Bangla - হাস্যকৌতুক

হাঁসের সাইকেল

Spread the love

বটুকেশ্বর পাল


পটাশপুর গ্রামের নাম যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন—এই গ্রামে জিনিসপত্র যত পুরনো, তার চেয়ে বেশি পুরোনো মানুষের বিশ্বাস। কিন্তু এই প্রাচীন চিন্তার ঢেউয়ে মাঝেমাঝে উঠে আসে এক-একটা অদ্ভুত ঢেউ, যেমন হরিপদ কাকা। উনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজেকে “গাঁয়ের গ্যালিলিও” বলেই দাবি করেন। যদিও কাকার অঙ্কে তেমন হাত ছিল না—শ্রেণি সাত অবধি পড়েছেন, তারপরে খাজাঞ্চির দোকানে হিসেব রাখার বদলে লোকের পকেট ভুল করে গুণে গুণে ফাঁকা করে ফেলেছিলেন। সেই থেকে “গণিত ত্যাগ” করে, মন দিয়েছেন বিজ্ঞানে—অর্থাৎ, নিজের মতো করে সব কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টায় দিনরাত বিভোর। কাকার এই বিজ্ঞানমনস্কতা আসলে এল আকাশ থেকে। কয়েক বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির রাতে কাকা দাবি করেছিলেন, “আমার মাথার উপর দিয়ে একটা মহাজাগতিক আলো চলে গেল, আর তার পর থেকেই আমার মাথার মধ্যে সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে।” তখন কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এরপর থেকে কাকা যা যা করতে শুরু করলেন, তাতে গাঁয়ের লোক বুঝে গেল—উনি সত্যিই কিছু একটা খেয়েছেন। একবার নিজের রান্নাঘরের খুন্তি আর ছেঁড়া ছাতা জোড়া দিয়ে তৈরি করলেন “আলু-বেগুন আলাদা করার মেশিন।” ফলাফল, বেগুন তো দূরের কথা, মেশিনই গিলে নিল হরিপদ কাকার হাতা। আরেকবার ঠাকুরঘরে বাতাস ঢুকিয়ে বানালেন “ঘামমুক্ত প্রার্থনার ঘর”—যা এমন শব্দ করে চলত, যে গ্রামে সবাই ভাবল ভূতের পুজো হচ্ছে। কাকা অবশ্য এসব নিয়ে মোটেই ভীত নন—তিনি গর্ব করে বলেন, “আমি একটা টাইম মেশিন বানাতে পারি। শুধু বাঁশের পাইপের অভাবে আটকে আছি।” এমনই কৌতুকময়, অথচ আত্মবিশ্বাসে ঠাসা মানুষ হরিপদ কাকা, যাঁর মাথায় আজ আবার এক নতুন ঝড় উঠেছে।

সকালটা ছিল রোদের, আর চায়ের দোকানে জমেছে গ্রামের চিরচেনা আড্ডা—চুনার দোকান। মধু, গোবিন্দ, নিতাই—এই তিন অলস ত্রয়ী বসে আছে তাশ নিয়ে, আর কাঁচা গরম জিলিপির সুবাসে মুখ ভরেছে। এমন সময় হরিপদ কাকা পোঁ-হাঁক দিয়ে দোকানে প্রবেশ করলেন, গাঁয়ের লোক জানে—ওই হাঁক মানেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে। “এই যে গোবিন্দ, শুনলে খবর?”—হরিপদ কাকা বললেন, চোখে অদ্ভুত জ্যোতি। গোবিন্দ বলল, “কোন খবর কাকা?” — কাকা উত্তর দিলেন, “আমি এবার একটা নতুন জিনিস বানাচ্ছি… হাঁসের সাইকেল।” তাশের তাস যেন একসঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল। কেউ ঠিক বুঝল না কাকা সিরিয়াস, না হাসির বোমা ফেললেন। “হাঁসের… কী বললেন কাকা?” — মধু দ্বিধাভরে জিজ্ঞেস করল। কাকা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “দ্যাখ, হাঁস হল জলের প্রাণী, ওরা ভারসাম্য জানে। মানুষ তো সাইকেল চালায়, কিন্তু হাঁসরা যখন হাঁটে, তারা এক লাইন ধরে হাঁটে। আমি ঠিক করেছি, হাঁস দিয়েই চালাব সাইকেল। সামনে পাঁচটা হাঁস বাঁধব, আর সাইকেলের চাকায় লাগাব দড়ি। হাঁস হাঁটলে চাকাও ঘুরবে। ব্যস!” চায়ের দোকান যেন ভূকম্পে কাঁপল। হাসির দমকে কেউ চায়ের কাপ ফেলে দিল, কেউ মুখ ঢেকে চিৎকার করে উঠল, “কাকা, আপনি তো নোবেল পাওয়ার যোগ্য!” কিন্তু হরিপদ কাকা গম্ভীর। “তোমরা হাসো ঠিক আছে, কিন্তু একদিন এই হাঁসদের দিয়েই সাইকেল চালিয়ে পটাশপুর থেকে কাঁথি যাব—সবাই দেখবে!” এই ঘোষণা যেন গ্রামে নতুন এক হাস্যতরঙ্গ ছড়িয়ে দিল, আর কাকার মাথায় নেমে এলো এক বৈজ্ঞানিক মেঘনাড়ির ঝড়। কাকা নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন, আর পেছনে রইল গাঁয়ের লোকের টিপ্পনি: “এইবার হয়তো হাঁসেই চিঠি যাবে, ডাক বিভাগের বেকার!”

***

পরদিন সকালবেলা, সূর্য তখনো গায়ে একগাল ঘুম নিয়ে বসে, আর গ্রামের লোকেরা ধীরে ধীরে উঠছে দুধ দোয়ার চিন্তায়—তখন হরিপদ কাকা সাইকেল পরিষ্কার করছেন। গায়ে পুরনো ধুতি, গায়ে পাটের ঝোলা, আর মাথায় সাদা তোয়ালে—যেটা আবার “মেড ইন সায়েন্স” লেখা। এই পোশাকে দেখে পটাশপুরের কেউ বলত, উনি নিশ্চয় দিল্লি যাচ্ছেন বিজ্ঞান কনফারেন্সে। কিন্তু কাকার গন্তব্য ছিল—পটাশপুর হাট, যেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার হয় হাঁস-মুরগির বাজার।
ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হলেন তিনি সাইকেল নিয়ে—যেটার পেছনে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটা ছোট খাঁচা বাঁধা, যাতে তিনি হাঁস নিয়ে ফিরবেন। “আজকে হাঁস কিনেই ছাড়ব। পাঁচটা লাগবে ঠিকঠাক। পঁচিশ কেজি টানতে পারবে এমন শক্তিশালী হাঁস”—এই ঘোষণা করতে করতে তিনি গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে চললেন হাটের দিকে। পথিমধ্যে তাকে দেখে অনেকে থমকে গেল। “ও কাকা, কোথায় চললেন?”—একজন জিজ্ঞেস করল। কাকা গম্ভীর মুখে বললেন, “হাঁস কিনতে, বৈজ্ঞানিক কাজ আছে।”
সাইকেল ঠেলে ঠেলে তিনি হাটে ঢুকলেন, আর ঢুকেই হাঁসের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেন। দোকানি মদনবাবু, যিনি নিজের হাঁসদের “নাগিন হাঁস” বলে বিক্রি করেন—বলেন, “কত কেজির হাঁস লাগবে কাকা?” হরিপদ বললেন, “ওজন দিয়ে কি হবে, আমি গতি দেখে হাঁস কিনি। কোন হাঁসটা দৌড়ে বেশি যায়?”
মদন হাঁসের পালে বাঁশ দিয়ে ঠেলা দিলেন—পাঁচটা হাঁস টুক করে দৌড়ে সামনে গেল। কাকা চোখ বন্ধ করে বললেন, “এই পাঁইচটা আমার চাই। চোখে গতি আছে!”

কিন্তু সমস্যা হলো হাঁস বাঁধা। কাকা তাদের সাইকেলের পেছনে বাঁধলেন পাটের দড়ি দিয়ে, আর তারা একসাথে গ্যাঁজম্যাজ করে চেঁচাতে লাগল। হাঁসের কাকফোনির শব্দে পটাশপুর হাট যেন যুদ্ধক্ষেত্র। একজন হেসে কুটিপাটি, “কাকা হাঁস কিনলেন না, যেন সন্ত্রাসী বাহিনী আনলেন!” হাঁসগুলো এক এক করে সাইকেল ঘোরাতে শুরু করল। সাইকেলও সেইমতো বেঁকে বেঁকে হাঁটছে, কাকা তখন সামনে দাঁড়িয়ে হাঁসকে ঠেলা দিচ্ছেন, হাঁস সাইকেলকে টানছে, আর সাইকেল হাঁসকে।
পথে এক বাচ্চা বলল, “মা গো! সাইকেলটা কি হাঁস চালাচ্ছে?” মা বলল, “চুপ কর! বেশি তাকালে তোর ঘুমে হাঁস ডাকে।”

কাকা যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তার সাইকেলের এক চাকা কাদা-মাটি জড়ানো, হাঁসের গায়ে ধুলো-ময়লা, আর কাকার মুখে বিজয়ীর হাসি। পেছনে লোকজন বলছে, “দেখলি তো, পটাশপুরে এখন হাঁস চালিত গাড়ি চলবে। এবার বুঝি গাধার জাহাজ বানাবে!”
হরিপদ কাকা কিন্তু নিশ্চিন্ত—তিনি বুঝতে পেরেছেন, এই পাঁচটি হাঁসই হতে চলেছে তার বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সহযোদ্ধা।

***

বিকেলটা ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধ। কাকারা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছেলেরা মাঠে খেলছে, আর হাঁসেরা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের নতুন বসকে নিয়ে ফিসফাস করছে। কিন্তু ঠিক তখনই হরিপদ কাকার বাড়ির ভিতর একটা জোরালো ‘ট্যাং’ শব্দ শুনে কাকার বউ গম্ভীর মুখে বললেন, “এইবার মনে হয় রকেট বানাচ্ছে।”
কাকার ল্যাবরেটরি, যার আসল নাম ‘দোকানঘর’, ছিল বাড়ির একপাশে পুরনো ধ্বস্ত ঘর। সেখানে একদিকে লুঙ্গির রডে ঝুলছে ইস্পাতের পাত্র, অন্যদিকে মাটিতে পড়ে আছে ভাঙা হারমোনিয়াম, আর মাঝখানে রাখা একটা টেবিল—যেটার পা একদিকে বাঁকা, অন্যদিকে ইট দিয়ে সমান করা। এই ঘরটাই কাকার ‘গোপন গবেষণাগার’।
কাকা দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকলেন, আর কাজ শুরু করলেন, যেন উনি ISRO-র চন্দ্রযান তৈরির কাজে ব্যস্ত। প্রথমেই তিনি হাঁসগুলোর ওজন করলেন—হাঁসরা একটু বিরক্ত হলেও বোঝে, এবার বড় কিছু হতে চলেছে। এরপর কাকা রেডিওর ভাঙা স্পুল থেকে বানালেন ‘গতি ট্রান্সমিটার’, হারমোনিয়ামের রিড দিয়ে বানালেন ‘কোয়াক ব্রেক প্যাড’। হাঁসদের গলায় লাগানোর জন্য তৈরি হল ছোট দড়ির বেল্ট, যার এক প্রান্ত সাইকেলের প্যাডেলে লাগানো।
পুরো ব্যবস্থার নাম দিলেন: Duck-Powered Velocity Engine – DPVE Mark I.

কিন্তু সমস্যা হলো, হাঁসের মনোভাব বিজ্ঞানবিরুদ্ধ। কাকা যখন প্রথম হাঁসের গলায় দড়ি বেঁধে বললেন “হাঁটো”, তখন হাঁসটি মুখ ঘুরিয়ে তাকাল কাকার দিকে, যেন বলছে—“তুমি হাটো আগে!” একটার পর একটা হাঁস হাঁটতে রাজি না। কেউ পেছনে হেঁটে যায়, কেউ কাদায় বসে পড়ে, আর একটা হাঁস কাকাকে চিমটি কেটে বসে! কাকা হতাশ, কিন্তু দমে যাওয়ার লোক নন। তিনি সাইকেলের সামনে রাখলেন মোয়া—“যেখানে মোয়া, সেখানেই গতি।”
তিন ঘণ্টার চেষ্টায় যখন হাঁসরা মোয়ার লোভে একসাথে সামনের দিকে এক ইঞ্চি হাঁটল, কাকার মুখে হাসি ফুটে উঠল—“এই তো, শুরু হল বিপ্লব!”
তবে ঠিক তখনই ঘটে বিপত্তি—সামনের হাঁসটি মোয়া খেতে গিয়ে হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরে গেল, আর পুরো সাইকেল ঘুরে কাকার ওপর পড়ে গেল। বাড়ির লোকজন ছুটে এল—কাকা কাদায় গড়াগড়ি করছেন, হাঁসরা পালিয়ে পুকুরে, আর মুখে কাকার সেই বিখ্যাত উক্তি:
“পরীক্ষা সফল! হাঁস সামনের দিকে না হাঁটলেও গতি প্রমাণিত!”

গাঁয়ের ছেলেরা হাসতে হাসতে বলে, “কাকা, এইবার আপনাকে নিয়ে রিল বানাব!”
কাকা গম্ভীরভাবে বললেন, “বানাও, তবে হ্যাশট্যাগ দিও #DuckDrive2025।”

***

পটাশপুর গ্রামে সপ্তাহে একদিন বসে পঞ্চায়েত সভা—সাধারণত কেউ কারো গরু চুরি করেছে, কিংবা খেজুর গাছ থেকে রস কে বেশি নিয়েছে, এসব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু আজকের দিনটি ছিল আলাদা। কারণ, কাকা ঘোষণা দিয়েছেন, “আমি সভায় আসছি বিশেষ বৈজ্ঞানিক বিবৃতি দিতে।” এই ঘোষণাতেই গাঁয়ের লোকের কৌতূহল তুঙ্গে।
সকাল সকাল পঞ্চায়েত ঘরে জমে গেল ভিড়। পঞ্চায়েতের মাঝখানে চৌকি, তার চারপাশে মোড়ায় বসে আছে সবাই—মদন হাঁসওয়ালা, মধু চা-ওয়ালা, গোবিন্দ মোড়ল, এবং আরও অনেকে। এমনকি হাটের কবিরাজ স্যারও এসেছেন, কারণ গুজব রটে গিয়েছিল কাকা নাকি হাঁস দিয়ে রোগ সারাবেন।
ঠিক ১১টা বেজে ৪ মিনিটে কাকা প্রবেশ করলেন, গায়ে পরা ছিল একখানা সাদা ধুতি, যার উপরে কলম দিয়ে লেখা—“বিজ্ঞান বাঁচাও, হাঁস বাড়াও।” সঙ্গে একটি ব্যাগ, যার ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই হাঁসের “ক্যাঁ ক্যাঁ” শব্দ ভেসে আসছিল।

কাকা চৌকির সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, “বন্ধুগণ, আমি আজ আপনাদের সামনে এমন এক ঘোষণা করতে এসেছি, যা এই পটাশপুরকে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে দিতে পারে।”
একজন চমকে উঠল, “পটাশপুর মানচিত্রে নেই?”
কাকা বললেন, “আছে, কিন্তু একেবারে নিচের দিকে। এবার উপরে উঠবে!”
তিনি ব্যাগ থেকে একটি হাঁস বের করে মোচড় দিয়ে সামনে ধরলেন, আর বললেন, “এই যে, এই হাঁস। একে আমি ব্যবহার করছি যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে।”
সবাই স্তব্ধ। কেউ বিশ্বাস করছে না, কেউ হেসে ফেলছে। পঞ্চায়েত সভাপতি বললেন, “মানে কাকা, আপনি বলছেন এই হাঁস দিয়ে গাড়ি চলবে?”
“না না, এত দূর না। আমি সাইকেল বানিয়েছি। হাঁস চালাবে।”
সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দ হাঁসার মতো হেসে পড়ে গেল। “তাহলে তো কাকাও গাড়ি চালাবে একদিন!”
কাকা কিন্তু গম্ভীর—“তোমরা হাসছো, জানো না, বিদেশে গরু দিয়ে গাড়ি টানা হয়। আমি তো হাঁস দিয়েই করছি। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিবিহীন!”
এমনকি পঞ্চায়েতের বিদ্যুৎ দপ্তরের প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে বললেন, “তাহলে আমরা যদি হাঁস কিনে বসি, পেট্রোল স্টেশন বন্ধ করে দিই?”
কাকা উত্তরে বললেন, “না না! সবই একে অপরের পরিপূরক। শুধু হাঁস থাকলেই হবে না, চালক দরকার। কিন্তু এই হাঁস চালক-কম-ইঞ্জিন!”

হাসির রোল উঠল, কেউ ফোন বের করে ভিডিও তুলতে লাগল, কেউ বলল, “কাকাকে Bigg Boss-এ পাঠানো উচিত!”
কিন্তু ঠিক তখন কাকা পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে বললেন, “এই যে, এই আমার হাঁসচালিত সাইকেলের নকশা। আমি চাই পঞ্চায়েত এটাকে সরকারি অনুমোদন দিক।”
পঞ্চায়েত সভাপতি বললেন, “কিন্তু কাকা, আপনি একবার চালিয়ে দেখান না আগে?”
“ঠিক আছে, বড়োদিনের মেলায় আমি প্রথম ‘Duck Cycle’ প্রদর্শন করব। দেখিয়ে দেব এই পটাশপুরে কি জিনিস তৈরি হয়।”
গ্রামের লোকজন তখন ছবি তুলছে, কেউ বলছে—“এই হলো আমাদের পটাশপুর! যেখানে বিজ্ঞান মানে হাঁস আর আবিষ্কার মানে হাসি!”

***

পঞ্চায়েতে ঘোষণা দেওয়ার ঠিক পরদিনই হরিপদ কাকা নিজের হাঁসদের নিয়ে তৈরি হয়ে গেলেন এক মহাবিপ্লবের যুদ্ধে। এই যুদ্ধ, মানুষের বিরুদ্ধে নয়—অলসতা, গাধামো, আর হাঁসদের ‘আমি কেন?’ মনোভাবের বিরুদ্ধে।

কাকা সকালবেলা উঠেই হাঁসদের নাম ধরে ডাকলেন—“বিমলা, চিমলা, টুলটুল, গোবুরাম, আর বাচ্চু।” হাঁসদের এতদিন নাম ছিল না, কিন্তু কাকা বুঝলেন, নাম না থাকলে কমান্ড দেওয়া যায় না। আর বাচ্চু নামের হাঁসটা একটু মোটা ও বোকা—সে কিছুতেই বোঝে না দড়ি মানে টান দিতে হয়, ঠ্যাং মানে গতি, আর মোয়া মানে পুরস্কার!

প্রথম ট্রেনিং ছিল—”সোজা হাঁটো।”
হাঁসদের সামনে একটা বাঁশের সরু রাস্তায় কাকা দাঁড়িয়ে হাঁসের পিছনে মোয়া নিয়ে বলছেন, “এগোও।”
বিমলা আর টুলটুল একটু চলল, তারপর গোবুরাম হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরে ধানের ক্ষেতে ঢুকে গেল। বাচ্চু তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা চুলকাতে লাগল!
কাকা চেঁচিয়ে উঠলেন, “না না না! এভাবে হবে না। এগুলো আসলে সেনা প্রশিক্ষণ ছাড়া শিখবে না।”

তখন শুরু হল দ্বিতীয় ধাপ—“সামরিক হাঁস-শিক্ষা”।
পুরো মাঠ ঘিরে কাকা বানালেন ছোটখাটো বাধা—ইটের গুহা, বাঁশের খোপ, পুকুরের পাড়ে কাঠের বোল্ডার। হাঁসদের নিয়ে চলল কসরত—ঝাঁপ, হামাগুড়ি, বাঁক নেওয়া।
তিনদিনে টুলটুল আর চিমলা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেল। বিমলা একটু চালাক, সে মোয়া দেখলেই দৌড় শুরু করে। কিন্তু বাচ্চু—সে শুধু গায়ে বাতাস লাগায় আর মাঝে মাঝে হাঁচে!

কাকা বাধ্য হয়ে একদিন বললেন, “দেখ বাচ্চু, তুই যদি শিখিস না, তোকে হাঁসের বদলে ‘কুঁড়েমি গবেষণা’ বলে পাঠিয়ে দেব।”
বাচ্চু কিচ্ছু বুঝল না, কিন্তু মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল পুকুরে সাঁতার কাটতে।

তারপর এল “সাইকেল সংযুক্তি ট্রেনিং”।
কাকা হাঁসদের সামনে সাইকেল রাখলেন। সাইকেলের প্যাডেলে লাগানো আছে পাঁচটা ছোট দড়ি, সোজা গিয়ে হাঁসদের গলায়। বাঁদিকে বাঁক নিলে বিমলা, ডানে গেলে গোবুরাম।
সেই প্রথম দিনে, সাইকেল শুরু করতেই টুলটুল সোজা দৌড়ে গেল পুকুরের দিকে, গোবুরাম মোয়ার লোভে পিছনে টান দিল, আর বাচ্চু গলায় দড়ি নিয়ে বসে পড়ল। ফলাফল—সাইকেল সোজা খালে পড়ল! কাকা কাদা থেকে উঠলেন, জামা ছিঁড়ে গেছে, মুখে হাঁসের পালক, আর হাতে ছেঁড়া মোয়া।

তবে কাকা হার মানলেন না। বললেন,
“অলংকারে না হয় ভুল ছিল,
তবু আমার পরিকল্পনা ছিল সঠিক।
এই হাঁসের পেছনে না থেকে,
তাদের সামনে খাবার দাও,
তবে তারা চলবে!”

তারপর তিনি চালু করলেন “পজিটিভ রিওয়ার্ড সিস্টেম”—প্রতিবার হাঁস প্যাডেল টানে, কাকা দেয় ছোট মোয়া।
এক সপ্তাহের মধ্যে বিস্ময়! হাঁসেরা দিনে অন্তত একশো মিটার টানতে পারছে সাইকেল।

গ্রামের ছেলেরা হর্ষধ্বনি দিয়ে বলল,
“দেখেছো, হাঁসরা এখন মুটকি নয়, রোডরানার!”

***

পটাশপুরের বড়োদিনের মেলা মানেই চারদিকে আলো, ঝলমলে স্টল, ফুচকা-চটপটির লাইন, আর মাঝখানে একটি খোলা মাঠে নানা প্রতিযোগিতা—ঝুড়িতে বল ফেলো, গালে বেলুন ফোলাও, এমনকি ‘কে বেশি ঢেঁকুর দিতে পারে’ তাও একবার হয়েছিল।

কিন্তু এইবার সব ছাপিয়ে গেছে একটিই ঘোষণা—
“সন্ধ্যা ৬টায় মঞ্চে থাকছে বিজ্ঞানী হরিপদ রায় ও তাঁর বিপ্লবী আবিষ্কার ‘হাঁসের সাইকেল’!”
গাঁয়ের ছেলে-মেয়েরা তখন থেকেই TikTok লাইভ অন করে রেখেছে, কেউ পোস্ট করেছে—“পটাশপুরে এলন মাস্ক জন্মেছেন।”
মেলায় মানুষের ভিড় এতটাই বেড়েছে যে চটপটির মশলা ফুরিয়ে গেছে, আর ফুচকার জল কম পড়ে গেছে কুয়োতেও।

সন্ধ্যা ছ’টার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে, কাকা এসে পৌঁছালেন তাঁর অবিষ্কার নিয়ে। সামনে একখানা ঘোড়ার গাড়ির মতো সাজানো প্ল্যাটফর্ম, যার উপরে রাখা সাইকেল—আর সাইকেলের সামনে পাঁচটি হাঁস দাঁড়িয়ে গলায় লাল ফিতা বাঁধা। বাচ্চু হাঁসের গলায় ছোট ঘন্টা ঝোলে—সে একটু মোটা হলেও এখন কাকা’র ভাষায় “মোটর ইন দ্য মিডল”!

কাকা গলায় মাইক টেনে বললেন,
“বন্ধুগণ, এ শুধু সাইকেল নয়, এ এক বিপ্লব।
যেখানে মানুষ হাঁসের ডিম খায়, আমি বলি—চলো হাঁসের গতি খাও!”

অতএব, কাকা নিজের গায়ে পরেন তাঁর বানানো জার্সি, যাতে লেখা—“Duck Drive Pilot – Official”
হঠাৎ বাঁশির শব্দে হাঁসেরা সামান্য নড়ল। কাকা মোয়া দেখিয়ে বললেন, “চলো!”
আর তখনই ঘটে যায় সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত—পাঁচটি হাঁস একসাথে টান দেয় সাইকেলের প্যাডেল!
সাইকেল চলতে থাকে আস্তে আস্তে—একটু হেলতে দুলতে, কিন্তু সামনে দিকে। মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে কাকা দুহাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন,
“এগিয়ে চল পটাশপুর! এ শুধু সাইকেল নয়, এ হল স্বাধীনতা!”

লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ে, কেউ মোবাইলে বলছে, “দ্যাখ দ্যাখ, কাকা উড়ান দিচ্ছে হাঁস দিয়ে!”,
কিন্তু সবার মুখেই বিস্ময় আর আনন্দ।
কেউ বলছে, “এই তো বাস্তব ফিউচার!”
কেউ বলছে, “এই সাইকেলে করে স্কুল যাব রে!”

এমন সময় এক সাংবাদিক এগিয়ে এসে বললেন,
“আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী, কাকা?”
হরিপদ কাকা গম্ভীর মুখে বললেন,
“আমি এখন ভাবছি, হাঁস দিয়ে ড্রোন বানানোর কথা।”
সাংবাদিক চুপ। লোকজন হাসতে হাসতে একে অপরকে বলছে, “এই কাকা না থাকলে আমাদের পটাশপুর এত বিখ্যাত হতো না!”

এদিকে হাঁসগুলো একটু ক্লান্ত, বিশেষ করে বাচ্চু—সে সাইকেলের সামনে বসে পড়েছে। কেউ তাকে জল খাওয়াচ্ছে, কেউ মোয়া।
তবে কাকা বিজয়ীর মতো বুক চিতিয়ে বলছেন,
“পটাশপুরের ইতিহাসে এই দিন লিখে রাখা হোক—যেদিন মানুষ নয়, হাঁস চালালো গাড়ি!”

***

বড়োদিনের মেলায় “হাঁসের সাইকেল” দেখার পর সবার মুখে মুখে একটাই কথা—“তুমি দেখেছো? হাঁস চালায় গাড়ি!”
একজন ভিডিও তুলে পাঠিয়েছিল WhatsApp গ্রুপে ‘পটাশপুর বিজ্ঞান সমাজ’। সেখানে থেকে সেটা যায় Facebook-এ।
Facebook থেকে তা যায় YouTube-এ।
YouTube থেকে যায় এক নামকরা সাংবাদিকের নজরে।
আর সেই সাংবাদিক, “সত্য প্রকাশ” নামের একটি বিখ্যাত পত্রিকার ফিচার বিভাগে খবর ছাপান:

> “গাঁয়ের বিজ্ঞানী, হাঁসের গতি—হরিপদ কাকার আজব আবিষ্কার”
সঙ্গে ছবিতে কাকা মাথায় হেলমেট পরে দাঁড়িয়ে, পাশে বাচ্চু হাঁস ক্লান্ত মুখে বসে।

 

আর ব্যস! শুরু হলো গাঁয়ে ঢল।
পরদিন সকালবেলা পটাশপুর স্টেশন থেকে নামল একদল লোক—ক্যামেরা, বুম মাইক, স্যুট পরে শহুরে ভাব।
তারা কাকার বাড়ি এসে বলে,
“আপনি কি হরিপদ রায়? হাঁস-ড্রাইভিং ইনভেন্টর?”
কাকা তখন লুঙ্গি পরে গোরু খাওয়াতে ব্যস্ত। তিনি বললেন, “আমি তো হাঁস দিয়ে চাষাবাদ করতে চেয়েছিলাম, শহর এসে আবার ড্রাইভিং বের করল?”

লোকজন বলল,
“না না, আপনাকে আমরা টিভি চ্যানেলে নিয়ে যাব। লাইভ শোতে ডাকছি।”
কাকা তাতে রাজি নন, কিন্তু গোবুরাম হাঁস দেখে এক সাংবাদিক মুগ্ধ হয়ে বলল,
“এই হাঁসের তো আলাদা Instagram অ্যাকাউন্ট হওয়া উচিত!”

এদিকে গ্রামের লোকেরাও দ্বিধায় পড়ে গেল।
একপক্ষ বলল, “কাকা নায়ক। ওঁর নামে গাঁয়ের মোড়ের নাম হোক ‘হাঁস-চত্বর’।’’
অন্যপক্ষ বলল, “হাঁস তো গরিবের খাদ্য। এখন যদি সরকার হাঁস কিনে নেয় সাইকেল চালাতে, তাহলে খাওয়া কীভাবে হবে?”

তবু, সবার মধ্যে একটাই উত্তেজনা—টিভি শোতে কাকা যাচ্ছেন!
কাকার জামাইয়ের ছেলের বন্ধু মানে শ্যামল, কাকাকে দিলেন কোট-প্যান্ট। কাকা পরলেন, সঙ্গে হাঁসের ফিতা গলায়।
টিভি শো-তে অ্যাংকর জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কেন হাঁস বেছে নিলেন? গরু, ছাগল নয়?”
কাকা উত্তর দিলেন,
“গরু মহারাজ, সে রাজনীতিতে ব্যস্ত। ছাগল গান গায়। হাঁসই সময়মতো ক্যাঁ ক্যাঁ করে।”

পুরো স্টুডিও ফাটিয়ে হাসি!
এরপর সরকার থেকে আসে এক চিঠি:

> “আপনার আবিষ্কারে আগ্রহী আমরা। অনুগ্রহ করে প্রযুক্তিগত বিস্তারিত দিন।”
কাকা সেই চিঠি নিয়ে এলেন পঞ্চায়েতে, বললেন,
“আমি তো কিছুই লিখিনি। সব তো মাথায়!”

 

পঞ্চায়েত বলল, “তাহলে মাথাটাই সরকারে দাও!”
কিন্তু এরপরই বাঁধে বিপত্তি—হাঁস চুরি!
রাতে কাকার গোয়ালঘর থেকে টুলটুল আর চিমলা গায়েব। গ্রামের লোক বলল,
“হ্যাঁরে, হাঁস এখন সরকারি সম্পত্তি, ওরা হয়ত অপহরণ করেছে গবেষণার জন্য!”

কাকা চিন্তিত, বললেন,
“আমি তো বিজ্ঞান করছিলাম, এখন তো লাগছে CID লাগাতে হবে!”
গ্রামের এক গোঁফওয়ালা ব্যাক্তি বলল,
“কাকা, আগে তো হাতের মোয়া দাও, পরে কথা বলো!”

***

পটাশপুরে এত বড় চুরি আগে হয়নি।
না মোবাইল, না বাইক, না গরু—চুরি হয়েছে হাঁস।
তা-ও আবার কাকার সেরা দুই চালক—টুলটুল আর চিমলা!

সকালে হরিপদ কাকা হাঁসেদের জল খাওয়াতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আরে রে রে! টুলটুল কই? চিমলা কই?”
বিমলা তখন ঠ্যাং চেটে বলল, “আমরা তো সন্ধ্যাবেলা ঘুমাতে গেছিলাম, তারপর থেকে দেখি দড়ি কাটা!”
গোবুরাম বলল, “আমি শুধু গলায় হালকা আতরগন্ধ পেয়েছি, মানে শহুরে লোক!”

সঙ্গে সঙ্গে গোটা পটাশপুরে ‘হাঁস হাইজ্যাক’ কাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চায়েতে ডাকা হয় এক জরুরি সভা—
কাকা, গ্রামপ্রধান, গোপাল দা, আর উপস্থিত ছিলেন অপ্রয়োজনীয়ভাবে স্বাস্থ্যকর্মী রানুদি (তিনি এসেছিলেন টেট ফর্ম ভরাতে)।
কাকা বললেন,
“আমরা তো আবিষ্কার করেছিলাম গর্বে, এখন তা নিয়ে হচ্ছে গুপ্তচরগিরি! দোষীকে ধরা চাই!”

ঠিক তখনই হাজির হয় বাচ্চু।
সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় কাকার সামনে, ঠ্যাং টিপে একটা আওয়াজ করে, আর ঠোঁটে ঝুলিয়ে দেয় কিছু…
এক টুকরো কালো কাপড়!

কাকা বললেন, “এ তো দেখে মনে হচ্ছে শহরের লোকের প্যান্টের কাপড়!”
রানুদি ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, “এই তো! এটা তো ‘মেট্রো ডিউটি ডিটারজেন্ট’-এর গন্ধ!”
মানে বুঝে গেল সবাই—চোর এসেছে শহর থেকে, হয়তো কোন গবেষণাগার থেকে!

কাকা বললেন, “আমাকে দিল্লি যেতে হবে!”
গ্রামপ্রধান বললেন, “গেলেই তো হবে না। বাচ্চু যাবে তোমার সঙ্গে। ওর ঘ্রাণশক্তি আছে, ও-ই পথ চিনে নেবে!”

এবার শুরু হয় ‘বাচ্চুর মিশন: হাঁস উদ্ধার’!
হরিপদ কাকা আর বাচ্চু হাঁস চেপে যান শহরের দিকে।
পথে তারা যায় এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, যেখানে কিছু ছাত্র হেলমেট পরে হাঁসের সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছে।
কাকা বললেন, “এ তো আমার প্যাটেন্ট চুরি!”
কিন্তু বাচ্চু ওদের পেছনের ফটকে গিয়ে গন্ধ শুঁকে চেঁচাতে থাকে—“ক্যাঁ! ক্যাঁ!”

সবাই তাকিয়ে দেখে—একটা কাচের ঘরে টুলটুল আর চিমলা, পরনে সাদা রোদের চশমা আর মাথায় EEG মেশিন!
হ্যাঁ! ওরা চালিত হচ্ছে মস্তিষ্ক গবেষণার জন্য—এক নামকরা বায়োটেক কোম্পানি ওদের অপহরণ করে এনে বলেছে,
“হাঁসের মস্তিষ্কেই ভবিষ্যতের এআই আছে!”

কিন্তু তখনই বাচ্চু বীরত্ব দেখায়।
সে দড়ি টেনে, খাঁচার দরজা খুলে দেয়। তারপর হাঁ করে খেয়ে ফেলে গবেষকের মোয়ার বাক্স!
গোটা ল্যাব জুড়ে হৈচৈ—
“এই মোটা হাঁস সব খেয়ে ফেলল!”
কিন্তু ততক্ষণে টুলটুল আর চিমলা দৌড়ে বেরিয়ে যায় কাকার কাছে।
কাকা তাদের কাঁধে করে নেন, আর বলেন,
“চলো পটাশপুরে ফিরি, আমাদের হিরো এখন বাচ্চু!”

পটাশপুরে ফিরে বাচ্চুকে দেওয়া হয় ‘গাঁয়ের বীর’ উপাধি।
তার গলায় ঝোলে গোল্ডেন ঘণ্টা, যার শব্দ শুনেই লোকজন বলে,
“চলো হাঁস দেখব!”

কাকা বলেন,
“আমি আবিষ্কার করেছিলাম প্রযুক্তি, কিন্তু মানুষ আবিষ্কার করল বাচ্চুর ভেতরের সাহস!”

***

পটাশপুর যেন এখন বলিউড নয়, হলিউড!
কাকার “হাঁসের সাইকেল” কীর্তি শুধু কলকাতা নয়, পৌঁছে গেছে সোজা লন্ডন, আমেরিকা, আর কানাডা অবধি।
BBC-র এক সাংবাদিক এক রাতের মধ্যেই বানিয়ে ফেলেছে ডকুমেন্টারি:
“The Duck That Drove the Nation”
তাতে কাকার হাঁস গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে হাঁটছে, আর পেছনে বাজছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক:
“Walk like a duck… Talk like a duck… Ride the dream!”

এই ভিডিও ভাইরাল হতে না হতেই পটাশপুরের ডাকঘরে আসতে থাকে চিঠির পাহাড়।
প্রথমে চিঠি এল NASA থেকে—

“We are deeply curious about the kinetic efficiency of duck-propelled vehicular design. Kindly ship the model and the duck.”
কাকা বললেন, “দ্যাখো ভাই, আমি হাঁস পাঠাব না। NASA যদি হাঁস চায়, আগে ডিম পাঠাক।”

এরপর এল Apple কোম্পানি থেকে—

> “We wish to collaborate on ‘iDuck’: a bio-mechanized smart mobility assistant.”
কাকা উত্তর দিলেন,
“তোমরা তো চার্জে চলে। আমার হাঁস চালায় ঝাঁপ দিয়ে। iDuck বানাতে গেলে হাঁসের খাবার অ্যাপে দিতে হবে!”

গ্রামে তো শুরু হলো হুলুস্থুল।
পঞ্চায়েত একেবারে ঘোষণা করল,
“পটাশপুরকে বানানো হোক হাঁস গবেষণা কেন্দ্র!”
এক ভাসমান সুপারিশ এলো,
“পটাশপুর বিমানবন্দর তৈরি হোক, যাতে বিদেশিরা হাঁস দেখতে আসে!”
গ্রামের মোড়ের দোকানে লেখা হলো:
“Duckla—Tea with Science”
যেখানে হাঁস-চা বিক্রি হয় (মানে চায়ের কাপের গায়ে হাঁস আঁকা)।

হরিপদ কাকা তার বাড়ির পেছনের খোলা মাঠে বানালেন সাইকেল টেস্টিং রেঞ্জ।
রোজ সেখানে টুলটুল, চিমলা, গোবুরাম আর বাচ্চু সকাল সন্ধ্যে এক রাউন্ড দেয়।
গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দলে দলে আসে দেখতে।
কেউ ছবি তোলে, কেউ ছবি তোলে হাঁসের সাথে সেলফি—
কেউ ক্যাপশনে লেখে,
“এটাই ফিউচার—ডিজেল নয়, হাঁসেল!”

একদিন এল কানাডা থেকে এক সাদা চামড়ার লোক—চোখে চশমা, মুখে বিস্ময়।
বলল,
“I want to invest in Duck Tech. You are the Duck Father!”
কাকা তখন বললেন,
“তুমি Duck বলছো, আমি বলি এটা বাংলা আবেগ। হাঁস মানেই পুকুর, চালডাল আর ভালোবাসা।”

বাচ্চুর জন্য বানানো হলো এক আলাদা রুম—এয়ার কন্ডিশন, মোয়া ভর্তি ফ্রিজ, আর গায়ে দেওয়ার জন্য চামচিকা হালকা তোয়ালে।
বাচ্চু এখন আর হাঁটে না—গাড়িতে করে ঘোরে।
সঙ্গে একজন ক্যামেরাম্যান সর্বক্ষণ ছবি তোলে।
পটাশপুরের লোকজন এখন বাচ্চুর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে লাইক দেয়—
@ducku_the_bachchu

পঞ্চায়েত ঠিক করল,
“পুজোর থিম হবে: হাঁসায়ন ২০৩০!”
যেখানে প্রতিমার পেছনে থাকবে এক বিশাল সাইকেল, চালাচ্ছে পাঁচটি হাঁস আর মণ্ডপে ঢুকতে গেলে সবাইকে হাঁসের আওয়াজে সাড়া দিতে হবে—“ক্যাঁ!”

***

পটাশপুরের কীর্তি এতদূর গড়ায়, যে একদিন ফরাসি রাষ্ট্রদূত চিঠি পাঠান,

“We cordially invite Mr. Haripada Ray and Team Duckcycle to the International Eco-Mobility Expo, Paris.”

কাকা প্রথমে রাজি না হয়ে বললেন,
“আমি তো হাঁস দিয়ে মাছ খোঁজার প্ল্যান করছিলাম। এখন প্যারিস গিয়ে ফ্যাশন দেখবো নাকি?”
তবে গোবুরাম বলল,
“সুযোগ এসেছে, পায়ের খোঁচা দাও কাকা!”
অতএব দল রেডি। হাঁসদের জন্য তৈরি হয় বিশেষ এয়ারবাস—‘Duck Jet 1’
যেখানে প্রতিটি সিটে থাকে মোয়া, পপকর্ন আর রিল্যাক্সিং সঙ্গীত:
“ক্যাঁ ক্যাঁ করো না বন্ধু, পাখা মেলে উড়ো…”

প্যারিসে পৌঁছেই চমক!
ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছে—টুলটুল, চিমলা, গোবুরাম আর বাচ্চু হাঁস, আর তাদের পেছনে সাদা কোট পরা হরিপদ কাকা।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী?
• জার্মানির “রোবোটিক টার্টল”
• আমেরিকার “সোলার স্কেটিং বিড়াল”
• চীনের “হাইড্রোজেন-পাওয়ার্ড হাঁস-ড্রোন”

রেস শুরু হলো!
সবার নজর বাচ্চুর দিকে, কারণ সে এত মোটা, চলতে গেলেই গড়াগড়ি খায়।
কিন্তু হঠাৎই হোস্ট বলল,
“India’s duck team has no fuel, no circuit… but they have heart.”
আর এই কথাতেই কাকা বলে উঠলেন,
“হাঁসেরা চালায় মন দিয়ে, আর মনেই শক্তি!”

ঘণ্টা বাজতেই সাইকেল চালু।
রোবোটিক টার্টল স্লো, বিড়াল ব্যালান্স রাখতে পারেনা, আর হাঁস-ড্রোন তো মাঝপথে ডানা ছিঁড়ে পড়ে যায় এক ফরাসি কফিশপে।
এদিকে টুলটুল-চিমলা দমদার গতিতে এগোচ্ছে।
গোবুরাম মাঝখানে ব্রেক কষে এক গ্লাস জল খায়।
আর তখনই দেখা যায়—বাচ্চু বীরত্বের ছাপ রাখে—সে সোজা রাস্তা না নিয়ে ছোট্ট খালের ওপর দিয়ে লাফিয়ে শর্টকাট নেয়!

ফিনিশ লাইন পার করে — হাঁসদের দল বিজয়ী!

মঞ্চে উঠে আসে কাকা।
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন,
“You have changed the way we look at ducks!”
কাকা বলেন,
“আমি তো হাঁসকে দেখেছি আগে কড়াইয়ে। এখন বুঝেছি, ওদের ডানায়ও দেশ গড়া যায়।”

গ্রামে ফিরেই কাকা গঠন করলেন এক সংস্থা—“হাঁসায়ন ভবিষ্যৎ”
যেখানে বাচ্চারা হাঁস দিয়ে প্রকল্প বানায়, আর বৃদ্ধেরা হাঁসের সান্নিধ্যে বসে চা খায়।

আজ পটাশপুরের ঢোকার মুখে লেখা—
“Welcome to the Land of Ducks and Dreams”
আর একটা নতুন গান বাজে রোজ স্কুলে—
“হাঁস আমাদের ভবিষ্যৎ, প্যাডেলে আমাদের গতি!”

হরিপদ কাকা তাঁর ডায়েরিতে লেখেন,
“আমি মানুষকে শিখিয়েছি কীভাবে হাঁস দিয়ে সাইকেল চলে, আর হাঁসদের শিখিয়েছি কীভাবে মানুষকে নিয়ে এগোতে হয়।”

দর্শক হাসে, হাঁস ক্যাঁ ক্যাঁ করে, আর পটাশপুর ইতিহাস হয়ে যায়!

1000028312.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *