Bangla - কল্পবিজ্ঞান

স্মৃতিচোর

Spread the love

অবন্তি দে


অধ্যায় ১: শহরের ছায়া

ভবিষ্যতের কলকাতা যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশচুম্বী টাওয়ার, নীয়ন আলোয় ঝলমল করা রাস্তাঘাট, উড়ন্ত গাড়ির শব্দে ভরা আকাশ—সব মিলিয়ে এক মহাজাগতিক প্রযুক্তির ঝলক শহরটিকে নতুন যুগে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এই উজ্জ্বলতার মাঝেই অন্ধকার গলিগুলো যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির আলো যত বেড়েছে, ততই মানুষের ভেতরের ভয়, শূন্যতা আর অচেনা অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে। সেই অন্ধকারেই ঘাপটি মেরে আছে এক রহস্যময় অপরাধী, যে অস্ত্র কিংবা বন্দুক ব্যবহার করে না, বরং মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে নিয়ে যাচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—স্মৃতি। আজকাল কলকাতার রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো মানুষদের চোখে একটা আতঙ্ক স্থায়ী ছাপ ফেলে যাচ্ছে, কারণ কেউ জানে না পরের মুহূর্তে কোন স্মৃতি হারিয়ে যাবে, কোন সম্পর্ক মুছে যাবে চিরকালের জন্য।

শহরের খবরের কাগজ, ডিজিটাল চ্যানেল, আর সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিদিন চিৎকার করছে এই অদ্ভুত অপরাধের কথা। গত সপ্তাহেই সল্ট লেকের এক বিশিষ্ট আইনজীবী হঠাৎ তার স্ত্রীর নাম মনে করতে পারেননি। আবার পার্ক স্ট্রিটের এক নামজাদা রেস্তরাঁর মালিক তার ছেলের মুখ চিনতে পারেননি, অথচ সামনেই বসেছিল ছেলেটি। ডাক্তাররা প্রথমে ভেবেছিলেন এটা হয়তো হঠাৎ হওয়া নিউরোলজিক্যাল অসুখ, কিন্তু যখন শহরের একের পর এক মানুষ একইভাবে তাদের জীবনের অন্তরঙ্গ স্মৃতি হারাতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল এর পেছনে একটা অদৃশ্য হাত আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ভুক্তভোগীদের শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না, অথচ তারা ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছে। কারও কাছে প্রিয়জনের হাসি, কারও কাছে বাবা-মায়ের স্মৃতি, আবার কারও কাছে জীবনের সবচেয়ে মধুর মুহূর্ত—সব হারিয়ে যাচ্ছে এক ঝটকায়। যেন কোনো অদৃশ্য শিকারি রাতের শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মানুষগুলো একে একে হয়ে উঠছে শূন্য পাত্র।

অপরাধীকে কেউ দেখেনি, কিন্তু তার ছায়া শহরজুড়ে ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। গলিপথে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়াশার মতো অদৃশ্য আতঙ্ক চেপে বসেছে মানুষের মনে। অফিসফেরত ভিড়ের ট্রামে বা মেট্রোয় এখন আর চেনা আলাপ নেই, মানুষ নিজের মনে নিজের নামও বারবার আওড়ে নিচ্ছে, যদি হঠাৎ ভুলে যায়! শহরের রাতের দৃশ্যও বদলে গেছে—আগে যেখানে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে ছাত্ররা আড্ডা দিত, বা গড়িয়ার লেনগুলোয় কিশোররা ফুটবল খেলত, সেখানে এখন এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছে। উড়ন্ত গাড়ির ঝলকানি যতই থাকুক না কেন, রাস্তাঘাটের কোণগুলোয় জমে থাকা অন্ধকারে একটা অজানা চোখের দৃষ্টি অনুভব করছে সকলে। যেন শহরের প্রতিটি দেওয়ালের ফাঁক, প্রতিটি কাঁচের জানালা, প্রতিটি ছাদ থেকে তাকিয়ে আছে সেই অচেনা অপরাধী, যাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

কিন্তু কলকাতা শুধু ভয়েই ডুবে নেই, বরং মানুষের কৌতূহল ও ক্ষোভও বাড়ছে প্রতিদিন। কে এই স্মৃতিচোর? সে কি মানুষ, না কি কোনো উন্নত প্রযুক্তির পরীক্ষার ফলাফল? পুলিশ কমিশনার প্রতিদিন সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দিচ্ছেন—“আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।” অথচ দিন গড়াচ্ছে, আর শহর হারাচ্ছে নিজস্বতা। মানুষ মনে করতে পারছে না তাদের গান, কবিতা, প্রেমের গল্প, এমনকি রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যন্ত। যেন শহরের আত্মাকেই ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে কেউ। কলকাতার অচেনা এই অন্ধকারের সূচনায় এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে—এই শহর শুধু স্মৃতি হারাচ্ছে না, বরং হারাচ্ছে তার মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় পরিচয়: মনে রাখার ক্ষমতা। আর এই ছায়া থেকে বাঁচার উপায় এখনও কারও জানা নেই।

অধ্যায় ২: প্রথম শিকার

কলকাতার ব্যবসাজগতে তিনি ছিলেন এক অচেনা শক্তির নাম—অশোক সেন, বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থার মালিক, যার এক ইশারায় কোটি কোটি টাকার বাজার উঠানামা করত। কিন্তু হঠাৎ করেই শহরের আলোড়ন কেটে গিয়ে সবার সামনে ভেসে উঠল এক অবিশ্বাস্য খবর—অশোক সেন হঠাৎ তার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভুলে গেছেন। বোর্ড মিটিংয়ের দিন তিনি নির্বিকার চেহারায় বসেছিলেন, কিন্তু যখন ব্যবসার পরিকল্পনা, বিদেশি বিনিয়োগ, কিংবা নতুন প্রকল্পের নাম জানতে চাওয়া হলো, তিনি যেন শূন্যে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে ছিল আতঙ্ক, ঠোঁটে অদ্ভুত কাঁপুনি, আর কপালে ঘাম। “আমি… আমি মনে করতে পারছি না,”—এই কয়েকটি বাক্যই যেন কাঁপিয়ে দিল গোটা শহরকে। প্রথমবার বোঝা গেল, স্মৃতিচোর কেবল সাধারণ মানুষকে নয়, শহরের ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী স্তম্ভগুলোকেও শিকার করতে শুরু করেছে।

অশোক সেনের স্মৃতি হারানোর প্রভাব যেন ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কলকাতার অর্থনীতিতে। বাজারে তার শেয়ার হঠাৎ নিম্নগামী হতে শুরু করল, কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলতে লাগল সংস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে। সংবাদমাধ্যম যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল—ডিজিটাল নিউজ পোর্টালগুলো শিরোনামে লিখল “স্মৃতিচোরের প্রথম বড় শিকার”। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটানা বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতে লাগল, যেখানে আলোচকরা বলছিলেন—“এটা কি স্রেফ দুর্ঘটনা, না কি সংগঠিত অপরাধ?” সাধারণ মানুষ, যারা এতদিন কেবল ছোটখাটো স্মৃতিচুরির ঘটনা শুনছিল, তারা এবার উপলব্ধি করল—এ অপরাধী শহরের শিরা-উপশিরায় ঢুকে পড়েছে। কারও ব্যক্তিগত স্মৃতি নয়, এবার হারিয়ে যেতে পারে কোটি টাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কিংবা পুরো অর্থনীতির ভিত।

পুলিশ সদর দফতরে যেন হুলস্থুল পড়ে গেল। কমিশনার নিজে টিম গঠন করলেন, সাইবার সেলের বিশেষজ্ঞদের ডাকা হলো, ডাক্তার আর মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে বসানো হলো টাস্কফোর্স। কিন্তু যতই খোঁজা হলো, কোনো প্রমাণ সামনে এলো না। অশোক সেনের অফিসের সিসিটিভি ফুটেজে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ল না, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরা শপথ করে বললেন তিনি সারাদিন অফিসের ভেতরেই ছিলেন, আর তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেল না। তবু তিনি হারালেন তার সমস্ত গোপন তথ্য—প্রকল্পের খুঁটিনাটি, প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি, এমনকি নিজের পরিবারের পুরোনো ছবিগুলো পর্যন্ত তার মাথা থেকে মুছে গেছে। যেন কেউ অদৃশ্য আঙুল দিয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু মুছে দিয়েছে। পুলিশের কাছে এ যেন এক অসম্ভব রহস্য—অপরাধ ঘটছে, অথচ অপরাধী নেই, অস্ত্র নেই, প্রমাণ নেই।

শহরে আতঙ্ক যেন নতুন মাত্রায় পৌঁছাল। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলে অনুভব করল, এই অপরাধী চাইলে যেকোনো মানুষকে লক্ষ্য করতে পারে। ব্যবসায়ীরা অফিসে যাবার আগে ফাইলগুলোর কপি রাখতে শুরু করলেন, সাধারণ মানুষ নিজেদের নাম আর পরিচিতজনদের ফোন নম্বর ডায়েরিতে লিখে রাখতে লাগলেন, আবার কেউ কেউ ভয় পেয়ে ডিজিটাল ডিভাইস বন্ধ করে রাখলেন। কিন্তু সবকিছুর পরেও আশঙ্কা রইল—যদি স্মৃতি চুরি হয়ে যায়, কোনো নথি কি তখন সত্যিই কাজে লাগবে? অশোক সেনের অসহায় চোখের দৃষ্টি যেন শহরের আয়নায় প্রতিফলিত হলো—প্রযুক্তির ঝলমলে আলোয় ঢাকা কলকাতার বুকের ভেতর ক্রমশ জমে উঠল ভয় আর সন্দেহের ঘন ছায়া। আর শহর বুঝে গেল, স্মৃতিচোরকে ধরা না গেলে এই খেলা আরও ভয়ংকর দিকে এগোবে।

অধ্যায় ৩: গোয়েন্দার আবির্ভাব

কলকাতা যখন আতঙ্কে কাঁপছে, সংবাদমাধ্যম যখন প্রতিদিন নতুন নতুন বিশ্লেষণ সাজাচ্ছে, তখনই আলোচনায় উঠে এল এক নাম—অরিত্র সেন। একসময় কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দক্ষ অফিসার ছিলেন তিনি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অপরাধজগতের গভীর অভিজ্ঞতা, আর অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁকে করেছিল অনন্য। কিন্তু হঠাৎ এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে চাকরি হারাতে হয় তাঁকে। অনেকেই ভেবেছিল, এর পর হয়তো তিনি অন্ধকারেই ডুবে যাবেন, কিন্তু অরিত্র নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি হয়ে উঠলেন শহরের অন্যতম স্বনামধন্য প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর—যার কাছে ধনী ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ, সবারই আস্থা ছিল। তবে চাকরি হারানোর পর তাঁর ব্যক্তিজীবন ভেঙে পড়ে—স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান, বন্ধুত্বের পরিসর সংকুচিত হয়, আর অরিত্র ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একাকী মানুষ। তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে সিগারেটের ধোঁয়া আর মামলার ফাইল।

অরিত্রর অভ্যাস ছিল—রাতের নীরবতা ভেঙে জানলার ধারে বসে ধোঁয়ার পাক ছাড়তে ছাড়তে কলকাতার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। তাঁর চোখে সবসময় এক অদ্ভুত দৃষ্টি—যেন দৃশ্যমান বাস্তবের আড়ালে কিছু দেখতে পান তিনি। শহরের প্রতিটি অন্ধকার গলি, প্রতিটি নোংরা আস্তানা তাঁর কাছে ছিল পরিচিত। অপরাধের গন্ধ তিনি চিনতে পারতেন নিখুঁতভাবে। হয়তো এজন্যই, যখন স্মৃতিচোরের খবর ছড়িয়ে পড়ল, তখন অনেকেই মনে করল—এই রহস্যের সমাধান একমাত্র অরিত্র সেনই করতে পারবেন। পুলিশের কাঁধে রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনের অসহায়তা—সবকিছুর মাঝে তাঁকেই ভরসা হিসেবে দেখল আতঙ্কিত মানুষ। সংবাদপত্রে লেখা হলো—“পুলিশ যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই কি অরিত্র সেন সফল হবেন?”

অরিত্রর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ন্যায়বোধ। তিনি কখনো টাকার লোভে মামলা নিতেন না, আবার রাজনৈতিক প্রভাবকেও পাত্তা দিতেন না। তাঁর জন্য সত্য মানে সত্যই, মিথ্যা মানে মিথ্যাই। এই নীতি তাঁকে যতটা সম্মান এনে দিয়েছে, ততটাই শত্রু তৈরি করেছে। তিনি জানতেন, এই স্মৃতিচুরির রহস্য উন্মোচন করা মানে শহরের এক গভীর অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়ানো, কিন্তু তবুও তিনি দ্বিধা করলেন না। কেস ফাইল হাতে নিলেন, সিগারেট ধরালেন, আর নিঃশব্দে বললেন—“এই খেলা শুধু স্মৃতির নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের আত্মা।”

প্রথম দিনেই তিনি অশোক সেনের বাড়ি গিয়ে তাঁকে দেখলেন। শিল্পপতির শূন্য দৃষ্টি, ভুলে যাওয়া নাম-চেনার অসহায়তা অরিত্রকে স্পষ্ট করে দিল—এটা সাধারণ কোনো মানসিক অসুখ নয়। তিনি ঘুরে ঘুরে বাড়ির প্রতিটি কোণ খতিয়ে দেখলেন, কর্মচারীদের জেরা করলেন, এমনকি অশোক সেনের হাতের লেখা পুরোনো নোটবুকগুলোও উল্টেপাল্টে দেখলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোথাও কোনো ফাঁক পাওয়া গেল না। যেন অপরাধী হাওয়ার মতো এসে গিয়েছিল আর চলে গেছে। রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফেরার পথে অরিত্র সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবলেন—“প্রমাণ নেই মানে অপরাধ নেই—এটাই সবাই ভাবছে। কিন্তু আমি জানি, এই শহরের ছায়ার ভেতর কেউ আছে, যে খেলছে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে।” তাঁর মনে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জেগে উঠল। কলকাতার আলো-অন্ধকারের মাঝেই শুরু হলো গোয়েন্দা অরিত্র সেনের নতুন লড়াই।

অধ্যায় ৪: রহস্যময় বাজার

অরিত্রর তদন্তে যতই দিন গড়াতে লাগল, ততই সে বুঝতে পারল—স্মৃতিচুরির ঘটনাগুলো কেবল নিছক অপরাধ নয়, এর পেছনে রয়েছে এক সুসংগঠিত চক্র। এক রাতে চৌরঙ্গির ধূসর কফি হাউসে বসে পুরোনো এক সূত্রের সঙ্গে কথা বলছিল অরিত্র। সেই সূত্র একসময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের নামকরা দালাল ছিল, বর্তমানে লুকিয়ে বাঁচে। গাঢ় ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে লোকটা ফিসফিস করে বলল—“শহরে একটা কালোবাজার আছে, যেখানে স্মৃতি কেনাবেচা হয়। যে স্মৃতি একদিন তোমার, সেটা আরেকদিন কারও সম্পদ হয়ে যায়।” অরিত্র প্রথমে অবিশ্বাস করলেও লোকটার চোখের ভয়ের ঝিলিক তাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল—এ কেবল গুজব নয়। গোপনে কলকাতার পেটের ভেতর চলছে এমন এক ব্যবসা, যার পরিণতি শহরের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে পারে।

শহরের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই বাজার ছিল অদৃশ্য, কিন্তু তার প্রভাব ছিল ভয়াবহ। জানা গেল, এখানে ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট এজেন্ট পর্যন্ত হাজির হয়। কেউ কারও প্রিয়জনের প্রেমের স্মৃতি কিনে নেয়, যাতে প্রতিযোগীকে দুর্বল করা যায়; কেউ আবার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফর্মুলা হাতিয়ে নেয় বিপুল দামে। একেকটি স্মৃতির দাম নাকি কোটি টাকারও বেশি। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ প্রতিদ্বন্দ্বীর অতীত মুছে দিতে গোপনে স্মৃতি কিনে নেন, আবার কোনো শিল্পপতি নিজের ব্যর্থতার স্মৃতি মুছে দিয়ে কৃত্রিম আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে ওঠেন। স্মৃতিগুলো যেন এই বাজারে রঙিন পণ্যের মতো সাজানো থাকে—কেউ চাইছে প্রথম চুম্বনের উষ্ণতা, কেউ চাইছে কোনো গোপন আবিষ্কারের সূত্র। আর এই লেনদেনের আড়ালে ক্রমে অচেনা হয়ে যাচ্ছে মানুষ।

অরিত্র জানত, এই বাজারে প্রবেশ করা সহজ নয়। এর দরজা খুলতে হলে চাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গভীর সংযোগ। সে নিজেই একসময় পুলিশের হয়ে অনেক দাগী অপরাধীর সঙ্গে লড়াই করেছে, তাই শহরের অন্ধকার গলির অচেনা মুখগুলো তার অচেনা নয়। রাতের পর রাত সে পুরোনো সূত্র খুঁজতে বেরোল—কখনো দমদমের নোংরা বস্তি, কখনো টপসিয়ার কুখ্যাত মদের আড্ডা, আবার কখনো সোনাগাছির আঁধারে ভরা অলি-গলি। প্রত্যেকেই প্রথমে মুখ বন্ধ রাখলেও, সিগারেটের ধোঁয়ার আস্তরণে আর অরিত্রর অদম্য দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে তথ্য ফাঁস হতে শুরু করল। এক লম্পট দালাল একসময় মদ্যপ অবস্থায় বলে ফেলল—“বাজারটা নদীর ধারের পুরোনো গুদামে বসে, যেখানে ঢোকার জন্য দরকার কোড আর পরিচয়।” সেই মুহূর্তে অরিত্র বুঝল, সে সঠিক পথে এগোচ্ছে।

কিন্তু যত গভীরে সে নামল, ততই রহস্য আরও জটিল হয়ে উঠল। এক রাতে শোভাবাজারের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ সে অনুভব করল—কেউ তার পিছু নিয়েছে। অচেনা ছায়াগুলো যেন ঘুরে ঘুরে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। স্পষ্ট বোঝা গেল, কালোবাজারের নিয়ন্ত্রকেরা তার উপস্থিতি টের পেয়েছে। কিন্তু অরিত্র ভীত হল না। সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁট থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে নিজেকেই বলল—“স্মৃতির এই ব্যবসা যদি সত্যিই থাকে, তবে শহরের ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছে। আর আমি সেই ছায়ার ভেতরে ঢুকবই।” অন্ধকার নদীর ধারে পুরোনো গুদামের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে অরিত্রর মনে হলো—খেলা মাত্র শুরু হয়েছে, আর এই খেলার পরিণতি হয়তো শহরের ইতিহাস পাল্টে দেবে।

অধ্যায় ৫: অন্ধকার গলি ও সূত্র

উত্তর কলকাতার গলিগুলো সবসময়ই রহস্যে ভরা। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো, ভাঙা ইটের দেওয়াল, শ্যাওলা জমে থাকা সিঁড়ি, আর অচেনা কুকুরের হুক্কাহুয়া ডাকে যেন জায়গাটা অন্য এক জগতের ছবি আঁকে। অরিত্র জানত, শহরের অন্ধকার যদি সত্যিই কোনো সূত্র ধরে রাখে, তবে তা লুকিয়ে আছে এই পুরোনো গলির ভেতরেই। এক সন্ধ্যায় সে পৌঁছাল গিরিশ পার্কের ধারে, যেখানে গলি পেরোতে না পেরোতেই কুয়াশার মতো আঠালো অন্ধকার জড়িয়ে ধরল তাকে। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার পাক ছাড়তে ছাড়তে অরিত্র পা ফেলছিল নিঃশব্দে, যেন অন্ধকারও তার প্রতিটি শ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ঠিক তখনই সে দেখতে পেল, ভাঙা এক ঘরের বারান্দায় বসে আছে এক ভবঘুরে, যার চোখে কোনো চেনা আলো নেই, শুধু শূন্য দৃষ্টি।

ভবঘুরেটি ছিল এক অদ্ভুত চরিত্র। তার মুখ শুকনো, দেহ কঙ্কালসার, আর চোখদুটো কুয়াশায় ঢাকা জানালার মতো ফাঁকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে বারবার একই শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে—এক অজানা নাম। “ইলিয়াস… ইলিয়াস… ইলিয়াস…”—যেন মন্ত্রোচ্চারণের মতো গলির অন্ধকারে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল সেই নাম। অরিত্র প্রথমে ভেবেছিল এ স্রেফ পাগলের বকুনি, কিন্তু যখন সে লক্ষ্য করল লোকটার চোখের ভেতরকার ভীতি, তখন বুঝল এর গভীরে কিছু আছে। সে ঝুঁকে লোকটার কাছে বসে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল—“ইলিয়াস কে? কোথায় থাকে?” ভবঘুরে হঠাৎ কেঁপে উঠল, তারপর কাঁপা গলায় বলল—“ছায়া… ছায়ার আড়ালে…” এর পরেই সে মাথা নেড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, যেন নিজের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে।

অরিত্র বুঝল, এই ভবঘুরের মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। হয়তো স্মৃতিচোর তাকে শিকার করেছে, আর বাকি সবকিছু মুছে দিয়ে রেখে গেছে কেবল এক নাম—‘ইলিয়াস’। এই নামই হয়তো রহস্যের মূল চাবিকাঠি। সে লোকটার দেহভঙ্গি, কথার পুনরাবৃত্তি, এমনকি হাতের অজান্তে করা নড়াচড়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। ভবঘুরে কখনো নিজের কপালে হাত দিয়ে আঁচড় কাটছিল, কখনো আবার চোখ বন্ধ করে কাঁদছিল। তার ভেতরে যে স্মৃতিহীনতার গভীর যন্ত্রণা চলছে, তা অরিত্রর অভিজ্ঞ চোখ এড়িয়ে গেল না। সে বুঝল, ‘ইলিয়াস’ হয়তো স্মৃতিচোরের আসল পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত, অথবা সেই কালোবাজারের কোনো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক।

রাত বাড়ছিল, অন্ধকার গলির শূন্যতায় বেড়ে উঠছিল নীরবতার চাপ। অরিত্র সিগারেটের শেষ টান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আর মনে মনে বলল—“খেলা এখন আরও বিপজ্জনক দিকে মোড় নেবে।” ভবঘুরেকে দেখে তার মনে হলো, শহরের ভবিষ্যৎ যদি রক্ষা করতে হয়, তবে তাকে এই নামের রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে। দূরে হাওড়া ব্রিজের আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু সেই আলো পৌঁছাচ্ছিল না উত্তর কলকাতার এই গলিতে। অরিত্র পকেট থেকে নোটবই বের করে লিখে নিল সেই নাম—‘ইলিয়াস’। এই শব্দই হয়তো কলকাতার ভয়াবহ স্মৃতিচুরির অন্ধকার রাজ্যের দরজা খুলে দেবে। আর সেই মুহূর্তে গোয়েন্দা অরিত্র সেন বুঝে গেল—এখন থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ মৃত্যুর সঙ্গে খেলায় নামবে।

অধ্যায় ৬: পুরনো বন্ধুত্ব, নতুন শত্রুতা

অরিত্রর জীবনের অনেক পুরনো সম্পর্কগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল অনিরুদ্ধ পাল—বর্তমানে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসার। কলেজ জীবনে তারা দু’জন ছিল অবিচ্ছেদ্য, একই সাথে পড়াশোনা, আড্ডা আর স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়া। পুলিশে যোগ দেওয়ার পর দু’জনেই অনেকটা সময় একসঙ্গে কাজ করেছে। অপরাধ দমন থেকে শুরু করে বড় বড় মামলা সমাধান—তাদের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। সেই বন্ধুত্বের ইতিহাসই অরিত্রকে একসময়ে মানসিক শক্তি দিত। তাই স্মৃতিচুরির এই অদ্ভুত কেসে নামার সময় অরিত্র প্রথমেই ভেবেছিল, অনিরুদ্ধকে পাশে পাবে। শুরুতে তাই হয়েছিলও। এক রাতে লালবাজারের পুরোনো ক্যান্টিনে বসে তারা দু’জন একসঙ্গে সিগারেট ধরিয়ে কেস নিয়ে আলোচনা করছিল। অনিরুদ্ধ তখনও বলেছিল—“তুই একা এ কেসে নামিস না, আমি আছি।”

কিন্তু যতই দিন গড়াল, পরিস্থিতি ততই পাল্টে গেল। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়তে লাগল। উপর মহল থেকে স্পষ্ট নির্দেশ এল—অরিত্র যেন বেশি নাক গলায় না। প্রশাসন চাইছিল, বিষয়টা ‘অজানা অসুখ’ বলেই জনসাধারণের সামনে চালানো হোক, যাতে আতঙ্ক না বাড়ে। অথচ অরিত্রর তদন্তে একের পর এক সত্যি বেরিয়ে আসছিল—কালোবাজার, স্মৃতিচোর, আর অদৃশ্য নাম ‘ইলিয়াস’। এই তথ্যগুলো প্রশাসনের কাছে হয়ে উঠল অস্বস্তির কারণ। অনিরুদ্ধকে ডেকে বারবার বলা হলো, সে যেন বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে অফিসের নির্দেশ মেনে চলে। ধীরে ধীরে সেই পুরোনো বন্ধু অরিত্রর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করল। যেখানেই অরিত্র কোনো সূত্র পেত, কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে পুলিশ হাজির হয়ে তদন্ত বন্ধ করে দিত।

অরিত্র প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো অনিরুদ্ধ কেবল দফতরের চাপ মেনে চলছে। কিন্তু শিগগিরই বুঝতে পারল, অনিরুদ্ধ নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে পুরোনো বন্ধুত্ব আর সত্যের অনুসন্ধান, অন্যদিকে চাকরির শপথ আর প্রশাসনিক দায়িত্ব—এই টানাপোড়েন অনিরুদ্ধকে বদলে দিল। একদিন হঠাৎ সে স্পষ্টভাবে বলেই দিল—“অরিত্র, তোকে আর সাহায্য করতে পারব না। অনেক হয়েছে। আমি যদি তোকে সাপোর্ট করি, তাহলে নিজের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।” সেই মুহূর্তে অরিত্রর বুকের ভেতর যেন একটা শূন্যতা তৈরি হলো। যাকে একসময় ভাইয়ের মতো বিশ্বাস করত, সেই আজ তার পথ রুদ্ধ করছে। ধোঁয়ার আস্তরণের ভেতর থেকে অরিত্রর ঠোঁট থেকে বেরোল তিক্ত একটা কথা—“বন্ধুত্বের মূল্য যদি ক্যারিয়ারের চেয়ে কম হয়, তবে তুই মানুষ না, কেবল সিস্টেমের চাকর।”

এরপর থেকে অরিত্র একেবারেই একা হয়ে গেল। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নেই, পাশে নেই পুরোনো বন্ধু। শুধু আছে নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, আর সত্যকে খুঁজে বের করার অদম্য ইচ্ছে। শহরের অন্ধকার গলিতে চলতে চলতে সে আরও বেশি উপলব্ধি করল, তার লড়াইটা কেবল স্মৃতিচোরের বিরুদ্ধে নয়, বরং এক পুরো সিস্টেমের বিরুদ্ধে, যে সিস্টেম সত্যকে আড়াল করে রাখে সুবিধার জন্য। সিগারেটের ধোঁয়া ঠোঁট থেকে ছাড়তে ছাড়তে সে মনে মনে বলল—“শত্রু যদি বন্ধুর মুখোশ পরে আসে, তবে লড়াই আরও কঠিন হয়। তবে আমি পিছিয়ে যাব না। সত্য যদি আলো হয়, তবে সেই আলোকে রক্ষার জন্য আমি অন্ধকারের ভেতরেও হাঁটব।” এই উপলব্ধি অরিত্রকে আরও দৃঢ় করল, যদিও সামনে অপেক্ষা করছিল আরও ভয়ংকর পরীক্ষা।

অধ্যায় ৭: মুখোশের আড়ালে

শহরের রাত যত গভীর হয়, অরিত্রর মনেও তত অন্ধকার জমতে থাকে। প্রতিদিনের তদন্তে সে বুঝতে শুরু করল—এই অপরাধী কেবল সাধারণ এক স্মৃতিচোর নয়, বরং শহরের অভিজাত সমাজের সঙ্গে অদ্ভুত এক যোগসূত্র রয়েছে তার। প্রতিটি ঘটনার আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে একাধিক ছদ্মবেশ। কখনো তাকে দেখা যায় একজন নামী চিকিৎসকের ক্লিনিকে, যেখানে রোগীদের চিকিৎসার নামে মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম প্রভাব ফেলা হচ্ছে। আবার কখনো তাকে শোনা যায় একটি বহুজাতিক কোম্পানির গোপন বৈঠকে, যেখানে নতুন প্রযুক্তির অজুহাতে মানুষের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা চলছে। অরিত্র বুঝল, এ কেবল এক ব্যক্তির মুখোশ নয়—এ যেন বহু পরিচয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি, যার প্রতিটি পদক্ষেপে শহরের ক্ষমতাবানদের ছাপ রয়ে গেছে।

অরিত্রর চোখে ভেসে উঠতে লাগল বিভিন্ন মুখ—ডাক্তার, ব্যবসায়ী, এমনকি একসময় যাদের সমাজসেবক মনে করা হতো তারাও এই মুখোশের আড়ালে থাকা অপরাধীর সঙ্গী হতে পারে। রহস্যটা যত উন্মোচিত হচ্ছিল, ততই জটিল হচ্ছিল। কে আসল, আর কে সাজানো চরিত্র—তা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। পুলিশের ফাইল ঘেঁটে ও বিভিন্ন তথ্যদাতার কথায় অরিত্র এক জটিল নকশা আঁকতে শুরু করল। কিন্তু প্রতিবারই মনে হচ্ছিল সেই নকশার মাঝখানটা ফাঁকা, যেন সত্যিকারের মুখটা ইচ্ছে করেই অদৃশ্য হয়ে আছে। এই অবস্থায় অরিত্রর মনে এক অদ্ভুত ভয় কাজ করছিল—সে কি তবে নিজেও এই ছায়ার খেলার মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ছে?

তদন্তের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অরিত্র লক্ষ্য করল, শহরের বিভিন্ন প্রভাবশালী বৃত্তে এক ধরণের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ তাকে সাহায্য করার নাম করে গোপনে ভুল তথ্য দিচ্ছে, আবার কেউ সরাসরি হুমকি দিয়ে বলছে এই অনুসন্ধান ছেড়ে দিতে। অরিত্রর কানে পৌঁছতে শুরু করল গোপন কথাবার্তা—“মুখোশধারী” নাকি আসলে একাধিক দেহে উপস্থিত, যেন একই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জীবনে বাস করছে। এই রহস্যময় চরিত্রের ভেতর লুকিয়ে আছে বিজ্ঞান, অপরাধ আর রাজনীতির ভয়াবহ মিশ্রণ। শহরের গোপন অলিগলিতে হঠাৎ অচেনা চোখের দৃষ্টি তাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি প্রতিনিয়ত তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারি করছে।

শেষরাতে, এক নির্জন ঘাটে দাঁড়িয়ে অরিত্রর মনে হলো সে যেন এক ছায়া-গহ্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। কে আসল? সেই ডাক্তার, যিনি নিরীহ রোগীদের চিকিৎসার আড়ালে তাদের স্মৃতি নিয়ে খেলছেন? নাকি সেই ধনী ব্যবসায়ী, যিনি স্মৃতিকে মুদ্রার মতো কিনে-বেচার বাজার বানিয়েছেন? না কি আরও উপরে বসে থাকা এক অজানা চরিত্র, যে কেবল অন্যদের পুতুল বানিয়ে এই খেলাটা চালাচ্ছে? প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না, শুধু আরও বেশি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। অরিত্র জানত, আসল মুখোশটা খোলার জন্য তাকে আরও গভীরে নামতে হবে—এক গভীরতায় যেখানে হয়তো ফিরে আসার পথ আর খোলা থাকবে না।

অধ্যায় ৮: ধাওয়া

রাত তখন গভীর, শহরের আকাশে নীয়নের আলো ভেসে উঠছে। হঠাৎই খবর পেল অরিত্র—স্মৃতিচোরের সহযোগীরা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে দেখা দিয়েছে। কোনো দ্বিধা না করে সে রওনা দিল। কিন্তু শীঘ্রই সবকিছু এক উত্তেজনাপূর্ণ ধাওয়ায় পরিণত হলো। উড়ন্ত গাড়ির শব্দে কেঁপে উঠল রাতের নিস্তব্ধতা। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশে ছুটে চলল গাড়িগুলো, একটার পেছনে আরেকটা। অরিত্রর গাড়ি যখন হাওড়ার পুরনো সেতুর দিক ঘুরছিল, তখন সামনের গাড়ি থেকে গুলি ছুটে এলো ঝড়ের মতো। শিস দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গুলিগুলো এড়িয়ে যেতে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে উঠল দ্বিগুণ। এ যেন কেবল শহরের রাস্তায় ধাওয়া নয়, বরং মৃত্যু আর বেঁচে থাকার সীমারেখায় এক ভয়ঙ্কর খেলা।

ধাওয়া সেতু থেকে নেমে চলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে। টানেলের ভেতর অন্ধকার, কেবল মাঝে মাঝে টিমটিমে আলো জ্বলছে। বাতাসে জমে আছে ধুলো আর পচা গন্ধ। গর্জন তুলে গাড়িগুলো ঢুকে পড়ল ভিতরে, আর প্রতিটি বাঁক যেন নতুন এক ফাঁদ। হঠাৎই সামনের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে দেয়, অরিত্রর গাড়ি অল্পের জন্য ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচে। চোখের সামনে ছায়ামূর্তিরা দৌড়ে পালাতে থাকে, অরিত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে পিছু নিল। টানেলের প্রতিধ্বনি তার পায়ের শব্দকে আরও ভারী করে তুলছিল, আর প্রতিটি ছায়া তাকে নিয়ে যাচ্ছিল গভীর রহস্যের ভেতরে।

ধাওয়া এবার গড়িয়ে এলো নদীর ধার ঘেঁষে। গঙ্গার কালো জলে চাঁদের আলো পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করেছিল। অপরাধীরা একটি ছোট বোটে উঠে পালাতে চাইছিল, কিন্তু অরিত্রর হাত থেকে ফসকে যাওয়া এত সহজ ছিল না। সে গুলি ছুঁড়ল না, বরং নদীর ঘাটে ঝাঁপ দিয়ে দৌড়ে তাদের ঘিরে ফেলল। এক মুহূর্তে লড়াই শুরু হয়ে গেল, ঘুষি, ধাক্কা আর ছুরির ঝলকানি। নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল উত্তেজনার আগুন। ধস্তাধস্তির মধ্যেই অরিত্র একটি ব্যাগ হাতিয়ে নিতে সক্ষম হলো—ভেতরে কিছু নথি আর এক জোড়া দস্তানা। এই দস্তানার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল অপরাধীর আসল আঙুলের ছাপ।

অবশেষে নিঃশ্বাস ফেলে অরিত্র বসে পড়ল নদীর ঘাটে। চারপাশে পুলিশের সাইরেন বাজতে শুরু করেছে, কিন্তু তার হাতে ধরা সেই আঙুলের ছাপই ছিল আসল পুরস্কার। এটি তাকে নিয়ে গেল এক নতুন দিকের দিকে—কলকাতার উত্তর প্রান্তের এক লুকোনো ল্যাবরেটরি, যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে ভয়ঙ্কর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। শহরের রহস্য আর বিপদের দরজা আরও বড় করে খুলে গেল তার সামনে। ধাওয়ার শেষে পাওয়া এই ছোট্ট সূত্রটাই যেন অরিত্রকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল গভীর অন্ধকারের দিকে, যেখানে সত্যি আর মিথ্যার সীমানা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

অধ্যায় ৯: ল্যাবরেটরির সত্য

ল্যাবরেটরির ভারী লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অরিত্রর মনে হলো যেন সে এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পা দিয়েছে। চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা, কেবল নীল আলোতে ভাসছে বিশাল কাচের চেম্বারগুলো। প্রতিটি চেম্বারের ভেতরে শুয়ে আছে মানুষ, চোখ বন্ধ, মুখে শ্বাসযন্ত্রের মতো মাস্ক লাগানো। যেন তারা ঘুমিয়ে নেই—বরং এক অদ্ভুত যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে বন্দি। চারপাশে মেশিনের গুনগুন শব্দ, তার ভেতর থেকে নির্গত হচ্ছে ঠান্ডা বাতাস আর ঝলমলে তারের আলোকরেখা। অরিত্রর বুক ধকধক করে উঠল—এরা সেই নিখোঁজ মানুষ, যাদের খোঁজে শহর তোলপাড় হয়েছিল। তারা জীবিত, কিন্তু আসলে আর নিজেদের নয়, কেবল এক পরীক্ষার অমানবিক অংশ হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে সে চোখে পড়ল লম্বা টেবিলের উপর সাজানো এক অদ্ভুত যন্ত্র। দেখতে হেলমেটের মতো, তার থেকে ঝুলছে অসংখ্য তার আর ধাতব সুচ। মেশিনের পর্দায় ভেসে উঠছে গ্রাফ, তরঙ্গ আর মানব মস্তিষ্কের ছবি। এখানেই লুকিয়ে আছে স্মৃতিচোরের আসল অস্ত্র। অরিত্র বুঝতে পারল—যন্ত্রটি সরাসরি মস্তিষ্কে প্রবেশ করে স্মৃতিকে আলাদা স্তরে ভাগ করতে পারে। তারপর সেই স্মৃতি আলাদা করে সংরক্ষণ বা বিক্রি করা যায়। মানুষের শৈশব, ভালোবাসা, গবেষণা—সব কিছু এই মেশিনের ঠান্ডা ধাতব হাতের মুঠোয় বন্দি। এক মুহূর্তে অরিত্রর গা শিউরে উঠল। এটা শুধু অপরাধ নয়, বরং সভ্যতার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার মতো এক ভয়ঙ্কর আবিষ্কার।

ল্যাবের এক কোণে সে খুঁজে পেল রেকর্ডের ফাইল। ভেতরে লিপিবদ্ধ আছে নামের তালিকা—যাদের স্মৃতি কেটে নেওয়া হয়েছে। অনেক নাম অচেনা হলেও কিছু নাম চোখে পড়তেই অরিত্র স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রভাবশালী শিল্পপতি, নামকরা বিজ্ঞানী, এমনকি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সবাই এই শিকারদের তালিকায়। এর মানে স্পষ্ট—স্মৃতিচোর কেবল অপরাধী নয়, বরং সে শহরের ক্ষমতার কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে নিজের মতো করে। যে যা মনে রাখছে না, সে আবার নতুন করে ভুল পথে চালিত হচ্ছে। এইভাবে কলকাতা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে এক অদৃশ্য শাসকের নিয়ন্ত্রিত পুতুলনাচে।

অরিত্র ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই ল্যাবই শহরের আতঙ্কের কেন্দ্র। মানুষের স্মৃতি চুরি করে কালোবাজারে বেচা নয়, এর পেছনে আরও বড় পরিকল্পনা আছে। বন্দিদের দিকে তাকিয়ে তার চোখ কঠিন হয়ে উঠল। তারা সবাই অসহায়, হয়তো আর কখনো নিজের স্মৃতি ফিরে পাবে না। কিন্তু অরিত্র জানত—যদি এখনই এই যন্ত্র ধ্বংস করা না যায়, তবে শহরের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। দাঁত চেপে সে প্রতিজ্ঞা করল—স্মৃতিচোরকে ধরতে হবে, এই ভয়ঙ্কর খেলা শেষ করতেই হবে, নাহলে কলকাতার প্রতিটি মানুষ একদিন নিজেদের নামও ভুলে যাবে।

অধ্যায় ১০: চূড়ান্ত মুখোমুখি

ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরে পা রাখতেই অরিত্রর চোখে পড়ল এক ছায়ামূর্তি—উঁচু, দৃঢ় চেহারা, মুখে এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ত হাসি। সে-ই স্মৃতিচোর। আলোতে এগিয়ে আসতেই চেনা গেল মানুষটিকে—ডক্টর সমরেশ গুহ, খ্যাতনামা স্নায়ুবিজ্ঞানী, যাঁর গবেষণা একসময় শহরের ভবিষ্যৎ বলে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর চোখে এখন পাগলামির ঝলক, আর ঠোঁটে কেবল লোভের ছাপ। “তুমি বুঝবে না অরিত্র,” সমরেশ বলল, “মানুষের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ মানে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ। আমি শুধু জ্ঞান বিক্রি করছি না—আমি নিয়ন্ত্রণ করছি ইতিহাস, প্রেম, সত্য, সবকিছু।” তার কথার সঙ্গে মিলেমিশে উঠছিল যন্ত্রের ধাতব গর্জন। অরিত্রর বুক ধকধক করছিল, কিন্তু সে জানত এটাই শেষ লড়াই।

হঠাৎই শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ্ব। সমরেশ মেশিনের হেলমেট মাথায় চাপিয়ে দিল, ঝলসে উঠল নীল আলো। তার হাত থেকে বেরোতে লাগল শক্তির প্রবাহ, যা সরাসরি অরিত্রর মনে আঘাত করছিল। অরিত্রর মনে হলো যেন তার নিজের স্মৃতিগুলো উল্টে যাচ্ছে—শৈশবের এক টুকরো, কোনো পুরনো প্রেমের মুহূর্ত, মৃত মায়ের হাসি—সব ভেসে যাচ্ছে ধোঁয়ার মতো। দাঁতে দাঁত চেপে সে লড়াই চালাল। শারীরিক শক্তি দিয়ে নয়, মন আর ইচ্ছাশক্তি দিয়েই তাকে লড়তে হচ্ছিল। একদিকে বন্দি মানুষদের যন্ত্রণা, অন্যদিকে শহরের ভবিষ্যৎ—এই দায়িত্ব তার কাঁধেই।

লড়াই তীব্র হয়ে উঠল। ল্যাবের দেয়াল কেঁপে উঠছিল, যন্ত্র থেকে স্ফুলিঙ্গ ছুটছিল। একসময় অরিত্র ঝাঁপিয়ে পড়ল, সমরেশের হেলমেট ছিঁড়ে ফেলতে চাইল। ধস্তাধস্তির মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো, মেশিন কেঁপে উঠে থেমে গেল। সমরেশ ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল, আর তার চোখে তখনও ছিল সেই উন্মাদনার আগুন। অরিত্র হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল—সে জিতেছে, কিন্তু এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বুঝতে পারল, এই লড়াইয়ে নিজের কিছু স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের মুখটা স্পষ্ট মনে করতে পারছিল না আর, কিছু শৈশবের স্মৃতিও ফিকে হয়ে গেছে। বিজয়ের আনন্দের জায়গায় ভর করল এক গভীর বেদনা।

শেষে ল্যাব থেকে বেরিয়ে এলো অরিত্র। বন্দি মানুষরা মুক্তি পেল, শহর আবার স্বস্তির নিশ্বাস নিল। সংবাদমাধ্যমে তাকে নায়ক বলা হলো, পুলিশের রিপোর্টে তার নাম ইতিহাস হয়ে গেল। তবুও অরিত্রর মুখে কোনো হাসি ছিল না। ধোঁয়ায় ভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে সিগারেট ধরাল, ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেল তার ভেতরের শূন্যতা। একটাই প্রশ্ন তার মনে ঘুরছিল—যদি স্মৃতি হারিয়ে যায়, তবে মানুষ কি আর সম্পূর্ণ থাকে? নাকি মানুষ আসলে কেবল তার অভিজ্ঞতার সমষ্টি, যা মুছে গেলে বাকি থাকে শুধু এক খালি খোলস? এই প্রশ্নের উত্তর সে পেল না, কেবল হেঁটে চলে গেল অন্ধকারের ভেতর, যেখানে তার নিজস্ব সত্য লুকিয়ে রইল।

____

 

1000063366.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *