শ্রীরূপা রায়
হাওড়া ব্রিজের নিচে, গঙ্গার পাড়ে প্রতিদিন ভোরবেলা একটা ছায়ামূর্তির মতো বসে থাকে এক তরুণ—অনির্বাণ ঘোষ। সারা শহর যখন ঘুমিয়ে থাকে অথবা ব্যস্ত যাত্রার জন্য ব্যাগ গোছায়, তখন সে একজোড়া ছেঁড়া ক্যানভাস জুতো পায়ে, পুরোনো ধূসর রঙের জ্যাকেট গায়ে, হাতে একখানা স্কেচবুক আর চারকোল পেনসিল নিয়ে গঙ্গার ঢেউয়ের দিকে চেয়ে বসে থাকে। পেছনে কুয়াশায় ঢেকে থাকা হাওড়া ব্রিজের বিশাল কাঠামো, সামনের দিকে রোদ্দুরের প্রথম রেখা যখন গঙ্গার বুকে পড়ে, তখন তার চোখে ফুটে ওঠে যেন দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার চিহ্ন। প্রতিটি সকাল যেন তার জীবনে নতুন করে সেই পুরোনো প্রশ্নটাই জাগিয়ে তোলে—আজ কি সে আসবে? আজ কি সেই মেয়েটি আবার এই ভিড়ের মধ্যে, ট্রেনের জানালার ওপাশে হঠাৎ তাকিয়ে পড়বে অনির্বাণের দিকে? বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিদিন এই ঘাটে সে অপেক্ষা করে; কারণ তার প্রেম শব্দহীন, মুখহীন, তবু অনন্ত।
সে কাউকে বলেনি, না চুনিদাকে, না নিজের মাকে, এমনকি না নিজের বন্ধুকে—এই অভ্যেসের পেছনের আসল কারণ। তারা ভাবে, অনির্বাণ নিঃসঙ্গ বলেই প্রতিদিন ভোরে ঘাটে আসে, জল দেখে মন শান্ত রাখে, ছবি আঁকে। কিন্তু আসলে সে একরকম রোগে ভুগছে—একতরফা প্রেমের, যেটা শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না। এক বছর আগে, এক বৃষ্টিভেজা সকালে, হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে সে মেয়েটিকে দেখে। ছাই রঙা চাদরের নিচে একটা হলুদ সালোয়ার, হাতে ধরা পুরোনো একটা বই, চোখে দূরে তাকানো ক্লান্তি। তারা একে অপরকে দেখেছিল ঠিক তিন সেকেন্ড, আর সেই তিন সেকেন্ডের মধ্যে অনির্বাণ যেন একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। মেয়েটি চলে যায় ট্রেনে চেপে, আর অনির্বাণ থেকে যায় এই শহরের কোলাহলে—একটানা সেই মুহূর্তে আটকে। সে জানে না মেয়েটির নাম, ঠিকানা, এমনকি গন্তব্য। শুধু জানে, তার হৃদয়ের সবটুকু নিঃশব্দে সেই অচেনা দৃষ্টিকে দিয়ে বসেছে।
আজও ঘাটে বসে সে একটা নতুন মুখ আঁকছে। তার ছবিগুলো সব অদ্ভুত রকমের একরকম—চোখের মধ্যে কোথাও সেই মেয়েটির ছায়া, ঠোঁটের রেখায় অলক্ষ্যে গোপন অভিমান, আর মুখের গড়নে গঙ্গার ঢেউয়ের মতো মিষ্টি অথচ ব্যথাতুর এক গঠন। চারপাশে ঠাণ্ডা কুয়াশা, নৌকাগুলো হালকা ভেঁপু বাজিয়ে গঙ্গার বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে, আর ঘাটে বসে থাকা চুনিদার চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে তামার কেটলির মুখ থেকে। চুনিদা আজও তাকে দেখে চুপ করে চা এগিয়ে দেয়—জানেন, এই ছেলেটা অনেক কথা বলতে পারে, কিন্তু মুখ খোলে না। তার মধ্যে জমে থাকা প্রেম, অভিমান, আশা আর একটা অসমাপ্ত প্রশ্ন—সবকিছু কেবল সেই এক ঝলক চোখাচোখির জন্য। কেউ বলে না, কেউ জানেও না, তবু ঘাটের বাতাস জানে, অনির্বাণ কার জন্য বসে থাকে প্রতিদিন এই ভোরবেলা। আর সেই অপেক্ষা—যেটা আর কেউ টের পায় না—সে প্রতিদিন রোদ ওঠার আগে গঙ্গার জলে ধুয়ে যায় আবার নতুন করে ফিরে আসে।
–
একটা ঝিম ধরা রেইনি সিজনের সকাল ছিল সেটা। শহর তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, রাস্তার পাশের গাছগুলো কাঁপছিল বৃষ্টির ফোঁটায়, আর ছাতা হাতে প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা কেউ জানালার ধারে, কেউ বা ভিড় ঠেলে কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে। হাওড়া স্টেশন তখন তার চিরচেনা কোলাহলে, কিন্তু সেই কোলাহলের ভেতরেও ছিল একটা নিঃসঙ্গতা, যেটা শুধু অনির্বাণের মনেই বাজছিল স্পষ্ট সুরে। সে দাঁড়িয়েছিল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ধারে, বুকে ঝুলন্ত ব্যাগে তার স্কেচবুক আর পেনসিল। তার চোখ শুধু এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে দাঁড়ানো বর্ধমান লোকাল ট্রেনের জানালার দিকে—আর ঠিক তখনই সে মেয়েটিকে প্রথম দেখে।
মেয়েটি বসে ছিল জানালার পাশের সিটে। পরনে একখানা হলুদ সালোয়ার কামিজ, যেটার কাপড়টা একটু ভেজা ছিল বৃষ্টির ছিটায়। চোখদুটো ছিল অনেক দূরে, হয়তো দূরবর্তী কোনো শহর, কোনো স্মৃতি, বা হয়তো নিজের মনেই—এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না সহজে। তার হাতে ছিল একটি পুরোনো কভারছাড়া বই, যার পাতাগুলো কিছুটা ভিজে, মুড়োনো। কপালের একপাশে হালকা একটা চুল এলোমেলোভাবে পড়েছিল, যেটা সে ঠিক করছিল না, কারণ তার ভেতরে তখন কিছু একটা চলছিল—একটা ব্যক্তিগত ভাঙন অথবা অভিমান, যা বাইরে প্রকাশিত হচ্ছিল না, কিন্তু জানালার কাচে ধাক্কা খাচ্ছিল অদৃশ্য চোখের জল হয়ে। অনির্বাণ দাঁড়িয়ে থেকে কেবল তাকিয়েছিল, একবার, দু’বার… কিন্তু তার পা যেন জমে গিয়েছিল প্ল্যাটফর্মের মাটিতে। সে না এগিয়ে যেতে পারছিল, না পিছিয়ে আসতে।
ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে মেয়েটি জানালা দিয়ে হঠাৎ একবার তাকিয়েছিল—ঠিক অনির্বাণের চোখে চোখ। কোনো শব্দ ছিল না, কোনো হাসি না, এমনকি বিস্ময়ও না—শুধু এক ঝলক দৃষ্টি, যেটা চুপচাপ বলে দেয়, “তুমি দেখলে, আমি বুঝলাম।” সেই চাহনিতেই ছিল এক অদ্ভুত সম্মতি, যেন কোনো কথাবিহীন চুক্তি। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে, প্ল্যাটফর্মের কোলাহল হঠাৎ করে যেন স্তব্ধ হয়ে আসে অনির্বাণের জন্য। সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, চুপচাপ, সেই চোখের দৃষ্টিকে বুকে বেঁধে। ট্রেনটা বেরিয়ে যায়, ভিড় কমে আসে, প্ল্যাটফর্ম আবার দৈনন্দিন ছন্দে ফিরে যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তে অনির্বাণ বুঝে যায়—তার জীবনের একটি অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে, যেটার কোনো নাম নেই, কোনো ঠিকানা নেই। কেবল একটি রঙের নাম—হলুদ, আর একটি আবেগের নাম—অপেক্ষা।
–
হাওড়া ব্রিজের নিচে, গঙ্গার পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো ছোট্ট এক টিনের চায়ের দোকান। টিনের ছাউনি বৃষ্টির দিনগুলোয় চুপচাপ কান্না করে, আর রোদ্দুরে ঝলসে ওঠে দারুণ আলোয়। দোকানটির মালিক চুনীলাল মন্ডল, যাকে সকলে চুনিদা বলে চেনে। বয়স পঞ্চান্ন, মাথার সামনের দিকটা টাক, কিন্তু চোখদুটো ঝকঝকে। কথার ধার ছুরি সমান, অথচ মনে মাখনের মতো নরম। এই দোকানই হাওড়া ব্রিজের ছায়ায় একটা সংসার, একটা আশ্রয়। এবং এই দোকানেই প্রতি সকালবেলা আসে অনির্বাণ—একটা অদৃশ্য টানেই যেন। চা খাওয়া তার বাহানা, আসলে সে আসে সেই ভোরবেলার গঙ্গা, সেই একঘেয়ে অপেক্ষা, আর সেই নিঃশব্দ স্মৃতির খোঁজে। আর চুনিদা—সে বুঝেও কিছু বলে না, কেবল মাথা নেড়ে এক কাপ দুধ-চিনি ছাড়া আদা চা এগিয়ে দেয়।
