শ্যামল সেন
অধ্যায় ১
হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, পাড়ার সকলে যাকে আদর করে হরিদাস কাকা বা হরিদাস বাবু বলে ডাকে, তিনি উত্তর কলকাতার এক পুরনো ভাড়াবাড়িতে থাকেন। তাঁর বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই, চেহারায় মোটাসোটা, গায়ের রঙ গমগমে, মাথার সামনের দিকে টাক, আর পিছনের দিকে কিছু ঝাঁকড়া চুল, যেগুলো তিনি প্রতিদিন সকালে খুব যত্ন করে সিঁদুরি তেল মাখিয়ে আঁচড়িয়ে নেন। গাল ভর্তি বড় বড় গোঁফ, যা তিনি বিশেষ যত্নে কেটে রাখেন যেন পাড়ার ছেলেরা তাকে “মশাই” সম্বোধন করার সময় ভক্তি ভরে বলে। হরিদাস বাবুর দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ এতটাই একঘেয়ে যে পাড়ার মানুষ তার সময়ানুবর্তিতার উদাহরণ টানে, “ওই দেখ, হরিদাস কাকা বেরোলো মানেই সাতটা বেজেছে।” সকাল ঠিক সাতটায় তিনি তাঁর লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরে পাড়ার গলির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ঘাটে যান। রাস্তায় যত চা দোকান, তাতে সবাই তাকে নমস্কার করে, কেউ চা অফার করলে তিনি বিনয়ের সাথে বলেন, “ধন্যবাদ, খেয়েছি।” গঙ্গার ধারে বসে তিনি কিছুক্ষণ বাতাস খান, পায়চারি করেন, আর ফেরার সময় পাড়ার দুধওলা থেকে দুধ আর মিষ্টিওলা থেকে ছানার জিলিপি কিনে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে স্ত্রী অমলার হাতে তৈরি লুচি-সবজি খেয়ে চশমা পরে পত্রিকা নিয়ে বসেন। তার চশমার কাচ এত মোটা যে চশমা খুললে তিনি নিজের মুখও ঠিকঠাক দেখতে পান না।
পাড়ার মানুষ হরিদাস বাবুকে যেমন শ্রদ্ধা করে, তেমনি তার কিছু অভ্যাস নিয়ে মজা করতেও পিছপা হয় না। কারণ, হরিদাস বাবু ছিলেন সহজ-সরল মানুষ, যার জীবনের লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে সময় কাটানো। তার বন্ধুবান্ধবেরা প্রায়ই বলেন, “হরিদাসের জীবন যেন ঘড়ির কাঁটার মতো এক সুরে চলে।” পাড়ার ক্লাবের বাচ্চারা যখন ক্রিকেট খেলে, তখন তিনি মাঠের এক কোনায় বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে খেলা উপভোগ করেন। সন্ধ্যাবেলা তার আরেকটি নিয়মিত কাজ ছিল—দোকানের সামনে বসে অল্প আলোয় পানের খিলি চিবিয়ে অমলা দেবীর কাছে দিনের গল্প শোনানো। অমলা দেবী মাঝে মাঝে বিরক্ত হতেন, কারণ হরিদাস বাবু গল্পের মধ্যে নিজের একঘেয়ে রুটিনের বর্ণনা দিতেন, যেমন কার কোন দোকান খুলেছে, কোন দোকান আজ দেরিতে বন্ধ হয়েছে, পাড়ার নতুন ছেলে কীভাবে মায়ের হাত ধরে স্কুলে গেছে। তার কথা শুনতে শুনতে অমলা দেবী বলতেন, “কতবার বলেছি এসব ছেলেমানুষি খবর আমাকে শুনিও না। বরং বাজারের খবর দাও।” কিন্তু হরিদাস বাবুর মুখে তখন দুষ্টু হাসি খেলে যেত, কারণ তিনি জানতেন স্ত্রী এই কথার পরও তার গল্প শুনে যাবেই। পাড়ার মানুষ জানত, হরিদাস বাবুর জীবনেই মজা লুকিয়ে আছে—তার চেহারায়, হাঁটার ভঙ্গিতে, চুল আঁচড়ানোর পদ্ধতিতে, আর সেই অতি যত্নে রাখা গোঁফে।
যতটা সহজ তার জীবন, ততটাই সহজ তার স্বভাব। পাড়ায় কখনও কোন ঝগড়াঝাঁটি হলে তিনি সেখানে হাজির হয়ে বলতেন, “এ সব ছেড়ে শান্তিতে থাকো ভাই! আমাদের এ জীবনটাই তো ক’দিনের!” এমন মধুর বাণী শুনে ঝগড়ার রাগ গলে যেত, আর পাড়ার ছোটরা হাসি চেপে হরিদাস কাকার গম্ভীর মুখের দিকে তাকাত। কারণ, তারা জানত, এই মানুষটি নিজে কখনও কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। তার জগৎ ছিল ছোট, কিন্তু সেই ছোট জগৎটাতেই সে ছিল রাজা। মাথার সামনের টাকটুকু তিনি লুকাতে চেষ্টা করতেন চুলগুলো কপালের ওপর টেনে নিয়ে, আর বাড়ির আয়নায় প্রতিদিন দাঁড়িয়ে অন্তত দশ মিনিট ধরে সেট ঠিকঠাক করতেন। তার কাছে চুল ছিল গৌরবের বস্তু। যখনই কেউ বলত, “হরিদাস কাকার টাকটা বেশ বাড়ছে তো!”, তখন তিনি মৃদু হেসে বলতেন, “বয়স হয়েছে বাবা, এই তো হবে। তবে যতদিন চুল আছে, যত্ন থাকবে।” এই চুল নিয়ে তার আত্মপ্রসাদ এত বেশি ছিল যে পাড়ার সেলুনে চুল কাটাতে যাওয়ার সময়ও তিনি বলতেন, “সাবধানে কাটবে, বুঝলে? চুলের এক বিন্দু নষ্ট হবে না।”
তবুও এই সহজ-সরল, নিয়মমাফিক জীবনের মধ্যে এক অদৃশ্য একঘেয়েমি হরিদাস বাবুকে মাঝে মাঝে কুরে কুরে খেত। রাতে শোওয়ার সময় চুপচাপ শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবতেন, “জীবনে কোনো উত্তেজনা নেই, নেই কোনো নতুনত্ব। এভাবে কবে যে শেষ হয়ে যাবে দিনগুলো!” পত্রিকার বিনোদন পাতা বা টিভির সিনেমা দেখে তিনি মাঝে মাঝে আফসোস করতেন, “দ্যাখো দ্যাখো, কেমন স্টাইলিশ মানুষ, কী চুল, কী চেহারা! আমাদের জীবনটাও যদি এমন হতো!” তার স্ত্রী যখন পাশ থেকে বলতেন, “আর কী চাই বলো তো? ভালো খাওয়া, ভালো থাকা—সবই তো আছে!”, তখন তিনি মুচকি হেসে বলতেন, “সেই থাকাটার মধ্যেই তো নতুন কিছু দরকার অমলা। সব দিন এক রকম কাটলে তো জীবনটা শুকিয়ে যায়!” আর এই চিন্তা থেকেই অজান্তেই তার মনে একদিন বাসা বাঁধল সেই ‘নতুনত্বের ইচ্ছে’, যা আগামী দিনগুলোতে তাকে পাড়ার হাসির খোরাক করে তুলবে, আর তার চিরচেনা রূপের ওপর বয়ে আনবে এক অদ্ভুত ঝড়!
অধ্যায় ২
সেই দিনটা ছিল এক রবিবারের সকাল। হরিদাস বাবু যথারীতি গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার পর লুচি-সবজি খেয়ে চা নিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টোচ্ছিলেন। কিন্তু আজকের দিনটা যেন অন্যরকম মনে হচ্ছিল। বাইরের হালকা মিষ্টি হাওয়া, রোদের নরম ছোঁয়া আর দূরে শোনা যাচ্ছিল বাচ্চাদের হাসির শব্দ। পত্রিকার পাতায় চোখ পড়ল এক বড়ো বিজ্ঞাপনে—“নতুন হেয়ার স্টাইল, নতুন লুক! এই শীতে নিজেকে দিন এক নতুন চেহারা!” বিজ্ঞাপনের ছবিতে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের আধুনিক হেয়ার কাট, পাশে মোটা ফ্রেমের চশমা আর স্টাইলিশ গোঁফ। হরিদাস বাবু পত্রিকার পাতার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হতে লাগল, এই ছবিটা যেন তারই জন্য ছাপানো হয়েছে। মনেই হলো, “আরে, এই চেহারা যদি আমার হত, কী সুন্দর হতো! পাড়ার ছেলেরা আর হাসাহাসি করত না, বরং বলত, দেখো কী স্মার্ট হরিদাস কাকা!” তার বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল। এত বছর ধরে তিনি যেমন ছিলেন, ঠিক তেমন থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হতে লাগল, জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল একঘেয়ে ভাবে, এবার সময় এসেছে নতুন কিছু করার। তার মনে হলো, এই চেহারার পরিবর্তনই হয়তো তার জীবনে নতুন রঙ এনে দেবে।
হরিদাস বাবু পত্রিকাটি ভাঁজ করে রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চশমা খুলে নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। সামনের টাকটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পেছনের চুলগুলো যতই তিনি টেনে কপালের দিকে আনেন না কেন, টাকটা ঢাকা যাচ্ছে না। গোঁফটাও আগের মতো ঘন নেই, চুলের মধ্যে পাকা চুলের সংখ্যা যে কতটা বেড়ে গেছে, সেটা তিনি নিজেই গুনে শেষ করতে পারলেন না। নিজেরই যেন অচেনা লাগল মুখটা। ভাবলেন, “এবার তো সত্যিই কিছু করা দরকার।” দুপুরবেলা খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভবিষ্যতের কল্পনা করতে লাগলেন। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল—তিনি নতুন হেয়ার স্টাইলে পাড়ায় হাঁটছেন, পাড়ার ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে, পাড়ার মেয়েরা কচি কচি হেসে বলছে, “বাহ হরিদাস কাকা, কী স্মার্ট লাগছে আপনাকে!” এমনকি অমলা দেবীর মুখেও দেখা যাচ্ছে গর্বের হাসি। সেই কল্পনা করতে করতে তার মনে হলো, এই নতুন চুলের ছাঁট শুধু তার চেহারাই বদলাবে না, বদলে দেবে তার পুরো জীবন। পাড়ার সবার চোখে তিনি হবেন এক নতুন হরিদাস, যার চেহারা হবে সবার ঈর্ষার কারণ।
এখন আর অপেক্ষা করা যায় না—সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন হরিদাস বাবু। বিকেল হতেই তিনি পাঞ্জাবি বদলে হালকা রঙের শার্ট পরলেন, চুলে ভালো করে তেল মাখালেন আর জুতো পায়ে দিয়ে বেরোতে উদ্যত হলেন। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছে অমলা দেবী ডাক দিলেন, “এই শোনো, কোথায় যাচ্ছ?” হরিদাস বাবু একটু থমকালেন, কারণ এ প্রশ্নের উত্তর দেবেন কীভাবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাই মুচকি হেসে বললেন, “আরে, পাড়ার দোকানটা অবধি যাচ্ছি, কিছু দরকার।” অমলা দেবী তখনো বুঝলেন না, কিন্তু সন্দেহের চোখে তাকালেন, কারণ এমনিতেই হরিদাস বাবু হালকা শার্ট পরে কখনও দোকান অবধি যান না। যাই হোক, তিনি আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। হরিদাস বাবু বেরিয়ে পড়লেন পাড়ার সেলুনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে তার বুকের মধ্যে কেমন যেন দোলা দিচ্ছিল, যেন জীবনের এক বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। রাস্তার লোকজনের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন, কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে কিনা। মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা যেন এক বিশেষ দিন। পাড়ার গলিতে হাওয়ার দোলায় শুকনো পাতা নাচছে, আর হরিদাস বাবু বুক চিতিয়ে সেই গলিপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।
সেলুনের সামনে পৌঁছে হরিদাস বাবু একবার থেমে দাঁড়ালেন। পাড়ার সেই পুরনো সেলুন, যার কাঁচের দরজা আর চায়ের কাপে জমে থাকা লাল চা-র দাগ আজও রয়েছে। ভেতরে লোহার কাঁচা কাঁচা চুলের চেয়ার আর দেওয়ালে নায়কদের ছবি। ভেতরে ঢুকেই তিনি অনুভব করলেন, ভেতরের ছেলেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ, যে হরিদাস বাবু প্রতি তিন মাস অন্তর চুলের প্রান্ত সামান্য ছেঁটে বাড়ি ফিরে যান, সেই হরিদাস বাবু আজ নতুন চেহারায় হাজির। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “শুনো, আজ একেবারে নতুন একটা হেয়ার স্টাইল চাই। এমন কেটে দেবে যেন পাড়ার লোক চিনতে না পারে। বুঝেছ?” সেলুনের তরুণ ছেলেটা, যে সদ্য কয়েকটি নতুন কাঁচি কিনেছে আর স্টাইলের বই ঘেঁটে নিজেকে বড় হেয়ার স্টাইলিস্ট ভাবে, সে যেন স্বপ্নের সুযোগ পেয়ে গেল। চোখ মেলে হরিদাস বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে কাকা, আজ আপনাকে এমন স্টাইল দেব, যে পাড়ার ছেলেরা আপনাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।” হরিদাস বাবু গর্বে বুক চিতিয়ে চেয়ারে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, “এই তো, এভাবে শুরু হল আমার নতুন জীবন। আর কেউ হাসবে না, বরং বলবে, এই বয়সে কী স্মার্ট চেহারা!”
অধ্যায় ৩
সেদিনের বিকেলটা পাড়ায় অন্যরকম নীরব ছিল। মেঘলা আকাশের নিচে হরিদাস বাবু যখন পাড়ার গলিপথ ধরে সেলুনের দিকে হাঁটছিলেন, তার মনে হচ্ছিল, যেন এই যাত্রা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা। এই পথে তিনি কতবার যে হেঁটেছেন, তার হিসাব নেই, কিন্তু আজকের পদক্ষেপগুলো অন্যরকম। প্রতিটি পায়ে পায়ে মনে হচ্ছিল, এই পায়ের ছাপের মধ্যে লেখা হচ্ছে নতুন হরিদাসের গল্প। পাড়ার চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুন্না চা-ওয়ালা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে ভাবল, “এ আবার কোথায় চলল এই বিকেলে, নতুন জামা পরে, চুলে এতো তেল দিয়ে?” কিন্তু মুখে কিছু বলল না। হরিদাস বাবুর চোখে তখন এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, মনে হচ্ছিল, তার মনের মধ্যে এক নতুন জোয়ার এসেছে। তিনি পকেটে হাত দিয়ে পনেরো টাকার নোটগুলো স্পর্শ করে নিশ্চিত হলেন, ঠিক আছে, যা যা দরকার সব আছে। সেলুনের দরজার কাছে গিয়ে তিনি এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শ্বাস নিলেন। সেই পুরনো সেলুন, সেই চেনা কাঁচের দরজা, যার ওপর সাদা রঙে লেখা: “শ্রীগুরু হেয়ার কাটিং সেলুন – অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রাখুন।” সেই লেখা দেখে হরিদাস বাবুর মনে সাহস জন্মাল।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পরিচিত ঘ্রাণ ভেসে এল নাকে—তেল, সাবান, চুলের গন্ধ মিশ্রিত সেই গন্ধ, যা তার শৈশব থেকে চেনা। দেওয়ালে নায়ক নায়িকার ছবি, কারও চুল গোঁফের স্টাইল দেখিয়ে দেওয়া আছে। সেলুনের কোণায় রাখা পুরনো ফ্যান ঘুরছে ধীরে ধীরে, আর সেই বাতাসে নড়ছে ঝোলানো খবরের কাগজের টুকরো। ভেতরে তিনটি চেয়ারে তিনজন কাস্টমার বসা, আর একপাশে বসে আছে পাড়ার এক দাড়িওয়ালা কাকু, সে গলা চুলকোতে চুলকোতে বলছে, “আরও কটা দিন দাড়ি না কাটলেও চলত, কিন্তু স্ত্রী রাগ করল তাই এলাম।” এইসব দৃশ্য দেখে হরিদাস বাবু চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলেন। সেলুনের প্রধান ছেলেটি, নাম রামু, সে হরিদাস বাবুকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “কাকা, অনেকদিন পর আসা, আজ কী হবে?” হরিদাস বাবু একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আজ নতুন কিছু চাই রে। একেবারে নতুন স্টাইল। আর একঘেয়ে লাগছে। চুল কেটে এমন করবি যেন লোকে চিনতেই না পারে। বুঝলি?” কথাটা শুনে সেলুনের অন্য ছেলেরা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। পাড়ার সেই গম্ভীর, শান্তশিষ্ট হরিদাস কাকা এমন কথা বলছেন—এতদিনে এমনটা কেউ শোনেনি।
রামু ভেতরে ভেতরে খুশি হয়ে উঠল। সে তো সবসময় চেয়েছিল নতুন কাঁচি, নতুন চুল কাটার স্টাইল প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে। সে সেলুনের এক কোণায় রাখা নতুন হেয়ার স্টাইলের ছবির বইটি বের করে আনল। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, “দেখুন কাকা, এই যে, এই স্টাইলটা করলে কী দারুণ লাগবে! পাশটা হালকা ছাঁটা, সামনে একটু লম্বা চুল রেখে সেট করব, আর পেছনে স্টেপ কাট দেব। আপনার মুখশ্রী একেবারে বদলে যাবে!” হরিদাস বাবু সেই ছবি দেখে প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়লেও ভাবলেন, “না না, এই তো চাইলাম নতুনত্ব, এখন পিছিয়ে গেলে চলবে না।” তিনি বুক চিতিয়ে বললেন, “যা বলিস কর, শুধু স্মার্ট যেন দেখাই।” রামু তখন হাত মুছে এসে কাঁচি তুলে নিল। প্রথমেই চুলের পাশগুলো বেশ ছোট করে ছাঁটা শুরু করল, কাঁচির কচকচ শব্দে হরিদাস বাবুর মনে হচ্ছিল, তার পুরনো চেহারাটাই যেন টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ছে। চেয়ারের আয়নায় তিনি চেয়ে দেখলেন, পাশের চুল নেই বললেই চলে! এরপর সামনের চুলগুলোকে জেল মাখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল রামু। পেছনের চুলগুলো স্টেপ কাট করে উল্টো দিকে আঁচড়াল। একেবারে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের ছবির মতো।
যখন কাজ শেষ হল, রামু হরিদাস বাবুর দিকে আয়নার দিকে তাকাতে বলল। হরিদাস বাবু প্রথমে অবাক হয়ে গেলেন নিজের চেহারা দেখে। এ কে? এ কি সেই হরিদাস চট্টোপাধ্যায়? যে মানুষটি জীবনের সমস্ত সময় নিজের চেহারা একরকম রেখেই কেটে দিয়েছে, সেই মানুষ আজ নতুন এক মুখোশ পরে আয়নায় তাকিয়ে আছে। তার কপালটা আগের চেয়ে বড় দেখাচ্ছে, কারণ পাশের চুল নেই বললেই চলে। সামনের দাঁড় করানো চুল আর পেছনের উল্টো দিকের স্টেপ কাটের চুলে তাকে আর চেনাই যাচ্ছে না। রামু বলল, “কাকা, কী দেখছেন! একেবারে হিরো লাগছেন!” হরিদাস বাবু মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তুই যা বলিস রে! তবে হ্যাঁ, অন্যরকম লাগছে ঠিকই।” টাকা মিটিয়ে তিনি যখন সেলুনের দরজা ঠেলে বেরোলেন, তখন তার মনে হচ্ছিল, আজ তিনি নতুন মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন। পাড়ার গলিতে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল আর সেই হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছিল হরিদাস বাবুর নতুন চুলের গন্ধ, নতুন জীবনের স্বপ্ন।
অধ্যায় ৪
সেলুনের সেই পুরনো লোহা আর কাঠের তৈরি চেয়ারে বসে হরিদাস বাবু জীবনে প্রথমবার এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করলেন। চারপাশের চেনা গন্ধ, কাঁচির কচকচ শব্দ আর সেই ঘরের ফ্যানের ঝিমঝিম বাতাস মিলে যেন এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করল। কাঁচের বড় আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে তার চোখে নিজের মুখই অচেনা লাগতে শুরু করল, কারণ কাঁচির ধার আর রামুর হাতের কারিকুরি মুহূর্তে বদলে দিচ্ছিল চেহারা। রামু প্রথমেই এক নতুন ধরনের ক্লিপার হাতে নিয়ে চুলের পাশের অংশগুলো একেবারে নিচ থেকে ছোট করে ছাঁটা শুরু করল। কাঁচির তীক্ষ্ণ শব্দে চুলের গুচ্ছ গুচ্ছ মেঝেতে পড়তে লাগল, আর হরিদাস বাবুর মনের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি—আনন্দ আর আতঙ্ক একসাথে খেলে গেল। তার মনে হলো, “বাহ! এ তো একেবারে সিনেমার হিরোর মতো হচ্ছে।” কিন্তু আবার অদ্ভুত এক আশঙ্কাও উঁকি দিল, “যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, যদি পাড়ার ছেলেমেয়েরা হেসে ফেলে!” তবুও তিনি কিছু বললেন না, কারণ আজ তো ঠিক করেছেন নতুনত্ব আনবেন, পিছিয়ে যাবেন না। রামু যতই চুল কাটছিল, ততই আয়নায় তার কপালের অংশ বড় বড় হতে লাগল, পাশে চুল নেই বললেই চলে। সামনের চুলগুলো জেল দিয়ে ওঠানো হলো, যেন কড়া কড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর পেছনের চুল স্টেপ কাট করে উল্টো দিকের দিকে ঝুঁকিয়ে দেওয়া হলো।
রামুর চোখে তখন এক শিল্পীর আনন্দের ঝিলিক। এমন একজন কাস্টমার পেয়ে সে বেজায় খুশি। মনে মনে ভাবছিল, “আজ কাকার উপর নতুন স্টাইলটা এমনভাবে করে দেব, পাড়া তো দূরের কথা, অমলা কাকিমাও চিনতে পারবে না!” সে কাঁচি ফেলে এবার ব্লো-ড্রায়ার চালাল। কানে হালকা গরম বাতাস লাগতেই হরিদাস বাবু আঁতকে উঠলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। ভেতরে ভেতরে ভাবলেন, “যা হচ্ছে হতে দাও, শেষে কপাল ভালই হবে।” রামু তখন চুলের লাইন ঠিক করতে ব্লেড বের করল। ব্লেডের ঠান্ডা ধার চামড়ায় লাগতেই হরিদাস বাবু একটু শিউরে উঠলেন, কারণ এর আগে কখনও এত ঘন ঘন ব্লেড ছোঁয়ানো হয়নি। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। রামু তখন স্টাইলের শেষ পর্যায়ে এসে এক বিশেষ ধরণের জেল মাখিয়ে চুল সেট করে দিল। পাশের কাস্টমার আর সেলুনের ছেলেরা থমকে গিয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। কারণ, পাড়ার সেই সহজ-সরল, শান্তশিষ্ট হরিদাস কাকার মাথায় এ কী কাণ্ড! চুলের পাশে মাটি দেখা যাচ্ছে, সামনের চুল কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে, আর পেছনে স্টেপ কাটা চুল উল্টোদিকে ঝুঁকে রয়েছে।
যখন পুরো কাজ শেষ হলো, রামু আয়নাটা সামনের দিকে এগিয়ে দিল। হরিদাস বাবু নিজের চেহারার দিকে চেয়ে থমকে গেলেন। এ কে? এ কি সেই হরিদাস চট্টোপাধ্যায়? চেনা মুখটাই অচেনা হয়ে গেছে। গম্ভীর চেহারার বদলে যেন এক আজব মুখসভার জন্ম হয়েছে। মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, “দেখতে কেমন লাগছে রে?” রামু আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলল, “একেবারে নায়ক লাগছে কাকা! নতুন লুক, নতুন স্টাইল। পাড়ার লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে।” পাশ থেকে এক বৃদ্ধ কাস্টমার মজা করে বলল, “নায়ক তো বটেই, তবে কোন সিনেমার তা বলতে পারছি না!” হরিদাস বাবু খুশি হলেন, না বিব্রত হলেন বোঝা গেল না। পকেট থেকে টাকা বের করে মিটিয়ে দিয়ে তিনি চুলে হাত বুলিয়ে সেলুন থেকে বেরিয়ে এলেন। মনে হচ্ছিল, নতুন চুলের এই ভিন্নতা যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, পাড়ার প্রত্যেকটা চেনা গলির কোণে তার নতুন রূপ আজ গল্প হয়ে থাকবে।
হরিদাস বাবু যখন সেলুন থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন, তখন পাড়ার মানুষজন তার দিকে চেয়ে রইল। মুন্না চা-ওয়ালা, পাড়ার রিকশা চালক হরি, এমনকি বাড়ির পাশের ছাদ থেকে লালু—সবাই চেয়ে রইল সেই নতুন হরিদাস কাকার দিকে। কেউ কেউ প্রথমে চিনতে পারল না। হরিদাস বাবু গম্ভীর মুখ করে হাঁটছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুকের মধ্যে কাঁপন চলছিল। “সত্যিই কি স্মার্ট লাগছে? নাকি লোকে হাসছে?” মনে মনে দ্বিধায় ভুগতে লাগলেন। তার প্রত্যেকটা পা যেন ভারী হয়ে গেল, কিন্তু নতুন চুলের ছাঁটের জন্য বুকের ভেতর গর্বও হচ্ছিল। আজ তিনি অন্যরকম, আজ তিনি সেই হরিদাস নন, যাকে সবাই চেনেন। আজ তিনি এক নতুন হরিদাস, এক নতুন চেহারা, আর হয়তো এক নতুন গল্পের নায়ক। আর সেই গল্পের প্রথম অধ্যায় শেষ করে তিনি এগিয়ে চললেন সেই বড় নাটকের পরবর্তী দৃশ্যের দিকে—যা ঘটবে ঠিক তার নিজের বাড়িতে!
অধ্যায় ৫
হরিদাস বাবু সেলুন থেকে বেরিয়ে গলির পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন, আর সেই হাঁটা যেন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাঁটা হয়ে উঠল। কাঁচি, ব্লেড আর জেলের জাদুতে তার চেহারা এমনভাবে বদলে গেছে যে নিজেই বারবার রাস্তার পাশে দোকানের কাঁচের জানালায় প্রতিফলন দেখে চমকে উঠছিলেন। মাথার পাশের চুল প্রায় নেই বললেই চলে, সামনের চুল দাঁড়িয়ে আছে জেল মাখিয়ে, আর পেছনের চুল স্টেপ কেটে এমনভাবে রাখা হয়েছে যে দূর থেকে দেখলে মনে হবে চুলের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকে। তার চোখে মোটা কাচের চশমা, আর গোঁফ দুই পাশ থেকে সামান্য কেটে সরু করে দেওয়া হয়েছে, যা তাকে আরও অদ্ভুত লাগাচ্ছে। কিন্তু হরিদাস বাবু ভেতরে ভেতরে নিজেকে বুঝিয়ে চলেছেন, “এই তো, নতুন লুক! এবার লোকে বলবে, হরিদাস কাকা কী স্মার্ট!” বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে তিনি গলির মধ্য দিয়ে হাঁটছিলেন। পাড়ার চায়ের দোকান, মুদি দোকান, এমনকি কুঁচকুঁচে সেই রিকশাওয়ালা হরি পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কেউ প্রথমে চিনতে পারল না, কারও মুখে যেন হাসির রেখা লুকিয়ে থাকল, কেউ ফিসফিসিয়ে অন্যজনকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “কে রে ওটা? হরিদাস কাকার মতো চেহারা তো!”
মুন্না চা-ওয়ালা কড়া দুধ চা ঢালতে ঢালতে হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, সে চশমা নামিয়ে ভালো করে দেখল, আর তারপর মৃদু হেসে বলল, “আরে, হরিদাস কাকা নাকি ওটা!” পাশের বাউল দাদা পাঁজি হাতে বসে গুনছিলেন, তিনিও থেমে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, “ওরে বাবা! হরিদাস কাকার এই চেহারা কবে হলো!” পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা, যারা রাস্তার ধারে ক্রিকেট খেলছিল, তারা ব্যাট আর বল ফেলে চমকে তাকিয়ে রইল। তাদের মুখে হাসির রেখা ফুটল, কেউ বলল, “দেখ তো দেখ, হরিদাস কাকা কি হেয়ার স্টাইল করিয়েছে!” আরেকটা ছেলে বলল, “মনে হচ্ছে সিনেমার ভিলেন!” হরিদাস বাবু সেই সব ফিসফাস শুনতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু গম্ভীর মুখে হাঁটতে লাগলেন, যেন কিছুই কানে আসছে না। তার মনে হচ্ছিল, এই হাঁটা এক বিজয়ীর হাঁটা। বুক চিতিয়ে পা ফেলে ফেলে তিনি হাঁটছিলেন, কিন্তু ভেতরের দ্বিধা, অস্বস্তি আর গর্ব একসাথে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করছিল।
এতক্ষণে তার বাড়ি প্রায় এসে গেছে। পাড়ার পুরনো বাড়িগুলো তাকে যেন নতুনভাবে দেখছিল। প্রতিটি জানালায় যেন নতুন চোখ উঁকি দিচ্ছিল তার এই নতুন চেহারার দিকে। বাড়ির সামনে পৌঁছে তিনি এক মুহূর্ত থামলেন, জামার বোতাম টেনে ঠিক করলেন, চুলে হাত বুলিয়ে সেট ঠিক করলেন, যদিও সেই সেট আসলে আরও কৌতুককর লাগল। দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে অমলা দেবীর গলা ভেসে এলো, “আসছি আসছি!” দরজা খুলতেই অমলা দেবী থমকে গেলেন। চোখ বড় বড় করে এক মুহূর্ত হরিদাস বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মুখে ভয় আর অবাক মিশ্রিত এক অভিব্যক্তি। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, “কে রে তুই? কী চাস? চোর ঢুকেছে বুঝি!” হরিদাস বাবু তাড়াতাড়ি বললেন, “অমলা! আমি হরিদাস!” কিন্তু ততক্ষণে অমলা দেবী লাঠি তুলে তেড়ে আসছেন। পেছন থেকে মেয়ে ছুটে এলো, সেও চমকে গেল বাবার নতুন চেহারা দেখে। অমলা দেবী তখন হরিদাস বাবুর কণ্ঠ শুনে থমকালেন, আর ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, এ তো তারই বর। মুখে হাত দিয়ে বললেন, “হে ভগবান! এ কী দশা করেছ তুমি?”
হরিদাস বাবু একটু লজ্জিত, একটু গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, “দেখলে অমলা, নতুন লুক! ভাবলাম এই বয়সেও কিছু স্টাইল করি, নতুন কিছু হোক জীবনে।” কিন্তু অমলা দেবী তখন কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। মেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ফিকফিক করে হাসছে। পাড়ার ছেলেরা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে, কেউ কেউ লুকিয়ে হাসছে। হরিদাস বাবু ভেতরে ঢুকে চশমা খুলে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে আবার একবার চমকে উঠলেন, মনে হলো, “এই আমি? এই চেহারাটা কি সত্যিই আমার?” আয়নার কাচে প্রতিফলিত অদ্ভুত সেই চুলের ছাঁট, সরু গোঁফ, আর উল্টো দিকের স্টেপ কাটা চুল যেন নিজেকেই অপরিচিত করে তুলেছে। বাইরে পাড়ার ফিসফাস, অমলার অস্থিরতা আর নিজের দ্বিধা মিলিয়ে হরিদাস বাবু তখন জীবনের নতুন অধ্যায়ের স্বাদ পেলেন—যে অধ্যায় শুরু হলো হেয়ার স্টাইল বদলানো দিয়ে, আর শেষ হলো পাড়ার লোকের হাসির খোরাক হয়ে। তবুও হরিদাস বাবুর বুকের ভেতর তখনও এক চিমটি গর্ব ছিল, “যা হোক, সাহস তো দেখালাম!”
অধ্যায় ৬
হরিদাস বাবু ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতেই যেন এক নতুন নাটকের মঞ্চ তৈরি হলো। অমলা দেবী তখনও ঘরের মাঝখানে চুপচাপ বসে আছেন, চোখ বড় বড় করে স্বামীর চেহারার দিকে তাকিয়ে। মুখে বিস্ময় আর রাগের মিশ্রণ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি আচমকা বলে উঠলেন, “এই বয়সে এসব কী করেছ তুমি? পাড়ার ছেলেরা তো কাল থেকে রাস্তায় বেরোলেই হাসবে! আমি কোথায় মুখ দেখাব বলো?” হরিদাস বাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “আরে অমলা, তুমিই তো বলেছিলে জীবনে নতুনত্ব আনতে। ভাবলাম এই বয়সেও যদি একটু স্মার্ট হই, ক্ষতি কী?” কিন্তু কথাটা শেষ হতেই মেয়ের ফিকফিক হাসি ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল। মেয়ে মুখ লুকিয়ে বলল, “বাবা, তোমায় একেবারে সিনেমার ভিলেনের মতো লাগছে। স্কুলে কাল সবাইকে বলব, আমার বাবার হেয়ার স্টাইল একেবারে ফিল্মি।” হরিদাস বাবু ভেতরে ভেতরে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইলেন, কিন্তু মুখে হাসি টেনে বললেন, “হাসছো কেন? বাবার সাহস আছে, তাই নতুন লুক করেছে। ক’জন পারে বলো?”
অমলা দেবী তখন ধপাস করে বসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “ভগবান! এই লোকটা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। এ বয়সে চুলের ছাঁট বদলানোটা এত জরুরি হয়ে পড়ল নাকি? লোকে কী বলবে? কাল সকালে বাজারে গেলে পাড়ার মেয়েরা যে ছিড়িয়ে হাসবে!” হরিদাস বাবু মৃদু গলায় বললেন, “আরে ওসব ভাবছ কেন অমলা? লোকে হাসুক না হাসুক, আমি তো খুশি! আমার মনে হয়েছে বদল দরকার।” অমলা তখন মুখে হাত দিয়ে বলল, “তোমার এই বদলের জন্য আমি আর বাইরে মুখ দেখাতে পারব না। রামরঙ্গির সেবাদিদি তো এমনিতেই মুখে মুখে সব খবর পায়, এখন পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে দেবে।” এরই মধ্যে পাড়ার ছেলে-বুড়োরা জানালা, বারান্দা আর গলির মোড়ে জড়ো হতে শুরু করেছে। কারও হাতে চা, কারও হাতে মোড়ানো বিড়ি, কারও মুখে ফিসফিস—“দ্যাখো দ্যাখো, হরিদাস কাকার নতুন চেহারা। সিনেমার ভিলেন কাকে বলে!”
বাইরের ফিসফাস ঘরের মধ্যে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। এমনকি পাশের বাড়ির বীণা কাকিমা জানালা খুলে অমলা দেবীকে ডাকলেন, “অমলা, কী হয়েছে গো? নতুন বর আনলে নাকি?” কথা শুনে অমলা দেবীর মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “আর বোলো না বীণা, হরিদাসের নতুন শখ হয়েছে হেয়ার স্টাইল বদলানোর। দেখছো না কী অবস্থা হয়েছে?” বীণা কাকিমার হেসে গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা। তিনি বললেন, “আরে বাহ! আমাদের জামাইবাবু একেবারে হিরো হয়ে গেছেন। কাল পাড়ার পুজোর কমিটির নাটকে নায়ক করে দিও।” ঘরের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত পরিবেশ—অমলার অসহায়তা, মেয়ের ফিকফিক হাসি, হরিদাস বাবুর মিশ্র অনুভূতি আর বাইরের ফিসফাস সব মিলিয়ে। হরিদাস বাবু এবার চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে চশমা খুলে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখে মনে হলো, সত্যিই কি খুব খারাপ হয়েছে? নাকি নতুনত্বের সাহসিকতাই এত হাসির কারণ?
হরিদাস বাবু নিজেই দ্বিধায় ভুগতে লাগলেন। ভেতরে ভেতরে লজ্জা বোধ হচ্ছিল, আবার এক চিমটি গর্বও অনুভব করছিলেন। কারণ জীবনে এই প্রথম তিনি নিজের সিদ্ধান্তে এমন বড় পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু পাড়ার লোকের হাসাহাসি, অমলা আর মেয়ের প্রতিক্রিয়া তাকে বিব্রত করছিল। বিছানায় বসে চশমা খুলে তিনি চুলে হাত বুলিয়ে মনে মনে বললেন, “যা হোক, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অন্তত একদিনের জন্য হলেও পাড়ার লোকের গল্পের কেন্দ্রে আমি।” বাইরে তখনও হাসির রোল চলছে। কেউ বলছে, “কাল হরিদাস কাকার ছবি তুলে রাখব, পাড়ার ক্লাবের পোস্টারে লাগাব।” কেউ বলছে, “ওকে নিয়ে ফেসবুক মিম হবে দেখো।” হরিদাস বাবু চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু তার কানে যেন সেই হাসির শব্দ প্রতিধ্বনি হতে থাকল। অমলা তখন ঘরের এক কোণ থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “এই বয়সে এমন নৌটঙ্কি আর কোরো না হরিদাস!” আর হরিদাস বাবু মনে মনে হাসলেন, “নৌটঙ্কি হোক, কিন্তু জীবনে একদিন তো নতুন কিছুর স্বাদ পেলাম!”
অধ্যায় ৭
সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার গলিতে আজ যেন অন্যরকম উৎসাহের বাতাবরণ তৈরি হলো। যে পাড়া একসময় ভোরবেলা কাকের ডাক আর শিবমন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে মুখরিত হতো, আজ সেই পাড়ায় মুখরতা এসেছে হরিদাস বাবুর নতুন চেহারাকে ঘিরে। বাড়ির পাশের পানের দোকানে কালীপদ দোকানদার চা-এর কেটলিতে পানি ফোটাতে ফোটাতে অন্য দোকানদার হরেকৃষ্ণকে বলল, “শোনলি, হরিদাস কাকা নাকি হেয়ার স্টাইল বদলে সিনেমার হিরো হয়ে গেছে!” হরেকৃষ্ণ হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, “দ্যাখো দ্যাখো, কী কাণ্ড! এ বয়সে হিরো হবার শখ হলো!” দোকানে বসা পাড়ার তরুণেরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আজ তো একবার কাকার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হবে। চুলটা না হয় নিজের চোখে দেখি।” সেই সঙ্গে পাড়ার মেয়েরা, যারা সকালে জল আনতে বের হয়, তারাও ফিসফিস করে বলতে লাগল, “দ্যাখো দ্যাখো, কী চুল কেটেছে কাকা। এ যেন পুরো মডার্ন!” সকালের বাতাসে যেন সেই হাস্যরসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, আর এই হাসির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন হরিদাস বাবু।
হরিদাস বাবু সেই সকালে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখলেন, সামনের গলিতে কিছু ছেলে থমকে তাকিয়ে আছে। একজন আরেকজনকে কনুই মেরে ইশারা করছে। হরিদাস বাবু ভেতরে ভেতরে লজ্জা বোধ করছিলেন, কিন্তু মুখে গম্ভীর ভাব রাখার চেষ্টা করলেন। তিনি চশমা টেনে ঠিক করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন, যেন বলতে চাইছেন, “হ্যাঁ, আমি নতুন চুল কেটেছি, কেমন লাগছে?” কিন্তু ছেলেরা মুখ টিপে হাসতে হাসতে দ্রুত হেঁটে চলে গেল। পাড়ার জানালায় জানালায় মুখ বের হতে লাগল, যেন লোকে নতুন এক নাটক দেখতে পেয়েছে। বীণা কাকিমা আবার মুখ বাড়িয়ে অমলা দেবীকে বললেন, “অমলা, কই কাল তো দেখলাম, আজ আবার ভালো করে দেখলাম, হরিদাসকে নায়কী নাটকে নিতে হবে।” পাশের বাড়ির দাস কাকা ঠাট্টা করে বললেন, “ভাগ্যিস শুটিং পার্টি আসে না এখানে, নাহলে হরিদাসকে সিনেমায় নিতেই হতো।” হরিদাস বাবু মুখে হাসি টেনে চা-এর কাপ হাতে বারান্দায় বসলেন, কিন্তু মনে মনে ভেবেই যাচ্ছিলেন, “আরে বাপরে! এমন প্রতিক্রিয়া হবে ভাবিনি তো।”
এরই মধ্যে সকালবেলার বাজারে গিয়ে পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াল। মাছের বাজারে পৌঁছাতেই মাছওয়ালা নরেন হেসে বলল, “ওমা কাকা! কী স্টাইল কেটে ফেলেছেন! কাল মেলা হলে স্টেজে উঠে গান গাইবেন না?” পেছন থেকে অন্য এক দোকানদার যোগ করল, “কাকা, এই চুলের স্টাইলে তো আপনার বয়স কমে গেছে দশ বছর!” হরিদাস বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “সবাই নতুনত্ব চায়, আমি চাইলেই দোষ?” কিন্তু সেই কথাতেও হাসি থামল না। বাজারে চারদিকে ফিসফিস, হাসির রোল বয়ে গেল। এমনকি এক বাচ্চা ছেলেও মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, এই কাকুটা কি নায়ক?” হরিদাস বাবু ব্যাগে মাছ ভরতে ভরতে মনে মনে বললেন, “ভাগ্যিস আমি অভিনেতা হইনি, তাহলে তো আমার জীবনই শেষ হয়ে যেত!” বাজার থেকে ফেরার পথে প্রতিটি পা যেন ভারী হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি বাড়ির জানালা, প্রতিটি দোকানের কাঁচের দরজা তার নতুন চেহারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
বাড়ি ফিরে এসে তিনি যখন চা খেতে বসলেন, অমলা দেবী তখনও মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। মেয়ে চুপচাপ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে রেখেছিল, কিন্তু চোখে মুখে স্পষ্ট দুষ্টুমি। হরিদাস বাবু এবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মন থেকে ভাবতে লাগলেন, “সবাই এত হাসছে কেন? এত খারাপ লাগছে নাকি?” তার চুলে হাত বুলিয়ে আবার ঠিক করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে যেন হাস্যকরত্ব আরও বেড়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, “আসলে আমি ভেবেছিলাম নতুন লুক পেলে লোকে বাহবা দেবে, কিন্তু এ যে হাসির খোরাক হয়ে গেলাম!” আর ঠিক তখনই বাইরে থেকে আবার ডাক এলো, “হরিদাস কাকা, কাল ক্লাবের নাটকে ভিলেনের চরিত্রটা আপনার জন্য বুক করে রাখব?” হরিদাস বাবু জানালা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকলেন, আর মনে মনে স্থির করলেন—এই চুল গজানো পর্যন্ত তিনি আর সেভাবে বের হবেন না। পাড়ার হাসির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যে শিক্ষা তিনি পেলেন, তা হয়তো সারা জীবন তার মনে গেঁথে থাকবে।
অধ্যায় ৮
হরিদাস বাবুর রাতের ঘুম যেন একেবারে উধাও হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে বারবার নিজের চেহারার কথা মনে পড়ছিল, আয়নায় দেখা সেই নতুন হেয়ার স্টাইলের প্রতিফলন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বাইরের পাখির ডাক, পাড়ার কুকুরের ঘেউ ঘেউ, সবকিছুর ভেতর দিয়ে যেন শোনা যাচ্ছিল পাড়ার সেই হাসাহাসি, ফিসফাস আর ঠাট্টার শব্দ। অন্ধকার ঘরে চোখ বড় বড় করে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, “কেন এমন করলাম? এতদিন শান্তিতে ছিলাম, পাড়ায় কারও হাসির খোরাক হইনি, আর আজ নিজের ভুলে সকলের হাসির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলাম!” পাশের বিছানায় অমলা দেবী তখনও ক্ষীণ গলায় বলছিলেন, “এ বয়সে এসব করার মানে কী? আমি কাল বাজারে মুখ দেখাব কীভাবে?” মেয়ের ঘর থেকে ফিসফিস হাসির শব্দ ভেসে এলো। হরিদাস বাবুর বুকের ভেতর চাপা কান্না আর রাগ মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। অথচ তিনি চেয়েছিলেন নতুনত্ব আনতে, জীবনকে একঘেয়েমি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে। তবুও, আজ সেই নতুনত্বই যেন তার আত্মসম্মানের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সকালে উঠে দরজার খিল খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখলেন, রাস্তায় চলা মানুষগুলো তাকিয়ে হাসছে। মুন্না চা-ওয়ালা চা ঢালতে ঢালতে অন্যদের ইশারা করছে, কালীপদ মাছওয়ালা পসরা সাজাতে সাজাতে গালে হাত দিয়ে হেসে ফেলছে। এমনকি স্কুলে যাওয়ার পথে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও কনুই দিয়ে একে অপরকে ঠেলে বলছে, “ওই দেখ হরিদাস কাকা!” হরিদাস বাবু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকলেন, কিন্তু মনের মধ্যে লজ্জা আর অপমানের ঝড় বইতে লাগল। তিনি ভাবলেন, “এখন আর কিছু বলার নেই। সময়ই সব ঠিক করবে। যখন চুলগুলো আবার গজাবে, তখন লোকে আর হাসবে না।” কিন্তু মন তো চাইলেই সব সামলে নিতে পারে না। প্রতিটি হাসির শব্দ, প্রতিটি মুচকি তাকানো যেন তার আত্মসম্মানে কাঁটা হয়ে বিঁধছিল। হরিদাস বাবু চশমা খুলে চুলে হাত বুলিয়ে চুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তা যেন আরও অদ্ভুত লাগল। বারান্দা থেকে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে জানালা বন্ধ করে দিলেন তিনি।
অমলা দেবী তখন ঘরে বসে কপালে হাত দিয়ে বললেন, “দেখো হরিদাস, আমার কথা তো কখনও শুনো না। কতবার বলেছি, এ বয়সে এসব সাজসজ্জা মানায় না। এখন কী হবে? লোকে বলবে, বুড়ো বয়সে হিরো হবার শখ জেগেছে।” মেয়েটা পাশে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে মজা পেয়ে বলল, “বাবা, সত্যি বলছি, তুমি একেবারে অন্যরকম লাগছ। স্কুলে বলব, আমার বাবা সিনেমার নায়কের মতো হেয়ার কাট করেছে!” হরিদাস বাবু রাগ আর লজ্জা চেপে মুখে হাসি টেনে বললেন, “তুমি মজা করছ, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো খারাপ কিছু করিনি। শুধু নতুন একটা চেহারা চেয়েছিলাম। মানুষ চেহারা বদলালে কি সবাই এমন করে হাসে?” কিন্তু মেয়ের চোখে মুখে দুষ্টুমি স্পষ্ট। অমলা দেবী তখন ভাতের হাঁড়ি নাড়তে নাড়তে গম্ভীর গলায় বললেন, “আজ আর বাইরে বেরিয়ো না। চুল গজানো পর্যন্ত ঘরে থাকো। এভাবে বাইরে বেরুলে পাড়ার লোকে হাসতে হাসতে পেট ধরে মরবে।” হরিদাস বাবু চুপচাপ জানালার পাশে বসে বাইরের রোদেলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকলেন, আর মনে মনে বললেন, “এই লজ্জা আর অপমানের দিনও একদিন কেটে যাবে।”
সেই দিন থেকে হরিদাস বাবু আস্তে আস্তে ঘরবন্দি হয়ে গেলেন। চা খেতে বারান্দায় যাওয়া বন্ধ, বাজারে যাওয়া বন্ধ, এমনকি পাড়ার মোড়ে বসা বন্ধ। তার একমাত্র সঙ্গী হলো আয়নার প্রতিফলন আর পরিবারের মজার কৌতুক। তিনি চুলে তেল মেখে চুল গজানোর আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে লাগলেন। পাড়ার লোকজনও আস্তে আস্তে নতুন কিছুতে মন দিতে শুরু করল। কিন্তু হরিদাস বাবুর মন থেকে লজ্জার অনুভূতি যাচ্ছিল না। তিনি ভাবতেন, “যদি সময়কে ফেরানো যেত, তাহলে সেদিন সেলুনে যেতাম না। সেই কাঁচি, সেই ব্লেড, সেই জেল—সবই যেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু।” তবুও, এই লজ্জা আর আত্মসম্মানের লড়াই তার মধ্যে এক নতুন শক্তি এনে দিল। তিনি স্থির করলেন, “যা হয়েছে হয়েছে। মানুষ হাসুক। আমি আবার নিজেকে তৈরি করব। এই অপমানের দিন একদিন গল্প হয়ে থাকবে।” আর সেই ভেবে হরিদাস বাবু চুপচাপ বসে থাকতেন, চোখের কোণে এক চিমটি অভিমান আর বুকের ভেতর এক অদম্য জেদের আগুন নিয়ে।
অধ্যায় ৯
দিন গড়াতে লাগল। পাড়ার মানুষের উৎসাহও আস্তে আস্তে ফিকে হতে লাগল। অন্য কোনো নতুন গল্প, অন্য কোনো বাড়ির ঝামেলা বা খবর পেয়ে সবাই সেই দিকেই মন দিল। কিন্তু হরিদাস বাবুর ভেতরের লজ্জা আর অপরাধবোধের দেয়াল ভাঙছিল না। দিনের পর দিন ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতেন, পাড়ার সেই হাসির মুখগুলো আর আগের মতো তাকাচ্ছে না, কিন্তু তবুও মনে হতো, সবাই যেন এখনো তার নতুন চুলের ছাঁট নিয়েই হাসছে। একদিন বিকেলে, জানালার বাইরে আকাশের নরম রোদ পড়ে থাকতে থাকতে হরিদাস বাবুর মনে হলো, “আর কতদিন এভাবে লুকিয়ে থাকব? মানুষ তো একদিন না একদিন ভুলেই যাবে। আমি কেন নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপন ছেড়ে রাখব?” সেই দিন সন্ধ্যায় চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। চশমা ঠিক করে নিলেন, চুলে হাত বুলিয়ে যতটা সম্ভব চুলগুলোকে ‘সেট’ করার চেষ্টা করলেন। আশ্চর্য, পাড়ার মানুষজন এবার আর আগের মতো হাসল না, কেউ কেউ সৌজন্যের হাসি দিয়ে কেবল মাথা নাড়ল। মনে হলো, এতোদিনে মানুষও তার এই নতুন লুকটাকে মেনে নিতে শিখেছে।
সন্ধ্যার পর তিনি আস্তে আস্তে হাঁটতে বের হলেন। পাড়ার মোড়ে পৌঁছাতেই মুন্না চা-ওয়ালা একটা চা বাড়িয়ে দিল, “কাকা, অনেকদিন পর বের হলেন! বসুন না এক কাপ চা খান।” হরিদাস বাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, “না, থাক, আজ সময় নেই।” কিন্তু মুন্না জোর করল, আর চারপাশের মানুষজনও আগের মতো হাসাহাসি না করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলল। মনে হলো, পাড়া তাকে নতুন করে গ্রহণ করছে। হরিদাস বাবু চুপচাপ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে চারপাশ দেখলেন। সেই চেনা পাড়া, সেই চেনা মানুষগুলো, কেউ আজ আর তাকে সেই আগের মতো বিদ্রূপের চোখে দেখছে না। তার নিজেরও বুকের মধ্যে একটা শান্তি এলো। “দেখো হরিদাস,” তিনি মনে মনে বললেন, “তুমি ভেবেছিলে লজ্জায় ডুবে যাবে, কিন্তু মানুষ তো একদিন সব ভুলে যায়। নিজের আত্মবিশ্বাসটাই আসল। এই চুল যেমন আছে, তেমনি নিয়ে বাঁচতে শিখতে হবে।” চায়ের কাপ শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ঠিক করলেন, কাল থেকে বাজারেও যাবেন, পাড়ার ক্লাবের বৈঠকে বসবেন, আর এই লজ্জার গণ্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন।
বাড়ি ফিরে এসে হরিদাস বাবু দেখলেন অমলা দেবী অবাক হয়ে বললেন, “আজ তুমি বের হলে?” হরিদাস বাবু মৃদু হেসে বললেন, “হ্যাঁ অমলা, আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। পাড়ার লোক হাসুক, না হাসুক, আমি তো নিজের মতো করেই বাঁচব। এভাবে ঘরবন্দি থাকলে আরও বেশি লোকে হাসবে।” মেয়েটা পাশে এসে বলল, “সত্যি বাবা, তোমার হেয়ার স্টাইলটা এখন অনেকটা মানিয়ে গেছে তোমার সঙ্গে।” হরিদাস বাবুর বুকের ভেতর সেই কথায় এক অদ্ভুত শান্তির ঢেউ বয়ে গেল। মনে হলো, হ্যাঁ, জীবনের প্রতিটি নতুনতার সঙ্গেই মানুষকে মানিয়ে নিতে হয়, সেটাই আসল সাহস। ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিফলনের দিকে চাইলেন তিনি। সেই প্রতিফলনে আজ আর আগের মতো অপরিচিত এক মুখ দেখলেন না। আজ দেখলেন, এক সাহসী মানুষ, যে নিজের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যার হাসির পাত্র হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে গ্রহণ করতে শিখেছে।
পরের দিন সকালেই হরিদাস বাবু বাজারে গেলেন, দোকানিদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেন। কেউ আর বিদ্রূপ করল না, বরং বলল, “কাকা, এই লুক আপনাকেই মানায়!” হরিদাস বাবুর বুকের মধ্যে গর্বের ফুল ফুঁটে উঠল। পাড়ার ছেলেরা যারা আগে হাসত, তারা আজ তার কাছে এসে বলল, “কাকা, দারুণ সাহস দেখিয়েছেন। আমরা তো পারতাম না এভাবে নতুন লুক নিতে।” হরিদাস বাবু মৃদু হেসে বললেন, “জীবনে সাহস না থাকলে মানুষ বাঁচে কী করে বলো?” সেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন, নিজের আত্মসম্মান কেউ বাইরে থেকে নেয় না, নিজের ভিতরের সাহসই সেটাকে রক্ষা করে। তার সেই হেয়ার স্টাইল আর লজ্জার দিনগুলো এখন তার কাছে এক শিক্ষার গল্প, যা সে হয়তো একদিন নিজের নাতি-নাতনিকে হাসতে হাসতে বলবে। আর তখন সে বলবে, “দেখো, মানুষ হাসুক, কাঁদুক, নিজের উপর বিশ্বাস রাখাটাই আসল।”
অধ্যায় ১০
সময় বয়ে যেতে লাগল। সেই হাসাহাসি, সেই বিদ্রূপের দিন পেরিয়ে পাড়ার মানুষ হরিদাস বাবুর নতুন চেহারাকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় বদল হলো হরিদাস বাবুর নিজের মনে। তিনি বুঝতে পারলেন, জীবন আসলে পরিবর্তনের আর সাহসের খেলা। যে মানুষ বদলের চেষ্টা করে, সে হয়তো প্রথমে হোঁচট খায়, লজ্জার মুখোমুখি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সেই চেষ্টাই তাকে আলাদা করে তোলে। পাড়ার মোড়ে বসে তিনি চা খেতে খেতে সেইসব দিনের কথা ভাবতেন। মুন্না চা-ওয়ালা একদিন মৃদু হেসে বলেছিল, “কাকা, আপনার ওই সাহসের কথা আমরা এখনো বলি। ক’জন পারে জীবনের এত বছর পরে নতুন চেহারা নিতে?” হরিদাস বাবু তখন মৃদু হেসেছিলেন, চোখের কোণে এক চিমটি স্মৃতি আর গর্ব মিশিয়ে। সেই চুল ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল, আগের মতো হয়ে গেল, কিন্তু মানুষ তাকে মনে রাখল সেই সাহসের জন্য, সেই আত্মবিশ্বাসের জন্য, যা একদিন পাড়ার মানুষের হাসির খোরাক হলেও পরে হয়ে উঠেছিল অনুপ্রেরণার গল্প।
পাড়ার ক্লাবের বৈঠকে, পুজোর কমিটির সভায়, সমাজসেবার নানা কাজে হরিদাস বাবু নিজের উপস্থিতি আবার জোরালোভাবে জানান দিতে শুরু করলেন। যেখানেই যেতেন, লোকে তাকে বলত, “কাকা, আপনার ওই হেয়ার স্টাইল কাহিনি না শুনিয়ে ছাড়বেন না যেন!” হরিদাস বাবু তখন মজা করে বলতেন, “সেটা সাহসের গল্প। মানুষ জীবনে নতুন কিছু না করলে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যায়। আমি নতুন কিছু করেছিলাম, তাই তো তোমরা আজও সেটা মনে রেখেছ।” পাড়ার ছেলেরা, যারা একদিন তার চুল কাটা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ত, তারাই আজ পাড়ার ছোটদের বলত, “দ্যাখো, হরিদাস কাকা কী সাহসী ছিলেন। জীবনে ওরকম সাহস দেখাতে পারলে তবেই আসল মানুষ হওয়া যায়।” হরিদাস বাবুর মুখের হাসিটা তখন আরও গভীর হতো। কারণ তিনি জানতেন, সে এক অভিজ্ঞতা যা মানুষকে শুধুই হাসিয়েই থেমে থাকেনি, বরং জীবনের গভীর এক শিক্ষা দিয়ে গেছে।
বাড়িতে অমলা দেবীও ধীরে ধীরে তার সেই চুল কাটা কাণ্ডের ওপর রাগ ভুলে গিয়েছিলেন। একদিন সকালে বারান্দায় বসে বুনুনি করতে করতে হেসে বললেন, “হরিদাস, তখন তো রাগ করেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হয়, ভালোই করেছিলে। অন্তত পাড়ার গল্পের কেন্দ্রে এসেছিলে। সেই দিনগুলো তো ভুলতে পারব না।” মেয়েটা তখন কলেজে ভর্তি হয়েছে, বাবার সাহসের গল্প সে তার বন্ধুদের কাছে হাসিমুখে বলে। হরিদাস বাবু একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো কাহিনি মনে করে মৃদু হেসে বললেন, “আয়না, তুই আমার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। তোর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে নতুন করে চিনেছিলাম।” সেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন, জীবনে সাহস না থাকলে, নিজের উপর বিশ্বাস না থাকলে মানুষ শুধু একঘেয়েমি আর ভয় নিয়ে বাঁচে। আর সেই ভয় ভাঙার জন্যই হয়তো তার জীবনে সেই হেয়ার স্টাইল কাহিনি ঘটেছিল।
শেষ পর্যন্ত হরিদাস বাবুর সেই একদিনের সাহসের গল্প পাড়ার গণ্ডি পেরিয়ে অন্য পাড়ায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, এমনকি ক্লাবের অনুষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই তিনি যেতেন, মানুষ হাসতে হাসতে সেই গল্প শোনার আবদার করত। আর হরিদাস বাবু মজা করে বলতেন, “দেখো, মানুষ চুল কাটতে ভয় পায় না, নতুন কিছু করতেও ভয় পায় না। ভয় পায় লোকে কী বলবে, সেই কথাটায়। আর আমি তো সেই ভয় কাটিয়েই তোমাদের সামনে বসে আছি।” সেই গল্পের মধ্য দিয়ে পাড়ার ছোটরা সাহসের পাঠ পেত, বড়রা পেত নতুনত্বের প্রেরণা। হরিদাস বাবু তখন সত্যিই হয়ে উঠেছিলেন পাড়ার অনুপ্রেরণার এক মুখ, যার গল্প একদিন পাড়ার কোনো নাটকের দৃশ্য, কোনো পুজোর মঞ্চে হাস্যরসের অংশ হয়ে থাকবে, কিন্তু তার ভেতরের সত্যিকারের শক্তির গল্প সবার মনে গেঁথে যাবে চিরকাল।
___




