Bangla

স্মৃতির সরণি

Spread the love

আরিফ জামান


অধ্যায় ১:

ঢাকার পুরনো এলাকা – গেন্ডারিয়া। ততোধিক পুরনো এক তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় সাবিহা খাতুন একা থাকেন। সময়ের ছোপ ধরা দেয়ালের ওপর ঘড়ির কাঁটা যেন ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে চায় প্রতিনিয়ত। বিকেল হলেই খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো এসে পড়তে থাকে তার কাঠের চেয়ারটায়, যেখানে তিনি বসে থাকেন প্রায় অনড় হয়ে, চোখ দুটি জানালার ওপারে তাকিয়ে—কিন্তু বাস্তব নয়, বরং স্মৃতির সরণিতে।

সাবিহার বয়স এখন বাহাত্তর। তবুও চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায়—এই বৃদ্ধা একদিন কতটা দীপ্তিময় ছিলেন। তীক্ষ্ণ নাক, পাতলা ঠোঁট, এবং চিবুকের কাছে সামান্য একটা আঁচিল—যা একসময় তাকে ‘সাবিহা বউদি’ নয়, ‘সাবিহা সুন্দরী’ বানিয়েছিল পাড়ার যুবকদের চোখে।

আজও তিনি পরেন সেই সাদা তাঁতের শাড়ি, যার আঁচলে থাকে নীল রঙের পাতলা পাড়। মাথায় চুল সাদা, খোঁপা করা, মাঝে মাঝে খোলা অবস্থায় ছড়িয়ে থাকে পিঠ অবধি—যেন ভুলে গেছেন আঁচড়াতে। চায়ের কাপ ধরা তার কাঁপা হাতে, মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে পুরনো অলোকেন্দ্রিক স্মৃতির টানে।

চায়ের কাপ হাতে নিয়েই আজ তিনি তাকিয়ে ছিলেন সেই কুঞ্জবনের দিকে, যেটা এখন কংক্রিটের দেয়াল ঘেরা একটা পার্ক। একসময় যেখানে পুকুর ছিল, সেখানে এখন ব্যস্ত এক মোটর গ্যারেজ। সময় সব বদলে দিয়েছে। শুধু বদলায়নি তার ভিতরের সেই পুকুরঘাট। সেই যেখানে বসে প্রথমবার একটা ছেলেকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি ভালো ছবি আঁকো।”

সে ছেলেটির নাম ছিল – নীলয়। নীলয় বসু। একজন অতি সাধারণ, চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। তার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। নীলয়দের বাড়ি সাবিহাদের গ্রামের পাশে ছিল—চন্দনপুর। তখন সাবিহার বয়স হবে মাত্র ষোল। আর নীলয়ের সতেরো। দুই বাড়ির ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে দেখা করত পুকুরঘাটে—চুপি চুপি, গাছের ছায়ায় বসে।

“তুমি কবিতা লেখো?”—একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন সাবিহা।

নীলয় হেসেছিল, সেই একধরনের শান্ত হাসি। “না, শুধু ভাবি। লেখা হয় না।”

এমন কথায় সাবিহার বুক কেঁপে উঠত। কথায় না বলা একটা টান ছিল সেই হাসিতে। কিন্তু সে সময় ছিল না একেবারে সহজ। এমন সম্পর্ক সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল না। স্মৃতির সরণি তখনই প্রথম আঁকা হতে শুরু করেছিল—কিন্তু কাঁচা রং দিয়ে।

ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। পাশের ঘর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ করে একটি ফ্যান ঘুরছে। একসময় এই ঘরে হাসত তার মেয়ে—তানিয়া। তার ছেলেটি, জুবায়ের, এখন কানাডায়। তানিয়া বিয়ে হয়ে গেছে খুলনায়। বছরে একবার ঈদের সময় ফোন আসে। আজকাল কণ্ঠগুলোও আর মায়ের জন্য ঠিক করে সময় বের করতে পারে না।

“তুমি খেয়েছো মা?”

“হুম।”

“ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা তো ভাবছি তোমায় আমাদের কাছে নিয়ে যাব…”

“থাক, আমি ঠিক আছি এখানে।”

এই কথোপকথনগুলো যেন রেকর্ডেড। প্রতিবার একই কথা, একই উত্তর। যেন সম্পর্ক নয়, দায়িত্ব পালন। সাবিহার জানালার পাশে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স—সেখানে পুরোনো চিঠি, কিছু ছবি আর নীল রঙা রিবনের মধ্যে বাঁধা একটা ছোট ডায়েরি। সেটি ছিল তার নিজের লেখা ডায়েরি—যা তিনি লিখতেন বিয়ের আগে পর্যন্ত। আজ অনেক দিন পর ডায়েরিটা খোলেন। পাতায় পাতায় তখনকার কালি আজ বিবর্ণ, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন চিৎকার করে বলে উঠছে – “আমার স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে!”

নীলয় আর সাবিহার সম্পর্কটা কখনো সমাজের চোখে ‘প্রেম’ হয়ে উঠেনি। কিন্তু তাদের চোখে চোখে যে ভাষা ছিল, তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারত না।

সাবিহার বিয়ের দিন যখন ঠিক হয়, তিনি চুপ করে গিয়ে নীলয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকক্ষণ। দরজায় কড়া নাড়েননি। জানতেন, এ কড়া নাড়া কোনো দরজা খুলবে না। পরদিন সকালে নীলয় চলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে—আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

কিন্তু একবার, বিয়ের পরে প্রায় বছর পাঁচেক পর, এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি চিঠি পৌঁছায় সাবিহার হাতে।

তাতে লেখা ছিল: “তুমি বলেছিলে, আমি কবিতা লিখি না। আমি এখন লিখি, কিন্তু পাঠানোর মতো কেউ নেই। তুমি ভালো থেকো।

— নীলয়”

এই একটুখানি চিঠির জন্যই এক জীবনের স্মৃতি তৈরি হয়! মাঝে মাঝে মানুষ চায় না সব পাবে—শুধু চায় একটি নাম যেন তার স্মৃতির পাতায় থেকে যায় চিরকাল।

হঠাৎ একটা শব্দ। সাবিহার কাঁপা হাতে চায়ের কাপ ফেলে দেন। মাটিতে পড়ে চায়ের দাগ ছড়িয়ে যায় কাঠের মেঝেতে। তিনি ধীরে ধীরে নিচু হয়ে কাপের ভাঙা অংশ তুলতে থাকেন, যেন ভাঙা স্মৃতিগুলোকেই জোড়া দিতে চাইছেন। কেউ ছিল না পাশে। কেউ থাকবে না—জানেন তিনি।

তবুও, তিনি জানেন—এ সন্ধ্যায় হয়তো আবার নীলয় আসবে স্বপ্নে। হয়তো আবার বলবে, “তুমি এখনো ঠিক আগের মতোই আছো।”

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আলোর রঙ লালচে হয়ে উঠছে জানালার ফ্রেমে। সাবিহা উঠে জানালাটা বন্ধ করেন না—কারণ তিনি জানেন, হয়তো এই শেষ বিকেলটি তাকে নিয়ে যাবে সেই কুঞ্জবনের ঘাটে, সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে, যেখানে সময় ধীরে গলে পড়ে স্মৃতির সরণিতে।

অধ্যায় ২:

ভোরের আলো ঠিক তখনো পুরোপুরি নামেনি চন্দনপুর গ্রামে। কুয়াশা ভরা আকাশ, দূরে সাঁঝবাতির মতো জ্বলছিল টিমটিমে আলো। এমন আলো-আঁধারি ভোরে ঘুম ভাঙত সাবিহার। তখন তার বয়স ছিল আট কি নয়। মাটির ঘরে খড়ের চাল, চাটাইয়ের বিছানা। মা মাটির হাঁড়িতে জল ঢালছেন—টিনের মগে ঠক করে শব্দ হতো।

মাঝেমধ্যে, ছোট ভাই মেহেদী ঘুম থেকে উঠে মুখ কুঁচকে বলত, “আর ঘুমাব!” মা হাসতেন। সেই হাসির শব্দ এখনো যেন সাবিহার কানে ভেসে আসে। এতদিন পর, এত শত স্মৃতির পরে, যখনই চোখ বন্ধ করেন, সাবিহার প্রথম যে ছবি ভেসে ওঠে—তা সেই পুকুরঘাট। ছায়াঘেরা ছিল জায়গাটা। বিশাল একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকত কোণায়। আরেক পাশে ছিল কাঁঠালগাছ। শুধু গাছ নয়, গাছের ছায়ার নিচে ছিল জীবন, রঙিন দিন, এবং প্রথম-প্রথম সেই আবিষ্কার—‘ভালো লাগা’ বলে কিছু একটা হয়।

সেই পুকুরঘাটে নেমে মা সাবিহাকে স্নান করাতেন। হাঁটু অবধি জল, আর কচি ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপত।

“হাঁসের মতন নাকি মাছের মতন তুই?”—মা বলতেন, সাবিহা কুঁকড়ে যেত। জল ছিটিয়ে দিয়ে সাবিহা বলত, “মাছ। আমি তো সাঁতার কাটি!”

মা হেসে বলতেন, “আবার মুখে বললে এক চড় খাবি।”

পাশেই স্নান করত পাশের বাড়ির মেয়েরা—জয়শ্রী, মালতী, ফারজানা। সবার সঙ্গে সাবিহার মিলেমিশে খেলা, গল্প, চিৎকার—পুকুরঘাট যেন ছিল এক স্কুলের মতো। আর স্কুল? সেটা দুপুরে, গ্রামের সরকারি স্কুল। তখনই প্রথম দেখা হয়েছিল নীলয় বসু-র সঙ্গে। নীলয় ছিল একেবারে অন্যরকম। অনেকটা চুপচাপ। স্কুলের বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে সে আঁকত।

খাতা ভর্তি ছিল নদী, গাছ, মেঘ, আর এক মেয়ে—চুলে বিনুনি, হাতে কাঁসার বালা।

“এইটা কে?”—একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সাবিহা।

নীলয় মাথা নামিয়ে বলেছিল, “কে আবার! তুমি তো।”

সেই প্রথম সাবিহার বুক কেঁপে উঠেছিল অদ্ভুত এক অনুভবে। এটা তো কেউ আগে বলেনি তাকে। কেউ বলেনি, তাকে দেখে ছবি আঁকে কেউ! তারপর থেকে, দুপুরবেলায় স্কুল ছুটির পরে, কখনো কখনো সাবিহা ও নীলয় একসঙ্গে বসত পুকুরঘাটের ধারে। গল্প করত না খুব বেশি—তবে চোখের ভাষায় চলত এক গভীর সংলাপ।

কিন্তু এই দিনগুলো স্থায়ী হয়নি। একদিন পুকুরঘাটে বসে থাকতে থাকতে তারা দেখল এক চাচা দূর থেকে তাকিয়ে আছেন। সেই চাহনি ছিল কঠিন, কাঁটা বিঁধে দেওয়ার মতো।রাতেই সাবিহার মা ডেকে বলেছিলেন, “নীলয় আর তুই কথা বলবি না। মেয়েমানুষের চরিত্র ভালো রাখতে হয়। মুখ দেখাতে পারব না সমাজে।”

তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝি—সমাজের ভয়টা অনেক সময় ভালোবাসার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। নীলয় আসা বন্ধ করে দিল পুকুরঘাটে। সাবিহাও যাওয়া কমিয়ে দিল।

দু’জনেই যেন বুঝে গেল, সম্পর্কটা বাড়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে—সে এক অসমাপ্ত চিঠির মতো। এরপর একদিন সাবিহার বাবা বদলি হলেন কুমিল্লায়। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো শহরে। সেই যাত্রার দিন ভোরে, ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সাবিহা। মনটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল—কার জন্য, তখনো বোঝেননি। আজ বুঝতে কষ্ট হয় না। নীলয়কে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। কোনো যোগাযোগও নয়। তবে তার ছবি এখনো রয়ে গেছে সাবিহার মনে—ছায়াঘেরা পুকুরঘাটের ছেলেটি, যার হাতে ছিল রঙিন খাতা আর চোখে ছিল স্বপ্ন।

