ঐশী মল্লিক
শুরুর চা, শুরুর স্বপ্ন
শহরের ঘুম তখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। কলকাতার গলি গলি জেগে উঠছে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে। হাওড়ার চায়ের দোকানগুলোর মধ্যে অন্যতম লালদার ছোট্ট দোকান। ছোট টিনের চালা, কাঁচের বয়ামে বিস্কুট, আর সিগারেটের গন্ধে ভাসা একটা সকাল। এখান থেকেই শুরু আমাদের পথচলা—স্বাদের পথে, মানুষের পথে, গল্পের খোঁজে।
আমরা পাঁচজন। আমি ঐশী, আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রিমা, ওর বর রজতদা, আমার ভাই নীল আর ড্রাইভারের আসনে থাকা বিজয়। আমাদের গন্তব্য—ডুয়ার্স, শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। তবে লক্ষ্যটা শুধু জায়গা দেখা নয়। লক্ষ্য হলো—প্রত্যেক জায়গার খাবার চেনা, অনুভব করা। তাই তো আমরা একে বলছি ‘খাবার-ভ্রমণ’, বা সহজ কথায়—স্বাদের পথচলা।
চায়ের কাপ হাতে রিমা হালকা হেসে বলল, “এই ট্রিপটা শুধু ঘোরাঘুরি হলে চলবে না, পেটে শান্তিও চাই। প্রতিটা জায়গায় লোকাল কিছু না খেলে তো অনুভবটাই সম্পূর্ণ হয় না।” কথাটা শুনে আমরা সকলে একমত হলাম। বিজয় তো হেসে বলেই ফেলল, “গাড়ির চাকা ঘোরার থেকেও বেশি দরকার পেটের চাকা ঘোরা!”
সকাল ছ’টা নাগাদ গাড়ি ছাড়ল। জানলা দিয়ে শহরের ভোর দেখতে দেখতে, মনে হচ্ছিল আমরা যেন নিজের শহরকেও নতুন চোখে দেখছি। নীলের হাতে একটা ছোট্ট ডায়েরি—ও লিখবে প্রতিটা জায়গার খাবার, স্বাদ, অভিজ্ঞতা। আর আমি? আমি লিখব গল্প। মাটির গন্ধ, মানুষের কথা, আর সেই স্বাদের ভেতর যে স্মৃতি লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে বার করব।
গাড়িতে রিমার ফোনে ‘চলো পালাই’ গানটা বাজছিল। জানলার বাইরের আলো ধীরে ধীরে সোনালি হচ্ছিল, আর আমরা এগোচ্ছিলাম শহর থেকে গ্রাম, মাঠ, ধানক্ষেত আর পাহাড়ের দিকে।
প্রথম গন্তব্য ঠিক করেছিলাম বর্ধমানের আশপাশে কোথাও—সকালবেলার এক বাঙালি ধাবায় থামা। শুনেছি ওখানে ঘি-ছাঁকা আলু পরোটা আর সরষে দিয়ে ভাজা তেলেভাজা পাওয়া যায়। আমরা ঠিক করেছিলাম, পেট খালি থাকলে মন খালি থাকে। তাই প্রতিটা দিন শুরু হবে ভালো খাওয়া দিয়ে।
আরও কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের দাগ ফিকে হয়ে এল। রাস্তার পাশে খেজুর গাছ, আর মাঝেমাঝে ভেসে আসছে গরুর গাড়ির ঘণ্টার আওয়াজ। আমার পাশে বসে থাকা রজতদা বলল, “এই রাস্তাটা ধরে চললে শরীরের চেয়ে মন আগে পৌঁছে যাবে দার্জিলিংয়ে।”
আর আমি ভাবলাম, হয়তো ঠিকই বলছে। কারণ এই রাস্তাটা শুধু গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে না, আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন গল্প, নতুন স্বাদের মুখোমুখি করাতে চলেছে।
আর ঠিক তখনই রাস্তার পাশে দেখা গেল সেই প্রথম ধাবা, যার দরজায় লেখা “নরেন কাকার হোটেল – ঘি আর ঘ্রাণে গরম রুটি।”
আমরা গাড়ি থামালাম। স্বাদের পথচলার প্রথম থামা।
***
বর্ধমানের ধাবায়—পরোটার গন্ধে সকাল
রাস্তার পাশে গাড়িটা থামাতেই মনে হলো আমরা যেন শহরের বাইরে, এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখলাম। দোকানটার নাম ‘নরেন কাকার হোটেল – ঘি আর ঘ্রাণে গরম রুটি’। এই হোটেলের কোনও বিলবোর্ড নেই, গুগল ম্যাপে খোঁজ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গন্ধ? দূর থেকে ভেসে আসছে ঘি দেওয়া ভাজাভুজির এমন সুবাস, যা কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই মন টানতে বাধ্য।
হোটেলটা ছোট, টিনের ছাউনির নিচে মাটির মেঝে। সামনে চারটে কাঠের বেঞ্চ, কয়েকটা টেবিল, আর কড়াইয়ে টগবগ করে ফুটছে কিছু একটা। একটা মাঝবয়সি মানুষ—চেহারায় মিশে আছে মাটির গন্ধ—হাসিমুখে এগিয়ে এল, “নতুন অতিথি বুঝি? পরোটা, ভাজা আর গরম চা রেডি আছে।”
বসে পড়লাম সবাই। টেবিলের উপর কলাপাতা বিছানো, আর তার ওপর একে একে সাজিয়ে দেওয়া হলো—
ঘি-মাখানো আলু পরোটা
ধনে-টমেটো-লঙ্কা বাটা চাটনি
ঝুরো করে ভাজা আলু-ঝিঙ্গে
আর একটা গরম মাটির ভাঁড় চা
পরোটায় প্রথম কামড়েই টের পেলাম—এটা কোনও সাধারণ আলু পরোটা নয়। পুরে ব্যবহার হয়েছে দেশি আদা, কাঁচালঙ্কা, সামান্য নুন, আর পুদিনা পাতা। মুখে দিলেই গলে যাচ্ছে। সঙ্গে চাটনির ঝাঁঝ আর কড়া চায়ে যেন চোখ-মুখ খুলে গেল।
নীল তো এক কামড় পরেই বলল, “দিদি, এর নাম পরোটা রাখা ঠিক না। এ তো একরকম মিষ্টি স্মৃতি।”
রিমা চাটনি চেটেপুটে খেয়ে বলল, “বিয়েতে এমন চাটনি পেলে পাত ছেড়ে উঠতাম না।”
রজতদা মজা করে বলল, “এই খাবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ব্র্যান্ড খুলতে পারি—নাম হবে ‘রুটি-রাস্তায়’।”
হোটেলের মালিক নরেন কাকা এসে বসলেন আমাদের পাশে। বললেন, “এই দোকান চালাচ্ছি পঁচিশ বছর। বাবার হাতের রান্না শিখেছি, ঘি তো নিজের গরুর। আর আলু জমির—সিজনে নিজের হাতে তুলে আনি।”
খাওয়ার সময় ওর মুখে যে গর্ব, তাতে বুঝলাম—এই পরোটা শুধু খাবার নয়, ভালোবাসা।
চা খেতে খেতে আমি জানলার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম—একটা ছেলে একটা সাইকেল ঠেলে স্কুলে যাচ্ছে, কাঁধে ব্যাগ, মুখে হাসি। ভোরের সেই হাসি আর আমাদের পেটভর্তি সকাল—এই মিলনটাই তো ভ্রমণের আসল সৌন্দর্য।
বিজয় বলল, “আর এক প্লেট পরোটা হলে হয়?”
নরেন কাকা হেসে বললেন, “তোমাদের মতো পেট-পূজারি অতিথির জন্য বাড়তি ঘি সবসময়।”
সেই পরোটা, সেই ভাঁড়ের চা, আর সেই মানুষটার হাসি—আমার ভ্রমণ ডায়েরির প্রথম পাতায় স্থায়ী জায়গা করে নিল।
গাড়িতে ওঠার সময় জানি আমরা সকলে একমত হয়েছিলাম—এখান থেকে শরীরের পেট ভরল ঠিকই, কিন্তু মন যেন আরও খিদে নিয়ে এগিয়ে চলেছে… স্বাদের খোঁজে।
***
মালবাজারের মোড়ে – শুঁটকি ভাজা আর বেগুন ভর্তার দুপুর
গাড়ি মালবাজার ঢুকতেই রাস্তার পাশে দৃশ্যটা পাল্টে গেল। সবুজে ঢাকা পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট দোকান, বাঁশের ছাউনি, আর মাথায় গামছা বাঁধা বিক্রেতারা। বাতাসে হালকা কাঁচালঙ্কা আর পোড়া বেগুনের ঘ্রাণ। গাড়ি একপ্রকার নিজের ইচ্ছেতেই ধীরে হলো।
“এখানে থামতেই হবে,” বলল রিমা। আমরা সবাই চুপ করে গন্ধটা গিলছিলাম। সামনে দেখা গেল এক বৃদ্ধা—কুঁচকে যাওয়া মুখে আশ্চর্য এক উজ্জ্বলতা। সামনে সাজিয়ে রেখেছেন:
পোড়া বেগুনের ভর্তা
সরষে-কাঁচালঙ্কা বাটা
শুঁটকি মাছের শুকনো ভাজা
পিঁয়াজ-সরষে দিয়ে টমেটো চাটনি
চালের মোটা রুটি—একেবারে হাতে গড়া
তিনি বললেন, “তোমরা শহর থেকে এসেছো বুঝি? খাও না, একবার খেলে পাহাড় তোমায় চিনে ফেলবে।”
আমরা বাঁশের মাচায় বসলাম। পাতপেড়ে বসে খাবার পরিবেশন করলেন তিনি নিজেই। চালের রুটি ছিল খসখসে, মোটা—একেবারে দেশি। পোড়া বেগুনে মাখানো হয়েছিল কাঁচালঙ্কা, নুন, সরষের তেল, আর সামান্য পেঁয়াজ। মুখে দিলেই যেন স্মৃতির মতন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। আর সেই শুঁটকি? তার গন্ধ প্রথমে নীলকে একটু থামিয়ে দিল। ও বলল, “খেতে পারব না বোধহয়।” কিন্তু এক চামচ খেয়ে চোখ গোল! “এটা তো ভাজা আগুন!”
শুঁটকির উপর সরষের বাটা, ধনে পাতা আর কাঁচালঙ্কা—পাহাড়ি রান্নার সেই অনন্য ধরণ। রজতদা বলল, “কলকাতার রেস্টুরেন্টগুলো এই রেসিপি জানলে দাম হাজার টাকা লিখত মেনুতে।”
বৃদ্ধা চুপ করে আমাদের খাওয়াটা দেখছিলেন। শেষে বললেন, “এই রান্না আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা। এখন তো কেউ শুঁটকি নেয় না, কিন্তু এই ঝাঁজেই বর্ষা কেটে যেত আমাদের।”
তাঁর কথায়, খাবারের ভেতর শুধু স্বাদ না, একটা সময়ের গল্প, একটা সংস্কৃতি লুকিয়ে থাকে—আমরা যেন সেই গল্পের স্বাদই নিচ্ছিলাম।
খাবার শেষে পাওয়া গেল গরম জল দিয়ে তৈরি একটা পানীয়—তেঁতুল, লঙ্কা আর সামান্য গুড় দিয়ে বানানো। মুখ ঝাল, মন ঠান্ডা। বিজয় তো বলেই ফেলল, “এইটা যদি বোতলে ভরে কলকাতায় বিক্রি হতো, আমি হকার হয়ে যেতাম।”
চলার আগে বৃদ্ধা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “ভালো থেকো, আর যেখানে যাও—লোকের রান্না খেয়ে চেনো তাদের।”
গাড়ি ফের চলতে শুরু করল। কিন্তু জানলার পাশে বসে মনে হলো—সেই শুঁটকি, সেই বেগুন, আর বৃদ্ধার হাতের স্পর্শ এখনো আমার জিভের এক কোণে, মনের এক কোণে থেকে গেছে।
***
শিলিগুড়ির সন্ধ্যা – থুকপা, মোমো আর মন ভেজানো গল্প
শিলিগুড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল পড়ে এসেছে। সূর্য তখন পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে, আর শহরের বাতাসে হালকা ঠান্ডা, ধুলোর গন্ধ আর চায়ের ধোঁয়া মিশে এক অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি করছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট খাবারের দোকান—তাতে ব্যস্ততা, গরম তেল, আর রান্নার গন্ধে সন্ধ্যা যেন কানে কানে বলছে, “এবার আসল স্বাদে ঢুকো।”
রিমা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ওই যে! ওইখানে মোমো আর থুকপা লেখা বোর্ড!”
সবাই গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে গেলাম সেই ছোট দোকানটার দিকে। বাঁশের দেয়ালে রঙচটা বোর্ড, লেখা—“তাশি কিচেন – হোম স্টাইল টিবেটিয়ান ফুড।”
ভেতরে ঢুকে দেখি—চারটে টেবিল, কাঠের বেঞ্চ, আর এক শান্ত মুখের মানুষ দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের পাশে। ওর নাম তেনজিং। হাসিমুখে বলল, “গরম থুকপা তৈরি হচ্ছে। মোমো স্টিমে। বসুন।”
টেবিলে বসে চারদিকে তাকাতে থাকলাম। দেওয়ালে বুদ্ধের ছবি, একপাশে পুরনো রেডিওতে বাজছে নেপালি গান, আর ছোট্ট একটা ছেলে প্লেট মুছে দিচ্ছে নিঃশব্দে।
প্রথমে এল থুকপা—গরম ঝোলভরা একটা বাটি। চিকেন, ক্যাপসিকাম, গাজর, নুডলস, আর ওপর থেকে ছড়ানো ধনেপাতা। প্রথম চুমুকেই মনে হলো—এই বাটি শুধু স্যুপ নয়, এটা একটা কোল দেওয়ার মতো অনুভূতি।
নীল বলল, “এটা যেন বুকের মধ্যে ঢুকে মন পরিষ্কার করে দিল।”
পাশাপাশি এল স্টিম মোমো—সাদা তুলোর মতন নরম, সঙ্গে ঝাল টমেটো আর রসুন দিয়ে বানানো ডিপ। রিমা তো এক কামড় খেয়ে বলল, “ও মা, আমি কলকাতায় যা খেতাম, ওগুলো আসলে মোমো না, ওগুলো ‘তথাকথিত মোমো’।”
আমরা খাচ্ছি আর তেনজিং আমাদের দেখছেন। তিনি নিজেই বললেন, “আমি দার্জিলিংয়ের ছেলে, বাবা-মা কৃষক ছিলেন। খাবারের মাধ্যমে ওদের সংস্কৃতি এখনো বাঁচিয়ে রাখতে চাই।”
তার কথায় এমন এক শান্তি ছিল, যেন খাবারটা শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, গল্প বলার মাধ্যম। প্রতিটা মোমো যেন বলছে পাহাড়ি জনপদের কথা, প্রতিটা থুকপার চুমুকে শুনতে পাচ্ছি কোনো মায়ের হাতের আদরের স্বাদ।
খাওয়ার পর আমরা সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমেছে, দোকানের আলো মৃদু হয়ে এসেছে, আর বাতাসে ভাসছে তেনজিংয়ের রান্নাঘর থেকে আসা আদা আর রসুনের ঘ্রাণ।
বিজয় ফিসফিস করে বলল, “এইটা যদি রোজ খেতে পারতাম… মনে হয় ঘুমটাই শান্ত হতো।”
যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, তেনজিং একটা ছোট কাগজে লিখে দিলেন রেসিপি—থুকপা’র আসল তিব্বতি পদ্ধতি। বললেন, “যদি মনে পড়ে, বাড়িতে একদিন বানিয়ে নিও। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষটাকেও মনে রাখা দরকার।”
গাড়িতে উঠে ফিরে তাকালাম দোকানটার দিকে। ছোট, নিঃশব্দ, অথচ এমন এক স্মৃতি হয়ে রইল, যা শুধু জিভ নয়, মনকেও আরাম দিল।
***
দার্জিলিং-এর ভোর – রুটি, সবজি আর কাঞ্চনজঙ্ঘার চুম্বন
রাতের শেষটুকু পার করে যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ির কাঁটা তখন সবে পাঁচটা ছুঁয়েছে। জানালার বাইরে চোখ যেতেই থমকে গেলাম—আকাশ তখন হালকা নীল, আর তার বুক চিরে সোজা দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। গোলাপি রোদে পাহাড়ের গায়ে যেন সোনা মাখানো। মন নিঃশব্দ হয়ে গেল।
রিমা ফিসফিস করে বলল, “এটা কি স্বপ্ন? নাকি চা না খাওয়া অবধি বিশ্বাস করব না?”
আমরা সবাই গায়ে শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম ম্যাল রোডের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ঠান্ডা, মুখে কুয়াশা, আর ভেতরে গরম চায়ের খিদে।
ম্যালের পাশেই একটা ছোট কাঠের দোকান—নাম নেই, সাইনবোর্ড নেই। শুধু জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়া উঠছে, আর এক বৃদ্ধা হাত দিয়ে মোটা রুটি বানাচ্ছেন।
আমরা ভেতরে ঢুকতেই উনি হেসে বললেন, “গরম রুটি চাই তো? সঙ্গে পাহাড়ি তরকারি আর লেবু-চা পাবেন।”
আমরা বসলাম কাঠের বেঞ্চে। চারপাশে দেয়ালে পুরোনো দার্জিলিংয়ের ছবি, কিছু ট্যুরিস্টের নোট, আর একটা ঘড়ি—যার কাঁটা থেমে আছে, যেন বলে, এই দোকানে সময় দাঁড়িয়ে যায়।
চট করে চলে এল আমাদের খাবার:
গরম রুটি—ময়দা আর আটার মিশেলে বানানো, ঘি-মাখানো
পাহাড়ি তরকারি—আলু, বিনস, ফুলকপি, মাশরুম আর অল্প কর্ন
একটা পাতিলে টগবগে গরম লেবু-চা, আদা-হলুদ-মধু দিয়ে তৈরি
রুটির প্রথম টুকরোতেই যেন শরীরের জমে থাকা ঠান্ডা গলে গেল। তরকারিতে লঙ্কা নেই, কিন্তু এক আশ্চর্য মিষ্টি ঝাঁজ আছে—যা শুধু তাজা উপকরণ আর ভালোবাসার রান্নায় আসে।
নীল থামিয়ে বলল, “এই রুটি এমনই, যেন গরম চাদরের মত পেট ঢেকে দেয়।”
রজতদা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, “দার্জিলিংয়ের সকাল আর এই লেবু-চা—বাকি সব ক্ষুধা মুছে দেয়।”
চা খেতে খেতে বৃদ্ধা আমাদের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। “আমি ছোটবেলায় মা’কে রুটি বানাতে দেখতাম। তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা এতটা উঁচু মনে হতো না, কিন্তু এখন মনে হয়, যত বয়স বাড়ে, পাহাড়ও যেন আরও বড় হয়।”
আমরা সবাই চুপ করে শুনছিলাম। সে এক অন্য রকম ভোর—যেখানে পাহাড়, রুটি আর কথার মায়া মিশে একাকার।
খাওয়া শেষ করে আমরা বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। বাইরে তখন আলো একটু একটু করে বাড়ছে, পাহাড়ের গায়ে রোদ নামছে, আর শহর জেগে উঠছে।
আমার মনে হচ্ছিল, এই সকালটা আর কোনওদিন ফিরে আসবে না, কিন্তু তার স্বাদ—গরম রুটি, নরম আলো আর মানুষের হাসি—চিরদিন থেকে যাবে।
***
পাহাড়ি থালি—ডাল, গুন্দ্রুক আর একরাশ নরম দুপুর
দার্জিলিং রেলস্টেশনের সাইড ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট খেলনা ট্রেন, যেন শিশুর মুখে ঘুম লাগা। স্টেশন থেকে একটু হেঁটে এলেই বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি একটা দোকান, বাইরে টাঙানো কাপড়ের ঝাপিতে লেখা—“মা’য়ের রান্নাঘর”। শব্দহীন দুপুর, শুধু ট্রেনের হুইসেল আর ধোঁয়ার মতো গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়—লঙ্কা পোড়া, সরষে তেল আর ধোয়া ওঠা চাল ভাতের।
ভেতরে ঢুকতেই স্বাগত জানালেন এক তরুণী, মুখে মিষ্টি হাসি, নাম তার ডলি। বললেন, “আজ আমাদের স্পেশাল থালি—নেপালি হোম স্টাইল। বসুন, ভাত রেডি।”
বসে পড়তেই একে একে প্লেটে সাজিয়ে দিলেন:
সাদা ধোঁয়া ওঠা চাল ভাত
পাতলা ডাল—অদ্ভুত সুগন্ধি
গুন্দ্রুক—শুকনো শাক ও টক-মিষ্টি মিশ্রণে তৈরি
টকআলু—সরষে ও রসুন দিয়ে বাটানো
সেদ্ধ ডিম ও লাল মরিচ বাটা
আর শেষে একটা মাটির কাঁসায় ঠান্ডা লেবু জল
গুন্দ্রুক খেয়েই বিজয় বিস্ময়ে বলল, “এইটা কী! আচারের মতো আবার ডালের সঙ্গীও!”
রিমা গম্ভীর মুখে বলল, “গুন্দ্রুক খেতে খেতে আমার মনে হচ্ছে কোনো পাহাড়ি মেয়ের হাতে কাঁথা সেলাই করা গল্প শুনছি।”
ডালটা ছিল পাতলা, তবু স্বাদে যেন হালকা আদা, মেথি, আর পাহাড়ি ধৈর্যের গন্ধ। ভাতের সাথে মিশিয়ে মুখে দিলেই এমন শান্তি লাগছিল, যেন ভোরবেলার চুপচাপ ধানের মাঠের মতন।
ডলি খেতে খেতে আমাদের বলছিলেন, “এই থালিটা আমার মায়ের তৈরি রেসিপিতে বানানো। পাহাড়ে খাবার মানে শুধু পেটভরা নয়, দিনের শান্তি।”
নীল বলে উঠল, “এই আলুর স্বাদ কলকাতার পাঁচতারা হোটেলেও পাইনি।”
আমি হেসে বললাম, “স্বাদের দামে নয়, আসে মন থেকে। এই দোকানেই সে মন পাওয়া যাচ্ছে।”
খাওয়ার শেষে একটা ছোট মিষ্টি—ছানার রসবড়া, আকারে ছোট কিন্তু মুখে দিলে গলে যাচ্ছে। ডলি বলল, “এইটা আমি বানাই, মা বলেন ‘মিষ্টি মুখ না করলে পাহাড় মন রাগ করে।’”
দুপুরটা যেন আরেকটু ধীরে চলছিল। দোকানের বাইরে ট্রেনের হুইসেল বাজল, পেছনের পাহাড়ে মেঘ জমছে। ডলি বলল, “আবার এসো, ভাত-ডাল আর গল্প তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।”
চলার পথে মনে হচ্ছিল, পাহাড়ের যত চূড়া, তার চেয়ে বেশি স্বাদ জমে আছে এই ছোট দোকানগুলোর থালায়।
***
ভুট্টার ভাজা, বৃষ্টির গান আর টিনের ছাউনির অপেক্ষা
দার্জিলিং ছাড়িয়ে গাড়ি এগোচ্ছে কালিম্পংয়ের দিকে। রাস্তা দু’পাশে বাঁক নিয়েছে, একদিকে গভীর খাদ, অন্যদিকে সবুজ চা-বাগান, বনের গায়ে ঝুলে থাকা মেঘ। হঠাৎ হাওয়া বদলে গেল। কালো মেঘ জমে এল এক কোণে।
পাঁচ মিনিটও হয়নি, শুরু হল হালকা বৃষ্টি—ঝিরিঝিরি, ঠিক যেন কেউ গান গাইছে। রাস্তার একপাশে দেখলাম টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট দোকান, সামনে বাঁশে ঠেস দিয়ে রাখা কাঁচা ভুট্টা, আর ধোঁয়া উঠছে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি থেকে।
রিমা জোরে বলল, “গাড়ি থামাও! ওই ভুট্টা না খেলে কালিম্পং মাফ করবে না!”
আমরা নেমে গেলাম ছাউনির নিচে। দোকানের মালিক—এক মাঝবয়সী পাহাড়ি মহিলা, গায়ে মোটা শাল, চোখে শান্ত হাসি। জিজ্ঞেস করলাম, “ভুট্টা ভাজা আছে?”
তিনি বললেন, “আছে, এখনই বানিয়ে দিচ্ছি—মাখন, লবণ, লঙ্কা দিয়ে। সঙ্গে চাইলে সিমও আছে।”
বৃষ্টি বাড়ছিল, আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছোট টিনের ঘরের নিচে, সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢাকা পড়ছে কুয়াশায়। ভুট্টা রোস্ট হতে হতে ঘ্রাণে মন ভরে উঠল। মাখনের সঙ্গে পোড়া ঘ্রাণ, তার ওপর শুকনো লঙ্কার ঝাঁজ—এক কথায় পেট খালি থাকুক আর না থাকুক, মন গেয়ে ওঠে।
দু’টো করে গরম ভুট্টা এল হাতে, তার ওপর লঙ্কা-লবণ-লেবুর রস। প্রথম কামড়েই যেন মুখে রোদ উঠল। কড়মড়ে শাঁসের ভেতর লবণের টক-মিষ্টি স্বাদ, আর তাতে বৃষ্টির শব্দ যেন তালি দিচ্ছে।
নীল তো একেবারে সোজা বলল, “এই জন্যেই পাহাড়ে বারবার আসা যায়। এই এক কামড়েই এত সুখ।”
সঙ্গে এল সেদ্ধ সিম, সামান্য সরষের তেল, নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখানো। রিমা বলল, “কেউ বলবে না, এটা রাস্তার দোকান। এটা তো একেকটা ছুটির সকাল।”
বৃষ্টির মধ্যে দোকানের ভেতরেই চায়ের কাপ এল—লেবুপাতা দেওয়া কালো চা। ঠোঁটে ছোঁয়াতেই শরীরের সব ক্লান্তি যেন ভেসে গেল।
দোকানদিদি বললেন, “বৃষ্টির দিনে ভুট্টা না খেলে পাহাড় বড্ড একঘেয়ে লাগে। ছোটবেলায় বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে এইভাবেই রাস্তার ধারে বসে খাইয়ে দিতেন।”
তার চোখে তখন দূরের পাহাড়, আর মনে রয়ে যাওয়া অতীত। আমরা আর কিছু বলিনি। শুধু গরম ভুট্টা, ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল—এটাই পাহাড়ের প্রকৃত খাওয়া, প্রকৃত জেগে থাকা।
চলার আগে ওনার কাছ থেকে কাগজে মোড়ানো সেদ্ধ সিমের প্যাকেট নিয়ে নিলাম। বললেন, “গাড়িতে বসে খেয়ো, মনে থাকবে।”
গাড়ি আবার চলল, বৃষ্টির শব্দ পেছনে ফেলে। কিন্তু সেই ভুট্টা, সেই ধোঁয়া, সেই এক কাপ চা—মনে রয়ে গেল যেন ভ্রমণের সঙ্গে বাঁধা এক স্বাদময় চিঠি।
***
কালিম্পংয়ের রাত – চ্যামিন, চিলি চিকেন আর থালাভরা গল্প
সন্ধ্যার আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। কালিম্পং শহরের ধারে ধারে তখন আলো জ্বলছে, আকাশে কুয়াশার চাদর। গাড়ি থেমে দাঁড়াল আমাদের হোমস্টের সামনে—একটা কাঠের তৈরি বাড়ি, চারপাশে গাছ আর পাহাড়ি ফুলের গন্ধ।
ঘরে ঢুকেই মনে হলো, আমরা যেন কোনও শান্ত গল্পের মধ্যে এসে পড়েছি। মালকিন বেনি আণ্টি হেসে বললেন, “রাতের খাওয়া আমি বানাচ্ছি, রেস্ট নাও, তোমরা তো অনেক হাঁটছ!”
রেস্ট নেওয়ার আগেই রিমা বলল, “না না, আগে দেখে নিই রান্না কী হচ্ছে!”
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি—বড় কড়াইতে উনুনের ওপর ঝলসানো চিলি চিকেন, পাশের হাঁড়িতে চ্যামিনের নুডলস ভাজা হচ্ছে পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, গাজর আর রসুন দিয়ে। মাটির কড়িতে ঝোলে সেদ্ধ করা মুরগির পাতলা ঝোল, আর চ্যামিনের পাশে ছোট এক বাটি ঝাল আচার।
টেবিল সাজানো হলো রাতে—গরম গরম চ্যামিন, টুকরো করা কাঁচালঙ্কা দেওয়া চিলি চিকেন, আর হালকা গরম ভাতের পাশে একটা প্লেটে শুটকি মাছের ছোট ভাজা।
রাত নেমে এসেছে, জানালার বাইরে কুয়াশা, আর ভেতরে আমাদের চারজন, বেনি আণ্টির গরম খাবারের পাশে বসে আছি।
প্রথমে চ্যামিনের এক চামচ মুখে দিতেই মুগ্ধতা। লবণ, সোয়া সস, রসুন আর মাখনের হালকা আস্তরণে এমন এক স্বাদ, যা কোনও রেস্তোরাঁর না, বরং ঘরের গল্পে লুকিয়ে থাকা।
চিলি চিকেন ঝাঁঝালো, টক-মিষ্টি চাটনির মতো মুখে গলে যাচ্ছে। রিমা বলল, “এইটা আমি কোনোদিন ভুলব না।”
রজতদা থেমে বলল, “এই পাহাড়, এই খাবার, আর এই বন্ধুত্ব—এর জন্যই তো ভ্রমণ।”
খাওয়ার মাঝে বেনি আণ্টি এসে বসলেন আমাদের সঙ্গে। গল্প চলল পাহাড়ি শীতকাল, ঝাড়খন্ড থেকে আসা পর্যটক, আর তাঁর ছেলেবেলার রেসিপির গল্প।
তিনি বললেন, “আমার মা বলতেন, খাবার হচ্ছে আত্মার স্পর্শ। বাইরে যত শীত, থালায় যদি মন থাকে, ভেতরে গরম থাকবে।”
খাওয়ার শেষে এল এক কাপ গরম দুধে মেশানো জাফরান আর চিনি—আণ্টির নিজস্ব রেসিপি। গলা বেয়ে নামতেই মনে হচ্ছিল, সমস্ত পথের ক্লান্তি আজ গলে যাচ্ছে এই এক কাপেই।
বাইরে তখন হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আর আমরা থালা খালি করে বসে আছি একেকটা স্মৃতি নিয়ে—মোমোর দোকান, ভুট্টার ছাউনি, ডাল-ভাতের গল্প, পাহাড়ি মেয়ের রান্না
ঘর আর বন্ধুত্বে মোড়া সন্ধ্যাগুলো।
সেই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিজয় আস্তে বলল,
“এই সফরের সবথেকে বড় পাওয়া? আমার মনে হয়—থালায় ছড়িয়ে থাকা ভালোবাসা।”
আর আমি মনে মনে লিখে রাখলাম—
এই ভ্রমণ শুধু পেটভরার গল্প নয়,
এই ভ্রমণ হলো ‘স্বাদের পথচলা’।
শেষ