অনির্বাণের সঙ্গে চুনিদার সম্পর্ক বড় অদ্ভুত। দুজনেই চুপচাপ, দুজনেই শহরের ভেতরে একধরনের নির্বাসন খুঁজে পেয়েছে। চুনিদা জানে, এই ছেলেটা কিছু একটা খুঁজছে—কোনো মানুষ, না হয় একটা মুখ, অথবা হয়তো নিজেরই কোনো হারিয়ে যাওয়া অংশ। একদিন সে বলেছিল, “তুই প্রতিদিন আসিস, কিন্তু গল্প করিস না। কিন্তু তোর চোখে আমি এক মেয়ে দেখি রে। সত্যি বলছি।” অনির্বাণ হেসে ছিল, সেই ম্লান, অনুচ্চ হাসি, যেটা কিছু গোপন রেখে দেয়, কিছু বলে দেয়। সেই দিন চুনিদা আর কিছু বলেনি। আসলে তারা দুজনেই জানে—সব গল্প মুখে বলা যায় না। কিছু গল্প চোখে থাকে, অপেক্ষায় থাকে, আর চায়ের কাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় প্রতিদিন।
আজকের সকালটা একটু ব্যতিক্রম। গঙ্গার ধারে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, ঘাটে লোকজন তুলনামূলকভাবে কম। অনির্বাণ তার স্কেচবুক খুলে বসেছে, আর চুনিদা চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে বলল, “শোন, গত সপ্তাহে ঘাটে একটা বই পড়ে ছিল, জল খেয়ে গেছে অর্ধেক। মেয়েদের হাতের লেখা মনে হল। শেষ পাতায় একটা নাম লেখা ছিল—নৈঋতা। জানিস কিছু?” অনির্বাণ যেন কিছুটা চমকে ওঠে। গলা শুকিয়ে যায় হঠাৎ। সে কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে চায়ের কাপের বাষ্পে। চুনিদা আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। কিন্তু তার মুখে একধরনের রহস্য লুকিয়ে থাকে। নৈঋতা—নামটা অনির্বাণের কানে সুরের মতো বাজে। সে জানে না, আদৌ এই নাম তার সেই মেয়েটির কিনা, জানে না এটা কোনো কাকতালীয়তা, না কোনো লক্ষণ। কিন্তু কিছু একটা মনে হয় দোলা দিয়ে যায় বুকের গভীরে। চা শেষ করে সে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়, পকেটে স্কেচবুক গুঁজে নেয়। চুনিদা তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে, “তুই যেমন খোঁজ করিস, মাঝে মাঝে কিছু নিজেকে খুঁজেও নিতে হয়, অনির্বাণ।”
–
নৈঋতা পাল সকালবেলা চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। দক্ষিণমুখো ছোট্ট খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায় সল্টলেকের ব্যস্ত রাস্তাটা—যেখানে বাসগুলো একের পর এক থামে, সাইকেলের ঘন্টা বাজে, আর স্কুলের বাচ্চারা চেঁচিয়ে ওঠে ইউনিফর্মে। অথচ তার চোখ সেসবের কোনো কিছুতেই ঠিকঠাক ধরে না। সে নিজের মনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে এক কাপ চা, চোখে একরকম চাপা ব্যথা। আজ তার স্কুলে যাওয়ার দিন, কিন্তু মনে হয় যেন কোনো ক্লাসই পড়াতে ইচ্ছে করছে না। শুধু মনে পড়ছে সেই ট্রেনযাত্রার দিনটা—যেদিন জীবনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সে হাওড়া স্টেশনের সেই লোকাল ট্রেনটায় উঠেছিল, অনিশ্চয়তার দিকে ছুটেছিল একাই। তার মনে নেই, ঠিক কী ভেবে উঠেছিল ট্রেনে। শুধু মনে আছে, বুকের মধ্যে একটা বোঝা ছিল—যেটা কারো কাছে বলা যায় না, কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।
সেই দিন তার সঙ্গে কিছুই ছিল না—একটা বই, একটা ছোট ব্যাগ, আর অনেকগুলো ভাবনা। সে জানত না কোথায় যাচ্ছে, কী করবে। শুধু একটা সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে, বাড়ির চাপে চুপচাপ ভেঙে পড়ে সেই ট্রেনে উঠে পড়েছিল। তার চোখে জল ছিল না, কিন্তু একটা ভারী অভিমান ছিল চোখের পাতায়। জানালার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল—প্ল্যাটফর্মের জনসমুদ্র যেন চোখে পড়ছিল না তার, কেবল মনের ভিতরে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল কিছু পুরোনো মুহূর্ত, কিছু অপূর্ণ স্বপ্ন, আর ভেঙে যাওয়া আত্মসম্মান। আর সেই মুহূর্তেই একবার সে তাকিয়ে দেখে—একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কোনো কথার প্রয়োজন হয়নি, শুধু চোখে চোখ—আর সেই চাহনিতে নৈঋতা একটা অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিল। ট্রেন ছাড়ছিল, অথচ সে হঠাৎ করে অনুভব করেছিল—কেউ তাকে বুঝেছে, একেবারে নির্জনে। সেই চাহনির স্মৃতি তাকে আজও ধাক্কা মারে, মাঝরাতে, বা এই সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন সে নিজের ভিতরের খালি জায়গাটা টের পায়।
গত ক’মাস ধরে সেই চোখজোড়া ভুলতে পারেনি সে। কাউকে কিছু বলেনি, কাউকে বোঝানোরও চেষ্টাও করেনি। শুধু মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যায়, তখন সে নিজের পুরোনো বইটার শেষ পাতায় ছোট করে লিখে রাখে কিছু নাম, কিছু তারিখ, কিছু মুহূর্ত—যা কেউ পড়ে বুঝবে না, কিন্তু সে জানে এর অর্থ কী। আজ তার সামনে আবার সেই বইটা পড়ে ছিল, যেটা সেই ট্রেনযাত্রার সময় তার হাত থেকে পড়ে গেছিল—হয়তো হাওড়া স্টেশনেই। ভেবেছিল, খুঁজে পাবে না আর। কিন্তু গত সপ্তাহে স্কুলের এক ছাত্র বইটা ফেরত দিয়েছে, বলেছে—কোনো এক ‘চা-ওয়ালা দাদু’র কাছ থেকে পেয়েছে তার বাবা। বুক কেঁপে উঠেছিল নৈঋতার। তাহলে কি কেউ সেই বই খুঁজে পেয়েছিল? কেউ কি বইটা পড়েছিল? কার কাছে গিয়েছিল সেটা? তার মাথায় অনেক প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর শুধু একটা অনুভূতিতে—সেই ছেলেটার দৃষ্টিতে। সে জানে না, আবার কখনো দেখবে কি না। কিন্তু একটা ক্ষীণ বিশ্বাস প্রতিদিন বাড়ে তার মনে—হয়তো কোনও ভোরে, কোনও ঘাটে, আবার সেই চোখদুটো তাকিয়ে থাকবে তার দিকে, কোনও প্রশ্ন ছাড়াই।
–
রাতটা বেশ ঠান্ডা ছিল। ঘরের জানালা খুলে রেখে অনির্বাণ শুয়ে ছিল বিছানায়, পাশে পড়ে থাকা খোলা ডায়েরি তার ছেঁড়া চাদরের ভাঁজে আটকে গেছিল। ঘরের ভিতরে লো পাওয়ারের আলোটা নিঃশব্দে জ্বলছিল, আর বাইরের থেকে মাঝে মাঝে গঙ্গার বাতাস ঢুকছিল ধীরে ধীরে। অনির্বাণের ডান হাতে চারকোল পেনসিল, বাম হাতে ধরা ছিল সেই বইটি—যেটা চুনিদা তাকে দিয়েছিল ক’দিন আগে। নামহীন, ছেঁড়া, জলখাওয়া পাতাগুলোয় একটা বিশেষ গন্ধ—ভেজা কাগজের, পুরনো চিঠির মতো। সে পাতা উল্টে উল্টে খুঁজছিল কোনো চিহ্ন, কোনো পরিচয়। হঠাৎ চোখে পড়ে শেষ পাতার কোণে হালকা করে লেখা একটা নাম—”নৈঋতা প.”। অনির্বাণের বুকের ভেতর যেন কেমন একটা কাঁপুনি ওঠে। সে নামটা পড়ে একবার, দু’বার… যেন শব্দটাকে বিশ্বাস করতে চায়, যেন শব্দটা শুধু শব্দ নয়—এটা তার প্রতীক্ষার প্রথম সাড়া।
অনির্বাণ উঠে বসে। বিছানায় পড়ে থাকা ডায়েরিটা টেনে নিয়ে আসে কাছে, সেই পাতায় বড় বড় করে লেখে “নৈঋতা” নামটা। নিচে আঁকে সেই চোখদুটো, যেগুলো সে কোনোদিন ভুলতে পারেনি। মুখের গঠন অস্পষ্ট, কারণ বাস্তবে সে মেয়েটিকে খুব কম সময়ের জন্য দেখেছে—তবু বারবার আঁকে সে চোখ, সেই ম্লান অভিব্যক্তি, সেই জানালার কাঁচের ওপাশের ছায়া। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় প্রতিদিন সে একটা মুখ আঁকে—সব মুখেই কোনো না কোনোভাবে থাকে সেই মেয়েটির ছায়া। সে নিজের অজান্তেই গড়ে তুলেছে একটা অলিখিত সম্পর্ক, যার কোনো নাম নেই, কোনো শরীর নেই—তবু তার চেয়ে বেশি বাস্তব কিছুই নেই অনির্বাণের কাছে। আজ সেই মুখটাই যেন একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল, নাম পেয়ে। সে জানে না “নৈঋতা প.” আসলে কে, কোথায় থাকে, এখন কেমন আছে। তবু হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, সেই ভেজা জানালার ধারে বসা মেয়েটি, আর এই নাম—সব একসুতোয় বাঁধা হয়ে যায় অনির্বাণের মনে।
পরদিন ভোর। চা হাতে বসে থাকে চুনিদার দোকানে। গঙ্গার হাওয়া তখনও ঝিরঝির করছে, পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ব্রিজের তারের ওপরে। চুনিদা কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে—চোখে একধরনের আলো, যেটা এতদিন সে দেখেনি। “তুই কিছু পেয়েছিস বুঝি,” চুনিদা বলে, ঠোঁটের কোণে এক ফোঁটা হাসি। অনির্বাণ মৃদু মাথা নাড়ে, পকেট থেকে বের করে সেই বইটা, আর চুপচাপ পাতাটা খুলে দেখায়। “নৈঋতা,” বলে ধীরে। চুনিদা চায়ের কেটলির স্টিমে একবার চোখ বন্ধ করে বলে, “তাহলে শুরু হোক খোঁজ। কোথাও না কোথাও থাকবেই সে। খুঁজে দেখ।”
অনির্বাণ জানে, তার এই যাত্রা শুরু—একটা নাম থেকে একটা মুখ, একটা দৃষ্টির গভীরতা থেকে জীবনের মানে। ডায়েরির পাতা খুলে গেছে, এখন জীবন নিজের গল্প লিখবে।
–
সেই বইটা যেন কোনো পাথরের মতো ওজন হয়ে বসে ছিল অনির্বাণের ব্যাগে। প্রতিদিন সকালে ঘাটে বসে সে বইটা বার করে দেখে—প্রতিটি পাতায় জল লাগার দাগ, কালি মুছে যাওয়া কিছু শব্দ, আর শেষ পাতায় সেই অস্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা “নৈঋতা প.”। নামটা শুধু নাম নয়, যেন একধরনের অঙ্গীকার, এক অব্যক্ত সংলাপ। অনির্বাণ আজ সকালবেলা একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়েছে। আজ আর শুধু গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা নয়, আজ শুরু হবে খোঁজ। বইটা তার প্রথম সূত্র, আর বইয়ের ভিতরে একটা স্কুলের নামের স্ট্যাম্প পাওয়া গেছে—”নবজীবন গার্লস স্কুল, বেহালা”। বইয়ের পাতায় ওই নাম দেখে তার কাঁধে এক আশ্চর্য শিহরণ বয়ে গেছিল। এই শহরেই হয়তো সে আছে, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও যাচ্ছে-আসছে, অথচ অদৃশ্য। আজ অনির্বাণ তার অলক্ষ্য অস্তিত্বের পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে।
বিকেলবেলা অনির্বাণ পৌঁছোয় বেহালায়, স্কুলটা খুঁজে বের করতে খুব কষ্ট হয়নি। একটা পুরোনো ভবন, বাইরে কিছু মেয়ের দল হাসছে, কেউ দৌড়ে যাচ্ছে ব্যাগ হাতে। সে গেটে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটিকে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করে—“এই নামের কোনো ম্যাডাম এখানে পড়ান? নৈঋতা পাল?” পাহারাদার একটু ভুরু কুঁচকে দেখে, তারপর বলে, “হ্যাঁ, আছে তো। ইংরেজি পড়ান। কিন্তু আজ একটু আগেই বেরিয়েছেন। ক্লাস শেষ হয়েছে।”
অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানত না, এই এত কাছে এসে আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আবার একঝলক উঁকি দেয় আশার আলো—তাহলে সে আজ সত্যিই এই শহরে আছে, এই স্কুলেই, বাস্তবে। মুখে কোনো শব্দ ফুটে না, বুকের ভিতরে ধীরে ধীরে জমতে থাকে আবেগের স্রোত। অনির্বাণ জানে না কী বলবে সামনে দেখা হলে, বা আদৌ বলবে কি না। শুধু জানে, এই বাস্তবতার স্পর্শে তার এতদিনের কল্পনার মূর্তি যেন হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যাবেলায় ঘাটে ফিরে সে চুপচাপ বসে থাকে অনেকক্ষণ। চারদিকে গঙ্গার ওপরে নৌকার আলো, ব্রিজের নিচে গাড়ির হুইসেল, চুনিদার চায়ের কেটলি টকটক করছে। কিন্তু আজ সে চুপ—একটা নিরব আবেশ তার চোখে। চুনিদা চা এগিয়ে দেয়, আর বলে, “দেখেছিস?”
অনির্বাণ একবার মাথা নাড়ে। “আজ কাছে গিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু এবার বুঝলাম, ও স্বপ্ন নয়। বাস্তব। আছে। এখানে।”
চুনিদা ধীরে বলে, “তা হলে আর বসে থাকিস কেন রোজ? এবার সামনাসামনি কথা বল। জানিস, কিছু অনুভূতি মুখে না বললে তাদের ওজন বাড়ে, জীবন ভেঙে যায়।”
অনির্বাণ মৃদু হেসে বলে, “আসলে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হতে সময় লাগে, দাদা। আমি তো এখনো সেই একঝলক চোখে আটকে আছি।”
চুনিদা আর কিছু বলে না। চা শেষ হলে অনির্বাণ ডায়েরির শেষ পাতায় আবার লেখে সেই নাম—”নৈঋতা পাল”। এইবার অক্ষরগুলো একটু বড়, একটু স্পষ্ট। কারণ আজ নামটা শুধুই স্মৃতি নয়—এটা এখন জীবন্ত।
–
সেই দিনটা ছিল শুক্রবার। আকাশে হালকা মেঘ, শহরের রোদ কিছুটা গুমোট, আর বাতাসে অজানা একটা চাপা উদ্বেগ। অনির্বাণ আজও এসেছিল বেহালার স্কুলের সামনে, কিন্তু এবার আর দূর থেকে চেয়ে না থেকে সে গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। হাতে তার সেই পুরোনো বইটা, শেষ পাতার নাম এখন আর শুধুই ছায়াময় নয়—এটা এখন বাস্তবের ছোঁয়া পাওয়া এক নাম, যার ভিতর লুকিয়ে আছে দীর্ঘ এক প্রতীক্ষার উত্তর। ঠিক বিকেল চারটের সময় গেট দিয়ে বেরোয় কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা। কেউ কেউ অটো ধরতে ব্যস্ত, কেউ বা মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আর তখনই, ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে নৈঋতা পাল।
আজ তার পরনে আছে হালকা নীল শাড়ি, খোলা চুলের গোছা একটা ক্লিপে বাঁধা। হাতে বই, কাঁধে ছোট একটা ব্যাগ। সে হাঁটছে নিজের গন্তব্যের দিকে, চোখে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু মুখে একটা শান্ত প্রকাশ। অনির্বাণ কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়—সেই ট্রেনের জানালার মুখ আর আজকের এই মুহূর্ত, যেন দুই বিপরীত বাস্তবতা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভিতর শব্দ করে ধুকপুক শুরু হয়, কিন্তু মুখে কোনো কথা আসে না। হঠাৎ সে টের পায়, তার হাতের বইটা আঁকড়ে ধরা, যেন সেটাই তার একমাত্র সাহস। সে ধীরে এগিয়ে যায় নৈঋতার দিকে, কয়েক কদম দূরে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর মৃদু গলায় বলে, “আপনি কি… নৈঋতা পাল?”
নৈঋতা থেমে যায়। মুখ তুলে তাকায় ছেলেটার দিকে। কয়েক সেকেন্ড একেবারে স্তব্ধ — সে যেন চিনতে পারছে না, বা হয়তো ভাবছে কোথায় যেন দেখেছে। অনির্বাণ বুঝতে পারে এই দৃষ্টি আগের চেয়ে আলাদা—এখানে বিস্ময় আছে, কিন্তু কোনো স্মৃতি নেই। সে আবার বলে, “এই বইটা… আপনার পড়ে গিয়েছিল, অনেকদিন আগে… হাওড়া স্টেশনে।” বইটা এগিয়ে দেয় তার হাতে। নৈঋতা বইটা হাতে নিয়ে দেখে, তারপর তার ঠোঁট ফাঁক হয়। “এইটা তো… হ্যাঁ, এটা তো আমারই বই,” সে ধীরে বলে। কিন্তু তার চোখে নেই সেই দিনকার জানালার ধারের অভিব্যক্তি। অনির্বাণ কেমন ফাঁকা অনুভব করে নিজের ভিতর।
কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্য। তারপর নৈঋতা ভ্রু কুঁচকে বলে, “তুমি কে? তুমি এই বইটা কোথায় পেলে?”
অনির্বাণ মাথা নিচু করে একটু হাসে। “সেদিন, সেই দিন… আপনি যখন ট্রেনে উঠেছিলেন, আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনি একবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিলেন। তারপর থেকেই আমি খুঁজছি আপনাকে… প্রতিদিন।”
নৈঋতা হতচকিত হয়। চোখে একরাশ বিস্ময়, কিন্তু একটা গোপন ঘূর্ণি যেন তার ভিতরেও ঘুরতে থাকে। কিছু মনে পড়ে কি? কোনো চিহ্ন? সে কিছু বলে না, কেবল বইটা শক্ত করে ধরে। অনির্বাণ বলে, “আমি প্রতিদিন হাওড়ার ঘাটে বসে থাকি, কেবল এই আশায় যে হয়তো আপনি আবার ফিরে আসবেন।”
নৈঋতার ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায়—কেমন যেন বিষণ্ন, কৃতজ্ঞ আর কিছুটা অপরিচিত। “আমি তো জানতামই না… কেউ এতদিন ধরে আমাকে খুঁজছে। অথচ আমি তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম,” সে বলে।
–
হঠাৎ দেখা হওয়ার পর দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটেছিল বেহালার রাস্তায়। নৈঋতা তখনও বইটা হাতে ধরে ছিল, মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছিল বইয়ের ভেজা পাতাগুলো—যা এখন কেবল কাগজ নয়, এক দীর্ঘ অপেক্ষার প্রমাণপত্র। তারা দুজনেই একসঙ্গে হাঁটছিল, কিন্তু ঠিক পাশে নয়—একটা অদৃশ্য দূরত্ব বজায় রেখেই। কথাবার্তা খুবই কম। নৈঋতা অবাক, কৌতূহলী—তবু সাবধানী। অনির্বাণ শান্ত, কিন্তু সেই পরিচিত অসহায় ভালোবাসার ভারে নুয়ে থাকা চোখে সব লুকানো। অবশেষে একটা মোড় ঘুরে নৈঋতা থেমে দাঁড়ায়, ধীরে বলে,
“এই পথটা আমার বাড়ির দিকে যায়।”
অনির্বাণ মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। নৈঋতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“তুমি আজও ঘাটে যাও প্রতিদিন?”
অনির্বাণ মৃদু হাসে, “হ্যাঁ। কারণ প্রতিদিন বিশ্বাস করেছি—আপনি ফিরে আসবেন। যদিও কখনো জানতাম না আদৌ তা হবে কিনা।”
নৈঋতা চুপ করে যায়। দূরের কোনও অটোর হর্ণ ভেসে আসে, পাড়ার শিশুরা খেলছে পাড়ার মোড়ে। এই শহরের ব্যস্ত জীবনে তারা দুজন দাঁড়িয়ে, যেন সময়ের বাইরে এক কাঁচের ঘরে। নৈঋতা ধীরে বলে,
“জানো… সেই দিন ট্রেনে বসে আমি ঠিক করেছিলাম, কাউকে বিশ্বাস করব না আর। কোনো অনুভবকে জায়গা দেব না আর।”
তার চোখে ক্লান্তি, তবু আজ প্রথমবার অনির্বাণের দিকে সোজা তাকায়।
“কিন্তু আজ, তোমার চোখে তাকিয়ে… মনে হচ্ছে কেউ একজন সত্যিই আমাকে বুঝেছে, কোনো দাবি না করে। এমন ভালোবাসা তো কেউ দেয় না।”
অনির্বাণ একবার তার চোখের দিকে তাকায়, তারপর নিচু গলায় বলে,
“আমি তোমার কিছু চেয়েছি কি কখনো?”
নৈঋতা একটু হেসে, এক পা এগিয়ে এসে বলে,
“না। তুমিই একমাত্র, যে শুধু চেয়ে থেকেছ। চেয়ে থেকেও কিছুই দাবি করোনি। সেই জন্যই… হয়তো আজ আমি আবার দাঁড়িয়ে আছি সামনে।”
শেষ বিকেলের আলো পড়েছে গালে, ঝিরঝির হাওয়ায় ওড়ে নৈঋতার চুল। একটা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দুজন, কিন্তু এই গলি শুধু রাস্তা নয়—দুজন মানুষের ভেতরের অনুভবের সীমানা। নৈঋতা বলে,
“আমার এখনো ভয় করে। আবার বিশ্বাস করতে। আবার কারও চোখে তাকাতে।”
অনির্বাণ সামনে এসে খুব আস্তে বলে,
“ভয় যদি করতেই হয়, তবে আমার পাশে বসে করো। ভয়কে পাশে নিয়েই তো হাঁটা শিখি আমরা।”
নৈঋতা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু বইটা তার হাতে রেখে বলে,
“তোমারই থাক এই বই। তাতে আমার পুরোনো আমি ছিল। এখন… আমি নতুন করে শিখতে চাই—তোমার সঙ্গে।”
আর কিছু বলা হয় না। বলা লাগে না। তারা দুজন হাঁটতে শুরু করে ধীরে, আর হাওড়া ব্রিজের নিচে গঙ্গার ঘাটের সেই পুরোনো বেঞ্চ—যেখানে অনির্বাণ প্রতিদিন বসত, আজও আছে। কেবল আজ প্রথমবার সেই বেঞ্চে দুটো মানুষ বসে, দুটো কাপ চা হাতে, দুটো নীরবতা পাশাপাশি।
হয়তো এই-ই অপেক্ষার সমাপ্তি।
হয়তো এই-ই নতুন অপেক্ষার শুরু।
—