মিতা চট্টোপাধ্যায়
স্বরূপা নিজের জীবনের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করে, যদিও তার কাজ ছিল কিছুটা অদ্ভুত এবং রহস্যময়। সে এক ধরনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল, যা তাকে অন্যদের স্বপ্নে প্রবাহিত হতে সাহায্য করত। তার কাজ ছিল মানুষের স্বপ্ন রেকর্ড করা, তাদের সেসব অনুভূতি, দৃষ্টিকোণ এবং অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করা। প্রতিদিন সে তাদের স্বপ্নের সুর ও ছন্দে প্রবাহিত হয়ে যেত, যেন একটি অবিকল চিত্র, যা তার কাছে একান্ত সত্য হয়ে উঠত। তার ঘরটা ছিল এক অদ্ভুত জায়গা, যেখানে শত শত স্বপ্নের ডায়েরি রাখা ছিল, স্বপ্নের টুকরো, ছবি, শব্দ — সব কিছু যার মাধ্যমে সে তাদের মানসিক জগতের গভীরে পৌঁছাতে পারত। তবে, এই ক্ষমতার জন্য তাকে কখনো প্রশংসা বা সমাদর মেলেনি। তার দিনগুলি চলছিল একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতায়, কারণ সে কোনোদিন নিজের অনুভূতিগুলোর গভীরে তেমন ডুবতে পারত না। তার কাছে এই শক্তি ছিল অভিশাপ, কারণ অন্যদের স্বপ্নে ঢুকে তার নিজের স্বপ্নের অন্বেষণে কোনো সময়ই সে যেতে পারত না। তার নিজের জগত ছিল অচেনা, যেমন একটি খালি পর্দা, যেখানে তার নিজের প্রতিফলন স্পষ্ট ছিল না।
একদিন, সে যখন নিজের ডায়েরি দিয়ে কাজ করছিল, তৎক্ষণাৎ তার সামনে আসে একটি নতুন নাম। এটি ছিল অরুণ — একজন মনোবিজ্ঞানী, যিনি স্বপ্নের উপর একটি গবেষণা করতে চান। অরুণের স্বপ্ন ছিল কিছুটা ভিন্ন; সাধারণ নয়, বেশ জটিল এবং রহস্যময়। সে তখন সবে শুধু তার গবেষণা শুরু করেছে এবং স্বরূপার কাছে তার স্বপ্নের বিশ্লেষণ চেয়েছে। স্বরূপা তখন প্রথম বার তার ক্ষমতাটিকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু অরুণের অনুরোধে সে রাজি হয়ে যায়। তার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল — অরুণের মনের মধ্যে কি রহস্য লুকানো ছিল? সেই সন্ধ্যায়, যখন স্বরূপা প্রথমবারের মতো অরুণের স্বপ্নে প্রবাহিত হয়, সে অবাক হয়ে যায়। স্বপ্নের মধ্যে অরুণের মুখ ছিল একরকম, কিন্তু তার চোখের মধ্যে এক ধরনের দুঃখ, যে দুঃখ সে আগে কখনো দেখেনি। এবং সেই মুহূর্তে, এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে — স্বপ্নের মধ্যে, তার পাশেই এক অজ্ঞাত পুরুষের উপস্থিতি দেখতে পায়। তার শরীরের উপস্থিতি কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল। মুখাবয়বটা পরিচিত নয়, অথচ এক অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হচ্ছিল। প্রথমবারের মতো স্বরূপার মনে হয়, কোনো কিছুই ঠিকঠাক নয়।
তবে, সেদিন রাতে, নিজের স্বপ্নে পুরুষটির উপস্থিতি তাকে গভীরভাবে ভাবায়। এর আগে সে কখনো এমন কিছু অনুভব করেনি। একদিকে, তার ক্ষমতা তাকে অন্যদের স্বপ্নের মধ্যে প্রবাহিত হতে সাহায্য করত, কিন্তু এইবার সে নিজের শৃঙ্খল ভাঙতে প্রস্তুত ছিল না। পুরুষটির মুখে এক ধরনের শূন্যতা ছিল, যা স্বরূপার মনে অদ্ভুত চিন্তা তৈরি করেছিল। সে জানত না, এটি কেবল একটি এলোমেলো স্বপ্ন, না কি তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার ইঙ্গিত। তার স্বপ্নের অভিজ্ঞতা এতটাই জটিল ছিল যে, পরদিন সকালে সে তার কাজটা আগের মতো করতে অস্বস্তি অনুভব করেছিল। সে বুঝতে পারেনি, সে কি খুঁজছে, তবে পুরুষটির উপস্থিতি তাকে এমন এক গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে, যা সে কখনো ভাবেনি। স্বপ্নের ক্লিপবোর্ডে এবার নতুন কিছু লেখা হবে, এবং সে প্রস্তুত ছিল, তবে কি লিখবে, তা জানা ছিল না।
–
স্বরূপা একদিন সকালে উঠে নিজের সঠিক অবস্থানটি বুঝতে পারেনি। সে নিজের কক্ষে বসে, ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু চোখের সামনে যা ছিল, তা ছিল আরও বেশি অস্বাভাবিক। গত রাতের স্বপ্ন, যেখানে অরুণের পাশেই এক অজানা পুরুষ ছিল, তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের ক্ষীণ দোলা সৃষ্টি করেছিল। সে বুঝতে পারছিল না, কেন সে অনুভব করছে যে পুরুষটি তার জীবনে এমনভাবে চলে আসবে যে, তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই অনুভূতির মধ্যে কিছু ছিল, যা স্বরূপাকে খুঁজে বের করতে বাধ্য করেছিল। সে জানত না, কিন্তু সে সঠিকভাবে অনুভব করছিল, এই পুরুষটি তার জীবনের এক নতুন পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কি ধরনের পরিবর্তন সেটা সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তবে স্বপ্নের মধ্যে তার উপস্থিতি ছিল কোনো এক অদৃশ্য শক্তির মতো।
স্বপ্নের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার পর, সে সেদিন অরুণের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে। অরুণ, যিনি ছিল একজন মনোবিজ্ঞানী, এক ধরনের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন, তাকে স্বরূপা আরো সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছিল। অরুণ স্বপ্নের মধ্যে অনেক কিছু খুঁজতে চাইছিল, আর স্বরূপা বুঝতে পারছিল না যে, তার কাজের মধ্যে তার ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোর জায়গা কোথায়। এতোদিন, সে শুধুমাত্র অন্যদের স্বপ্নের দিকে প্রবাহিত হয়ে তাদের অনুভূতিগুলোর মধ্যে আটকে পড়ত, কিন্তু এবার সে নিজেই গভীরভাবে একটি অজানা অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছিল। অরুণ যখন স্বপ্নের ওপর আলোচনা শুরু করল, স্বরূপা তেমন কিছু উত্তর দিতে পারছিল না। সে মনে মনে কিছু অনুভব করছিল, কিন্তু সে বলতে পারছিল না। স্বপ্নের পুরুষটি কি তার জীবনের অংশ হতে চলেছে? সে কি তার জীবনের কোনো অন্য দিকের প্রতিফলন ছিল? অরুণের সামনে এসব প্রশ্ন তার গলায় আটকে যায়, কিন্তু মুখে কিছু বের হয়নি।
সন্ধ্যায়, একদিন আবার স্বরূপা তার সারা দিনের কাজ শেষ করে ক্লিপবোর্ডে বসেছিল। সে নিজের স্বপ্নের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এবার, সেই পুরুষটি স্বপ্নে আবার হাজির। সে তাকে আরো কাছ থেকে দেখতে পায়, তার চোখের দিকে তাকিয়ে, তার শরীরের গতিবিধি লক্ষ্য করে। এবং, সেই মুহূর্তে, স্বপ্নের মধ্যে পুরুষটি তার দিকে তাকিয়ে হাসে। তার হাসি ছিল অদ্ভুত, কিছুটা মায়াময়, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে স্বরূপা বুঝতে পারে, কিছু একটা রয়েছে যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। পুরুষটি বলে, “তুমি আমাকে চেনো, তবে তুমি জানো না আমি কে।” এই কথাটা স্বরূপাকে আরো বিভ্রান্ত করে দেয়। সে জানত না, সে কেন এই পুরুষকে অনুভব করছে। তার অদ্ভুত উপস্থিতি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে, কিন্তু সে জানে না, কিভাবে সে এই অদ্ভুত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলবে। তার স্বপ্নের অধিকারী হয়ে ওঠার পথ এখন এক অদ্ভুত বাঁকে পৌঁছেছে।
এভাবে, স্বপ্নের এই অবাক জায়গায়, স্বরূপা বুঝতে পারল যে, সে তার নিজের জীবনের প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে চলেছে। পুরুষটির উপস্থিতি শুধু একটি বিভ্রান্তি ছিল না, বরং এটি তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। এটি তার অজানা ইচ্ছার প্রতি আহ্বান ছিল, যা সে কখনো বুঝতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্ন একটাই ছিল — তার জীবনের এসব রহস্য কি সে সত্যিই খুঁজে বের করতে পারবে? স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে সীমারেখা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, আর সেই পুরুষটি ছিল সেই সীমারেখার শেষ সীমানা, যা স্বরূপা একবার অতিক্রম করলে আর ফিরে আসতে পারবে না।
–
স্বরূপা তার জীবনের গতিপথে আর একবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করছিল। সে অনুভব করছিল, সবকিছু যেন এক গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে চলছে, আর সেই সমুদ্রের মধ্যে সে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সমুদ্রের জলে শুধুই জল ছিল না, ছিল অনন্ত প্রশ্ন, অবোধ্য অনুভূতি, এবং অজানা সমীকরণ। পুরুষটি, যার উপস্থিতি তার স্বপ্নে ছিল, যেন তাকে তার নিজের অজানা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানত না, সে কোথায় যাচ্ছে, তবে পুরুষটির মধ্যে এক ধরনের পরিচিতি ছিল, যা তার নিজস্ব জীবনের অন্ধকারতম কোণগুলোতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সে যেন প্রতিনিয়ত তার নিজের পরিচয় খুঁজে পাচ্ছিল না, আর পুরুষটি ছিল তার সেই আবিষ্কারের পথপ্রদর্শক। কিন্তু তার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে, তাকে নিজের সমস্ত শঙ্কা, দ্বন্দ্ব এবং অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হবে, যা সে এতদিন অবহেলা করেছিল।
একদিন, দুপুরে, স্বরূপা যখন তার একান্ত কাজে মগ্ন ছিল, তখন তাকে অরুণের একটি ফোন আসে। অরুণ তার স্বপ্নের বিশ্লেষণ সম্পর্কে আরও আলোচনা করতে চায়, কিন্তু স্বরূপার মন আর সেখানে ছিল না। অরুণের সঙ্গে কথা বলার সময়, তার মনের মধ্যে বারবার সেই পুরুষটির ছবি ফুটে উঠছিল। তার চোখের মধ্যে কী ছিল, সে ভাবতে থাকে। এই প্রথমবার, স্বরূপা অনুভব করে, পুরুষটির উপস্থিতি তার জীবনে এক অদ্ভুত শক্তি নিয়ে এসেছে। সেই শক্তি ছিল একটি প্রবাহ, যা তাকে না চাইলেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারে, সেই পুরুষটি তার জন্য শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন নয়, সে তার বাস্তবতা, তার পরিচয়ের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, সে কীভাবে এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করবে? এই বিপর্যয়ের মধ্যে, সে নিজের পুরনো পরিচয় হারিয়ে ফেলছে, এবং নতুন পরিচয়ের সন্ধানে তার আত্মা সাঁতার কাটছে।
স্বরূপা রাতে এক গভীর ঘুমে চলে যায়। তার চোখের সামনে পুরুষটির মুখ আবার উপস্থিত হয়, তবে এবার তার মধ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা ছিল না। পুরুষটি তার সামনে দাঁড়িয়ে, তার হাত বাড়িয়ে দেয়। “তুমি জানো না, কিন্তু আমি তোমার জীবনের অংশ,” পুরুষটি বলে। এই কথাটি যেন একটি তীব্র ঝড়ের মতো স্বরূপার অন্তর জাগিয়ে তোলে। এই কথার প্রতিধ্বনি তার মনের মধ্যে বাজতে থাকে, এবং তাকে একেবারে অন্য একটি পৃথিবীতে নিয়ে যায়। সেখানে, পুরুষটি তার সঙ্গে একটি অদ্ভুত জায়গায় চলে যায়। এটি ছিল একটি পুরনো, ভাঙাচুরা বাড়ি, যার দেয়ালগুলো নিঃশব্দে সময়ের দীর্ঘশ্বাসে নিস্তব্ধ ছিল। পুরুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলে, “এখানেই তোমার সত্ত্বা খুঁজে পাবে। এখানেই তুমি জানতে পারবে তুমি কে।” স্বরূপা প্রথমবারের মতো তার নিজের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত কিছু অনুভব করে। তার জীবনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেন এখানেই লুকিয়ে ছিল, এই ভাঙা দেয়ালগুলো, এই নিঃশব্দ ঘরগুলোর মধ্যে। তবে, এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে তাকে আরও গভীরভাবে তার অতীতের দিকে নজর দিতে হবে। প্রতিটি চিহ্ন, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি মনের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ইঙ্গিত তাকে সেই সত্ত্বার দিকে নিয়ে যাবে, যা সে এতদিন হারিয়ে ফেলেছিল।
এখন, স্বরূপা জানত, এই স্বপ্ন আর তার জীবনের মধ্যে সীমারেখা ছোঁয়ার সময় এসেছে। সে একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার পিছনে ফিরতে হলে, তাকে সেই পুরনো সত্ত্বার মধ্য দিয়ে যেতে হবে যা সে এতদিন এড়িয়ে এসেছে। প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতা, প্রতিটি নতুন চিন্তা তাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু একসাথে তাকে আরও বেশি অজ্ঞাত, আরও বেশি বিভ্রান্তি তৈরি করবে। সে জানত না, এই পথে চলতে গিয়ে সে কোথায় পৌঁছাবে, তবে তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত তাগিদ ছিল — সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, সে প্রস্তুত ছিল।
–
স্বরূপা আর কোনোভাবেই স্বপ্নের অদ্ভুত প্রভাবে মুক্ত হতে পারছিল না। তার মনে মনে, পুরুষটির উপস্থিতি যেন এক ধারালো গতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, এবং প্রতিটি ধাপের সঙ্গে তার নিজের আত্মপরিচয় আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল, তবে স্বরূপার মন এক জায়গায় স্থির ছিল না। ঘুমের মধ্যে কিংবা জাগ্রত অবস্থায়, পুরুষটির মুখ তার সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, যেন কোনো পুরানো স্বপ্নের মতো ফিরে আসছিল। কিন্তু এই অবস্থার মধ্যে অরুণ, যার সঙ্গে সে কিছুটা সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করেছিল, তাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। অরুণ, একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানী, যে স্বপ্নের জগৎ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করছে, এখন স্বরূপার জন্য একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছে — কিন্তু তা কতটা সঠিক, তা নিয়ে তার কিছু সন্দেহ ছিল।
একদিন, স্বরূপা অরুণের অফিসে গিয়ে তাকে তার স্বপ্নের গভীরতা নিয়ে আলোচনা করতে বলল। অরুণ তাকে শান্ত ভাবে বলল, “তুমি জানো, স্বপ্নের সীমানা কখনও একরকম থাকে না। এটা শুধু আমাদের মনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ইম্প্রেশনগুলোর সারসংকলন। কিন্তু, মাঝে মাঝে, কিছু স্বপ্ন আমাদের নিজেদের অজানা অংশের সামনে এনে দাঁড় করায়।” অরুণের এই কথাগুলোতে এমন কিছু ছিল যা স্বরূপার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত সংকোচ সৃষ্টি করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, অরুণ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় এত বেশি ডুবে গিয়েছে যে, সে হয়তো তার ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোকে অবহেলা করছে। তবে, অরুণের কাছ থেকে স্বপ্নের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে চাওয়ার পর, স্বরূপা বুঝতে পারছিল, তার নিজের জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে চলেছে — এবং সেটা কেবল পুরুষটির উপস্থিতির কারণে নয়, বরং তার নিজের জীবনের গোপন রহস্যের কারণে।
কিছুদিন পর, স্বরূপা আবার তার স্বপ্নে প্রবাহিত হতে যায়। এইবার, পুরুষটি তাকে একটি অন্ধকার গুহার মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে, চারপাশে শুধুই নিস্তব্ধতা ছিল। পুরুষটি তাকে বলে, “তুমি এখনও জানো না, কিন্তু আমি তোমার ভেতরের কিছু গোপন রেখা প্রকাশ করতে এসেছি। তোমার মনের গভীরে যা লুকানো আছে, আমি সেটাকে বের করতে পারি।” তার এই কথাগুলো স্বরূপার ভেতরে এক শিহরণ সৃষ্টি করে। সে তখন বুঝতে পারে, পুরুষটি তার জীবনের অতীতের কোনো অংশ। হয়তো সে তারই কিছু অজানা, কিছু ভুলে যাওয়া দিককে তুলে আনতে চাচ্ছে, যা তার পরিচয় এবং অস্তিত্বের গভীরে লুকানো ছিল। এসময়, পুরুষটির মুখে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি ছিল, যা স্বরূপার মনকে আরো বিভ্রান্ত করে তোলে। মনে হচ্ছিল, এই পুরুষটি তাকে এক নতুন বাস্তবতায় নিয়ে যেতে চায়, তবে সে নিজে জানে না, সে কোথায় যাচ্ছে।
স্বরূপা ধীরে ধীরে অনুভব করছিল যে তার জীবন এবং তার স্বপ্নের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এবং এই দূরত্বটা অরুণের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করছে। অরুণ স্বপ্নের রহস্য এবং মানসিক বিশ্লেষণের মধ্যে এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে, সে স্বরূপাকে নিজের অন্তরের প্রতি সচেতন হতে কখনও বলেনি। তাকে কখনও তার নিজের অনুভূতিগুলোকে স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেনি। স্বরূপা যখন একবার অরুণকে জানায়, “আমি আমার জীবনের এই গভীর অবস্থায় আটকা পড়েছি,” তখন অরুণ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে তার দিকে তাকায়। সে বুঝতে পারে না, যে স্বপ্নের মধ্যে পুরুষটির উপস্থিতি স্বরূপার জীবনে কী ধরনের বিপ্লব তৈরি করবে, তা অরুণের বিশ্লেষণ থেকে অজানা ছিল। কিন্তু অরুণ, স্বপ্নের জগতে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, নিজে জানত না এই স্বপ্নের রহস্য কি আসলে তার এক গভীর আত্মপ্রকাশ হতে চলেছে। সে ভাবে, “শायद স্বরূপা নিজেই তার এই নতুন আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা তার জীবনের সমস্ত ধারণাকে এক নতুন আলোয় দেখা শুরু করবে।”
কিন্তু, সে কি প্রস্তুত ছিল? প্রতিটি নতুন স্বপ্ন, প্রতিটি নতুন বাস্তবতা যেন তাকে নিজের অস্তিত্বের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে বাধ্য করছিল। আর পুরুষটির উপস্থিতি ছিল সেই অধ্যায়ের এক নির্দিষ্ট দিক, যা তার জীবনকে এক ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
–
স্বরূপা এবার পুরোপুরি বুঝতে পারছিল, তার জীবনে যা ঘটছে, তা কেবল স্বপ্নের রেশ নয়। এটি ছিল তার আত্মার মধ্যে এক নতুন রূপান্তরের সূচনা। পুরুষটির উপস্থিতি, যে তাকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করছিল, যেন তাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। প্রথম দিকে সে ভাবছিল, এটি শুধুমাত্র একটি স্বপ্নের বিভ্রম, কিন্তু এখন, প্রতিটি মুহূর্তে তার মনোযোগ তার জীবনের এক অজানা দিকের দিকে পরিচালিত হচ্ছিল। পুরুষটির চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল, এবং সেই শান্তির মধ্যে তার অস্তিত্বের অজানা কোণগুলি প্রकट হতে শুরু করেছিল। পুরুষটি বলেছিল, “তুমি জানো না, কিন্তু আমি তোমার অতীতের অংশ। তোমার মনে যা কিছু লুকানো ছিল, তা আজকে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।”
স্বরূপা স্বপ্নে প্রবাহিত হওয়ার পর আবার সে পুরুষটির মুখ দেখতে পায়। এবার, তার মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। পুরুষটি তাকে নিজের জীবনের এক অজানা পর্বে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা এক পুরনো বাড়িতে পৌঁছে যায়, যেখানে চারপাশে নিঃশব্দ, পাথরের মতো স্থিরতা ছিল। পুরুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলে, “এখানেই তোমার জীবনের আসল পরিবর্তন শুরু হবে। তুমি যদি সত্যিকারের আলো দেখতে চাও, তোমাকে এই অন্ধকার ঘরটায় প্রবেশ করতে হবে।” স্বরূপা তখন বুঝতে পারে, এটি শুধু একটি স্বপ্ন নয়, বরং একটি সংকেত — একটি সংকেত তার নিজের সত্ত্বার দিকে যাওয়ার। সে যদি সত্যিকার ভাবে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেতে চায়, তাহলে তাকে এই অন্ধকারকে গ্রহণ করতে হবে, তাকে তার ভয়গুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।
এবার, স্বপ্নের মধ্যে প্রবাহিত হতে গিয়ে, স্বরূপা নিজে একটা নতুন আলোর সন্ধান পেতে শুরু করে। পুরুষটির উপস্থিতি তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল, যদিও সে জানত না সে কোথায় যাচ্ছে। তার মনের মধ্যে যেন এক মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল — একদিকে একটা ভয়, অন্যদিকে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা। সেই পুরুষটির মাধ্যমে, তার মনের অন্ধকার কোণগুলোতে এক নতুন আলো প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার অতীত, তার ভুল, তার ভয়, সবকিছুই এই নতুন আলোতে পরিণত হতে চলেছে। পুরুষটি তাকে বলেছিল, “অন্ধকারের ভেতর থেকেও আলোর পথ খুঁজে বের করা যায়, তুমি যদি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারো।”
এদিন, স্বপ্নের মধ্যে সে আবার পুরুষটির কাছ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পায়। পুরুষটি স্বরূপাকে তার হাত বাড়িয়ে দেয় এবং বলে, “তুমি কখনো জানো না, জীবন তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। তবে, যখন তুমি সত্যিকারের আলো পাবে, তখন তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে। আলো তোমাকে তোমার ভেতরের শক্তি দেখাবে।” এই কথাগুলো স্বরূপার জীবনে এক নতুন দিক উন্মোচিত করে। সে অনুভব করে, পুরুষটি তার জীবনের আসল উদ্দেশ্যের প্রতি তাকে সচেতন করে তুলছে। সে যদি নিজের জীবনের রহস্য খুঁজে পেতে চায়, তাহলে তাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে, নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে।
স্বপ্নের শেষে, পুরুষটি তাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে সবকিছু আলোতে ভরে ওঠে। পুরুষটির উপস্থিতি আর রহস্য তখন আর ভয় নয়, বরং সে এক শক্তিশালী শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে, যা স্বরূপাকে তার জীবনের অন্ধকার পথে আলোর সন্ধান দিয়েছে। আর এবার, স্বরূপা জানত, সে প্রস্তুত ছিল। সে নিজের ভয়ের প্রতি জয়লাভ করতে পারবে। সে তার নিজের জীবনের গভীরে গিয়ে, নিজের অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে বের করতে পারবে। এবং, পুরুষটির মাধ্যমে, তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছিল।
–
স্বরূপা এবার তার জীবনের পথে এক নতুন সত্যের দিকে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল। প্রতিটি স্বপ্নে, পুরুষটির উপস্থিতি যেন আরও স্পষ্ট হচ্ছিল, এবং সেই উপস্থিতি তাকে এক নতুন জগতের দরজা খুলে দিচ্ছিল। স্বপ্নের মাঝে পুরুষটি তাকে বারবার বলেছিল, “তুমি আমাকে জানো না, তবে আমি তোমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছি। তুমি যখন আমাকে দেখতে পাবে, তখন সব কিছু স্পষ্ট হবে।” সেই কথাগুলো তার মনের মধ্যে বেজে উঠছিল, আর এক অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে এই রহস্যময় পুরুষের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এতদিন, সে জানত না, এই পুরুষটি তার জীবনে আসবে বাস্তবে। এখন, বাস্তবতার পৃথিবী থেকে তার সামনে সে উপস্থিত হয়।
একদিন, অফিসের কাজ শেষ করে স্বরূপা বাড়ি ফিরছিল, তখন তার চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এক পুরুষ, যাকে সে প্রথমবার তার স্বপ্নে দেখেছিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দৃষ্টি ছিল, যা স্বরূপার মনোযোগকে আকর্ষণ করে। প্রথমে তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হলেও, কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারে, এই পুরুষটি তার স্বপ্নের পুরুষই। তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি ছিল যেন এক অদ্ভুত মায়ার মতো, তাকে জানিয়ে দেয় যে তার সমস্ত অবচেতন চিন্তা সত্যি হয়ে আসছে। পুরুষটি সরলভাবে বলে, “তুমি আমাকে চেনো না, কিন্তু আমি তোমার জীবনের একটি অংশ। আমি তোমার অন্তরের গভীরে আছি।” তার কণ্ঠে এক ধরনের শান্তি ছিল, কিন্তু সেই শান্তি ছিল কিছুটা রহস্যময়, কিছুটা ভয়াবহও।
স্বরূপা হতবাক হয়ে যায়। সে জানত না, সে কি চাচ্ছে, সে কি চূড়ান্তভাবে পুরুষটির কাছে আসতে চায়, না কি তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। তার মনে নানা প্রশ্ন ওঠে। কেন এই পুরুষটি তার জীবনেও প্রবাহিত হচ্ছে? সে কি শুধুই তার স্বপ্নের অংশ ছিল, না কি সে বাস্তবে আসবে? কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির চোখে এক ধরনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, যেন সে তার জীবনের কিছু অজানা দিক উন্মোচন করতে এসেছে। সে বলেছিল, “আমি তোমাকে সেই শক্তি দিতে এসেছি, যা তোমার জীবনের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। তোমার অতীতের কোণে, তোমার ভবিষ্যতের পথে, আমি তোমার সাথে আছি।”
এই কথাগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি ছিল, যা স্বরূপাকে একেবারে বেঁধে ফেলেছিল। তার মনে হতে থাকে, এই পুরুষটি তার জীবনে আসার পর, তার নিজের অস্তিত্বের সমস্ত স্তর খুলে যাবে। কিন্তু সে কি প্রস্তুত ছিল এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য? সে জানত না, তবে তার ভিতরে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয় — এই অদ্ভুত পুরুষটির কথা শোনা, তার রহস্যের পেছনে লুকানো তথ্য খুঁজে বের করা, এবং তার মাধ্যমে নিজের জীবনের অর্থ খোঁজা।
তারপর, পুরুষটি তাকে নিয়ে যায় এক স্থানান্তরিত জায়গায়, যেখানে অদ্ভুত আলো ছিল, আর সব কিছু যেন থেমে গিয়েছিল। সেখানে, চারপাশে শুধু নিঃশব্দতা, আর পুরুষটি বলেছিল, “এখানে, তুমি নিজের সত্ত্বাকে খুঁজে পাবে। সব কিছু যা তুমি জানো, তা এখনো অসম্পূর্ণ। তোমার এই নতুন পথে, তুমি যে খোঁজে যাচ্ছ, তা শুধুমাত্র তোমার অন্তরের গভীরে পাবে।” পুরুষটির কথা শুনে স্বরূপা আরও একবার চমকে যায়। সে মনে মনে ভাবছিল, এই পুরুষটি কি সত্যিই তার জীবনের অতীতের একটি অংশ? সে কি তার জীবনের কোনো অজানা ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছে?
পুরুষটির উপস্থিতি তার জন্য এক অদ্ভুত মিশ্রণ ছিল — একদিকে কিছুটা ভয়, অন্যদিকে গভীর আকর্ষণ। সে জানত না, সে কী চাচ্ছে, কিন্তু পুরুষটির কাছ থেকে কিছু একটা সত্য বের করতে হবে। এই পুরুষটি, তার মতোই, স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে কোনো এক জায়গায় ছিল। স্বরূপা জানত, একবার এই পথ চলতে শুরু করলে, সে আর ফিরতে পারবে না। সে এই অজানা পথে এক নতুন জীবনের সূচনা করবে, যেখানে তার নিজের সত্ত্বা খুঁজে পাওয়ার পর তাকে নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
এই প্রথম, স্বরূপা অনুভব করল যে পুরুষটি তার জীবনের রহস্যময়তম অধ্যায়ের অংশ হতে চলেছে।
–
স্বরূপা এখন তার জীবনের এক অদ্ভুত মোড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানত না, কীভাবে তার মনের মধ্যে এমন বিশাল পরিবর্তন আসছে, তবে পুরুষটির উপস্থিতি এবং তার রহস্যময় কথাবার্তা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই পুরুষটির মধ্যে এমন কিছু লুকানো ছিল যা তাকে তার নিজের অতীতের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করবে। সে কখনো ভাবেনি যে তার জীবন এত দিন পরে এমন একটি দিক প্রকাশ করবে, যা তার কাছ থেকে লুকিয়ে ছিল। পুরুষটির কথাগুলো বারবার তার মনের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, “তুমি জানো না, তবে আমি তোমার অতীতের অংশ। আমি তোমার ভেতরের এক সত্যি দিক তুলে ধরব।”
একদিন, যখন স্বরূপা তার অফিস থেকে ফিরে আসছিল, সে দেখে পুরুষটি আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের মধ্যে এক ধরনের সংকেত ছিল, যেন কিছু বলার আছে। “আজ রাতে,” পুরুষটি বলে, “তুমি তোমার অতীতের মুখোমুখি হবে। আমি তোমাকে তোমার জীবনের এক অজানা দিক দেখাতে নিয়ে যাব।” স্বরূপা শিউরে ওঠে, তার হৃদয় দ্রুত লাথাতে থাকে। তবে, এর মধ্যেই সে অনুভব করছিল যে, এটা তার জন্য একটি সুযোগ — নিজের অতীতের সত্য জানার, সেইসব অদ্ভুত স্মৃতি এবং ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার একটি সুযোগ।
রাতে, পুরুষটি তাকে একটি পুরনো বাড়িতে নিয়ে যায়, যেটি একসময় তার শৈশবের বাড়ি ছিল। বাড়িটির ফাটল ধরা দেয়াল, পুরনো আসবাবপত্র এবং ধুলোয় ঢাকা জানালাগুলো দেখে স্বরূপার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হয়। এই বাড়িটিকে সে অনেক বছর আগে ভুলে গিয়েছিল। তার মনে ছিল না কেন সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে, আজ, তার সামনে আবার সেই বাড়ি, সেই জায়গা, সেই অতীত ফিরে এসেছে। পুরুষটি বলেছিল, “এই বাড়ি তোমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা তুমি মনে রাখতে চাও না। কিন্তু এখন তোমাকে সেই স্মৃতিগুলো দেখতে হবে।”
স্বরূপা ভেতরে প্রবেশ করে। প্রতিটি ঘর যেন এক ইতিহাস শোনাচ্ছিল। প্রথম ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় একটি পুরনো আয়না, যার মুখে ধুলো জমে আছে। সে আয়নার দিকে তাকায়, এবং তার চোখে এক অব্যক্ত দুঃখ এবং ক্লান্তি দেখা দেয়। আয়নায় তার নিজের প্রতিফলন ছিল না, বরং একটি তরুণী মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যাকে সে কখনো আগে দেখেনি, তবে তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত পরিচিতি। মনে হচ্ছিল, এই মেয়ে তারই কোনো ভাঙা অংশ। সে এক নিঃসঙ্গ পথ ধরে চলে যায়, এবং একেকটি ঘরে পুরনো ছবি, বই, এবং সেসব স্মৃতি দেখতে পায় যা তার অতীতের সঙ্গী ছিল।
এরপর, পুরুষটি তাকে একটি ভেতরের ঘরে নিয়ে যায়, যেখানে একটি পুরনো ডায়েরি রাখা ছিল। পুরুষটি ডায়েরিটি খুলে বলে, “এখানে তোমার গল্প লুকানো আছে। তুমি যদি জানো, তো তোমার অতীতের সঙ্গে মিটমাট করতে হবে।” ডায়েরিটি খুলে স্বরূপা প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ পড়ে। সেখানে লেখা ছিল, “আমি সবকিছু ভুলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, যদি আমি আমার অতীতকে স্বীকার না করি, তবে আমি কখনো আগাতে পারব না।” তার মনে হয়, এই কথাগুলো যেন তারই। এই ডায়েরি যেন তার নিজের অন্তরের অজানা দিকগুলোকে প্রকাশ করে দেয়।
এক মুহূর্তে, স্বরূপা উপলব্ধি করে, তার অতীতের ঘটনা এবং হারানো স্মৃতিগুলো তার জীবনের বর্তমানের অন্ধকার কোণগুলোকে ঘিরে রেখেছে। সেই মেয়েটি, যে আয়নায় দেখা ছিল, ছিল তার ছোটবেলার বন্ধু। একদিন, তাকে সে হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু সেই হারানো বন্ধুর স্মৃতি তার মন থেকে মুছে যায়নি। আজ, সেই বন্ধুর ছবি আবার তার সামনে হাজির, তার অতীতের সত্ত্বা হিসেবে। এবং পুরুষটির কথাগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, “যতদিন না তুমি তোমার অতীতকে গ্রহণ করবে, তুমি কখনো সামনে এগোতে পারবে না।”
পুরুষটির উপস্থিতি স্বরূপাকে শিখিয়ে দেয় যে, জীবনের সবচেয়ে গভীর বেদনা এবং ভয়গুলোকে আলিঙ্গন করা না হলে, তার আসল শক্তি কখনো প্রকাশ পাবে না। অতীতের অন্ধকার এবং ভুলগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে তাকে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু সেই সব অজানা স্মৃতি, সেই গভীর ক্ষত, যে বন্ধুকে সে হারিয়েছিল, আজ সব কিছু তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। আর এইসব স্মৃতির মুখোমুখি হতে তাকে জানতে হবে, সে কীভাবে এই অতীতকে মেনে নেবে।
পুরুষটি শেষে বলেছিল, “তুমি তোমার অতীতের অংশ, এবং তবেই তুমি বুঝবে তোমার ভবিষ্যতের পথ। সে পথ এখন তোমার সামনে রয়েছে, স্বীকার করো।”
–
স্বরূপা এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে ডুবে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে নিজের জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে, তবে এটি তার আগের সকল ধারণাকে একেবারে উল্টে দিয়েছে। সে জানত, পুরুষটির উপস্থিতি এবং তার গভীর কথাবার্তা তাকে তার অতীতের সীমানা ছাড়িয়ে একটি নতুন জগতে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, এই নতুন জগত কি সত্যিই তাকে তার খুঁজে পাওয়া সত্ত্বার দিকে নিয়ে যাবে? পুরুষটির দেওয়া উপদেশগুলো, যেগুলো শুরুতে কেবল গূঢ় এবং রহস্যময় মনে হয়েছিল, আজ সে বুঝতে শুরু করছিল। তবে, এসব অনুভূতি তার জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেখানে সে আর একা নয়।
এদিন, স্বরূপা যখন পুরনো বাড়ি থেকে ফিরে আসে, তখন তার মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হয়। পুরুষটির কথা মনে করে, সে বুঝতে পারে যে, তার জীবনের পরিবর্তন আসন্ন। পুরুষটি তাকে তার অতীতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার পরে, সেই অন্ধকারেই আলো ফুটে উঠেছে। সে নিজেকে আরও শক্তিশালী, আরও স্বচ্ছ অনুভব করছিল। এখন, সে জানত, তার অতীতের সব ভয় এবং ক্ষত তার জীবনের অংশ, এবং তাদের ছাপ মুছিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল। তবে, সঠিকভাবে এগোতে গেলে, তাকে সেই পুরানো অন্ধকারগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।
তারপর, একদিন সকালে, স্বরূপা আবার পুরুষটির দেখা পায়। তারা এক জায়গায় বসে, দীর্ঘ নীরবতা কাটিয়ে কিছু সময় পর, পুরুষটি বলে, “তুমি জানো, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কাব্য হচ্ছে বাস্তবতা। স্বপ্নের মাধ্যমে, তুমি তুমি নিজেকে খুঁজে পাও, কিন্তু একমাত্র বাস্তবতায় তোমার শক্তি প্রকাশ পায়।” পুরুষটির কথা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সে বুঝতে পারে, শুধু স্বপ্ন এবং অতীতের মধ্যে আটকে থাকলে চলবে না; বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই তার আসল উদ্দেশ্য। তবে, এর জন্য তাকে নিজের ভেতরের অন্ধকার ও আলোকে একসঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
অফিসে ফিরে আসার পর, স্বরূপা কাজের মধ্যে আরও মনোযোগী হয়ে ওঠে। তার মনে পুরনো ভয় বা দ্বন্দ্ব আর ছিল না। সে নিজের গতিকে আরও দৃঢ়ভাবে স্থির করে, বুঝতে পেরেছে, যে সে শুধুমাত্র অন্যদের স্বপ্নের বিশ্লেষণ করে তাদের অনুভূতির গভীরে প্রবাহিত হতে পারে, কিন্তু তার নিজের অনুভূতিগুলির প্রতি সত্যিকার দৃষ্টি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষটির উপস্থিতি তাকে শিখিয়েছে, যদি সে নিজেকে ভালোভাবে জানে, তবে সে সব কিছু বুঝতে পারবে — নিজের জীবনকে, নিজের শক্তি এবং সেই অজানা দিকগুলোকে, যা তাকে এতদিন অব্যক্তভাবে বিভ্রান্ত করেছিল।
দিনগুলি কাটতে থাকে, আর স্বরূপা নিজেকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করে। তার মনের মধ্যে যে অন্ধকার ছিল, তা একদিন পুরুষটির মাধ্যমে আলোতে পরিণত হয়েছিল। এখন, সে জানে, যে জীবনে আলো এবং অন্ধকার একসঙ্গে চলতে থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করাই তার জীবনের আসল শক্তি। বাস্তবতার কবিতা, সেই যা কিছু তাকে এক নতুন মানুষ হিসেবে আবির্ভূত করেছে, এখন সে পুরোপুরি উপলব্ধি করছিল।
একদিন, যখন আকাশে মেঘ জমে আসে, এবং পৃথিবী এক তীব্র ঝড়ের মুখে পড়ে, তখন স্বরূপা আবার পুরুষটির মুখ দেখতে পায়। পুরুষটি যেন তার সামনে থেকে এক আলোকমালার মতো প্রস্থ হয়ে যায়। “তুমি নিজের আলো খুঁজে পেয়েছ, এবং তোমার সত্যের পথ পরিষ্কার হয়েছে,” পুরুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলে। এই মুহূর্তে, স্বরূপা বুঝতে পারে, পুরুষটি আর তার জীবনে একটি উপদেশদাতা বা পথপ্রদর্শক ছিল না। সে ছিল তার নিজের অন্তরের প্রতিফলন, যা তাকে তার জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
যতই সময় কাটে, স্বরূপা অনুভব করে, যে পুরুষটির কথা তাকে ঘিরে রেখেছিল, সে ছিল এক বাস্তবতার কবিতা — এক যাত্রার প্রতীক, যা তাকে শুধু তার অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে সংযোগ করতে শেখায়নি, বরং তার জীবনের এক অমোঘ অর্থের সন্ধানও দেয়। এই কবিতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চিহ্ন, আর প্রতিটি ছন্দ ছিল তার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞান। বাস্তবতার কবিতা এখন স্বরূপার জীবনের গল্প, এবং সে জানত, এটি তার নিজের সৃষ্টি।
–
স্বরূপা এখন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। পুরুষটির উপস্থিতি, যা এক সময় তাকে বিভ্রান্ত করেছিল, এখন তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সে আর তার অতীতের অন্ধকার কোণগুলোকে ভয় পায় না। বরং, সেই অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে, সে জানে যে তার জীবনকে আসল সত্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাকে তার নিজের ভেতরের আলোকে গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি দিন যেন এক নতুন খোলসের দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে সে তার সমস্ত সংকোচ এবং দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, এক নতুন মানুষ হিসেবে উদ্ভাসিত হচ্ছে।
এবার, স্বরূপা বুঝতে পারে যে তার এই যাত্রা কেবল তার নিজের ভেতরেই নয়, বরং বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে তার কাজের মধ্যে, নিজের আত্মবিশ্বাস এবং স্বচ্ছতার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে এগোতে থাকে। তার মনোবিজ্ঞানী বন্ধু অরুণও অবশেষে তার পরিবর্তন লক্ষ করে। একদিন, তাদের এক বৈঠকে অরুণ তাকে বলে, “তুমি এখন নিজেকে আরও ভালোভাবে জানো, স্বরূপা। তুমি নিজেকে মেনে নিয়েছ, আর তাই তোমার জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে।” অরুণের এই মন্তব্যে স্বরূপা কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটি শান্তি বয়ে যায়। সে জানত, অরুণ ঠিক বলেছে। তার ভেতরের অসীম শক্তি এখন বাস্তবতা এবং স্বপ্নের সীমানা অতিক্রম করে, এক নতুন কাব্যে পরিণত হয়েছে।
একদিন, স্বরূপা তার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বসে নিজের পুরনো ডায়েরি আবার খুলে ফেলে। সেখানে, ছোটবেলায় লেখা কিছু চিন্তা, কিছু অল্প কথার মধ্যে সে খুঁজে পায় তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। একসময়, সে ছিল তার জীবনের দিকে অজ্ঞ এবং অবহেলিত, কিন্তু আজ, সেই পুরনো পাতা তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে কীভাবে এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। পুরুষটির সঙ্গে তার পথচলা তাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল। সে দেখতে পায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি স্মৃতি ছিল এক অভিনব সৃষ্টি — এক বিশেষ কাব্য, যেটি শুধুমাত্র সে নিজেই রচনা করতে পারে। তার নিজের অভ্যন্তরীণ যাত্রা, তার অতীত এবং বর্তমানের চিত্র, সব কিছু যেন একটি সমাপ্ত গল্পের দিকে এগিয়ে যায়।
সেদিন রাতে, যখন স্বরূপা তার ডেস্কে বসে একটি নতুন প্রজেক্টের ওপর কাজ করছিল, তখন জানালা দিয়ে বাইরে অদ্ভুতভাবে আলো পড়ছিল। সে জানত, এই আলোটি কিছুটা আলাদা, যেন এক গভীর উপলব্ধি তাকে ঘিরে রেখেছে। তার চোখের সামনে পুরুষটির প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, যদিও সে জানে না সে কোথায় আছে বা সে আসবে কিনা। তার মনে হয়, সে সবসময় তার পাশে ছিল। কিন্তু এখন, সেই পুরুষের উপস্থিতি তাকে আরো গভীর সত্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। “এখন তুমি প্রস্তুত,” পুরুষটি বলে। “তোমার জীবনের সঠিক পথে চলতে, তুমি জানো তোমার কী করতে হবে।”
এ মুহূর্তে, স্বরূপা অনুভব করে, সে এক কঠিন পথ পেরিয়ে এসেছে, তবে এখন তার সামনে সমস্ত পথ পরিষ্কার। সেই পুরুষটি, যার উপস্থিতি একসময় তাকে বিভ্রান্ত করেছিল, আজ তার জীবনের এক অমোঘ সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার এই যাত্রা, সেই পুরুষের সহযোগিতায়, তাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। পুরুষটির আদান-প্রদান, তার রহস্যময় কথাগুলো, এবং তার উপস্থিতি সব কিছুই তাকে প্রস্তুত করেছে একটি নতুন বাস্তবতার জন্য।
তবে, সে জানত, এটাই শেষ পথ নয়। তার সামনে আরও অনেক কিছু ছিল — তার নিজের জগত, তার নিজের সৃষ্টি, এবং সেই সৃষ্টিকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তার ভেতরের শক্তি। সে জানত, তার জীবনের সবচেয়ে বড় কবিতা এই মুহূর্তে লেখা হচ্ছে, এবং সে সেই কবিতার লেখক।
স্বরূপা জানত, তার সত্যের সন্ধান কোনো বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং তার নিজের অন্তরের গহীনে। আর সেই অন্তরের আলো তাকে আজ এক নতুন পৃথিবী দেখাচ্ছিল — বাস্তবতা, যে বাস্তবতার মধ্যে সমস্ত রহস্য, সমস্ত সংশয়, সমস্ত সন্দেহ ছড়িয়ে ছিল, আজ তা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল।
এবং সেই মুহূর্তে, স্বরূপা অনুভব করেছিল, সে নিজেই তার জীবনের কবি, এবং তার জীবনই সবচেয়ে সুন্দর কাব্য।
–
স্বরূপা জানত, আজকের দিনটি তার জীবনের শেষ অধ্যায়ের শেষ পাতা হতে যাচ্ছে। পুরুষটি, যে এক সময় তার জীবনের অদ্ভুত রহস্যের প্রতীক ছিল, আজ তাকে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। তার উপস্থিতি আর কোনো বিভ্রান্তি তৈরি করে না, বরং সে এক শক্তিশালী পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে তাকে তার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে শেখিয়েছে। স্বরূপা বুঝতে পেরেছে, সে যে দীর্ঘ সময় ধরে অন্যদের স্বপ্নের গভীরে প্রবাহিত হয়ে তাদের অনুভূতিগুলোর দিকে গেছে, আজ সে নিজের স্বপ্নের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এটি তার নিজস্ব যাত্রার পথ, এবং সেই পথ এখন সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, নিজের পায়ে হেঁটে এক নতুন শুরুতে পৌঁছানোর জন্য। আগের দিনের মত হোঁচট খেয়ে পড়া, বিভ্রান্তি আর অন্ধকার তার জীবনে আর কোনো জায়গা নেই। আজ, তার ভেতরের আলো এতটাই উজ্জ্বল যে, সেটি বাইরের পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখাতে পারছে। সে জানে, যে পথ সে অনুসরণ করছে, তা সোজা নয় — তবে এটাই তার পথ, এবং সে প্রস্তুত। তার গতকালকে সে ভুলে যেতে চায় না, কারণ সেটা তাকে আজকের মানুষে পরিণত করেছে, তবে সে জানে, আজ থেকে সে তার নিজের শর্তে জীবনযাপন করবে। অতীতের সব বোঝাপড়া, পুরনো আঘাত এবং দুর্ভাগ্য এখন তার গল্পের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সে আর সেই গল্পে আটকে থাকবে না। সে নতুন কিছু শুরু করতে চায়।
অফিসে ফিরে আসার পর, স্বরূপা তার কাজের ওপর নতুন উদ্যম নিয়ে মনোযোগ দেয়। সে অনুভব করে, প্রতিটি প্রকল্প, প্রতিটি কর্মতৎপরতা, এবং প্রতিটি সিদ্ধান্ত এখন তার জন্য নতুন অর্থ বহন করে। আগের চেয়ে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী, সে জানে যে তার জীবনের গতিপথ একমাত্র সে নিজেই নির্ধারণ করবে। অফিসের সহকর্মীরা তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করতে শুরু করে। তারা দেখে, স্বরূপা আজ আরো শান্ত, আরো কেন্দ্রীভূত এবং কোনো কিছুতেই বিভ্রান্ত হয়নি। তার অঙ্গভঙ্গি এবং কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট ছিল, সে এখন তার জীবনের অন্যতম সেরা অধ্যায় শুরু করতে চলেছে।
একদিন, সন্ধ্যায়, যখন সে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল, একটি নতুন সূর্যাস্তের আলো তাকে মোহিত করে। সূর্য তার শেষ বিকেল বেলা হেলে পড়ে, যেন একটি নতুন দিন শুরু হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বরূপা জানত, আজ সে আর কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে নেই। তার ভিতরের অন্ধকারে সূর্যটি এখন পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠেছে। সেই আলো তার জীবনের সব অন্ধকারকে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং তাকে একটা নতুন দিক দেখাচ্ছে। সে জানত, তার সামনে আরও অনেক পথ রয়েছে, তবে সে আর একা নয়। তার ভেতরের সত্য এবং শক্তি তার সঙ্গে থাকবে।
সে জানে, যে পুরুষটি তার জীবনে এসে তাকে এত কিছু শিখিয়েছে, সে আর তার বাস্তবতায় নেই। কিন্তু তার শিক্ষা, তার উপস্থিতি, এবং তার দেওয়া সত্য আজ স্বরূপার হৃদয়ে গভীরভাবে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সে জানত, তার জীবনে অনেক কিছু পাল্টে গেছে, তবে এই পরিবর্তন তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে এবং নিজের অস্তিত্বের নতুন সীমানায় পৌঁছেছে।
স্বপ্ন, বাস্তবতা, অতীত, বর্তমান — এসব কিছুই এখন তার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। তার জীবনে শুরু হয়েছে এক নতুন সূর্য, এক নতুন দিন, এক নতুন যাত্রা। এখন, স্বরূপা জানে, সে নিজের গল্পের লেখক। তার জীবন, তার আত্মবিশ্বাস, এবং তার অভ্যন্তরীণ শক্তি এক নতুন সূর্যকে উদিত করতে চলেছে। আর সেই সূর্যই তার জীবনের প্রকৃত কাব্য — একটি চিরন্তন গল্প, যা এখন শুরু হচ্ছে।
***