স্মৃতি থেকে ফিরে সাবিহা চোখ মেলে দেখেন জানালার ওপারে আবার বিকেল নামছে। ঘরে এখনো আলো জ্বলেনি। অথচ তিনি যেন আলোয় ভেসে আছেন—সেই অতীতের আজকের এই নির্জন ঘর, এই চুপচাপ বিকেল, যেন আরেকটি ছায়াঘেরা পুকুরঘাট। শুধু এখন নেই নীলয়। নেই মা। নেই সেই স্নানের কুয়াশা। তবু এই নিঃসঙ্গতা এতটা ভয়ানক লাগে না, কারণ স্মৃতির সরণিতে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ বারবার ফিরে পায় নিজের হারানো রঙ।

অধ্যায় ৩:

শহরটা তখনো পুরোপুরি তার হয়নি। চন্দনপুর গ্রামের মাটির গন্ধ এখনো লেগে ছিল সাবিহার মনের কোণে। কুমিল্লা শহরে এসে তাদের বাসা হয়েছিল চকবাজারের এক পুরনো দোতলা ভাড়াবাড়িতে। চোরা বাতাসে ভিজে থাকত সিঁড়ির কাঠ, আর ছাদের কোণে জমানো ছত্রাক-ঘেরা শৈশব। এখানে এসে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল—নতুন স্কুল, নতুন বান্ধবী, নতুন ছাদ। কিন্তু নীলয়ের স্মৃতি তখনো বুকের কোণে ছায়ার মতন ছায়া ফেলে থাকত।

নতুন স্কুলে প্রথম যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, সে ছিল রোকসানা—এক ঝলমলে মেয়ে, চোখে ফ্রেমহীন চশমা, আর কথায় কথায় হাসির ঝরনা।

“তুই এত চুপচাপ কেন রে?” —প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করেছিল সে।

সাবিহা হেসে বলেছিল, “চুপ করলেই তো শোনা যায় সবকিছু ভালো করে।”

রোকসানার হাত ধরে সাবিহা নতুন জগতে পা রাখল। স্কুলের নোট বইয়ের পাশে জমা হতে থাকল রঙিন গল্প। কিন্তু নীলয়ের সঙ্গে সেই অসমাপ্ত সময়টা যেন বারবার ফিরে আসত। এক বিকেলে, ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে যখন ঠান্ডা বাতাসে ওড়াচ্ছিল চুল, হঠাৎ তার হাত কাঁপে উঠল—কে যেন নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।

মাথা ঘুরিয়ে দেখে—সাদমান। সাদমান ছিল পাশের বাসার ছেলে—কলেজে পড়ে, সাদা পাঞ্জাবি পরে। তার চোখে ছিল এক ধরণের স্থিরতা, আর ভ্রু-ভাজের মাঝে অদ্ভুত মায়া।সাবিহা যখন ছাদে দাঁড়াত, সাদমান চুপচাপ নিচে তাকিয়ে থাকত। কিছু বলত না, ইশারা করত না—কিন্তু সেই দৃষ্টিতে যেন হিমালয়ের মতো ওজন ছিল। একদিন রোকসানা বলল, “ও তোকে পছন্দ করে, বুঝলি না?”

সাবিহা চমকে গেল। “কী বলিস? আমি… আমি কাউকে পছন্দ করিনা আর।”

“তবু তোর চোখে দেখি, তুই নীরব প্রেমে ডুবে আছিস,”—বলেছিল রোকসানা।

সেদিন রাতে সাবিহা চুপ করে নিজের ডায়েরি খুলে লিখেছিল প্রথমবার—

“যদি কোনোদিন বলার সাহস পাই, তবে তাকে লিখে দেব একটি চিঠি। বলব, আমি কিছু ভুলতে পারি না। আর তুমি, তুমি হয়তো ভুলতে সাহায্য করতে পারো।”

তার কয়েকদিন পর এক রবিবার দুপুরে, চারপাশে নীরবতা, পাখির ডাক যেন গান হয়ে উঠেছিল—সাবিহা প্রথমবার একটি কাগজে লিখেছিল তার মনের কথা।

“সাদমান,

আমি জানি তুমি কোনোদিন আমার থেকে কিছু চাওনি। আমি নিজেও কিছু চাই না। কিন্তু তবু মনে হয়, কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে বলে আমি আবার বাঁচতে শিখছি। তুমি যদি কখনো জানতে চাও—আমি কি মনে করি, আমি শুধু বলব—তুমি আমার নিরব চিঠির পাঠক, আর আমি সেই অক্ষর, যাকে উচ্চারণ করতে ভয় হয়।

—সাবিহা”

চিঠিটা কাঁপা হাতে ভাঁজ করে রাখল সে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে তার বুক কাঁপছিল, যেন ধরা পড়লে পৃথিবী ভেঙে যাবে। চিঠিটা সে রোকসানার মারফত পৌঁছে দিতে বলেছিল, সাদমানের ছোট বোনের হাতে। কিন্তু জীবন তো সবসময় নাটকের মত চলে না। রোকসানা ভুল করে চিঠিটা সাবিহার খালা-র ছেলে রাশেদের হাতে দিয়ে ফেলে। রাশেদ, সে ছিল রাশভারী ছেলে—বাড়ির চোখে আদর্শ, কিন্তু ভেতরে একজন কঠিন নীতির ধারক। সেই চিঠি গিয়ে পৌঁছায় সাবিহার বাবা শরীফ মোল্লা-র হাতে। রাত দশটায় বাবা ঘরে ডেকে পাঠালেন।

“তুই এটা লিখেছিস?”—চিঠি হাতে।

সাবিহা বোবা হয়ে গিয়েছিল।

“এ বাড়িতে বসে তোদের মতো প্রেম করা হবে না, বুঝলি? মেয়েমানুষের কাজ প্রেম নয়, সংসার করা, স্বামী মানা।”

চড়, থাপ্পড়, আর সেই ভর্ৎসনার গর্জনে ঘর কেঁপে উঠেছিল।পরদিন থেকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি বন্ধ। ছাদে ওঠাও নয়। এমনকি রোকসানার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা। সাবিহা বন্দী হয়ে গেল নিজে থেকেই।

দরজা বন্ধ ঘরে বসে, তার ডায়েরির পাতা শুধু জবাব খুঁজে বেড়াত—“ভালোবাসা কি সত্যিই এত দোষের?”

সাদমান? সে আর চোখের আড়ালেই রয়ে গেল। কিছু বলল না, খোঁজও নেয়নি। হয়তো ভয় পেয়েছিল। কিংবা হয়তো জানত, এই সমাজে ভালোবাসা ব্যর্থ হয়, আর কন্যাদের শুধু দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

বয়সের ভারে চোখে চশমা পরে সাবিহা এখন সেই প্রেমপত্রটার কথা ভাবেন। ডায়েরির পাতা রয়ে গেছে। লেখা, স্মৃতি, যন্ত্রণা—সবই। তবে উত্তর আর কেউ দেয়নি। সাদমানও না, সমাজও না।

এই একাকী বিকেলে জানালার পাশে বসে সাবিহা নিজেকে জিজ্ঞেস করেন—

“তবে কি ভালোবাসা মানেই হারানো? না কি ভালোবাসা মানেই নিজের ভিতর এক পৃথিবী গড়ে তোলা, যা কেউ ভাঙতে পারে না?”

অধ্যায় ৪: 

শরৎকালের এক দুপুর। ঘরের কোণে বসে সাবিহা আয়নার সামনে চুল আঁচড়াচ্ছিল। তার চোখে কোনো সাজ নেই, ঠোঁটে লিপস্টিকের আভাসও নয়। তবু মা বললেন, “একটু ঠিক করে বস। আজ কিন্তু ছেলে-পক্ষ আসবে।”

সাবিহার মন চুপচাপ। যেন কেউ বুকের মাঝখানটা হালকা করে চেপে রেখেছে। ঘরে এসে বসলেন তিনজন—ছেলের মা, এক কাকিমা আর সেই ছেলেটি, নাম তানভীর রহমান।

ঢাকায় চাকরি করেন, সরকারি অফিসার, মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তানভীর বেশ ভদ্রভাবে হেসে বললেন, “আপনার মেয়েকে একটু কথা বলার সুযোগ দিলে ভালো লাগত।”

সাবিহাকে ডেকে নেওয়া হল পাশের ঘরে। দুজনেই বসলেন চুপচাপ।

তানভীর বললেন, “আপনি কি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান?”

সাবিহা একটু চমকে উঠেছিল। সাধারণত এসব প্রশ্ন কেউ করে না। সে বলল, “হ্যাঁ… চাই।”

তানভীর মাথা নেড়ে বলল, “ভালো। আমার মা যদিও একটু রক্ষণশীল, কিন্তু আমি চাই আমার স্ত্রী নিজের মত করে বাঁচুক।”

এই প্রথম সাবিহা ভেতরে এক ধরনের দ্বিধা অনুভব ককরলষ এমন একজন মানুষ, যে সম্মান করে? তবে কি জীবন আবার শুরু করা যায়?

রাতে মা বললেন, “ছেলেটা ভালো। আমরা হ্যাঁ বলতে চাই।”

সাবিহা কিছু বলল না। চুপচাপ উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। পূর্ণিমার আলোয় তার মুখ যেন মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নীলয়, সাদমান—সবই কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু তানভীর? সে কি এক নতুন সম্ভাবনা?

রাতে ঘুমের আগে সাবিহা ডায়েরির একটি পুরনো পৃষ্ঠা খুলল।

সেখানে লেখা ছিল: “আমি চাই না, আমার জীবন শুধু কোনো এক অতীতের ছায়ায় আটকে থাকুক। আমি বাঁচতে চাই—নতুনভাবে, নিজের মতো করে।”

চোখে জল এসে গেল। নিজেরই লেখা যেন নিজেকে উত্তর দিল।

সেই দিনটির কথা আজও সাবিহার মনে গেঁথে আছে—নববধূর মতো নয়, বরং একজন সফরের মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকা পথিকের মতো সে পা রেখেছিল নতুন জীবনে।

বিয়ের দিন কুমিল্লার আকাশে মেঘ ছিল। শরতের শেষভাগ, বাতাসে মিশে থাকা ধূপ আর মেহেদির গন্ধ যেন আরও ভারি করে তুলছিল দিনটাকে। সাবিহার চোখে কাজল ছিল, কিন্তু সেই কাজল জলে গলে গিয়েছিল ঠিক সন্ধ্যার আগে, যখন মায়ের কোলে মাথা রেখে সে কেঁদে বলেছিল—
“মা, আমি পারব তো?”

মা শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “নারীরা চুপচাপ পারতে শিখে যায় রে মা, না পারলেও বলে না।”

এই কথাটা তখন বুঝেনি সাবিহা, কিন্তু আজ এত বছর পর জানে—এই একটি বাক্যেই লুকিয়ে ছিল তার ভবিষ্যতের ছায়াপথ।

তানভীরের সরকারি কোয়ার্টার—মোহাম্মদপুরের এক সুনসান গলির শেষপ্রান্তে, দোতলার ছোট ফ্ল্যাট। ছিমছাম সাজানো, দেয়ালে framed ছবি, বইয়ের আলমারিতে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রথমদিনই তানভীর সাবিহাকে বলেছিল, “তুমি কি বই পড়ো?”
সাবিহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ… মাঝে মাঝে।”
তানভীর হেসে বলেছিল, “তোমার মাঝে মাঝে’তেই যে একটা কবিতা লুকিয়ে থাকে, সেটা আমি বুঝতে পারি।”

এই মানুষটা ভদ্র, ভেতরে ভদ্রতা নয়—সহানুভূতি।
সেই ভোরে, সবার অজান্তে, সাবিহা মনে মনে বলেছিল,
“হয়তো এবার… হয়তো আমি পারব।”

তানভীর প্রতিদিন অফিসে যায়, সাবিহা ঘর গোছায়, রান্না করে, বারান্দার গাছে জল দেয়। দুপুরে সে যখন একা থাকে, তখন জানালার ধারে বসে পুরনো ডায়েরির পাতা উল্টায়। নীলয়ের পুকুরঘাট, সাদমানের ছাদতলা, প্রেমপত্রে জড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ ভালোবাসা—সবকিছু যেন গোপনে ফিসফিস করে ফিরে আসে।

একবার সে তানভীরকে জিজ্ঞেস করেছিল,
“তুমি কি কারো প্রেমে পড়েছিলে আগে?”
তানভীর থেমে গিয়েছিল, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল,
“হ্যাঁ, পড়েছিলাম। কিন্তু সেটা শুধু মনে আছে, জীবনে নয়।”
তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি?”
সাবিহা হেসেছিল। খুব ছোট্ট করে, খুব মৃদু স্বরে বলেছিল,
“হয়তো… একসময়।”

প্রথম কয়েক মাস চলেছিল শান্তির ছায়ায়—তানভীর ঠিক মতো সময় দিত, আত্মীয়রা সাবিহাকে ভালোবাসত, মা ফোন করে বলত, “তোর কপালে ভালো মানুষ পড়েছে রে মা।”
সাবিহা জানত, কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু রাতের গভীরে, যখন তানভীর ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সাবিহা জেগে বসে থাকত।
আকাশের তারা গোনার মতো করে তার স্মৃতি গুনত—কে কোথায় কষ্ট দিয়েছিল, কে আদর করেছিল, কে চিঠির কোনো জবাব দেয়নি।

তানভীর পাশে থেকেও দূরে ছিল না, কিন্তু মনের ভেতর যে ঘরখানি খালি ছিল—সেটা যেন কোনোভাবেই পূর্ণ হতো না।

একদিন দুপুরে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে করতে সাবিহা একটা পুরনো চিঠির খাম পায়, আলমারির কোণায়। মাঝে কোনো তারিখ নেই, না কোনো নাম।

তার মনে পড়ে—এই খামটা তার বাবার বাড়ি থেকে এসেছে বিয়ের পর, মা পাঠিয়েছিলেন কিছু পুরনো জিনিস।
চিঠিটা খুলে দেখে—সেই চিঠি, যা সে একদিন সাদমানের জন্য লিখেছিল, কিন্তু কখনও পাঠাতে পারেনি। হাত কাঁপতে থাকে। সেই অক্ষরগুলো, সেই অনুভব—সব যেন মনের দরজায় ধাক্কা দেয়।

“তুমি যদি কখনো জানতে চাও…” —এই লাইনটা এখনো কাঁপিয়ে দেয় তাকে।

সেই রাতে তানভীর ঘরে ঢুকে দেখে সাবিহা ছাদে বসে আছে। চুপচাপ।

“সব ঠিক আছে?” —জিজ্ঞেস করে।

সাবিহা ঘাড় নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ… একটু নিজের সঙ্গে বসেছিলাম।”

তানভীর পাশ বসে বলে, “কখনো যদি কষ্ট হয়, আমায় বলবে। আমি সব জানতে চাই না… কিন্তু পাশে থাকতে চাই।”

এই কথায় সাবিহার বুকের ভেতরটা একটু নরম হয়ে আসে।
সে ভাবল—ভালোবাসা না হয় হয়নি, তবে ভালোবাসার মতো সম্মান তো আছে। তানভীর তাকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে না, জোড় করে না কিছু। এই সম্পর্ক হয়তো প্রেমের নয়, কিন্তু একধরনের শান্তি।

একদিন সে ডায়েরিতে লিখল:

“আমি এখন জানি—ভালোবাসা একমাত্র সত্য নয়। সম্মান, সহানুভূতি, বোঝাপড়া—এই তিনে সম্পর্ক টিকে থাকে।
আর অতীত? সে যেমন ছিল, তেমনই থাক। আমি তাকে দাফন করিনি, শুধু হৃদয়ের এক কোণে চুপ করে বসিয়ে রেখেছি।
কারণ, আমি আজ বাঁচছি। এক নতুন ঠিকানায়, নতুন নামে—কিন্তু আমারই মন নিয়ে।”

অধ্যায় ৫:

এক সন্ধ্যায় যখন মেঘলা আকাশের নিচে বারান্দায় বসে সাবিহা লাল চা খাচ্ছিল, মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। দ্বিধা নিয়ে ধরল।

— “হ্যালো?”

— “সাবিহা? আমি… সাদমান।”

এক মুহূর্তে যেন সব শব্দ থেমে গেল। কোনো কথা না বলে সে কেবল শুনে গেল সেই চেনা কণ্ঠস্বর, যা একদিন তার স্বপ্ন গড়েছিল, আবার ভেঙেও দিয়েছিল।

— “অনেক বছর কেটে গেছে, জানি। তবু আজ তোমার কথা মনে পড়ল, তাই ফোন করলাম।”

সাবিহা কিছু বলল না। তার কণ্ঠে কোনো আগুন নেই, শুধু এক ধরনের শান্ত ঠান্ডা।

— “তুমি কেমন আছ?”

সাবিহা বলল, “ভালো… খুব ভালো। তুমি?”

সাদমান বলল, “চেষ্টা করছি… ভালো থাকার।”

কথা শেষ হওয়ার আগে সাদমান বলল, “তুমি কি কখনও আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছো?”

সাবিহা একটু চুপ করে থেকে বলল, “ক্ষমা করেছি অনেক আগেই। কিন্তু ভুলিনি।

কারণ কিছু ব্যথা রয়ে যাওয়াই ভালো। তারা মনে করিয়ে দেয়—কখনো আবার সেই পথে না হাঁটতে।”

কল কেটে যায়। তারপর আর কোনো শব্দ নেই, শুধু বাতাসে পুরনো পাতা উড়ে যায়।

বছর দশেক কেটে গেছে। সাবিহার চুলে পাক ধরেছে। তানভীর এখন অবসরপ্রাপ্ত, দিনের বেশির ভাগ সময় বই আর রেডিওর মাঝে কাটে। সন্তান নেই, কিন্তু সংসারে শূন্যতা নেই।এক সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাবিহা দেখল নিজের মুখ। চোখের চারপাশে বলিরেখা, ঠোঁটে ক্লান্তি, কপালে সময়ের দাগ। তবু সে হেসে ফেলল। এই মুখেই তো প্রেম জেগেছিল, এই মুখেই কান্না এসেছিল, এই মুখ দিয়েই সে একদিন বলেছিল, “আমি পারব তো?”

আজ সে জানে, পারা-না-পারা এসব কথার বাইরে গিয়ে জীবন একটা প্রবাহ—যেখানে ভুল, ভালোবাসা, ছেড়ে যাওয়া, নতুন করে গড়া—সবই দরকারি।

সে আবার আয়নায় তাকিয়ে বলল, “তুই ভালোই ছিলি, সাবিহা।”

বর্ষার বিকেল। সাবিহা আজ বারান্দায় বসে ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লিখছে। তানভীর চুপচাপ এক কাপ চা দিয়ে রেখে গেল। সে জানে, আজকের লেখাটি শেষ পাতার শেষ লেখা।

“আজ আমি জীবনের এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। যেখানে অতীতের দিকে তাকালে কষ্ট নেই, রাগ নেই, শুধু মায়া।ভালোবাসা বলতে চিৎকার করে বলার মতো কিছু ছিল না, তবু যা পেয়েছি, তা কম কিছু নয়। আমি বেঁচেছি। সত্যিকারের বেঁচে থাকা—যেখানে নিজের ভুল, নিজের ক্ষমা, আর নিজের গল্পগুলোকে নিজের মতো করে ধরে রাখা যায়। আমার নাম সাবিহা। আমি একজন নারী, একজন মানুষ—যার পেছনে এক জীবন জমে আছে স্মৃতির সরণি হয়ে।”

সে কলম বন্ধ করে দেয়। একটা পাতা উড়ে জানালা দিয়ে বাইরে চলে যায়। নিচে ভিজে উঠোনে পড়ে থাকে—একটি পুরনো জীবন, যা এখন আর কাঁদায় না, কেবল চুপ করে পাশে বসে থাকে।

 

সমাপ্ত

1000022492.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *