পাৰ্থ প্ৰতিম রায়
১
অরিন্দম চক্রবর্তী কলকাতার ভিড়ভাট্টা, কোলাহল আর অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন ছেড়ে এসেছিল এই প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে তাকে নতুন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কলেজের দিনগুলোতে তার স্বপ্ন ছিল একদিন শান্ত, নিরিবিলি কোনো জায়গায় পড়াশোনার মাধ্যমে মানুষ গড়ে তোলা। তবে শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, হট্টগোল আর অন্তহীন প্রতিযোগিতার ভেতর সে যেন নিজের ভেতরকার স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছিল। গ্রামে এসে প্রথম দিনেই যখন সে হেঁটে যাচ্ছিল ধুলোমাখা কাঁচা রাস্তা ধরে, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। দূরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, তালগাছের মাথায় ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো, আর একেবারে নিঃসঙ্গ সোনালি সন্ধ্যা—সবকিছু মিলিয়ে তাকে মনে হয়েছিল, সে যেন এক অন্য পৃথিবীতে পা রেখেছে। অথচ এই প্রশান্তির ভেতরও ছিল এক ধরনের চাপা অস্বস্তি, যেন হাওয়ায় লুকিয়ে আছে অতীতের অদৃশ্য গল্প। গ্রামের প্রাচীন বাড়িগুলো, যাদের অধিকাংশই অর্ধেক ভেঙে পড়া, চুনকাম খসে যাওয়া দেয়াল আর অন্ধকার জানলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ভেতরে ভেতরে কৌতূহলী করে তুলেছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই গ্রামে শুধু মানুষের জীবন নয়, সময়ও যেন থেমে গেছে এক জায়গায়, আর সেই থেমে থাকা সময়ের মধ্যে চাপা পড়ে আছে অনেক অজানা রহস্য।
স্কুলের জন্য নির্ধারিত কোয়ার্টারে পৌঁছে অরিন্দম বুঝল, জায়গাটা যতই নিস্তব্ধ হোক না কেন, রাতের নিস্তব্ধতায় এক অন্যরকম ভারী আবহাওয়া ভাসতে থাকে। কোয়ার্টারটি স্কুলের পেছনের দিকে, যেখানে আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই, শুধু কয়েকটা অন্ধকার গাছ আর দূরে পুরোনো এক ভাঙাচোরা জমিদারবাড়ি, যেটি গ্রামের মানুষ ‘কালোবাড়ি’ নামেই ডাকে। সে যখন প্রথম রাতের খাওয়া শেষ করে পড়ার টেবিলে বসেছিল, তখন জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল অদ্ভুত অন্ধকারে মোড়া সেই জমিদারবাড়িটি। চাঁদের আলোয় ভাঙা জানলাগুলির ফাঁকফোকর তাকে যেন এক অদৃশ্য দৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দিল। অরিন্দম যতই যুক্তিবাদী হোক, হঠাৎই তার মনে হলো, ওই ভাঙা জানলার ভেতরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল নিজের বোকামির জন্য, কিন্তু ঠিক তখনই ঠান্ডা হাওয়ার দমকা এসে পাশের জানলাটাকে টনটন করে কাঁপিয়ে তুলল। তার মনে হলো, হয়তো নিস্তব্ধতা আর অপরিচিত পরিবেশই তাকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল করে তুলছে। কিন্তু অবচেতনে একটা টান কাজ করতে লাগল, তার মন চাইল ওই কালোবাড়ির দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে সত্যিই বোঝা, সেখানে আদৌ কেউ আছে কি না।
রাত যত গভীর হতে লাগল, ততই চারপাশের নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে উঠল। গ্রামের কুকুরের ডাকে মাঝেমধ্যে শূন্যতা ভেঙে উঠলেও তা আরও ভয়ের আবহ তৈরি করছিল। অরিন্দম শুয়ে শুয়ে জানলার বাইরে তাকাচ্ছিল। দূরে কালোবাড়ির একটি জানলার কাচ ভেঙে গেছে, আর সেখান থেকে অদ্ভুতভাবে আলো পড়ছে বলে মনে হচ্ছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল এটা চাঁদের আলো, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে স্পষ্ট দেখল, ভাঙা জানলার ফাঁক দিয়ে একটি হাত বেরিয়ে আসছে। হাতটি ছিল অদ্ভুত শীর্ণ, কালচে রঙের, আর যেন কেবল বাতাসে ভেসে আছে। কোনো দেহ নেই, শুধু হাত, যেটা ধীরে ধীরে বাইরের দিকে নড়ছে—যেন কাউকে ডেকে আনছে। অরিন্দম প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার মনোযোগ দিয়ে তাকাল, কিন্তু হাতটা তখনও সেখানেই, অনবরত ইশারা করছে। তার শরীর কেঁপে উঠল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তবে কৌতূহল তার ভয়ের থেকেও বড় হয়ে উঠল। সে খেয়াল করল, হাতটি যেন তাকে ডাকছে, সরাসরি তার দিকে টানছে। এই হাত কি সত্যিই কোনো আত্মার ইঙ্গিত, নাকি নিছকই তার কল্পনা? অরিন্দম সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, তবে জানলার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা হাতের অদ্ভুত ছায়া তার ভেতরে এক অনির্বচনীয় টান তৈরি করেছিল।
অরিন্দমের জীবনের সেই প্রথম রাত ছিল অস্থিরতা আর অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় ভরা। সে জানত, গ্রামের গল্পে নানা কুসংস্কার মিশে থাকে, আর মানুষ এসব নিয়ে অকারণ ভীত হয়। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখল, তা নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। জানলার ফাঁক দিয়ে বেরোনো সেই হাত যেন তার মনের ভেতরে অচেনা এক দাগ কেটে দিল। পরদিন সকালে হয়তো এই দৃশ্যকে স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু অন্তরের গভীরে সে জানল—এটা নিছক স্বপ্ন নয়। সে অনুভব করছিল, অদৃশ্য এক শক্তি তাকে কাছে টানছে, এমন এক শক্তি যা তাকে এই গ্রামের নিস্তব্ধতায় আটকে ফেলবে। অরিন্দমের মনে হল, এই হাতই হয়তো তার জীবনের গতি বদলে দেবে—যেমনটা সে এখনো জানে না, তবে নিশ্চিতভাবেই তার নিয়তি আর আগের মতো থাকছে না। গ্রামের ভাঙাচোরা জানলার ফাঁক দিয়ে বেরোনো হাতটা তার জীবনের অজানা অধ্যায়ের সূচনা করে দিল, আর সেই হাতছানি থেকেই শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর অথচ অদ্ভুত যাত্রা।
২
সকালের আলোয় গ্রামটা শান্ত হলেও অরিন্দমের ভেতরে অশান্তির ঢেউ উঠছিল। সারারাত প্রায় ঘুম হয়নি তার, জানলার ফাঁক দিয়ে বেরোনো সেই হাতের দৃশ্যটা বারবার ফিরে আসছিল মনে। সকালে স্কুলে গিয়ে ক্লাস নিলেও পড়ানোর সময় সে লক্ষ্য করল, বারবার মন অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল, কারণ নতুন শিক্ষককে তারা কল্পনার চেয়েও বেশি গম্ভীর আর অস্থির পাচ্ছিল। দুপুরবেলায় যখন ক্লাস শেষ হয়ে এল, সে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের খেলা দেখতে লাগল। তখনই তার নজরে পড়ল, কয়েকজন শিশু স্কুলের মাঠের শেষ প্রান্তে হঠাৎ থেমে গেছে। তারা কিছুক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ভাঙাচোরা কালোবাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু তারপরেই একসঙ্গে চমকে উঠে পালিয়ে গেল। অরিন্দমের মনে হলো, এই গ্রাম আর এর মানুষরা যেন ওই বাড়ি সম্বন্ধে ভেতরে ভেতরে ভয় পায়। আর ঠিক তখনই স্কুলের সহকর্মী এক শিক্ষিকা—মৃণাল—তার কাছে এসে দাঁড়াল। বয়সে তার চেয়ে কিছুটা ছোট, কিন্তু চোখেমুখে ছিল বুদ্ধিমত্তা আর গভীর কৌতূহলের ছাপ। প্রথম আলাপেই মৃণালের ভেতরকার আত্মবিশ্বাস অরিন্দমকে আকর্ষণ করেছিল, আর আজ যেন তার কাছে প্রশ্ন করার সুযোগ চলে এসেছে।
মৃণাল প্রথমেই হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনার ঘুম হয়েছে তো গতকাল রাতে? শুনেছি এখানে নতুন যারা থাকে, তাদের প্রথম রাতটা কখনোই সহজ যায় না।” অরিন্দম হকচকিয়ে তার দিকে তাকাল। “তুমি এমনটা বলছ কেন?”—সে প্রশ্ন করল। মৃণাল একটু চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল, “কারণ এখানে একটা অভিশপ্ত জানলা আছে—যেটা এই গ্রামের সবাই চেনে, সবাই ভয় পায়। কালোবাড়ির ভাঙা জানলা থেকে যখন হাত বেরোয়, তখন গ্রামে কারো না কারো জীবনে বিপদ নেমে আসে। ছোটবেলায় আমি নিজে দেখেছি, এক দিদিমণি ওই জানলার কাছে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন। তারপর আর কখনো সুস্থ হতে পারেননি।” অরিন্দম শিউরে উঠল, কিন্তু নিজের যুক্তিবাদী মন তাকে থামাল। সে হেসে বলল, “এগুলো নিছক কুসংস্কার, মৃণাল। গ্রামে তো অনেক রকম গল্প ছড়িয়ে থাকে। হয়তো কাকতালীয়ভাবে কিছু ঘটনা ঘটেছে, তাই সবাই ভয় পায়।” মৃণাল তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “স্যার, আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমি জানি—ওই জানলা যে কারও ভাগ্য বদলে দেয়। শিশুদের তো ওদিকে খেলতে যেতেই নিষেধ আছে। আমাদের মধ্যে কেউ কাছে গেছে, আর সুস্থভাবে ফিরে এসেছে—এমন নজির নেই।” তার গলার দৃঢ়তা অরিন্দমকে থামিয়ে দিল।
দুজনের কথোপকথন দীর্ঘ হতে লাগল। মৃণাল তাকে জানাল, গ্রামের প্রবীণরা প্রায়শই বলেন—কালোবাড়ির ভেতরে এক নারীর অশান্ত আত্মা বন্দি হয়ে আছে। মৃত্যুর আগে সে নাকি শেষবার কারও হাত চেয়েছিল, মুক্তি চেয়েছিল, আর তাই আজও সেই হাত ভাঙা জানলার ফাঁক দিয়ে ডেকে যায়। অরিন্দম ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল, মৃণালের কথাগুলো নিছক গল্প নয়; তার নিজের দেখা অভিজ্ঞতার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছে। তবু সে নিজেকে বোঝাতে চাইছিল, হয়তো এটা শুধু তার মানসিক বিভ্রম। কিন্তু মৃণাল যখন একের পর এক ঘটনার উল্লেখ করতে লাগল—যেমন কিশোরী সুলেখা, যে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকার কয়েকদিন পরেই নিখোঁজ হয়েছিল; কিংবা রমেন, যিনি সাহস করে বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন, আর তারপর থেকে তিনি আর স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন না—তখন অরিন্দমের গা শিউরে উঠছিল। সে বুঝতে পারল, গ্রামের ভয় আসলে শুধু কথার গুজব নয়, বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া আতঙ্ক।
সন্ধ্যার দিকে যখন অরিন্দম একা কোয়ার্টারে ফিরছিল, মৃণালের বলা কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছিল অবিরাম। হাওয়া যেন আরও শীতল হয়ে উঠেছিল, গাছের ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছিল অদ্ভুত ছায়া তৈরি করে। দূরে কালোবাড়ির জানলা চাঁদের আলোয় ঝলসে উঠছিল, আর অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, সেই হাত আবারও ডাকছে। সে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব অনুভব করছিল—একদিকে যুক্তি বলে এগুলো সব কল্পনা, অন্যদিকে তার চোখ যা দেখেছিল তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর মৃণালের বলা গল্পগুলো যুক্তির জায়গাটাকে ভেঙে দিচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, এই হাতছানি শুধু অলৌকিক ঘটনার ইঙ্গিত নয়, বরং হয়তো তার নিজের জীবনের সঙ্গেও কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। অরিন্দমের বুকের ভেতর অচেনা এক টান জমে উঠছিল, আর সেই টানই হয়তো তাকে ঠেলে নিয়ে যাবে সেই জানলার আরও কাছে। গ্রামের মানুষ ভয় পায়, শিশুরা দূরে সরে যায়, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল—এই হাতছানির সঙ্গে তার অদ্ভুত এক যোগসূত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে আর সহজে মুক্তি নেই।
৩
গ্রামের মানুষজন যদিও কালোবাড়ির প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়, কিন্তু অরিন্দমের কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই চলছিল। কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ্য করল, স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধ বসে থাকেন—শুকনো চেহারা, কুঁচকানো মুখ, কাঁপা হাতে লাঠি আঁকড়ে থাকা এক নিঃসঙ্গ মানুষ। গ্রামের ছেলেরা তাকে ‘হরিবাবু’ বলে ডাকে, আর মৃণাল তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল—হরিপদ দত্ত, আশি ছুঁই ছুঁই বয়স, একসময় জমিদারবাড়ির চাকর ছিলেন। কথিত আছে, সেই বাড়ির ইতিহাস আর রহস্য তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। অরিন্দম একদিন সাহস সঞ্চয় করে তাঁর পাশে গিয়ে বসে পড়ল। প্রথমে হরিপদ চুপচাপ ধোঁয়া ওঠা বিড়ি টানছিলেন, তারপর হঠাৎ অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি তো নতুন শিক্ষক, তাই না? কালোবাড়িটা নিয়ে ভেবে চলেছেন?” অরিন্দম চমকে উঠল—কেউ তো তাকে কিছু বলেনি, তবে বৃদ্ধ বুঝলেন কীভাবে? বৃদ্ধের চোখ ছিল ঘোলা অথচ গভীর, যেন বহু গোপন স্মৃতি সেখানে জমে আছে।
হরিপদ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, এই গ্রামে জমিদার হরিদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন। তাঁর ছিল বিপুল ধনসম্পদ আর ক্ষমতা, কিন্তু সঙ্গে ছিল নিষ্ঠুরতা। তবে তাঁর একমাত্র কন্যা ছিল দেবলীনা—রূপে-গুণে অদ্বিতীয়া। গ্রামের সাধারণ এক যুবক, রমাকান্ত, তার প্রেমে পড়েছিল। প্রেমটা ছিল দু’পক্ষের, কিন্তু সমাজ মেনে নেয়নি। জমিদার মেয়েকে সাধারণ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন, এ কল্পনাই ছিল অসম্ভব।” অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। বৃদ্ধ থেমে বিড়িতে টান দিয়ে আবার বললেন, “এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয়, দুজন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জমিদারের লোকেরা ধরে ফেলে। রমাকান্তকে মেরে ফেলা হয় বাড়ির আঙিনাতেই, আর দেবলীনাকে বন্দি করা হয় সেই ঘরে—যার জানলা আজ ভাঙা পড়ে আছে। ক’দিন পর মেয়েটি রহস্যজনকভাবে মারা যায়। কেউ বলে, সে আত্মহত্যা করেছিল; কেউ বলে, তাকে খুন করা হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে নাকি বারবার হাত বাড়িয়ে বলেছিল—‘কেউ কি আমার হাতটা ধরবে?’ আর সেই হাতই আজও ভাঙা জানলা দিয়ে বেরোয়।”
অরিন্দমের গা শিউরে উঠছিল, কিন্তু হরিপদ তখনও গল্প চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, “দেবলীনাকে কখনো শান্তি দেওয়া হয়নি। তার আত্মা বন্দি হয়ে গেছে ওই ঘরে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, যেদিন সে মুক্তি পাবে, সেদিনই অভিশাপ ভাঙবে। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার জন্য দরকার এমন এক মানুষের হাত, যে নিঃস্বার্থভাবে তাকে গ্রহণ করবে। আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি, কেউ সাহসও করেনি। যে-ই কাছে গেছে, বিপর্যয় নেমে এসেছে। হয়তো মেয়েটির ব্যথা এতটাই তীব্র ছিল যে সে কাউকে নিজের যন্ত্রণায় টেনে নেয়।” হরিপদের গলা ধীরে ধীরে কাঁপছিল, যেন তিনি নিজেও বহুদিনের চাপা ভয় খুলে ফেলছিলেন। অরিন্দম অনুভব করছিল, এই বৃদ্ধ আসলে অনেক কিছু জানেন, কিন্তু পুরোটা বলতে চান না। কারণ, ইতিহাসের আড়ালে হয়তো এমন কিছু অন্ধকার গোপনীয়তা আছে যা জানলে গ্রাম কেঁপে উঠবে।
অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, কথার আড়ালে হরিপদ কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি কিছুটা রহস্য রেখে বললেন, “আপনি যেহেতু নতুন এসেছেন, তাই সাবধান করে দিলাম। ওই হাত যদি একবার আপনাকে ডাকে, সহজে আর রেহাই নেই। আমি সব জানি, কিন্তু সব বলার নয়।” এ বলে তিনি বিড়ি মাটিতে ফেলে ভাঙা কণ্ঠে হেসে উঠলেন—একটা হাসি, যাতে ভয়ের ছায়া লুকিয়ে আছে। অরিন্দম বুঝতে পারল, প্রাচীন এই গল্পে আছে অমর প্রেম, অসমাপ্ত প্রতিশোধ আর দুঃখের ইতিহাস। কিন্তু তার মনে আরও অনেক প্রশ্ন জেগে উঠল। সত্যিই কি দেবলীনাই আজও হাত বাড়িয়ে ডাকছে? নাকি জমিদারবাড়ির অতৃপ্ত অভিশাপ ভেসে বেড়াচ্ছে এই গ্রামে? হরিপদ স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন শুধু ধোঁয়াশা আর ভয়ের গন্ধ। সেই রাতেই অরিন্দম আবার জানলার দিকে তাকাল—চাঁদের আলোয় হাতটি যেন আগের চেয়েও স্পষ্ট, আগের চেয়েও কাছে এসে ডাকছিল। এখন সে বুঝল, এ আর নিছক ভ্রম নয়; এ এক ডাক, যার উত্তর তাকে একদিন দিতেই হবে।
৪
রাতগুলো ক্রমশ অরিন্দমের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছিল। দিনের বেলায় স্কুলের পড়াশোনা, ছাত্রছাত্রী আর সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যস্ততা তাকে কোনোভাবে যুক্তির জগতে ধরে রাখত, কিন্তু রাত নামলেই ভাঙা জানলার হাতছানি যেন তাকে অদৃশ্য এক ফাঁদে টেনে নিয়ে যেত। প্রতিদিন সে ঠিক করত—আজ আর ওদিকে তাকাবে না, আজ বিছানায় শুয়ে পড়বে, বই পড়বে বা লেখা লিখবে। কিন্তু জানলার দিকে একবার চোখ যেতেই মনে হতো, যেন কিছু একটা অদ্ভুত শক্তি তাকে ডেকে নিচ্ছে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। যুক্তিবাদী শিক্ষক হিসেবে সে সবসময়ই ছাত্রদের শিখিয়েছে—ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই, অলৌকিক ঘটনা নিছক কল্পনা। অথচ নিজের জীবনে এখন যা ঘটছে, তা এই বিশ্বাসের বিপরীত। সে যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করুক, ততই অনুভব করছিল—কোনো অদৃশ্য সত্তা যেন সত্যিই তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
এই টান আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিল যখন অরিন্দম রাতের স্বপ্নে দেখতে শুরু করল তার প্রয়াত স্ত্রী শ্রীলেখাকে। শ্রীলেখা মারা গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে, এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। জীবনের সবচেয়ে কঠিন ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছিল অরিন্দম, যেটা তাকে নিঃসঙ্গ আর ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সেই শ্রীলেখাই যেন স্বপ্নে এসে উপস্থিত হচ্ছিল, আর তাকে ডাকছিল—“অরিন্দম, আমার হাতটা ধরো…”। স্বপ্নে শ্রীলেখার হাত যেন ভাঙা জানলার হাতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। একদিকে অতীতের অপূরণীয় ভালোবাসা, অন্যদিকে বর্তমানের রহস্যময় ডাক—দুটো মিলেমিশে অরিন্দমকে এক দুঃস্বপ্নের গোলকধাঁধায় আটকে ফেলছিল। সে ভেবেছিল, হয়তো এটা নিছক অবচেতন মনের খেলা, হয়তো শ্রীলেখার শূন্যতা আর গ্রামের অদ্ভুত গল্পগুলো মিলেমিশে এ ধরনের বিভ্রম তৈরি করছে। কিন্তু যতবার সে স্বপ্ন দেখত, ততবারই ডাকটা বাস্তবের মতো মনে হতো।
দিনের পর দিন এই দ্বন্দ্বে অরিন্দমের মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করল। স্কুলে পড়াতে গিয়েও মাঝেমধ্যে হঠাৎ থেমে যেত, বোর্ডে লেখা ভুলে যেত, ছাত্রছাত্রীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। সহকর্মী মৃণালও লক্ষ্য করছিল তার এই পরিবর্তন। একদিন সে সরাসরি বলেই ফেলল, “স্যার, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো কিছুর সঙ্গে লড়াই করছেন। কী হয়েছে?” অরিন্দম সরাসরি উত্তর দিতে পারল না। সে কেবল অস্পষ্টভাবে বলল, “কিছুই হয়নি, হয়তো নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে সময় লাগছে।” কিন্তু মৃণাল সহজে বিশ্বাস করল না। তার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—অরিন্দম কোনো গভীর টানে আটকে গেছে। আর এই টান শুধু সাধারণ চাপ নয়, বরং এক অজানা ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা। মৃণাল মনে মনে ভেবেছিল, অরিন্দম যদি একবার খোলাখুলি সব বলে, তবে হয়তো কিছুটা হালকা হবে। কিন্তু অরিন্দমের নিজের ভেতরকার দ্বন্দ্বই এত প্রবল ছিল যে সে কিছুই মুখে আনতে পারল না।
রাতের পর রাত এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকল। একসময় অরিন্দম অনুভব করল, তার মস্তিষ্ক আর হৃদয় যেন দুটি বিপরীত দিকে টানছে। মস্তিষ্ক বলছে—“এটা শুধুই কল্পনা, মানসিক অবসাদের ফল।” কিন্তু হৃদয় বলছে—“ওই হাতটা শুধু হাত নয়, হয়তো শ্রীলেখার অদৃশ্য ছায়া, যে তোমাকে আবার টেনে নিতে চাইছে।” ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি নেই। হয়তো তাকে কোনোদিন ওই হাতের সামনে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে যুক্তির পথ বেছে নেবে, নাকি অদৃশ্য প্রেম আর মৃত্যুর টান মেনে নেবে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে সে যখন রাতের চাঁদের আলোয় হাতটাকে উঁকি দিতে দেখত, তখন মনে হতো, যেন শ্রীলেখাই আবার ফিরে এসেছে। এই অনুভূতি তাকে simultaneously ভীত আর আকৃষ্ট করছিল। সে বুঝতে পারল, যতক্ষণ না সে হাতছানির রহস্য উদঘাটন করছে, ততক্ষণ তার জীবনে শান্তি নেই। এই অদ্ভুত টানই হয়তো তার নিয়তি, যা তাকে নিয়ে যাবে এক অনিশ্চিত অথচ অপরিহার্য মুখোমুখি হওয়ার পথে।
৫
অরিন্দমের দিনগুলো তখন একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। স্কুলে পড়ানোর সময়েও তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক ক্লান্তি জমে থাকত। মৃণাল খেয়াল করছিল সবকিছু—সে লক্ষ্য করেছিল অরিন্দমের দৃষ্টি মাঝে মাঝে শূন্যে আটকে যায়, কিংবা হঠাৎ করেই কোনো শব্দে চমকে ওঠে। মৃণাল জানত, কালোবাড়ির ভাঙা জানলার হাতছানি কেবল গল্প নয়, তার ভেতর সত্যিই এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস লুকিয়ে আছে। তবুও সে চাইছিল না অরিন্দম একা একা ভয় আর দ্বন্দ্বে দগ্ধ হোক। একদিন স্কুল ছুটির পর মাঠের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মৃণাল সরাসরি বলল, “স্যার, পালিয়ে বাঁচা যাবে না। ওই জানলার ঘরে একবার ঢোকা দরকার। যতক্ষণ না ভেতরের সত্যিটা চোখে দেখা হচ্ছে, ততক্ষণ আপনি শান্তি পাবেন না।” অরিন্দম প্রথমে ভয় আর সন্দেহের মিশ্রণে চুপ করে থাকল, কিন্তু মৃণালের কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যা তাকে প্রভাবিত করল। মৃণাল আবার বলল, “আমি থাকব আপনার সঙ্গে। একা নয়। যদি মৃত্যু আসে, তবে দু’জন একসঙ্গে মুখোমুখি হব।” এই প্রতিশ্রুতিতে অরিন্দমের বুকের ভেতর হালকা একটা আলো জ্বলে উঠল, যদিও ভয়ের ছায়া এখনো অটুট রইল।
তাদের সম্পর্কের বাঁধনও অদ্ভুতভাবে বদলাতে শুরু করল। এতদিন সহকর্মী হিসেবে তারা কাছাকাছি এসেছিল, কিন্তু কালোবাড়ির রহস্যের টান যেন তাদের আরও অন্তরঙ্গ করে তুলছিল। অরিন্দম যখন নিজের ভেতরের ভাঙাচোরা অনুভূতিগুলো গোপনে লড়াই করত, মৃণাল তখন ধীরে ধীরে তার পাশে দাঁড়িয়ে শক্তির স্তম্ভ হয়ে উঠছিল। এক রাতে স্কুলের কাগজপত্র গুছানোর সময় মোমবাতির আলোয় মৃণাল তাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি এখনও শ্রীলেখাকে স্বপ্নে দেখেন?” অরিন্দম চমকে উঠেছিল, কারণ এই প্রশ্ন এতদিন কেউ করেনি। সে নীরবে মাথা নেড়ে স্বীকার করল। মৃণালের চোখে তখন সহানুভূতির পাশাপাশি এক অদৃশ্য কষ্টও ফুটে উঠেছিল। হয়তো অজান্তেই সে অনুভব করতে শুরু করেছিল—অরিন্দমকে সে শুধু সহকর্মী হিসেবে নয়, আরও গভীর কিছু হিসেবে দেখতে চাইছে। কিন্তু সেই আবেগকে মুখে আনার সাহস তার ছিল না। তবুও তাদের কথোপকথনের প্রতিটি মুহূর্তে এক ধরনের আবেগিক টান অনুভূত হচ্ছিল, যা বন্ধুত্বের সীমা পেরিয়ে অন্যরকম অর্থ খুঁজছিল।
যখন তারা পরিকল্পনা করছিল কীভাবে কালোবাড়ির ভেতরে ঢুকবে, তখনও ভয় মনের মধ্যে কামড় বসাচ্ছিল। গ্রামজুড়ে এতসব গল্প ছড়ানো, কারও সাহস হয়নি সেখানে প্রবেশ করার। মৃণাল স্পষ্ট বলেছিল, “আমি ভয় পাই, স্যার। কিন্তু ভয় পেলেই কি আমরা থেমে যাব? যদি সত্যিই ওটা দেবলীনাদের আত্মার হাত হয়, তবে আমাদের একবার দেখা উচিত। হয়তো তার মুক্তির জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।” এই কথাগুলো অরিন্দমকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। নিজের স্ত্রীকে হারানোর পর তার ভেতর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেই জায়গাতেই মৃণালের কথাগুলো যেন এক অদ্ভুত সান্ত্বনা এনে দিচ্ছিল। তাদের চোখাচোখি হলে মাঝে মাঝে মনে হতো, দুজনের মাঝখানে নীরব ভাষায় কিছু কথা ভেসে বেড়াচ্ছে—যা বলা যায় না, অথচ অনুভব করা যায়। জানলার ঘরে ঢোকার পরিকল্পনা করতে করতে তারা যেন ধীরে ধীরে পরস্পরের উপর ভরসা করতে শিখছিল, এমনকি অব্যক্ত এক আবেগের বাঁধনে আবদ্ধ হচ্ছিল।
অরিন্দম এখন আর পুরোপুরি একা নয়। মৃণালের সাহস আর সঙ্গ তাকে নতুন করে দাঁড়ানোর শক্তি দিচ্ছিল। যদিও ভেতরে ভেতরে সে জানত, ভাঙা জানলার ঘরে ঢোকা মানে অজানা এক মৃত্যুফাঁদের মধ্যে প্রবেশ করা। কিন্তু হয়তো এই ফাঁদই তাদের দুজনকে নতুন সত্যের মুখোমুখি করবে। আর হয়তো এই যাত্রাপথেই তাদের সম্পর্ক এমন এক জায়গায় পৌঁছাবে যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। মৃণালের সাহসিকতা যেন অরিন্দমের যুক্তি ও ভয়ের দ্বন্দ্বকে এক নতুন রূপ দিচ্ছিল—এখন আর সে কেবল শ্রীলেখার হাতছানিতে আবদ্ধ এক নিঃসঙ্গ মানুষ নয়, বরং এমন এক সঙ্গী পেয়েছে যে বিপদের মুহূর্তে তার হাত শক্ত করে ধরে রাখতে পারবে। সেই রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিল—অচিরেই কালোবাড়ির ভেতরে ঢুকতে হবে। জানলার হাতছানি আর দমিয়ে রাখা যাবে না, তাকে মুখোমুখি হতেই হবে। আর এই যাত্রায় তাদের বন্ধুত্বের আবেগ ইতিমধ্যেই অন্যরকম এক সম্পর্কের জন্ম দিয়ে ফেলেছে, যা হয়তো ভয়ঙ্কর, হয়তো মুক্তিদায়ক, আবার হয়তো সর্বনাশের সূচনা।
৬
রনজয় মুখার্জীর সতর্কবাণী প্রথমে যেন বজ্রাঘাতের মতো নেমে এলো অরিন্দমের উপর। রনজয় গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ, স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি এবং এককথায় গ্রামের লোকজনের অঘোষিত মুখপাত্র। একদিন সকালে স্কুলের বারান্দায় সবার সামনে দাঁড়িয়ে সে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “অরিন্দমবাবু, এই গ্রামের নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করবেন না। ভাঙা জানলার ঘর নিয়ে কৌতূহল দেখানো মানে বিপদকে ডেকে আনা। আমরা চাই না আপনার মতো একজন মানুষও ওই হাতছানির শিকার হোন।” চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষক থেকে ছাত্র, এমনকি গ্রামের কয়েকজন অভিভাবকও তখন সেখানে উপস্থিত ছিল। রনজয়ের চোখে সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত কড়া আলো ঝলসে উঠছিল—যেন অরিন্দমকে শুধু সতর্কই করছে না, বরং হুমকিও দিচ্ছে। অরিন্দমের বুকের ভেতর দ্বিধার ঝড় বইতে লাগল। একদিকে সে জানত, রনজয়ের কথার পেছনে কোনো না কোনো সত্য আছে, কারণ এই গ্রাম বহু বছর ধরে অজানা ভয়ে বন্দি হয়ে আছে। অন্যদিকে, মৃণালের সাহস আর নিজের কৌতূহল তাকে থামতে দিচ্ছিল না। কিন্তু রনজয়ের সেই প্রকাশ্য সতর্কবার্তা গ্রামের মানুষের মনে এক নতুন সন্দেহের জন্ম দিল—অরিন্দম কি তবে সত্যিই হাতছানির টানে বদলে যাচ্ছে?
এরপর থেকেই স্কুলের ভেতরে অদ্ভুত এক অশান্তি শুরু হলো। ছাত্রছাত্রীরা ফিসফিস করে অরিন্দমকে “হাতছানির টানে ধরা” বলে ডাকতে লাগল। তাদের ভয় মিশ্রিত কৌতূহল প্রতিদিন বাড়ছিল। শ্রেণিকক্ষে কেউ যদি হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে ছায়া দেখতে পেত, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠত—“স্যার, হাত এল কি?” এতে পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠত। সহকর্মীরাও ধীরে ধীরে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করল। দুপুরের খাবারের সময়, টিফিন রুমে কেউ অরিন্দমের পাশে বসতে চাইত না। এমনকি একদিন গ্রামের অভিভাবকরা স্কুলে এসে সরাসরি প্রশ্ন তুলল—“আমাদের ছেলেমেয়েদের কি ওই হাতছানির প্রভাব পড়বে না? যদি স্যার সত্যিই বদলে গিয়ে তাদের ক্ষতি করেন?” অরিন্দম এমন অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে গেলেও বুঝতে পারল, ভয় মানুষকে কেমন অন্ধ করে দেয়। যেসব মানুষ তাকে প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিল, তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিল, তারাই এখন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, গ্রাম যেন তাকে অদৃশ্য এক ঘেরাটোপে বন্দি করে ফেলছে।
এই অশান্তির মধ্যেও মৃণালই একমাত্র মানুষ যে দৃঢ়ভাবে অরিন্দমের পাশে দাঁড়াল। এক রাতে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, “আপনাকে ভয় দেখিয়ে থামানোই রনজয়ের উদ্দেশ্য। কারণ এই গ্রামের মানুষকে অজানার ভয়ে বন্দি করে রাখা মানেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। যদি জানলার ঘরের রহস্য ফাঁস হয়ে যায়, তবে রনজয়ের দাপট কমে যাবে।” মৃণালের যুক্তি অরিন্দমকে ভাবতে বাধ্য করল। সে উপলব্ধি করল, রনজয়ের সতর্কবার্তা নিছক ভয় নয়, বরং তার অবস্থান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। কিন্তু অরিন্দম জানত, এভাবে চুপ করে থাকলে তার নিজের ভিতরকার দ্বন্দ্বও কখনও থামবে না। গ্রামের মানুষদের সন্দেহও মুছবে না। ফলে সে আরও দৃঢ় সংকল্প করল—যা-ই হোক না কেন, ভাঙা জানলার রহস্যের মুখোমুখি তাকে যেতেই হবে। তবু মানুষের চোখের দৃষ্টি তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। যাদের সামনে সে শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে ছিল, সেই চোখগুলোতে এখন ভয়, সন্দেহ আর ঘৃণার ছাপ স্পষ্ট। এটা তার আত্মসম্মানকে প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল।
অবশেষে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে গেল গুজব—অরিন্দম নাকি রাতে হাতছানির ঘরে যায়, অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলে, এমনকি তার ছায়াও নাকি অন্য রকম হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলল, তার চোখে এখন আগের মতো মায়া নেই, বরং ভূতের শূন্য দৃষ্টি ভর করেছে। এসব গুজব যত ছড়াচ্ছিল, ততই তার চারপাশের মানুষজন দূরে সরে যাচ্ছিল। স্কুলের করিডরে হাঁটার সময় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ভয়ে সরে দাঁড়াত। অথচ এইসব অভিযোগের বিরুদ্ধে অরিন্দম কিছু বলতেও পারছিল না। যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেও গ্রামের লোকজনের মনে ভয় এত গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে কোনো ব্যাখ্যা শোনার মতো মানসিকতা তাদের ছিল না। একমাত্র মৃণাল তখনও অটল, সে শুধু একটাই কথা বলত—“ভয় যত বাড়বে, সত্যের পথ তত পরিষ্কার হবে।” কিন্তু এই কথার মধ্যেই অরিন্দম বুঝে নিল, অশান্তির ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে তাকে শুধু রহস্যের নয়, গ্রামের বিশ্বাসেরও পরীক্ষা দিতে হবে। আর এই পরীক্ষার ফলাফলই ঠিক করবে—সে একজন শিক্ষক হিসেবে বেঁচে থাকবে, নাকি “হাতছানির টানে বদলে যাওয়া মানুষ” হিসেবে ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
৭
অরিন্দমের ভিতরে বহুদিন ধরে জমে থাকা ভয়, দ্বন্দ্ব আর কৌতূহল সেই রাতে একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলো। চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল, কেবল দূরের কুকুরের ডাক আর বাঁশঝাড়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মৃণাল তাকে বারবার বলেছিল, “যদি একা যান তবে বিপদ বাড়বে।” কিন্তু অরিন্দম জানত, এই লড়াইটা একেবারে তার নিজের। রাত গভীর হওয়ার পর সে লণ্ঠন হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কালোবাড়ির দিকে। বাড়িটা দিনের বেলায় যেমন ভগ্নদশা আর নিঃসঙ্গ মনে হয়, রাতের অন্ধকারে সেটা যেন আরও ভয়ঙ্কর দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভাঙা জানলার নিচে দাঁড়িয়ে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ধুকপুক শুরু হলো। মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অদৃশ্য টানে ভেতরে ডেকে নিচ্ছে। লণ্ঠনের কাঁপতে থাকা আলোয় সে অবশেষে ভেতরে পা রাখল। কাঠের দরজা ঠেলতেই এক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ উঠল, যেন বাড়িটা নিজেই তার আগমনের সাক্ষী হয়ে উঠল। অরিন্দম অনুভব করল, সে আর আগের মতো নিছক এক শিক্ষক নেই—সে প্রবেশ করেছে এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে যুক্তি আর বাস্তবতার সব নিয়ম ভেঙে যাচ্ছে।
ঘরের ভেতরে পা রাখতেই প্রথম যে জিনিসটা তার চোখে পড়ল, তা হলো দেয়ালের গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত সব চিহ্ন। অল্প আলোয় সেগুলোকে বোঝা কঠিন ছিল, তবে চিহ্নগুলো কোনো সাধারণ আঁকিবুঁকি নয়, বরং একধরনের রহস্যময় প্রতীক। কিছুটা মনে হচ্ছিল প্রাচীন কোনো লিপির অংশ, আবার কিছুটা যেন তন্ত্র-মন্ত্রের ছাপ। প্রতিটি চিহ্ন থেকে অদ্ভুত এক ঠান্ডা অনুভূতি বেরোচ্ছিল, যেন সে দেয়াল স্পর্শ করলেই নিজের শরীরের ভেতর দিয়ে শীতল হাওয়া বইতে থাকবে। অরিন্দম হাত বাড়িয়ে এক চিহ্ন স্পর্শ করতে চাইলে হঠাৎই পিছনে একটা নরম শব্দ হলো। সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল—অন্ধকার ভেদ করে ভাঙা জানলার ফাঁক থেকে সেই অদৃশ্য হাত বেরিয়ে আসছে। আগের মতো দূরত্বে নয়, এবার সেটা যেন অনেক কাছাকাছি, প্রায় তার মুখের সামনেই। হাতটা যেন কাঁপছিল, হয়তো তাকে স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল। অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করে উঠল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে ভয়ে পিছিয়ে আসতে পারল না। বরং এক অজানা টানে সে হাতটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। বাতাসে তখন একধরনের গন্ধ ভেসে আসছিল—পুরনো কাঠ, ছত্রাক আর ধূপের ধোঁয়ার মতো। অরিন্দম স্পষ্ট শুনতে পেল, কেউ যেন ফিসফিস করে তার নাম ডাকছে। সেই মুহূর্তে সময় থেমে গেল, পৃথিবী শূন্য হয়ে গেল, শুধু সে আর সেই হাত রয়ে গেল ভেতরের শূন্যতায়।
কিন্তু ঠিক যখন হাতটা তার আঙুল ছুঁয়ে দেওয়ার মতো কাছে চলে এলো, তখন এক প্রবল ঝাপটা হাওয়ায় লণ্ঠনটা নিভে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অরিন্দম অনুভব করল, ঘরের ভেতর দেয়ালগুলো কেঁপে উঠছে, আর কোথাও থেকে একটা দীর্ঘ, বিষণ্ন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, শরীর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে বুঝল, এ ঘরের ভেতর শুধু হাতছানি নয়, আছে এক অসমাপ্ত যন্ত্রণার ইতিহাস, আছে দমিয়ে রাখা অভিশাপ। একসময় ঠোঁটে অচেনা কিছু শব্দ ফসকে বেরিয়ে এলো—যেন তার নিজের ভাষা নয়, বরং অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। আর সেই মুহূর্তেই হাতটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের ভেতর। ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল, কেবল অরিন্দমের দ্রুত শ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। সে ভয়ে ভেঙে পড়ল না, কিন্তু শরীর যেন ভেতর থেকে অবশ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে পা টেনে সে ঘরের বাইরে বেরোল। বাইরে এসে সে বুঝতে পারল—সে শুধু জানলার হাত দেখেনি, বরং তার শরীর-মন কোনো অদৃশ্য শক্তির স্পর্শে বদলে গেছে।
পরদিন সকালে গ্রামজুড়ে অরিন্দমকে দেখে সবার মনে সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। তার মুখের ভাব বদলে গিয়েছিল—চোখ দুটি শূন্য অথচ গভীর, ঠোঁটে অচেনা এক হাসি লেগে ছিল। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ঢুকেই বুঝতে পারছিল, তাদের শিক্ষক আর আগের মতো নেই। সে আগের মতো গল্প করে পড়াচ্ছে না, বরং এক অদ্ভুত নীরবতায় ভরে উঠেছে। মাঝে মাঝে সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেমে যেত, যেন অদৃশ্য কিছু চোখে পড়ছে। সহকর্মীরা ফিসফিস করতে লাগল—“হাতছানি এবার সত্যিই তাকে ছুঁয়ে গেছে।” মৃণাল বারবার তাকে প্রশ্ন করছিল, “কী দেখলেন? কী হলো ভেতরে?” কিন্তু অরিন্দম স্পষ্ট কিছু বলতে পারছিল না। শুধু তার চোখের গভীরে একটা টান স্পষ্ট ছিল, যা বোঝাচ্ছিল—সে এখন এমন এক সত্যের মুখোমুখি হয়েছে, যা তাকে গ্রাম থেকে, মানুষ থেকে, এমনকি নিজের ভেতরকার সত্তা থেকেও আলাদা করে দিচ্ছে। গ্রামের মানুষরা নিশ্চিত হয়ে গেল, হাতছানির প্রভাব এখন তার ওপর সম্পূর্ণভাবে পড়েছে। অরিন্দম নিজেও বুঝতে পারছিল, রাতের সেই স্পর্শ তার আত্মার ভেতর চিরদিনের মতো এক ছাপ ফেলে দিয়েছে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই।
৮
হরিপদ বৃদ্ধ অনেকদিন ধরে এই গ্রামের ইতিহাস নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। গ্রামের সবাই জানত, সে একসময় জমিদার বাড়ির খাজাঞ্চি ছিল, কিন্তু তার মুখ থেকে কখনও পুরো সত্য কেউ শোনেনি। এক সন্ধ্যায় অরিন্দম আর মৃণাল তার উঠোনে বসে থাকতেই হরিপদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এবার শোনো, যা লুকিয়ে রেখেছিলাম এতদিন।” তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, চোখের ভেতর জমে থাকা আতঙ্ক আর অপরাধবোধ যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করল, সেই পুরনো জমিদারবাড়ির ইতিহাস, যেটা শুধু প্রাচীন স্থাপত্য নয়, বরং এক অমর অভিশাপের সাক্ষ্য। জমিদার হরিশচন্দ্র মুখার্জীর অত্যাচার আর অহংকারের কাহিনি বেরিয়ে এলো। তিনি ধনসম্পদে অঢেল ছিলেন, কিন্তু হৃদয়ে ছিল নিষ্ঠুরতা। তাঁর জমিদারবাড়িতে কাজ করত এক তরুণী, নাম শ্যামলতা—অসাধারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী আর সাহসী। তাকে দেখে গ্রামের অনেকেই মুগ্ধ হয়েছিল, এমনকি জমিদারও। কিন্তু জমিদারের কামনা যখন প্রত্যাখ্যাত হলো, তখন শ্যামলতার জীবনে নামল অন্ধকার।
হরিপদর চোখ ভিজে উঠছিল যখন সে বলছিল—“শ্যামলতা শুধু একজন দাসী ছিল না, সে ছিল গ্রামের আশার প্রতীক। তার প্রেমিক ছিল এক সাধারণ কৃষক, যার সঙ্গে সে বিয়ের স্বপ্ন দেখত। কিন্তু জমিদারের হিংস্রতা সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। এক অমাবস্যার রাতে, জমিদার তাকে জোর করে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। শ্যামলতা আপ্রাণ প্রতিরোধ করে, সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু কেউ তাকে রক্ষা করতে আসেনি। সেদিনই জমিদারের হাতে তার মৃত্যু হয়—এক নিষ্ঠুর, অকথ্য উপায়ে।” হরিপদ চুপ করে গেল, কেবল রাতের নীরবতা ভর করল চারদিকে। তারপর সে আরও নিচু গলায় বলল, “মরার আগে শ্যামলতা শেষবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, যেন কেউ তাকে বাঁচায়, যেন কেউ তার যন্ত্রণার শেষ করে। কিন্তু সেই হাত শূন্যেই থেকে যায়। সেই হাত আর ফিরল না—এখনও ভাঙা জানলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে, মুক্তির জন্য হাতছানি দেয়।”
অরিন্দম শিউরে উঠল। মৃণাল ঠোঁট চেপে ধরল, যেন কান্না আটকাতে চাইছে। হরিপদ বলল, “এই গ্রাম তাই অভিশপ্ত। জমিদারের বাড়ি যতদিন আছে, শ্যামলতার আত্মাও মুক্তি পাবে না। যে-ই ওই হাতের কাছে যায়, তার জীবনে ছাপ পড়ে যায়। কারণ ওই হাত শুধু ডাকছে না, খুঁজছে কারও হৃদয়ে সহমর্মিতা, খুঁজছে মুক্তির পথ।” বৃদ্ধের কণ্ঠে এক অদ্ভুত ব্যথা ভেসে আসছিল, যেন সেও এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কোনো পাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। অরিন্দম এবার বুঝতে পারল, কেন প্রথম রাতেই হাতটা তাকে ডাকছিল—তার ভেতরের অসমাপ্ত শূন্যতা, স্ত্রী শ্রীলেখার মৃত্যুর বেদনা তাকে এমন এক অবস্থায় এনেছে, যেখানে সে শ্যামলতার ব্যথার সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছে। হাতটা যেন তার কাছে মুক্তির আবেদন করছে, তাকে আশ্রয় চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সে কি সত্যিই পারবে সেই আত্মাকে মুক্তি দিতে, নাকি তার জীবনও ধ্বংস হয়ে যাবে?
হরিপদর কাহিনি শোনার পর গ্রামের পরিবেশ যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। মানুষজন বুঝতে পারছিল, এতদিন যেটাকে কুসংস্কার ভেবেছিল, তার পেছনে আসলেই আছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। শ্যামলতার হাত শুধু ভয়ের প্রতীক নয়, সেটা এক অসমাপ্ত ভালোবাসা আর নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। অরিন্দম সেদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। জানলার বাইরে তাকিয়ে সে স্পষ্ট দেখেছিল, ফাঁক দিয়ে হাতটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন শ্যামলতা বলছে—“আমাকে মুক্তি দাও।” কিন্তু মুক্তির মানে কী? তাকে কি প্রার্থনা করতে হবে, নাকি কোনো রীতির মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া সম্ভব? এসব প্রশ্নের উত্তর অরিন্দমের কাছে নেই। তবে সে বুঝল, তার নিজের জীবনের নিয়তি এখন সেই হাতের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। গ্রাম তাকে সন্দেহের চোখে দেখুক, রনজয় তাকে থামাতে চাইুক, সে আর থেমে থাকতে পারবে না। শ্যামলতার হাত তাকে প্রতিরাতেই ডাকবে, আর সেই ডাকে সাড়া না দেওয়া মানে হবে নিজের ভেতরের মানুষটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। তাই অরিন্দম স্থির করল—সত্য যাই হোক, অভিশাপ যত গভীরই হোক, এই হাতের ইতিহাসের শেষ তাকে করতেই হবে।
৯
অরিন্দম দিন দিন বুঝতে পারছিল, শ্যামলতার হাত আর তার নিজের জীবনের মধ্যে এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল, এটা নিছক এক ভয়ংকর অভিশাপ, কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, ততই তার ভেতরে নতুন এক উপলব্ধি জন্ম নিচ্ছিল। রাতে ঘুমের মধ্যে বারবার শ্রীলেখাকে দেখতে পেত সে—তার প্রয়াত স্ত্রী, যে বছরখানেক আগে এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল। স্বপ্নের ভেতর শ্রীলেখা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে, কিন্তু সেই হাতের ভঙ্গি হুবহু মিলে যায় শ্যামলতার হাতের সঙ্গে। অরিন্দমের মনে হতে লাগল, শ্যামলতার আত্মার যন্ত্রণা আর শ্রীলেখার অদৃশ্য উপস্থিতি যেন একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। দুজনেরই অসমাপ্ত কষ্ট, দুজনেরই আকুল হাতছানি তাকে ডেকে নিচ্ছে। যুক্তিবাদী মানুষ হয়েও সে স্বীকার করতে বাধ্য হলো—এটা নিছক কাকতাল নয়, এর ভেতরে আছে এক গভীর যোগ। হয়তো শ্যামলতার মুক্তিই শ্রীলেখার আত্মাকে শান্তি দেবে, অথবা উল্টোটা। এ যেন এক আত্মিক সেতু, যা তাকে এই রহস্য উন্মোচনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
এই অদ্ভুত উপলব্ধির কথা প্রথমে মৃণালকেই জানায় অরিন্দম। মৃণাল মনোযোগ দিয়ে শোনে, তার চোখে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে ভাসছিল। সে চুপচাপ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “হয়তো সত্যিই একটা যোগ আছে। আত্মার তো সীমা থাকে না, তারা মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে। হয়তো শ্যামলতা তোমার ভেতরে শ্রীলেখার অভাবটা টের পাচ্ছে, তাই তোমার কাছে এসেছে।” অরিন্দম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে, কারণ এতদিন সে ভাবত এই গ্রামে কেবল তিনিই যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অথচ আজ মৃণালই তার এই অতিপ্রাকৃত ভাবনার পাশে দাঁড়ালো। মৃণাল বলল, “আমরা যদি সত্যিই মুক্তি দিতে চাই, তবে আমাদের জানতে হবে আত্মাকে মুক্ত করার উপায়। শুধু ইতিহাস জানলেই চলবে না, বুঝতে হবে কীভাবে তাকে শান্ত করা যায়।” এরপর থেকে দু’জনে মিলে খুঁজতে শুরু করল গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো কাহিনি, লোকমুখে প্রচলিত মন্ত্র-তন্ত্রের উপায় আর হরিপদের অর্ধেক-অপূর্ণ স্মৃতির মধ্যে লুকোনো সূত্র।
খোঁজ করতে গিয়ে তারা জানতে পারল, শ্যামলতার আত্মা শান্তি পাবে কেবল তখনই, যখন তার মৃত্যুর সত্যিটা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হবে এবং জমিদারবাড়ির ভেতরে এক বিশেষ প্রার্থনা সম্পন্ন করা হবে। গ্রামজুড়ে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, জমিদারের রক্তসন্তানরা কখনও এই সত্যকে স্বীকার করেনি, বরং বারবার চাপা দিয়ে রেখেছে। তাই আত্মা মুক্ত হয়নি। হরিপদও এই সত্য চাপা দিতে বাধ্য হয়েছিল জমিদারের ভয়ে। কিন্তু এখন সেই প্রাচীন লজ্জা আর ভয়ের প্রাচীর ভাঙতে হবে। মৃণাল বলল, “অরিন্দমদা, হয়তো আপনাকেই এটা করতে হবে। কারণ আপনিই একমাত্র মানুষ যাকে হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়েছে।” অরিন্দম তখন বুঝতে পারল, শ্যামলতার হাত শুধু অভিশাপ নয়, বরং তার নিজের জীবনেরও পরীক্ষা। সে যদি সাহস নিয়ে সত্যিটা প্রকাশ করতে পারে, তবে হয়তো শ্যামলতা মুক্তি পাবে, আর শ্রীলেখার অদৃশ্য হাতছানিও মিলিয়ে যাবে। কিন্তু এই পথে হাঁটা সহজ নয়—কারণ গ্রাম ইতিমধ্যেই তাকে সন্দেহ করছে, রনজয় মুখার্জী তাকে হুমকি দিচ্ছে, আর ভেতরে ভেতরে এক ভয়ংকর শক্তি তার আত্মাকে দখল করতে চাইছে।
তবুও, অরিন্দম আর মৃণাল একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল। তারা অন্ধকারকে জয় করতেই হবে। মৃণালের সাহচর্যে অরিন্দম এক ধরনের শক্তি পেতে লাগল। সে অনুভব করল, শ্রীলেখার অদৃশ্য ছায়া আসলে তাকে দুর্বল করছে না, বরং শ্যামলতার যন্ত্রণা বোঝার শক্তি দিচ্ছে। এই সংযোগই তাকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। পরের কয়েক রাত তারা দু’জন একসঙ্গে ভাঙা জানলার কাছে বসে থাকত, শ্যামলতার হাত যখন বেরিয়ে আসত, তারা নিঃশব্দে প্রার্থনা করত, কথা বলত, আর খুঁজে বের করার চেষ্টা করত আত্মার ইশারাগুলো। কখনও হাতটা স্থির থাকত, কখনও কেঁপে উঠত, কখনও মিলিয়ে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে অরিন্দম অনুভব করতে লাগল—হাতটা শুধু মুক্তি চাইছে না, সে দিশাও দেখাচ্ছে। সেই দিশা অনুসরণ করেই হয়তো তারা জানতে পারবে, কীভাবে শেষ করা যায় এই অভিশাপের যাত্রা। আর ঠিক তখনই তাদের সামনে আসন্ন সংঘর্ষের আভাস দেখা দিল—কারণ গ্রামের রক্তসন্তানরা, বিশেষ করে রনজয় মুখার্জী, এ সত্য প্রকাশ পেতে দেবে না। তাই অরিন্দম জানত, সত্যকে খুঁজতে গিয়ে সে শুধু আত্মিক অন্ধকার নয়, বাস্তব প্রতিরোধের মুখোমুখিও হবে। কিন্তু তবুও তার মনে দৃঢ়তা জন্ম নিল—সে পিছিয়ে যাবে না, কারণ এ শুধু শ্যামলতার মুক্তির লড়াই নয়, তার নিজের জীবন, তার মৃত স্ত্রী আর মৃণালের প্রতি অনুভূতির সঙ্গেও এই লড়াই বাঁধা পড়ে গেছে।
১০
পূর্ণিমার রাত। আকাশজুড়ে রুপোলি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, চারদিকের অন্ধকারকে এক অদ্ভুত মায়াবী আভায় মোড়ানো। গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন আরও গভীর, যেন প্রকৃতি নিজেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে এক ঘটনার জন্য। সেই রাতে অরিন্দম ধীরে ধীরে পা বাড়াল জমিদারবাড়ির দিকে। মৃণাল বারবার বোঝাতে চেয়েছিল, এই কাজ তার একার করা উচিত নয়। কিন্তু অরিন্দম জানত, এই পথ সে ছাড়া আর কেউ হাঁটতে পারবে না। শ্রীলেখার স্বপ্নগুলো, শ্যামলতার ব্যথা আর নিজের অস্তিত্বের টানাপোড়েন তাকে ঠেলে এনেছে এই শেষ মুহূর্তে। জমিদারবাড়ির ভাঙাচোরা প্রাচীরের সামনে দাঁড়াতেই তার মনে হলো, কত শত বছরের কান্না যেন দেয়াল বেয়ে ঝরে পড়ছে। সে ভিতরে ঢুকে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল—ভাঙা জানলার ঘর। জানলার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো প্রবেশ করছে, আর ঠিক তখনই অদৃশ্য হাতটা বেরিয়ে এলো, আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট, অনেক বেশি আকুল। অরিন্দম থমকে গেলেও এবার আর ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করল না। সে অনুভব করল, এ হাত কোনো শয়তান নয়, এটা মুক্তির আর্তি।
ধীরে ধীরে হাতটা তার দিকে এগিয়ে এলো। অরিন্দমের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ যেন পুরো ঘর ভরে দিচ্ছিল। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, দেওয়ালের পুরনো চিহ্নগুলো হালকা জ্বলজ্বল করতে লাগল, যেন তারা একসঙ্গে সাক্ষী দিচ্ছে এই ঘটনার। অরিন্দম চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিল। শ্রীলেখার হাসি তার কানে বাজল, মৃণালের উৎসাহ মনে পড়ল, হরিপদের কাহিনি আবার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে হাত বাড়িয়ে দিল। ভেতরে যে হাতটা ভেসে ছিল, সেটি তার আঙুল ছুঁয়ে গেল। এক শিহরণে অরিন্দম কেঁপে উঠল। যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা কান্না, যন্ত্রণা আর আর্তনাদ একসঙ্গে প্রবাহিত হলো তার শরীরে। ঘর কেঁপে উঠল, ছাদ থেকে ধুলো ঝরে পড়তে লাগল, জানলার কাঠামো কাঁপতে লাগল। কোথাও থেকে নারীর কান্না ভেসে এলো—এক অমানবিক, হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। কান্নার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল শ্রীলেখার কণ্ঠস্বর, যেন সে-ও বলছে, “আমাকে শান্তি দাও।”
অরিন্দমের হাতের মুঠোয় যে অদৃশ্য হাত ছিল, ধীরে ধীরে তা শক্ত হতে লাগল, যেন এক অদৃশ্য আত্মা পুরোপুরি তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। ঘরের ভেতর আলোছায়ার খেলা শুরু হলো। কখনও মনে হচ্ছিল এক তরুণীর মুখ ভেসে উঠল, আবার মিলিয়ে গেল; কখনও মনে হচ্ছিল দেয়ালের পুরনো খোদাইগুলো জ্যোৎস্নায় নড়ছে। অরিন্দম অনুভব করছিল, তার শরীর আর মন ভেঙে যাচ্ছে, আবার এক নতুন শক্তি দিয়ে ভরে উঠছে। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে এক চিৎকার ভেসে এলো, তারপর সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন সময় থমকে দাঁড়াল। চোখ খুলতেই অরিন্দম দেখল, জানলার ফাঁক নিজে থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একসময় যে ফাঁক দিয়ে হাতটা বেরিয়ে আসত, তা এখন সিল হয়ে গেছে, পাথরের মতো শক্ত। আর হাত নেই, কান্না নেই—কেবল নিস্তব্ধতা। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতর এক আশ্চর্য প্রশান্তি লুকিয়ে ছিল, যেন শতাব্দী পুরনো অভিশাপ ভেঙে গেছে। গ্রামের বুক থেকে বোঝা নেমে গেছে।
পরদিন ভোরে গ্রামবাসীরা ছুটে এলো জমিদারবাড়ির সামনে। তারা অবাক হয়ে দেখল—ভাঙা জানলার ফাঁক আর নেই, যেন প্রকৃতি নিজেই তা মেরামত করে দিয়েছে। মানুষ একে অপরের দিকে চেয়ে ফিসফিস করতে লাগল, “অভিশাপ ভেঙেছে।” কিন্তু অরিন্দমকে আর কেউ খুঁজে পেল না। কেউ বলল, সে আত্মাকে মুক্তি দিয়ে নিজে মিলিয়ে গেছে; কেউ বলল, সে-ই হয়ে গেছে নতুন বাসিন্দা, হাতের অভিশাপ এখন তার শরীরে বন্দি। মৃণাল চোখ ভিজে দাঁড়িয়ে রইল, তার মনে হচ্ছিল অরিন্দমকে হারালেও, সে নিজের চোখে ইতিহাসের সমাপ্তি দেখেছে। গ্রামে নতুন ভোর এলো, কিন্তু সেই ভোরের আকাশে অরিন্দমের অনুপস্থিতি এক গভীর শূন্যতা তৈরি করল। তবুও মানুষ বিশ্বাস করল, তার আত্মত্যাগেই গ্রাম মুক্তি পেয়েছে। আর মৃণাল একদিন রাতে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখল—আলোর ফাঁকে যেন অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত মুখে, শ্রীলেখার সঙ্গে, শ্যামলতার সঙ্গে। তাদের হাত একত্রে জড়িয়ে আছে, আর তারা মিলিয়ে যাচ্ছে অনন্তের দিকে। গ্রামের মানুষরা বুঝল, হাতছানির ইতিহাস শেষ হয়েছে, কিন্তু অরিন্দমের স্মৃতি চিরকাল তাদের বুকের ভেতরে হাতছানির মতোই বেঁচে থাকবে।
শেষ