে উঠল, তার হাত অজান্তেই অর্ণবের হাতে চলে গেল। অর্ণব শ্বাস রুদ্ধ করে চারপাশে কান পেতে রইল। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কারণ সে জানত এই শব্দই সেই কিংবদন্তির প্রাণ। নিধির কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “অর্ণব… এটা কি সত্যি? কেউ কি এখানে আছে?” অর্ণব ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, এটাই সেই শিকলের ডাক।” দুজনেই তখন বুঝল—আজকের রাত আর পাঁচটা রাতের মতো নয়। এই দ্বীপে কিছু আছে, যা এখন তাদের সামনে আসতে শুরু করেছে।

পাঁচ

দ্বীপের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে অর্ণব ও নিধি হঠাৎ লক্ষ্য করল, জঙ্গলের গভীরে কুয়াশার আড়ালে একটি কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, তবুও ঘরটিতে জ্বলা ক্ষীণ আলো যেন প্রমাণ দিচ্ছিল—এখানে কেউ বাস করে। নিধি প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেল, কিন্তু অর্ণব দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কাঠের দরজায় টোকা দিতেই ভিতর থেকে ভাঙা গলার শব্দ ভেসে এলো, “কে ওখানে?” দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল এক শুকনো কাঠির মতো বৃদ্ধা নারী। চুল সাদা, চোখে কালি জমাট, তবুও তার দৃষ্টিতে ছিল ভয় আর ইতিহাসের ভার। তার নাম হালিমা। আশ্চর্যের বিষয়, এই নির্জন দ্বীপে সে একাই বেঁচে আছে। নিধি বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলল, “এখানে মানুষও থাকে?” হালিমা কেঁপে ওঠা গলায় উত্তর দিল, “আমি থাকি… আমি একা।”

ঘরের ভেতরে ঢুকে তারা চারপাশে তাকিয়ে দেখল পুরোনো লণ্ঠন, জীর্ণ কাপড় আর কয়েকটা মাটির হাঁড়ি। ঘরের বাতাসে ধোঁয়া আর ভেজা কাঠের গন্ধ ছড়িয়ে ছিল। হালিমা বসতে বলল, তারপর ধীরে ধীরে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা বাইরের মানুষ, কিন্তু কেন এসেছ এখানে? জানো না এই দ্বীপে যারা আসে, তাদের ভাগ্য আর আগের মতো থাকে না?” অর্ণব নির্ভীক কণ্ঠে বলল, “আমরা সত্য খুঁজতে এসেছি। শুনেছি এখানে রাতে শিকলের শব্দ শোনা যায়। আপনি তো এখানে থাকেন, নিশ্চয়ই জানেন এর রহস্য।” হালিমার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল—হাসি, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল গভীর যন্ত্রণা। সে বলল, “রহস্য নয়, বাবু, এটা অভিশাপ। আমি তার সাক্ষী।” নিধি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি সাক্ষী মানে?”

হালিমার চোখ জ্বলে উঠল, আর সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল, “আমার দাদার দাদা ছিল সেই জলদস্যু শাহজাহানের দলে। যখন তারা ধরা পড়ে, তখন এই দ্বীপেই গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে। একে একে সব পুরুষ ফাঁসিতে ঝুলল, আর তাদের স্ত্রীরা, সন্তানরা চিৎকার করতে করতে অশ্রু ফেলে বিলাপ করল। আমি তখনো জন্মাইনি, কিন্তু আমার ঠাকুরমা সব দেখেছিল। সে আমাকে বলত—রাত নামলে সেই ঝুলন্ত দেহগুলো নড়ে উঠত, আর শিকল টেনে টেনে ডাকত মুক্তির জন্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবার এই দ্বীপের সঙ্গে বাঁধা রয়ে গেছে। আমিই আজ শেষ জীবিত সাক্ষী। আমি শুনেছি, আমি দেখেছি। ওরা মুক্তি চায়… কিন্তু কেউ ওদের মুক্তি দিতে পারছে না।” তার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল, চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিধির শরীর কাঁপতে লাগল এই কাহিনি শুনে, আর অর্ণব হতভম্ব হয়ে বসে রইল।

ঘরের বাইরে তখন বাতাস গর্জন করে উঠছিল, যেন হালিমার বলা প্রতিটি শব্দ প্রকৃতির বুকেও কাঁপন তুলছে। হালিমা আবার ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “রাত হলে তাদের ডাক শোনা যাবে। তারা শুধু শিকল নয়, বরং মানুষের আত্মাকেও টেনে নিতে পারে। আমি থেকেছি, কারণ আমি ওদের বংশের রক্ত। ওরা আমাকে আঘাত করে না। কিন্তু তোমাদের… তোমাদের ওরা ছাড়বে না।” নিধির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে অর্ণবের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে কি এর কোনো শেষ নেই? মুক্তি দেওয়ার উপায়ও নেই?” হালিমা মাথা নাড়ল, তার কণ্ঠে অসহায়তার কান্না, “উপায় আছে হয়তো, কিন্তু কেউ তা জানে না। যতদিন না কেউ ওদের অভিশাপ ভাঙতে পারে, ততদিন এই দ্বীপ থেকে শিকলের শব্দ থামবে না।” ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আর অর্ণব ও নিধি দুজনেই বুঝল—তারা এখন এমন এক কাহিনির অংশ হয়ে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ হবে না।

ছয়

হালিমার কণ্ঠ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি শব্দের সঙ্গে তার বুকে জমে থাকা ইতিহাসের ভার বেরিয়ে আসছিল। মাটির দেওয়ালে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো কাঁপছিল, আর তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল এক ভৌতিক সময়ের স্মৃতি। সে বলতে শুরু করল—“শাহজাহান শুধু নামেই জলদস্যু ছিল না, সে ছিল সমুদ্রের ঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর। তার দল লুণ্ঠন করত ব্যবসায়ীদের জাহাজ, হত্যা করত নিরীহ মাঝি আর জেলে। সুন্দরবনের নদীপথে তখন তার দাপট ছিল অপ্রতিরোধ্য। অনেকে বলত, তার হাতে অশরীরীর শক্তি আছে, নাহলে এতদিন ধরে কেউ তাকে ধরতে পারল কী করে? কিন্তু সময়ের কাছে কোনো দাপটই টেকে না। অবশেষে নবাবের ফৌজ তাকে আর তার দলকে ধরে ফেলে। তখন এই দ্বীপটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর মঞ্চ হিসেবে।” অর্ণব আর নিধি নিঃশ্বাস আটকে শুনছিল। মনে হচ্ছিল, হালিমার ভাঙা কণ্ঠের ভেতর দিয়েই ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে।

সে আরও বলল, “ফাঁসির আগে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল অমানবিকভাবে। একে একে সবাইকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল দিনরাত। ভারী লোহার শিকল মাংসে খোঁচা দিত, রক্ত গড়িয়ে পড়ত, অথচ তাদের ছাড়া হতো না। দিনের পর দিন ওই যন্ত্রণায় তারা মরার মতো বেঁচে থাকত। শেষমেশ গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাদের সবাইকে। বাতাসে তখন দুলছিল শুধু দেহ নয়, শিকলের শব্দও। সেই টুং টুং আওয়াজই থেকে গেছে এই দ্বীপে।” হালিমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। নিধি গলা শুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “মানে সেই শব্দই আমরা শুনছি?” বৃদ্ধা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “হ্যাঁ, ওরা মরেনি… ওরা এখনো এখানে আছে। শিকলই তাদের শরীর, শিকলই তাদের অভিশাপ।”

অর্ণব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, আর তার মস্তিষ্কে তখন চলছিল ইতিহাসের টুকরো টুকরো হিসাব মেলানোর চেষ্টা। কলকাতার আর্কাইভে পড়া পুরোনো দলিলের কথা মনে পড়ল তার। সেখানে উল্লেখ ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে সুন্দরবনের এক দ্বীপে জলদস্যুদের গণফাঁসি হয়েছিল। যদিও নির্দিষ্ট কোনো নাম পাওয়া যায়নি, কিন্তু ঘটনার মিল অস্বীকার করা যায় না। অর্ণব বুঝতে পারল, হালিমার গল্প শুধুই লোককথা নয়, বরং ইতিহাসের শিকড়ে বাঁধা। সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে নিধিকে বলল, “দেখছ? সব মিলছে! এ শুধু ভূতের গল্প নয়, এটা আসল ঘটনা।” নিধি ভীত হলেও মনের ভেতর একটা অদ্ভুত টান অনুভব করল। তার মনে হলো, হয়তো এই গবেষণাই তাকে এখানে টেনে এনেছে।

কিন্তু হালিমা তখন গম্ভীর হয়ে ফিসফিস করে বলল, “ইতিহাসের সঙ্গে মিল খুঁজছ, তা ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখো, ইতিহাস কেবল অতীত নয়, সে বর্তমানেও বেঁচে থাকে। ওরা এখনো মুক্তি পায়নি। তুমি যতই প্রমাণ খুঁজো, এই দ্বীপে তোমাদের রক্ষা হবে না।” বাইরে হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা এসে দরজায় ধাক্কা মারল। কুঁড়েঘরের ভেতর টিমটিমে আলো দুলে উঠল। নিধি কেঁপে উঠল আর অর্ণব নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গেল, যেন অতীতের ছায়া এসে তাদের ঘিরে ধরেছে। ইতিহাসের রহস্য মেলাতে গিয়েই তারা এখন এমন এক অন্ধকার শক্তির মুখোমুখি, যাকে শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

সাত

রাত নামতেই দ্বীপের চারপাশ যেন এক অদৃশ্য অন্ধকারের জালে আটকে গেল। চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, আর জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাক। অর্ণব, নিধি আর করিম মাঝি কুঁড়েঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—আজ রাতেই সত্যিটা সামনে আনবে। অর্ণব ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত, নিধির চোখে ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে অদ্ভুত এক ছায়া। করিম মাঝি বারবার বলছিল, “বাবু, আমি বলেছিলাম তো! রাত হলে এই দ্বীপে থাকা ভালো না।” কিন্তু অর্ণব জেদি ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আজ কিছু না হলে কাল হয়তো আর কোনো প্রমাণ পাব না। আমি এটা ক্যামেরায় ধরতেই হবে।”

অল্প কিছুক্ষণ পরেই চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে এল। প্রথমে হালকা একটা ধাতব শব্দ ভেসে আসল—টুং… টুং… যেন দূরে কোথাও লোহার শিকল মাটিতে ঠেকে প্রতিধ্বনি তৈরি করছে। নিধি আতঙ্কে অর্ণবের হাত চেপে ধরল, আর করিম ভয়ে প্রার্থনার মতো করে কুরআনের আয়াত পড়তে শুরু করল। শব্দটা ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগল। হঠাৎ করেই তারা দেখল, বিশাল একটা গাছের নিচে মাটির উপর দিয়ে কিছু শিকল টেনে চলেছে, অথচ সেখানে কোনো শরীর নেই। শুধু অদৃশ্য পায়ের চাপের মতো দাগ পড়ছে মাটিতে, আর সেই শিকলগুলো যেন নিজে নিজেই নড়ে উঠছে। চারদিকের বাতাসে তখন হাহাকার ভেসে বেড়াচ্ছে—শুকনো পাতার মতো কণ্ঠস্বর, যেন শত শত মানুষ একসাথে আর্তনাদ করছে।

নিধির শরীর কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল, “ওরা… সত্যিই আছে।” করিম তখন আর স্থির থাকতে পারল না, চিৎকার করে উঠল, “না, আমি থাকব না! আমি এখনই চলে যাচ্ছি।” সে দৌড় দিয়ে নৌকার দিকে যেতে চাইছিল, কিন্তু অর্ণব তাকে থামিয়ে দিল। অর্ণবের চোখে তখন কেবল একটাই তৃষ্ণা—এই অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ ধরে রাখা। সে ক্যামেরা অন করে ভিডিও রেকর্ড করতে লাগল। শিকলের শব্দ, বাতাসের গর্জন, আর গাছের নিচে অদৃশ্য পায়ের চলাচল স্পষ্টভাবে ক্যামেরায় ফুটে উঠতে শুরু করল। তার শ্বাস দ্রুত হয়ে আসছিল, তবুও সে হাত কাঁপতে দিচ্ছিল না। নিধি বারবার অনুরোধ করছিল, “অর্ণব, থামো! এটা আমাদের পক্ষে নয়।” কিন্তু অর্ণব যেন এক অদম্য শক্তির টানে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছিল।

একসময় দৃশ্যটা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। গাছের ডালগুলো অদৃশ্য শক্তিতে কাঁপতে শুরু করল, আর হাহাকার যেন কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। শিকলের ফাঁকে ফাঁকে তখন জ্বলজ্বল করে উঠছিল আগুনের মতো লাল আভা, যেন অশান্ত আত্মারা ক্রোধে ফেটে পড়ছে। করিম দৌড়ে নৌকার দিকে ছুটল, নিধি কান্নাজড়িত গলায় অর্ণবকে টেনে ধরল, কিন্তু অর্ণব এক মুহূর্তও থামল না। সে ক্যামেরার লেন্স গাছের দিকে তাক করল, আর হঠাৎ মনে হলো, লেন্সের ভেতর দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে এক অর্ধেক দৃশ্য—গলায় ফাঁস দেওয়া জলদস্যুরা বাতাসে ঝুলছে, আর তাদের শিকল গাছের শেকড়ে বাঁধা। নিধি হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠল, “চলো এখান থেকে!” অথচ অর্ণবের ঠোঁটে শুধু এক ফিসফিসানি—“আমি সব রেকর্ড করেছি।” সেই মুহূর্তে তারা বুঝল, দ্বীপের ইতিহাস কেবল শোনা কাহিনি নয়, বরং এখনো জীবন্ত ভয়াল বাস্তবতা।

আট

সত্যের দ্বারপ্রান্তে, গল্পের সবচেয়ে অন্তর্মুখী এবং রহস্যময় অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাত গভীর, নিধি স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করে। সে দেখেছিল এক বিশাল কেল্লার ভিতরে শাহজাহান দাঁড়িয়ে আছেন, তার চোখে অদ্ভুত বিষণ্ণতা এবং মায়া-মিশ্রিত আকুতি। শাহজাহান নিধির দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে, “আমাদের মুক্ত করো।” নিধির হৃদয়টা দ্রুত নড়েচড়ে ওঠে—এ যেন অতীতের নীরব কান্না যা আজও পৃথিবীর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। সে বুঝতে পারে, এটা শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন নয়, বরং ইতিহাসের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যের আভাস। নিধি অজান্তে কাঁপতে থাকে, কারণ স্বপ্নটি যেন তাকে বলে দিচ্ছে যে ইতিহাসের অবহেলিত পাতা এখনও তার ডাক শোনাচ্ছে।

অর্ণব, নিধির স্বপ্নের সেই গভীর প্রভাব থেকে প্রেরণা পেয়ে, শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে যায়। সেখানে সে একাধিক ইতিহাসের নথি খুঁজে পায়, যেখানে বিস্তারিতভাবে লেখা আছে কীভাবে ইংরেজ শাসকরা জলদস্যুদের দাফন না করে, তাদের খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখত। অর্ণবের চোখে অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের ছাপ দেখা যায়—তথ্যগুলো এতই নৃশংস এবং হৃদয়বিদারক যে তার মনের গভীরাংশে দাগ কাটে। সে বুঝতে পারে, যে গল্পগুলি ইতিহাসের বইগুলোতে বড়সড় অক্ষরে লেখা নেই, সেগুলিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সত্যিকার। অর্ণব ভাবতে থাকে, কতো মানুষের মৃত্যু ইতিহাসে শুধুই সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, অথচ তাদের আত্মারা আজও মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে।

হালিমা অর্ণবের হাতে সেই নথিগুলি দেখে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকে। সে জানায়, এই জলদস্যুদের আত্মা এখনও সেই দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়, কারণ তাদের মরার পরও শান্তি পায়নি। তাদের আত্মা চিৎকার করে না, তারা চুপচাপ পথিকের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে থাকে, যারা সত্য জানার ইচ্ছা রাখে। হালিমার কথায় অর্ণব এবং নিধি এক অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব উপলব্ধি করে। তারা বুঝতে পারে, এই দ্বীপ শুধুমাত্র ভূগোলের জন্য নয়, বরং অতীতের নিঃস্ব ইতিহাস ও অনুরণনের জন্যও এক বৃহৎ স্মৃতিস্তম্ভ। নথিগুলি যতই ভয়ানক হোক না কেন, এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া তাদের জন্য একধরনের মুক্তির পথ খুলে দেয়।

অধ্যায়টি শেষ হয় নিধি এবং অর্ণবের এক অদ্ভুত সংকল্পের দৃশ্যে। তারা ঠিক করে, এই ইতিহাসের স্রোতকে তাদের কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে আনা হবে। নিধি স্বপ্নে দেখা শাহজাহানের অশ্রুত আহ্বান যেন তাদের মনকে দৃঢ় করে। তারা বোঝে, শুধুমাত্র সত্য জানালেই তাদের আত্মারা শান্তি পাবে। এই অধ্যায়ে ইতিহাস, অতীতের ক্ষত, এবং মানুষের কণ্ঠহীন কষ্ট একত্রিত হয়ে একটি বড় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়—যা স্বাধীনতা, স্মৃতি, এবং ন্যায়বিচারের প্রতিফলন। এখানে পাঠকরা অনুভব করে যে, সাহসী মন এবং সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাসই ইতিহাসকে পুনর্লিখনের একমাত্র পথ।

নয়

মুক্তির আচার, গল্পের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং নাটকীয় অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। হালিমা অর্ণব ও নিধিকে জানায়, ইতিহাসের বেদনার ভর করে থাকা আত্মাদের শান্তি দেওয়ার জন্য একটি প্রতীকী অনুষ্ঠান অপরিহার্য। তাকে মাটিতে শিকল পুঁতে জলাশয়ের পাশে প্রদীপ জ্বালাতে হবে, আর সেই কার্যক্রমের মাধ্যমে অতীতের অশান্ত আত্মারা মুক্তি পাবে। নিধি ও অর্ণব এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বুঝে একত্রিত হয়, তাদের চোখে অদ্ভুত এক সংকল্পের দীপ্তি। করিম ভয়ের কাছে প্রায় অচল, কিন্তু বন্ধুদের সাহস দেখে সে নিজের ভয়কে বশে নিয়ে সাহায্য করতে চায়। তারা সবাই জ্ঞান করে যে, এটি কেবল একটি আধ্যাত্মিক কার্যক্রম নয়, বরং অতীতের অত্যাচার ও অবহেলিত ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের এক পথ।

অর্ণব, নিধি, এবং করিম সতর্কভাবে শিকলটি মাটিতে পুঁতে রাখে। বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে আসে, যেন প্রকৃতিই তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। নিধি প্রদীপ জ্বালায়, এবং আগুনের নরম আলো জলাশয়ের ধারে ছড়িয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে অদ্ভুত শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা চারপাশকে জড়িয়ে ধরে। অর্ণবের হৃদয় দ্রুত ধকধক করতে থাকে; সে বুঝতে পারে যে, প্রতিটি ছোটো পদক্ষেপ তাদের কাজের সাফল্য এবং ইতিহাসের প্রতি ন্যায়বিচারের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। করিমের কাঁপা হাতেও অদ্ভুত এক ধ্রুবক সাহস জন্ম নেয়, কারণ সে অনুভব করে—এখানেই মুক্তির মূল চাবিকাঠি লুকানো।

শিকল পুঁতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ প্রবল ঝড় উঠে যায়। বাতাসে বিদ্যুতের মতো শক্তি ছড়িয়ে পড়ে, এবং চারপাশে আওয়াজ গর্জন করতে থাকে। অর্ণব ও নিধি স্থির থাকতে চেষ্টার সঙ্গে ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়ে, আর করিম যেন ভয় ও বিস্ময়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। তবে, ঝড়ের তীব্রতা তাদের হাল ছেড়ে দেয় না—বরং এটি প্রতীকী প্রক্রিয়ার পূর্ণতা বোঝায়। হালিমা জানায়, এই প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়াই সেই শক্তির প্রকাশ, যা দীর্ঘদিন ধরে শিকলবন্দী আত্মাদের মধ্যে বন্দী ছিল। বাতাসের সঙ্গে প্রতিটি স্ল্যাশ, প্রতিটি গর্জন যেন অতীতের চিৎকারকে মুক্তির দিকে ঠেলে দেয়।

অধ্যায়ের সমাপ্তি হয় মুক্তির একটি অনন্য অনুভূতির দৃশ্যে। ঝড় থেমে গেলে, চারপাশে শান্তি নেমে আসে, এবং জলাশয়ের ধারে প্রদীপের আলো অনন্য এক উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। অর্ণব, নিধি, এবং করিম একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, তারা শুধু একটি আধ্যাত্মিক কাজ সম্পন্ন করেনি, বরং ইতিহাসের কণ্ঠহীন চিৎকারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে মুক্ত করেছে। হালিমার চোখে আনন্দের চিহ্ন দেখা যায়, কারণ এই আচারটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ায় অতীতের আত্মারা অবশেষে শান্তিতে বিশ্রাম নেবে। এই অধ্যায় পাঠককে শেখায় যে, সাহস, বিশ্বাস, এবং একটি ছোট প্রতীকী কার্যক্রমই কখনও কখনও ইতিহাসের সঠিক সমাধান আনতে পারে।

দশ

 টুং টুং শব্দের অবসান, গল্পের চূড়ান্ত মোড় এবং মুক্তির অমোঘ অনুভূতির প্রতিফলন। রাত গভীর, দ্বীপে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে। অর্ণব, নিধি এবং করিম শেষ প্রদীপটি জ্বালায়, আর আগুনের নরম আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ টুং টুং শব্দ থেমে যায়—যা এতদিন দ্বীপের অতীতের কণ্ঠশব্দের মতো প্রতিধ্বনিত হতো। নিধি এবং অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে থমকে থাকে, যেন এই নিস্তব্ধতাই তাদের কঠিন পথচলার পুরস্কার। বাতাসও হঠাৎ নরম হয়ে আসে, যেন প্রকৃতিই জানিয়ে দিচ্ছে—যে বন্দী আত্মারা মুক্তি পেয়েছে।

দূরে, জলাশয়ের ধারে শিকল টেনে নিয়ে যাওয়া দলটি ক্রমে ম্লান হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। অর্ণবকে মনে হয়, তাদের অস্তিত্ব কেবল ইতিহাসের একটি ছায়া ছিল, যা এখন চিরতরে শান্তির দিকে চলে গেছে। করিম এখনও কিছুটা কাঁপছে, কিন্তু সে উপলব্ধি করে যে ভয় তার স্থান ছেড়ে গেছে—এখন শুধু অবাক করা শান্তি এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা রয়ে গেছে। নিধি, চোখে অশ্রু নিয়ে, আকাশের দিকে তাকায়। সে জানে, তাদের এই ছোট উদ্যোগই দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত আত্মাদের মুক্তি এনে দিয়েছে, যা কোনো সাধারণ মানুষ কখনো বুঝতে পারত না।

ভোরের আলো আস্তে আস্তে দ্বীপের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, এবং সবকিছু শান্ত হয়ে যায়। জলাশয়, গাছপালা, এবং ছোট পাহাড়গুলো যেন নতুন এক জীবন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যে রূপান্তরিত হয়। অর্ণব দেখেন, ইতিহাসের আঘাত এবং অতীতের কষ্টের ছায়া এখন শান্তির আলোয় মিলিয়ে গেছে। নিধি এবং করিমও এই শান্তি অনুভব করে, তাদের হৃদয় অদ্ভুত এক প্রশান্তি ও গর্বে ভরে যায়। তারা বুঝতে পারে, সত্যকে সম্মান এবং প্রতীকী আচারই যে অতীতের অতৃপ্ত আত্মাদের মুক্তির পথ।

অর্ণব তার নোটবুকে লিখে রাখে—“এ শুধু লোককথা নয়, ইতিহাসের সাথে জড়ানো মানুষের হাহাকার।” এই বাক্যটি শুধু গল্পের সারমর্ম নয়, বরং পাঠককে একটি গভীর বার্তা দেয়: অতীতের কষ্টকে ভুলে যাওয়া যায় না, কিন্তু সাহস, বিশ্বাস, এবং সচেতনতার মাধ্যমে তা চিরস্থায়ী শান্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। দ্বীপে যা ঘটেছে, তা ইতিহাস এবং লোককথার এক অনন্য মিলন, যা প্রমাণ করে যে মানুষের ছোট উদ্যোগও ইতিহাসকে মুক্তি দিতে পারে এবং চিরকাল ধরে মানুষের মনে প্রতিধ্বনিত হয়।

***

1000055097.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *