Bangla - রহস্য গল্প

হাওড়ার হীরের বাক্স

Spread the love

দেবাশিস লাহা


হাওড়া স্টেশন তখনও ভোরের কুয়াশায় ঢাকা, ট্রেনের আওয়াজ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে প্ল্যাটফর্মজুড়ে। ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে মানুষের ভিড় তখনও জমে ওঠেনি, শুধুই কিছু কুলি, এক-আধজন ঘুমন্ত ভিখারি আর স্টেশন মাস্টারের হ্যান্ডল্যাম্পের আলোয় ঝিম ধরা রেললাইন। ঠিক তখনই, সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরের ছায়াঘেরা জায়গায় হঠাৎ দেখা যায় এক লোককে—মাথা ও মুখ ঢাকা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে একটা লাল রঙের ট্রাঙ্ক। কেউ তাকে ভালো করে লক্ষ্য করেনি, শুধু কুলি কানু দে পরে বলেছিল, লোকটা যেন ছায়ার ভেতর থেকে উঠে এসেছিল, আর ওই ট্রাঙ্কটা রেখেই হাওড়ার ঝাঁকুনি মেশানো শব্দের ভেতর মিলিয়ে গেল। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি, এমনকি দু’ঘণ্টা পরেও যখন ট্রাঙ্কটি একই জায়গায় পড়ে ছিল, কেবল তখনই কুলিরা স্টেশন অফিসে জানায়। তৎক্ষণাৎ আসে সাব-ইন্সপেক্টর চন্দ্রশেখর দে, যার হাতে প্রায়ই এমন অব্যাখ্যেয় কিছু পড়ে যায়। কাঁধে রিভলভার, চোখে চিরকালের উদ্বেগ আর মুখে বিরক্তি—এসেই তিনি নিজের মতো করে ট্রাঙ্ক ঘিরে ফেলেন। কাটা চুল, ধুলো ধরা বাহ্যিক অবস্থা, অস্বাভাবিক ভারী ও তালা লাগানো সেই ট্রাঙ্ক খুলতেই যা বেরোয়, তা মুহূর্তে কাঁপিয়ে তোলে গোটা হাওড়া স্টেশন। ভিতরে ছিল একখানা মানুষের কাটা হাত—রক্ত শুকনো, কিন্তু করতলজুড়ে অদ্ভুত ট্যাটু খোদাই—আর তার পাশে রাখা একটি ছোট, সুসজ্জিত হীরার বাক্স। বাক্সটি এমনভাবে উজ্জ্বল, যেন আলো নিজের মুখ তুলে ধরে।

এই অদ্ভুত আবিষ্কারে প্ল্যাটফর্ম যেন থমকে যায়। পুলিশ গার্ড ঘিরে ফেলে এলাকা, মিডিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ে যেন আগুন। সকাল ৭টার মধ্যেই পৌঁছে যায় অভিজিৎ মুখার্জী—‘কলকাতা ক্রনিকল’-এর ক্রাইম রিপোর্টার। গায়ের সোয়েটার খুলে কাঁধে ফেলে, গলায় ঝোলানো ক্যামেরা আর চোখে গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—অভিজিৎ বরাবরই খোঁজেন সেসব কেস যেগুলোতে যুক্তি আর ইতিহাসের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটে। কেসটার খবর সে পেয়েছিল এক পরিচিত রেলকর্মীর ফোনে—“ট্রাঙ্কের ভিতর কাটা হাত, দাদা… আর একটা হীরার বাক্স! কোনো রহস্য আছে।” অভিজিৎ বুঝেছিল, এমন কেস হাতছাড়া করা চলে না। ঘটনাস্থলে পৌঁছে সে দেখে, চন্দ্রশেখর দে বেশ বিরক্ত মুখে স্টেশন ইন্সপেক্টরদের বকুনি দিচ্ছেন। প্রথমে তাকে পাত্তা না দিলেও, অভিজিতের বিশ্লেষণী চোখ দেখে শেষমেশ চন্দ্রশেখর নিজেই বাক্সটি তার হাতে তুলে দেন—“এটা দেখে বলুন তো, কী মনে হচ্ছে?” বাক্সটি ছিল সত্যিই দুর্লভ। খোদাই করা ছিল এক অদ্ভুত প্রতীক—যেটা দেখে অভিজিৎ মুহূর্তে বুঝে যায়, এই কেস কেবল খুন বা পাচার নয়, এর সঙ্গে জড়ানো আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য—আর হয়তো অভিশাপও।

এরপর পুলিশ নিয়ে যায় কাটা হাত ও বাক্সটিকে ফরেনসিক টেস্টের জন্য, কিন্তু অভিজিৎ বসে থাকে হাওড়া স্টেশনেরই এক কোণে—স্টল থেকে চা নিয়ে ঘন ঘন সিগারেট টানতে টানতে সে ভাবতে থাকে, এই ‘অচেনা ট্রাঙ্ক’ কে রাখলো? কেন এমন একটা চিহ্নযুক্ত হীরার বাক্স সঙ্গে করে নিয়ে কেউ নিজের পরিচয় ঝুঁকিতে ফেলবে? ট্রাঙ্কের ভার—অতিরিক্ত, যা বোঝায় ভিতরে আরও কিছু থাকতে পারে—কিন্তু সেটি বের করা হয়নি। রাত তখন নামছে ধীরে ধীরে, কুয়াশা আবার গাঢ় হচ্ছে। চন্দ্রশেখর তখন চলে গেছেন থানায়, বাক্সটি পুলিশ হেফাজতে। অভিজিৎ একবার চোখ মেলে দেখে সিসিটিভি মনিটরে সেই রহস্যময় ছায়ামূর্তি—যার হাঁটার ভঙ্গি যেন কোনো সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ব্যক্তির। তার চলার ছন্দ, বাক্স রাখার সময় ঘাড় না ঘোরানো, কোনও শব্দ না করা—সবকিছু এক সুনিপুণ পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। ঠিক তখনই প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত থেকে ঘুরে আসে সেই কুলি—স্টেশন কানু। তার চোখে আতঙ্ক, কণ্ঠে কাঁপুনি—“সাব… ঐ বাক্স আমি আগেও দেখেছি… বছর তিরিশ আগে… এক লোকের মৃত্যু হয়েছিল… তার হাতটাও এমনই ছিল।” অভিজিৎ থমকে দাঁড়ায়। হাওড়ার কুয়াশার মধ্যে, ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে—কিন্তু এবার যেন সেটা শুধু যাত্রার নয়, এক অজানা অতীতের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

হাওড়ার কনক্রিটের কোলাহল এবং ধোঁয়াটে আলোয় দাঁড়িয়ে অভিজিৎ মুখার্জী অনেকটা সময় ধরে চিন্তা করে যাচ্ছিলেন। তাঁর অভ্যাস—প্রতিটি কেসের সূচনা হয় দৃষ্টিভঙ্গি বদলে। সংবাদ নয়, সত্যকে কেন্দ্র করে। স্টেশন ক্যান্টিনের ধারে বসে তিনি তার পুরোনো রিপোর্টারের খাতা খুলে বসেন, যেখানে লেখা—“কোনো ট্রাঙ্ক নিজে নিজে কথা বলে না, কিন্তু সে দেখিয়ে দেয় কে কথা লুকিয়ে গেছে।” তার চোখ পড়ছিল সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়া ছায়ামূর্তির দিকে। মুখ ঢাকা, মাথায় ক্যাপ, একটা সাধারণ হ্যাভারস্যাক কাঁধে ঝোলানো। কিন্তু তার হাঁটা—একেবারে নিখুঁত মাপজোক করা, যেন কোনোরকম হোঁচটের সুযোগই নেই। অভিজিৎ একবার ঠোঁটের কোণে সিগারেট রেখে ক্যামেরার ফুটেজ থামিয়ে বলে ওঠে, “চন্দ্রদা, আপনার কি মনে হয় এ লোকটা কোনো চোরাপথে চলেছে?”
চন্দ্রশেখর দে, যার পুলিশের অভিজ্ঞতা প্রায় কুড়ি বছরের, মাথা নাড়িয়ে বলে, “না মশাই, এ কোনো সাধারণ লোক নয়। ধরা পড়ার ভয় ছিল না, তাই সে সোজাসুজি এসে ট্রাঙ্কটা রেখে গেছে। এমন নির্ভরতা শুধু তখনই আসে যখন কেউ জানে কেউ তাকিয়ে নেই—অথবা তাকিয়ে থাকলেও কিছু করতে পারবে না।” কথাটা শোনামাত্র অভিজিৎ যেন কিছু একটা ধরে ফেলে। তার মনে পড়ে যায় কলকাতার পুরনো এক কেস—২০১৭ সালে, শিয়ালদহ স্টেশনে একই রকম এক বাক্স পাওয়া গিয়েছিল, যাতে কাটা ছিল একটি পায়ের পাতা—আর তার পাশে ছিল একটা ছায়াছবির পোস্টার, যেখানে লেখা ছিল—“লুকিয়ে থেকো না।”
এ কেস কি সেই ধারারই পরবর্তী অধ্যায়?

তদন্তের প্রথম ধাপ হয় ট্রাঙ্কটির গায়ের চিহ্ন শনাক্ত করা। অভিজিৎ নিজে থানা হয়ে যায় রেলওয়ে ওয়্যারহাউজ পর্যন্ত, যেখানে পুরনো ট্রাঙ্ক বা লাগেজ সিস্টেমের হিসাব রাখা হয়। সেখানকার এক বৃদ্ধ কর্মচারী বলেন, “এই ধরণের লাল লোহার ট্রাঙ্ক আমরা ১৯৮৫ সালের পর ব্যবহার করি না।” তাহলে এটি পুরোনো—খুবই পুরোনো। তখনই অভিজিৎ একটি তথ্য পান—গত মাসেই হারিয়ে গিয়েছিল একটি হীরার পুরাকীর্তির বাক্স, যেটি নাকি মিউজিয়ামে যাওয়ার পথে ছিল, তবে রেকর্ড অনুযায়ী তা নাকি পৌঁছেছিল ঠিকঠাক। মজার ব্যাপার হলো, সেই রিপোর্টটি পাঠিয়েছিল এক অচেনা নাম—‘বি. রহমান’। নামটি মেলে না কোনো সরকারি রেকর্ডে, এবং তা পুলিশের ফাইলেও নেই। এই নাম খুঁজতে গিয়ে অভিজিৎ অনলাইনে ঢুকে পড়ে এক পুরনো রেলঘটনার মধ্যে—১৯৯৪ সালে, হাওড়া থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে এক রেলগাড়ি থেমে যায় বারুইপুর স্টেশনের ঠিক আগেই, কারণ হঠাৎ এক যাত্রীর গলায় দড়ি পাওয়া গিয়েছিল। সেই কেসের তদন্ত রিপোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন একজন রতন রুইদাস—কারিগর, হীরার বাক্স বানাতেন। আর সেই রুইদাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন এক হীরালাল রুইদাস—যার নাম উঠে এসেছিল আগের রাতে, খোদ স্টেশন কুলি কানুর মুখে। অভিজিৎ ঠিক করলেন, এতদিন ধরে লুকিয়ে থাকা রহস্য একে একে জড়ো হচ্ছে, এবং সেই জট একমাত্র খুলতে পারে অতীতের ছায়াদের মুখোশ খুলে।

সন্ধ্যাবেলা আবার দেখা হয় চন্দ্রশেখরের সঙ্গে। হাওড়া জিআরপি অফিসে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। একঘণ্টা বিশ্লেষণের পরও অচেনা ব্যক্তির মুখ পরিষ্কার নয়। কিন্তু অভিজিৎ লক্ষ করে, ট্রাঙ্ক রাখার সময় লোকটি একবার তার ডান হাতের কবজির কাছটায় ঘষেছিল, যেন সেখানে কিছু চাপা দিচ্ছে। জুম করে দেখা যায় একটি খুব সূক্ষ্ম ডিজিটাল ঘড়ি, যার ব্র্যান্ড চেনা যায় না। “এটা সামরিক বাহিনীর স্পেশাল অপস ঘড়ির মতন…,” বলে ওঠেন এক পুলিশ অফিসার। চন্দ্রশেখর একটু ঠোঁট কামড়ে বলেন, “তাহলে কি এর পেছনে কোনো আন্তর্জাতিক হাত?” অভিজিৎ তখনও চুপচাপ, শুধু তার নোটবুকে লিখে যায় একটা লাইন—“সে জানত সে নজরে আসবে। হয় সে ভয় পায় না, নয় সে জানে, সে অদৃশ্য।” সেই রাতে হাওড়ার আকাশে কুয়াশা নেমে আসে একটু বেশি ঘন হয়ে। কিন্তু স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ৯-এর ঠিক পেছনে, পরিত্যক্ত ওয়েটিংরুমের গায়ে একটা কালো ছায়া যেন দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ—আর তারপর নিঃশব্দে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।

হাওড়া থানার আলোকসজ্জার নিচে রাখা সেই ছোট হীরার বাক্সটি যেন অন্য কিছুর চেয়ে আলাদা ছিল — যেন কোনো সাধারণ বস্তু নয়, বরং এক নিঃশব্দ নরকদূত, যে যতক্ষণ না তার ইতিহাস কেউ পড়ে ফেলে, ততক্ষণ নির্বাক থেকে যায়। পুলিশ সেটিকে একটি বিশেষ কাঁচের ভিতরে রেখেছে, যেখানে রঙিন আলোয় তার পৃষ্ঠের খোদাই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অভিজিৎ প্রথমেই খেয়াল করে—বাক্সটির গায়ে অদ্ভুত এক প্রতীক খোদাই করা, যেটি সাধারণ ধর্মীয় চিহ্ন নয়, বরং অনেকটা কাব্যালিপির মতো। পাশাপাশি পাতলা সোনালি রেখায় খোদাই করা আছে দুটো জ্যামিতিক আকৃতি — একটা অর্ধেক চাঁদের মতো বাঁকানো, আরেকটা যেন তলোয়ারের মতো ছুঁচলো, যার কিনারায় লেখা আছে কিছু অদ্ভুত হরফে, যা বাংলা, উর্দু বা আরবি—কোনো নির্দিষ্ট ভাষায় পড়ে না। চন্দ্রশেখর এইসব দেখে মুখ ভেংচায়, “এইসব বিদেশি ঢং বুঝি না মশাই, আপনি যদি বলেন এটা সোনা নয়, তাহলে আমাদের গায়ে হাত পড়বে।”
অভিজিৎ বুঝতে পারে, এবার সময় এসেছে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়ার। তার মনে পড়ে শ্রেয়া রায়ের কথা — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক, যিনি মুঘল আমলের রত্ন ও রাজস্ব সিল সম্পর্কিত কাজে পিএইচডি করছেন। ভোররাতেই সে ফোন করে শ্রেয়াকে — “তুমি একটা বাক্স দেখতে চাও? যার গায়ে এমন প্রতীক খোদাই করা যেটা শাহজাহানের রাজকোষে পাওয়া মোহরের মতো?” শ্রেয়া প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, তবে অভিজিতের গলায় এমন কিছু ছিল যা চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না।

দুপুরে শ্রেয়া থানায় এসে বাক্সটি পরীক্ষা করে। ছোটখাটো গড়নের মেয়ে, চোখে ফ্রেমহীন চশমা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি অবিশ্বাস্য রকমের তীক্ষ্ণ। হাতে দস্তানা পরে, ফিনিক্স হাল্কা আলোয় তুলে নেয় বাক্সটি। কয়েক মিনিট খুঁটিয়ে দেখে সে বলে ওঠে, “এই খোদাই কোনো সাধারণ শিল্পীর কাজ নয়। এগুলো মুঘল সাম্রাজ্যের Shamsher-e-Murassa ঘরানার নিদর্শন হতে পারে। এটা হীরা দিয়ে মোড়ানো অস্ত্রের বাক্স ছিল, যেখানে ক্ষুদ্র অথচ পবিত্র কোনো বস্তু রাখা হতো—হয়তো কোনো মৃত সম্রাটের অংশবিশেষ কিংবা এমন কিছু যা ধ্বংস করা যায় না, শুধুই গোপন রাখা যায়।” চন্দ্রশেখর যেন গলায় কাঁটা ফোটে, “মানে, এটা কি কোনো দেহাংশ রাখার বাক্স?” শ্রেয়া মাথা নেড়ে বলে, “হয়তো, অথবা তার থেকেও বেশি কিছু। এই খোদাইয়ের নিচে যে রাশি দেখা যাচ্ছে, সেটা হিজরি ১০৫৮—মানে ১৬৪৮ সাল। এ বছরেই সম্রাট শাহজাহান আগ্রার দুর্গে বন্দি হন। সেই সময়কার রাজ্য কোষাগার থেকে যদি কিছু হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার একটা চিহ্ন হয়তো এই বাক্স।”

এইসব শুনে থানার বাতাস একেবারে থমথমে হয়ে ওঠে। যে কেসটা তারা ভেবেছিল খুন আর পাচারের ঘটনা, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের গোপন অধ্যায়—সম্রাট, মৃত্যু আর ধনসম্পদের অতল গহ্বরে প্রবেশের প্রাক্কালে। ঠিক সেই সময়েই থানার অফিসার ঢুকে চেঁচিয়ে ওঠে—“স্যার, বাক্সটা নাই!” সবার দৃষ্টি ঘুরে যায়। সেই কাঁচঘরের ভিতর, যেখানে বাক্সটি রাখা ছিল, এখন কেবল শূন্যতা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় না কেউ ঢুকেছে। অথচ দরজা বন্ধ, জানালাও লক করা। মনে হয়, বাক্সটা যেন নিজেই কোথাও গায়েব হয়ে গেছে। চন্দ্রশেখরের গলা শুকিয়ে আসে, অভিজিৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর শ্রেয়া ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “এই বাক্স হয়তো চুরি হয়নি, এটা হয়তো তার জায়গা খুঁজে নিচ্ছে।” বাক্সটির প্রকৃত ইতিহাস কী? কে আবার এটিকে ফেরত নিয়েছে? নাকি বাক্সটির সঙ্গে সত্যিই জড়িয়ে আছে এমন কোনো অশরীরী অভিশাপ, যা তার মালিককে খুঁজে বেড়ায় যুগের পর যুগ ধরে?

হাওড়া থানার ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা। বাইরে মেটাল প্ল্যাটফর্মের নিচে হাওয়া বেয়ে আসে হালকা শিস বাজিয়ে, যেন হঠাৎ কোথা থেকে একটা ট্রেন ঢুকছে না বেরোচ্ছে—অথচ রেল টাইমটেবিলে সে সময় কোনো ট্রেন ছিল না। কাচের ঘর ফাঁকা, হীরার বাক্স নেই। চন্দ্রশেখর কিছুক্ষণের জন্য নিজের কপাল চেপে ধরে বসে থাকেন। শ্রেয়া থামতে চায় না—তার হাতে পুরনো রাজপ্রাসাদ সংক্রান্ত মুঘল প্রত্নতত্ত্বের তিনটি বই, যার পাতায় পাতায় সে মিলিয়ে দেখতে চাইছে খোদাইয়ের অর্থ। অভিজিৎ কিন্তু ভিন্নদিকে যাচ্ছে। তার মাথায় ঘুরছে সেই লোকটার মুখ—যে মুখ ঢাকা রেখে ট্রাঙ্কটা রেখে গেল, যার শরীরের চালচলন এক সামরিক লোকের মতো সুশৃঙ্খল। অথচ কেউ তাকায়নি তখনও। সে ভাবে—এতটা নিখুঁতভাবে কিছু গায়েব হতে পারে না যদি না কেউ আগে থেকেই জানে কোথায় কী আছে, আর কোথায় কী নেই। তখনই ফোন আসে — স্টেশন কুলি কানুর।

“সাব… আপনি আসবেন? আমি ওই বাক্সটা আগেও দেখেছি বলেছিলাম না? আমি ভুল বলিনি… প্ল্যাটফর্ম ১১-এর পেছনে যে পরিত্যক্ত স্টোরঘর, সেখানে আমি একটা সিন্দুক দেখেছি, ঠিক এমন বাক্সের পাশে, ত্রিশ বছর আগে। সে রাতে যে ঘটেছিল… তারপরে ঘুমাতে পারি না।”
অভিজিৎ কিছু না ভেবে সোজা রওনা দেন হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ১১-এর দিকে। সঙ্গে নেয় চন্দ্রশেখরকেও। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটা ছুঁইছুঁই, কিন্তু কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্ল্যাটফর্ম যেন ভিন্ন কোনো সময়ের অংশ। কেউ নেই, শুধু এক কোণে বসে থাকা কানু—ভূতুড়ে ছায়ার মতো। তার গায়ে মোটা চাদর, মুখ ধরা চোয়ালে ক্লান্তি আর ভয়ের ছাপ। “জানেন দাদা,” শুরু করে সে, “১৯৯৩ সালের এক ডিসেম্বরের রাত ছিল। এক লোক—সাদা ধুতি আর শাল গায়ে, মুখ ঢাকা, এসে একটা বাক্স রেখে দেয় ঠিক এই স্টোরঘরের পাশে। আমি আর মদন কুলি ছিলাম—ভেবেছিলাম কেউ ভুলে রেখে গেছে। রাতে ঠান্ডায় বসে থাকার সময় আমরা তাকাই সেই বাক্সটার দিকে—আলোয় চকচক করছে, ঠিক আজকের মতো। তারপর দেখি মদন একা চলে যাচ্ছে বাক্সটা খুলতে। কিছু বলার আগেই—মনে হলো যেন কেউ তাকে কিছু দেখিয়েছে। তার শরীরটা একেবারে জমে গেল। আমি চিৎকার করেও কিছু করতে পারিনি। মদনের দেহ পরে পাওয়া গেল ওভারব্রিজের নিচে, আর হাতটা ছিল না… ঠিক যেমন ওই ট্রাঙ্কে ছিল।”

অভিজিৎ থমকে যায়। “তাহলে তুমি সেই বাক্সের মতোই বাক্স আবার দেখেছ।”
“হ্যাঁ,” বলে কানু, “আর বিশ্বাস করেন বা না করেন, সেদিন মদন মারা যাওয়ার আগে একটা কথা বলেছিল—‘বাক্সটা কেউ ডাকে… আর যে ডাকে, সে ফেরে না।’”
এই ভৌতিক কথাগুলো পুলিশের কাছে হাস্যকর মনে হলেও, অভিজিতের মনে হয়—হয়তো কাহিনিতে কল্পনা আর বাস্তব মিশে গেছে এমনভাবে, যার ব্যাখ্যা এখনো বিজ্ঞান দিতে পারে না। সে প্ল্যাটফর্মের পেছনের সেই পুরনো ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা বন্ধ, কিন্তু তালা খুলতে দেরি হয় না। ভিতরে ঢুকে সে দেখে—পুরনো কাঠের সিন্দুক, ধুলোয় ঢাকা। আলো ফেলতেই দেখা যায়, এক পুরনো কাপড় মোড়ানো কাঠের বাক্স—অনেকটা সেই ট্রাঙ্কের মতো। অভিজিৎ জোর করে সেটা তোলে, খুলে দেখে—কোনো হাত নেই, কিন্তু ভিতরে পাওয়া যায় এক পাথরের সিল—যেখানে খোদাই করা ঠিক সেই প্রতীক, যা সেই হীরার বাক্সে ছিল।

এই দৃশ্য দেখে চন্দ্রশেখরের মুখ সাদা হয়ে যায়। শ্রেয়াকে খবর দেওয়া হয়—সে এসে দেখে, এই সিলটি আসলে সেই “শাহী রক্তমোক্ষ” সিল, যেটি শুধুমাত্র রাজপরিবারের মৃত সদস্যদের দেহাংশ বা গোপন নিদর্শন রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো। আর এর মানে দাঁড়ায়—বাক্সটি কোনো কিছুর কনটেইনার নয়, বরং একটি হত্যার স্মারক, একটি কালো অভিশপ্ত উত্তরাধিকার, যা কেবল ইতিহাসের নয়, বরং জীবন্ত বিপদ।
স্টেশন কুলি কানু চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “ওর ভিতর থেকে আবার ডাক আসছে… সাব, আপনি গেলে আর ফিরবেন না।”

স্টেশন কানুর সেই কথাটা, “ওর ভিতর থেকে ডাক আসছে… আপনি গেলে আর ফিরবেন না”—এই লাইনটা যেন অভিজিৎ মুখার্জীর মস্তিষ্কে অজস্র শব্দের গুঞ্জন তুলে দেয়। সে জানে, আতঙ্ক থেকে মানুষের মনে কল্পনা দানা বাঁধে, কিন্তু একাধিক ঘটনার মধ্যে যদি মিল থাকে, ইতিহাস বারবার একইভাবে ফিরে আসে, তবে তাকে আর কাকতালীয় বলা চলে না। প্ল্যাটফর্ম ১১-এর পুরনো স্টোররুম থেকে পাওয়া সেই পাথরের সিল, আর সিন্দুকের পাশে খোদাই করা প্রতীক—সবই স্পষ্টত এক জায়গার দিকে নির্দেশ করছে, যা সাধারণ মানুষের নজর এড়িয়ে গেছে। সেই রাতে অভিজিৎ নিজে শ্রেয়া ও চন্দ্রশেখরকে নিয়ে ফেরত যায় তার বাড়িতে, কারণ সে একটা কেসফাইল খুঁজে বার করতে চায়—২০১২ সালে সে লিখেছিল এক অপরাধ ইতিহাস সিরিজ, যার এক পর্বে উল্লেখ ছিল, আগ্রা থেকে কলকাতায় পাঠানো এক ব্রিটিশ রেল অফিসার হার্টলে উইলসনের ব্যক্তিগত চিঠি, যেখানে সে লিখেছিল, “কলকাতায় পৌঁছনোর আগেই সেই রহস্যময় বাক্সটা নিজে থেকেই ট্রেনের খোলা জানালায় পড়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই কামরায় আগুন ধরে যায়।” সে চিঠি পড়ে অনেকে বিষয়টিকে অলীক ভেবেছিল, কিন্তু আজকের ঘটনার পরে, সেই চিঠির ভাষা যেন ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শ্রেয়া তখন বলে, “আমার বিশ্বাস, এই খোদাই ও প্রতীক আসলে রাজকীয় কোষাগারের ব্যক্তিগত চিহ্ন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে একটা নথি দেখেছিলাম যেখানে বলা আছে, শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাঁর ব্যক্তিগত কিছু রত্ন এবং ধর্মীয় বস্তু গোপনে একটি সিন্দুকে ভরে দিল্লি থেকে নদীপথে পাঠানো হয়েছিল কলকাতায়, কারণ তখন ইংরেজরা আগ্রায় ঢুকে পড়ছিল।” এই তথ্য শুনে চন্দ্রশেখর অবাক হয়ে বলে, “তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন এই ট্রাঙ্কের ভিতরের বাক্স সেই মুঘল রাজপরিবারের কোনো গোপন রত্ন বহন করছিল?” শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে বলে, “তা শুধু নয়… আমার মনে হয়, এটিতে হয়তো এমন কিছু ছিল, যা একদম শারীরিক—হয়তো কোনও দেহাংশ, হয়তো কারও দাঁত, কিংবা হৃদপিণ্ড পর্যন্ত। ঐতিহাসিকরা বলেন, কিছু কিছু সুলতান বা সম্রাটের দেহাংশ ‘অভিষেক রত্ন’ নামে রক্ষা করা হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন, এর মাধ্যমে পরবর্তী শাসকের উপর প্রভাব পড়বে।” চন্দ্রশেখর স্পষ্টতই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও অভিজিৎ তখন অনেক শান্ত—তাঁর মনে হতে থাকে, কেসটা হয়তো তার জীবনের সেরা… এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক।

পরদিন সকালে শ্রেয়া অভিজিৎকে নিয়ে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন নথি বিভাগের নিচতলার আর্কাইভে। ঘরের দেওয়ালজুড়ে পুরনো মানচিত্র, কাঁচের আলমারিতে ধুলো ধরা খাতা, আর এক কোণায় রক্ষিত রয়েছে ‘ইন্ডো-মুঘল করেসপন্ডেন্স বুক’। প্রায় এক ঘণ্টার খোঁজাখুঁজির পরে তারা পায় সেই পৃষ্ঠাটি—যেখানে ১৬৪৯ সালের এক রাজকীয় ঘোষণাপত্র রয়েছে। সেখানে লেখা: “জেনারেল নাসির খাঁন এবং দ্য কারিগর হীরালাল রুইদাসকে দায়িত্ব প্রদান করা হইল রাজকীয় অন্ত্যোষ্ঠির হীরার বাক্স নির্মাণ ও রক্ষার জন্য। তাহার ভিতরে থাকিবে সম্রাটের অভিষিক্ত দেহাংশ এবং তিনটি হিরে, যাহা কেবল রাজ্যের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে ব্যবহৃত হইবে।” অভিজিৎ পড়া থামিয়ে শ্রেয়ার দিকে তাকায়—তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের এক অন্ধকার, অথচ ঝকঝকে টুকরো। এই হীরালাল রুইদাসই কি সেই কারিগর যার নাম কুলি কানু বলেছিল? আর সেই অভিষিক্ত দেহাংশ—তা কী?

আলো ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। চন্দ্রশেখর থানায় জানায়, আগের রাতে পাওয়া সিল ও সিন্দুক কলকাতার জাদুঘরের নিরাপত্তা গুদামে পাঠানো হয়েছে রক্ষণের জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অভিজিৎ জানতে পারে—সেই গুদামে পৌঁছানোর আগেই ট্রাক উধাও হয়ে গেছে, এবং তার চালক অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল হেস্টিংস ফ্লাইওভারের নিচে। তার স্মৃতিশক্তি প্রায় মুছে গেছে, শুধু একটাই কথা বলে—“গাড়িতে কেউ ছিল না… কিন্তু আমার মাথার ভিতর কেউ কথা বলছিল… যেন বলছিল, ‘এটা আমার, ফেরত দাও।’” অভিজিৎ আর চন্দ্রশেখরের গায়ে কাঁটা দেয়—ব্যাখ্যা যাই হোক, সত্যটা হলো—হীরার বাক্স এখন আবার কারও হাতে… কিন্তু কার? অভিশপ্ত কোনও উত্তরাধিকারীর? না কি এমন কারও, যিনি ইতিহাসের আড়ালে নিজের উপস্থিতি লুকিয়ে রেখেছেন দীর্ঘ সময় ধরে?

হীরালাল রুইদাসের নামটি এখন কেবল একটি ইতিহাসের পাতা নয়, বরং জীবন্ত এক রহস্যের সাপের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে অভিজিতের মাথায়। সে ঢুকে পড়ে আরও গভীরে—পুরনো নথি, মানুষের সাক্ষ্য, এবং নিঃশব্দ স্মৃতিতে, যা তার জীবনে এত দিন ধরে থাকা এক ধূলিমাখা কেসকে নতুন করে চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। হাওড়া থেকে প্রায় পঁইত্রিশ কিলোমিটার দূরে, বর্ধমান জেলার এক ছোট গ্রামে রুইদাস পরিবারের বাড়ি এখন অর্ধ-ধ্বংসপ্রাপ্ত। স্থানীয়দের কথায়, সেখানে আগুন লেগে গিয়েছিল বছর তিরিশ আগে, আর তারপর থেকে সেই জায়গা যেন মায়াবী অভিশাপে আচ্ছন্ন। অভিজিৎ, চন্দ্রশেখর, ও শ্রেয়া মিলে সেই গ্রামে পৌঁছান, যেখানে গ্রামবাসীর মধ্যে এখনও ছড়িয়ে আছে ‘হীরালালের অভিশাপ’ নামে একটি কিংবদন্তি। গ্রামের এক বৃদ্ধা বললেন, “রুইদাস পরিবারের কারিগররা ছিলেন দুনিয়ার সেরা, কিন্তু ওরা কখনো নিজেদের কাজ বাইরে প্রকাশ করত না। কেউ বলে, হীরালালের মৃত্যুর পর থেকেই সেই অভিশাপ গ্রামে নেমে এসেছে—যে যাকে ওই বাক্স নিয়ে আসে, তার ভাগ্য তারাই খারাপ।”

গ্রামের পুরনো পুকুরের ধারে তারা খুঁজে পায় এক অর্ধশত বছরের পুরনো খাতা। খাতার পৃষ্ঠাগুলো বর্ণময় এক জগৎ খুলে দেয়—দৈনিক জীবনের গল্প, কারিগরদের টুলস, আর একটি বিশেষ অংশে হীরালালের হাতে আঁকা বেশ কিছু নক্সা, যেগুলো হীরার বাক্সের গঠন ও আকারের সঙ্গে অবিকল মিলে যায়। এই নক্সার মাঝেই একটি রহস্যময় প্রতীক বার বার ফুটে ওঠে—একটি চার পেটা ফুল, যার কেন্দ্রে সোনালি রঙের ছোট একটা পাথর আঁকা। শ্রেয়া তা দেখে মুগ্ধ হয়, “এটা কেবল নকশাই নয়, এটি এক ধরনের সাংকেতিক বার্তা। হীরালাল সম্ভবত এই প্রতীক দিয়ে নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে সংকেত দিচ্ছিলেন।”

অভিজিতের মন তখন ক্রমেই জোরালো হয়—এই বাক্স কেবল একটি বস্তু নয়, এটি এক ‘উত্তরাধিকার’ যার সঙ্গে কারও জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক আছে। তদন্ত করতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, হীরালাল রুইদাস কেবল কারিগর ছিলেন না, তিনি ছিলেন সেই সময়কার এক গোপন সংগঠনের সদস্য, যারা মুঘল সাম্রাজ্যের অমূল্য ধন-সম্পদ রক্ষা করত। সেই সংগঠনের গোপন ডায়েরি তাদের হাতে আসে, যেখানে লেখা ছিল, “যে বাক্সে রাজা-সম্রাটের রক্ত বাঁধা, তার রক্ষাকর্তা ছাড়া কেউ কখনো সেই বাক্সে হাত দিবে না।” আর সেই বাক্স নিয়েই অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে—বাক্সের অভিশাপের কথা তখন সবাই জানত।

অন্ধকার রাতে হাওড়ার স্টেশনে ফিরে এসে অভিজিতের মাথায় ঝকঝক করে নতুন এক তথ্য—একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম পাওয়া গেল, যিনি সম্প্রতি কলকাতার একটি পুরনো বাড়িতে নজরদারি করছিলেন। তাকে শনাক্ত করা গেল—তার নাম ‘অরিন্দম সান্যাল’। পুলিশ তার ঠিকানা তলব করে, কিন্তু সে যেন নিখোঁজ। সবকিছু মিলিয়ে বোঝা যায়, এই রহস্য শুধুমাত্র হাওড়া স্টেশনের ট্রাঙ্ক ও হীরার বাক্সের বাইরের গল্প নয়; এটি এক প্রাচীন চক্র, যার শিকারে এখনও রয়েছে অনেক মানুষ।
এই মুহূর্তে অভিজিত বুঝতে পারেন, খেলা শুরু হয়ে গেছে; আর সেটার পরিণাম হয়তো রক্তাক্ত।

কলকাতার সোনাগাছির গলির আঁকাবাঁকা পথে এক নিঃসঙ্গ বৃষ্টি পড়ছিল। শহরের রং ছেয়ে যাওয়া পলেস্তারা, ঝাঁঝালো আলো আর দূর থেকে বাজতে থাকা লাঠির শব্দ—সব মিলিয়ে যেন এই রহস্যময় শহরটাকে আরেকটু গাঢ় করে তুলেছিল। অভিজিৎ মুখার্জী আর চন্দ্রশেখর সেই দুপুরে সোনাগাছির এক পুরনো বাড়িতে পৌঁছান, যেখানে খবর মেলে—এক নামকরা গায়ক, যিনি হীরার বাক্স নিয়ে গানের মধ্যে বিশেষ ইঙ্গিত দিয়েছেন, সম্প্রতি রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছেন। গায়কটির নাম ছিল সঞ্জয় দত্ত। লোকমুখে শোনা যায়, সে শুধু গায়কই ছিল না, পাশাপাশি একটি গোপন চক্রের সদস্য, যারা এই হীরার বাক্সের বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ করত।

সঞ্জয়ের পিছু নেয়া কেসগুলো পুলিশ রিপোর্টে নেই, তবে স্থানীয়রা তাকে ‘বাক্সের সুরকার’ বলেই ডাকে। তিনি গানের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতেন, যাতে গোপন চিহ্ন আর সংকেত লুকানো ছিল। অভিজিতের খোঁজে জানা যায়, তার শেষ গান ‘হীরার ছায়া’ ছিল বিশেষ। গানের লিরিকে সে ‘হীরালাল রুইদাসের বাক্সের অভিশাপ’ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল। তবু কেন সে মারা গেল? কি এমন জানত, যা কারো পছন্দ হয়নি? পুলিশের ফাইল থেকে বের করা হয় সঞ্জয়ের মরদেহের রিপোর্ট—যা বলে, তার মৃত্যু হয় হঠাৎ এক অদ্ভুত দুর্ঘটনায়, যেখানে তার গলায় একটি লম্বা দড়ি পাওয়া গিয়েছিল।

শ্রেয়া তখন অভিজিতকে বলে, “এই ঘটনার সঙ্গে সেই কাটা হাতের ঘটনাটার মধ্যে স্পষ্ট মিল রয়েছে। সঞ্জয়ের মৃত্যুর সময় তার হাতে ছিল সেই বিশেষ ডিজিটাল ঘড়ি, যেটা আমরা সিসিটিভিতে দেখেছি। তার মৃত্যু একটা সতর্কবার্তা।” অভিজিত মাথা কুঁকড়িয়ে ভাবতে থাকে, এই সোনাগাছির অন্ধকার গলিরা শুধু গানের নয়, বরং কালো লেনদেনের মাঠও বটে। চন্দ্রশেখর সতর্ক করে, “আমাদের সামনে এমন এক চক্র, যাদের হাত অনেক গুটিয়ে, আর কেউ জানে না তারা আসলে কারা।”

এক বিকেলে তারা সঞ্জয়ের ঘরে প্রবেশ করে। ঘরটি যেন সময়ের আবর্তে আটকা পড়েছিল—পুরনো রেকর্ড, সিলভার প্লেট, এবং দেয়ালে ঝুলছে সেই গানের লিরিকের খসড়া। অভিজিত খুঁজে পায় একটি লুকানো নোটবুক, যেখানে লেখা ছিল বাক্সের বিভিন্ন অংশের অবস্থান ও তার ইতিহাসের খুঁটিনাটি তথ্য। সেই নোটবুকে ছিল একটি নাম—‘অরিন্দম সান্যাল’। অরিন্দম, যাকে তারা আগে শনাক্ত করেছিল, হাওড়ার রহস্যের অন্যতম কেন্দ্র। অভিজিত বুঝতে পারে, এই অরিন্দম এককথায় একটি সোনাগাছি-র মতো—যে শুধু নিজে খেলছে না, অন্যদেরও এই জটিল খেলায় টেনে নিচ্ছে।

সন্ধ্যায় সোনাগাছির সঙ্কীর্ণ গলির মাঝ থেকে তারা ফিরে আসার সময়, অভিজিতের মনে হচ্ছিল, যেন পুরো শহর একটি বড় রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে—যা খুলতে হলে মুঘল সম্রাটের মৃত্যুর পর থেকে লুকিয়ে রাখা ইতিহাস, আর মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করা এক অদৃশ্য শক্তিকে জয় করতে হবে।
চন্দ্রশেখর ধীরে ধীরে বলে, “আমাদের সময় কম, অভিজিৎ। যেটা খুঁজছি, সেটা শুধু বাক্স নয়—আমাদের জীবনও ঝুঁকিতে।”
অভিজিত মাথা নীচু করে বলে, “তাহলে শুরু করা যাক এই শেষ যুদ্ধ।”

সোনাগাছির গলির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে অভিজিৎ মুখার্জী ও চন্দ্রশেখর দে রাতের নীরবতায় নিজেদের অদ্ভুত এক যুদ্ধে নেমে পড়লেন। বাক্সের রহস্য আর তার সঙ্গে জড়ানো অমীমাংসিত মৃত্যু যেন এক অভিশাপের মতো তাঁদের ঘিরে রেখেছে। পরদিন তাঁরা ফের হাওড়া থানায় ফিরে এসে ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেলেন, যা রহস্যকে আরও জটিল করে তুলল। রিপোর্ট বলল, সেই কাটা হাতের মালিক ছিলেন একজন পুরনো বিখ্যাত কারিগর, যিনি ১৯৯০-এর দশকে হীরার বাক্স তৈরিতে যুক্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল অজ্ঞাত কারণে, আর সেই মৃত্যুর সময়ও দেখা গিয়েছিল ওই একই ডিজিটাল ঘড়ি।

শ্রেয়া তখন বলল, “আমাদের সামনে শুধুমাত্র একটি বস্তু বা ঐতিহাসিক গহনা নয়, এটি একটি অভিশপ্ত উত্তরাধিকার, যার খোঁজে রয়েছে বহু প্রাণ। যাঁরা এই বাক্সের সঙ্গে জড়িয়েছেন, তারা সবাই অমীমাংসিতভাবে মারা গেছেন বা হারিয়ে গিয়েছেন।” অভিজিত অনুভব করল, কেসটা কেবল নিখুঁত খুন নয়, বরং এক ভয়ানক চক্র, যেখানে ইতিহাস, বিশ্বাস আর মৃত্যুর মেলবন্ধন আছে। সে ভাবল, ‘বাক্সের অভিশাপ’ কি সত্যিই আছে?

এক রাতে, যখন পুলিশ স্টেশন শুনশান, অভিজিৎ নিজের নোটবুকে লিখল, “যে বাক্সে রাজাদের রক্ত বাঁধা, সেটির গায়ে লেগে থাকা কালো ছায়া কখনো দূরে যায় না।” সেই রাতে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। হঠাৎ হাওড়া থানার গ্যালারিতে বাতি জ্বলে উঠল, অথচ কেউ সেখানে নেই। সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ল, বাক্সের দিকে ধীরে ধীরে একটি অস্পষ্ট ছায়া আকৃতি এগিয়ে আসছে—যার হাত কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু সেই ট্যাটু খোদাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলল, “এ কি সেই কাটা হাতের আত্মা?” চন্দ্রশেখর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, আর অভিজিৎ শুধুই দেখতে থাকে, যেন জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য তার চোখের সামনে প্রাণ পেতে চলেছে।

তাদের সামনে নতুন প্রশ্ন—কি সত্যিই এই বাক্সে কোনো অভিশাপ আছে? নাকি এটি এক নিখুঁত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? এবং কে সেই অদৃশ্য শক্তি, যে এই রহস্যের পেছনে লুকিয়ে আছে?
একটা কথা নিশ্চিত—এই যাত্রা এখানেই শেষ হবে না।
হাওড়া স্টেশনের ধোঁয়াটে বাতাসের মাঝে এই ‘হীরের বাক্স’ যেন আরও গভীর অন্তর্জগতে ডুব দিচ্ছে, আর তাদের জীবনকে এক নতুন বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে।

হাওড়ার অন্ধকার রাত যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। অভিজিত, চন্দ্রশেখর ও শ্রেয়া—তিনজনেই এক ধরনের ভয়ের মাঝেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের সামনে যেন এক অস্পষ্ট ছায়া নাচছিল, যাকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে তারা নিজেই হারিয়ে যেতে চাইছিল। অভিজিত জানত, এই রহস্যের অন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা মুক্তি পাবেন না। স্টেশনের পাশের একটি পুরোনো গুদামঘর থেকে পাওয়া যায় কিছু পুরনো নথি, যেখানে লেখা ছিল—‘বাক্সের আসল মালিক কে হতে পারে এবং তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি’। ঐ নথিতে উল্লেখ ছিল ‘অরিন্দম সান্যাল’ নামের একজন ব্যক্তি সম্পর্কে, যে বিভিন্ন সময় কলকাতার বিভিন্ন স্থানে নজরদারি করত এবং রহস্যময় ঘুরপাক খেত।

অভিজিত তার অনুসন্ধানে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি জানতে পারলেন, অরিন্দম সান্যাল আসলে একটি গোপন সঙ্ঘের প্রধান সদস্য, যার উদ্দেশ্য ছিল মুঘল আমলের গোপন ধন-সম্পদকে আধুনিক দুনিয়ায় পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। এই সঙ্ঘটি বহু বছর ধরে এই ‘হীরের বাক্স’ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রহস্যের উপর নজর রাখছিল। তারা যাঁদের ওপর আস্থা রাখত, তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় দত্তের মতো শিল্পী, পুলিশ অফিসার, এমনকি সাংবাদিকরাও ছিল। এখন বাক্সের অবস্থা এবং তার পেছনে থাকা জটিল ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে অভিজিত ও তার সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নিলেন—এই ছায়াকে খুঁজে বের করতে হবে, তাকে প্রকাশ করতে হবে।

রাতের গভীরে, হাওড়ার স্টেশনের পাশের পরিত্যক্ত বাল্কওয়্যারহাউসে তারা পৌঁছালেন। ভেতর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রহস্যময় ঠান্ডা বাতাস তাদের শ্বাস আটকে দেয়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া সেই ছায়া আকৃতির পদচিহ্ন মেঝেতে স্পষ্ট। অভিজিতের হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে স্থির হয়ে বলল, “এখনই শেষ করার সময় এসেছে—আমরা এই ছায়াকে ধরে না ফেলে ফিরে যাব না।” তাদের সামনে জ্বলজ্বল করে এক আলোর রেখা, যা যেন এক ভয়ঙ্কর গোপনির পথ দেখাচ্ছিল। তারা একসঙ্গে ঢুকল সেই অন্ধকার গুদামে, যেখানে অন্তরালের সব গোপনীয়তা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

১০

হাওড়ার পরিত্যক্ত গুদামের অন্ধকারে ঢুকে অভিজিত, চন্দ্রশেখর ও শ্রেয়া ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগল। বাতাস যেন থমকে গেছে, চারপাশে একটা অতিপ্রাকৃত অনুভূতি বিরাজ করছিল। মেঝেতে থাকা ছায়ার পা চিহ্নগুলো অনুসরণ করে তারা পৌঁছালো এক পেছনের কক্ষে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক বয়স্ক ব্যক্তি — অরিন্দম সান্যাল। তার চোখের মধ্যে ছিল গভীর অভিজ্ঞতার ছাপ, আর মুখে একটা ধূসর হাসি। “আমি তোমাদের অপেক্ষা করছিলাম,” বললেন সে গম্ভীর কণ্ঠে।

অরিন্দম জানালেন, এই ‘হীরের বাক্স’ শুধুমাত্র এক মূল্যবান বস্তু নয়, বরং এক ধরনের রহস্যময় ঐতিহ্য, যার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের গোপন অস্ত্র — এক বিশেষ ধরণের রত্ন, যার শক্তি বহু পুরনো বিশ্বাসের আলোকে আবৃত। তিনি জানান, বাক্সটি কারও মালিকানা নয়, এটি সময়ের সাথে চলা একটি অভিশপ্ত দায়িত্ব, যা তাকে এবং তার মতো কয়েকজনকে রক্ষা করার এবং সতর্ক করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “যারা এই বাক্সের প্রতি লোভ দেখায়, তারা ধ্বংসের মুখে পড়ে; যারা এর গোপনীয়তা সম্মান করে, তারা জীবন পায়।”

অভিজিত বুঝতে পারে, এটা কোনো সাধারণ রহস্য নয়; এটা এক ঐতিহাসিক সত্যের প্রতীক, যা আজও বহু মানুষের জীবন ও মৃত্যুর পেছনে কাজ করছে। সেই রাতের শেষে, তিনজনই সিদ্ধান্ত নিলেন—এই রহস্যের প্রতি সম্মান রেখে, বাক্সটিকে পুনরায় নিরাপদ স্থানে রাখবেন, যেখানে এর অভিশাপ আর লোভের হাত ছুঁবে না। হাওড়া স্টেশনের ধোঁয়াটে বাতাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো, যেখানে অতীতের ছায়া আজকের দিনে মিশে গেছে, আর ‘হীরের বাক্স’ হয়ে উঠল এক চিরন্তন গাথা।

____

1000039577.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *