অয়ন দত্ত
অধ্যায় ১ – মেলার ডাক
গ্রামের বার্ষিক মেলার দিনটি এসেছে, এবং পুরো গ্রাম যেন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে। সকাল থেকেই মাটির রাস্তাগুলো জমে ওঠে মানুষের পদচারণায়, বেচাকেনা এবং উৎসবের আওয়াজে। হরেক রকমের দোকান সাজানো হয়েছে মেলার মূলমাঠে—ফুলের গলায়, রঙিন বাতির সারিতে, মাটির খেলনা, কাঠের পুতুল, হাতের কাজের ঝুলনা, আর দেশী ও বিদেশী খাবারের তামাশা সব মিলিয়ে যেন গ্রামের প্রতিটি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। শিশুরা উল্লাসে দৌড়াচ্ছে, মুখে হেসে খেলে এবং নাগরদোলার ধোঁয়া ও লাল, সবুজ, নীল বাতি তাদের চোখকে মুগ্ধ করছে। গ্রামের বৃদ্ধা-বৃদ্ধরা মাটির বেঞ্চে বসে এই দৃশ্যটি দেখছে, আর তাদের চোখে এক অদ্ভুত ভাব—একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে কিছুটা শঙ্কা। ছোট থেকে বড় সবাই মেলার জন্য উদগ্রীব, কিন্তু প্রবীণরা জানে, এই মেলার মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু রহস্য, যা বহু বছর ধরে লোকমুখে ছড়িয়ে আসছে।
মেলার আবহটা এক ধরনের জাদুময়, কিন্তু সেই সাথে ভিতরে ভয়ে চুম্বিত। স্থানটি ঘিরে আছে সবুজ গাছের সারি, আর বাতাসে ঘ্রাণ মিশেছে মাটির ধোলাই ও পিঠার সুবাসে। দোকানিদের চিৎকার আর ক্রেতাদের চাহিদার হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ করেই শোনা যায় কোন অদ্ভুত শব্দ—যেমন কোন হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবল পাখির ডাক নয়, বরং ভেসে আসে এক মানুষের অব্যক্ত কান্নার মতো। লোকমুখে প্রচলিত একটি গল্প আছে—মেলার সময় এই স্থানে প্রায়ই দেখা যায় এক হাতকাটা সাধু, যে নিজের হাত হারিয়ে ফেলে বহু বছর আগে, আর মেলায় ঘুরে বেড়ায় যেন কেউ তার দিকে তাকালে কয়েক দিনের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে যায়। প্রবীণরা জানে, এটা শুধুই গল্প নয়; বহু বছর ধরে এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছে গ্রামের মানুষ। কেউ কেউ মেলার মধ্যে এমন অদ্ভুত ছায়া দেখে ফেলে, কেউ শুনেছে হালকা পদধ্বনি, যেন কোন অদৃশ্য প্রান্তরের মধ্যে কেউ হাঁটছে। মেলার আনন্দের মধ্যে এই ছায়াময় গল্পটি এক অদ্ভুত উভয় অনুভূতি তৈরি করে—একটি দুঃসাহসী কৌতূহল এবং ভয়ের মিশ্রণ।
মেলা ধীরে ধীরে জমে ওঠে। ছোট শিশুরা চকচকে বেলুন হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে, পুতুল কিনতে চেয়ে গলায় চিৎকার করছে। কিশোর-কিশোরীরা নাগরদোলার ভাঁজে ভাঁজে ঘুরছে, আর প্রাপ্তবয়স্করা তাদের সন্তানের হাতে লুঠতে বসেছে রঙিন খেলনা কিনতে। কিন্তু প্রবীণরা বারবার মেলার আশেপাশা তাকাচ্ছে, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের মুখে অপ্রকাশিত শঙ্কা, মনে কেবল একটি প্রশ্ন—আজ কি তারা সেই হাতকাটা সাধুর দেখা পাবে? যদিও সবাই নিজের চোখের সামনে আনন্দ খুঁজছে, প্রবীণদের মনে গভীর একটা সতর্কতা কাজ করছে। মেলার ডাক যেমন সবাইকে আনন্দে টানে, তেমনই এটি এক অদ্ভুত, অজানা রহস্যের প্রতিও আহ্বান। বাতাসে বাজছে বাঁশি, শিশুরা হাসছে, ক্রেতারা বেচাকেনার মধ্যেই ব্যস্ত, আর সেই একই সময়ে মেলার ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি অদৃশ্য হাতকাটা সাধু—যার উপস্থিতি কেবল বিশ্বাসের উপর নয়, বরং আতঙ্কের গভীর ছায়া ফেলে দিচ্ছে। মেলার এই উচ্ছ্বাসময় সকালে এই অদ্ভুত ছায়ার উপস্থিতি যেন সমস্ত আনন্দের মধ্যে এক ধরনের সজাগ সতর্কতা যোগ করছে, যা পরবর্তী দিনের ঘটনার জন্য ধীরে ধীরে মাটির নীচে জমে যাচ্ছে, প্রস্তুত এক রহস্যময় ঘটনার সূচনা হতে।
অধ্যায় ২ – প্রথম দর্শন
মেলার ভিড়ে কিশোর অমল তার বন্ধুবন্ধবদের সঙ্গে ঘুরছে, চোখে আনন্দ আর কৌতূহলের মিশ্রণ। সে ছোট ছোট খেলনা আর মিষ্টির দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে, নাগরদোলার দিকে তাকিয়ে খুশিতে উল্লাস করছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে মেলার একদম প্রান্তে, যেখানে রঙিন আলো আর মানুষের ভিড় কম। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত চরিত্র—এক হাতকাটা সাধু। অমল প্রথমে ভ্রান্ত হয়, মনে হয় হয়তো এটি কোনো নাটকীয় ভাস্কর্য বা মেলার কোনো অভিনয়। কিন্তু যখন সে তার দিকে এগোতে শুরু করে, তখন স্পষ্ট দেখা যায়—সাধুর গেরুয়া কাপড় জমাটবদ্ধ, চুল জটাজুট করে মাথার উপর উঠেছে, আর দু’হাত সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তার দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে পায় যেন সে অদ্ভুতভাবে দোল খাচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপে হাতের অনুপস্থিতি স্পষ্ট হলেও তার পা শক্ত হাতে মাটিতে জমে আছে। অমলের হৃদয় দ্রুত ধকধক করছে, আশ্চর্য এবং ভয় একই সঙ্গে। লোকেরা সরাসরি তার দিকে তাকাচ্ছে না; কেউ কেউ অদূর থেকে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অমল, যার কৌতূহল সব ভয়ে ছাপিয়ে গেছে, তাকিয়ে থাকলো।
সাধুর চোখ—কোনো হাসি বা রাগের ছাপ নেই, কেবল স্থির নজর। সেই চোখ যেন একরাশ রহস্য আর বেদনার কথা বলছে। অমল ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে চায়, কিন্তু পায়ের গতি থেমে যায় ভেতরের এক অজানা ভয়বোধে। সাধু ঠিক তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন অমলকে স্বাগত জানাচ্ছে বা পরীক্ষা নিচ্ছে। পাশের লোকেরা আতঙ্কিতভাবে সরছে, কেউ আবার লজ্জার মতো মেলার ধোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। অমলের মনে ঘুরছে—কোনো মানুষের পক্ষে কি সম্ভব একা এমনভাবে ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দু’হাত ছাড়া নিজের ভারসাম্য বজায় রাখা? তার মন বলছে, এটি কোনো সাধারণ মানুষ নয়; এটি যেন এক অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতীক। অমল এক মুহূর্তের জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সাধুর দৃষ্টির গভীরে নিজের কৌতূহল মিলিয়ে নিল।
মেলার ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার, হাওয়ার সোঁদা ঘ্রাণ, সবকিছু যেন অচেনা হয়ে গেল এক মুহূর্তে। অমল অনুভব করলো, সাধুর উপস্থিতি শুধু ভয়ে নয়, বরং এক ধরনের আকর্ষণও সৃষ্টি করছে। সে অনুভব করছে, যদি তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, হয়তো আর কখনও এমন সম্ভাবনা পাবেনা। তাই অমল মনস্থ করলো—আজ সে অবশ্যই সেই সাধুর কাছাকাছি গিয়ে দেখবে, সামনের মঞ্চের আলো বা ভিড়ের চাপ তাকে থামাতে পারবে না। সাধুর ফাঁকা হাত, তার দোল খাওয়া পদক্ষেপ, আর স্থির নজর—সবকিছু মিলে অমলের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা জাগিয়ে তুলছে, যা কেবল কৌতূহল নয়, বরং গভীর রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছে। লোকেরা ভিড়ের ভেতর তার চারপাশ থেকে দূরে সরে গেলেও অমল এগোচ্ছে, মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা, ভয়, কৌতূহল এবং রহস্যের মিশ্রণ। এই প্রথম দর্শন, মেলার সেই আনন্দময় ভোরের মাঝে, অমলের জীবনে এক চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে গেল, যা তাকে ধীরে ধীরে সেই অদ্ভুত সাধুর রহস্যের দিকে টেনে নেবে।
অধ্যায় ৩ – অদ্ভুত দৃষ্টি
মেলার কোলাহল, নাগরদোলার ঝকঝকে আলো, বায়োস্কোপওয়ালার চিৎকার, ভাঁপাও মোমো আর জিলাপির গন্ধে মাতোয়ারা সন্ধ্যাটা হঠাৎ থমকে যায় অমলের চোখে ধরা পড়া দৃশ্যে। সে দাঁড়িয়ে ছিল ঝালমুড়ি হাতে, কিরণ তার পাশে, দু’জনেই মেলার আনন্দ উপভোগ করছিল; কিন্তু ভিড় ঠেলে, লণ্ঠনের ম্লান আলো পেরিয়ে, দূরে দেখা গেল সেই অদ্ভুত সাধুটিকে। শরীরে গেরুয়া কাপড়, চুলের জটাগুলো এলোমেলো, চোখদুটো অস্বাভাবিক দীপ্তিতে জ্বলছে। তার দুই হাত নেই, কেবল দু’টো ফাঁকা হাতা বাতাসে দুলছে—যেন সেই শূন্যতা থেকেই কোনো অদৃশ্য শক্তি বেরিয়ে আসছে। অমলের চোখে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা লাগে—কারণ সাধুটি ভিড়ের কারও দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। সে লক্ষ্য করল, সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি হঠাৎ ঘেমে ওঠে, কাঁপতে থাকে, আর নিজের অজান্তেই পিছিয়ে যায়। চারপাশের কেউ যেন প্রথমে বিষয়টি টেরই পায়নি, কিন্তু অমল এবং কিরণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তাই দেখতে পেল সেই ভয়ের দৃশ্য। মানুষের ভিড়ের ভেতরেও সাধুর চোখ যেন আগুনের শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, আর যাকে লক্ষ্য করে তাকানো হচ্ছিল, সে ধীরে ধীরে যেন নিজের ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিল।
সেই রাতটা অমলের ঘুম আসেনি। বারবার চোখে ভেসে উঠেছে সাধুর দৃষ্টি। তার মনে হচ্ছিল, চোখ দুটো কোনো সাধারণ চোখ নয়, যেন শত শত বছরের জমে থাকা আক্রোশ, দুঃখ আর অভিশাপের আগুন সেখানে জমে আছে। পরদিন সকালেই খবর রটে গেল—মেলায় যাকে সাধু তাকিয়ে দেখছিল, সেই লোক হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেছে। তার নাম ছিল পরেশ, সে পাশের গ্রামের লোহার দোকানের মালিক। সকালে তার স্ত্রী চিৎকার করে গ্রামবাসীদের ডেকেছিল, বলেছিল রাত থেকে আর ঘরে ফেরেনি। খোঁজাখুঁজির পরও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। খবর দ্রুত আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজন গোপনে বলাবলি করতে লাগল—“কাল রাতে সাধু তাকিয়ে ছিল, আজ লোকটা উধাও!” ভয়ের শিহরণে গ্রাম কেঁপে উঠল। কেউ কেউ বলল এটা নিছক কাকতাল, আবার অনেকে পুরোনো গল্প মনে করল—যে হাতকাটা সাধু গ্রাম ছেড়ে যেতে না পেরে অভিশপ্ত আত্মা হয়ে মেলায় ভেসে বেড়ায়, আর যার দিকে সে তাকায়, তার জীবন শেষ হয়ে যায়।
অমল এবং কিরণ বুঝতে পারল, এটা নিছক গুজব নয়। তারা নিজের চোখে দেখেছে সেই অদ্ভুত দৃষ্টি, আর তারপরই ঘটেছে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। অমলের বুকের ভেতর ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের কৌতূহলও জাগতে থাকল। সে ভাবছিল, সাধুটি আসলে কে, কেন সে এইভাবে তাকায়, আর কোথায় হারিয়ে যায় যাদের দিকে তার চোখ পড়ে? গ্রামবাসীরা আতঙ্কে মেলায় যাওয়া কমিয়ে দিল, অথচ অমল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল—সে বিষয়টি অনুসন্ধান করবে। এই দৃষ্টি, এই অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়ার রহস্যের পেছনে কোনো না কোনো সত্য আছে। কিন্তু সত্যটা কী? ভয়ের শীতল স্রোত শরীর কাঁপিয়ে দিলেও, অমলের চোখের সামনে ঘুরছিল সেই তীক্ষ্ণ, জ্বলন্ত চোখদুটি—যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ডাকছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার রহস্যের গভীরে।
অধ্যায় ৪ – পুরোনো কাহিনি
মেলার হাটের এক শান্ত কোণায় বসে, অমল প্রবীণ হরিদাস কাকার কথার দিকে মন দিয়ে শুনতে থাকে। হরিদাস কাকা চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং কণ্ঠে সেই দিনের ভয় এবং রোমাঞ্চের মিশ্রণ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, বহু বছর আগে গ্রামের মেলায় এক অদ্ভুত সাধু প্রবেশ করেছিলেন, গেরুয়া কাপড় আর জটাজুট চুলে আবৃত, শান্ত ভঙ্গিতে ভিক্ষা চাইতে। শুরুতে গ্রামের মানুষ তাকে হাসিমুখে দেখেছিল, অনেকেই হয়তো মনে করেছিল এটি কোনো অদ্ভুত ভিক্ষুক, মেলার এক ধরনের নাট্যপ্রদর্শন। কিন্তু কিছুকাল যেতে না যেতেই গ্রামের কিছু লোক তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। তারা ভাবল, এই সাধুর চোখের মধ্যে যেন কোনো অদ্ভুত শক্তি লুকিয়ে আছে, এবং তার উপস্থিতি শুধু আনন্দ নয়, বরং অজানা বিপদের আভাস দিচ্ছে। গ্রামের প্রভাবশালী লোকেরা সিদ্ধান্ত নিল, এই ভিক্ষুকের সঙ্গে কখনো কোনো ঝামেলা না হোক, তাকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সরাসরি কথা বলার বা চলে যেতে বলার পরিবর্তে তারা এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করল—সাধুর দেহে শাস্তি আর ভয় দেখানোর জন্য তাকে হাত কেটে দেওয়া হবে।
হরিদাস কাকা থেমে একবার গভীর শ্বাস নেন, যেন অতীতের স্মৃতি আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, সেই সময় গ্রামের কিছু সাহসী লোক তাকে ধরে এক নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সাধু চুপচাপ ছিল, কোনো শব্দই বের করছিল না, কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শোক এবং শক্তি। গ্রামের লোকেরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল—শাস্তি হিসেবে তার দুই হাত কেটে ফেলতে হবে। এটি ছিল এক ধরনের ভয় দেখানো, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, যে কেউ অচেনা, অস্বাভাবিক এবং অতিপ্রাকৃত হওয়ার চেষ্টা করলে তার ফল ভয়ানক হবে। সাধু যখন তার হাত হারাল, তখন সে শুধুই চুপচাপ থাকল, কিন্তু তার চোখে ঝলসানো আগুন দেখা যাচ্ছিল। কাকা বলেন, সেই মুহূর্তে সে শপথ নিয়েছিল—যে মেলায় তার সাথে এই অন্যায় করা হয়েছে, সেই মেলায় সে প্রতিবার ফিরে আসবে, শুধু মানুষকে দেখার জন্য নয়, বরং তার বিদ্বেষের জন্যও। তার শপথের কথাগুলো এমন ছিল, যেন মেলার আনন্দের মাঝে এক অদৃশ্য আতঙ্কের ছায়া চিরকাল থাকবে।
হরিদাস কাকার চোখে আর্দ্রতা, কণ্ঠে নরম উত্তেজনা। তিনি আরও বলেন, তখন থেকে গ্রামের অনেক মানুষ এই গল্প শুনেছে, অনেকেই দাবি করেছে—মেলায় যে হাতকাটা সাধু ভেসে বেড়ায়, তার চোখে সেই পুরোনো শপথের জ্বলন এখনও আছে। কখনও কেউ তাকে সরাসরি দেখে, আবার কেউ শুধুই তার উপস্থিতির অনুভূতি পায়, যেন কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অমল সেই কথাগুলো মন দিয়ে শুনে, কল্পনার মধ্যে ভেসে যায়—সাধুর চোখ, তার দোল খাওয়া পদক্ষেপ, এবং সেই অদ্ভুত শপথের কথা। মনে হয়, মেলার আনন্দময় চিৎকার, বাতাসের সোঁদা ঘ্রাণ, আর দোল খাওয়া নাগরদোলা—সবকিছু যেন সেই অতীতের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভয়ের এক জটিল নকশা তৈরি করছে। অমল বুঝতে পারে, যা সে দেখেছে তা শুধুই চোখের জোড়া নয়, বরং এক দীর্ঘ ইতিহাসের চিহ্ন, যা প্রতিবার মেলায় ফিরে আসে, শুধু দেখার জন্য নয়, বরং যে সাহস দেখাতে পারবে, তাকে এক গভীর, অদ্ভুত রহস্যের মুখোমুখি করে। এই পুরোনো কাহিনি শুধু অতীতকে বর্ণনা করে না, বরং অমলের মনে আগ্রহ এবং ভয় মিশ্রিত এক অদ্ভুত উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে, যা পরবর্তী মেলার প্রতিটি মুহূর্তকে আরও রহস্যময় করে তুলবে।
অধ্যায় ৫ – আতঙ্কের ছায়া
মেলার রঙিন আলো, শিশুর উচ্ছ্বাস আর ক্রেতাদের চিৎকার—সবকিছু হঠাৎ করে যেন ম্লান হয়ে যেতে থাকে। দিনের ধোয়া এবং মাটির ঘ্রাণের মাঝে ভরা আনন্দ ফিকে হয়ে আসে, আর মানুষের মুখে থাকা হাসি যেন কমে আসে। আগে যেখানে শিশুরা দৌড়াচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ করে ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ে। কিছু মানুষ ভয়ে ভিড়ের ধারে ধারে গা ঢাকা দিতে শুরু করে, কেউ কেউ নিজের ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে ধীরে ধীরে সরে যায়। দোকানিরা ক্রেতার অভাবের কারণে হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর মেলার শব্দে হঠাৎ একটি অদ্ভুত চুপচাপ বিরতি এসে যায়। বাতাসের হালকা সোঁদা ঘ্রাণও যেন বদলে গেছে—মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশেছে হাড় শীতল করা অদ্ভুত ঘ্রাণ, যা গ্রামে বহু বছর ধরে লোকমুখে ভয়ের গল্পের সঙ্গে যুক্ত। অমল এবং তার বন্ধুরা, যারা সকাল থেকে মেলার আনন্দে মগ্ন ছিল, তারা প্রথমবার প্রকৃত ভয়ের মুখোমুখি হয়। তারা বুঝতে পারে, মেলার মধ্যে শুধুই আনন্দ নয়, বরং কিছু অদৃশ্য শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা লোকদের মনে অজানা ভয় জাগাচ্ছে।
রাত নেমে আসে, আর মেলার বাতি-আলোগুলো আগের মতো উজ্জ্বল থাকে না। বাতাসে ভেসে আসে এক অদ্ভুত সুর—ভজনের সুর, যা আগে কখনো শুনেনি কেউ। এই সুর যেন মানুষের রক্তে ভয়ের স্রোত ছড়িয়ে দেয়, হঠাৎ করেই ঘ্রাণের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমস্ত মেলার পরিবেশকে অদ্ভুতভাবে পরিবর্তন করে। লোকেরা আর অনায়াসে হাঁটতে পারে না; তারা জানে, যে স্থানে এই সুর বাজছে, সেখানে উপস্থিতি অদৃশ্য কোনো চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অমল নিজের কণ্ঠও অজান্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়, সে বুঝতে পারে, এখন মেলার আনন্দ নয়, বরং আতঙ্কের ছায়া পুরো গ্রামকে জড়িয়ে ধরেছে। কিছু মানুষ মনে মনে শপথ নেয়, যেন তারা যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরে যাবে, কিন্তু কিছুরা কৌতূহলের কাছে আটকানো—তারা চাইছে, এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হোক। বাতাসের হাওয়া, রাতের অন্ধকার, এবং সেই ভেসে বেড়ানো ভজনের সুর—সবকিছু মিলিয়ে একটি অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি তৈরি করছে।
মেলার মধ্যরাত্রি পৌঁছালে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দোকান বন্ধ, মানুষ নিজ নিজ ঘরে লুকিয়ে, আর কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ানো সেই অদ্ভুত সুর এবং ঘ্রাণের ছায়া ছড়িয়ে আছে। অমল এবং কিছু সাহসী যুবক মেলার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে অনুভব করছে, যেন অদৃশ্য কিছু পদক্ষেপ তাদের চারপাশে নড়াচড়া করছে। তাদের চোখে দৃশ্যমান কিছু নেই, কিন্তু মন জানে—হাতকাটা সাধুর উপস্থিতি এখনও মেলার মধ্যে ঘুরছে। রাতের ঠান্ডা বাতাস, ভেসে বেড়ানো সুর, আর হাড় শীতল করা ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর আভা সৃষ্টি করেছে, যা একদিকে আতঙ্ক জাগাচ্ছে, অন্যদিকে কৌতূহলকে আরও তীব্র করছে। মেলার আনন্দ এবং উৎসবের রঙ যেন অদৃশ্যভাবে ম্লান হয়ে গেছে, এবং সেই হাতকাটা সাধুর ছায়া যেন মানুষের মনে গভীর অস্থিরতার বীজ বপন করছে। অমল জানে, এটি কেবল একটি রাতের ঘটনা নয়—মেলার ইতিহাস এবং সাধুর শপথের ছায়া প্রতিবার একইভাবে ফিরে আসে, এবং এবার সেই ভয় আরও ঘনভাবে গ্রামে ঘুরবে।
অধ্যায় ৬ – প্রমাণের খোঁজে
রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আর মেলার বাতিগুলো দূর থেকে ফিকে আলো ছড়াচ্ছে। অমল এবং তার বন্ধু কিরণ, কৌতূহল আর অজানা ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণে, ধীরে ধীরে মেলার ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। তাদের চোখে শুধুই সেই হাতকাটা সাধুর ছবি ঘুরপাক খাচ্ছিল, এবং মনে এক অদ্ভুত তাড়না জাগছিল—সাধুর রহস্যময় উপস্থিতির প্রমাণ নিজেদের চোখে দেখা। তারা একটি অন্ধকার গলি ধরে এগোতে থাকে, যেখানে অন্য মানুষের পদচারণা কম, এবং হাওয়ার সঙ্গে মিশে আসে হালকা ঘ্রাণ, যা আগের রাতের মতো হাড় শীতল করে দেওয়ার মতো। হঠাৎ অমল লক্ষ্য করে, সাধু ধীরে ধীরে তাদের দিকের দিকে এগিয়ে আসছে। তার গেরুয়া কাপড় ঝুলছে বাতাসে, আর জটাজুট চুলের মধ্যে তার চোখের দীপ্তি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিরণ কাঁপতে কাঁপতে অমলের কাঁধে হাত রাখে, কিন্তু দুই বন্ধু ঠিক বুঝতে পারে—সাধু কোনো সাধারণ মানুষ নয়।
তারা মেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে তার পেছনে চলতে থাকে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের হৃদয় দ্রুত ধুকধুক করছে, আর মনে ভয় এবং উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিল তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ, তারা দেখল, সাধু কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন মাটি তার নিচে গিলে নিয়েছে। অমল চমকে যায়, কিরণও চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু তারা বুঝতে পারল না কীভাবে সে হারালো। তবে এক মুহূর্ত পরে, অন্য দিক থেকে হঠাৎ করেই সাধু আবার হাজির হলো, যেন অদৃশ্য পথ ব্যবহার করে ভ্রমণ করছে। তার পদক্ষেপে কোনো শব্দ নেই, এবং বাতাসে কোনো স্পর্শ নেই—সবকিছু নিখুঁত চুপচাপ। অমল আর কিরণ একে অপরের দিকে তাকায়, মুখে বিস্ময় এবং চোখে বিশ্বাসঘাতকতার ছাপ। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে—কী ধরনের শক্তি বা ক্ষমতা তাকে এমন করতে পারছে, যা মানুষ সহজে করতে পারে না?
ধীরে ধীরে তারা বুঝতে শুরু করে, এটি শুধুই কোনো মেলার দর্শনের আনন্দ নয়, বরং একটি গভীর, অদ্ভুত রহস্যের প্রতিফলন। সাধু কোনো সাধারণ মানুষ নয়; তার দোল খাওয়া পদক্ষেপ, হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া এবং অন্য জায়গায় হঠাৎ উপস্থিতি—সবকিছু মিলিয়ে এটি এক অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা। অমল এবং কিরণ নিজেদের চোখে যা দেখছে, তা কেবল প্রমাণ নয়, বরং ভয় এবং কৌতূহলের এক নতুন মাত্রা যোগ করছে। তারা স্বীকার করে যে, মেলার এই রাত, যা দিনের আলোয় আনন্দময় ছিল, এখন এক রহস্যময় এবং অদ্ভুত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, শুধু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যাবে না—প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া বুঝা সম্ভব নয় যে, এই হাতকাটা সাধুর ক্ষমতা কতোটা ভয়ঙ্কর এবং গভীর। মেলার ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা, সাধুর অদ্ভুত আচরণের পেছনে তাদের অনুসন্ধান একদিকে ভয়, অন্যদিকে এক ধরনের কৌতূহল জাগাচ্ছে, যা ধীরে ধীরে তাদের মেলার আনন্দকে এক চিরস্থায়ী রহস্যময় অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করছে।
অধ্যায় ৭ – অদ্ভুত চিহ্ন
মেলার পরদিন গ্রামে একটি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আনন্দের শব্দ, শিশুদের চিৎকার আর দোকানিদের ক্রেতা-হট্টগোল—সব কিছু যেন অদৃশ্যভাবে লোপ পেয়েছে। মানুষ একে অপরের দিকে ভয়ভীতির সঙ্গে তাকাচ্ছে, কারণ কয়েকজন মেলার পর থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। যারা শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছে, তারা বর্ণনা করতে পারে না কী ঘটেছে—শুধু তাদের ঘরের মেঝেতে এবং দেয়ালে অদ্ভুত চিহ্ন দেখা গেছে। সেই চিহ্নগুলো ছিল একধরনের রক্তমাখা দাগ, যেন কেউ নিজের হাতের পরিবর্তে কাঁধ বা বাহু দিয়ে ঠেলে দিয়েছে। লোকেরা প্রথমে আতঙ্কে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিন্তু ধীরে ধীরে চিহ্নগুলোর গঠন এবং অবস্থান দেখে বোঝা যায়, এটি কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা বা মানুষের দাগ নয়। অমল এবং কিরণ সেই চিহ্নগুলো দেখার পর রোমাঞ্চিত ও ভীত, কারণ তারা জানে, মেলার মধ্যে যে হাতকাটা সাধু ভেসে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গেই এই চিহ্নগুলোর সম্পর্ক আছে।
গ্রামের পণ্ডিত হরিদাস কাকা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি নিখোঁজ মানুষের বাড়ি ঘুরে যাচ্ছেন। তিনি মাটির উপর ও দেয়ালে থাকা রক্তমাখা দাগগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। পণ্ডিত বলেন, “এগুলো সাধারণ রক্তের দাগ নয়, এগুলো অভিশাপের চিহ্ন। যে কেউ এই চিহ্নের সামনে আসে, তার সঙ্গে অতিপ্রাকৃত শক্তির সংস্পর্শ ঘটে।” তাঁর চোখে এক অদ্ভুত সতর্কতা এবং মুখে গভীর ভাব—যা গ্রামের মানুষকে আরও ভয়জাগানিয়া মনে হয়। অমল এবং কিরণ এই চিহ্নগুলো দেখতে পেয়ে কেবল বিস্মিত নয়, বরং তাদের মনে ভয়ের সঙ্গে কৌতূহলও জাগে। তারা বুঝতে পারে, মেলার ভিড়ের মধ্যে যে আনন্দের ছোঁয়া ছিল, তা এখন এক অদ্ভুত আতঙ্কের গল্পে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নিখোঁজ হওয়া মানুষ, রক্তমাখা দাগ, আর পণ্ডিতের সতর্ক বাণী—সব মিলিয়ে গ্রামের মানুষকে এক অদ্ভুত চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
রাত যত গভীর হচ্ছে, আতঙ্কের ছায়া তত বিস্তৃত হচ্ছে। নিখোঁজ মানুষের ঘরে রাতের বেলায় এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসে, হাড় শীতল করা ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে গ্রামে এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছে। অমল ও কিরণ নিজে এগিয়ে গিয়ে চিহ্নগুলো পরীক্ষা করতে চায়, কিন্তু আতঙ্ক তাদের থামাচ্ছে। তারা দেখতে পায়, চিহ্নগুলো এমন স্থানে, যেখানে কোনো সাধারণ মানুষ ছোঁয়াও দিতে পারবে না—দেয়াল এবং মেঝেতে কেবল এমন নিখুঁত দাগ, যেন কারও হাত না থাকলেও কাঁধ বা বাহু দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের পণ্ডিত আরও বলেন, “যে ব্যক্তি এই চিহ্নগুলোকে পর্যবেক্ষণ করবে, তার জীবনে এই অভিশাপের প্রভাব দীর্ঘকাল থাকবে।” এই মুহূর্তে অমল ও কিরণ বুঝতে পারে, হাতকাটা সাধুর উপস্থিতি কেবল মেলার ভিড়ে নয়, বরং গ্রামের প্রতিটি ঘর ও স্থানে এক অদৃশ্যভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অদ্ভুত চিহ্ন এবং নিখোঁজ হওয়া মানুষের ঘটনা গ্রামে এমন এক আতঙ্কের স্রোত জাগাচ্ছে, যা শুধুমাত্র ভয়ের নয়, বরং রহস্যময় কৌতূহলের দ্বারও খুলে দিয়েছে।
অধ্যায় ৮ – মুখোমুখি সংঘর্ষ
রাত গভীর হয়ে এসেছে, আর মেলার ধ্বনি, যা সকালে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা ছিল, এখন নিঃশব্দ হয়ে গেছে। অমল এবং কিরণ, দীর্ঘক্ষণ লুকিয়ে সাধুর অনুসরণ করার পর, অবশেষে সাহস জোগাড় করে তার সামনে দাঁড়ায়। তাদের চোখে ভয়, হৃদয়ে কৌতূহল, আর মাথায় এক অদ্ভুত উত্তেজনার মিশ্রণ। হাতকাটা সাধু, গেরুয়া কাপড় ঝুলানো, জটাজুট চুলের মধ্যে অদ্ভুত স্থিরতায় দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টিতে কোনো হাসি বা বিরক্তি নেই, শুধু নিখুঁত শীতল স্থিরতা। অমল প্রথমে কণ্ঠ কেঁপে উঠলেও জিজ্ঞাসা করে, “আপনি আসলে কে? কেন আপনি মেলায় আসেন?” কিরণও একইভাবে পাশে দাঁড়িয়ে, ভয়ের মধ্যে কৌতূহলকে জাগিয়ে, একই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করে। তাদের মুখে সাহস থাকলেও, শরীর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসে, যেন বাতাস তাদের ভেতরে ঢুকছে এবং রক্তকে জমিয়ে দিচ্ছে।
সাধু কোনো শব্দ নেই, কোনো কথা নেই, কেবল তাকিয়ে আছে। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যা দেখতে পারলেই মনে হয়, সে শুধু একজন মানুষ নয়—বরং অতিপ্রাকৃত এক শক্তির ধারক। অমল এবং কিরণ একে অপরের দিকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে যে কি করা উচিত। তাদের বুক ধড়ফড় করতে থাকে, শ্বাস গ্রহণ যেন বাধাপ্রাপ্ত হয়। চারপাশে মেলার বাতি অচেনা রঙে ঝলসে উঠছে, আর রাতের হাওয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরো পরিবেশে এক অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করছে। তারা বুঝতে পারে, প্রশ্ন করার মাধ্যমে তারা যে সাহস দেখিয়েছে, তা এতই ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু সামনে যে শক্তি দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রতি ভয় এবং সম্মান তৈরি হচ্ছে। কোনো শব্দের অভাবে, শুধু চোখের মাধ্যমে তারা এক অদ্ভুত সংযোগ অনুভব করে—যেন সময় থমকে গেছে, মেলার আলো তাদের চারপাশে অচল হয়ে গেছে, এবং শুধুই এই মুখোমুখি সংঘর্ষের মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বের ভারসাম্য স্থির।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের দিকে চোখ রেখে, শরীর শীতল হয়ে যাওয়া অনুভব করে। অমল এবং কিরণ বুঝতে পারে, সাধু তাদের ভয়ের খেলায় আটকে রাখছে—কোনো উত্তরের জন্য নয়, বরং তাদের সাহস, কৌতূহল এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি পরীক্ষা করছে। রাতের হাওয়া, বাতির ফিকে আলো, এবং মেলার নিঃশব্দ পরিবেশ—সবকিছু মিলিয়ে তাদের মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং উত্তেজনার মিশ্রণ তৈরি করছে। বুক ধড়ফড় করা, হাত শীতল হওয়া, শ্বাস থেমে যাওয়া—সবই এই অদ্ভুত সংঘর্ষের অংশ। যদিও তারা প্রশ্নের উত্তর পায়নি, এই মুহূর্ত তাদের জীবনে এক চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে যায়। মুখোমুখি হওয়া এই সংঘর্ষ শুধু ভয় তৈরি করেনি, বরং তাদের কৌতূহল, সাহস এবং মেলার অদ্ভুত রহস্যের প্রতি আকর্ষণকে আরও তীব্র করেছে।
অধ্যায় ৯ – গোপন রহস্য
মেলার ধীরে ধীরে নেমে আসা রাতে অমল ও কিরণ গ্রামের এক নিস্তব্ধ কোণে বসে ভাবতে থাকে, হাতকাটা সাধুর রহস্য তাদের মনে ভয় এবং কৌতূহলের এক অদ্ভুত মিশ্রণ সৃষ্টি করেছে। ঠিক সেই সময়ে গ্রামের এক বৃদ্ধী, যিনি জীবনের অনেকটা সময় অচেনা পথে কাটিয়েছেন, তাদের কাছে আসে। তার চোখে সময়ের গভীরতা এবং মুখে এক অদ্ভুত সতর্কতা; তার কণ্ঠে এমন ভীতি এবং অভিজ্ঞতার ছাপ, যা শুনলে অজানা ভয় জন্মায়। সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, “শিশুরা, তোমরা যাকে সাধু বলছো, সে আসলে একজন পরিত্যক্ত সন্ন্যাসী। বহু বছর আগে সে গ্রামে এসেছিল, শান্তি এবং ভিক্ষার উদ্দেশ্যে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে অপমান করেছে, অবহেলা করেছে, কখনও কখনও আক্রমণ করেছে। সে কোনো অপরাধ ছাড়াই নির্যাতিত হয়েছিল।” অমল এবং কিরণ কেবল বিস্মিত নয়, তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে যে, এই গল্পের প্রতিটি শব্দ শুধু অতীতের ইতিহাস নয়, বরং তাদের চোখের সামনে যে অদ্ভুত দৃশ্য ঘটছে, তার এক গভীর ব্যাখ্যা।
বৃদ্ধী আরও বলেন, “সে শান্তি পায়নি, কারণ তার হৃদয় ভীষণ আঘাত পেয়েছিল। মৃত্যুর পরও সে নিজের প্রাপ্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারত না। তাই প্রতি বছরের মেলায় সে ফিরে আসে, যেন তার অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার একটি সুযোগ পায়। তার হাত কাটা, তার দোল খাওয়া পদক্ষেপ, হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া—সবকিছুই সেই প্রতিশোধের ছাপ। তবে, সে কোনো অযাচিত মানুষকে আঘাত করতে চায় না, বরং যে তার প্রতি কদর ও সম্মান দেখাবে, সে তাদের ক্ষতি করে না। এই মেলায় তার উপস্থিতি, তার দৃষ্টির শক্তি, এবং অদ্ভুত কর্মকাণ্ড—সবই এক গভীর ব্যথা এবং অতীতের অন্যায়ের প্রতিফলন।” অমল ও কিরণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে, তাদের শরীর শীতল হলেও মনে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস জাগছে, যেন তারা এই রহস্যের অন্তর্নিহিত সত্যের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়েছে।
বৃদ্ধীর কথাগুলো শেষ হবার পর অমল এবং কিরণ বুঝতে পারে, এই হাতকাটা সাধুর রহস্য শুধুই ভয়ের জন্য নয়, বরং এটি এক পুরোনো গল্পের অব্যক্ত প্রতিশোধ। গ্রামের মানুষদের অজ্ঞতার কারণে যে অন্যায় হয়েছিল, তার ছায়া এখনও প্রতিটি মেলার ভেতরে বিদ্যমান। অমল মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, শুধু ভয় পেলে চলবে না, বরং তাকে বুঝতে হবে, তার উপস্থিতি এবং কর্মকাণ্ডের মানে খুঁজে বের করতে হবে। এই গোপন রহস্য, যা অতীতে ঘটে গিয়েছিল, এখন বর্তমান মেলার সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অদ্ভুত কৌশল তৈরি করছে—ভয়, কৌতূহল এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির এক জটিল মিশ্রণ। অমল এবং কিরণ বুঝতে পারে, মেলার আনন্দ এবং আতঙ্কের ভেতরে যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তা কেবল সাহসী চোখই দেখতে পাবে, আর তারা ঠিক সেই সাহসিকতা অর্জন করার পথে রয়েছে।
অধ্যায় ১০ – অভিশাপের পরিসমাপ্তি, নাকি নতুন শুরু?
গ্রামের মন্দিরের অন্ধকারে অমল ও কিরণ ধীরে ধীরে প্রবেশ করে, হাতে মোমবাতি এবং ফুল নিয়ে। তাদের মন কাঁপছে, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আছে—হাতকাটা সাধুর শাস্তি ও অভিশাপের স্রোত থামাতে হবে। মন্দিরের মূল প্রাঙ্গণে পৌঁছে তারা প্রাচীন মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে, যার প্রতিটি শব্দে ভয়ে ভরা বাতাসে যেন এক অদৃশ্য শক্তি প্রতিধ্বনি করছে। অমল এবং কিরণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে সাহস জোগাচ্ছে, এবং এক সঙ্গেই তাদের হৃদয় কেবল শাস্তি ও মুক্তির দিকে ঝুঁকছে। মন্দিরের ভেতরের বাতাস ঘন হয়ে আসে, আর ভেসে বেড়ানো আলো কাঁপতে থাকে। হঠাৎ, তারা শুনতে পায়—এক হাহাকার ভরা চিৎকার, যা শুধু তাদের কানে নয়, বরং মনে গভীর দাগ কেটে যাচ্ছে। এটি সাধুর অভিশাপ এবং বেদনার ছায়া, যা মন্দিরের ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন শেষবারের মতো নিজের মুক্তির জন্য আত্মার ডাক দিচ্ছে।
চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের চারপাশে আলো ঝলমল করতে শুরু করে, মেলার আগের আনন্দের প্রতীকগুলো যেন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। বাতাসে মাটির ঘ্রাণ, মোমবাতির সোঁদা সুবাস, আর ফুলের গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে মন্দিরে এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে। অমল ও কিরণ দৃঢ়ভাবে প্রার্থনা চালিয়ে যায়, নিজের হৃদয় সব সাহস দিয়ে সাধুকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। হাহাকার ভরা ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, আর অদৃশ্য শক্তি যেন শান্তির ছোঁয়া পায়। মেলা আবার রঙিন হয়ে ওঠে, মানুষের মুখে হাসি ফিরে আসে, শিশুদের চিৎকার আর ক্রেতাদের হট্টগোল—সব কিছু আগের মতো প্রাণবন্ত। মনে হয়, অভিশাপের চক্র শেষ, এবং হাতকাটা সাধুর রাগ ও বেদনা এখন শান্ত। অমল ও কিরণ শান্তির অনুভূতি নিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়, মনে ভরসা ও স্বস্তি অনুভব করে।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, দূরের আরেক গ্রামে মেলার বাতাসে এক অদ্ভুত সাড়া শোনা যায়। মানুষের ভিড়ে হঠাৎ চোখে পড়ে, হাতকাটা সাধু আবার ভেসে বেড়াচ্ছে। তার দোল খাওয়া পদক্ষেপ, স্থির দৃষ্টি, এবং অদ্ভুত উপস্থিতি—সব কিছু আগের মতোই রহস্যময়। অমল ও কিরণ বুঝতে পারে, মেলার আনন্দ পুনরায় ফিরে এসেছে, কিন্তু সাধুর ছায়া কেবল একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক ধারা, যা প্রতিটি মেলায় ফিরে আসে, যেন নতুন অভিশাপ, নতুন রহস্য এবং নতুন কৌতূহলের সূচনা ঘটায়। মেলার রঙিন আলো, হাসি আর উচ্ছ্বাসের মাঝে এই অন্তর্নিহিত ভয় এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি যেন অনন্তকাল ধরে চলবে। তারা জানতে পারে, অভিশাপ হয়তো কিছুটা শান্ত, কিন্তু নতুন শুরু সবসময় অপেক্ষা করে—যেখানে সাহসী চোখ ও সাহসী হৃদয়ই সেই রহস্যের মুখোমুখি হতে পারবে।
সমাপ্ত